Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

অতঃপর দশ বর্ষ অতীত হইয়াছে।

বৈশালী নগরীর সুরম্য রাজপথ। পথের দুই পাশে উচ্চ অট্টালিকা। পথ দিয়া জনস্রোত চলিয়াছে, দুই-চারিটি রথ ও শিবিকাও যাতায়াত করিতেছে। খর রৌদ্রে চারিদিক উজ্জ্বল।

একজান পাণ্ডা জাতীয় লোক একটি নবাগত বিদেশীকে নগর দেখাইয়া লইয়া বেড়াইতেছে। পাণ্ডা লোকটি চতুর বাকপটু; বিদেশীর চেহারা বোকাটে ধরনের কিন্তু মুখের ভাব সন্দিগ্ধ। তাহারা বাক্যালাপ করিতে করিতে চলিয়াছে।

নির্দেশক বলিল—আপনি দেশ ভ্রমণে বেরিয়েছেন, বৈশালীর মত এমন নগর আর্যাবর্তে আর পাবেন না। মর্তে অমরাবতী-সাক্ষাৎ ইন্দ্রপুরী!

দর্শক বিজ্ঞের মত মাথা নাড়িতে নাড়িতে বলিল–হুঁ হুঁ, আমাকে আর বোকা বুঝিও না—আমি কাশী কাঞ্চি অবন্তী সব দেখেছি।

নির্দেশক বলিল—আরে মশায়, তা তো দেখছেন। কিন্তু বৈশালীর মত এমন বড় বড় অট্টালিকা দেখেছেন? এখানে দ্বিভূমক সপ্তভূমক অট্টালিকা আছে। আপনার কাশী কাঞ্চিতে আছে?

দর্শক চক্ষু পাকাইয়া বলিল—কি বলছ হে তুমি? অবন্তীতে এমন উঁচু অট্টালিকা আছে যে আকাশকে ফুটো করে দিয়েছে—সেই ফুটো দিয়ে অপ্সরাদের দেখা যায়!

এই সময় পাশের পথ দিয়া একটি চতুর রথ সবেগে বাহির হইয়া আসিল। আর একটু হইলে দর্শক মহাশয় চাপা পড়িতেন, কিন্তু নির্দেশক ক্ষিপ্রহস্তে তাহাকে টানিয়া লইল। রথ চলিয়া গেল।

নির্দেশক বলিল-আরে মশায়, শেষে কি রথ চাপা পড়ে মারা যাবেন?

দর্শকের দৃষ্টি কিন্তু রথের দিকে

কার রথ? রাজার রথ বুঝি!

নির্দেশক ক্ষুব্ধস্বরে বলিল—কতবার বলব মশায়, আমাদের দেশে রাজা নেই। প্রজাতন্ত্র—প্রজাতন্ত্র! বুঝলেন?

দর্শক ক্ষণেক চিন্তা করিয়া বলিল—রাজা নেই কিন্তু তাহলে তো রানীও নেই।

না। চলুন ঐ দিকটা দেখবেন—

রাজকন্যাও নেই?

কি বিপদ! রাজাই নেই তো রাজকন্যে আসবে কোত্থেকে!

ভারি অদ্ভুত দেশ।

নির্দেশক দৃঢ়ভাবে দর্শকের বাহু ধরিয়া একদিকে টানিয়া লইয়া চলিল। নগরের অপেক্ষাকৃত নির্জন অংশ। বাড়িগুলি ছোট ছোট, উদ্যান দিয়া ঘেরা। দর্শক ও নির্দেশক পথে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। দর্শক চারিদিকে চাহিতে চাহিতে বলিল—এ জায়গাটা মন্দ নয়, বেশ নিরিবিলি। (একটি সুন্দর বাটিকার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়া) ওটা কার বাড়ি? রাজার প্রমোদভবন বুঝি!

নির্দেশক হতাশকণ্ঠে বলিল—কি বিড়ম্বনা! বললাম না আমাদের রাজা নেই। ওটা শিবামিশ্রের বাড়ি।

শিবামিশ্র! সে আবার কে? রাজার মন্ত্রী বুঝি!

নির্দেশক ক্লান্তভাবে বলিল—শিবামিশ্র কে তা জানি না। দশ বছর বৈশালীতে আছেন কিন্তু কেউ তাঁর পরিচয় জানে না।

দর্শক বলিল–অদ্ভুত নাম-শিবামিশ্র।

নির্দেশক গম্ভীরস্বরে বলিল—তাঁর মুখটা শেয়ালের মত কিনা তাই শিবামিশ্র নাম।

শেয়ালের মত মুখ হলেই শিবামিশ্র নাম হবে?

কেন হবে না? এদেশের এই নিয়ম।

যদি বাঁদরের মত মুখ হয়?

তাহলে তার নাম হবে মর্কট মিশ্র।

আর যদি চাঁদের মত মুখ হয়?

নির্দেশক হাসিল—তাহলে নাম হবে চন্দ্রবদন বর্মা। আমার নাম জানেন?-চন্দ্রবদন বর্মা। আসুন।

সে দর্শককে টানিয়া লইয়া চলিল।


শিবামিশ্রের উদ্যানবাটিকার পিছনের অঙ্গন। অঙ্গনের এক প্রান্তে কাষ্ঠবেদিকার উপর একটি মৃত্তিকার ময়ূর উত্তপ্ত হইয়া যেন আকাশের মেঘদর্শন করিতেছে। অঙ্গনের অপর প্রান্তে ময়ুর হইতে অনুমান ত্রিশ হস্ত দূরে উল্কা ধনুর্বাণ হস্তে দাঁড়াইয়া আছে, তাহার পিছনে শিবামিশ্র। উল্কার বয়স এখন দশ বৎসর; যৌবন এখনও দূরে, কিন্তু বেত্রবৎ ঋজু নমনীয় দেহে অনাগত বসন্তে প্রতিশ্রুতি। শিবামিশ্র এই দশ বৎসরে একটু বৃদ্ধ হইয়াছেন, তাঁহার গণ্ডে শৃগালক্ষত এখনও মিলায় নাই। ক্ষত সারিয়াছে, দাগ আছে।

উল্কা ধনুকে বাণ সংযোগ করিয়া মৃন্ময়ুরের দিকে লক্ষ্য স্থির করিল। তারপর বাণ মোচন করিল। বাণ গিয়া ময়ুরের কাষ্ঠবেদিকায় বিদ্ধ হইল।

উল্কা লজ্জিত হইয়া পিছনে শিবামিশ্রের পানে চাহিল। শিবামিশ্র তাহার পিছনে আসিয়া দুই স্কন্ধে হাত রাখিলেন। বলিলেন

কন্যা, লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ো না। এ সংসারে যে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় সে কোনও সিদ্ধিই লাভ করতে পারে না (উল্কা নতমুখী হইল)-নাও, আবার তীর নাও, মন দিয়ে লক্ষ্য স্থির কর

উল্কা আবার ধনুকে তীর পরাইয়া ধনুক তুলিল এবং নির্নিমেষ চক্ষে মৃন্ময়ুরের পানে চাহিয়া রহিল।

শিবামিশ্র বলিলেন—হাঁ—একদৃষ্টে চেয়ে থাকো। কী দেখতে পাচ্ছ?

উল্কা বলিল-পাখি।

শিবামিশ্র বলিলেন—আরও একাগ্র মনে লক্ষ্য কর। এবার কী দেখছ?

উল্কা বলিল-পাখির মাথা।

শিবামিশ্র বলিলেন—বেশ। আরও দৃষ্টি স্থির কর। যখন কেবল পাখির চক্ষু দেখতে পাবে

উল্কার ধনু হইতে তীর নির্গত হইয়া ময়ুরের দেহে বিদ্ধ হইল। উল্কা ক্রুদ্ধ আক্ষেপে ধনু ফেলিয়া দিল। শিবামিশ্র সস্নেহে তাহাকে ক্রোড়ে টানিয়া লইলেন। বলিলেন

উল্কা—ছি, ধৈর্য হারাতে নেই। ধনুর্বিদ্যা এক দিনে আয়ত্ত হয় না। ক্রমে শিখবে।

উল্কার শিক্ষা চলিতেছে। শিবামিশ্রের গৃহে একটি কক্ষ। দশমবর্ষীয়া উল্কা যন্ত্রবাদ্যের তালে তালে নৃত্য করিতেছে। তাহার দুই সখী বাসবী ও বীরসেনা মৃদঙ্গ ও মঞ্জীরা বাজাইতেছে। কক্ষের এক কোণে বেদীর উপর বসিয়া শিবামিশ্র বিচারকের দৃষ্টিতে নৃত্য দেখিতেছেন। উল্কা নৃত্যের সঙ্গে গাহিতেছে—

শঙ্কর শশাঙ্কমৌলি
শিব সুন্দর হর শম্ভু দিগম্বর
করধৃত ডম্বরু জয় জয় শশাঙ্কমৌলি।
শিরে সুর-শৈবলিনী
নৃত্য-উছল জলভঙ্গ
টলমল তরল-তরঙ্গ
জয় জয় শশাঙ্কমৌলি।

নৃত্যগীত শেষ হইলে উল্কা শিবামিত্রের পায়ের কাছে গিয়া বসিল।

বলিল—পিতা, আজ আমাদের নৃত্যগীত আপনার ভাল লেগেছে?

শিবামিশ্র সস্নেহে বলিলেন—হাঁ বৎসে, ভাল লেগেছে। এখন যাও, তোমার সখীদের সঙ্গে খেলা কর গিয়ে।

উল্কা সখীদের লইয়া প্রস্থান করিল। শিবামিশ্র উঠিয়া চিন্তান্বিত মুখে গণ্ডের ক্ষতচিহ্নে হাত বুলাইতে বুলাইতে গবাক্ষের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন। কিছুক্ষণ পরে গবাক্ষপথে দেখা গেল, একটি লোক তোরণপথে প্রবেশ করিতেছে।

শিবামিশ্র প্রসন্নমুখে বলিলেন-নাগবন্ধু! এস বৎস—

নাগবন্ধু কক্ষে প্রবেশ করিয়া শিবামিশ্রের পদস্পর্শ করিল।

শিবামিশ্র বলিলেন—জয়োস্ত। অনেকদূর পথ এসেছ, আসন গ্রহণ কর। পাটলিপুত্রের সংবাদ কি?

নাগবন্ধু মাটিতে বসিল, শিবামিশ্রও সম্মুখে বসিলেন।

নাগবন্ধু বলিল-প্রভু, চণ্ডের অত্যাচার আর তো সহ্য হয় না—প্রজারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।

ভাল ভাল। তারপর?

চণ্ডের যথেচ্ছাচারের কোনও বলগা নেই, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে সে সকলের উপর উৎপীড়ন করছে। উচ্চ-নীচ নেই, ধনী-নির্ধন নেই–

ভাল ভাল।

প্রভু, এবার এর প্রতিকার করুন। অসহায় প্রজাপুঞ্জের শক্তি নেই, তারা নীরবে অত্যাচার সহ্য করছে। তাদের দুর্গতি চরমে উঠেছে

না নাগবন্ধু, এখনও চরমে ওঠেনি। প্রজাপুঞ্জের দুর্গতি যেদিন চরমে উঠবে, সেদিন কাউকে কিছু করতে হবে না, তাদের সম্মিলিত ক্রোধ একসঙ্গে জ্বলে উঠে চণ্ডকে দগ্ধ করে ফেলবে। আমি সেই দিনেরই প্রতীক্ষা করছি।

কিন্তু যতদিন তা না হয় ততদিন আমরা কী করব?

সমিধ সংগ্রহ কর, সমিধ সংগ্রহ কর, প্রজাপুঞ্জের মনে যে বিদ্বেষ ধোঁয়াচ্ছে তাকে নিভতে দিও না। আর বেশী দিন নয়, চণ্ডের সময় ঘনিয়ে এসেছে। শিশুনাগ বংশের চিরনির্বাণ আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।

তাঁহার নির্নিমেষ দূরদর্শী চক্ষু ভবিষ্যের পানে চাহিয়া রহিল।


পাটলিপুত্রে চণ্ডের রাজসভা। চণ্ড সিংহাসনে আসীন। এই দশ বৎসরে চণ্ডের আকৃতি আরও বীভৎস আকার ধারণ করিয়াছে; সুরার প্রভাবে দুই চক্ষু কষায়বর্ণ, দৃষ্টি নিষ্প্রভ। দুইজন কিঙ্করী সিংহাসনের দুই পাশে দাঁড়াইয়া চণ্ডকে আসব যোগাইতেছে।

সভায় সভাসদের সংখ্যা অল্প। পূর্বতন সভাসদ কেহই নাই, গ্রহাচার্যও অন্তর্হিত হইয়াছেন, বটুক ভট্টেরও দেখা নাই। যে কয়জন নবীন সভাসদ আছে তাহারা নিবিষ্ট মনে বসিয়া সুরাপান করিতেছে।

বাহিরে শৃঙ্খল-ঝনৎকার শুনা গেল। দুইজন যমদূতাকৃতি রক্ষী একটি শৃঙ্খলিত যুবককে মধ্যে লইয়া প্রবেশ করিল এবং চণ্ডের সম্মুখে দাঁড়াইল। যুবকের নাম সেনজিৎ, বয়স অনুমান কুড়ি বৎসর। তাঁহার আকৃতি সুশ্রী, দৃষ্টি নির্ভীক।

সেনজিৎ বলিলেন-মহারাজের জয় হোক!

চণ্ড কিছুক্ষণ গরল-ভরা চোখে সেনজিতের পানে চাহিয়া রহিলেন। তারপর বলিলেন—সেনজিৎ!

সেনজিৎ বলিলেন—আজ্ঞা করুন আর্য। রক্ষীরা বিনা অপরাধে আমাকে ধরে এনেছে।

চণ্ড বলিলেন-আমার আজ্ঞায় ওরা তোমাকে ধরে এনেছে। —সেনজিৎ, তুমি শিশুনাগ বংশের সন্তান। শুনেছি তুমি পাটলিপুত্রের অধম নাগরিকদের সঙ্গে মেলামেশা কর—এ কথা সত্য?

সেনজিৎ বলিলেন—সত্য মহারাজ। পাটলিপুত্রের নাগরিকরা আমাকে ভালবাসে, আমিও তাদের ভালবাসি

চণ্ডের দৃষ্টি আরও বিষাক্ত হইয়া উঠিল।

চণ্ড বলিলেন—বটে! এই অপরাধেই তোমাকে শুলে দিতে পারি। তুমি রাজা হতে চাও, পাটলিপুত্রের সিংহাসনে বসতে চাও—তাই প্রজাদের মনোরঞ্জন করছ!

সেনজিৎ স্তম্ভিতভাবে চাহিয়া রহিলেন। শেষে বলিলেন—মহারাজ! আমি স্বপ্নেও সিংহাসনে বসবার দুরভিসন্ধি করিনি। প্রজারা আমাকে ভালবাসে

চণ্ড গর্জন করিলেন—তোমাকে শুলে দেব। যাও নিয়ে যাও।

রক্ষীরা সেনজিৎকে টানিয়া লইয়া যাইবার উপক্রম করিলে সেনজিৎ দৃঢ় শান্ত স্বরে বলিলেন—

মহারাজ, আপনি আমার রাজা, আমার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। আমাকে যদি হত্যা করতে চান স্বহস্তে হত্যা করুন—আমি শিশুনাগ বংশের সন্তান। চণ্ডালের হাতে আমার লাঞ্ছনা করবেন না।

চণ্ড টলিতে টলিতে উঠিয়া দাঁড়াইলেন, কটি হইতে শাণিত খর্ব কৃপাণ বাহির হইয়া আসিল। সেনজিৎ নিজ বক্ষের বস্ত্রাবরণ মোচন করিয়া দিলেন।

অস্ত্র উদ্যত করিয়া চণ্ড থামিয়া গেলেন, তাঁহার কষ্ঠ হইতে বিকৃত স্খলিত হাস্য নির্গত হইল। বলিলেন—

তোমাকে হত্যা করব না—তুমি শিশুনাগ বংশের শেষ পুরুষ। কিন্তু পাটলিপুত্রে আর তোমার স্থান নেই, তোমাকে নির্বাসন দিলাম। যাও, নিজ দুর্গে বাস কর গিয়ে। যদি কখনও পাটলিপুত্রে পদার্পণ কর—তোমার শূলদণ্ড হবে।

সেনজিতের অঙ্গ হইতে শৃঙ্খল খসিয়া পড়িল।

সেনজিৎ যুক্তকরে বলিলেন

ধন্য মহারাজ।


বিগত ঘটনার পর আরও ছয় বৎসর অতীত হইয়াছে।

বৈশালীতে শিবামিশ্রের গৃহে একটি বাতায়নের সম্মুখে শিবামিশ্র ও নাগবন্ধু দাঁড়াইয়া আছেন। শিবামিত্রের ভ্রূযুগল পলিত হইয়াছে। তিনি নাগবন্ধুর বার্তা শুনিয়া অর্ধ-স্বগত কণ্ঠে বলিতেছেন—

ভাল ভাল—আমাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার ফল এবার ফলবে। চণ্ড চণ্ড— আমি ভুলিনি (গণ্ডে অঙ্গুলি বুলাইলেন)—যেদিন তোমার ছিন্ন মুণ্ড মাটিতে ফেলে ক্ষিপ্ত প্রজারা পদাঘাত করবে, তোমার রক্ত কুকুরে লেহন করবে—সেদিন আমার হৃদয় শীতল হবে—

নাগবন্ধু উদ্দীপ্তস্বরে বলিল—সেদিন আসতে দেরি নেই—প্রজারা মনে মনে আগুন হয়ে উঠেছে, একটা সূত্র পেলেই ফেটে পড়বে।

শিবামিশ্র বলিলেন—সেই সূত্র শীঘ্রই পাবে। সামান্য কারণ থেকে বৃহৎ কার্যের উৎপত্তি হয়, একটি ক্ষুদ্র দীপশিখা সুযোগ এবং অবকাশ পেলে একটা নগর ভস্মীভূত করতে পারে। জনগণ সামান্য নয়, তাদের ক্রোধ ক্ষুদ্র নয়—চণ্ড তা বুঝবে।

হাঁ প্রভু।

কিন্তু শুধু চণ্ড নয়, অভিশপ্ত শিশুনাগ বংশের সকলকেই এই বিদ্রোহের আগুনে আহুতি দিতে হবে। এ কথা যেন মনে থাকে, মগধেও বৈশালীর মত প্রজাতন্ত্র গড়ে তুলতে হবে।

হাঁ প্রভু।

এই সময় বাহিরে দ্রুত অশ্বক্ষুরধ্বনি শুনা গেল। উভয়ে চকিতে গবাক্ষের বাহিরে চাহিলেন।

শ্বেতবর্ণ অশ্বের পৃষ্ঠে উল্কা আসিতেছে। অপূর্ব সুন্দরী ষোড়শী; অঙ্গে পুরুষের বেশ, হস্তে ধনুর্বাণ। বলগা-মুক্ত অশ্ব নক্ষত্রবেগে ছুটিয়া আসিতেছে।

অঙ্গনের প্রান্তে মৃন্ময়ূর এখনও উৎকণ্ঠ হইয়া আছে। ধাবমান অশ্বপৃষ্ঠ হইতে উল্কা ময়ুর লক্ষ্য করিয়া তীর নিক্ষেপ করিল। তীর ময়ুরের চক্ষু বিদ্ধ করিল।

উল্কা বিজয়োফুল্ল মুখে উচ্চহাস্য করিয়া উঠিল। তারপর অশ্বের বেগ সংযত করিয়া বাতায়নতলে আসিয়া দাঁড়াইল। শিবামিশ্র স্নেহস্মিত মুখে বলিলেন

ধন্য!

উল্কা বলিল—পিতা! দেখলেন?

শিবামিশ্র কহিলেন—দেখেছি বৎসে। আজ তোমার ধনুর্বিদ্যা সার্থক হল।

উল্কা মহানন্দে ধনুক শুন্যে লুফিতে লুফিতে ঘোড়া ছুটাইয়া অদৃশ্য হইয়া গেল। নাগবন্ধু স্মরণ-মন্থর কণ্ঠে বলিল—সেই উল্কা শ্মশানকন্যা–গুরুদেব, উল্কা যে আপনার কন্যা নয় তা সে জানে?

শিবামিশ্র এতক্ষণ স্মিতমুখে বাহিরে চাহিয়া ছিলেন, গম্ভীরমুখে নাগবন্ধুর দিকে ফিরিলেন। বলিলেন

না, বলিনি। মহাকাল করুন যেন বলবার প্রয়োজন না হয়।

শিবামিশ্রের চোখের দৃষ্টি আবার কঠিন হইয়া উঠিল। ক্ষণেক পরে তিনি বলিলেন

নাগবন্ধু, তুমি পাটলিপুত্রে ফিরে যাও–সুযোগের প্রতীক্ষা করবে; সুযোগ যত ক্ষুদ্রই হোক তাকে অবহেলা করবে না। জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলবে। জনতা যখন একবার ক্ষেপে উঠবে তখন আর তোমাদের কিছু করতে হবে না, জনতা নিজের কাজ নিজেই করবে।—জয়ী হও বৎস, এবার যখন আসবে তোমার মুখে যেন চণ্ডের মৃত্যু-সংবাদ পাই—স্বস্তি!

নতজানু নাগবন্ধুর মস্তকে হস্তাৰ্পণ করিয়া শিবামিশ্র আশীর্বাদ করিলেন।


পাটলিপুত্রের উপকণ্ঠে রাজকীয় মৃগয়া কানন। কাননে নানা জাতীয় বৃক্ষ—আম্র কণ্টকী জম্বু; নানা জাতীয় পশু পক্ষী-হরিণ, ময়ুর, শশক। কাননের স্থানে স্থানে কৃত্রিম জলাশয়; তাহাতে সারস মরাল ক্রীড়া করিতেছে। দ্বিপ্রহরে স্থানটি নির্জন।

মৃগয়া কাননের ভিতর দিয়া সেনজিৎ অশ্বপৃষ্ঠে চলিয়াছেন। অশ্বের গতি অত্বরিত। সেনজিৎ ইতস্তত বৃক্ষশাখায় দৃষ্টিপাত করিতেছেন, তাঁহার চক্ষু পক্ষীসন্ধানী। আশেপাশে নিশ্চিন্ত হরিণের দল বিচরণ করিতেছে কিন্তু সেদিকে তাঁহার আগ্রহ নাই। তিনি পক্ষী-প্রেমিক।

লক্ষ্যহীনভাবে ভ্রমণ করিতে করিতে সহসা সেনজিতের দৃষ্টি পড়িল এক বৃক্ষশাখায় একটি পাখির বাসার উপর। বাসার কিনারায় দুইটি অর্ধোদগতপক্ষ শাবক বসিয়া আছে। সেনজিৎ মুগ্ধ নেত্রে চাহিয়া রহিলেন, বলগার আকর্ষণে অশ্ব স্থগিত হইল। নূতন পাখি, সেনজিৎ পূর্বে কখনও দেখেন। নাই।

পাখির বাসার উপর কুতুহলী চক্ষু নিবদ্ধ রাখিয়া সেনজিৎ অশ্ব হইতে নিঃশব্দে নামিয়া পড়িলেন। অশ্ব নিশ্চিন্তভাবে শষ্পাহরণ করিতে করিতে একদিকে চলিয়া গেল। সেনজিৎ পা টিপিয়া টিপিয়া বৃক্ষের দিকে অগ্রসর হইলেন।

মৃগয়া কাননের প্রধান রক্ষী কুন্ত দূর হইতে সেনজিৎকে দেখিতে পাইয়াছিল। কুম্ভ কৃষ্ণকায় অনার্য; আকৃতি যেমন ভয়ঙ্কর, প্রকৃতি তেমনি রূঢ়। তাহার মাথায় কল্কপত্রের চূড়া। হাতে দীর্ঘ ভল্ল, কটি হইতে শৃঙ্গ ঝুলিতেছে। সে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে সেনজিতের দিকে অগ্রসর হইল।

সেনজিৎ অতি সন্তর্পণে গাছে উঠিবার উপক্রম করিতেছেন এমন সময় পিছনে কুম্ভের কটু কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইলেন

দাঁড়াও। –কে তুমি?

সেনজিৎ চকিতে ফিরিয়া ওষ্ঠে অঙ্গুলি রাখিলেন—

চুপ—শব্দ কোরো না। পাখির বাসায় ছানা আছে, এখনি উড়ে যাবে।

কুম্ভ কাছে আসিয়া ধৃষ্টতা-ভরা চক্ষে সেনজিৎকে পরিদর্শন করিল, রূঢ় স্বরে বলিল

কে হে তুমি? এটা রাজার মৃগয়া কানন তা জান না!

সেনজিৎ পাখির বাসার দিকে চোখ তুলিয়া দেখিলেন পাখির ছানাদুটি ভয় পাইয়া উড়িয়া গিয়াছে। তাঁহার মুখ অপ্রসন্ন হইল। কুম্ভের দিকে চোখ নামাইয়া তিনি বলিলেন—

মৃগয়া কানন তা জানি। তুমি কে?

কুম্ভ সদম্ভে বলিল—আমি কুম্ভ—এই কাননের প্রধান রক্ষী। তুমি কার হুকুমে রাজার মৃগয়া কাননে পাখি ধরে বেড়াচ্ছ? রাজার অনুমতিপত্র আছে?

সেনজিৎ বিরক্ত স্বরে কহিলেন—অনুমতিপত্র আমার দরকার নেই।

কুম্ভ ব্যঙ্গভরে বলিল—বটে! তুমি কি রাজবংশের ছেলে নাকি!

সেনজিৎ বলিলেন—হাঁ।

তিনি গমনোদ্যত হইয়া কুম্ভের দিকে পিছন ফিরিলেন; অমনি কুম্ভ হাত বাড়াইয়া তাঁহার স্কন্ধ ধরিল

রাজবংশের ছেলে! আমার সঙ্গে বাকচাতুরী! তোমার নাম কি?

সেনজিৎ সবলে নিজ স্কন্ধ হইতে কুম্ভের হাত সরাইয়া দিলেন। বলিলেন—আমার নাম সেনজিৎ!

কুম্ভের চোখে উত্তেজনা দপ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল, সে ক্ষণেক সেনজিৎকে সবিস্ময়ে পর্যবেক্ষণ করিয়া সহসা কটি হইতে শৃঙ্গ তুলিয়া তাহাতে ফুৎকার দিল। শিঙার শব্দ কাননের চারিদিকে প্রতিধ্বনি তুলিল। তারপর কুম্ভ শিঙা নামাইয়া দন্তবিকাশ করিল

তুমি সেনজিৎ! মহারাজ চণ্ড তোমাকে পাটলিপুত্র থেকে নির্বাসিত করেছিলেন—তুমি সেই!

শৃঙ্গ-নিনাদে আকৃষ্ট হইয়া বিভিন্ন দিক হইতে কয়েকজন রক্ষী ছুটিয়া আসিতেছিল। তাহাদেরও হাতে ভল্ল, বেশবাস কুম্ভেরই মত। সেনজিৎ বিপদ বুঝিয়া উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিলেন। বলিলেন

হাঁ, আমি সেই সেনজিৎ। কিন্তু তাতে কি হয়েছে?

অন্য রক্ষীরা আসিয়া সেনজিৎকে ঘিরিয়া ধরিল। কুম্ভ সেনজিতের মুখের উপর অট্টহাস্য করিয়া উঠিল। বলিল–

তুমি রাজার আদেশ অমান্য করেছ—এখন রাজসভায় চল। ভাই সব, একে রাজার কাছে নিয়ে চল।

রক্ষীরা সেনজিৎকে ধরিল। সেনজিৎ তাহাদের হাত ছাড়াইবার চেষ্টা করিতে করিতে বলিলেন

কিন্তু আমি তো পাটলিপুত্র নগরে প্রবেশ করিনি

কুম্ভ দন্তবিকাশ করিয়া বলিল—সে কথা রাজাকে বোলো

রক্ষীরা সেনজিৎকে টানিয়া লইয়া চলিল।

পাটলিপুত্রের একটি অপেক্ষাকৃত নির্জন পথ। কুম্ভ এবং অন্যান্য উদ্যানরক্ষীরা সেনজিতের কোমরে দড়ি বাঁধিয়া টানিয়া লইয়া যাইতেছে।

হঠাৎ পাশের একটি রাস্তা দিয়া নাগবন্ধু প্রবেশ করিল এবং এই দৃশ্য দেখিয়া থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। তাহার চোখে চকিত চিন্তার ছায়া পড়িল—এই সুযোগ! সে উচ্চকণ্ঠে বলিয়া উঠিল—

সেনজিৎ! সেনজিৎকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে!

সেনজিৎ ঘাড় ফিরাইয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন—

আমি নির্দোষ। আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে

কুম্ভ ধমক দিয়া বলিল—চুপ–কথা কোয়ো না!

তাহারা নাগবন্ধুকে ছাড়াইয়া দূরে চলিয়া যাইতে লাগিল। ইতিমধ্যে আরও দুই-চারিজন পথচারী আসিয়া জুটিল। নাগবন্ধু দুই হস্ত আস্ফালিত করিয়া চিৎকার করিয়া বলিল—

ভাই সব শীঘ্র এস! দ্যাখো, আমাদের প্রিয় সেনজিৎকে রাজার রক্ষীরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে—

আরও লোক আশপাশের গলি হইতে ব্যস্তসমস্তভাবে প্রবেশ করিল; তাহাদের হাতে লাঠি।

জনগণ ব্যগ্রস্বরে প্রশ্ন করিল-কী হয়েছে? কী হয়েছে?

নাগবন্ধু বাহু প্রসারিত করিয়া দেখাইল—

ঐ দ্যাখো—আমাদের প্রিয় বন্ধু সেনজিৎকে রাজরক্ষীরা বিনা দোষে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে—


অপেক্ষাকৃত জনবহুল পথ। রক্ষীরা সেনজিৎকে টানিয়া লইয়া চলিয়াছে, কিন্তু রক্ষীদের মুখে আশঙ্কার ছায়া। বিক্ষুব্ধ জনতা তাহাদের পশ্চাতে চলিয়াছে। তাহাদের মধ্য হইতে নাগবন্ধুর উদ্দীপ্ত কণ্ঠস্বর শুনা যাইতেছে।

সেনজিৎ আমাদের বন্ধু—পাটলিপুত্রের নাগরিকেরা সেনজিৎকে ভালবাসে রাজার জল্লাদেরা তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আর কতদিন আমরা চণ্ডের অত্যাচার সহ্য করব? আর কতদিন একটা রক্তপিপাসু রাক্ষস আমাদের রক্ত শোষণ করবে? মগধবাসি ওঠো! জাগো।…


রাজপুরীর তোরণদ্বার। কয়েকজন সশস্ত্র প্রতীহার তোরণদ্বারের সম্মুখে সারি দিয়া দাঁড়াইয়া আছে; তাহাদের চোখে-মুখে উদ্বিগ্ন সতর্কতা। দূর হইতে অগ্রসর জনতার গর্জন ক্রমশ নিকটবর্তী হইতেছে।

প্রতীহারদের মধ্যে নিম্নস্বরে কথাবার্তা হইল; তারপর তাহারা তোরণদ্বার অরক্ষিত রাখিয়া ভিতরের দিকে চলিয়া গেল। বোধহয় রাজসভায় সংবাদ দিতে গেল।

বিপুল জনতা তোরণদ্বারের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল; তাহাদের মাঝখানে সেনজিৎ। রক্ষীরা পলাইয়াছে। জনতা সেনজিতের হস্তের রজ্জু খুলিয়া বিরাট জয়ধ্বনি সহকারে তাঁহাকে স্কন্ধে তুলিয়া লইল। সেনজিৎ দুই হাত তুলিয়া জনগণকে শান্ত হইতে বলিলেন। কোলাহল ঈষৎ শান্ত হইলে নাগবন্ধুর কণ্ঠস্বর শুনা গেল।

মগধবাসি। রাজপ্রাসাদের দ্বার থেকে ফিরে যেও না—চণ্ড তোমাদের ওপর যে অত্যাচার করেছে তার প্রতিশোধ নাও-মারো কাটো-রক্তের স্রোত বইয়ে দাও

বিক্ষুব্ধ জনসংঘ একবার দুলিয়া উঠিল, তারপর বাঁধভাঙা স্রোতের মত তোরণপথে প্রবেশ করিল।

রাজসভার অভ্যন্তর। চণ্ড সিংহাসনে বসিয়া দুলিতেছেন, দুইটি কিঙ্করী পিছনে দাঁড়াইয়া সিংহাসনে দোল দিতেছে। বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে চণ্ডের মুখাকৃতি আরও কদাকার হইয়াছে। অদূরে ভূমিতে বটুক ভট্ট নিবিষ্ট মনে একাকী অক্ষক্রীড়া করিতেছেন। সভায় সভাসদ বেশী নাই, যে কয়জন আছে তাহারা তদগতচিত্তে মদ্যপান করিতেছে। প্রত্যেকের পাশে একটি ভৃঙ্গার-হস্তা তরুণী দাসী দাঁড়াইয়া।

বাহির হইতে জনতার কল-কোলাহল ক্রমে বর্ধিত হইতেছে শুনিয়া চণ্ড ভ্রূভঙ্গ করিয়া আরক্ত চক্ষু মেলিলেন। এই সময় প্রতীহারগণ দ্রুত প্রবেশ করিল। ভয়ার্তস্বরে চিৎকার করিল

পালাও পালাও—পাটলিপুত্রের নাগরিকেরা ক্ষেপে গেছে—তারা রাজপুরী আক্রমণ করেছে-পালাও

কিঙ্করীগণ চিৎকার করিয়া যে যেদিকে পারিল পলাইল। সভাসদেরাও ক্ষণেক হতভম্ব থাকিয়া সহসা কিঙ্করীদের অনুসরণ করিলেন। বটুক ভট্ট লাফ দিয়া সিংহাসনের শৃঙ্খল ধরিয়া ঊর্ধ্বে অন্তর্হিত হইলেন। সভায় চণ্ড ভিন্ন আর কেহ রহিল না।

চণ্ড টলিতে টলিতে সিংহাসন হইতে উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

আমার খড়গ—খড়্গ কোথায়!

এই সময় সভার বিভিন্ন দ্বার দিয়া ক্ষিপ্ত জনতা প্রবেশ করিল; চণ্ডকে নিরস্ত্র দেখিয়া তরক্ষুপালের মত তাঁহার উপর লাফাইয়া পড়িল। চণ্ড বন্য মহিষের মত যুদ্ধ করিলেন। বটুক ভট্ট ঊর্ধ্বে ঝুলিতে ঝুলিতে ব্যায়তচক্ষে যুদ্ধ দেখিতে লাগিলেন।


রক্তপাগল জনতা কথঞ্চিৎ শান্ত হইয়াছে। চণ্ডকে মাটিতে ফেলিয়া কয়েকজন লোক তাঁহার হস্তপদ মাটির উপর চাপিয়া ধরিয়াছে। তাঁহার চারিদিকে চক্রাকারে দাঁড়াইয়া জনগণ বুভুক্ষু-চক্ষে চাহিয়া আছে। চণ্ড বন্দী হইয়াছেন বটে, কিন্তু অসহায় অবস্থাতেও তাঁহার প্রকৃতির দুর্দম বন্যতা কিছুমাত্র প্রশমিত হয় নাই। তিনি মাঝে মাঝে গর্জন করিয়া হস্তপদ মুক্ত করিবার চেষ্টা করিতেছেন।

নাগবন্ধু দর্শকচক্রের সম্মুখভাগে দাঁড়াইয়া ছিল; সহসা সে চণ্ডের বুকের উপর লাফাইয়া পড়িয়া ছুরিকা ঊর্ধ্বে তুলিল। ছুরিকা চণ্ডের বক্ষে প্রবেশ করিত—যদি না এক বিপুলকায় ব্যক্তি নাগবন্ধুর মণিবন্ধ ধরিয়া ফেলিত।

বিপুলকায় ব্যক্তি বলিল—ও কি করছ নাগবন্ধু!

নাগবন্ধু উন্মত্তের ন্যায় বলিল—ছেড়ে দাও মল্লজিৎ—আমি প্রতিশোধ চাই। আমার শিশুপুত্রকে রথের চাকার তলায় পিষে মেরেছিল—তার প্রতিশোধ চাই—

মল্লজিৎ বলিল—স্থির হও নাগবন্ধু। আমাদের সকলের কাছেই চণ্ড ঋণী, তাকে হত্যা করলে সে-ঋণ শোধ হবে না। মৃত্যু তো মুক্তি। চণ্ডকে আমরা এত সহজে মুক্তি দেব না, তিল তিল করে কড়ায় গণ্ডায় তার অত্যাচারের ঋণ আদায় করে নেব। আমরা চণ্ডকে এমন শাস্তি দেব! কিন্তু ভেবেচিন্তে সে-শাস্তি ঠিক করতে হবে—এখন নয়। ভাই সব, তোমরা চণ্ডকে বাইরে নিয়ে গিয়ে গলায় শিকল দিয়ে বেঁধে রাখো

যাহারা চণ্ডের হস্ত-পদ চাপিয়া বসিয়াছিল তাহারা তাঁহাকে টানিয়া তুলিল এবং টানিতে টানিতে সভার বাহিরে লইয়া গেল। অধিকাংশ জনতাও কলকোলাহল করিতে করিতে সঙ্গে গেল।

সভার মধ্যে সেনজিৎ নাগবন্ধু মল্লজিৎ ও চার-পাঁচ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ব্যতীত আর কেহ নাই। সেনজিৎ সভাগৃহের একপাশে বিমর্ষভাবে করলগ্নপোলে বসিয়া আছেন, অন্য সকলে চক্রাকারে দাঁড়াইয়া মন্ত্রণা করিতেছে। মন্ত্রণাকারীদের মধ্যে মল্লজিৎ অগ্রণী। বটুক ভট্ট অলক্ষিতে মন্ত্রণাকারীদের মাথার উপর ঝুলিতেছেন।

মল্লজিৎ বলিল—বিপ্লবের কাজ শেষ হয়েছে, এখন আবার গড়ে তুলতে হবে। আবার আমাদের নতুন রাজা চাই

নাগবন্ধু বলিল—রাজার কী দরকার? বৈশালীর মত প্রজাতন্ত্র

সকলে বিস্ফারিত নেত্রে নাগবন্ধুর পানে চাহিল।

একজন বিস্মিত প্রশ্ন করিল-প্রজাতন্ত্র আবার কি?

মল্লজিৎ বলিল—প্রজাতন্ত্র কাকে বলে আমরা জানি না। আমরা জানি যে রাজ্যে রাজা নেই, সে রাজ্য অরাজক। অতএব আমাদের রাজা চাই। এখন প্রশ্ন এই—কে রাজা হবে! কাকে আমরা রাজা করব। রাজা হবার যোগ্যতা কার আছে।

সকলের দৃষ্টি ধীরে ধীরে সেনজিতের দিকে ফিরিল। সেনজিৎ এই মিলিত দৃষ্টির আঘাতে সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিলেন। চকিতস্বরে বলিলেন—

কী! আমার দিকে চাইছ কেন? আমি রাজা হতে চাই না। না না, তোমরা আর কাউকে

মল্লজিৎ হাত তুলিয়া সেনজিৎকে নিরস্ত করিল। ধীরকণ্ঠে বলিল—

সেনজিৎকে রাজ্যের সকলে ভালবাসে—সেনজিৎ শান্ত প্রকৃতির নিরভিমান হৃদয়বান পুরুষ। আমার অভিমত সেনজিৎ রাজা হোন

নাগবন্ধু বলিল—কিন্তু শিশুনাগ বংশেরই আর একজনকে

মল্লজিৎ বলিল—শিশুনাগ বংশের বিরুদ্ধে আমার কোনও অভিযোগ নেই।

অন্য এক নাগরিক বলিল—আমাদেরও নেই। চণ্ডই আমাদের শত্রু ছিল।

সেনজিৎ বিষণ্ণভাবে বলিলেন—কিন্তু কিন্তু—সিংহাসনে আমার রুচি নেই। বন্ধুগণ, আমি এ সম্মানের যোগ্য নই–

মল্লজিৎ বলিল—সে কথা জনসাধারণ বিচার করুক।

সেনজিতের হাত ধরিয়া মল্লজিৎ সভাগৃহের এক প্রান্তে একটি মুক্ত বাতায়নের সম্মুখে উপস্থিত হইল। বাতায়নের বাহিরে পুরভূমির উপর বিক্ষুব্ধ জনমদ আবর্তিত হইতেছে, বাতায়নে মল্লজিতের সহিত সেনজিৎকে দেখিয়া তাহারা সোল্লাসে গর্জন করিয়া উঠিল। মল্লজিৎ হাত তুলিয়া তুর্যকণ্ঠে তাহাদের সম্বোধন করিল

মগধবাসী জনগণ, আমরা আমাদের প্রিয়বন্ধু সেনজিৎকে চণ্ডের পরিবর্তে সিংহাসনে বসাতে চাই—তোমাদের অভিমত আছে কিনা জানাও।

জনমর্দ হইতে বিপুল হর্ষধ্বনি উত্থিত হইল। সেই সঙ্গে শঙ্খ ও শৃঙ্গনিনাদ আকাশ বিদীর্ণ করিয়া দিল। সেনজিতের মুখে কিন্তু হাসি নাই। নাগবন্ধুর ললাটও মেঘাচ্ছন্ন।

সেনজিৎকে লইয়া মল্লজিৎ ও অন্য সকলে সভার মধ্যস্থলে গেল এবং সেনজিৎকে সিংহাসনে বসাইল।

মুকুট রাজমুকুট কোথায়?

সকলে ইতস্তত রাজমুকুট খুঁজিতে লাগিল। একজন সিংহাসনের পিছনে চণ্ডের শিরশ্চ্যুত মুকুট দেখিতে পাইল। এই যে বলিয়া সে মুকুট কুড়াইয়া লইয়া সেনজিতের মাথায় পরাইয়া দিল।

এই সময় বটুক ভট্ট শৃঙ্খল-যোগে ঊর্ধ্বলোক হইতে নামিয়া আসিলেন। দুই হাত তুলিয়া গম্ভীর স্বরে বলিলেন—

জয়োস্তু মহারাজ।

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress