Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বরযাত্রী হোঁৎকা || Shaktipada Rajguru

বরযাত্রী হোঁৎকা || Shaktipada Rajguru

বরযাত্রী যাবার আনন্দে হোঁৎকা অধীর হয়ে তার দেশজ ভাষায় বলে—হঃ! বিহার মধ্যে বরযাত্রী যাওনই আনন্দের। গাড়িতে যামু—খামু—হৈচৈ করুম।

গোবর্ধনের ছোট মামার বিয়ে, হরিপালের ওদিকে কোনো এক গ্রামে। তাই গোবর্ধনের বন্ধু হিসাবে লিস্টের মধ্যে আমরাও আছি। তবে বরযাত্রী দলে তরুণদের সংখ্যা কমই, মাত্র আমরা ক’জন। পটলা, ফটিক, আমি আর হোঁৎকা। গোবর্ধন তো নিতবর হতে হতে রয়ে গেছে।

এখান থেকে বাসে বরযাত্রীকুল যাবে, বর অবশ্য আলাদা গাড়িতে যাবে। বর বলে কথা! ফেরার সময় নতুন কনেও আসবে ওই গাড়িতে। বেশ ফুল, সবুজ শেওলা-টেওলা দিয়ে প্রজাপতি বানানো হয়েছে গাড়ির সামনে।

বিকেল নাগাদ বের হতে হবে।

গোবর্ধনের মামার কুমড়োর আড়তে আমরা জমায়েত হয়েছি। ওপাশে ওদের বাড়ি, আড়তে কুমড়োর টাল, এক কেজি থেকে মৃদঙ্গের সাইজের আট-দশ কেজিটাকও আছে, ওদিকে চালকুমড়োর স্টক। পাউডার মাখানো পাশবালিশ, তাকিয়ার সাইজও আছে।

আজ কুমড়ো সেল বন্ধ। গোবরার মামা নদুবাবু তারকেশ্বরের কুমড়োর সাইজের ভুঁড়ি ঢেকে গরদের পাঞ্জাবি পরেছে। বর্ণটি কালো—তাতে চালকুমড়োর গায়ের মত পাউডারের প্রলেপ পড়েছে, গলায় মফচেন হার। ওদিকে এসে পড়েছে পাড়ার অনুকূল কবরেজ। শীর্ণ, পাকা বেলের মত চকচকে মাথা, কণ্ঠস্বর খাগড়াই ফাটা কাঁসরকেও হার মানায়। রয়েছে গুরুগম্ভীর মানুষ আমাদের স্কুলের সংস্কৃত স্যার, গলার উত্তরীয়, পরনে চটি। বাজারের ম্যানেজার হাবুলবাবু। বাজারের মাছ, ডিম, আনাজপত্র বিনা পয়সায় খেয়ে খেয়ে দেহটিকে যেন একটি জিপিও থামে পরিণত করেছে। কথায় কথায় লোককে শাসায়। গোবর্ধনের মামার বন্ধু কেশব ডাক্তারও এসেছে। বাজারে কেশববাবুর হোমিওপ্যাথি ডাক্তারখানা।

অনুকূল কবরেজ ওকে দেখে বলে—ওই সাদা গুলিটাও বরযাত্রী যাচ্ছে?

কেশব ডাক্তারের পাশেই অনুকূলের কবরেজখানা। দুজনের প্রায়ই ঝগড়া বাধে। ও বলে—আমার রুগি ভাঙাবি?

কেশব বলে—শেকড়বাকড় দে রোগ সারে? সারে না। হ্যানিম্যান বলেন—

—রাখ তর হ্যানিমুন। চরক-শুশ্রুতের নাম শোনসনি? গণ্ডমূর্খ—

-খবরদার!

দুজনেই দোকান ছেড়ে পথে অবতীর্ণ হয়। এদিকে চকচকে টাক, অন্যদিকে বাবরি চুল কেশব। শেষে রোগীরাই তাদের ডাক্তার কবরেজকে সামলায়। আজ কেশব এখানে এসে ওই মন্তব্য শুনে বলে—বরযাত্রী যাচ্ছ চলো কবরেজমশাই, বাজে কথা বলো না। নো টক । আমাদের সংস্কৃত স্যার আশুবাবু বলেন—শান্তি-শান্তি—

ওদিকে বাকি বরযাত্রী দলও এসে পড়েছে। বরের গাড়ি রেডি। যেতে হবে অনেকটা পথ আর কলকাতা থেকে বিকেলের দিকে যানজট ভেদ করে বের হওয়া অভিমন্যুর চক্রব্যূহ ভেদ করে বের হবার মতই কঠিন ব্যাপার।

অবশ্য লগ্ন রাত্রি নটার পরই। তবু দূরের পথ। গোবর্ধনের মামাই বরকর্তা। মামা ওই গাড়িতে বরের সঙ্গে নাপিত, পুরুতকে নিয়ে নিজে উঠে ম্যানেজারকে বলে—গাড়ি এলে এদের নে এসো। হরিপাল রোডের থেকে ডানদিকে কানা নদীর ধারে মাথাভাঙা কাদাপোঁতা

গ্রাম।

কুমড়োর আড়তদার রাজুবাবু। ম্যানেজার ওখানে কুমড়ো আমদানি করতে কয়েকবার গেছে। বলে—ঠিক আছে।

এদিকে শাঁখ বাজিয়ে উলু দিয়ে বরকে বিদেয় করা হল। বরযাত্রীদের বাহনের দেখাই নাই। কে জানে বরযাত্রীবিহীন বিয়েই হবে। ওদিকে ফোন করে ম্যানেজার। বাসওয়ালা জানায় গাড়ি শ্রাদ্ধবাড়িতে গেছে, পার্টিকে নামিয়ে দিয়েই চলে যাবে।

পণ্ডিতমশাই বলে—শ্রাদ্ধ তৎপর বিবাহ! কেমন অশুভ ব্যাপার হে-

অনুকূল কবরেজের আবার ভূতের ভয়। অবশ্য এ খবরটা অনেকেই জানে না। আমরা দেখেছি কুলেপাড়ার বাঁশবাগানের পাশ দিয়ে সন্ধ্যার পর যাবার সময় কবরেজমশাই সজোরে রামনাম করে। সেদিন আমাদের দূর থেকে দেখে রামনাম ছেড়ে বু বু বু…করতে শুরু করে। ছিটকে পড়ে আর কি! আমাদের চিনতে পেরে ধড়ে প্রাণ ফিরে পায়-তো-তো তোরা ! সাড়া দিবি তো! আমরা হাসছি ওর অবস্থা দেখে। কবরেজ বলে—কাউকে বলিসনি বাবা । ওই কেশব যেন না শোনে।

আমরা অবশ্য কাউকে বলিনি, কবরেজমশাই ঘুষ বাবদ চ্যবনপ্রাশের গুলি কিছু দেয় আমাদের।

এহেন কবরেজ বলে—সত্যিই শ্রাদ্ধের ছোঁয়া-টোয়া নিয়ে বিয়েতে যাবে !

ম্যানেজার বলে—লোহাতে দোষ নেই ।

বিকেল গড়িয়ে আসছে। শীতের দিন। আলো মুছে আসছে খালের বুকে। গাছগাছালিতে কাকের দল দিনের পরিক্রমা সেরে ফিরছে। বাসটা এলো এইবার ।

বরযাত্রী দল রেডিই ছিল। বাহান্ন সিটের বাস ভর্তি হয়ে গেল দেখতে দেখতে। আমরা কজন অবশ্য উঠেই সিটকটা দখল করেছি। ভিড়ের মধ্যে দেখা যায় কবরেজ বসেছে কেশবের পাশেই, দুজনের মুখ দুদিকে, যেন ছোঁয়াও লাগাতে রাজি নয় কেউ কারো।

ম্যানেজার লাদাই পর্ব শেষ করে। কুমড়ো লোড করা মাথা, তাই বাকি কয়েকজনকেও তুলে এদিক-ওদিকে দাঁড় করিয়ে দেয়। বাসও যাত্রা করল।

দিল্লি রোড ছাড়িয়ে এবার বাস বাবার পথ দিয়ে চলেছে। সংস্কৃতের স্যার দু’হাত তুলে বাবা তারকনাথের উদ্দেশে স্তোত্র আওড়ায়—

প্রভুমীশমনীশমশেষগুণং

প্রণমামি শিবম্ শিবকল্পতরুম্।

কে জয়ধ্বনি দেয়—জয় বাবা ভূতনাথ! এ ভূতপ্রেতের রাজ্য হে। অনুকূল কবরেজের টাক ঘামছে। কেশব বলে—ভূতের দেশই বটে।

ধমকে ওঠে কবরেজ—ওনাদের নাম না নিলেই নয় ?

ওদিকে বাজারের মাছের কারবারি নকুল এর মধ্যে বাবার প্রসাদও পেয়ে গেছে। সিগ্রেটের ভিতরে গঞ্জিকা পুরে জোরসে টান দিয়ে হিসাব করে দামি ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে চোখ বুজে সে বলে—মলে সব ব্যাটাকেই তো ওই-ই হতে হবে গো। ভূতনাথই পরম গতি। জয় বাবা ভূতনাথ।

পথ অন্ধকার। বাস চলেছে নাচতে নাচতে। বরযাত্রী দলের পেটে দুপুর থেকে কিছুই পড়েনি। খালি পেটে বাসের নাচনে খোল-কত্তাল বাজতে শুরু করে।

কালীবাবু বাজার ম্যানেজার হাবুলবাবুকে বলে—কি হে ম্যানেজার, তুমি বরযাত্রী নে যাচ্ছ না কুমড়ো চালান দিচ্ছ হে? লোকগুলোর কি খিদে-তেষ্টাও নাই? একটু চা-টা খাওয়াও হে । ম্যানেজার ভেবেছিল এই বাবদ খরচটা পুরো বাঁচিয়ে নিজেই ম্যানেজ করে নেবে। কিন্তু গোবর্ধন বলে—সামনেই একটা ধাবা আছে, ম্যানেজারবাবু ওখানেই চা-টা মিলবে।

ম্যানেজার গাঁইগুই করে—এই তো এসে গেছি। কিন্তু বরযাত্রীদের চটানো নিরাপদ নয় । কাজেই থামাতে হল বাসটাকে।

ম্যানেজারের বেশ কিছু লোকসানই হল। বরযাত্রীর দল শুধু চাতেই থামেনি, টাও খেয়েছে—বিস্কুট, টোস্ট কেউ আবার ওমলেট।

ম্যানেজার বলে—তাড়াতাড়ি করুন ডাক্তারবাবু, বিয়েবাড়িতে গিয়ে জলটল খেতে হবে আবার। কিন্তু সে কথাতে কেউ কান দেয় না।

বিয়েবাড়ি অবশ্য সেখান থেকেও ঘণ্টাখানেকের রাস্তা। তবে এটা পাকা রাস্তা নয়, মেঠো রাস্তা। মোরাম ইটভাঙা ঢালা। কুমড়ো, আলুর লরিই যাতায়াত করে। বাসওয়ালা বেঁকে বসে—নেই যায়েগা ।

একেবারে মাঝ মাঠ। রাতের অন্ধকার নেমেছে। পথের ধারে একটা পুরোনো বটগাছ, এদিক-ওদিকে ঝুরি নেমেছে।

দত্তমশায় নেমে বলে—এ কোথায় এলেম হে?

কবরেজ মশাই নেমেই আঁতকে ওঠে। ওর চকচকে টাকে সাদা চুনগোলা কিছুটা বস্তু পড়েছে গাছের উপর থেকে। তারপরই ডাল কাঁপিয়ে শন শন শব্দ। কোথায় একটা বাচ্চা ছেলে ককিয়ে ওঠে।

—রাম রাম রাম! কবরেজ মশাইয়ের টাক থেকে সেই তরল বিষ্ঠা গড়িয়ে কপালে এসেছে। রুমাল দিয়ে মুছে নেয়। তবু কপালে খানিকটা লেগে থাকে তিলকের মতো। হাবুলবাবু বলে—শকুনির পাল রয়েছে গাছে। কাছেই শ্মশান।

—অ্যাঁ! কবরেজমশাই কেন, অনেকেই আঁতকে ওঠে। ভূতের রাজ্যে এসে পড়েছে। কেশব ডাক্তার ভয় পেলেও চুপ করে থাকে। সংস্কৃতের পণ্ডিত তখন কালীস্তোত্র শুরু করেছে—ওঁ কালী কালী মহাকালী—শুভদে বরদে দেবী—

ম্যানেজার বলে-ড্রাইভারজি, থোড়া চলো জি। সামনেই বিয়েবাড়ি।

ড্রাইভার বলে—শ্বশুরবাড়ি হলেও ভি নেহি যাবে। গাড়ি ব্যাক করবে কাঁহা? বহুত খারাব রাস্তা।

সংস্কৃত স্যার বলে—এ যে বহুত অপবিত্র স্থান হ্যায়। অপদেবতা রহতা ইধার ।

ড্রাইভার বলে–অপদেবতা! সো কোন চীজ !

হাবুলবাবু বলে—ভূত পিরেত জানতা?

—হ্যাঁ ভূত! রহনে দেও। আপলোক পায়দল চলা যাইয়ে। নজদিক তো হ্যায়। হম নেহি যায়েগা।

বলে সে ব্যাটা সিটের উপর টান টান হয়ে শুয়ে পড়ে। নড়ার লক্ষণও নেই। কবরেজ বলে—ও মানুষ না ভূত-পেরেত হে? অ্যাঁ! ভূতের কথা শুনে শুয়ে পড়ল। ছেরাদ্দ বাড়ি থেকে গাড়ি নে আসাই ভুল হয়েছে। কে জানে ভূত-টুত কিছু রয়ে গেছে কিনা !

সংস্কৃত স্যার বলে—ভাববার কথা !

ওদিকে খিদের জ্বালা শুরু হয়েছে। গাড়ি যাবার লক্ষণ নেই। গ্রামের বিয়েবাড়ি কতদূরে জানি না। গোবরা বলে—মুশকিল হল।

হোঁৎকার খিদে সহ্য করার অভ্যাস নেই। দুপুরের পর পেটে কিছুই তেমন পড়েনি। উল্টে ঝাঁকানির চোটে যা ছিল তাও হজম হয়ে গেছে।

পটলা বলে-ভূ-ভূতের দেশে এনে ফেলেছে।

হোঁৎকা গর্জে ওঠে—তহন কইলাম যামু না। হালায় কুমোড় মহাজনের বিহা, তার বরযাত্রী! ল্যাঙোটের কয় বুকপকেট! এহন কি খামু?

শেষ অবধি পেটের জ্বালায় আর ভূতের ভয়েই এরা রাজি হয় হেঁটে যেতে। ম্যানেজার অভয় দেয়—পথ বেশি নয়।

অন্ধকার রাত্রি, তবু আকাশে ঝকঝকে তারার মেলা। ওরই আভায় দেখা যায় পথের রেখাটা। ওই পথ ধরে সঙ্গের দু’একটা টর্চের আলোয় কোনোমতে এগিয়ে চলি।

সামনে চলেছে বদন খাঁড়া, সে নাকি এসব অঞ্চলে, সুন্দরবনে, মধ্যপ্রদেশের বনে-পাহাড়ে বাঘ, হাতি শিকার করেছে। সেই লিড করে চলেছে। হঠাৎ এদিকের ঝোপ থেকে নীল জ্বলন্ত চোখ নিয়ে দুটো প্রাণী এসে রাস্তার উপর আমাদের দেখে থমকে দাঁড়িয়ে চাপা গর্জন করতে থাকে।

দলটা থেমে যায়। বদন খোঁড়া বাপরে বলেই তুড়ি লাফ দিয়ে এপাশের বনবাদাড় ভেদ করে দৌড় লাগায় । পিছনেই ছিল সংস্কৃত স্যার। তিনি তো কাঁটাগাছে কাপড়টা আটকে যেতে কাপড় রেখেই আন্ডারওয়ার পরে যঃ পলায়তি সঃ জীবতি—এই নীতি গ্রহণ করে হাওয়া। বাকিরা অস্ফুট আর্তনাদ শুরু করেছে।

হোঁৎকা পথের থেকে গোটা দুই আধলা ইঁট নিয়ে ওদের দিকে ছুঁড়তে ওরাও পালায় । টর্চের আলোয় দেখা যায় এক জোড়া শিয়াল। তারাও এসময়ে আমাদের দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিল।

শিয়াল তো গেল—এদিকে বদন খাঁড়া আর পণ্ডিতমশাই উধাও। হাঁকডাক করতে দূর থেকে সাড়া মেলে সংস্কৃত স্যারের—এই যে এইস্থানে। আমার বস্ত্রটা দাও ।

বস্ত্রদান করে স্যারকে ফিরে পেলাম, বদন তখনও লা পাত্তা। শেষে দূর থেকে বদন সাড়া দেয়—আসছি।

বদনচন্দ্রকে আর চেনা যায় না। বেগে ধাবমান হয়ে বোধহয় অন্ধকারে কোনো জলার মধ্যে পড়েছে। কাদা-পাঁকে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি বিবর্ণ। বদন বলে—ব্যাটাদের ধরব বলেই ওৎ পেতেছিলাম, তা ব্যাটারা পালালো বদনের চোখে ধুলো দিয়ে।

বরযাত্রী দল চলেছে সামনে। ক্রমে দূরে আলো দেখা যায়, শোনা যায় লোকের কোলাহল। পটলার অভ্যাস পথেঘাটে বের হলে জলের বোতল সঙ্গে রাখা। অবশ্য দেখলাম অনেকেই জলের বোতল নিয়ে এসেছে। পথেঘাটে জল ঠিক মেলে না। এতক্ষণ ওই জলের উপরই চলেছি। এবার সামনে বিয়েবাড়ি দেখে আমাদের চলার স্পিডও বেড়ে ওঠে।

গ্রামের সঙ্গতিপন্ন গৃহস্থের বাড়ি। রাস্তা থেকে বাগান, বাঁশবন শুরু, তারপর বড় এলাকা জুড়ে বাড়ি। সামনে বিরাট প্যাণ্ডেল করে জেনারেটারে আলো জ্বালা হয়েছে। বাইরে দু’তিনটে গাড়ি, তার মধ্যে বরের গাড়িও রয়েছে।

ম্যানেজার এগিয়ে যায়। বিয়েবাড়িতে আমাদের দেখে অভ্যর্থনার ধুম পড়ে। হাঁক-ডাক শুরু হয়, বসার জায়গা এগিয়ে দেয়, সঙ্গে সঙ্গে জলখাবার এসে যায় প্লেটে। সিঙ্গাড়া, কচুরি-চার-পাঁচ রকম মিষ্টি। খিদের মুখে তখন পাল্লা দিয়ে জলখাবারই চলেছে। হোঁৎকা তো একসঙ্গে তিনটে এডিশন শেষ করে দিল। কবরেজ মশাই, সংস্কৃত স্যার মায় হাবুল, দত্তবাবুও দু’প্লেট করে শেষ করে গরম চা নিয়ে বসে।

ওদিকে বাদ্যবাণ্ড চলেছে। অন্দরে উলু-শঙ্খধ্বনি হচ্ছে। রাত তখন প্রায় বারোটা। গোবরা বলে—কই মামাদের কাউকে দেখছি না ?

হোঁৎকা বলে—এহানে এহন হক্কলেই তর মামা। পাইবি। মামা যাইব কনে! চুপ মাইরা বোস।

এর মধ্যে হাবুলবাবু খোঁজ এনেছে, এদের খাওয়ার আয়োজনও দারুণ। মাছ-মাংস ভরপেট, মিষ্টান্ন পাঁচ পদের।

সংস্কৃত স্যার বলে—ভূষিমাল বেশি খেয়ে নিলাম হে।

অনুকূল কবরেজ ব্যাগ থেকে একটা মাঝারি বয়াম বের করে বলে—কোনো ভয় নাই । লৌহজারকচূর্ণ এনেছি, খেলে লোহা অবধি হজম হয়। এক মাত্রা করে খেয়ে নাও—

নিজেও এক মাত্রা খায়। সংস্কৃত স্যার, হাবুল, গোবরা হোঁৎকা আরও অনেকে খায় । কেশব ডাক্তার বলে—ওসবে কি হয়? পালসেটিলা থার্টি খেয়ে নে, ডবল খিদে হবে।

কবরেজের তেতো-কষা বিস্বাদগুলির চেয়ে ওই মিষ্টি লবেনচুসের মত গুলিই খাই আমরা। অনুকূল কবরেজ বলে— ঠকলে। হাতে হাতে ফল পাবে এর। ওই হনিমুনের গুলিতে কি হবে ? কিসসু না ।

-খবরদার!

—অ্যাও! গর্জে ওঠে কবরেজ।

বিয়ের আসরেই দুজনের বাধে আর কি লড়াই। হঠাৎ কন্যাকর্তাদের কে বলে—রাত হয়েছে। ভোজনপর্ব সেরে নিলে হত না?

—উত্তম প্রস্তাব। সংস্কৃত স্যারই এসব ব্যাপারে একটু তৎপর। ফলে কবরেজ আর কেশবের লড়াইটা মুলতুবি রইল। খাবার জায়গায় গিয়ে বসা গেল ।

নাহ্। উত্তম ব্যবস্থা। গরম রাধাবল্লভী, কাশ্মিরী আলুর দম, বিরিয়ানি—তার সঙ্গে গরম মাংসের কারি পাতে পড়েছে। বেশ জমে উঠেছে ভোজনপর্ব। মাংস রিপিট হচ্ছে। হঠাৎ এমন সময় দেখা যায় আর একদল বরযাত্রী উইথ বর এসে গেছে।

এবার সেই কন্যাকর্তাদের রূপও বদলে যায়। একটু আগেই কত খাতির আপ্যায়ন, এবার গর্জে ওঠে মুশকো সেই কন্যাকর্তা আরও কজন—এটা কি! দল বেঁধে লোক ঠকানো! অ্যাই ন্যাপা—ভূতো—গজু, ঘিরে ফেল সবকটাকে, এক ব্যাটাও যেন পালাতে না পারে। ফাঁকি দিয়ে বরযাত্রী সেজে ঠকিয়ে যাবে হাড়ভাঙা নিকেশপুরে এসে! সব কটার হাড় ভেঙে দফা নিকেশ করে দেব। ওঠো—

বদন খাঁড়া ওদিকের লাইনে প্রথম কাদা মাখা জামাকাপড় পরে বসেছিল। তার নুড়ো ধরে তুলে সপাটে একটা রদ্দা ঝেড়ে গর্জায় সেই মুগুরের মত চেহারার লোকটা।—তখনই বোঝা উচিত ছিল, ধানখেতের কাদা থেকে উঠে এল কোন ব্যাটা! বরযাত্রী! আবার এক রদ্দায় বদনের বদনই বিগড়ে যায়।

সংস্কৃত স্যার তিড়িং করে লাফিয়ে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে বলে—আমাদের খোঁজখবর নিতে দিলেন? সোজা জলখাবারের প্লেট ধরিয়ে দিলেন, আমরাও প্রাপ্তিমানে ভক্ষয়িষ্যৎ-খাইলাম ।

—চোপ! বিটলে বামুন, ঘাটের মড়া, এখনও নোলা গেল না?

ম্যানেজার বলে—বিশ্বাস করুন, ভুল হয়ে গেছে। আমরা বরযাত্রীই।

—তবে এখানে এসে জুটলে কেন?

অনুকূল কবরেজের কপালে তখনও শকুনের বিষ্ঠা তিলকের মত বিদ্যমান। কবরেজ বলে—ভ্রমপূর্বক। বিশ্বাস করুন।

সংস্কৃত স্যার বলে—আমরা প্রবঞ্চক নই ।

ম্যানেজার শোনায়—মাথাভাঙায় আমার মালিক কুমড়োমার্চেন্ট গদাইবাবুর ভাইয়ের বিয়ে। সেখানে যেতে এখানে এসে পড়তে এই কাণ্ড। কিছু বলার অবকাশই দিলেন না ।

এর মধ্যে অবশ্য বরযাত্রীদের দু’চার জন গজু-ন্যাপার দলের হাতে বেশ দুচার ঘা খেয়েছে। হোঁৎকা কি বলতে গিয়ে তার দেশজ ভাষায় তালগোল পাকাতে তাকেও নাক বরাবর কে একটা ঘুঁষি ঝেড়েছে। গোবরার কপাল আমড়ার মত ফুলেছে, তার সিল্কের পাঞ্জাবি বুকখোলা চাইনিজ শার্টে রূপান্তরিত হয়েছে।

শেষ অবধি রেহাই পাই অনেক কাকুতি-মিনতির পর। তারাই জানায়-মাথাভাঙা ওই বড়তলা থেকে উত্তরে দেড় মাইল মাঠ পার হয়ে আমরা দক্ষিণে চলে এসেছি পথ ভুলে। ফিরতে হবে আবার সেই বটতলায়।

কোনোমতে পৈত্রিক প্রাণটা নিয়ে বের হলাম। মাঠ ভেঙে আবার সেই বনঢাকা বটতলায় এসে উত্তরের পথ ধরে যেতে হবে। তবে সেই বিয়েবাড়ি। রাত তখন দুটো বেজে গেছে। মধ্যরাত্রি। যুদ্ধে পরাজিত, বিপর্যস্ত, ছত্রভঙ্গ সৈন্যবাহিনীর মত কোনোমতে ফিরছি। দূরে অন্ধকারে ঘন বটগাছ, জঙ্গলটা দেখা যায়। গাড়ির ভিতর একটা মোমবাতির মত আলো জ্বলছে।

এবার শুরু হয় আসল বিপর্যয়। পথের ধারে জঙ্গলে কে দৌড়ে সোঁদলো, তারপরেই সংস্কৃত স্যার বলে ওঠে—উদরে তীব্র বেদনা, উঃ! তিনিও দৌড়লেন এদিকের বনে। অন্ধকার চারিদিক। দেখি এতগুলো বরযাত্রীদের অনেকেই এদিক-ওদিক দৌড়চ্ছে।

হোঁৎকা বলে—জলের বোতল। পরক্ষণেই গর্জে ওঠে—বোতলটা দেহি। ছোঁ মেরে জলের বোতল নিয়ে দৌড়লো সেও, পিছু পিছু গোবরাও।

বটতলার জঙ্গলে আমরা ক’জন দাঁড়িয়ে আছি। বাকি যে যেদিকে পেরেছে দৌড়েছে। অনুকূল কবরেজও দৌড়েছে। অন্ধকারে বসে পড়ে।

ঘন জঙ্গল। গাছের উপরে ছোট ছেলের আর্তনাদ, শন শন হাওয়া বয়। ঠান্ডাটাও বোধ হচ্ছে। কোথায় যেন হাসছে কারা ।

কবরেজ প্রকৃতির ডাকে চোখে অন্ধকার দেখে বসে পড়েছে। হঠাৎ নাকিস্বরে কে বলে— কবরেজ, জলের বোতলটা রেঁখে যাঁও। কবরেজ—

কার ঠান্ডা হাতের ছোঁয়া। কবরেজ ভাবে, বুঝি বটগাছের ভূত-প্রেতরাই ধরেছে তাকে। আর্তনাদ করে ওঠে কবরেজ—ভূ-ভূ-ভূত! মেরে ফেললো রে—

ছুটে যাই আমরা। কবরেজ তো ধরাশায়ী আর বদন বলে—ওঁ কঁবরেজ মশাই—আঁমি ।

মারের চোটে বদনের নাক বিগড়ে এখন নাকি স্বর বের হচ্ছে। সেও প্রকৃতির তাগিদে ঝোপে বসে পড়েছিল। এবার জলের দরকার হতে কবরেজের বোতলটা চাইতেই এই বিভ্রাট। চোখেমুখে জল দিতে কবরেজকে সুস্থ করে তুলতে, উঠেই সে আবার দৌড়াদৌড়ি করছে। এবার কবরেজ চিঁ চিঁ করে বলে–লৌহজারকচূর্ণ মনে করে উৎকৃষ্ট জোলাপের শিশিটাই এনেছিলাম বোধহয়। ওরে বাবা-

আবার দৌড়লো কবরেজ ঝোপের দিকে। একা কবরেজই নয়, লৌহজারক চূর্ণ যারাই খেয়েছিল তাদের অবস্থা তখন কাহিল।

এমন সময় হৈ হৈ করে ওদিকের গ্রাম থেকে আলো, লাঠিসোটা নিয়ে এসে পড়ে মাথাভাঙার কুমড়োমামার বেহাইয়ের লোকজন। বরযাত্রীদের গাড়ি পৌঁছায়নি দেখে তারা এইবার খোঁজ নিতে এসে দেখে বরযাত্রীদের ওই অবস্থা। ঘন ঘন ঝোপের দিকে দৌড়চ্ছে তো দৌড়চ্ছেই। আর নতুন করে বরযাত্রী যাবার তাগদ তাদের নেই।

কেশব ডাক্তার কিছু জরুরি ওষুধ সঙ্গে নিয়ে গেছল, তাই দিচ্ছে সকলকে। হোঁৎকাও খায়। অনুকূল কবরেজও বলে—তাই দে কেশব। জয়পালের মাত্রাটা জোলাপে বেশি হয়ে গেছে-উঃ। আবার দৌড়ায় সে।

সংস্কৃত স্যার কিছুটা সামলে বলে—আর বরযাত্রী যাইতে পারিব না। মাপ করিতে আজ্ঞা হয়। সংস্কৃত স্যার একটা সিটে এলিয়ে পড়েছে। প্রায় সকলের ওই অবস্থা। বদনের তো পেটে-নাকে দুদিকেই যন্ত্রণা ।

ভোর হয়ে আসছে। পাখিদের ঘুম ভাঙে। সারা মাঠ আলোয় ভরে ওঠে। কন্যাপক্ষ নিয়ে যাবেই। বরযাত্রী বলে কথা! ড্রাইভার বলে-হকো অন্নপ্রাশনের ট্রিপ লে যানে হোগা বারো বাজে। অব যায়েগা হম্ কলকাতা। যানা হ্যায় তো চলো–নেহি তো হম গাড্ডি লেকে ভাগেগা ।

বিয়ের আসরে আর যাওয়াই হল না। ভূতুড়ে বটতলা থেকেই ফিরে এলাম। কারো আর সাড়াশব্দ নেই।

সংস্কৃত স্যার বলে—বরযাত্রী কদাপি যাওয়া উচিত নয়। যাহারা বাপের কুপুত্র তাহারাই যায় বরযাত্রী। সুপুত্রেরা ওই কর্ম কদাপিও করে না ।

তবু অনুকূল কবরেজ বলে – কি কেশব, ওষুধ আমি খাঁটিই তৈরি করি দেখলি তো? নেহাত অদল-বদল হয়ে গেছল, তাই। এ তোর ঘুমন্ত হনিমুন হোমিওপ্যাথি নয়, জীবন্ত ওষুধ । বুঝলি। তাই এই হাল !

অবশ্য গোবরার কুমড়োমামা বৌভাতে এই খামতিটা পুষিয়ে দিয়েছিল। দারুণ খাইয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *