ফেরা (Fera) : 02
কল্যাণী এয়ারপোর্টটি দেখে আর অবাক হয়। নতুন এয়ারপোর্ট, কী বড় আর ঝকঝকে! দমদম কি এর ধারে কাছে দাঁড়াতে পারবে? ঢাকার তেজগাঁ এয়ারপোর্ট থেকে প্লেনে চড়ে কল্যাণী একবার চট্টগ্রাম গিয়েছিল মাসতুতো বোনের বিয়েতে, তখন ওই এয়ারপোর্টকেই তার বিশাল মনে হয়েছিল। ছোটবেলার চোখ, তা হয়ত মনে হবেই, যে মাঠকে একসময় জগতের সবচেয়ে বড় মাঠ মনে হয়, পরে সেটিই দেখতে একরত্তি লাগে। ইমিগ্রেশন আর কাস্টমস পার হয়ে কল্যাণী যখন বাইরে এসে দাঁড়ায়, তার বিশ্বাসই হয় না তার তিরিশ বছরের স্বপ্ন আজ সত্যি সত্যিই সফল হল। কল্যাণী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, যেন তিরিশ বছর সে কোনও অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে ঘরে দম আটকে পড়ে ছিল। দীপনকে বলে—’বুক ভরে শ্বাস নাও তো বাবা, এত ফ্রেশ এয়ার কলকাতায় পাবে না।’
তিলজলার বাড়িতে কোনও গাছপালা ছিল না। একটু সবুজের ছোঁয়া পেতে তাকে যেতে হত গোবরা ঝিলের কাছে, শশিকান্তর বাড়িতে যেমন বিশাল বিশাল বৃক্ষ ছিল, ঠিক তেমন বৃক্ষে ছাওয়া ছিল এলাকাটি। হঠাৎ হঠাৎ তার চোখে পড়ত টুপি পাঞ্জাবি পরা লোকেরা খাটিয়া কাঁধে নিয়ে লোবানের ঘ্রাণ ছড়িয়ে ছড়িয়ে কাছের গোরস্থানে যায়। দেখে তার মনে পড়ে, শরিফার বাবা মারা গেলে এরকম খাটিয়া এসেছিল নিতে। বুড়ো এক লোক শরিফার বাবার ওপর ঝুঁকে তোতাপাখির মত বলে যাচ্ছিলেন—‘লাইলাহা ইল্লাললাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’, গোবরায় খাটিয়া গেলে মৌমাছির গুঞ্জনের মত লাইলাহা শব্দ হত আর কল্যাণীর চোখের সামনে ভেসে উঠত শরিফার নির্বাক চেয়ে থাকা, খাটিয়া কাঁধে নিয়ে আনিস, বুলবুল, কবিরদের গুলকিবাড়ি গোরস্থানের দিকে হেঁটে যাওয়া, যেন সে বিষণ্ণ মুখে তাদের কালিবাড়ির বাড়ির জাম গাছতলায় দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছে। সে যে কলকাতায়, সে যে গোবরায় একা নিঃসঙ্গ এক মানুষ একথাক সবুজ দেখবে বলে ছুটে এসেছে, তিলজলার স্যাঁতসেঁতে জীবন থেকে পালিয়ে সে যে একটু কেবল হাওয়া চাইত, শীতল একটু হাওয়া—তাকে যে আবার ফিরতে হবে টিমটিমে বাতির বাড়িতে—এ সে ভুলেই বসত। ননীগোপালকে কল্যাণী আগে কখনও দেখেনি, নাম শুনেছিল কেবল। সরলাবালা বলতেন তাঁর ছোটভাই সিভিল সাপ্লাইয়ের কাজ নিয়ে দেশভাগের আগেই কলকাতা চলে গেছে। ওখানে ক’দিন চন্দননগর, ক’দিন মানকুণ্ডু কাটিয়ে বিয়ে-টিয়ে করে সংসারী হয়েছে। তিলজলায় জমি কিনে ঘরও তুলেছে। কল্যাণী যখন তার মায়ের মুখে না-দেখা মামার গল্প শুনত, তার খুব কাছের মনে হত সব কিছু, যেন হাত বাড়ালেই তিলজলা ছাঁওয়া যায়, চাইলেই মামার কোলে কাঁখে চড়া যায়, যেন দেখা হলে মামা তাকে পাহাড় দেখাতে নেবে। বিকেলে কালিবাড়ির ছাদে দাঁড়ালে নদীর ওইপারের আকাশে কালো কালো ছায়া ভাসত। জ্যোতিপ্রকাশ বলত ওই যে দেখা যায় আবছা গারো পাহাড়। ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে ওই পাহাড়ের কাছে একদিন সে যাবেই মনে মনে ভাবত। জ্যোতিপ্রকাশকে বলেছিল, ‘চল নৌকা কইরা ওই পার যাই, দৌড়ে ছুঁইয়া আসি পাহাড়টারে।’ শুনে জ্যোতিপ্রকাশ বলেছে, ‘দূর বোকা, ক-ত দূরে ওই পাহাড়, শম্ভুগঞ্জ তারাকান্দা ফুলপুর তারপর কংশ নদী, কংশ পার হলে হালুয়াঘাট, জয়রামকুরা, তারপর পাহাড়, পাহাড়ের ওই পারে মেঘালয়।’ কল্যাণী অবাক হত অত দূরের পাহাড়কে এত কেন কাছের মনে হয়। তিলজলায় এসে মনে ভাবা কাছের মানুষগুলোকে তার যখন দূরের খুব দূরের বলে বোধ হল জ্যোতিদার কথা কানে বাজত—‘বোকা মেয়ে, দূরের জিনিসকে কী চাইলেই ছোঁওয়া যায়!’
একচিলতে উঠোন ঘিরে টালির ছাদঅলা ঘর ছিল কয়েকটি, দু পশলা বৃষ্টি হলেই এত কাদা হত উঠোনে যে ইট বিছিয়ে হাঁটতে হত। কল্যাণী কাদাকে ‘প্যাক’ বলত বলে শান্তি সুনীতি তো হাসতই, মামিও হাসত। শুনিয়ে শুনিয়ে বলত—‘হাঁস ডাকে প্যাঁক প্যাঁক।’ ওরা উচ্চারণে এত ভুল ধরত যে কল্যাণী কথা বলতেই লজ্জা পেত। ওখানে বেঁচে থাকতে হলে যে ওদের মত চলা-বলা রপ্ত করতে হবে তা সে ঠিকই বুঝেছিল। বাড়িতে, বাড়ির বাইরে তার মুখের ‘আইছিলাম গেছিলাম’ নিয়ে তাকে কম অপদস্থ হতে হয়নি। সে চোরকে চুর বলে, কাটারিকে দাও, বাড়িকে বাসা—অবসরে এসবই ওদের হাসিরসের খোরাক ছিল। কল্যাণী আর পরিমল যে ঘরের মেঝেয় ঘুমোত, সে ঘরে একটি চৌকি পাতা ছিল, ওতে কখনও সৌমিত্র, কখনও তার বুড়ো দিদিমা ঘুমোত। সৌমিত্র দিনে লেকমার্কেটের দোকানে বসত, রাতে নাইট কলেজে ল’ পড়ত। শান্তি সুনীতির মত কল্যাণীকে ঘিরে সে ফড়িং ফড়িং নাচত না। প্যাঁক প্যাঁক বলেও হাসত না। কথাও কম বলত। কল্যাণীকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল—‘তোমাদের দেশের ওরা তো উর্দু বলে তাই না?’
কল্যাণী বলেছিল—পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেরা বলে।
—আর ইস্টের নন-বেঙ্গলিগুলো?
—ইস্টে আবার নন-বেঙ্গলি কোত্থেকে আসল?
—আই মিন মুসলমানরা?
—ওরা উর্দু কইব কেন? ওরা তো বাঙালি!
—বাঙালি? সৌমিত্র যেন অসম্ভব একটি সংবাদ শুনেছে এমন মুখ করে তাকিয়েছিল।
দেখতে ভালমানুষ এই ছেলেই, একরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে কল্যাণী দেখে, তার শরীরে হাত বুলোচ্ছে; সে ছিটকে সরে আসতে গেলে সৌমিত্র তাকে শক্ত হাতে চেপে ধরে, পেটিকোটের ফিতে ধরে টান দেয়, আতঙ্কে কল্যাণীর গলায় স্বর বেরোয় না। সে দুহাতে যতটুকু কুলোয় সৌমিত্রকে গা থেকে ঠেলে সরিয়ে পরিমলের দিকে গড়িয়ে গিয়েছিল, দ্রুত শ্বাস পড়ছিল তার। যে ঝিঁঝিঁ ডাকা রাতে নিজের মামাতো ভাই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেই রাত পার হয়ে যখন সকাল হয়, কাক ডাকে, সূর্য ওঠে, সকলে কাজে বেরোয়, তখন ডাকপিয়ন সরলাবালার চিঠি দিয়ে যায়। চিঠিতে লেখা— ‘মা কল্যাণী, আশা করি কুশলেই আছ। মামার বাড়িকে আপন বাড়ি মনে করিয়াই থাকিবে। যাহা খাইতে ইচ্ছা করে খাইবে। লজ্জা করিও না। তোমার বাবা নিয়মিত ননীগোপালের কাছে লোক মারফত টাকা পাঠাইতেছেন, তোমাদের যাহাতে ভবিষ্যতে কোনও অসুবিধা না হয় তিনি তাহারই চেষ্টা করিতেছেন। নিরাপত্তার জন্যই তোমাদের কলকাতায় পাঠাইয়াছি, বিশেষ করিয়া তোমার। মেয়ে বড় হইলে বাপ-মা’র যে কী দুশ্চিন্তা হয়, তুমি যখন মা হইবে বুঝিবে। মন দিয়া পড়াশুনা করিও। তুমি নিরাপদে আছ ইহা ভাবিয়া আমরা শান্তি পাই। ননীকে চিঠি লিখিতে বলিও। পরিমলকে দেখিয়া রাখিও। অনেকদিন তোমার চিঠি পাই না, চিঠি দিও। মন খারাপ হইলে শান্তি সুনীতির সাথে বেড়াইতে বাহির হইও। জ্যোতির কোনও খবর পাইলে জানাইও।
তোমার বাবার প্রেসার বাড়িয়াছে। ডায়বেটিস ধরা পড়িয়াছে। বাড়ি বিক্রির কাজ আপাতত বাদ দেওয়া হইয়াছে। তোমার বাবা সুস্থ হইলে আমরা চলিয়া আসিব। আমাদের জন্য চিন্তা করিও না।
ইতি তোমার মা।’
চিঠিটি মাত্র একবার পড়েই ছিঁড়ে ফেলেছিল কল্যাণী। ‘নিরাপত্তা’ শব্দটি তাকে ভোগায় বেশ, জন্মের মাটি ছেড়ে, নিজের ঘরবাড়ি চৌদ্দ পুরুষের ভিটে ফেলে এক অচেনা অদ্ভুত দেশের উদ্বাস্তু হয়ে কী নিরাপত্তা সে পেয়েছে—আজ যদি এই প্রশ্ন সে করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হরিনারায়ণ রায় এবং তাঁর স্ত্রী সরলাবালা দেবীকে? কি জবাব তাঁরা দেবেন যদি সে জানিয়ে দেয় তিলজলায় তিল তিল করে তাকে বোবা কালা বধির করে দেবার গল্প? যে কল্যাণী রুই কাতল ইলিশ ছাড়া খেতে বসে নাক সিঁটকাতো, সে এখন মুখ বুজে এক চিমটি কুচো চিংড়ি দিয়ে ভাত মাখায়। কী নিরাপত্তা তবে পেয়েছে কল্যাণী, যদি বিধর্মী মুসলমান যুবকদের ধর্ষণ থেকে বাঁচবার জন্য ভিন শহরের এঁদো গলিতে এসে তাকে স্বজন দ্বারাই ধর্ষিতা হতে হয়!
দেশ থেকে আসা চিঠিপত্রও কল্যাণীর হাতে সব আসত না। হরিনারায়ণ এক চিঠিতে লিখলেন ‘পাঁচটি চিঠি লিখিয়াও তোমার কোনও উত্তর পাই নাই।’ পাঁচটির মধ্যে হয়ত সে একটি পেয়েছে। একদিন সৌমিত্রর সার্ট ধুতে গিয়ে দেখে বুকপকেটে বাদলের একটি চিঠি! একটি চিঠির অপেক্ষায় সে কত দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী কাটিয়েছে। বাদল তাকে আজও মনে রেখেছে, আজও সে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে একা বসে থাকে, চোখের সামনে ডিঙি নৌকো দুলতে দুলতে যায়, আর সে তার স্মৃতিগুলো চোখের জলে ধুয়ে বুকের কৌটোয় তুলে রাখে। কলঘরে দাঁড়িয়ে চিঠি পড়তে পড়তে কল্যাণীর বুক ভেঙে কান্না নামে, কান্নার শব্দ বাড়িতে যদি কোনও অঘটন ঘটায় সে কল ছেড়ে দেয় যেন জলের শব্দের তলে সেটি হারিয়ে যায়। তিলজলার জীবনকে নিয়তি মেনে সে তার পালিয়ে আসবার ইচ্ছেকে ধীরে ধীরে লালচক্ষু কসাইয়ের মত কাটে। কল্যাণী পালিয়ে আসতে পারত না বলেই কি আসেনি নাকি চরম অনিশ্চয়তার কাছে তার হাসি-আনন্দ, সুখ-স্বপ্ন সব বিকিয়ে দিয়েও সে বাবা-মাকে ‘নিশ্চিন্তি’ দিয়েছে!
বিচ্ছেদের অভিমান তাকে এত বেশি ছেয়ে ফেলেছিল যে হরিনারায়ণ, সরলাবালা, শরিফা, মুন্নি, অনিলকাকা, বাদল—কারও চিঠির উত্তর সে দেয় না। বড়জোর ভাল আছি ধরনের দায়সারা চিঠি লিখে গা বাঁচায়। হ্যাঁ গা-ই বাঁচায় বৈকি। যে গা বাঁচাবার জন্য তাকে প্রিয় শহর, প্রিয় নদীর কোল থেকে ছুঁড়ে ফেলা হল—সেই গা-ই তো তার বাঁচানো উচিত।
রাতে রাতে একটি নীল নেকড়ে তাকে তাড়িয়ে ফিরত। পায়ে কুটো পড়লেও চমকে উঠত সে। লজ্জায় বেদনায় আশঙ্কায় সঙ্কোচে সে এত কুঁকড়ে থাকত যে মনে হত এই পাপ তারই, জন্মের পাপে তার উড়োখুড়ো এই জীবন। জোনাকির পেছনে যে মেয়ে দৌড়োয়, সেই মেয়েকেই রাত হলে ঝোপঝাড়ে লুকোতে হয়েছে। সে এত সেঁধিয়ে থাকত নিজের ভেতর, কারও চোখের দিকে চোখ তুলত না। অনির্বাণ সেই ক্ষুদ্র, সীমাবদ্ধ, একলা জীবন থেকে তাকে হঠাৎই উদ্ধার করে। উল্টোডাঙায় পিসির বাড়িতে দেখা, ঠিক পিসির বাড়ি নয়, পিসি উঠেছিল তার ননদের বাড়ি, সেই ননদের বাড়িতে; ননদের ছেলে নিমাই, তারই বন্ধু অনির্বাণ, শ্যামলা গায়ের রঙ, চোখে হাই পাওয়ার চশমা, ছ’ফুটের কাছাকাছি লম্বা, ঘন ঘন সিগারেট ফোঁকে—কল্যাণীর মুখের দিকে পলকহীন তাকিয়েছিল, কী নাম, কোন কলেজে পড়া হয়, কোথায় থাকা হয় জিজ্ঞেস করবার পর বলল—‘আপনি খুব লাজুক নয়ত কথা কম বলেন।’ কল্যাণী বলেছিল—‘কেন বলুন তো!’ অনির্বাণ হেসে বলেছিল—‘এই দেখুন আপনি কিন্তু এখনও আমার নাম রাঘব বোয়াল কি না, আমি ঘোড়ার ঘাস কাটার কাজ করি কি না কিছুই জানতে চাননি।’ পরে নিজে থেকেই অনির্বাণ বলেছে—‘অধমের নাম অনির্বাণ দাশ, গড়িয়াহাটের ব্যাঙ্কে কাজ করি।’ এর দিন সাতেক পর কল্যাণী বাসস্টপে একা বসে বাসের অপেক্ষা করছিল, আর তখনই রোদে ভিজে অনির্বাণ আসে, কল্যাণীকে দেখে ওর চোখে আনন্দ উপচে পড়ছিল, পিসির বাড়িতে আর যাওয়া হয় কি না, নিমাই কেমন আছে এসব সৌজন্য দ্রুত সেরে বলল—‘সেদিন বাড়ি ফিরে আপনার কথা খুব মনে পড়েছে।’ কল্যাণী বলল—‘আমি তো কথাই তেমন বলিনি!’ অনির্বাণ হেসে বলল—‘আপনার না-বলা কথাগুলো।’ এরপর প্রায়ই দুজনের দেখা হয় ট্রামে বাসে রাস্তায়, কল্যাণী তখন বাঙাল-জিভের জড়তা অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে, দিবামকে দোবো, নিবামকে নোবো, করেন বলেন চলেনকে করুন বলুন চলুন, নাস্তাকে জলখাবার, দাওয়াতকে নেমন্তন্ন দিব্যি তার রপ্ত হয়ে গেছে। দেখা হলে অনির্বাণের সঙ্গে সে অনর্গল কথা বলে। অনির্বাণ প্রায়ই ভুলে যেত যে কল্যাণী পশ্চিমের মেয়ে নয়। একদিন সে কল্যাণীকে বলে—‘চলুন কোথাও বসা যাক,’ ব’লে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে তাকে নিয়ে যায়, নিরালা দেখে বসে, বলে—‘জীবন খুব ছোট, তাই না কল্যাণী?’
কল্যাণী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল—‘আমার কাছে জীবন খুব দীর্ঘ মনে হয়। যেন কাটছে না। যেন দিন যাচ্ছে না। এই জীবন কোনও রকম ফুরিয়ে গেলে বাঁচি।’
—বল কী, তুমি তো হতাশায় ভুগছ।
কল্যাণী ম্লান হাসে।
অনির্বাণ একদিন বলল—চল সিনেমা দেখি।
কল্যাণী তখনও কলকাতার কোনও ছবিঘরে যায়নি। শান্তি সুনীতিরা মাঝরাত অব্দি সিনেমার গল্প করত, কল্যাণী ওইসব গল্পের কতক বুঝত, কতক বুঝত না। এক রোববারে মৌলালির মোড়ে বাস থেকে নেমে হেঁটে গিয়ে একটি রেস্তোরাঁয় বসল দুজন। অনির্বাণ অর্ডার দিল ব্রেস্ট কাটলেট। কল্যাণী বুঝে পেল না জিনিসটি কী। খেতে গিয়ে সে একটু দ্বিধায় পড়েছিল। অনির্বাণ হেসে বলল—‘এই কাটলেট ভাজলে বাদামি হয়, বুঝলে! ব্রেইজড কাটলেট।’ নিজের কাটলেট থেকে একটুকরো কল্যাণীর মুখে তুলে দিয়ে সে বলল—‘ভালবাসাকে শেষ অব্দি রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পেতে হল, কী বল?’
—রাস্তা থেকে? নাকি নিমাইদের বাড়ি থেকে?
—ও এক কথাই।
—ছুঁড়ে ফেলে দিলেই হয়।
—ওইসব ছোঁড়াছুঁড়িতে আমি নেই। যা পেয়েছি সেইটুকুতেই খুশি আমার মন।
কল্যাণীর বড় ভাল লেগেছিল দেখতে উদাস উদাস ভেতরে গোছানো মানুষটিকে। সেদিন ‘প্রাচী’তে দুজন ঘন হয়ে বসে ছবি দেখল আর হল খানিকটা আঁধার হলেই অনির্বাণ যখন হাত রাখছিল তার সরু সরু আঙুলগুলোয়, তার তখন এমনও মনে হয়েছে স্বপ্নকে দূরের করে রাখলে আবছা হয়ে যায়, না হয় নাগালের মধ্যে কিছু সুখ আসুকই মাঝে মধ্যে।
অনিবার্ণকে ভুলে থাকবার উপায় ছিল না। একদিন বলল—‘আজ ব্যাঙ্ক হলিডে, চল গড়িয়া যাই।’ গড়িয়া থেকে জয়নগর মজিলপুরের বাসে চড়ে অনিবার্ণ সারা পথ ভালবাসা হলে মন উড়ু উড়ু করে, কাজে মন বসে না, গোনায় ভুল হয় বারবার—এসব শোনাল। জয়নগরের অপেরা হাউস ঘুরে দেখতে গিয়ে কল্যাণীর খুব মুক্তাগাছার জমিদার জীবন কৃষ্ণ আচার্যের নাটমন্দিরের কথা মনে পড়ছিল। জ্যোতিপ্রকাশ বলত—এই যে দেখছিস ঘোরানো স্টেজ, এখানে আগে নাচ হত, নাটক হত; জমিদাররা পায়ের ওপর পা তুলে বসে নাটক দেখতেন।
হঠাৎ একদিন, কল্যাণী নিজেও জানে না কেন, দেখতে সে ফর্সা বলেই কি না, তার শরীরের গড়ন আঁকবাঁক চমৎকার বলেই কি না, অথবা সে সোজা-সাপটা কথা বলে, মনে কোনও প্যাঁচ-গোচ নেই বলেই কি না অনির্বাণ তাকে একদিন বলা নেই কওয়া নেই বলে বসে—‘চল কোর্টে যাই, বিয়ে করি।’
বিয়ে শব্দটি শুনে ধুলোর ঝড় যেমন বয়—ডাল-পাতা মুচড়ে নিয়ে যায়, তেমন তছনছ ঝড় বইছিল তার ভেতরে কোথায় যেন। ভেতরে কোথায় যেন একটি পাথর এসে থেমেছিল, ঝড়ে উড়ে বাদল নামের একটি নিঃসঙ্গ পাথর।
অনির্বাণ তাড়া দিত—ওদিকে কিন্তু নবদ্বীপের মেয়ে দেখা প্রায় সারা, বাড়িতে তোমার কথা তুলেছিলাম সামান্য, বৌদি বলেছে রিফিউজি-টিফিউজি চলবে না। অগত্যা গান্ধর্ব মতে চল দেখি কিছু করা যায় কি না। দেরি করলে শেষ অব্দি নবদ্বীপেই সাতপাক ঘুরতে হয় কি না কে জানে!
সে কারণেই যে কল্যাণী দেরি করেনি তা নয়। তিলজলার অন্ধকার ঘরে গাদাগাদি শুয়ে সারারাত ঢিপঢিপ করে বুক বাজবে, কেউ একটু পাশ ফিরলেই চমকে তাকাবে, পায়ের কাছে বেড়াল এসে বসলেও ধড়ফড় করে উঠে বসবে, ভোর না হওয়াতক শ্বাস বন্ধ করে পড়ে থাকবে—এমন আর কতদিন! কল্যাণী তাই আপত্তি করেনি। বিকেলে সে পার্ক সার্কাসে দুটো টিউশনি করত, টিউশনির টাকা উঠিয়ে গড়িয়াহাট থেকে দুটো শাড়ি কেনে। নতুন শাড়ি পরে বাড়ি থেকে বেরোবার সময় পরিমলকে বলে—‘জ্যোতিদার কাছে পারলে চলে যাস।’ জ্যোতিপ্রকাশ বর্ধমানে কাপড়ের ব্যবসা করে, পিসি একদিন বলেছিল। গায়ে গায়ে লেগে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে এ শহর যে কত বেশি দূরত্ব তৈরি করেছে—তা কল্যাণী তার সমস্ত একাকীত্ব দিয়ে টের পায়। ময়মনসিংহের বাড়িতে জ্যোতিপ্রকাশ, পরিমল আর সে তাসের ম্যাজিক নিয়ে হো হো করে হাসত, আড্ডায় পড়ে দুপুরের খাওয়ার কথা ভুলে যেত, পুকুরে বড়শি ফেলে সারা বিকেল তিনজোড়া চোখ পাতাকাঠির দিকে স্থির তাকিয়ে থাকত—এমন মনেই হয় না। যেন জন্ম থেকেই যোজন দূরত্ব নিয়ে তাদের বয়স বেড়েছে।
বিয়ে জিনিসটি যে খুব মূল্যবান কিছু—এ সে মন থেকে মুছেই অনিবার্ণকে বিয়ে করতে গিয়েছিল। হরিনারায়ণ মাঝে মধ্যে বলতেন—‘আমার একটাই মেয়ে, এই মেয়েকে আমি ব্যারিস্টারি পড়াইবাম, মেয়ের বিয়া এমন ঘটা করে দিয়াম যে পুরা শহরের লোক কইব শহরে একটি বিয়া হইতাছে বটে, জামাইকে আমি ঘরজামাই রাখবাম।’ কেবল বেঁচে থাকবার জন্য যে নোংরা তাকে ঘাঁটতে হয়েছে, যে আপস সে করেছে নির্মম নিষ্ঠুর মানুষের সঙ্গে, তার মত আদরে আহ্লাদে বড় হওয়া মেয়ের পক্ষে এ কী করে সম্ভব হল—কল্যাণী অবাকই হয়। কল্যাণী এখন জানে জীবন কী জিনিস। ব্রহ্মপুত্রের হাওয়ায় ভাসা জীবন নয় এটি। এখানে একটি আস্ত মানুষের চেয়ে ঘসা একটি সিকির দাম বেশি। দেশ থেকে যেদিন টেলিগ্রম এল হরিনারায়ণ গত হয়েছেন, কল্যাণী সেদিনই বুঝেছিল এ বাড়ির পাট তাকে শিগরি চুকোতে হবে। ততদিনে ব্রেবোর্ন থেকে তার বি. এ. পাশ হয়েছে, ব্যারিস্টারি হয়নি। আর স্বয়ং হরিবাবুই যখন ইহজগতে নেই তখন ‘ঘটা’র বিয়ের আশা বাদ দিয়ে চেনা-শোনা কেউ নেই এমন ঘরে কোর্টের উকিলের সামনে অনির্বাণকে স্বামী স্বীকার করে রেজিস্ট্রি খাতায় সই করেছে।
বিয়ে হয়ে গেল। জীবন যেভাবে গড়ায়, সেভাবে গড়াল। বড়মামা, মামি, পিসি, পিসেমশাই, নীলোৎপল কাকাকে একদিন অবসরমত প্রণাম করেও আসা হল। মামি বললেন—‘কেমন ফাঁকি দিয়ে চলে গেলি। তোর বড় বোনগুলোরই বিয়ে বাকি রয়ে গেল। একটু ভাবলি ওদের কথা!’ কল্যাণ নিঃশব্দে হেসেছে। সে কী শান্তি সুনীতিকে ফাঁকি দিয়েছে, নাকি নিজেকেই দিয়েছে ফাঁকি, নিজের পুষে রাখা স্বপ্নকে সে কায়দা করে ঠকিয়েছে! কী লাভ হয়েছে তার এতে! বাদলের সঙ্গে রিক্সায়, নৌকোয়, ঘাসে বসে যখন গল্প করত, লজ্জায় আনন্দে মুখ তার রঙিন হয়ে উঠত, বুকের মধ্যে রিমঝিম রিমঝিম করে সুখের বৃষ্টি হত। কই অনির্বাণের সঙ্গে গায়ে গা লেগে বসেও ওরকম তো কখনও লাগেনি! কেউ দেখে ফেলবার ভয় ছিল না, যখন তখন বেরিয়ে যেখানে খুশি সেখানে চলে যাওয়া যেত। ঘরের কাজ সারা হলে আর কল্যাণী কোথায় যায় কি করে এ নিয়ে হল্লা করেনি মামি, তা ছাড়া কল্যাণী টিউশনি করে, তার তো যেতেই হবে বাইরে, টিউশনিতে তো তার আপত্তি চলে না। আপত্তি করবেই বা কেন, গুনে গুনে অর্ধেকের বেশি টাকা তো মামির হাতেই দিতে হত। অনির্বাণের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নির্বিঘ্নে কেটে গেছে ঘুরে বেড়িয়ে। বাদলের ব্যাপার অন্যরকম, বাদলের বেলায় বাড়িতে বলতে হত কলেজে প্র্যাকটিক্যাল আছে, নয়ত বান্ধবীর জন্মদিন। সাতদিন আগে থেকে জানা থাকত কবে তারা কোথায় যাবে, দিন ঘনিয়ে আসত আর বুকের ধুকপুকুনি বাড়ত। লুকিয়ে প্রেম করবার আলাদা একটা স্বাদ আছে, কল্যাণীর তাই মনে হয়। নদী-ঘেরা, বৃক্ষ-ঘেরা, পড়শি-ঘেরা, স্বজন-ঘেরা প্রাণবান একটি জীবনকে যদি আচমকা কোনও ঝড়ো হাওয়া নিরুদ্দেশে উড়িয়ে নেয়, তবে তার ভাবনার সংসারে ধুলো আর ঝরাপাতা ছাড়া থাকে কী! কোথায় শরিফা—কোথায় তার গা ছুঁয়ে ফিরে আসবার কথা দিয়ে আসা, কোথায় বাদল—কোথায় তার সঙ্গে জীবন গড়বার স্বপ্ন, ডিঙি নৌকোয় বসে তার থই থই কণ্ঠে গাওয়া ‘কোথায় পাব কলসি কইন্যা কোথায় পাব দড়ি। তুমি হও গহীন গাঙ, আমি ডুইবা মরি’ কলকাতার হাওয়ায় ধুলোর মত উড়ে গেছে। বিয়ের পর টালিগঞ্জের একটি প্রাইমারি স্কুলে চাকরি জোগাড় করে নিয়েছে, চাকরিটি পেতে জুতোর সুকতলা থেকে শুরু করে মাংস মেদ মেধা সব তার খরচা গেছে। সেই স্কুলের কাজে তাকে একবার বনগাঁ যেতে হয়েছিল। বনগাঁয় হাঁটতে হাঁটতে সীমান্তের অনেকটা কাছে যখন চলে আসে, দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থেকে তার হঠাৎ, সে জানে না, বুকের মধ্যে হু হু করে ওঠে। ওইতো আকাশ—একই তো আকাশ—হাত বাড়ালেই ছোঁওয়া যায় এমন—ওই আকাশের তলে তার স্বপ্নরা এখন কেমন আছে—কেমন আছে বাদল শরিফা মুন্নি অনিলকাকা রুখসানা—কেমন আছে তার জন্মের শহর-বাড়িঘর-ব্রহ্মপুত্র—এখনও কি তার মত কোনও দুরন্ত উচ্ছল বালিকা মাঠ জুড়ে কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলে, সেই বালিকার চোখে কানামাছির রুমাল বেঁধে তাকে কি এখনও পৃথিবীর নিষ্ঠুর লোকেরা দেশান্তরী করে?
জ্যোতিপ্রকাশ গিয়েছিল হরিনারায়ণের মুখাগ্নি করতে, গিয়ে পায়নি। দেরি হচ্ছে বলে পাড়ার লোকেরাই দায়িত্ব নিয়ে নেয়, তা নেবে না কেন, অসুখ হলে যারা হাসপাতালে নিল, ডাক্তারের পেছন পেছন দৌড়ল, ওষুধপথ্য খাওয়াল, শিয়রের কাছে রাত জেগে বসে রইল, লাশ ঘরে রেখে তারা পচতেই বা দেবে কেন—‘বলো হরি হরি বোল’ বলে কাঁধে তুলে শ্মশানে নিয়ে গিয়েছে হরিনারায়ণের নিস্পন্দ শরীর। অনিল মুখার্জির ছেলে সৌমেন চিতা জ্বালবার কাজ সেরেছে। সরলাবালাকে কলকাতায় নিয়ে আসবার অনেক চেষ্টা করেও জ্যোতি সফল হয়নি। ‘জীবনের বাকি কয়টা দিন স্বামী শ্বশুরের ভিটায় কাটাইতে দে, আমি আর বাঁচবই বা কয়দিন! আমারে নিয়া টানা হেঁচড়া আর না করলি।’—এসব বলে সরলাবালা কাঁদছিলেন, জ্যোতিপ্রকাশকে অগত্যা একাই ফিরে আসতে হয়েছে। পরে যখন সরলাবালারও খবর এল, জ্যোতিপ্রকাশ যায়নি, বলেছে—‘শ্মশানঘাটে যেতে আমার ভাল লাগে না। জ্যেষ্ঠ ছেলে হবার এই বিপত্তি—মুখে জল দেবার যো নেই, আগুন দিয়ে ফিরতে হয়।’ কল্যাণী যেতে চেয়েছিল, অনির্বাণ বলেছে—‘তুমি যাবে কী, তোমার তো এডভান্সড স্টেজ!’
দেশ থেকে অনিল মুখার্জির চিঠি আসে—‘তোমরা আসিয়া বাড়িটির একটি ব্যবস্থা কর। দরজায় তালা লাগাইয়া দিয়াছি। আমার বয়স হইয়াছে। চোখে ভাল দেখি না। সব দিক সামলাইতে পারিব না। এইভাবে বাড়ি ফেলিয়া রাখা ঠিক না। বাড়িটি বিক্রি না করিলে পরে বেদখল হইবার আশঙ্কা আছে। ভগবান তোমাদের মঙ্গল করুন।’
কল্যাণী জ্যোতিপ্রকাশকে বাড়ি বিক্রির কথা জানালে সে বর্ধমান থেকে চিঠি লিখে জানায়—নিজের হাতে ওই বাড়ি আমি বিক্রি করতে পারব না। এতটা পাষণ্ড আমি এখনও হইনি। আমার অত টাকার দরকার নেই যে স্মৃতিগুলো সের দরে কারও কাছে বেচে আসব। তার চেয়ে পড়ে আছে থাক, মনে মনে জানব যে আছে, ওখানে আমাদের কিছু হলেও আছে।
পরিমলকে বলাতে বলল—ওখানে শুনছি শত্রু সম্পত্তি আইন করেছে। দেশ ছাড়লে সরকার জায়গা-জমি নিয়ে নিচ্ছে। কী দরকার ঝামেলায় গিয়ে, ও বাড়ি এনিমি প্রপার্টির ভয়ে কেউ কিনবে না এখন।
—হ্যাঁরে পরিমল, আমাদের প্রপার্টি বুঝি এনিমি প্রপার্টি! আমরা দেশের শত্রু ছিলাম?
পরিমল আর কথা বাড়ায় না। চলে যায়। তার ব্যস্ততাও বেড়েছে। একটি অ্যাড ফার্মে কপি লিখবার কাজ করে। পরিমল খুব প্রয়োজন ছাড়া কল্যাণীর বাড়িতে আসত না। থাকত নাকতলায়। জ্যোতিপ্রকাশের কাছে যায়নি যে তা নয়, গিয়ে দেখেছে ঠিকানা দশ ফুট বাই দশ ফুট, অর্ধেক রাত অব্দি পাড়ার লোক নিয়ে সে ঘরে বসে জুয়ো খেলে। জ্যোতিপ্রকাশ রাখঢাক না করে পরিমলকে বলে দিয়েছে—‘এ বাড়িতে থাকলে তুই মানুষ হবি না, তা ছাড়া আমার নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। তার চেয়ে বরং কল্যাণীর কাছে যা।’ কল্যাণী একদিন অনির্বাণকে বলেছিল—‘আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে কী যে মিল ছিল! পূর্ণিমায় আমরা সারারাত ছাদে বসে গান গাইতাম। লোকে বলত দুই পাতা এক কুঁড়ি। এখন তো বছরেও একবার দেখা হয় না। পরিমলটা কী খায় কোথায় থাকে, শুকিয়ে দড়ি দড়ি হয়ে গেছে। আমাদের এখানে তো এসে থাকতে পারে, কী বল?’
অনির্বাণের মুখের দিকে বড় আশা নিয়ে তাকিয়েছিল কল্যাণী। অনির্বাণ তাকে সরাসরি বলেনি পরিমলকে এ বাড়িতে এনো না। বলেছে—‘তিলজলায় থেকে তো দেখেছই জীবন কী টাফ। এভরিওয়ান শুড স্ট্রাগল ফর এক্সিসটেন্স। কলকাতায় কত লোক ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করে তা জানো?’
কল্যাণী এর সরল উত্তরটি বুঝে নিয়েছে।
দশটা-পাঁচটা চাকরি করে, সংসার সামলে, বাচ্চা জন্ম দিয়ে—লালন করে, স্বামীর আদেশ-আবদার সয়ে, ছোটখাট সুখ দুঃখে অনেকগুলো বছর কল্যাণী পার করে দিয়েছে। জয়িষার জন্মের আগে তিনবার স্পনটেনিয়াস এবরশন হয়েছে তার, অনির্বাণ তখন এমন মুখ করে থাকত যেন দোষ কল্যাণীরই, গত জনমে সে কোনও পাপ করেছিল, গত জনম বলতে কল্যাণীর ময়মনসিংহের জীবনই হয়ত বোঝায়। এরপর জয়িষা হলেও অনির্বাণের মন অত ভরেনি, দীপন হলে যত ভরেছে। জয়িষার পর দীপন হতে সময় লেগেছে বারো বছর। এই বারো বছর কম মেজাজ করেনি অনিবার্ণ। কিন্তু ছেলে পেটে না এলে কী-ই বা করবার ছিল কল্যাণীর! ডাক্তার পরীক্ষা করে বলেছেনও যে বাচ্চা না হবার কোনও কারণ নেই, ধৈর্য ধরুন, হবে। তবু তর সইত না অনির্বাণের। মাস মাস জিজ্ঞেস করত—কী এবারও কি লাল পতাকা উড়িয়েছ?
কল্যাণীর লজ্জা হত শুনে। যেন ছেলে না হবার সব দোষ কল্যাণীর, ছেলে না জন্ম দিলে সংসারে যে মেয়েমানুষের কোনও মূল্য নেই তা সে ভাল বুঝতে পেরেছিল। জয়িষা তরতর করে বাড়ছিল। ওর লেখাপড়া, নিজের চাকরি এসব নিয়ে কল্যাণী ব্যস্ত থাকত তবু অনির্বাণের দীর্ঘশ্বাস তাকে রাতে রাতে ঘুমোতে দিত না। জয়িষাও বুঝত তাকে দিয়ে মন তেমন ভরছে না বাবার। একটি ছেলের আশায় অনির্বাণের মত আধুনিক ছেলে তারাপীঠ পর্যন্ত দৌড়েছে। শ্বশুরবাড়ির লোক এসে চুক চুক দুঃখ করে যেত, বলত—‘বউ-এর কোনও শক্ত অসুখ আছে কি না কে জানে!’ কল্যাণী এসব কথায় ফিরে না তাকালে কি হবে অনিবার্ণ কিন্তু ছাড়ত না। বংশের বাতি জ্বালবে কে, জয়িষাকে বিয়ে দিলেই পর হয়ে যাবে, আপন তবে কে থাকল—এসব নিয়ে মাঝরাত অব্দি অনির্বাণ আর দশটা সাধারণ মানুষের মত হা-পিত্যেস করত। দেখে কল্যাণী কতবার বলেছে—আমি কি এখন ছেলে বানাবো?
—না, তা বানাবে কেন? মা’র বয়স হয়ে গেছে। নাতির মুখ যদি দেখে যেতে পারেন তাই ভাবছি।
—জয়িষার মুখ তো দেখেছেনই তোমার মা, তাতে হবে না?
—ও তো নাতনি। নাতির মুখের কথা বলছি। মায়েরা নাতির মুখ দেখতে চান সে তো জানই।
কল্যাণীর তখন মনে পড়ত সরলাবালা নিজের মেয়ের বিয়ে, নাতি-নাতনি কিছুই তো দেখে গেলেন না। সেই যে মেয়ে পার করলেন বাষট্টিতে। চার বছর পর নিজে মরলেন। তাঁর কি নাতি দেখবার কোনও বাসনা ছিল না মনে? মেয়ে তাঁর পড়ালেখা করবে, জজ ব্যারিস্টার হবে, কালো কোট পরে বাবার মত কোর্টে যাবে, এরকম স্বপ্ন হরিনারায়ণের মত সরলাবালাও দেখতেন। এসব স্বপ্নের চাপে নাতির মুখ দেখবার ইচ্ছে তাঁর কতটুকু টিকে ছিল কে জানে। দীপন জন্মাবার পর ঝাড়গ্রামে যত কাছের দূরের আত্মীয় ছিল অনির্বাণের, ভেঙে পড়েছে কলকাতার বাড়িতে। যেন বাঁজা একটি মেয়েমানুষের বাচ্চা হয়েছে, একে না দেখলে চলে না। ছেলের হাত পা ঠিক ঠিক আছে কি না, জোড়া শক্ত কি না, বুকের শ্বাস সময়মত পড়ছে কি না এসব পরখ করে যেত আত্মীয়রা। অনির্বাণের সঙ্গে দীর্ঘ সংসার জীবনে বড় কোনও খিটিমিটি বাঁধেনি কল্যাণীর, আপসের একটি অভ্যেস সে কলকাতার ভাষার মত রপ্ত করেছিল বলেই হয়ত। তিলজলা থেকে বেরিয়ে সুস্থ একটি জীবন সে যাপন করছে—নিজেকে সে এমন বোঝাতে চেয়েছে অনেক। সে খুব নিমগ্ন হতে চাইত বিষয়-আশয়ে কিন্তু তার মন ঘুরত দূরে দূরে। সংসারে একটি ছেলে জন্ম দেওয়ায় কল্যাণীর মান কিছু বেড়েছিল, আদর করে তাকে চুড়ি মালা দিয়ে যেত অনেকেই, এমনও বলত তোমার নারীজন্ম সার্থক হয়েছে গো। এসব সে শুনত, কিন্তু মনে যেন ঠিক স্পর্শ করত না কিছু। জীবন তো তার আর হঠাৎ আকাশ থেকে পড়েনি যে সে যে কোনও কিছুতে আহ্লাদিত হয়ে উঠবে! উদ্বাস্তুর জীবন ঘরদুয়োর পেল, বাঁধা একটি চাকরিও জুটল, সব পেয়েও তবু তার মনে হত কী যেন কী পাওয়া হয়নি। কল্যাণী মনে যেন শুনত পেছন থেকে তাকে কেউ ডাকছে। সে নিজেও এলোপাতাড়ি খুঁজে বেড়াত কী বা কে তাকে এত ডাকে। পেছনে কিসের ডাক তার গুছিয়ে তোলা জীবনকেও হঠাৎ হঠাৎ এলো করে দেয়। প্রায় সবটুকু জীবন কাটিয়ে এসে কল্যাণীর এই বোধ জন্ম নেয় জীবন আসলে বৃক্ষের মত, বৃক্ষ যেমন এক মাটি থেকে উঠে নতুন মাটিতে ডালপালা-পত্র-পুষ্প মেলে আগের মত বাঁচে না, জীবনও তেমনি, কেটে যায় হয়ত, কিন্তু বড় এক ফাঁকি থেকে যায়।
গড়িয়াহাট, কাঁকুড়গাছি, টালিগঞ্জ ঘুরে ঘুরে শখের জীবন এসে থেমেছে সল্টলেকে। ঝাড়গ্রামের দুটো ধানি জমি বিক্রির টাকার সঙ্গে আরও কিছু টাকা যোগ করে সল্টলেকে আড়াই কাঠা জমি কিনেছে অনির্বাণ। সেই জমিতে প্রথম যেদিন কোদালের কোপ পড়ে, কল্যাণী বলেছিল—গেটের দুপাশে মাধবীলতা লাগাতে হবে।
এ আর এমন কী, মাধবীলতা দুর্লভ কিছু নয়। ক্যাকটাস হত, খুঁজে পেতে সময় লাগত। অনির্বাণ বলেছিল—ঠিক আছে, দেখি।
এর দিন দুই পর অনির্বাণ একদিন মাঝরাতে জল খেতে উঠে দেখে কল্যাণী জেগে আছে, কি ব্যাপার ঘুমোওনি বলতেই সে বলল—তুমি বুঝবে না অনির্বাণ, কালো গেটের ওপর সবুজ পাতা ছাওয়া লাল মাধবীলতা কী অপূর্ব লাগে!
—এত রাতে তুমি মাধবীলতার কথা ভাবছ!
আহ্লাদি বউ স্বামীর কাছে যে সুরে শাড়ি-গয়না চায় কল্যাণী সেই সুরে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল—বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে নারকেল সুপুরির গাছ পুঁততে হবে কিন্তু। মনে মনে বলল—আর জানালার পাশে একটি কামিনী গাছ। জায়গা থাকলে একটি পুকুরও কাটা যায়। পুকুরের ধারে যদি কাঠগোলাপের একটি গাছ থাকে, জলের ওপর শাদা শাদা ফুল পড়ে ভাসতে থাকবে আর ফাঁকে ফাঁকে লাফিয়ে উঠবে খলসে মাছ।
অনির্বাণ পাশ ফিরে একটু বিরক্ত হয়েই জবাব দিয়েছিল—নারকেলের শেকড় বড্ড ছড়ায়, বাড়ির ফাউন্ডেশনে ক্ষতি করবে।
কল্যাণী অনির্বাণের দিকে ঝুঁকে বলল—কী যে বল ছাই, আমাদের বাড়িতে কি ফাটল ধরেছিল? আম জাম তাল লিচু নারকেল সুপুরি কী ছিল না সেখানে?
বুকের মধ্যে অবচেতনেই যে স্বপ্ন সে লালন করে, সেটি যখন সব দেওয়াল ভেঙে সামনে দাঁড়ায়, কল্যাণী এতই ঘোরে থাকে যে সে বোঝে না সে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, সে বোঝে না কলকাতার স্রোতে ভাসা কচুরিপানার জীবনে মাথা গুঁজবার ঠাঁই পাওয়াই যেখানে ঝক্কির ব্যাপার, সেখানে নারকেল সুপুরির বাগান করা একরকম বিলাসিতাই বটে—এত মাটিই বা কোথায়, আর এত সময়ই বা কার আছে!
পল্যুটেড কলকাতায় কল্যাণী হাওয়া খুঁজে বেড়াত। মুক্ত হাওয়া। কোথাও গাছপালা দেখলে দু দণ্ড থামত। জয়িষা যখন ছোট, ভাড়াবাড়ির একচিলতে বারান্দা পাতাবাহারের টব দিয়ে ভরে ফেলেছিল কল্যাণী। দেখে অনির্বাণ বলেছিল—এই কবুতরের খোপেও হাঁটাচলার জায়গা বন্ধ করে দিলে!
—বাচ্চাটা নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। কলের ধোঁয়া ওর কচি ফুসফুস কালো করে দিচ্ছে।
—আমরা সবাই তো এই হাওয়ায়ই বড় হলাম।
—তুমি বড় হয়েছ। আমি হইনি। আমার চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ ছিল, আমি খোলা হাওয়া পেয়েছি, একেবারে নদী থেকে উঠে আসা। আমাদের ওখানে মানুষ তাই বাঁচেও বেশিদিন। ঠাকুরদা বেঁচেছিলেন একশ পাঁচ বছর। ওই বয়সে ওঁর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে পঁচিশের যুবকরাও হেরে যেত।
অনির্বাণ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলেছিল—পঁচিশের যুবকরাই বা হারত কেন? ওরা তো ওখানেরই লোক। ওরা কি হাওয়া খায়নি?
কল্যাণী বিষণ্ণ মুখে বলেছিল—তা হয়ত খেয়েছে তবে আমাদের বাড়ির কথা আলাদা।
—ও তাই বল। অনির্বাণ বাঁকা ঠোঁটে হাসত।
দীপন বড় বড় শ্বাস নেয়। কৈশোরে বৌচি খেলতে গিয়ে দম নিয়ে দৌড়বার আগে যেমন শ্বাস নিত কল্যাণী, এখনও তেমন টেনে শ্বাস নেয়। এই শ্বাসের সঙ্গে মুক্ত হাওয়া আসে, সুগন্ধ আসে, ঝেঁপে স্মৃতিও আসে।