Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

নুহাশ দরজা খুলল

ফিহা বললেন, কেমন আছ নুহাশ?

নুহাশ তাকিয়ে আছে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। এটা কি কোনো স্বপ্নদৃশ্য? সে কি ঘুমুচ্ছে? মানুষটিকে সে দেখছে ঘুমের মধ্যে?

আমাকে চিনতে পারছ আশা করি।

নুহাশ জবাব দিচ্ছে না। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

তোমার জন্যে এক প্যাকেট কফি নিয়ে আসছিলাম। ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছি বলে আনা হয় নি। এখন মনে হচ্ছে আনলেও হত। তুমি কি আমাকে ঘরে ঢুকতে দেবে, না দরজায় দাঁড় করিয়ে রাখবে?

নুহাশ তাকিয়ে আছে। কথা বলার চেষ্টা করছে, বলতে পারছে না। ফিহা বললেন, আমার অবশ্যি ভেতরে যাবার তেমন প্রয়োজন নেই। তোমাকে কয়েকটা জরুরি কথা বলা দরকার। বলে চলে যাব। খুব মন দিয়ে শোন। তার আগে জানা দরকার তুমি কি বিবাহিত?

নুহাশ না-সূচক মাথা নাড়ল।

ফিহা বললেন, আমি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সিদ্ধান্ত হঠাৎ করেই নিলাম। কোনো তরুণীর সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। একমাত্র তোমার সঙ্গেই সামান্য পরিচয়। কাজেই আমি এসেছি তোমার কাছে। যদি আমাকে তোমার পছন্দ হয়, যদি মনে হয় আমাকে বিয়ে করা যেতে পারে তাহলে আমার কাছে চলে আসবে। আচ্ছা, আমি যাচ্ছি। অসময়ে আসার জন্যে লজ্জিত।

নুহাশ কঁপা গলায় বলল, একটু বসে যান।

ফিহা বললেন, না বসব না। তুমি আমার কারণে তোমার একটি প্রিয় গ্রন্থ ছিড়েছ। তা ঠিক হয়নি। যে প্রিয় সে সব সময় প্রিয়। আমি খারাপ বললেই কি প্রিয়জন অপ্রিয় হবে? তুমি অবশ্যই আরেকটি বই কিনে নেবে। মনে থাকবে?

নুহাশ হাসছে। লাজুক ভঙ্গিতে হাসছে। ফিহা তা লক্ষ করলেন না। তিনি সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছেন। নুহাশ এখনো দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে এখন দেখাচ্ছে রোবটের মতে, চোখের পলক ফেলছে না।

ফিহা রাস্তায় নেমে পুরো ব্যাপারটা মাথা থেকে সরিয়ে দিলেন। এটা নিয়ে এখন তিনি আর ভাববেন না। মেয়েটা যদি সত্যি আসে তখন দেখা যাবে। শুধু শুধু চিন্তা ভাবনা করার কোনো মানে হয় না। তাঁর অনেক কাজ।

এরিন গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফিহা বললেন, তুমি আমাকে আমার বাড়িতে পৌঁছে দাও। তুমি করে বলায় রাগ করনি তো?

এরিন হাসল। সুন্দর দেখাল এরিনকে। হাসলে সবাইকে সুন্দর দেখায়।

এরিন তুমি কেমন আছ?

জ্বি ভালো।

এই চাকরি কি তুমি পছন্দ কর।

করি।

তুমি কি বিবাহিত?

না। পুলিশদের বিয়ে করার নিয়ম নেই।

কাদের তৈরি নিয়ম এরিন?

মেন্টালিস্টদের নিয়ম।

গাড়ি ছুটে চলেছে। ফিহার ঝিমুনি ধরে গেছে। তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।

ফিহার বাড়িটা প্ৰকাণ্ড। অনেকটা দুর্গের মতো। উঁচু পাচিল, পাঁচিলের উপর কাঁটা তার। পাঁচিল থেকে এক হাজার গজ দূরে মূল রাস্তায় সাইনবোর্ড লাগানো।

মেন্টালিস্টদের প্রবেশ কাম্য নয়।

আমি নীরবতা পছন্দ করি।

ফিহা

এ জাতীয় লেখা ফিহার পক্ষেই লেখা সম্ভব। মেন্টালিস্টরা এই পথে যাওয়াআসা করে। সাইবোর্ড দেখে। কেউ কেউ এক মুহূর্তের জন্য হলেও থমকে দাঁড়ায়। তবে কখনো বলে না, এ জাতীয় সাইনবোর্ডের মানে কি? মেন্টালিস্টদের প্রধান গুণ তারা অভিযোগ করে না, বিরক্তি প্রকাশ করে না এবং কখনোই রাগ করে না। তাছাড়া ফিহার উপর রাগ করার প্রশ্ন উঠে না। উনি এসবের ঊর্ধ্বে। অন্যের রাগ ভালবাসা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই।

মানুষটি জন্ম থেকেই নিঃসঙ্গ। বিশাল বাড়িটায় থাকেন একা। মাঝখানে কিছুদিন কুকুর পুষেছিলেন। দুটি শিকারী কুকুর, এদের পছন্দ করতেন। এক গভীর রাতে টাইম ডিপেনডেন্ট ইরেটা ফাংশান নিয়ে ভাবছিলেন। কুকুরের ডাকে চিন্তা এলোমেলো হয়ে গেল। তিনি বিরক্ত মুখে হুকুম দিলেন কুকুর দুটাকে এই মুহূর্তে বিদেয় কর। কুকুর বিদেয় হয়ে গেল। তারপর পাখি পোর শখ হল। চার পাঁচ ধরনের পাখি যোগাড় হল। এক সময় তাদের চিৎকারও অসহ্য বোধ হল। এখন আর পাখি নেই—খাঁচা পড়ে আছে।

এ বাড়িতে বর্তমানে কোনো মানুষ নেই। তিনটি রোবট আছে। তিনটিই কর্মী রোবট। দুজনের বুদ্ধিশুদ্ধি নিচের দিকে। নিজের কাজ ছাড়া অন্য কিছু প্রায় জানে না বললেই হয়। একটি রোবটের দায়িত্ব হচ্ছে ঘর গুছিয়ে রাখা এবং রান্না করা। তার নাম লীম লীম দিনরাত এইটি করে। খুব যে ভালো করে তাও না। রান্নায় লবণের পরিমাণ কখনোই ঠিক হয় না। বাকি দুটি রোবটের একটির কাজ বাড়ি পাহারা দেয়া। সে ক্রমাগত বাড়ির চারদিকে হাঁটে। তৃতীয় রোবটের কোনো কাজকর্ম নেই। এই রোবটটি PR টাইপের। বুদ্ধিবৃত্তি বাকি দুজনের মতো নিচের দিকে নয় বরং বেশ ভালো। ফিহা তাকে কিনেছিলেন নিজের কাজে সাহায্য করার জন্যে। শেষটায় মত বদলেছেন। রোবটের সাহায্য তার কাছে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়েছে। এখন রোবটটার কাজ হচ্ছে দিনরাত বারান্দায় বসে বই পড়া। ফিহা একে খানিকটা পছন্দ করেন। পাঠক নামে ডাকেন। মাঝে মধ্যে ডেকে কথাবার্তা বলেন। PR টাইপের রোবটের বড় ত্রুটি হচ্ছে এরা গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। অপ্রয়োজনে দীর্ঘ বাক্য বলে। কথা বলতে এরা পছন্দ করে। ফিহা বাইরে থেকে এলে চেষ্টা করবে একগাদা কথা বলতে।

আজ ফিহা গেট দিয়ে ঢুকতেই সে এগিয়ে গেল এবং একঘেয়ে গলায় বলল, স্যার আজ আপনি দুঘণ্টা একত্রিশ মিনিট বাইশ সেকেন্ড বাইরে কাটিয়েছেন। ন তারিখ আপনি বাইরে ছিলেন। সেদিন আপনি ছিলেন এক ঘণ্টা চল্লিশ সেকেন্ড। আবার তিন তারিখে…

চুপ কর।

পাঠক চুপ করে গেল। তবে তাও অল্প কিছুক্ষণের জন্যে। ফিহার পেছনে পেছনে আসতে আসতে বলল, স্যার, আপনার কি মনে আছে কাল রাতে আপনি বাগানে এসে বললেন, আজ তো আকাশে অনেক তারা। আপনার কথা শোনার পর আমি সিদ্ধান্ত নেই কোন সময় আকাশে তারা বেশি দেখা যায় তা বের করব। বের করতে গিয়ে পড়াশোনা করেছি এবং কিছু মজার তথ্য…

ফিহা দ্বিতীয়বার বললেন, চুপ কর।

তিনি জানেন পাঠক চুপ করবে না। তবে অসুবিধা নেই। তিনি এখন তাঁর শোবার ঘরে ঢুকে যাবেন। পাঠক শোবার ঘরে ঢুকবে না। তাকে সে অনুমতি দেয়া হয় নি। সে খাবার ঘরে চুপচাপ বসে অপেক্ষা করবে ফিহার জন্যে। ফিহার দেখা পেলে কোনো একটা আলাপ শুরুর চেষ্টা করবে। ফিহা ঠিক করলেন তাকে এই সুযোগ দেবেন না। শোবার ঘর থেকে বের হবেন না। তাঁর মন বেশ খারাপ। খেতেও ইচ্ছা করছে না। মেন্টালিস্টদের সঙ্গে কথাবার্তা বললেই তাঁর মেজাজ আকাশে চড়ে যায়।

শোবার ঘরের চেয়ারে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে তিনি মত বদলালেন। নিজেকে কষ্ট দেবার কোনো মানে হয় না। খাওয়া-দাওয়া করা যেতে পারে। পাঠকের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্পও করা যায়। বেচারা গল্প করতে পছন্দ করে। গল্প করার সঙ্গী নেই।

ফিহা খাবার ঘরে ঢুকলেন।

পাঠক সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমি কি কথা বলতে পারি স্যার?

না।

ফিহা খেতে বসলেন। আজও লবণ কম হয়েছে। শুধু কম না, বেশ কম। অথচ দুদিন আগে প্রতিটি খাবারে অতিরিক্ত লবণ ছিল। এই রোবটটা মনে হয় বদলানো দরকার। ফিহা বিরক্ত মুখে বললেন, লবণের জন্যে তো কিছু মুখে দিতে পারছি না। তুমি কি লবণের ব্যাপারটা কিছুতেই ঠিক করতে পারবে না?

লীম চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে তার কিছু বলার নেই। পাঠক বলল, লবণ প্রসঙ্গে আমি কি একটা ছোট্ট কথা বলতে পারি স্যার?

না।

আপনার নিষেধ অগ্রাহ্য করেই কথাটা বলার ইচ্ছা হচ্ছে, যদিও জানি তা সম্ভব না। আপনাকে আবারো অনুরোধ করছি লবণ সম্পর্কে আমাকে কথাটা বলতে দিন।

বল।

আমাদের রোবট লীম লবণের পরিমাণে কোনো ভুল করে না। সমস্যাটা আপনার।

সমস্যা আমার মানে?

আপনার যখন মন-টন ভালো থাকে, তখন আপনি লবণ কম খান। আবার যখন মেজাজ খারাপ থাকে লবণ বেশি খান। আমি দীর্ঘ দিন পরীক্ষা করে এই সিদ্ধান্তে এসেছি। মনে হয় মেজাজ খারাপ থাকলে আপনার শরীর বেশি ইলেকট্রোলাইট চায়। শরীরবিদ্যার কোনো বিশেষজ্ঞের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করা যায়। আমি চারজন বিশেষজ্ঞের ঠিকানা জোগাড় করেছি। আপনি কি কথা বলতে চান?

কথা বলতে চাই না। বাইরে গেলেই আপনার মেজাজ খারাপ হয় এর কারণ কি?

ফিহা জবাব দিলেন না। পাঠক বলল, মেন্টালিস্টদের নিয়ে আপনি কি খুব বেশি চিন্তা করেন?

না। তুমি কথা বলা বন্ধ কর।

এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে যদি আপনার খারাপ লাগে তাহলে অন্য বিষয়ে কথা বলি, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জন্যরহস্য নিয়ে কি স্যার আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করব?

পাঠক!

জ্বি স্যার।

তোমার কথা বলার জন্যে কি এখন সঙ্গী দরকার?

পাঠক প্রথমবারের মতো প্রশ্নের জবাব দিল না। মনে হচ্ছে সে গভীর চিন্তায় পড়ে গেছে। ফিহা বললেন, নুহাশ নামে একজন তরুণীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। শতকরা কুড়িভাগ সম্ভাবনা সে এ বাড়িতে আসবে। যদি আসে তুমি কথা বলার সঙ্গী পাবে।

আমি স্যার শুধু আপনার সঙ্গে কথা বলাতেই আগ্রহ বোধ করি।

কেন?

আমি চিন্তা করছি আপনার একটা জীবনী লিখব। জীবনী লেখার জন্যে আপনার সম্পর্কে অনেক তথ্য প্রয়োজন। তথ্য তেমন কিছু নেই। তাই সারাক্ষণ কথা বলতে চেষ্টা করি, যদি কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে কোনো তথ্য পেয়ে যাই।

কিছু পেয়েছ?

জ্বি স্যার।

কি পেলে?

আমি যে অল্প কয়েক পাতা লিখেছি আপনি কি পড়তে চান?

না।

আপনার জীবনী গ্রন্থে আমি উল্লেখ করেছি যে না শব্দটা আপনার প্রিয়। যখন তখন আপনি না বলেন। মাঝে মধ্যে কিছু না ভেবেই বলেন। জীবনী গ্রন্থের শুরুটা একটু দেখে দিলে ভালো হয়। অনেক মজার মজার জিনিস সেখানে আছে। যেমন ধরুন, শুরুতেই একটা চমক আছে। পাঠক শুরুর কয়েকটি লাইন পড়েই চমকে উঠবে–

শুরুটা কি?

শুরু হচ্ছে—মহামতি ফিহা বড় হয়েছেন একটি মেন্টালিস্ট পরিবারে। এই পরিবারটি ফিকে অনাথ আশ্রম থেকে তুলে নিয়েছিলেন। পরম আদর এবং মমতায় ফিকে তাঁরা লালন পালন করেন। অসাধারণ প্রতিভাধর এই বালকটির প্রতিভার পূর্ণ বিকাশে মেন্টালিস্ট পরিবারের ভূমিকাকে ছোট করে। দেখার কোনো উপায় নেই। বার বছর বয়সে ফিহা ঐ মেন্টালিস্ট পরিবার ছেড়ে চলে আসেন। পরবর্তী সময়ে কোনোদিনও তিনি তাঁর পালক পিতা-মাতার সঙ্গে যোগাযোগ করেন নি।

পাঠক থামল। ফিহা মূর্তির মতো বসে আছেন। পাঠক বলল, আমি কি কোনো ভুল তথ্য দিয়েছি স্যার?

না। সব ঠিকই আছে।

জীবনী গ্রন্থের ভাষাটা আপনার কাছে কেমন মনে হচ্ছে?

ভাষার বিষয়ে আমি কিছু জানি না।

আমি জীবনী গ্রন্থটি কয়েক ধরনের ভাষা ব্যবহার করে লিখেছি। একই জিনিস খুব কাব্যিকভাবেও লিখেছি। যেমন…

ফিহা উঠে পড়লেন। পাঠকও উঠে দাঁড়াল। ফিহা বললেন, পাঠক, তুমি আমার মেন্টালিস্ট বাবা-মার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। বলবে, আমি তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

এটা তো স্যার সম্ভব না। আমি চেষ্টা করেছিলাম। তাঁদের একটা ইন্টারভ্যু নেয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ভূগর্ভস্থ মেন্টালিস্টরা সবার যোগাযোগের বাইরে।

ফিহা শোবার ঘরে ঢুকে পড়লেন। অস্থির ভাব আবার ফিরে এসেছে। শুধু ফিরে এসেছে তাই না। দ্রুত বাড়ছে। তিনি এই অস্থিরতার ধরন জানেন। এ অন্য ধরনের অস্থিরতা। ঘুমের ওষুধ খেয়ে তিনি কি নিজেকে শান্ত করবেন? না, তার প্রয়োজন নেই। অস্থিরতার প্রয়োজন আছে। তিনি সময় সমীকরণের খুব কাছাকাছি আছেন। তিনি জানেন তাঁর মস্তিষ্ক কাজ করছে। সমীকরণের সমাধান অবচেতন মনের কাছে চলে এসেছে। চেতন মন বা তার জাগ্রত সত্তা সেই সমাধান এখনো পায় নি। তবে পেয়ে যাবে। খুব শিগগিরই পেয়ে যাবে। এখন প্রয়োজন নিজেকে শান্ত রাখা। সর্বযুগের সর্বকালের সবচে বড় আবিষ্কারটির মুখখামুখি তিনি দাঁড়িয়ে আছেন।

সময় সমীকরণের সমাধান।

এর ফলাফল কি হবে? মানবজাতি কি উপকৃত হবে? না ধ্বংস হয়ে যাবে? এই মুহূর্তে তা বলা যাচ্ছে না। কিছু ব্যাপার আছে যা আগে বলা যায় না, যার সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না। মেন্টালিস্টদের কথাই ধরা যাক।

মেন্টালিস্ট তৈরি করা হয়েছিল যে উদ্দেশ্যে তা সফল হয় নি। মানবজাতি আজ দুটি ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একদিকে প্রচণ্ড মানসিক ক্ষমতাধর মেন্টালিস্ট। অন্যদিকে মানসিক ক্ষমতাহীন সাধারণ মানুষ। এই সাধারণ। মানুষদের নিয়ন্ত্রিত করছে মেন্টালিস্টরা। সাধারণ মানুষ তাদের হাতের পুতুলের মতো। হাসতে বললে হাসতে হবে, কাঁদতে বললে কাঁদতে হবে। তারা বাধ্য করবে। সেই ক্ষমতা তাদের আছে। তারা এগুচ্ছে খুব ঠাণ্ডা মাথায়। পুরো মানবগোষ্ঠীকে মেন্টালিস্ট বানানোই তাদের পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা কিছুতেই শুভ হতে পারে না। প্রকৃতি মানবগোষ্ঠী চায় নি। এটা একটা কৃত্রিম ব্যবস্থা।

ফিহা কমুনিকেটর-এ হাত রাখলেন। কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে। একজন মেন্টালিস্টের সঙ্গে কথা বলা দরকার। যে-কেউ হতে পারে। মারলা লির সঙ্গেই কথা বলা যায়।

মারলা লি বিস্মিত গলায় বললেন, গভীর রাতে আপনি? কি ব্যাপার মহামতি ফিহা?

রাত কি খুব বেশি হয়েছে?

মন্দও হয়নি। এগারোটা বাজে।

আমি কি আপনাকে ঘুম থেকে তুললাম?

বিছানা থেকে তুললেন। আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনেকরাত পর্যন্ত পড়ি। আপনার মতো আমারো রাত জাগা স্বভাব। কি ব্যাপার জানতে পারি?

মেন্টালিস্টদের সম্পর্কে আমি কিছু পড়াশোনা করতে চাই।

ও আচ্ছা।

আপনি কি এই বিষয়ে বইপত্র দিয়ে আমাকে সাহায্য করতে পারেন? বইপত্র নিশ্চয়ই আপনাদের কাছে আছে।

আছে। কিন্তু মহামতি ফিহা, এইসব বইপত্র আমাদের জন্যে। যারা মেন্টালিস্ট নয় তাদের কাছে বইপত্র দেয়া নিষেধ আছে।

নিষেধ আছে বলেই আপনার কাছে চাচ্ছি।

আপনার বিষয় পদার্থবিদ্যা। পড়াশোনা সেই বিষয়ে সীমিত রাখাই কি ভালো নয়?

তার মানে কি আপনি আমাকে বই দিতে পারবেন না?

আপনি চেয়েছেন, অবশ্যই আপনাকে দেয়া হবে।

ফিহা বললেন, ধন্যবাদ। আমি কমুনিকেটর বন্ধ করে দেব। তার আগে একটি জিনিস জানতে চাই। মেন্টালিস্ট সমাজের সবচে দুর্বল দিক কি?

আমাদের কোনো দুর্বল দিক নেই।

ভুল বললেন। আপনাদের সমাজের সবচে দুর্বল দিক হচ্ছে এই সমাজে কোননা সৃষ্টিশীল মানুষ নেই। আপনাদের কোনো বিজ্ঞানী নেই, কবি নেই, গল্পকার নেই, শিল্পী নেই…আমি কি ভুল বললাম?

না ভুল বলেন নি। তবে–

তবে কি?

আজ থাক। অন্য সময় এই নিয়ে কথা বলব। শুভ রাত্রি মহামতি ফিহা। আমি মেন্টালিস্টদের নিয়ে লেখা ছোট্ট একটা বই পাঠাব। বইটা পড়ার পর আপনার আর কিছু পড়তে ইচ্ছা করবে না। বইটা কাল ভোরে পাঠালে কি হয়?

আজ রাতে পাঠাতে পারবেন?

অবশ্যই পারব।

আরেকটি কথা।

বলুন।

আমি যদি বিয়ে করতে চাই তাহলে কি আপনাদের অনুমতি প্রয়োজন আছে?

আপনার জন্য নেই। আপনি কি বিয়ের কথা ভাবছেন?

ফিহা কম্যুনিকেটর বন্ধ করে দিলেন। নিজের উপর রাগ লাগছে। শুধু শুধু এই কথা বলার প্রয়োজন ছিল না।

মারলা লি বিছানা থেকে নামলেন। কাপড় পাল্টালেন। গাড়ি বের করতে বললেন। রোবট নিয়ন্ত্রিত স্বয়ংক্রিয় গাড়ি নয় নিজে চালাবেন এমন গাড়ি। গভীর রাতে রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকে, গাড়ি চালানোয় আনন্দ আছে।

আজ রাস্তাঘাট অন্যসব রাতের চেয়েও ফাঁকা। বিজ্ঞান পল্লী ধী ১১-র মানুষজন মনে হয় আতঙ্কগ্ৰস্ত। বিক্ষিপ্তভাবে নানান জায়গায় মেন্টালিস্টদের সঙ্গে

সংঘর্ষ হচ্ছে। মানুষজন রাস্তায় বেরুচ্ছে না।

মারলা লি গাড়ি নিয়ে হাইওয়েতে চলে এলেন। হাইওয়ের পেট্রল পুলিশের গাড়ি জায়গায় জায়গায় থেমে আছে। ট্রেল পুলিশকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে।

মারলা লির গাড়ির ড্যাসবোর্ডে জরুরি সংবাদজ্ঞাপক লাল বোতাম দুটি ক্রমাগত জ্বলছে নিভছে। জরুরি কোনো খবর আছে। জরুরি খবর শুনতে ইচ্ছা করছে না। তবু অভ্যাসের বসে বোতাম টিপে দিলেন। আবহাওয়া দপ্তর ঘূর্ণিঝড় বিষয়ক সতর্ক সংকেত প্রচার করছে। ঘূর্ণিঝড়টির বিজ্ঞান পল্লী ধী-১১-র উপর দিয়ে উড়ে যাবার একটি সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সতর্ক ব্যবস্থা হিসেবে পদার্থবিদ্যা গবেষণাগারের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

মারলা লির ভুরু কুঞ্চিত হল।

লোহার ভারি গেট। কোনো কলিং বেল নেই। মারলা লি বেশ কয়েকবার গেটে ধাক্কা দিলেন। সেই শব্দ বাড়ি পর্যন্ত পৌছল কি-না তিনি বুঝতে পারছেন না। আকাশ মেঘলা হয়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়ে যেতে পারে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন? মারলা লি আবার গেটে ধাক্কা দিতে শুরু করলেন। পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, রোবটের পায়ের শব্দ। মাটি কাঁপিয়ে রোবট আসছে। কি ধরনের রোবট? এত ভারি রোবটলতা আজকাল তৈরি হয় না।

গেট খুলল না। গেটের একটা জানালা খুলে গেল। মুখ বের করল পাঠক। তার ইরিডিয়ামের চোখ অন্ধকারে জুল জুল করছে। সে আনন্দিত স্বরে বলল, বই নিয়ে এসেছেন?

হ্যাঁ।

আমার কাছে দিন। দিয়ে চলে যান।

তোমার কাছে দেয়া যাবে না। বইটি মূল্যবান, আমাকেই পৌঁছে দিতে হবে ফিহার কাছে।

আপনি বিনা দ্বিধায় আমার হাতে দিতে পারেন। আমি ফিহার একজন ব্যক্তিগত সহকারী। আমার নাম পাঠক। ফিহা আমাকে খুবই পছন্দ করেন।

ফিহা তোমাকে খুব পছন্দ করেন জেনে আনন্দিত হচ্ছি। ফিহা আমাকে তেমন পছন্দ করেন না, তবু আমাকেই বইটি তাঁর হাতে পৌঁছে দিতে হবে।

গেটের জানালা বন্ধ হয়ে গেল। পাঠক ধুপ ধুপ শব্দে ফিরে যাচ্ছে। মারলা লি লক্ষ করলেন বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। তাপমাত্রা আরো নেমে গেছে। তিনি গাড়ির ভেতর গিয়ে বসবেন কি-না বুঝতে পারছেন না। পাঠক নামের এই রোবটটি কতক্ষণে ফিরবে কে জানে। পি আর ধরনের রোবট। এদের কাজকর্ম ঢিলেঢালা ধরনের, তবে এদের লজিক খুব উন্নত। তারচে বড় কথা এর আশেপাশের জগৎ থেকে জ্ঞান আহরণ করে। যতই দিন যায় ততই এদের ক্ষমতা বাড়তে থাকে।

গেট খুলে গেল। পাঠক বলল, ভেতরে আসুন স্যার। ফিহা লাইব্রেরি ঘরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। আপনাকে খুব সাবধানে আসতে হবে। ভেতরে আলো নেই। ইচ্ছা করলে আপনি আমার হাত ধরতে পারেন।

মারলা লি শান্ত স্বরে বললেন, হাত ধরার প্রয়োজন নেই। তুমি আগে আগে যাও।

ফিহা ভুরু কুঁচকে তাকালেন। মনের বিরক্তি গোপন করার কিছুমাত্ৰ চেষ্টা করলেন না। মারতা লি বললেন, এত রাতে কাউকে বিরক্ত করতে ইচ্ছা করল না। আমি নিজেই বইটি নিয়ে এসেছি। যদিও জানি অনধিকার চর্চা হয়েছে। আমি একজন মেন্টালিস্ট আপনার বাড়ির এক হাজার গজের ভেতরে আমার আসার কথা না। তবু এসেছি।

একজন রোবটকে দিয়ে বইটি আপনি পাঠাতে পারতেন।

জ্বিনা, পারতাম না। এই বই অন্যের হাতে দেয়া সম্ভব না।

ফিহা হাত বাড়িয়ে বই নিলেন। মারলা লি বললেন, আপনার জন্যে এক প্যাকেট কফি এনেছি। যে কোনো কারণেই হোক আগের প্যাকেটটি আপনি ফেলে দিয়েছিলেন।

ফিহা কফির প্যাকেট হাতে নিলেন। মারতা লি বললেন, বাইরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। লক্ষ করেছেন কিনা জানি না, বৃষ্টি পড়ছে। গরম এক কাপ কফি খেলে আমার জন্যে ভালো হত।

বসুন। কফি দিতে বলি।

আপনাকে ধন্যবাদ।

মারলা লি বসলেন। ফিহা বসলেন না দাঁড়িয়ে রইলেন। বসতে ইচ্ছা করলেও অবিশ্য বসার উপায় নেই। একটিই চেয়ার। মারলা লি বললেন, আপনি বসবেন না ফিহা?

বসার প্রয়োজন কি আছে?

মুখোমুখি বসলে কিছুক্ষণ কথা বলতাম। শত্রুপক্ষের সঙ্গেও তো মানুষ। দুএকবার কথা বলে। তাছাড়া বাড়িতে ঢােকার অনুমতৃি যখন দিয়েছেন। কথা বলার অনুমতিও দেবেন।

ফিহা লাইব্রেরি ঘর থেকে বের হয়ে পাঠককে বললেন আরেকটি চেয়ার লাইব্রেরি ঘরে দিতে।

পাঠক বলল, চেয়ার টানাটানি করা আমার জন্যে সম্মান হানিকর। রাঁধুনী রোবটকে এই কাজটা করতে বলি?

বল।

আরেকটা কথা স্যার, মনে হচ্ছে এই মানুষটি আপনাকে খুব বিরক্ত করছে। দ্রতার কারণে আপনি তাকে চলে যেতে বলতে পারছেন না। আমাকে যদি অনুমতি দেন তাহলে কথার পঁাচে ফেলে লোকটাকে বিয়ে করব। আপনার দ্রতাও রক্ষা হবে।

তার প্রয়োজন দেখছি না। তুমি আড়ি পেতে কথা শুনছিলে এ ব্যাপারটিও আমার অপছন্দের। যাও গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাক।

পাঠক চলে গেল। তার ইরিডিয়াম চোখের উজ্জ্বলতা কিছুটা ম্লান হয়েছে।

মারলা লি বললেন, আপনার বিশাল লাইব্রেরিতে একটি মাত্র চেয়ার দেখে বিস্মিত হয়েছি।

ফিহা বললেন, বিস্মিত হবার কিছু নেই। আমি একা মানুষ।

আমিও একা মানুষ ফিহা; কিন্তু তাই বলে আমার বসার ঘরে বা আমার লাইব্রেরিতে একটি মাত্র চেয়ার থাকবে তা কল্পনাও করতে পারি না।

আপনি ফিহা নন বলে কল্পনা করতে পারেন না। আমি পারি, এবং আমার কাছে এটিই যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে। আমার লাইব্রেরি ঘর কফি খাবার কিংবা আড়া দেবার জায়গা নয়।

এখানে বসে কথা বলতে যদি আপনি অসুবিধা বোধ করেন তাহলে আমরা অন্য কোথাও বসতে পারি।

আপনাকে কি কথা বলতেই হবে?

বলতে পারলে ভালো হত। আপনি না চাইলে বলবেন না।

আমি কথা বলতে চাচ্ছি না।

বেশ। আমি কফি শেষ করেই বিদেয় হব।

মারল লি নিঃশব্দে কফি শেষ করলেন। মাথার টুপি খুলে টেবিলে রেখেছিলেন। টুপি মাথায় দিলেন। শান্ত গলায় বললেন, বিদায় নিচ্ছি। শুভরাত্রি মহামতি ফিহা।

শুভরাত্রি।

মারল লি পা বাড়াতে গিয়েও বাড়ালেন না, থমকে দাঁড়ালেন। আগের চেয়েও শান্ত গলায় বললেন, আমি কিন্তু ইচ্ছা করলেই আমার কথা শুনতে আপনাকে বাধ্য করতে পারতাম। আমি একজন মেন্টালিস্ট। আমি চাইলে, আপনার না বলার ক্ষমতা নেই। আমি আপনাকে বাধ্য করতে পারতাম, তা কিন্তু করিনি। মেন্টালিস্টরা কখনোই কাউকে বাধ্য করে না। তারপরেও সাধারণ মানুষদের ভেতর ভয়াবহ ভুল ধারণা যে মেন্টালিস্টরা তাদের ইচ্ছা অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়।

সেনাবাহিনী কি পুরোপুরি আপনারা নিয়ন্ত্রণ করেন না?

অবশ্যই করি। প্রয়োজনেই করি। নিয়ন্ত্রণ না করলে সেনাবাহিনী দুভাগ হয়ে যেত। একটি সাধারণ মানুষদের বাহিনী অন্যটি মেন্টালিস্টদের বাহিনী। তার ফলাফল নিশ্চয়ই আপনাকে ব্যাখ্যা করতে হবে না।

ফিহা বললেন, পদার্থবিদ্যা গবেষণাগারে একটি বিশেষ ধরনের গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে। আপনারা সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছেন। গবেষণা এগুতে দিচ্ছেন না।

সঠিক তথ্য কিন্তু ভুল ব্যাখ্যা। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কারণ ঝড় আসছে। শক্তিশালী টর্নেডো। ঝড় শেষ হলেই বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু হবে। আমাদের প্রতি আপনার যত বিদ্বেষই থাকুক আপনাকে স্বীকার করতে হবে যে আমরা কোনো রকম গবেষণায় বাধা দেই না। আমাদের দুর্ভাগ্য আমাদের মধ্যে কোনো বিজ্ঞানী নেই। মেন্টালিস্টরা সষ্টিশীল কাজ পারে না। যারা এই কাজটি পারে তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার সীমা নেই। আপনি নিজের কথা ভেবে দেখুন মহামতি ফিহা। কি পরিমাণ সম্মান আপনি ভোগ করেন?

ফিহা বললেন, এই সম্মান আপনারা আপনাদের নিজেদের স্বার্থেই করেন। জ্ঞান বিজ্ঞান, আধুনিক প্রযুক্তির জন্যে বিজ্ঞানীদের উপর নির্ভর করা ছাড়া আপনাদের উপায় নেই।

আরেকটি সঠিক তথ্য ভুলভাবে আপনি উপস্থিত করলেন। আপনাদের ছাড়া জ্ঞান বিজ্ঞানে আমরা অগ্রসর হতে পারছি না এটা ঠিক। কিন্তু যতটুকু অগ্রসর হয়েছি আমাদের জন্য তাই যথেষ্ট। এর বেশি আমাদের প্রয়োজন নেই। মেন্টালিস্টদের প্রয়োজন সামান্য। তারা অল্পতেই সুখী। সমস্ত বিশ্ব ব্ৰহ্মাণ্ড জয়ের স্বপ্ন তারা দেখে না।

যারা দেখে তাদের বাধা দেয়।

না তাও আমরা দেই না। দীর্ঘদিন বিজ্ঞান কাউন্সিলের প্রধান হিসেবে আপনি জানেন যে আমরা কোনো গবেষণাতেই কখনো বাধা দেই না। আপনারা যখন টেলিপ্যাথিক যোগাযোগের কৌশল উদ্ভাবনের গবেষণা করতে চাইলেন আমরা কিন্তু অর্থ বরাদ্দ করলাম। বিপুল অর্থই বরাদ্দ করা হল। সেই গবেষণা কাজে এল না। আবার আমরা যখন বিশেষ কোনো গবেষণা আপনাদের করবার জন্যে অনুরোধ করলাম আপনারা তা করতে রাজি হলেন না। মেন্টালিস্টদের কিছু শারীরিক সমস্যা ত্রিশ বছরের পর থেকে শুরু হয়। পিটুইটারি গ্র্যান্ড থেকে বিশেষ এক ধরনের এনজাইম বের হয়। তার উপর গবেষণা কোনো বিজ্ঞানী করতে রাজি হন নি।

আমি জীববিজ্ঞানী নই কাজেই এই বিষয় জানি না।

মহামতি ফিহা আপনি অনেক বিষয়ই জানেন না। আমরা যখন অসুস্থ হই তখন চিকিৎসার জন্যে রোবট ডাক্তারদের উপর নির্ভর করি। মানুষ ডাক্তাররা যখন আমাদের চিকিৎসা করতে আসেন তখন প্রচণ্ড ঘৃণা নিয়ে আসেন। আমরা মেন্টালিস্ট, আমরা তা বুঝতে পারি।

ফিহা বললেন, আপনাদের মধ্যে ডাক্তার নেই?

না। আমাদের মধ্যে ডাক্তার নেই।

আমার জানা ছিল না।

মারলা লি বললেন, আপনার অনেক সময় নিলাম। আমার কথা ধৈর্য ধরে শুনেছেন তার জন্যে ধন্যবাদ।

ফিহা বললেন, আপনি কি একটা সত্যি কথা আমাকে বলবেন?

অবশ্যই বলব।

এই যে এতক্ষণ আপনি কথা বললেন, আপনি কি কথা শোনাবার ক্ষেত্র সাবধানে প্রস্তুত করেন নি? আপনি কি আপনার মানসিক ক্ষমতা ব্যবহার করেন। নি?

মারলা লি বললেন, না করিনি। জানি না আপনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন কি-না। আমি সত্যি কথাই বলেছি। শুভরাত্রি।

রাত্রি খুব শুভ হল না। প্রচণ্ড ঝড় হল। বিজ্ঞান পল্লী লণ্ডভণ্ড করে টর্নেডো বয়ে গেল। যাবতীয় সাবধানতা সত্ত্বেও তেইশজন মানুষ মারা গেল, তারা সবাই পুলিশ। তাদের ডিউটি ছিল রাস্তায়। ঝড়ের সময় আশ্রয় কেন্দ্রে যাবার অনুমতি তাদের ছিল না।

ফিহা বইটি শেষ করেছেন। বিদ্যুৎ ছিল না। বিদ্যুৎ সেলের সঞ্চিত বিদ্যুৎ ব্যবহার করে বাতি জ্বালাতে হল। বাইরে হাওয়া শোঁ শোঁ শব্দ করছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। তিনি একমনে পড়ছেন।

চল্লিশ পৃষ্ঠার বই। পুরানো ধরনের ভাষা, জটিল অলংকার ভৰ্তি বাক্য। মাঝে মাঝে অর্থহীন পদের পুনরাবৃত্তি। অনেকটা ধর্মগ্রন্থের আকারে লেখা

তিনি মানুষ নন। মানুষের ছায়া, তিনি খাদ্য গ্রহণ করেন না। তিনি কাহাকে জন্ম দেন না। তাঁহার আগমন আছে; নির্গমন নাই। তিনি আসিয়াছেন ভবিষ্যত হইতে। তিনি ভবিষ্যত জানেন। যে বিদ্যা তিনি ভবিষ্যত হইতে আনেন সেই বিদ্যা ভবিষ্যতে ফিরিয়া যায়। চক্র পূর্ণ হয়। বিশ্ব ব্ৰহ্মাণ্ড একটি চক্রের অধীন। তিনি শুধু একটি ক্ষুদ্র চক্র সম্পন্ন করেন। ইহার অধিক তাহার কোনো কৰ্ম নাই। নতুন মানব সমাজের খবর তিনি ভবিষ্যত হইতে নিয়া আসেন। বীজ বপন করেন অতীতে। এইভাবেই চক্র সম্পন্ন হয়। বিশ্ব ব্ৰহ্মাণ্ড একটি চক্রের অধীন। তিনি তাঁহার চক্ষু দিয়া নতুন মানব সমাজের বীজ বপন করেন। এইভাবেই চক্র সম্পন্ন হয়। বিশ্ব ব্ৰহ্মাণ্ড একটি চক্রের অধীন। তিনি শুধু একটি ক্ষুদ্র চক্র সম্পন্ন করেন।

যতই আগানো যায় বই ততই জটিল হতে থাকে।

বইয়ের মাঝামাঝি জায়গায় আছে–

প্রত্যেকের জন্যে কর্ম নির্দিষ্ট। সবাই তাহার নিজ নিজ কৰ্ম সম্পন্ন করিবে। অতঃপর তাহার প্রয়োজন নাই। অসংখ্য ক্ষুদ্র চক্র একটি বৃহৎ চক্র তৈরি করে। বিশ্ব ব্ৰহ্মাণ্ড চক্রের অধীন। শূন্য ধাবিত হয় অসীমের দিকে। আবার অসীম যায় শূন্যের দিকে। এমতে চক্ৰ সম্পন্ন হয়। এই বিশ্ব ব্ৰহ্মাণ্ড চক্রের অধীন।…

ফিহা বইটি দ্বিতীয়বার পড়লেন। প্রতিটি বাক্য পড়ার পর খানিকক্ষণ ভাবলেন। যদি তাতে কোনো লাভ হয়।

তিনি মানুষ নন। মানুষের ছায়া।

এর মানে কি? মানুষের ছবি? মানুষের ছবিও তো ছায়া।

তিনি খাদ্য গ্রহণ করেন না। ছবি খাদ্য গ্রহণ করে না।

তিনি কাহাকে জন্মও দেন না। ছবি কাউকে জন্ম দেবে না। তবে একটি ছবি থেকে অনেক ছবি করা যায়…। মেলানো যাচ্ছে না।

পুরো জিনিসটা অঙ্কের একটি মডেলে কি দাঁড় করানো যায়?

ধরা যাক মানুষ হচ্ছে x!

তিনি মানুষের ছায়া।

অর্থাৎ তিনি মানুষের একটি ফাংশান। তিনি যদি y হন

তবে y = f (x)

তিনি কাহাকেও জন্ম দেন না। z যদি হয় জন্ম দেয়া সংক্রান্ত সংখ্যা তাহলে তিনি হবেন z এর ফাংশান তবে z এর মান হবে ঋণাত্মক, কাল্পনিক সংখ্যা।

y = f (x) f(z)

যেখানে, z = cosθ + sinθ

তিনি আসিয়াছেন ভবিষ্যত হইতে। অর্থাৎ y হচ্ছে সময়েরও ফাংশান। এমন ফাংশান যা শুধু একদিকে প্রবাহিত হবে। ভেক্টর রাশি।

y = f (x) f(z) f (t)

যে বিদ্যা তিনি ভবিষ্যত হইতে আনেন সেই বিদ্যা ভবিষ্যতে ফিরিয়া যায়। চক্র পূর্ণ হয়।

চক্র পূর্ণ হতে হলে y কে যেখানে থেকে শুরু সেখানেই ফিরে যেতে হবে। গ্রেগরিয়ান ইন্টিগ্রাল নিয়ে আসা যায়। গ্রেগরিয়ান ইন্টিগ্রালকে অর্থপূর্ণ করতে হলে Yকে ফাইনাইট ফাংশান হিসেবে দেখতে হবে।

ফিহা ডাকলেন, পাঠক।

পাঠক ছুটে এল।

সেন্ট্রাল কম্পিউটার চালু করার ব্যবস্থা কর।

চালু করা যাবে না স্যার।

কেন?

প্রচণ্ড ঝড় হচ্ছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ।

ও আচ্ছা।

ছোটখাটো হিসেবের ব্যাপার হলে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি স্যার।

গ্রেগরিয়ান ইন্টিগ্রাল জানা আছে?

আছে স্যার। তবে…

তবে কি?

ভেরিয়েবল-এর সংখ্যা সাতের নিচে হতে হবে। এর উপর হলে আমি পারব না। আমার ক্ষমতা অল্প।

সাতের নিচে রাখার চেষ্টা করা হবে।

আরেকটি ক্ষুদ্র প্রশ্ন স্যার।

বল।

সমীকরণটি সময় মুক্ত?

না, সময় মুক্ত নয়।

তাহলে স্যার হেসবিয়ান নরমালাইজড ফাংশান আমাকে বের করতে হবে। সময় লাগবে।

ধীরে ধীরেই কর। তার আগে এই বইটি পড়। খুব ভালো করে পড়। বইটি মেন্টালিস্টদের উপর লেখা একটি গ্রন্থ। সম্ভবত ওদের ধর্মগ্রন্থ।

পাঠক বই হাতে নিল। ফিহা পেন্সিলে অঙ্ক সাজাতে শুরু করলেন। তাঁর চোখ-মুখ উজ্জ্বল। অঙ্কের মডেল দাঁড় করানোর আলাদা আনন্দ আছে। তিনি পাঠকের দিকে তাকালেন। সে অতি দ্রুত বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে। রোবটের গ্রন্থপাঠ দেখা এক বিরক্তিকর ব্যাপার। এরা এত দ্রুত পাতা উল্টায় যে মনে হয় পাতা গুনছে, কিছু পড়ছে না।

পড়লাম স্যার।

কেমন লাগল?

কোন্ অর্থে কেমন লাগল জানতে চাচ্ছেন?

বিষয়বস্তু।

বিষয়বস্তুতে নতুনত্ব আছে। তারা চক্রকে ঈশ্বর বলছে।

চক্রকে ঈশ্বর কোথায় বলল?

রূপকের মাধ্যমে বলেছে স্যার। বিজ্ঞানের রূপক বৰ্জিত ভাষা এবং ধর্মগ্রন্থের রূপক ভাষা দুরকম।

তোমার ধারণা তুমি বিষয়বস্তু বুঝতে পেরেছ?

এক ধরনের ধারণা তৈরি হয়েছে। ধারণা কতটুক সত্যি তা বলা মুশকিল। রূপকের ভাষা পাঠ করে একেকজন একেক রকম ধারণা করবে। এমনও হতে পারে যে সবারটাই সত্যি আবার কারোরটাই সত্যি না। আপনি আপনার সমীকরণ বলুন স্যার। আমি সাজাতে শুরু করি।

সমীকরণ বলছি। তার আগে তোমার ধারণা কি শুনি।

এই গ্রন্থে মেন্টালিস্টদের জন্মের ইতিহাস বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে তিনি মেন্টালিস্ট তৈরি করলেন। সেই তিনি মানুষ নন। যেহেতু সেই তিনি খাদ্য গ্রহণ করেন না সেহেতু সেই তিনি খুব সম্ভব একজন যন্ত্র। এটা আমার অনুমান। বলা হচ্ছে তিনি এসেছেন ভবিষ্যৎ থেকে। মনে হচ্ছে টাইম ট্রাবেল-এর কথা বলা হচ্ছে। একটি যন্ত্র অর্থাৎ একটি রোবট ভবিষ্যত থেকে অতীতে গেল। তৈরি করল মেন্টালিস্ট। যন্ত্রটির আগমন আছে, নির্গমন নেই। অর্থাৎ যন্ত্রটি অতীতে গিয়েছে কিন্তু ভবিষ্যতে ফিরে আসতে পারেনি। বলা হয়েছে—তিনি তাঁর চক্ষু হইতে নতুন মানবগোষ্ঠী তৈরি করিলেন। এই অংশটি মজার। রোবটের চোখের আলোর সংবেদনশীল অংশ তৈরি করা হয় যৌগিক অণু ইরিকার্বো ফসফিন দিয়ে। ইরিকার্বো ফসকিন হচ্ছে একটি ইরিডিয়াম, দুটি কার্বন, একটি ফসফরাস এবং দুটি হাইড্রোজেন পরমাণুর যৌগ;

HIrPHC2

এই অদ্ভুত যৌগ মাত্র পাঁচশ বছর আগে তৈরি হয়েছে। খুবই আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে এই যৌগের র‍্যাডিকেল মেন্টালিস্টদের জীনে উপস্থিত।

তুমি কি করে জানলে?

মেন্টালিস্টদের প্রতি আমিও এক ধরনের আগ্রহ অনুভব করি। এই আগ্রহ থেকেই ওদের বিষয়ে পড়াশোনা করেছি।

ওদের বিষয়ে কি করে পড়াশোনা করবে? ওদের সম্পর্কে কোনো গ্ৰন্থ তো তোমার পক্ষে পাওয়া সম্ভব নয়।

বৈজ্ঞানিক জার্নালগুলিতে কিছু কিছু তথ্য পাওয়া যায়। মেন্টালিস্টদের জীনের গঠন সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখা প্রকাশিত হয়েছে। মেটালিস্টরা তাদের সম্পর্কে সব তথ্যই নিষিদ্ধ করেছে; কিন্তু তাদের জীন নিয়ে গবেষণা নিষিদ্ধ করে নি।

তুমি সেই সব লেখা পড়েছ?

আমি খুব আগ্রহ নিয়ে পড়েছি।

আর কি পড়েছ?

এ্যাংগেল হার্স্ট-এর সেই বিশেষ বক্তৃতাটা এবং বক্তৃতা প্রদানের ঘটনা পড়েছি। এটি পড়েছি ইতিহাস বই-এ।

এ্যাংগেল হার্স্ট কে?

তাকেই মেন্টালিস্টদের জনক বলা হয়। পুরো ঘটনাটা কি স্যার আপনাকে বলব?

বল। তবে অল্প কথায়।

নিউ ম্যাক্সিকো শহরে তিন হাজার পাঁচ খ্রিস্টাব্দে এমব্রায়োলজিস্টদের একটি বিশেষ অধিবেশন হয়। সেই অধিবেশনে বিশিষ্ট এমব্রায়োলজিস্ট প্রফেসর এ্যাংগেল হার্স্ট একটি বিচিত্র নিবন্ধ পাঠ করে সবার হাসি-তামাশার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। নিবন্ধের শিরোনাম—নতুন মানব সম্প্রদায়।

তিনি নিবন্ধে বলেন, মানুষের জীনে ভারি ধাতুর একটি যৌগ ইরিকার্বো ফসফিন ঢুকিয়ে দিতে পারলে মাধ্যমিক মস্তিষ্কের গঠনে সূক্ষ্ম কিন্তু সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন ঘটবে। থ্যালামাস ও হাইপোথ্যালামাসের সুপ্ত কর্মক্ষমতা জাগ্রত হবে। থ্যালামাসের বিশেষ নিউক্লিয়াসের কেন্দ্রস্থল হচ্ছে মানুষের যাবতীয় অনুভূতির কেন্দ্র। যে কটি অনুভূতি নিয়ে মানুষ পৃথিবীতে এসেছে তার সঙ্গে নতুন একটি অনুভূতি যুক্ত হবে। এই মানব সম্প্রদায় হবে প্রচণ্ড মানসিক ক্ষমতার অধিকারী। এরা টেলিপ্যাথিক ক্ষমতাসম্পন্ন হবে। নিজেরা নিজেদের মধ্যে কোনো রকম মাধ্যম ছাড়াই ভাবের আদান-প্রদান করতে পারবে। অন্য মানুষদের তারা সকৰ্মে, সৎ চিন্তায় প্রভাবিত করতে পারবে…

অধিবেশনে প্রবন্ধ পাঠের মাঝখানে সাধারণত বাধা দেয়া হয় না। প্রফেসর এ্যাংগেল হার্স্টকে বাধা দেয়া হল। অধিবেশনের সভাপতি ঘণ্টা বাজিয়ে তাঁকে থামালেন এবং বললেন, প্রফেসর এ্যাংগেল হা, আপনি কি কোনো বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ পাঠ করছেন?

প্রফেসর বললেন, অবশ্যই বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ পাঠ করছি।

আপনি যেভাবে বলছেন তাতে মনে হচ্ছে পরীক্ষাগুলি ইতিমধ্যে করা হয়েছে। মানুষের জীনে ভারি ধাতুর যৌগ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। টেলিপ্যাথিক মানব সম্প্রদায় তৈরি হয়ে গেছে।

হয়নি কিন্তু হবে। আপনি আমাকে প্ৰবন্ধ শেষ করতে দিন তারপর আমি আপনাদের সমস্ত প্রশ্নের জবাব দেব।

ঠিক আছে, প্রবন্ধ শেষ করুন।

প্রফেসর এ্যাংগেল হার্স্ট বিজ্ঞানীদের হাসাহাসির ভেতর প্রবন্ধ পাঠ শেষ করলেন। তাঁর প্রবন্ধের বড় অংশ জুড়ে নতুন মানবগোষ্ঠীর জীবনযাপন পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হল। পৃথিবীতে এরা যে শুভ প্রভাব ফেলবে তার কথা বলা হল।

বিজ্ঞানের ইতিহাসে এমন উদ্ভট এবং অবৈজ্ঞানিক নিবন্ধ পাঠ করা হয় নি। প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হল।

প্রশ্ন : প্রফেসর এ্যাংগেল হার্স্ট, মনে হচ্ছে আপনি নিশ্চিত যে জীনে একটি ভারি অণু ঢুকিয়ে দিলেই আমরা সুপারম্যান পেয়ে যাব।

উত্তর : আমি সুপারম্যান বলছি না। আমি বলছি বিস্ময়কর মানসিক ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ।

প্রশ্ন : আপনার ধারণা, আপনার মানসিক ক্ষমতা তেমন বিস্ময়কর নয়?

[সভাকক্ষে তুমুল হাস্যরোল শুরু হয়। সভাপতি ঘণ্টা বাজিয়ে সবাইকে থামালেন।]

উত্তর: আপনি আমাকে হাস্যস্পদ করার চেষ্টা করছেন। তার প্রয়োজন দেখি না।

প্রশ্ন : জীনে কোন্ ভারি ধাতু ঢকাবার কথা ভাবছেন–প্লাটিনাম?

উত্তর : না ইরিডিয়াম।

প্রশ্ন : ইরিডিয়াম পরমাণু কীভাবে জীনে সংযুক্ত করবেন?

উত্তর: এটি করতে হবে ডিম্বাণু নিষিক্তকরণ প্রক্রিয়ার সময়ে। পদ্ধতি জটিল নয়।

প্রশ্ন : জেনেটিক ইনজিনিয়ারিং-এর পুরো পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল বলে আমরা সবাই জানি এবং আপনিও জানেন।

উত্তর : আমি যে পদ্ধতির কথা বলছি তা মোটেই জটিল নয়।

প্রশ্ন : আপনি নিজেই এই অসাধারণ পদ্ধতি বের করেছেন।

উত্তর : [নীরবতা]

প্রশ্ন : আপনি কি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে চাচ্ছেন না?

উত্তর : আমি নিজে এই পদ্ধতি বের করিনি। আমি একজনের কাছ থেকে পেয়েছি।

প্রশ্ন : দেবদূতের কাছ থেকে পেয়েছেন? সভাকক্ষে আবারো হাসি।

উত্তর: দেবদূতের কাছ থেকে পাইনি, যন্ত্রের কাছ থেকে পেয়েছি।

প্রশ্ন : যন্ত্র আপনাকে বলে গেছে কি করে সুপারম্যান তৈরি করা যায়?

উত্তর : অনেকটা তাই।

প্রশ্ন: আপনার ধারণা এই পদ্ধতি ব্যবহার করে আমাদের সুপারম্যান তৈরি করা উচিত?

উত্তর : অবশ্যই উচিত।

প্রশ্ন : যন্ত্রটি পেয়েছেন কোথায়?

উত্তর: সে এসেছে।

প্রশ্ন : কোত্থেকে এসেছে?

উত্তর ও উত্তর দিতে চাচ্ছি না। উত্তর শুনলে আপনারা আম ভাবতে পারেন।

প্রশ্ন : আপনি কি ইদানিংকালে কোনো সাইকিয়াট্রিস্টকে দিয়ে আপনার মাথা পরীক্ষা করিয়েছেন?

সভাকক্ষে তুমুল হৈ চৈ, হাসাহাসি হতে থাকল। সভাপতি বললেন, প্রশ্নোত্তর পর্বের এখানেই সমাপ্তি। এই নিবন্ধ এখানে পাঠ করার কথা ছিল না। প্রফেসর এ্যাংগেল হার্স্ট অন্য একটি নিবন্ধ জমা দিয়েছিলেন। সেইটি না পড়ে তিনি এই বিচিত্র নিবন্ধ পড়লেন। এটি নিয়ে আর হৈ চৈ করার কোনো মানে নেই। আমি প্রফেসর এ্যাংগেল হার্স্টকে আসন গ্রহণ করবার জন্যে অনুরোধ করছি।

প্রফেসর এ্যাংগেল বললেন, আসন গ্রহণ করার আগে আমি আপনাদের একটি তথ্য দিতে চাই। ইতিমধ্যে আপনারা আমাকে হাস্যকর ব্যক্তিত্ব হিসেবে জেনে গেছেন। আমার মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্বন্ধেও প্রশ্ন উঠেছে। আমি জানি, যে নিবন্ধ আমি পাঠ করেছি তা বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ নয়। পৃথিবীর সেরা এমব্রায়োলজিস্টদের এই সম্মেলনে আমি ঘোষণা করছি যে, নিবন্ধে উল্লেখিত প্রক্রিয়ার প্রয়োগ আমি করেছি। আর্টিফিসিয়াল ইনসেমিনেশন এবং টেস্ট টিউবে ডিম্বাণু নিষিক্তকরণের মাধ্যমে আমি এ পর্যন্ত একুশটি মানব শিশুর জীনে ইরিডিয়ামের একটি করে পরমাণু সংযুক্ত করেছি। এরা এখনো ভূমিষ্ঠ হয়নি। ভূমিষ্ঠ হলেই জানবেন এরা সম্পূর্ণ নতুন এক মানবগোষ্ঠী। এরা মেন্টালিস্ট। এরা বড় হবে। নিজেদের মধ্যে বিয়ে করবে। এদের সন্তান-সন্ততিরাও হবে মেন্টালিস্ট।

আপনার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে।

সময় তা বিচার করবে।

আপনি যে পরীক্ষার কথা বলেছেন তা যদি করে থাকেন তাহলে আপনি শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। এমব্রায়োলজিস্টের এথিক ভঙ্গ করেছেন।

প্রফেসর এ্যাংগেল হার্স্ট যেমন বলেছিলেন তেমনি হল। একুশটি শিশুর জন্ম হল। ভয়ংকর রুগণ সব শিশু। মাত্র সাতজন কোনোক্রমে বাঁচল, তাও ইনকিউবেটরে।

এ্যাংগেল হার্স্টকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হল। এ্যাংগেল হার্স্ট বললেন, মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছেন দিন, শুধু দণ্ডাদেশ চার বছরের জন্যে পিছিয়ে দিন। আমি দেখতে চাই সত্যি সত্যি মানসিক শক্তিসম্পন্ন শিশু তৈরি হয়েছে কি-না।

তাঁকে সেই সুযোগ দেয়া হল না। সুযোগ দিলে তিনি বিস্ময় এবং আনন্দ নিয়ে দেখতেন সাতজন মেন্টালিস্টকে। আজকের বিশাল মেটালিস্ট সমাজের যারা আদি পিতা ও মাতা।

ফিহা বললেন, তুমি বলতে চাচ্ছ প্রফেসর এ্যাংগেল হান্ট-এর এক্সপেরিমেন্ট সফল হয়েছিল?

ইতিহাস তাই বলে স্যার।

যে যন্ত্রের কাছ থেকে তিনি এই বিদ্যা পেয়েছিলেন সেই যন্ত্র খুঁজে বের করার চেষ্টা হয় নি?

ইতিহাস বই-এ আর কোনো তথ্য নেই স্যার।

খুব ভালো কথা। এখন অঙ্কের মডেলটা নিয়ে কাজ শুরু করা যাক।

ফিহা অতি দ্রুত সংখ্যা বলে যেতে লাগলেন। এখন শুধু ডাটা এনট্রি।

স্যার।

ফিহার চিন্তায় বাধা পড়ল। ডাটা এন্ট্রিতে শেষ সংখ্যা কি বলেছিলেন ভুলে গেলেন। তিনি ক্রুদ্ধ চোখে তাকালেন। লীম দাঁড়িয়ে আছে। নিচু বুদ্ধিবৃত্তির রোবটগুলির চেহারাও কি বোকার মতো করে বানানো হয়? কী অদ্ভুত বোকা বোকা লাগছে এই গাধা ধরনের রোবটটাকে।

কি চাও?

আমি কিছু চাই না স্যার।

কেন এসেছ এখানে?

একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

কোথায় দাঁড়িয়ে আছে? গেটে।

কি চায়?

জানি না কি চায়।

ফিহার শরীর জ্বলে যাচ্ছে রাগে। গাধা ধরনের এই রোবটগুলি কেন তৈরি করা হয়?

নাম কি?

আমার নাম লীম।

মেয়েটার নাম জানতে চাচ্ছি।

মেয়েটার নাম মেয়েটা জানে। আমি জানি না।

ফিহা প্ৰচণ্ড ধমক দিতে গিয়েও দিলেন না। হঠাৎ মনে হল নুহাশ নয়ত? সে কি আসবে? তার আসার সম্ভাবনা ছিল মাত্র দশভাগ; কিন্তু.ফি উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর পেছনে পেছনে লীম আসছে। এর হাঁটাচলাও বেকুবের মতো। অকারণে দরজায় ধাক্কা খেল।

ফিহা থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি কেন পেছনে পেছনে আসছ?

জানি না স্যার।

তোমাকে আসতে হবে না।

গেটের বাইরে নুহাশ দাঁড়িয়ে আছে। তার সঙ্গে দুটো ব্যাগ। একটা বেশ বড়, একটা ছোট। প্যাকেট করা এক গাদা বই। একটা ফোল্ডিং ইজিচেয়ার, একটা টেবিল ল্যাম্প। নুহাশ লাজুক গলায় বলল, আপনি আসতে বলেছিলেন, আমি এসেছি।

ঠিক কোন কথাটা বললে ভালো হবে ফিহা বুঝতে পারছেন না। সব কেমন জট পাকিয়ে গেছে। মেয়েটিকে ঐদিন তেমন আকর্ষণীয় মনে হয় নি। আজ অসম্ভব রূপবতী বলে মনে হচ্ছে। কোনো সাজসজ্জা করেছে বলেতো মনে হয় না। তাহলে সুন্দর লাগার কারণ কি? সৌন্দর্য ব্যাপারটা কি? একটা জিনিসকে কেন সুন্দর লাগে, কেন অসুন্দর লাগে?

আমি কি চলে এসে আপনাকে খুব ব্ৰিতকর অবস্থায় ফেলেছি।

না।

আমি আমার সব জিনিসপত্র নিয়ে এসেছি।

ভালো করেছ।

আমি কি বাড়ির ভেতর আসব?

অবশ্যই আসবে। অবশ্যই।

সুন্দর কিছু বলা উচিত। বলতে ইচ্ছাও করছে। কিন্তু সুন্দর কোনো কথা মনে আসছে না। তাঁর কি উচিত না মেয়েটির রূপের প্রশংসা করে কিছু বলা? কি বলা যায়?

নুহাশ বলল, আপনি গেট ছেড়ে সরে না দাঁড়ালে তো আমি ভেতরে আসতে পারছি না।

ফিহা সরে দাঁড়ালেন। তাঁর ইচ্ছা করছে মেয়েটিকে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যেতে, কিন্তু লজ্জা লাগছে। অসম্ভব লজ্জা লাগছে। লজ্জা লাগার কারণ কি?

নুহাশ বলল, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি খুব বিব্রত হচ্ছেন।

না না না। বিব্রত হচ্ছি না। মোটেই বিব্রত হচ্ছি না। অঙ্কের একটা মডেল তৈরি করছিলাম, মাঝখানে তুমি এলে মানে সব এলোমেলো হয়ে গেল। একটা কাজ করা যাক। তুমি ঘরে যাও। লীম তোমাকে সব দেখিয়ে দেবে। কোন ঘরে থাকবে। এইসব আর কি।

লীম কে?

লীম হচ্ছে কর্মী রোবট। বোকা ধরনের তবে ঘরের কাজে খুব পটু। তুমি সব দেখে শুনে নাও। আমি এই ফাকে আমার কাজটা শেষ করি। অবশ্যি বিয়ের লাইসেন্সের জন্যে দরখাস্ত করতে হবে। এটা যদিও তেমন জরুরি নয়। কফি?

কফি খাবে?

আমাকে নিয়ে আপনি ব্যস্ত হবেন না।

ব্যস্ত হচ্ছি না তো। মোটেই ব্যস্ত হচ্ছি না। নুহাশ।

জ্বি।

মেয়েদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় আমি জানি না। কি বললে তারা খুশি হয় তাও জানি না। পদে পদে আমার ভুল হবে, তুমি কিছু মনে কর না। কি করলে তুমি খুশি হবে তা যদি তুমি বল তাহলে আমি তা করব। অবশ্যই করব।

নুহাশ হাসিমুখে বলল, আপনি যদি হাত ধরে আমাকে বাড়িতে নিয়ে যান তাহলে আমি খুশি হব।

ফিহা নুহাশের হাত ধরে বাড়ির দিকে এগুচ্ছেন। পাঠক এবং লীম দুজনই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। পাঠক এমন ভাব করছে যেন সে কিছু দেখছে না। কিন্তু গাধা লীম চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছে এবং খুব মাথা দুলাচ্ছে যেন সে সব বুঝে ফেলেছে। এই গাধাটিকে বাড়িতে রাখাই ভুল হয়েছে। বিরাট বোকামি হয়েছে।

ফিহা লাইব্রেরি ঘরে ফিরে গেলেন। অঙ্কের মডেলটা শেষ করতে হবে। নতুন পরিস্থিতির কারণে সব কাজ কর্ম বন্ধ রাখার কোনো মানে হয় না। তাছাড়া এটা খুব জরুরি, খুবই জরুরি।

Pages: 1 2 3 4 5

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *