Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ফরাসি প্রেমিক || Taslima Nasrin » Page 6

ফরাসি প্রেমিক || Taslima Nasrin

জীবনের কী মূল্য আছে, জীবন যদি যে কোনও সময় ফুরিয়ে যায়, যে কোনও মুহূর্তে মলিনার মতো ফুরিয়ে যায়।

নীলা জানে জীবনের কোনও অর্থ নেই। জেনেও সে হাবিতাত থেকে, ফন্যাক, বি এইচ ভি থেকে, গ্যালারি লাফায়েত থেকে ঘর সাজাবার জিনিস কেনে। প্রয়োজনের তো বটেও, প্রয়োজনের বাইরেও অনেক। টাকা থাকলেও বাড়ি ভাড়া হয়তো পাওয়া যায় না, কিন্তু বাড়ি সাজাবার যা কিছু আছে, সবই পাওয়া যায়। বালিগঞ্জের বাড়িটি মলিনা কখনও পছন্দ মতো সাজাতে পারেননি। সোফা কোথায় বসবে, বিছানাগুলো জানালার কাছে না কি দেয়ালের কাছে, কোন আলমারি কোনদিকে, খাবার টেবিল এদিকে না কি ওদিকে, এসব সিদ্ধান্ত সব অনির্বাণই নিতেন। এমনকী রান্নঘরের সিদ্ধান্তও। আজ খিচুড়ি হবে নাকি সাদা ভাত হবে, মাংস হবেনা মাছ হবে, মাছ হলে মাছের সঙ্গে কি আলু যাবে না পটল, তাও। মলিনা ছিলেন আদেশ পালন করার জন্য। অনির্বাণ বুঝিয়ে দিতেন, এ বাড়ি মলিনার নয়, বাড়ি অনির্বাণের, সুতরাং অনির্বাণ যেভাবে ইচ্ছে করেন, সেভাবেই এ বাড়ির প্রতিটি প্রাণী, বাড়ির প্রতিটি কীটপতঙ্গ, ইটপাথর, গাছপাতা, লতাগুল্ম অব্দি সে ভাবে চলবে। চলেছেও সেভাবে। ততদিন পর্যন্ত চলেছে, যতদিন না নীলা দেশ ছাড়ল আর মলিনা জগৎ।

বিকেলে দোকানের লোকেরা এসে বাড়িতে জিনিসপত্র রেখে যায়, নীলা যেভাবে যেখানে চেয়েছে রাখতে, ঠিক সেখানেই। আরও দুদিন যায় তার বাড়ি পুরো সাজাতে। বারান্দায় নানা রঙের ফুলের টব বসিয়ে দেয়। খাবার টেবিলের ওপর অর্কিড, সোফা-টেবিলের ওপর লিলি আর যে টেবিলটিতে কম্পিউটার রেখেছে, বেনোয়ার কখনও যদি প্রয়োজন হয় কম্পিউটার, সে টেবিলের ফুলদানিতে রাখে দশটি তাজা লাল গোলাপ।

বাড়ি সাজিয়ে নীলা নিজেই ঘরে ঘরে হাঁটে আর মুগ্ধ হয়। একটি শোবার, একটি বসার, একটি লেখাপড়া করার, আর একটি অতিথির শোবার। এরপর কী নীলা? সব তো হল! নীলা নিজেকেই বলে। নিজেকেই উত্তর দেয়, সব কই হল। একা লাগছে তো!

স্নান সেরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তার লোক দেখতে দেখতে নীলা ভাবে কাকে তার চাই। কে হলে তার এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি ভাল লাগবে। এরকম যদি হত, দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ, দরজা খুলে সে দেখবে মলিনা দাঁড়িয়ে আছেন! প্যারিসে কেমন আছে নীলা, মলিনা দেখতে এসেছেন। মলিনাকে জড়িয়ে ধরে, নীলা বলবে, তোমাকে আমি ভালবাসি মা, যা কোনওদিনই তার বলা হয়নি। মলিনাকে বিছানায় শুইয়ে নিজেও সে শোবে পাশে, তারপর জগতের নিষ্ঠুরতার কথা সে বলবে, সব বলবে মলিনাকে। আর কাউকে তো বলা হয় না, নিজের ভেতর জমিয়ে রাখতে রাখতে, মাঝে মাঝে তার বুক এমন ভারী হয়ে থাকে যেন নিতে কষ্ট হয়।

সব আয়োজন শেষে, স্নান শেষে, ক্লান্ত নীলা মলিনার সঙ্গে মনে মনে কথা বলে। ভুলে যায় বেনোয়ার জন্য তার অধীর ব্যাকুলতার কথা। দিন পার হয় ভুলে থেকে, আর রাত যখন শকুনি শরীরে করে ঝুপঝুপ অন্ধকার নিয়ে আসতে থাকে, এ ঘর ও ঘর একা একা হাঁটে নীলা আর নিজের ছায়াটিই দীর্ঘ হতে হতে যখন তার দিকেই এগোতে থাকে, বেনোয়াকে সে তার নতুন জীবনের নতুন ঠিকানা জানায়।

তুমি কী করছ না করছ, আমাকে জানাবে না, আমি কি তোমার কেউ হই না নাকি?

বেনোয়ার অভিযোগের কোনও উত্তর নীলা দেয় না।

বেনোয়া বাড়িতে ঢুকে থতমত খায়, কার বাড়ি এটি?

কী মনে হয়?

আমি জানি না কার বাড়ি এটি। তুমি খুলে বলো।

আমার। নীলা হাসে।

তোমার? বেনোয়া সোফায় বসে চারদিক দেখতে দেখতে ভ্রূ কোঁচকায়।

হ্যাঁ আমার।

তুমি আবার বাড়ি পেলে কোথায়? তুমি না ভাড়া নেবার জন্য বাড়ি দেখছ! আমি তোমাকে সাহায্য করছি ভাড়া নিতে!

তুমি সাহায্য করছ?

করছি না? তোমাকে এমিল জোলার বাড়ি দেখাতে নিলাম, ভজিরায় নিলাম।

ও।

আর কে কে থাকবে এই বাড়িতে।

আমি।

আর?

আর তুমি।

আমি? আমি থাকব কী করে?

নীলা বলে, যদি না চাও, থাকবে না। আমি একা থাকব। ব্যাস।

একার জন্য এত বড় বাড়ি নিয়েছ?

আসলে কী জানো, কলকাতায় বড় বাড়িতে থেকে অভ্যেস। রক্তে কোথাও সম্ভবত অভ্যেস এখনও কিলবিল করে।

চাকরি বাকরি করছ না, এত ভাড়া দেবে কী করে!

তোমাকে আগেও বলেছি চাকরি না করেও আমার চলবে। ভয় পেয়ো না।

হুম।

বেনোয়া মুখ শুকনো করে বসে থাকে।

নীলা বেনোয়ার শুকনো মুখের সামনে নিজের হাসি মুখ তুলে ধরে, তুমি খুশি হওনি?

খুশির কী আছে বলো?

খুশির কিছু নেই? এতদিন দেখেছ আমি এক উদ্বাস্তু ছিলাম, এর বাড়ি ওর বাড়ি থাকতাম। দানিয়েল, আমার সেই বান্ধবী, আমাকে ওর বাড়ি থেকে দূর দূর করে তাড়িয়েছে। ভাল আমি সুনীলের বাড়িতে ছিলাম না। লোকটি আমাকে যাচ্ছেতাই ভাবে অপমান করেছে। আমার আসলে সত্যিকার কোনও আশ্রয় ছিল না। এমনকী উপায় না দেখে হোটেলে উঠেছি। এখন নিজের একটি বাড়ি হল, নিজের বাড়ির স্বাদ কেমন, তুমি তো জানো, তোমার নিজের বাড়ি আছে, তুমি তো বোঝো। বোঝ না, নিজের একটি বাড়ি থাকা কী ভীষণ প্রয়োজন! কী শান্তি এতে। ধরো যতই আমরা পরস্পরকে ভালবাসি না কেন, তুমি যদি বলো তোমার বাড়িতে যেতে এবং থাকতে, তবেই আমার অধিকার আছে তোমার বাড়িতে যাওয়ার এবং থাকার। তুমি যদি রাত তিনটের সময় আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলল, এখন বেরিয়ে যাও, আমার বেরিয়ে যেতে হবে। হবে না, বলো?

বেনোয়া গলা উঁচু করে, তুমি কি পাগল হয়েছ? আমি তোমাকে বেরিয়ে যেতে বলব কেন?

বলোনি, বলতে তো পারো। আমিও পারি। পারি না?

তুমি কি আমাকে চলে যেতে বলছ?

সোফার হাতলে বসে বেনোয়াকে জড়িয়ে ধরে বলে সে

না। মোটেই না। আমি সারাক্ষণ তোমাকে চাই। দিনেও যেমন চাই, রাতেও চাই। জেগে যখন থাকি, চাই, ঘুমোই যখন, চাই।

বেনোয়া চারদিক তাকিয়ে বলে, তুমি কি লটারি জিতেছ নাকি?

হালকা সবুজ পর্দা জানালায়, হালকা সবুজ সোফার রং, বিছানার চাদরও হালকা সবুজ রঙের।

তোমারও বুঝি হালকা সবুজ রং পছন্দ।

নীলা হেসে বলল, না, আমার পছন্দ নীল রং।

তবে সব হালকা সবুজ কেন?

সে তোমার পছন্দ বলে।

বেনোয়া ঠোঁট কামড়ে মিষ্টি হাসি হাসে।

তর্জনীতে বেনোয়ার ঠোঁট ছুঁয়ে নীলা বলে, বাসলে আমি এভাবেই বাসি ভাল, একশো ভাগ।

তুমি কি জাদু জানো নাকি! এই কদিনে কী কাণ্ড করে ফেললে বলো তো।

নীলা তুড়ি বাজায়। তুড়ি বাজালেই সব হয়।

অবশ্য টাকা থাকলে দুদিনে কেন দু মিনিটে সব হয়। বেনোয়া বড় শ্বাস ফেলে।

উঠে সে শোবার ঘরে যায়, কোমরে হাত রেখে হালকা সবুজ বিছানা, বিছানার দু কিনারের দুটো টেবিল, টেবিলের ওপর দুটো ঢাকনাঅলা বাতি, দেয়াল জুড়ে কাঠের আলমারি দেখে আর জিভে চুক চুক করে, ইকিয়া থেকে কিনলে খুব সস্তায় কেনা যেত। অপেক্ষা করলে পারতে। আমি তোমাকে নিয়ে যেতে পারতাম ইকিয়ায়।

টোকা মেরে খাটের, টেবিলের, চেয়ারের, আলমারির কাঠ পরখ করেও চুক চুক করে, এসব তো ভাল কাঠের দেয়নি। তুমি রীতিমতো ঠকেছ। কোত্থেকে কিনেছ?

হাবিতাত।

হাবিতাত কোনও দোকান হল? বাজে জিনিসপত্র সব। এসব কেনার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করবে না! উফ। কী যে বোকামো করো তুমি!

বেনোয়ার হাত টেনে আলমারির কাছে এনে নীলা বলে, খোলো এটা, দেখো। বেনোয়া খুলে বলল, এটা কত দিয়ে কিনেছ? নিশ্চয় এ টাকায় অন্য দোকানে আরও ভাল পেতে।

ভেতরে দেখো কী আছে?

বেনোয়া দেখল, ছেলেদের জামাকাপড়, এমনকী জুতো, শেভিংএর জিনিসপত্র, অডি তয়লেত।

কার এসব?

অনুমান করো তো!

কিষানের?

প্রশ্নই ওঠে না।

তা হলে কার?

অনুমান করো।

সুনীলের?

সুনীলের জিনিসপত্র এখানে থাকবে কেন?

তবে কার?

অনুমান করো।

পারছি না।

নীলা হাসে, বেনোয়ার বুকে আঙুল বুলিয়ে নিবিড় কণ্ঠে বলে, তোমার।

নীলা, তোমার কি মাথা টাথা খারাপ হয়েছে? খেঁকিয়ে ওঠে বেনোয়া।

কেন?

আমার তো সব আছে এগুলো। ধপাস করে সে বসে বিছানায়। হালকা সবুজ বিছানায়। তার পছন্দের রঙের বিছানায়।

তাতে কী! তবে জুতো নিয়ে খানিকটা সন্দেহ আছে। দেখো তো এ জুতো পায়ে লাগে কি না। কালো একজোড়া ইতালিয়ান জুতো প্যাকেট খুলে বেনোয়ার পায়ের কাছে রেখে বলে নীলা।

জুতো? মাপ কী?

মাপ জানি না, চোখের অনুমানে মনে হল এ হবে তোমার।

বেনোয়া জুতোর পেছনে নম্বর দেখে সরিয়ে রাখে জুতো, না এ আমার মাপের নয়।

এসব তুমি আমার জন্য কিনেছ? কেন? বেনোয়ার প্রশ্ন, পনেরো ভাঁজ কপালে, চোখে।

বেনোয়ার পাশে ঘন হয়ে বসে কাঁধে মাথা রেখে নীলা বলে, তোমাকে ভালবাসি, তাই।

আরও একটি চমক এখনও বাকি। নীলা যখন শেষ ঘরটিতে বেনোয়াকে নিয়ে গেল, বইয়ের তাকে সারি সারি বই, টেবিলে কম্পিউটার।

বেনোয়া চোখ নাচিয়ে বলে, তুমি বুঝি কম্পিউটারও ব্যবহার করবে?

না, যন্ত্রে আমি মোটেও অভ্যস্ত নই, এ তোমার জন্য।

আমার জন্য? আমার তো কম্পিউটার আছে। বেনোয়া শব্দ করে হাসার চেষ্টা করে।

তা জানি, আছে।

রিভলভিং চেয়ারে বসে বৃত্তাকারে নিজেকে ঘোরাতে থাকে বেনোয়া। গোলাপের কিনার থেকে দুটো কালচে পাতা সরিয়ে নিতে নিতে নীলা বলে, এ বাড়িতেও যদি ইচ্ছে হয় তোমার কম্পিউটার ব্যবহার করতে!

কত গিগাবাইট এতে?

তা জানি না।

র‍্যাম কত আছে তা জানো?

তাও জানি না। বেনোয়া আবারও জিভে চুক চুক শব্দ করে।

নীলা চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে বেনোয়ার চুলে আঙুল ডুবিয়ে দেয়, চুমু খায় ঘন সোনালি চুলে।

তোমার পছন্দ হয়নি?

আচ্ছা তুমি যে এটি কিনলে, বোতাম টিপে কম্পিউটার চালু করে, বলে বেনোয়া, তুমি কি আমার চেয়ে কম্পিউটার ভাল জানো?

আমি তো তা বলছি না আমি তোমার চেয়ে বেশি জানি। তুমি ব্যবহার করবে বলে কিনলাম। নীলা মিষ্টি হেসে বলে।

আমি তো এই ধরনের কম্পিউটার ব্যবহার করি না। খামোকা টাকা খরচ করলে। আবার চুক চুক।

টাকা খরচের কথা ভেবো না। কোন ধরনের পছন্দ করো বলো, আমি এটা পালটে নেব।

তুমি বললেই ওরা পালটে দেবে নাকি? বেনোয়ার কপালে চোখের কোণে সেই পনেরো ভাঁজ।

ঠিক আছে কম্পিউটার তোমার পছন্দ হয়নি, ফুলগুলো?

নীলা ঘ্রাণ নেয় গোলাপের। ফুলগুলো দেখতে ভাল, বেনোয়া বলে কিন্তু ঘ্রাণ নিতে এগোয় না। ফুল পশ্চিমিদের কাছে বেশির ভাগই দেখার জিনিস, ঘ্রাণ শোঁকার নয়, নীলার মন বলে।

এসব বই প্যারিস থেকে কিনেছ? বইয়ের তাকের কাছে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে বেনোয়া।

কিছু এখান থেকে, কিছু কলকাতা থেকে আনা।

সব তো দেখছি ক্লাসিক।

সব নয়। কিছু। নিজের একটি বাড়ি হবে, নিজের একটা বইয়ের ঘর হবে, এ শখ আমার অনেক দিনের।

ইউলিসিস-এর দিকে আঙুল তুলে, ওটা পড়েছ।

নীলা ঠোঁট ওলটায়, কোনওদিনই কুড়ি পাতার বেশি পড়তে পারি না, সম্ভবত পারবও না।

বেনোয়া উঠে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলে, কফি খেতে হবে আমার, আছে?

পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে নীলা বলে, নিশ্চয়ই।

রান্নাঘরের দরজায় হেলান দিয়ে বলে, তবে কী জানো, কফি আমি বানাতে জানি না।

বেনোয়া নিজেই কফি বানাতে শুরু করে। নীলা পাশে দাঁড়িয়ে বলে, আমি হলাম চা খোর, তুমি তো জানোই।

নীলা শিখে নেয় কী করে মেশিনে কফি বানায়, বেনোয়া বলে বলে দেয়। প্রথম ফিল্টার দেবে, তারপর কফি, তারপর এদিকটায় জল, ফিল্টার চুঁইয়ে চুঁইয়ে কফি এসে তলে জমা হবে।

খাবার টেবিলে কফি নিয়ে বসে বেনোয়া, নীলা নিজের জন্য এক কাপ চা করে নিয়ে মুখোমুখি বসে। চোখ হাসছে তার, ঠোঁট হাসছে। বেনোয়া চামচে কফি নাড়তে নাড়তে বলে, আচ্ছা তুমি টম ক্লেন্সির বই পড়েছ?

না।

স্টিভেন কিং?

না।

এড ম্যাকবেইন? টরি ব্রুকস?

না।

তারপর ধরো, বেনোয়া সময় নেয়।

নীলা বলে, আসলে বিদেশি সাহিত্য আমি বেশি পড়িনি। বেশির ভাগই বাংলা।

এলমোর লেনার্ড?

না।

জর্জ সিমেনো?

না।

ডেভিড এডিংস?

না।

বেনোয়া কফিতে চুমুক দেয়।

টেরি প্র্যাটচেট পড়েছ?

নীলা শুকনো মুখে বলে, না পড়িনি।

তুমি টেরি প্র্যাটচেটের বই পড়নি?

না।

বলো কী? এত বিখ্যাত লেখকের বই পড়নি।

দু একটা নাম বলো তো!

জাদুর রং, পিরামিড, মজার সময়, আত্মার সংগীত।

নীলা মাথা নাড়ে।

নামও শোনোনি?

না।

বই পড়তে ভালবাসো, অথচ, ঠিক আছে ভেবো না, তোমাকে আমি টেরি প্র্যাটচেটের বই দেব কিছু।

বেনোয়া আরও কফি ঢেলে নেয় কাপে।

কী ধরনের উপন্যাস লেখেন তিনি? নীলা খালি চায়ের কাপ সামনে নিয়ে বসে থাকে।

সে কী বলব, তুমি যদি শুরু করো, শেষ না করে উঠতে পারবে না।

এমনই?

হ্যাঁ এমনই।

বেনোয়ার চোখ হাসে, গা হাসির দমকে কাঁপে, সে কাঁপুনিতে কফির কাপ নড়ে ওঠে, ছলকে কফি পড়ে টেবিল ভিজিয়ে দেয়। বেনোয়া খেয়াল করে না, বলে যায় পৃথিবী হচ্ছে, বুঝলে, চেয়ার সরিয়ে হঠাৎ উঠে যায়, দৌড়ে শোবার ঘরের দিকে, ফিরে আসে হাতে একটি সি ডি নিয়ে, বসে, হেসে, বলে, এর মতো দেখতে।

মানে?

পৃথিবীর আকার আকৃতি এর মতো। তবে এত ছোট নয়, অনেক বড়।

নীলা হাত বাড়িয়ে ফলের ঝুড়ি থেকে একটি কমলালেবু হাতে নিয়ে বলে, পৃথিবী তো জানি এটির মতো দেখতে।

ধ্যুৎ, নীলাকে থামিয়ে, শোনোই না তারপর। চারটে বিশাল হাতির কাঁধে এই পৃথিবীটা। চারটে হাতি আবার দাঁড়িয়ে আছে একটি বিশাল কচ্ছপের ওপর, কচ্ছপটি শূন্যে ভাসছে।

কমলালেবুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে, বেনোয়ার তখনও শেষ হয়নি গল্প, নীলা বলে, তুমি এসব বিশ্বাস করো?

বিশ্বাসের কিছু নেই। এ গল্প, মজার গল্প।

এরকম মজার গল্প আমি অবশ্য ছোটবেলায় পড়েছি। ঠাকুরমার ঝুলি।

কী ঝুলি?

ঠাকুরমার ঝুলি!

এ আবার কী?

এ বাচ্চাদের গল্পের বই। অবশ্য বাংলায়।

বাংলায়, সে বলো। বেনোয়া জোরে হাসে। বাংলা বই সম্পর্কে জানার কোনও কারণ আমার নেই।

নীলা দুটো হাত টেনে নেয় বেনোয়ার। বলে, দেখবে না আর কী অপেক্ষা করছে তোমার জন্য?

বেনোয়া ঠাণ্ডা গলায় বলে, কী?

ময়েট এ শ্যানডন শ্যাম্পেন এনে সে হাতে দেয় বেনোয়ার।

নতুন বাড়িতে প্রথম যা করতে হয়, শ্যাম্পেনে ভেসে যাওয়া। কী বলো?

গাড়ি চালাতে হবে, এ সময় মদ খাওয়া ঠিক হবে না।

নীলা চমকায়। বেনোয়াকে এত সতর্ক হতে আগে কখনও দেখেনি সে।

তুমি তো মদ খেয়েও গাড়ি চালাও।

হয়তো চালিয়েছি, কিন্তু উচিত না।

আজ এ নতুন বাড়িতে, শ্যাম্পেন খুলতে গিয়ে উচিত অনুচিত দেখছ! আরে খোলো তো শ্যাম্পেন, কিছু হবে না।

নীলা দুটো শ্যাম্পেনের গেলাস সামনে রাখে।

বেনোয়া বড় শ্বাস ফেলে, তুমি চাইছ, খুলতে তো হবেই।

মলিন মুখে বেনোয়া শ্যাম্পেন খোলে। সশব্দে উপচে পড়ে ফেনা। নীলার উল্লাসধ্বনি সেই শব্দকে ম্লান করে দেয়।

শ্যাম্পেনের গেলাস হাতে নীলা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। বেনোয়াও।

কী চমৎকার হাওয়া বইছে তাই না?

হ্যাঁ বইছে অথবা না বইছে না শব্দগুলোর আগে ফোনের শব্দ হয়, বেনোয়ার পকেটে। কথা বলতে সে ঘরের ভেতর ঢুকে যায়। নীলা দাঁড়িয়েই ছিল, ফুরফুরে হাওয়ায় চোখ বুজে। ফিরে এসে বেনোয়া বলে, পাসকাল কাল প্যারিসে ফিরছে।

হাতে শ্যাম্পেনের গেলাস নড়ে ওঠে, নীলা দ্রুত চুমুক দেয় গেলাসে।

শ্যাম্পেনটা বেশ ভাল, তাই না?

নীলা, পাসকাল কাল প্যারিসে ফিরছে।

শুনেছি।

শুনেছ, কিছু বলবে না?

আমি কী বলব, বলো।

তুমি কি জানো পাসকালকে আমি আমাদের কথা সব বলেছি!

না তুমি বলোনি আমাকে।

এখন বললাম, পাসকাল আমাদের সম্পর্কের কথা জানে।

তো আমাকে কী করতে হবে, বলো।

তুমি কি জানো, আমার আর পাসকালের একটি মেয়ে আছে, নাম জ্যাকলিন?

জানি।

তুমি কি অনুমান করতে পারছ পাসকালের জন্য আমাদের এ সম্পর্ক মেনে নেওয়া অসম্ভব একটি ব্যাপার!

গেলাসে আরও শ্যাম্পেন ঢালতে নীলা ভেতরে যায়। পেছন পেছন বেনোয়া।

কী ব্যাপার উত্তর দিচ্ছ না যে!

নীলা শ্যাম্পেন ঢালে নিজের গেলাসে। বেনোয়ার গেলাসে ঢালতে গেলে, সরিয়ে নেয় সে গেলাস, টেবিলে শব্দ করে রেখে দেয়।

কাঁধ ধরে ঝাঁকায় সে নীলার, কিছু বলছ না কেন? তুমি কি বোবা হয়ে গেলে হঠাৎ, এতক্ষণ তো বেশ কথা বলছিলে? বাড়ি ঘর দেখালে, কত দামি জিনিস কী কী কিনেছ সব দেখালে। এখন বলো!

নীলা বসে ঢকঢক করে জল পান করার মতো শ্যাম্পেন পান করে, করে বেনোয়ার চোখে তাকায়। সেই চোখে, সেই নীল চোখে, তার ভালবাসার চোখে।

আমি জানি, নীলা বলে, পাসকালের পক্ষে এ মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তুমি ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে নাও। তারপর আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ কোরো না। আমিও করব না।

বেনোয়া তার খালি গেলাসটি মেঝেয় ছুঁড়ে ফেলে চেঁচিয়ে ওঠে, এই কি তুমি চাও?

নীলা কেঁপে ওঠে বেনোয়ার বিকট শব্দে।

টেনে তাকে চেয়ার থেকে ওঠায়, সামনে দাঁড় করিয়ে বেনোয়া বলে, আমার চোখের দিকে তাকাও।

নীলা মেঝেয় টুকরো কাচের দিকে তাকিয়ে থাকে।

ওদিকে কী দেখছ? তোমার দামি গেলাস ভেঙে দিয়েছি?

বেনোয়ার চোখে তাকায় সে, চোখে উৎকণ্ঠা কাঁপে।

তুমি কি আমাদের সম্পর্ক শেষ করে দিতে চাও? এ তোমার মনের কথা?

নীলার চোখের কোনায় দুফোঁটা জল থমকে থাকে। চিবুক উঁচু করে ধরে চোখের জল দেখে বেনোয়া, যতক্ষণ না সে জল গড়িয়ে নামে।

ভাঙা কণ্ঠে নীলা বলে, না আমি চাই না।

নীলাকে বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বেনোয়া উন্মাদের মতো চুমু খায়। শরীর অবশ হতে থাকে নীলার।

অবশ হতে থাকা শরীরটিকে বিছানায় নিয়ে বুকে মুখ ঘসতে ঘসতে বেনোয়া বলতে থাকে, জ তেম জ তেম জ তেম।

স্বস্তির শ্বাস ফেলে নীলা। মলিনাকে কি কখনও এভাবে ভালবেসেছেন অনির্বাণ। যেভাবে তাকে জড়িয়ে ধরে আছে বেনোয়া, অনির্বাণ কখনও মলিনাকে এভাবে জড়িয়ে ধরেননি, কখনও বলেননি, যে তিনি মলিনাকে ভালবাসেন। মলিনা যদি পাখি হয়ে বসতেন ওই জানালায়, একবার দেখতেন কেউ তাঁর কন্যাকে ভালবাসছে…।

এই, কী ভাবো?

নীলার চিবুক ধরে নিজের দিকে ফেরায় বেনোয়া।

নীলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কিছু না।

কিছু তো নিশ্চয়ই। আমাকে বলো।

তুমি আমাকে সত্যিই ভালবাসো বেনোয়া?

কেন এ কথা জিজ্ঞেস করছ, বোঝো না?

মাঝে মাঝে…

কী মাঝে মাঝে?

মাঝে মাঝে আমার কাছে অবাক লাগে, যে তুমি আমাকে ভালবাসো। আমি কে, বলো? আমি কিছু না। কেউ না। আত্মীয় বলো, বন্ধু বলল, কেউ নেই আমার। ভাঙাচোরা জীবন আমার।

তোমার আমি আছি তো! আমি তোমাকে সব দেব, সব দেব।

বেনোয়া নীলাকে সব দেয়। শরীরে যতটা নীলার প্রয়োজন, তারও চেয়ে বেশি দেয়। একবার নয়, বারবার দেয়। সারারাত দেয়।

ভোরের আলো নীলার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালে নীলা বলে, এই ঘুমোবে না নাকি! সাতবার হল কিন্তু।

বেনোয়া বাঁ হাতের ওপর মাথার ভর রেখে কাত হয়ে ডান হাতে তার প্রিয় চেরিদুটো নিয়ে খেলা করতে করতে বলে, তুমি আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছ নীলা। কী যে আশ্চর্য সম্পদ তোমার ভেতরে, যত ভেতরে যাই, তত ইচ্ছে করে যেতে, প্রতিবার যেন প্রথমবারের মতো যাচ্ছি, প্রতিবার যেন নতুন করে দেখছি তোমাকে, যত তৃষ্ণা মেটাই, তৃষ্ণা আরও বাড়ে। সবচেয়ে ভাল লাগে তুমি যখন আনন্দে কাতরাতে থাকো, দেখতে। তুমি যখন আমার পিঠ খামচে ধরো প্রচণ্ড সুখে, পৌরুষ সার্থক মনে হয় আমার!

সকালে নীলাকে নরম স্পর্শে জাগায় বেনোয়া। সুপ্রভাত মাদাম। বেনোয়ার হাতে ট্রে, ট্রেতে কোয়াসোঁ, আর চা। সকালের স্নিগ্ধতা বেনোয়ার সারা মুখে।

নীলা বিছানায় শুয়ে চা পান করে না তো করে অমৃত পান।

বেনোয়া বলে, কাল আমার মাথার ঠিক ছিল না নীলা। আমি খুব দুঃখিত।

নিজের কফি নিজেই বানিয়ে নিয়েছে বেনোয়া, নীলা দেখে আর ভাবে, একদিনও সে অনির্বাণকে বা কিষানলালকে দেখেনি নিজে কফি বা চা বানাতে। কোনওদিনও শোনেনি, কোনও ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে। নীলা মুগ্ধ চোখে বেনোয়াকে নয়, দেখে নিজেকে। নিজের সৌভাগ্যকে।

সকালবেলা অনেকক্ষণ দেখেছি তোমার ঘুমন্ত মুখ। কী সুন্দর শিশুর মতো ঘুমোচ্ছিলে। তোমার যেন ঘুম না ভাঙে, পা টিপে উঠে শ্যাম্পেনের ভাঙা গেলাস সরালাম, তোমার যেন পা না কাটে, ও জায়গাটা ভাল করে ঝাড়ু দিয়ে দিলাম। তারপর স্নান করলাম, বুলনজেরি থেকে কোয়াসোঁ কিনে আনলাম, চা বানালাম, তারপর তোমাকে ডেকে তুললাম।

গুনে গুনে নীলাকে একশো চুমু খেয়ে, বাড়ির দরজার দুটো চাবির মধ্যে থেকে একটি তুলে নিয়ে, বেনোয়া আপিসে যায়। আপিস থেকে ঘণ্টায় দুবার ফোন করে জানায়, সে নীলাকে ভালবাসে। শেষে এও জানায়, পাসকালকে তুলে আনতে আজ আপিস ছুটির পর তার ইশটিশনে যেতে হবে। ইশটিশন থেকে সোজা রু দ্য রেনে। আর পাসকালের জন্য না হলেও জ্যাকলিনের জন্য তাকে বাড়ি থাকতে হবে। দেখা হচ্ছে না।

নীলা দিন পার করে শুয়ে বসে, দুএকটি বইয়ের কিছু পাতা পড়ে, সন্ধের পর টেলিভিশন খোলে, বন্ধ করে। শুয়ে থাকে, উঠে বসে। জ্যাক ব্রেলের গান শোনে। গান বন্ধ করে। বারান্দায় দাঁড়ায়, ফিরে আসে। রান্নাঘরে ঢোকে। রান্না করতে ইচ্ছে করে না। ফোনের কাছে যায়, রিসিভার হাতে নেয়, রেখে দেয়। বালিশে মুখ গোঁজে, চাদরে মুখ মাথা ঢাকে, চাদর সরিয়ে ফেলে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটি একটি করে পরনের কাপড় খোলে, নিজেকে দেখে, কাপড় পরে আয়নায় নিজেকে ভেংচি কেটে, কাঁদো মুখ করে, স্মিত হেসে, হা হা হেসে, সরে আসে। একা বসে গান গাইতে গীতবিতান হাতে নেয়, গাইতে গিয়ে লক্ষ করে গলার স্বর বুজে আসছে, গীতবিতান রেখে দেয়।

আর রাত হলে বিছানায় শুয়ে সে খোলা জানালায় কালো আকাশ দেখতে দেখতে ভাবে, বেনোয়া পাসকালকে চুমু খাচ্ছে, ঠিক যেমন করে চুমু খায় নীলাকে। জ্যাকলিনকে ঘুম পাড়িয়ে পাসকাল শোবার ঘরে এসেছে, আর তাকে জড়িয়ে ধরে বেনোয়া বলছে জ তেম জ তেম জ তেম। জ তেম প্যাশনোমো, জ তেম সিরিয়াসোমো। তারপর ঠিক যেমন করে নীলাকে উলঙ্গ করে বেনোয়া, তেমন করে করছে পাসকালকে। নীলার স্তনবৃন্ত দুটোর নাম যদি চেরি হয়, পাসকালের ও দুটো লিঙমবেরি তবে। পাসকালের সাদা ত্বক স্পর্শ করে বেনোয়া উল্লাসে ফেটে পড়ছে আর বলছে, কী সুন্দর রং তোমার, কী মসৃণ তোমার ত্বক, ঠিক যেমন করে নীলার রং দেখে সে বলে। পাসকালের ভেতর ঢোকার জন্য বেনোয়ার পুরুষ অঙ্গ ফুলে ফেঁপে উঠেছে, ফুঁসছে। সারারাত পাসকালকে ঠিক তেমন করে সুখ দিচ্ছে, যেমন করে নীলাকে দেয় বেনোয়া।

পাসকাল নামের এক অদৃশ্য আততায়ীর উত্তপ্ত শ্বাস নীলার সারা গা পোড়াতে থাকে।

পাঁচটা থেকে সাতটা

পরের সপ্তাহে প্রতিদিনই বেনোয়া বিকেল পাঁচটায় আসে নীলার বাড়িতে, সাতটায় চলে যায়। যেতে হয়, কারণ পাসকালের সঙ্গে তার রাতের খাবার খেতে হবে। যেতে হয়, কারণ জ্যাকলিনের সঙ্গে তার ভূত ভূত খেলতে হবে। কোনওদিন আবার ওদের নিয়ে রেস্তোরাঁয় যেতে হয়, কোনওদিন বন্ধুর বাড়ি নেমন্তন্ন।

নীলা সারাদিন বাড়িতেই থাকে। কোথাও যাবার নেই তার। বেনোয়া পাঁচটায় আসবে এই অপেক্ষায় তার সারাদিন কাটে। আর সন্ধেয় বেনোয়া চলে যাবার পর সারা শরীরে বেনোয়ার গন্ধ স্পর্শ আগলে রেখে বাকি রাত কাটায় সে।

শুক্রবার বিকেলে বেনোয়া এসে যখন প্রতিদিনকার মতো চুমু খেতে যায়, নীলা সরিয়ে নেয় নিজেকে।

কী ব্যাপার, হল কী তোমার?

পাসকালকে কি এভাবেই চুমু খাও?

এসব জিজ্ঞেস করছ কেন? তুমি তো সব জেনেই আমাকে ভালবেসেছ। তুমি তো জানতেই যে আমি বিবাহিত।

নীলা অস্বীকার করতে পারে না। সে অস্বীকার করতে পারে না সব জানার পরও তার ইচ্ছে করে বেনোয়ার চুমুতে অবশ হতে, ইচ্ছে করে বেনোয়ার বেনো জলে ভাসতে, ডাল পাতা ভেঙে নেওয়া ভীষণ ঝড়ের কবলে পড়তে।

আর বেনোয়া সেই ঝড়ের দূত হয়ে নীলার শরীরে ঝুঁকতেই নীলা সরে যায়। জিজ্ঞেস করে, তুমি কি পাসকালের সঙ্গে এসব করো?

বেনোয়া দুহাত ছড়িয়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়ে। ওর নীল চোখ দুটো পাপড়িতে ঢাকা, কেবল শিশ্নের লাল চোখ আকাশপানে।

নীলা অপেক্ষা করে বেনোয়ার উত্তরের।

তুমি কি জানো না যে আমি পাসকালকে ভালবেসে বিয়ে করেছি?

জানি।

তবে কেন এসব জিজ্ঞেস করো।

তোমাকে কারও সঙ্গে ভাগ করতে আমার কষ্ট হয়।

নীলা, এত স্বার্থপর তুমি!

নীলা দমে যায়। সে টের পায় নিজের স্বার্থপরতা।

একবার পাসকালের কথা ভাবো, ও আমাকে ভালবাসে।

তুমিও তো ওকে ভালবাসো, তাই না?

শোনো নীলা, আমি মিথ্যে বলি না। অন্য যে কোনও বিবাহিত পুরুষ তার প্রেমিকাকে বলে আমি আমি আমার বউকে ঘেন্না করি, কেবল তোমাকেই ভালবাসি। কিন্তু, নীলা, আমি এ নিয়ে ভেবেছি অনেক, কাকে আমি ভালবাসি, তোমাকে না পাসকালকে। আমি, সত্যি কথা, দুজনকেই ভালবাসি।

দুজনকে ভালবাসা যায়?

যাবে না কেন? নিশ্চয়ই যায়।

আমি তো কল্পনা করতে পারি না অন্য কোনও পুরুষকে ভালবাসার, তার সঙ্গে শোয়ার!

কিছু কিছু বাস্তবতার মুখোমুখি না হলে সেগুলো কল্পনারও অতীত থেকে যায়। লাল চোখ জানালাপানে। তুমি বুঝবে না নীলা, তুমি ভালবেসে বিয়ে করোনি, তোমার কোনও সন্তান নেই। তোমার পক্ষে বোঝা সম্ভবও নয়।

বেনোয়া ওভাবেই উলঙ্গ উঠে গিয়ে মেঝেয় ফেলা প্যান্টের পকেটে থেকে ওয়ালেট বের করে আনে।

ওয়ালেটের ভেতরের খোপ থেকে চারটে রঙিন ছবি বের করে, জ্যাকলিন আর পাসকাল, জ্যাকলিন চুমু খাচ্ছে পাসকালের গালে, আর একটিতে বেনোয়া পেছন থেকে পাসকালকে জড়িয়ে ধরে আছে, পাসকাল হাসছে, পাসকালের কোলে বসে হাসছে জ্যাকলিন। আর একটিতে পাসকাল আর বেনোয়া। আরেকটি একা জ্যাকলিন, দু বছর আগের। ছবিগুলো নীলা দেখে, নীলার চেয়ে বেশি সময় নিয়ে দেখে বেনোয়া। লাল চোখ বুজে আসতে থাকে।

দেখো, জ্যাকলিন দেখতে ঠিক আমার মতো হয়েছে, ঠিক না?

নীলা অনেকক্ষণ দেখেও সামান্য মিল খুঁজে পায় না দুটি মুখে।

দেখো, ওর নাক, একেবারে আমার নাক যেন বসিয়ে দেওয়া।

তাই কি? ওর নাক তো ছোট। নীলা আস্তে বলে।

তা ছোট! কিন্তু বড় হতে কদিন।

কানদুটো দেখো তো! কান প্রসঙ্গে নীলা আর কিছু বলে না, জ্যাকলিনের কান বড় হয়ে বেনোয়ার কানের মতো হতে আর কতদিন।

তোমার চুল তো সোনালি, ওর চুল কেমন লালচে লাগছে না!

পাসকালের চুল লাল তো, তাই। কিন্তু পাসকাল বলেছে, জ্যাকলিনের চুলের রং নাকি লাল আর থাকছে না, ধীরে ধীরে সোনালি হচ্ছে।

ও।

কী অদ্ভুত সুন্দর জ্যাকলিন, দেখেছ!

নীলা ছবিটি হাতে নেয়, লাল ফুটিতে গাল ভর্তি, ফিনফিনে কটি লাল চুল মাথায়, হাসিতে লাল মাড়ি বেরিয়ে আছে, আর দুটো পোকা খাওয়া দাঁত।

হ্যাঁ দেখেছি। নীলার নিরুত্তাপ স্বর।

পৃথিবীতে এত সুন্দর আর কোনও শিশু নেই নীলা, নেই।

ছবিটি বুকের ওপর নিয়ে বেনোয়া তৃপ্তির হাসি হাসে।

আমার বেঁচে থাকার কারণ হচ্ছে জ্যাকলিন। আমার জীবনের যদি কোনও অর্থ থাকে সে জ্যাকলিন।

চকিতে উঠে, বেনোয়া প্রশ্ন করে, জ্যাকলিনকে তোমার দেখতে ইচ্ছে করে না?

নীলা ঠিক বুঝে পায় না কী উত্তর সে দেবে। জ্যাকলিন তার কাছে আর যে কোনও শিশুর মতো। দল বেঁধে সাদা শিশুদের নীলা প্রায়ই দেখে বাসে চড়ে মাস্টারদের সঙ্গে জাদুঘর দেখতে যাচ্ছে। এদের যে কোনও একটি শিশুই জ্যাকলিন।

জ্যাকলিন আমার অস্তিত্বের একটি অংশ নীলা, আমাকে যদি ভালবাসো, জ্যাকলিনকেও তোমার ভালবাসতে হবে।

জ্যাকলিনের সঙ্গে আমার কখনও দেখা হয়নি। ভালবাসা তো আকাশ থেকে গড়িয়ে নামে না, যে কোনও সম্পর্কই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। নীলা শান্ত কণ্ঠে বলে।

একটি দুধের শিশুকে তুমি ভালবাসতে পারো না নীলা, ছি। মানুষ তো যে কোনও শিশুকে ভালবাসে। তুমি হিংসে করো জ্যাকলিনকে!

বাজে কথা বোলা না তো। জ্যাকলিনকে আমি হিংসে করতে যাব কেন!

তাই তো অবাক হচ্ছি, একটি শিশুর সঙ্গে তো তোমার কোনও বিরোধ নেই। তুমি তো অনায়াসে একটি শিশুকে ভালবাসতে পারো। পারো না?

পারি, সে শিশু যদি চমৎকার হয়।

জ্যাকলিন যে চমৎকার নয় সে জানো কী করে?

জ্যাকলিন চমৎকার নয়, সে তো আমি বলছি না। জ্যাকলিন হয়তো খুব চমৎকার একটি মেয়ে, ওর সঙ্গে সম্ভবত ভাল বন্ধুত্ব হবে আমার। ওকে হয়তো ভালবাসব খুব। ভালবাসব ওকে, ও চমৎকার বলে, তোমার মেয়ে বলেই যে ওকে আমার ভালবাসতে হবে, এ ঠিক নয়। এ কৃত্রিমতা। জোর করে আর যাই হোক, ভালবাসা হয় না।

ধরো তোমার যদি একটা মেয়ে থাকত, তুমি কি চাইতে না ওকে আমি ভালবাসি, ওকে আমি আমার নিজের মেয়ের মতো ভালবাসি?

চাইতাম, কিন্তু তোমাকে জোর করতাম না।

আমি তাকে ভালবাসলে তোমার ভাল লাগত তো!

হ্যাঁ লাগত।

তবে বোঝো না কেন, জ্যাকলিনকে তুমি যদি ভালবাসো, তাহলে আমারও ভাল লাগবে। পরস্পরের কী ভাল লাগে, কী পেলে কী হলে আমরা খুশি হই, আমাদের তো তাই দেখতে হবে। তুমিও তো তাই দেখেছ! আমি হালকা সবুজ রং পছন্দ করি বলে, তুমি ওই রঙের জিনিস কিনেছ। কেনোনি? তোমাকে তো জোর করেনি কেউ!

নীলা বিছানা ছেড়ে যায়। তার মনে হয় বেনোয়া এরপর আবদার করবে পাসকালকে ভালবাসার জন্য। পাসকালকে নীলার ভালবাসতে হবে, কারণ পাসকাল বেনোয়ার বউ, ঈশ্বর যার সঙ্গে বেনোয়ার জুটি গড়ে দিয়েছেন, বেনোয়াকে ভালবাসলে পাসকালকেও ভালবাসতে হবে, না হলে নীলা হবে হিংসুটে কুচুটে একটি মেয়ে।

বেনোয়া হাত বাড়িয়ে নীলাকে কাছে টানে। বুকের ওপর নীলার মাথাটি রেখে দীঘল চুলের ঘ্রাণ নেয়, বলে, তুমি একটা বাচ্চা চাও না নীলা? একটা বাচ্চা, সারা ঘর জুড়ে খেলবে, আমরা দেখব, আমাদের বাচ্চা। ফুটফুটে, সুন্দর। তোমার জীবন পূর্ণ হবে, একটি শিশুর জন্ম দিয়ে। নিষ্পাপ একটি শিশু।

নীলা চোখ বোজে। একটি পুতুল পুতুল সাদা শিশু, সোনালি চুলের শিশু, মিষ্টি হাসির শিশু দৌড়ে আসছে নীলার দিকে মা মা বলে, শিশুটিকে কোলে তুলে নিচ্ছে সে, শিশুটি নীলার কোল থেকে ঝাঁপিয়ে বেনোয়ার কোলে যাচ্ছে, বুকে জাপটে ধরে বেনোয়া তাকে আদর করছে।

নীলার ইচ্ছে করে, এভাবে বেনোয়ার বুকের ওপর, এভাবে মাথা রেখে, দীর্ঘ বছর কাটিয়ে দিতে। বেনোয়া তার কানে কানে এভাবে একটি সন্তানের কথা বলবে। নীলাকে স্বপ্ন দেখাবে, যে স্বপ্ন নীলাকে বাঁচিয়ে রাখবে। নীলার আর আছে কী এ সংসারে!

তুমি ছেলে চাও?

যে কোনও, ছেলে হোক, মেয়ে হোক। বেনোয়া বলে। নীলার মুখটি তুলে চুমু খায়। বেনোয়ার নীল সাগরে নীলা হারিয়ে যেতে থাকে। কুল নেই কিনার নেই।

কিন্তু কী হবে সে ছেলে বা মেয়ের পরিচয়?

আমাদের ভালবাসার সন্তান। এই কি সবচেয়ে বড় পরিচয় নয়?

আমাদের তো বিয়ে হয়নি! বলে নীলা জানালায় তাকায়। জানালার ওপারে কিছু নেই, ঝাঁজালো রোদ্দুর শুধু।

তুমি তো একদিন বলেছ, তুমি বিয়েতে বিশ্বাসী নও, তুমি ভালবাসায় বিশ্বাসী। এখন হঠাৎ বিয়েতে বিশ্বাসী হয়ে উঠলে।

বেনোয়া নীলার মুখ নিজের দিকে ফিরিয়ে বলে, ভারতীয় রক্ষণশীলতা ঘৃণা করো বলেছ। এখন তো দিব্যি মেনে নিচ্ছ।

আমাকে কেন ভালবাসো বেনোয়া? তোমার বউ আছে বাচ্চা আছে, সুখের সংসার তোমার। খামোখা…নীলা ভাঙা কণ্ঠে বলে।

কেবল পাসকালকেই ভালবাসি তাই জানতাম। কিন্তু কী যে ঘটল আমার ভেতর। তুমি হঠাৎ আলোর ঝলকানি নিয়ে এলে। তুমি ছাড়া এখন আর উপায় নেই আমার, তোমাকে আমি চাই, তোমাকে আমার প্রয়োজন, তোমাকে আমি ভালবাসি। সারাদিন তোমার কথা ভাবি। রাতে ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে উঠি তোমাকে স্বপ্ন দেখে। পাসকাল আজ সকালেও আমাকে বলেছে ঘুমের মধ্যে নাকি আমি নীলা নীলা বলে ডাকি।

বেনোয়ার দুবাহু থেকে আলগোছে নিজেকে সরিয়ে নীলা বলে, বলেছ, ও জানে আমার কথা!

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেনোয়া, জানে। ও যে কী রকম কষ্ট পাচ্ছে এ আমি বুঝি। আমাকে কিছু বলে না। ওকে জানাবার পর আমাকে দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করেনি তোমার কথা। আমারও কষ্ট হয় ওর জন্য। কিন্তু কী করতে পারি আমি বলো। পাসকালকে ছাড়া আমার চলবে না, ও আমার জ্যাকলিনের মা। তোমাকে ছাড়াও আমার চলবে না, তুমি আমার বাঁধনছেঁড়া আবেগ। তুমি না হলে আমি একটি মৃত মানুষ।

নীলা উঠে রান্নাঘরে যায়।

নিবে যাওয়া কুঁচকে যাওয়া লাল চোখ বেনোয়ার উরুসন্ধিতে ঝুলে থাকে যখন সে রান্নাঘরে নীলার পেছনে দাঁড়ায়, কী হঠাৎ উঠে এলে যে!

চা করতে।

কিছু বলার নেই তোমার?

আমার মনে হয় বেনোয়া, আমাদের এই সম্পর্কটি বেশ জটিল হয়ে যাচ্ছে। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তুমি কাকে সত্যিকার ভালবাসো, কার সঙ্গে জীবন যাপন করতে চাও। অবশ্য তুমি বলছ যে দুজনকেই ভালবাসো। দুজনকেই তোমার চাই। কাল যদি দেখো যে আরও এক মেয়ে তোমার জীবনে হঠাৎ আলোর ঝলকানি নিয়ে এল, কী করবে? তাকেও নিশ্চয়ই চাই তোমার জীবনে, তাই না?

আমি আর কাউকে ভালবাসতে পারব না। বেনোয়ার উদাস স্বর।

আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে তো তুমি পাসকালকে তাই বলতে, বলতে না? নিশ্চয়ই বলতে যে ওকে ছাড়া আর কাউকে ভালবাসবে না। তারপর কী হল, আমাকে বললে আমাকে ভালবাসো। অবশ্য জানি না এ সত্যিই ভালবাসা না কি অভিনয়। বাড়তি একটি শরীর ভোগ করার সুযোগ তুমি ছাড়তে চাও না তাই। ভুলিয়ে ভালিয়ে…একটি বোকা মেয়েকে…

ছি নীলা ছি।

বেনোয়া দ্রুত সরে যায়, শোবার ঘরে ঢুকে কাপড়চোপড় পরে নেয়। নীলা যখন চা নিয়ে ঘরে ঢোকে, বেনোয়া জুতোর ফিতে বাঁধছে।

কী ব্যাপার চললে নাকি? আমি তোমার জন্য রান্না করেছি। বাঙালি খাবার। বরগোন ওয়াইনও কিনেছি, তুমি পছন্দ করো বলে।

তুমি খাও ওগুলো।

তুমি না খেয়ে যাবে? ক্ষিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই তোমার। কী খেয়েছিলে দুপুরবেলা?

স্যান্ডুইচ।

স্যন্ডুইচে সারাদিন? এসো খাবে। নীলা হাত ধরে টানে বেনোয়ার। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বেনোয়া বলে, খাওয়া দাওয়া আমার কাছে বড় কোনও ব্যাপার নয়, এ তোমার কাছে বড় ব্যাপার। না খেয়ে মরে তো তোমার দেশে সব, তাই ভাতের চেয়ে মূল্যবান তোমার কাছে আর কিছু নেই।

বেনোয়া বেরিয়ে যাবার পর নীলা বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে। যে তীব্র সুখ তার জীবনে হঠাৎ এসেছিল, সে অনুভব করে, দূরে সরছে তা, নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।

রাতে ঢাউস একটি বই নিয়ে সে সোফায় বসে। বেনোয়ার কথা আজ রাতে সে আর ভাববে না, নিজের জীবনের জটিল অঙ্কের কোনও সমাধান সে জানে না, তার চেয়ে হোমার ওয়েলসই ঢের ভাল, এতিমখানায় জীবন শুরু করেছিল হোমার, অস্পৃশ্য অদ্ভুত হোমার। নীলার নিজেকেও হোমারের মতো এতিম মনে হয়, কেউ তাকে নেয় না, কোথাও তার জায়গা হয় না।

অনেক রাতে ফোনের শব্দে নীলা লাফিয়ে ওঠে। এতিমখানা, হোমার ওয়েলস গড়িয়ে পড়ে মেঝেয়।

জ তেম নীলা।

এপাশে নীলা থামিয়ে রাখে জিভের ডগায় এসে যাওয়া মুয়া উসি।

কী করছিলে?

পড়ছিলাম।

কী পড়ছিলে?

তেমন কিছু না। আপেলের মদ বানায় এক বাড়িতে, সেখানে অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটে—

জানো, কী ঘটেছে আজ রাতে? বেনোয়া এমন স্বরে বলে, যেন পাসকালের সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।

কী ঘটেছে? উত্তেজিত নীলা।

আমি খাইনি।

ও।

আমার ইচ্ছে ছিল তোমার সঙ্গে খাব।

নীলা মেঝে থেকে এতিমখানার গল্প তোলে। শেষ পাতায় চোখ বুলিয়ে বইটি বন্ধ করে রাখে।

তুমি কি আমাকে ভালবাসো নীলা? বেনোয়া জিজ্ঞেস করে।

তুমি কি জানো না?

জানি। তবু শুনতে ভাল লাগে।

বেনোয়ার শুনতে ভাল লাগে বলে নীলাকে জ তেম বলতে হয়।

পরদিন সকালে বেনোয়ার স্পর্শে ঘুম ভাঙে নীলার। সাতসকালে বাড়িতে ঢুকেছে বেনোয়া। তার ইচ্ছে করে বেনোয়াকে বলতে, চলে যাও। তার একার জীবন সে একাই যাপন করবে। বেনোয়ার জিভ যখন খুঁজতে থাকে নীলার জিভ, খুঁজতে খুঁজতে গভীরে যেতে থাকে, খুঁজতে থাকে চেরিফল, ছাই সরিয়ে অমূল্য ধন পাবার মতো সে ফল মুখে নেয়, বেনোয়ার রোদ জ্বলা শরীর যখন উন্মাদের মতো খুঁজতে থাকে নীলার অতল সরোবর, সে সরোবরের জল যেন অমৃত পান করছে এমন করে পান করে, আর বেনোয়ার মেদহীন মাংসল শরীরের নীচে যখন নীলা সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে যায়, একার জীবন একা যাপন করার শক্তি লোপ পায় তার। নীলার মনে হতে থাকে কেবল পাসকালকে কেন, একশো মেয়েকে বেনোয়া এমন করে ভালবাসুক, ক্ষতি নেই। যদি বেনোয়ার শতভাগের একভাগ নীলা পায়, ছিটেফোঁটা সামান্য, এইই তার জন্য অনেক। যার কিছু নেই, তার যদি কিছু জোটে তবে আর পুরোটা পাইনি কেন বলে অভিমান করার অর্থ হয় না। বেনোয়াকে পুরোটা নিজের করে পাওয়ার যোগ্যতা তার নেই, সে জানে।

বেনোয়া সারাদিন নীলার সঙ্গে কাটাবে। কারণ পাসকাল চলে গেছে সারাদিনের জন্য তার এক বন্ধুর বাড়ি, গাড়ি নিয়ে গেছে, বেনোয়া মেট্রো করে এসেছে, রু দ্য রেন থেকে কভোঁসিওঁ, ওখান থেকে পরিচ্ছন্ন হাওয়ায় হেঁটে হেঁটে এখানে, রু দ্য ভুইয়েতে, পথে বুলনজেরি থেকে একটি বাগেতও নিয়ে এসেছে কিনে। বগলে একটি বাগেত আর হাতে একটি ওয়াইনের বোতল নিয়ে ফরাসিরা হেঁটে বাড়ি যায়, ঘামের গন্ধঅলা বাগেত ছিঁড়ে ছিঁড়ে বাড়িসুদ্ধ লোক খায়, এরকমই অভ্যেস এদের। মদ আর রুটি, প্রভু যিশুর রক্ত আর মাংস, এ না খেলে ধর্ম থাকে না, অন্তত ফরাসি ধর্ম।

বাইরে সূর্যকিরণ রেখে যারা ঘরে বসে থাকে, তাদের মতো হতভাগা আর নেই কেউ, বেনোয়া মনে করে। সুতরাং চলো চলো। বেনোয়ার সঙ্গে মহা আনন্দেই নীলা বেরোয়। কথা, প্রথম কার্তে লাতা, তারপর টইটই। কার্তে লাতার বাড়িতে কে থাকে? জঁ জ্যাক। জঁ জ্যাক মাত্র কদিনের জন্য এসেছে প্যারিসে, থাকে মারসেই-এ, মারসেইলেস, ফরাসি উচ্চারণে মারসেই। ফরাসিরা বেশির ভাগ অক্ষরই, বিশেষ করে লেজের দিকের অক্ষরগুলো উচ্চারণ করে না, গিলে ফেলে। এদের ভাষায় বর্ণ কম নেই, কিন্তু অর্ধেক বর্ণই খামোখা। বর্ণগুলো মুখে ব্যবহার করে না, কিন্তু শব্দের শেষে বসিয়ে দেয়, সম্ভবত বর্ণগুলো দিয়ে কী করবে তা বুঝে পায় না বলেই বসিয়ে দেয়, বর্ণে জং ধরল না, রইল। রইল কিন্তু রইল না। জঁ জ্যাক খুবই গুণী লোক। গুণী লোকের অভাব নেই এ দেশে, সুতরাং নীলা আর খুঁটিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করে না জঁ জ্যাকের গুণের কথা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি করে সোজা কার্তে লাতায় রু পিয়ের-এ মাদাম কুরির ছ তলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ঘড়ি দেখে ঠিক এগারোটা পাঁচ বাজলে বেনোয়া ওপরে উঠে তিন তলার দরজায় কড়া নাড়ে। একটি লম্বা চুল দাড়িঅলা লোক দরজা অল্প খুলে বড় বড় চোখ করে আগন্তুকদের দেখে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয়। মিনিট দুই পর অন্য একটি লোক, এ লোকের হাসি মুখ, দরজা হাট খুলে বিনীত ভঙ্গিতে বেনোয়া আর নীলার সঙ্গে হাত মেলায়। বেনোয়া নিজের পরিচয় দেয়। নীলা অনুমান করে এ বাড়ির কাউকে চেনে না বেনোয়া, জানে না কোন লোকটি জঁ জ্যাক। হাসিমুখের লোকটি আগন্তুকদের আমন্ত্রণ জানায় ভেতরে ঢুকতে। বেনোয়া নীলার হাত শক্ত করে ধরে আছে, নীলার হাতের ভেতর ঘামছে তার হাত। নীলার কৌতূহল হয় জানতে কী কারণে এই অচেনা লোকের বাড়ি এসেছে বেনোয়া।

বেনোয়াকে কোনও প্রশ্ন করার কোনও সুযোগ পায় না সে। হাসিমুখের লোকটি দুটো আসবাবহীন ঘর পেরিয়ে ছোট একটি প্রায় অন্ধকার ঘরে ওদের নিয়ে যায়, দুটো মোড়া মতো পাতা, আর একটি সোফা। সোফায় লোকটি বসে, অন্ধকারে তার লাল নাকের ডগা আর লাল দেখাচ্ছে না। মুখের হাসি নিবিয়ে ভারী গলায় বলে, আপনি তো বেনোয়া দুপঁ।

ঠিক।

জন্ম অরলেওঁয়।

ঠিক।

উনআশির অক্টোবরে।

ঠিক।

ছোটবেলা থেকেই গাঁট্টাগোট্টা ছিলেন।

ছিলাম।

এই মেয়েটির সঙ্গে দেখা হঠাৎ।

ঠিক।

মেয়েটিকে ভালবাসেন।

বাসি।

অথচ বউ আছে।

একটি কন্যাও।

কন্যার বয়স তো বেশি নয়।

তিন।

যান্ত্রিক স্বর বেনোয়ার।

জ্যাকলিনের তো একটা অসুখ আছে, না? জঁ জ্যাক একটি কলম মুখে নিয়ে মাথাটি কামড়াতে থাকে।

তীক্ষ্ণ চোখ। হঠাৎ বেনোয়ার মাথার ওপর আলো জ্বলে ওঠে। তীব্র আলো। সবুজ আলো। বেনোয়ার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে।

বেশ পুরনো অসুখ। জঁ জ্যাক আবার বলে।

হ্যাঁ, কানে।

কানে কম শুনছে তো!

বেনোয়া বলে, হ্যাঁ মাঝে মাঝে এরকম হচ্ছে।

বেনোয়াকে উদ্বিগ্ন দেখায়।

আপনার বউয়ের নাম কী? ফাবিয়ান? ফ্রাসোয়াজ? পাসকাল?

পাসকাল।

এই মেয়েটি, নীলার দিকে ফেরে জঁ জ্যাক, হবে এর সঙ্গে হবে, চালিয়ে যান। মেয়ে ভারতীয়, ভারতীয় মেয়েদের কাণ্ডজ্ঞান থাকে। যা করে বুঝে শুনেই করে। হুজুগে চলে না। হা হা।

জঁ জ্যাক হাসছে আর বেনোয়ার মাথার ওপর আলো নিবে যাচ্ছে।

একেবারে অন্ধকার হয়ে গেলে ঘর, বোমা ফাটার মতো শব্দ হয়।

বলুন কী অসুবিধে? হঠাৎ সেই তীব্র আলো আবার, এবারের আলোর রং লাল।

লাল আলোর নীচে বেনোয়াকে শ্মশানের ভূতের মতো দেখায়। গলার স্বর আরও যান্ত্রিক হতে থাকে।

বেনোয়ার একটি হাত নীলা নিজের হাতে নেয়। ঠাণ্ডা হয়ে আছে হাতটি।

আলকাটেল লোক ছাঁটাই করছে, তাই তো?

তাই।

এরিকসনএও তো চাকরি নেবার কথা ভাবছেন।

আবেদন করেছি।

আলকাটেলেই থাকতে চাচ্ছেন, তাই তো?

তাই। আমার পদোন্নতি হওয়ার কথা এখানে।

কিন্তু এখনও হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখছেন না। তাই না?

তাই।

লোকটি শার্টের বুক পকেট থেকে এক প্যাকেট তাস বের করে। সাফল দিয়ে টেবিলের ওপর উলটো করে বিছিয়ে দেয়।

বেনোয়াকে একটি তাস তুলতে হবে। কাঁপা হাতে তোলে সে ইস্কাপনের ছয়। তাসটি জঁ জ্যাকের দিকে বাড়াতেই বাতি নিবে যায়। ঘর শীতল নৈঃশব্দ্যে ডুবে যেতে থাকে। বেনোয়ার খাসের শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই ঘরে।

নীলা বলে, এসব কী হচ্ছে, চলো বেরোই।

বেনোয়া নীলার হাতে শক্ত চাপ দিয়ে শব্দ করে শশশশশশ।

লাল নয়, সবুজ নয়, অন্য একটি আলো জ্বলে ধীরে ধীরে। বেনোয়ার মাথার ওপর নয়, এবারের আলোটি জঁ জ্যাকের পায়ের কাছে জ্বলছে। কাঠের মেঝের ফাঁক দিয়ে। আগরবাতির গন্ধ ঘরের বাতাসে।

নীলার অস্বস্তি হতে থাকে।

বেনোয়া কপালের ঘাম মুছে আগের চেয়ে স্বাভাবিক হয়।

জঁ জ্যাক বেনোয়ার চোখে তীক্ষ্ণ তাকিয়ে বলে আজ সন্ধেয় এক কিলো ভুট্টার গুঁড়ো কোনও একটি জঙ্গলে ছড়িয়ে দেবেন। আর ঠিক এক সপ্তাহ পর, দু কিলো ভুট্টার গুঁড়ো একই রকম ভাবে অন্য এক জঙ্গলে ছড়াবেন। প্যারিসের ভেতরে জঙ্গলে চলবে কি না ভাবছেন তো? না, তা হবে না, যেতে হবে প্যারিসের বাইরে।

দু হাজার ফ্রাঁ লোকটির হাতে দিয়ে বেরোয় বেনোয়া। সিঁড়ির কাছে পৌঁছতেই নীলা হেসে গড়িয়ে পড়ে।

কী ব্যাপার হাসছ কেন?

তুমি গণকের কাছে গেছ?

বেনোয়া দ্রুত সিঁড়ি পেরিয়ে রাস্তায় নামে।

নীলা পেছন পেছন।

কী ওরকম চেঁচাচ্ছিলে কেন সিঁড়িতে। আর বোকার মতো হাসছিলে। বেনোয়া বিরক্ত কণ্ঠে বলে।

দু হাতে হাসি আড়াল করে নীলা বলে, তুমি এসবে বিশ্বাস করো?

নিশ্চয়ই। বেনোয়ার গম্ভীর স্বর।

মজা করছ। নীলা হাসে।

মজা না নীলা। অনেকে এই লোকের কাছে গেছে। ফল পেয়েছে।

তুমি বিশ্বাস করো যে তুমি ভুট্টার গুঁড়ো ছিটোলে আলকাটেল থেকে ছাঁটাই হবে না?

হয়তো হব না। বেনোয়া হাঁটা শুরু করে।

সামনে দাঁড়িয়ে পথ আগলে আবার জিজ্ঞেস করে নীলা, তুমি ছিটোবে গুঁড়ো?

পাশ কেটে হেঁটে যায় বেনোয়া, নিশ্চয়ই।

নীলা দাঁড়িয়েই থাকে, গলায় রঙিন স্কার্ফ জড়ানো ছিল, ঢিলে হয়ে খসে পড়ে।

হঠাৎ খেয়াল হয় যে বেনোয়া একা এগিয়ে যাচ্ছে, দৌড়ে বেনোয়ার কাছে পৌঁছে ওর হাতটি হাতের মুঠোয় নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলে কোথায় যাচ্ছ?

চলো তোমাকে প্যানথিওঁ দেখাব।

বেশ তো। আমি আবার ভাবছিলাম, তুমি বুঝি গুঁড়ো ছিটোতে যাচ্ছ।

বেনোয়া এর উত্তর দেয় না। তবে বলে তুমি এত বেখেয়ালি, কী বলব! যখন মাদমোজেল মাদমোজেল ডেকে পেছনে এক ভদ্রলোক নীলার স্কার্ফটি দু আঙুলে ধরে এগোতে থাকে।

প্যানথিওঁ। সতেরোশো চুয়াল্লিশ সনে পঞ্চদশ লুই মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে, জীবন ফিরে পেয়ে এমনই উচ্ছ্বসিত ছিলেন যে শাঁ জনোভিভের উদ্দেশে একটি গির্জা বানাবেন বলে স্থির করলেন। নয়া ক্লাসিক্যাল ধরনে ফরাসি স্থপতি জ্যাক জার্মা কুড়ি বছর পর গির্জার কাজ শুরু করে দিলেন, কাজ শেষ হতে পঁচিশ বছর লাগল। কাজও শেষ হল, ফরাসি বিপ্লবও শুরু হল। বিপ্লবীরা তখন দেশের গির্জা ভেঙে দিচ্ছে সব, তবে এই শাঁ জনোভিভ গির্জাটিকে না ভেঙে, করা হল প্যানথিওঁ, যেখানে ফরাসি মনীষী আর দার্শনিক ফরাসি জাতির গৌরব, ঘুমোবেন। যাঁরা আগে থেকেই ঘুমিয়ে আছেন, কেবল তাঁরাই। ভিক্টর উগো, এমিল জলা, ভলতেয়ার, রুশো, মাদাম কুরি, পিয়ের কুরির কফিন মাটি খুঁড়ে তুলে এনে রাখা হল প্যানথিওঁতে। নেপোলিয়ন এটিকে আবার গির্জা করে দিয়েছিলেন, আঠারোশো ছয় সালে। আশি বছর প্যানথিওঁকে অপেক্ষা করতে হল, পুরোপুরি প্যানথিওঁ হতে। আশি বছরে আরও একবার অগির্জা হয়েছিল এটি, আরও একবার গির্জা। প্যানথিওঁর মেঘছোঁয়া উঁচু ডোম থেকে একটি দীর্ঘ পেণ্ডুলাম ঝুলছে, ফরাসি পদার্থবিদ লিও ফুকো উনিশ শতকের মাঝামাঝি যে পেণ্ডুলাম দেখিয়ে বলেছিলেন পৃথিবী নিজের অক্ষপথে ঘুরছে। মেঝের তলায়, পাতালে গেলে মন ধাধাঁনো সব ফরাসি গৌরব।

মাদাম কুরির কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে নীলা বলে, এ তো পোলিশ গৌরব, ফরাসি নয়।

বেনোয়া বলে মাদাম কুরি ফরাসি গৌরব, কারণ যে দেশেই তাঁর জন্ম হোক না কেন, এ দেশে তিনি বাস করেছিলেন।

নীলা ধীরে বলে, আমি তো এ দেশে বাস করছি। আজ যদি সাংঘাতিক কিছু একটা আবিষ্কার করি আমি, খুব বড় কিছু, আমাকে কি ফরাসি গৌরব বলে ভাবা হবে?

বেনোয়া উত্তর দেয় না।

নীলাই উত্তর দেয় তার প্রশ্নের, ভাবা হবে। আর যতদিন না বড় কিছু ঘটাচ্ছি, ততদিন ভারতীয়ই থাকব। গরিব দুঃখী ভারতীয়, খেতে না পাওয়া ভারতীয়, শূন্য থালা হাতে ভিক্ষে করা ভারতীয়। ফরাসি সংস্কৃতি নষ্ট করা, বিনাশ করা অনুপ্রবেশকারী।

নীলা শব্দ করে হেসে ওঠে। বেনোয়া সতর্ক করে দেয়, এখানে এত জোরে হাসার নিয়ম নেই।

ফুঁপিয়ে কপট কেঁদে বলে, কাঁদা কি চলবে?

না, তাও চলবে না।

ভলতেয়ারের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে নীলা বলে, কিন্তু ওই কফিনের ভেতর কি ভলতেয়ারের মৃতদেহ আছে?

বেনোয়া হেসে ওঠে, মৃতদেহ কি আর এতদিন থাকবে, হাড়গোড় আছে।

নীলাও হাসে, তাই তো। কিন্তু আমার মনে হয় কী জানো, এখানে ভলতেয়ারের কিছু নেই।

নিশ্চয়ই আছে।

কিন্তু যদ্দুর জানি ধর্মান্ধ ক্রিশ্চানরা ভলতেয়ারের মৃতদেহ চুরি করে নিয়েছিল এখান থেকে, কেটে ছিঁড়ে আবর্জনার স্তূপে ফেলে দিয়েছে। হৃৎপিণ্ডটা অবশ্য আছে এখনও, বিবলিওটেকে, মস্তিষ্ক অকশনে বিক্রি হতে হতে এখন লাপাত্তা।

বেনোয়া হেসে উড়িয়ে দেয় নীলার গল্প।

প্যানথিওঁ থেকে বেরিয়ে বেনোয়া বলে, আমার অবশ্য ভলতেয়ারকে তেমন মনে হয় না।

কেন বড় কিছু মনে হয় না ভলতেয়ারকে, তা বেনোয়া খোলসা করে বলে না, বলে দেকার্তকে মনে হয় বড় কিছু। তারপর গড়গড় করে দেকার্তের অঙ্ক কষার অসাধারণ পদ্ধতি ব্যাখ্যা করে, দীর্ঘ সময় নিয়ে বর্ণনা করে দেকার্তের জ্যামিতি বিশ্লেষণ তত্ত্ব। নীলার মন পড়ে থাকে ভলতেয়ারে।

কগিতো আরগো সাম। বেনোয়া দুবার বাক্যটি আওড়ায়।

এ আবার কী? নীলা জিজ্ঞেস করে।

দেকার্তের বিখ্যাত লাতিন উক্তি।

নীলা জানে না। বেনোয়া অর্থ বলে দেয়, আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমি।

দেকার্তের তো ঈশ্বরে বিশ্বাস ছিল। নীলা বলে।

এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যা কিছু সব ঈশ্বরের তৈরি। মানুষের মন হচ্ছে ঈশ্বরের মতো, ভাবে। মানুষের আকার আছে, ঈশ্বর নিরাকার। কিন্তু মানুষ মরে যায়, মানুষের ভাবনা থেমে যায়, ঈশ্বর থাকেন, তাঁর ভাবনা থাকে, তাঁর থাকার জন্য তাঁকে নির্ভর করতে হয় না তাঁর সৃষ্টিকর্তার ওপর। বেনোয়া মুখস্থ বলে যায়।

বেনোয়ার চোখ মাঝে মাঝে আকাশে, ঈশ্বরের গল্প করলে অনেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে করে, ভেতরে একটি ছবি ভাসে সম্ভবত, আকাশের ওপর কোথাও কোনও সিংহাসনে বসে আছেন স্বয়ং ঈশ্বর। অবশ্য বেনোয়ার ধারণায় ঈশ্বর নিরাকার। নিরাকার ঈশ্বরের তো কোথাও বসার কথা নয়।

নীলা বলে, মুসলমানরা বিশ্বাস করে ঈশ্বর নিরাকার। আবার এও বিশ্বাস করে ঈশ্বর আকাশে বাস করেন। রীতিমতো ভ্রমণ করেন এক আকাশ থেকে আরেক আকাশে। তোমার দেকার্তের ঈশ্বর কি আকাশে থাকেন?

বেনোয়া হাতের মুঠো থেকে নীলার হাত খসিয়ে দেয়, কী ব্যাপার, তুমি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করো না?

নীলা হেসে বলে, আমি ফ্রাসোয়া মারি আরোয় বিশ্বাস করি।

এ আবার কে? বেনোয়া জিজ্ঞেস করে।

এ হচ্ছে এক ফরাসি লোক, জন্মেছেন প্যারিসে।

প্রেমে পড়েছ নাকি তার?

হ্যাঁ। অনেকদিন। নীলা হাসে।

দেখতে কেমন?

সুন্দর। ছিপছিপে শরীর। মেদহীন।

শুয়েছ ও ব্যাটার সঙ্গে?

না শুইনি এখনও।

নীলা বেনোয়ার আঙুলের ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে হাতটিকে বন্দি করে।

আমার চেয়ে বয়সে বড় না ছোট? বেনোয়া জিজ্ঞেস করে।

তোমার চেয়ে বড়, খানিক ভেবে, বেশি না, তোমার চেয়ে দুশো পঁচাশি বছর বড়।

বেনোয়া হো হো করে হাসে। নীলাও।

তো তাকে বিশ্বাস করার কারণ কী তোমার? বেনোয়া উদগ্রীব জানতে।

সে অনেক কারণ। ফ্রাসোয়া জীবনে ভুগেছেন অনেক। ফরাসি সরকারের সমালোচনা করে কবিতা লিখেছিলেন, সরকার তাঁকে বাস্তিলে বন্দি করে রাখল এগারো মাস। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি লিখতে শুরু করলেন। বেশ চলছিল। হঠাৎ একদিন তিনি এক নামকরা লোককে, সমাজের উঁচুতলার কোনও এক লোক হবে, বিষম অপমান করলেন। এর শাস্তি পেতে হবে ফ্রাসোয়াকে। হয় জেল নয় নির্বাসন। ফ্রাসোয়া নির্বাসন বেছে নিলেন। নির্বাসনে পাশের একটি দেশে গেলেন, নাম বলব না। সে দেশে বছর তিনেক ছিলেন, প্যারিসে ফিরে এসে সে দেশের বেশ গুণ গেয়ে একটি বই লেখেন। সে দেশের সঙ্গে ফ্রান্সের শত্রুতা বহুকালের…

বুঝেছি ইংলন্ড। আচ্ছা লোকটি কে? দ্ৰফুস? আলফ্রেড দ্ৰফুস?

দ্ৰফুসের চেয়ে দুশো পঁচাশি বছর ছোট হলে তুমি এখনও জন্ম নাওনি। আর ইংলন্ডে কোনও শয়তানের দ্বীপ নেই, যে দ্বীপে দ্ৰফুস ছিলেন। নীলা বলে যায়। যা বলছিলাম, তো ফরাসি সরকার তা মেনে নেবে কেন? ফ্রাসোয়ার শাস্তির ব্যবস্থা হল আবার। এবারও ফ্রাসোয়াকে নির্বাসনে যেতে হল। এবার তিনি দেশের খুব দূরে যাননি, কাছাকাছিই ছিলেন। মানে কোনও সমুদ্র পাড়ি দিতে হয়নি।

বেলজিয়ামে ছিলেন?

না।

ইতালিতে?

না।

স্পেনে?

না। সেই নির্বাসনে বসে তিনি প্রচুর বই লিখতে লাগলেন। অন্ধত্বর বিরুদ্ধে, যুক্তির পক্ষে। তারপর তিরাশি বছর বয়সে যখন তিনি দেশে ফিরে এলেন, তাঁকে বিরাট সংবর্ধনা দেওয়া হল। বয়স অনেক, মারা গেলেন প্যারিসে। কিন্তু কোনও গির্জার ভেতরে তাঁর কবর দেওয়া সম্ভব হয়নি, কারণ গির্জার বিপক্ষে তিনি বেশ সোচ্চার ছিলেন। শেষে যাই হোক শঁপাঁর এক অ্যাবিতে কবর দেওয়া হল। তারপর আঠারো শতকের শেষ দিকে তাঁকে প্যারিসে নিয়ে আসা হয়, অবশ্য বেশ সম্মানের সঙ্গেই।

বেনোয়াকে লক্ষ করে নীলা, অন্যমন।

এই দালানটা দেখো। বিশাল একটা বাড়ির দিকে চিবুক তুলে বেনোয়া বলে, এটা আমার ইস্কুল। একোল নরমাল সুপেরিয়ের। ফ্রান্সের সবচেয়ে নামকরা ইস্কুল। এই ইস্কুলের সার্টিফিকেট পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তুমি যদি পড়ার সুযোগ পাও, তোমাকে নব্বই হাজার ফ্রাঁ করে বছরে দেওয়া হবে। আমিও তা পেয়েছি। এখানে লেখাপড়া করে নোবেল পুরস্কার পেয়েছে অনেকে। তুমি লুই পাস্তুরের নাম শুনেছ?

নীলা মাথা নাড়ে, শুনেছে।

মিশেল ফুকো? জ পল সার্ত্র? রমা রলাঁ? আঁরি বারগসন?

নীলা এঁদের নামও শুনেছে।

সব এই ইস্কুলের ছাত্র ছিলেন। বেনোয়া নীলাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। খুব সুখী দেখায় তাকে।

খাকির ওপর হালকা সবুজ টিশার্ট পরেছে বেনোয়া। গরমের পোশাকই এমন, যত পাতলা হওয়া যায়, যত ছোট হওয়া যায়। নীলার পরনে ছোট একটি স্কার্ট, অর্ধেক উরু খোলা, আর একটি আঁটসাঁট কালো জামা। চুল পিঠে গড়াচ্ছে। পায়ে উঁচু জুতো, উঁচু পরেও বেনোয়ার কাঁধের নীচেই পড়ে থাকে তার কাঁধ। ভরা বুক। পেটে চিকন মেদের ভাঁজ, এই মেদ নিয়ে নীলার শরম ছিল, বেনোয়াই বলেছে, ওটুকু মেদ না থাকলে মেয়েদের ভাল দেখায় না। আজকালকার মেয়েরা যে হারে না খেয়ে থাকে মেদ কমাতে, না খেয়ে না খেয়ে কঠিন অসুখ বাধিয়ে ফেলে, মরেছেও তো অনেক এই করে। স্তন বলতে কিছু নেই, উরুতে মাংস নেই, জীবিত কঙ্কাল সব। শুনে মনে জোর পেয়েছে নীলা। নিজে সে এমন আঁটো জামা পরে উরু খুলে বেশ নিশ্চিন্তে বাইরে বেরোয়। ফরাসি পুরুষেরা, নীলা লক্ষ করে, মেয়েদের পা আর উরুর দিকে তাকায় বেশি, যদি তাকায়। ভারতীয় ছেলেদের চোখ পড়ে মেয়েদের স্তনে। স্তন শাড়ির আড়ালে থাক কি ওড়নার আড়ালে থাক, বা ঢিলে পোশাকের তলে থাক, চোখ আগে যাবেই ওদিকে। পা, সে যত সুডোল হোক, মসৃণ হোক মেয়েদের, ভারতীয় পুরুষের কাছে এ বিদঘুটে বিশ্রী জিনিস। পুরুষের যৌনবোধ দু দেশে ভিন্ন রকম। নীলা মাঝে মাঝে ভেবে পায় না, কেন। ভারতে যে মোটা তাজা শরীরকে ভাল স্বাস্থ্য বলা হয়, তা এখানে অসুস্থ বলে বিবেচিত। অসুস্থ কারণ মেদহীন নয় শরীর। নীলাকে কলকাতার লোকেরা বলে, হাড়গিলে মেয়ে। আর প্যারিসে, দিব্যি তাকে বলা হয় ভাল স্বাস্থ্যের মেয়ে, অবশ্য ক্যাথারিন নীলাকে এক বা দু কিলো ওজন কমালে ভাল দেখাবে বলেছিল।

দুপুরের খাবার খেতে দুজন কার্তে লাতায় এক ব্রাসারিতে ঢোকে। এই এক মজা প্যারিসে, যেখানেই হাঁটো, যে রাস্তাতেই, ক্যাফে পাবেই, রেস্তোরাঁ পাবেই। রেস্তোরাঁয় নীলা শুধু সালাদ চাইল খেতে।

কী ব্যাপার, তুমি ওই হাড়গিলে মেয়েদের মতো হতে চাও নাকি?

খানিকটা যে চায় না নীলা তা নয়। পেটের ওই চিকন মেদ, মাঝে মাঝে আশঙ্কা হয়, না আবার বেড়ে যায়। রাস্তায় বেটপ আকারের শরীর দেখেনি সে তা নয়। বেশির ভাগই, নীলা দেখেছে, একা। বোধহয় বেনোয়া একদিন বলবে, ধুর কী শরীর বানিয়েছ বলো তো। পাসকালের ওজন, কম করে হলেও নীলার চেয়ে পাঁচ কিলো কম, নীলার বিশ্বাস।

রেস্তোরাঁয় বসে ওই সালাদই খেতে খেতে নীলা জিজ্ঞেস করে, তুমি এমন ভাল বিজ্ঞানের ইস্কুলে পড়েছ, তুমি গণককে বিশ্বাস করো কেন? লোকটি তো ভণ্ড।

না জেনে মানুষকে ভণ্ড বোলো না নীলা। কী করে সে আমার বয়স, পাসকালের নাম, জ্যাকলিনের অসুখের কথা জানল বলো?

নিশ্চয় কারও কাছ থেকে খবর নিয়েছে।

না। আমার এক সহকর্মীর ভাইয়ের বন্ধুর বোন গিয়েছিল জঁ জ্যাকের কাছে। সহকর্মীটি কোনওদিন যায়নি। সে কেবল ঠিকানা জোগাড় করে দিয়েছে। আর ওর ভাই বা ভাইয়ের বন্ধু কেউ আমাকে চেনে না।

রাদেভুঁ নেওয়ার সময় তোমার নাম তো বলেছ। সে এই নামের লোকের তথ্য কোথাও থেকে বের করেছে।

প্যারিসে সম্ভবত কয়েক হাজার বেনোয়া দুপঁ আছে। জঁ জ্যাক পারিসের লোকও নয়। দেখলে না মারসেই-এর উচ্চারণে ফরাসি বলছিল সে। বেনোয়া নীলাকে ঠকিয়ে দিয়ে বলে।

এদের চর থাকে, জানো তো! চর খোঁজ দেয় কে আসছে দেখা করতে, কোথায় বাড়ি, কী করে, কী অসুবিধে সব। আর অন্য উচ্চারণে কথা বলা, এ তো কোনও ব্যাপারই নয়।

বেনোয়া সবেগে মাথা নাড়ে দুপাশে। না।

বাইবেলেই আছে এসব কথা। এলিশা সিরিয়ার রাজার যুদ্ধ পরিকল্পনা জানতে তার শোবার ঘরে ঢুকেছিলেন। জনদার্ক কে তো জানো, তার তো অশরীরী কিছুর সঙ্গে দেখা হত। অশরীরী কিছুই আগাম বলে দিয়েছিল, কোন তরবারি দিয়ে যুদ্ধ করলে সে ইংরেজদের তাড়াতে পারবে। শাঁ আলফোনসুসের নাম শুনেছ? তিনি বলেছিলেন, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এই এই হবে, ঠিক তাই তাই হয়েছে, রোমে পোপের মৃত্যুশয্যায় তাঁর শরীর পাওয়া যাবে বলেছিলেন, পাওয়া গেছে। তুমি তো আবার সাহিত্য নিয়ে মাথা ঘামাও, হ্যামলেটের ব্যাপারটা দেখো, হ্যামলেটের সঙ্গে কি অপার্থিব কিছুর দেখা হয়নি? হয়েছে। আজ প্যানথিওঁতে ভিক্টর উগোর কফিন দেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলে, জানো ভিক্টর উগো কী করতেন? অশরীরী আত্মার সঙ্গে দেখা করতেন। মস্ত মস্ত খাতায় লিখে রেখেছেন, ওদের সঙ্গে সংলাপগুলো। কিছু একটা কোথাও আছে। তা না হলে জগতের বড় বড় মনীষী, বিজ্ঞানী অলৌকিক ব্যাপারগুলোকে উড়িয়ে দিতেন, দেননি কিন্তু।

রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে নীলাকে অবাক করে এক কিলো ভুট্টার গুঁড়ো কিনে প্যারিসের বাইরে বোয়া দ্য বোলোনে গিয়ে ঠিক ঠিকই নির্জন জঙ্গলে ছড়িয়ে দিল বেনোয়া।

বাড়ি ফিরে নীলা সারাদিনের চমক সামলাতে বাথটাবের ফেনা তোলা জলে নেমে পড়ে। বেনোয়াও নামে। টাবের কিনারে দুজনের জন্য দু গেলাস বোরগোন ওয়াইন রাখা। কড়া বাতি নিবিয়ে কেবল দুটো মোম জ্বালানো। মায়াবী আলোয় ডুবে দুজনেই অল্প অল্প ওয়াইন পান করে। বেনোয়া হাততোয়ালেতে তরল সাবান ঢেলে নীলার শরীরে বুলিয়ে দেয়। নীলার ভাল লাগতে থাকে, সারাদিনের তার ভাল না লাগার ঘটনাগুলো একটু একটু করে দূরে সরতে থাকে। সাদা ফেনার তলে ডুবে থাকে নীলার শরীর, কেবল চেরিদুটো উঁকি দেয়। চেরি খেতে বেনোয়া ঝুঁকে আসে নীলার দিকে। জিভ বাড়াতেই চেরি ডুবে যায় ফেনার তলে। লুকোচুরি খেলা চলে জিভের জলে আর চেরিতে। বেনোয়ার শরীর ফুঁড়ে জেগে উঠতে থাকে আরেক শরীর। সে শরীরটির স্পর্শ নীলা তার গায়ে পায়ে পেতে থাকে, শ্বাস ঘন হতে থাকে তার, বেনোয়ারও। নীলার পা দুটো জলের ভেতর থেকে তুলে আনে ওপরে, যেন পা নয়, অতল জলে হারিয়ে যাওয়া কোনও রহস্য, বেনোয়া মুগ্ধ চোখে দেখে ভেজা মসৃণ পা, বাদামি পা। বেটোফেনের বাজনার তালে তালে বেনোয়ার শরীর ওঠে নামে নীলার শরীরে, যতক্ষণ না অসুরের চিৎকারের মতো মোবাইল বাজে।

রাত এগারোটায় বেনোয়া বেরোয়। যাবার সময় আরও একটি চমক দেয়। সে কাল আসছে না, কেবল কাল নয়, দশ দিন তার আসা হবে না, রিভিয়েরায় যাবে বউ বাচ্চা নিয়ে, ছুটি কাটাতে, সমুদ্র পারে রোদ পোহাতে। আর নীলা কী করবে? বেনোয়ার কথা ভাববে, ভাববে যে সে তাকে ভালবাসে, ভাববে যে সে যেখানেই থাকুক, যতদূরেই, নীলা সারাক্ষণ তার হৃদয়ে আছে।

দরজা বন্ধ করে জানালা বন্ধ করে আলো বন্ধ করে বেটোফেন বন্ধ করে অতল নৈঃশব্দ্যের ভেতর নীলা যখন তার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনছে কেবল, দরজায় কড়া নড়ে।

বেনোয়া, সিঁড়ির মুখ থেকে ফিরে এসেছে যে জিনিসটি জানা হয়নি, জানতে।

তোমার ওই ফ্ৰাসোয়াটা কে?

ভলতেয়ার।

সন্ধে বরদোর স্রোতে ভাসে, রাত ওড়ে গুলোয়াজের ধোঁয়ায়

মরুনি আর দানিয়েলের নেমন্তন্ন নীলার বাড়িতে। নিজের বাড়ি হলে মরুনিকে বাঙালি খাবার খাওয়াবে, এরকম ইচ্ছে ছিলই নীলার। দানিয়েলকে ডাকার পেছনে কারণ, এক, দুজনের পক্ষে অতিরিক্ত খাবার তৈরি করা হয়ে গেছে, দুই দানিয়েল বন্ধু হিসেবে এক সময় মন্দ ছিল না, তিন, দানিয়েল দেখে যাক নীলা পরনির্ভর নয় আর।

আমার বাড়ির তুলনায় এ তো দেখছি প্রাসাদ। দানিয়েল ঘরগুলো দেখে আর বলে।

কেবল দারিদ্র্যই ঘোচেনি, নীলা প্রেমে পড়েছে এবং সুখে আছে এ দুটো খবরও শ্যাম্পেনের বুদবুদের মতো নীলা থেকে বেরোয়।

রাতে ঘরের বাতি নিবিয়ে খাবার টেবিলে প্রথামতো মোম জ্বেলে দেওয়া হল, ভারতীয় খাবারের সঙ্গে ভারতীয় সংগীত হলে মন্দ হয় না, রবীন্দ্রসংগীত চালিয়ে দেওয়া হল। নীলা লক্ষ করে গানের দিকে কান কারও পাতা নেই। নীলাই কান পেতে কান পেতে রই শোনে, শোনে ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান..আর বলে মরুনি, তুমি যদি বাংলা জানতে, কাঁদতে গান শুনে।

মরুনি জোরে হেসে ওঠে।

থালা সাজিয়ে গেলাসে ওয়াইন ঢেলে দিয়ে নীলা পরিবেশন শুরু করে।

আমরা নিজেরা নিয়ে নিতে পারব, ঠাকুরমা, তুমি বসো। দানিয়েল বলে।

দানিয়েলের অভিজ্ঞতা আছে বাঙালির সপ্তব্যঞ্জনের। মরুনির নেই, ঠোঁট টিপে হাসে টেবিল ভরা খাবার দেখে।

মনে হচ্ছে, পঞ্চাশ জনের খাবার রান্না করেছ।

তুমি যদি কলকাতা থাকতে মরুনি, তা হলে ঠিক এই রাঁধতে, আমি যা রেঁধেছি।

বাঙালি খাবার মাছ ভাত, কাঁটা ছুরিতে খেতে নীলার ইচ্ছে করে না, সে হাতে শুরু করে। মরুনি হাঁ হয়ে নীলার হাতে খাওয়া দেখে।

ভাত নিয়ে সেই ভাতের সঙ্গে সবজি মাছ মাংস সব একবারেই ওরা নিয়ে নেয়। থালার কিনারে নুন নেওয়ার মতো করে মরুনি ভাত নেয়, মাছ আর মাংসের পরিমাণ বেশি। হলে কী হবে, রুইয়ের একটি টুকরো খেতে নিয়েই সে টের পায়, মাছ তার পক্ষে খাওয়া সম্ভব হবে না, কাঁটা। কাঁটা বলে দানিয়েলও মাছ ছুঁল না, মাংসের ওপর ঝড় গেল। ভাত ভাতের মতো পড়ে রইল। তলবিয়াকের চিনে দোকান থেকে কেনা রুই তেলাপিয়া, কই নীলার জিভেই রুচল কেবল।

নীলা হাতে মাছের ঝোলে ভাত মাখতে মাখতে মরুনিকে বলে, কখনও দেখোনি কাউকে হাতে খেতে?

মরুনি দেখেনি, কখনও চোখের সামনে দেখেনি, যা দেখেছে পর্দায়, আফ্রিকার দুর্ভিক্ষ দেখায় যখন টেলিভিশনে, তখন।

হাতে খাওয়ার স্বাদই অন্যরকম। খেয়ে তৃপ্তি হয়। নীলা বলে।

দানিয়েল কাঁটা ছুরি ফেলে বাঁ হাত ডুবিয়ে দিল খাবারে। নীলা আঁতকে ওঠে দেখে।

বাঁ হাতে খেতে হয় না, ডান হাতে খাও। নীলা চেঁচিয়ে বলে।

আমি তো বাঁ হাতি, দানিয়েল বলে।

বাঁ হাতে খেতে হয় না কেন? মরুনি জিজ্ঞেস করে।

নীলা বলে, বাঁ হাতে নোংরা কাজ করা হয়, তাই।

নোংরা কাজ?

মল মূত্র ত্যাগের পর বাম হস্তে আমরা আমাদের গোপন অংশগুলো ধৌত করি কিনা।

দানিয়েল বলে, কিন্তু আমরা তো ধৌত করি না। কাগজ ব্যবহার করি।

তবু দেখতে যেন কেমন বিচ্ছিরি দেখায়। নীলার নাক কুঁচকে ওঠে, যেন দানিয়েলের বাঁ হাত থেকে ভুরভুর করে দুর্গন্ধ বেরিয়ে সোজা তার নাকে ঢুকছে।

ডান হাতে খেলে বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে না, বাঁ হাতে খেলে দেখাবে তা দানিয়েল যেমন বোঝে না, মরুনিও না।

দানিয়েল বাঁ হাতে লেখে, বাঁ হাতে টেনিস খেলে, বাঁ হাতে বাজারের ব্যাগ হাতে নেয়, বাঁ হাতে সিগারেট নেয়, বাঁ হাতে ওয়াইনের গেলাস ধরে, দেখতে বিচ্ছিরি লাগে কি? লাগে না।

নীলা এর উত্তর জানে না। আসলে যুক্তি নেই। দেখার অভ্যেস নেই, তাই।

হাতে খাওয়ার অভ্যেস নেই বলে দানিয়েলকেও হাত গুটোতে হয়। ও যতবারই হাতে ভাত নিচ্ছিল, ভাত গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিল হাত থেকে। মুখ অব্দি ভাত ওঠাচ্ছিল হাত ভাঙা রোগীর মতো।

মরুনি তুমি পারবে? নীলার কৌতূহল হয়।

মরুনি সাহস করে না। আবদারের পর সে হাতে ভাত তুলতে গেলে থালা গড়িয়ে পড়ে যায় খাবারসহ ওর কোলের ওপর। বেচারার জামা ঝোলে লাল হয়ে থাকে।

মরুনিকে একটি জামা এনে দেয় নীলা, পরতে। জামাটি পরে কোন দেশের জামা এটি ভারতের নাকি জিজ্ঞেস করায়, নীলার ইচ্ছেটি হয়, মরুনিকে শাড়ি পরানোর।

নীলার ইচ্ছের কথা শুনে হাতে তালি লাগায় দানিয়েল। ওঠে দানিয়েল।

খাবার অর্ধেক ফেলে নীলা মরুনিকে নিজের একটি শাড়ি পরাল। নীলার কুচি কাটা দেখে নয়ন জুড়োল ওদের।

তোমার ওই বুট জুতোজোড়া খোলো তো। মানাচ্ছে না।

নীলা একজোড়া চটি দেয় পরতে মরুনিকে।

হেঁটে আয়নার সামনে যাও। মরুনি হাঁটতে গিয়ে উপুড় হয়ে পড়ল চেয়ারে।

ধীরে বন্ধু ধীরে।

দু বছরের শিশুকে শাড়ি পরিয়ে নীলা হাঁটাচ্ছে, এমনই বোধ হল তার।

আয়নার সামনে ভাবলেশহীন মুখে দাঁড়িয়ে থাকে মরুনি।

খুব সুন্দর লাগছে। লাগছে না। একবারে বাঙালি মনে হচ্ছে তোমাকে। নীলা উত্তেজিত। কেমন লাগছে তোমার? বলো তো।

মরুনি চুপ করে থাকে।

নীলা বলে, যদি ফ্রান্সে না আসা হত, মরুনি ভেরনেস না হয়ে মরুনি পাল বা মরুনি দাস হতে, এরকম শাড়ি পরতে, রবীন্দ্রসংগীত গাইতে।

নীলা মরুনির কপালে লাল একটি টিপ পরিয়ে দেয়।

কী, দেখেছ নিজেকে, কী সুন্দর লাগছে, তাই না!

মরুনি মুখ খোলে, শাড়িটি ভাল সুতোয় বানানো, কিন্তু শাড়িতে তাকে মানাচ্ছে এ তার মনে হয় না। সে তার পাতলুনেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

ভারতীয় মেয়েরা এ পরে কী করে হাঁটে! মরুনি শাড়ি খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করে।

কেবল হাঁটে? দৌড়োয়, ট্রেনে চড়ে, বাসে চড়ে। চর্চায় কী না হয়।

ভারতীয় সংস্কৃতি, মরুনিকে টানছে না, নীলা টের পায়। শাড়ি না পরে, এ সময় জাপানি কিমোনো পরলেও মরুনির একই রকম অনুভূতি হত। ভারতীয় খাবার না রেঁধে আজ মেক্সিকান বা চিনে খাবার রাঁধলেও মরুনির একই রকম আনন্দ হত। নীলা বিশ্বাস করতে শুরু করে মরুনি আগে যা বলেছিল, ভারত তার কাছে যে কোনও একটি দেশ, কলকাতা যে কোনও একটি শহর। নীলার কাছেও কি তাই নয়? নীলা ভাবে।

মাদার তেরেসা কেবল কি মরুনিকেই, এরকম কত লক্ষ মানুষকে বাঁচিয়েছে। দানিয়েল বলে। মরুনিও মাথা নেড়ে সায় দেয়।

মাদার তেরেসার গুণ গাইছে যখন ওরা, নীলা বাধা দেয়, এত গুণ গেয়ো না তো, রাগ লাগে।

নীলার কেন রাগ হয় তা জানতে ওরা আগ্রহী।

নীলার রাগ হয় এই কারণে যে মাদার তেরেসা তাঁর প্রভু যিশুকে খুশি করতে যা করার প্রয়োজন বোধ করেছেন, করেছেন, মানুষের জন্য মায়ায় বা মমতায় কিছু তিনি করেননি। দরিদ্রের দুর্দশা তিনি দূর করতে চাননি, কারণ দুর্দশা ঈশ্বরের দেওয়া। রাস্তা থেকে অসুস্থ মানুষ তুলে এনেছেন নিজের আশ্রমে, খেতে দিয়েছেন, বিছানা দিয়েছেন, আরাম করে মরার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, আর জগৎসুদ্ধ নাম কামিয়েছেন। যারা মাদার তেরেসার গুণ গায় তারা জানে না, কোনও একটি রোগীর জন্যও তিনি ডাক্তার ডাকেননি। চিকিৎসা হলে বেঁচে থাকতে পারত ওরা, তেরেসার আশ্রমে চিকিৎসাহীনতায় মরতে হয়েছে ওদের! রাস্তায় পড়ে থাকলে বরং ভাল হত, একসময় কোনও দরদী লোক, একটি রিকশা করে অথবা টেনে হিঁচড়ে হলেও অন্তত হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারত, সে সুযোগ ছিল। রাস্তায় পড়ে মরতে থাকা রোগীদের মাদার তেরেসা আশ্রমে তুলেছেন, রাস্তায় না মরে বিছানায় রোগীরা মরেছে, এই হল পার্থক্য। যন্ত্রণায় সে সব রোগী চিৎকার করেছে, কিন্তু কাউকে তিনি একটি ব্যথা কমার ওষুধ দেননি। বলেছেন, যন্ত্রণা সইতে, কারণ প্রভু যিশু এই যন্ত্রণা দিচ্ছেন।

আর নিজের বেলায়, তাঁর অসুখের সময় কিন্তু চিকিৎসার অভাব হয়নি। সর্বাধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছে তাঁর জন্য, যিশুর দেওয়া যন্ত্রণা তাঁর পোহাতে হয়নি।

মারা তো গেলেন। দানিয়েল বলে।

ভালই তো হল। তাঁর প্রভুর কাছে গেলেন। প্রভু তাঁকে বিরাট পুরস্কার দেবেন। সারাজীবন এই প্রভুকে তুষ্ট করে গেছেন। পুরস্কারের লোভেই তো করেছেন। এ জগতের নোবেলও পাওয়া হল, ও জগতের নোবেলও হল।

মরুনি সিগারেট ধরায়। ধোঁয়া ছেড়ে বলে, এ তুমি ঠিক বলছ না নীলা। নিজের ভোগ বিলাসিতার কথা মাদার তেরেসা ভাবেননি।

নীলার উত্তপ্ত উচ্চ কণ্ঠ, বলো কী? কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ব্যাঙ্কে। সে টাকায় নিজের নামে এখানে ওখানে আশ্রম খুলছেন। পৃথিবীর তাবৎ লোক তাঁকে মহা সম্মান করছে। বিরাট তারকা তিনি। মানুষের প্রশংসা তিনি প্রতি মুহূর্তে ভোগ করেছেন।

দানিয়েল বলে, গরিব দেশের মানুষের দুঃখ দূর করতেই তিনি জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাই তিনি কলকাতা গেছেন।

নীলা বলে, আলবেনিয়া এমন কোনও ধনী দেশ ছিল না। আর ভারতে এসে ভারতের দারিদ্র্য ঘোচাতে তিনি বিন্দুমাত্র কিছু করেননি। সমাজের শ্রেণীভেদ সম্পর্কে কখনও তিনি প্রশ্ন তোলেননি। ধনী দরিদ্রের বৈষম্য নিয়ে কখনও না। ভারতের বড় বড় দুর্নীতিবাজদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। দিয়েছেন বলেই নিয়েছেন। কারা দিচ্ছে কেন দিচ্ছে, টাকাটা কী থেকে উপার্জন, তা একবারও দেখেননি, দেখতে চাননি। হাইতির স্বৈরাচারি জেনারেলের কাছ থেকেও তো টাকা নিয়েছেন। ভারতের কালোবাজারি, লুটেরা, বদমাশদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সমাজে ওদের সম্মানের জায়গায় বসিয়ে গেছেন। কারণ মাদার তেরেসাকে টাকা দিলে পুণ্যের কাজ করা হয়, সাত খুন মাপ হয়, কালো টাকা সাদাও হয়। আর কী জানতে চাও? ভারতের দারিদ্রের বড় একটি কারণ জনসংখ্যার আধিক্য। যেখানে জনসংখ্যা রোধ করা খুব জরুরি একটি ব্যাপার, সেখানে তোমাদের মাদার তেরেসা জন্মরোধের বিপক্ষে সোচ্চার হয়েছেন, ভারতের মতো দেশে। কনডম চলবে না, পিল চলবে না, যিশু মন খারাপ করবেন। এবরশন? তা তো চলবেই না, যিশু হার্টফেইল করবেন।

দানিয়েল আর মরুনি দুজনই উচ্চস্বরে হাসে।

ওয়াইন এক এক বোতল করে শেষ হয়, আর স্বর উঁচুতে উঠতে থাকে তিনজনেরই। সবচেয়ে বেশি ওঠে নীলার। দানিয়েল বলে, কেবল ওয়াইনের কারণে নয়, বাঙালিরা ওয়াইন না খেয়েও জোরে কথা বলে।

নীলা বলে, আমাদের বলতে হয়, প্রচুর জনসংখ্যা তো, এক বাড়িতে এগারোজন করে বাস করে। কিচিরমিচির হাউ মাউ লেগেই আছে। ঘরে মানুষ বাইরে মানুষ, যানবাহনের চিৎকার, ধুলোয় বাতাস ভারী হয়ে থাকে। চিৎকার না করলে কেউ কারও কথা শুনতে পাবে না। অভ্যেস।

নীলার এই হয়। পেটে ওয়াইন পড়লে বিরামহীন বকে যায়।

আবার নীলা মরুনিতে ফেরে, ধরো, এই মরুনির মা, তার বিয়ে হয়নি, বিয়ে না হয়ে বাচ্চা জন্ম দিয়েছে, আর এ এমনই পাপ, যে কোলের বাচ্চাকে আবর্জনায় ফেলে দিতে হয়েছে তার। কিন্তু এবরশন করার সুযোগ হলে, তাকে ওইন মাস বাচ্চা বইবার কষ্টটা ভোগ করতে হত না। আর একটি দুধের শিশুকে ছুঁড়ে ফেলার কষ্ট নিয়েও তাকে সারাজীবন বাঁচতে হত না।

মরুনি হেসে ওঠে, ও প্রভু, তা হলে আমার কী হত! ও মহিলা এবরশন করে ফেললে আমার তো জগৎ দেখা হত না।

জগৎ বলে যে একটা ব্যাপার আছে, তা তো জগতে এসে বুঝেছ। কয়েক সপ্তাহের ভ্রুণ মরুনি মারাটা অনেক ভাল, এক মাসের মানুষ মরুনিকে মারার চাইতে।

দানিয়েল থামায় নীলাকে, থামায়, কিন্তু, দানিয়েল কিছু বলার আগে মরুনি বলে, এবরশন করার সুযোগ হলেই কি সমাজে একটা বড় বিপ্লব ঘটে গেল। বিয়ে হয়নি বলে বাচ্চা জন্ম দেওয়া অপরাধ, এই নিয়মটি পালটানোর কথা বলছ না কেন নীলা!

নীলা এবার দুজনের উদ্দেশেই গলা নামিয়ে বলে, আমি তো বলছি না এ নিয়ম ভাল। মরুনির মা, তার বিয়ে হয়নি বলে, বা মেয়ে জন্মেছে বলে, বা মেয়ে কালো বলে সে কোনওরকম দুঃখ করবে না, এমন একটা সমাজই তো চাই।

দানিয়েল কাঁধ ঝাঁকায়, মুখ বাঁকায়, এরকম সমাজ চাই ওরকম সমাজ চাই, তা বললেই তো হয় না। সে সমাজ গড়ার জন্য কিছু করা চাই। কী করেছ তুমি নীলা? কিছু করেছ?

নীলার শান্ত কণ্ঠ, না কিছু করিনি।

পালিয়ে এসেছ এই তো!

হ্যাঁ পালিয়ে এসেছি। সুখে থাকতে এসেছি। যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াতে এসেছি।

মরুনির হাতের সিগারেটটি নিয়ে নীলা ফোঁকে। ধোঁয়ার রিং বানাতে বৃথা চেষ্টা করতে করতে বলে, ফরাসি বিপ্লবের মতো একটা বিপ্লব দরকার ভারতে।

বিপ্লবে তুমি কী অংশ নেবে? বুর্জোয় পরিবারে জন্ম তোমার, সুবিধে ষোলো আনা পাচ্ছ। দানিয়েল চোখ টিপে বলে।

নীলা হাসে, বুর্জোআজি ছাড়া ফরাসি বিপ্লব সম্ভব হত না।

খানিকক্ষণ ফরাসি বিপ্লব নিয়ে নীলা একা বকে গেল। এ নিয়ে কারও কথা বলার, নীলা লক্ষ করে, আগ্রহ নেই।

চৌদ্দই জুলাইয়ে কে কী করছে সে জানতে চায়। কেউ শাঁজ এলিজেতে কুচকাওয়াজ দেখতে যাবে না, মারণাস্ত্রের প্রদর্শনী দেখবে না, শিরাখের কৃত্রিম আর জসপার অকৃত্রিম হাসি দেখতে ওদের কারও উৎসাহ নেই। দানিয়েল আর নাতালি যাবে মিমিজঁ, আতলান্তিকের পারে, রোদ পোহাতে, সাঁতার কাটতে। মরুনি এখনও ঠিক করেনি কোথায় যাবে।

আর নীলা কী করবে? নীলা বসে বসে বেনোয়ার কথা ভাববে, ভাববে যে সে তাকে ভালবাসে, ভাববে যে সে যেখানেই থাকুক, যতদূরেই, নীলা সারাক্ষণ তার হৃদয়ে আছে।

এরকম ঘরে বসে থাকতে আমার ভাল লাগে না। একটা চাকরি টাকরি করলে ভাল হত। আর বসে খেলে তো রাজার ধনও ফুরিয়ে যায়। নীলা বলে।

তা ফুরোক। হাতে যখন টাকা আছে, যত পারো ঘুরে বেড়াও। যা আনন্দ করার করে নাও। বসে সময় নষ্ট করবে কেন! টাকা ফুরোলে তারপর চাকরি খুঁজো। আমার যদি এত টাকা থাকত, এই চাকরি ছেড়ে দিতাম। বেরিয়ে পড়তাম বিশ্ব ভ্রমণে। ভ্রমণ শেষ করে তারপর সাধারণ জীবনে ফিরতাম। যদি নটা পাঁচটা চাকরি করো, ভ্রমণের সময় এবং খরচা কোনওটাই জোগাড় করতে পারবে না। আর ওই বাক্সবন্দির মতো জায়গায় কাজ করে এত বড় বাড়িতে থাকা, হা হা স্বপ্ন। দানিয়েলের ঠোঁট বেঁকে থাকে।

নীলার একবার মনে হয় দানিয়েল তাকে ঈর্ষা করছে। আরেকবার নিজেকে শুধরে দেয় সে, না করছে না।

দানিয়েল বলে, কী ব্যাপার, একবারও তো জিজ্ঞেস করলে না সুইডেনে কেমন কাটালাম?

নীলার জিজ্ঞেস করতে হয় না, দানিয়েল নিজেই বলে সুইডেনের উত্তরে ল্যাপল্যান্ডে এবসুলুত পান করতে করতে রাত বারোটায় মাথার ওপর সূর্য দেখতে কেমন লেগেছিল। নিকল বুঝে পায়নি কখন রাত আর কখন দিন। চব্বিশ ঘণ্টাই আলো থাকলে বোঝা অসম্ভব বটে। শীতের সময় যেমন চব্বিশ ঘণ্টা ও জায়গা অন্ধকার, গরমে তার উলটো। যে জিনিসটি দেখে নিকল, মিশেল আর দানিয়েল হেসে বাঁচেনি তা হল, জেব্রা ক্রসিং-এ ভুল করে গাড়ি থামিয়ে ফেলে, রাস্তায় কোনও লোক ছিল না, কিছু না, কারও কোনও ক্ষতি হয়নি, কিন্তু মারিয়ার নিজে গিয়ে পুলিশকে তার ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গের কথা জানিয়ে জরিমানা দিয়ে আসা। যে জিনিসটিতে দানিয়েল মুগ্ধ হয়েছে তা হল সুইডেনে কোনও জেলখানা নেই, যা আছে তা হল ত্রুটি সংশোধন কেন্দ্র অথবা বয়স্ক শিক্ষায়তন। খুন করার পর বিচারে খুনির শাস্তি হলে পুলিশ এসে খুনিকে অনুরোধ করে, ত্রুটি সংশোধন কেন্দ্রে যেতে। খুনি যদি বলে তার সময় হবে না, তবে কবে সময় হবে জিজ্ঞেস করে। যেদিন সময় হয় সেদিন পুলিশ তাকে কেন্দ্রে ভর্তি করে দেয়, কেন্দ্রে দামি আসবাবে ভরা বাড়ি দিয়ে দেওয়া হয় আত্মীয়স্বজন নিয়ে থাকার, বাদশাহি খানা দেওয়া হয়। এই আয়েসি জীবনযাপনের বাইরে যা করতে হয়, তা হল রুটিন মতো ক্লাস করা। মাস্টাররা আসে নিয়মিত। ক্লাস নেয়। পরীক্ষা নেয়। পাশ করলে ব্যাস ছুটি। কারও ছুটি হয় দশ দিনে কারও তিন মাস লাগে। মাস্টারদের কাজ কেন লোকটি খুন করেছে, তার মনে কী সমস্যা ছিল, কীসের অভাব ছিল তার, তার শৈশব কেমন ছিল, ভালবাসা পরিমাণ মতো পেয়েছে কি না, তার গড়ে ওঠায় কোনও রকম ত্রুটি ছিল কি না এ সব খুঁটিয়ে দেখে বিশ্লেষণ করে, সমস্যার গভীরে গিয়ে সমস্যার সমাধান করা।

সুইডেনের গল্প শুনতে নীলার ইচ্ছে হয় না। এ সব গল্প তাকে মনে করিয়ে দেয় সে ক্ষুদ্র তুচ্ছ একটি মানুষ, যে কোথাও যাবার আমন্ত্রণ পাবার যোগ্য নয়। অহংকার করার একটি গল্পই তার আছে, সে বেনোয়া দুপঁ।

নীলা বলে, একবারও তো তুমি জিজ্ঞেস করলে না আমার প্রেমের কাহিনী!

দানিয়েল আগ্রহ দেখায় না, কিন্তু নীলা বেনোয়া দুপঁর সঙ্গে তার প্রথম দেখা, কাছে আসা, ভালবাসা, বেনোয়ার আলা ফলি প্রেম, বেনোয়ার বেনো জলে তার ভেসে যাওয়া ইত্যাদি বর্ণনা করে। দানিয়েলের প্রশ্নের উত্তরে অবশ্য এ তার বলতে হয় যে বেনোয়ার স্ত্রী কন্যা আছে।

শেষ অব্দি বেনোয়ার রক্ষিতা হয়ে জীবন কাটাতে শুরু করেছ! বাহ বাহ বাহ! অভিনন্দন। দানিয়েল জোরে তালি বাজায়।

নীলা দাঁতে দাঁতে চাপে, এত জোরে তালি বাজিয়ো না। প্রতিবেশীদের ঘুমের অসুবিধে হবে। উফ মাদাম সুজান দুগের আজ রাতে বুঝি ঘুম হল না।

ঠিক তখনই বেনোয়ার ফোন।

কী করছ?

আড্ডা দিচ্ছি, দুজন বন্ধুর সঙ্গে।

বন্ধু? ছেলে না মেয়ে?

মেয়ে।

সমকামী।

একজন। আরেকজন নয়।

তো কতক্ষণ আড্ডা দেবে?

জানি না।

ওরা যাবে তো? না কি থেকে যাবে তোমার বাড়ি?

জানি না।

নিশ্চয় জানো।

না জানি না।

আমার কথা জানে ওরা?

কেন?

বলো। বলো যে তোমার একজন প্রেমিক আছে।

কেন?

কেন নয়? লুকোতে চাও। আমি তো লুকোই না।

লুকোও না? কাকে কাকে বলেছ, আমার কথা?

বলেছি অনেককে।

কী বলেছ, বলেছ তোমার এক রক্ষিতা আছে, তাই না?

বাজে কথা বোলো না নীলা।

বাজে কথা নয়। সত্যি কথা।

খটাস।

আড্ডা গড়াতে গড়াতে আরও দূর যায়। নীলার মিমিজঁ যাবার শখ হয়। মরুনিরও হয়। দল বেঁধে না হোক তিজেভি ঘন ঘন যাচ্ছে বোরদো, চড়ে বসলেই হয় আজ বা কাল, দেখা হবে সাগরপারে।

রাত দুটোয় দানিয়েল বেরোয়। মরুনি আরও কয়েক গেলাস শেষ করে তিনটেয় ওঠে।

এত রাতে যাচ্ছ যে, তোমার ভয় লাগবে না রাস্তায়?

মরুনি আকাশ থেকে পড়ে, ভয় লাগবে কেন?

নীলা নিজেকে আবার শুধরে দেয়, এ কলকাতা নয় নীলা, এ প্যারিস।

কোনও এক সম্ভবত প্রতিমা পাল অথবা সরস্বতী দাসের মেয়ে মরুনির জন্য নীলা লক্ষ করে, অযথাই মায়া হচ্ছে তার। মরুনিকে চন্দনকাঠের একটি হাতি উপহার দিয়ে বলে, এর সুগন্ধ কোনও দিন যাবে না। কাছে রেখো।

মরুনি ধন্যবাদ বলে, চুমু খায় নীলার দু গালে। তারপর আলো থেকে আলোয় বেরিয়ে যায়। নীলা একা অন্ধকার বারান্দায় বসে চেয়ারে দুলতে দুলতে কল্পনা করে মরুনি ওই হাতিটির সুগন্ধ নিচ্ছে, ওই হাতিটিকে সে তার বিছানার কাছের টেবিলটিতে রাখবে, হাতিটি দেখতে দেখতে তার হয়তো একদিন মনে হবে কোথাও একটি দেশ আছে তার, সে দেশে এক দুঃখিতা গোপনে কাঁদছে তার হারিয়ে যাওয়া মেয়ের জন্য। সারাজীবন কেঁদে যাবে সেই দুঃখিতা। মরে পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও কাঁদবে সে।

মরে গেলে কেউ কি কাঁদে, নীলা ভাবে। মলিনা কি কোথাও বসে চোখের জল ফেলছেন নীলার জন্য!

চৌদ্দই জুলাই

চৌদ্দই জুলাইয়ের উৎসব শুরু হয়ে গেছে প্যারিসে। ফরাসি বিপ্লব নীলাকে উত্তেজিত করে ভীষণ, ফরাসিদের যে খুব একটা করছে তা মনে হচ্ছে না তার। বেনোয়া বলে ফরাসি বিপ্লব পালন করা মনে হয় সেই দিনটিকে পালন করা যেদিন আমার টাইফয়েড জ্বর হয়েছিল। বেনোয়া প্যারিস ছেড়ে রোদ পোহাতে চলে গেছে রিভিয়েরায়। ফরাসি বিপ্লবকে বিপ্লব বলেই মানে না সে, বলে খুনোখুনি। শাঁ জার্মা দি প্রের গিজা দেখিয়ে একদিন বলেছিল, এখানে ওই খুনোখুনির সময় গির্জার কত লোকদের নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছে! নীলা বলেছে, বেশ ভালই করেছে। গির্জার লোকেরা তো সুবিধে ভোগ করত সবচেয়ে বেশি। রাষ্ট্র আর গির্জাকে আলাদা করে বিপ্লবীরা মহৎ একটি কাজ করেছে। ওই ধর্মবাদীদের খুন না করলে বিপ্লব টিকে থাকত না। বেনোয়া বিড়বিড় করে, একদিকে নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা হল, অন্যদিকে গির্জার সম্পত্তির ওপর মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়া হল, বৃক্ষ কেটে বন উৎপাদনের মতো।

নীলা শাঁ জার্মার কোলাহলে দৃষ্টি ছড়িয়ে বলেছে, অবশ্য রাজা খেদিয়ে পরে আবার রাজা মেনে নেওয়াটা আমার কাছে একটু কেমন কেমন যেন লাগে। নেপোলিয়নও তো বেশ বিপ্লবীর মতো উড়ে এসে জুড়ে বসে সেই রাজাগিরিই শুরু করেছিলেন। আর বিপ্লবী ফরাসিরাও তা মেনে নিয়েছিল।

নেবার অবশ্য কারণ আছে। আর…গির্জার সবাই তো আর বিপ্লবের বিপক্ষে ছিল না। পক্ষেও ছিল অনেকে। বেনোয়ার চোখ তখনও ফিরে ফিরে দি প্রের গির্জায়।

নীলা বেনোয়ার কথার পেছনে কথা বলেই যাচ্ছিল পাশে বসে, পক্ষে ছিল কারণ ছোট জাতের ছিল তো। বড় জাতের মার খেয়ে ছোট জাত শত্রু দলে ভেড়ে।

তুমি তো গির্জা দেখে বেড়াও, তো গির্জার বিরুদ্ধে কেন বলো। বেনোয়া কঠিন স্বরে প্রশ্ন করেছে। কঠিনের উত্তর নীলা নরম করে দিয়েছে, প্যারিসের চব্বিশটি নতরদাম দেখা হয়ে গেছে। দেখেছি এ সবের স্থাপত্যসৌন্দর্য, আর কিছু নয়।

আচ্ছা তুমি কি সত্যিই বলতে চাও যে তুমি ধর্মে বিশ্বাস করো না? সে দিনও বেনোয়া জিজ্ঞেস করেছে। নীলা বলেছে, আমি ইগালিতে, লিবার্তে আর ফ্রাতারনিতেয় বিশ্বাস করি।

তুমি খুব প্রশ্ন এড়িয়ে যাও, নীলা।

বেনোয়ার অভিযোগের কোনও উত্তর নীলা দেয়নি।

নিস থেকে বেনোয়া ফোনে খবর নেয় নীলার, নীলা কেমন আছে, কী করছে, কী ভাবছে। বেনোয়া বলে সে তীরের বালুতে তোয়ালে পেতে শুয়ে আছে, চোখে রোদ চশমা, পাশে পাসকালও শুয়ে আছে, এল ম্যাগাজিন পড়ছে, ওর নিম্নাঙ্গে এক টুকরো কাপড় শুধু, বাকিটা খোলা। পাসকালের গায়ে সে সানটান মেখে দিয়েছে খানিক আগে। জ্যাকলিন বালুতে খেলছে। একফোঁটা মেঘ নেই আকাশে, পরিষ্কার নীল আকাশ। আকাশ দেখতে দেখতে বেনোয়ার নীলাকে মনে পড়ছে।

কদিন থেকে সামুদ্রিক মাছই খাচ্ছে বেনোয়া।

কাল মন্টে কারলো যাবে।

পরশু মনাকো।

বেনোয়ার কণ্ঠে সুখ ফেনিয়ে উঠছে।

নীলার ইচ্ছে করে না বেনোয়ার সুখের গল্প শুনতে। তার ভয় হয় বেনোয়া হয়তো নিখুঁত বর্ণনা করে বসবে জ্যোৎস্নারাতে পাসকালের সঙ্গে সে কী করে ভালবাসা ভালবাসা খেলেছে অর্ধেক জলে অর্ধেক বালুতে। একবার সে বলেওছিল তাকে যে, গরমকালে ঘরে সম্ভোগে মজা নেই, মজা বনে, সমুদ্রপারে। চাঁদের আলোয় পাসকালকে নিশ্চয় অপ্সরীর মতো লেগেছে, আর বেনোয়া তার নোনা জলের ঢেউয়ের সঙ্গে নেচেছে।

ভয়ে অথবা শোধ নিতে, নীলার বিশ্বাস শোধ নিতেই, সে বাড়ি থেকে বেরোয়, মিমিজঁ অনেকটা ঘরের মধ্যে পৌঁছে। পথে অতলান্তিকের চেয়ে ভূমধ্যসাগরই ঢেউ তুলেছে বেশি। এভিন্যু দু ল্যাকে একটি হোটেল নিয়ে সারা দুপুর সে শুয়ে থাকে। রোদ খানিকটা নরম হলে বেরোয় সমুদ্রপারের দিকে। উচ্ছল উদ্দাম উলঙ্গ নারী পুরুষের ভিড় চারদিকে, দীর্ঘ বালুতীরে সারা শরীরের মেলা। নীলা একা বোধ করে। কেউ তার দিকে ফিরে তাকায়, যদি তাকায় কেউ, নীলা বেমানান বলে তাকায়। সমুদ্রপারে শরীর ভরে কাপড়চোপড় পরে গরমকালে কেউ আসে না। গাছের ছায়ার বেমানান নীলা একা বসে থাকে। নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হয় নিজেব কাছেই। বেনোয়া অন্তত আকাশের দিকে তাকিয়ে নীলার কথা ভাবে। কোথাও তো আর কেউ নেই তাকে ভাবার। যে ভাবে, সে যদি আরেকটি শরীরে বুঁদ হয়, হোক। নীলা ঠকে যায়, এর নাম শোধ নেওয়া নয়, শোধ নেওয়া হতে পারত সে যদি কোনও সুদর্শন পুরুষকে সঙ্গী করে মিমিজঁ আসত, একা নয়, সে যদি জ্যোৎস্নারাতে সেই পুরুষকে বলতে পারত জ তেম, যদি সে নোনা জলে আর সাদা বালুতে মিশে ভালবাসার গোপন খেলা খেলতে পারত। বেনোয়া ছাড়া আর কোনও পুরুষকে তার গভীর নিকটে কল্পনা করতে চেষ্টা করে, ভেবে তার গা গুলিয়ে ওঠে অন্য এক পুরুষকে সে জ তেম বলছে।

নীলা ফিরে যায় হোটলের ঘরে। একা জানালায় বসে সমুদ্রের নীলের সঙ্গে আকাশের নীলের সঙ্গম দেখে।

সন্ধেয় মরুনির সঙ্গে কথা হয় নীলার। বন্ধু নিয়ে গতকাল মিমিজঁ পৌঁছেছে সে।

দানিয়েলের সঙ্গে মরুনির কথা হয়েছে, দানিয়েল আর নাতালি গানের উৎসবে গেছে।

তুমি কি সেখানে যেতে চাও?

ঠিক জানি না।

কী করবে তা হলে?

ঠিক জানি না।

হোটেলে বসে থাকতে মিমিজঁ এসেছ।

কি জানি না।

মরুনি হেসে ওঠে। কী ভাষায় হাসে মরুনি, নীলা ভাবে। হাসি বা কান্নার কোনও ভাষা আছে কি?

নীলা বেজোড়, জোড়দের আনন্দক্ষণে বেজোড় আস্ত আপদ ছাড়া কিছু নয়।

আপদটিকে মরুনি উপেক্ষা করে না। সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে বেরোয় সাগরপারে। সাগর জলে ঢেউয়ের উৎসব, পারে উৎসবের ঢেউ। হাঁটতে হাঁটতে রক্ত আর গৌরবের উৎসবে নীলার গতি শ্লথ হয়। মরুনি দ্রুত হাঁটে। বোহা রেকর্ডসের সিডি বিক্রি হচ্ছে মঞ্চের কাছ থেকে।

জিনস, বুট, বোম্বার জ্যাকেটের টাটুঅলা, ন্যাড়ামাথা ছেলের দলের উদ্দাম উৎসবে অভিভূত চোখ নীলার। বড় ব্যানারে ওআই, স্কা, ছোটতে স্নিক্স, কিডন্যাপ, তলবিয়াক টোডস, ওয়ারিওর কিডস, কমিটারন সেক্ট, দ্য হেরবেরটস। আর ছোটবড় ব্যানারের মধ্যিখানে নীলা। সমুদ্রের গর্জন ছাপিয়ে উঠছে ন্যাড়াদের গর্জন, ল ভলনত দ্য লা নেশন এরিয়েন। নীলা দু হাতে কান চেপে মরুনির দিকে এগোতে থাকে, তখনই রেনজারস্কিনের ধাক্কা, ডক মারটেনের মুহুর্মুহু লাথি নীলার পিঠে, উপুড় হয়ে পড়ে নীলা, পড়ে ফ্যানজাইনে। মরুনি দৌড়ে নীলাকে তুলতে আসে যেই, সেও পড়ে উপুড় হয়ে। কটি গোলাপি আর সবুজচুলো পাংক ভিড় ঠেলে নীলা আর মরুনিকে ওঠায়, নীলার গালে সেঁটে থাকে ফরাসি চুমুর মতো ফ্যানজাইনের গৌরব আর মরুনির দু হাতে রক্ত।

এই বুঝি লিবার্তে ইগালিতের উৎসব! একটি গোলাপি পাংক চেঁচিয়ে বলে।

সবুজ পাংক মরুনিকে পাঁজাকোলা তুলে দৌড়ে যায় রাস্তার দিকে। পেছন পেছন বাকিরা।

ওদিকে গোলাপি পাংক রাইট রাইট করে চেঁচাচ্ছিল। পরিষ্কার ইংরেজিতে গোলাপিকে উত্তর দেয় এক দশাসই ন্যাড়া, দে হ্যাভ দ্য গড গিভন রাইট টু বিলিভ হোয়াটএভার দে ওয়ান্ট, বাট আই হ্যাভ দ্য গড গিভন রাইট টু কিক দেয়ার অ্যাস।

মরুনি যখন অপারেশন থিয়েটারে, হাসপাতালে নীলার বিছানার পাশে বসে নাতালি, দানিয়েল আর ফ্রেডেরিক–মরুনির প্রেমিক বর্ণনা করে যায় ন্যাড়াদের দৌরাত্ম্য। নাতালি কদিন আগেই নাকি দেখেছে এক ন্যাড়াকে সেইনের জলে ধাক্কা দিয়ে এক মরককান ছেলেকে ফেলতে। ফ্রেডেরিক দেখে এসেছে বোহা রেকর্ডস-এর দুই ন্যাড়া পুলিশকে ধমকে বসিয়ে দিচ্ছে। এদিকে নীলার বোকামো দেখে বোকা বনে যাচ্ছে দানিয়েল, ন্যাড়াদের ভিড়ে মরতে যেতে নীলাকে কে বলেছিল।

নীলা শোনে।

নীলার চৌদ্দই জুলাই কাটে।

এ প্রবাসে মজি প্রেম-ভাবে

সমুদ্রস্নান সেরে ফিরে বেনোয়া নীলাকে নিয়ে হাওয়া খেতে বেরোয়। ভেরসাই বাগানের হাওয়া বেশ সুস্বাদু হাওয়া। লা নত্রের বানানো দু হাজার একর জমির ওপর অসম্ভব সুন্দর বাগানটিতে হাঁটতে হাঁটতে ফোয়ারার জলে আধেক ভিজে গ্র্যান্ড ক্যানেলের পাশে বসে দুজন, সূর্যরাজার প্রাসাদের দিকে মুখ করে।

যাবে দেখতে প্রাসাদ? সূর্যরাজার শোবার ঘর, রানি মারি তেরেসের ঘর?

নীলা সবুজ ঘাস ছিঁড়ে দাঁতে কাটতে কাটতে বলে, রাজা রানির শোবার ঘর আলাদা ছিল কেন!

বেনোয়া বলে এত বড় প্রাসাদ। ঠেলাঠেলি করে থাকার কী দরকার।

ঘাসের একটি ডগা বেনোয়ার ঠোঁটে ছুঁইয়ে নীলা বলে নাকি তিন তিনটে রক্ষিতা নিয়ে তোমাদের লুইয়ের সময় কাটত বলে।

নীলাকে চুমু খেয়ে বেনোয়া বলে, আমাদের লুই তাঁর রক্ষিতাকে বিয়েও করেছিলেন।

নীলা ঘাসের ওপর শুয়ে আকাশের দিকে মুখ করে বলে, বিয়ে করে সেই বউয়ের শোবার ঘরও আলাদা করে দিয়েছিলেন।

বাদ দাও। যাবে নাকি প্রাসাদের ভেতর? বেনোয়া তাড়া দেয়।

নীলা তেমন শুয়ে থেকেই বলে, বাদ দাও, ওসব ঝকঝকে তকতকে প্রাচুর্য দেখলে আমার গা শিউরে ওঠে।

কেন শিউরে ওঠে?

নিজেকে এক দরিদ্র দীন হীন প্রজার মতো মনে হয়। মনে হয় রাজাদের চাবুকের মার খাচ্ছি। অকারণে।

বেনোয়া দু হাতের কনুইয়ে ভর রেখে পেছনে গা হেলিয়ে বলে, চলো যাই ভেরসাই চুক্তির আয়নাঘরটা অন্তত তোমাকে দেখিয়ে আনি।

নীলা বেনোয়ার বাঁ হাতটি হাতে নিয়ে আঙুলগুলো নিজের গালে ছোঁয়ায়। গালে বেনোয়ার তর্জনীর সোনার অঙ্গুরির স্পর্শ, বেনোয়ার সঙ্গে পাসকালের বন্ধনের স্পর্শ।

ওই আয়নাঘর দেখে কী লাভ? ভেরসাই চুক্তি তো কোনও শান্তি আনেনি, বরং আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ ঘটিয়েছে।

বেনোয়া উঠে বসে, উলটোপালটা না বকে বলো, এখান থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না।

হাওয়ায় নীলার চুল ওড়ে। চুলে বুক ঢেকে যায়, মুখ ঢেকে যায়। উঠে হাতখোঁপা করে বলে যে সে ওই প্রাসাদে যাবে না, যাবে বারো নম্বর রু দ্য শাতিয়ে তে।

ওখানে কী আছে?

ওখানে প্রাসাদ নয়, ভাঙা একটি বাড়ি আছে। সে বাড়িতে এককালে এক কবি থাকতেন। খুব বড় কবি।

কী নাম সেই কবির?

মধুসূদন দত্ত।

বেনোয়া বলে, এ আবার কী অদ্ভুত নাম? এ তো ফরাসি নাম নয়।

অসকার ওয়াইভও তো ফরাসি নাম নয়। গারট্রুড স্টাইনও নয়, হেনরিক ইবসেনও নয়। এই নামগুলো কি অদ্ভুত লাগে তোমার কাছে? নিজেই উত্তর দেয় সে লাগে না।

মধুসূদন দত্ত বাঙালি ছিলেন। নীলা বলে।

ও সে কথা বলো। বাঙালি!

বেনোয়া শ্বাস ফেলে বড় নিশ্চিন্তে, বাঙালি কবির নাম না জানা আর আমাজান জঙ্গলের কোনও ক্ষুদ্র কীটের নাম না জানা একই কথা, কিছু যায় আসে না।

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি মধুসূদনের নাম জানবে কেন? ভারতের কারও নাম যদি জানো, জানবে সাঁইবাবার নাম, দীপক চোপড়ার নাম, স্বামী প্রভুপাদের নাম। যতসব প্রতারকের নাম।

বেনোয়া মধুসূদন সম্পর্কে জানার আগ্রহ না দেখালেও নীলা বলে যায় মধুসুদন কে ছিলেন, নীলা নিজেকেই শোনায় মধুসূদনের গল্প। মধুসূদন জমিদারপুত্র ছিলেন। খুব অল্প বয়স থেকেই ইয়োরোপীয় সংস্কৃতির প্রতি অন্ধ মোহ ছিল ওঁর। নিজের পোশাক ছেড়ে ইয়োরোপীয় পোশাক পরতেন। বাংলা ছেড়ে ইংরেজিতে কবিতা লিখতে শুরু করলেন এক সময়। হিন্দুধর্ম ছেড়ে ক্রিশ্চান হয়েছিলেন। নিজের সংস্কৃতিকে এমনই ঘৃণা করতেন যে বলেছিলেন, ঈশ্বর অ্যাংলো স্যাক্সনকে জগতে পাঠিয়েছেন হিন্দুদের উদ্ধার করতে, সভ্য করতে, এক কথায় ক্রিশ্চান করতে। মাদ্রাজে থাকাকালীন ফরাসি মেয়ে হেনরিয়েটার প্রেমে পড়ে ওঁকে বিয়েও করলেন। জাত কুল সব গেল, বাবা তাড়িয়ে দিলেন বাড়ি থেকে। ইংল্যান্ডে এসে ব্যারিস্টারি পাশ করেছেন। চরম অভাবে অনাহারে দিন কাটাতেন এখানে, এই ভেরসাইয়ে, কলকাতা থেকে বন্ধুরা টাকাপয়সা পাঠিয়ে মধুসূদনকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। এ দেশে এসে তিনি প্রথম দিকে বেশ আনন্দে ছিলেন কারণ ফরাসিরা তাঁকে ড্যাম নিগার বলে অন্তত গাল দেয় না, ইংরেজরা যেমন দেয়, বরং ফরাসি সম্রাট এবং সম্রাজ্ঞীকে কুর্নিশ করলে পালটা কুর্নিশ পাওয়া যায়, বলতেন। ইওরোপীয় ভাষায় সাহিত্য রচনা করে তিনি খ্যাতি লাভ করবেন যে স্বপ্ন ছিল তাঁর, কাটে। মোহ কেটে যায়। অতীতে ফেরেন, সাগরদাঁড়িতে তাঁর শৈশবের নদ কপোতাক্ষের কথা মনে পড়ে তাঁর,

সতত যেমতি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া মন্ত্রধ্বনি তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে!
বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?
দুগ্ধ শ্রোতরূপী তুমি জন্মভূমি স্তনে!…
এ প্রবাসে মজি প্রেম-ভাবে
লইছে যে তব নাম বঙ্গের সঙ্গীতে!

কেবল নদ নয়, মনে পড়ে ফেলে আসা নদীতীরের বটবৃক্ষ, ভাঙা শিবমন্দির, বউ কথা কও পাখি, অন্নপূর্ণার ঝাঁপি, রামায়ণ, মহাভারত, গৌরবজ্জ্বল প্রাচীন ভারত।…ভেরসাইয়ে থাকাকালীন ইতালিয়ান কবি পেত্রার্কার সনেটের অনুকরণে কিছু সনেট লিখেছিলেন। পেত্রার্কার সঙ্গে মধুসূদনের বেশ মিল ছিল বলতে হবে। পেত্রার্কার বাবা ছিলেন আইনজীবী, পেত্রার্কাকে আইন পড়িয়েছিলেন, কিন্তু সব ছেড়ে ছুঁড়ে পেত্রার্ক ডুব দিয়েছিলেন ধ্রুপদী ভাষা ও সাহিত্যের বিশাল সমুদ্রে। মধুসূদনও তেমন। অবশ্য পার্থক্য যা ছিল, তা হল, পেত্রার্কা যেমন তাঁর প্রেমিকা লরাকে নিয়েই সনেট লিখতেন, মধুসূদন তা মোটেও করেননি। বোদলেয়ারের সঙ্গেও কিছুটা মেলে, বোহেমিয়ান ছিলেন, ভোগ বিলাসের নেশা ছিল, ধার করে মদ খেতেন। ভেরসাই থেকে তিনি কলকাতা ফিরে যান, ভাগ্যিস ফিরে গিয়েছিলেন, না ফিরলে বাংলা সাহিত্যকে এত সমৃদ্ধ করত কে! মধুসুদনের ভুল স্বপ্ন কেটেছিল বলেই বাংলা সাহিত্য আজ সমৃদ্ধ তাঁর চতুর্দশপদী কাব্যে, মেঘনাদ বধ কাব্যে। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীকে তিনি নতুন করে গড়েছেন, দৈবশক্তির বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রামের জয়গান গেয়েছেন। নীলা বারো নম্বর রু দ্য শাঁতিয়ের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পাথরের ফলকটি দেখে

LE POETE INDIEN

MICHAEL MADHUSUDAN DATTA
(1824-1873)

A DEMEURE DANS CATTE MAISON
DE 1863 A1865
ET Y A COMPOSE EN BENGALI
DES SONNETS ET DES FABIES

বাড়িটির সামনে উবু হয়ে ধুলো নিয়ে কপালে ছোঁয়ায়। দেখে হেসে ওঠে বেনোয়া, এ কী করছ?

মধুসূদনকে কুর্নিশ করলাম।

মধুসুদনকে কুর্নিশ করলে না কি ফ্রান্সের মাটি কপালে ছোঁয়ালে?

এ মাটিতে মধুসূদন একদিন হেঁটেছিলেন, সে কারণেই করা। নীলা শাতিয়ের রাস্তায় উদাস হাঁটতে হাঁটতে বলে।

সে মাটির ওপর কত মাটি পড়েছে। কত লুই কত ফিলিপ, কত ভালেরি কত,

বেনোয়ার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে নীলা বলে, কত বেনোয়া, কত পাসকাল, কত জ্যাকলিন…

প্রসঙ্গে পালটে বলে, তা কেমন কাটালে সমুদ্রপারে?

বেনোয়া উত্তর দেয় না।

গাড়িতে উঠে বেনো দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তুমি খুব বদলে গেছ নীলা।

কী করে বুঝলে! নীলা বলে।

সবসময় আমার হাত ধরে হাঁটতে, আজ হাতই ধরেনি।

বোয়ার অভিযোগ সে খণ্ডায়, মনে করিয়ে দেয় সে প্রাসাদের বাগানে বসে তার হাত নিয়েছে হাতে, সুন্দর সাদা আঙুলে সোনার অঙ্গুরিটি চমৎকার মানিয়েছে, দেখেছে।

নীলা তুমি আমাকে বোকা বানাচ্ছ! বেনোয়া ক্ষীণ স্বরে বলে।

আমি দুর্বল, দীন, হীন, ক্ষীণ, তোমাকে বোকা বানাবার সাধ্য আমার হবে কেন!

প্যারিসে ফিরতে ফিরতে নীলা ভাবে, বেনোয়া চৌদ্দই জুলাইয়ের ঘটনার কথা রিভিয়েরা থেকে ফেরার পর আর তুলছে না। যদিও বলেছিল প্যারিস ফিরে এসে সে এ নিয়ে কথা বলবে। প্রথম রাতেই ঘটনা জানিয়েছিল নীলা, বিস্তারিত শোনার পর বেনোয়ার প্রথম প্রশ্ন ছিল, কেন তুমি মিমিজঁ গেছ?

নীলা বলেছে সে মিমিজঁ গেছে, কারণ তার ইচ্ছে হয়েছিল। বেনোয়া অবাক হয়েছে নীলার অদ্ভুত ইচ্ছের কথা শুনে, একা একা সমুদ্রপারে কারও কি ইচ্ছে করে যেতে, বেনোয়া কি রিভিয়েরা একা যেত, যদি না বউ বাচ্চা না থাকত সঙ্গে! যেতে পারত নীলাকে নিয়ে, একা নয়। ওসব জায়গায় সঙ্গী ছাড়া যাওয়ার কোনও মানে হয় না।

অপেক্ষা করতে পারতে। আমি তোমাকে নিয়ে যেতাম মিমিজঁ। হঠাৎ হঠাৎ কী যে সব কাণ্ড ঘটাও তুমি নীলা।

নীলা নিজের চেয়ে মরুনির জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বেশি। বেনোয়া বলেছে, মরুনিটা আবার কে? এর নাম তো তোমার মুখে আগে শুনিনি।

তারপর মরুনির সঙ্গে কী করে পরিচয় হল, কোথায় হল ইত্যাদি খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করেছে।

শেষে অবশ্য সান্ত্বনা দিয়েছে, ভিড়ের মধ্যে এ সব হই হট্টগোলে পড়লে কত রকম দুর্ঘটনা ঘটে। এই এখানেই তো জ্যাকলিনের বয়সি একটা বাচ্চা হারিয়ে গেল সেদিন বিকেলে। ঘন্টা চারেক পর বাচ্চাটির খোঁজ পাওয়া গেছে। ছিল একটি ক্যান্ডির দোকানে।

নীলা যখন তার লাথি খাওয়া আর মরুনির পেটে ছুরি খাওয়ার সঙ্গে বাচ্চা হারিয়ে যাওয়ার দুর্ঘটনা এক নয় বোলে বলে এবং স্পষ্ট করে বলে, ওরা বর্ণবাদী ছিল, বেনোয়া ঠিক নিশ্চিত হতে পারেনি। বলেছে, মোটা বুটের কথা বলছ তো! ও সব কিন্তু সমকামীরাও পরে।

আর যদি বর্ণবাদী ওরা হয়েই থাকে, তবে খুব ছোট দল এরা। গান বাজনা করে, বুদ্ধি শুদ্ধি এখনও হয়নি, ভাল শিক্ষা পায়নি, অথবা শৈশবে এদের অভিভাবক এদের মন মানসিক সুস্থ করে গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ট পরিশ্রম করেননি, এ সব নানা কারণ দেখিয়েছে। নীলা বেনোয়ার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ মন দিয়ে শুনেছে, শুনেছে কারণ সে বেনোয়া, তার প্রেমিক, সুদর্শন, সুপুরুষ, একোল নরমাল-এর ছাত্র, বিজ্ঞানী, হাই টেক, হাই ফাই, সাদা। আর বেশি কী গুণ থাকতে পারে একজন মানুষের।

ওই ঘটনার আর নতুন কোনও ব্যাখ্যা নীলা এখন শুনতেও চায় না। ফুটো পেট সেলাই হবার পর মরুনির পাশে সারারাত জেগে বসেছিল নীলা, নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য ক্ষমা চেয়েছে। মরুনি হেসে বলেছে, ক্ষমা চাচ্ছ কেন, ও কি তোমার দোষ ছিল, তুমি কি জানতে ওখানে কারা কী করছে? আমার বরং দূর থেকে অনুমান করা উচিত ছিল। সমুদ্রের হাওয়া খেতে এসেছিলাম কি এত সতর্ক থাকার জন্য। যাক, ভাল যে বেঁচে গেছি।

নীলাও বেঁচেছে, নীলারও তো হাড়গোড় ভাঙতে পারত, বুটের চাপে ফুসফুস ফেটে যেতে পারত, হৃৎপিণ্ড ফুটো হতে পারত। হয়নি। দানিয়েল এক্সরের কাগজ হাতে নিয়ে সুখবর সুখবর বলে চেঁচিয়েছিল। সুখবরই বটে।

নীলার হাতের ওপর কালো কোমল হাত রেখে মনি বলেছে, যে এক মাসের বাচ্চা আবর্জনার স্তূপে চাপা পড়ে মরেনি, সে কেন সুস্থ সবল হবার পর আপেল কাটার সামান্য ছুরির আঘাতে মরবে?

ফ্রেডেরিক মরুনিকে নিয়ে পরদিন প্যারিসে রওনা হয়ে যাবার পর নীলার আর থাকতে ইচ্ছে করেনি, সেও মিমিজঁ থেকে প্যারিসে ফিরেছে, দানিয়েল আর নাতালি অবশ্য আরও দুদিন কাটিয়ে তবে ফিরেছে।

প্যারিসে ফেরার পর রিভিয়েরা থেকে প্রতিদিনই বেনোয়া নীলাকে ফোনে জ তেম বলেছে। প্যারিসের আবহাওয়ার খবর নিয়েছে, নীলা কী খেয়েছে, কী পরে আছে, বেনোয়াকে মনে পড়েছে কি না, ওকে ভালবাসে কি না এ সব জিজ্ঞেস করেছে। নীলা বলেছিল ওই ঘটনার কথা সে ভুলতে পারছে না, রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠে দেখে বুক ধড়ফড় করছে, গা ঘামছে। বেনোয়া তখন বলেছিল, ও প্যারিস ফিরে এ নিয়ে কথা বলবে।

পথে গাড়ি থামিয়ে যখন ক্যাফেতে বসল, নীলা ভেবেছিল, বুঝি অতলান্তিকের পাড়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা বা দুর্ঘটনার কথা পাড়বে বেনোয়া। এখনও নীলার হাঁটুর কাছে ফুলে আছে, পিঠে নীল দাগ পড়ে আছে, কাঁধ নাড়লে এখনও টনটন করে, এ সব কথা নীলারও বলা বাকি রয়ে গেছে। কফি খেতে খেতে বেনোয়া মনাকোর গল্প করে। মনাকোতে যারা আছে সুখে আছে। কর দিতে হয় না। যা উপার্জন করো, তা ভোগ করো। ফরাসি সরকারকে উপার্জনের তিরিশ পঁয়ত্রিশ ভাগ দিয়ে ধুয়ে থাকে কী! মনাকোতে থাকলে টাকাটা বাঁচত। কফি খেয়ে শহরে দু চার পাক ঘুরে পঁ নফের কাছাকাছি গাড়ি রেখে হেঁটে যায় দুজন,হাঁটতে হাঁটতে নতরদাম সেতুতে, সামনের যে সেতুর ওপর দাঁড়ালে নতরদাম দ্য পারির আগপাশতলা দেখা যায়, সেখানেই দাঁড়ায় নীলা সেইনের জল দেখব বলে, সেইন দেখলে যা হয় ওর, জলে জনদার্কের ছাই ভাসতে দেখে, এত বছর আগের ছাই, ভেসে গেছে কোথায়, তবু তার মনে হয় সেইন জানে, সেইনের প্রতি বিন্দু জল জানে, কোনও একদিন সাহসী এক কিশোরীর গা পোড়ানো ছাই এসে পড়েছিল এই জলের শরীরে, আসলে ছাই তো দেখে না, গোটা জনদার্ককেই দেখে জলে, সেইনের আর গঙ্গার জলে কোনও কি তফাত আছে, প্রশ্নটি হঠাৎই একটি পালকের মতো যেন উড়ে এল, গঙ্গার জলও তো দেখতে এমন, ঘোলা, জগতের সব জলই আসলে এক, এরকম একটি উত্তর মতো ভাবতে ভাবতে সেতুর রেলিং থেকে সরে আসে নীলা, জল থেকে চোখ সরে এসেছে, জনদার্ক থেকেও, চোখ তখন পাথরের সেতুতে, মন তখন গঙ্গায়, নাহ! গঙ্গা অন্যরকম, গঙ্গার জল বাঁধনছেঁড়া, আর সেইন যেন একোয়রিয়াম, সেইনের সঙ্গে জীবনযাপন হয় না, যা হয় গঙ্গার সঙ্গে, জগতের সব জল এক নয়। গঙ্গার জল ছাপিয়ে মন তখন নয়েল ক্যাথারিনে। ক্যাথারিন গ্র্যান্ডও এখানে, ঠিক যেখানে নীলা দাঁড়িয়েছিল কোনও একদিন। নীলার মতো ক্যাথারিনও ছিল কলকাতার মেয়ে, চন্দননগরের ফরাসি বড়কর্তার অসাধারণ রূপসি কন্যা, মর্তের মানবী নয়, স্বর্গের অপ্সরা, কলকাতার ইংরেজ ফরাসি যুবকদের নিদ্রা হরণ করা ক্যাথারিন। সেই অপ্সরার বিয়ে হয়ে গেল বেশি বয়সের এক ইংরেজ অফিসার ফ্রান্সিস গ্র্যান্ডের সঙ্গে, চন্দননগরের গিজায়। ফরাসি বিপ্লব তখনও শুরু হয়নি। ক্যাথারিনের প্রেমে উতলা ফরাসি যুবক ফিলিপ রাতের অন্ধকারে পাঁচিল টপকে গিয়েছিল ক্যাথারিনের শোবার ঘরে, জানাজানি হয়ে গেল ফিলিপের কীর্তি, ফ্রান্সিস মামলা করে ফিলিপকে পঞ্চাশহাজার সিকা টাকা জরিমানা দেওয়াল, ঢি ঢি পড়ে গেল চন্দননগরে, কলকাতায়, ক্যাথারিনকে হতে হল তার ফরাসি প্রেমিক ফিলিপের রক্ষিতা। হায় ক্যাথারিন। অপ্সরার কপালে রক্ষিতা হওয়াই ছিল! এক পুরুষের হাত থেকে আরেক পুরুষে চালান হল বেচারি, কলকাতা থেকে লন্ডন এসেও, প্যারিস এসেও রক্ষিতার ভাগ্য বদলায়নি৷ নীলার বয়সেই প্যারিসে এসেছিল সে আর হোটেল দ্য ভিল থেকে হাঁটতে হাঁটতে একদিন এই সেতুতে, সেতুটি তখন কাঠের, সেতুর ওপর কত কিসিমের লোক বসে থাকত, ফেরিঅলা, ভিখিরি, মদ্যপ…ক্যাথারিনের জামা ধরে টেনেছিল এক দুষ্ট লোক, আর আরও কিছু দুষ্ট লোক তা দেখে হা হা হেসেছিল। ক্যাথারিনের অস্তিত্ব নীলা অনুভব করে নিজের ভেতর, যদিও দুজন দেখতে এক নয়, ক্যাথারিন ছিল গোরা, ক্যাথারিনের ছিল সোনালি চুল, নীল চোখ, নীলার রং বাদামি, কালো চুল, কালো চোখ, কানো মখমল চোখ! হাত থেকে হাতে গড়িয়ে, শেষে ক্যাথারিন গড়িয়ে পড়ল তালের কোলে। মঁসিয়ে তালেরর রক্ষিতা হয়ে। তালের তখন পররাষ্ট্র সচিব। বিদেশি দুতের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় আলাপ আলোচনা তালেরর চেয়ে ক্যাথারিনেরই বেশি হয়। প্যারিসেও ঢি ঢি পড়ে গেল, নেপোলিয়ন বললেন এ কী কাণ্ড তালের! রক্ষিতা দিয়ে রাষ্ট্রের কাজ চালাচ্ছ! ক্যাথারিন শেষ দিকে দুষ্ট্রর সঙ্গে দুষ্টুমিও করেছে, নেপোলিয়ানকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বলেছে, তালেরঁর সন্তান আমার গর্ভে। নেপোলিয়ান তখন সন্তান বলতে অজ্ঞান, সন্তান হচ্ছে না বলে শখের বউ জোসেফিনকে ত্যাগ করে মারি লুইসকে বিয়ে করার কথা অব্দি ভাবছেন। তক্ষুনি তালেরঁকে আদেশ করলেন রক্ষিতাকে বিয়ে করার, নেপোলিয়ানের আদেশ অমান্য করার বুকের পাটা তালেরঁর ছিল না। শেষ অব্দি জীবনভর রক্ষিতা হিসেবে পড়ে থাকার দিন শেষ হয় ক্যাথারিনের, কলকাতার টানে ফরাসি বলা মেয়ে, এর ওর রক্ষিত হয়ে জীবনের অনেক বছর কাটানোর পর হল পড়ন্ত বয়সে এক মন্ত্রীর বউ। ওই দুষ্টমিটুকু না করলে অবশ্য রক্ষিতা হয়েই বাকি জীবন তার বেঁচে থাকতে হত। নীলার মনে হয় যেন দুশো বছর পর সেই ক্যাথারিনই আবার এসে দাঁড়িয়েছে এই সেতুতে।

শহরভর্তি মানুষ, মানুষের কাঁধে কাঁধে মানুষ, পায়ে পায়ে কুকুর, কাউকে নীলার চেনা লাগে না। অন্য কোনও গ্রহ থেকে নেমে আসা এরা, না কি সে নিজেই অন্য গ্রহের। না কি নীলারই এমন, আর কারও নয়, খালি খালি লাগে। পাছে পাতা ধরলেও মনে হয় ধরেনি, ফুলগুলোকেও মনে হয় ফুল নয়, যখন ঘাসে হাঁটে, ঘাসগুলোকে পাথর মতো লাগে, মেঘগুলোকেও ঠিক মেঘ মনে হয় না, চাঁদকেও চাঁদ না। রোদ্দুর গড়াচ্ছে গায়ে, তবু মনে হয় প্রতি কণা ত্বক সেঁধিয়ে গেছে লোমকূপের অন্ধকারে। রাতে নিয়ন আলোর নীচেও এক শরীর অন্ধকার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে, আর ওই দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই পাথরের শরীরে, তার মনে হয়, ঢুকে যাচ্ছে তার নিজের শেকড়। নীলা, নিজের কাছেই দিন দিন কেমন অচেনা হয়ে যাচ্ছে। শহরটিও, শহরের মধ্যিখানে ঘোলা জলের নদীটিও। যে নদীটির ধারে উদাস বসে থাকতে নীলার এত ভাল লাগে, সেটিকে, সেতু পার হতে হতে বলে ওলো সেইন, তোমাকে খুব পাথর-মতো লাগে।

বেনোয়ার স্পর্শে নীলার মগ্নতা ভাঙে। নতরদামের পেছনে ইল সা লুই দ্বীপটিতে উত্তরে হাওয়ায় উদাস হাঁটতে হাঁটতে হোটেল লজের সামনেও নীলা আবার মগ্ন হয়, এটির কি এককালে নাম ছিল হোটেল পিমোদাঁ? এখানে কি একসময় শার্ল বোদলেয়ার থাকতেন?

বেনোয়া নীলাকে সরিয়ে আনে, আবহাওয়া খারাপ হচ্ছে, বাড়ি চলো।

নীলা আকাশে কালো মেঘ দেখে খুশিতে নেচে ওঠে।

এ তো চমৎকার আবহাওয়া। একে খারাপ বলছ কেন? চলো ভিজি।

নীলার বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করে। বেনোয়ার করে না। গনগনে সূর্যের তলে তার জন্ম নয়, মেঘ-বৃষ্টি সুধা তার কাছে পৌঁছে না। বাড়ি পৌঁছোনোর পর বেনোয়াকে পায় যৌনতায়, নীলাকে কবিতায়। বোদেলেয়ারের ফ্লর দু ম্যল হাতে নিয়ে সোফায় বসে নীলা জিজ্ঞেস করে, মালাবারের মেয়ে নিয়ে বোদেলেয়ার কবিতা লিখেছেন কেন?

বেনোয়া বইটি সরিয়ে নীলাকে জড়িয়ে প্রেমকাতর চোখ নীলার চোখে রেখে বলে, কারণ বোদেলেয়ার মালাবারের মেয়েকে ভালবেসেছিলেন। ভালবেসে কী করতেন বোদেলেয়ার, দেখবে?

উত্তপ্ত চুম্বন নীলার ঠোঁটে। দক্ষিণী উষ্ণতা বহন করে এনেছে বেনোয়া, সূর্যের সবটুকু আগুন ঠোঁটে করে এনেছে নীলাকে পোড়াতে।

আবার ফ্লর দু মল হাতে নিয়ে নীলা বলে, মালাবারে তো বোদেলেয়ার যাননি।

বইটি কেড়ে নিয়ে মিষ্টি হাসে বেনোয়া, যাননি তোমাকে বলেছে কে?

গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ। বেনোয়া মাথা নাড়ে।

না যাননি। বোদেলেয়ারের সৎবাবা তাঁকে ধরে বেঁধে জাহাজে তুলে দিয়েছিলেন ভারতে যাবার জন্য, ১৮৪১ সালের ৯ জুনে। মরিশাসের কাছে এসে বোদেলেয়ার জাহাজ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, তিনি যাবেন না ভারতে, পরের বছর ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি প্যারিসে ফিরে এলেন। বোদেলেয়ারের তো মালাবার বন্দরে পা দেননি।…

আমাদের বোদেলেয়ার সম্পর্কে তো বেশ জানো দেখছি।

জন দুভালের মতো কালো রেশমি চুল ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে নীলা। গা থেকে সুগন্ধ বেরোচ্ছে তার। এ সুগন্ধ বেনোয়াকে এমন মাতাল করছে যে সে নীলার শরীরের গভীরে উন্মত্ত অস্থির প্রেমের কবিতা রচনা করতে চাচ্ছে।

বেনোয়ার হাত থেকে বইটি নিয়ে নীলা পাতা ওলটাতে থাকে। বেনোয়া প্রশ্ন করে, মালাবার ভারতে নাকি?

তুমি জানো না মালাবার কোথায়?

নাহ! বেনোয়ার নাহ-টি বেশ স্বাধীন, আক্ষেপের লেশ নেই, জানে না বলে একধরনের অহংকারও যেন ঠোঁটের ওপর বসে।

নীলা বলে, আশ্চর্য!

আশ্চর্য কেন?

আশ্চর্য এই জন্য যে তোমাদের কবি কোন মালাবারের মেয়েকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন, সেই মালাবার কোথায় কোন দেশে, মালাবারের মেয়েকে কি মালাবারে দেখেছেন নাকি কল্পনায়, এ নিয়ে ভাবোনি?

বেনোয়া নীলার পাশ থেকে উঠে অন্য সোফায় বসে। সে ভাবেনি, কারণ ভাবার তার অন্য জিনিস আছে।

কী আছে? মনাকো আছে?

জিভের লালায় ভিজে ওঠে পাসকাল আছে, জ্যাকলিন আছে?

বেনোয়া হঠাৎ কোনওরকম প্রসঙ্গ ছাড়া জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা নতরদাম কবে বানানো হয়েছে জানো?

তেরোশো চৌত্রিশ সালে।

হল না, তারও আগে।

কাজ শুরু হয়েছিল এগারোশো সালের মাঝামাঝি, শেষ হয়েছে তেরোশো চৌতিরিশে।

এগারো সালের কখন শুরু হয়েছিল বলো।

তা জানি না।

বেনোয়া মুচকি হেসে বলে, তোমাদের তো আছে ওই এক তাজমহল। ভারতে খুব পুরনো কিছু কিন্তু দেখলাম না…কলকাতায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখলাম, তাও তো ইংরেজের করা।

নীলা উঠে বসে জিজ্ঞেস করে, তুমি কি মহেঞ্জোদারো হরপ্পার নাম শুনেছ?

এ আবার কী?

এ হল সভ্যতা। তোমাদের যিশুর জন্মের আড়াই হাজার বছর আগে সে সভ্যতা ছিল ভারতবর্ষে, সেটির কথা বলছি।

বেনোয়া কাঁধ ঝাঁকায় এ সব তার জানার কথা নয়।

নীলা বলে, ভেবো না, এ ভারতবর্ষের ব্যাপার, তোমার না জানলেও চলবে। এ পৃথিবীর ইতিহাস।

ইতিহাস আমার জানতেই হবে কেন?

বেনোয়া শব্দ করে সোফা ছেড়ে ওঠে। শব্দ করে হাঁটে। শব্দ করে শ্বাস নেয়, ছাড়ে। চেঁচায়,

তুমি কি ভেবেছ, সবাই সবকিছু জানে? আমার যে বিষয়ে জানার আগ্রহ আমি সে বিষয়ে জানি। নিজেকে তুমি সবজান্তা ভাবো নীলা। তোমার অহংকার খুব বেশি।

নীলা হাসে, হেসে ধীরে নিচু স্বরে বলে, অহংকার থাকা খারাপ নাকি! যদি জ্ঞান থাকে, তা নিয়ে কুঁকড়ে থাকব কেন। বলি যে হ্যাঁ আছে জ্ঞান।

নীলাকে টেনে সোফা থেকে উঠিয়ে, ফ্লুর দ্য ম্যল মেঝেয় ছুড়ে ফেলে, নীলাকে টেনে নেয় বেনোয়া লাইব্রেরি ঘরে, কম্পিউটারের গায়ে জোরে থাপড় মেরে বলে জগৎ এখন কম্পিউটারে চলছে, এত জ্ঞানের বড়াই যখন করছ বলো তো টেন বেস টু টারমিনেটরের সঠিক ভ্যালু কত? জানো না তো! পাঁচশো ওমস। কিবোর্ডে কী আই আর কিউ আছে? নীলা জানে না। বেনোয়া জানে, পাঁচ। বলো, এস সি এস আই বাসে কতগুলো এস সি এস আই নম্বর সম্ভব? আট। ম্যাক এড্রেসে কতগুলো বাইট থাকে বলো। পারবে? জানি পারবে না। তোমার জ্ঞান হল গোল্লা এ সবে। ছটি বাইট থাকে।

শক্ত করে ধরে রেখেছে সে নীলার হাত। টেনে নীলাকে আবার বসার ঘরে এনে সোফায় ছুড়ে দেয়।

নীলা হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে বলে, বইটা তুলে দাও।

বেনোয়া ঘন ঘন শ্বাস ফেলে। বই সে তুলবে না।

বই কে ফেলেছে? আমি না তুমি? নীলা জিজ্ঞেস করে

আমি। বেনোয়া বলে।

তা হলে ভাল ছেলের মতো বইটা তুলে আমার হাতে দাও। তুমি তো দুষ্টু ছেলে নও। দুষ্টু ছেলেদের গড গিভন রাইট আছে বই ফেলে দেবার। তোমার তো নেই। নাকি আছে?

বলে হাসে নীলা।

বেনোয়া চেঁচায় হাসছ কেন?

হাসছি কারণ আমার গড গিভন রাইট আছে হাসার।

নীলা সোফার হাতলে চুল ছড়িয়ে আবার আগের মতো শোয়। আগের মতো সুগন্ধ ছড়িয়ে। বেনোয়া পেছনের সোফায়।

গলা নামিয়ে বলে, নীলা আমার দিকে মুখ করে বসো, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে, জরুরি।

নীলা ধীরে, নরম গলায় বলে যায়, আগে বইটি আমাকে তুলে দাও, একটি কবিতা আমার পড়তে ইচ্ছে করছে, পড়াটা জরুরি।

আমার কথা শোনার চেয়ে কবিতা পড়ার গুরুত্ব বেশি? বেনোয়ার কণ্ঠে বিস্ময়।

নীলা বলে, হ্যাঁ বেশি।

তোমাকেও জাতে ওঠার রোগে ধরেছে। আমাদের দেশে এই হয়, বাইরে থেকে লোক এসে আমাদের শিল্প সাহিত্য নিয়ে আমাদের চেয়েও বেশি মেতে ওঠে হঠাৎ।

জানালার ওপারে রোদেলা বিকেলের দিকে চোখ রেখে বলে, আমি মেতেছি কারণ আমার রক্তে কবিতা।

রক্তে কবিতা! হা হা বেনোয়া অদ্ভুত স্বরে হাসে।

তোমাদের ফ্রান্স যখন বরফের তলে ডুবে ছিল, তখন আমাদের কবিরা কবিতা লিখত। দৃশ্যটি ভাবো, তোমার বর্বর পূর্বপুরুষেরা কামড়াকামড়ি করে কাঁচা মাংস খাচ্ছে, ওদিকে আমার দার্শনিক পূর্বপুরুষেরা কবিতা আওড়াচ্ছে।

বেনোয়ার গায়ে ঝড়ের গতি, বইটি তুলে সে জানালায় ওপারে ছুঁড়ে

থাকো তোমার রক্ত আর গৌরব নিয়ে, পড়ো কবিতা।

ঝড় চলে যায়।

স্নিগ্ধ হেসে শুদ্ধতম নারী মখমল চোখ বোজে। সে চোখে একটি স্বপ্ন এসে বসে, নিজেকে সে দেখে মালাবারের তীরে, হাওয়ায় চুল উড়ছে, শাড়ি উড়ছে, সূর্যাস্তের সবটুকু রং গায়ে মেখে হাসছে সে, দৌড়োচ্ছ খালিপায়ে, জলের সঙ্গে খেলছে লুকোচুরি খেলা, জল ছুঁয়ে দিচ্ছে তার সুতনু শরীর আর হাওয়া তার কানে বলছে

ও মালাবারের মেয়ে,
তোমারই হাতের মতো সুকুমার তোমার পা দুটি,
জঘনে জাগাও ঈর্ষা ব্যক্ত করে শ্বেতাঙ্গীর ত্রুটি,
ভাবুক শিল্পীর চোখে কম্র কান্ত তোমার শরীরে
আরও গাঢ় কালো জ্বলে মখমল চোখের গভীরে।
সেই নীল আতপ্ত হাওয়ার দেশে, যেখানে কবিতা
তোমাকে দিলেন জন্ম—কৌটো ভরে লঙ্কা তেজপাতা
তুলে রাখো, কুঁজোয় ঠাণ্ডা জল, আয়েশি ভর্তার
কলকেতে তামাক সাজো, ঠেকাও মশার হল্লা, আর
যখন ভোরের গান ঝাউবনে ওঠে কেঁপে কেঁপে
কিনে আনো সদ্য বাজার থেকে আনারস, পেঁপে
খোলা পায়ে, যেখানে সেখানে তুমি বেড়াও স্বাধীন
অচেনা পুরনো সুর গুনগুন করে, সারাদিন।
আর লাল সন্ধ্যার আঁচল যেই খসে পড়ে দূরে,
দাও গা এলিয়ে স্নেহে বারান্দায় নরম মাদুরে,
পাখির কুঞ্জনে পূর্ণ তোমার স্বপ্নেরা ভাসমান
এবং পুষ্পল রূপে নিরন্তর তোমারই সমান।

মালাবারের মেয়ে তপ্ত হাওয়ায় ওড়ে, বাড়ির কাছে বইয়ের দোকানে ঢুকে ফ্লর দু ম্যল খোঁজে। বোদেলেয়ার, র‍্যাবোঁ, পল এলুয়ার, পল ভারলেইন, পল ভালেরি, রেনে শাস কাচের বাক্সে সাজানো। ঝুঁকে বাক্স খুলে বইয়ে হাত বাড়িয়ে নীলা বলে ওরা বাক্সে বন্দি কেন?

কবিতা সপ্তাহ চলছে। দোকানির নিরুত্তাপ কণ্ঠ।

প্রতিটি সপ্তাহই কি কবিতার নয়। প্রতিটি দিনই?

দোকানি হাসে, কবিতার দিন শেষ মাদমোজেল।

নীলার কলকাতায় কবিতার দিন কখনও শেষ হতে দেখেনি। প্রতিটি দিনই কবিতার, প্রতিটি মুহূর্ত কবিতার। মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাজার লোকের সভা যে সবচেয়ে বেশি মাতায়, সে কবি। মেলায় মাঠে যাকে দেখতে লোকের ভিড় উপচে পড়ে, সে কবি। রাস্তায় বাজারে যে লোকটির পায়ের ধুলো নেয় আবালবৃদ্ধবনিতা, সে কবি। যাকে ফিরে ফিরে লোকে মোহিত চোখে দেখে, সে কবি। প্রতিটি কিশোরই কবিতা লেখে, প্রতিটি কিশোর। প্রেমে পড়লে লেখে, প্রেমে না পড়লেও। বৃষ্টি হলে, বৃষ্টি না হলেও। মাতালের সব মাতলামো ক্ষমা করে দেয় লোকে কলকাতায়, সে যদি কবি হয়। দুষ্টু লোকেরা বলে, কলকাতায় কাকের চেয়ে কবি বেশি, কচুরিপানার মতো ছড়িয়েছে কবি। সুশান্তর প্রেমে পড়ে নীলা নিজেও কবিতা লিখেছে। কবিতা ছাড়া মানুষ বাঁচে কী করে! এই ফরাসি দেশকে কবিতার দেশ বলে জানত সে, এখানে কবিতার বই ছাপাতে আর বিক্রি করতে একটি বিশেষ সপ্তাহের আয়োজন করতে হয়, দাম কমিয়ে রাখতে হয়। নীলা চুক চুক করে দুঃখ করে দেশটির জন্য। বইটি বুকে চেপে বাড়ি ফিরতে ফিরতে নীলার মনে হতে থাকে, বাড়ির দরজা ভেতর থেকে খুলে দেবেন মলিনা, মাদুর বিছিয়ে তাকে খেতে দেবেন ঝিঙেপোস্ত, সুক্তো, ভাপাইলিশ, তেলকই। পাশে বসে হাতপাখায় বাতাস করবেন আর কপালের ঘামচুল সরিয়ে দিতে দিতে বলবেন, শুকিয়ে একেবারে দড়ি দড়ি হয়ে গেছিস, তৃপ্তি করে খা রে। কদ্দিন খাসনে বল তো মায়ের হাতের রান্না! জিভে জল চলে আসে নীলার। গ্রস্তের মতো বাড়ি ফিরে দরজায় কড়া নাড়ে। কেউ নেই নীলার জন্য অপেক্ষা করে, নিজেকেই দরজা খুলে ফাঁকা ঘরে ঢুকতে হয়। মা মা ডেকে নিজের গলার স্বরে নিজেকে চমকাতে হয়।

শান্ত স্তব্ধ ঘরে নীলা বইটিকে আঁকড়ে ধরে শক্ত করে, যেন কেউ এটি কেড়ে নিতে না পারে, যেন কেউ এটিকে আবার জানালা দিয়ে দূরের রাস্তায় ফেলে দিতে না পারে। বাড়িটিতে জৌলুসের স্তূপ, কিন্তু মরুর বালু উড়িয়ে হু হু করে উড়ছে আগুনে হাওয়া, তপ্ত বালুতে চোখ ঢেকে যায় নীলার, দু চোখ, কুঁকড়ে যেতে থাকে সে।

কেউ নেই পিঠে একটি কোমল হাত রাখার, কারও হাতভরা কাচের চুড়ি রিমঝিম করে মন ভরানো সংগীতের মতো বাজে না। কারও দারুচিনি ঘ্রাণের শাড়ির আঁচল এসে ঝেড়ে দিচ্ছে না চোখে পড়া বালু। নীলা অন্ধের মতো অন্ধকারে পথ হাতড়ায়। কেউ তাকে ছায়াবীথিতলে টোনাটুনির সংসারের স্বপ্ন দিচ্ছে না আর। সেই তপ্ত বালুতে, আগুনে হাওয়ায় কারও নিশ্বাসের শব্দ টের পায় ঠিক ঘাড়ের পেছনে, ক্লেদজ কুসুমের ঘ্রাণ ঘরময়, কে যেন করোটির ভেতর এক আকাশ রাত্তির নিয়ে পেছনে দাঁড়িয়েছে, যে হাসে না, কাঁদে না, সমুদ্রকে যার বড় ঘৃণা, অরণ্যে যার ভয়, নিঝুম স্বরে বলছে।

হায় রে, দুলালী, কেন বেছে নিলি আমাদের এই
জনকাতর ফ্রান্স, যেখানে দুঃখের শেষ নেই?
কেন তোর আজন্মের আদরিণী তেঁতুলতলারে
বিশাল বিদায় দিয়ে নাবিকের বাহুর বিস্তারে
সঁপে দিলি জীবন, যৌবন? কোনওদিন যদি পড়ে মনে
পাতলা মসলিনে কেঁপে শীত, শিলা, তুষার বর্ষণে—
দেখিস মধুর খেলা, ছেলেবেলা, আকাঙ্ক্ষার পটে,
তবুও চোখের জল ঠেলে রেখে, নিষ্ঠুর করসেটে
পিষ্ট স্তনে, ভিনদেশি অঙ্গের আঘ্রাণ ফেরি করে
অন্ন খুঁটে খেতে হবে প্যারিসের পঙ্কিল খর্পরে–
এদিকে, কুয়াশা ক্লেদ ছিঁড়ে তোর খিন্ন পথচাওয়া
খোঁজে, সেই সুদূর সুপুরিদের ক্ষীণ প্রেতচ্ছায়া।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress