ফরাসি প্রেমিক (Farasi Premik) : 03
গার দ্য নর্দ থেকে গার দ্য অস্তারলিজ
ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছ না কেন?
বেরিয়ে যাব কোথায়?
আপাতত আমার বাড়িতে এসো। তারপর দেখা যাক।
এই তোমার চাবি, সব রইল, আমি কেবল আমার জিনিসপত্র নিয়ে গেলাম। বাড়িঘর যেমন ছিল, আছে। বাড়ি ছাড়ার একটি কারণ, আমাদের মিলছে না, এ কথা কিষান তুমিও ভাল জানো। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে জীবনযাপন যে সহজ নয়, সে আমি জানি। চাকরি নেবার পরই তোমার অন্য রূপ দেখতে পাচ্ছি, তুমি আমাকে প্রতিটি মুহূর্তে অসম্মান করছ। কিন্তু একবারও ভেবে দেখতে চাওনি, ওই বাক্সবন্দির কাজ করে আমি কি খুব আনন্দ পাই, ও করব বলে কি লেখাপড়া করেছিলাম। আমি যে কারণে ও কাজটি নিয়েছি, তা হল, তোমার কাছে ভিক্ষে চাইতে আমার ভাল লাগে না। জানি, তুমি একে ভিক্ষে মনে করো না, তুমি মনে করো, তুমি তোমার স্ত্রীর ভরণ পোষণ করছ, দায়িত্ব পালন করছ, এ করলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই তুমি বিনিময় দাবি করা, বিনিময়টি হচ্ছে, তোমার আদেশ মতো আমাকে প্রতিটি কাজ করতে হবে, তুমি ডানে যেতে বললে আমাকে ডানে যেতে হবে, বামে বললে বামে যেতে হবে, কারণ তুমি কর্তা, তুমি প্রভু, তুমি না হলে আমার জীবন চলবে না, আমি হলাম নেহাতই এক দাসী তোমার, তোমার ঘরদোর সামলে রাখার, রান্নাবান্না করার, পরিবেশন করার, আর রাতে বিছানায় তোমাকে যৌনানন্দ দেবার। এ ছাড়া আর কোনও ভূমিকায় আমাকে দেখো কি? অবশ্য দেখো, সেদিন বললে তোমার সন্তান দরকার। তোমাকে সন্তান দিতে হবে আমার। এ যেন আমার ব্যাপার নয়, কেবলই তোমার ব্যাপার। তুমি চাও বলে আমাকে দিতে হবে। এরকম তো হতে পারত যে আমরা চাইব।
সে রাতে আমার দুজন বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করে আমি বুঝলাম, এ বাড়িতে কাউকে নিমন্ত্রণ করার আমার কোনও অধিকার নেই। সম্ভবত কোনও বন্ধু থাকার অধিকারও আমার নেই। মাছ মাংসের গন্ধ নিয়ে তোমার ঢং অনেক দেখেছি, সারাদিন রেস্তোরাঁয় ওই গন্ধের মধ্যে থেকে এসে বাড়িতে সে গন্ধ আর চাও না। কী কারণ, কারণ আমাকে যে করেই হোক নিরামিষাশী বানাবে তুমি। এতকাল ধরে গড়ে ওঠা আমি, আমার অভ্যেস, আমার ভাষা, আমার স্বভাব, আমার রুচি সব জলাঞ্জলি দিয়ে আমাকে তোমার মনোমতো হয়ে উঠতে হবে। আমি অন্যায় কিছু করিনি, সে তুমি জানো। আমার ওপর তোমার রাগের মূল কারণ, তোমার আদেশ আমি অমান্য করেছি। এত বাধা নিষেধের মধ্যে আমার পক্ষে বাঁচা সম্ভব নয়।
আমি এ বাড়ি থেকে গেলে আমিও বাঁচি, তুমিও বাঁচো।
অনিশ্চিতের পথে পা বাড়ালাম। আপাতত এক বান্ধবীর বাড়িতে।
আমার খোঁজ কোরো না।
নীলা।
চিঠিটি খাবার টেবিলের ওপর রেখে, তার ওপর চাবির গোছা, দানিয়েলের সঙ্গে নীলা বেরিয়ে এল পরদিন বিকেলে। গার দ্য নর্দ থেকে গার দ্য অস্তারলিজ। আগের রাতের এঁটো বাসনপত্র ওভাবেই রান্নাঘরে পড়েছিল। থাকুক, নীলা মনে মনে বলেছে।
গার দ্য অস্তারলিজের ঠিক পেছনের পাঁচতলা একটি বাড়ির সারি সারি চিলেকোঠার একটি কোঠায় থাকে দানিয়েল, এককালে বড়লোকের বাড়ির চাকরানিরা থাকত ও সবে। বড়লোকেরা থাকত নীচতলায় আর চাকরানিরা ঠিক ছাদের তলায়, ছোট একটি চৌকি আর ছোট একটি টেবিল রাখার জায়গা ধরে এমন সব কোঠা, সাকুল্যে আট বর্গমিটার জায়গা। স্নানঘর নেই, করিডোরের এক কোণে একটি শুধু মলমূত্র ত্যাগের ঘর। দেশ থেকে শ্রেণীভেদ দূর হল, প্রভু-ভৃত্যের আমল গেল, চিলেকোঠাগুলোও খালি হল। খালিই পড়ে ছিল, আজকাল ছাত্রছাত্রীরা, নয়তো অল্প রোজগার যাদের, ভাড়া নেয়। দানিয়েল আটশো ফ্রাঁ দেয় মাসে ঘরটির ভাড়া। গত দু বছর সে এই চিলেকোঠাটিতেই আছে। টাকা পয়সা খুব একটা নেই, মাঝে মধ্যে এদিক ওদিক ছোটখাটো কাজ করে, আর করে লেখাপড়া, মেয়েদের পত্রিকায় লেখে, লেখা বলতে বইয়ের আলোচনা, তাও আবার যে কোনও বইয়ের নয়, মেয়েদের লেখা বইয়ের। দানিয়েল কানাডার মেয়ে, ফরাসি ওরও ভাষা, ওর মা অবশ্য আইরিশ। উনিশ শতকে আলুর দুর্ভিক্ষের সময় দানিয়েলের দাদু দিদিমা জাহাজে করে আয়ারল্যান্ড ছেড়ে উত্তর আমেরিকায় চলে গিয়েছিলেন। দানিয়েলের বাবার যদিও কানাডায় জন্ম, ফরাসি আর আদি আমেরিকানের রক্ত শরীরে, ওর ঠাকুরদাই ছিলেন সম্ভবত আদি আমেরিকান, যদিও দানিয়েল তাঁকে দেখেনি কোনওদিন, ঠাকুরদা প্রসঙ্গে কিছুই ওর বাবা ওকে বলেওনি, ব্যাপারটি দানিয়েলের বাবাকে এমনই অপ্রতিভ করত যে এ ব্যাপারে কোনও প্রশ্ন উঠলে বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেত, নয়তো চেঁচিয়ে প্রসঙ্গ থামাত। দানিয়েলের ভাই ফিলিপের মধ্যে একফোঁটা চিহ্ন নেই, কিন্তু দানিয়েলের নাকে, চোখে সেই পূর্বপুরুষের চিহ্ন, খানিকটা চিবুকেও, যদিও রং সাদাদের মতোই সাদা।
দানিয়েলের আট বর্গমিটার জায়গার ঘরটিতে একটি বিছানা, একটি টেবিল, তার ওপর ছোট একটি কম্পিউটার, এক কোণে ছোট একটি রেফ্রিজারেটর, তার ওপর একটি চুলো, চুলোর পাশে জলের কল, বেসিন, দেয়ালে বইয়ের তাক, বইয়ের ঘাড়ে বই, মাথায় বই আর একটি হাতলঅলা চেয়ার, একটিই চেয়ার।
আমার কিন্তু একটি বিছানা। দুটো বিছানা পাতার জায়গাও নেই। আর আমার দুটো তোশক নেই, দুটো লেপও নেই যে মেঝেয় বিছানা পাতব!
চাপাচাপি করে শোয়া যাবে, যাবে না। নিশ্চয়ই যাবে। নীলা বলে।
চাপাচাপি করে নীলা আগে অনেক শুয়েছে। গ্রামের কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে বিয়ে হলে শহর থেকে রাজ্যির লোক নেমন্তন্নে যায়, বিয়েবাড়ির মেঝেতে টানা বিছানা পেতে সাত আটজন করে ঘুমোয় রাত্তিরে। অভ্যেস যে তার একবারেই নেই, তা নয়। আর বালিগঞ্জের বাড়িতেও কোনও মাসি বা পিসি এলে তার বিছানাতেই শোবার জায়গা করা হত। মাসি পিসিদের গায়ে গা ঘেঁসে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যেতে তার আনন্দও তো কম হয়নি, মঞ্জুষামাসির গা কাঁটা দেওয়া ভূতের গল্প তার এখনও মনে আছে।
রাতে, দানিয়েল বলল নীলাকে খুব ভাল এক রেস্তোরাঁয় খাওয়াবে।
তাহলে আমি ড্রেস পরে নিই কী বলো!
দানিয়েল দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। নীলা পরনের কাপড় পালটে নীল জিনসের সঙ্গে লাল একটি শার্ট পরল, আর ওপরে জিনসের জ্যাকেট। হয়ে গেছে জানালে দানিয়েল ঘরে ঢুকে চোখ কপালে তুলল, কই তুমি না ড্রেস পরবে বললে।
তা তো পরলামই। নীলা হেসে বলে।
এ তো জিনস পরলে। ড্রেস তো পরলে না!
নীলা ঠিক বুঝে পেল না দানিয়েল কী বলতে চাচ্ছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় দাঁড়িয়ে চিকন গলায় বলে, দেখতে কি খুব খারাপ লাগছে?
রায় দিয়ে দিলে, মোটে তাকে দেখতে খারাপ লাগছে না। বাইরের হাওয়ায় এসে নীলার ধিন তা তা ধিন তা তা ছন্দ ওঠে শরীরে। এমন সুখ তার প্যারিসে হয়নি কখনও, নিজেকে কখনও সে এত স্বাধীনতা পেতে দেখেনি। শুন্যে দু হাত ছুঁড়ে বলে, ভারতের দাসী পোষার শখ হয়েছিল কিষানলালের! কোথায় তোমার সেই দাসী এখন, কিষানবাবু?
সখেদে বলে, আহা আরও আগে কেন পায়ের শেকল ছিঁড়িনি।
দু বাহুতে দানিয়েলকে জড়িয়ে সে সুখোচিৎকার করে, তুমি আমাকে বাঁচালে।
তুমি একদিন না একদিন ওখান থেকে বেরোতেই নীলা। ওভাবে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে নাকি!
নীলা প্রাণ খুলে হাসে। তাকে হাসিতে পায়। তাকে খুশিতে পায়। তার সারা শরীরে আনন্দ। সারা মনে স্ফুর্তি। রাতের রাস্তায় ছেলে মেয়েরা আনন্দ করতে নামে, নীলা দেখেছে। রাত বলে, অন্ধকার বলে যে কিছু নেই সে দেখেছে। তার সামনে আলোয় ঝলমল একটি জগৎ। এই জগতের প্রতি তীব্র আকর্ষণে নীলা লক্ষ করে গা কাঁপছে তার। দানিয়েলের কাঁধে হাত রেখে নীলা হাঁটে, নীলা হাঁটে না তো নীলা ওড়ে। দানিয়েলের হাত টেনে নেয়, হাতে হাত রেখে হাঁটে, আর সব মুক্ত মানুষের মতো হাঁটে। নীলা হাঁটে না তো নীলা ওড়ে।
কী যে ভাল লাগছে তোমাকে দেখে নীলা। এ সত্যিকার তুমি। এ তুমি। মাদাম কিষানলালের মুখোশ পরিয়ে তোমার ভেতরের তুমিকে আড়াল করে রাখা হয়েছিল। আর এখন, দেখো কী জীবন্ত তুমি! কী অসম্ভব সুন্দর তুমি! দেখো, দুশ্চিন্তার লেশমাত্র নেই তোমার মুখে। গোপন কোনও কষ্ট লুকিয়ে রাখার কোনও চিহ্ন নেই কোথাও। এ তুমি অন্যরকম। দানিয়েল মুগ্ধ চোখে নীলাকে দেখে আর বলে। নীলার হাতের মুঠোর ভেতর ওর হাতখানা কাঁপে, ঘামে।
শাতলের ক্যাফে জিমমারে ঢুকে দানিয়েল মেনু খুঁটিয়ে পড়ে স্পাগেটি বোলোনেস আর আর লাল ওয়াইন চাইল। মেনুতে স্যান্ডুইচ ছাড়া আর বাকি খাবার যেহেতু জানে না কী, দানিয়েলকেই বলল নীলা, তার জন্য একটি বেছে দিতে। একই খাবার হোক না, স্পাগেটি বোলোনেস।
ওয়াইন কোনটা নেবে সাদা না লাল? অবশ্য, দানিয়েলের মতে, এ খাবারের সঙ্গে লালই যায়।
লালই যায় তো লালই।
কাঁটা চামচে স্পাগেটি যতবারই তুলতে নেয় নীলা, পিছলে পড়ে যায়। হাল ছেড়ে দেয় সে, স্পাগেটি কাঁটায় তোলাও অসম্ভব আর মুখে নিলেও আটাগোলার স্বাদ। বরং সে জমজমাট ক্যাফের ভেতরের মানুষ দেখে, পাশের টেবিলে একটি একুশ বাইশ বছর বয়সি ছেলেকে দেখে, ছেলেটির কানে দুল, ছেলেটির সঙ্গে যে মেয়ে তার কানে তো আছেই, একটি নয়, এক কানেই ছটি, নাকেও, কেবল নাকে নয়, চোখের ভুরুতে, ঠোঁটে, আর মেয়েটি হা হা করে হেসে উঠলে নীলা দেখে, মেয়েটির জিভে দুল।
এ কী কাণ্ড, মেয়েটির চোখের ভুরু ফুটো করেছে? ঠোঁট, জিভ?
ঘটনাটি যেন ডাল ভাত, দানিয়েল বলে, হ্যাঁ করেছে, ইচ্ছে করেছে তাই করেছে।
নীলা ভাবে, এরা ইচ্ছে যা করে, তাই করতে পারে। আর সে, নিজের জীবনের কথা খানিক ভাবে, ইচ্ছে যা করে, তা কখনই করতে পারেনি। করলে, বলা হত, যাচ্ছেতাই কাণ্ড করছে। শার্ট প্যান্ট পরে বাড়ি থেকে বেরোতে গেলেই অনির্বাণ তেড়ে আসতেন, কী পরেছিস কী! রাস্তায় তো লোকেরা ঢিল ছুড়বে। ঢিল থেকে বাঁচার কারণেই হোক, আর অনির্বাণের আদেশেই হোক নীলাকে পুরুষের পোশাক খুলে মেয়েদের পোশাক পরতে হত, সালোয়ার কামিজ নয়তো শাড়ি।
ক্যাফে জিমমার থেকে বেরিয়ে লে আলের দিকে হেঁটে যেতে যেতে নীলা দেখে কিছু ছেলে মেয়ের চুল খাড়া হয়ে আছে ওপরের দিকে, মোরগের ঝুঁটির মতো, শজারুর কাঁটার মতো। চুলগুলো কালো নয়, বাদামি নয়, লাল নয়, সোনালি নয়, রাঙিয়ে হলুদ করেছে, সবুজ করেছে, গোলাপি করেছে। ও মা কী কাণ্ড।
দানিয়েল এসবকেও বলে, ইচ্ছে করেছে তাই করেছে।
কেন ইচ্ছে করেছে, জানার জন্য নীলার মন আঁকুপাকু করে।
সমাজের নিয়ম কানুন ওদের ভাল লাগে না, তাই করেছে। এক ধরনের প্রতিবাদ।
সমাজের অনেক নিয়ম নীলারও ভাল লাগে না। কিন্তু কখনও তার চুল রাঙানোর ইচ্ছে হয়নি। অত তাকত তার নেই। এত সুন্দর সুস্থ সমাজ এদের, এত চমৎকার নিয়ম কানুন, ভাল না লাগার মতো কী পেয়েছে রঙিনচুলো ছেলেমেয়েগুলো, জানার জন্য দানিয়েলের দিকে প্রশ্নচোখে তাকায় সে। দানিয়েলের দৃষ্টি তখন পমপিডুর উঁচু চুড়োয়, ওই চুড়ো থেকে প্যারিস দেখতে কেমন দেখায় তাই সে ভাবছে। নীলা এই এলাকায় আসেনি এর আগে। পমপিডু কি তেলের কারখানা? শুনে দানিয়েল এমন জোরে হাসে যে নীলা লজ্জায় মুখে হাত চাপা দেয়। হাসতে হাসতে দানিয়েল নীলার হাত ধরে ক্যাফে বো বোর ভেতর ঢোকে। ক্যাফেতে ভিড় উপচে পড়ছে, লোকের বসার জায়গা নেই, দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু আছে, বেরিয়ে যাচ্ছে না, দাঁড়িয়েই ওয়াইন পান করছে। দানিয়েলের পেছনে জড়সড় দাঁড়িয়ে নীলা দেখে, তার ঠিক পাশেই এমনিতে বাঁশের মতো লম্বা তার ওপর উঁচু জুতো পরে আরও লম্বা হওয়া একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে ওয়াইন খাচ্ছে, আর হেলেদুলে দুটো যুবকের সঙ্গে কথা বলছে। মেয়েটি বেশ সুন্দরী, পরনে লাল ফ্রক, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, জুতোর রংও লাল, মাথায় একটি টুপি পরা, সেটিও লাল। লাল ঠোঁটজোড়া পাখির ঠোঁটের মতো সরু করে যুবকদ্বয়ের একটিকে চুমু খায় মেয়েটি। চাপাচাপি ভিড়ে দাঁড়িয়ে আছে বলেই চুমু খাওয়া বড় কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয় নীলার। মেয়েটি যখন অন্য যুবকের ঠোঁটে চুমু খায়, দানিয়েলের কানে কানে বলে সে, দেখো দেখো, মেয়েটি দুটো যুবককেই চুমু খেয়েছে। কোনটি তার প্রেমিক তবে?
দানিয়েল নিস্পৃহ কণ্ঠে বলে, ও মেয়ে নয়। ও ছেলে।
নীলা অনেকক্ষণ কোনও শব্দ পায় না উচ্চারণ করার।
ছেলে হলে, মেয়ের মতো সেজেছে কেন?
ইচ্ছে, তাই।
ঠিক আছে, নীলা মেনে নিল ও ছেলে, কিন্তু সে ছেলেদের চুমু খাবে কেন?
নীলার গা শিউরে ওঠে যখন দানিয়েল বলে, ওরা সমকামী।
জীবনে এই প্রথম নীলার কোনও সমকামী দেখা। যখন যাকে জড়িয়ে ধরতে বা চুমু খেতে ইচ্ছে, এরা খায়। যখন যে পোশাক পরতে ইচ্ছে করে, এরা পরে। মানুষের এই অবাধ স্বাধীনতা নীলাকে মোহিত করে।
বসার জায়গা জোটে, ওয়াইনও আসে। দানিয়েল খেয়ে যায়, নীলা হঠাৎ হঠাৎ এক কি দু চুমুক।
কী ব্যাপার খাচ্ছ না যে!
ওয়াইন খেয়ে আমার অভ্যেস নেই।
অভ্যেস নেই? তোমাদের দেশের লোকেরা কী পান করে তবে?
হুইস্কি।
ও তো খাবারের আগে খেতে হয়। খাবার খেতে গিয়ে কী পান করো?
জল।
তোমার দেশের আর লোকেরা?
সবাই জল।
সবাই জল?
হ্যাঁ সবাই জল।
সবাই জল হলেও নীলা একটু একটু করে খেতে শিখছে ওয়াইন। একটি ব্যাপার সে চোখ কান নাক খুলে লক্ষ করে, সকাল সন্ধে ওয়াইন পান করা ফরাসিদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। কলকাতায় সে দেখেছে, লোকেরা মদ কিনে কাগজে মুড়িয়ে নেয়, যেন বাইরে থেকে দেখে কেউ বুঝতে না পারে বোতলটি মদের, যেন ভাবা হয় তেলের বা ফলের রসের বা ওষুধের বোতল। নিখিল যখন মদ খায়, নিজের ঘরে বসে খায়, ভেতর থেকে ঘরের দরজা বন্ধ করে, তবে। বাড়িতে অতিথি এলে মুখ সাতবার ধুয়ে মদের গন্ধ দূর করে তবে অতিথির সামনে আসে। মলিনা চিরকালই জানে, মদ খায় মন্দ লোকে। নীলাও তাই জানত, কিন্তু সুশান্তকে যখন মদ খেতে দেখল দু একদিন, মন্দ লোকে মদ খায় এ ধারণাটি দূর হল বটে, কিন্তু খেলে সুশান্তর মতো লুকিয়ে চুরিয়ে খাওয়াই নীলা মনে করত শোভন। এখন, এই আশ্চর্য স্বাধীন শহরে এসে নীলার বোধোদয় হয়, যদি কিছু করিই, তবে লুকিয়ে কেন গো! এ শহরে সে আরও লক্ষ করে, মদ না খাওয়াই বরং অন্যায়। লোকে খারাপ চোখে দেখে, ভাবে এর বুঝি কোনও সংস্কৃতি নেই, এসেছে কোনও ঝোপ জঙ্গল থেকে।
যেহেতু স্পাগেটি জিনিসটি নীলার পেটে ঢোকেনি, নীলা ক্যাফে বো বো-তে, মাংস খাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে, গোরু খাবে না, ভেড়ায় গন্ধ, গ্রিল করা মুরগি আছে, চলবে? চলবে। এর সঙ্গে পান করবে কী? কোকোকোলা। কোকোকোলা? বো বো-র যে লোক খাবার দিয়ে যায়, সে হেসে কুটিকুটি। এ কোন আজব জীব এসেছে, যে মাংসের সঙ্গে কোকোকোলা পান করে। নীলা লক্ষ করে লজ্জায় দানিয়েলের মাথা নিচু হচ্ছে।
এ লজ্জা। এ স্রেফ লজ্জা। ওয়াইন না খাওয়া। এ অন্যায়।
নীলা সিদ্ধান্ত নেয়, ওয়াইন পান করা দ্রুত করতে হবে তার, এই লজ্জা থেকে বাঁচতে তাকে হবেই।
বো বো থেকে বেরিয়ে নীলাকে আরও এক ক্যাফেতে নিয়ে গেল দানিয়েল, ওখান থেকে এক আইরিশ পাবে, আইরিশ পাব থেকে ডিসকোটেকে, আলো নিবছে জ্বলছে আর বিষম জোরে গান বাজছে, তালে তালে লোকেরা নাচছে। দানিয়েল ধুন্ধুমার উল্লাসে নীলার হাত ধরে টানে, চলো নাচব। নীলা না না করে ওঠে, সে যাবে না, সে নাচতে জানে না।
নাচতে না জানাও সে লক্ষ করে বিষম লজ্জার ব্যাপার। এক আজব জীবেরাই নাচতে জানে না। নাচ বলতে এখানে, নীলা লক্ষ করে সুরের তালে গা নাড়ানো। কেউ পা নাড়ছে, কেউ হাত, কেউ পিঠ, কেউ মাথা, কারও সঙ্গে কারও মিলছে না, তালে তালে শরীরের কিছু একটা নাড়ানোই নাচ।
দানিয়েল একাই নেচে এল। এসে মুখ ভার করে বলল, তুমি আমাকে এত অপছন্দ করো?
কেন?
আমার সঙ্গে নাচলে না যে।
নীলা লজ্জায় কুণ্ঠায় মাথা নিচু করে বলল, আমি যে নাচতে জানি না।
এ আবার না জানার কী আছে।
ছোটবেলা থেকে না নাচলে নাচ হয় না, তাই নীলা জানে। তার খুব নাচের শখ ছিল, অনির্বাণ মেয়েকে নাচ শেখাতে রাজি হননি বলে নীলার নাচও হয়নি। হারমোনিয়াম কিনে দিয়ে নাচের বদলে গান শিখতে বলেছিলেন। ওস্তাদ রেখে দিয়েছিলেন, বড় গাইয়ে হয়নি নীলা, তবে ভাল গাইতে জানে, ছোটখাটো আসরে আবদার করলে নীলা শরম না করে গেয়ে দেয়। ভারতে যারা নাচে, ভরতনাট্যম, কথক বা মণিপুরি, তারা সেই ছোটবেলা থেকেই নেচে আসছে। শরীর ওদের একতাল কাদার মতো, বেঁকে ধনুকের মতো হতে পারে।
দানিয়েল পথে বেরিয়ে বলে, তুমি যে আমাকে অপমান করেছ, তা আমি আগেই বুঝতে পেরেছি অবশ্য।
নীলা চমকে ওঠে, কখন? কখন আমি তোমাকে অপমান করলাম। বলছ কী দানিয়েল!
আমি তোমার গেলাসে ওয়াইন ঢেলে দিলাম, আর তুমি কোনও ধন্যবাদ বলোনি। দানিয়েল বলে।
বলে কী মেয়ে। দানিয়েলকে ইতিমধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে মনে করছে নীলা। বন্ধুরা কখনও বন্ধুকে কোনও কারণে ধন্যবাদ বলে! নীলা অন্তত এ শিক্ষা পায়নি। কলকাতায় কোনও বন্ধু তার গেলাসে ওয়াইন ঢেলে দিলে, নীলা যদি ধন্যবাদ বলত, তা হলে সে বন্ধু নির্ঘাত একে অপমান বলে ভাবত। বাংলায় একটি কথাই আছে, ধন্যবাদ জানিয়ে আমাকে খাটো কোরো না।
ঠিক আছে, বন্ধুকে যদি ধন্যবাদ না বলো, তবে কাকে ধন্যবাদ বলো?
নীলা অপ্রতিভ কণ্ঠে বলে, অপরিচিত কেউ যদি হয়। আর সে যদি কিছু দেয় আমাকে বা কিছু করে আমার জন্য, তবে।
ক্যাফে জিমমারের লোকটি তো তোমার বন্ধু ছিল না, তাকেও তো ধন্যবাদ বলোনি।
তাকে কেন ধন্যবাদ বলব?
তুমি জল চাইলে, সে তোমাকে জল এনে দিল। সে কারণে তাকে ধন্যবাদ দেবে। আদেশ, বুঝলে নীলা, লোকটিকে তুমি আদেশ করেছ জল আনতে, অনুরোধ করোনি। ও লোক তো তোমার ক্রীতদাস নয়। ও ওখানে চাকরি করে। দানিয়েল এক দমে বলে যায়।
নীলা ঠিক বুঝে পায় না কী বলবে। সে সাধারণত যেভাবে রেস্তোরাঁয় কিছু চায়, এক গেলাস জল দিন তো, সেভাবেই চেয়েছে। আদেশ করলে স্বরটি রুক্ষ হয়, অনুরোধ হলে স্বরটি নরম, ঠোঁটে এক চিলতে হাসি দোলে, এই পার্থক্য। দানিয়েলের আপত্তি নীলা দয়া করে শব্দদুটো বলেনি। আপনি কি দয়া করে আমাকে এক গেলাস জল দিতে পারেন এভাবে চাইতে হত।
আসলে কী জানো দানিয়েল, নীলা ধীরে বলে, স্বরটি ভাঙা, ধন্যবাদ দেবার অভ্যেস নেই বলে সম্ভবত দিইনি, তবে ওই লোককে আমি মোটেও ছোট করে দেখিনি।
অভ্যেস নেই? কেন অভ্যেস নেই? অভ্যেস নেই, কারণ তোমরা মানুষকে মানুষ বলে জ্ঞান করো না। দানিয়েল বলে।
তাই কি!
তাই।
নীলা মনে মনে শক্ত চাবুকে নিজেকে চাবকায় নিজের এই অসভ্যতার জন্য, মানুষকে মানুষ না ভাবার জন্য। এই সমতার দেশে, কোনও মানুষই বড় নয়, কোনও মানুষ ছোট নয়, সবাই সমান। কেউ ছোট কাজ করে, কেউ বড় কাজ করে, কিন্তু সবাই মানুষের মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকে। নীলা মনে মনে বলে, তাই তো হওয়া উচিত। শ্রেণীবিদ্বেষ নেই তার, তাই সে জানত। দানিয়েল আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল, আছে।
বোধোদয় হয় নীলার। নিজেকে সে ঘৃণা করতে থাকে। দাঁতে ঠোঁট কামড়ায়। চোখ জ্বালা করে।
নীলা ছোটবেলায় দেখত, নিখিল রাত জেগে লাল বই পড়ছে। কী লেখা লাল বইয়ে? শ্রেণীসংগ্রামের কথা লেখা। নীলা তার উনিশ বছর বয়সেই মার্কস এঙ্গেলস পড়ে অনুপ্রাণিত হয়েছে, কলেজে কমুনিস্ট দলে ভিড়েছে, মিটিং মিছিল করেছে, আর আজ কিনা সে নিজেই প্রমাণ করল সে শ্রেণীভেদ মানে, সে মানে যে লোকটি খাবার এনে দেবে ক্যাফে রেস্তোরাঁয়, সে ছোটলোক! এই সভ্য সমাজে এসে, এই সাম্যের দেশে এসে এই লিবার্তে, ইগালিতে আর ফ্রাতারনিতের দেশে, যেখানে নারী পুরুষে ভেদ নেই, ধনী গরিবে ভেদ নেই, সেখানে এসে নীলার শ্রেণীবিদ্বেষী মন এমনই প্রকট হয়ে উঠেছে যে দাঁতকপাটি মেলে নীলার দিকে তেড়ে আসছে। ছি!
দানিয়েল, আমি জানি আমি অন্যায় করেছি। এরকম ভুল আর হবে না। আমাকে ক্ষমা করে দাও। বিনত স্বর নীলার।
দানিয়েল শোনে, শুনে স্বস্তি পায়।
দানিয়েলকে আরও স্বস্তি দিতে নীলা বলে, আমাদের পশ্চিমবঙ্গে তিরিশ বছর ধরে কোন দল ক্ষমতায়, জানো? কমুনিস্ট। জ্যোতি বসুর নাম শুনেছ? তাঁর মতো জনপ্রিয় নেতা ভারতবর্ষে আর একজনও নেই।
দানিয়েল হাঁটা বন্ধ করে দাঁড়ায়।
মুখ হাঁ।
চোখ হাঁ।
দম নাও মেয়ে, দম নাও। বানের জলে ভেসে এসেছি ঠিকই, সাম্যের অঞ্চল থেকেই এসেছি।
তিরিশ বছর? হাঁ মুখ থেকে বেরিয়ে আসে দুটো কেবল শব্দ আর সাদা ধোঁয়া।
হ্যাঁ তিরিশ বছর!
কেন?
কেন মানে, ভাল বলে। আমরা ভোট দিই বলে!
কমুনিস্টকে ভোট দাও?
নিশ্চয়ই।
ছি ছি।
দানিয়েল সারা পথ ছি ছি করল।
সারা পথ দানিয়েল বলতে বলতে এল, স্তালিন যত লোক খুন করেছে, হিটলার তার চেয়ে অনেক কম করেছে। বলতে বলতে এল, মার্কস ভুল, এঙ্গেলস ভুল। বলতে বলতে এল, লেনিন ছিল আপাদমস্তক ভণ্ড। আস্ত সন্ত্রাসী।
নেমন্তন্ন
নিকল নেমেরের বাড়িতে সন্ধেয় নেমন্তন্ন দানিয়েলের আর দানিয়েল যে ভারতীয় মেয়েটিকে আশ্রয় দিয়েছে, তার। নতুন এক পত্রিকার সাংবাদিকের সঙ্গে বিকেলে দানিয়েলের ক্যাফে কায়রোতে রাদেভুঁ, সেই রাদেভুঁতে যাবার আগে সে বলে যায় নীলা যেন নেমন্তন্নে যাবার জন্য তৈরি হয়ে থাকে, সন্ধে সাতটায়।
ও যখন ফিরে এল ঘরে, নীলা তখনও শুয়ে, এ মুভেবল ফিস্ট পড়ছে।
কী ব্যাপার তুমি এখনও তৈরি হওনি? দানিয়েল বোকা বনে যায় ঘরে ঢুকে।
নীলা আড়মোড়া ভেঙে বলে, এখনই? বাজে কটা?
সাতটা।
এ আর এমন কী!
আমি তোমাকে সাতটায় তৈরি হয়ে থাকতে বলেছি।
আমার তো এখনও স্নান করাই হয়নি। নীলা উঠে বসে।
বলো কী? দানিয়েলের ছোট চোখে ছোট চিবুকে দু টুকরো বিস্ময় এসে বসে।
আমার তো কাপড় ইস্ত্রি করাই হয়নি।
দানিয়েল ধুপ করে শরীর ছেড়ে দিল চেয়ারে। ঠিক সাড়ে সাতটায় আমাদের পৌঁছতে হবে নিকলের বাড়িতে। তোমাকে তো আগেই বলেছি।
সাড়ে সাতটার জায়গায় আটটা বা সাড়ে আটটা হলে কী ক্ষতি নীলা বুঝে উঠতে পারে না। কলকাতায় কোথাও নেমন্তন্ন থাকলে ঘণ্টা দেড়ঘণ্টা দেরি করেই সে যায়, সে কেন, সবাই যায়। একেবারে কাঁটায় কাঁটায় পৌঁছোনো কেমন অস্বস্তিকর, দানিয়েলের কাছে অবশ্য কাঁটায় কাঁটায় না পৌঁছোনোই অস্বস্তির ব্যাপার। স্নান করতে আবার কাছের গণ স্নানাগারে যেতে হবে নীলার, ও সেরে আসতে গেলে দানিয়েল আত্মহত্যা করবে। দানিয়েলের স্নানের ঝামেলা নেই, ও মাসে একবার যায় স্নানাগারে, আর সপ্তাহে সপ্তাহে ঘরের তোলা জল মুখে গলায় ঘাড়ে হাতে ছিটিয়ে স্নান সারে।
পরনে ওর কালো লম্বা জামা, আর নীলা তড়িঘড়ি হাতের কাছে যা পায়, ইস্ত্রি ছাড়াই, পরে নেয়। নীলা লক্ষ করেছে, ইস্ত্রি করা কাপড় জামা খুব কম লোকেই পরে। শীতের দেশ, বছরের বেশির ভাগ সময়ই সোয়েটার বা কোটের তলায় ঢাকা পড়ে থাকে না-ইস্ত্রি জামা।
জিনস পরলে? নেমন্তন্ন খেতে যাচ্ছ।
খারাপ দেখাচ্ছে?
জিনস তো দিনের বেলায়। কাজের জায়গায়।
দানিয়েল সময়ের অভাবে নীলার জিনস মেনে নেয়। নীলা তড়িঘড়ি একটি লাল টিপ পরে নেয় কপালে, অন্তত এ যদি কিছু সৌন্দর্য রক্ষায় সাহায্য করে।
দানিয়েলের ঘর থেকে গার দ্য অস্তারলিজ মেট্রোতে যেতে আড়াই মিনিট, গার দ্য অস্তারলিজ থেকে নিকলের বাড়ির কাছের মেট্রোতে পৌঁছোতে লাগে বাইশ মিনিট, আর সেই মেট্রো থেকে হেঁটে নিকলের বাড়িতে যেতে পাঁচ মিনিট। হাতে দেড় মিনিট থাকে। এক মিনিট হাতে রাখো, রাস্তা পার হওয়ার সময় যদি ট্রাফিকের লাল বাতি জ্বলে, তবে গেল এক, আর নিকলের বাড়ির লিফটে যদি লোকের ভিড় থাকে, তবে সিঁড়ি পেরোতে হবে, সিঁড়িতে যাবে আধ মিনিট। নীলার কারণে দানিয়েলের এই হিসেবে গোল বাধে। লাল বাতির ঝামেলা ছিল না, লিফটেও কোনও লোকের ভিড় ছিল না, তার পরও নিকলের বাড়িতে ঢুকতে বাজল সাতটা সাঁইত্রিশ।
দানিয়েল প্রথমেই এই দেরির জন্য ক্ষমা চেয়ে নিল।
নিকল, তারও পরনে লম্বা কালো জামা, লাল চুলের সবুজ চোখের মেয়ে, নীলার চেয়ে লম্বায় দুবিঘত, বয়সে দুবিঘত বড়, দানিয়েলকে ক্ষমা করল।
বাড়িতে আরও তিনজন অতিথি, মারিয়া সুয়েনসন, মিশেল কজ আর রিতা সিকসুস। সবাই দাঁড়িয়ে, সবার হাতে সরু শ্যাম্পেনের গেলাস, এক মারিয়া ছাড়া, তার গেলাসে কমলার রস। সবার পরনে কালো লম্বা জামা, নেমন্তন্নের সঙ্গে কালো লম্বা জামার একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে, নীলা অনুমান করে। ঢোকার পরই নিকল সহ অতিথি তিনজন নীলা আর দানিয়েলের দুগালে চকাস চকাস চুমু খেল।
মারিয়া সুইডেনের মেয়ে, ফ্রেডরিকা ব্রেমের ফরবুনডেট নামের একটি নারী সংগঠনের নেত্রী, প্যারিসে এসেছে মেয়েদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বিষয়ে একটি সভা হচ্ছে, ওতে বক্তৃতা করতে, মিশেল কজ প্যারিসের নয়, থাকে ফ্রান্সের দক্ষিণে, ফিজাক নামের এক শহরে, প্যারিসে এসেছে এই সভা শুনতে আর রিতা সিকসুসের কোনও সভা সমিতি নেই, জন্মেছে আলজেরায়, ইহুদি পরিবারে, প্যারিসেই বাস, ছবি পরিচালনা করে, নিকলের দীর্ঘদিনের বন্ধু, এ বাড়ির যে কোনও আড্ডায়, বিশেষ করে শনি রোববারে রিতার উপস্থিতি অনেকটা মাছের ঝোলে নুনের মতো, থাকা চাই। আর নিকল, মাস্টারি করে কলেজ দ্য ফ্রান্সে, দানিয়েলেরও পরিচয় আছে বলার, সে সাংবাদিক। নীলার পরিচয় সে ভারতের মেয়ে। কী করো? কিছু না। ভেরেন্ডা ভাজি।
তাই তো নীলা ভাবে, এই প্যারিসে তার পরিচয় হয় কিষানলালের বউ নয়তো নীলাঞ্জনা মণ্ডল, শ্রমিক।
ভেরেন্ডাভাজনেঅলা। দানিয়েল করুণা করে নীলার আরও এক পরিচয় উল্লেখ করল, তার বন্ধু।
নীলা হাঁফ ছাড়ল।
হাঁফ ছাড়তে না ছাড়তেই দুটো বীভৎস কুকুর নীলার ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ও মাগো বাবাগো বলে তারস্বরে চিৎকার জুড়ল নীলা, আর হাসির রোল উঠল ঘরে। দানিয়েল ফ্লুন ফ্লুন বলে ভোঁতা নাকের একটিকে কোলে তুলে নিয়ে মাথাখারাপের মতো চুমু খেতে লাগল, আরেকটিকে নিকল তুলল কোলে, বাচ্চাদের মতো না কাঁদে না না কাঁদে না ভঙ্গিতে দুলতে লাগল।
তুমি কুকুরকে ভয় পাও? মারিয়া ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে।
নীলাকে ভয় পাচ্ছে মারিয়া, কারণ কুকুরকে জড়িয়ে ধরার বদলে নীলা চিৎকার করেছে। এরকম অদ্ভুত কাণ্ড মারিয়া কেন, এ বাড়ির কেউ দেখেনি এর আগে। নীলার আশঙ্কা হয়, পাঁচ জোড়া চোখ যেভাবে তাকে দেখছে, নিশ্চয় এদের সন্দেহ হচ্ছে যে তার মাথায় কোনও রোগ আছে।
রিতা জিজ্ঞেস করল, খুব কোমল কণ্ঠে যদিও, আচ্ছা তোমার কি কোনও অসুখ টসুখ আছে। এরকম হয়, কিছু অসুখ থাকলে বিশেষ করে কুকুর দেখলে…।
নীলাকে মানসিক রোগী হওয়ার যন্ত্রণা থেকে উদ্ধার করে দানিয়েল বলল, সম্ভবত ও আগে কুকুর দেখেনি। ওদের দেশে কুকুর নেই।
নীলা পাঁচ জোড়া চোখের সামনে যদি বলতে পারত যে ঠিক তাই, নেই, তবে একরকম বাঁচত। বলল, আছে।
আছে?
নিকল চমকাল।
থাকলে ভয় পেলে কেন? পাঁচজোড়া চোখে একটিই প্রশ্ন।
নীলা উত্তর দেবার সাহস পেল না।
পাঁচ মানুষের চোখ এবার অন্যদিকে ফিরল। ফ্লুনের চোখও। নিকলের কোলেরটিরও, ফিফিরও। কালো চারটে বেড়ালেরও।
এরপরের দীর্ঘ আলোচনায় নীলার অংশগ্রহণ মোটে জরুরি নয়। শ্যাম্পেন পান করতে করতে যে আলোচনাটি চলে, তা কুকুর বেড়াল বিষয়ে, সকালে চোখ মেলতেই কাকে নিকল দেখেছে তখনও ঘুমোচ্ছে, আর কোনটি লাফিয়ে তার বুকের ওপর বসেছে, কে ঘাড় কাত করে নিকলকে একবার দেখে সরে গেছে অন্য ঘরে, সকালের কোন খাবার কার পছন্দ হয়নি, কে সোফায় শুয়ে টেলিভিশন দেখতে দেখতে খাবার খেতে ভুলে গেছে, আর খেতে গিয়ে কোনটির কোন খাবার পছন্দ হয়নি, কোনটি অভিমান করে লেপের তলায় সারা বিকেল শুয়ে ছিল, কার আজ দুদিন ধরে মন খারাপ এসব। নীলা লক্ষ করে, সবাই বিষম আগ্রহ নিয়ে শুনছে এসব, মাঝে মাঝে আহা আহা করছে, মাঝে মাঝে হাতে হাসতে বেড়াল বা কুকুর কোনও একটিকে বুকে জাপটে ধরে নাক মুখ ডুবিয়ে দিচ্ছে লোমে। বেড়ালের গায়ের বোটকা গন্ধে নীলা প্রথম থেকেই নাক চেপে আছে, হঠাৎ হঠাৎ শ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকার ব্যাপারটি নিশ্চিত করে বাকি সময় শ্বাস বন্ধই করে রাখছে। একটি ব্যাপার সে লক্ষ করছে, এত সোফা চেয়ার খালি পড়ে আছে, তবু দাঁড়িয়ে পান করছে সবাই। কী জানি, কার শরীরের মাপ কী, কে কার চেয়ে কত উঁচু, কার জুতো কোথা থেকে কেনা নাকি কার জামাটি দেখতে কত চমৎকার তা বোঝাতেই। নীলা তার জিনস, তার কড়া হলুদ রঙের একটি না-ইস্ত্রি শার্ট, তার সবুজ রঙের জ্যাকেটের দিকে তাকিয়ে টের পায় তাকে উৎকট লাগছে দেখতে, অন্য কারও যেন চক্ষুপীড়া, নাসিকাপীড়া না হয় তাকে দেখে, আলগোছে সে বৃত্ত ভেঙে সোফার একটি কোণে গিয়ে জবুথবু বসে, বসে টের পায় এ নিয়ম নয়, নিয়ম দাঁড়িয়ে থাকা। বৃত্তে দাঁড়িয়ে থাকো, যতক্ষণ না তোমাকে বসতে বলা হচ্ছে, বৃত্তে দাঁড়িয়ে, তুমি যদি জংলি কিছু পরা থাকে, তাই দেখাও, তুমি যে গেঁয়ো ভূত, তুমি যে সংস্কৃতির স-ও জানো না, কোথায় কোন পোশাক পরতে হয়, কী করে মেরুদণ্ড লোহার মতো শক্ত করে দাঁড়াতে হয় তা জানো না, তা বোঝাও। নীলা বসেই থাকে, কুলকুল করে ঘামে, লক্ষ করে কারও গায়ে কোনও গরম কাপড় নেই, দরজার কাছে হুকে ঝুলিয়ে তবে ঘরে ঢুকেছে সবাই, কারণ ঘরের ভেতরটা ঠাণ্ডা নয়, ঘরের ভেতর ওম আছে, মানুষের ওম, কুকুর বেড়ালের ওম, উষ্ণ সংস্কৃতির ওম, দম্ভের ওম।
এক কোণে ফায়ারপ্লেসে কাঠ পুড়ছে, আরেক পাশে বড় এক পিয়ানো। ধনীর বাড়িতে এ দুটো জিনিস না থাকলে চলে না। ঘর গরম করার যন্ত্র থাকলেও ফায়ারপ্লেসে আগুন ধরিয়ে ঘর গরম করার মধ্যে আভিজাত্য আছে, আর পিয়ানো কেউ বাজাক না বাজাক, এটি থাকলে সম্ভ্রম থাকে। সবুজ জ্যাকেটখানা খুলে ঝুলিয়ে আসে হুকে, কারও যেন চোখ না পড়ে তার দিকে, এমন সন্তর্পণে। ও খুলেও সংস্কৃতি রক্ষা তার পক্ষে সম্ভব হয় না, কারণ তার কড়া হলুদ শার্ট থেকে অসংস্কৃতির আলো ছিটকে বেরোচ্ছে, সে আলো অন্যের চোখকে আঘাত তো করেই, অন্ধ করতেও ছাড়ে না।
ফ্লুন বসন্তকালটা আবার খুব পছন্দ করে, বলতে বলতে নিকল সোফার দিকে এগোল। পেছন পেছন বাকিরা। বাকিদের বসতে অনুরোধ করে নিকল নিজেও বসল।
বসন্তের ঘ্রাণ পাচ্ছ বাতাসে?
সবাই এক বাক্যে সায় দেয়, ঘ্রাণ পাচ্ছে, নতুন পাতার ঘ্রাণ, নতুন কুঁড়ির ঘ্রাণ। জানালা সামান্য খোলা, ওতেই হুড়মুড় করে ঢুকছে বসন্তের ঘ্রাণ। নীলাও সে ঘ্রাণ পেতে শ্বাস নেয় লম্বা করে, তার ওই শ্বাসে বেড়ালের গায়ের ওই বোটকা গন্ধ ছাড়া কিছু ঢোকে না। বেচারা নীলা।
কী ভীষণ ঠাণ্ডাই না গেছে এবারের শীতে! রিতা বলল।
খুব ঠাণ্ডা গেছে বলে মারিয়া আর দানিয়েল মানল না, থাকতে মন্ট্রিয়ালে, থাকতে উপসালায়, দেখতে ঠাণ্ডা কাকে বলে।.দানিয়েল ছ বছর আগে কানাডা ছেড়ে এসেছে, ওই ঠাণ্ডা দেশে তার আর ফেরার শখও নেই, আর সে দেশের নামও সে নিতে চায় না, নাম নিলেই নাকি স্মৃতির এক পাহাড় বরফ তার গায়ের ওপর ধসে পড়ে। রীতিমতো আভালাঞ্জ।
শীতকালের প্রসঙ্গ যে যত দ্রুত সম্ভব দূর করে। যে বিষয়টির দিকে মারিয়া হাত বাড়িয়ে আছে, সে সূর্য। কী অভাবনীয় এর কিরণ, কী মধুর এর তাপ, কী যে আশ্চর্য জাদু এর আলোয়। নীলা শ্বাস বন্ধ করতে ভুলে যায়, বেড়ালের বোটকা গন্ধও যেন নিমেষে উবে গেছে, বসন্তের এমন রূপ বর্ণনা শুনে। নীলা বরং ঘন ঘন শ্বাস নেয়। শ্বাস নেয়, কারণ স্মৃতিতে এখন তার চাঁদি ফাটানো সূর্য। সূর্যের কোনও মোহনীয় রূপ তার কোনওকালে দেখা হয়নি, দেখা হয়েছে এর রুক্ষতা, তিক্ততা, এর রোষ, ক্ষোভ, এর গা পোড়ানো চরিত্র। ভ্যাপসা বিচ্ছিরি গরমে নীলার বরাবরই ঘন ঘন শ্বাস পড়ে, এখনও তাই পড়ছে। জল তেষ্টাও পায়, এখনও তাই পাচ্ছে। জলতেষ্টাকে সে দাবিয়ে রাখে, যতটা অপাঙক্তেয় অবজ্ঞাত হওয়া যায়, সে হতে চায় এ আলোচনায়। কারণ, কোনও কারণে কেউ যেন আবার না ভাবে, নীলা কুকুরকেই নয় কেবল, সূর্যকেও ভয় পায়। আর তা শুনে দানিয়েলকে যেন এগিয়ে আসতে না হয় নীলাকে উদ্ধার করতে এই বলে যে ও সম্ভবত সূর্য দেখেনি বা ওদের দেশে সূর্য ওঠে না।
চোখ আছে যেমন ওদের, চোখের লজ্জাও আছে। আর সে চোখের লজ্জার কারণে, ওরা বলে, সোফার এককোণে বসে খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে নখ খুঁটতে থাকা নীলাকে, আচ্ছা তোমাদের ভারতে এখন কী কাল?
দানিয়েলই জিজ্ঞেস করে। তার বন্ধুটি যে একেবারে ফেলনা নয়, ভারতে কী কাল চলছে, শীতকাল না গ্রীষ্মকাল এই সহজ প্রশ্নটির উত্তর অন্তত দিতে পারবে, সে ব্যাপারে অনেকটা নিশ্চিত হয়েই দানিয়েল প্রশ্ন করল, আর নীলাকে একাকিত্ব থেকে উদ্ধার করতেও।
নীলা আসলে একা বোধ করছিল না, এখনই বরং সে একা বোধ করে।
ম্লান কণ্ঠে উত্তর দেয়, বসন্তকাল।
বসন্তকাল?
নিকলের ভুরুতে অবিশ্বাস।
ভারত কি বিষুবরেখার উত্তরে না দক্ষিণে? প্রশ্ন।
রিতা বলে, উত্তরে।
নিকল বলে না না দক্ষিণে।
দানিয়েল বলে, বসন্তকাল হলে এ নিশ্চয়ই উত্তরে।
নিকল উঠে গেল, ফিরে এল হাতে একটি ঢাউস বই নিয়ে। পাঁচটা মাথা পৃথিবীর মানচিত্রে উপুড় হয়ে আছে। লাল (নিকলের), সোনালি (মারিয়ার), কালো (রিতার), বাদামি (মিশেলের), গাঢ় বাদামি (দানিয়েলের)।
মাথাগুলো দূর থেকে দেখে নীলা।
এবার রিতা, সঠিক উত্তরের রিতা, নীলার দিকে ঝুঁকে বলে, কী নাম ওই পরিচালকের? ওই স্যালন দ্য মুজিক যে বানিয়েছে…সত্যজিৎ রায়। ওর ছবি দেখেছি আমি। আকৰ্ণবিস্তৃত হাসি রিতার মুখে।
নীলার মুখে হাসি ফোটে। কথা ফোটে।
ওঁর আর কী ছবি দেখেছ?
প্রায় সব ছবিই।
পথের পাঁচালি দেখেছ? নীলা উদগ্রীব।
দেখেছি। তত ভাল লাগেনি।
ভাল লাগেনি? নীলা অবাক।
চারুলতা?
তাও দেখেছি। ওর সবচেয়ে ভাল ছবি হল স্যালন দ্য মুজিক, জলসাঘর।
রিতার রায় শুনে নীলা, যেহেতু তার মতে পথের পাঁচালিই সত্যজিৎ রায়ের শ্রেষ্ঠ ছবি, দমে যেতে গিয়েও যায় না, কারণ এক রিতাই একজন ভারতীয় তার ওপর বাঙালি সম্পর্কে বিস্তর জ্ঞান ধারণ করে আছে।
জলসাঘর কেন, রিতা যদি মহাপুরুষ বা কাপুরুষও পছন্দ করে, নীলার মনে হয় না সে এতটুকু চুক চুক করবে।
রিতাই আসলে একরকম নীলাকে উদ্ধার করে, নত মস্তক থেকে নখ খোঁটা থেকে সত্যিকার মুক্তি দেয়। নীলার কণ্ঠ থেকে কুণ্ঠা বিদেয় করে।
আর কোনও ভারতীয় পরিচালকের ছবি দেখেছ? নীলা জিজ্ঞেস করে।
দেখেছি আর দুএকটা। তবে তোমাদের ছবিতে খুব নাচ গান থাকে।
তা থাকে, সস্তা মারদাঙ্গা, রুচির ছিটেফোঁটা নেই। হিন্দি ছবিগুলোকে নীলার অস্বীকার করার উপায় নেই যে এ তার বা তাদের ছবি নয়।
ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, অপর্ণা সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত এদের ছবি দেখেছ? না দেখেনি। নাম শুনেছ? শোনেনি।
রিতা নিজে এখনও কোনও বড় ছবি, যাকে বলে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, বানায়নি। এ অব্দি যা করেছে, সব ছোট। ছোট বলতে দু মিনিটের, পাঁচ মিনিটের, পনেরো মিনিটের। তিনটে তথ্যচিত্র করেছে কুর্দ মেয়েদের জীবন নিয়ে, আর একটি করেছে তুরস্কে রুশ মেয়েদের পতিতাবৃত্তি নিয়ে। পূর্ণদৈর্ঘ্য? ও বানানো সহজ, কিন্তু সহজ নয় প্রযোজক পাওয়া।
দানিয়েল বলে, মেয়েদের পণ্য করে আজ বানাতে চাও কোনও ছবি, দেখবে প্রযোজকেরা লম্ফ দিয়ে আসবে ছবির খরচ দিতে।
নিকল সংশোধন করে দেয়, পুরুষ প্রযোজক।
টেবিলে বিভিন্ন মদের বোতল। শ্যাম্পেন আছে, পরতো আছে, মার্টিনি, ভদকা, হুইস্কি আছে, যে যা পান করো।
নিকল গেলাসে ঢেলে দেয়, যে যা চাচ্ছে। মারিয়া সবেগে মাথা নাড়ে, সে মদ্যপান করবে না আগেই বলেছে, কারণ সে গাড়ি চালাবে।
প্যারিসে এ দুদিনের জন্য গাড়ি?
দুদিন পর সে যাচ্ছে দক্ষিণে, কান-এ।
ওখানেও বক্তৃতা?
না, ওখানে সমুদ্র। দক্ষিণী উষ্ণতা।
ও সুইডিশ, আর কিছু না জানলেও আইন মানতে জানে, মিশেল কজ চোখ টিপল বোলে। আমরা ফরাসিরা দুএক গেলাস পেটে না ফেলে স্টিয়ারিঙে হাত দিই না। নাকি এবসলুত লাগবে?
এবসুলেটলি নট।
নীলা পরতো নেবে বলল। নেবে কারণ বোতলটি দেখতে অন্য বোতলের চেয়ে ভাল। আর পান করতে যেহেতু হবেই, যেহেতু পান না করলে ভাবা হবে সে এক গেঁয়ো ভূত। আর নিকল যখন হাতে দেয় গেলাস, নীলা ধন্যবাদ বলে।
ম্যা(গ)সি বকু।
এটির উচ্চারণ শিখতেই তার অনেকদিন লেগেছে। এম ই আর সি আই মেরসি, বি ই এ সি ও ইউ পি বিয়াকুপ। মেরসি বিয়াকুপ। তাই বলত। যেরকম বানান সেরকম উচ্চারণ। কিন্তু শুনে লোকে অবাক হয়, এ আবার কী আজব ভাষায় কথা বলছে এ মেয়ে! ফরাসিরা র উচ্চারণ করতে গেলে গ-এর মতো এক শব্দ বেরোয়, আর শব্দের লেজ বেশির ভাগ সময়ই এরা উচ্চারণ করে না। এ দেখে নীলার বদ্ধ ধারণা, বই পড়ে আর যে ভাষাই শেখা যাক, ফরাসি ভাষা নয়।
নীলার মাথা খারাপ হবার জোগাড় হয় যখন দেখে ফরাসি সব জিনিসেরই, সব পদেরই লিঙ্গ আছে। বড় লিঙ্গপ্রেমী এরা। টেবিল চেয়ার দরজা জানালা খাতা কলম থাল বাসন সবকিছুরই লিঙ্গ আছে। টেবিল পুংলিঙ্গ তো চেয়ার স্ত্রীলিঙ্গ, বই পুংলিঙ্গ তো কলম স্ত্রীলিঙ্গ। দরজা কি পুংলিঙ্গ না স্ত্রীলিঙ্গ? স্ত্রীলিঙ্গ। কী কারণ? কোনও কারণ নেই। ব্রেসিয়ার কী লিঙ্গ। পুংলিঙ্গ। এ মেয়েদের জিনিস, এ পুংলিঙ্গ কেন? কারণ নেই। প্যান্টি? পুংলিঙ্গ, লিপস্টিক? এও পুংলিঙ্গ। মন্ত্রী কী লিঙ্গ? মন্ত্রী পুংলিঙ্গ। তবে মেয়ে মন্ত্রীদের উপায় কী? পুংলিঙ্গই ব্যবহার করছে, কেউ আবার দাবি তুলছে শব্দ বদলাবার। নীলার জানতে ইচ্ছে করে, পুংলিঙ্গটি কোন লিঙ্গ, পুংলিঙ্গ তো? না কি স্ত্রীলিঙ্গ।
নীলা অনেকটা আশা ছেড়েই দেয়, এ ভাষা শেখা তার দ্বারা হবে না। এত লিঙ্গ সামলাবার ক্ষমতা ওর নেই। আপাতত ম্যা(গ)সি বকু বলতে পেরে সে স্বস্তি পায়। অন্তত তাকে অসভ্য বলে এখন আর কেউ গাল দেবে না। অতি সতর্ক সে, চোখ কান নাক মুখ সব খোলা, কোনও কারণেই যেন ধন্যবাদ বলতে ভুল না হয়।
আলোচনা গড়িয়ে যাচ্ছে পুরুষ প্রযোজক থেকে নারী প্রযোজকে, নারী প্রযোজক থেকে নারী পরিচালকে, এরপর ব্যাক গিয়ারে একশো বছর পিছিয়ে যায়, সুসান বি এনথনি, এলিজাবেথ, কেডি স্ট্যানটন—ভোটের আন্দোলন। ভোট থেকে লাফিয়ে নারী শ্রমিক আন্দোলনে, ক্লারা জেটকিনের সভায়। সেই সভা থেকে আরও একটি লম্বা লাফে জন্মনিয়ন্ত্রণ। সেটির ফয়সালা হল। এখন কী? এই ফ্রান্সে, এই ইগালিতের সংসদে শতকরা দশজনও মেয়ে নেই। কী লজ্জা কী লজ্জা। সিমোন ভেইল, কী করেছে সংসদে বসে? কিচ্ছু না। আউসউইৎস থেকে বেঁচে এসে ডানপন্থী দলে ভিড়েছে, বোকামো ছাড়া আর কী! ক্যাথারিন ত্রতমেন? স্টারসবুর্গের মেয়র থাকাই ওর ভাল ছিল, সংস্কৃতিমন্ত্রী হয়ে কাজের কাজ কিছু করেনি। এলিজাবেথ গিগুকে বরং বাহবা দিতে হয়, পঞ্চাশ ভাগ মেয়েদের নাম থাকতে হবে দলের নমিনেশনে, এ একটা ঘটনা বটে। নমিনেশন পাওয়া মানে তো আর সংসদে বসা নয়। ভোটে আর কজন জিতবে!
মারিয়া তার উঁচু নাক আরও খানিকটা উঁচুতে তুলে বলে, অবশ্য আমাদের দেশে এই ঝামেলাটা নেই। সংসদে মেয়েরা চল্লিশের ওপর।
যা হবার ওই স্ক্যানডিনেভিয়াতেই হচ্ছে। নিকল বলে, মুখ মলিন তার।
মারিয়া পরক্ষণেই ঝাঁজালো করে স্বর, ছাই হচ্ছে। একাডেমিক পদগুলোয় দেখো গিয়ে, বড় পদে কারা আছে, সব পুরুষ।
মন দিয়ে বরফের দেশ থেকে আসা মেয়ে মারিয়াকে শোনে বাকিরা। বরফের দেশটি ছিল ভাইকিং জলদস্যুদের দেশ, জলদস্যুরা বিভিন্ন দেশে অতর্কিতে হামলা করত, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিত, শহর গুঁড়িয়ে দিত, দেদারসে মানুষ খুন করে রত্নরাজি ধনদৌলত লুট করত। জলদস্যুর উত্তরপুরুষ এবং উত্তরনারীরা এখন পৃথিবীর অন্যতম সভ্য পুরুষ এবং সভ্য নারী বলে পরিচিত, জলদস্যুর দেশ এখন সমতা সাম্য সুখ আর সমৃদ্ধির দেশ।
মারিয়া বলে, মোনা সালিনের ব্যাপারটা জানো তো? ও তো প্রধানমন্ত্রী হয় হয় করেও হচ্ছে না।
কারণ?
সরকারি ক্রেডিট কার্ডে কবে নাকি চকোলেট কিনেছিল, গেছে ফেঁসে। হত পুরুষ, দেখতে ক্রেডিট কার্ডের ব্যাপারটি নেহাতই তুচ্ছ।
নীলা প্রায় বলতে নেয়, মেয়েরা রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী হলেই কি সব সমস্যা ঘুচে যায়। কই, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশে তো মেয়েরা পেয়েছে ও পদ, কিন্তু সমাজে মেয়েদের অবস্থা যা ছিল, তাই তো আছে। কিন্তু বলে না, বরং গিলে ফেলে, পরতোর মতো গেলে। নীলার ধারণা, এ বাক্যও গর্দভের মন্তব্য বলে বিবেচিত হতে পারে। পারেই তো, নীলা ভাবে, বাপ স্বামীর লেজ ধরে ওসব দেশে মেয়েরা ক্ষমতায় আসে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নয়।
ভারত হল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র। নীলা মনে মনে বলে।
বোলে, নীলা, মনে মনে শোনে ওরা বলছে, তোমার ওই সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র ধুয়ে খাও। নীলা ধুয়ে খেল। ফরাসি বরদিওক্স ওয়াইনে ধুয়ে ইয়া বড় গণতন্ত্র গিলল। বরদিওক্স, ভুল। দানিয়েল শুধরে দেবে, বরদো। নীলা ভারতের নিচু জাতের মেয়ে, বড় জাতে ওঠার কোনও সম্ভাবনা নেই তার। তবে ফরাসি জাতে উঠতে হলে কিছু জিনিস মকসো করলেই চলে। এদেশে জাতে ওঠার ব্যাপারটি অন্যরকম, জন্মপরিচয় তত দরকার হয় না, বরদো পান করাটা ভাল শিখে গেলে অনেকটা কাজ হয়, পান করা মানে যে গিলতে পারা তা নয়, গেলাস কী করে দু আঙুলে ধরতে হয়, কী করে প্রথম ছোট্ট চুমুকে জিভাগ্রে ভিজিয়ে মাথা ডানে কাত করতে হয়, তারপর সামনে পেছনে আলতো করে কী করে মাথা ঝাঁকাতে হয়, চুমুকে চুমুকে ছন্দময় বিরতি, এসব হচ্ছে শিল্প, এ শিল্প করায়ত্ত করতে পারলেই জাতে আশি ভাগ উঠে যাওয়া যায়, মই ছাড়াই।
মিশেল কজ অম্লান বদনে বলে, যাই বলো বাপু, জগৎ বদলাচ্ছে। মেয়েরা কী অবস্থায় ছিল, এই ইয়োরোপের কথাই ভাবো না কেন! গির্জার লোকেরা মেয়েদের জ্যান্ত পুড়িয়ে মারেনি? মেরেছে।
নিকল হাত তুলে থামতে বলল সবাইকে। থামলে, ধীরে সে বলল, কিন্তু প্রতিটি শব্দে জোর দিয়ে, বদলাচ্ছে ওপরে ওপরে, ভেতরে ঠিক তাই আছে, যা বরাবরই ছিল। নারীর ওপর পুরুষের শোষণ। শোষণের কাঠামোর কিন্তু কোনও বদল হচ্ছে না।
বরাবরই ছিল বলছ কী নিকল, মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা তো এককালে ছিল। নারীর হাত থেকে পুরুষ তো ক্ষমতা নিল অস্ত্রের জোরে।
নিকল জোর গলায় বলে, মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা কোথাও কোনও কালেই ছিল না। ছিল যা, তা হল মাতৃলোকাল আর মাতৃলিনিয়ার সমাজ। সম্পত্তি মেয়েদের নামে হত, আর মেয়েদের পদবি বংশানুক্রমে গ্রহণ করা হত, এই যা। এ মাতৃতন্ত্র নয়।
যদিও দানিয়েল বলেছিল তোমার আর মারিয়ার কারণে, যেহেতু তোমরা ফরাসি জানো, আমরা ইংরেজিতে কথা বলব, যা কথা, যা আলোচনা ইংরেজিতেই হচ্ছে, আর নীলা বেশ ভাল বুঝতে পাচ্ছে, হচ্ছে মারিয়ার কারণেই, নীলার কারণে এ আলোচনা ইংরেজিতে হওয়ার কোনও কারণ নেই, কারণ সে অংশগ্রহণ করছে না এতে, তার পক্ষে সম্ভবও নয়। এক গেলাস পরতো শেষ করে, অপাঙক্তেয় নীলা, নারী আন্দোলনে না পারুক, ফরাসি ভাষায় দক্ষতা দেখাতে বলল, জে পুর আভোইর দু ভিন রোগি সিল ভোউস প্লেইট!
নীলা কী বলছে তা বোঝার ক্ষমতা কারও নেই। তাকে ইংরেজিতে বলতে হল সে কী বলতে চাচ্ছে। আমি লাল ওয়াইন খেতে চাই।
উথলে ওঠে হাস্যরসফেনা। দানিয়েল শুধরে দেয় জ পু আভোয়া দু ভা রুজ সিল ভু প্লে।
ঠোঁট বিযুক্ত করলেই গোল বাঁধছে। ঠোঁট জোড়া চেপে রাখে নীলা। নিকল ভাল ইংরেজি জানেনা বলে নীলা ভেবেছিল, এ কদিনে শেখা তার ফরাসি যথাসম্ভব আওড়াবে সে। অন্তত ঘরে ঢুকেই নিকলের দিকে হাত মেলাতে মেলাতে, কমেন্ট তালেজ ভাউজ? আর তাকে একই প্রশ্ন করলে, উত্তর, এত্রে বিয়েন। ভাল যে কুকুরের ঝাঁপিয়ে পড়া নীলাকে ফরাসি বলতে বিরত করেছিল।
ওই হাসির স্রোতে সীল মাছের মতো মাথা ভেসে ওঠে নিকলের। আজ রাতে ভোজের আয়োজন নিয়ে তার যে পরিকল্পনা আছে, তার বর্ণনা। রেফ্রিজারেটরে শুয়োরের মাংস আছে, সে চাচ্ছে, একে রসুন দিয়ে রান্না করতে।
মমমম মমমম শব্দ উঠল।
আলু সেদ্ধ। আর হল সালাদ। আর পনির। আর আছে তার্ত। নিকল।
মমমম মমমম। বাকিরা।
শেষে কফি। নিকল।
মমমমম। বাকিরা।
নিকল রান্নাঘরে চলে গেল রেফ্রিজারেটর থেকে শুয়োর বের করতে। পেছন পেছন দানিয়েল, দানিয়েলের পেছন পেছন রিতা। দেখে নীলা নিশ্চিত যে রান্না শেষ হতে রাত পার হবে। কিন্তু পাঁচ কি ছ মিনিটের মতো পার হয়েছে কি হয়নি, টেবিলে রান্না করা শুয়োর এনে রাখে নিকল, এত শিগরি কী করে শুয়োর গলেছে, তা আর সবার মাথায় ঢুকলেও, নীলার মাথায় ঢোকে না। নিকল ঝটপট বলে দেয় কে কোন চেয়ারে বসবে। যার যার পানীয়ের গেলাস হাতে নিয়ে টেবিলে চলে এসো। আলুসেদ্ধ তুলে নাও, আর শুয়োরের টুকরো।
কী করে রান্না হয়েছে এটি?
মাখনে ভাজা হয়েছে, ভাজার সময় এক কোয়া রসুন চটকে দেওয়া হয়েছে, ব্যাস।
এটির নাম, রসুনে শুয়োর।
ডান হাতে ভাত ডলে খাওয়ার মেয়ে নীলার হাতে কাঁটা চামচ, আর ছুরি। ডান হাতে কাঁটা চামচ, বাঁ হাতে ছুরি নিয়ে মাংস কাটতে গিয়ে ছিটকে পড়ে ছুরি, ছুরি তুলে আবার কাটতে গিয়ে ছিটকে পড়ে কাঁটা। এবার তুলে আর কাটাকাটিতে যায় না, শক্ত হাতে কাঁটা ছুরি ধরে রাখে, ভয় হয় মাংসে ছোঁয়ালেই হাত থেকে খসে পড়বে সব। আড়চোখে অন্য হাতগুলো দেখে সে, ডান হাতে ছুরি, বাঁ হাতে কাঁটা। কেউ যেন না দেখে, লুকিয়ে নিজের কাঁটা ছুরির হাত বদল করে নীলা। ছুরি বাঁ হাত থেকে ডানে নেয়, আর কাঁটা ডান থেকে বাঁয়ে। হাত বদলের পর নির্ভাবনায় ছুরি কাঁটা ফের মাংসে ছোঁয়াতেই পড়ল হাত খসে আবার।
নীলার দিকে কেউ তাকাচ্ছে না নীলা লজ্জা পাবে বলেই সম্ভবত, তার চেয়ে যদি হইরই করে উঠত সব, বলত কী ঘটনা কী, তুমি বুঝি কাঁটা ছুরি ধরতে জানো না? মুঠো করে নয়, কাঁটার গায়ে তর্জনী রাখো, ছুরির গায়েও, কাঁটা ঢুকিয়ে দাও মাংসের পেটে, তারপর ডান হাতের ছুরিতে কাটো, বাঁ হাতের কাঁটায় তুলে নাও টুকরো। নীলা অন্তত হেসে বলতে পারত, কী জানো, আমাদের হাতে খেয়ে অভ্যেস। হাতে খাওয়ার স্বাদই আলাদা। হাতে খাবার ছুঁলে খাবারের সঙ্গে একরকম ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়, আত্মীয়তামতো। টেবিলের নীরবতা, নীলার ছুরিপতন, কাঁটাপতন দেখেও না দেখা, তাকে দ্বিগুণ লজ্জায় ফেলে। লজ্জা থেকে নীলার মুক্তি নেই।
দানিয়েলের দিকে আড়চোখে তাকায় সে, নীলার হাতখসা কাঁটা ছুরির শব্দ ওকে কতটা অস্বস্তিতে ফেলছে, অনুমান করার চেষ্টা করে। সম্ভব হয় না। নীলার পক্ষে সম্ভব হয় না মশলাহীন মাংস চিবোতে। আর সবার মতো নুন আর কালো লঙ্কার গুঁড়ো ছিটিয়েও নীলা লক্ষ করে কাজ হচ্ছে না। মাংস বিস্বাদই লাগছে তার জিভে। শুয়োরের শরীরের গন্ধ পাচ্ছে সে মাংসে। সারা টেবিল তখন উমমমমম উমমমমম করছে, নীলা একটি আলুসেদ্ধর কণা মুখে দিয়ে সালাদের আধখানা পাতা চিবিয়ে মুখের শুয়োরের গন্ধ দূর করল খানিক। তারপর পনির এসে মুখকে আবার বিনাশ করে দিল। এদিকে বড় বাগেত রুটি ছিঁড়ে যে যার থালার পাশে টেবিলের ওপর রেখেছে, দ্রুত, অভ্যস্ত এবং অবশ্যই সভ্য হাতে ছুরির মাথায় পনির নিয়ে রুটির ওপর লাগিয়ে রুটিপনির সোজা মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিচ্ছে। বাগেত গড়াচ্ছে টেবিলের ছাইয়ে ধুলোয়। ও খাওয়া নীলার পক্ষে সম্ভব হয় না, পনিরের দুর্গন্ধ দূর করতে তার্তের আশ্রয় নিতে হল তাকে। তার্ত তাঁতা, সাদামাটা আপেল পাইএর নাম। কোনও এক বাড়ির কোনও এক দুবোন আপেল পাই বানিয়ে ভুল করে উপুড় করে ঢেলেছিল থালায়। তলার আপেল উঠে এল ওপরে, আর ওপরের আটাগোলা ভাজা চলে গেল তলে, তাই মনে ধরল লোকের, সেই থেকে আপেল পাইএর নাম গেল বদলে, তার্ত পম(আপেল) না হয়ে তার্ত তাঁতা। তাঁতা ছিল দুবোনের পদবি।
নীলা কফি খাবে না। চা আছে? না চা নেই। সুতরাং জল গিলতে হয় নীলাকে। খাওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পরও খাবার টেবিলে বসে থাকার অভ্যেস নীলার নেই। ছটফট করে সে, কিন্তু উঠে ওই সোফায় গিয়ে বসতে পারে না, কারণ নিয়ম নেই। নিয়ম খাওয়া শেষে খাওয়ার টেবিলেই সময় কাটানো। অভিজাত ইংরেজ অবশ্য এক ঘরে মূল খাবারটি খায়, তারপর হাতে ন্যাপকিন নিয়ে উঠে যায় অন্য ঘরে মণ্ডা মিঠাই খেতে, খেয়ে আরেক ঘরে যায় চা বা কফি খেতে। রীতিমতো দৌড়োদৌড়ি করে খাওয়া। নীলা হিসেব করে দেখে নিকলের বাড়িতে খাবার টেবিলেই পার হয়েছে পুরো পাঁচ ঘণ্টা। বাঙালি আর ফরাসিতে পাঁচের একটি মিল লক্ষ করে সে। বাঙালির খাবার বানাতে সময় খরচা হয় পাঁচ ঘণ্টা, আর খাওয়া শেষ হয় পাঁচ মিনিটে। আর ফরাসিরা খাবার বানাতে সময় নেয় পাঁচ মিনিট, আর খায় সে খাবার পাঁচ ঘণ্টায়।
নীলার ওই অস্থিরতা গুঁড়িয়ে দিয়ে নিকল গেলাস উঁচিয়ে ধরে, নীলার উদ্দেশ্যে। কী ঘটনা? আরতে টেলিভিশনে ভারতের ওপর এক্ষুনি একটি তথ্যচিত্র দেখানো হবে। ব্যাস চেয়ার ঘুরিয়ে বসল সবাই। নীলাকে ঠেলে দেওয়া হল সবার সামনে, পিয়ানোর পাশে, কুকুর বেড়াল সোফায়, ওদের চোখও তথ্যচিত্রে।
টেলিভিশনের পর্দা জুড়ে শুন্য একটি টিনের থালা, ফুটো থালা। ক্যামেরা পেছন দিকে সরছে, থালা ছোট হচ্ছে, পর্দা জুড়ে খালি পা, হাঁটছে। এবার ক্যামেরা আরও দূরে সরল, খালি পায়ে, খালি গায়ে, মাথায় রুক্ষ চুল, নাকে সর্দি ঝুলছে এক আট বছরের ছেলে হাঁটছে রাস্তায়। হাতের ফুটো থালা এগিয়ে ধরছে রাস্তার লোকের দিকে, ভিক্ষে চাইছে। কেবল একটি ভিখিরিই নয়, এক ভিখিরির পেছনে আরও ভিখিরি। আর রাস্তায় মানুষের গিজগিজ ভিড়, ভাঙা ট্রাম ঘটঘট শব্দ করে এগোচ্ছে, আধভাঙা বাস ট্রাক ভিড়ের মধ্যে গলা ঢুকিয়ে দিচ্ছে ভয়াবহ শব্দে ভোঁ বাজাতে বাজাতে, আর এর মধ্যে শীর্ণ কটি গোরু হাঁটছে, ভিড়ের রাস্তায় কিছু গোরু বসে জাবর কাটছে, কিছু গোরুরগাড়ি হেই হেই করতে করতে ছুটছে। ভিখিরিতে উপচে গেছে ফুটপাত। আর সেই ছেলেটিই ফুটো থালা হাতে ঘরে ফিরছে, ঘর বলতে একটি ভাঙা ঝুপড়ি। ঝুপড়িটি একটি জলাশয়ের ওপর, সরু বাঁশে হেঁটে তবে ঢুকতে হয় ঝুপড়িতে, শুকনো পাতায় বানানো ঝুপড়িতে। ভেতরে এক দঙ্গল ভাইবোনের কিচির মিচির। ভাইবোনগুলো ভাতের হাঁড়ির ওপর হামলে পড়ছে।
নীলা এক ঘর স্তব্ধতা ভেঙে বলল, নিশ্চয়ই খুব গরিব ঘরের কাহিনী দেখাচ্ছে।
শশশশশ। নীলাকে ঠোঁট যুক্ত করতে বলা হচ্ছে।
পর্দায় তখন ভাতের হাঁড়ি, শূন্য হাঁড়ি। সাঁকো পেরিয়ে মা যাচ্ছে কলসি ভরে জল আনতে নীচের জলাশয়টি থেকে। জল এনে চুলো ধরালো রেললাইনের ধারে। রেলগাড়ি যায়, আর চুলোর আগুন যায় নিভে। ধোঁয়ায় চোখ ঢাকতে ঢাকতে মা ভাত ফুটোচ্ছে। ক্যামেরায় আবার ভাতের হাঁড়ি। হাঁড়ির ওপর হামলে পড়ছে ছেলেমেয়েগুলো। মা ঠেলে সরাচ্ছে ওদের। এর পরের দৃশ্য, সেই ভিখিরি বালক বাইরে সাঁকোয় বসে খোলা আকাশের নীচে বসে মলত্যাগ করছে, নীচে বদ্ধ জলাশয়।
তথ্যচিত্র শেষ হতেই রিতা প্রথম মুখ খুলল, আহ, কী চমৎকার ক্যামেরার কাজ।
নীলা সোফার পাশ-টেবিল থেকে একটি ম্যাগাজিন টেনে ঝুঁকে রইল তার ওপর, যেন খুব মন দিয়ে সে পড়ছে ওটি। নীলা জানে,নীলা মুখ লুকোচ্ছে। কান খোলা, সে কানে ঢুকছে রিতার উচ্ছ্বাস।
মিশেলের কণ্ঠ, আরতের তথ্যচিত্রের মতো তথ্যচিত্র হয় না।
আর ক্যামেরা যখন জুম করল হাঁড়িতে, নেপথ্যসংগীতটা খেয়াল করেছ? এডিথ পিয়াফের ওই গানটার সুরটা না?
কোনটা, লা ভি লামোর…?
না না, দ লর বেইসের…
নীলার চোখ ভোগ ম্যাগাজিনের ছবিতে স্থির হয়ে থাকে। এক সুন্দরী দুচোখে থই থই কামনা নিয়ে সমুদ্রতীরে উলঙ্গ শুয়ে আছে, আর পায়ের কাছে বালুতে পড়ে আছে একটি সুগন্ধীর শিশি, অপিয়াম।
ম্যাগাজিন থেকে নীলা চোখ সরাল, অথবা মুখের সামনে থেকে ম্যাগাজিন সরাল যখন চেয়ার সরানোর শব্দ পেল কারও। ওঠার উদ্যোগ। ঠিক এটিই প্রাণপণ চাইছিল সে, উঠতে। প্রায় লাফিয়ে উঠে সবুজ জ্যাকেটখানা পরে নিল। দানিয়েল আবার অসভ্যতার দোষ না দেয়, মাথা নিচু, কিন্তু মুখে বলল, এ বিয়েনটট।
ও বললেই বিদায়ের পাট শেষ হবে, তা নয়। নিকল, মিশেল আর রিতার গালে তিন দুগুণে ছটি চুমু খেতে হল নীলাকে। মারিয়াকে খেতে হল না কারণ নীলা আর দানিয়েলকে সে গাড়িতে অনেকটা পথ পৌঁছে দেবে, পথে নেমে যাবে দুজন, মারিয়ার সঙ্গে তখন হবে চুমোচুমি।
দানিয়েলও তিনজনকে চুমু খেয়ে বলল, আবিয়াঁতো।
রিতা বলল, এ আমার সৌভাগ্য ভারতের ওপর তথ্যচিত্র দেখলাম একজন ভারতীয়কে সঙ্গে নিয়ে।
নীলা হাসল, হাসতে হয় বলে হাসল। তা না হলে অবিনয়ী অথবা ধৃষ্ট বলে তার দুর্নাম হবে।
মারিয়ার গাড়িতে নীলা পেছনে বসল, সামনে দানিয়েল। মারিয়া মন্দ্রগম্ভীর স্বরে বলল, সিটবেল্ট। সিটবেল্ট।
সুইডিশ কানুন। পেছনের অন্ধকারে হাতড়ে সিটবেল্ট পেল বটে নীলা, তা বাঁধার কোনও উপায় পেল না।
যখন ঘরে পৌঁছল, অনেক রাত। দানিয়েল জামা কাপড় খুলে সোজা বিছানায়।
নীলার ঘুম পাচ্ছে না। তবু সে শুয়ে রইল, জামা কাপড় না পালটেই।
দানিয়েল বলে, কী দীর্ঘশ্বাস ফেলছ যে! কী হয়েছে?
না কিছু না।
কথা বলছ না যে।
কী বলব, বলো!
কেন কিছু কি বলার নেই! দানিয়েল নীলার কাঁধে হাত রেখে বলল। কেমন লেগেছে। নিকলকে, নিকলের আর বন্ধুদের?
ভাল।
উঁহু, তোমার মন ভাল নেই নীলা। স্পষ্ট বুঝতে পারছি।
আসলে কী জানো, আমার নিজের ওপর খুব রাগ হচ্ছে।
এবার দানিয়েল নীলাকে নিজের দিকে ফেরাল।
কেন রাগ হচ্ছে?
নিকলের বাড়িতে আমার যাওয়াই উচিত হয়নি।
কেন উচিত হয়নি?
দানিয়েলের প্রশ্নের উত্তরে অনেকক্ষণ নৈঃশব্দ্যের জলে নীলা ডুবে থাকে, প্রশ্নটি বারবার যখন তার কানের কাছে ঝিঁঝি পোকার মতো ডাকতে থাকে, নীলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, দেখলে না কেমন গাধার মতো সারাক্ষণ ছিলাম। আমাকে এসব জায়গায় মানায় না। কিষানের ঘরের বউ হয়ে থাকাই বোধহয় ভাল ছিল, আপাদমস্তক গৃহবধূ। রাঁধব বাড়ব, ভারতীয় দু একজনের সঙ্গে কথা বলব, ব্যাস। আমি আসলে এই সমাজে চলার উপযুক্ত নই।
দানিয়েল উঠে বসল, কী হচ্ছে কী? একটা ভাল জায়গায় গেলে, কোথায় তোমার মন ভাল হবে, আর তুমি কিনা অনুযোগ করছ!
নীলা তেমন বিষণ্ণ গলায় বলে, আচ্ছা, তোমার কি ওই তথ্যচিত্রটা ভাল লেগেছে?
নিশ্চয়ই। তোমার লাগেনি?
নাহ্।
বাহ আরতের মতো এত ভাল একটা চ্যানেল ভারতের ওপর ছবি দেখাচ্ছে, এর মূল্য অনেক, সে জানো?
দানিয়েল, নীলা ধরা গলায় বলে, ভারতে ওরকম দারিদ্র্যই কেবল আছে তা নয়। প্রচুর ধনী লোক আছে ওখানে, প্রচুর মধ্যবিত্ত…
দানিয়েল সশব্দে হেসে উঠে বলল, আরতে টেলিভিশন কি ভারতের ধনীদের ছবি তুলতে যাবে! ধন দেখালে বিল গেইটসের ধন দেখাবে। আর দারিদ্র্য দেখানোই তো ভাল। ভারতের জন্য লাভ, আর্থিক সাহায্য পাবে।
দানিয়েল পিঠের পেছনে দুটো বালিশ রেখে আরাম করে বসে গুলোয়াজের গুঁড়ো পাতলা কাগজে পুরে সিগারেট বানিয়ে ধরাল। লম্বা একটি টান দিয়ে ধোঁয়া ছড়িয়ে ঘরে, নীলার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, এ তো তুমি অস্বীকার করতে পারো না যে ভারত একটি গরিব দেশ। এ কি তুমি অস্বীকার করতে পারো যে পরিবারটিকে দেখাল আজ, সেরকম পরিবার নেই ভারতে? আছে। নিশ্চয়ই আছে। পৃথিবীর কত কোথাও মানুষ এমন মানবেতর জীবন যাপন করছে নীলা! এদের জন্য কিছু করা দরকার সবার। বিশেষ করে এই ধনী দেশগুলোর। ভারতে ধনী আছে, ঠিক আছে। কিন্তু ধনীদের জীবনযাপন তো আমরা জানিই। বরং এসব দরিদ্রের জীবন দেখলে আমরা উঠে বসি, ভাবি। সবাই না, যারা ভাবার, তারা ভাবে। যাদের হৃদয় আছে, তারা। এ অনেকটা, জানো নীলা, চাবুকের মতো আমাদের পিঠে পড়ে।
নীলার কুণ্ঠিত কুঞ্চিত মন হঠাৎ ভিখিরির ভাঙা ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। দানিয়েলের হাতটি টেনে নিয়ে বলল, তুমি কী যে ভাল! তোমাকে যত দেখি, মুগ্ধ হই।
দানিয়েল নীলার হাতটি আঙুলে বুলোতে থাকে।
নীলার ভাল লাগে।
এই, এত কাপড় চোপড় পরে ঘুমোতে এসেছ যে, আরামে ঘুমোতে পারবে না।
পাশ ফিরে বলে নীলা, ন্যাংটো ঘুমোনোয় আমার অভ্যেস নেই।
গায়ে লেপ টেনে গুটিসুটি শুয়ে থাকে সে। দানিয়েলের আঙুল নীলার বাহু থেকে ঘাড়ে, ঘাড় থেকে চুলে পৌঁছে। মাথায় কোনও নরম আঙুল ঘুরে বেড়ালে, নীলার ঘুম নেমে আসে চোখে। মলিনা প্রায়ই চুলে বিলি কেটে দিতেন, নীলা ঘুমোত। এই মা-হীন দেশে, দানিয়েল অনেকটা মায়ের মতো। নীলার ঘুম ছুটে যায় যখন দানিয়েলের আঙুল ওর বুকের ওপর হেঁটে বেড়ায়।
ওর হাত সরিয়ে দিয়ে হেসে ওঠে, কাতুকুতু, না?
না। না স্বরটি বেশ গম্ভীর।
নীলা ঘাড় ফিরে তাকায় দানিয়েলের দিকে। বাদামি চোখদুটোয় কাতুকুতুর দুষ্টুমি নেই।
জানো, আমার মা এরকম চুলে হাত বুলিয়ে দিতেন, আমার কী যে ভাল লাগে কেউ এরকম দিলে।
তোমার ভাল লাগে? এই দেখো দিচ্ছি। কী সুন্দর কালো চুল তোমার। কী সুন্দর, তোমার গায়ের রং।
গায়ের রং সুন্দর হবে কেন! সাদা না তো! নীলা ভেংচি কাটে নিজেকে।
সাদা না বলেই তো সুন্দর।
তোমার বাদামি রং পছন্দ?
খুব। খুব।
দানিয়েল হাত বুলিয়ে দিতে থাকে নীলার চুলে, ওর দিকে ফিরে, ওকে জড়িয়ে শিশুর মতো শুয়ে থাকে নীলা। মলিনার বুকে মুখ লুকিয়ে নীলা এমন করে রাতের পর রাত ঘুমিয়েছে। নীলার অতীত হঠাৎ এই চিলেকোঠার খোলা জানালা দিয়ে এক ঝাঁক আলোর মতো ঢোকে।
কিন্তু আমার যে কোনও গুণ নেই দানিয়েল! নীলার ভাঙা স্বর।
কে বলল নেই। আমার সবচেয়ে ভাল লাগে তোমার সারল্য।
দানিয়েলের আঙুল নীলার চুল থেকে কপাল, কপাল থেকে নাক বেয়ে ঠোঁটে নামে।
তোমার ঠোঁট এত সুন্দর, বড় চুমু খেতে ইচ্ছে করে।
চুমু? ঠোঁটে?
নয় কেন?
উহুঁ।
উহুঁ মানে? চাও না?
নীলা মাথা নাড়ে। চায় না।
তোমার পা দুটো কী বিষম ঠাণ্ডা হয়ে আছে। দানিয়েল তার পা বাড়িয়ে নীলার দু পায় বুলোতে বুলোতে বলে।
দানিয়েলের আঙুল নীলার শরীর থেকে সরে না। দানিয়েলের পা নীলার পা থেকে সরে না।
নীলা আবার পাশ ফেরে। ঘুমকণ্ঠে বলে চলো ঘুমোই। অনেক রাত হয়েছে।
তাতে কী, কাল রোববার।
কাল কাজ নেই, সকালে ওঠার তাড়া নেই। তাই দানিয়েলের আঙুল ঘোরে নীলার শরীরে। আঙুল শরীরের অলি গলি ঘুরে উরুর ফাঁকে যায়। নীলা যতই উরু যুক্ত করে, দানিয়েল তা বিযুক্ত করে দেয়।
এবার সে এক লাফে বিছানা থেকে নেমে গিয়ে চেয়ারে বসে।
দানিয়েল এ কী করছ তুমি?
কেন! তুমি কি চাও না? দানিয়েলের কণ্ঠে বিস্ময়।
কী চাই না?
সঙ্গম।
মানে?
আমি তো জানি তুমি চাও।
কী করে জানো?
দানিয়েল বলে, কেন, তুমি আমার হাত ধরে রাস্তায় হাঁটোনি?
তো?
তুমি আমাকে পছন্দ করো, তাই বুঝেছি।
নীলা অবাক চোখে বলে, পছন্দ করি বলেই তো হাতে হাত ধরে হেঁটেছি। আর সঙ্গম… এসব কী বলছ, মেয়েতে মেয়েতে আবার ওসব হয় না কি?
দানিয়েল ঠোঁট চেপে হাসে, হয় না তোমাকে কে বলেছে?
আমি কখনও শুনিনি!
নীলা কেবল শোনেনি যে তা নয়, তার নিজের কল্পনাকে যতদূর বিস্তৃত করা যায় করে সে কোনও আবছা ছবিও খুঁজে পায় না, যা দেখে অন্তত অনুমান করবে যে মেয়েদের মধ্যে কোনও যৌনসম্পর্ক হয় বা হতে পারে।
দানিয়েল বলে, অবাক সেও, আমি যে সমকামী তা তুমি বোঝোনি?
কী করে বুঝবে নীলা দানিয়েল সমকামী। সমকামীরা দেখতে কেমন হয়। মানুষের মতোই তো। দানিয়েল দেখতে আর যে কোনও মেয়ের মতোই।
কেন আমাকে দেখে বোঝোনি?
নাহ।
ধাঁধা কাটে না নীলার। চোখের সামনে ঘরটি পাক দিয়ে ঘুরতে থাকে, ঘরটি শূন্যে ভাসে, ঘরটি ওড়ে। বিছানায় ফিরে এলে, দানিয়েলের আগ্রাসী জিভ নীলাকে লেহন করে বাকি রাত। নীলা বাকরুদ্ধ শ্বাসরুদ্ধ পড়ে থাকে বিছানায়।
এক লজ্জায় শত লজ্জা ঢাকে নীলা।
প্যারিসে স্বপ্নের ঘোরে
নীলার বিশ্বাস হয় না এ জীবন সে যাপন করছে। যেন স্বপ্নের ভেতর ঘটে যাচ্ছে এক এক করে ঘটনাগুলো। স্বপ্ন ভাঙলেই সে দেখবে কলকাতায় সে তার নিজের ঘরে, সেই বিছানায়, জানালায় বসে ভোরের আলো খুঁটে খাচ্ছে দুটো চড়ুই, চড়ুই দুটোর সঙ্গে তার মনে মনে কথা হবে। সুশান্তর সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হবার পর নীলা নিদ্রাহীন রাত পার করত, আর দিনের বেলা ঝিমোত, কখনও আবার পুরো দিন জুড়ে ঘুমোত, অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে জেগে উঠত। একবার দেখল, কোনও এক জঙ্গলে হাঁটছে সে, আর তার দিকে দৌড়ে আসছে একটি সিংহ, দৌড়োচ্ছ সে, হঠাৎ পেছন ফিরে দেখে যে সিংহ নয়, একশো সাপ আসছে ধেয়ে, দৌড়াতে দৌড়োতে বিশাল এক সমুদ্রের মধ্যে পড়ে নীলা, একেবারে তলে গিয়ে দেখে সেই সিংহটি বসে আছে। নীলাকে কিছু বলল না, খেতে এল না। সিংহের পেছনে একটি গাছ, সেই গাছের ওপর একটি বাড়ি। বাড়িতে ঢুকে দেখে মলিনা ঘুমোচ্ছেন। মলিনার ঘরের বন্ধ জানালা খুলে দিতেই সামনে রোদে ফাটা চৌরঙ্গির ব্যস্ত রাস্তা। সেই রাস্তায় ত্রস্ত পায়ে নেমে দেখে রাস্তার ওপর একশো সাপ ফণা তুলে আছে। মুহূর্তে কোনও আর মানুষ নেই সে রাস্তায়। কেবল সাপ, আর একা নীলা। নীলা সে দিন ঘুম থেকে জেগে লক্ষ করে তার সারা গা ঘামে ভিজে গেছে, আর বুকের ভেতর ধুকপুক। জেগে ওঠার দু এক মুহূর্ত অব্দি ভয়ে সে নীল হয়েই ছিল। স্বপ্নটির কথা যখনই পরে তার মনে হয়েছে, বুক ধুকপুক করেছে।
রোববার সকালে ঘুম থেকে জেগে নীলা দেখে গায়ে কোনও জামা নেই, দানিয়েল দাঁত মাজছে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে। শুয়ে শুয়ে দানিয়েলের শরীরটি দেখে মনে হয় তার, রোদ্যাঁর জীবন্ত ভাস্কর্য। এরকম শরীর হাতের কাছে পেলে যে কোনও পুরুষই উতলা হবে। কিন্তু দানিয়েল কোনও পুরুষের হাতে তার শরীর কোনওদিন দেয়নি, দেবেও না। পুরুষের শরীর, ও বলে, বড় কুৎসিত, ওকে মোটেও উত্তেজিত করে না। নারীর শরীর করে। নীলার শরীর করে। দানিয়েলের শরীরের দিকে তাকিয়ে নীলার মনে হয় না এই শরীরটিকে সে কাছে পেতে চায়, চুমু খেতে চায়। দাঁত মেজে যখন ও দাঁতন রাখে বেসিনের কিনারে, নীলা দেখে মাজনটি গোলাপি রঙের। তার মাজনের রং।
দানিয়েল, তোমারও একই রঙের মাজন? গোলাপি?
আমার মাজন নেই। দানিয়েলের সরল উত্তর।
তবে কী দিয়ে দাঁত মাজো তুমি?
মাজি না।
এটি কার মাজন তবে?
এটি তোমার।
নীলা উঠে বসে।
তুমি আমার মাজন ব্যবহার করেছ?
দানিয়েল কলের তলে মাথা ঢুকিয়ে মুখ হাঁ করে, সেই হাঁয়ের ওপর জল পড়ে।
মুখের জল ফেলে বলে, হ্যাঁ, তোমার মাজন। অসম্ভব নির্লিপ্ত স্বরে।
তুমি অন্যের মাজন দিয়ে দাঁত মেজেছ? জেনেই মেজেছ? নাকি ভুল করে?
জেনে। দানিয়েলের কণ্ঠ শান্ত। যেন এ খুবই স্বাভাবিক এক ঘটনা। বরং তার অবাক লাগে, নীলা এ নিয়ে এত প্রশ্ন করছে কেন!
জানো, দানিয়েল, আমার জীবনে এই প্রথম দেখলাম, অন্যের দাঁতন কেউ ব্যবহার করে।
বলে নীলা আবার ঢুকে যায় লেপের তলে, গা মাথা ঢেকে।
দানিয়েল কফির জল বসায় চুলোয়।
দানিয়েল যখন কফি বানিয়ে, গায়ে একটি টিশার্ট চড়িয়ে, চেয়ারে বসে কফি খাচ্ছে, নীলা লেপের তল থেকে মুখ বের করে বলে, তুমি কি কোনওদিন দাঁত মাজো না?
দানিয়েলের আবারও শান্ত গলা, মাজি হঠাৎ হঠাৎ। ইচ্ছে হলে।
শেষ কবে মেজেছিলে?
মনে নেই।
নীলার একবার ইচ্ছে হয়, হাসে। আরেকবার ইচ্ছে করে লেপের তলে ঢুকে সে অনেকক্ষণ কাঁদে। নিজের জন্য কাঁদে। নীলার হাসাও হয় না, কাঁদাও হয় না। দানিয়েল বাইরে গেল, লিবারেশন পত্রিকা আর চারটে কোয়াসাঁ কিনে ফিরল। নীলা তখনও শুয়ে। কফি আর কোয়াসাঁ খেতে পত্রিকা পড়ছে যখন দানিয়েল, নীলা বলল, চা খাব।
খাও।
দাও।
কেন দেব, করে নাও।
উঠতে ইচ্ছে করছে না যে! নীলা আহ্লাদি ঠোঁট ফোলায়।
নীলার আহ্লাদ বোঝার ক্ষমতা দানিয়েলের নেই। নীলাকে উঠতে হয়, চা বানাতে হয়, চা পান করতে করতে ছোট জানালার বাইরে যেটুকু আকাশ, সেটুকু দেখতে হয় আর চা শেষ করে বাইরে বেরিয়ে দুটো মাজন কিনে আনতে হয়, একটি দানিয়েলের জন্য, একটি নিজের, আর পুরনোটিকে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে, নিজেরটি দিয়ে দাঁত মাজতে হয়, আর দানিয়েল যখন বলে, পোর্ত দ্য সিনেকোর্তে বড় বাজার বসে রোববারে, যাবে নাকি? সেটি শুনতে হয়, এবং বলতে হয়, সে যাবে।
দানিয়েল বলে, ও জায়গাটা তোমার ভাল লাগবে।
কেন?
ওখানে অনেক কালোলোক বাদামি লোক আছে।
সস্তা, দু নম্বর, পুরনো জিনিসপত্রের খোলা বাজারে এসে লক্ষ করে নীলা, নানা রঙের লোকদের এই ভিড় মোটেও তার ভাল লাগছে না বরং বিষম অস্বস্তি হচ্ছে। নীলার চোখের সামনে এক কালো ছেলে একটি ঘড়ির দোকান থেকে একটি ঘড়ি উঠিয়ে পকেটে ভরে নিয়ে সোজা চলে গেল হেঁটে। আরেকটি ছেলে একটি রোদচশমা নিয়ে চোখে পরে আয়নায় কেমন দেখাচ্ছে দেখে ওটি ফেরত না দিয়ে, দাম না দিয়ে দিব্যি চলে গেল।
দানিয়েল পুরনো কাপড়ের স্তূপ খুঁজে দুটো জামা কেনে আর নীলা অবাক তাকিয়ে এই বিচিত্র জগৎ দেখে। কালো চশমায় ঢাকা মুখের কিছু লোক, সেতুর তলায় দাঁড়িয়ে আছে, পায়ের কাছে কালো ব্যাগ তাদের, ব্যাগের ভেতর জিনিসপত্র, পুলিশ আসছে, এরকম একটি রব শুনে ব্যাগ গুটিয়ে মুহূর্তে সব সরে গেল সেতুর তল থেকে। নীলা জিজ্ঞেস করে দানিয়েলকে, এসব কী হচ্ছে ওখানে?
অবৈধ ব্যাবসা।
নীলা বুঝে পায় না এই চমৎকার সাজানো গোছানো সব ভালর শহরে অবৈধ ব্যবসা করে কেন লোকেরা। তার উৎসুক চোখ ভিড়ের দিকে যায়। ভিড় ঠেলে খেলা দেখানো লোকটির দিকে, কালো মাথার লোকটি ম্যাচবাক্সের মতো ছোট্ট দুটো বাক্সে ছোট্ট একটি বল নাড়ছে, খুব দ্রুত নাড়ছে, নাড়তে নাড়তে বাক্সে বলটি ঢেকে ফেলল, এবার বলতে হবে কোন বাক্সের নীচে বলটি। বাজি খেলা। একশো ফ্রাঁ হাতে দাও কালো মাথার, উত্তর সঠিক হলে একশো ফ্রাঁ সে দিয়ে দেবে, সঙ্গে আরও একশো ফ্রাঁ, দুশো। আর উত্তর বেঠিক হলে কালো মাথা সেই একশো ফ্রাঁ নিয়ে নেবে। দাঁড়িয়ে থাকতেই দুটো বাজি হয়ে গেল, দুজন পেল একশো ফ্রাঁ করে, একজন হারল। কালো বল যখন নড়ছে, নীলা স্পষ্ট দেখতে পেল বলটি কোন বাক্সের নীচে কালো মাথা ঢুকিয়েছে, নীলা চেঁচিয়ে ওঠে, ওই বাক্সে বল, আমি জানি। ঠিক আছে বাজি ধরো। দানিয়েল বলল, বাজি ধোরো না নীলা, হারবে।
হারব কেন, আমি দেখেছি কোথায় বল। জিতবই।
নীলা একশো ফ্রাঁ দিল কালো মাথাকে, লোকটি বাক্স ওঠাল, বাক্সের তলে কালো বল নেই। কালো বল অন্য বাক্সের তলে। আবার সে বাজি ধরল, আবার হারল। আবার ধরল, আবার হারল। দু মিনিটে চারশো ফ্রাঁ ফুরিয়ে নীলা যখন ভিড়ের বাইরে এল, দানিয়েল একটি দোকানের দেয়ালে হেলান দিয়ে সিগারেট খাচ্ছে।
বলল, হেরেছ, ঠিক না?
করুণ চোখে তাকাল নীলা।
আমি জানতাম।
কী করে?
কারণ এরা সব ভণ্ড। লোক ঠকানোর ব্যবসা করে এরা। অবৈধ ব্যবসা।
হঠাৎ বাজিখেলার ভিড় থেকে কিছু লোক চোখের নিমেষে হাওয়া হয়ে গেল। ভিড় ভেঙে ছড়িয়ে পড়ল।
দানিয়েল বলল, দেখো, পুলিশের ভয়ে কেমন পালিয়ে গেল।
তা ঠিক, পালিয়েছে। ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর মধ্যে কালো মাথার সঙ্গী ব্যবসায়ীরা ছিল, যখন কেউ জেতে, ওরা জেতে। যখন কেউ হেরে যায়, হারে নীলার মতো মানুষ, লোভী তো বটেই, বোকাও, যারা জানে না, প্রতারক তার জাল কী করে ছড়িয়ে বসে।
নীলা দেখে, বাদামি আর কালো রঙের লোকেরা লোক ঠকাচ্ছে, পুলিশের ভয়ে দৌড়াচ্ছে, দোকানের জিনিস চুরি করছে।
কোন দেশের লোক এরা? নীলা নাক কুঁচকোয়।
আফ্রিকার। এশিয়ার। দক্ষিণ আমেরিকার।
ভারতের কেউ আছে বলে আমার মনে হল না। নীলা বলে।
বেশির ভাগই মধ্যপ্রাচ্যের।
তাই হবে।
তাই হবে।
নীলা স্বস্তি পায়। স্বস্তি পায় বলে মনে করে, আসলে পায় না। নীলা জানে, বেশ ভাল করেই জানে যে ভারতে প্রতারকের অভাব নেই, রাস্তাঘাটে, আপিসে আদালতে, এমনকী সংসদেও বসে লোকেরা লোক ঠকাচ্ছে।
রোববার, প্যারিসের নানা ফুটপাত ভরে ওঠে বাজারে। মাছ মাংস থেকে শুরু করে কাপড় চোপড়, থাল বাসন, এমনকী খাট পালঙ্ক। চারশো ফ্রাঁ গচ্চা দেওয়ার পর, ও এলাকা যত শিগরি সম্ভব ত্যাগ করে দুজন।
মোঁপারনাসের এক গলিতে, দানিয়েলের ইচ্ছে, ছবি বিক্রি করতে লোক বসে প্রতি রোববার, দেখবে। রাস্তার দুপাশে ছোট ছোট তাঁবু ফেলে নিজের আঁকা ছবি নিয়ে বসে আছে তত বেশি না বিক্রি হওয়া চিত্রকরেরা। ছবি দেখতে দেখতে নীলা অতীতে ফেরে, সেও শখের ছবি আঁকত এককালে।
দানিয়েল নীলার উদাস চোখে তাকিয়ে সস্নেহে বলে, আবার রং তুলি হাতে নাও।
ধুৎ। খামোকা।
চেষ্টা তো করো। প্যারিসে কি শ্রমিকের জীবন কাটাতে এসেছ? এ ছবির শহর তোমাকে যদি শিল্পী না করে তবে পৃথিবীর আর কোন শহর করবে?
শিল্পী হবার কোনও গুণ আমার নেই দানিয়েল।
কী করে জানো যে নেই?
জানি।
কার যে গুণ আছে, কার যে নেই, নীলা। কার ভেতরে কোন সম্পদ লুকিয়ে আছে, তার আমরা কতটুকু জানি। ভ্যানগগের ছবি আজকাল কোটি ফ্রাঁয়ে বিক্রি হয়, বেঁচে থাকতে তার ছবি কেউ কেনেনি। অভাবে অসুখে লোকটা আত্মহত্যা করেছে।
মিউজি দর্সের দিকে হাঁটতে হাঁটতে দানিয়েল নিজের জীবনের কথা বলে। মন্ট্রিয়ালে সে আইন পড়তে শুরু করেছিল, ফেলে ঘোড়ার পেছনে দৌড়োল। ঘোড়া চালাত, আর অবসরে লোকদের ঘোড়া চালানো শেখাত। সেও একসময় আর ভাল লাগেনি। সব ছেড়ে, প্যারিস চলে এল, প্যারিসে এসে লেভাই কাপড়ের কারখানায় প্রথম চাকরি নিয়েছিল, তারপর লেভাই যখন এ দেশের শ্রমিকদের তত বেশি শোষণ করতে পারে না বলে চলে গেল গরিব দেশে গরিবদের শোষণ করতে, দানিয়েল ফুটপাতে পা ছড়িয়ে বসে প্যারিসের আশ্চর্য রূপ দেখত প্রতিদিন আর শহরে ঘুরে পুরনো বইয়ের দোকান থেকে সস্তায় বই কিনে মাঠে রোদের তলে শুয়ে শুয়ে পড়ত। বই পড়তে পড়তেই তার লেখার ইচ্ছে হয়। লিখতে লিখতেই এখন লেখা ছাপা হয়। আর ছাপা যেহেতু হয়, দানিয়েল একটি বইও লিখে ফেলেছে। বইটি তার বাবাকে নিয়ে। বাবা পিয়ের লরু। পাণ্ডুলিপি কিছু প্রকাশকের কাছে ডাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। একজন প্রকাশকের উত্তর এসেছে, লিখেছে এদিক ওদিক খানিকটা বদলালে বইটি ছাপা যায়।
মিউজে দর্সেতে পুরো দিন কাটিয়ে বাড়ি ফেরার পথে দানিয়েল টাকা ধার দেয়, নীলা ইজেল কেনে, রং তুলি কেনে। নীলা ওড়ে, হঠাৎই ওড়ে, প্যারিসে স্বপ্নের ঘোরে।
নীলা তখনও ঘোরে, আর তার নিখুঁত শরীর জুড়ে দানিয়েলের তৃষ্ণার্ত আঙুল আর জিভ খেলা করে। আঙুলগুলো শরীরের সব আনাচ কানাচ চেনে। কোথায় কোন ঠোঁট, সেই ঠোঁটের আড়ালে আরেক ঠোঁট, আর সেই ঠোঁটের গায়ে ভ্রমর ঘুমোয়, জাদুর ভ্রমর, ভ্রমর ছুঁলেই ফোয়ারায় জল ওঠে, সেই জলে ভেসে যায় সব। সব।
নীলা সাঁতার জানে না। তুখোড় সাঁতারু দানিয়েলকে আঁকড়ে ধরে সে উতল নদী পার হয়।
দানিয়েল পাড়ে উঠে নীলার কানে কানে বলে, আমার জাদুর ভ্রমরকে জাগিয়ে দাও।
নীলা জাগায় না, ভ্রমরে বড় ভয় নীলার। ঘেন্না নীলার।
নীলার খুব জানতে ইচ্ছে করে দানিয়েল কবে নিজেকে বুঝল যে সে সমকামী। দানিয়েল বলে যখন সে ইস্কুলে পড়ত, বারো বছর বয়স, ইস্কুলের এক মেয়েমাস্টারের প্রেমে পড়েছিল প্রথম। ক্লাসে বসে হাঁ করে মাস্টারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত।
তারপর?
জোসেলিনের স্বামী ছিল, তিনটে বাচ্চা ছিল। ইস্কুলের পর প্রতিদিনই দানিয়েল চলে যেত জোসেলিনের বাড়ি। পাঁচিল টপকে ভেতরে ঢুকত আর জানালা দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখত জোসেলিনকে।
তারপর?
একদিন জোসেলিন টের পেল জানালায় দুটো ব্যাকুল চোখ। সেদিন বাড়িতে সে ছাড়া আর কেউ ছিল না। দানিয়েলকে ভেতরে ডেকে আনে জোসেলিন। সারা গা তার কাঁপে যখন জোসেলিন তাকে স্পর্শ করে। সারা গা কাঁপে যখন জোসেলিন তাকে চুমু খায়। সারা গা কাঁপে যখন জোসেলিন তার গায়ের জামা খুলে দেয়, নিজেরটিও খোলে।
তারপর? তারপর কী ঘটেছে দানিয়েলের মনে নেই। কেবল মনে আছে অসম্ভব এক আনন্দে সে জোসেলিনের বিছানায় গড়াগড়ি খেয়েছে। হাত পা ছুঁড়েছে আনন্দে।
ইস্কুল ছাড়ার পর জোসেলিনের সঙ্গে সম্পর্কটিও যায়। চৌদ্দ বছর বয়সে দানিয়েল বাড়ি ছেড়ে এক কমিউনে থাকতে শুরু করে। কমিউনে ছিল পাঁচটি মেয়ে আর দুটি ছেলে। সম্মিলিত সংসার যাকে বলে। পাঁচটির মধ্যে দুটি মেয়ের সঙ্গে তার যৌনসম্পর্ক ছিল। কমিউনে থাকাকালীনই দানিয়েল সমকামীদের বারে যেত, মদ খেতে খেতে যার সঙ্গে চোখাচোখি হত, ইঙ্গিত হত, তার সঙ্গে চলে যেত তার বাড়িতে অথবা নিয়ে আসত তাকে কমিউনে। রাত শেষ, সম্পর্ক শেষ। সকালে আবার যে যার জীবনে। পরদিন দেখা হলে, এমনও হত যে সে মনে করতে পারত না যে গতরাতে এর সঙ্গে রাত কাটিয়েছে।
তারপর?
পিয়ের লরু মারা গেল। দুমাস পর ক্লারা, দানিয়েলের মা। বাপ মায়ের টাকা দু ভাই বোনে ভাগ হল, নিজের ভাগের টাকায় সে বাড়ি কিনল মন্ট্রিয়ালে। একা জীবন। পরিবারের কারও সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক থাকেনি। নিজের দাদা ফিলিপের সঙ্গেও না।
তারপর?
তারপর প্রেম হল গোটা চারেক। একসঙ্গে থাকাও হল, ছাড়াছাড়ি হল। আবার প্রেম হল, আবার থাকা হল। আবার ছাড়াছাড়ি। আর প্রেমিকার যখন অভাব, তখন বার থেকে রাতের সঙ্গী তুলে আনা। এভাবেই জীবন চলছিল দানিয়েলের। ব্যক্তিগত জীবন। আর বাইরের জীবনে ছিল ছোট চাকরি ছোট বেতন, কিন্তু অন্য উত্তেজনা, আন্দোলনের উত্তেজনা। সমকামীদের অধিকার আন্দোলনে নানা সভা সমিতি করে বেড়াত। মিছিলে গলা ফাটাত।
তারপর?
তারপর নিকল। ও কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিল মেয়েদের সামাজিক ইতিহাস সম্পর্কে বক্তৃতা করতে। কদিন ছিল। আর ও কদিনের মধ্যে দানিয়েলের সঙ্গে সখ্য, সঙ্গম সবই হয়। নিকল প্যারিসে চলে আসার পর দানিয়েলের মন পড়ে থাকে নিকলে। বুঝল এ কেবল যৌন সম্পর্ক নয়, এ প্রেম। সেই প্রেমেরই আকর্ষণে প্যারিস আসা। নিকলের বাড়িতেই ছিল পুরো চার বছর। চার বছরে প্রেমও গেছে, যৌনসম্পর্কও গেছে। কিন্তু বন্ধুত্ব রয়ে গেছে।
গুলোয়াজের কড়া ধোঁয়া ছড়িয়ে দানিয়েল আরেকটি সিগারেট ধরায়। বলে, তোমার কি কখনও এমন হয়েছে, স্মৃতি থেকে মুছে যাওয়া কোনও ঘটনা, ধরো কুড়ি বছর আগে ঘটে যাওয়া কোনও ঘটনা, আচমকা একদিন মনে পড়ে?
নীলা মাথা নাড়ে, এরকম হয়নি তার।
আমার যখন ছবছর বয়স, আমার বাবা আমাকে ধর্ষণ করেছিল। ঘটনাটি, এই আট বছর আগে, মন্ট্রিয়ালে, একা বসে আছি ঘরে, বরফের ঝড় হচ্ছে, দেখছি, আলটপকা মনে পড়ল।
নীলা চকিতে উঠে বসে। চোখের মণিতে, চোখের পাতায় অবিশ্বাস।
আসলেই ঘটেছিল না কি অন্য কারও গল্প শুনে তোমার মনে হয়েছে, এ তোমার নিজের জীবনে ঘটেছে। নীলা দানিয়েলের কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে।
আসলেই ঘটেছিল। আমার স্পষ্ট মনে পড়েছে, মা গেছে বাইরে কাজে, একা বাড়িতে আমি, কুকুরকে নিয়ে খেলছি, বাবা আমাকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর ধর্ষণ করল। আমার মুখের ভেতর তার পরনের শার্ট গুঁজে দিয়ে আমার চিৎকার বন্ধ করেছিল।
তোমার আপন বাবা?
আমার আপন বাবা।
প্যারিসে স্বপ্নের ঘোরে নীলা ঠিকই একদিন ছবি আঁকতে শুরু করল। তেলরঙে। এক দল মেয়ে সবুজ মাঠে নাচছে, আকাশ জুড়ে মেঘ। পশ্চিমে কালো মেঘ।
দানিয়েল ছবিটিকে বসে দাঁড়িয়ে শুয়ে ডানে হেলে বাঁয়ে হেলে দেখে বলল, বড় মাতিসের প্রভাব।
মোটেই না, মাতিস কাগজ কেটে সেঁটেছেন, আর এ আঁকা। আর এরা হাতে হাত ধরেও নাচছে না।
বড় মন খারাপ করা ব্যাপার আছে।
এ তো খুশির দিন। খুশিতে ময়ূরের মতো নাচছে মেয়েরা।
দানিয়েল ভুরু কোঁচকায়, তা হলে মেঘলা কেন? ঝকঝকে রোদ দাও। মেঘলা দিন তো মন খারাপ করা দিন।
ছবিটির দিকে নেশাগ্রস্তের মতো তাকিয়ে নীলা বলে যায়, মেঘ দেখলে ময়ূর যেমন আকাশে পেখম মেলে নাচে, মেয়েরা তেমন নাচছে। খরায় পোড়া শরীর তাদের। অনেকদিন পর আকাশে মেঘ জমেছে, বৃষ্টি হবে। মেয়েরা খুশিতে ছুটে এসেছে বন্ধ ঘরের বাইরে, বাইরের ঝিরঝিরে হাওয়ায়। বৃষ্টিতে ভিজবে, গা শীতল হবে এদের, গায়ের ধুলোকালি দূর হবে।
ছবি আঁকার নেশায় নীলা বাক্সবন্দির কাজে অনিয়ম করতে লাগল।
দানিয়েল ও চাকরি ছেড়ে, যে প্রকাশনী তাকে চিঠি লিখেছিল যে তার বই ছাপা যেতে পারে, সেখানেই একটি চাকরি জুটিয়ে নিয়েছে, বই পড়ার চাকরি। বই পড়ে মন্তব্য করার।
অভাবের মুখে নীলা একদিন সুটকেসে তার অলংকার খুঁজল, ইচ্ছে, বিক্রি করে দেবে। অলংকার নেই, কিষানলালের বাড়ি থেকে সব এনেছে, অলংকার আনতেই কেবল ভুলেছে।
দানিয়েল বলেছে শুনে, এত উদাসীন হলে চলে না নীলা। টাকা পয়সা, আমি দেখেছি, হাতে থাকলে বেহিসেবি খরচা করো। তারপর ফুরিয়ে গেলে অন্যের কাঁধে চড়ো।
তোমার কাঁধ থেকে নামাতে চাইছ আমাকে? দাও নামিয়ে?
আমি চাইছি না। যে চাকরি আছে, তাই করতে থাকো আপাতত।
এসব ছোট চাকরি আমার ভাল লাগে না।
কার ভাল লাগে! কিন্তু থাকা খাওয়ার খরচা আছে না! সে তো জোগাতেই হবে। ছোট চাকরি ভাল লাগে না, তো বড় চাকরি খোঁজো, খুঁজতে তো হবে।
নীলা এক সকালে বড় চাকরি এবং ভাল চাকরি খুঁজতে বেরোল, চাকরি খোঁজা বলতে পত্রিকা কিনে বিজ্ঞাপন দেখো, দু একটা ফোন নম্বর টোকো। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে পত্রিকা কেনা হয় নীলার, বিজ্ঞাপন দেখা হয় না, ফোন নম্বরও টোকা হয় না। সে হারিয়ে যায় বিশাল এক স্রোতে। একটি আনন্দস্রোত যাচ্ছে প্যারিসের রাস্তায়। লাল নীল বেলুন উড়ছে। আর সেই স্রোত নীলাকে নিতে নিতে জনদার্ক অব্দি নেয়। নীলা কলকাতায় অনেক মিছিল দেখেছে, এমন চমৎকার কোনও মিছিল দেখেনি। অভিভূত মুগ্ধ মোহিত নীলা আর সবার মতো জনদার্কের মূর্তির সামনে মাথা নোয়ায়, পায়ে ফুল দেয়।
বাড়ি ফিরে যখন সে দানিয়েলকে তার এই চমৎকার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করে, দানিয়েল চমকে তাকায়, সব্বনাশ করেছ।
সব্বনাশের কী হল?
বেঁচে যে ফিরেছ এই বেশি।
নীলা বোকা বনে যায়। তাকে আরও বোকা করে দিয়ে দানিয়েল বলে, এরা বর্ণবাদী লিপেনের দল। এরা এ দেশ থেকে যত অসাদা আছে, এদের তাড়াতে চায়। জনদার্ক হচ্ছে এদের দেবী। আর তুমি কিনা এই চরম ডানপন্থীর সঙ্গে মিছিল করেছ?
মিছিলে লোকদের পাশাপাশি হেঁটেছে নীলা। কই তাকে তো কেউ কিছু আঘাত করেনি, কিছু বলেনি।
পাশাপাশি হেঁটে নীলা জনদার্কে ফুল দিয়েছে, ওদের কেউ তো বিষচোখে নীলার দিকে তাকায়নি।
ফরাসি গৌরব, ফরাসি সংস্কৃতি রক্ষা করতে লিপেন রাজনীতিতে নেমেছে। ফরাসি ছাড়া, সাদা ছাড়া অন্য কোনও জাতি, অন্য কোনও রং এ দেশে আসুক বা থাকুক লিপেন চায় না। লিপেনের ভয়, কালোয় ছেয়ে যাবে এ দেশ, সাদার হাত থেকে সাদার দেশ চলে যাবে কালোর হাতে, সাদাদের বংশবৃদ্ধি হচ্ছে না, সাদা মেয়েরা বিয়ে না করার, সন্তান জন্ম না দেবার স্বাধীনতা পেয়ে গেছে, কিন্তু ওদিকে কালো মেয়েরা বছর বছর জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। কালোরা গ্রাস করে ফেলবে এ দেশ, সাদা সংস্কৃতি বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। সাদা ফুরোতে ফুরোতে একসময় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তাই এ দেশ থেকে যত অসাদা আছে সময় থাকতে তাড়িয়ে দেশটির পুরনো গৌরব ফিরিয়ে আনতে হবে, সার দিয়ে সাদার উৎপাদন বাড়াতে হবে, উঁচু জাতের মানুষ তৈরি করতে হবে। লিপেনের আবেগকে নীলা যুক্তি দিয়ে দেখে। আজ যদি, নীলা ভাবে, ভারত ভরে যেত আফ্রিকার জঙ্গল থেকে আসা লোকে, লুটপাট চালাত, ভারতীয়দের সব সুবিধেয় ভাগ বসাত, ভারতীয়দের করের টাকায় বসে খেত, আর নিজেদের অসভ্যতায় সংক্রামিত করতে শুরু করত সমাজ, তবে নীলা বেশ জানে, ভারতেও এমন বিদেশি তাড়াও আন্দোলন হত। যেভাবে ইংরেজ তাড়াতে হয়েছে, দেশের স্বার্থে, সংস্কৃতির স্বার্থে এদেরও তাড়াতে হত। হত না কি? হত। ঔপনিবেশিক শক্তি ছাড়াও তো অন্য কোনও শক্তি হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। পারে না কি? নিশ্চয়ই পারে।
দানিয়েল বলে, হিটলারের জন্যও সম্ভবত তোমার এক ধরনের মমতা আছে।
আছে, নীলা হেসে বলে, তার কাকা সিদ্ধার্থর আছে, কেবল সিদ্ধার্থ নয়, ভারতের অনেক লোকেরই আছে। তারা বলে, অমন মহাশক্তিমান কারও শৌর্যে বীর্যে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না।
দানিয়েল দম বন্ধ করে শোনে নীলার যুক্তি।
আবার নীলার বাবার যুক্তি অন্য, অনির্বাণ বিশ্বাস করেন শত্রুর শত্রু হল বন্ধু। হিটলার সুভাষ বসুকে সমর্থন জুগিয়েছেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করতে। সুভাষ বসু বাঙালির গর্ব, কেবল বাঙালির নয়, পুরো ভারতবর্ষের গর্ব, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যে মানুষ প্রাণপণ লড়েছেন। যে মানুষ কোনও আপসের মধ্যে ছিলেন না। গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে যাঁর বিশ্বাস ছিল না, যিনি শত্রুর বন্দুকের সামনে খালি হাতে দাঁড়াতে রাজি হননি। গুলির বিনিময়ে গুলি। তাই তো হয়। তা না হলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মিত্রশক্তি তো গান্ধীর আদর্শ মানত। তারা তো গুলির বিনিময়ে গুলিই করেছে। পশ্চিমের এই গান্ধীপ্রীতি অনির্বাণকে হাসায়। গান্ধী কিন্তু তাঁর কাহাকেও মারিব না, কেবল মার খাইব নীতি দিয়ে ইংরেজ তাড়াননি, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ইংরেজের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙেছিল বলেই ভারতের পাট গুটিয়ে নিয়েছিল।
দানিয়েল জিভে কামড় দেয়। হিটলারের সঙ্গে যে লোক বন্ধুত্ব করেছে, তাকে নিয়ে বাঙালির গৌরব?
নীলা হেসে বলে, গুন্টার গ্রাসও এভাবে জিভ কেটেছিলেন লজ্জায়। কলকাতায় সুভাষ বসুর মূর্তিতে মানুষের ফুল দেওয়া দেখে।
ওরই মধ্যে এক মন উদাস করা বিকেলে নীলা বেরিয়ে পড়ে, এলোমেলো হেঁটে বেড়িয়ে পের লাসেজের দক্ষিণ দরজার উলটোদিকে ছত্রিশ নম্বর বাড়িতে ঢোকে, ক্যাথারিনের বাড়ি। ক্যাথারিনের সঙ্গে চা খেতে খেতে বাউলের গল্প করবে, আর ও চাপাচাপি করলে দুটো বাউলসংগীতও ওকে শুনিয়ে দেবে, এরকম ইচ্ছে।
দরজায় কড়া নাড়লে ক্যাথারিন বেরিয়ে আসে। নীলাকে দেখে চমকে ওঠে, তুমি?
অপ্রস্তুত হেসে নীলা বলে, একা লাগছিল খুব। ভাবলাম তোমার বাড়ি বেড়াতে যাই।
ক্যাথারিন দরজা ধরে দাঁড়িয়ে, অবাক, বলে, কিন্তু তোমার তো আসার কথা ছিল না।
না ছিল না।
কোনও জরুরি দরকার আছে আমার কাছে?
না তা নেই।
তবে?
নীলা লজ্জায় চোখ নামিয়ে বলে, আসলে পের লাসেজের কবরগুলো দেখার ইচ্ছে ছিল তো…।
ও তাই বুঝি, ক্যাথারিন শুকনো মুখে বলে, তা কবরখানা তো একেবারে কাছে। নেমে হাতের বাঁদিকে সোজা চলে যাবে। তারপর একটু ডানে ঘুরতেই দেখবে বড় দরজা।
শুনে, যত দ্রুত সম্ভব হয় নীলা সরে যায় ক্যাথারিনের দরজা আগলে দাঁড়িয়ে থাকা থেকে, ওর শুকনো মুখ থেকে, ওর কপালে ওঠা দুচোখ থেকে। নীলা যেতে যেতে পেছনে শোনে দরজা বন্ধ হবার খটাস শব্দ। নীলার জীবনে এরকম ঘটনা কখনও ঘটেনি। কলকাতায় বিকেলবেলা সে বন্ধুদের বাড়ি বেড়াতে চলে যেত, কোনও জরুরি কাজে নয়, আগে থেকে বলে রাখা নয়, এমনি। নীলার বাড়িতেও যে কেউ ওভাবেই আসে। অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথির মুখোমুখি নীলাকে হতে হয়েছে, তার পরও তো ঘরে এনে বসিয়েছে, চা বিস্কুট দিয়েছে, খেতে খেতে গল্প করেছে। শত্রুও যদি বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ে, তাকেও ফেরাতে হয় না, এরকমই নিয়ম বলে জানে নীলা। মলিনা প্রবাদ আওড়ান প্রায়ই, শত্রুকে সবসময় বড় পিড়িটা দিতে হয় বসতে।
বড় বড় পায়ে সিঁড়ি নেমে যায় নীলা, পেছনের খটাস শব্দ পেছনেই পড়ে থাকে না, এটি নীলার সঙ্গে সঙ্গে যায়। গার দ্য অস্তারলিজ অব্দি যায়।
পরদিন নীলাকে অবাক করে ক্যাথারিন সেই বাক্সবন্দির কারখানায় আকৰ্ণবিস্তৃত হাসি উপহার দিয়ে জিজ্ঞেস করে, পের ল্যাসেজেয় গিয়েছিলে?
নীলা বলে, গিয়েছিল।
কার কার কবর দেখলে, টিম মরিসনের কবর দেখলে তো? অস্কার ওয়াইল্ডের? বালজাক, শঁপা, এডিথ পিয়াফ, খুব মলিন একটি কবর পল এলুয়ারের, দেখেছ?
সেই পল এলুয়ার যে লিখেছিল, ইল প্ল দ মা কর, কম ইল প্ল দ্য লা ভিল?
সেই পল এলুয়ার যে লিখেছিল জা ক্রি ত নম, লিবার্তে।
ক্যাথারিনকে দেখে একেবারে মনে হয় না, সে আদৌ মনে করছে গতকাল তার ব্যবহার মোটে অসুন্দর ছিল। ও নিয়ে একটি শব্দ সে উচ্চারণ করল না, বলল না, অন্তত এরকম যে কাল আমার ব্যস্ততা ছিল, বা আমার কোথাও যাবার ছিল। যেন ব্যাপারটিই খুব স্বাভাবিক যে, আমার বাড়ি যাবার তোমার কথা ছিল না, তুমি যাবে কেন, আমি যেদিন বলব, সেদিন যাবে।
ক্যাথারিনের অশালীন ব্যবহারে ক্যাথারিনের লজ্জা হয় না, লজ্জা হয় নীলার।
লজ্জায় নীলা ক্যাথারিনের চোখের দিকে তাকায় না। লজ্জায় সে বলে না, তোমার ব্যবহারে কাল আমি খুব কষ্ট পেয়েছি, পের লাসেজ দেখার কোনও ইচ্ছে আমার ছিল না, ও আমি আগেই দেখেছি, বরং হেসে, যেন গতকাল বলে কোনও কাল আসলে আসেনি, যেন ক্যাথারিনের বাড়ির দরজায় নীলা আচমকা উপস্থিত হয়নি, ক্যাথারিন তাকে তাড়িয়ে দেয়নি, দুজনের শেষ স্মৃতি কিষানলালের বাড়িতে যে আমোদটুকু হয়েছিল ওটুকুই।
বোদেলেয়ারের কবরটা কোথায়, পের লাসেজে? কিছুই ঘটেনি স্বরে নীলা বলে।
সে দেখতে তোমাকে যেতে হবে মোপারনাস কবরখানায়। কিছুই ঘটেনি স্বর ক্যাথারিনেরও।
ও আচ্ছা, ধন্যবাদ। নীলা মনে করে ধন্যবাদ বলে।
নীলা ধন্যবাদ বলে না, ব্যবহার জানে না, কথা বললে নীলা অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে, দেয়াল বা চেয়ার টেবিলের দিকে, যে বলছে তার মুখের দিকে বা চোখের দিকে তাকায় না। নীলা মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করে। এসব কথা কারখানার লোকের মুখে মুখে কানে কানে ঘোরে, নীলা টের পায়।
নীলা ধন্যবাদ বললে ক্যাথারিনের মুখে চমৎকার একটি হাসি ফোটে। এরকম হাসি ফুটেছিল প্রথম যেদিন ক্যাথারিন তাকে বিস্ত্রো রোমায় নিয়ে গিয়েছিল খেতে। দুজন মুখোমুখি বসে এন্ত্রোকত খেল, পান করার জন্য লাল ওয়াইন থাকতে হয়, ছিল। খাওয়া শেষ হলে রেস্তোরাঁর লোক লাদেসিঁয়ো রেখে গেল, একশো বিরানব্বই ফ্রাঁ। ক্যাথারিন পঁচানব্বই ফ্রাঁ টেবিলে রেখে বলেছিল, আমার ভাগেরটা, এন্ত্রোকত আর কফি।
ঠিক বুঝিনি, তোমার ভাগেরটা মানে?
আমি তো তাই খেলাম। তোমার দিতে হবে সাতানব্বই, এন্ত্রোকত আর চা।
ক্যাথারিনের পঁচানব্বই ক্যাথারিনের দিকে ঠেলে দিয়ে দুশো ফ্রাঁর একটি নোট বের করে রেস্তোরাঁর লোকের হাতে দিয়ে নীলা বলেছিল, দুটোর দাম রাখুন।
ক্যাথারিনের ভুরুতে সংশয় কাঁপে, কী ব্যাপার দুটোর দাম দিচ্ছ যে!
ওর ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে নীলার নিজেকে এক দাগি আসামির মতো মনে হল, যেন গুরুতর এক অন্যায় কাজ সে করতে যাচ্ছে, আর এ কাজের পেছনে তার বদ উদ্দেশ্য আছে।
নীলাকে বুঝিয়ে বলতে হল, আমাদের দেশে আমরা এরকম ভাগ করে দাম দিই না, খেতে গেলে যে কোনও একজন মেটায় দাম। মানে, হয় আমি দেব, নয় তুমি দেবে।
ক্যাথারিনের ভুরুতে সংশয় তখনও লেগে আছে দেখে নীলা ওর কাঁধে হাত রেখে হেসে বলেছিল, চলো উঠি।
তুমি যে দাম দিলে, তোমাকে আমি বিনিময়ে কী দিতে পারি? ক্যাথারিন কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেছিল।
আমাকে কিছু দিতে হবে না। দিতে হবে কেন! তুমি এমন বিনিময়ের কথা ভাবো কেন বলো দেখি!
ক্যাথারিনের ভুরু থেকে সংশয় নামে, মুখে হাসি ফোটে, চমৎকার হাসি। ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।
নীলার মনে হয়েছিল, বিনিময়ের দায়িত্ব কাঁধ থেকে নেমেছে বলেই সম্ভবত ক্যাথারিনের সারা মুখে প্রশান্তি ছড়াল।
ওরকমই চমৎকার একটি হাসি এখন ক্যাথারিনের ঠোঁটে।
নীলা এত চমৎকার হাসতে জানে না। হাসলে ওর ভাঙা দাঁতটি বেরিয়ে আসে, ছোটবেলায় কলতলায় পড়ে ভাঙা।
লা ফামেলিয়া
কিষানের কাছ থেকে ঠিকানা পাওয়া যায়নি বাক্সবন্দির কারখানার, মোজাম্মেলের কাছে ধরনা দিয়ে ঠিকানা জোগাড় করে দুদিন ফোন করে একদিন নিজে কারখানায় এসেও নীলার সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি সুনীলের। অতঃপর এই ডাকের চিঠি, তোমার মা খুব অসুস্থ, কলকাতা চলে যাও যত শীঘ্র পারো।
সুনীলের এই পরামর্শে নীলা হেসে ওঠে। নীলা হাসে কারণ তার কিছুতে মনে হয় না মলিনার অসুখ করেছে, যদি করেই থাকে, সে সর্দিজ্বর, আর সুনীল পরামর্শ দিচ্ছে নীলাকে কলকাতা যাওয়ার এ মলিনার কোনও অসুখের কারণে নয়, নীলার স্পর্ধার কারণে যে স্পর্ধায় সে কিষানের বাড়ি ত্যাগ করেছে, সুনীলকে যে কারণে বেকায়দায় পড়তে হয়েছে, যেহেতু কিষান সুনীলকেই দোষ দিচ্ছে নীলার এই ধৃষ্টতার জন্য, আর প্যারিসের ভারতীয় মহলে নীলা যেহেতু মুখরোচক আড্ডার একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিষানের বউ পালিয়েছে রে, পালিয়েছে! আর সুনীলের যেহেতু ইচ্ছে হয় না এসব শুনতে, স্বামীর সংসার করতে নীলা প্যারিসে এসেছে, তার যদি স্বামীর বাড়ি ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে, সে বাপের বাড়ি চলে যাক, যা নিয়ম।
নীলা প্রথম দানিয়েলকে খবরটি দেয়।
শুনে দানিয়েল বলে, পরিষ্কার ষড়যন্ত্র। দেখো গিয়ে কিষান জড়িত আছে এর মধ্যে। আর, তোমার মার যদি অসুখ হয়েই থাকে তো তুমি গিয়ে অসুখ সারাবে নাকি? তোমাদের দেশে কি ডাক্তার নেই?
তাই তো! নীলা বলে।
তাই তো। দানিয়েলও।
তারপর দুজন এক বোতল সাদা ওয়াইন শেষ করে। সাদা ওয়াইন, কারণ দানিয়েল এক থালা শামুক আর এক বাটি ঝিনুক শেষ করেছে। ওর রাতের খাবার। ওসবের সঙ্গে লাল ওয়াইন যায় না, যায় সাদা।
নীলার শামুক ঝিনুক পোষায় না। ভেতো বাঙালি ভাত খেয়েছে। সবজি খেয়ে তার অভ্যেস হয়েছে। মাছ মাংস না হলেও আজকাল চলে তার।
শুতে যাবার আগে দানিয়েল দুটো সুখবর দেয়, প্রথম–রিতা সিকসুস একটি ছবি বানাচ্ছে প্যারিসে বিদেশি মেয়েদের অবস্থা নিয়ে। এতে নীলার একটি সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে। পাঁচশো ফ্রাঁও দেবে।
দ্বিতীয়–দানিয়েল তার তিনজন বন্ধুকে বলেছে নীলার জন্য ভাল একটি চাকরি খোঁজ করতে।
দানিয়েলকে জড়িয়ে ধরে নীলা নাচে।
এই তো নাচলে!
পেটে কিছু পড়লে নাচা যায়। হাত পা ছুঁড়ে ডিসকোটেকের নাচ নাচা যায়। ভরতনাট্যম নয়।
দেখলে তো, যোগাযোগ থাকলে কী হয়! সেদিন নিকলের বাড়িতে যাওয়ার উপকারটা পেলে তো!
নীলা অস্বীকার করতে পারে না।
রাতে তার ভাল ঘুম হয় না। সারারাত উঠে উঠে পেচ্ছাপ করে, রাতের পেচ্ছাপ জমা করতে হয় ঘরের বালতিতে, সকালে ভরা বালতি করিডরের কোণে বারোয়ারি পেচ্ছাপখানায় ঢেলে দিতে হয়। এ কাজটি নীলা নাক চোখ মুখ বন্ধ কোরে করে, করতে হয়। দানিয়েলই করত প্রথম প্রথম। কিন্তু একসময় অতিষ্ঠ হয়ে আদরের দুলালিকে বলল, এই মেয়ে, তুমি কি আমাকে তোমার চাকর পেয়েছ? না, নীলা দানিয়েলকে চাকর পায়নি মোটে, চাকর যে পায়নি তা প্রমাণ করতেই সপ্তাহে তিনদিনের জায়গায় পাঁচদিনই বালতি পরিষ্কার করে সে।
সকালবেলা ছতলার করিডরের কোণে তয়লেতে যাবার লাইন লাগে, নীলা লাইন ভেঙে তয়লেতে ঢুকতে চেয়েছে কদিন, দানিয়েল বলেছে, এই মেয়ে, যে আগে সে আগে। যে আগে সে আগে, কনুই ঠেলে লাইন ভেঙে গা গলিয়ে আগে যাওয়ার বদঅভ্যেস নীলাকে ত্যাগ করতে হয়েছে। রোববার সকালে বুলানজেরিতে লাইন, বাসে উঠতে লাইন, নামতে লাইন, মেট্রোয় টিকিট কেনার লাইন, যেদিকে যায় সেদিকে লাইন, লাইনের শহর এটি, নীলার চোখ মুখ নাক বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে লাইন রক্ষা করতে হয়। যে আগে সে আগে, যে পেছনে, সে পেছনে। নীলা বরাবরই পেছনে। সবার পিছে, সবার নীচে, সবহারাদের মাঝে।
ভোরের আলো ফুটতেই নীলা তৈরি হয়।
দানিয়েল জিজ্ঞেস করে, এত সকালে নীলা যাচ্ছে কোথায়। এত সকালে নীলা ভোরের হাওয়ায় হেঁটে বেড়াবে, ক্যাফেতে ঢুকে চা আর কোয়াসাঁ খাবে, এত সকালে নীলা সকাল দেখবে শহরের।
কুয়াশায় ঢাকা রাস্তায় নীলা একা হাঁটে। দুতিনটে মাতাল রাস্তায় কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছ। মাথার কাছে খালি মদের বোতল। দুতিনটে লোক কুকুর নিয়ে বেরিয়েছে, কুকুরের হাওয়া খাওয়া আর প্রাতঃক্রিয়া দুটোই সারতে। কুকুরমূত্রে পথচারীর কোনও অসুবিধে হয় না, হয় মলে। শহরের ফুটপাতে কুকুরের মলের পাহাড় গড়ে উঠত, যদি না মল তোলার সরকারি এক সবুজ বাহিনী থাকত। সবুজ বাহিনীর চাকরিই হচ্ছে মটরসাইকেলে ঘুরে ঘুরে শহরের যত জায়গায় যত কুকুরনির্যাস আছে, তুলে সাইকেলের পেছনে বড় সবুজ বাক্সে ভরে শহরের বাইরে চলে যাওয়া।
অত সকালেই রাস্তার ধারে এক সাদা ভিখিরি বসে গেছে, হাতে বড় একটি কাগজ ধরে রেখেছে, আমরা ক্ষুধার্ত। লোকটির পাশে বসে আছে লোকটির চেয়ে দ্বিগুণ বড় একটি কুকুর। দানিয়েল এ দৃশ্য দেখলে, নীলা জানে, কুকুরটির জন্য আহা আহা করবে, লোকটির সামনে রাখা টুপির ওপর দশ ফ্রাঁ রেখে তবে যাবে। কেবল দানিয়েলই নয়, এই ভিখিরি লোকটিকে যে লোকই পয়সা দেবে, দেবে কুকুরটির প্রতি মায়ায়। লোকের প্রতি নয়। নীলা মেট্রো ইশটিশনের ভেতরে দেখেছে, মেক্সিকান ছেলেরা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আদি মেক্সিকান সংগীত বাজায়, অদ্ভুত এক ধরনের বাঁশি ওদের মূল বাদ্যযন্ত্র, সামনে টুপি থাকে, গিটারের খোল পড়ে থাকে, লোক যেন পয়সা ফেলে ওতে, লোকে ভিড় করে দাঁড়িয়ে শোনে, শুনে বেশির ভাগই চলে যায়, পয়সা ফেলে না। মেট্রোয় বাজনা বাজিয়ে ভিক্ষে করা অবশ্য বেশ পুরনো ব্যাপার, কেউ কেউ জগৎবিখ্যাত সংগীতশিল্পী হয়েছে, জীবন শুরু করেছিল প্যারিসের মেট্রোয়। নীলার ধারণা, মেক্সিকান ছেলেরা যদি সংগীতে না যেয়ে কুকুরের খেলা দেখাত, ভাল পয়সা পেত। আমি ক্ষুধার্ত লেখা কাগজ নিয়ে আর হাতে একটি জলের গেলাস নিয়ে আজকাল অনেক মেয়েরাও বসে মেট্রোতে। সাদা মেয়ে। দানিয়েল বলেছে এরা কসোভা থেকে আসা, পূর্ব ইয়োরাপের গরিব দেশ থেকে আসা।
পূর্ব ইয়োরোপের গরিব দেশ থেকে লোকেরা এখন ভিক্ষে করতে আসছে এখানে? কমুনিজম ভেঙে তা হলে ওদের লাভটা হয়েছে কী, যদি ভিক্ষেই করতে হয়!
দানিয়েল বলেছে, কম্যুনিজম থাকাকালীন ওদের কোনও স্বাধীনতা ছিল না।
কী স্বাধীনতা ছিল না?
স্বাধীনতা ছিল না দেশের বাইরে যাবার।
নীলা প্রশ্ন করছে, হেসে, দেশের বাইরে গিয়ে ভিক্ষে করার?
কেবল তো ভিক্ষেই নয়, ওসব দেশের শিক্ষিত মেয়েরা, যারা একসময় ইস্কুলের মাস্টার ছিল, অথবা বড় কোম্পানিতে বড় পদে চাকরি করত, কমিউনিজম ঝরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে, ইস্কুল বন্ধ হল, কোম্পানির দরজায় তালা পড়ল, কাজ কর্ম চাকরি বাকরিও ঝরে পড়ল, ঝাঁকে ঝাঁকে পতিতা হতে পশ্চিমে ধাইছে। এ নিয়ে দানিয়েল কোনও মন্তব্য করতে চায়নি।
পৃথিবীর সব দেশ থেকে লেনিন স্তালিনের মূর্তি উপড়ে ফেললেও, শহরের নাম বা রাস্তার নাম থেকে লেনিন স্তালিন দূর করলেও এই প্যারিসে কেন একটি জায়গার নাম এখনও স্তালিনগ্রাদ, তা জিজ্ঞেস করলেও দানিয়েল উত্তর দেয়নি, বিরক্ত হয়েছে।
নীলা হেঁটে হেঁটে ল্যুভর জাদুঘরের পেছনে যায়, পেছনে রু দ্য রিভলি, পেছনে সুনীলের বাড়ি।
সুনীল নীলাকে দেখে অবাক, এই সকালে তুমি কোত্থেকে? কোথায় থাকো! কী করো! চিঠি পেয়েছ! একটা খবর দেবে না! এদিকে কী রকম দুশ্চিন্তায় আছি, সে জানো?
একসঙ্গে অনেক প্রশ্ন। নীলা একটিরও উত্তর দেয় না। জিজ্ঞেস করে, কী অসুখ হয়েছে মার?
সে জানি না। নারায়ণ, যে শ্যানেল পৌঁছে দিয়েছিল তোমাদের বাড়িতে, কলকাতা থেকে ফিরে এসেছে, সেই বলেছে যে মাসিমার অসুখ নিখিল ফোন করেছিল দুদিন, বলেছে তোমাকে কলকাতা যেতে। পারো তো আজই।
এ কথা সে কথার পর নীলা আসল কথা পাড়ে। সোনার অলংকার।
কিষানের সঙ্গে অনেকদিন যোগাযোগ নেই সুনীলের। শেষ কথা হয়েছে ফোনে, সুনীল ফোন করেছিল, নীলার কোনও খবর পেয়েছে কি না জানতে, কিষান বলেছে আমার কাছে জিজ্ঞেস করো কেন, নীলার খবর তুমিই তো ভাল জানো।
আমি জানব কী করে? সুনীল অবাক।
আমার বউকে ভাগিয়ে নিয়ে গেছ, তুমি জানবে না তো কে জানবে। এই হল কিষানের উত্তর।
কিষান বিশ্বাস করে, সুনীলের আশকারা পেয়ে নীলার এমন বাড় বেড়েছিল। কিষানের বিশ্বাস সুনীলের সঙ্গে শলা পরামর্শ করেই নীলা বাড়ি ছেড়েছে।
ওই বেশ্যার নাম আমার সামনে আর নেবে না। বলে কিষান ফোন রেখে দিয়েছে।
এরপর সুনীল আর কিষানের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। কিষানের তো প্রশ্ন ওঠে না।
সুতরাং অলংকারের কথা জিজ্ঞেস করা সুনীলের নিজের পক্ষে সম্ভব হবে না, তবে কিষাণের বন্ধুদের সে জানাতে পারে। সুনীলের ধারণা, কিষান সে অলংকার ফেরত দেবে না।
নীলারও ইচ্ছে করে সব দুর্ঘটনার জন্য সুনীলকে দায়ী করতে। দায়ী করে কিষানলালের সঙ্গে তার বিয়ে ঘটানোর জন্য। কিন্তু নীলা আবারও ভাবে, আজ যদি কিষানলাল না হয়ে অন্য এক ভারতীয় হত তার স্বামী, খুব একটা পার্থক্য হত কি! হত না, সে ওই বসে থেকেই দেখছে, চৈতালি সকালের খাবার তৈরি করে টেবিলে রাখছে, সুনীল খেতে বসছে। সুনীল ক্লিনিকে চলে গেলে টুম্পাকে ইস্কুলে ওই চৈতালিই দিয়ে আসবে, তারপর যাবে নিজের আপিসে। আপিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে টুম্পাকে ইস্কুল থেকে নেবে। বাচ্চাকে স্নান করানো, খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো সব চৈতালিই করবে। ঘরদোর ঝাড়মোছ চৈতালিই করবে, রাতের রান্না, চৈতালিই। সংসারে সময় বেশি দিতে হয় বলে, চৈতালি চাকরি নিয়েছে কম সময়ের, আট ঘণ্টার জায়গায় চার ঘণ্টার।
দানিয়েলের সঙ্গে নীলার যে সংসার, এতে কোনও বৈষম্যের ব্যাপার নেই। নীলা রান্না করল তো দানিয়েল বাসন ধুল। নীলা বাজার করল তো দানিয়েল রান্না করল। সে এ মাসে বাড়ি ভাড়া দিল তো পরের মাসে দানিয়েল দিল। নীলার হাতে টাকা নেই তো দানিয়েল সংসার চালাচ্ছে, হাতে টাকা এলে সে তা শোধ করে দেবে।
নীলা চা খেল কেবল। চা খেয়ে বলল উঠি।
উঠি মানে? কোথায় যাবে?
কাজে। তারপর কাজ থেকে বাড়ি।
বাড়িটা কোথায় শুনি।
এক বান্ধবীর বাড়ি।
বান্ধবীর বাড়িতে কদিন থাকবে?
যতদিন ইচ্ছে।
এভাবে হয় না, বুঝলে নীলা। একটা কিছু সিদ্ধান্ত নাও।
কী সিদ্ধান্ত?
হয় কিষানের কাছে ফেরো, নয় কলকাতা ফেরো।
নীলা এরকমই একটা উত্তর মনে মনে জানত, যে সুনীল দেবে।
সুনীল নাগাড়ে বলে গেল, নীলা যা ইচ্ছে তাই করছে। এভাবে যা ইচ্ছে তাই করে জীবন চলে না। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এরকম মনোমালিন্য হয়ই। সময়ে সব ঠিক হয়ে যায়। কিষান এখনও নীলার জন্য অপেক্ষা করছে, সুনীলের তাই মনে হয়। আর যদি চেষ্টা করে ব্যর্থ হতে হয়, দেখা যায়, সম্পর্ক কিছুতে টিকবে না, তবে কিষানের সঙ্গে সরাসরি কথা বলুক নীলা, পাকাপাকি ভাবে ছাড়াছাড়ির ব্যবস্থা হোক। তারপর সে অন্য কাউকে বিয়ে করুক, যার সঙ্গে জীবন যাপন সম্ভব হবে।
কী অন্যায় করেছিল কিষান? তোমাকে মেরেছিল?
না।
বাইরে অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে ওর সম্পর্ক ছিল?
না।
তবে কি ইমানুয়েলের ঘটনা?
না।
তবে কী?
নীলা ম্লান হাসল।
নীলা কুয়াশায় বেরিয়ে পড়ল।
কিষানের কাছ থেকে অলংকার উদ্ধারের পথ কী আছে সামনে ভাবতে ভাবতে নীলা কুয়াশার ভেতর হাঁটে। মেট্রোয় চড়ে না। কারখানার কাজে যাওয়ার ইচ্ছেকে বাতিল করে ক্যাফে রিভলিতে বসে পর পর দুকাপ চা খায়। চা খেয়ে সে বাসে চড়ে, আগের মতো বাসে, নিরুদ্দেশ যাত্রায়।
বাসে যা কখনও ঘটতে দেখেনি নীলা, ঘটে সেদিন। দুজন ইনস্পেক্টর টিকিট দেখতে উঠেছে যাত্রীদের। নীলা বসেছিল বাসের পেছনের দিকে, সাদা ইন্সপেক্টর সব লোক রেখে নীলার কাছে এল টিকিট চাইতে। প্যান্টের না কি জ্যাকেটের পকেটে টিকিট রেখেছে মনে করতে না পেরে সে এক এক করে পকেট খুঁজতে থাকে, টিকিটও বেরোতে থাকে একাধিক, যে টিকিটই ইনস্পেক্টরের হাতে দেয়, নাকচ করে দেয় পুরনো বলে। তাকে নতুন টিকিট দেখাতে হবে। এ পকেট, ও পকেট, হাতব্যাগ তন্ন তন্ন করে খোঁজে, চুপসে যায়, ঘামে, আর টের পায়, বাসের লোকগুলোর চোখ তার দিকে। পেছন ফিরে সবাই তাকে দেখছে। অসংখ্য সাদার মধ্যে নীলা এক অসাদা, অদ্ভুতুড়ে এক জীব, নীলা অন্যরকম, আর সব বাসযাত্রীর মতো সে দেখতে নয়। দাঁড়ালে, তার সন্দেহ হয়, লোকেরা তার পেছনদিকটায় তাকাবে লেজ আছে কি না দেখতে। নীলা টিকিট না নিয়ে বাসে চড়ে, দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজায়, সাদাদের নিজেদের জন্য করা সুযোগ সুবিধে বহিরাগত হয়ে দেদারসে ভোগ করে। ইন্সপেক্টরের ঠোঁটের কোণে দেখলে তো, অপরাধীকে চিনতে আমাদের ভুল হয় না। রং দেখলেই বুঝি কে টিকিট করেছে কে না করেছে ধরনের হাসি।
হাতব্যাগের কাগজের আড়ালে লুকিয়ে ছিল নতুন টিকিটটি, শেষ অব্দি খুঁজে পায় সে। ইন্সপেক্টরের হাতে দিলে টিকিটের সময় মিলিয়ে নীলাকে ছাড়ল। তার মনে হয়, অনেকটা আশাহত হয়েই ছাড়ল। বাসের আর কারও কাছে ইন্সপেক্টর টিকিট দেখতেও চাইল না। আর কারও রং, সে লক্ষ করে, তার রঙের মতো নয়।
হোটেল দ্য ভিলের সামনে বাস থামলে নীলা নেমে পড়ে। এই দালানটি সে বরাবরই মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখে, এত দেখে তবু দেখা ফুরোয় না। যেন অনন্তকাল সে এটির সামনে বসে বিমুগ্ধ নয়নে দেখতে পারবে এর স্থাপত্য, এতটুকু ক্লান্ত হবে না। নেমে সে দানিয়েলকে ফোন করে বলে দেয় সে কাজে যায়নি, তার ইচ্ছে করেনি। কেন ইচ্ছে করেনি, সে জানে না কেন ইচ্ছে করেনি। কী করছে নীলা? কিছুই করছে না। কোথায়? হোটেল দ্য ভিলের সামনে। কেন ওখানে গেছে, সে জানে না কেন। কখন বাড়ি ফিরবে, তাও সে জানে না।
দানিয়েল বলে, ওখানেই থেকো। আমি আসছি।
নীলা চায়নি দানিয়েল আসুক। ওভাবেই সে কাটাতে চেয়েছিল একা। তার আরও একটি ফোন করতে ইচ্ছে হয়েছিল, কিন্তু সে হাত গুটিয়ে রাখে। ফোনটি সে করে না, করে না কারণ তার ইচ্ছে করে না সে কোথায় থাকে কার সঙ্গে থাকে, আর কেনই বা কিষানের বাড়ি থেকে সে বেরিয়েছে এরকম প্রশ্নের সামনে পড়তে। নীলার ভয় হয়, পাছে সে শোনে সে বেশ্যা।
দানিয়েল এসে নীলাকে নিয়ে কাছের এক ক্যাফেতে ঢোকে।
কী হয়েছে।
নীলা হেসে বলে, কিছু হয়নি তো।
মন ভাল নেই তোমার নীলা, হয়েছে কী বলো?
কিছু হয়নি।
কী করলে সকাল থেকে?
সুনীলের বাড়ি গিয়েছিলাম। অলংকারের কথা জিজ্ঞেস করলাম। ফেরত পাবার কোনও সম্ভাবনা দেখছি না।
দানিয়েল জিজ্ঞেস করে, সে কারণেই কি এত ভেঙে পড়েছ?
নীলাও হাসে, আমাকে দেখে তাই কি মনে হচ্ছে তোমার?
না নীলাকে দেখে তা মনে হচ্ছে না। নীলাকে দেখে কিছুই অনুমান করতে পারে না দানিয়েল।
আমি তোমাকে ভালবাসি নীলা, আমার কাছে সব খুলে বলো না কেন! কাতরতা দানিয়েলের কণ্ঠে।
ভালবাসি শব্দটি নীলা দানিয়েলের মুখে আগেও শুনেছে। ঘরে। শব্দটি কখনও নীলাকে ফাঁপরে ফেলেনি, এখন ফেলছে। নীলার আশঙ্কা হয়, যে কেউ দানিয়েলের মুখে ভালবাসি শব্দটি শুনলেই বুঝে নেবে মেয়েটি সমকামী, আর ওর সঙ্গী, স্বাভাবিকভাবেই সমকামী। মেয়েতে মেয়েতে প্রেম কী করে হয়, নীলা বুঝে পায় না। আর মেয়েতে মেয়েতে কী করেই বা সত্যিকার সঙ্গম সম্ভব, যদিও প্রায় রাতেই দানিয়েলের পাশে শুয়ে ভোগ করে শীর্ষসুখ, বুঝে পায় না। এরকম সুখ সে নিজেই অবশ্য দিতে পারে নিজেকে, দানিয়েলের যে খুব একটা প্রয়োজন এ সুখ পেতে, নীলার মনে হয় না। নিজের শরীর নিয়ে সে নিজে কখনও খেলেনি, খেলা যে যায়, তাই সে কখনও জানত না। দানিয়েল বলেছে, যখন প্রেমিকার অভাব, তখন সে নিজেই নিজেকে যা সুখ প্রয়োজন, দেয়। শুনে নীলা অবাক হয়েছে। কত যে অবাক করা ব্যাপার চারদিকে। যৌনতা বিষয়ে বিষম লজ্জা ছিল নীলার, কেবল নীলার কেন, ভারতীয় মেয়ে মাত্রই থাকে, আর যে কথাই বলো যৌনতা বিষয়ে কোনও কথা নয়, এ লজ্জার জিনিস, এ লুকোনোর ব্যাপার, এ ঢেকে রাখার বিষয়। সুশান্তর সঙ্গে দু বছরে বড়জোর ছবার চুমু খেয়েছে দুজন। আর সেই ছটি চুমু খেতে কত না অপেক্ষা গেছে, কত না আড়াল তৈরি করতে হয়েছে। আর এখানে, নীলার ভাল লাগে আবার রাগও হয়, দেখে যে, ছেলেমেয়েরা দিব্যি রেলে বাসে, রাস্তায় বাগানে যেখানে ইচ্ছে চুমু খাচ্ছে একশো লোকের সামনে। ভাল লাগে ভালবাসা এরা লুকোয় না বলে, এদের ভেতর রাখঢাক বলে কিছু নেই বলে, এরকম হওয়াই তো উচিত, আর রাগ হয় এ কারণে কী রক্ষণশীলতার মধ্যে থেকে নীলা কত আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। নীলা তো এদেশে জন্ম নিতে পারত, নীলা তো পুরো কৈশোর, যখন তাকে ঘরে বসে থাকতে হয়েছে, ঘুরে বেড়াতে পারত বন্ধুদের সঙ্গে, প্রেমিকের কোমর জড়িয়ে হাঁটতে পারত যেখানে সেখানে, থাকতে পারত তার যা খুশি করার স্বাধীনতা। নীলার অনেকটা বয়স অব্দি যা খুশি করা হয়ে ওঠেনি, পারেনি সে। এই এখন, কিষানের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে অনেকটা যা খুশিই করছে সে, একটি মেয়ের সঙ্গে যৌনসম্পর্ক করা নিশ্চয়ই যা খুশি করা, নীলা অবশ্য এটিকে যা খুশি বলে না, এ সঙ্গম তার ইচ্ছেয় নয়, দানিয়েলের ইচ্ছেয়। সে দিব্যি ভেবে নিয়েছে নীলা তাকে ভালবাসে। দানিয়েল অবশ্য লক্ষ করে মাঝে মধ্যে, যে রাস্তায় হাঁটলে, রেস্তোরাঁ বা ক্যাফেয় বসলে নীলা তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে সুদর্শন ফরাসি যুবকদের দিকে। এই ক্যাফেতেও, দানিয়েল যখন বকে চলছে, ঘণ্টাখানেক পর দানিয়েলকে উঠতে হবে, নিকলকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে সে, নীলার চোখ অন্যদিকে।
কী ব্যাপার আমার কথা শুনছ না?
শুনছি।
মোটেও শুনছ না।
শুনছি।
তবে যে অন্যদিকে তাকিয়ে আছো!
এখানেই ভুল করছ। যখন আমি মন দিয়ে কথা শুনি, তখন মুখের দিকে তাকাই না। তাকালে মনোযোগ নষ্ট হয় আমার।
তা তাকাও কোথায়?
তাকাই চেয়ার টেবিলের দিকে, দেয়ালের দিকে। যেসব পদার্থ মনকে অন্যদিকে ফেরায় না।
আর মুখ বুঝি অন্যদিকে ফেরায়?
তা ফেরায়। নাক ভোঁতা না টিকোলো, চোখ কালো না বাদামি, হাসলে কি গালে টোল পড়ে, কথা বললে মুখের কোন কোন পেশি নড়ছে, কপালে ভাঁজ পড়ছে কিনা কোনও কারণে, আর যদি পড়েই কটি ভাঁজ পড়ে…এসব দিকে মন চলে যায়।
দানিয়েল বলে, আমি কী বলেছি বলো তো? শুনেছ যখন!
বলেছ, নিকলকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
নিকলের আবার কী অসুখ হল হঠাৎ? নিকলের নয়। অসুখ পিপির। পিপিটা কে? পিপি হচ্ছে নিকলের বেড়াল।
পিপি পেচ্ছাপ করছে না। দানিয়েল বলে।
বেড়াল পেচ্ছাপ করছে না তো নিকলের হয়েছে কী?
তাই তো নিকলের মন খারাপ। ও মানসিক রোগের ডাক্তারের কাছে যাবে।
নীলা চমকায়। বেড়াল খাচ্ছে না বলে কারও মনে অসুখ হয় আর সে অসুখ সারাতে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়! নীলা জোরে হেসে উঠতে চায়, কলিকালে কত কী দেখব বাবা! বলে অনেকক্ষণ সে হাসির রেশ ধরে রাখতে চায়, কিন্তু দমন করে নিজের কুকুরে স্বভাব।
কুকুর বেড়ালের নাম শুনলে নীলার পা উসখুস করে লাথি লাগাতে। কুকুর বেড়ালকে সে লাথি লাগিয়ে আসছে হাঁটতে শেখার পর থেকে, বলা যায় লাথি লাগানো শেখার পর থেকে। পাঁচিল টপকে রাস্তার বেড়াল রান্নাঘরে ঢুকে পাতিলের ঢাকনা সরিয়ে রাঁধা মাছ মাংস খেয়ে যায়, এ ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। তাই চোরা বেড়াল দেখলে একেবারে পেট বরাবর লাথি লাগানোই ছিল একরকম নিয়ম। রাস্তার নোংরা ঘাঅলা নেড়িকুত্তাগুলো বাড়ির ত্রিসীমানায় ঢুকতে চাইলে লাথি মেরেই ওদের সরাতে হত। নীলা এই সভ্য সুন্দর কুকুরবিড়ালপ্রেমীর দেশে নিজের উসখুস করা পা দুটোকে ধমকে উদার করে।
এত কী দেখছ ওদিকে। নীলার চোখ যেদিকে, সেদিকে তাকিয়ে দানিয়েল দেখে এক ঝাঁকড়া চুলের যুবক দাঁড়ানো।
নীলার স্বীকারোক্তি, সুদর্শন থেকে চোখ ফেরাতে পারি না।
ছোঃ! একগাদা ঘেন্না ছুড়ে দেয় দানিয়েল। তুমি কি আবার আগের জীবনে ফিরতে চাও নীলা? দেখেছই তো পুরুষের সঙ্গে জীবনযাপন কী জঘন্য। তোমার শিক্ষা হয়নি?
সব ছেলেই তো কিষান নয়।
কিষান নয় তো সুশান্ত। ওই তো। সব পুরুষই এক। সব পুরুষই নারীকে অত্যাচার করে।
সবাই এক না দানিয়েল। কেউ কেউ ভালও তো বাসে।
ভালবাসা? এসপ্রেসোর কাপে চিনি নাড়তে নাড়তে দানিয়েল বলে, ও এক ধরনের জাল। পুরুষের ওই পাতা জালে আটকা পড়ে মেয়েরা। ভাবে, পুরুষ ছাড়া মেয়েদের চলে না। খুব চলে। এই দেখো আমাকে, আমার কি কোনও পুরুষের দরকার!
নীলার চা ঠাণ্ডা হতে থাকে, দানিয়েলের চোখে তাকিয়ে মুখের কথা শোনে।
দানিয়েলের পুরুষ ছাড়া চলছে, কিন্তু জগতের সবাই যদি দানিয়েলের মতো সমকামী হয়, জগৎ চলবে কী করে, নীলার প্রশ্ন। নীলা প্রাণী জগতের উদাহরণ দেয়, যে কোনও প্রাণীই স্বাভাবিক আকর্ষণ বোধ করে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি, মিলিত হয়, মিলিত হয় বলেই জন্মপ্রক্রিয়া চলছে, তা না হলে, সব মরে ভূত হয়ে যেত, জগৎটিও প্রাণীহীন হত, এমনকী উদ্ভিদহীন। ফিনিতো।
দানিয়েল বলে, এসব পুরুষের সৃষ্টি করা নিয়ম।
তুমি আমি কি কোনও বাচ্চা জন্ম দিতে পারব? পারব না। নীলা বলে।
কফিতে চুমুক দিতে গিয়েও না দিয়ে দানিয়েল বলে, আর কত বাচ্চার দরকার এ জগতে? যথেষ্ট আছে। আর পুরুষশাসিত বৈষম্যের জগতে আরও বাচ্চা এনে তাদের বৈষম্যের মধ্যে ফেলার দরকার কী!
একসময় তো আর বৈষম্য থাকবে না। এক হবে সব। সূদুর স্বপ্নের দিকে তাকিয়ে নীলা বলে।
দানিয়েল বলে, যখন হবে তখন হবে…আর যৌনতার জন্য, নারী যেদিন বলবে তার কোনও প্রয়োজন নেই পুরুষের, সেদিনই হবে পুরুষের পরাজয়। তার আগে নয়।
নীলা ঠাণ্ডা চায়ে চুমুক দেয়। এখানে ক্যাফেতে এক কাপ চা নিয়ে তিন চার ঘণ্টা পার করে লোকে। ক্যাফের বাইরে এদের দেখলে কী বিষম ব্যস্ত মনে হয়, যেন দৌড়োচ্ছ, ব্যস্ত ব্যস্ত বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলে এরা আর ক্যাফেতে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেয় বসে, ব্যস্ততার নীলা দেখে না কিছু। তার অনেক সময় মনে হয়, এদের চেয়ে কলকাতার লোকেরা অনেক ব্যস্ত, সত্যিকার ব্যস্ত, কিন্তু ব্যস্ততার কথা ওরা অত বলে না। এরা সপ্তাহে দুদিন ছুটি পায়, এই দুদিন দিব্যি ঘুরে বেড়ায়, শুয়ে থাকে, দুঘণ্টা বসে থেকে কাগজ পড়ে বলে শক্ত পরিশ্রম করে এলাম। ছো! শক্ত পরিশ্রমের এরা কিছুই জানে না। দেখত কলকাতার মুটে মজুর, দেখত রিকশাঅলা। কলকাতায় চায়ের দোকানে কেবল চা খাওয়ার জন্য যায় লোকে, খামোকা বসে থাকার জন্য নয়। এখানে ক্যাফেতে বসে অলস সময় কাটানো, বা সস্তা আড্ডাকেও সম্ভবত ব্যস্ততা বলে ধরে এরা।
পরিশ্রমের সংজ্ঞাও আলাদা এখানে। ভোরবেলা থেকে রাত অব্দি মাথায় দুমণ করে একশোটি বালুর বস্তা নিয়ে দু মাইল দূরে যেখানে দালান তোলা হচ্ছে, হেঁটে পৌঁছে দিলে নীলা বলবে বেশ পরিশ্রম করে এসেছে লোকটি। নীলার কাছে পরিশ্রমের সংজ্ঞা হল এই।
দানিয়েল যেদিন প্রথম বলেছিল, আমি শক্ত পরিশ্রম করেছি গত দুসপ্তাহ।
কী পরিশ্রম? নীলা জানতে চেয়েছিল।
গোটা দুই বই পড়ে সারাংশটা লিখেছি।
শক্ত পরিশ্রম কী করলে সেটা বলো।
ওটাই তো শক্ত পরিশ্রম।
ওটা শক্ত পরিশ্রম? নীলা অবাক হয়েছে শুনে।
হ্যাঁ।
বই পড়ার মতো আরামের জিনিস আর আছে নাকি? কী বই?
গল্পের।
বাহ। এ তো অবসরের মজা।
বলো কী? অবসরে আমি ঠিক ওই বইটিই হয়তো পড়তে চাই না।
হুম, ক পাতা লিখেছ?
দু পাতা!
এমন চাকরি যদি আমি পেতাম। নীলা মনে মনে বলেছে।
দানিয়েল তাকে আকর্ষণ করে আবার করেও না। দানিয়েলের কথায় যুক্তি আছে, আবার নেইও। নীলা দোলে। ভাল লাগায় না লাগায়। দানিয়েল যে যুক্তিই দিক, সুদর্শন পুরুষ থেকে নীলা চোখ ফেরাতে পারে না। তার ইচ্ছে করে পুরুষটি তাকে বলুক ভালবাসি। পুরুষটি তাকে চুমু খাক। তাকে নিয়ে শৃঙ্গারে মাতুক, পুরুষটি তার ভেতর ঘরে চলে যাক অপার আনন্দে। কিন্তু নীলা চাইলেই ব্যাপারটি ঘটে না। সে লক্ষ করছে, কোনও সুদর্শন পুরুষ তার দিকে ফিরে তাকায় না। কলকাতার রাস্তায় বেরোলে লোকে ফিরে ফিরে দেখত তাকে। এখানে রাস্তার বখাটে ছেলেরাও সিটি বাজায় না নীলাকে দেখে, যেন সে কেউ নয়, যেন সে বিদঘুটে একটি মাংসপিণ্ড, তাকে এড়াতে পারলেই বাঁচে সব। রূপসি বলে তাকে সবাই বলত কলকাতায়, তার রূপের কোনও দাম নেই এদেশে। দানিয়েল দাম দিচ্ছে, দানিয়েলের শরীর রোদ্যাঁর ভাস্কর্যের মতো সুডোল সুন্দর হোক না কেন, ওর মুখটি লাবণ্যহীন, কণ্ঠটি কর্কশ। নীলা শেষ অব্দি এক কুশ্রী মেয়ের সঙ্গে জীবন জড়াল কি! আসলে এ ঠিক জীবন জড়ানো নয়, দানিয়েলের প্রেমে সে পড়েনি, দানিয়েলকে নিয়ে কোনও স্বপ্ন সে দেখে না, ও কি জানে একথা? নীলার বিশ্বাস, জানে না।
এত গভীরভাবে ভাবছে কী নীলা, দানিয়েল কফি শেষ করে জানতে চায়। কী ভাবছে তা নীলা বলে না, কিন্তু জিজ্ঞেস করে দানিয়েল তাকে কিছু ফ্রাঁ ধার দিতে পারবে কি না।
কত?
এই ধরো, পাঁচ হাজার।
পাগল হয়েছ। কী করবে ফ্রাঁ দিয়ে?
কলকাতা যাব।
কলকাতা কেন?
মার অসুখ।
ওই সুনীলের বাড়ি গেছিলে তো! ও তোমার মাথায় এসব দিয়েছে। যাও কলকাতা, দেখবে কীভাবে তোমাকে বন্দি করে ওখানে। দানিয়েল ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলে।
আমার মার অসুখ, আমি দেখতে যাব। ব্যাস।
তুমি গিয়ে অসুখ সারাবে? এমনই দেশ তোমাদের, ডাক্তার নেই? হাসপাতাল নেই?
সব আছে, কিন্তু আমি দেখতে যাব।
এখন গিয়ে কোনও লাভ আছে? সৎকারের সময় না হয়ে যেয়ো।
সৎকারের প্রশ্ন আসছে না। সেবার প্রশ্ন।
ওখানে নার্স নেই সেবা করার? তুমি তো বলেছ কাজের লোক আছে অনেক।
সব আছে। কারও অভাব নেই। কিন্তু আমি যাব কলকাতা…
তা যাও। আমার কাছে এত টাকা নেই।
অন্য কারও কাছে ধার করে দিতে পারবে?
কেউ এত টাকা দিতে পারবে না।
নীলা নিঃশব্দের কোলে মাথা রেখে বসে থাকে। চা তার অনেকক্ষণ শেষ হয়েছে।
এখন গিয়ে যদি চলে আসো, তারপর সৎকারের সময় কি আবার যাবে? দানিয়েল তার কর্কশ কণ্ঠ যথাসাধ্য মধুর করে বলে।
সৎকার সৎকার কোরো না দানিয়েল। আমার মার এমন অসুখ হয়নি যে তিনি মারা যাবেন। নীলা দাঁতে দাঁত পিষে বলে, চোয়ালের পেশি তার শক্ত হয়ে থাকে।
তাহলে আর যাওয়া কেন?
যাওয়া, কারণ আমার মা…
দানিয়েল নীলাকে কথা শেষ করতে দেয় না, ভেংচি কেটে বলে, আমার মা, আমার বাবা, আমার ভাই, আমার বোন, যত্তসব।
দানিয়েলের ভেংচিতে ভ্রূক্ষেপ না করে নীলা বলে, আমার মন বলছে মার কেবল সর্দিজ্বর হয়নি। অন্য কিছু।
দানিয়েল নিজের কফির দাম টেবিলে ছুঁড়ে দিয়ে শব্দ করে চেয়ার সরায়। বাঁ হাতের মধ্যমাটি তুলে ধরে নীলার সামনে। নিজের বাঁ বাহুতে ডান হাতে চাপড় লাগিয়ে, কনুই তেঙে ঝাঁকুনি দেয়। দানিয়েলের সারা গা থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে দগদগে রাগ, সেই রাগ সামান্য দমন না করে সে ক্যাফের দবজা ঠেলে বেরিয়ে যায়, চেঁচাতে চেঁচাতে, লা ফামেলিয়া। লা ফামেলিয়া।
আবিয়াঁ তো
কলকাতা যাবার আগে দুটো জায়গায় যাওয়া হয় নীলার। এক সানদানি, আর দুই ত্রকাদেরোয় মানসিক রোগের ডাক্তারের বাড়ি। সানদানিতে, কারণ রিতা সিকসুস তার তথ্যচিত্রের জন্য সাক্ষাৎকার নেবে। বাসিলিক দ্য সানদানির বাগানে বসে সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে। বাগানের ভেতর সার্জ সান্তোসের বাড়ি। সার্জের সঙ্গে রিতার পরিচয়, তার বান্ধবী আন লরের কারণে, আন লরের মা ফ্রান্স বেনজাকিন জন্মেছে মিশরের এক ইহুদি পরিবারে, ফ্রান্সের যখন পাঁচ বছর বয়স, মিশর থেকে সব ইহুদিদের বের করে দেওয়া হয়েছিল, ফ্রান্সের পুরো পরিবার তখন চলে আসে ফ্রান্সে, রিতার প্রতিবেশী ছিল ফ্রান্স, এই সানদানিতেই, সানদানি তখন অনেকটা গ্রাম। সেই সানদানি এখন ঘিঞ্জি শহরতলি, চুরি ডাকাতি ছিনতাই হামেশা ঘটছে, সাদার বসতি খুব কম, বেশির ভাগই কালো আর বাদামি, বেশির ভাগই দরিদ্র, বেশির ভাগই লেখাপড়া না জানা, বেশির ভাগই বেকার।
নীলাকে যখন সানদানির ঝকঝকে বাড়িঘরের দিকে আঙুল তুলে বলা হয়, এসব দরিদ্র লোকের বাড়ি, নীলা ঠিক বোঝেনি দারিদ্র্য বলতে এরা কী বোঝে। বাড়িগুলোর সামনে দাঁড়ানো সার সার গাড়ি দেখে নীলা বলে, এই গাড়িগুলো তবে কাদের? ওদেরই, ওই দরিদ্রদের। নতুন মডেলের দামি গাড়ি নেই বলে ওরা দরিদ্র। নতুন মার্সেডিজ হলে, বি এম ডব্লু হলে, লিমোজিন হলে ওরা দরিদ্র নয়, খুব সহজ অঙ্ক। নীলার চোখ দেখেছে কলকাতার বস্তি, এ চোখে আর কোনও দারিদ্র্য দারিদ্র্য ঠেকে না। নীলার চোখ দেখেছে লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল মানুষ, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, পেটে খাবার নেই, পরনে কাপড় নেই, অসুখে ধুকছে, চিকিৎসা নেই, নীলাকে তোমরা দারিদ্র্য দেখিয়ো না, যে লোকটি রঙিন টেলিভিশনের সামনে বসে ভরপেট খেয়ে এই মাত্র বেরিয়ে এল, গায়ে ফ্যাশনের জামা জুতো, জোরে গান ছেড়ে, মাথা দুলোতে দুলোতে গানের তালে, গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে, তাকে আর যাই বলো দরিদ্র বোলো না, অন্তত নীলার সামনে।
বোতাম টিপে বিশাল দরজা খুলে দিলে রিতার গাড়ি ঢুকে যায় সার্জের বাগানে। গির্জার ঠিক পেছনেই বাগান। বাগান বলতে ঘাসের মাঠ। মাঠে ছড়িয়ে আছে পুরনো পাথরের কফিন। কফিনের ওপর বসে কফি খাচ্ছে আন লর। মাঠে খেলছে রাফায়েল আর বেনজামিন। আন লরের দুই ছেলে।
রিতা পৌঁছতেই এক দফা চুমোচুমি হল।
দানিয়েল বাসিলিকের পাদদেশের বাড়িখানা দেখে অনেকক্ষণ উ লা লা উ লা লা করে। এত চমৎকার জায়গায় বাড়ি পাওয়া নাকি ভাগ্যের ব্যাপার। ভাগ্য কি আর সাধে, সার্জ এই বাসিলিকের পরিচালক বলেই না!
রিতার সঙ্গে নীলা আর দানিয়েল ছাড়াও আরও দুজন এসেছে, একজনের হাতে ক্যামেরা, আরেকজনের হাতে মাইক্রোফোন। নীলার বুক কাঁপে। ক্যামেরার সামনে সে কোনওদিন দাঁড়ায়নি আগে। রিতা তাকে কী প্রশ্ন করবে তার সে কিছুই জানে না। নীলার হাতের তালু ঘামতে থাকে, নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
রিতা বলে, তুমি নাকে একটু পাউডার লাগিয়ে আসবে?
নীলা হাতে নাক মুছে বলে, না, ঠিক আছে। আর আমি পাউডার আনিওনি সঙ্গে।
রিতার মুখ রক্তিম হয় শরমে।
দানিয়েল নীলার কানে কানে চাপা স্বরে বলে, নাকে পাউডার লাগানো মানে নাকে পাউডার লাগানো নয়। এর মানে তয়লেতে যাওয়া। পেচ্ছাপ পায়খানা করা।
তয়লেতে যাব কি না তা জিজ্ঞেস করলেই তো হয়?
না, এ শরমের কথা।
শরমের?
নীলা ঠিক বোঝে না, এ সমাজের শরম ঠিক কোথায় থাকে। এখনও গ্রীষ্মকাল আসেনি, এখনই মেয়েরা রাস্তায় আধন্যাংটো ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছে। কাপড় চোপড় ব্যাপারটিই ঝামেলার। শরম ধুয়ে খেয়েছে বলেই না এদের দেখতে এত মৌলিক দেখায়।
ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর আগে ক্যামেরার লোকটি বলল, মুখে একটু পাউডার লাগালে ভাল হয়।
এই পাউডার সত্যিকার পাউডার। তয়লেত নয়। নীলার মুখে আন লর পাউডার মাখাতে নিয়ে যায়। আন লর-এর সাজানো ঘরদোর দেখে নীলা বলে, তোমাদের অনেকদিন বিয়ে হয়েছে?
না তো আমাদের তো বিয়ে হয়নি।
সার্জের কী হও তুমি তা হলে?
প্রেমিকা হই।
একসঙ্গে থাকো?
নিশ্চয়ই। আজ ছ বছর ধরে সংসার করছি।
আর বাচ্চারা?
আমাদের বাচ্চা। আমার আর সার্জের। আন লর মিষ্টি হেসে বলে।
নীলা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে পাউডার ঘসে। আজ রিতার অনুরোধে সে শাড়ি পরেছে। শাড়ি পরা, কপালে লাল টিপ পরা বাঙালি মেয়ে নীলা। মনে মনে কলকাতা ঘুরে আসে নীলা। মনের এই এক বড় গুণ, এটি খুব দ্রুত উড়তে পারে।
দুটো চেয়ার পেতে দেওয়া হয়েছে মাঠে। নীলার সামনে বসে রিতা দেখে নিল ক্যামেরায় ঠিক ঠিক আসছে কি না নীলার মুখ আর পেছনের বাসিলিক, বিখ্যাত গির্জা, ফ্রান্সের সব রাজারা শুয়ে আছেন যে গির্জায়। দেখে নিন নীলার মুখে রোদ পড়ছে কি না, কপালের টিপটিকে দেখাচ্ছে কি না রক্তের মতো লাল। পড়ছে, দেখাচ্ছে।
এবার মুখোমুখি বসে প্রথম প্রশ্ন, আচ্ছা নীলা, তুমি কপালে যেটি খোদাই করে লাগিয়েছ, সেটি তো তুমি যে বিবাহিত তার একটি প্রতীক, তাই না?
না।
রিতা থতমত খায়, কিন্তু একটি বেদনার্ত হাসি ঝুলিয়ে রাখে ঠোঁটে, অপেক্ষা করে নীলার ব্যাখ্যার, কেন না।
এটি বিয়ের কোনও চিহ্ন নয়, সব মেয়েরাই বিয়ের আগে টিপ পরে, দেখতে সুন্দর লাগে বলে পরে।
রিতার প্রশ্ন, এটি কি স্থায়ীভাবে লাগানো হয়নি তোমার কপালে?
নীলা হেসে ওঠে, হেসে সে কাগজের টিপটিকে আঙুলে তুলে নিয়ে দেখায়, দেখো, এটি অস্থায়ী একটি জিনিস। এই পরলাম, এই খুললাম।
কাট।
রিতার পছন্দ হয়নি টিপের ম্যাজিকটি। লাল একটি বিয়ের রং যদি নীলার কপালে খোদাই করা থাকত, সম্ভবত তার সুবিধে হত সাক্ষাৎকারে।
কোলের ওপর প্রশ্নের কাগজে চোখ বুলিয়ে রিতা পরের প্রশ্ন করে, তুমি তো ভারতের মেয়ে, অত দূর দেশ থেকে প্যারিসে এসেছ স্বামীর সঙ্গে সংসার করতে, তাই না?
হ্যাঁ তাই।
শুনেছি তুমি স্বামীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছ। একটু বিস্তারিত বলবে, কেন?
কারণ স্বামীর সঙ্গে আমার মেলে না।
কেন মেলে না?
মেলে না কারণ দুজন আমরা ভিন্ন ধরনের মানুষ।
তোমার স্বামী তো ভারতীয়, তবে ভিন্ন কেন বলছ?
ভিন্ন কারণ আমাদের মানসিকতা ভিন্ন।
তোমার স্বামী শুনেছি অত্যাচার করত তোমার ওপর। খুলে বলো কী কী করত সে।
অত্যাচার বলতে আসলে যা বোঝায় তা সে কিছুই করেনি।
তোমার স্বামী তো তোমাকে মারত, কী করে মারত, কী ব্যবহার করত মারতে গিয়ে? চাবুক, নাকি লাঠি নাকি কোমরের বেল্ট। নাকি হাত…
আমার স্বামী আমার গায়ে কখনও হাত তোলেনি।
কাট।
রিতা হাত উঠিয়ে ক্যামেরা বন্ধ করতে বলে।
উঠে আসে নীলার সামনে, হাঁটু গেড়ে বসে বলে, তুমি বোধহয় আমার প্রশ্ন বুঝতে পারোনি নীলা।
নীলা নির্ঘাত বেকায়দায় পড়ে। তার অস্বস্তি দেখে, রিতা জল জল বলে চিৎকার করে। আন লর দৌড়ে এক গেলাস ঠাণ্ডা জল নিয়ে আসে। নীলার তেষ্টা পায়নি তবু পান করতে হয় জল, অর্ধেক জল হাতের কাছে রাখতে হয় যদি পান করার তাগাদা দেওয়া হয়।
ক্যামেরা তাক করা নীলার মুখে।
রিতা শুরু করে আবার, তোমাদের ভারতীয় মহলে আর যে মেয়েরা স্বামীর ঘর ছেড়েছে, তাদের সঙ্গে নিশ্চয়ই তোমার কথা হয়েছে। ওদের অবস্থার কথা কিছু বলো, ওদের ওপর ওদের স্বামী কী কোরে অত্যাচার করে।
নাহ। এরকম কারও সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। নীলার নিরীহ জবাব।
কাট।
এবার দানিয়েলের কাছে উঠে যায় রিতা। চেয়ার ফেলে কফিনের ওপর বসে দানিয়েলের সঙ্গে লঘুস্বরে কথা বলে। নীলা চেয়ারেই বসা, রোদের দিকে মুখ করা, পাউডার ঘসা মুখ।
ফিরে এসে মুখে হাসি টেনে রিতা বলে, শাড়িতে তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে নীলা। দেখেছি তুমি পশ্চিমি পোশাক পরো বেশি। শাড়িতেই কিন্তু তোমাকে মানায়।
এবার নতুন প্রশ্ন, তোমাদের সংস্কৃতিতে তো সতীদাহ বলে একটা ব্যাপার আছে, তোমার স্বামীর মৃত্যু হলে, তোমাকেও চিতায় উঠতে হবে।
সে পুরনো প্রথা। গত শতাব্দীতে এ প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
মেয়েদের ভগাঙ্কুর ছেদ করা তো ভারতীয় সংস্কৃতির একটি অংশ, তা কত শতাংশ মেয়ের ভগাঙ্কুর ছেদ করা হয় ভারতে?
ভগাঙ্কুর ছেদ করা ভারতীয় সংস্কৃতি নয়।
আচ্ছা, তোমার সংসারজীবনের কিছু কথা বলো। তোমাকে তো সংসারের সব কাজ করতে হত তাই না?
তা করতে হত।
কী কী করতে বলো তো?
রান্না করা, বাসন ধোয়া, ঘর পরিষ্কার করা, কাপড় ধোয়া এসব।
তোমার স্বামী কী কী কাজ করত ঘরের?
তেমন কিছু না।
তোমার স্বামী কখনও রান্না করেছে?
না।
ঘর পরিষ্কার করেছে?
না।
সে কাজ থেকে ঘরে ফিরে কী কী করত?
টেলিভিশন দেখত, মদ খেত…
রিতা মাথা নাড়ে, বলো বলো আর কী কী করত…
আর কী, খেত, ঘুমোত।
সংসারের খরচ দুজনে মেটাতে তাই না?
না, আমার চাকরি ছিল না, আমার স্বামীই সব খরচ দিত।
তুমি চাকরি করো, এ তোমার স্বামী চায়নি তো!
না চায়নি।
তোমার স্বামী তোমাকে ঘরে বন্দি করেছিল তো, তাই না?
ঘর থেকে বাইরে একা বেরোই সেটা চায়নি। তবে বন্দি বলতে যা বোঝায় তা ঠিক না। দরজার চাবি আমার কাছেও থাকত।
তোমার স্বামী তো তোমার যা কিছু সম্পদ, তোমার স্বর্ণালংকার সব রেখে দিয়েছে।
রাখেনি। ও আমি ভুলে ফেলে এসেছি।
তোমার স্বামী তোমাকে পর্দা করার জন্য চাপ দেয়নি, মানে মাথায় কাপড় চড়ানো?
না। ও রক্ষণশীল মুসলমান পরিবারে ঘটে, হিন্দু পরিবারে নয়।
তোমার স্বামী তো তোমাকে মাছ মাংস খেতে দেয়নি। কী খাবে না খাবে তাও তার আদেশে হত!
তা ঠিক, ও নিরামিষাশী। চাইত ঘরে নিরামিষ রান্না হোক।
আর তা না করলে কী করত? মারত?
না মারেনি কখনও।
গাল দিত?
তাও দেয়নি।
তা হলে কী করত?
মন খারাপ করত।
কাট।
সানদানি থেকে বেরিয়ে দানিয়েল বলে, কিষানের জন্য বেশ দরদ তো তোমার!
নীলা জিজ্ঞেস করে, কী বলা উচিত ছিল আমার? কী বললে বোঝা যেত যে আমার দরদ নেই?
বাদ দাও। দানিয়েল হাত ঝাঁকায়।
এই তথ্যচিত্রটা মূলত কীসের ওপর?
মেয়েদের ওপর, মেয়েদের কী করে অত্যাচার করা হচ্ছে, সেসবের ওপর।
নীলার মনে আরও প্রশ্ন, কোন মেয়ে? যে কোনও মেয়ে? ফরাসি মেয়েও?
এটা আগেই তো বলেছি, বিদেশি মেয়েদের নিয়ে।
বিদেশি মেয়ে? জার্মান মেয়ে? সুইস মেয়ে? বেলজ?
ওরা তো ফ্রান্সে থাকতে আসে না। যারা আসে তারা।
রুয়ান্ডার, সোমালিয়ার, মালির, ভারতের, পাকিস্তানের, ইরানের, আফগানিস্তানের মেয়েরা তাই না?
দানিয়েল অনেকক্ষণ উত্তর দেয় না। মেট্রোয় ভিড় উপচে পড়ছে। সেই ভিড়ে গা ধাক্কা খেতে খেতে বলে, তুমি মেয়েদের ভগাঙ্কুর কেটে নেওয়ার ঘটনা জানো না? এই ফ্রান্সে কত মেয়েদের ভগাঙ্কুর কেটে নেওয়া হচ্ছে। সংস্কৃতির নামে এই নির্মমতা চলছে, এখানেও। তুমি যেন ব্যাপারটিকে সমর্থন করছ নীলা।
নীলা বলে, গলায় জোর তার, আমি সমর্থন করতে যাব কেন! যা সত্য তাই বলেছি, ভারতে এই সংস্কৃতি নেই।
এটা না থাক, অন্য কিছু আছে তো। সেসব বললে না কেন! এই তো বড় সুযোগ ছিল লোককে জানানো। যারা জানে না, তৃতীয় বিশ্বে মেয়েরা কী হারে বঞ্চিত হচ্ছে, লাঞ্ছিত হচ্ছে, তাদের মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয় না, পুরুষের দাসী হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য মনে করা হয় যে মেয়েদের জন্ম, সব বললে না কেন? এমনিতে তো অনেক বৈষম্যের উদাহরণ দাও।
নীলা বলে, আমাকে যা জিজ্ঞেস করা হয়েছে, তার উত্তর দিয়েছি।
রিতা তোমার সাক্ষাৎকারে খুব একটা তুষ্ট নয়, সত্যি কথা বলতে গেলে।
নীলা পাঁচশো ফ্রাঁ কবে পাচ্ছে বা আদৌ পাচ্ছে কি না তা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করে না। মুখ বুজে থাকা, নীলা লক্ষ করেছে, অনেক সময় মঙ্গলজনক।
কী ব্যাপার কথা বলছ না যে! দানিয়েলের অতুষ্ট বাদামি চোখ নীলার চোখে।
কী বলব? কোনও প্রশ্ন করোনি তো!
তোমার সাক্ষাৎকারের পাট তো অনেকক্ষণ চুকেছে। এবার ধরায় ফেরো। স্বাভাবিক হও।
নীলা হেসে ওঠে। খামোখাই হাসে সে। দানিয়েল নীলার হাসির কারণ জিজ্ঞেস করলে নীলা ভেবে নেয়, বলবে যে খামোখাই হাসছে। খামোখা হাসে তো পাগল লোকেরা। নীলা বলবে যে সে পাগল।
.
বাসিলিক সানদানি থেকে কনকর্ড পৌঁছল দুজন। কনকর্ড থেকে এক নম্বর লাইনে এখন যেতে হবে শার্ল দ্য গোল এতোয়াল। কিন্তু এতোয়ালের দিকে মেট্রো চলবে না। এতোয়াল থেকে নেশনের পথে তিন ইস্টিশন গেলেই ত্রকাদেরো। কনকর্ড থেকে মেট্রো চলছে না, এতোয়াল থেকেও চলবে না। দানিয়েল উঠে আসে পাতাল থেকে মাটিতে। দানিয়েলের পেছন পেছন নীলা। বাস ধরা ছাড়া গতি নেই। কনকর্ডের বাসস্টপে দাঁড়ায় দুজন, বাস আসছে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু লোক তুলছে না, তিল ধারণের জায়গা নেই বাসের ভেতর। মেট্রো চলছে না তাই ভিড় বাসে, বাসস্টপের দু একজন বলে। ট্যাক্সি দেখলেই দানিয়েল হাত লম্বা করে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে, ট্যাক্সি যেমন যাচ্ছে, তেমন যেতে থাকে, কারও থামার লক্ষণ নেই। দেখে নীলা বলে, ভারতের মতো অবস্থা দাঁড়িয়েছে দেখছি। একরকম সে স্বস্তি বোধ করে দেখে যে কিছু অনিয়ম ঘটছে, এতদিন সে কোনও রেলগাড়ি বা বাসকে, সময়ের এতটুকু বাইরে যেতে দেখেনি। ঠিক পাঁচটা পঁয়ত্রিশে থামার কথা, পাঁচটা পঁয়ত্রিশে এসেই থামে, পাঁচটা চৌত্রিশেও নয়, পাঁচটা ছত্রিশেও নয়। ট্যাক্সি ডাকলেও তিন মিনিটে আসার কথা, তিন মিনিটেই আসে। হাত তুললে সে যে রাস্তায় হোক, যত রাত হোক, থামে। একটু অনিয়ম না হলে কেমন যেন দমবন্ধ লাগে, নীলা ভাবত। নীলা এই অনিয়ম দেখে মুক্ত হাওয়ায় শ্বাস নেয়।
মুহূর্তে কনকর্ড মেট্রো ইশটিশনটি পুলিশ এসে ঘেরাও করে ফেলে। পুলিশের একজনকে দানিয়েল জিজ্ঞেস করে, ঘটনা কী?
ঘটনা কিছু না। দুটো আত্মহত্যা ঘটেছে।
কী কারণ।
ওই যা ঘটে। কারণ হল বসন্ত।
কারণ হল বসন্ত, নীলা হাঁ হয়ে থাকে। দানিয়েল নীলার হাঁয়ের ভেতর একবোঝা তথ্য গুঁজে দেয়।
বসন্তকাল হল আত্মহত্যার ঋতু। দুটো যুবক চলন্ত গাড়ির তলায় ঝাঁপ দিয়েছে। মরতে চেয়েছে, মরেছে। এরকম প্রতি বসন্তকালেই লোকে রেলের তলে জীবন দেয়। এর কারণ, দানিয়েল আগেই জানিয়েছে যে বসন্তকাল।
বসন্তকালে মানুষের আত্মহত্যা করার ইচ্ছে হবে কেন, এই কারণটি নীলা জানতে চায়।
বসন্ত এলে পশ্চিমিরা যত দূর জানে সে, আনন্দে মেতে ওঠে। তবে আত্মহত্যা কেন?
দানিয়েল বলে, যারা একা, সঙ্গীহীন, তারা আত্মহত্যা করে এ সময়টায়। বসন্তকালে একাকিত্বের জ্বালা খুব বেশিরকম হয় কিনা। বসন্তই তো জানিয়ে দেয় যে গ্রীষ্ম আসছে, সুখের সময় আসছে, প্রেমের সময় আসছে, মিলনের সময় আসছে। সারা গ্রীষ্মকাল প্রেমিক প্রেমিকা জোড়ায় জোড়ায় ঘুরে বেড়াবে, আনন্দ করবে, আর যারা একা, মাঠে ঘাটে লেকের ধারে, সমুদ্রতীরে এত জোড়া দেখে আরও বেশি একা বোধ করবে, এই ভয়ে এই কষ্টে বসন্তকালেই, গ্রীষ্ম আসার আগেই আত্মহত্যা করে।
নীলা বোঝে না।
বুঝলে না তো! বুঝবে কেন? অন্যের কষ্টের কথা তুমি বুঝবে কেন!
দানিয়েলের ব্যঙ্গোক্তি নীলাকে স্পর্শ করে না। ত্রকাদেরোর দিকে হাঁটতে হাঁটতে সে অন্যমন হয়। ভাবতে থাকে রেলের চাকায় পড়ে খুলি উড়ে যাওয়া, গায়ের মাংস হাড় থেতলে ছিটকে পড়া দুটো যুবকের কথা।
আত্মহত্যা করল কেবল সঙ্গী ছিল না বলে, সামনের দুটো মাসে তাদের আনন্দ করা হবে না বলে! নীলার যদি কোনও প্রেমিক না থাকত, নীলা কি আত্মহত্যা করতে পারত? পারত না। প্রেমই তো জীবনের একমাত্র সুখের ঘটনা নয়, আরও কত কী আছে, ঝরাপাতার মর্মর শব্দ শোনা আছে, মেঘের সঙ্গে এলোমেলো ভেসে বেড়ানোর খেলা আছে, দীর্ঘ বিকেল জুড়ে চমৎকার একটি কবিতার বই পড়ে ফেলা আছে, জীবন পূর্ণ করার সহস্র উপায় পড়ে আছে।
মানুষকে বুঝতে শেখো নীলা, মানুষের কষ্টগুলোকে জানতে শেখো।
নীলার জানা হয় না অনেক কিছু। ত্রকাদেরোর ডাক্তারখানায় রোগীর ভিড় দেখে নীলা ঘাবড়ে যায়। এত লোকের মনে কী অসুখ তার জানতে ইচ্ছে করে। নীলা দেখে, খুব মন দিয়ে কেউ পত্রিকা পড়ছে, কেউ পাশের জনের সঙ্গে গলা নামিয়ে কথা বলছে, কেউ ঝিমোচ্ছে। নিকল এসেছিল তার বেড়ালের পেচ্ছাপের অসুখ হয়েছিল বলে সে মনোকষ্টে ছিল, তা সারাতে। দানিয়েল এসেছে, নীলা কলকাতা যাচ্ছে বলে মনে সে আঘাত পেয়েছে, সেটি দূর করতে। নীলা অনুমান করে ঝিমোচ্ছে লোকটির নিশ্চয় বউয়ের সঙ্গে দু রাত ঝগড়া হয়েছে বলে এসেছে, পত্রিকা পড়ছে ভদ্রলোকের নিশ্চয় কয়েক রাত ভাল ঘুম হয়নি বলে এসেছে, আর পাশের জনের সঙ্গে কথা বলছে যে সম্ভবত কথা যখন বলে জোরে বলে বলে এসেছে। আর যে ষোলো সতেরো বছর বয়সি মেয়েটি জানালায় তাকিয়ে আছে, মেয়েটি, নীলা অনুমান করে, প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল যাচ্ছে না বলে এসেছে। প্রথম বিশ্বের লোকের মনের সামান্য এদিক ওদিক হলে চলে না। মন থাকা চাই একশো ভাগ সুস্থ। মনের ভেতর কোনও রোগ শোক, কোনও দুঃখ কষ্ট, কোনও জ্বালা যন্ত্রণার চিহ্ন যেন না থাকে। শরীরে বল না থাকতে পারে, মনে যেন বল থাকে। আবেগ পরিমাণ মতো, কম বা বেশি হলে চলবে না। আর তৃতীয় বিশ্বে লোকের মনে পরিমাণ মতো কিছু নেই। এক কিলো শুয়োরে রসুনের কটি কোয়া চটকে দিলে স্বাদ হয় ভাল, তা নিয়ে প্রথম বিশ্বে গবেষণা চলে, তৃতীয় বিশ্বে চলে না, রসুনের পরিমাণ নিয়ে গবেষণা করার সময় নেই। পেটে ভাত নেই যাদের তাদের আবার রসুন, তাদের আবার মন। মন ধুয়ে জল খাওয়া গেলে, সে জলও খেত তৃতীয় বিশ্ব, খাবার জলের অভাব।
দানিয়েলের হয়ে আসতে ঘণ্টা দুই লাগে। ও ঠিক বেরিয়ে আসে গির্জার স্বীকারোক্তি ঘরের জানালা থেকে পাঁড় ক্যাথলিকের মতো। বেরিয়ে বিষণ্ণ মুখ, নীলার দিকে না এগিয়ে দরজার দিকে। নীলা ভিড় কেটে দানিয়েলকে ফেরায়।
নীলার দু বাহুর বেষ্টন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দানিয়েল বলে, আমাকে একা থাকতে দাও।
তাকে একা থাকতে দেয় না নীলা, কারও মন খারাপ হলে একা থাকতে দিতে সে শেখেনি। তার যদি মনে কষ্ট হত কোনও, মলিনা এসে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেন, চোখের জল মুছিয়ে দিতেন, আদর পেয়ে নীলার কষ্ট চলে যেত ত্রিসীমানার বাইরে। নীলার কখনও কোনও মনের ডাক্তার খুঁজতে হয়নি।
কেন তোমার ডাক্তারের কাছে যেতে হল। আমি যদি কারণ হই, আমার সঙ্গে কথা বলো। মনের যা কথা আছে খুলে বলো। আমাকে বলো, আমাকে তো তুমি ভালবাসো, ভালবাসো না? নীলা দানিয়েলের চিবুক ধরে নিজের দিকে মুখটি ফিরিয়ে বলে।
দানিয়েল চেঁচায়, বলেছি তো তোমাকে, আমাকে একা থাকতে দাও।
তোমার মন খারাপ, একা থাকলে মন আরও খারাপ হবে। ডাক্তারের ঘরে ঢোকার আগে মন তোমার এত খারাপ ছিল না। বলে নীলা দানিয়েলকে জড়িয়ে ধরে আবার দুহাতে। নীলার হাত ছুড়ে নিজেকে মুক্ত করে দানিয়েল ত্রকাদেরোর বেদিতে গিয়ে বসে। পাশে বসে নীলা বড় মমতায় একটি হাত রেখে দানিয়েলের কাঁধে, বলে, এত সুন্দর শহর, এত সাজানো, সবার পেটে খাবার আছে, সবার বাড়ি আছে, সবার পরনে কাপড় আছে, সবার জন্য নিরাপত্তা আছে, তার পরও কেন মানসিক রোগের ডাক্তারের কাছে যেতে হয় এত লোকের।
দানিয়েলের চোখে জল উপচে পড়ছে। নীলা আঙুলে তা মুছতে গেলে সে ঝটিতে সরিয়ে নেয় মুখ, মাথা, চোখ, চোখের জল।
তুমি বুঝবে না নীলা, অন্ন বস্ত্র আশ্রয়ই সব নয় জীবনে, তুমি তৃতীয় বিশ্বের চোখ দিয়ে সবাইকে বিচার করতে চাও। মন বলে একটি জিনিস আছে, আর সে মন সম্পর্কে তুমি কিছুই জানো না।
নীলা বলে, মন তৃতীয় বিশ্বেও আছে দানিয়েল, সে মন পাথর দিয়ে গড়া নয়। আমি জানি তুমি কষ্ট পাচ্ছ। আমিও অনেক কষ্ট পাই, আমার তো কোনও ডাক্তারের কাছে যেতে হয় না। কষ্টকে এত ভয় পাওয়ার কী আছে। আমি কোনওদিনই শুনিনি, আমার দেশে লোকেরা মনের অসুখ সারাতে ডাক্তারের কাছে যায়।
অনেকক্ষণ নীলা আর কথা বলে না, দানিয়েল তার চোখের জল প্রাণপণ আড়াল করে।
চলো সাঁস এলিজেতে হাঁটি গিয়ে, তোমার মন ভাল হবে।
না। দানিয়েল কোথাও যাবে না। সে বাড়ি ফিরবে। সে একা থাকতে চায়।
মনখারাপের হাত ধরে টানে নীলা, চলো সিনেমায় যাই।
না।
চলো কোনও ক্যাফেতে বসি।
না।
সেইনের ধারে হাঁটি।
না।
থিয়েটার?
না।
রাতে তোমাকে খাওয়াব লা তুর দারজোঁয়, চলো।
না।
মরো গিয়ে। যত্তসব ঢং।