Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ফরাসি প্রেমিক || Taslima Nasrin » Page 2

ফরাসি প্রেমিক || Taslima Nasrin

১.

ওঠো ওঠো।

ওঠো ওঠো বেলা অনেক।

সারারাত ঘুম হয়নি তার, ভোরের দিকে ক্লান্তিতে চোখ বুজে এসেছিল। ডাক শুনে সে ধড়ফড়িয়ে ওঠে, এ কোথায় নীলা, এ তার কলকাতার ঘর নয়, এ তার বিছানা বালিশ নয়। কিষানের দিকে চোখ পড়তে, কিষানের মোটা কালো মোচে, হোঁদল কুতকুতে চোখে, বসন্তের দাগ বসা গালে, তার চেতন ফেরে, এ তার স্বামীর ঘর, স্বামীর সঙ্গে সংসার করতে সে এখানে, এই রু দ্য ফুবো সানদানিতে, এই ছ’তলায়, এই প্যারিসে, ধবধবে সাদা বিছানা বালিশে। কিষান কোমরে তোয়ালে পেঁচিয়ে স্নানঘরের দিকে যেতে যেতে বলে, দেখো তো কাল রাতের বাসনপত্র ওভাবেই পড়ে আছে।

ওসব যে পড়ে আছে, নীলা রাতেই দেখেছে। বাসনপত্র কলকাতার বাড়িতে এরকম পড়ে থাকলে কোনওদিন সে ফিরে তাকায়নি। বাসন সরিয়ে নেবার, ধোবার, গুছিয়ে তুলবার লোক আছে। কিষান স্মরণ করিয়ে দেয়, কলকাতায় রাজার হালে বাস করা গেলেও প্যারিসে যায় না। এখানে মেথরের কাজও নিজের হাতে করতে হয়। কলকাতায় হলে নীলা অনেকক্ষণ বিছানায় শুয়েই কাটাত। চিত্রা চা আর খবরের কাগজ দিয়ে গেলে চা খেয়ে কাগজ পড়ে তবে বিছানা ছাড়ত। বিছানা ছেড়ে আরেক দফা চা। এ বাড়িতে চিত্রার বংশও নেই। নীলাকেই উঠতে হবে। উঠে কাল রাতের এঁটো বাসনপত্রের ঝামেলাও নীলাকেই ঘোচাতে হবে। ওঠে সে।

সুতি একটি শাড়ি গায়ে জড়িয়ে, চা চড়াতে রান্নাঘরে ঢুকে আঁতিপাতি করে খুঁজেও চা পাতা না পেয়ে, স্নানঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, চা পাতা কোথায় রেখেছ?

কিষান স্নান সেরে দাড়ি কামাচ্ছিল, অর্ধেক গাল ফেনায় সাদা, অর্ধেক কামানো। আয়না থেকে মুখ ফিরিয়ে, চোখে বিস্ময়ের ফেনা তুলে বলে, চা কে খাবে, চা তো আমি খাই না!

বলো কী! চা খাও না তুমি?

নীলার নেত্ৰমলে সংশয়। কৈশোর পার হয়েছে, অথচ চা পান করে না, ভারতবর্ষে এমন লোক নীলা কখনও দেখেনি।

নাহ।

আবার আয়না। ফেনার গাল টান করে ধরা। ফেনার গালে ধারালো ব্লেড।

আমার চা না হলে চলে না, সকালে অন্তত দু কাপ আমার লাগেই। নীলা দরজায় দাঁড়িয়ে আঙুলে চোখের পিঁচুটি মুছতে মুছতে বলে। পিঁচুটি যায়, সংশয় লেগে থাকে। ও আঙুলে ওঠে না।

চায়ের নেশা করো নাকি?

নেশা ঠিক না। অভ্যেস। নীলা বলে।

এই তো মুশকিলে ফেললে।

মুশকিলে?

এক বাড়িতে দুরকম অভ্যেস থাকলে মুশকিলই তো।

নীলা স্নানঘরের দরজা থেকে সরে আসতে আসতে শোনে কিষান বলছে, আমার দেরি হয়ে গেল।

পাঁউরুটি, মাখন, জেলি, কমলার রস, টেবিলে সাজিয়ে দেয় সে। স্বামী যখন সকালে আপিসে যায়, ঘরের বউদের ব্যস্তসমস্ত হয়ে এভাবেই প্রাতরাশের আয়োজন করতে হয়। বুদ্ধি হবার পর থেকে সে দেখছে, অনির্বাণের কখনও আওয়াজ দিতে হয় না যে তাঁর দেরি হচ্ছে বা কিছু, ভোরবেলা নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে মলিনা উঠে যান রান্নাঘরে, স্বামীর জন্য নিজে হাতে রুটি বেলে ভেজে গরম গরম আলুপুরি ডালপুরি, অনির্বাণের মুখে যা যা রোচে, ঠিক তাই তাই তৈরি করেন। সংসারধর্মে মলিনার কোনওদিন কোনও ত্রুটি হয়নি। নীলা মলিনার কন্যা, লোকে বলে মায়ের মতোই নাকি নম্র, শ্লীল, সুবোধ, শান্ত সে, মায়ের মতোই প্রিয়ংবদা, তার কেন ত্রুটি হবে স্বামীসেবায়।

গতরাতের বাসনপত্রও তড়িঘড়ি সরিয়ে নেয় নীলা।

কিষান সুটেড বুটেড সাহেব, টেবিলের সরঞ্জাম দেখে বলে, বাহ বেশ লক্ষ্মী বউ তো তুমি!

কেন লক্ষ্মী বলছ, টেবিলে খাবার এনে রেখেছি বলে?

কেবল কি তাই! কিষান চোখ ছোট করে হাসে।

অনির্বাণ এরকমও কখনও হাসেননি মলিনার দিকে চেয়ে। বরং প্রায় দিনই অনুযোগ করেছেন, সবজিটা একটু কম সেদ্ধ হয়েছে, ডিমের কুসুমটা ভেঙে গেছে, রুটির কোনাটা পুড়ে গেছে বলে। নীলা নিজের ভাগ্যকে বাহবা দেয় কিষানকে অসন্তুষ্ট তো নয়ই, বরং অল্পতে তৃপ্ত হতে দেখে।

তুমি ফিরছ কখন? নীলা জিজ্ঞেস করে।

ঠিক নেই। ঠিক নেই কারণ কিষান নটা পাঁচটা চাকরি করে না যে বলবে পাঁচটায় আপিস থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেব, রাস্তায় ট্রাফিকে নেবে পঁয়ত্রিশ মিনিট, আর ছ মিনিট যাবে নীচে রাস্তায় গাড়ি রাখার জায়গা খুঁজতে, আর দু মিনিট ওপরে উঠতে, ফিরব পাঁচটা তেতাল্লিশে। দুটো রেস্তোরাঁ চালায় কিষানলাল। মঁপারনাসে তাজমহল নামে একটি, দ্বিতীয়টি লাল কিল্লা, পনেরো এরনদিসমোয়। লাল কিল্লাটি ভাল চলছে না, নাম পালটালে ভাল চলবে, কিষানের বিশ্বাস।

একটা নাম ভাবো তো! কিষান বলে।

সারাদিন আমি কী করব? নীলা কিষানের মুখোমুখি বসে গালে হাত, মাথা ঝুঁকে থাকে ডানে, চোখ কিষানে, জিজ্ঞেস করে।

বসে বসে আমার কথা ভাববে।

আর?

আর কী? এ ভেবেই কি সময় ফুরোবে না?

যদি না ফুরোয়? নীলার উদাসীন প্রশ্ন।

এও কথা বটে।

খুব শিগরি নীলাকে নিয়ে তার বাইরে যেতে হবে, গরম জামা জুতো কিনতে, শিগরিটি ঠিক কবে, তা অবশ্য সঠিক করে কিষান বলে না।

নীলার চোখ কিষান থেকে সরে গিয়ে জানালায় আটকে থাকে। বাইরের স্বর্গে।

আচ্ছা ওটা, ওটা কি রাজার বাড়ি? আঙুল তুলে জানালার ওপারে গায়ে গায়ে মূর্তি বসানো একটি বাড়ি দেখায় সে।

রেল ইশটিশন। গার দ্য নর্দ।

বলো কী? ইশটিশন এত সুন্দর হয়?

নীলা দৌড়ে যায় জানালার দিকে।

শহরটা কখন ঘুরে দেখাবে? গলায় তার শিশুর আহ্লাদ। পতিব্রতার সাধ আহ্লাদ অত থাকতে নেই, তবুও।

কাল তো শহর খানিকটা ঘুরে দেখালাম, এত অস্থির হচ্ছ কেন, সবে তো এলে, দেখার জন্য তো সারা জীবন পড়ে আছে তোমার। বলে বেরিয়ে যায় কিষান।

দেখার জন্য সারাজীবন পড়ে আছে, নীলা তা জানে। তবু প্রতি লোমকূপে অস্থিরতার উদ্বাহু নৃত্য দেখে সে। ইস্পাতের ঘরটিতে বসে ঠিক যেরকম দেখেছিল। ওই ঘরে বসেও সে অপেক্ষা করছিল ছুটি পেতে, এ ঘরেও একই রকম অপেক্ষার অনুভব নীলার। ছুটি পাবার অপেক্ষা, কোত্থেকে ছুটি, কোথায় যেতে, স্পষ্ট করে কিছু সে জানে না যদিও। এ ঘরেও একই রকম ডানা ঝাপটায় প্রাণপাখি। ইস্পাতের দেয়ালের চেয়ে কিছু কম নির্জীব নয় এ বাড়ির দেয়াল।

জানালায় উদাসীন বসে থেকে নীলা দেখে নীচের রাস্তায় মানুষ হাঁটছে, গাড়ি ছুটছে, সুনসান নিস্তব্ধতার মধ্যে সভ্য সুন্দর সুচারু ব্যস্ত জীবন মানুষের। কলকাতা বিষম চিৎকারে ফেটে পড়ে এই মাঝ দুপুরে–ভোঁ বাজার, ট্রাকের চাকা ফাটার, ঠেলাগাড়ির, ফিরিঅলার, ভিখিরির, কুকুরের ঝগড়ার, জলকলে মেয়েমানুষের চুলোচুলির তীব্র শব্দ, হল্লা হুল্লোড়ে কলকাতা এত তেতে ওঠে যে, তিষ্ঠোনো দায়। নীলার মনে হতে থাকে পৃথিবীর বাইরে কোথাও চলে এসেছে সে, যেখানে জঞ্জাল নেই, ঝঞ্জাট নেই, বিসদৃশ কিছু নেই, অসংবৃত, অশোভন, অকুলীন কিছু নেই।

এ শহর তেতে ওঠে না, চেঁচায় না, তা ঠিক, কিন্তু এ শহরে সবারই ব্যস্ততা আছে কেবল তারই নেই, তারই নটা পাঁচটা নেই, এক তারই অপেক্ষা কেউ করছে না কোথাও। নীলা আনমনে তার অলস অবসর জুড়ে গাইতে থাকে ভেঙে মোর ঘরের চাবি, নিয়ে যাবি কে আমারে। গাইতে গাইতে নিজের স্বরে নিজেই চমকায় সে। গার দ্য নর্দ-কে মনে হতে থাকে ফরাসি রাজার বাড়ি, আর রাজার ছেলে সে বাড়ির জানালা খুলে দেখছে দূরে এক দৈত্যের ঘরে বন্দি এক রাজকন্যা, খোঁপা ভেঙে ঘন কালো দীঘল চুল গড়িয়ে পড়েছে তার। বুকে পিঠে। রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে বন্দিনীকে উদ্ধার করতে ছুটে আসছে, হাতে তার জাদুর কাঠি, সে কাঠি ছোঁয়ালেই দৈত্যের ঘরের দরজা আপনাতে সিসিম ফাঁকের মতো খুলে যাবে, রাজকন্যাকে ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে রাজপুত্র সেই প্রাসাদের সিংহদরজায় নামবে, তারপর দুজন হাত ধরে হেঁটে যাবে অন্তঃপুরের দিকে। নিজের হাতটির দিকে তাকায় নীলা, কিষান কখনও এই হাতটি হাতে নিয়েছে বলে তার মনে পড়ে না। হাতে হাত ছুঁয়ে গেছে নিশ্চয়ই, শখ করে এই সরু সরু আঙুলের দিকে, রাঙানো নখগুলোর দিকে বাহ বেশ তো ধরনের দৃষ্টিও, নীলার মনে পড়ে না, কিষান ছুড়েছে। নীলার শরীর নিয়ে অন্ধকারে প্রমোদবিহারে যখন সে নামে, তখন তার প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ কিষানের এ তার একেবারেই মনে হয় না, বড়জোর নীলার একটি অঙ্গ লাগি ফোঁসে কিষানের একটি অঙ্গই। নীলার লাবণ্যলতা আঙুল, সুবিন্যস্ত রক্তিম নখ, ভ্রমর কালো চোখ, দীঘল ঘন চুল অন্ধকারে নমশুদ্র অস্পৃশ্যের মতো পড়ে থাকে।

জানালা থেকে সরে সারা বাড়িতে বই খোঁজে নীলা। থানইটের মতো গোটা পাঁচেক টেলিফোনের বই, একটি ইংরেজি ফরাসি অভিধান, তিনটে রান্নার বই হিন্দি ভাষায়, দু বছর আগের সাতটি ল মন্দ পত্রিকা, চারটে হেরাল্ড ট্রিবিউন, আত তিনটে পর্নো ম্যাগাজিন, এ ছাড়া পাতি পাতি করে খুঁজেও নীলা আর ছাপার অক্ষরের কিছু পায় না। হাল ছেড়ে গানের জগতে হামলে পড়ে, হিন্দি সিনেমার গান, চারটে ইংরেজি, কিছু ভাংড়া, আর একখানা এডিথ পিয়াফ, এই। রবীন্দ্রসংগীতের রও নেই, এমনকী ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের ছিটেফোঁটাও ভাণ্ডারে নেই। এডিথ পিয়াফ চাপিয়ে নীলা দেখে একই সুরে কিচিরমিচির করে যাচ্ছে এ দেশের ছোট্ট চড়ুই। অচেনা জায়গায় অচেনা কিচিরমিচির শুনলে আরও একা লাগে। এডিথ পিয়া বন্ধ করে ঘর থেকে ঘরে হাঁটে নীলা। সঙ্গে হাঁটে তার পায়ের শব্দ শুধু। অতঃপর এক বর্ণ ফরাসি না বোঝা নীলা টেলিভিশন খুলে সাদা মানুষের হাসি ঠাট্টা দৌড় ঝাঁপ দেখতে থাকে মন দিয়ে। মগ্নতা ভাঙে ফোনের শব্দে, তখন বিকেল, ওপাশে কিষানের স্বর, কী রেঁধেছ গো গিন্নি?

গিন্নি তো কিছু রাঁধেনি।

কিষান বলে, তা হলে খাব কী গো? স্বামীকে না খাইয়ে মারবে?

নীলা ঠিক কী উত্তর দেবে বুঝে পায় না। আপাতত বিধবা হওয়ার ইচ্ছে তার নেই।

কিষানের গম্ভীর গলা, একেবারে ভুলে গেছি, বুঝলে। তোমাকে দরজার চাবি দিয়ে আসা উচিত ছিল। বাড়িতে আগুন ধরলে…

আগুন ধরবে কেন? নীলা জিজ্ঞেস করে।

আরে, দুর্ঘটনা ঘটে না? চুলো টুলো থেকে। সাবধানের মার নেই।

তা ঠিক, সাবধানের মার নেই। আগুন ধরলে সে আগুন কী করে নেভাবে সে নিয়ে ভাবছিল, এবং বুঝে পাচ্ছিল না আগুনের সঙ্গে চাবির সম্পর্ক কী হতে পারে। জিজ্ঞেস করল, কী হবে আগুন ধরলে?

তখন চাবি থাকলে বেরোতে পারবে। তেষ্টা পেলে জল পান করার মতো সোজা উত্তরটি দেয় কিষান।

ও। নীলা বোঝে উত্তরটি, ঘরে আগুন লাগলে প্রাণ বাঁচাতে ঘরের বাইরে যাবার স্বাধীনতা তার সম্পূর্ণই আছে। আগুন না লাগলে প্রাণ বাঁচানোর প্রশ্ন নেই, প্রশ্ন ওঠে না।

কিন্তু যদি ওঠে!

রান্নাঘরে এঁটো বাসন ধুতে ধুতে, ভাত ডাল আর সবজি রাঁধতে গিয়ে, বারবারই ভাবল সে, যদি ওঠে!

নীলার ভাত গেল পুড়ে, সবজি রইল অসেদ্ধ, ডাল হয়ে গেল নুনে তেতো।

সন্ধের পর বাড়ি ফিরে ভারী শরীরটিকে কিষান ছুড়ে দিল সোফায়।

কাপড় জামা খোলো! হাত মুখ ধোও, বাইরে থেকে এসেছ। নীলা বলে, বলে টের পায়, বোনের স্নেহ উপচে পড়ছে কণ্ঠে তার।

এ কি তোমার নোংরা কলকাতা পেয়েছ যে বাইরে থেকে এলে ধুলোবালি দূর করতে হাত মুখ ধুতে হবে! হা হা! কিষান বলে।

সারাদিন এমন ভারী জুতো পরে আছ, জুতোটা খোলো অন্তত! বলে নীলার মনে হয়, ঠিক এভাবে মলিনা তাঁর পুত্রধন নিখিলকে জুতো খুলতে বলেন।

খুলে দাও না। কিষান দু পা এগিয়ে দেয় নীলার দিকে।

কিষানের পায়ের কাছে বসে সরু আঙুলে জুতোর সরু ফিতে ঢিলে করে জুতো খোলে নীলা, মোজা খোলে।

নিজেকে এবার ঘরের দাসীর মতো মনে হয়, যেন চিত্রা সে, চিত্রা এরকম জুতো খুলে দেয় বাড়িসুদ্ধ লোকের।

স্নানঘরে ময়লা কাপড়ের ঝুড়ি আছে। ওতে রেখে দাও। কাল ধুয়ে দিও সব। কিষানের কণ্ঠ স্বামীর অথবা প্রভুর। বাড়ির বউকে অথবা দাসীকে যে কণ্ঠে কিছুর আদেশ করা হয়, এ ঠিক সে কণ্ঠ।

ময়লা মোজা দুটো স্নানঘরে নিতে নিতে নীলা ভাবে, রাতে বিছানায় তাকে দিব্যি পতিতা সাজতে হবে, পতিতারা যেমন করে দুটো পয়সার জন্য শরীর বিকিয়ে দেয় তেমন করে বিকোতে হবে তার নিজেকে। পতিতার খদ্দেরে এবং স্বামীতে কোনও পার্থক্য আছে কি না। নীলা ভাবে। যে পার্থক্যটি সে দেখে, তা হল পতিতাকে তার পাওনা বুঝিয়ে তবে খদ্দেরকে পার পেতে হবে, কিন্তু স্ত্রীর পাওনা না মিটিয়েও স্বামী পার পেয়ে যায় বা যেতে পারে। পতিতার স্বাধীনতা স্ত্রীর চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে বেশি বলে তার মনে হয়।

নীলা ভাবে, মা বোন আর পতিতা এই তিন চরিত্রে দক্ষ অভিনয় করতে হয় স্ত্রীকে না কি এ অভিনয় নয়, এই তিন চরিত্র নিয়েই জন্ম হয় যে কোনও মেয়ের।

কী কেমন লাগছে প্যারিসে? কিষান বলে।

নীলা জানালায় উদাস তাকিয়ে উত্তর দেয়, এই প্রথম ভারতের বাইরে আসা। মাঝে কোনও সমুদ্দুর নেই, তবু মনে হয় যেন সাত সমুদ্দুর পেরিয়ে এসেছি। অন্য এক জগতে, বড় অচেনা।

কিষান ধীরে মাথা নাড়ে, ধীরে বলে, যাক না কটা বছর, দেখবে ভারতকেই অচেনা লাগছে। জীবন এরকম নীলা, অভ্যেস, আর কিছু নয়। এখানকার জীবনে অভ্যস্ত হলে ভারতের জীবনে তুমি খাপ খাওয়াতে পারবে না, যদিও ভারতেই তোমার জন্ম, বড় হওয়া।

তা কী কী করলে সারাদিন? কিষান প্রশ্ন করে।

সারাদিন একা লেগেছে। ওদের ফোন নম্বর থাকলে কথা বলতে পারতাম..

ওদের কাদের?

ওই কাল রাতে যারা এসেছিল..

ওদের সঙ্গে খামোকা কথা বলতে যাবে কেন? কাল রাতের ব্যাপার কাল রাতেই শেষ। কাজের কাজ হল দেশে ফোন করা।

কিষান কলকাতায় ফোন করে। মধ্যরাত ওখানে, ঘুমোবার আয়োজন চলছে। নীলা পৌঁছেছে, ভাল আছে, কাল অনেকটা বিয়ের অনুষ্ঠান মতো হল এ বাড়িতে, কিষান জানাল। অনির্বাণের সঙ্গে কথা হওয়ার পর নিখিলের সঙ্গে হয়, শেষে মলিনার মলিন কণ্ঠের সঙ্গে।

কী যে ফাঁকা লাগছে বাড়ি। তুই তো কখনও দূরে যাসনি আগে। মলিনার কণ্ঠ ওপাশে কাঁদে।

ধমকে ওঠে নীলা, থামো তো! বোকার মতো কাঁদছ। ওই বাড়িতে, ওই বালিগঞ্জে আমি পচে মরলে তোমার বুঝি ভাল লাগত!

কেমন আছিস, বল আমাকে। মলিনা জিজ্ঞেস করেন।

নীলা উচ্ছ্বসিত, ভাল আছি, খুব ভাল আছি। এখানে সব কিছু খুব সুন্দর। কাল রাতে খুব মজা হল। অনেক লোক এসেছিল। চমৎকার লোক সব।

ওপাশে তবু বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদেন মলিনা।

নীলার রাগ হয় কান্না শুনলে। মা ব্যাপারটি বড় বিচ্ছিরি, মেয়ের বিয়ে না হলে কেঁদে বালিশ ভেজান, আর হলেও বুক ভাসান।

কিষান মদ নিয়ে আয়েশ করে বসে। খেতে খেতে তার রেস্তোরাঁ লাল কিল্লায় লাল বাতি জ্বলছে জানায়। শিগরি নাম পালটাতে হবে। নীলা ঠিক বুঝে পায় না, নাম পালটালে লাল থেকে বাতি সবুজে যাবার কী কারণ। প্রশ্ন করলে কিষান হাসে, বলে এ সব বুঝবে না। বুঝিয়ে দাও, বুঝব। নীলা আবদার করে। বোঝালেও নীলা বুঝবে বলে কিষানের মনে হয় না। মেয়েদের ব্যবসাবুদ্ধি সাধারণত থাকে না বলেই সে জানে।

সুরুচি, খাবার দাবার, তৃপ্তি এই নামগুলো নীলা প্রস্তাব করে রেস্তোরাঁর নামের জন্য। কিষান উড়িয়ে দেয় নামগুলো মদগন্ধ হাওয়ায়। চলবে না। কী চলবে তা হলে? চলবে গান্ধী। গান্ধীর সঙ্গে ভারতীয় খাবারের সম্পর্ক কী? সম্পর্ক না থাকলেও গান্ধীর সঙ্গে ফরাসিদের সম্পর্ক আছে, ফরাসিরা গান্ধী নামটি যত জানে, লাল কিল্লা তত জানে না। রেস্তোরাঁয় খাবারের মান কতটুকু পালটাবে? সে একই থাকবে, আগের বাবুর্চিই রাঁধবে, আগের লোকরাই পরিবেশন করবে।

বোতল অর্ধেক খালি হলে কিষান খেতে বসে। স্বামীকে থালায় ভাত তরকারি বেড়ে দিয়ে চুক চুক করে দুঃখ করে নীলা, রান্না ভাল হয়নি বলে। অপরাধী মুখ করে সে বসে থাকে সামনে। খেতে খেতে কিষান বলে, শত হলেও বউয়ের হাতের রান্না।

নীলা জানে স্ত্রীর হাতের রান্না খেতে সব স্বামীই পছন্দ করে। অনির্বাণ যদিও মলিনার রান্নার ক্রটি সকাল বিকাল আবিষ্কার করতেন, কিন্তু চিত্রার হাতে রান্না কিছুতে মুখে তুলতেন না। একবার মলিনা জ্বরে পড়ে শুয়ে রইলেন, চিত্রা রান্নাবান্না করল, নিখিল খেল, নীলা খেল, কিন্তু অনির্বাণ খাবেন না। মলিনাকে জ্বর গায়ে নিয়ে রাঁধতে হল, তবে অনির্বাণ খেলেন। এতে অনির্বাণই যে কেবল তৃপ্তি পেয়েছিলেন তা নয়, মলিনাও পেয়েছিলেন।

কিষান খাওয়া শেষে বলে আমি বাচ্চুকে, রেস্তোরাঁয় যে ছেলেটি রাঁধে, একদিন বাড়িতে পাঠিয়ে দেব রান্না শেখাতে।

নীলা হেসে বলে, রান্নাও অভ্যেসের ব্যাপার।

রান্না যেমন অভ্যেসের ব্যাপার, স্বামীর সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমোনোও। বিয়ের পর প্রথম যখন কিষান শুয়েছিল নীলার সঙ্গে, সারারাত হাঁসফাঁস করেছে নীলা, হাত পা ছুড়ে শোয়া, এপাশ থেকে ওপাশে গড়ানো সম্ভব হচ্ছিল না বলে। ধীরে ধীরে বেশি অর্ধেক জায়গা ছেড়ে দেবার, হাত পাকে শেকলবন্দি করার এবং নাক ডাকার শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যেতে অভ্যস্ত হয়েছে সে, এটিকে ধাতস্থ করেছে ধীরে, এটিই মজ্জাগত হবে তার।

কিষান যখন শাড়ি সরিয়ে হাঁ মুখ ডুবিয়ে দিচ্ছে বুকে, আহ্লাদি গলায় বলে নীলা, আমি কিন্তু কাল একটু রাস্তায় হাঁটতে চাই।

কেন?

এমনি?

এমনি এমনি কেউ বেরোয় নাকি?

দূরে যাব না। কাছেই।

এই নোংরা এলাকায় কী হাঁটবে?

নোংরা বলছ? এমন ঝকঝকে।

একা হাঁটবে? হারিয়ে যাও যদি। সামনের শনিবার আমি সময় পাব, তখন তোমাকে ইফেল টাওয়ার দেখাতে নেব।

এদিকে ইফেল টাওয়ারের স্বপ্নে নীলা বিভোর, ওদিকে কিষান পরমানন্দে নীলার টাওয়ার এর চুড়োয়..

০২.

ছদিন অপেক্ষা করার পর সামনের সেই শনিবার এল। নীলাকে গরম জামা জুতো কিনে দিয়ে ইফেল টাওয়ার দেখিয়ে মঁপারনাসে তাজমহল রেস্তোরাঁয় থামে কিষান। মালিকের বউ এসেছে, ছড়িয়ে পড়ে খবর।

কালো সুট নেকটাই মোজাম্মেল এক গাল হেসে এগিয়ে আসে দিদি কী খাবেন বলুন, চা কফি, নাকি ঠাণ্ডা কিছু?

নীলা চা খাবে, কারণ তার মনে হচ্ছে বছর চলে যাচ্ছে তার চা খাওয়া হচ্ছে না। চায়ের তৃষ্ণা চা ছাড়া আর কিছুতে মেটে না।

কী চা, ভারতীয় চা, না কি কালো চা?

নীলা অবাক হয়, ভারতীয় চা কী রকম শুনি?

দুধ দিয়ে, এলাচ লবঙ্গ দিয়ে। নীলা ওয়াক থু করে, সে চায়ে দুধই নেয় না, আবার এলাচ লবঙ্গ।

চা এল। এক দঙ্গল বাঙালি ছেলেও এল। রান্না ফেলে বাচ্চুও। এদের কারও বাড়ি যশোর, কারও রংপুর, কারও বরিশাল। হৃদয়ে নীলার খুশির জোয়ার ওঠে, বলে, আমার বাবার বাড়ি ছিল ফরিদপুর। দেশভাগের সময় বাবা পূর্ববঙ্গ ছেড়ে এলেন, আর ফিরে যাননি।

ছেলেগুলোও নীলাকে, যেন ওদের পাড়াতুতো বোন, মেঘনা যমুনা পদ্মার গল্প শোনাল। দেখে কিষান ক্যাশবাক্সের সামনে থেকে চেঁচায় বাঙালির আড্ডা হচ্ছে তাই তো! এই বাঙালির মতো অলস জাতি এ জগতে নেই। কেবল খাও, ঘুমোও আর আড্ডা দাও। চলো চলো।

আরে চাটা খেতে দাও তো। নীলাও গলা তোলে। বাঙালি পেলে এই হয়, গলায় জোর বাড়ে। কেবল কি গলায়, নীলা অনুমান করে, খানিকটা মনেও।

চা খেতে খেতে নীলা জানল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে লেখাপড়া করেছে, সর্বোচ্চ ডিগ্রিও নিয়েছে, ঢাকায় চাকরি জোটেনি বলে উপার্জনের আশায় মোজাম্মেল ফ্রান্সে এসেছে আজ তিন বছর। গলা কাটা পাসপোর্ট নিয়ে এ দেশে এসেছে।

এ আবার কী জিনিস?

এ হচ্ছে অন্যের পাসপোর্টে ছবি থেকে গলা কেটে নিয়ে নিজের গলা বসিয়ে দেওয়া।

নীলা শিউরে ওঠে।

মোজাম্মেল বলে, কী আর করা, বিদেশের ভিসা তো পাব না..ভিসাঅলা পার্সপোর্ট কিনতে পাওয়া যায়, জমিজমা বাবার যা ছিল বিক্রি করে পাঁচ লাখ টাকায় সে পাসপোর্ট কিনে, তারপর…

নীলা উৎসুক।

তারপর ফ্রান্সে এসে কাজ শুরু করলাম।

কী কাজ?

রাস্তায় গোলাপ বিক্রি।

পদার্থবিজ্ঞান পড়ে ফুল বিক্রি?…কেন এখানে ভাল কোনও চাকরি পেলেন না? উৎকণ্ঠায় কাঁপে নীলার স্বর।

মোজাম্মেল হেসে বলল, আমাদের লেখাপড়ার কোনও মূল্য নেই এখানে। ঝাড়ুদারের চাকরিও করেছি কিছুদিন।

এই রেস্তোরাঁয় কাজ পাওয়ার আগে মোজাম্মেল কমপিউটার বাক্সবন্দি করার কাজ করত। পয়সা কম জোটে এ সব কাজে, কারণ বৈধ কাজ নয় এ সব। কাগজ না হওয়া তক চাকরি বাকরি করার অনুমতি দেয় না এ দেশের সরকার। যা করতে হয়, লুকিয়ে। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে। তাই অবৈধ। কাগজ সম্পর্কে কৌতূহল বাড়ে নীলার। কেবল মোজাম্মেলই নয়, জুয়েল নামের একটি বাচ্চা বাচ্চা মুখের ছেলেও এই শব্দটি উচ্চারণ করেছে। নীলা অনুমান করে সবাই যে দুর্লভ জিনিসটির অপেক্ষা করছে রাতদিন, যেটির জন্য প্রার্থনা, যেটির জন্য প্রাণ পেতে বসে থাকা, যেটি পেলে জীবনের অন্ধকার, অসুন্দর, অবিন্যাস দূর হবে, সে হল কাগজ।

কী এই কাগজ।

এ দেশে থাকার অনুমতি।

নীলার কৌতূহল দানোর মতো বাড়ে। মোজাম্মেল অসংকোচে বলে যায়, এদেশ থেকে দুবার তাড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, শেষে মামলা করলাম থাকার কারণ দেখিয়ে, ঝুলে আছে মামলা, যদ্দিন ঝুলবে, তদ্দিন থাকতে পারব…

কারণটা কী?

দিদি কী বলব…এ সব বলতেও খারাপ লাগে..নতুন পাসপোর্ট করলাম হিন্দু নাম নিয়ে, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে..আমার দেশে ফেরা নিরাপদ নয়, এই বলে…

ডাহা মিথ্যে কথা। মোজাম্মেল নিজেই স্বীকার করছে। মিথ্যে শুনলে নীলার বড় রাগ হয়, কিন্তু মোজাম্মেলের মিথ্যে শুনতে শুনতে নীলা লক্ষ করে, তার রাগ হচ্ছে না।

কী বলব দিদি, মোজাম্মেল মাথা চুলকে বলে, এ সব লুকোনোর জিনিসও নয়। সবাই জানে গরিব দেশের ছেলেরা কীভাবে আসে এ সব দেশে, কী করে থাকে…

মিথ্যে না বললে হয় না?

হয় না। মোজাম্মেল বলে সে যদি বলে যে লেখাপড়া শেষ করে বেকার বসে থাকতে হচ্ছে ঢাকায়, এ দেশে সে তার বিদ্যে খাটাতে চায়, তার শ্রম খাটাতে চায়, একটি স্বাস্থ্যকর সুন্দর জীবন যাপন করতে চায়, যে জীবনের স্বপ্ন সবাই দেখে, তবে এ দেশ থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হবে। রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলে দিতে পারে, অর্থনৈতিক আশ্রয় দেবে না।

ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের কী কোরে করে, নীলার সামান্য অভিজ্ঞতা হয়েছে বিমানবন্দরে। এ নিয়ে প্রশ্ন করার রুচি হয় না তার।

মোজাম্মেলের পাশে বসে জুয়েল বলে যায় যে সে মেট্রো ইশটিশনে ফল বিক্রি করত, পুলিশের জ্বালায় ও কাজও তার ছেড়ে দিতে হয়েছে।

পুলিশ জ্বালায় কেন?

মেট্রোতে ফল বিক্রি নিষিদ্ধ, তাই। থানায় ধরে নিয়ে যায় প্রায়ই, কাগজ দেখতে চায় কাগজ…

কাগজ কি কারও নেই?

আছে কারও কারও, কেউ কেউ আবার মোটা টাকার চুক্তিতে ফরাসি মেয়েদের বিয়ে করে, বিয়ে করলে থাকার অনুমতি জোটে, নাগরিকও হওয়া যায়। আর বহু বছর মাটি কামড়ে পড়ে থাকলে একসময় হয়তো বৈধ করে নেয়, একধরনের ক্ষমাঘেন্না করে থাকতে দেওয়া আর কী!

মোজাম্মেল আর জুয়েল বেলভিলের এক বাড়িতে থাকে, সঙ্গে আরও পাঁচজন বাঙালি ছেলে, গাদাগাদি করে ওই এক ঘরেই।

সাতজন? নীলা ঠাণ্ডা চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করল।

কী করব দিদি, খরচ বাঁচাই।

কিষান রেস্তোরাঁর হিসেবপত্তর গুছিয়ে রব দেয়, চলো চলো।

নীলা বলে, কিন্তু আমি যে আরেক কাপ চা খাব!

চা তো খেলেই।

এক কাপে কী হয়! তোমাকে তো বলেছিই আমি খুব চা খোর। নীলা মাথা তুলে স্পষ্ট স্বরে বলে, অনুনাসিক অনুনয় নয়।

কিষানের চলো চলো রবে নীলাকে ঘিরে যারা বসেছিল, এক এক করে সরে যায়, মোজাম্মেল ছাড়া।

দেশে ফিরে যান না কেন? নীলা গলা চেপে প্রশ্ন করে।

দেশে? এত বছর এখানে কাটিয়ে দিলাম এখানে ভাল রোজগারের আশায়, এখন দেশে ফিরে করবটা কী, খাবটা কী, চাকরিও এই বয়সে কী করব, বয়সও চলে গেছে চাকরির। আর মুখ দেখাবই বা কী করে। খালি হাতে ফিরতে হবে সংসারে। এখান থেকে ছোট কাজ করেও অন্তত কিছু টাকা দেশে পাঠাতে পারি। ছোট ভাইটার লেখাপড়ার খরচ পাঠাচ্ছি।

জুয়েল আরেক কাপ কালো চা দিয়ে যায় নীলাকে, ওতে দ্রুত চুমুক দিয়ে সে জিজ্ঞেস করে, এতকাল লেখাপড়া শিখে তা হলে আপনার লাভ হল কী?

লাভ কিছু নেই দিদি। মোজাম্মেল চেয়ার ছেড়ে ওঠে।

ওরাও এখানে আর যারা আছে, সবাই কি আপনার মতোই, মানে এভাবেই এসেছে এদেশে?

সবাই।

সবাই শিক্ষিত? নীলা উদগ্রীব জানতে।

সবাই শিক্ষিত, সবাই। বাচ্চু তো ডাক্তার।

এখানে ডাক্তারি করে না?

নাহ, চাকরি কে দেবে? দেশ থেকে ডাক্তারি পাশ করলেও এ দেশে আবার পরীক্ষায় বসতে হয়। অবৈধভাবে এ দেশে এলে সে পরীক্ষায়ও বসা যায় না। ভাষাটা বড় সমস্যা। বলতে পারলেও লিখতে পারা যায় না।

আপনার আত্মীয়রা জানে যে রেস্তোরাঁয় কাজ করছেন? নীলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করে।

জানাই না। লজ্জা লাগে…

মোজাম্মেল হেসে ওঠে, হাসতে হাসতে বলে, আমার আত্মীয়রা কী জানে জানেন তো? আমি ডিসি-র পদে আছি…লোকে জানে ডেপুটি কমিশনার, আমি জানি ডিস ক্লিনার।

নীলাও হেসে ওঠে। কিষান অনাহুতের মতো সে হাসিতে ঢোকে, এত হাসির হচ্ছে কী এখানে! চলো চলো।

মোজাম্মেল সরে যায়।

বাহ রান্নাঘরটা দেখে যাব না।

নীলা রান্নাঘরে ঢুকে দেখে বরিশালি সোহেল পেঁয়াজ কাটছে। বাচ্চু কড়াইয়ে তেল ঢালছে। জুয়েল থাল মাজছে।

কী ডাক্তারবাবু, কী রান্না করছেন?

ঝোল। বাচ্চু হেসে বলে।

কীসের ঝোল?

সবকিছুর।

সবকিছুর মানে? মাছ না মাংসের? কোনটার?

মুরগি গোরু ভেড়া মাছ ডাল সবজি সবকিছুরই এক ঝোল।

নীলা বলে, হায় এ কী কাণ্ড। সব রান্নার এক ঝোল হবে কেন?

হবে দিদি। এটাই নিয়ম।

এ তো সত্যিকার ভারতীয় খাবার হল না তবে।

ঠিক ভারতীয় খাবার নয়। ফরাসি স্বাদে ভারতীয় খাবার।

বাচ্চু জানাল সে জার্মানিতেও এ কাজ করেছে, ওখানে রাঁধত জার্মান স্বাদে ভারতীয় খাবার।

নীলা বলে, আমার বেশ অবাক লাগছে দেখে যে ছেলেরা পেঁয়াজ কাটছে রান্না করছে, থাল ধুচ্ছে দেখতে। এ দৃশ্য আমার জীবনে এই প্রথম দেখছি।

বাচ্চু এক বাটি পেঁয়াজ ঢেলে দিয়ে কড়াইয়ে, বলে, জীবনে কোনওদিন পানিটা গ্লাসে ঢেলে খাই নাই। জগ থেকে কেউ পানি ঢেলে দিত গ্লাসে, তারপর খেতাম। আর রান্নাঘর কাহাকে বলে এবং ইহা কী, এই বিষয়ে ধারণা আমার ছিল না। হয়েছে ইয়োরোপে এসে।

তেলে পেঁয়াজে চি চি শুরু হয়, আর গলা উঁচিয়ে নীলা বলে একরকম ভালই হয়েছে, কী বলেন। এখন বুঝতে পারছেন, মেয়েরা কী কাজটা করে রান্নাঘরে!

বাচ্চু পেঁয়াজ নাড়তে নাড়তে ধোঁয়া থেকে চোখ সরিয়ে মিষ্টি হেসে বলে দিদি, একদিন আসুন, কিছু রান্না শিখিয়ে যান।

বলে কী, আমিই কি রান্না জানি। আমিই কি গেছি রান্নাঘরে কোনওদিন। এ তো মায়েদের কাজ।

এ সব মায়েদের কাজ। মলিনার কাজ। নীলা এমনই জানে। এমনই সে দেখেছে সারা জীবন যে মলিনা রান্না করে খাবার নিয়ে আসেন টেবিলে, স্বামী সন্তানদের থালে খাবার বেড়ে দেন। স্বামী সন্তান গল্প করতে করতে খায়। মলিনা দাঁড়িয়ে থাকেন টেবিলের পাশে, কারও কিছু যদি লাগে হঠাৎ। নুন বা কিছু। ঝোল বা কিছু। জল বা কিছু। নীলা মনে করতে চেষ্টা করে মলিনাকে কখনও সে খেতে দেখেছে কি না কারও সঙ্গে বসে। না দেখেনি।

বাইরে ঝকঝকে রোদ দেখে গরম কাপড়ে গা না মুড়েই রাস্তায় বের হতে চায় নীলা। কিষান টেনে তাকে গরম ঘরে ঢুকিয়ে নবিশ বউটিকে বলে, ও রোদে তাপ নেই। তা যে নেই, তা আপাদমস্তক মোড়া লেপের পুঁটলি হয়ে রোদের তলে দাঁড়াতেই হুল ফোঁটানো ঠাণ্ডা গায়ে কামড় মেরে বোঝায়। মলিনাকে লেখা চিঠিটি ফেলতে নীলা একটি পোস্টাপিস খোঁজে। থিরথির করে থুতনি কাঁপছে তার, খোঁজে। এ শহরে খুঁজতে হয় না কিছু, হাতের কাছেই যেন দাঁড়িয়ে থাকে সব। চোখ মেললেই বস্তু মেলে। পোস্টাপিসে গিয়ে লম্বা লাইন দেখে লাইন না দাঁড়িয়ে সামনে এগোতে গেলেই কিষান অস্থির নীলার গরম জামার ঝুল ধরে টেনে পেছনে এনে কানে মন্ত্র দেয়, এ দেশে যেখানেই যে লাইন দেখবে, শ্রদ্ধা করবে। এ দেশ সমতার দেশ। যে আগে, সে আগে।

নীলা এক পাক নেচে ছোটবেলার খেলার মতো বলে, আগে গেলে বাঘে খায়, মাঝে গেলে নাচে গায়, শেষে গেলে দেশে যায়…

লাইনে দাঁড়াতে হয় না। পোস্টাপিসের ভেতরেই মেশিন বোঝাই। হলুদ একটি মেশিনে চিঠিটি রাখতেই মেশিন বলে দিল, কত টাকার টিকিট লাগবে এতে, টাকা দিলে টিকিট বেরিয়ে এল। সে টিকিট চিঠির গায়ে লাগিয়ে বাক্সে ফেলে দিল, ব্যাস। এক মিনিটের কাজ। কাজ নয় তো জাদু। শহরের মোড়ে মোড়ে ম্যাজিক বাক্স। কার্ড ঢোকালে সুড়সুড় করে টাকা বেরিয়ে আসে, পয়সা ঢাকালে মেশিনের পেট থেকে চা কফি বেরোয়, ঠাণ্ডা পানীয়ের বোতল বের হয়, খেলনা গাড়ি বেরোয়, চকলেট বিস্কুট বেরোয়। আরও ম্যাজিক দেখতে নীলার এবার অনুনাসিক অনুনয়, চলো শহরটা আরও ঘুরে দেখি।

কিষান নীলার জন্য একটি উপহার কিনবে, শহর দেখার জন্য সারা জীবন পড়ে আছে।

কী সে উপহার?

বলা যাবে না।

ফুরফুরে মন নিয়ে গাড়িতে ওঠে কিষান। মোঁপারনাস থেকে রু দ্য রেনের ভেতর দিয়ে, শাঁ জার্মা দি প্রে বাঁয়ে রেখে, বুলোভার্ড শাঁ জার্মায় যেতে থাকে গাড়ি আর নীলা হাঁ হয়ে দেখতে থাকে ঝকঝকে ক্যাফে, রেস্তোরাঁ, সিনেমা। ইচ্ছে করে গাড়ি থেকে নেমে আর সব মানুষের মতো সেও হাঁটে, কোনও ক্যাফেতে থেমে আর সব মানুষের মতো বসে চা খায়, চা খায় আর মানুষ দেখে, ঝকঝকে মানুষ, ফুটফুটে মানুষ।

শাঁ মিশেলে গাড়ি রেখে জিবারে ঢোকে কিষান। বইয়ের সমুদ্র। এই সমুদ্রে নীলা ডোবে ভাসে, তল পায় না। এই সমুদ্রের জল তার চেনা নয়। চেনা জলের অন্তত একটি ছোট্ট সরোবর তার আছে, রেখে এসেছে কলকাতার বাড়িতে। বালজাক, ভিক্টর হুগো, গুস্তব ফ্লবের, মোপাসাঁ, আলবেয়ার কাম্যু, জঁ পল সার্ত্রের বইগুলো সে নেড়ে চেড়ে দেখে, বোদেলেয়র দেখে, র‍্যাঁবো দেখে, পল ভারলেইন, পল এলুয়ার দেখে, এঁদের বাংলা অনুবাদ সে কবেই পড়েছে, মূল ভাষায় বইগুলো হাতে নিয়ে নীলার অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়। মোহগ্রস্তের মতো নীলা একটির পর একটি বই হাতে নেয়, ঘোর আবেশে শোঁকে বইগুলো, বুকে চেপে ধরে। পেছনে ক্রমাগত ডেকে যায় কিষান, নীলার কানে পৌঁছে না কারও ডাক।

জিবার থেকে নীলাকে প্রায় টেনে বার করতে হয়। তখনও বিহ্বল চোখ নীলার, তখনও মোহাবিষ্ট, তখনও বিবশ অস্তিত্ব তার, ফরাসি ভাষাটা শেখা দরকার আমার।

কিষান দ্রুত গাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলে, সে তো শিখতেই হবে। যে দেশে থাকবে, সে দেশের ভাষা না জানলে চলবে কেন!

শিখতে চাই ফরাসি সাহিত্য পড়তে। নীলা বলে।

ও তুমি তো আবার বইপোকা বলে শুনেছি। কিষান খ্যাক করে হাসে। ঠোঁট বেঁকে থাকে সে হাসিতে।

কলকাতায় বইপোকা বলে নীলার দুর্নাম আছে। বই পেলে সে নাওয়া খাওয়া তো ভোলেই, নিজের নামও নাকি ভুলে যায়, বাড়ির লোকেরা তো বলেই, বাড়ির বাইরেও বলে।

কী ব্যাপার জোরে হাঁটো। কিষান তাড়া দেয়।

চলো না এই ফোয়ারাটার সামনে বসি।

না আজ নয়।

ওটা তো সেইন নদী। চলো নদীর ধারে হাঁটি।

আরেকদিন। কিষান কাটিয়ে যায়।

গাড়িতে উঠে কাগজে মোড়া একটি প্যাকেট নীলার হাতে দিয়ে কিষান বলল, বাড়িতে নিয়ে খুলবে।

প্যাকেটটি কোলের ওপর রেখে, নীলা আবার অস্থির হয়, আচ্ছা, এখানে বেশ তো সিনেমা, চলো সিনেমায় যাই।

ধুর, ও তুমি বুঝবে না, সবই ফরাসি…কিষানের ঠোঁট উলটে থাকে।

কেন ইংরেজি ছবি নেই বুঝি…

ফরাসিরা ইংরেজি জানে না, জানতে চায় না।

আচ্ছা নাটক ফাটক হয় না, যাও না তুমি নাটক দেখতে?

সময় কোথায়!

প্যারিসে তো কত জাদুঘর। চলো ল্যুভরে যাই।

আজ সময় নেই আর, বাজার করে বাড়ি ফিরতে হবে।

চলো তা হলে অন্তত কোনও ক্যাফেতে বসে চা খাই।

চা তো খেয়েই এলে তাজমহল থেকে।

নীলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তা ঠিক চা তো সে খেয়েই এসেছে, এক কাপ নয়, দু কাপ।

নীলার ব্যাকুল বায়না স্বচ্ছন্দে নাকচ করে দেয় কিষান। স্ত্রীলোকের এ ধরনের বিনতি মিনতিকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়, এ শিক্ষা কিষান তার ছ বছর বয়সেই নাকি পেয়েছে। কিষান বলেও, অবশ্য হেসে গড়িয়ে, তার মায়ের একবার শখ হয়েছিল পাকা আম খাবে, সে আম পাড়তে গিয়ে গাছের মগডাল থেকে পড়ে পা ভেঙেছিলেন কিষানের বাবা, সেই থেকে কিষানের বাবা ছেলেদের ডেকে সাবধান করে দিয়েছেন, স্ত্রীলোকের আবদারে কান দিবি তো মরবি।

গাড়ি চোখের নিমেষে সেইন পার হয়ে যায়। শাতলের মিনিপ্রিতে ঢুকে নীলার বিস্ময় কাটে না। থরে থরে সাজানো খাবার দাবার। রান্না করা ভাত, এমনকী রান্না করা মাছ মাংস সবজি রঙিন রঙিন প্যাকেটে পোরা। বাড়ি নিয়ে গিয়ে গরম করে খেয়ে নিলেই রান্নার ঝামেলা যায়। বোতলে সিমের বিচি আর ভেড়ার মাংস রান্না করে রাখা, খাবারের নাম কাসুলে।

নীলা বলে, এরা কি রান্নাবান্না করে না? প্যাকেটের বোতলের খাবার কিনে খায়!

রান্না করে সময় নষ্ট করতে কেউ চায় না। কিষান বলে।

কৌটোর জলে মটরশুঁটি, ঢেঁড়শ, গাজর, টম্যাটো ভেজানো। ন বছর পার হলেও এগুলো তাজাই থাকবে জলে। মাছ মাংসের ঝোলের পাউডার করে রাখা প্যাকেটে, বছর কয় গেলেও ক্ষতি নেই, জলে গুলে ঝোল বানিয়ে নিতে পারে। এমনকী আল সেদ্ধরও পাউডার। নীলা হতবুদ্ধি দাঁড়িয়ে থাকে।

ওটা কি সবুজ সবুজ, বোতলে?

জলপাই।

জলপাই? না জলপাইয়ের বাচ্চা!

সবজির এলাকায় এসে সে জিজ্ঞেস করে, পুঁইশাক নেই? ওটি আমার খুব পছন্দ।

দেশি শাক পাবে না।

লাউ কুমড়ো?

পাগল!

আচ্ছা এদের সবজি আনাজ সব এত বড় বড় কেন!

সব কৃত্রিম উপায়ে বানানো।

পাঁচটা ধনেপাতার ডাল একটি ঝলমলে প্যাকেটে পোরা দেখে নীলা লাফিয়ে ওঠে, বাহ কী চমৎকার দেখো দিকিনি। ধনেপাতা আমার খুব পছন্দ…

আরে তোমাকে কিলো কিলো ধনেপাতা এনে দেব চিনাদের দোকান থেকে। বারো ফ্রাঁ রাখছে, পাঁচটা ধনেপাতার জন্য…এগারো ফ্রাঁই প্যাকেটটির জন্য রেখেছে।

নীলা রেখে দেয় প্যাকেট, যেখানে ছিল।

চাপাতা?

ঠিক আছে চাপাতা নাও। তবে কি জানো, চায়ের নেশা বড় খারাপ নেশা।

পাঁচশো রকম পনির। সবচেয়ে দামি পনিরটি নাকের কাছে ধরে সুগন্ধ নিতে গেলেই নীলার বমি উঠে আসে, পেট থেকে গলায়। গলায় বমি আটকে নাক চোখ বন্ধ করে সে পনিরের এলাকা থেকে নিজেকে ত্বরিতে সরিয়ে নিয়ে, মাছ মাংসের এলাকায় গিয়ে শ্বাস নেয়, চোখ খোলে। টুকরো টুকরো মাংস প্যাকেটে সাজানো। ভেড়া, মুরগি, বড় মুরগি, হাঁস, খরগোশ, গোরু, শুকর। সবচেয়ে দামি মাংস গোরুর, সবচেয়ে কম দাম মুরগির। কলকাতায় সবচেয়ে সস্তা গোরু, আর চড়া দাম মুরগির। হাড় নেই কেন মাংসে? হাড়ের মাংসেই তো স্বাদ বেশি। এরা হাড় ছাড়িয়ে, তেল ছাড়িয়ে মাংস খায়। ঘটে বুদ্ধি থাকলে লোকে নাকি তাই করে। মাংসেরও ছোট জাত বড় জাত আছে, বুকের মাংস বড় জাত, দামি, পায়ের মাংস ছোট জাত, তাই দামেও কম।

কাঁটা ছাড়িয়ে আঁশ ছাড়িয়ে নানারকম মাছ রাখা প্যাকেটে।

গোলাপি সালমনের দিকে আঙুল তুলে নীলা বলে, এটি কী করে রাঁধে?

কাঁচা খায়।

আর চিংড়ি?

এও কাঁচা খায়।

নীলা ওয়াক করে। ওয়াক করেও ঘুরে ঘুরে বাজার তো নয়, জমকালো দোকানটিতে হাঁটে সে। হাজার রকম চকলেটে ছেয়ে আছে তাক, হাজার রকম ওয়াইনে। চোখ জুড়িয়ে যায়, মনও।

প্যাকেটের খাবারের ওপর কৌতূহল বাড়ে নীলার। একটি ঝলমলে প্যাকেট হাতে তুলে নিতেই কিষান বলে, করো কী করো কী এ তো কুকুরের খাবার!

আরেকটি কৌটো হাতে নিয়েও ঝামেলায় পড়ে। কিষান হাত থেকে কৌটোটি নিয়ে তাকে রেখে দিয়ে গলা চেপে বলে, বেড়ালের খাবারে হাত দিচ্ছ কেন? ঘরে কি বেড়াল পোষো?

নীলা বোকা বনে যায়। কুকুর বেড়ালের জন্য দোকানে খাবার কিনতে পাওয়া যায়, তাও আবার মানুষের খাবারের পাশেই সে খাবার রাখা, মানুষের খাবারের প্যাকেটের মতোই প্যাকেটে, কৌটোর মতোই কৌটোয়। কলকাতার বাজারে নীলা অনেক গেছে, ধুলো কাদায়, চিৎকারে গ্যাঞ্জামে পচা মাছের বাসি খাবারের নোংরা নর্দমার গন্ধে নীল ডুমো মাছি ভনভনে দাঁড়িয়ে নেড়িকুকুরের ঘাঅলা গায়ে লাথি কষিয়ে দূরে সরিয়ে, মানুষের বগলের ঘাড়ের দুর্গন্ধ থেকে নাক বাঁচিয়ে গা বাঁচিয়ে, চেঁচিয়ে দরদাম করে খোলা মাছের মাংসের গা থেকে মাছির উৎসব সরিয়ে, চোর ছ্যাঁচড় সরিয়ে, তবে কিছু কিনতে হয়েছে তাকে।

শাক, সবজি, ময়দা, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, দুধ ডিম ইত্যাদি আর দুটো জনি ওয়াকার দোকানের ঠেলাগাড়িতে ভরে, কিষান তাড়া দেয়, চলো চলো। দাম মেটাতে গিয়ে দেখে কিষান কোনও দরাদরিতে গেল না, প্রতিটি দ্রব্যের গা থেকে পড়ে নিয়ে মেশিনই হিসেব করে দিল কত, আর কিষান একখানা নীল কার্ড বাড়িয়ে দিল, মেশিনই সে কার্ডের নম্বর টুকে নিল, মেশিনই কিষানের ব্যাঙ্ক থেকে টাকা জোগাড় করে নেবে। বাহ।

নীলার ইচ্ছে করছিল বাজারটিতেই অন্তত আরও সময় কাটাতে। এ তো আর কলকাতার বাজার নয়। কিন্তু কিষান বাড়ি যাবে। নীলা, যেহেতু সে কিষানের বউ, তাকেও বাড়ি যেতে হয়। বাড়ি ফিরে সে প্যাকেটের বইটি খুলে দেখে, রান্নার বই, মিনা জাফরির লেখা ভারতীয় রান্নায় একটি ইংরেজি বই।

কিষান যথারীতি মদের বোতল আর টেলিভিশন খুলে বসে যায়, নীলা ঠিক বোঝে, বাজার করা হয়েছে, রান্নার বইও কেনা হয়েছে, এখন তার কাজ রান্নাঘরে ঢুকে রাতের খাবারের আয়োজন করা। নীলা তাই শুরু করে, আঁচলখানা কোমরে গুঁজে। কিষান গলা উঁচু করে বলে, অনেকদিন মালাইকোফতা খাই না, আজ করো তো দেখি কেমন হয়।

আর কী?

নান করো। আর একটা সবজির কিছু থাকলে ভাল হয়, পালক পনির করো।

ও তো বাঙালির খাবার নয়। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে, চোখে পেঁয়াজের ঝাঁজ, হাতে রসুনের গন্ধ, নীলা বলে।

আমি তো বাঙালি নই। কিষান হেসে বলে।

ও তাই তো। চোখ ঢেকে দেওয়া উড়ো চুল হাতের পিঠে সরিয়ে নীলাও হাসে।

সারা সন্ধে রান্না করে নীলা। টেবিল সাজিয়ে দিয়ে খেতে ডাকে কিষানকে। খেতে খেতে কিষান জিজ্ঞেস করে, রেস্তোরাঁয় ছেলেগুলো অমন ছেঁকে ধরেছিল কেন তোমাকে?

নীলা হেসে বলে, বাঙালি তো, তাই!

মোজাম্মেলের সঙ্গে কী এত গল্প করলে?

কিষানের থালায় মালাইকোফতা তুলে দিয়ে নীলা বলে, কী করে এল এ দেশে, কেমন আছে এসব।

আর কী বলল?

এসবই, বলল কাগজ না হলে ভাল চাকরি জুটবে না।

আর?

আর বলল বেলভিলে থাকে।

আর?

আর বলল সাতজন ছেলে একটি ছোট্ট ঘরে থাকে।

আর?

আর বলল দেশের লোকেরা তাকে ডিসি বলে জানে।

আর?

আর বলল দেশে গেলে চাকরি পাবে না ভাল, বয়স হয়ে গেছে।

আর?

আর বলল বাচ্চু ছেলেটা ডাক্তার।

আর?

আর বলল চায়ে আরেক চামচ চিনি লাগবে কি না। না বলেছি, হ্যাঁ বললে আরেক চামচ চিনি ও এনে দিত। আরও বলল যে চায়ে চিনির বদলে নুন হলে অন্যরকম স্বাদ হয়। আমি বললাম হ্যাঁ তা হয়। ও বলল, দেব এক চিমটি নুন? আমি বললাম, না, তেতো জিনিস আমি একদম পছন্দ করি না। ও বলল, দিই একটা লেবুর টুকরো। আমি বললাম, না টক চা আমি খাই না। আরও বললাম, লেবু বেশি টিপলে কী হয় জানেন তো? ও জিজ্ঞেস করল, কী হয়? আমি বললাম, তেতো হয়।

আচ্ছা তুমি ডাল মাখানি বানাতে জানো? কিষান জিজ্ঞেস করে।

নীলা উত্তর দেয়, না।

তবে যাই বলল, আজকের রান্নাটা সেদিনের চেয়ে ভাল হয়েছে। বইটা তোমার কাজে দেবে।

নীলা খাওয়া শেষ না করেই উঠে পড়ে, তুমি তো মাছ মাংস একেবারেও খাও না। খাবে না?

সে তো তুমি জানোই যে আমি খাই না। এবং কী জানো, কখনও খাব না।

মাছ মাংস খাওয়া অভ্যেস আমার। সবসময় নিরামিষ খেতে পারি না।

আমি যে নিরামিষাশী তা জেনেই তো তুমি বিয়েতে মত দিয়েছ, দাওনি?

হ্যাঁ দিয়েছি। কিন্তু আমি তো বলিনি, আমি আমিষ খাওয়া বন্ধ করব।

এক বাড়িতে দুরকম রান্না হবে, এ তুমি ভেবেছিলে?

অত ভাবার সময় পাইনি।

নীলা এঁটো বাসন রান্নাঘরে ধুতে নিয়ে যায়। কিষান বড় একটি ঢেকুর ছেড়ে ফোলা পেটখানায় হাত বুলোতে বুলোতে বলে, এত ভাল খেলে ভুঁড়ি বাড়বে না তো কি!

নীলা রান্নাঘর থেকে জল পড়ার শব্দকে আড়াল করে উঁচু স্বরে বলে, তুমি তো ডিম খাও দুধ খাও, এ সব তো আমিষ। তবে মাছ মাংস না খাবার কারণটা কী? অভ্যেস নেই, নাকি ভাবো যে জীব হত্যা মহা পাপ!

কিষান কোনও উত্তর দেয় না।

নীলা বলে, আমি না হয় তোমার রেস্তোরাঁয় গিয়ে মাঝে মাঝে খেয়ে আসব। মোজাম্মেলও বলছিল।

কিষান এরও কোনও উত্তর দেয় না।

রাতে ঘুমোবার আগে আর দিনের মতো মহা উদ্দীপনায় কিষান যখন শাড়ি খুলতে নেয়, নীলা অপ্রসন্ন স্বরে বলে আমার ঘুম পাচ্ছে।

ঠিক আছে ঘুমিয়ে যাও। আমি আমার কাজ করছি। একটুও টের পাবে না কী করছি আমি।

নীলা জানে এ কাজটি কিষানেরই। এ কাজে তার নিজের কোনও ভূমিকা নেই।

কিষান যখন হাতের তেলোয় স্তন দলছে, নীলা পাশ ফিরে বলে, ঘুমোতে দাও।

নীলাকে ঘুমোতে দিতে কিষানের কোনও আপত্তি নেই, তবে হাত পা মুখ মাথা যেন নীলা না নাড়ে, তা হলেই কিষান তার কাজ ভালয় ভালয় সারতে পারবে। নীলার সংশয় জাগে ভোগের জন্য জীবিত নারীদেহের আদৌ কোনও প্রয়োজন আছে কি না কিষানের। নিস্পন্দ পড়ে থাকে সে, কিষানের ভারী শরীরটি তার শরীরের ওপর কী কাজ করে যায়, কিষান ঠিকই বলেছে একটুও টের পাবে না নীলা, টের নীলা পায় না।

এর পরের ঘটনা নীলা বেশ ভাল জানে, তার শরীর থেকে নেমেই কিষান নাক ডেকে ঘুমোতে থাকবে আর সে অনেকক্ষণ একা একা জেগে থাকবে, ঘুম আসবে না সহজে। সকালবেলা ঘুমের নীলাকে ঠেলে জাগাবে কিষান ওঠো ওঠো ওঠো ওঠো বেলা অনেক। তার অত সকালে জাগতে ভাল লাগবে না, তবুও সে উঠবে, কিষানের খাবার তৈরি করবে, রুটি মাখন সাজিয়ে রাখবে টেবিলে, গেলাসে কমলার রস ঢেলে দেবে। আর নিজের জন্য চা করবে, যখন চা পান করতে থাকবে, কিষান বলবে, চা খেলে গায়ের রং কালো হয়ে যায়।

নীলা জিজ্ঞেস করবে, কখন ফিরবে?

কিষান বলবে ঠিক নেই।

এরপর নীলা জানালায় দাঁড়াবে। জানালা থেকে মানুষ দেখবে রাস্তায়।

০৩.

এক শুক্রবার সুনীলের বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে গেল কিষানলাল, নীলাকে নিয়ে। সুনীলের বাড়ি রু দ্য রিভলিতে, ইতালির রিভলিগ্রামের নামে নাম, যেখানে ১৭৯৭ সালে অস্ট্রিয়ানদের পরাজিত করেছিলেন নেপোলিয়ন। চেকস্লোভাকিয়ার অস্তারলিৎস শহরের নামে এ শহরে একটি ইশটিশন আছে, রাস্তা আছে, সেতু আছে, কারণ অস্তারলিৎসে ১৮০৫ সালে নেপোলিয়ন রাশান ও অস্ট্রিয়ান সৈন্যদের হারিয়েছিলেন। ফ্রিডল্যান্ড বলেও রাস্তার নাম আছে, যেহেতু রাশার ফ্রিডল্যান্ডে ১৮০৭ সালে রাশানদের হারিয়েছিলেন নেপোলিয়ন। যে যুদ্ধক্ষেত্রগুলোয় নেপোলিয়ন জয়ের পতাকা গেড়েছিলেন, সেগুলোই কেবল প্যারিসে সসম্মানে অবস্থিত। প্যারিসের মানচিত্র আঁতিপাতি করে খুঁজেও ওয়াটারলু বলে কোনও জায়গা নীলা পায়নি। বাঁয়ে হোটেল দ্য ভিল, ডানে ল্যুভর জাদুঘর, বাড়ির জানালা থেকে ল্যুভরের কালো ছাদ স্পষ্ট চোখে পড়ে, জানালায় দাঁড়িয়ে সামনে অবাধ সুন্দরের দিকে দৃষ্টি ছড়িয়ে নীলা বলে, কিষান তুমি এমন জায়গায় বাড়ি নিতে পারো না?

কিষানের মোটা ঠোঁটে মোটা হাসি, তোমার বাবার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের পণের টাকা পেলে ঠিকই পারি। আজই পারি।

নীলা ঘাড় বাঁকায়, কেন? সুনীল কি পণের টাকায় বাড়ি নিয়েছে এ অঞ্চলে?

সুনীলের সঙ্গে আমার তুলনা! ও ডাক্তার, কোটি টাকা কামায়। আমি ভাই খেটে খাওয়া মানুষ। আমার ব্যবসায় প্রায় লালবাতি জ্বলছে।

সুনীলের বাড়িটিতে নীলার বোধ হচ্ছে না যে সে অতিথি, যেন এ তার নিজের বাড়ি অথবা আপন কারও বাড়ি। কিষানের বাড়ির চেয়ে এ বাড়িতেই, সে লক্ষ করে, সহজবোধ তার বেশি, স্বস্তিবোধ অসামান্য। দেয়ালে সোনালি ফ্রেমে ঝুলে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজি সুভাষ বসু, স্বামী বিবেকানন্দ। তিন খ্যাতিমান বাঙালি। বিবেকানন্দ নিয়ে নীলার মনে খুঁতখুঁতি আছে, লোকটি মেয়েদের বাল্যবিবাহের পক্ষে ছিলেন, বিধবাবিবাহের বিপক্ষে ছিলেন। ছিলেন না কি? নীলা জিজ্ঞেস করে, সুনীল বলে যে সে জানে না, জানে চৈতালি, চৈতালি ব্যস্ত রান্নায়, বিবেকানন্দের বিবেক বলতে কিছু ছিল না, এ ধরণের মন্তব্য তার শোনার ইচ্ছে নেই। বইয়ের আলমারিতে একগাদা বাংলা উপন্যাস, গান বাজছে আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, শুধাইল না কেহ…ঝুঁকে বই দেখতে দেখতে গানটি গানের সঙ্গে গাইতে গাইতে রান্নাঘর থেকে আসা সর্ষে ইলিশের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়া ঘরে, নীলার ইচ্ছে করে, থেকে যায়। বইয়ের তাক থেকে তিনটে বাংলা উপন্যাস আর উনিশ শতকে ফরাসি শিল্পচেতনা হাতে নিয়ে ধার নেবার অনুমতি চাওয়ার আগেই নীলা দেখে সুনীল মাথা নাড়ছে, অর্থাৎ অনুমতির অপেক্ষা কোরো না।

আর দুটো রবীন্দ্রসংগীতের ক্যাসেট? কণিকার? এতেও কোনও বাধা নেই।

নীলা প্রফুল্লচিত্তে পায়ের ওপর পা তুলে পা নাচাতে থাকে, হাতে জর্জ পেরেকের একটি বই, নাচের পা জোড়া মেঝে থেকে সোফায় ওঠে, কুণ্ডলী থেকে ধীরে ধীরে সিধে হয়, মাথা কাত হতে হতে সোফার এক কোণে, পা ছড়াতে ছড়াতে সোফার আরেক কোণে। কলকাতার বাড়িতে সোফায় বিছানায় মাঠে উঠোনে মেঝেয় শুয়ে নীলা এরকম জগৎ ভুলে মেতে থাকত বইয়ে। সুনীল এবং কিষান দুজনই মন্তব্য করে সাহিত্যের ছাত্রী তো, বইয়ের নেশা থাকবেই।

কী ব্যাপার, বই পড়তে এখানে এসেছ নাকি?

কিষানের মন্তব্যে নীলা সোজা হয়ে বসে। বৈঠকঘরে দুটো পুরুষমানুষ বসে গল্প করছে। সেখানে নীলার এরকম সোফায় শুয়ে বই পড়া মোটেই শোভন নয়, তার বরং রান্নাঘরে গিয়ে চৈতালিকে সাহায্য করা দরকার।

রান্নাঘরে না গিয়ে সে সুনীলকে একটি বাক্য তৈরি করতে বলে যেখানে কোনও আকার নেই, ইকার নেই।

সুনীল কিছুক্ষণ ছাদের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে, বাক্য তৈরি সম্ভব হয় না।

জর্জ পেরেক ইকার ছাড়া এই আজদাহা বইটি লিখেছে। ভাবা যায়! নীলা তখনও বুঁদ হয়ে আছে, পেরেকে।

কী অসামান্য প্রতিভা! বিভোর নীলা।

তাই নাকি তাই নাকি বলে সুনীল কিছুক্ষণ আগ্রহ দেখিয়ে কিষানের রেস্তোরাঁ ব্যবসার গল্পে পরক্ষণেই মেতে ওঠে।

এই বইটিকে নীলা ধারের বইয়ের কাতারে রেখে কাঠের মেঝেয় হামাগুড়ি দিয়ে টুম্পার দিকে এগোয়। এই টুম্পামণি আমাকে খেলায় নেবে? টুম্পা আপন মনে খেলতে থাকে, ফিরে চায় না।

টুম্পামণি, ওই যে কথা বলা পুতুলটা দেবে আমাকে?

টুম্পা কথা বলে না।

সুনীল বলল, ও বাংলা জানে না।

নীলা অবাক হয়। বাঙালি মেয়ে বাংলা বলতে জানে না, জানে কেবল ফরাসি। ইস্কুলে ফরাসি বলে, ঘরেও ফরাসি। সুনীল চৈতালি নিজেদের মধ্যে বাংলায় বললেও টুম্পার সঙ্গে বলে ফরাসি।

ওকে বাংলা শেখান না কেন?

দুটো ভাষা শেখার চাপে ওর মাথাটা যাবে। এ সুনীলেরও মত, চৈতালিরও। বাংলা শিখে লাভ কী, কী কাজে লাগবে এ ভাষা!

নীলা কলকাতাতেও দেখেছে, বাঙালি বাচ্চাদের ইংরেজি ইস্কুলে পাঠানো হয়, ঘরেও তাদের সঙ্গে ইংরেজি বলা হয়, যেন বাংলা কোনও অস্পৃশ্যদের ভাষা, আর এরকম যুক্তিই দেওয়া হয় বাংলা জেনে কী লাভ! ভারতবর্ষের বাংলা মুল্লুকে অর্থনৈতিক দুরবস্থা, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে বড় বড় বিদ্বান বসে আছে, চাকরি জোটে না, জীবিকার তাগিদে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিতে হয় বাঙালিদের, উত্তরপ্রদেশে, মহারাষ্ট্রে, ও সব রাজ্যে বাংলা চলে না, ইংরেজি ভাল জানলে যে কোনও রাজ্যে চাকরি পাওয়া সহজ হয়, সে কারণে বাংলার প্রতি অনীহা। নীলা সব জেনেও বাংলা সাহিত্যে লেখাপড়া করেছে, অনির্বাণ বলেছিলেন, এ পড়ার কোনও মূল্য নেই, কিন্তু প্রতিবাদ করেছে সে, পৃথিবীতে একুশ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে, এর মূল্য থাকবে না কেন? পৃথিবীর ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা এটি, এর লিখিত সাহিত্যই হাজার বছরেরও অধিক পুরনো, বাংলার যত গভীরে গেছে, ততই অমূল্য সম্পদের খোঁজ পেয়েছে সে, কোনও গোপন হিরের খনির সন্ধান পাওয়ার মতো। এ ভাষাটি নিয়ে অন্যভাষীরা গৌরব করলেও, নীলা দেখেছে, বাঙালিরাই এই ভাষায় কথা বলতে, লিখতে, বাংলাভাষী বলে নিজেদের পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত বোধ করে।

টেবিলে হরেক রকম খাবার এনে রাখে চৈতালি, খাবারের গন্ধেই জিভে জল চলে আসে নীলার। ডালের বড়া, শুক্তো, পোস্ত, বেগুনভাজা, ফুলকপিভাজা, ছোট মাছের চচ্চড়ি, রুইমাছের পাতুরি, সরষেইলিশ, চিংড়িমাছের মালাইকারি, মুরগির ঝোল, ভেড়ার মাংসের কালিয়া খেতে খেতে নীলার মনে হয়, দীর্ঘদিন সে উপোস ছিল। ভরপেট খেয়ে সোফায় গা এলিয়ে দেয়, সে জানে, জিজ্ঞেস করলে চৈতালি পই পই করে বলবে কোন দোকান থেকে কোন মাছ কিনেছে, কোন দোকান থেকে মাংস। এ সব জেনে নীলা এও জানে, তার কোনও লাভ নেই। কিষানের বাড়িতে মাছ মাংস কেন, এর গন্ধও ঢুকলে চলবে না।

খাওয়া শেষে বাটায় পান নিয়ে দিদিমা ঠাকুরমাদের মতো চৈতালি বসে সুনীলের সামনে, এই পুজোয় পবন দাস বাউলকে ডাকছ তো?

নীলা পান মুখে দিয়ে বলে, এই প্যারিসে পুজোও হয়?

কেন হবে না? রীতিমতো ঘটা করে হয়।

সুনীল মাথা চুলকোয়। পুজোকমিটির সভাপতির পদ পেয়েছে সে এ বছর, এত দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে কাঁধ ঝুলে পড়ার জোগাড়। আমার এত পোষায় না। জয়ন্তকে দেব দায়িত্ব।

জয়ন্তকে দেবে, ও তো বাংলাদেশি!

তা হোক হিন্দু তো।

তার চেয়ে অসীম রায়কে দাও। গতবার বাংলাদেশিগুলো মণ্ডপ করবে বলল টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেল, ভুলে গেছ? চৈতালি অদৃশ্য এক অনুযোগের বাটাও পানের বাটার সঙ্গে নিয়ে বসেছে।

সুনীল ভোলেনি।

বাঙালির মাঝখানে শক্ত এক দেয়াল, নীলা অনুমান করে। বাংলাদেশের বাঙালিরা বেশির ভাগই এ দেশে অবৈধভাবে এসেছে, থাকেও অবৈধভাবে, কাজও করে অবৈধভাবে। যতসব অবৈধ ছোটলোক। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি বাঙালি যত না, তার চেয়ে বেশি ভারতীয়। পাঞ্জাবি, মরাঠি বা গুজরাটি যাকে পাক দেশি ভাই বলে জড়িয়ে ধরে ফরাসি, হিন্দি, ইংরেজি ধুমসে বলে যাচ্ছে, কেবল পেচ্ছাপ পায়খানা চেপে রাখার মতো বাংলাটা পেটে চেপে রাখে, ব্যাস। বাংলা হচ্ছে আড়ালে আবডালে, না পারতে।

তিন বাঙালির মাঝখানে কিষানলালকে একটি রামছাগলের মতো দেখতে লাগে। রামছাগলটি, নীলা কায়মনোবাক্যে কামনা করে, একা বাড়ি ফিরে যাক, বাড়ি ফিরে একা ঘরে মদ খাক, মদ খেয়ে একা বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ক, সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখুক সে একা, তার নাস্তা তৈরি করার কেউ নেই ঘরে, কেউ নেই তার জুতোর ফিতে বেঁধে দেবার, সন্ধে বা রাতে ফিরেও দেখুক সে একা, তার জুতো মোজা খুলে দেবার কেউ নেই, রান্না করার, টেবিলে খাবার সাজিয়ে দেবার, পরিবেশন করার কেউ নেই, একা সে কথা বলুক নিজের সঙ্গে, একা সে কাঁদুক। কিষান একা বাড়ি ফিরবে না, একা তার না ফেরায় সায় দেয় সুনীল। সুনীলের চশমাচোখের লম্বাটে মুখের দিকে তাকিয়ে নীলা ভাবে, এই লোকটি প্রেসিডেন্সি কলেজে নিখিলের সঙ্গে পড়ত, লোকটি নীলাদের বালিগঞ্জের বাড়িতে অনেকদিন গিয়েছে, মলিনা যত্ন করে ছেলে আর ছেলের বন্ধুকে খাইয়েছেন। মাসিমার হাতের রান্নার তুলনা হয় না! খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে এই লোকটি অনেকদিন বলেছে। নীলা বেণী দুলিয়ে ইস্কুল থেকে ফিরলে লোকটি প্রায়ই বলত, কীরে পাগলি, এত লেখাপড়া করে কী হবে, বরের ঘরে গিয়ে তো ওই হাঁড়িই ঠেলবি! নীলা জিভ দেখিয়ে চলে যেত অন্য ঘরে। সেই জিভ দেখানো মেয়ে, পরোয়া না করা মেয়ে, দিব্যি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ডিঙিয়ে গেল তরতর করে, অশিক্ষিত গৃহবধূ না হতেই তো! হাঁড়ি ঠেলার কাজ না নিতেই তো! লেডি ব্রেবোর্ণ কলেজে নয়তো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ছাত্রী পড়াবে, এই স্বপ্ন নিয়েই তো! আর শেষ অব্দি, এই লোকটি, এই সুনীল, নিখিলের বন্ধু সুনীল, এক কদাকার ব্যবসায়ীকে পাঠিয়ে দিল নীলার স্বপ্নের বাগানে মোষ চরিয়ে দিতে, নীলাকে তুলে এনে হাঁড়ি ঠেলার কাজে লাগাতে! ভেবে তার অবাক লাগে, নিখিলের এই বন্ধুটির হাতেই ছিল তার ভবিষ্যৎ। নিখিলের এই বন্ধুটি বিশ্বাস করত, নীলাকে হাঁড়ি ঠেলতে হবে যত বিদুষীই সে হোক না কেন! ঠিকই নীলা হাঁড়ি ঠেলছে। আগের মতো আর সে জিভ দেখাতে পারে না। জিভ এত ভারী আর শক্ত হয়ে আছে যে ইচ্ছে করলেও সম্ভব নয়। নীলার নিজের কোনও মাটি নেই, যেখানে সে স্বপ্ন রোপণ করবে। নীলার রাগ হতে থাকে সুনীলের ওপর।

বাড়িতে ফিরতে গিয়ে রাতের উজ্জ্বল প্যারিস দেখতে দেখতে মনে মনে ঘ্রাণ নেয় নীলা ছোটবেলার সেই সুগন্ধীর, সেই ইভনিং ইন প্যারিস নামের সুগন্ধীর। রাস্তায় ছেলে মেয়ের কোলাহল, মেয়েরা নিশ্চিন্তে হাঁটছে, শিরদাঁড়া টান করে, শক্ত করে। আতঙ্কের লেশ নেই কোথাও, পদক্ষেপে দ্বিধা নেই কোনও।

রাস্তায় এত রাতেও মেয়েরা একা একা হাঁটে? ভয় পায় না? নীলা জিজ্ঞেস করে।

কীসের ভয়? কিষান পালটা জিজ্ঞেস করে।

তাও তো কথা! নীলা ভাবে, কীসের ভয়। এ তো আর কলকাতা নয় যে ঝোপের আড়াল থেকে পাঁচটা কামুক বা ডাকাত অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে মেয়েদের ওপর। টাকা পয়সা গয়নাগাটি মান সম্মান এমনকী জীবন, যদি ইচ্ছে হয়, ছিনিয়ে নেবে।

নীলা জিজ্ঞেস করে, আঙুল তুলে একটি মেয়েকে দেখিয়ে, এই মেয়েটি, এই ধরো ষোলো সতেরো বছরের মেয়ে, সামনের ওই বাড়ি থেকে এই বেরোল, কোথায় যাচ্ছে বলো তো এত রাতে!

কিষান উত্তর দেয়, হয়তো কোনও বারে, নয়তো ডিসকোতে, সারারাত আড্ডা দেবে, নাচবে, আনন্দ করবে।

ওর মা বাবা কিছু বলবে না? বড় বড় চোখে নীলা তাকায় কিষানের দিকে।

যদি শুক্রবার রাতে এ বয়সি মেয়েরা ঘরে বসে থাকে, যদি কোনও ছেলে বন্ধু না থাকে, যদি না শোয় কোনও ছেলের সঙ্গে, তা হলে মা বাবাই বরং বিষম ভেঙে পড়ে। ভাবে যে এ মেয়ের যৌনাঙ্গে অথবা মস্তিষ্কে দুরারোগ্য কোনও ব্যাধি আছে। মেয়েরা বেরিয়ে গেলে মা বাবা নিশ্চিন্তে ঘুমোয়, আর ঘরে থাকলে বরং দুশ্চিন্তায় সারারাত না ঘুমিয়ে কাটায়। আর বেশির ভাগই তো এ বয়সে বেরিয়ে যায় বাবা মায়ের বাড়ি থেকে। নিজেরা একা থাকে নয়তো প্রেমিকের সঙ্গে থাকে।

বিয়ে ছাড়া? নীলা আবার প্রশ্ন করে।

নিশ্চয়ই। বিয়ে আজকাল কেউ করে না। আর করলেও অনেক পরে। পাঁচ ছ বছর এমনকী দশ বছর একসঙ্গে থাকার পর। বাচ্চা কাচ্চা হলে পর।

লেখাপড়া? নীলার কৌতূহল ক্রমাগত বাড়ে।

লেখাপড়া করতে এ দেশে পয়সা লাগে না। সরকারই দেয়। আর মেয়েরা লেখাপড়ার পাশাপাশি ছোটখাটো কাজ করে, চলে যায়।

খুব মুক্ত জীবন। নীলা বলে।

হ্যাঁ, এদের মূল উদ্দেশ্য জীবনকে উপভোগ করা, সে যে ভাবেই হোক। কিষান বলে, ঠোঁট তার উলটে থাকে, নাক কুঁচকে থাকে।

যত্তসব। কিষান বলে, এই মেয়েরা সতীত্ব হারায় কখন জানো তো! পাঁচ ছ বছর বয়সে, ডাক্তার ডাক্তার খেলতে গিয়ে। কুড়ি বছরের আগেই একশো একটা ছেলের সঙ্গে ঘুমোনো সারা। কোনও আদর্শ নেই, মাইরি। আজ একে ভালবাসল তো কাল ছেড়ে গেল, পরশু আরেক জনের সঙ্গে, এরা কোনও স্থায়ী বন্ধনে নেই। এরা জানে না কী করে স্থির হতে হয়, কোথায় এবং কখন। এরা জানে না, পারে না।

নীলা ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শোনে নিজের ভেতরে কোথাও, চলো ওই সেতুতে থামি কিষান, ওই পঁনফে, একটু হাঁটি। চলো সেইন নদীটি দেখি ঝুঁকে, ঢেউ কী করে ফুলে ফুলে আসছে দেখি, দূর থেকে নতরদামের চুড়োর আলো ঢেউগুলোর মাথায় কেমন সোনার মুকুট পরাচ্ছে দেখি।

কিষান গাড়ি থামায় না। হাতে স্টিয়ারিং তার, হাতে যার স্টিয়ারিং, তার ক্ষমতা অনেক, নীলা জানে। তবে কিষানকে থামতে হয় রিপাবলিকের মোড় থেকে যখন শাঁ শাঁ শব্দ তুলে ধেয়ে আসে হাজার হাজার রোলার স্কেটার, হাজার প্রজাপতির মতো উড়ে, তখন। নীলা দুচোখে রাজ্যির বিস্ময় নিয়ে দেখে তরুণ তরুণীর জুতোয় চাকা লাগানো, চাকা চলছে, জুতো চলছে, ওরাও চলছে। তারুণ্যের এমন বিচ্ছুরণ, নবীন প্রাণের জাগরী নিনাদ এর আগে এত কাছ থেকে নীলা দেখেনি, শোনেনি।

এ সব করছে কেন এরা?

কিষান বলে, আনন্দ করতে।

কী করতে?

আনন্দ। আনন্দ। কিষানকে চেঁচাতে হয়।

কেবলই আনন্দ?

কেবলই।

নীলা বেরিয়ে আসে বাইরে, দু চোখ মেলে দেখে গতিময় মানুষ, নীলাকে পেছনে রেখে চলে যাচ্ছে, চোখের পলকে যাচ্ছে, হাওয়ার গতিতে যাচ্ছে, জীবনের গতিতে যাচ্ছে আর গতিহীন নীলা, স্থবির নীলা দাঁড়িয়ে থাকে একা, দুচোখে বিস্ময় তার, দুচোখ জুড়ে মুগ্ধতা।

কিষান তাড়া দিলে গাড়ির ভেতরের অন্ধকারে ঢুকতে হয় নীলাকে, যদিও তার ইচ্ছে করছিল রাস্তায় হাঁটতে, দৌড়োতে, চাইছিল শরীরে মনে নির্ঝরের গতি, চাইছিল সারারাত তারুণ্যের উল্লাসে মেতে উঠতে, কিন্তু কিষান, যেহেতু কিষান তার স্বামী, আর যেহেতু স্বামীর আদেশ অমান্য করা অন্যায়, যেহেতু স্বামী ছাড়া সে চলৎশক্তিহীন, ডাকলে তার ইচ্ছের পায়ে শেকল পরাতে হয়।

কী অপূর্ব! অন্ধকার বলে কিছু নেই এখানে। সবই উজ্জ্বল, আলোকিত, সবই জীবন্ত। বার বার বলে নীলা।

বাড়ির কাছে পৌঁছে গাড়ি রাখার জায়গা খুঁজতে বড় রাস্তার এ মাথা থেকে ও মাথা, এক গলি থেকে আরেক গলিতে কলুর বলদের মতো ঘোরে কিষান। জায়গা ঘণ্টাখানেক পর মেলে।

গাড়ি গ্যারেজে না রেখে রাস্তায় রাখছ যে? নীলা বেরিয়ে বলে।

কারও গ্যারেজ আছে নাকি, সব্বাই তো রাস্তাতেই রাখে।

কলকাতায় রাস্তায় এরকম গাড়ি পড়ে থাকতে নীলা দেখেনি। অনির্বাণের অ্যামবেসেডার গাড়িটির লেজের দিকটা ডেবে গেছে, দরজায় জং ধরেছে, তারপরও ওটি রাখা হয় গ্যারেজে, রেখে আবার শক্ত তালাও লাগানো হয় গ্যারেজের দরজায়।

এই যে রাস্তার দুপাশে সারি সারি গাড়ি দাঁড়ানো, সারারাত এখানেই থাকবে গাড়ি?

কিষান মাথা নাড়ে। থাকবে। থাকে। থেকে আসছে।

চুরি হয় না?

চুরি হবে কেন?

নীলা ভাবে, তাই তো চুরি হবে কেন? এ তো চোর ডাকাতের দেশ নয়।

বাড়ি থেকে গাড়ি দূরে রাখাতে নীলার একরকম ভালই লাগে, অনেকটা পথ এখন সে হেঁটে যাবে, অনেকটা পথ সে দেখে দেখে যাবে পথের চরিত্র। আলোর প্লাবন বইছে বন্ধ দোকানগুলোয়, ইটের নয় কাঠের নয় পাথরের নয়, কাচের দেয়াল দোকানগুলোর। নীলা কাচের ওপারে দেখে সারি সারি অলংকার সাজানো, দামি পাথরের, সোনার রুপোর মুক্তোর হিরের। যে কেউ ইচ্ছে করলে কাচ ভেঙে ভেতরে ঢুকে অনায়াসে হাতিয়ে নিতে পারে অমূল্য সব মণিমুক্তো।

চুরি হয় না?

কিষানের কণ্ঠস্বরে এক রাশ বিস্ময়, চুরি হবে কেন?

নীলার চেতন ফেরে, তাই তো, চুরি হবে কেন? এ তো কলকাতা নয়।

০৪.

কোনও ঘটনা না ঘটলে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কাও থাকে কম, কিন্তু নীলার সাদামাটা ঘটনাবিহীন জীবনে হঠাৎ এক দুর্ঘটনা ঘটে যায়। স্নানঘরে পা পিছলে কপাল ফাটে তার। ফাটা কপালের কপাল ফাটা বড় ভয়ানক, নীলার ধারণা। মাথা গিয়ে পড়েছিল বাথটাবের কোণে, স্রোতের মতো রক্ত বয়ে গেছে। কিষানকে ফোনে খবর দেওয়ার শক্তিটুকু শেষ অব্দি ছিল, ভাগ্য। তড়িঘড়ি বাড়ি পৌঁছে নীলাকে নিয়ে কিষান দৌড়োল লারিবুয়াসিয়ের হাসপাতালে, গার দ্য নর্দের কাছেই সে হাসপাতাল। কলকাতার হাসপাতালে শত রোগীর উপচে পড়া ভিড় দেখে নীলা অভ্যস্ত, আর এ হাসপাতালের অপেক্ষাঘরে পাঁচ কি ছ জন রোগী বসে আছে, ধোপদুরস্ত জামাকাপড় পরা, দেখে রোগী বলে বিশ্বাস হয় না, যেন বাড়িটির ভোজসভার নিমন্ত্রিত অতিথি এরা। নীলার গায়ে রক্তমাখা শাড়ি, পাতলা তোয়ালেয় পেঁচানো মাথা, নীলরতন-বর্হিবিভাগের জলজ্যান্ত রূপ। একজন একজন করে ডাক পড়ছে ভেতরে। ডাক পড়লে নীলাকে ভেতরে যেতে হয়, নার্স বলে, গায়ের সব কাপড় চোপড় খুলে পাতলা একটি বুক খোলা জামা পরে পরীক্ষা করার বিছানাটিতে শুয়ে পড়তে। মাথা পরীক্ষা হলে পরনের সব কাপড় খুলতে হবে কেন, নীলা বুঝে পায় না, দ্বিধায় দাঁড়িয়ে থাকে। নার্সকে ডেকে স্মরণ করিয়ে দেয়, মাথা ছাড়া আর কোথাও তার কোনও অসুবিধে নেই। নার্স বলে, মাথা হোক, পায়ের আঙুল হোক, কাপড় খুলতেই হবে। এরকমই নিয়ম? এরকমই নিয়ম। শাড়ি ব্লাউজ পেটিকোট খুলে হাসপাতালের সাদা জামাটি পরে নেয় নীলা। নার্স দেখে বলে, জামার তলে কোনও সুতো থাকলেও চলবে না। ব্রাও খুলতে হবে? ব্রাও। প্যান্টিও? প্যান্টিও। নীলা খোলে, শোয়, ডাক্তার এসে নাড়ি দেখে, মাথা টেপে, পাঠিয়ে দেয় এক্সরে করতে। এক্সরে করতে গিয়ে মহা বিপদ, পুরো উলঙ্গ হয়ে এক্সরে টেবিলে শুতে হবে। নীলা জিজ্ঞেস করল মাথার এক্সরে হলে উলঙ্গ হতে হবে কেন? ওরা বলে হতে হবে। বুকের এক্সরেও হবে, বুকের এক্সরে হলেই বা উলঙ্গ হওয়ার দরকার কী? ওরা বলে দরকার আছে। মাথা হোক, বুক হোক, পেট হোক, পা হোক, পায়ের আঙুল হোক, এক্সরে করতে হলে পুরো উলঙ্গ হতেই হবে। এরকমই নিয়ম? এরকমই নিয়ম। নীলার বাবা অনির্বাণ নিজে ডাক্তার, নীলা নিজে বহুবার হাসপাতালে গেছে, ঘুরে ঘুরে হাসপাতালের নানা বিভাগ দেখেছে সে, নিজের বুকের এক্সরে একবার করতে হয়েছিল, পরনের কোনও কাপড় খুলতে হয়নি। এখানে উলঙ্গ হওয়ার প্রস্তাব শুনে নীলা লজ্জায় মাটির সঙ্গে কেবল মিশে যায় না, মাটির তলেও ঢুকে যায় মনে মনে। তার পক্ষে পুরো ন্যাংটো হয়ে ড্যাং ড্যাং করে স্তন দেখিয়ে নিতম্ব দেখিয়ে নার্স ডাক্তারের সামনে হেঁটে যাওয়া সম্ভব হয় না। সম্ভব না হলে চিকিৎসাও হবে না জানিয়ে দেওয়া হয়। নার্স এবং ডাক্তার ঠিক বুঝে পায় না নীলা চিকিৎসা নাকচ করে দিচ্ছে কী কারণে। লজ্জায় শেষ পর্যন্ত তাকে উচ্চারণ করতে হয়েছে লজ্জা শব্দটি। সে যে লজ্জা করছে এ সহজ ব্যাপারটি তবুও কারও বোঝার ক্ষমতা নেই। দুবার বলার পর নার্স আর ডাক্তার দুজনের চোখ কপালে ওঠে।

লজ্জা, কাকে?

তোমাকে। তাকে।

কেন?

কেনর উত্তর না দিয়ে নীলা তার শাড়িকাপড় পরে নিয়ে সোজা বেরিয়ে গিয়ে, কিষানকে জানায় তার পক্ষে হাসপাতালের অসভ্য প্রস্তাব মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি।

কিষান কোদালি হাসি হেসে নীলাকে ঠেলে দেয় এক্সরে করার ঘরে, উলঙ্গ হতে বললে উলঙ্গ যেন হয় নীলা, পরামর্শ দেয়।

তুমি রাগ করবে না? নীলা জিজ্ঞেস করল।

মহানুভবতার চুড়ান্ত উদাহরণ দেখিয়ে কিষান বলে ডাক্তারের সামনে উলঙ্গ হওয়া কোনও অন্যায় নয়।

নীলা লজ্জার মাথা খেয়ে মাথার এক্সরে করে।

দুটো সেলাই নেয় ফাটা বা কাটা কপালে, সেলাই নেওয়ার পর ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্রও নেয়, সে নিতে গিয়ে অবশ্য তাকে উলঙ্গ হতে হয়নি।

০৫.

কিষানের থুতনির কাছে কাটা দাগের একটি চিহ্ন আছে, এ কারণে, নীলা কখনও বলেনি যে কিষানের রূপের বারোটা বেজেছে কিন্তু তার কপালের ছোট্ট দাগটির জন্য যেটি চুলের তলে ঢাকা পড়ে থাকে, কিষান প্রায়ই মুখ মলিন করে বলে যে নীলার আগের সেই আগুন রূপটি আর নেই।

কাটা ঘা সারার পর ওষুধ খেয়ে চাঙা হতে কদিন পেরোয়, রান্না করার আর ঘর গোছানোর পর যে অবসর জোটে, বই পড়ে কাটায় নীলা। এরপর মুখ থুবড়ে পড়া দিনগুলোকে টেনে হিঁচড়ে যেমন তেমন পার করছিল, তেমনই এক দিনে গান্ধী নামকরণের পর রেস্তোরাঁর ব্যবসা ভাল জমে ওঠায় কিষানের শখ হয় নীলাকে নিয়ে গ্যালারি লাফায়েতে যেতে।

বুলোভার্ড হুসমানের চোখকাড়া বাড়ি দেখতে দেখতে গ্যালারি লাফায়েতে এক বিকেলে থামা হয়। ভেতরে ঢোকাও হয়। চমকানোও হয়।

ও মা, আমি তো ভেবেছিলাম এ একটা গ্যালারি, ছবি টবি থাকে।

এ দোকান, এক দোকানের ভেতরে একশো দোকান। আকাশছোঁয়া রঙিন ছাদে চোখ যায় তার, চোখ সরতে চায় না সেই অসম্ভব সুন্দর থেকে। কিষানের গুঁতো খেয়ে ঘাড় সোজা করতে হয়।

এ দোকান, না কি সোনায় মুড়োনো প্রাসাদ!

নীলা এর আগে এত সুন্দর কোনও দোকান কেন, প্রাসাদও দেখেনি।

এটা কেনো, ওটা কেনো, জুতো কেনো, জামা কেনো, কিষান বলেই যাচ্ছে। কপালের দাগটি সত্ত্বেও নীলা রূপসি রয়ে গেছে, তার হাতের রান্নাও দিন দিন সুস্বাদু হচ্ছে, আর নীলা যেহেতু তারই বউ, তারই সম্পদ, তারই সম্পত্তি, তারই হাতের মুঠোয় নীলার জীবন, নীলাকে আরও সুন্দরী দেখালে লোকে তারই প্রশংসা করে বলবে যে কিষান বড় সুন্দরী বউ পেয়েছে, নীলা ভাল জামা জুতো পরলে এ প্রশংসাও কিষানের, নীলা অসুখ থেকে সেরে উঠলে লোকে বলেছে কিষান তার বউকে সারিয়ে তুলেছে, নীলার কিছুতে যেহেতু নীলার কিছু নয়, সবই কিষানের, নীলার প্রতি উদারতা তাই উথলে উঠেছে তার, এ আসলে কিষানের নিজেকেই নিজের ভালবাসা, নীলা অনুমান করে।

জুতোর দোকানে ঢুকলে দোকানি নীলার পায়ের মাপ জিজ্ঞেস করে। মাপ তো দাদা জানি না! নীলা মাপ জানবে কেন, কলকাতার জুতার দোকানে ঢুকে যে জুতো বা স্যান্ডেল পায়ে আঁটে, তা কিনে অভ্যেস তার। এ মাসে আট নম্বর জুতো আঁটসাঁট হল, পরের মাসে দেখা যায় সাত নম্বরই বড় হচ্ছে। তবে কি পা কুঁকড়ে যাচ্ছে, না পা কুঁকড়োচ্ছে না, জুতোর মাপের ঠিক নেই। জুতোঅলারা যার যা পছন্দ নম্বর বসিয়ে দেয়, যার পায়ে জুতো দরকার দোকানে এসে একটি পর একটি জুতো পরে পরখ করে তবে কেনে। এরকমই নিয়ম।

কিষান জুতোর তাক থেকে একজোড়া বুটজুতো নিয়ে বলে, পরে দেখো তো।

ও মা এ তো ছেলেদের জুতো। নীলা জিভে কামড় দেয়।

এ মেয়েদের।

কিষান বলে, দোকানিও বলে এ মেয়েদের।

জুতো কিনে জামা কাপড়ের দোকানে এসে নীলা ঝামেলায় জড়ায় আবার। পান্তলুনে হাত রাখতেই কিষান সরিয়ে নেয় নীলাকে, ও সব ছেলেদের।

তা হলে এই শার্ট!

এও ছেলেদের!

কী তফাত গো ছেলেদের মেয়েদের পোশাকে? নীলা উৎসুক জানতে। কলকাতায় মেয়েদের ছেলেদের জামা কাপড় জুতোয় আকাশ পাতাল তফাত। শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, ফিতেঅলা চটি মেয়েদের আর ছেলেদের ধুতি, ফতুয়া, স্যান্ডো গেঞ্জি, শার্ট, প্যান্ট, টাই, জুতো, মোজা। তফাত স্পষ্ট। এ দেশে একই রকম পোশাক ছেলে মেয়েরা পরছে, দু পোশাকে তফাত বোঝা কঠিন। বোতামের ঘর এদিক না হয়ে ওদিক, কোমরের কাছটা সামান্য চাপা, বুকের কাছে একটি বাড়তি সেলাই, খুব মন দিয়ে না দেখলে কোনটি কার তা বোঝা যায় না। কিষানের মতে প্রচুর তফাত, কোমরে তফাত, নিতম্বে তফাত, দৈর্ঘে তফাত, প্রস্থে তফাত।

তোমার মাপ কী?

মাপ তো জানি না! নীলা তার মাপ জানবে কেন, মাপ জানে পাড়ার দরজি।

আর ওই লাল সোয়েটার, ওটি বেশ সুন্দর তো।

হাত দিয়ো না। ও ছেলেদের।

মেয়েদের সোয়েটারের সঙ্গে এটির তফাত কোথায়?

আছে। ঘাড়ে, গলায়, কোমরে, বুকে।

বুকে শব্দটি বলে কিষান কনুইয়ে আলতো চাপ দেয় নীলার বুকে।

কমলা রঙের একটি মেয়েদের সোয়েটার কিনে কিষান যখন দাম দিতে যায়, নীলা বলে পাঁচশো ফ্রাঁ এর দাম, তার মানে সাড়ে তিন হাজার টাকা?

এরকমই দাম এ সবের। কিষান হাসে।

কিছু কম করে দিতে বলো। দুশো ফ্রাঁ-এ দেবে কি না জিজ্ঞেস করো।

এ দেশে দরাদরি নেই। দাম যা লেখা আছে, তাই।

যে দোকানে কোনও ভিড় নেই সে সোনার দোকান। আর এ দোকানেই নীলা আটকে যায়। সোনায় বানানো নানান অলংকার।

সোনার এমন লালচে রং কেন?

আঠারো ক্যারেটের সোনা এরকমই দেখতে হয়।

আঠারো ক্যারেট মাত্র! কেন গো! আমরা তো বাইশ ক্যারেট পরি।

এরা সোনা তেমন পরে না। পছন্দও করে না। কেনে পাথরের অলংকার।

এরা ধনী হয়েও সোনার অলংকার কেনে না আর গরিব দেশ ভারতে সোনা না হলে চলে। সোনা না পরলে মান যায় জাত যায়। সোনা না হলে বিয়ে হয় না, বিয়ে হলেও সুখ হয় না। নীলার বিয়েতেই অনির্বাণ আট ভরি সোনা দিয়েছেন, চকচকে সোনা। অনির্বাণের ধারণা সোনা থেকে সুখের প্রপাত বইয়ে কন্যার সংসার ভাসিয়ে দিচ্ছে। সোনার প্রতি লোভ ভারতীয় মেয়ে মাত্রই থাকে, নীলারও আছে। কিন্তু আঠারো ক্যারেটের লালচে সোনা কিনতে মোটে তার আগ্রহ জন্মায় না।

আগ্রহ তার সুগন্ধী কেনায়। সুগন্ধীর রাজ্যে ঢুকে নীলা বিবশ হয়ে থাকে। এত সুগন্ধীও জগতে আছে! এ তো সুগন্ধীরই দেশ। এটি পছন্দ হয় তো ওটিও পছন্দ হয়। নীলা পছন্দ করে জিভাঁসির অরগানজা, কিষানের পছন্দ ক্রিশ্চান ডিওরের পয়জন। তা হলে কোনটা কেনা হবে। একেবারে সোজা। কেনা হবে পয়জন।

পয়জনের এত দাম এখানে? কলকাতায় তো অনেক কম।

হ্যাঁ অনেক কম, কারণ ওখানে যা পাওয়া যায়, সব নকল। এখানে আসল, বুঝলে হে, সব আসল।

নীলা সব আসলের ভিড়ে খাবি খায়। সবই আসল, সবই ভাল, সবই সুন্দর।

সুগন্ধী নো হলেও সুগন্ধীর এলাকা থেকে মোটে সরতে চায় না সে। একটি সুগন্ধী সে খুঁজছে, খুঁজছে ইভনিং ইন প্যারিস। পাতি পাতি করে খুঁজেও সেই নীল রঙের ছোট্ট শিশি, সেই ইভনিং ইন প্যারিস কোথাও পেল না। চোখ গেল শ্যানেল নং ফাইভে। শ্যানেলই কিনবে সে, নিজের টাকায় কিনবে।

কিষান চমকায়, কার জন্য?

দাদার জন্য।

সুনীলের এক বন্ধু কলকাতা যাচ্ছে, তার হাতে কিছু জিনিস পাঠানো যেতে পারে, সুনীল নিজে বলেছে।

নিখিলের জন্য তো। অনেক অল্প দামের সুগন্ধী আছে, ওগুলো কেনো। কিষান বলে।

না এটিই কিনব। শ্যানেল নং ফাইভ দাদার খুব পছন্দ। নীলা গোঁ ধরে।

কিষান নীলার হাত থেকে শ্যানেলটি দোকানিকে ফেরত দিয়ে নীলাকে টেনে সরাল দোকান থেকে, গলা চেপে বলল, তোমার কাণ্ডজ্ঞান একেবারে নেই।

নীলা শান্ত গলায় বলে, আসলে কী জানো দাদা আমাকে দুশো ডলার দিয়েছে যেন ঠিক এই সুগন্ধীটিই কিনে তাকে পাঠাই।

ঠিক এটিই?

হ্যাঁ ঠিক এটিই।

নীলা ডলার ভাঙিয়ে শ্যানেল নং ফাইভ কিনল। কিনে, দেখল, তার একরকম আনন্দ হচ্ছে নিজের টাকায় কিছু কিনে। কিষানের কাছ থেকে ব্যাগ ভরে জিনিসপত্র উপহার পাওয়ার চেয়ে বেশি আনন্দ।

বাড়ি ফিরে, কিষান মদ নিয়ে বসল, আর নীলা আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান, প্রাণের আশা ছেড়ে সঁপেছি প্রাণ গাইতে গাইতে পয়জন মাখল গায়ে। কিষান জিজ্ঞেস করল, কী গান এটি?

রবীন্দ্রসংগীত।

ওই বাঙালিব্যাটা তো যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিল, তার গান?

হ্যাঁ ওই বাঙালিব্যাটার গান। ওই বাঙালিব্যাটা এই পয়জন সুগন্ধী নিয়ে চমৎকার একটা গান লিখেছে, সেটিই গাইছি।

এই পয়জন?

হ্যাঁ এই পয়জন।

ঠিক এটিই।

হ্যাঁ ঠিক এটিই।

অনুবাদ করে শোনাও তো।

নীলা হেসে বলল, কিছু কিছু গান আছে, যার অনুবাদ হয় না।

কিছু কিছু মানুষ আছে, যার অনুবাদ হয় না। কিষান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে।

আর কিছু কিছু মানুষের অনুবাদ খুব সহজ। নীলা রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ঘরময় সুগন্ধ ছড়িয়ে বলে।

কিষান খেয়ে শুয়ে পড়ার পর নীলা চিঠি লিখতে বসে মলিনাকে।

তুমি যে বলেছিলে, এখানে একা একা কী করে সংসার করব আমি! তুমি একবার এসে দেখে যাও। কাজের লোক নেই, তা ঠিক। কোনও প্রয়োজনও নেই। মেশিনে বাড়ি ভর্তি, এখানে কাজ বলতে সুইচ টেপা। জানো মা, আমি আজকাল রান্না করছি। রান্নায়, আবার ভেবো না, কষ্ট হচ্ছে কিছু। একেবারেই না। কিষান আজ আমাকে অনেক জিনিস কিনে দিল। বারবার বুঝিয়ে দিল সে কিনে দিয়েছে। জীবন তো এরকমই মা, তাই না! স্বামী স্ত্রীকে জিনিসপত্র কিনে দেবে, আর স্বামীর আদেশ মতো স্ত্রী চলবে। জিনিসপত্রের কাছে আমরা একরকম বন্দি। আমাদের হাত পা বাঁধা। তোমাকেও দেখেছি, বাবা দুটো শাড়ি কিনে আনলে কী বিষম খুশি হতে তুমি। বাবাকে খাওয়াতে মাছের মুড়ো দিয়ে, পাশে বসে হাতপাখায় বাতাস করতে। ভালবেসে করতে হয়তো। জিনিসপত্র দিয়ে কি ভালবাসা কেনা যায়? কী জানি! যায় হয়তো। আজ রাতে কিষানের জন্য ডাল মাখানি রান্না করলাম, ও খুব পছন্দ করে খায়।

প্যারিস আশ্চর্য সুন্দর একটি শহর। আজ অপেরার পাশ দিয়ে আসার সময় আমার মনে হয়েছে, কিষানের সঙ্গে বিয়ে হয়ে একরকম ভালই হয়েছে আমার, না হলে এ শহর দেখা হত না। আর এ শহর না দেখে মৃত্যু হলে, জীবন পূর্ণ হত না।

সারাজীবন কেবল অন্যকে আনন্দ দেবার জন্য নিজের জীবন খরচ করলে মা। এবার নিজের কথা ভাবো। নিজে আনন্দ করো। দাদু মারা যাবার পর সম্পত্তি তো ভাগ হয়েছে, তোমার নিজের ভাগ বিক্রি করে টাকা তো পেয়েছ অনেক, কার জন্য জমিয়ে রাখছ সে সব? খরচ করো। নিজের জন্য করো। জীবন আর কদিনের বলো! দেখো, এখানকার লোকেদের ভাত কাপড়ের ভাবনা নেই। এরা জীবনকে ভীষণ রকম উপভোগ করে। এরা প্রাণ খুলে হাসে। আর আমরা হাসি না, ভয়ে হাসি না, কারণ রামশর্মা নামে এক বদমাশ লোক বলে গেছে, যত হাসি তত কান্না।

এটুকু লিখে থেমে পুনশ্চ দিয়ে লেখে দাদার জন্য শ্যানেল নং ফাইভ পাঠালাম, খুব দামি সুগন্ধী। এটি কিষানের টাকায় কেনা না, আমার টাকায়, যে টাকা জমিয়েছিলাম টিউশনি করে।

০৬.

আমাকে কিছু টাকা দেবে, তোমার তো সময় হয় না, আমি একা না হয় বেরোই।

একা?

হ্যাঁ একা।

পাগল হয়েছ?

কেন একা বুঝি আমি বেরোতে পারি না? আমি কি ছোট্ট বাচ্চা?

আমার কাছে অবশ্য তুমি ছোট্ট বাচ্চাই। কিষান নীলার গালে আঙুল বুলিয়ে বলে।

নীলা হাসে। বলে, কিন্তু আমার কাছে তো আমি ছোট্ট বাচ্চা নই।

তবে কি বড় বাচ্চা? কিষানও হাসে, কোদালি হাসি।

আমার সাতাশ বছর বয়স। আমি প্রাপ্তবয়স্ক।

প্রাপ্তবয়স্ক হলে বুঝি বেরোতে হয় রাস্তায়?

রাস্তায় যে হতে হবে তা নয়। ধরো সুনীলের বাড়ি গেলাম কি কোনও ক্যাফেতে বসে চা খেলাম, ধরো কোনও জাদুঘরে গেলাম, অথবা বইয়ের দোকানে। ধরো অপেরার ভেতরটা দেখতে গেলাম। প্যারিসে আসব বলে প্যারিসের ওপর কিছু বই পড়েছি, দেখতে ইচ্ছে করে জায়গাগুলো। নীলা জানালায় উদাস তাকিয়ে বলে।

একা একা এ সব করতে চাও তুমি? কিষানের ছোট ছোট চোখ দুটো গোল আলুর মতো বড় হয়ে ওঠে।

তুমি তো সময় পাও না তাই। ভাবছিলাম, একটু না হয় হাঁটিই রাস্তায়, কোথাও যদি নাও যাই। নীলার উদাস স্বর।

হাঁটবে? কেন?

কোনও কারণ নেই। এমনি।

এমনি এমনি হাঁটে কেউ রাস্তায়! দেখো তো এই দেখো, কিষান হেঁচকা টেনে নীলাকে জানালার কাছে নিয়ে বলে, ওই যে লোকগুলো হাঁটছে, কেউ কি অকারণে হাঁটছে বলে মনে হয় তোমার! সকলেই কিছু না কিছু কারণে হাঁটে। সকলেই ব্যস্ত। আমিও ব্যস্ত। কাজে ব্যস্ত না হলে উনুন জ্বলবে না। মাথার ওপর ছাদ থাকবে না নীলা, তোমাকে একদিন দেখাতে নেব কী করে উদ্বাস্তুগুলো রাস্তায় কাটায়, শীতের রাতেও। তখন বুঝবে, খামোখা সময় নষ্ট করার মানে হয় না।

নীলা শাড়িতে আঙুল পেঁচাতে পেঁচাতে বলে, আসলে কী জানো, আমার মোটে সময় কাটে না। লেখাপড়া করেছি কি ঘরে বসে থাকার জন্য? কোনও চাকরি বাকরি করলেও না হয়…

চাকরি? চাকরি বা করতে হবে কেন? আমি কি টাকা রোজগার করছি না? কিষান তাজ্জব হয়ে প্রশ্ন করে।

তা করছ।

আর এই যে আমি ব্যস্ত থাকি, সে তো এ সংসারের জন্যই। আমি কাজ না করলে তুমি থাকবে কোথায়, খাবে কী! পরবে কী? গলার স্বর ক্রমে উঁচুতে উঠছে কিষানের।

সে কি কেবল আমার জন্যই করছ! বিয়ের আগেও তুমি এ কাজই করতে। আমাকে ভরণ পোষণ করতে হবে বলে কি কাজ নিয়েছ? তা তো না। নীলার অদ্ভুত শান্ত গলা।

ওহ নীলা, কিষান সোফায় ধপাস করে বসে বলে, তুমি তো বেশ কথা বলতে জানো! এত কথা শিখলে কোথায়।

কোথাও তো শিখিনি। এ তো সবাই বলতে পারে।

কিষান সজোরে মাথা নেড়ে বলে, না না না, ভারতীয় বউরা এমন বলে না।

নীলা আবারও আগের সেই শান্ত গলায় বলে, ভারতীয় বউ কারা এমন বলে না। তোমার দিদিমা বলে না, তোমার ঠাকুরমা বলে না। এই তো!

কেউ বলে না। কিষান চেঁচাল।

আসলে কী জানো, তোমার এক বোবা মেয়ে বিয়ে করা উচিত ছিল। মুখ বুজে সংসারের কাজ করবে, এমন এক মেয়ে। সাত চড়ে রা করবে না এমন এক মেয়ে। তিন কুলে যার কেউ নেই, এমন মেয়ে। লেখাপড়া না জানা মেয়ে। মাথায় গোবর ছাড়া কিছু নেই, এমন মেয়ে। সাধ নেই স্বপ্ন নেই এমন মেয়ে। নীলা চিবিয়ে চিবিয়ে বলে।

কিষানের গলার স্বর সপ্তম থেকে নবমে, লেখাপড়ার বড়াই করছ কেন? এমন তো নয় যে ডাক্তার হয়েছ বা ইঞ্জিনিয়ার হয়েছ। তোমার ওই বাংলাসাহিত্যের লেখাপড়া দিয়ে কী করতে পারো তুমি। এক ফ্রাঁ উপার্জন করতে পারবে? পারবে না। তোমার সারাজীবনই আমার ওপর নির্ভর করতে হবে, এ ছাড়া তোমার উপায় নেই। সুতরাং দেমাক কমাও, এত দেমাক দেখিয়ে তোমার যে কোনও লাভ হবে না মাথায় সামান্য ঘিলু থাকলে বুঝতে পারতে।

কিষান উঠে দাঁড়ায়। হাঁটে, কোনও কারণ ছাড়াই ঘরময় হাঁটে। ভারী শরীরের ধপ ধপ শব্দ তুলে মেঝেয়, হাঁটে। জল খায়। এক গেলাস। দু গেলাস। হাঁটে। এরপর ভারী কণ্ঠে বলে, শোনো, সুনীল চৈতালি দুজনই চাকরি করে, ওরা দিনের বেলা বাড়ি থাকে না। আর ক্যাফেতে যাবে কেন, ঘরে চা আছে, সে বানিয়ে খাও। বাইরে খামোখা পয়সা খরচার দরকার কী! জাদুঘর, সিনেমা থিয়েটার, এ সবে আমি যাই না, কিন্তু তোমার যদি এতই যাবার ইচ্ছে, তা হলে ঠিক আছে, আমার সময় হলে আমি নিয়ে যাব।

কিষান বেরিয়ে যায়। সিঁড়িতে শব্দ হয় ধপ ধপ, নামার।

টেবিলে চাবির গোছা। নীলা সারাদিনই ঘুরে ফিরে চাবিটি হাতে নেয়, ঘরে আগুন না লাগলে এ চাবি ব্যবহারের কোনও পরামর্শ কিষান দেয়নি।

০৭.

কবে তোমার সময় হবে গো?

শনিবার সকালে কিষানের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে নীলা।

নীলার দিকে আরও সরে এসে কিষান তার ডান বাহুটি নীলার শরীরে ছড়িয়ে দিয়ে বলে তোমাকে সময় দেবার সময় তো এই শনি রোববার। সপ্তাহগুলো ব্যস্ততায় কাটে, ঘরে শুয়ে বসে থাকার দুটো কেবল দিন। বউয়ের নরম হাতের স্পর্শ সারাদিন ধরে নেব।

কোদালি দাঁত যতটা সম্ভব আড়াল করে হাসে কিষান। এ হাসিটি তার যে কোনও হাসির চেয়ে ভাল। কিষান সম্ভবত ভাবে এ হাসিটি প্রেমিকের হাসি। প্রথম প্রেমে পড়লে প্রেমিকার সঙ্গে এমনই কায়দায় হাসে প্রেমিককুল।

সারাদিন শুয়ে বসে থাকবে? আর কিছু না? নীলা জিজ্ঞেস করে। মন তার উড়ছে খোলা হাওয়ায়।

কিষান মাথা নাড়ে। আর কিছু না।

আগে একদিন বলেছিলে শনি রোববার হল ঘর পরিষ্কার করার, কাপড় ধোবার।

তাও ঠিক। কিষান ঘুম ঘুম স্বরে বলে।

নীলা সারাদিন নিপুণ হাতে ঘর ঝাড়ু দিল, কাপড় কাচল, ফুলগাছের গোড়ায় জল ঢালল, রান্না করল। এ সব করে নীলার অভ্যেস নেই যদিও, করল। করতে করতে নীলা ভাবে, সে কি এ সব কিষানকে ভালবেসে করছে না কি ওকে খুশি করার জন্য করছে যেন অন্তত এ কারণে নীলাকে সে ভালবাসে, ভালবাসার তো কোনও একটি কারণ থাকতে হবে, কিছু গুণ না থাকলে তো জোর করে ভালবাসা যায় না। গুণ বলতে তো রান্নাবান্না করা, ঘর গোছানো, এ সব। বউ হয়েছে বলেই যে আকাশ থেকে বউয়ের জন্য ভালবাসা জলের ফোঁটার মতো বুকের ওপর পড়বে তা তো নয়! নীলা ভাল গান গায়, সাহিত্যের ভাল খবর রাখে, এ সব কিষানের মনে ভালবাসা জাগাবার কোনও কারণ নয়, কারণ কিষান বাংলা ভাষা বোঝে না। এ ভাষায় শুয়োরের বাচ্চা বলে গাল দিলেও কিষান বুঝবে না যে এ গাল, না বুঝে মিষ্টি মিষ্টি হাসবে। এ ভাষায় কবিতা আবৃত্তি করলেও কিষান ভাবলেশহীন মুখে বসে থাকবে সামনে। এ ভাষা, এ বাড়িতে ভাঙা কাচের মতো মূল্যহীন। ভাঙা কাচ গা কাটা ছাড়া আর কোনও কাজে আসে না। এ অচল ভাষাও তেমন। শরীর না কাটলেও মন কাটে। এ ভাষার অসম্ভব সুন্দর শব্দাবলী নীলার ভেতরে গুমরে মরে আর যখন একা একা নীলা নিজের সঙ্গে এ ভাষায় কথা বলে বা গেয়ে ওঠে আমি কান পেতে রই, ও আমার আপন হৃদয় গহন দ্বারে, কোন গোপন বাঁশির কান্না হাসির গোপন কথা শুনিবারে, ভ্রমর সেথা হয় বিবাগি নিভৃত নীল পদ্ম লাগি রে, কোন রাতের পাখি গায় একাকী সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে..নীলা লক্ষ করে চোখে জল তার, আসলে জল নয়, নীলা ভাবে, এ হৃদয় কাটা রক্ত।

সারা সকাল বিছানায় গড়িয়ে কিষান টেলিভিশনের সামনে সোফায় আসে দ্বিতীয় দফা গড়াতে, ভিডিওতে কেয়ামত সে কেয়ামত চালিয়ে। নীলা তখন কার্পেট ঝাড়ু দিয়ে জানালার কাছে কাচ মুছছে। কাচ মুছে, রান্না সেরে, স্নান সেরে, কেবল গুণ নয়, রূপও যেহেতু চাই কিষানের, মুখে তাই ক্রিম মেখে, পাউডার মেখে, চোখে কাজল পরে, ঢাকাই শাড়ি পরে সামনে এসে বসে নীলা। বউ নীলা। লক্ষ্মী নীলা। ঘরণী নীলা।

কেমন লাগছে দেখো দিকিনি! কিষানের পাশে ঘন হয়ে বসে জিজ্ঞেস করে।

বেশ।

এই ওদের একবার নেমন্তন্ন করবে না?

কাদের?

সুনীলদের।

সময় কোথায়।

আজ সন্ধেয় না হয় ডাকো।

এভাবে ডাকা যায় নাকি! অন্তত দু সপ্তা আগে থেকে জানাতে হবে তো!

ও।

কেন, হঠাৎ ওদের কথা কেন!

অনেকদিন বাংলায় কথা বলি না তো!

হুম তাও কথা। তোমার সঙ্গে কোনও এক বাঙালির বিয়ে হলে ভাল হত।

বাঙালির সঙ্গে বিয়ে না হয়ে ঢের ভাল হয়েছে। বাঙালিকে বিশ্বাস নেই।

কিষান তার না কোদালে হাসিটি হাসে।

আচ্ছা, তুমি ঘরে বসে পাঞ্জাবি ভাষাটা শিখলেও তো পারো!

কী করে?

পাঞ্জাবি গান শোনো। ছবি দেখো। আমার সঙ্গে একটু একটু বলো। হয়ে যাবে।

তার চেয়ে ফরাসি ভাষাটা শেখা ভাল না?

মাথায় যদি কুলোয়, তা হলে শেখো।

ফরাসি ভাষা যে ঘরে বসে থেকে আর কিষানের সঙ্গে গাড়িতে হঠাৎ হঠাৎ এদিক ওদিক ঘুরে এলে শেখা হবে না, তা নীলা যেমন জানে, কিষানও জানে। এ প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে সে বলে আচ্ছা সানালের বাড়ির নেমন্তন্নে তো গেলে না, কাটিয়ে দিলে, ওকেই না হয় আজ খেতে ডাকো!

নাহ। ও ছেলের মুখের লাগাম নেই! দেখলে না তোমার সঙ্গে কী রকম রং তামাশা করল সেদিন।

রং তামাশা?

তাই তো। এ নিয়ে পরে রাজেশ বলেছেও যে সালের এ সব করা মোটেও ঠিক হয়নি। অন্যের বউয়ের দিকে নজর দেওয়া ওর চিরকালের স্বভাব। ভারতীয় বউগুলো এলেই সানাল ঝাঁপিয়ে পড়ে। কেন রে বাবা নিজে একটা জোগাড় করে নিলেই তো পারিস, অন্যের সম্পদে চোখ দিস কেন!

কিষানের সারা মুখে ঈর্ষা চমকাচ্ছে, নীলা স্পষ্ট দেখে। সানাল গত রবিবার নীলা আর কিষানকে নেমন্তন্ন করার পর, কিষান প্রথম বলেছে নিশ্চয়ই যাব, তারপর বলেছে দেখি, তারপর বলেছে, মনে হচ্ছে না হয়ে উঠবে, একেবারে শেষে বলেছে, ভাই খুবই দুঃখিত, বিষম এক কাজ পড়ে গেছে, জরুরি কাজে আমাকে লিওঁ যেতে হচ্ছে। কিষান লিওঁ যায়নি সেদিন, প্যারিসেই ছিল।

সে রাতে ওর তো তোমাকে স্ক্রু ড্রাইভার বানিয়ে দেওয়া উচিত হয়নি। কিছু বানাতে হলে সে আমি বানাব। আমার বউ আমি দেখব তার কী লাগবে না লাগবে। কিষানের ঘাড়ের রোয়া ফুলে ওঠে বলতে গিয়ে।

ধুর কী যে বলল। তোমারই তো বন্ধু। বউদির সঙ্গে মজা করেছে এই যা। নীলা বলে।

তুমি বুঝবে না, এ সব মজা না। এই পনেরো বছরে প্যারিসের ভারতীয় ছেলেদের কাণ্ড কম শুনিনি, অন্যের বউ ভাগিয়ে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করে, নয়তো অবৈধ সম্পর্ক করে।

কিষান নাক কুঁচকোলো। কপাল কুঁচকোলো। ঠোঁট কুঁচকোলো।

নীলা কুঁচকোনো কিষানের সামনে থেকে সরে জানালায় গিয়ে দাঁড়ায়। আচ্ছা, আজ চলো না তোমার রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার সারি।

কী যে বলো, পুরো সপ্তাহটা কাটে ওই রেস্তোরাঁয়। আজ যাব না! অবশ্য…সামনের সপ্তাহে তোমায় নিয়ে যাব, রেস্তোরাঁয় মাছ মাংস খাওয়াতে…

নীলা ঘুরে দাঁড়ায়। কিষানের দিকে পায়ে পায়ে যেতে যেতে বলে, ঠিক বলছ তো!

ঠিক বলছি, ঠিক।

কিষান নীলার ডান হাত টেনে নিয়ে নিজের চুলে বসিয়ে দিয়ে বলে, দেশি মেয়ের হাতের স্পর্শই অন্যরকম, দেশি মেয়ের স্বাদই আলাদা!

কিষানের চুলে এবং টাকে দুটোতেই হাত বুলিয়ে দিতে দিতে চাপা হাসি ঠোঁটে, নীলা বলে, বিদেশি মেয়ের স্বাদ কেমন?

ধুর। কিষান ঠোঁট ওলটায়।

কেউ কি হাত বুলিয়ে দিয়েছে চুলে? কিষানের মুখের ওপর ঝুঁকে বলে নীলা।

কিষান চোখ বোজে। হুলো বেড়াল চোখ বোজে। গড়গড়।

বলছ না যে, কেউ হাত বুলোয়নি?

ওরা এ সবের বোঝেই না, কী বুলোবে!

কী করে জানো যে বোঝেই না?

বোজা চোখ বুজেই থাকে। জানি জানি। কে না জানে!

০৮.

সোমবার সকালে নীলাকে নিয়ে ইল দ্য লা সিতের পুলিশঅফিসে গিয়ে নীলার নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করল কিষান। ঘণ্টা দুয়েক কাটানোর পর যখন বেরিয়ে এল, নীলার ইচ্ছে করে নতরদামে যেতে, কিষানের ইচ্ছে করে না। নীলার ইচ্ছে করে সেইনের পাড় ধরে হাঁটতে, কিষানের ইচ্ছে করে না। এই দ্বীপটিতে, এই ইল দ্য লা সিতের ছিল সবচেয়ে পুরনো বসতি, এখানেই এক উপজাতি জেলেদলের নাম ছিল পারিসি। রোমানরা এসে পরে এ জায়গা দখল করে নিয়ে সেইনের ধারে বাড়ি ঘর তুলেছিল, রোমান শহরের চিহ্ন কিছু আছে ওপারে। জানো, ওই পারিসি উপজাতির নামেই এ শহরের নাম প্যারিস হল। আগে নাম ছিল লুতেসিয়া। কিষান জানে না, জানার কোনও ইচ্ছে তার নেই। তার তাড়া রেস্তোরাঁয় যাবার। নীলাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে সে চলে গেল। ওই তাড়ায় কিষান ভুলে গেছে তার ঠিকানা আর টেলিফোন নম্বর লেখা নোটবইটি সঙ্গে নিতে। কিষানের ছোট্ট নীল নোটবইটি হাতে নিয়ে এ থেকে জেড পর্যন্ত লেখা নামগুলো দেখে নীলা। বেশির ভাগ নামই সে চেনে না। নীলার নাম নেই, বদলে নিখিলের নাম, পাশে বালিগঞ্জের বাড়ির নম্বর। সুনীলের নামের পাশে পাঁচটা ফোন নম্বর, একটি প্যারিসের বাড়ির, দুটো ক্লিনিকের, একটি মোবাইলের, আর একটি কলকাতার বাড়ির।

নীলা শুয়ে নোটবইটি কোলের ওপর নিয়ে সুনীলের আপিসের একটিতে ফোন করল।

ফরাসি ভাষায় একটি মেয়েকণ্ঠ তড়বড় করে কিছু বলল, নীলা কেবল জিজ্ঞেস করল, তুমি কি ইংরেজি জানো?

মেয়েটি সাফ বলে দিল, না। বলে ফোন রেখে দিল। খটাস।

সুনীলের আপিসে আরেকটি নম্বরে ফোন করে এবারও একই কণ্ঠ পেল। খটাস।

সুনীলের নাম থেকে ওপরে চোখ পড়তেই দেখে সানাল।

নম্বরটি নীলা টুকে রাখে। সানালেরও দুটো নম্বর, আপিসের নম্বরে খটাসের ভয়ে নীলা ফোন করে না।

শেষে তাজমহলে, কিষানকে বলতে যে টেলিফোনের নোটবইটি বাড়িতে পড়ে আছে। কিষান নেই, এখনও রেস্তোরাঁয় পৌঁছোয়নি, সবে রেস্তোরাঁ খোলা হল, থাল বাটি সাজানো হচ্ছে, গেলাসে ন্যাপকিন পোরা হচ্ছে। লোবানের গন্ধ ছড়ানো হচ্ছে রেস্তোরাঁয়।

গন্ধটা বিচ্ছিরি লাগে না? নীলা বলে।

এ দেশি লোকেরা আবার এ গন্ধ পছন্দ করে। আমার সহ্য হয় না, মনে হয় কেউ যেন মারা গেছে। মোজাম্মেল বলে।

দুপুরে কী রান্না হচ্ছে ওখানে?

রান্না নতুন করে কিছু হয় না। সেদ্ধ খাবার থাকেই ফ্রিজে, বের করে তেলে ভেজে দাও, বারোয়ারি মশলায় ছেড়ে দাও। তবে তন্দুরি চিকেন আর নানরুটিতে মন ঢালতে হয়। এ দেশিরা এটিই খায় বেশি।

ও।

এদিকে যে অনেকদিন আসেন না!

যাব একদিন, খেতে যাব। মাছ মাংসের স্বাদই ভুলে যেতে বসেছি। ছাগলের মতো ঘাসপাতা চিবোতে হয় শুধু।

মোজাম্মেল হাসে। বলে, যাই বলুন দিদি, শাক সবজিতে ভিটামিন আছে।

তা আছে। এ থেকে জেড পর্যন্ত ভিটামিন টলটল করছে। বলে নীলা নিজেই হাসে।

দিদি আপনি কি লেখাপড়া করছেন না কি চাকরি করছেন?

লেখাপড়া করছি না। তবে চাকরি করছি। ঘর সংসারের চাকরি। বেতন ছাড়া চাকরি।

মোজাম্মেল হাসে, নীলাও।

আচ্ছা মোজাম্মেল, আপনি তো অনেক জায়গায় কাজ টাজ করেছেন, আমার জন্য একটা কাজ খুঁজে দেখবেন।

নীলার কণ্ঠস্বরে মোটেও মনে হয় না, সে কথার কথা বলছে।

আপনি চাকরি করবেন? তো কিষানবাবুকে বলুন না, ওঁর তো অনেক চেনা আছে। আমি তো ছোট চাকরি করি…আমি কী করে বড় চাকরির খোঁজ দেব বলুন।

মোজাম্মেলের কথা শেষ না হতেই নীলা বলে, ছোট চাকরিই করব। আপনি পদার্থ বিজ্ঞানে মাস্টার্স করে থাল মাজেন, আমি বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স করে না হয় ঘরই ঝাড়ু দিলাম। নীলা বলে। নীলার কণ্ঠস্বর শুনে আবারও কেউ বলবে না যে সে মজা করছে।

ছি ছি কী বলছেন দিদি। আমি তো করি আর কোনও উপায় নেই বলে।

আর আমার বুঝি খুব উপায় আছে?

নীলা হাসে, মোজাম্মেলও।

কিষানবাবু তো ভাল টাকা রোজগার করেন।

তো?

কেন, ওতে তো চলছে ভাল।

মোজাম্মেল, কিষান রোজগার করে, ও তো ওর টাকা, আমার তো নয়।

মোজাম্মেল অপ্রস্তুত। থেমে থেমে বলে, আপনি কিষানবাবুকে বললে নিশ্চয়ই…

ও বউদের চাকরি করা পছন্দ করে না…

কেন কিষানবাবুর আগের স্ত্রী তো চাকরি করতেন!

আগের স্ত্রী?

মোজাম্মেল অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলে, কেন দিদি, আপনি জানেন না?

না তো…

মোজাম্মেল খদ্দেরের দোহাই দিয়ে ফোন রেখে দেয়।

সেদিন বিকেলেই নীলা সুনীলের বাড়িতে ফোন করে কিষানের আগের বিয়ের ঘটনাটি সত্য কি না জানতে চায়।

কেন তুমি জানো না?

নাহ।

হ্যাঁ, ওর তো ফরাসি বউ ছিল। ইমানুয়েল। কিষান বলেনি?

নাহ।

বলো কী, আমি তো জানি, তুমি জেনেই বিয়েতে রাজি হয়েছ।

নীলা অনুভব করতে চেষ্টা করে, কিষানের আগে একটি বউ ছিল বলে তার কষ্ট হচ্ছে কিনা। কোনও যন্ত্রণা তার শরীর থেকে মনে ছড়াচ্ছে কি না, আশ্চর্য, না। ছড়াচ্ছে না।

০৯.

কী ব্যাপার এই সন্ধেবেলা ঘুমোচ্ছ? কিষান ঘুমের নীলাকে ডেকে প্রশ্ন করল।

আড়মোড়া ভেঙে নীলা বলল, সময় খুব বড় শত্রু আমার, তাই সময়কে হত্যা করছি একরকম, ঘুমিয়ে।

রাতে দুজন লোক আসবে, বেশ কিছু পদ রান্না করতে হবে। শুরু করে দাও এক্ষুনি।

নীলা হেসে বলল, এই তো ব্যস্ত বানিয়ে দিলে। কারা আসবে শুনি?

এক পাঞ্জাবি দম্পতি। তুমি চেনো না।

কেবলই দেশি বন্ধু, তোমার বিদেশি বন্ধু নেই?

আছে, তবে বাইরে, ঘরের বন্ধু দেশিই হয়।

ইমানুয়েলও কি বাইরের বন্ধু ছিল?

ইমানুয়েল কে?

তোমার স্ত্রী।

ও তা খবর দিল কে?

যেই দিক না।

মনে হয় তুমি খুব ভেঙে পড়লে?

মোটেই না! এত সহজে ভাঙলে চলবে!

ইমানুয়েলকে বিয়ে না করলে আমার ফরাসি নাগরিক হওয়া হত না, আর সে সুবাদে যে তোমারও হচ্ছে, সেটিও হত না।

তুমি তো আগে বলনি ইমানুয়েলের কথা।

কেন, আগে জানালে বুঝি এ বিয়েতে রাজি হতে না?

হয়তো না।

হতে হতে।

কী করে জানো হতাম?

হতে কারণ প্রেমিকপ্রবর সুশান্ত তোমাকে ছেড়ে যেভাবে পালিয়েছে, আমি না বিয়ে করলে তোমাকে কেউ বিয়ে করত না, খবর তো আর কম রটেনি। শুয়েছও তো ও ছেলের সঙ্গে, শোওনি?

নীলার বুকের ভেতর এক কলস ঠাণ্ডা জল উপুড় হয়ে পড়ল।

কী শুয়েই থাকবে নাকি? রান্না করতে হবে তো! কিষান টাই ঢিলে করতে করতে গলা চড়ায়।

১০.

সকালে কিষান বেরিয়ে যাবার পর নীলা অলস শুয়ে রইল। শুয়ে শুয়ে ভাবছিল গত রাতে পাঞ্জাবি বন্ধুদম্পতি নিয়ে মধ্যরাত অব্দি কিষানের হইচই এর কথা। নীলা শোবার ঘর থেকে শুনেছে, তিন মাতালের উচ্ছ্বাস। যা রান্না করেছিল, কিষান বারবারই বলেছে, মোটে ভাল হয়নি। নান পুড়ে গেছে, ডালমাখানিতে কিছু একটা কম হয়েছে, কী কম হয়েছে তা অবশ্য বলেনি আর ফুলকপির তরকারি, পাঞ্জাবি বউটি যদিও বলেছে ভাল, জিভে চুক চুক শব্দ করে কিষান বলেছে আরও ভাল হতে পারত। নিজেকে নীলার মনে হয়েছে, সে তার মা, সে মলিনা। অনির্বাণ এমন আচমকা বলে বসতেন, রাঁধো তো, বন্ধুরা খেতে আসছে। মলিনা রান্নাঘরে ঘেমে নেয়ে রাঁধতেন। খেতে গিয়ে অনির্বাণ সব সময়ই এটা ওরকম হলে ভাল হত আর এটা না হয়ে ওটা হলে স্বাদ হত এ সব বলতেনই। মলিনা স্বামীকে যত তুষ্ট করতে চাইতেন, তত ব্যর্থ হতেন।

নীলা সানালকে ফোন করে।

ওপাশে সানাল গলা শুনে চিনতে পারেনি, চিনতে পারার কোনও কারণও নেই।

নীলা। নীলাঞ্জনা মণ্ডল।

ও মিসেস কিষানলাল!

হ্যাঁ মিসেস কিষানলাল।

তা কী খবর মিসেস লাল। হঠাৎ?

নীলা টের পায় সানাল আশা করছে কোনও জরুরি খবরের।

না এমনি। এমনি ফোন করলাম। নম্বরটা পেলাম। ভাবলাম জিজ্ঞেস করি কেমন আছেন।

আমি ভাল আছি। বেশ ভাল। হা হা। তা আপনি কেমন আছেন! সানালের সেই উৎফুল্ল কণ্ঠস্বর।

আমার আর থাকা! তা আসুন না একদিন আমাদের বাড়িতে। অনেকদিন আপনাকে দেখি না। নীলার গলায় ব্যাকুলতা।

তা স্বামী দেবতাটি কোথায়? ঘরে আছে?

নেই। ওর তো দিনরাত ব্যস্ততা।

হুম। বিদেশে ব্যস্ত না থাকলে চলেও না..তা ভাবীজি আমারও ব্যস্ততা ভীষণ। এই তো ছুটতে হবে কাজে।

সানালের ব্যস্ত কণ্ঠ।

ও। ঠিক আছে। আমি বোধহয় অসময় ফোন করলাম।

নীলা ফোন রাখে। নিজের ওপর রাগ হয় তার। কেন এই ফোনটি সে করেছে, কেন সে শুনতে গেছে যে সানাল খুব ব্যস্ত, এত ব্যস্ত যে নীলা যেচে ফোন করার পরও তার যেহেতু এখন সময় নেই, কখন সময় হবে কথা বলার, সকালে না হলে দুপুরে, দুপুরে না হলে রাতে, আজ না হলে কাল তা বলেনি। এত ব্যস্ত যে নীলা যে ভাল নেই তার ইঙ্গিত দেবার পরও সানালের এতটুকু উৎসাহ হয়নি জানতে কেন নীলা ভাল নেই, কী ঘটেছে বা কী ঘটছে।

সানালের সঙ্গে সে কেন কথা বলছে চেয়েছে! এ কি কেবল কারও সঙ্গে কথা বলার জন্যই! কারও সঙ্গে কথা বলার জন্য এমনই যদি আকুতি, তবে সে মলিনার সঙ্গে বলতে পারত অথবা কলকাতার পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে। কলকাতা যেহেতু দূরে, যেহেতু কিষান বলেছে, ঘন ঘন বিদেশে ফোন করলে ফ্রান্স টেলেকমের ধারালো ছুরিতে গলাটা কাটা পড়বে, সে প্যারিসেই সুনীল বা চৈতালির সঙ্গে বলতে পারত যত কথা আছে মনে। বলেনি কারণ নীলা সানালের সঙ্গেই চেয়েছে বলতে, যে সানালের দুর্নাম আছে অন্যের বউয়ের সঙ্গে রং তামাশা করার, যে সানালের দুর্নাম আছে অন্যের বউয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার, অন্যের বউকে ভাগিয়ে নিয়ে যাবার, সেই সানালকেই নীলা চেয়েছিল তাকেও যেন ভাগিয়ে নেয় এ বাড়ি থেকে, যে করে হোক। নীলা নিজেকে প্রশ্ন করে, এই কি কারণ? নীলা কারণ জানে না। আজকাল নীলার মনে হয় অনেক কিছু সে জানে না। কেন সে সারাদিন শুয়ে থাকছে সে জানে না। কেন সে উঠে চা পর্যন্ত খায়নি, সে জানে না। কেন সে স্নান করতে ওঠেনি, দুপুরের খাবার খেতে না, এমনকী জানালায় দাঁড়িয়ে রাস্তার কোলাহল দেখতেও না, সে জানে না। কেন সে সুনীলের বাড়ি থেকে আনা বইগুলো পড়তে নিয়েও রেখে দিয়েছে, সে জানে না।

বিকেলে ফোন বাজে, নীলা ফোনের দিকে পিঠ ফিরে শোয়, কেউ হবে হয়তো, কিষান কিংবা রেস্তোরাঁর কোনও লোক তাকে খুঁজছে, অথবা কোনও পাঞ্জাবি কারবারি।

শ্রুতিযন্ত্রে সুনীলের কণ্ঠ শুনে নীলা রিসিভার তোলে, কী ব্যাপার নীলা, ফোন ধরছ না।

শুয়েছিলাম। ক্লান্ত স্বর নীলার।

এই অসময়ে? তা আছ কেমন?

এই তো।

কিষান বাড়িতে?

না।

কী ব্যাপার ও রেস্তোরাঁয় নেই। মোবাইলও ধরছে না, ভাবলাম বাড়ি আছে বুঝি।

নেই।

তা কী করে সময় কাটাচ্ছ? কী কী দেখলে প্যারিসে?

ইফেল টাওয়ার দেখেছি।

আর?

আর কিছু দোকান।

ল্যুভরে যাওনি?

না।

মিউজি দর্সে?

না।

পিকাসো, রোদ্যাঁ কিচ্ছু না?

না।

কিষানকে একদিন বলেছিলাম আমাদের সঙ্গে তোমাকে যেন বেরোতে দেয়, তা হলে প্রদর্শনীগুলোয় নিয়ে যেতে পারতাম, আর দেখার এত কিছু আছে এ শহরে, ও বলল ও নিজেই নাকি তোমাকে নেবে, আর বিয়ের পর পর কেউ কি বউ ছাড়তে চায়, স্ক্রৈন হয়ে থাকে তো অন্তত ক’মাস।

বলে সুনীল হাসে দম টানা হাসি। হেসে আবার বলে, আমি নিজেকে দিয়ে বুঝি, চৈতালিকে বিয়ে করার পর তো কাজেই যাইনি পুরো দু মাস। চব্বিশঘণ্টা আঠার মতো লেগে ছিলাম দুজনে।

আচ্ছা, সুনীলদা, আপনার হাতে কোনও চাকরি টাকরি আছে? নীলা আচমকা প্রশ্ন করে।

চাকরি? কেন? কার জন্য?

আমার জন্য।

তুমি চাকরি করবে?

করব।

কিষানকে বলেছ? ও কী বলে?

ওকে বলিনি।

ওকে বলনি? তা হলে হবে কী করে?

কিষান কিষান কিষান, কিষান ছাড়া যেন আমার জীবনে কিছু হবার নয়।

না সে কথা বলছি না। কাজ করার আগে ভাষাটা তো শিখতে হবে…

ভাষা শিখব কোথায়?

আলিয়ঁস ফ্রসেজে যাও না কেন! কিষানকে বলো…

আমাকে ঠিকানা দিন, কী করে যেতে হয় বলুন, আমি একাই যেতে পারব।

কিষান তো রাগ করবে…

নীলা দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে।

ওপাশ থেকে সুনীল বলে, কিষান বাড়ি এলে বোলো বাড়িতে আমাকে একবার ফোন করতে।

কোনও জরুরি ব্যাপার?

আরে ওই পুজোকমিটির ব্যাপার। ও কিছু চাঁদা দেবার লোক জোগাড় করে দেবে বলেছিল।

ও৷

১১.

যে চাবি ঘরে আগুন না লাগলে ব্যবহারের পরামর্শ কিষান দেয়নি, সে চাবি ঘরে আগুন লাগেনি, অথচ নীলা ব্যবহার করে। বাইরে বেরোয় সে। বেরিয়ে রাস্তায় এলোপাতাড়ি হাঁটে। পকেটে শহরের একটি মানচিত্র আর কিছু ফ্রাঁ। গার দ্য নর্দ নামের সেই প্রাসাদের ভেতর ঢুকে দেখে, মানুষ ঢুকছে, বেরোচ্ছে, রেলগাড়ি থামছে, ছাড়ছে। নীলা একটি থামে হেলান দিয়ে রেলগাড়ি দেখে, ইচ্ছে করে দূরে কোথাও যেতে। রাজপুত্রের মতো দেখতে নীল চোখের সোনালি চোখের যুবকেরা রেলগাড়িতে চড়ে কোথায় যেন চলে যাচ্ছে, নীলাকে কেউ নিচ্ছে না, নীলার দিকে কেউ তাকাচ্ছে না। তার হঠাৎ মনে হয় সে দৃশ্যমান তো! নিজের দিকে তাকায়, পাট ভাঙা কালো জিনস, তার ওপর সাদা একটি সিলকের শার্ট, শার্টের ওপর গোলাপি একটি কার্ডিগান, পায়ে পালিশ করা কালো জুতো, নীলাকে নীলা নিজেই বোঝে মোটেও কুৎসিত লাগছে না। তবু কেন তার দিকে কারও তাকাবার রুচি হয় না। কলকাতার রাস্তায় হাঁটলে সে নিশ্চিত যে কোনও পুরুষই তাকে ফিরে ফিরে দেখত। প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে আবারও নীলা উদ্দেশ্যহীন হাঁটে, হেঁটে হেঁটে একটি বাসস্টপে দাঁড়াতেই মুহুর্মুহু বাস আসছে, একটিতে চড়ে বসে। কোন বাস, কী বাস, কোথায় যাচ্ছে কিছু না জেনেই সে চড়ে। কিষান একবার বলেছিল, নীলা হারিয়ে যেতে পারে একা বেরোলে। তার মনে হয়, সে যদি হারিয়ে যায়, যাক, ক্ষতি কী। নীলা নিজেকে হারাতে চায়। এমন কোথাও চলে যেতে চায় যেখান থেকে বাড়ির পথ আর সে চিনবে না। বাস যতদূর তাকে নেয়, সে যায়। এক বাস থেকে নেমে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক হেঁটে আবার সে নতুন বাসে চড়ে। কখনও উদাস, কখনও ঔৎসুক্য চোখে। কলকাতার বাসে গাদাগাদি ভিড়, ভ্যাপসা গরম, জানালায় বসলে ধুলোয় চোখ মুখ চুল ভেসে যায়। আর এখানকার শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাসের চারদিকটা প্রশস্ত জানালায় মোড়া, ধুলোর বংশও নেই। সামনের দরজা দিয়ে ওঠো, কমলা রঙের টিকিট, মাসের টিকিট, ওঠার সময় ড্রাইভারের সামনে কেবল উঁচিয়ে ধরো, ঢুকে যাও, আর কমলা টিকিট না থাকলে ড্রাইভারের কাছ থেকে সবুজ টিকিট কিনে নাও আট ফ্রাঁ দিয়ে, ছোট মেশিনে সে টিকিট ঢোকালে কড় কড় শব্দ করে সময় তারিখ বসিয়ে দেবে। নিয়ে গদিঅলা চেয়ারে বসে যাও। কোনও চিৎকার নেই, চেঁচামেচি নেই, রাজনীতির গল্প নেই, মাছের বাজারের আলাপ নেই, ঘর সংসারের বর্ণনা নেই। সকলেই শান্ত, সকলেরই সুখী মুখ, কারও ব্যাপারে কেউ নাক গলাচ্ছে না। সাদা সব মানুষের মধ্যে বাদামি রঙের এক মেয়ে বসে আছে, কেউ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করছে না তুমি কোত্থেকে এসেছ, কোথায় দেশ, কোথায় বাড়ি। নীলা বাসের ভেতরের বাইরের সুখী মুখগুলো দেখে, দেখে এক যুবক যুবতী উঠল বাসে, প্যারামবুলেটরে বাচ্চা ঠেলে। বাচ্চা ঘুমিয়ে আছে আর যুবক যুবতী এক বাস লোকের সামনে দাঁড়িয়ে চুমু খাচ্ছে। গভীর চুমু। ফরাসি চুমু। নীলার কান লাল হয়ে ওঠে লজ্জায়। নীলা দেখে বাসের আর কেউ তাকাচ্ছে না চুমুখাওয়া জোড়ার দিকে। কলকাতায় এ ঘটনাটি ঘটতে পারত না, বাসে কেউ যদি চুমু খায়, অশালীন কর্ম করার দায়ে বাসের লোকেরা ধাক্কা দিয়ে জোড়া ফেলে দেবে বাইরে। রাস্তায় অশালীন কর্মটি করলে রীতিমতো ঢিল ছুড়বে লোকে। নীলা ভাবে, এই যে চুমু খাচ্ছে এরা, খেতে ইচ্ছে হচ্ছে বলে খাচ্ছে, চুমুটাকে বাড়ির শোবার ঘরের জন্য রেখে দিচ্ছে না, আড়াল খুঁজছে না, অন্ধকার খুঁজছে না, এর মতো শালীন এবং সুন্দর ব্যাপার আর হয় না। কলকাতার রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে কোনওদিন সুশান্তর হাতে হাত রেখে হাঁটতে পারেনি সে, লোকে কী বলবে বলে। লোকে কী বলবে বলে সন্ধের পর চারদিক কালো হলে শহর থেকে চার মাইল দূরে গিয়ে অন্ধকার ঝুপড়ির আড়ালে কোথাও কেউ নেই, এমন জনমনুষ্যহীন জায়গায় এদিক ওদিক দেখে নিয়ে ভয়ে ভয়ে একটি কি দুটি চুমু খেয়েছে। নীলার আর সুশান্তর সবচেয়ে বেশি ভয় ছিল মানুষের। শেয়াল ডাকছে ঝুপড়ির পেছনের জঙ্গলে, সে ক্ষতি নেই, মানুষ ডাকলেই সর্বনাশ।

নীলা দেখছে যুবকটি একটির পর একটি চুমু খাচ্ছে আর যুবতীটির পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করছে। এক শরীরের সঙ্গে আরেক শরীর মিশে একাকার। নীলার ইচ্ছে করে মেয়েটির মতো আদর পেতে, ইচ্ছে করে এমন এক সুদর্শন যুবক তাকে এমন করে ভালবাসুক, এমন করে জড়িয়ে থাকুক, এমন গভীর করে চুমু খাক। সেইন নদীর কাছাকাছি এলে নীলা নামে বাস থেকে, সেইনের পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে ফুটপাতের সারি বাঁধা সবুজ বাক্স বইয়ের দোকানগুলো দেখে। পর্যটকের ভিড় দোকানের সামনে, বই কেনার নয়, ভিড় ছবি তোলার। হাঁটতে হাঁটতে চোখের সামনে দেখে ল্যুভর জাদুঘর। অপ্রকৃতিস্থের মতো সে দৌড়ে যায় জাদুঘরে। জাদুঘরের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে অতি ক্ষুদ্র পিঁপড়েসম যদিও মনে হয় তার, বিশালতার কাছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নিজেকে নির্দ্বিধায় সমর্পণ করে। ল্যুভরের বিশাল জগতে নীলা হারিয়ে যায়, সত্যিকার হারানো যাকে বলে। তার আর মনে থাকে না সে কলকাতার কোনও এক অনির্বাণ মণ্ডলের কন্যা নীলাঞ্জনা মণ্ডল, নিজের কোনও অস্তিত্ব সে অনুভব করে না, ভিড়ের মধ্যে কারও কাঁধ কারও হাত নীলার গায়ে ধাক্কা খায়, নীলা অনুভব করে না। রসোলিও থেকে সুলি, সুলি থেকে দেনোতে সে গ্রস্তের মতো হেঁটে যায়, অনুভব করে না সে হাঁটছে, মনে হয় কেউ তাকে নিয়ে যাচ্ছে, কোনও দেবদূত পাখায় করে তাকে এক কোঠা থেকে আরেক কোঠায় নিচ্ছে। দুপুর গড়িয়ে যায় নীলার খিদে পায় না, খিদে পাবে কেন, তেষ্টাই বা পাবে কেন, নীলা এই জগৎ সংসার থেকে অনেক দূরে। এক অসাধারণ আচ্ছন্নতার মধ্যে নীলার বিকেল পার হয়ে যায়। ল্যুভর থেকে বেরিয়ে আসার পরও তার আচ্ছন্নতা কাটে না, কাচের পিরামিডের পাশে পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকে। নীলা ভুলে যায় যে তার বাড়ি ফিরতে হবে, ভুলে যায় যে তার একটিই পরিচয় সে মিসেস লাল, মিসেস কিষানলাল।

বাড়ি ফিরে দেখে কিষান তখনও ফেরেনি। বাথটাবের গরমজলে নিজেকে ডুবিয়ে শুয়ে থাকে। তার উঠতে ইচ্ছে করে না, রাঁধতে ইচ্ছে করে না। কিষান যখন ফেরে তখনও নীলা সাদা ফেনায় ঢাকা। স্নানঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে কিষান বলে, কী ব্যাপার, এই অসময়ে স্নান করছ?

ওঠো ওঠো। তাড়া দেয় সে।

কেন? নীলার ঠাণ্ডা স্বর।

কেন মানে? আমি এসেছি না?

তো?

তো উঠতে হবে। সেদিন কুমড়োর কথা বলেছিলে, দেখো কুমড়ো এনেছি। এ দিয়ে কিছু একটা করো তো। শুনেছি কুমড়োর নাকি মোরব্বা হয়, জানো করতে?

সাদা ফেনায় নিজেকে আরও ঢাকতে ঢাকতে বলে সে, না।

তা হলে বুদ্ধি করে কিছু একটা করো এটি দিয়ে।

তুমি করো না। তোমার তো অনেক বুদ্ধি।

আমি রান্না করতে জানি নাকি!

নীলা বেশ ভাল জানে যে কিষান রান্না করতে জানে, সে এ বাড়িতে আসার আগে কিষান নিজের জন্য রান্না করত। নীলা বেশ ভাল জানে যে তার ইচ্ছে না করলেও এই ফেনা সরিয়ে তাকে উঠতে হবে। মোরব্বা বানাতে না জানলেও, তাকে মোরব্বা বানাতে হবে।

নীলা যখন স্নানঘর থেকে এল, কিষান মীনাক্ষীর সঙ্গে কথা বলছে ফোনে। জানতে চাইছে, কুমড়োর মোরব্বা কী করে বানায়। ধুতে হবে, চামড়া ছাড়াতে হবে, টুকরো করতে হবে, ছিদ্র করতে হবে, চিনির সিরা বানাতে হবে, সে সিরায় কুমড়োর টুকরো ছাড়তে হবে…চারটে লবঙ্গ ছাড়তে হবে, পাঁচটা এলাচ ছাড়তে হবে, কম আঁচে অনেকক্ষণ রাখতে হবে ইত্যাদি।

ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

সে রাতে কুমড়োর মোরব্বা বানিয়ে কিষানকে তুষ্ট করার পর নীলা চিঠি লেখে মলিনাকে,

আমার যদি টাকা থাকত মা, আমি বেশ ভাল বেঁচে থাকতে পারতাম। নিজের টাকা মা, নিজের টাকা না হলে, যার টাকা আছে তার কথায় কথায় সারাজীবন কেবল উঠবে বসবে, তুমি ডানে যেতে চাইলে টাকাঅলা বলবে বামে, তোমাকে বামে যেতে হবে। ইচ্ছের কোনও মূল্য নেই, তুমি যদি কপর্দকহীন হও। অন্যের পয়সায় খাব, আর স্বাধীনতা চাইব, এটি হয় না। তুমি কী আমাকে, কাউকে জানিয়ো না, কিছু টাকা পাঠাতে পারো? যে টাকা এনেছিলাম দেশ থেকে, প্রায় শেষ। নিজের হাতখরচের জন্য কিছু থাকা ভাল।

১২.

সকালে মলিনাকে লেখা চিঠিটি দুবার পড়ে ছিঁড়ে ফেলে নীলা, ছিঁড়ে মোজাম্মেলকে ফোন করে।

যেমন তেমন একটা চাকরি আমাকে খুঁজে দেবেন, যেখানে ভাষাটা খুব দরকার হয় না!

দিদি, সে পারি, পরে না আবার আমার অসুবিধে হয়। মোজাম্মেল অসহজ কণ্ঠে বলে।

ব্যগ্ৰ নীলা, সে বুঝতে পারছি, আমি কাউকে বলব না।

দিদি আমার চাকরিটা থাকবে না…

নীলা কথা দিল কিষানকে সে কিছুতে জানতে দেবে না যে মোজাম্মেলের কোনওরকম ভূমিকা আছে তার চাকরির ব্যাপারে। দোষ সব নিজের ঘাড়ে নীলা নেবে।

নীলা সেদিনও বেরোল। সারাদিন ঘুরে ফিরে সন্ধের মুখে বাড়ি ফিরল।

কিষান ঘরে ফিরে, এক থোকা উৎকণ্ঠা তার স্বরে, জিজ্ঞেস করে, কোথায় ছিলে, ফোন ধরোনি কেন?

কখন ফোন করেছিলে?

দুপুরে করেছি, বিকেলেও।

নীলা একবার ভাবে বলবে সে ঘুমিয়েছিল। আরেকবার ভাবে, না ঘুমিয়ে না, স্নান করছিল। ধুত, স্নান না, টেলিভিশন দেখছিল, ফোনের শব্দ শোনেনি। নীলা যখন যে কোনও একটি বলার, যেটি বললে কিষান স্বস্তি পাবে, খুঁজছিল, আর কিষান দাঁড়িয়েছিল নীলার উত্তরের অপেক্ষায়, তার চোখের সামনে, নাকের সামনে, ঠোঁটের সামনে, নীলা বলল, সে বাড়ি ছিল না। ছিটকে পড়ল কিষান। বাড়ি ছিল না নীলা। বাড়ি ছিল না, তো কোথায় ছিল? বাড়িতে আগুন ধরেছিল? না ধরেনি। ভূমিকম্প হয়েছিল, যা হলে দরদালান থেকে লাফিয়ে নামতে হয়! না হয়নি। কিছুই হয়নি, কিন্তু নীলা বেরিয়েছিল। বেরিয়েছিল, কারণ তার ইচ্ছে করছিল বেরোতে। কিষান তাকে নিয়ে বেরোতে পারত সে নীলা জানে, জেনেও সে একা বেরিয়েছে। কারণ তার একা বেরোতে ইচ্ছে করছিল।

কিষান টাই ঢিলে করে মদের তাকের দিকে যায়, একটি কথা না বলে।

মদের তাক থেকে বোতল হাতে সোফার দিকে যায়, একটি কথা না বলে।

রান্নাঘর থেকে মদের গেলাস আনে, একটি কথা না বলে।

গেলাসে মদ ঢেলে পান করতে থাকে, একটিও কথা না বলে।

নীলা ফ্রিজের খাবার গরম করে টেবিলে এনে রাখে, একটি কথা না বলে।

একটি থালা রেখে যায় টেবিলে, কথা না বলে।

১৩.

রাতে কিষান বাড়ি ফিরে দেখে নীলা সোফায় বসে সামনে টেবিলের ওপর পা তুলে টেলিভিশন দেখছে, টেলিভিশনে কোনও ছবি নয়, নাটক নয়, রীতিমতো ফরাসি খবর। কিষান ঘরে ঢোকে, নীলা যেমন বসেছিল, তেমন বসে থেকেই বলে, আজ ফোন করেছিলে বাড়িতে?

কেন?

বাড়ি ছিলাম না তো, তাই জিজ্ঞেস করলাম।

কিষান জিজ্ঞেস করে, কোথায় গিয়েছিলে?

বিশেষ কোথাও না। আটচল্লিশ নম্বর বাসে চড়ে শাঁ জার্মা দি প্রেতে গেলাম, ক্যাফে দ্য ফ্লোরে বসে চা খেলাম। তারপর বুলোভার্ড শাঁ জার্মায় হাঁটলাম। কত মানুষ হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে দেখি অদ্ভুত সুন্দর এক বাগান, লুক্সেমবার্গ বাগান। সেখানে বসেছিলাম অনেকক্ষণ। তারপর… কার্তে লাতার এক ব্রাসারিতে দুপুরে খেলাম, তারপর, তারপর কী করলাম, ও তারপর

কিষান দাঁতে দাঁত চাপে। নীলা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে স্পষ্ট সে দেখছে। কিষানকে দেখেও সে টেবিল থেকে পা নামায়নি বরং জিজ্ঞেস করার আগেই নিঃসংকোচে, নির্ভয়ে, নিরুদ্বেগে, নির্বিকারে, নিশ্চিত নির্লিপ্তিতে বর্ণনা দিচ্ছে নিজের নিন্দনীয় নিষিদ্ধ আচরণ। নিশপিশ করা দুটো হাত কিষান মুঠো করে রাখে, মুঠো না করলে সে দুটো হাত নীলার চুলের মুঠি ধরে সোফা থেকে উঠিয়ে ধাক্কা দিয়ে বাইরে ফেলত, দরজার বাইরে।

যাও, এবার তোমার শখের ঘুরে বেড়ানোর সাধ মেটাও।

গা এলিয়ে, কেলিয়ে, নীলা বলে দেখলে তো দিব্যি ঘুরে এলাম, কোনও অসুবিধে হয়নি, রাস্তায় দু একজনকে অবশ্য জিজ্ঞেস করতে হয়েছে কোথাকার বাস এ সব। আমি কচি খুকি নই তা দেখলে তো!

তুমি যে কচি খুকি নও, সে বেশ আন্দাজ করতে পারছি। দাঁতে দাঁত। এরকম ব্যাটাছেলেদের মতো পা তুলে বসেছ কেন?

কে বলেছে ব্যাটাছেলেদের মতো! আমি তো একেবারে খাঁটি মেয়েদের মতো পা তুলে বসেছি। নীলা খিলখিল হাসে।

পা নামাও।

কেন? তোমার বসতে অসুবিধে হচ্ছে? নীলার সরল প্রশ্ন।

আমার চোখে অসুবিধে হচ্ছে। তোমার ওই উরু ফাঁক করে বসাটা দেখতে বিচ্ছিরি লাগছে। আবারও দাঁতে দাঁত।

তা হলে দেখো না। মিটে গেল। সরল উত্তর।

ঠিক আছে দেখব না। দূরে যাও তুমি। কিষানের তপ্ত স্বর।

আমি কেন, তুমি দূরে যাও। বলে নীলা পা নামায়। পা নামায় এ কারণে যে কিষান খুব স্বাভাবিক ভাবে খুব শান্ত গলায় একটি খুব সত্যি কথা এখন বলতে পারে, বলতে পারে যে এটা আমার বাড়ি, আমি কোথায় বসব না বসব তা তুমি বলে দিতে পারো না।

খাবার দাও টেবিলে। দাঁত খিঁচিয়ে বলে কিষান।

খাবার কেন? মদ খাও। নীলা বলে।

মদ খাব কি খাব না, সে তোমার বলে দিতে হবে না। খেতে ইচ্ছে করলে আমি নিজেই খাব।

আবারও সেই আদেশ, খাবার দাও টেবিলে।

খাবার তো রাঁধিনি। নীলার শান্ত স্বর।

কেন?

সময় পাইনি।

তোমার নাকি সময়ের অভাব নেই। সময় নিয়ে কী করবে তাই ভেবে পাও না! বলতে গিয়ে ছোট চোখ আরও ছোট হয় কিষানের।

সে তো অকাজে ঘরে বসে থাকলে। নীলা দাঁতে নখ খুঁটতে খুঁটতে, বলে, এবারে পায়ের ওপর পা তুলে, কাল বেরোবার আগে আমাকে কিছু টাকা দিয়ে যেয়ো তো।

কেন?

কিছু বই কিনব।

কী বই?

আজ সেইনের ধারে হাঁটতে গিয়ে দেখলাম ইংরেজি বইয়ের এক দোকান। আসলে এ শহরে একটি নয়, বেশ কটি ইংরেজি বইয়ের দোকান আছে। কিছু বই কিনলে সময় কাটবে।

আমার খুব হিসেব করে চলতে হয় নীলা। কিষান উঠে দাঁড়ায়, টাই ঢিলে করতে।

আচ্ছা আমি চাকরি বাকরি কিছু করলে তো পারি…এভাবে বসে থাকার চেয়ে…নীলা তাকায় কিষানের দিকে নরম চোখে।

তোমার তর সয় না নীলা, বড় অস্থির তুমি। বড় খাই খাই তোমার। বড় চাই চাই তোমার। ক’দিন হল এসেছ? দু মাস, তিন মাস…এরই মধ্যে তুমি ছটফট করছ!

আমি জীবনে কখনও এরকম বসে কাটাইনি। কলকাতায় লেখাপড়া করতাম, সঙ্গে টিউশনিও। নিজের হাতখরচটা হত।

তোমার হাতখরচ, পাখরচ, মাথাখরচ, যা যা খরচ আছে, আমি কি দেব না বলেছি? দিচ্ছি না?

নীলা হেসে বলল, তাহলে দাও, আমার হাতখরচ দাও। পা মাথার খরচ তো চাইছি না।

হাতখরচের দরকারটা কী, আমি বুঝতে পারছি না। তোমার যা দরকার সব আছে এ বাড়িতে। যা যা দরকার, সব পাচ্ছও। মদের তাকের দিকে যেতে যেতে বলে কিষান।

আমার আইসক্রিম খাবার দরকার। বাড়িতে কোনও আইসক্রিম নেই।

ঠিক আছে কাল আমি দশ প্যাকেট আইসক্রিম কিনে আনব, যত ইচ্ছে খেয়ো।

নীলা দাঁত থেকে নখ নামিয়ে জোরে হেসে বলে, আমার মাংস খাবার দরকার।

কে বলল দরকার? মাংস ছাড়া মানুষ বেঁচে আছে না? আমি বেঁচে নেই?

মদের বোতল টেবিলে শব্দ করে রেখে কিষান বলে।

হ্যাঁ আছো, বেঁচে থাকাটাই তো কেবল আমার উদ্দেশ্য নয়। আরও কিছু দরকার।

কী দরকার?

নীলা কিষানের চোখে চোখ রেখে ধীরে, শান্ত গলায় বলে, তুমি রুটির কথা বলছ, কেবল রুটি দিয়ে সব হয় না, গোলাপও দরকার হয়।

ঠিক আছে, কাল একশো গোলাপ কিনে তোমাকে দেব।

তুমি দেবে। কিষান, তুমি দিতে চাও আমাকে। কিন্তু আমি যে আমাকে কিছু দিতে চাই।

১৪.

কম্পিউটার বাক্সবন্দি করার চাকরি পেল নীলা। সপ্তাহে দেড় হাজার ফ্রাঁ। এই বা কম কীসে, নীলার কাছে এ অনেক। সকালে কিষান যখন ঘুম থেকে ওঠে, পেছন পেছন নীলাও ওঠে, কিষানের মতো নীলাও বাইরে বেরোয়, কিষান গাড়িতে, নীলা মেট্রোয়, গার্দ দ্য নর্দ থেকে দু নম্বর লাইন ধরে বেলভিল, বেলভিল থেকে এগারো নম্বরে উঠে মেট্রো টেলিগ্রাফ। মেট্রো থেকে নেমে রু পেলপোর্ত ধরে হাঁটলেই রাস্তার ওপর কারখানা। চাকরিতে ঢুকেছে এই খবরটি নীলা প্রথম দেয়নি কিষানকে। বাড়িতে কুরুক্ষেত্র বাধাক কিষান, সে চায়নি।

কিষান চণ্ডিগড়ের লোক, কুরুক্ষেত্রেই জন্ম, রক্তের টান বলে কথা। পাণ্ডবে কৌরবে যুদ্ধ বেধে গেল, আর কিষান তো ভগবানেরই সন্তান, ফাঁক পেলেই কৃষ্ণনাম জপে। নীলাকে বেশ অনেকদিন বলেছে, জন্মাষ্টমীর আগে আগে তাকে নিয়ে সে চণ্ডিগড় যাবে, কী ঘটা করেই যে কৃষ্ণের জন্ম উৎসব হয় চণ্ডিগড়ে তাকে দেখাবে সে। হোলি উৎসবও দেখাবে, রঙে ডুবতে চাইলে নীলাকে এমন রঙে ডোবাতে পারে কিষান যে নীলার জীবন ফুরিয়ে যেতে পারে কিন্তু রং ফুরোবে না। নীলা প্যারিসের স্থাপত্য দেখে হাঁ হয়েছে আর কত, চণ্ডীগড় দেখলেও তেমনই হবে, চণ্ডীগড় তো ফরাসি স্থপতি লা করবুসিয়ের করা। মসিয়ে হুসমান থেকে করবুসিয়ে কম কীসে! জারদা দ্য লুক্সেমবার্গ বা জারদা দ্য প্লানত দেখে নীলা উচ্ছ্বসিত হয়, চণ্ডিগড়ের পিঞ্জরবাগান, শুখনালেক, শান্তিকুঞ্জ দেখলেও কম হবে না। কিষানের বর্ণনাতেও নীলা আগ্রহ দেখায়নি চণ্ডিগড় যেতে। কলকাতায় বিয়ের অনুষ্ঠানে নীলা চণ্ডিগড় থেকে আসা কিষানের যে কজন আত্মীয়কে দেখেছে, তাতে তার মনে হয়নি চণ্ডিগড়ে এদের সঙ্গ সে সামান্যও উপভোগ করবে।

খবর লুকিয়ে রাখা যায় না। কিষান জেনে যায় নীলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোনও এক বাক্সবন্দির দোকানে কাজ করে। যেদিন জানল কিষান, সেদিনই বাড়িতে ডাকল সুনীলকে।

সুনীল বাড়ি ঢুকে এ ঘর ও ঘর হেঁটে কিষানের মুখোমুখি বসে বলল, কী ব্যাপার, জরুরি তলব কেন, হয়েছে কী?

নীলা ফরাসি ভাষা শেখার বই পড়ছিল শুয়ে। সুনীলকে দেখে বই রেখে, ক্যাসেটেও বাজছিল ফরাসি উচ্চারণ শেখানো, বন্ধ করে, উঠে এল।

বাহ্, ভদ্রলোক কি পথ ভুলে? নীলার মুখে মিষ্টি হাসি।

সুনীলের গম্ভীর মুখ, উত্তর নেই। তলবের কারণ সে তখনও বুঝে উঠতে পারছে না।

এ কেমন মেয়ে তুমি বিয়ে করালে সুনীল, এ তো কথা শোনে না, যা ইচ্ছে, তাই করছে। অভিবাদনের আগে আগে অভিযোগ জানায় কিষান। নীলা সোফায় নয়, খাবার টেবিলের একটি চেয়ার টেনে সামনে বসে।

কী করছে? ঘটকচূড়ামণি এখন বিচারকের আসনে।

ওকেই জিজ্ঞেস করো কী করছে। কিষান কাটা দাগের থুতনি তুলে নীলাকে দেখায়।

সুনীল মুখ খোলার আগেই নীলা বলে, খারাপ কিছু করছি না।

কত বড় স্পর্ধা দেখো আমাকে না জিজ্ঞেস করে ও নিজে চাকরি নিয়েছে।

তাই নাকি? সুনীল সুতীক্ষ্ণ চোখে তাকায় নীলার দিকে জানতে যে কিষান যা বলছে তা সত্যি কি না, নীলা সত্যি সত্যি কিষানকে না জানিয়ে কোনও চাকরি নিয়েছে কি না।

নীলা মাথা নাড়ে, নিয়েছে।

কত ফ্রাঁ পায় ওখানে, ও কটা ফ্রাঁ কি আমার কাছে চাইলে পারে না? ওর জন্য ঘর সংসার ফেলে এভাবে আজেবাজে যতসব কালো লোকদের সঙ্গে কাজ করতে হবে! কিষান এক দমে বলে নিয়ে দম ছাড়ে, সেই ছাড়া দমের সঙ্গে সঙ্গে পেটের তেল চায় শার্টের বোতাম ফেটে বেরোতে।

তুমি বুঝি সাদা? বলে নীলা রান্নাঘরে চপ্পলের চটাস চটাস শব্দ তুলে গেল চায়ের জল চড়াতে।

আমার মান সম্মান সব গেল সুনীল। কিষান বড় শ্বাস ফেলে।

সামনে মদ নেই। টেলিভিশন খোলা নেই। শুকনো স্তব্ধতা সামনে নিয়ে দুজন বসে থাকে।

অনেকক্ষণ বাদে কিষান মলিন স্বরে বলে, সুনীল কিছু বলছ না যে! এর তো একটা বিহিত করতে হবে।

সাদা দেয়ালের দিকে উদাস তাকিয়ে সুনীল বলে, আমি কী বলব, তোমরা স্বামী স্ত্রী, তোমরা এর মীমাংসা করো।

ওকে চাকরি ছাড়তে বলো। কিষানের গলায় বাঘের জোর। অস্থির আঙুলগুলো মুঠোর ভেতর।

এবার দেয়াল থেকে চোখ সরিয়ে সুনীল কিষানে চোখ ফেলে, আমি বলব কেন, তুমি বলো।

খানিক বিরতি দিয়ে সুনীল থেমে থেমে বলে, বিদেশ বিভুঁয়ে আমার মনে হয় দুজনের কাজ করাই ভাল, একজনের টাকায় তো পোষায়ও না। আমি আর চৈতালি দুজন চাকরি করছি, আমাদের বেশ ভাল চলে যায়। তুমি যদি মনে করো, তোমার টাকা পয়সা খুব বেশি…বউকে পালঙ্কে শুইয়ে রাখবে, সে তোমার ব্যাপার।

কিষান উঠে এক গেলাস জল খায়, আবার ফিরে আসে সোফায়, বলতে বলতে যে হ্যাঁ আমি জানি, দুজনের উপার্জন করা ভাল। এতে সংসারে সচ্ছলতা আসে। কিন্তু কী কাজ ওর করতে হবে, কী করলে ভাল, কী করলে মান সম্মানও থাকে, টাকা পয়সাও আসে, তা আমার চেয়ে ও ভাল বুঝবে?

সুনীল মাথা নাড়ে, না, নীলা কিষানের চেয়ে ভাল বুঝবে না।

সুনীলের এমন গম্ভীর মুখ নীলা এর আগে দেখেনি, যে ভাষায় বৈঠক চলছে, ইংরেজি, সে ভাষাতেই বলে সুনীল, তুমি যা করবে কিষানের সঙ্গে পরামর্শ করে করো। ও তোমার স্বামী, ও তো তোমার কোনও খারাপ চায় না।

দুজনে নীলার উত্তর আশা করছে, আশা করছে নীলা বলবে যে ঠিক আছে, মেনে নিচ্ছি, অন্যায় করেছি, কাল থেকে ওই চাকরিতে আমি আর যাচ্ছি না। এখন থেকে আমার স্বামীর আদেশ মতো চলব। ও যেদিন চাকরি করতে বলবে, সেদিন করব। যে চাকরি করতে বলে, সে চাকরি করব, কারণ ও আমার চেয়ে ভাল বোঝে কোন চাকরি ভাল, কোন চাকরি মন্দ। আমার ভাল ওর চেয়ে বেশি তো আর কেউ চায় না। ইত্যাদি ইত্যাদি…

নীলা নীরব থাকে।

নীরবতা ভাঙে সুনীল, বলে, এরকমও হয়, এখানকার বাঙালির বাচ্চাদের ও বাংলা শেখাল, ঘরেই একটা ইস্কুল খুলে নিতে পারে।

কিষান ঠোঁট বাঁকায়, বলো যে সরবনে বাংলার প্রফেসর হতে। এত কি সোজা এসব নাকি! একটা রেস্তোরাঁ খুলতে আমাকে বারো বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।

লীলা বলে, তোমার মতো গাধার তো বারো বছর লাগবেই। বাংলায় বলে।

যেন কিষান বলে কেউ এখানে উপস্থিত নেই, যেন মান সম্মান ফিরে পেতে কিষান, তার স্বামী কোনও জরুরি বৈঠকে বসেনি, নীলা সুনীলের দিকে মুখ করে বলে যায়, প্যারিসের ক্যাফে সংস্কৃতি আমাকে খুব মুগ্ধ করেছে। লোকেরা বসে আছে, খবরের কাগজ পড়ছে, বই পড়ছে, লিখছে, আবার সাহিত্যের আসরও বসছে ক্যাফেতে, কী চমৎকার তাই না? আচ্ছা, জঁ পল সার্ত্র নাকি ক্যাফে দ্য ফ্লোরে আড্ডা দিতেন, সিমোন দ্য বোভোয়াও? নতরদামের উলটোদিকে একটা বইয়ের দোকান আছে না, শেকসপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি! ওখান থেকে জেমস জয়েসের ইউলিসিস প্রথম বেরিয়েছে, জানেন সুনীলদা?

জেমস জয়েস কে? কিষান নীলাকে নয়, শুধোয় সুনীলকে।

নীলা উত্তর দেয়, আইরিশ লেখক।

কলকল করে বইছে নীলা, হেমিংওয়েও আড্ডা দিতেন বইয়ের দোকানটায়। টাকা ছিল না বলে দোকানটি থেকে পড়ার জন্য বই ধার নিতেন।

বলে নীলার আশঙ্কা হয় কিষান জিজ্ঞেস করবে, হেমিংওয়ে কে? ভাল যে করেনি, কারণ নীলা মনে একটি উত্তর তৈরি করেছিল ওই প্রশ্নের, হেমিংওয়ে আমার পিসতুতো দাদা হয় গো পিসতুতো দাদা।

সে রাতের বৈঠকে কিছু এগোল না। নীলার ব্যাপারটি অমীমাংসিত রেখেই সুনীল পুজোর চাঁদা নিয়ে পড়ল। ট্রেতে করে চা বিস্কুট আনল নীলা। চা খেতে খেতে সুনীলকে সেই বাঙালি লোকটির কথা জিজ্ঞেস করল, যার যাবার কথা ছিল কলকাতা। সেই লোক কলকাতা পৌঁছেছে, সেই লোক নীলার বাড়িতে শ্যানেল পৌঁছেও দিয়েছে, সেই লোক ফিরেও আসবে শিগরি। সেই লোক আবার কবে যাবে, নীলা জানতে উৎসুক। সেই লোক এ বছর আর যাবে না তবে এ বছর কে যাবে কলকাতা? এ বছর সুনীল নিজেই যাবে, পুজোর পর। আর নীলা কোন বছর যাবে? নীলা কোন বছর যাবে, সে কিষান জানবে।

রাতে ঘুমিয়েপড়া নীলাকে জাগায় কিষান, জামার বোতাম খুলতে মোটা লোমশ হাত বাড়ায়। নীলা সরিয়ে দেয় কিষানের হাত। কিষান শক্ত হাতে নীলার হাত চেপে চাপা কণ্ঠে বলে, আমি একটা বাচ্চা চাই নীলা।

নীলা বলে, আমাকে ঘুমোতে দাও।

প্রায় সে বলতে নিচ্ছিল, কেন, ইমানুয়েল তোমাকে বাচ্চা দেয়নি? কিন্তু উচ্চারণ করে না ও নামটি। করলেই, নীলার আশঙ্কা হয়, কিষান সুশান্তর প্রসঙ্গ ওঠাবে। শুয়েছে কিনা সুশান্তর সঙ্গে। হ্যাঁ শুয়েছে। নীলা নিজে কুমারী নয় বলে যে নিজেকে তার অপরাধী মনে হত, ইমানুয়েলের ঘটনা জানার পর তার সে বোধটুকু নেই, সেই অপরাধবোধ। নীলা বরং অনেক স্বস্তি বোধ করে আগের চেয়ে। ইমানুয়েল তাকে একরকম বাঁচিয়েছে।

১৫.

চাকরি করতে গিয়ে নীলা দেখে বেশির ভাগই কালো, বাদামি আর হলুদ রঙের লোক বাক্সবন্দির কাজ করে। হাতে গোনা কজন কেবল সাদা। প্রথম দিনই মসিয়ে গিগু নীলাকে কী কাজ করতে হবে এবং কী করে, তার নিখুঁত বর্ণনা করলেন ফরাসি ভাষায়। নীলা মসিয়ে গিগুর কথা পুরোটাই শুনে গেছে একটি অক্ষর না বুঝে। গিগু ঘর থেকে বেরোলে ওই হাতে গোনা সাদার দল থেকে একটি মেয়ে, দানিয়েল, এগিয়ে এসে নীলাকে জিজ্ঞেস করে কিছু বুঝলে, কী বলে গেল?

নীলা মুখ মলিন করে বসেছিল। কিছুই বোঝেনি সে।

দানিয়েলে বুঝিয়ে বলল।

সেই থেকে দানিয়েলই ফরাসি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে দেয়, যা কিছু বেরোয় গিগুর মুখ থেকে।

সেই থেকে দানিয়েলই নীলাকে চা খেতে নিয়ে যায় কাছের ক্যাফেতে।

সেই থেকে দানিয়েলকেই অল্প অল্প করে নীলা তার প্যারিসে আসার গল্প করে, কিষানের সঙ্গে তার জীবনযাপনের গল্প করে।

ক্যাথারিন, আরেকটি সাদা মেয়ে, ভাঙা ইংরেজিতে একদিন বলে, তুমি ভারত থেকে এসেছ তাই না?

নীলা হ্যাঁ বলার আগেই ক্যাথারিন বলেছে কিছু টাকা জমলেই সে ভারত যাবে। এই বাক্সবন্দির কাজ করে সে যা পায় তা জমিয়ে দূরের কোনও দেশে চলে যায়। গত বছর গিয়েছিল মালটায়। তার আগের বছর মার্টিনিতে। ক্যাথারিন কলেজ দ্য ফ্রান্সে ইন্ডোলজি পড়েছে, তার থিসিসের বিষয় বাউল। থিসিস লেখার শুরুতে, সে পশ্চিমবঙ্গের অজ পাড়াগাঁয়ে এক বাউলের বাড়ি মাস দুয়েক থেকেও এসেছে। থিসিস তার এখনও জমা দেওয়া হয়নি, আবার সে যাবে, সেই গ্রামে।

বাউলের প্রসঙ্গ আনায় ক্যাথারিনকে মুহূর্তে খুব আপন মনে হয় নীলার। সেদিন দুপুরে একসঙ্গে ব্রাসারিতে খেতে গেল দুজন। খেতে খেতে ক্যাথারিন বর্ণনা করল, কী করে সে হাতে ভাত খেয়েছে বাউলের বাড়িতে, কী করে মাইলের পর মাইল হেঁটেছে কাদাজলে। না কলকাতায় সে থাকেনি, ইচ্ছেও করেনি, ওই গ্রামে গ্রামে বাউলের জীবন দেখতেই তার ভাল লেগেছে। আর সবচেয়ে ভাল লেগেছে যা, যা সে নিয়েও এসেছে একগাদা, তা হল…

নীলার মুখে খাবার, শুনবে বলে সে চিবোনো বন্ধ রাখল।

বিড়ি।

নীলা অনেকক্ষণ ভুলে ছিল মুখের খাবার চিবোতে।

খাওয়া শেষ করে ক্যাথারিন তার পকেট থেকে খুব যত্ন করে একটি বিড়ির প্যাকেট বের করে, দু আঙুলে আরও যত্ন করে একটি বিড়ি তুলে নিয়ে, টানে।

নীলা তার জীবনে কখনও এত কাছ থেকে বিড়ির গন্ধ পায়নি আগে। বিড়ি খাওয়া দেখেছে দূর থেকে, রাস্তার শ্রমিক বা ভিখিরিদের। আগে নীলার এমন জানাও ছিল না যে কোনও গন্ধ এত বিশ্রী হতে পারে।

বিড়ির সৌন্দর্য এবং স্বাদ যে অকল্পনীয় রকমের ভাল, ক্যাথারিন তা হাত পা মুখ মাথা নেড়ে বোঝাতে থাকে আর নীলা নির্বাক বসে বিড়ির বিশ্রী গন্ধ সইতে সইতে শুনতে থাকে এর অসামান্য গুণের কথা।

নীলা সেই বিকেলে বাড়ি ফেরার পথে দানিয়েল আর ক্যাথারিনের সঙ্গে কারখানার পাশেই এক ক্যাফেতে ঢুকল। ওরা কফি খাবে, নীলা চা। চা কফি এলে নীলা বলে, চলো চেয়ার খালি আছে বসি গিয়ে।

দানিয়েল বলল, না এ দাঁড়িয়ে খাবার চা কফি।

নীলা জানত না, ক্যাফেতে তিন রকম দাম আছে খাবারের। ধরা যাক চা, দাঁড়িয়ে খেলে সাত ফ্রাঁ, বসে খেলে আঠারো ফ্রাঁ, আর বাইরের তেরাসে বসে খেলে তিরিশ ফ্রাঁ। দানিয়েল কাগজে তামাক মুড়ে সিগারেট বানায়। সিগারেট ফুঁকে ছাই ফেলে মেঝেয়। এও নাকি নিয়ম, কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কফি খাওয়া লোকেরা কোনও ছাইদানি পাবে না সামনে, যা ফেলবে মেঝেয়।

তোমরা বাঙালি খাবার পছন্দ করো। নীলা জিজ্ঞেস করে।

নিশ্চয়ই। ক্যাথারিন বলে।

দানিয়েল খায়নি কোনওদিন বাঙালি খাবার। লাফিয়ে ওঠে সে প্রস্তাব শুনে।

নীলা ওই তখনই চা খেতে খেতে ক্যাফেতে, নেমন্তন্ন করে বসে দুজনকে। আগামীকাল সপ্তাহের মাইনে নেবে সে, নিয়ে সোজা বাড়ি, বাড়িতে রান্না করবে, কাজ শেষে দানিয়েল আর ক্যাথারিন সন্ধের দিকে চলে যাবে নীলার বাড়িতে, এরকম কথা হল। নীলা ঠিকানা আর ফোন নম্বর লিখে দিল।

পরদিন ঠিক ঠিক তাই করল নীলা। বেলভিল থেকে মাছ মাংস কিনে বাড়ি ফিরল। সারা বিকেল রান্না করল।

সন্ধেয় দানিয়েল আর ক্যাথারিন দুজনই এল। দানিয়েল ওয়াইন এনেছে দু বোতল।

টেবিলে ন’রকমের খাবার এনে রাখল যখন নীলা, দানিয়েল আর ক্যাথারিন দুজনই প্রথম উ লা লা, উ লা লা করল, তারপর মনে তাদের প্রশ্ন, নীলা আর কাকে কাকে নেমন্তন্ন করেছে। আর কাউকে না, কেবল ওদের দুজনকেই। দানিয়েল আর ক্যাথারিন পরস্পরের দিকে চেয়ে বিস্ময় বিনিময় করল।

নীলা, তোমার মাথার ঠিক আছে তো!

নীলা বলল, না ঠিক নেই। তার মন খারাপ।

কেন খারাপ।

আরও দুটো পদ রান্না করতে চেয়েছিল, কিন্তু সময়ের অভাবে হল না।

দানিয়েল ওয়াইন খুলে তিনটে গেলাসে ঢালল।

সঁতে।

বোনা পিতি।

নীলা ওদের থালায় খাবার বেড়ে দিল। কিন্তু নীলার পরিবেশন ওদের ঠিক মনমতো হয় না। নীলা দিতে চায়, প্রথম শাক ভাত, শাক শেষ হলে দিতে চায় নিরামিষ, নিরামিষ ফুরোলে মাছ ভাজা, তারপর মাছের ঝোল, তারপর মাংস…কারণ আলাদা আলাদা করে খেলে সব কিছুর আলাদা স্বাদ পাওয়া যায়, এ যুক্তি দানিয়েলের পছন্দ হয় না, একবারেই সে ন’পদের কিছু কিছুটা করে নিজের থালায় নেয়। বিয়েবাড়ির রেখে দেওয়া থালার খাবার ছুড়ে ফেললে ঠিক এরকমই জগাখিচুড়ি দেখতে লাগে, দেখে নীলার অস্বস্তি হয়। তার ধারণা, ওরা মোটেও এক একেকটি পদের স্বাদ আলাদা করে পাচ্ছে না। মাছ ভাজার সঙ্গে মাংসের ঝোল মেলাচ্ছে। নীলা আহা আহা করে ওঠে, তার আহা আহা বোঝা ওদের পক্ষে সম্ভব হয় না। খেতে খেতে দানিয়েল আর ক্যাথারিন উমমম উমমম শব্দ করে। এই শব্দের অর্থ, খুব স্বাদ।

মাছের ঝোল মুখে পড়তে দানিয়েলের চোখ মুখ কান লাল হয়ে ওঠে। ক্যাথারিন বাউলের বাড়িতে ঝাল খেয়েছে, সুতরাং তার, সে বলল, অসুবিধে হচ্ছে না। দানিয়েল ঝালের তরকারি ফেলে দিয়ে অঝালের দিকে মন দিল। খেতে খেতে দানিয়েল বারবারই বলল, ক্যাথারিনও, কখনও তারা এত পদ দিয়ে খায়নি।

কলকাতায় লোককে নেমন্তন্ন করলে আমরা তো এরকমই করি, এ এমন কোনও আহামরি ব্যাপার নয়।

অতিথির থালায় মাছের টুকরা শেষ হতে, আরেকটি টুকরো তুলে দেয় নীলা। আরেক চামচ ভাত। আরও একটু মাংস নাও। ওরা না বলে। তারপরও নীলা, হাতের ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়। ওরা অতিথি, ওরা তো না বলবেই, কিন্তু দিতে তো হবে। এরকম নিয়ম, এরকম নিয়ম দেখেই নীলা বড় হয়েছে কলকাতায়। দানিয়েল হেসে বলে, আশ্চর্য, তুমি ঠাকুরমাদের মতো করছ কেন!

ঠাকুরমার মতো নয়। নীলা ওদের বোঝাতে পারে না অতিথি হল নারায়ণ, অতিথি হল ভগবান, বাঙালির বিশ্বাস এই। ভগবান না মানলেও বাঙালি অতিথি মানে। বাঙালির ঘরে অতিথি এলে সবচেয়ে বড় আসনটি দেওয়া হয়, বড় বিছানাটি দেওয়া হয়, সবচেয়ে ভাল খাবারের আয়োজন করা হয়। ভালবাসি, এ কথাটি মুখে বলা শক্ত বাঙালির পক্ষে, খাইয়ে এবং দিয়ে ভালবাসা বোঝায় বাঙালি।

দানিয়েল আর ক্যাথারিন খেতে খেতে ওয়াইন পান করে, নীলা ওয়াইনে এক কি দু চুমুক দিয়েই রেখে দেয়। ওয়াইনে ওর অভ্যেস নেই।

মহাভোজ তখনও শেষ হয়নি, অতিথিরা বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে খাচ্ছে, খাওয়া স্থগিত রেখে দুবার সিগারেট ফুঁকেছে দানিয়েল, ক্যাথারিন বিড়ি, এর মধ্যে কিষান এল। এক বোতল দুধের মধ্যে দুফোঁটা চোনা।

দানিয়েল আর ক্যাথারিন দুজনই বঁজু বলল, কিয়ান বঁজু বলে শোবার ঘরে চলে গেল।

এই বুঝি তোমার স্বামী!

নীলা মাথা নাড়ে, এই তার স্বামী।

নীলা ফ্যাকাশে মুখে শোবার ঘরে এসে গলা চেপে বলল, তুমি এমন কথা না বলে চলে এলে যে ওরা কী মনে করবে বলো তো।

ওরা কারা?

আমার সঙ্গে চাকরি করে। দয়া করে ওদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করো। এসো।

কেন?

ওরা তো সাদা। দেখছ না? কালো নয়। বাদামিও নয়। হলুদও নয়।

তো?

এসো, তুমিও খেতে বসো৷ অনেক রেঁধেছি আজ।

কী রেঁধেছ?

এখানেই নীলা গেল ফেঁসে।

কী রেঁধেছ? মাছ মাংসের গন্ধ পাচ্ছি কেন?

ওরা তো মাছ মাংস ছাড়া খায় না।

ওরা খায় না তো আমার কী? আমার বাড়িতে তো মাছ মাংস রাঁধার কথা না। কিষানের বিস্ফারিত চোখের সামনে নীলা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।

এই শেষ, আর রাঁধব না। কথা দিচ্ছি। অনুনয়ের স্বর নীলার। অন্তত অতিথি সামনে রেখে বাড়িতে গুমোট হাওয়া বওয়াতে চায় না সে।

তোমার আর রাঁধার দরকারও নেই। সামনে থেকে সরো। আমাকে আর জ্বালিয়ো না।

নীলা সরে এল।

দানিয়েল আর ক্যাথারিন যতক্ষণ ছিল বাড়িতে, কিষান শুয়ে ছিল শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে।

ধুৎ

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress