Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ফটিকচাঁদ || Satyajit Ray » Page 3

ফটিকচাঁদ || Satyajit Ray

ও এখন বেঞ্চিতে বসে হাঁপাচ্ছে। এত জোরে শ্বাস নিতে হচ্ছে যে, কথা বলতে চাইলেও পারবে। না। ও নোকটার দিকে চেয়ে আছে। ধমক দিলে কী হবে–মুখ দেখে মনে হয় না খুব বেশি রাগ করেছে। কিংবা হয়তো প্রথমে রেগেছিল, এখন ওকে ভাল করে দেখে রাগটা কমে গেছে। এখন ওর চোখে চালাক হাসি, ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে দাঁতগুলোতে রোদ পড়ে হাসি আরও খোলতাই হয়েছে। দেখে মনে হয় লোকটার মাথায় হাজার বুদ্ধি কিলবিল করে, আর সেগুলো খাটিয়ে সারাটা জীবন সে চালিয়ে দিতে পারে।

কামরায় আরও লোক রয়েছে, কিন্তু ওদের বেঞ্চিতে কেবল ওরা দুজন। সামনের বেঞ্চিতে তিনজন বুড়ো পাশাপাশি বসে আছে। একজন বসে বসেই ঘুমোচ্ছে, একজন এইমাত্র এক চিমটে কালো গুঁড়ো নিয়ে নাকের ফুটোর সামনে ধরে হাতটাকে ঝাঁকি দিয়ে শ্বাস টেনে নিল। আর-একজন খবরের কাগজ পড়ছে। ট্রেনের দুলুনি যত বাড়ছে, তাকে তত বেশি শক্ত করে কাগজটাকে ধরে চোখের কাছে নিয়ে আসতে হচ্ছে।

এবার বলো তো চাঁদ, মতলবখানা কী?

লোকটার গলা গম্ভীর, কিন্তু হাসিটা এখনও যায়নি। সে এমনভাবে চেয়ে আছে ওর দিকে, যেন চাহনির জোরেই ওর মনের সব কথা জেনে যাবে।

ও চুপ করে রইল। মতলব তো পুলিশের কাছ থেকে পালানো; কিন্তু সেটা ও বলতে পারল না।

পুলিশ?–ওর মনের কথা জেনে তাক করে জিজ্ঞেস করল লোকটা।

চালের ব্যাপার?–লোকটা আবার জিজ্ঞেস করল। এই নিয়ে পর পর তিনটে প্রশ্ন করল, যার একটারও উত্তর ও দেয়নি।

উঁহু। তুমি ভদ্দরলোকের ছেলে। চালের থলি কাঁধে নিয়ে ছুটবে এমন তাগদ নেই তোমার।

ও এখনও চুপ করে আছে। লোকটাও ওর দিকে সেইভাবেই চেয়ে আছে। পে

টে বোমা মারতে হবে নাকি?–এবার বলল লোকটা। তারপর কাছে এগিয়ে এসে গলা নামিয়ে বলল, আমাকে বলতে কী? আমি কাউকে বলব না। আমিও ঘর-পালানো ছেলে, তোমার মতন।

ও জানত যে, এবার লোকটা ওর নাম জিজ্ঞেস করবে, তাই ও উলটে ওকেই ওর নাম জিজ্ঞেস করে ফেলল। লোকটা বলল, আমার নামটা পরে হবে, আগে তোমারটা শুনি।

বারবার জানি না বলতে ওর মোটেই ভাল লাগছিল না। খড়্গপুর ডাক্তারখানার উলটো দিকে একটা দোকানের দরজার উপরে ও একটুক্ষণ আগেই একটা নাম দেখেছে। সাদা টিনের বোর্ডে কালো দিয়ে লেখা–মহামায়া স্টোর্স, আর তার নীচে প্রো : ফটিকচন্দ্র পাল। ও তাই ফস করে বলে দিল–ফটিক।

ডাক-নাম না ভাল-নাম?

ভাল নাম।

পদবি কী?

পদবি?

পদবি কথাটার মানের জন্য ওকে কিছুক্ষণ মাথার মধ্যে হাতড়াতে হল।

পদবি বোঝে না?–লোকটা বলল। তুমি কি সাহেব ইস্কুলে পড়ো নাকি? সারনেম। সারনেম বোঝো?

সারনেম ও আরওই বোঝে না।

নামের শেষে যেটা থাকে, লোকটা ধমক দিয়ে বলল। যেমন রবির শেষে ঠাকুর।…তুমি সত্যিই বোকা, না বোকা সেজে রয়েছ, সেটা আমাকে জানতে হবে।

নামের শেষে বলাতেই ও বুঝে ফেলেছে। বলল, পাল। পদবি পাল। আর মাঝখানে চন্দ্র। ফটিকচন্দ্র পাল।

লোকটা একটুক্ষণ ওর দিকে চেয়ে রইল। তারপর তার ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, যে লোকটা ঝড়াকসে নিজের একটা নাম বানিয়ে বলতে পারে, সেও আর্টিস্ট। এসো, হারুনের সঙ্গে হাত মেলাও ফটিকচাঁদ পাল। হারুন, মাঝখানে অল, শেষে রসিদ। বোগদাদের খলিফা, জলরের বাদশা।

ও হাতটা বাড়িয়ে দিল বটে, কিন্তু লোকটা ওর বানানো নাম বিশ্বাস করল না বলে ওর একটু রাগ হল।

তুমি যে বাড়ির ছেলে, লোকটা সটান ওর দিকে তাকিয়ে বলল, সেসব বাড়ি থেকে ফটিক নামটা উঠে গেছে সিরাজদ্দৌলার আমল থেকে।–দেখি তোমার হাতের তেলো।

ও কিছু বলার আগেই লোকটা ওর ডান হাতটা খপ করে ধরে তেলোটা দেখে নিয়ে বলল, হুঁ…বাসের রড ধরে ঝুলতে হয়নি কস্মিনকালেও।…শার্টের দাম কম-সেকম ফর্টি ফাইভ চিপস..টেরিকটের প্যান্ট..নো মাদুলি…লাস্ট টিকে-টা উঠেছিল কি? ..সেলুনে ছাঁটা চুল, খুব বেশিদিন না..পার্ক স্ট্রিটের সেলুন কি? তাই তো মনে হচ্ছে?..

লোকটা আবার চেয়ে আছে ওর দিকে; হয়তো চাইছে ও কিছু বলুক। ও বাধ্য হয়েই বলল, আমার কিছু মনে নেই।

লোকটার চোখ দুটো হঠাৎ খুদে খুদে আর জ্বলজ্বলে হয়ে গেল।

বোগদাদের খলিফের সঙ্গে ফচকেমো করতে এসো না চাঁদ। ওসব কারচুপি খাটবে না আমার কাছে। তুমি অনেক ভাজা মাছ উলটে খেয়েছ। সাহেবি ইস্কুলের তালিম তোমার, হুঁ হুঁ! ব্যাড কোম্পানি হয়ে এখন বাপের খপ্পর থেকে ছটকে বেরিয়ে এসেছ। আমি কি আর বুঝি না? কনুইয়ে চোট লাগল কী করে? মাথা ফুলেচে কেন? ল্যাংচাচ্চ কেন? যা বলবার সাফ বলে ফেলো তো চাঁদ! নইলে ঘাড় ধরে নামিয়ে দেব জকপুরে গাড়ি থামলেই। …বলল, বলে ফেলো।

ও বলল। সব বলল। ওর মনে হল, একে বলা যায়। এ লোকটা ক্ষতি করবে না ওর, ওকে পুলিশে দেবে না। আকাশে তারা দেখা থেকে আরম্ভ করে বাথরুমের পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সব বলল।

লোকটা শুনে-টুনে কিছুক্ষণ চুপ করে জানালা দিয়ে বাইরের চলন্ত মাঠঘাটের দিকে চেয়ে ভাবল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, তোমার তো তা হলে একটা ডেরা লাগবে কলকাতায়। আমি যেখানে থাকি, সেখানে তো তোমার থাকা পোষাবে না।

তুমি কলকাতায় থাকো?

আগে থেকেছি। এখন আবার থাকব। ডেরা একটা আছে আমার এন্টালিতে। মাঝে-মধ্যে এদিক-সেদিক ঘুরতে বেরোই বাক্স নিয়ে। রথের মেলা, চড়কের মেলা, শিবরাত্তিরের মেলা। বিয়ে-শাদিতেও বায়না জুটে যায় টাইম টু টাইম। এখন আসছি কোয়েম্বাটোর থেকে। কোয়েম্বাটোর জানো? মাদ্রাজে। তিন হপ্তা স্রেফ ইডলি-দোসা। এক সাকাস কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে এসেছি। ভেঙ্কটেশ ট্রাপিজ দেখায় গ্রেট ডায়মন্ডে, আমার সঙ্গে দোস্তি হয়েছে। বলেছে চান্স হলেই জানাবে। আপাতত কলকাতা। শহিদ মিনারের নীচে ঘাসের উপর একফালি জায়গা, ব্যস্।

তুমি ঘাসের উপর থাকবে? ও জিজ্ঞেস করল। ও নিজে অনেকক্ষণ ঘাসের উপর শুয়ে ছিল, সেটা ওর মনে আছে।

লোকটা বলল, থাকব না, খেল দেখাব। ওই যে বেঞ্চির নীচে বাক্সটা দেখছ, ওর মধ্যে আমার খেলার জিনিস আছে। জাগলিং-এর খেলা। একটি জিনিসও আমার নিজের কেনা নয়। সব ওস্তাদের দেওয়া।–ওস্তাদ কথাটা বলেই লোকটা তিনবার কপালে হাত ঠেকাল। –তিয়াত্তর বছর বয়স অবধি খেল দেখিয়েছিল। তখনও চিরুনি দিয়ে দু ভাগ করে আঁচড়ানো দাড়ির অর্ধেক কাঁচা। নমাজ পড়ার মতো করে বসে লাটু ছুঁড়েছে আকাশে, তারপর তেলোটা চিত করে হাতটা বাড়িয়েছে ধরবে বলে হঠাৎ দেখি, ওস্তাদ হাত টেনে নিয়ে দু হাত দিয়ে বুক চেপে দুমড়ে গেল। লাটু আকাশ থেকে নেমে এসে ওস্তাদের পিঠের দুই পাখনার মধ্যিখানে শিরদাঁড়ার উপর পড়ে ঘুরতে লাগল–পাবলিক ক্ল্যাপ দিচ্ছে, ভাবছে বুঝি নতুন খেলা কিন্তু ওস্তাদ আর সোজা হল না।

লোকটা কিছুক্ষণ চুপ করে জানলার বাইরে চেয়ে থেকে বোধহয় ওস্তাদের কথাই ভাবল। তারপর বলল, উপেনদাকে বলে দেখব, যদি তোমার একটা হিল্লে করে দিতে পারেন। অবিশ্যি পুলিশ লাগবে তোমার পেছনে, সেটা বলে দিলাম।

ওর মুখ আবার শুকিয়ে গেল। লোকটা বলল, নিয়মমতো তোমাকে আমার পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া উচিত।

না-না!–ও এবার বেশ জোরের সঙ্গে বলে উঠল।

ভয় নেই, লোকটা একটু হেসে বলল, আর্টিস্টের নিয়মগুলো একটু আলাদা। নিয়ম যদি মানতাম গোড়া থেকেই, তা হলে তোমার সঙ্গে আজ এইভাবে থার্ড কেলাসে বসে কথা বলতে হত না। নিয়ম মানলে এই আপিস ভাঙার টাইমে অরুণ মুস্তাফি হয়তো ফিয়াট গাড়ি হাঁকিয়ে বি বি ডি বাগ থেকে বালিগঞ্জে ফিরত।

একটা লোকের নাম ওর মাথায় ঘুরছিল। ও জিজ্ঞেস করল, উপেনদা কে?

লোকটা বলল, উপেনদা হল উপেন গুঁই। বেনটিং ইস্ট্রিটে চায়ের দোকান আছে।

হিল্লে কাকে বলে?

হিল্লে মানে গতি। যাকে বলে ব্যবস্থা। –তুমি নিঘ্‌ঘাৎ সাহেব ইস্কুলে পড়েছ।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress