Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ফটিকচাঁদ || Satyajit Ray » Page 2

ফটিকচাঁদ || Satyajit Ray

ওর সামনে একটা মানুষের মাথা নড়ছে। দাড়িওয়ালা পাগড়িওয়ালা মানুষের মাথা। না, মানুষটা নড়ছে না, আসলে ও নিজেই নড়ছে। মানুষটা ওর গা ধরে নাড়া দিচ্ছে।

দুধ পী লো বেটা–গরম দুধ।

লোকটার হাতে একটা কাঁচের গেলাসে দুধ থেকে একটু একটু ধোঁয়া বেরোচ্ছে।

এবার ও বুঝল। একটা লরির পিছনে ও শুয়ে আছে। লরিতে মাল, মালের একপাশে, যেদিকটা খুলে যায় লরির, সেইদিকে একটুখানি জায়গাতে ও একটা চাদরের উপর শুয়ে আছে। ওর গায়েও একটা চাদর, আর মাথার নীচে পুঁটলিকরা কিছু কাপড়।

লোকটার কাছ থেকে গেলাসটা নিয়ে ও উঠে বসল। লরির একপাশে রাস্তা, অন্যদিকে একটা খাবারের দোকান। দোকানের সামনে কয়েকটা বেঞ্চি পাতা, তাতে তিনজন লোক বসে চা খাচ্ছে। আরও দোকান রয়েছে রাস্তার দু ধারে। একটায় বোধহয় গাড়ি মেরামত হয়; সেখান থেকে ঠকঠাক আওয়াজ আসছে। দোকানটার সামনে একটা কালো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, তার পাশে একজন শার্ট আর প্যান্ট পরা নোক রুমাল দিয়ে চশমার কাঁচ মুছছে।

পাগড়ি-পরা লোকটা দোকানের দিকে চলে গিয়েছিল, আবার ওর দিকে এগিয়ে এল। ওর পিছন পিছন বেঞ্চির লোকগুলোও এগিয়ে এল।

কেয়া নাম হ্যায় তুমহারা? পাগড়িওয়ালা লোকটা জিজ্ঞেস করল। ওর হাতে এখনও দুধের গেলাস, অর্ধেক খাওয়া হয়েছে। খুব ভাল দুধ, খুব ভাল লাগছে খেতে।

ও বলল, জানি না।

কেয়া জানি না? তুম বাংগালি আছে?

ও মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। নিশ্চয়ই বাঙালি। এতক্ষণ অবধি ও যা ভেবেছে সবই তো বাংলাতে।

তোমার ঘর কুথায়? চোট লাগা ক্যায়সে? সাথে আউর আদমি ছিল? তারা কুথায় গেল?

জানি না, আমার মনে নেই।

কী ব্যাপার? ছেলেটি কে?

সেই কালো গাড়ির লোকটা এগিয়ে এসেছে লরির দিকে। মাথায় বেশি চুল নেই, কিন্তু বয়স বেশি না। লোকটা চোখ কুঁচকে একদৃষ্টে দেখছে ওর দিকে। পাগড়িওয়ালা হিন্দিতে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল। খুব সহজ। রাস্তার ধারে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে লরিতে তুলে নিয়ে আসে। পরিচয় পেয়ে যদি দেখে কলকাতার ছেলে, তা হলে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দেবে।

বাঙালি ভদ্রলোক এবার আরও কাছে এলেন।

তোমার নাম কী?

নামটা ভুলে গিয়ে ওর খুব মুশকিল হয়েছে। ওকে আবার জানি না বলতে হল, আর পাগড়িওয়ালা হো-হো করে হেসে উঠল। জানি না, জানি না ছোড়কে আউর কুছ বোলতা হি নেহি।

জানি না মানে কী? ভুলে গেছ?

হ্যাঁ।

ভদ্রলোক ওর কনুইয়ের জখমটা দেখলেন।

আর কোথায় লেগেছে?

ও হাঁটুর ছড়াটা দেখিয়ে দিল।

মাথায় লেগেছে?

হ্যাঁ।

দেখি, মাথা হেঁট করো।

ও হেঁট করলে পর ভদ্রলোক ফোলা জায়গাটা ভাল করে দেখলেন। হাত দিতে ব্যথা লাগায় ও শিউরে উঠেছিল।

একটু কেটেছে বোধহয়। চুলের মধ্যে রক্ত জমে আছে মনে হচ্ছে। …তুমি নামতে পারবে? দেখো তোএসো।

ও হাতের গেলাস পাগড়িওয়ালাকে দিয়ে পা ঝুলিয়ে হাত বাড়াতেই ভদ্রলোক ওকে খুব সাবধানে ব্যথা না লাগিয়ে নামিয়ে নিলেন। তারপর পাগড়িওয়ালার সঙ্গে ভদ্রলোক কথা বলে নিলেন। খড়্গপুর আর ত্রিশ মাইল দূর। ওখানে ডিসপেনসারিতে গিয়ে ওকে ওষুধ দিয়ে ব্যান্ডেজ করিয়ে নিয়ে ভদ্রলোক ওকে সঙ্গে করে সোজা চলে যাবেন কলকাতা।

সিধা থানা মে লে যাইয়ে, পাগড়িওয়ালা বলল। কুছ গড়বড় হুয়া মালুম হোতা।

থানা যে কী জিনিস, সেটা বুঝতে ওর কিছুটা সময় লাগল। তারপর পুলিশ কথাটা কানে আসতে ওর বুকের ভিতরটা ঢিপঢিপ করে উঠল। পুলিশ চোর ধরে। শাস্তি দেয়। ও চুরি করেছে। বলে তো ও জানে না!

ভদ্রলোক নিজেই গাড়ি চালান। সামনে ওকে নিজের পাশে বসিয়ে নিলেন। গাড়ি ছাড়ার অল্পক্ষণের মধ্যেই দোকান ঘরবাড়ি শেষ হয়ে গিয়ে খোলা মাঠ পড়ল। ও বুঝতে পারছিল যে, ভদ্রলোক মাঝে মাঝে আড়চোখে ওর দিকে দেখছেন। কিছুক্ষণ পরেই উনি আবার প্রশ্ন করতে আরম্ভ করলেন।

তুমি কলকাতায় থাকো?

ও তাতেও বলল, জানি না।

তোমার বাপ মা ভাই বোন কারুর কথা মনে পড়ছে না?

না।

তারপর ও নিজে থেকেই রাত্তিরের ঘটনাটা বলল। ভাঙা গাড়ির কথাটা বলল। দুটো লোকের কথা বলল।

গাড়ির নম্বরটা দেখেছিলে? ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন।

না।

লোকগুলো কী রকম দেখতে, মনে আছে?

ওর যা মনে আছে, বলল। বাকি রাস্তা ভদ্রলোক ভুরু কুঁচকে রইলেন, আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না।

এখন দুটো বেজেছে, সেটা ও ভদ্রলোকের হাতঘড়িটা দেখে জেনে নিয়েছে। একবার ভেবেছিল ও বলবে যে, ওর খিদে পেয়েছে, শুধু দুটো পেয়ারা আর এক গেলাস দুধে পেট ভরেনি; কিন্তু সেটা আর বলার দরকার হল না। যেখানে রাস্তার ধারে খড়্গপুর ১২ কিলোমিটার লেখা পাথরটা রয়েছে, তার পাশেই একটা গাছের তলায় ভদ্রলোক গাড়িটা দাঁড় করিয়ে একটা সাদা কাগজের বাক্স খুলে তার থেকে লুচি আর আলুর তরকারি বার করে ওকে দিলেন, আর নিজেও নিলেন। চ্যাপ্টা সাদা গোল জিনিসটার নাম যে লুচি, সেটা ওর কিছুতেই মনে পড়ছিল না, শেষে আকাশে অনেকগুলো পাখিকে একসঙ্গে উড়তে দেখে চিল মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লুচি মনে এসে গেল।

পাথরের ফলকের নম্বর বারো থেকে কমতে কমতে দুই হবার পরেই খড়্গপুর শহর দেখা গেল। ভদ্রলোক বললেন, খড়্গপুর এসেছ কখনও?

ওর খড়্গপুর নামটাই মনে নেই, এসেছে কিনা জানবে কী করে? দেখে মনে হল ও কোনও দিন এখানে আসেনি। ভদ্রলোক বললেন, এখানে একটা বড় ইস্কুল আছে, তাকে বলে আই আই টি।

আই আই টি কথাটা ওর মাথার মধ্যে কিছুক্ষণ ঘুরপাক খেয়ে শহরের শব্দ বেড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেল।

একটা চৌমাথায় একটা পুলিশ দেখেই ওর বুকটা আবার কেঁপে উঠল, আর ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ল, আমার পুলিশ ভাল লাগে না।

ভদ্রলোক রাস্তার দিকে চোখ রেখেই বললেন, পুলিশে খবর দিতেই হবে। ও নিয়ে তুমি কথা বলো না। তুমি ভদ্র ঘরের ছেলে, তোমাকে দেখলেই বোঝা যায়। তোমার বাপ-মা আছেন নিশ্চয়ই। তুমি তাঁদের ভুলে গেলেও তাঁরা নিশ্চয়ই তোমাকে ভোলেননি। তুমি কে, সেটা জানতে হলে পুলিশের কাছে যেতেই হবে, আর তারাই তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারবে। পুলিশ তো খারাপ নয়। পুলিশ অনেক ভাল কাজ করে।

.

শংকর ফার্মেসির ডাক্তার ওর ছড়ে-যাওয়া জায়গাগুলোতে ওষুধ লাগিয়ে দিলেন, মাথায় বরফ লাগিয়ে দিলেন, কনুইয়ের উপর ওষুধ দিয়ে তুলে লাগিয়ে তার উপর একটা আঠাওয়ালা তাপ্পি মেরে দিলেন। এবার যিনি ওকে এনেছিলেন, তিনি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের এখানে থানাটা কোথায়?

ডাক্তার কিছু বলার আগেই ও বলল, আমি একটু বাথরুমে যাব।

এসো আমার সঙ্গে, বলে ডাক্তারবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন।

ডাক্তারখানার পিছন দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে একটা বারান্দা। সেই বারান্দার শেষ মাথায় একটা দরজা দেখিয়ে দিলেন ডাক্তারবাবু।

ও দরজা খুলে ঘরে ঢুকেই ছিটকিনিটা লাগিয়ে দিল। তারপর সত্যি করেই বাথরুমের কাজ সেরে আর-একটা বন্ধ দরজার ছিটকিনি খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল।

এটা একটা গলি। ডাইনে গেলেই বড় রাস্তা। তার মানে ধরা পড়ার ভয়। ও বাঁয়ে ঘুরল। কোথায় যাচ্ছে জানে না, তবে পুলিশের কাছে নয় এটা ভেবেই ফুর্তি। ওর কনুইয়ের ব্যান্ডেজ, ময়লা কাপড়, রক্তের দাগ, খুঁড়িয়ে হাঁটা–এই সবের জন্যেই বোধহয় রাস্তার কিছু লোক ওর দিকে ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে। কিন্তু কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল না ওকে।

ও এগিয়ে চলল। ট্রেনের ভোঁ শোনা যাচ্ছে।

গলিটা শেষ হতেই একটা বেশ বড় রাস্তা পড়ল। এ রাস্তায় অনেক লোক, সবাই ব্যস্ত, কেউ ওর দিকে চাইছে না। বাঁ দিকে লোহার রেলিং-এর ওপারে রেলের লাইন। অনেকগুলো পাশাপাশি লাইন; তার মধ্যে একটাতে একটা মালগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ইঞ্জিনের ভোঁ শোনা যাচ্ছে খুব জোরে আর কাছে। সামনে লাইনের পাশে একটা লোহার ডাণ্ডার মাথায় অনেকগুলো আড়াআড়ি ছোট ডাণ্ডা, তাদের গায়ে লাল-সবুজ গোল গোল আলো। কী যেন বলে ওগুলোকে? ওর মনে পড়ল না।

ওই যে সামনে স্টেশন। বেশ বড় স্টেশন। একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, তার সামনে প্ল্যাটফর্মে লোকের ভিড়।

ও খোঁড়াতে খোঁড়াতে স্টেশনের ভিতর গিয়ে ঢুকল। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে ট্রেনটা। ভোঁ বেজে উঠল ইঞ্জিনের দিক থেকে। ওর মনটা ছটফটিয়ে বলে উঠল–তোমাকে উঠতে হবে এই গাড়িতে। এই সুযোগ। এইবেলা উঠে পড়ো।

ওর সামনে পিছনে ডাইনে বাঁয়ে চারদিকে লোক ছুটোছুটি করছে। পিছন থেকে একটা পুঁটলির ধাক্কায় ও প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল। কোনওরকমে সামলে এগিয়ে গিয়েই দেখল, ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। গাড়িগুলো সরে সরে যাচ্ছে ওর সামনে দিয়ে। ও আরও এগোল। সব দরজা বন্ধ। খোলা দরজা না পেলে ও উঠবে কী করে?

ওই একটা দরজা খোলা। ও কি পারবে উঠতে? পারবে না। ওর হাতে জোর নেই। পায়ে জোর নেই। তবু মন বলছে এই সুযোগ, এগিয়ে যাও।

ও এগিয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে দিল। ওই যে দরজা। সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে হবে। তারপর হাতল ধরে লাফ। পা হড়কালেই ফসকে গিয়ে একেবারে

ওর পা আর মাটিতে নেই। পা ফসকায়নি। একটা হাত কামরা থেকে বেরিয়ে এসে ওর কোমর জাপটে ধরে হুশ করে ওকে কামরায় তুলে নিল। আর তারপরেই শুনল ও ধমক–

ইয়ার্কি হচ্ছে? মারব নাকি ল্যাঙা ঠ্যাঙে ঠ্যাঙার বাড়ি?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress