Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

নবযৌবনের প্রধান ধর্ম এই যে, সে জীবনটাকে গাম্ভীর্যের চশমার ভিতর দিয়া দেখে না; জগৎ তাহার কাছে খেলার মাঠ; যুদ্ধ একটা সরস কৌতুক, প্রেম একটা মাদক উত্তেজনা।

মহারাজ মঘবা মহানন্দে অর্ধেক সৈন্য লইয়া যুদ্ধ করিতে চলিয়া গেলেন। রাজ্যের দক্ষিণ সীমান্তে কোদণ্ড নামে এক অনার্য জাতি আছে, উদ্দেশ্য—তাহাদের উৎপীড়ন করা।

আধুনিক গণনায় যে-সময়টাকে তিন মাস বলা চলে, অনুমান তত দিন পরে মঘবা যুদ্ধযাত্রা হইতে ফিরিয়া আসিলেন। তাঁহার পিঙ্গল কেশ রুক্ষ, দেহে পশুচর্মের আবরণ ছিন্নভিন্ন, মুখে পরিতৃপ্ত বাসনার হাসি।

আসিয়াই তিনি প্রদ্যুম্নের পৃষ্ঠে বজ্রসম চপেটাঘাত করিলেন। বলিলেন, কি রে, কেমন আছিস?

দুই বন্ধু নিবিড়ভাবে আলিঙ্গনবদ্ধ হইলেন। প্রদ্যুম্ন বলিলেন, রোগা হইয়া গিয়াছিস দেখিতেছি; রাক্ষসদের মুলুকে কিছু খাইতে পাস নাই বুঝি? তারপর আত্মসম্বরণ করিয়া কহিলেন, মহারাজের জয় হোক। আর্যের সমস্ত সংবাদ শুভ?

মঘবা বলিলেন, মন্দ নয়। কোদণ্ড ব্যাটাদের খুব ঠুকিয়াছি। শুধু তাই নয়, একটা মজার জিনিস আনিয়াছি, দেখাইব চল!

বিজিত জাতির নিকট হইতে অপহৃত বহু বিচিত্র বস্তু এক দল সৈনিকের রক্ষণায় ছিল, মঘবা তাহাদের ইঙ্গিত করিয়া রাজভবন অভিমুখে চলিলেন। যাইতে যাইতে প্রদ্যুম্নকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তারপর, রাজ্য কেমন চলিতেছে? প্রজারা আনন্দে আছে?

প্রজাদের আনন্দ সম্প্রতি বিলক্ষণ বাড়িয়া গিয়াছে।

কিরূপ?

আর্য যোদ্ধৃগণের প্রাণে রসের সঞ্চার হইয়াছে। তাহারা অনার্য মেয়ে ধরিয়া আনিয়া পটাপট বিবাহ করিয়া ফেলিতেছে।

মঘবা উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিলেন, তাই নাকি?—রোগ ছোঁয়াচে দেখিতেছি।

প্রদ্যুম্ন মঘবার প্রতি বক্র কটাক্ষ করিলেন। মঘবা বলিলেন, কিন্তু উপায় কি? এই দেশেই যখন বসবাস করিতে হইবে, তখন আর্য রক্ত নিষ্কলুষ রাখা অসম্ভব। আর্যাবর্ত হইতে এত মেয়ে আমদানি করা চলে না, অথচ বংশরক্ষাও না করিলে নয়। এই যে রাজ্য জয় করিলাম—কাহাদের জন্য?

প্রদ্যুম্ন শুধু বলিলেন, হুঁ।

রাজা ও সেনাপতি মন্ত্রগৃহে গিয়া বসিলেন! সামন্ত সচিব শ্রেষ্ঠী বিদৃষক কিছুই নাই, সুতরাং মন্ত্রণাগৃহ শূন্য। চার জন সৈনিক একটা বৃহৎ বেত্র-নির্মিত পেটারি ধরাধরি করিয়া তাঁহাদের সম্মুখে রাখিল। পেটারির মুখ ঢাকা, ভিতরে গুরুভার কোনও দ্রব্য আছে মনে হয়।

বিস্মিত প্রদর বলিলেন, কি আছে ইহার মধ্যে? অজগর সাপ নাকি?

মঘবা হস্তসঞ্চালনে সৈনিকদের বিদায় করিয়া হাসিতে হাসিতে পেটারির ঢাকা খুলিয়া দিলেন।

সাপুড়ের ঝাঁপি খোলা! পাইয়া কৃষ্ণকায় সপী যেমন ফণা তুলিয়া দাঁড়ায়, তেমনই একটি নারী। পেটারির মধ্যে উঠিয়া দাঁড়াইল। তাহার নীলাঞ্জন চোখে ধিকি ধিকি বিদ্যৎ।

প্রদ্যুম্ন হতভম্ব হইয়া গেলেন। তাঁহার ব্যাদিত মুখ হইতে বাহির হইল, আরে একি! এ যে একটি মেয়ে।

মঘবা অট্টহাস্য করিলেন; তারপর বলিলেন, কেমন মেয়ে? সুন্দর নয়?

প্রদ্যুম্ন নীরবে বন্দিনীকে নিরীক্ষণ করিলেন। মার্জিত তাম্রফলকের ন্যায় দেহের বর্ণ; দলিতাঞ্জন দুটি চোখ, দলিতাঞ্জন চুল। বস্ত্র-অলঙ্কারের বাহুল্য নাই; গলায় একটি বীজের মালা, বাহুতে শঙ্খের অঙ্গদ; কবরী ও কর্ণে পুষ্পভূষা শুকাইয়া গিয়াছে। কটি হইতে জানু পর্যন্ত একটি বিচিত্র বর্ণে রঞ্জিত পট্টাংশু। কৃশাঙ্গী যুবতীর যৌবনমেদুর দেহের অভ্যন্তর হইতে যেন কৃশানুর দীপ্তি বিচ্ছুরিত হইতেছে।

মঘবা পুনশ্চ জিজ্ঞাসা করিলেন, কি মনে হয়? সুন্দর নয়?

প্রদ্যুম্ন চমকিয়া মঘবার দিকে ফিরিলেন, তারপর ভসনাপূর্ণ স্বরে বলিলেন, তুই একটা আস্ত গোঁয়ার। যুদ্ধ করিতে গিয়া মেয়ে ধরিয়া আনিলি। এখন ইহাকে লইয়া কি করিবি?

ইহাকে দিয়া যে দাসীকিঙ্করীর কাজ চলিবে না, তাহা একবার দৃষ্টি করিয়াই আর সংশয় থাকে না।

মঘবা বলিলেন, ঠিক করিয়াছি বিবাহ করিব।

প্রদ্যুম্ন সচকিতে বলিলেন, বিবাহ!

হাঁ! ও কে জানিস? কোদণ্ডরাজার মেয়ে।

প্রদ্যুম্নের মুখ সহসা গম্ভীর হইল। মঘবা বলিতে লাগিলেন, কোদণ্ডদের রাজপুরী দখল করিয়া দেখিলাম সকলে পলাইয়াছে, কেবল মেয়েটা একা দাঁড়াইয়া আছে। ভারি ভাল লাগিল। ওকে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলাম, কিন্তু বিন্দুবিসর্গও বুঝিতে পারিল না। তাই পেটারি বন্ধ করিয়া সঙ্গে আনিয়াছি। আর্য রাজার মহিষী হইবার যোগ্য মেয়ে বটে; কিন্তু উহাকে আগে আর্যভাষা শিখাইতে হইবে। তারপর আমার পট্টমহিষী করিব।

প্রদ্যশ্ন আর একবার যুবতীর পানে ফিরিয়া দেখিলেন। সে তাহাদের কথাবার্তার মর্ম কিছুই বুঝিতে পারে নাই; কেবল তাহার চোখ দুটি একের মুখ হইতে অন্যের মুখে যাতায়াত করিতেছে! তাহার মুখে ভয় বা আশঙ্কার চিহ্ন কিছুই নাই; আছে কেবল এই বর্বরদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে ঘৃণাপূর্ণ গর্বিত জিজ্ঞাসা।

ভুযুগল ঈষৎ কুঞ্চিত করিয়া প্রদ্যুম্ন মঘবার দিকে ফিরিলেন, অন্যায় করিয়াছ মঘবা। হাজার হোক রাজার মেয়ে, তাহাকে এভাবে ধরিয়া আনা আর্য শিষ্টতা হয় নাই।

মঘবা বলিলেন, বিবাহ করিবার জন্য কন্যা হরণ করিলে আর্য শিষ্টতা লঙ্ঘন হয় না।

হয়! অরক্ষিত মেয়েকে ধরিয়া আনা তস্করের কাজ। এই দণ্ডে এই কন্যাকে ফেরত পাঠানো উচিত।

তপ্তকণ্ঠে মঘবা বলিলেন, কখনই না–! তারপর আত্মসম্বরণ করিয়া অপেক্ষাকৃত শান্তস্বরে বলিলেন, আমি মহারাজ মঘবা, তোমাকে আদেশ করিতেছি, সেনাপতি প্রদ্যুম্ন, তুমি এই কন্যার যোগ্য বাসস্থানের ব্যবস্থা কর—যাহাতে সুখে থাকে অথচ পলাইতে না পারে।–মনে থাকে যেন, কন্যা পলাইলে দায়িত্ব তোমার।

প্রদ্যুম্ন একবার কয়েক মুহূর্তের জন্য বন্ধুর মুখের পানে চাহিয়া রহিলেন, তারপর যুক্তকরে মস্তক অবনত করিয়া শুদ্ধস্বরে কহিলেন, মহারাজের যেরূপ অভিরুচি।

দুর্গাচূড়ার কূটকক্ষে ভাবী রাজমহিষীর বাসস্থান নির্দিষ্ট হইল! কোদণ্ড-কন্যা দৃঢ়বদ্ধ ওষ্ঠাধরে অকম্পিত পদে দ-শীর্যের কারাগারে প্রবেশ করিলেন। কার্যত কারাগার হইলেও স্থানটি প্রশস্ত অলিন্দযুক্ত একটি মহল। সকল সুবিধাই আছে, শুধু পলাইবার অসুবিধা।

মঘবা সহর্ষে প্রদ্যুন্মের পৃষ্ঠে একটি মুষ্ট্যাঘাত করিয়া বলিলেন, রানীর মতো রানী পাওয়া গিয়াছে—কি বলিস?

প্রদ্যুম্ন বলিলেন, হুঁ।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress