দ্বিতীয় অংশ–দুঃস্বপ্ন
ছয়
প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে রুমীর সাথে কাজ করে আরিফ, হালকা-পাতলা সুদর্শন একটা ছেলে। ভারি হাসি-খুশি ছেলে আরিফ, সব সময়েই একটা না একটা কিছু নিয়ে হৈচৈ করছে। পড়াশোনায় খুব মন নেই, সব সময়েই বলছে এ দেশে আর থাকবে, কি আছে এই পোড়া দেশে? আমেরিকান, ব্রিটিশ এবং আরও সব বিদেশি কাউন্সিলে ঘোরাঘুরি করে, বিভিন্ন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে চিঠি লিখে বেড়ায়। একবার বিদেশে পৌঁছতে পারলে নাকি বাসন মেজেই অবস্থার পরিবর্তন করে ফেলবে। খুব বড়লোকের ছেলে, “পোড়া দেশের কোনো দুঃখ-কষ্টই কখনো তাকে স্পর্শ করে না, তবু কেন বিদেশে গিয়ে বাসন মাজার এত আগ্রহ আজকাল রুমী খানিকটা বুঝতে পারে। জন্ম হবার পর থেকে বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন এমন কি এ দেশের পত্রপত্রিকাতেও শুধু বিদেশের প্রশংসাই শুনে এসেছে, ওর দোষ কি? ওদের শুধু এ দেশে জন্ম, কিন্তু ওরা এ দেশের মানুষ নয়।
এ সপ্তাহের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে রুমীদের হিলিয়াম গ্যাসের স্পেকট্রাম বের করার কথা। হিলিয়াম গ্যাস ভরা ডিসচার্জ টিউবের দুই মাথায় ইনডাকশন কয়েল দিয়ে কয়েক হাজার ভোল্ট দিতে হয়, একটু সাবধানে কাজ করার কথা, হঠাৎ ছুঁয়ে ফেললে প্রচণ্ড শ লাগে, কারেন্ট কম বলে আর কিছু হয় না। রুমী সুইচ অফ করে তার দুটি লাগাচ্ছিল, হঠাৎ তার স্পষ্ট মনে হলো আরিফ মনে মনে বলছে, দেই শালাকে একটা শ! এত স্পষ্ট মনে মনে কথাটি শুনল যে রুমী অবাক হয়ে ঘুরে আরিফের দিকে তাকায়, আর আরিফ সত্যি সত্যি সেই মুহূর্তে ইনডাকশন কয়েলটির সুইচ অন্ করেছে।
প্রচণ্ড একটা ইলেকট্রিক শক খেল রুমী। যদিও আরিফ বারবার বলল সে খুব দুঃখিত, ভুলে সুইচটা অন করে ফেলেছে, কিন্তু রুমী ঠিক জানে কাজটা সে ইচ্ছা করে করেছে। আরিফের ওপর ঘেন্না ধরে গেল তার।
কিন্তু কীভাবে শুনল সে আরিফের মনের কথাটা? রুমী এত অবাক হলো যে বলার নয়।
সন্ধ্যার পর রিকশা করে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ফিরে আসছিল রুমী। অনেকদিন অপেক্ষা করে একটা আবাসিক জায়গা পেয়ে সে তার ফুফুর বাসা ছেড়ে দিয়েছে। আজকাল ছুটিতে রোববার বেড়াতে যায়, ফুফু গাল ফুলিয়ে বলেন ভুলেই গেলি আমাদের? বিপদের সময় তো আমিই জায়গা দিয়েছিলাম ইত্যাদি ইত্যাদি। নির্বোধ মহিলা, রুমী কিছু মনে করে না।
বুড়ো রিকশাওয়ালার রিকশাটা টেনে নিতে জোর পরিশ্রম হচ্ছে। রিকশার বেল কাজ করছে না। তাই ছোট একটা লোহার শিক দিয়ে ঠুন ঠুন করে বেলটা ঠুকছে একটু পর পর। রুমীর একটু মায়া হলো বুড়ো রিকশাওয়ালার ওপর। কে যেন বলেছিল রিকশাওয়ালারা নাকি একজন কেরানির চেয়ে বেশি টাকা উপার্জন করে। যে কষ্টটুকু করতে হয় ওদের, তাতে প্রফেসরের থেকেও বেশি টাকা উপার্জন করা উচিত। পৃথিবীটা বড় একচোখা, কাউকে বেঁচে থাকার জন্যে এত কষ্ট করতে হয়, আবার কেউ..
রুমীর চিন্তার স্রোত হঠাৎ থেমে গেল পেছন থেকে একটা গাড়ি ক্রমাগত হর্ন দিয়ে যাচ্ছে, খুব তাড়া নিশ্চয়ই। রিকশাওয়ালা জায়গা দিতে পাশে সরতে পারছে না। পাশে কাদা জমে আছে, একবার চাকা আটকে গেলে টেনে নিতে জান বেরিয়ে যাবে।
বাস্টার্ড! রুমী হঠাৎ পরিষ্কার শুনল পেছনে গাড়ির লোকটি মনে মনে রিকশাওয়ালাকে গালি দিচ্ছে। ড্যাম রিকশাওয়ালা… এমন একটা কুৎসিত ইংরেজি শব্দ, বাংলায় এর ভালো প্রতিশব্দ পর্যন্ত নেই। রুমী অবাক হয়ে পেছনে তাকায়, হেডলাইটে চোখ ধাঁধিয়ে গেল ওর, কিছু দেখতে পেল না।
হারামজাদা–হাঠাৎ চমকে ওঠে রুমী, শালা তোমাকে দেখাচ্ছি মজা, এক ধাক্কায় যদি তোমার বাপের নাম না ভোলাই!
কিছু বোঝার আগে পাশ থেকে প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে রুমী রিকশা থেকে ছিটকে পড়ল মাটিতে, রিকশাওয়ালাকে নিয়ে রিকশা আরও সামনে কাত হয়ে পড়ল। দেখতে দেখতে অনেক লোক জমা হয়ে গেল ওদের ঘিরে। রিকশার বারোটা বেজে গিয়েছে, কিন্তু রিকশাওয়ালার বিশেষ কিছু হয়নি, হাঁটুর ওপর থেকে শুধু খানিকটা ছাল উঠে গেছে। রুমীর হাত-পায়ে সামান্য কাদা লেগেছে কিন্তু কোথাও ব্যথা পায় নি। বুকটা শুধু ধক ধক্ করছে অনেক্ষণ থেকে।
লোকজন গাড়িওয়ালাকে মুখ খারাপ করে গালি দিল, যদি কোনোভাবে ধরতে পারতো পিটিয়ে মেরে ফেলতো। যাদের গাড়ি আর পয়সা আছে আর যাদের গাড়ি বা পয়সা কিছুই নেই, দুই ভিন্ন দল। এক দলের সাথে আরেক দলের সম্পর্ক শুধু পথে-ঘাটে, কারো জন্যে কারো মমতা নেই।
রুমীর পকেটে বেশি টাকা ছিল না, যা ছিল তাই রিকশাওয়ালাকে দিয়ে পুলিশ আসার আগেই সরে এলো। সে থেকে আর কি করবে?
হেঁটে হেঁটে ফিরে এলো রুমী। কিন্তু কি আশ্চর্য! কি পরিষ্কার শুনল সে লোকটির কথা!
এলিফেন্ট রোড ধরে হাঁটছিল রুমী হঠাৎ ভারি অন্যমনস্ক হয়ে গেল সে, আবছা মনে হলো কে জানি বলছে ভাত খাওয়ার পয়সা নেই ওষুধ খাওয়ার শখ! কানে শোনা যায় না, কিন্তু এত
স্পষ্ট শোনার অনুভূতি যে রুমী ভীষণ চমকে ওঠে। একটা ওষুধের দোকানের সামনে দিয়ে হাঁটছে সে, হতে পারে এ দোকান থেকেই কেউ বলেছে। রুমী একটু এগিয়ে যায়। আধময়লা সবুজ শাড়ি পরা রোগা কমবয়সী একটি মেয়ে ওষুধ কিনছে। রুমী শুনতে পেল মেয়েটি বলল, খুব জ্বর পোলাডার। ডাক্তার সাব কইছেন চাইরডা বড়ি খাইলেই জ্বর নাইমা যাইবো।
হুঁ। ওষুধ তো জ্বর নামানোর জন্যেই। রুমী স্পষ্ট শুনল ওষুধের দোকানের লোকটা এ বলেই থেমে গেল না, মনে মনে বলল, লাটসাহেবের পোলা অ্যান্টিবায়োটিক খাবেন!
কি দিয়া খাওয়ামু? পানি দিয়া?
হুঁ। দুইটা বড়ি একবারে।
তয় ডাক্তার যে কইলো একটা কইরা?
মনে মনে অশ্লীল একটা গালি দিল লোকটা। মুখে বলল, একটা করে খাওয়াতে পারো একটু দেরি হবে জ্বর নামতে এই আর কি? দুইটা করে দিলে…
ডাক্তার সাব যে কইলো। ছেডু পোলা একটার বেশি যেন না দেই…
লোকটা আবার মনে মনে বিশ্রী অশ্লীল একটা গালি দেয়। মুখে বলল ডাক্তাররা ওই রকমই বলে। আমি ওষুধ বিক্রি করি আমি জানি না? এরপর মনে মনে যে কথাটি বলল তা শুনে রুমী থ হয়ে যায়, বলল, মাগি তোর এত চিন্তা কি? তোকে টেরামাইসিন কে দিচ্ছে? অ্যাসপিরিন দিচ্ছি, দুটো করেই খাওয়া, বাঁচার হলে এমনি বাঁচবে।
রুমী আরেকটু এগিয়ে যায়। মেয়েটি বলল, কত দাম?
চোদ্দ টাকা।
কিছু কম নেন। গরিব মানুষ, ঠিকা কাম করি।
থামো থামো! টেরামাইসিনের দাম জানো? ষোলটার দাম ষোল টাকা। তোমার কাছে এমনি দুই টাকা কম নিচ্ছি। মনে মনে বলল, নেট লাভ সাড়ে তেরো টাকা, যা মাগি দূর হ, সারাদিন বিক্রি নাই।
রুমী দোকানের ভিতর ঢোকে, মেয়েটি সরে ওকে জায়গা দিল। লোকটা উৎসুক চোখে ওর মুখের দিকে তাকায়, রুমী খুব ঠাণ্ডা গলায় বলল, টেরামাইসিনের বদলে অ্যাসপিরিন দিলেন
কেন?
দাড়িসহ লোকটার চোয়াল ঝুলে পড়ে অদ্ভুত একটা মাছের মতো দেখাতে লাগল, রুমী তার জীবনে কোনো মানুষকে এত অবাক হতে দেখে নি। লোকটা প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজেকে সামলানোর জন্যে।
নেট লাভ সাড়ে তোরো টাকা, না?
আমি… আমি… আমি… লোকটা খাবি খেতে থাকে।
মেয়েটি হাতে শক্ত করে টাকাগুলি ধরে অবাক হয়ে রুমীর দিকে তাকিয়ে ছিল। রুমী বলল, তুমি এসো আমার সাথে, ওষুধ কিনে দিই। এ তোমাকে অন্য ওষুধ দিচ্ছিল।
লোকটার অবস্থা দেখে সন্দেহের অবকাশ নেই, এত হতভম্ব হয়ে গিয়েছে যে প্রতিবাদ করার সাহস পর্যন্ত নেই। রুমী প্রেসক্রিপশনটি নিয়ে মেয়েটির হাতে দেয়।
কি চোরা, কি সর্বনাইশা চোরা, আবার দাড়ি রাখছে হারামির বাচ্চায় মেয়েটি সরু গলায় চিৎকার করে লোকটিকে গালি দিতে শুরু করে, অসুস্থ সন্তানের কথা চিন্তা করে মেয়েটির রাগ কিছুতেই কমতে চায় না। রুমী অনেক কষ্টে মেয়েটিকে শান্ত করে, এখন সে লোকজনের ভিড় জমাতে চায় না। অন্য একটি দোকান থেকে সে ঠিক ওষুধ কিনে দিয়ে মেয়েটিকে বিদায় করল।
মেয়েটি যাবার সময় বারবার বলল, সে আল্লাহর কাছে তার জন্যে দোয়া করবে, তার ভালো হবে, গরিবের দোয়া নাকি বৃথা যায় না।
ছটফট্ করে ঘুরে বেড়ায় রুমী, হঠাৎ সে প্রায়ই আজকাল এর ওর মনের কথা শুনে ফেলছে। ভালো ভালো সব লোকজন কি ভয়ানক সব কথা বলে, মনে মনে সে অবাক হয়ে যায় শুনে। কাউকে সে বিশ্বাস করে না আজকাল, পৃথিবীতে ভালো লোক নেই একটিও, সব ভণ্ড। খ্যাপার মতো হয়ে যাচ্ছিল রুমী, কোনো কিছুতে শান্তি নেই ওর। লোকজনের মনের কথা শোনার ওপর তার নিজের কোনো হাত নেই, তাহলে সে কখনোই কিছু শোনার চেষ্টা করতো না। আজকাল সে একটু আগে থেকে বুঝতে পারে কিছু একটা শুনবে, সেজন্যে ভারি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে সে, কোনোকিছু ঠিক করে ভাবতে পারে না, অনেকটা ঠিক ঘুমিয়ে পড়ার আগের অবস্থা। তার মাঝে হঠাৎ করে সে শুনতে পায় কথাটা, যেন সে নিজেই বলে ওঠে মনে মনে। সে যেন আর রুমী থাকে না, অন্য একজন হয়ে যায়। তার মতো করে কথা বলে, তার মতো করে চিন্তা করে। একদিন কি ভয়ানক ইচ্ছা করছিল একজনকে ধাক্কা মেরে ট্রাকের সামনে ফেলে দিতে। শেষ পর্যন্ত দেয় নি, হয়তো ঠিক সুযোগটা পায় নি বলে। সে নিজে তখন একটা রেস্টুরেন্টে বসে চা খাচ্ছে বন্ধুদের সাথে। হঠাৎ করে আবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় একটি বৃদ্ধ লোকের মুখ, অনাহারে দুঃখে কষ্টে শীর্ণ হয়ে আছে। দেখে ওর কোনো করুণা হয় না, উল্টে প্রচণ্ড রাগ ফুঁসে উঠতে থাকে, হারামির বাচ্চা দুনিয়াটা নোংরা করে ফেললি তোরা-দেই শালাকে ধাক্কা মেরে ট্রাকের নিচে ফেলে। রুমী হঠাৎ একটা ট্রাকের শব্দ শুনতে পায়। দেই শালাকে ফেলে, দেই ফেলে…দেই ফেলে…
হঠাৎ করে রুমী সম্বিৎ ফিরে পায়। বন্ধুটি তাকে ডাকছে, কি রুমী, কি হলো তোর?
দরদর করে ঘামছে সে, মুখ-চোখ কাগজের মতো ফ্যাকাশে। আস্তে আস্তে বলল, না, হঠাৎ মাথাটা ঘুরে উঠল কেমন!
ব্লাড প্রেশার। বন্ধুটির অভিমত দিতে এক মুহূর্ত দেরি হয় না, কান আর কপালে গরম লাগতে থাকে না?
হুঁ, অন্যমনস্কের মতো মাথা নাড়ে রুমী।
মনে হয় না কেমন চেপে ধরে আছে?
হুঁ।
ব্লাড প্রেশার, পরিষ্কার ব্লাড প্রেশার। লবণ কম করে খাবি। বন্ধুটির বাবা ডাক্তার অথচ তার নিজের ডাক্তারির যন্ত্রণায় কারো দুই দণ্ড সুস্থ হয়ে থাকার উপায় নেই।
রুমী রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়েই বৃদ্ধটিকে দেখতে পায়, ভিক্ষে করছে। শেষ পর্যন্ত ধাক্কা মেরে ফেলেনি তাহলে। রুমী আস্ত এক টাকা লোকটিকে দিয়ে দিল। বৃদ্ধটি হাত তুলে দোয়া করল রুমীকে। রুমী গলা নামিয়ে বলল, রাস্তার এত কাছে দাঁড়াও কেন চাচা? গাড়ি একটা ধাক্কা মারে যদি? ওই পাশে সরে দাঁড়াতে পারো না?
বৃদ্ধটি অপ্রস্তুতভাবে একটু হেসে নির্জীবভাবে বিড়বিড় করে কি যেন বলে একটু সরে দাঁড়াল। ভাগ্যের কাছে কি পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ! হয়তো এর বাবাও ভিক্ষে করেছে, এর ছেলেও তাই করবে।
কথা শোনার সাথে সাথে দেখতে পাওয়াটা আজকাল নতুন শুরু হয়েছে। আগে শুধু আশেপাশের লোকজনের মনের কথা শুনতে পেত, আজকাল অনেক দূরের লোকজনের মনের কথাও শুনতে পায়, কার কথা শুনতে পাচ্ছে জানে না পর্যন্ত। শুধু যে শুনতে পায় তাই নয়, সে নিজে কিছুক্ষণের জন্যে ওই লোকটি হয়ে যায়, তার মতো করে কথা বলে, তার মতো করে ভাবে, এমন কি তার মতো করে দেখে। পরিষ্কার দেখতে পায় কখনো কখনো। হয়তো কারো ভয়ার্ত মুখ, কারো যন্ত্রণাক্লিষ্ট চেহারা, কিন্তু কি হচ্ছে বলতে পারে না। কখনো কখনো সে এমন অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস দেখে যার অর্থ বুঝতে পারে না, মানুষের বা জন্তু-জানোয়ারের আশ্চর্য রূপ, অদ্ভুত সব রং, বিচিত্র রকমের গন্ধ, অর্থহীন নানা শব্দ। রুমীর চেহারা খারাপ হয়ে যেতে থাকে; রাতে ভালো ঘুম হয় না, খেতে পারে না, প্রায়ই হজমের গোলমাল হয়। মেজাজ সব সময় খিটখিটে হয়ে থাকে। সব সময়েই ভেতরে অশান্তি, একটা চাপা ভয়, কখন আবার তাকে কি দেখতে হয়, কি শুনতে হয় যা সে দেখতে চায় না, শুনতেও চায় না। রুমী ঠিক করল, কাউকে এটা বলতে হবে, জিজ্ঞেস করতে হবে কি করা উচিত তার। কে জানে, হয়তো সে পাগলই হয়ে যাচ্ছে।
কিবরিয়া ভাইয়ের বাসায় গিয়ে তাকে পেল না। দরজায় একটা চিঠি লিখে দিয়ে এলো, বিশেষ প্রয়োজনে এসেছিলাম, আপনাকে পেলাম না। কাল আবার আসব, সম্ভব হলে বাসায় থাকবেন।
সময় কাটানোর জন্যে সে তার ফুফুর বাসায় গেল। রাতে খাবার জন্যে জোরাজুরি করায় সে খেয়েই নিল। অনেকক্ষণ থেকেই তার ভেতরে কেমন একটা চাপা অশান্তি এসে ভর করেছে। থেকে থেকে সে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল, চোখের সামনে অদ্ভুত অদ্ভুত সব চেহারা ভেসে ওঠে, নারী-পুরুষ-শিশু, সবাই দুঃখে কষ্টে জীর্ণশীর্ণ। হঠাৎ হঠাৎ কে যেন কুৎসিত গালি দিয়ে ওঠে ওর ভেতরে, শুনে সে নিজেই চমকে ওঠে।
হলে ফিরে দরজা বন্ধ করে ঘরের বাতি নিভিয়ে বিছানায় বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল রুমী। পুকুরে আলোর প্রতিফলন পড়ে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে। তিরতির করে কাঁপছে নারকেলগাছের পাতা আর কেমন চুপচাপ হয়ে আসছে চারদিক। রুমীর ঘুম ঘুম লাগতে থাকে। কিন্তু ঘুমোতে পারে না। ভেতরে কেমন জানি একটা চাপা উত্তেজনা। জেগে জেগে দুঃস্বপ্ন দেখার। মতো অবস্থা, কিছু একটা হবে এখন, ও বুঝতে পারে; রুমীর স্নায়ু অপেক্ষা করে আছে।
খুব আস্তে আস্তে হলো পুরো ব্যাপারটা। প্রথমে ছাড়াছাড়াভাবে স্বপ্ন দেখার মতো তারপর খুব স্পষ্টভাবে, এত স্পষ্ট যে রুমীর সারা শরীর শিউরে ওঠে।
সে হাঁটাছে, রাস্তার ধারঘেঁষে হাঁটছে অন্ধকারে। অদ্ভুতভাবে হাঁটে সে, ডান পা-টা একটু টেনে টেনে, প্রতি পদক্ষেপে কোমরের কাছাকাছি কোথায় যেন ব্যথা করে ওঠে। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে দেখে এদিক-ওদিক। অন্ধকার বাড়ি, বন্ধ দোকানপাট। রাস্তার পাশে ঘুমিয়ে থাকা পথের লোকজন দেখে বিতৃষ্ণায় ওর ভিতরটা বিষিয়ে ওঠে। অবাক হয়ে রুমী দেখল কি সহজে সে কুৎসিত একটা গালি দিল ওদের।
মন ভালো নেই ওর, প্রচণ্ড রাগ যেন কার ওপরে। ইচ্ছে করে কাউকে লাথি মেরে ফেলে দেয় কোথাও, কারো কুঁটি ছিঁড়ে নিয়ে আসে। তার ওপর কোমরের কাছে সেই ব্যথা, প্রতি পদক্ষেপে ওর সারা শরীর যন্ত্রণায় ককিয়ে ওঠে। প্রচণ্ড রাগ হতে থাকে, ভয়াবহ যুক্তিতর্কহীন অন্ধ রাগ। একজন বুড়ো এগিয়ে আসে কোথা থেকে, যেন অন্ধকার কুঁড়ে বের হয়ে এসেছে। ভয়ানক চমকে ওঠে সে, আর রাগটা বেড়ে যায় হাজার গুণ।
বাবা, একটা টাকা দিবেন, বাবা? সারাদিন খাতি পাই নি।
খাওয়াচ্ছি তোকে, দাঁতে দাঁত চিবিয়ে মনে মনে বলল, রুমী, খাওয়াচ্ছি, তোকে এমন খাওয়াব যে আর খেতে চাবি না।
বহুদূরে একটা গাড়ির হেডলাইট দেখা যায়, একটা গাড়ি আসছে, কিসের গাড়ি? রুমীর হৃদস্পন্দন হঠাৎ বেড়ে যায় দশ গুণ।
বৃদ্ধটি আবার হাত পেতে দাঁড়াল। দিবেন, বাবা?
দাঁড়াও। গলার স্বর শুনে রুমী অবাক হয়ে ভাবে কি চমৎকার ভরাট গলার স্বর।
বৃদ্ধটি পঁড়িয়ে থাকে আশা নিয়ে। দূর থেকে গাড়িটা এগিয়ে আসছে আরও কাছে, ইঞ্চিনের শব্দ শোনা যাচ্ছে এখন, ওটা একটা ট্রাক।
বাবা…
এক মিনিট, পকেটে হাত ঢোকায় রুমী। রক্তের কল্লোল শুনতে পায় সে, মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে।
ট্রাক আরও কাছে এগিয়ে আসে।
আরও কাছে…
আরও কাছে…
এইবার! প্রচণ্ড ধাক্কায় বৃদ্ধটি ছিটকে গিয়ে পড়ে ট্রাকের সামনে। প্রাণপণে ব্রেক কষার চেষ্টা করে ট্রাক ড্রাইভার, কিন্তু বৃদ্ধটিকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে প্রায় তিরিশ ফুট দূরে গিয়ে থামে অতিকায় ট্রাক।
ছুট, ছুট, ছুট, প্রাণ নিয়ে ছুট, ধরা পড়ার আগে ছুট। ডান পা-টা টেনে টেনে প্রাণপণে ছুটতে লাগল রুমী। ওই তো যাত্রাবাড়ীর মোড়, সাঁকোটা পার হলেই মিশে যাবে সে ছোট ছোট ঝোঁপঝাড় আর বাড়িঘরের মাঝে। ছুট ছুট ছুট প্রাণপণে ছুট। পেছন ফিরে তাকাল একবার, ট্রাকটা ছেড়ে দিয়েছে, পালিয়ে যাচ্ছে ট্রাক ড্রাইভার।
হা হা করে হেসে উঠল রুমী, পালিয়ে যাচ্ছে সে ভয় পেয়ে। প্রচণ্ড হাসির দমকে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। পা টন্ টন্ করছে ওর, হাঁটু চেপে বসে পড়লো মাটিতে। পেট চেপে হাসতে থাকল বসে বসে, হাসি আর থামানো যায় না-কিছুতেই থামানো যায় না।
প্রচণ্ড আঘাতে যেন ঘুম ভাঙল রুমীর, অন্ধকার ঘরে বিছানায় শুয়ে সে পাগলের মতো হাসছে। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে, বুক ধক ধক্ করছে, যেন এখনি ফেটে যাবে, উঠে বসতে গিয়ে ওর মনে হলে ওর মাথা ছিঁড়ে যাবে প্রচণ্ড ব্যথায়। আবার শুয়ে পড়ল রুমী বালিশের তলা থেকে ঘড়ি বের করে দেখল, রাত দেড়টা বাজে।
কি করবে সে? একটা মানুষকে ও খুন হতে দেখল, এখন সে কি করবে?
সি কি খুন করেছে? না, না, কিছুতেই না!
তাহলে ওরকম দেখল কেন? সব নিশ্চয়ই দুঃস্বপ্ন, ভোর হলে দেখবে সব স্বপ্ন।
প্রচণ্ড মাথাব্যথায় রুমী কাটা মুরগির মতো ছটফট করতে থাকে তার বিছানায়।
সারারাত ছটফট করে ভোরের আলো ফোঁটার পর রুমী ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম যখন ভাঙল তখন বেলা দুপুর হয়ে গেছে। সকালে এর মাঝে দুটি ক্লাস হয়ে গেছে। এমনিতে সে এমন। কিছু নিয়মিত ক্লাসে যাওয়া ছাত্র নয়, তবু আজ ওর যাবার ইচ্ছা ছিল, একটা ভালো বিষয় পড়ানোর কথা। কিন্তু এ নিয়ে তার মাথা ঘামানোর অবসর নেই, প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছে, কিন্তু এতক্ষণে কেন্টিনও বন্ধ হয়ে গেছে। রুমী উঠে হাত-মুখ ধুয়ে গতরাতের কথা ভাবল, রাতের অন্ধকারে যে ঘটনাটা এত ভয়াবহ মনে হচ্ছিল দিনের আলোতে সেটাকে অনেক অবাস্তব এমন কি খানিকটা ছেলেমানুষী মনে হতে থাকে। নিশ্চয়ই একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছে সে, এ নিয়ে এত ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। যদিও সে প্রাণপণে ব্যাপারটি উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল, তবু ওর ভেতরে কোথায় জানি খুঁতখুঁত করতে থাকে।
রুমী পাশের একটা রেস্টুরেন্টে চা-নাস্তার অর্ডার দিয়ে রেস্টুরেন্টের খবরের কাগজটি নিয়ে এক কোনায় আরাম করে বসে। মধ্যপ্রাচ্যে আবার নতুন ঝামেলা বেধেছে, ব্যাংককে প্লেন হাউজ্যাক, আফ্রিকাতে খাদ্যাভাব এ ধরনের খবরগুলিতে চোখ বোলাতে বোলাতে রুমী নিজের অগোচরে যাত্রাবাড়ীতে ট্রাক দুর্ঘটনার খবরটি খুঁজতে থাকে। রুমী আগে কখনো লক্ষ করে দেখেনি যে প্রতিদিন অনেক করে মানুষ দুর্ঘটনায় মারা যায়, বেশির ভাগই ট্রাক দুর্ঘটনা। সারা খবরের কাগজ খুঁজেও যাত্রাবাড়ীর ঘটনাটা না পেয়ে রুমী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। রাতের ঘটনা পরদিন ভোরেই কাগজে পাওয়া যায় কি না এ নিয়ে সন্দেহটুকু সে জোর করে সরিয়ে রাখল।
নাস্তা শেষ করে সে চায়ে চুমুক দিয়ে একটা আরামের ভঙ্গি করে চেয়ারে হেলান দিয়ে পকেটে হাত দেয়। সিগারেট খাওয়া আজকাল বেশ রপ্ত হয়ে গেছে, চায়ে চুমুক দিলেই ওর আজকাল সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়ে যায়। খবরের কাগজটি ভাজ করে সরিয়ে রাখতে গিয়ে ওর চোখে পড়ে খবরের কাগজের নিচে ছোট ছোট করে লেখা শেষের খবর-গতরাতে যাত্রাবাড়ীতে এক ট্রাক দুর্ঘটনায় জনৈক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির শোচনীয় মৃত্যু ঘটেছে। শেষ খবর অনুযায়ী ট্রাক ড্রাইভার পলাতক।
রুমী স্তব্ধ হয়ে বসে রইল, হাতের সিগারেটের ছাই লম্বা হয়ে জমে একসময়ে টুক করে ভেঙে ওর কোলের ওপর পড়ে, তবু ওর সিগারেট টানার কথা মনে পড়ে না।
প্রচণ্ড রোদ, গরমের হলকা ছুটছে যেন। উদ্দেশ্যহীনভাবে রুমী হেঁটে বেড়ায় রাস্তা ধরে। কেমন একটা চাপা অভিমান ওর বুকের ভিতর গুমরে উঠছে। ইচ্ছে করে কোথাও বসে হু হু করে খানিকক্ষণ কেঁদে নেয়। কেন সে এরকম হয়ে পেল, কি দোষ তার? কি করেছে সে? এতটুকু শান্তি নেই ওর ভিতরে। সেই ভয়াবহ রাতে তার ওপর যখন প্রেতের আবির্ভাব হয়েছিল তারপর থেকে সব ওলটপালট হয়ে গেছে। এতদিন সে কিছু বিশ্বাস করে নি, ভেবেছে ডাক্তারের কথাই ঠিক, মারাত্মক যত ওষুধ তাকে ভয়াবহ সব অনুভূতি দিয়েছে। এখন সে আর ডাক্তারের কথা বিশ্বাস করে না। হয়তো সত্যিই তার ওপরে প্রেতের আবির্ভাব হয়েছিল, সে-প্রেত কখনো ফিরে যায় নি, তার ভিতরে রয়ে গেছে। ধীরে ধীরে সে নিজেও এখন প্রেতের মতো হয়ে যাচ্ছে, সব অশুভ ব্যাপার সে দেখতে পায়, শুনতে পায়, বুঝতে পারে। কোনো ভালো জিনিসের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই, সে শেষ হয়ে গেছে।
হাঁটতে হাঁটতে কখন সে রমনা পার্কের কাছে চলে এসেছে। কিছুক্ষণ গাছের ছায়ায় দেয়ালের ওপরে পা ঝুলিয়ে বসে রইল। হঠাৎ হঠাৎ একটু বাতাস এসে ওর সারা শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছিল। খানিকক্ষণ একটা সিগারেট খাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু মুখে কটু স্বাদ, দুই টান দিয়েই সে ওটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। ছোট অর্ধোলঙ্গ একটা বাচ্চা ছেলে সেটা তুলে নিয়ে গভীর পরিতৃপ্তির সাথে টানতে টানতে হেঁটে চলে গেল। কতইবা বয়স বাচ্চাটার অথচ এখনই তার কত দায়িত্ব। মাথায় একটা টুকরি, হয়তো পাতা কুড়ায়, হয়তো। কিছু ফেরি করে বেড়ায়। কি একচোখা পৃথিবী, এই বাচ্চাটির এখন মাথায় টুকরি নিয়ে রোদের মাঝে আরেকজনের ফেলে দেওয়া সিগারেট খেয়ে আনন্দ পাবার কথা নয়, স্কুলে বসে পড়ার কথা, দুরন্তপনা করার কথা, মায়ের সাথে মান-অভিমান করার কথা…
রুমী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তবু তো বাচ্চাটি তার থেকে সুখী! সে তো সিগারেটটা পর্যন্ত খেতে পারল না।
আপনি কীভাবে জানেন?
আমি দে-দেখেছি।
কীভাবে দেখেছেন?
রুমী একটু ভেবে বলল, আমি ওখানে ছিলাম।
রাত কয়টা তখন?
একটা-দেড়টা হবে। এত রাতে ওখানে কি করছিলেন?
রুমী কুলকুল করে ঘামতে থাকে। থানার পাশ দিয়ে আসার সময় হঠাৎ কি ভেবে হুট করে থানার ভিতর ঢুকে পড়ে সে শুধু জানতে চেয়েছিল, যাত্রাবাড়ীর অ্যাকসিডেন্টে ড্রাইভার ধরা পড়েছে কি না। নিরপরাধ ড্রাইভার ধরা পড়লে সে হয়তো নিজে থেকেই বলতো ড্রাইভারের কোনো দোষ নেই। কিন্তু তাকে কিছু না বলে বসিয়ে রেখেছে অনেকক্ষণ, একটু উত্তেজনা লক্ষ করেছে। তারপর মধ্যবয়স্ক একজন তাকে জেরা করতে শুরু করেছেন। রুমী যা জানতো সব বলেছে, শুধু সে যে নিজের ঘরে বসে পুরো ব্যাপারটি ঘটতে দেখেছে সেটা বলে নি, বললে কেউ বিশ্বাস করবে না তাই। পুলিশ অফিসারের ঠিক সেখানেই আপত্তি, এত রাতে ওই রাস্তায় কি করতে গিয়েছিল সে, ঘুরেফিরে শুধু ওই কথাটিই জিজ্ঞেস করছেন। রুমী বলেছে এমনি ওখানে হাঁটছিল, পুলিশ অফিসার সেটা বিশ্বাস করতে চান না।
বলুন কেন গিয়েছিলেন ওখানে।
এমনি হাঁটতে।
এত রাতে?
হ্যাঁ। ঘুম আসছিল না তাই হাঁটতে বের হয়েছিলাম।
হেঁটে যাত্রাবাড়ী গিয়েছেন?
রুমী একটু থতমত খেয়ে বলল, হ্যাঁ।
হেঁটে?
হেঁটে। রুমী বুঝতে পারে আস্তে আস্তে সে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ছে। একটি মিথ্যা কথা বললে সেটিকে বাঁচানোর জন্যে আরও দশটি মিথ্যা বলতে হয়। সে মিথ্যা ভালো বলতে পারে না, অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসারের নিশ্চয়ই সেটা বুঝতে বাকি নেই। রুমী কুলকুল করে ঘামতে থাকে।
কটার সময় হল থেকে বের হয়েছেন?
ঠিক জানি না। ঘড়ি দেখি নি।
তবু, আন্দাজ?
সাড়ে বারোটা হবে।
কেউ নিশ্চয়ই দেখেছে আপনাকে বের হতে?
জানি না। রুমী শুকনো গলায় বলল, এত রাতে সবাই শুয়ে পড়ে।
কেউ দেখে নি তাহলে, পুলিশ অফিসার হঠাৎ অন্য প্রসঙ্গে চলে এলেন, যে লোকটি বুড়োটিকে ধাক্কা মেরে ট্রাকের নিচে ফেলেছে তার গলার স্বর কি রকম?
ভরাট স্বর, বেশ ভালো।
তার কথা স্পষ্ট শুনেছেন?
হুঁ।
কি বলেছে সে?
বলেছে, একটু দাঁড়াও তারপর পকেটে হাত ঢুকিয়ে পয়সা বের করার ভান করেছে।
কত কাছে থেকে ওর কথা শুনেছেন?
রুমী ঢোঁক গিলে বলল, এই দশ-বারো হাত।
এত দূর থেকে স্পষ্ট শুনেছেন ওর কথা?
তাহলে হয়তো আরও কাছে ছিলাম।
কত কাছে? দেখিয়ে বলুন।
রুমী অনিশ্চিতের মতো একটা দূরত্ব দেখাল, যেটুকু দূর থেকে কথা শোনা সম্ভব।
এত কাছে?
রুমী মাথা নাড়ল।
সে আপনাকে দেখে নি?
পুলিশ অফিসার অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকেন। আস্তে আস্তে একটা সিগারেট ধরিয়ে অন্যমনস্কভাবে টানতে থাকেন। একসময় সিগারেট নামিয়ে ঘুরে ওর দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বললেন, কেন মিথ্যে কথা বলছেন?
রুমী ভীষণ চমকে ওঠে, কিন্তু কি বলবে বুঝতে পারে না। আমতা আমতা করে প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল, কিন্তু পুলিশ অফিসার কঠোর স্বরে ওকে থামিয়ে দেন, ট্রাক ড্রাইভারকে আজ ভোরে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। সে বলেছে, কে একজন ধাক্কা মেরে বুড়োটিকে ট্রাকের নিচে ফেলে দিয়েছে।
রুমী উত্তেজিত হয়ে বলল, বললাম না, আমি বললাম না…
হাত তুলে থামিয়ে দিলেন ওকে পুলিশ অফিসার, ট্রাক ড্রাইভার বলেছে সে তার হেডলাইটে স্পষ্ট দেখেছে সেই লোকটিকে। একা ছিল সে, ধারে কাছে কেউ ছিল না।
রুমী ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সে হঠাৎ বুঝতে পেরেছে পুলিশ অফিসার কি সন্দেহ করছেন। অসহায় ভয়ের একটা শীতল স্রোত তার মেরুদণ্ড বেয়ে মাথায় উঠে আসতে থাকে। সে শুনতে পায় পুলিশ অফিসার আস্তে আস্তে বলছেন বুড়োটিকে কেন খুন করেছেন?
পুরোপুরি ভেঙে পড়ল রুমী।
পরদিন কিবরিয়া ভাই হাজতে রুমীর সাথে দেখা করতে এলেন। এক রাতে তার বয়স দশ বছর বেড়ে গিয়েছে। সারারাত সে ঘুমোতে পারে নি। শক্ত মেঝেতে কুটকুটে কম্বলে গা ঘিনঘিন করা দুর্গন্ধ, ভ্যাপসা গরম, মশা আর ছারপোকার কামড়। হাজতবাসী অন্যদের হাসি-মশকারা সবই সহ্য করা যায়, কিন্তু খুনের অপরাধে তাকে ধরে রাখা হয়েছে এ চিন্তাটি তাকে একেবারে কাবু করে ফেলেছে। রুমী কিবরিয়া ভাইকে নিজের অবস্থাটা বোঝানোর চেষ্টা করল। কিবরিয়া ভাই গুম হয়ে শুনলেন, তবে কোনো কথা বিশ্বাস করলেন বলে মনে হলো না। রুমী খুন করেছে সেটি বিশ্বাসযোগ্য নয়, কিন্তু একেবারে বিনা কারণে পুলিশ তাকে অ্যারেস্ট করবে কেন? কিবরিয়া ভাই বেশিক্ষণ থাকলেন না, তার খাওয়ার ব্যবস্থা করে চলে গেলেন, জামিনের বন্দোবস্ত করে আবার ফিরে আসবেন বলে গম্ভীর মুখে বিদায় দিলেন। রুমী আবার দুর্গন্ধময় অন্ধকার হাজতে অনির্দিষ্টকালের জন্যে আটকা পড়ে গেল।
এক কোনায় বসে কয়জন তাস খেলছে। মনে হয় এরা ঘুরেফিরে প্রায়ই আসে এখানে। দু-একজনের পুলিশের সাথে ভালো খাতিরও আছে, পান-সিগারেট কিনিয়ে আনে ওদের দিয়েই। উচ্চস্বরে হাসে, কুৎসিত গালাগালি দিয়ে ওঠে একটু পর পর। আশ্চর্য এক জগতের লোক ওরা, রুমী ভয় পেয়ে যায় ওদের দেখে। ওর গাঘেঁষে এসে বসে বারবার, অশ্লীল রসিকতা করে ওকে নিয়ে। এখানে বেশিদিন থাকতে হলে রুমী পাগল হয়ে যাবে। বিভিন্ন ধরনের লোকজন আছে এখানে। কয়জন প্রচণ্ড মার খেয়েছে, রক্তাক্ত শরীর বীভৎসভাবে ফুলে আছে। একজনের মাথায় টুপি, হাজতের ভিতর নির্বিকারভাবে নামাজ পড়ল একবার। কয়েকজন বেশ অল্পবয়সী, তাদের ভিতর একজন ভেউ ভেউ করে কাঁদছে। একজন পাঞ্জাবি আর চশমা পরা ছেলে শান্তভাবে সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে, রুমী কথা বলার চেষ্টা করে বেশি সুবিধা করতে পারল না।
রাত গম্ভীর হয়ে এলে একজন দুজন করে এখানে-সেখানে শুয়ে পড়ে। গুমোট গরম আর ভ্যাপসা গন্ধে হাজতের গিঞ্জি ঘরটা বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। রুমী দেয়ালে হেলান দিয়ে চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। বাইরের ওই সাধারণ পথঘাট, বাড়িঘর তার কাছে কত অচেনা বলে মনে হতে থাকে। কে জানে কিবরিয়া ভাই জামিনের ব্যবস্থা করতে পারলেন কি না। বসে থাকতে থাকতে একসময়ে তার চোখে ঘুম নেমে আসছিল, হঠাৎ কে জানি তার ভিতরে একটা কুৎসিত গালি দিয়ে ওঠে। রুমী ভয়ানক চমকে লাফিয়ে উঠে বসে। ওই লোকটা! কীভাবে সে বুঝতে পারে জানে না, কিন্তু তার কোনো সন্দেহ থাকে না।
ধরতে হবে লোকটাকে, যেভাবে হোক ধরতে হবে। কীভাবে ধরতে হবে জানে না সে, এর আগে কখনো চেষ্টা করে নি, কিন্তু আজ তাকে চেষ্টা করতেই হবে। মাথা ঢেকে সে শুয়ে পড়ে তারপর সমস্ত মনপ্রাণ ইন্দ্রিয় একত্র করে লোকটার কথা ভাবতে থাকে, তার মনের ভেতর ঢোকার চেষ্টা করতে থাকে। হাজতঘরে চাপা গলার স্বর, অশ্লীল গালির শব্দ দূরে কোথাও ঘণ্টা বাজিয়ে একটা দমকল চলে গেল। ছাদে কোথাও কবুতর বাসা করেছে, বাকবাকুম বাকবাকুম শব্দে প্রেয়সীর মনোরঞ্জন করার চেষ্টা করছে। বাইরে একটা সেপাই হাতের রাইফেল মেঝেতে ঠুকে ঠুকে একটানা একটা শব্দ করে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে রুমীর মনে হতে থাকে সে যেন ভেসে চলে যাচ্ছে সব শব্দ যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে ওর কাছে। সে দূরে আরও দূরে চলে গেল, সব শব্দ আস্তে আস্তে অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর হয়ে একসময় একেবারে মিলিয়ে গেল।
হাঁটছে রুমী। ফাঁকা অন্ধকার রাস্তা ধরে লাঠিতে ভর দিয়ে দিয়ে সে পা টেনে টেনে হাঁটছে। প্রতি পদক্ষেপে ওর সারা শরীর ব্যথায় শিউরে উঠছে, রাগ ফুঁসে উঠছে ভেতরে। এদিক-সেদিক ওর চোখ নড়ছে দ্রুত, মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছে সে, দুর্বল নিরীহ মানুষ। ওর ভেতরকার রাগটা ঝাড়তে হবে কারো ওপর। ইচ্ছে করছে কাউকে ধরে পশুর মতো নির্যাতন করতে। কিন্তু কীভাবে করবে? ওর সে ক্ষমতা কই? শক্ত লাঠিটার স্পর্শ পেয়ে ওর হাত নিশপিশ করতে থাকে আহ্! কারো মাথার ওপর যদি বসিয়ে দিতে পারতো সজোরে, খুলিটা ফাটিয়ে দিতে পারতো এক আঘাতে…
মালিবাগ… মালিবাগ… মালিবাগ… একটা রিকশাওয়ালা ডাকছে। বাড়ি ফিরে যাচ্ছে, কাউকে পেয়ে গেলে আর খালি রিকশা নিয়ে যেতে হয় না। রুমী রিকশাওয়ালার দিকে তাকায় না। খুব বেশি জোয়ান এই রিকশাওয়ালাটা। হাতে-পায়ে শক্ত পেশি, সাপের মতো কিলবিল করছে শক্তির প্রাচুর্যে। একে দিয়ে হবে না। লাঠিতে ভর দিয়ে রুমী আবার হাঁটতে থাকে।
রাস্তার পাশের গাছের নিচে ছোট একটা খুপরিতে চায়ের দোকান। ইটের ওপর বসে এক বুড়ো চা খাচ্ছে সেখানে, পাশে তার খালি রিকশা। দুর্বল বৃদ্ধ লোকটিকে দেখে ওর ভেতরে লোভ জেগে ওঠে। একে একবার চেষ্টা করে দেখা যায়, পায়ে ওর ব্যথা কিন্তু হাত দুটি তো ঠিক আছে, দুহাত একত্র করে পেছন থেকে মাথায় মারতে পারলে এক ঘায়ে কাজ শেষ হয়ে যাবে। জিভে পানি এসে গেল ওর।
যাবে নাকি রিকশা?
না স্যার। বুড়ো চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে পরিতৃপ্তির শব্দ করে।
চলো না, এত রাতে রিকশা কোথায় পাব?
পাবেন স্যার, একটু হাঁটেন তাইলেই পাবেন।
হাঁটতে পারছি না বলেই তো বলছি, পায়ে ব্যথা আমার। চলো, তোমাকে দুই টাকা বেশি দেব।
কই যাবেন?
ইন্দিরা রোড।
লোকটার যাবার ইচ্ছে নেই, কিন্তু সে জোর করল। পায়ের ব্যথা এবং টাকার লোভ দেখিয়ে রাজি করাল।
কি উত্তেজনা। রুমীর ভেতরটা আনন্দে নেচে ওঠে, আর খানিকটা গেলেই অন্ধকার নির্জন অংশটুকু, তখন দুহাত শক্ত করে লাঠিটা ধরে মাথার পেছন থেকে দেবে এক ঘা। আনন্দে খিকখিক করে হেসে ওঠে সে।
ঠুন ঠুন করে রিকশা চালিয়ে যাচ্ছে রিকশাওয়ালা, ঘুণাক্ষরেও কিছু সন্দেহ করে নি। অন্ধকার রাস্তায় তাড়াতাড়ি চালাচ্ছে সে, মাঝে মাঝে গুণ্ডারা নাকি এখানে হামলা করে পেছনের সিটে বসে রুমী দুই হাতে ধরে লাঠি ওপরে তুলল, তারপর প্রচণ্ড এক ঘা।
ছোট একটা আর্তচিৎকার করে রিকশার হ্যাঁন্ডেলের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল রিকশাওয়ালা। রিকশা তাল সামলাতে না পেরে ঘুরে রাস্তার পাশে গড়িয়ে যাচ্ছিল, একটা লাইটপোস্টে ধাক্কা লেগে থেমে গেল। অদ্ভুতভাবে হ্যাঁন্ডেলে ঝুলে আছে বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা, মাথা থেকে টন্ টন্ করে রক্ত পড়ছে গাল বেয়ে। রুমী লাফিয়ে নামল রিকশা থেকে পালিয়ে যেতে হবে এখন, কেউ দেখে ফেলার আগে…
হঠাৎ রুমী সম্বিৎ ফিরে পায়। এই লোকটাকে থামাতে হবে, কিছুতেই ওকে পালিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না, কিছুতেই না, কিছুতেই না। কিন্তু রুমীর কিছু করার নেই। লোকটা পা টেনে টেনে হেঁটে চলে যাচ্ছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আর একটু গেলেই ওই গলির ভেতরে ঢুকে যাবে, ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে তখন।
রাস্তা ঘুরতেই একটা গাড়ি এসে পড়ে ওর সামনে, হেডলাইটে চোখ ধাঁধিয়ে যায় লোকটার। মুখ ঢেকে ফেলে লোকটা ভয়ে, তারপর উলটোদিকে ছুটতে শুরু করে। গাড়িটা থেমে গেছে রিকশাটার কাছে। গাড়ি থেকে দুজন লোক নেমে এলো, বৃদ্ধ রক্তাক্ত রিকশাওয়ালাকে ধরাধরি করে নামাল রিকশা থেকে। বিড়বিড় করে কি যেন বলল রিকশাওয়ালা, সাথে সাথে লোক দুটি চিৎকার করে উঠল, ধর শালা ল্যাংড়াকে…
ভয়-ভয়-ভয় জান্তব ভয় ওর ভেতরে। ছুটে যেতে চেষ্টা করছে। সে, পা টেনে টেনে ছোটা যায় না, ব্যথায় ককিয়ে উঠছে, তবু প্রাণপণে ছুটতে থাকে। কিন্তু পেছন পেছন ছুটে আসছে দুজন, লম্বা লম্বা পা ফেলে ধরে ফেলল প্রায়। প্রচণ্ড ভয় হলো ওর, ঘুরে দাঁড়াল হঠাৎ, দুই হাতে শক্ত করে ধরল লাঠি…
কিন্তু তার আগেই মুখে প্রচণ্ড ঘুষি। মাথা ঘুরে পড়ে গেল মাটিতে, মার শালা শুয়োরের বাচ্চাকে-প্রচণ্ড লাথি পড়ল ওর পেটে। ফার্স্ট ডিভিশন ফুটবল লীগে হাফ ব্যাক খেলে নীলু, ওর এক লাথিতে বল মাঠ পার হয়ে যায়। লোকটা জ্ঞান হারাল প্রচণ্ড যন্ত্রণায়।
থরথর করে কাঁপছে রুমী, ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে হাজতের সব কজন লোক। চশমা পরা ছেলেটা ডাকছে ওকে, কি হয়েছে? এই ছেলে, কি হয়েছে তোমার?
রুমী উঠে বসে। তখনো ওর সারা শরীর কাঁপছে, কোনোমতে বলল, না, কিছু না।
কে একজন বলল, মৃগী ব্যারাম। উঠতে দেবেন না, চেপে ধরে নাকের কাছে জুতাটা ধরেন।
রুমী ওদের কথায় কান দিল না, দরজার কাছে গিয়ে চিৎকার করে ডাকাডাকি করতে থাকে, এই যে, কে আছেন? শুনে যান…
একজন সেপাই ঘুম ভাঙা গলায় হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, কি হয়েছে?
ওসি সাহেবকে ডাকেন একবার, ভয়ানক জরুরি দরকার।
ঘুমা শালা শুয়োরের বাচ্চা! এখন আমি ওসি সাহেবকে ডাকি!
কে একজন হো হো করে হেসে ওঠে হাজতের ভেতর। রুমী তবু হাল ছাড়ল না, বলল, গিয়ে বলেন আসাদগেটের কাছে ধরা পড়েছে ওই পা খোঁড়া লোকটা।
সেপাইটি খানিকক্ষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে, তারপর খেঁকিয়ে ওঠে বিশ্রীভাবে।
বিশ্বাস করেন। একটা রিকশাওয়ালার মাথায় লাঠি মেরে…
চোপ শালা হারামজাদা, আর একটা কথা বলবি তো দাঁত ভেঙে দেব।
রুমী চুপ করে গেল। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
কিন্তু সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো না। রাত তিনটের সময় সেই পুলিশ অফিসার নিজে এসে রুমীকে ডেকে নিয়ে গেলেন। সেন্ট্রি সেপাইটা চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সে নিজের কানে শুনেছে রুমী বলেছে আসাদগেটের কাছে। খোঁড়া লোকটা ধরা পড়েছে, রিকশাওয়ালাকে মেরে পালিয়ে যাচ্ছিল। কি করে বলল ও?
একটু আগে থানায় দুজন এসে ডায়েরি করিয়ে গেছে। রিকশাওয়ালা আর খোঁড়া লোকটাকে নিয়ে গেছে হাসপাতালে। সেপাইটা একটু এগিয়ে রুমীর কাছে গলা নামিয়ে বলল, আপনি কীভাবে জানলেন? হাজতেই তো ছিলেন সারাক্ষণ। কিছুক্ষণ আগেই সে তার দাঁত ভেঙে ফেলার ভয় দেখাচ্ছিল, কিন্তু তা আর মনে রাখে নি রুমী। একটু বিব্রতভাবে বলল, জানি না, কি করে যে জানলাম। আপনি রাগ করেন নি তো, স্যার? মুখটা খারাপ আমার।
না, না।
কীভাবে বুঝব, স্যার? এতগুলি চোর-ছ্যাচোড়ের মাঝে যে আপনি আছেন আমি কীভাবে জানব?
হুঁ। মাথা নাড়ে রুমী, তা তো বটেই।
কিছু মনে করবেন না স্যার। বাচ্চাকাচ্চার বাপ আমি-সেপাইটা ভয় পেয়ে যায়। না, না রাগ করব কেন?
পুলিশ অফিসার অনেকক্ষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে রুমীর দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর আস্তে আস্তে বললেন, কোনো শালা বিশ্বাস করবে না।
কিসের কথা বলছে বুঝতে পেরে একটু হাসার ভঙ্গি করল রুমী। কোর্টে কেস ওঠার সময় একেবারে চেপে যেতে হবে পুরো ব্যাপারটা। কোনো শালা বিশ্বাস করবে না, আর বেকসুর খালাস পেয়ে যাবে ল্যাংড়া!
চুপ করে থাকে রুমী।
আপনি কাউকে বলবেন না, খবরের কাগজ যেন খোঁজ না পায়, আপনার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে! আমি এদিকটা সামলাবো।
রুমী ব্যস্ত হয়ে বলল, হ্যাঁ, প্লিজ, আমি চাই না কেউ জানুক।
জানবে না, নিশ্চিন্ত থাকুন। একটু হেসে পুলিশ অফিসার আন্তরিক গলায় বললেন,
এত রাতে আর কোথায় যাবেন? আমার বাসায় চলুন, এই কাছেই আমার বাসা।
না, না, থাক। আমি হলে ফিরে যাই বরং, ভালো করে গোসল করে ঘুমাব। আমার বাসায় চলুন, গোসলের ব্যবস্থা করে দেব। কিছু খেয়ে ঘুমোবেন, হাজতে থেকে কি চেহারা হয়েছে আপনার। কোনো কথা শুনলেন না তিনি, তাকে বাসায় নিয়ে গেলেন। ভদ্রলোক একটু স্ত্রী-পাগল, রুমীর ব্যাপারটা শুধু গল্প করে মন। ভরবে না বলে নিজের চোখে দেখাতে চাইছিলেন তার স্ত্রীকে। তার মতো আর কয়টা কেস আছে এই পৃথিবীতে?
সাত
নৃশংস : ঢাকা, ২১ জুন; গতরাত একটার সময় আশফাক হাসান (৩৫) নামে এক ব্যক্তিকে নির্মমভাবে জনৈক রিকশাওয়ালার মাথায় আঘাত করার অপরাধে গ্রেফতার করা হয়। উক্ত আশফাক হাসানের স্বীকারোক্তিতে আরও জানা যায়, সে পূর্ব রাত্রিতে যাত্রাবাড়ীর নিকটে কদম আলী নামক এক পথচারীকে চলন্ত ট্রাকের সামনে ধাক্কা দিয়া ফেলিয়া নির্মমভাবে হত্যা করিয়াছে। পুলিশ সূত্রে জানানো হয় যে, এই অমানুষিক হত্যাকাণ্ডের এখন পর্যন্ত কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় নাই। রিকশাচালক সৈয়দ ইমতিয়াজ আলীকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হইয়াছে, তার অবস্থা সংকটজনক। আশফাক হাসান ঢাকার প্রখ্যাত চক্ষু চিকিৎসক ডা. আবিদ হাসানের জ্যেষ্ঠ পুত্র। বৎসরাধিককাল পূর্বে জার্মানিতে সড়ক দুর্ঘটনায় এক পা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় উক্ত আশফাক হাসান স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করিয়াছে। শেষ খবর পাওয়া অনুযায়ী জোর পুলিশি তদন্ত চলিতেছে।
শহরে রিকশা ধর্মঘট : ঢাকা, ২২ জুন, রাত এগারোটার সময় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আহত রিকশাচালক সৈয়দ ইমতিয়াজ আলী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)। জনৈক আশফাক হাসান পূর্বরাত্রে রিকশার সিটে বসে লাঠি দিয়ে তার মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করে। সৈয়দ ইমতিয়াজ আলীর মৃত্যুতে ঢাকা নগরী রিকশাচালক ইউনিয়নের আহ্বানে সারা শহরে রিকশা ধর্মঘট পালন করা হয়। জানাজার পর ক্ষুব্ধ রিকশাচালকেরা শোভাযাত্রা সহকারে সৈয়দ ইমতিয়াজ আলীর মৃতদেহ বহন করে সমস্ত শহর প্রদক্ষিণ করে। আজিমপুর গোরস্তানে দাফন সম্পন্ন করে ফিরে আসার পথে ক্ষুব্ধ রিকশাচালক এবং জনতা ওই আশফাক হাসানের পিতা ডা. আবিদ হাসানের বাসা ঘেরাও করে। পুলিশ অনেক কষ্টে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে সক্ষম হয়। এ ব্যাপারে কাউকে গ্রেফতার করা হয় নাই।
সম্পাদকীয় : আমাদের সমাজে ভায়োলেন্স কম তাহা এখন জোর করিয়া বলা মুশকিল। দশ বৎসর আগের তুলনায় আজকাল সংবাদপত্রে অনেক বেশি হত্যাকাণ্ড বা অন্য ধরনের নৃশংসতার বিবরণ প্রকাশিত হয়। কিন্তু এইসব হত্যাকাণ্ড বা নির্মমতা কখনোই সম্পূর্ণ বিনা কারণে ঘটে নাই। সামাজিক বা রাজনৈতিক কারণ, পারিবারিক কলহ, অর্থলোভ কিংবা ক্রোধের বশবর্তী হইয়া এ হত্যাকাণ্ডগুলি সংঘটিত হইয়াছে। কিন্তু এ দেশে সম্পূর্ণ বিনা কারণে হত্যাকাণ্ড বোধ করি এই প্রথম ঘটিল। আশফাক হাসান নামক জনৈক সম্ভ্রান্ত, বিদেশ হইতে তথাকথিত উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তি শুধু মনের খেয়াল মিটাইবার জন্যে দুই-দুইটি নির্মম হত্যাকাণ্ড করিয়াছে বলিয়া পুলিশ সূত্রে জানানো হইয়াছে। বিদেশে এ ধরনের নমুনার অভাব নাই। ব্রিটেনের জ্যাক দা রিপার, ইদানীংকার ইয়র্কশায়ার রিপার, আমেরিকার সান অফ স্যাম, হিলসাইড স্ট্র্যাংলার, ফ্রি ওয়ে কিলার বা আটলান্টার শিশু হত্যাকারী বিভিন্ন সময়ে সারা পৃথিবীতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করিয়াছিল। বিদেশে শিক্ষা লইতে গিয়া যদি এই দেশের যুবকেরা এই প্রকার শিক্ষা গ্রহণ করিয়া আসিতে থাকে…
খুব সাবধানে পরের কদিন সব কটি খবরের কাগজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ল রুমী। তার সম্পর্কে কোথাও একটি কথাও লেখা হয় নি। তার ব্যাপারটি কোনোভাবে প্রকাশ পেয়ে গেলে চমৎকার একটি খবর হলো, প্রথম পৃষ্ঠায় তার ছবি এবং নিচে তরুণের অলৌকিক রহস্যভেদ’ বা এই ধরনের একটা কিছু লিখে একটি ছোটখাটো আলোড়নের সৃষ্টি করা যেতো। কিন্তু পুলিশ অফিসার তার কথা রেখেছেন, তাই রুমীকে একটি আলোড়নের কেন্দ্রস্থল হওয়ার বিড়ম্বনা সহ্য করতে হলো না। এমনিতেই তার সমস্যার অন্ত নেই, তার ওপর আবার নতুন বিড়ম্বনার জায়গা কই?
প্রাথমিক উত্তেজনাটুকু কেটে যাবার পর কিবরিয়া ভাই রুমীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বড় বড় ডাক্তার এবং নিউরোলজিস্টের সাথে যোগাযোগ করে রুমীকে তাদের কাছে নিয়ে গেলেন। তারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে পরীক্ষা করলেন। রক্ত, কফ, মলমূত্র কিছুই বাকি থাকল না। তার ইইজি ইসিজি করানো হলো, কিবরিয়া ভাই বিভিন্ন জায়গায় কথাবার্তা বলে প্রায় বিনা খরচে করিয়ে দিলেন সব। ডাক্তাররা অনেক কঠিন কঠিন অসুখের নাম বলে নিজেরা আলোচনা করলেন, তার বেশির ভাগই বুঝতে পারলো না রুমী। তার মস্তিষ্কের ছোট একটা অংশ পাকাপাকীভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। যার জন্যে কোনো কোনো ব্যাপার সে কিছুতেই মনে করতে পারে আবার তার মস্তিষ্কের সামনের অংশে কিছু একটা হয়েছে যা স্বাভাবিক নয়, সেখানকার বৈদ্যুতিক বিশ্লেষণ অন্য কারো সাথে মেলে না। এর পরেই ডাক্তাররা নিজেদের সাথে আর একমত হতে পারলেন না। কয়েকজন বললেন রুমীর দৈনন্দিন জীবনে এর জন্যে কোনো ধরনের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, অন্যরা বললেন যে তার চিন্তা করার ক্ষমতা অনেক পরিবর্তিত হয়ে যাবার কথা। অবিশ্যি সবাই এক বিষয়ে একমত হলেন যে মস্তিষ্ক সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান এত কম যে তারা কোনো কিছুই জোর দিয়ে বলতে পারেন না। ডাক্তাররা রুমীকে মনোবিজ্ঞানীর সাথে কথা বলার উপদেশ দিলেন।
কিবরিয়া ভাই খুঁজে খুঁজে তাকে এক মনোবিজ্ঞানীর কাছে নিয়ে গেলেন। ভদ্রলোক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। অবসর সময়ে মানসিক রোগীদের দেখেন। রুমীর নিজেকে মানসিক রোগী হিসেবে কল্পনা করতেও প্রচণ্ড আপত্তি, কিন্তু কিছু করার নেই। মনোবিজ্ঞানী ভদ্রলোক তাকে অদ্ভুত অদ্ভুত সব প্রশ্ন করলেন। কিছু কিছু এত অবান্তর নির্লজ্জ প্রশ্ন যে শুনে লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে রুমী। পাকা দুই ঘণ্টা তাকে নানাভাবে জেরা করে ভদ্রলোক বললেন, তার সুপ্ত অপরাধবোধ নাকি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে তার ভেতরে দ্বিতীয় আরেকটা ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি করেছে। এই দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব নিজেকে প্রেত হিসেবে কল্পনা করে। কাজেই তাকে সম্মোহিত করে প্রেত-ব্যক্তিত্বকে বের করে এনে সেটিকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে হবে। সব শুনে সেখানে দ্বিতীয়বার যাওয়ার সাহস হলো না রুমীর।
কে জানে, হয়তো ভুল করে তার নিজের ব্যক্তিত্বকেই টেনে বের করে ছিন্নভিন্ন করে দেবে, তারপর আজীবন তাকে প্রেতের ব্যক্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। তাছাড়া অনেক করে টাকা নেয়, শুধু গালগল্প শোনার জন্যে এত টাকা দেওয়ার কোনো মানে হয়
কিবরিয়া ভাই কিন্তু রুমীকে নানাভাবে জোর করে মনোবিজ্ঞানীর কাছে পাঠানোর চেষ্টা করতে থাকলেন। রুমীকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন মানুষের মন কি বিচিত্র, সাধারণ মানুষ যা ধরতে পারেন না মনোবিজ্ঞানীরা তা ধরে ঠিক সমস্যাটা খুঁজে বের করতে পারেন। টাকার কথা বলে লাভ নেই, কিবরিয়া ভাই তাহলে নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে দেবেন। শেষ পর্যন্ত আর একবার চেষ্টা করতে রাজি হলো রুমী। কিন্তু এই শেষ, যদি তার কোনো উপকার না হয় সে সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে দেবে।
কিন্তু মনোবিজ্ঞানীর কাছে আর যেতে হলো না তাকে, তার আগেই একটা ছোট ঘটনা অনেক কিছু পাল্টে দিল।
বাসে করে আসছিল ও, প্রচণ্ড ভিড় কিন্তু বসার জায়গা পেয়েছে সে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল, আবছা আবছাভাবে সে বুঝতে পারে আবার একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে তার ভেতরে। প্রচণ্ড ভয় আর অস্বস্তিতে ছটফট করতে থাকে রুমী। তাড়াতাড়ি হলে পৌঁছে চারটে ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে মড়ার মতো ঘুমিয়ে পড়বে। আগে দুটো খেলেই ঘুমোতে পারতো, আজকাল চারটের কমে হয় না। যখনই তার মনে হয় কোনো ধরনের ভয়ানক অভিজ্ঞতা হতে পারে, তখনই ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, পরের দুদিন গা ম্যাজম্যাজ করে, মাথা ভার হয়ে থাকে তবুও সে বেশ কিছুদিন থেকে তাই করে আসছে।
ওর কাঁধে হাত দিল কে যেন। ঘুরে তাকিয়ে দেখে একজন বুড়োমতো লোক। মাথায় সাদা কিস্তি টুপি, পরনে আধময়লা শার্ট, ওর পাশে বসে আছে। গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করে ওকে, বাবা, তোমার কি হয়েছে?
অবাক হয়ে লোকটির দিকে তাকায় রুমী, চোখ দুটি কি আশ্চর্য স্বচ্ছ! হঠাৎ করে মনে হয় খুব আপনজন। মাথা নেড়ে বলল রুমী, কিছু হয় নি তো।
লোকটা গলা আরও নামিয়ে বলে, বলো আমাকে, কি হয়েছে?
রুমী আবার বলতে যাচ্ছিল কিছু হয় নি কিন্তু লোকটা বাধা দেয়, আমাকে বলো, আমি হয়তো তোমাকে সাহায্য করতে পারব।
অবাক হয়ে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে রুমী, আপনি কি করে বুঝলেন আমার কিছু হয়েছে?
বোঝা যায় বাবা, মানুষের মুখ দেখলে সব বোঝা যায়। বলো বাবা আমাকে, তোমার কিসের ভয় এত?
কি বলবে বুঝতে পারছিল না রুমী। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনি ঠিকই ধরেছেন, আমার কিছু একটা হয়েছে তাই এত অশান্তিতে আছি, কাউকে বললে বিশ্বাস করবে না।
আমি বিশ্বাস করব, বাবা।
রুমী লোকটার চোখের দিকে তাকায়, এত আশ্চর্য স্বচ্ছ কোমল চোখ সে জীবনে কখনো দেখে নি। লোকটা দেখতে এত সাধারণ, আধময়লা কাপড়, মাথায় একটা টুপি, কিন্তু চোখ দুটির দিকে তাকালে সবকিছু গোলমাল হয়ে যায়। এ সাধারণ মানুষ নয়, রুমীর হঠাৎ তাকে বিশ্বাস হয়, একে সব খুলে বলা যায়। সে গলা নামিয়ে তার কথা বলতে শুরু করে। লোকটা গম্ভীর হয়ে শোনে, একটি-দুটি প্রশ্ন করে, তারপর চুপ হয়ে যায় অনেকক্ষণের জন্যে।
বাস ততক্ষণে কার্জন হলের কাছে চলে এসেছে, ওরা দুজনে নেমে পড়ে সেখানে, হেঁটে হেঁটে পুরোনো হাইকোর্টের সামনে একটা গাছের নিচে বসে।
রুমী তার সব কথা শেষ করে বলল, বিশ্বাস হয় আপনার?
লোকটা একটু হেসে আস্তে আস্তে বলল, আল্লাহ্র দুনিয়ায় কত কি আছে, বিশ্বাস না করলে চলে না বাবা। আমি নিজে কত কি দেখেছি, বললে লোকে পাগল ভাববে। তোমার কোনো ভয় নেই বাবা, সব ঠিক হয়ে যাবে।
কীভাবে?
এমনি ঠিক হয়ে যাবে বাবা। তোমার ভেতরে একটা ক্ষমতা হয়েছে যেটা অন্য লোকের নাই। কেন হলো আমি জানি না। আশ্চর্য মানুষের মন, কীভাবে কাজ করে কেউ জানে না। হয়তো ওইসব লোক তোমার মাথায় কিছু করেছে, হয়তো তোমার মাথায় অপারেশন করার সময় কিছু হয়েছে, কে জানে এমনিতেই হয়তো হয়েছে। তোমার এটা ভালো লাগে না, তুমি ভয় পাও সেটাই হয়েছে তোমার জন্যে মুশকিল। তুমি ভয় পেয়ো না, তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমার মন তোমার কথায় ওঠে-বসে, যা তোমার ভালো লাগে না তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না।
কিন্তু…
হ্যাঁ বাবা। তুমি অশিক্ষিত লোক হলে তোমাকে একটা তাবিজ দিয়ে বলতাম, এটা গলায় ঝুলিয়ে রাখো তোমার আর অসুবিধা হবে না। তুমি সেটা বিশ্বাস করে ভাবতে তোমার কিছু হবে না, তখন সত্যিই তোমার কিছু হতো না। কিন্তু তুমি যে মূর্খ লোক নও, তোমাকে ঠকাই কেমন করে বলো?
একটু অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলল রুমী, এত সহজ ব্যাপারটা?
হ্যাঁ বাবা। এত সহজ। যদি তুমি চাও। আর যদি না চাও অনেক কঠিন। তুমি যদি মনে করো, বিশ্বাস করো তোমার আর কোনোদিন এরকম হবে না তাহলে সত্যিই কোনোদিন হবে না। তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে। তোমার মন তোমার কথায় ওঠে বসে, সেটা তোমার বিশ্বাস করতে হবে। নিজের ওপরে বিশ্বাস। পারবে?
উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে রুমী। লোকটা আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলে, এর মানে পারবে না! বিশ্বাস নেই নিজের ওপর।
না, বিশ্বাস থাকবে না কেন। কিন্তু…
ওই কিন্তুটাই হচ্ছে বিশ্বাসের অভাব। তুমি জানো না বাবা, মানুষের ভেতরে কি শক্তি আছে। পৃথিবীতে কিছু নেই যা মানুষের সাথে পারে, মানুষ জানে না বলে ভয় পায়। যখন ভয় পায় তখন সেই শক্তি চলে যায়। তুমি তোমার ক্ষমতাটা পছন্দ করো না, যদি করতে তাহলে কি বলতাম জানো?
কি?
বলতাম ওইসব লোকের ওপর তুমি জোর খাটাও, ওদের সব শক্তি কেড়ে নাও, ওদের জন্মের মতো শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দাও। কিন্তু তুমি তোমার ক্ষমতাটা পছন্দ করো না, তোমার কাছে খারাপ মনে হয়। তাই তোমাকে আমি কখনো বলব না সেটা করতে। কিন্তু তুমি নিজেকে কষ্ট দিও না। যেটা পছন্দ করো না সেটা কেন ঘটতে দাও? এটা তো অসুখের বীজাণু নয় যে রক্তের মাঝে আছে। এটা তোমার নিজের মন, ধমক দিয়ে থামিয়ে দাও। যদি না পারো নিজেকে ব্যস্ত রাখো, বন্ধুর সাথে গল্প করো, কিছু তৈরি করো, কিছু ভেঙে ফেলো, রাজনীতি করো, তর্ক করো, ঝগড়া করো, মারামারি করো, কিছু একটা করো। বসে থেকে তোমার মাঝে ওটা ঘটতে দিও না।
লোকটা একটু উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল বলে অপ্রস্তুত হয়ে গেল। গলা নামিয়ে বলল, বাবা, কিছু মনে করো নি তো?
না, না, মনে করব কি? আপনি তো ঠিকই বলেছেন, আমি আসলেই কিছু করি না। একা একা থাকি, আমার ভালো কোনো বন্ধু নেই। সব সময়ই ভয় ভয় করে, মনে হয় এই বুঝি আবার কিছু হলো।
হ্যাঁ বাবা। নিজের কাছে নিজে হেরে যেও না। এখন নিজের ওপর বিশ্বাস নেই তাতে ক্ষতি কি? আস্তে আস্তে হবে। যখন নিজেকে বুঝতে পারবে তখন খুব তাড়াতাড়ি বিশ্বাস ফিরে আসবে। আজ রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোবে বলছিলে না?
হ্যাঁ। ভুলেই গিয়েছিল রুমী। আবার সব একসাথে মনে পড়ে যায়। সাথে সাথে চাপা অস্বস্তি, ভয় সব একসাথে ফিরে আসে। রুমীর মুখে তার স্পষ্ট ছাপ পড়ে।
এই যে, এই যে, বাবা, তুমি আবার ভয় পাচ্ছ। লোকটা হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। খানিকক্ষণ কি যেন ভেবে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, আজ রাতে যদি তোমার কিছু না হয় তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে?
আপনার কথা আমি কখনো অবিশ্বাস করি নি।
আমি বলছিলাম তোমার কথা, নিজের ওপর বিশ্বাসের কথা। করবে?
করব।
তার জন্যে তুমি কতটুকু কষ্ট করতে পারবে, বাবা?
যতটুকু দরকার।
পুরো রাত?
হ্যাঁ।
ঠিক আছে। লোকটা শার্টের পকেট থেকে একটা ওষুধের শিশি বের করে বলে, এটা খুব একটা দরকারি ওষুধ, বাজারে পাওয়া যায় না। টাঙ্গাইলে একজনের এটা খুব দরকার। আজ রাতের মধ্যে এটা যদি তাকে খাওয়ানো যায় তাহলে সে বেঁচে যেতে পারে। আমি এটা নিয়ে টাঙ্গাইল যাচ্ছিলাম। এখন আমি আর যাব না। তুমি এটা পৌঁছে দিয়ে এসো বাবা।
শুনে একটু হকচকিয়ে যায় রুমী, সে এ ধরনের কিছু আশা করে নি। লোকটার সদিচ্ছায় ওর কোনো সন্দেহ নেই, যদি সত্যি ওষুধটা টাঙ্গাইলে পৌঁছে দিয়ে এলে সে ভালো হয়ে যায়, তাহলে কেন যাবে না? কিন্তু ওর ভয় ভয় করতে থাকে, এখন ওর ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে থাকার কথা।
লোকটা পকেট থেকে কটা দুমড়ানো-মোচড়ানো নোট বের করে ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ভাড়াটা..
সে কি, আপনি ভাড়া দেবেন কেন, আমি দিয়ে দেব।
না বাবা, কাজটা আমার। তাছাড়া আমি চাই তুমি এখান থেকে সোজা রওনা দিয়ে দাও।
কেন? হল থেকে কয়টা দরকারি জিনিস ব্যাগে…
না বাবা, তুমি সোজা এখান থেকে যাবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওষুধটা পৌঁছানো দরকার; কিন্তু আমি সেজন্যে বলছি না, আমি তোমার নিজের জন্যেই বলছি। নাও বাবা, টাকাগুলি ধরো।
রুমী একটু ইতস্তত করে বলে, আমার পকেটে কিছু টাকা আছে, টিউশনি বাবদ গত মাসের টাকাটা সে আজকেই পেয়েছে। যাওয়া-আসার ভাড়া উঠে যাবে।
তবু এটা রাখো বাবা। ভাড়া যদি নিজে দিতে চাও, দিও। এই টাকাটা তাহলে ওই লোকটাকে দিয়ে দিও। লোকটা পকেট হাতড়ে একটা চিরকুটের মতো কাগজ বের করে ওর হাতে দেয়, ওপরে লেখা কোথায় যেতে হবে।
ঠিক আছে বাবা, তুমি তাহলে যাও। মনে রেখো, আজ রাতে এ ওষুধটা খেলে লোকটা হয়তো বেঁচে যাবে। আল্লাহ্ যদি চান তাহলে তার জীবনটা এখন তোমার হাতে। লোকটা তার শক্ত হাতে রুমীর হাত স্পর্শ করে বিদায় নেয়, আল্লাহ্ তোমার ভালো করবেন, তুমি এখন যাও বাবা। রুমীর উৎসুক চোখের দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে অনুনয়ের স্বরে বলে, বাবা তুমি আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করো না, মিথ্যে বলতে আমার খুব কষ্ট হয়…
রুমী আর কিছু জিজ্ঞেস করে না। কি আশ্চর্য লোক! ও তাকিয়ে তাকিয়ে লোকটাকে চলে যেতে দেখে। দ্রুত হেঁটে রাস্তার লোকজনের মাঝে মিশে গেল লোকটা, কে জানে আর কখনো দেখা হবে কি না।
সে রাতের অভিজ্ঞতার কোনো তুলনা নেই। রুমী রাতের অন্ধকারে বাসের পেছনে বসে আছে। প্রচণ্ড ঝড় বাইরে, আকাশ চিরে বিজলি নেমে আসছে পৃথিবীর বুকে। বাস যাচ্ছে আহত জন্তুর মতো শব্দ করতে করতে। মাঝে মাঝে চাপা দুঃস্বপ্নের মতো কি একটা ওর ওপর ভর করতে চায়, কিন্তু সে প্রাণপণে তার সাথে যুদ্ধ করে, ওর ওপর এখন একজন অসুস্থ মানুষের জীবন-মরণ নির্ভর করছে, এখন সে অন্য কিছুকে প্রশ্রয় দিতে পারে না। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে ও, মন থেকে সব চিন্তা দূরে সরিয়ে দেয়, তারপর বাইরে ঝড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
প্রথম একবার দুবার ওর মনে হতে থাকে সে বুঝি পারবে না, প্রায় হাল ছেড়ে দিতে গিয়ে অনুভব করে, ভেতরে কে যেন ক্রমাগত বলতে থাকে-না, না, না কিছুতেই না, কিছু-তে-ই-না! আর সত্যি সত্যি কিছুক্ষণ পর ও বিস্মৃতির অন্ধকার থেকে আবার বের হয়ে আসে। আস্তে আস্তে ও সাহস ফিরে পায়। বুঝতে পারে সত্যি সত্যি সে যদি চায়, তাহলে আর চেতনা হারিয়ে অন্ধকার জগতের দাসত্ব করতে হবে না। ওই অনুভূতিটা কি আনন্দের, কি পরিতৃপ্তির, ওর বহুকাল এরকম অনুভূতি হয় নি।
মাঝরাতে বাস যখন টাঙ্গাইল পৌঁছেছে তখন বাসের সবাই আধো ঘুমে, সে নিজেও খুব ক্লান্ত, কিন্তু ওর চোখে ঘুমের রেশ নেই, মনে ফুরফুরে একটা আনন্দ। বাসস্টেশনের কাছে একটা রেস্টুরেন্টে গরম এক কাপ চা খেয়ে সে চাঙ্গা হয়ে নিল। রেস্টুরেন্টের লোকজনকে ঠিকানাটা দেখিয়ে সে জায়গাটা কোথায় সে-সম্পর্কে একটা ধারণা করে নেয়। ভাগ্য ভালো থাকলে এত রাতে রিকশা পেতেও পারে, কিন্তু পুরো রাস্তা রিকশা করে যাওয়া সম্ভব না, অন্তত মাইলখানেক ওকে হাঁটতে হবে। সে নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নেই রুমীর, হালকা মনে শিস দিতে দিতে বের হয়ে পড়ে।
বাসাটা সে বেশ তাড়াতাড়িই খুঁজে বের করে ফেলে। জীর্ণ-শীর্ণ চেহারা, বাঁশের ঘরের ওপর নড়বড়ে টিনের ছাদ। ভেতরে কোথায় জানি একটা মিটমিটে বাতি জ্বলছে। রুমী দরজায় কড়া নাড়ে, বেশ অনেকক্ষণ পর জানালা খুলে একজন মেয়ে ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করে, কে?
আমি, ঢাকা থেকে ওষুধ নিয়ে এসেছি।
ওষুধ। মেয়েটা আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, ওষুধ এনেছে মা, ওষুধ!
দরজা খুলে হারিকেন হাতে একজন মহিলা পাগলের মতো বের হয়ে এলেন। রুমীর হাত জড়িয়ে ধরে সাগ্রহে ওষুধটা হাতে নিলেন। উদ্ভান্তের মতো চেহারা, ঝড়ে দিকভ্রষ্ট নাবিকের চেহারাও বুঝি এত ব্যাকুল নয়। রুমীকে বাইরের ঘরে বসিয়ে রেখে তারা ভেতরে চলে গেল। ভেতর থেকে অস্ফুট কথাবার্তা শোনা যেতে থাকে, চামচের টুংটাং শব্দ, একটু চাপা কান্না, দীর্ঘশ্বাস। রুমী চুপচাপ বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভেতরে একজন মানুষ মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করছে, ও কখনো দেখে নি মানুষটাকে, কিছু জানে না তার সম্পর্কে, কিন্তু তবু কি আশ্চর্য, বাইরের ঘরে বসে অপেক্ষা করছে সে, মনপ্রাণে কামনা করছে লোকটা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসুক।
দুদিন পর ফিরে এলো রুমী। অসুস্থ লোকটা উঠে পথ্য করার পর। দুদিনের পরিশ্রমেই সে বেশ শুকিয়ে গেছে, পরিবর্তনটা সবাই লক্ষ করে। ও এখন অনেক হাসি-খুশি, অনেক চঞ্চল। একেবারে অন্য মানুষ হয়ে ফিরে এসেছে সে। ও জানে, ও ভালো হয়ে গেছে।
সাদাসিধে সেই লোকটাকে রুমী অনেক খুঁজেছে, আর পায় নি। নিজের অজান্তে লোকজনের ভিড়ে সেই মুখটা খুঁজতে থাকে, বড় ইচ্ছা করে আরেকবার কথা বলতে, অন্তত কৃতজ্ঞতাটুকু জানাতে। কিন্তু তাকে আর কখনো দেখে নি সে।