Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » প্রত্যানীত || Buddhadeb Guha » Page 2

প্রত্যানীত || Buddhadeb Guha

০৩.

ঘুম ভাঙল হাঁসা-হাঁসীর প্যাঁকপ্যাঁকানিতে। কানের কাছে যেন তাদের নিশ্বাসও শুনতে পেল চখা। কত যুগ পরে।

মনে পড়ে গেল, সে নিজে যখন শিশু ছিল এবং রংপুরের পাঠশালাতে পড়ত, সেই সব দিনে ঘরের টিনের দেওয়ালের ফুটো-ফাটা দিয়ে সকালের আলোর রেশ আসামাত্রই চখা ঘরের দরজা খুলে দৌড়ে গিয়ে হাঁসেদের ঘরের দরজা খুলে দিত। তারপর চোখ মুখ না ধুয়েই হাঁসেদের পেছন পেছন হরিসভার পুকুর অবধি দৌড়ে যেত।

হাঁসেদের মতন সমস্ত শরীরে আন্দোলন তুলে কোনো পাখি বা প্রাণীই চলে না। তাদের দুই পা, পেট, পিঠ, বুক, গলা, ঠোঁট সবই যেন ওদের হেলতে-দুলতে দৌড়ে যাওয়াতে পুরোপুরি শামিল হয়ে যায়।

হরিসভার পুকুরপাড়ে পৌঁছে ওরা যখন এক এক করে উড়ে গিয়ে পুকুরের মধ্যে ঝপাং ঝপাং করে পড়ত চারদিকে জল-উপছিয়ে দিয়ে, তখন ভারি মজা পেত চখা। জলের গন্ধ, পুকুরের চারপাশ থেকে ঝুঁকে পড়ে পুকুরে মুখ-দেখা নানান গাছগাছালির গায়ের প্রভাতি গন্ধ, শিশিরের গন্ধ, শামুক আর টাকাকেন্নোর গায়ের গন্ধ, ঘাসফুলের গন্ধ, হাঁসেদের গায়ের আঁশটে গন্ধর সঙ্গে মাখামাখি হয়ে যেত তখন। মুগ্ধ চোখে, মুগ্ধ কানে এবং মুগ্ধ নাকে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকত চখা হাঁসেদের দিকে চেয়ে।

হাঁসেরা মাটির ওপরে দৌড়ে যাওয়ার সময়ে তাদের দৌড়ের রকম এক আর তারা যখন জলে চলে তখন একেবারেই অন্য। হিরে যেমন করে কাঁচ কাটে, হাঁসও তেমন করে জলের নিস্তরঙ্গ কাঁচ কেটে দু-টুকরো করে। তাদের দু-পাশে দুটি ঢেউ উঠে ক্রমশই ছড়িয়ে যেতে থাকে পেছনে আর তারা নিষ্কম্প শরীরে গ্রীবা তুলে যেন মন্ত্রবলে অবহেলে এগিয়ে যায় জলের মধ্যে। তাদের শরীর দেখে বোঝা পর্যন্ত যায় না যে, তাদের পা দুটি জলের নীচে আন্দোলিত হচ্ছে। তাদের সাঁতার কেটে এগিয়ে যাওয়া দেখে ছেলেবেলা থেকে অবলীলায় শব্দটির মানে প্রাঞ্জল হয়েছে চখার কাছে।

পিসিমা ঘরে এলেন।

বললেন, এলি কখন কাল? আমি তো ঘুমিয়েই পড়েছিলাম।

ভালোই করেছিলেন। এগারোটাতে।

রাতে খেলি কী?

কিছুই খাইনি। ঝন্টু আর কসমিক এবং ঝন্টুর শালা শক্তি আর শালাজ দেবীও অনেক সাধাসাধি করেছিল। কিন্তু অত রাতে কিছু খেতে ইচ্ছে করেনি।

পিসিমাকে আর বলল না যে, কোচবিহার শহরে একবার থেমেছিল পথে পাঁচ মিনিটের জন্যে। চখার প্রথম যৌবনের প্রিয়পাত্রী শেলি যে শহরে থাকে। যাকে সে শেষবার দেখেছিল অনেকই বছর আগে এবং যাকে এ-জীবনে আর কখনো দেখতে চায় না। দেখতে এইজন্যেই চায় না যে, মনের চোখে এবং মস্তিষ্কের মধ্যে গন্ধরাজ আর রঙ্গনের ঝাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বারো বছরের ছিপছিপে, কালো, লজ্জারাঙা শেলির স্থিরচিত্রটি অস্থির হয়ে যাবে যে শুধু তাই নয়, ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। টুকরো হয়ে গেলে আজকের কোনো অ্যারলড়াইট দিয়েই সেই ছবিকে যে আর জোড়া দেওয়া যাবে না। তাই।

অনেক কষ্ট থাকে, যা গভীর আনন্দর উৎস হয়ে আজীবন কোনো মানুষের বুকের মধ্যে ম্যাগনোলিয়া গ্রাণ্ডিফ্লোরার ঝাড় হয়ে ফুটে থাকে।

না। কোচবিহার শহরে থেমেছিল কিছু খাবার জন্যে নয়। দীর্ঘ যাত্রার শারীরিক ক্লান্তি, অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষাজনিত অবসাদ এবং তামাহাটে অনেকই বছর পরে প্রত্যাগমনের উত্তেজনাতে অস্থির হয়ে একটি রয়্যাল-চ্যালেঞ্জের বোতল কিনে মিনারাল ওয়াটারের বোতলে মিশিয়ে খেতে খেতে এসেছিল পথে, নিজেকে উজ্জীবিত করার জন্যে। সঙ্গীদেরও দিয়েছিল। স্বার্থপর নয় সে। তা ছাড়া একযাত্রায় পৃথক ফলে বিশ্বাসও করেনি কোনোদিন।

রাতে বেশ ঠাণ্ডা ছিল। লেপ গায়ে শুয়ে একটু আলসেমি করল।

শুনতে পেল, পাকঘরের বারান্দাতে কলকণ্ঠের কনফারেন্স বসেছে, কী দিয়ে এবং কেমন করে চখার এত বছর পরে তামাহাটে আসাটাকে খাওয়ার মাধ্যমে স্মরণীয় করে রাখা যায়?

পিসিমা বললেন, ফেনাভাত খাবি তো?

চখার মনে পড়ে গেল রংপুরে তো ব্রেকফাস্ট বলতে ফেনাভাতই বোঝাত। নিজেদের খেতের চালের সুগন্ধি ভাত। নানা তরকারি সেদ্ধ দিয়ে আর হাঁসের ডিম সেদ্ধ। কলককাতাতে চাইলেও ফেনাভাত এখন পায় কোথায়? কলকাতা তো এখন অ্যামেরিকা হয়ে গেছে। ব্রেকফাস্ট মানেই সিরিয়ালস আর ফ্যাট-ফ্রি স্কিমড-মিল্ক। সেই সিরিয়ালস-এর মধ্যে আবার মুড়ি-চিড়ে পড়ে না। দুর্মূল্য প্যাক-এ বিদেশি কোলাবরেশানে তৈরি হওয়া নামি-দামি কোম্পানির সিরিয়ালস। গরম দুধে খই কি মুড়ি বা চিড়ে-কলা দিয়ে মেখে খাওয়ার গভীর দিশি আনন্দ থেকে অধুনা কলকাতার ইংরেজ-তাড়ানোর পরে সাহেব-হওয়া বাঙালিরা পুরোপুরিই বঞ্চিত হয়েছে।

চখা বলল, তাই খাব। ফেনাভাত।

তারপর চান করে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিল। বাথরুমে বালতি করে গরম জল দিয়েছিল ঝন্টুর ভার্সেটাইল বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন ড্রাইভার পান্ডে।

চখা তামাহাটে আসবে আসবে বলে ভয় দেখাচ্ছিল বহুবছর হল, তাই ঝন্টুর বছর পাঁচেক আগেই একটি বাথরুমে কমোড় লাগিয়েছিল। যদিও কোনো প্রয়োজন ছিল না তার।

অনেক সাহেব-সুবোধ সঙ্গে অদ্যাবধি মিশেও চখা এখনও আদৌ সাহেব হয়ে উঠতে পারেনি। কলকাতার প্রচুর পাতি-বাঙালিদের সাহেব হয়ে ওঠার চেষ্টাতে নিরন্তর প্রাণপণ দাঁত-কড়মড় প্রতিযোগিতাতে লিপ্ত দেখে নিজে সাহেব হওয়ার বিল্টুমাত্র বাসনাই আর পোষণ করে না ও। কারণ ও জানে, পাতিহাঁসেরা পতিহাঁসই থাকে। কখনোই রাজহাঁস হয়ে ওঠে না তারা।

সকলে রোদে পাশাপাশি বসে বাড়ির গোরুর গাওয়া-ঘি দিয়ে পালংশাক, শিম ও আলুসেদ্ধ দেওয়া ফেনাভাত, গোটা চারেক হাঁসের ডিম সেদ্ধ দিয়ে জম্পেস করে সকালের খাওয়া সারার পরে ঝন্টু বলল, চলো চখাদা, কোথায় যাবে? বিকেলে তো আবার ধুবড়ি থেকে বর নিতে আসবেন ওঁরা। সাতটার সময়ে।

ওঁরা মানে?

সবুজের আসর-এর উদ্যোক্তারা–যাঁরা প্রথম বইমেলা করছেন। তুমি তো তাঁদেরই নিমন্ত্রণে আর খরচে এসেছ। নাকি?

আর কাকে কাকে বলেছেন ওঁরা? মানে, কবি-সাহিত্যিক?

চখা জিজ্ঞেস করল।

ঝন্টু বলল, শুনেছিলাম অমিয়ভূষণ মজুমদারকে বলেছিলেন। তবে তিনি নাকি শারীরিক কারণে আসতে পারছেন না। নিমাই ভট্টাচার্যকেও নাকি বলেছেন।

তুই জানলি কী করে?

ধুবড়ির ছাতিয়ানতলার বাড়িতে ফোন করেছিলাম। আমার জ্যাঠতুতো ভাই রাজার স্ত্রী। রুবি বলল।

করে কী রাজা?

স্টেট ব্যাঙ্কে কাজ করে।

বাবা:। রাজারও বউ। কত ছোটো ছিল।

তা কী হবে! রাজারই যদি রানি না থাকে তো, থাকবে কার?

ঝন্টু বলল।

তা ঠিক।

চখা বলল।

চখা তারপরে বলল, এইরকম স্ট্র্যাটেজিক ভুল কেউ করে! ধুবড়ির সবুজের আসর-এর কর্তাদের যদি বুদ্ধি থাকত তবে আমার আর নিমাইদার মতন ফালতু লেখককে ওঁরা নেমন্তন্ন করতেন না।

ফালতু বলছ কেন?

বড়ো কাগজে যাঁরা চাকরি না করেন বা যাঁরা তাঁদের পেটোয়া নন, সেই সব লেখক, গায়ক, শিল্পী, খেলোয়োড় সকলেই তো ফালতু।

তাই কি হয় নাকি?

এমন সময়ে দাতু, চানু আর চোগা এসে হাজির। দাতু বলল, মায়ে পঠাইয়া দিল। আমাগো বাসায় চলো আগে।

চল। নিশ্চয়ই যাব।

চখা বলল।

দাতু, বৈদ্যকাকুর ছেলে। বৈদ্য দত্ত। মাতৃপিতৃহীন স্বল্পবিত্ত সদাহাস্যময় পুরুষ ছিলেন। পরোপকারী। দাবিদাওয়াহীন। শত অপমানেও নিরুত্তর। এক আশ্চর্য চরিত্র ছিলেন তিনি। কুচকুচে কালো গায়ের রং। বড়ো বড়ো লাল চোখ। অথচ নেশা-ভাং করতেন না। কাটা-কাটা চোখ-মুখ।

সেই চখা-প্রিয় বৈদ্যকাকুর সঙ্গেই বিয়ে হল রংপুরের রাঙাপিসির বা অনু বোস-এর। দেশভাগের বছরই। রংপুরে হল বিয়ে। আর বিয়ের পরদিনই রংপুর থেকে তামাহাটে এসে বর-কনের ফুলশয্যা হল। গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে দিয়েছিল ছবিদিরা ফুল-লতাপাতা-তোলা রেশমি বেডশিটের ওপরে। পরিষ্কার মনে আছে চখার। রাঙাপিসির মতন সরল ভালোমানুষ প্যাঁচঘোঁচহীন গ্রাম্য মেয়েও তখনকার দিনে কমই ছিল।

আজ বৈদ্যকাকু নেই। অনেকেই নেই, যাঁরা তখন ছিলেন। মনে মনে নিজেকে অভিসম্পাত দিচ্ছিল চখা এত বছর পরে তামাহাটে আসাতে। কোনো জায়গাতেই এত বছর পরে আর কখনোই ফিরে যেতে নেই বোধ হয়।

একবার ওর মনে হল, এসে আদৌ ভালো করেনি এখানে এবং মনে হল ধুবড়িতে গিয়েও বোধ হয় ঠিক এমনই মনে হবে।

পায়ে হেঁটেই গেল দাতুর সঙ্গে বৈদ্যকাকুর বাড়িতে।

রাঙাপিসির চুল পেকে গেছে, দাঁত পড়ে গেছে। যে জমিতে একটি মাত্র ঘর ছিল আর একটু দূরে রান্নাঘর, সেখানে অনেকই ঘর হয়েছে। মাঝে উঠোন। পাশেই হাস্কিং মেশিন চলছে। তার পুপ পুপ পুপ পুপ শব্দ উঠছে গভীর রাতের খাপু পাখির ডাকের মতন অবিরাম। দাতুর বড়োদিদি বুড়ুর বিয়ে হয়েছিল ধুবড়িতে। তার সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল চখার কলকাতাতেই, ঢাকুরিয়ার বিপিসির ছেলের বিয়েতে।

তোর বর কোথায়?

একথা সেই বিয়ের রাতে বুড়কে জিজ্ঞেস করাতে বুড়, দার্শনিকের মতন বলেছিল, ওমা! তুমি শোনো নাই নাকি। সে ত কবেই পটল তুলছে।

বাক্যটি মনে গেঁথেছিল। কুড়ির কোঠার কোনো মেয়ের স্বামীবিয়োগ যে সে এমন ফিলসফিকালি নিতে পারে, তা জেনে বুড়র প্রতি এক ধরনের শ্রদ্ধা জন্মে গেছিল চখার।

চখা ভাবছিল যে, প্রত্যেক মানুষের জন্মের মুহূর্তের মধ্যেই তার মৃত্যুও অবিসংবাদী হয়ে নিহিত থাকে। আমরা শুধু জানি না সেই মুহূর্ত কখন আসবে। অথচ সেই বিদায়ক্ষণ নিয়ে চখার মতন সাধারণ মানুষদের কম নাটুকেপনা নেই। সেই ক্ষণকে বিলম্বিত করার লজ্জাকর চেষ্টারও কোনো বিরাম নেই। চখার মতন মানুষের এবং অতিসাধারণ সব পশু-পাখি কীট পতঙ্গরই মতন বেশিদিন বাঁচার ইচ্ছার এই লজ্জাকর মানসিকতা ওকে সত্যিই পীড়িত করে। জন্মেরই মতন সহজে মৃত্যুকে নিতে যে পারে না কেন মানুষে, সেকথা ভেবে আশ্চর্য হয় ও।

দাতুর বউ কলকাতার মেয়ে। এখানে এই গন্ডগ্রামে থাকতে চায় না। দাতু, হাতে চামড়ার একটা ছোট্ট ব্যাগ নিয়ে ঘুরে ঠিকাদারি করে এখানে-ওখানে। দাতুর পরের ভাই, তার নাম ভুলে গেছে চখা, কুড়ির কোঠাতে থাকতেই বেশি পরিমাণে দিশি মদ খেয়ে সুন্দরী বউকে বিধবা করে পরপারে চলে গেছে।

বউটিকে ভালো লাগল চখার।

রাঙাপিসি বললেন, আরে, মাইনষে খায়, খায়, একটু মাইপ্যা-জুইপ্যা খা। তা নয়। বউটারে ভাসাইয়া থুইয়া গেল।

বউ ডানাকাটা পরি নয় কিন্তু এক বিষাদমলিন সৌন্দর্য আছে তার। তা ছাড়া, যৌবনে সব মানুষই সুন্দর। যৌবন চলে গেলে, এই দুঃখময় সত্যকে হৃদয়ংগম করে দুঃখ পেতে হয়।

চোখ দিয়ে কথা বলে সে মেয়ে। মুখে নীরব।

উঠোনের মস্ত কাঁঠালি চাঁপা গাছের নীচে তার হলুদ-কালো ডুরে শাড়ি-পরা চেহারাটি অনেকদিন চখার মনের চোখে ধরা থাকবে। সেই বউটি প্রাইমারি স্কুলে পড়ায়। তার একটিই ছেলে। ভালো শিক্ষা দিয়েছে মনে হল ছেলেটিকে। সভ্য-ভব্য। বিধবা মায়ের ভবিষ্যৎ।

কিন্তু এই বয়েসের সুন্দরী বিধবা যে কেন আবারও বিয়ে করে, যে-জীবন তার কোনোরকম দোষ ব্যতিরেকেই উৎপাটিত হয়েছে, তাকে নতুন করে অন্য কোনো মাটিতে রোপণ করে নতুন করে বাঁচবে না তা চখা বুঝতে পারে না। অবশ্যই সেই ইচ্ছা যদি তার থাকে।

এদেশে আজও অনেকই বিদ্যসাগরের প্রয়োজন আছে।

মনে হল চখার।

আরও এক ছেলে আছে রাঙাপিসির। সেও ঠিকাদারি করে। তারই হাস্কিং-মেশিন। তাকে দেখে মনে হয় ম্যাটার অফ-ফ্যাক্ট। এ যুগের উপযুক্ত। তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হল না। হয়তো বাড়িতে ছিল না।

প্রত্যেক মানুষের জীবনেই তার চরিত্রে পরিণতি আসার পরে রক্তের আত্মীয়তার থেকে আত্মার আত্মীয়তাই বড়ো হয়ে ওঠে। এর চেয়ে বড়ো সত্য আর নেই। যার মানসিক উন্নতির উচ্চতা যত বেশি, সেই অনুপাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত এবং সমমনস্ক মানুষেরা ছাড়া তার অন্যান্য রক্তের আত্মীয়রা যতই দিন যায়, ততই দূরে সরে যেতে থাকে। এর চেয়ে বড়ো দুঃখময় সত্য মানুষের জীবনে হয়তো সত্যিই বেশি নেই। যারা তথাকথিত পর তারাই দেখা যায় ধীরে ধীরে আপন হয়ে ওঠে আর আপনেরাই পর।

ঝন্টু বলল, এবারে যাবে নাকি বরবাধায়?

বরবাধার জঙ্গলে?

হ্যাঁ।

চল।

কিন্তু যাওয়ার আগে স্কুলে একটু ঘুরে যেতে হবে।

স্কুলে?

হ্যাঁ।

কেন?

তারপর সেই প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা না করেই চখা বলল, বাচ্ছদের আর চানুদের বাড়ি একবার গেলে হত না?

বাছুরা তো ধুবড়িতেই থাকে।

ওর বউ? পাগু? সেই যে গান গাইত না একটা? যেন কার অভিশাপ লেগেছে মোর জীবনে।

গানটার কথা আজও মনে আছে তোমার?

চখা বলল, আছে রে আছে। কিছু গান, কিছু কথা, মনের জমি যখন নরম থাকে তখন তাতে চেপে বসে যায়। সারাজীবন বসে থাকে।

ঝন্টু বলল, ওরা সকলেই ধুবড়িতেই থাকে। ওদের মেয়ে টুলটুলও থাকে। মেয়েটা সুন্দরী হয়েছে। সাজেও সুন্দর। টুলটুল খুব ভালো নাচে। সুন্দর ফিগার। ওদের এক কন্যা। জামাইও নানারকম বাজনা বাজায়। অর্কেস্ট্রা কনডাক্ট করে। ভালো ছেলে-স্বাস্থ্যবানও। দুজনের মধ্যে খুব ভাব-ভালোবাসা। দারুণ হ্যাপিলি ম্যারেড ওরা।

বাবা:! তুই তো অনেক বুঝিস আজকাল!

চখা বলল।

ঝন্টু বলল, বুঝি ঠিক না। তবে দাম্পত্যর রকম কি আর বাইরে থেকে বোঝা যায়, বলো? একের চোখে অন্যের দাম্পত্য হচ্ছে চিড়িয়াখানার খাঁচার মধ্যে শুয়ে-থাকা বাঘ। খাঁচার বাইরে বেরুলে তার কী রূপ সে শুধু তার Spouse-ই জানে একমাত্র।

ঝন্টু আরও বলল, দেখা হবে ওদের সকলেরই সঙ্গে ধুবড়ি গেলে। আর চানুর বউ মিঠু তো আসবেই দুপুরবেলাতে তোমার সঙ্গে দেখা করতে। আরও কত জন আসবে। দেখো, ভেঙে পড়বে তামাহাট।

তাই? তবে তো চিন্তার কথা হল।

কেন?

আমি যে ইতিমধ্যেই আধভাঙা হয়ে গেছি। বাগডোগরা থেকে আসার পথেই আমার মেরুদন্ড গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে। পরীক্ষা করালে কী যে বলবেন ডাক্তারেরা কে বলতে পারে।

ঝন্টু বলল, কলকাতার ডাক্তারদের কথা ছাড়ো। তাদের অধিকাংশরই উচিত ছিল নরকঙ্কালের ব্যাবসা করে বড়োলোক হওয়া। অধিকাংশই টাকা ছাড়া কিছুই বোঝে না। আমার পতুমামাকে কী করে মারল তারা।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, নকশালদের আসার সময় হয়েছে আবার। ওঁরা শক্তের ভক্ত, নরমের যম। গুলি করে মারা দরকার ওঁদের অনেককেই। এমনই বিবেকহীন অর্থগৃধহয়ে গেছেন অধিকাংশ ডাক্তারই।

কথাটা মিথ্যে বলিসনি। তবে ব্যতিক্রম এখনও আছে। ভাগ্যিস।

সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। এবারে চলো চখাদা। দুপুরে খেয়ে একটু জিরোবে তো? রাতে তো ঘুম হয়নি নতুন জায়গাতে।

তা ঘুমোব। তবে জায়গা তো নতুন নয়। কিন্তু বহু পরিচিত জায়গাতেও বহুদিন পরে এলে তা নতুন মনে হয় বই কী। দূর দেশে থাকার পর ফিরে এসে নিজের বউকে নতুন বলে মনে হয়। আর তামাহাটকে তো নতুন মনে হবেই।

তারপরে চখা বলল, নদীর ধারেও একবার নিয়ে যাবি না? কাল আসবার সময়ে গঙ্গাধর নদীর কথাই ভাবতে ভাবতে আসছিলাম চোখ বুজে। সব কি খুব বদলে গেছে? আগের মতন কি কিছুই নেই?

চলো যাই। নিজের চোখেই দেখবে।

বাড়িতে ছোটো শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করার পর থেকে ঝন্টু প্রতিবছরই শিবরাত্রির সময়ে নাকি আসে তামাহাটে। সে ধানবাদেই থাকুক, কি ঘেটো-টাঁড়ে, কি কলকাতার বরানগরে! পিসিমা থাকাকালীন অবশ্যই আসবে। পরের কথা শুধু ভবিষ্যই জানে। তামাহাটের এই বাড়ি, জমিজমা আদৌ থাকবে, না বিক্রি হয়ে যাবে, তাই বা কে জানে! শহরে যে একবার সেঁধিয়েছে সে আর গ্রামে ফিরতেই চায় না। অথচ কেন যে, তা ভেবেই পায় না চখা।

নদীর পারে যেতে নৃপেন্দ্রমোহন মিত্র প্রাইমারি স্কুল এবং তিনকড়ি মিত্র হায়ার সেকেণ্ডারি স্কুলও পড়বে। স্কুলের মাস্টারমশাই ইদের ছুটি থাকা সত্ত্বেও তুমি এসেছ শুনে স্কুলে অপেক্ষা করছেন তোমাদেরই জন্যে স্কুল খুলে।

ঝন্টু বলল।

তাই?

হ্যাঁ।

দুটি স্কুলেই গেল ওরা। গাড়িতেই গেল। চখার পিসিমা প্রায় পঞ্চাশ বিঘা জমি দান করেছেন এই দুই স্কুলের জন্যে। খেলার মাঠও। তবে গঙ্গাধর প্রতিবছরই খেলার মাঠকে খাবলে খাবলে খেয়ে যাচ্ছে অনেকখানি করে। নদী যদি গতি না বদলায় তবে বছর পঁচিশের মধ্যে সেকেণ্ডারি স্কুলটি নদীর গর্ভে চলে যাবে।

হেডমাস্টারমশাই-এর ঘরে বসে নদী দেখতে পাচ্ছিল চখা। তবে নদীকে চেনা যায় না। এদিকেই চর ফেলেছে। বিস্তীর্ণ। এতদিন পরে এলে কোনো নদী বা নারীকে চিনতে না পারাটাই যে স্বাভাবিক সেকথা অবশ্য বোঝে চখা। অনেকই দিন পর কোনো প্রিয় নদী অথবা নারীর কাছে যদি না এসে পারা যায়, তবে না আসাই ভালো। দুজনের পক্ষেই ভালো। সময়, সময়ে সময়ে আনন্দ যেমন দেয়, সময়ে সময়ে দুঃখও কম দেয় না।

রতুজ্যেঠুর ছোটো ছেলের স্ত্রী সেকেণ্ডারি স্কুলের শিক্ষিকা। সে আবার কবিও। কবি অবশ্য আজ হয়নি। যখন ক্লাস নাইনে পড়ে, তখনই ১৯৭৫-এর তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। নাম নীলিমা। আগে সাহা ছিল, এখন বিশ্বাস হয়েছে। তারপরে প্রেম করে বিয়ে। এবং তারপরে সাধারণত যা হয়, কবিতার ভরা নদীতে ভাটা পড়ে। তবে নীলিমার স্রোত এখনও আছে। তবে কোন দিকে চর ফেলছে আর কোন দিকে ভাটা, এখনই বলা মুশকিল। তার বয়েসও তত বেশি না। তিরতির করে জল বয় এখনও সেই কাব্যি-নদীতে। ভারি উচ্ছল মেয়ে নীলিমা। তার একখানি বই, বাস্তবের দর্পণ দিল চখাকে মতামতের জন্যে। এবং লিখিত মতামতের জন্যে।

বিপদে পড়ল চখা প্রথমত ও কবি নয় বলে। দ্বিতীয়ত প্রতিদিন অপরিচিত এত কবি ও লেখক তাঁদের বই পাঠিয়ে মতামত চান যে, সময় করে ওঠা সত্যিই অসম্ভব। আরও বিপদ যে, ও মিথ্যাচারী নয়।

নীলিমা যেদিন নামি কবি হবে সেদিন এই কথা নিজেও বুঝবে। তা ছাড়া, চখা চক্রবর্তী যেহেতু কবি নয়, কবিতা সম্বন্ধে মত সে দেবেই বা কেমন করে! নীলিমা মতামত চাইল বারংবার তার বইটি দিয়ে চখার কাছ থেকেই।

একটু ভেবে, চখা তাকে কবি দিব্যেন্দু পালিতের ঠিকানা দিয়ে দিল এবং তাঁর মতামতের জন্যে কাব্যসংকলনটির একটি কপিও পাঠিয়ে দিতে বলল কলকাতাতে। তিনি যদি তাঁর মূল্যবান মতামত দেন তাহলে এই তরুণী কবি বিশেষ উপকৃত হবে। সে এই কথাও লিখতে বলল চিঠিতে।

তিনি কি খুব বড়ো কবি?

আমি নিজে তো কবি নই। কী করে বলি বলো? তবে বড়ো কবিদের সঙ্গেই ওঁর ওঠা বসা। তা ছাড়া দিব্যেন্দু পালিতের কবিতার বই যখন আনন্দ পাবলিশার্স ও দেজ পাবলিশিং থেকে বেরোয় তখন তিনি যে মস্ত কবি, সে-বিষয়ে কারওরই কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।

উনি যদি উত্তর না দেন?

ন্যায্য প্রশ্ন করল নীলিমা।

না-দেওয়াটাই স্বাভাবিক। বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকেরা প্রতিদিনে এত চিঠি ও বই পান যে, তাঁদের সকলেরই চিঠির উত্তর বা বইয়ের সম্বন্ধে মতামত দিতে হলে তাঁদের নিজেদের আর কোনো কাজই করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বিখ্যাতরাই জানেন একমাত্র তাঁদের সমস্যার কথা, অপারগতার কথা এবং দুঃখের কথা। তবে অমন ব্যস্ততার মধ্যেও কেউ কেউ দেনও উত্তর মাঝে মাঝে। সব চিঠির না হলেও কিছু চিঠির উত্তর অত্যন্ত কষ্ট করেও দেন।

দিব্যেন্দু পালিত তো শুধু কবি নন, তিনি তো গদ্যকারও।

প্রাণেশ বলল। চানুর বন্ধু।

অবশ্যই। এবং শুধু গদ্যকারই নন, তাঁর ছোটোগল্প বিখ্যাত পত্রিকাতে আমরা প্রথম পড়েছি, যখন কলেজে পড়ি, তখন।

বাবা:! এত জানতাম না। ওঁর বয়স কত হবে? পঁচাত্তর?

নীলিমা বলল।

হেসে ফেলল চখা।

বল, দিব্যেন্দু নিজে বলেন পঞ্চাশ। আমার মনে হয় আরও কম। দিব্যেন্দু পালিতও আনন্দবাজারের মস্ত অফিসার। উনি কাজ করেননি এমন খবরের কাগজ ও বিজ্ঞাপন কোম্পানি কলকাতায় খুব বেশি নেই। খুব ভাবনা-চিন্তাও করেন। রীতিমতো চিন্তাবিদ বিদগ্ধ মানুষ। তাঁর হাঁটা-চলা, কথা বলা, দাঁড়ানো সবকিছুর মধ্যেই এই বৈদগ্ধ্য ফুটে ওঠে। নিজের ভাষা সম্বন্ধে অত্যন্তই সচেতন। উনি আর কারও মতনই লেখেন না বাংলা। ওঁর বাংলা সম্পূর্ণই নিজস্ব।

তাই?

শ্রদ্ধামিশ্রিত বিস্ময়ের সঙ্গে বলল নীলিমা।

তারপরই বলল, চিন্তা যে করেন তা তাঁর টাক দেখলেই বোঝা যায়। মাথায় একটিও চুল নেই।

চিন্তাবিদদের মধ্যে অধিকাংশরাই টেকো হন। রবীন্দ্রনাথ, আইনস্টাইন, সত্যেন বোস আর শরৎবাবুরা যদিও এক্সেপশান।

হেডমাস্টারমশাই বললেন।

চানুর বন্ধু প্রাণেশ বলল, সে কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছে ক-দিনের জন্যে, ছিঃছিঃ, কার সঙ্গে কার তুলনা মাস্টারমশাই! দিব্যেন্দু পালিতের নামের সঙ্গে শরৎবাবুর নাম একসঙ্গে উচ্চারণ করলেন! ভাগলপুরে থাকতেন বলেই কি দুজনে সমান হলেন। আপনি আর কারও সামনে একথা বলবেন না মাস্টারমশাই। দিব্যেন্দু একজন জ্যোতিরিন্দু ইন্টেলেকেচুয়াল। লেখা নিয়ে উনি কত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন সবসময়ে। ভাষা সম্বন্ধে কত সচেতন উনি। তুলনামূলক সাহিত্যের এম এ। বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্তদের মতো দিকপালদের কাছে বাংলা এবং পৃথিবীর সাহিত্য পড়েছেন। ওঁর সঙ্গে ডিগ্রিহীন শরৎ চ্যাটার্জির তুলনা যিনি করেন তিনি আকাট আনকালচারড! একটি স্কুলের হেডমাস্টার হয়ে আপনি একথা কী করে বললেন? ছি :! শরৎবাবু আবার কোনো লেখক নাকি? ছ্যা! ছ্যা! আর শরৎবাবু তো মেয়েদের লেখক। ওঁর লেখা তো সেন্টিমেন্টাল। ট্র্যাশ।

ঝন্টু এবারে হাঁপ ধরে যাওয়াতে বলল, এ সবকিছুই কিন্তু আমার মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। আমি মিস্ত্রি মানুষ। এবারে ওঠো চখাদা। সব বিষয়ই কি সকলের হজম হয়! তুমি এর পরের বারে হাতে সময় নিয়ে এসো। তখন এইসব আলোচনা কোরো প্রাণেশের সঙ্গে, মাস্টারমশায়দের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এবারে ক্ষ্যামা দাও। সকালের ফেনাভাতই আমার হজম হয়ে গেল।

আমি তো কিছুই বলিনি। আলোচনা তো করছিলেন হেডমাস্টারমশাই আর প্রাণেশ। আমিও কি লেখক নাকি! এসব আলোচনা করার এক্তিয়ারই নেই আমার। আমি ভালো করেই জানি আমার বিদ্যা-বুদ্ধির দৌড়!

নীলিমা ওদের উঠতে দেখে বলল, আচ্ছা চখাদা, দিব্যেন্দু পালিত কি বুদ্ধদেবের ভাই?

কোন বুদ্ধদেব? সরোদিয়া বুদ্ধদেব-এর কথা বলছ কি? এখন তো বঙ্গভূমে বুদ্ধদেবের ছড়াছড়ি। মন্ত্রী, দাশগুপ্ত-স্কোয়ার, গঙ্গোপাধ্যায়, আরও কত।

চানু বলল, না, না, ফিলম ডিরেক্টর। সরোদিয়া বুদ্ধদেববাবুর মাথার চুলে তো চিরুনি চালালে চিরুনি ভেঙে যাবে। শুনছ না? হচ্চে টাকের কথা! উইথ রেফারেন্স টু দ্য কনটেক্সট কথা এল।

বলেই, হো হো করে হেসে উঠে বলল, বলেছ ঠিক। তবে, দুজনের–দিব্যেন্দু পালিত এবং বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের চেহারার মধ্যে আশ্চর্য মিল আছে। তবে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, দিব্যেন্দু পালিতের মতন মোটা ফ্রেমের চশমা পরেন না আর বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর টাকটি দিব্যেন্দু বাবুর টাকের মতন অত চকচকেও নয়।

ইংরেজির মাস্টারমশায় তাঁর নিজের টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, টাক চকচকে কী করে করা যায় বলুন তো? আমার টাকটা বড়োই ম্যাড়ম্যাড়ে।

চানুর সবজান্তা বন্ধু প্রাণেশ বলল, Min নামের একটি Polish পাওয়া যায়। সপ্তাহে দু-দিন লাগিয়ে শ্যাম লেদার দিয়ে ঘষবেন, দেখবেন টাক একেবারে ঝিকমিক করবে।

আর দাড়ি চকচকে করতে হলে কী করতে হয়? মানে, জেল্লা আনতে?

ইতিহাসের মাস্টারমশায় বললেন।

দাড়ি চকচকে করতে হলে কী করতে হয়?

আবারও প্রশ্ন হল।

স্কুলের সামনের বাগানের মধ্যে বিচরণরত একটি স্মার্ট এবং ইন্টেলিজেন্ট দাড়িওয়ালা পাঁঠার দিকে চেয়ে এবং নিজের দাড়িতে আদরে হাত বুলিয়ে এবারে প্রশ্ন করলেন, ভূগোলের সুগোল শিক্ষক।

চানু বলল, দাড়ি চকচকে করার মতন সোজা কাজ আর কিছুই নেই।

কীরকম?

সপ্তাহে তিন দিন বৈদ্যনাথের চ্যবনপ্রাশ লাগাতে হবে মাত্র একচামচ করে, সঙ্গে চার ফোঁটা রেড়ির তেল।

বোগাস।

রতুজেঠুর ছোটোছেলে বাবলা বলল এবারে।

চখা লক্ষ করল দীপ আগাগোড়া চুপ করেই রইল। ও শুধু তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চখাকে দেখে যাচ্ছে। চখা যেন চিড়িয়াখানাতে নতুন-আসা কোনো দুষ্প্রাপ্য জন্তু।

ঝন্টু দাঁড়িয়ে উঠে ঈষৎ বিরক্ত গলাতে বলল, চখাদা, তোমাকে নিতে কিন্তু ওঁরা সাতটার আগেই ধুবড়ি থেকে এসে হাজির হবেন। এদিকে সাড়ে এগারোটা বেজে গেল। বরবাধা থেকে ফিরতে ফিরতে দেড়টা-দুটো হয়েই যাবে। তারপর খাবে-দাবে। অনেকে আসবে তোমার সঙ্গে দেখা করতেও। কাল তাঁরা রাত দশটা অবধি অপেক্ষা করে চলে গেছেন। তুমি তো এলেই রাত সোয়া এগারোটা বাজিয়ে। তার ওপর মরনাই চা-বাগানেও তো যাবে। একবার ব্যানার্জি সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে। কী যাবে না?

ভেবেছিলাম।

তো চলো। আর দেরি করলে আমার টেনশান হয়ে যাচ্ছে। বর নিতে এসে কি তাঁরা বসে থাকবেন?

বর নিতে এলে কী হবে? নিতবর ছাড়া তো বর যাবে না! তুই পারফিউম-টারফিউম এনেছিস তো? ঘেমে-গন্ধ নিতবরকে নিয়ে আমি বিয়ে করতে যাব না কিন্তু।

দীপ, চানু, প্রাণেশ এবং স্কুলের সব মাস্টারমশাইয়েরাই হেসে উঠলেন একসঙ্গে চখার কথা শুনে।

ঝন্টুর সাদা টাটা মোবিল গাড়িটা সেকেণ্ডারি স্কুল এবং প্রাইমারি স্কুল পেরিয়ে তামাহাট এর সামনে এসে ডিঙ্গডিঙ্গার দিকে রওয়ানা হল।

চখা, পান্ডে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছিল সামনে। এই পথ দিয়ে কতবার কত জায়গাতে যাওয়ার স্মৃতি শীতে গ্রীষ্মে বর্ষাতে যে আছে, তা মনে পড়ে গেল। চখার বাবা, রতুজ্যাঠা, বৈদ্যকাকু, বাবার আরবান ইনফ্যানট্রির বন্ধু অজিত কাকু, হাওড়ার অজিত সিং, বাগচীবাবু, গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বাগচী, তাঁর ছেলে গামাবাবু, অহীন চৌধুরি, ধুবড়ির আবু ছাত্তার, মোটাসোটা কাসেম মিয়া, বাপ্প, আরও কত মানুষের স্মৃতি!

মনটা বিধুর হয়ে এল নানাকথা ভাবতে ভাবতে।

ঝন্টু বলল, কী হল? কথা বলছ না যে, শরীর খারাপ লাগছে নাকি?

না:। ভাবছি।

তারপর বলল, এটা কী জায়গা?

নুয়াহাট বা নুয়াবাজার বলতে পারো। ডিঙ্গডিঙ্গার আগে এই নতুন জায়গার পত্তন হয়েছে। আস্তে আস্তে মানুষে ভরে যাবে সারাপৃথিবী। গাছ থাকবে না, পাখি থাকবে না, মাঠ থাকবে না, বন থাকবে না। ভাবলেও খারাপ লাগে।

যা বলেছিস। তারপর বলল, বুঝলি, সেদিন কলকাতার বইমেলাতে দেজ পাবলিশিং-এর স্টলের সামনে বসে অটোগ্রাফ দিচ্ছি পাঠক-পাঠিকাদের কেনা বইতে, এমন সময়ে এক সুন্দরী ভদ্রমহিলা সঙ্গে একটি অল্পবয়েসি সুন্দরী যুবতীকে নিয়ে এসে আলোকঝারি-র একটি কপি সই করতে দিয়ে অল্পবয়েসি মেয়েটিকে দেখিয়ে বললেন, এ হচ্ছে ডিঙ্গডিঙ্গার মেয়ে, কলকাতার বউ।

চখা সেই বইয়ের ওপরে লিখে দিল ডিঙ্গডিঙ্গার মেয়েকে। তারপরে সই করে দিল। মেয়েটির নামও লিখেছিল জিজ্ঞেস করে, কিন্তু শয়ে শয়ে নাম সই করতে হয়েছিল বইমেলায় অটোগ্রাফ দেওয়ার সময়ে, তাই নামটি মনে করতে পারল না। তবুও ঝন্টু, চানু, দীপ ইত্যাদিদেরও বলল সেকথা।

চানু বলল, বরবাধাতে চলেন আগে। ফেরার সময়ে মরনাইতে ঢুইক্যা দেখা যাবখন, ডিঙ্গডিঙ্গার সে কোন মাইয়া।

মরনাই চা-বাগানটা তো মস্ত বড়ো হয়ে গেছে!

স্বগতোক্তি করল চখা।

হ্যাঁ। পথের দু-পাশেই ছড়িয়ে গেছে। মিশনের বাগান তো!

এই বাগানের ডিরেক্টরস বাংলো বা গেস্ট হাউস নেই? এখানে এসে ক-দিন নিরিবিলিতে লেখালেখি করা যেত।

হ্যাঁ। থাকবে না কেন? তবে চা-বাগানেই যদি থাকবে তো বাগডোগরা বা নিউ কুচবিহার থেকে এত ঝক্কি করে এতদূরে আসতে যাবে কোন দুঃখে। ডুয়ার্স এবং আপার অসমে এবং দার্জিলিং-এর পাহাড়েও তোমাকে কত লোকে আদর করে ডেকে নেবে একবার জানতে পারলে।

চখা বলল, তবু মরনাই, মরনাই-ই। মরনাই, ডিঙ্গডিঙ্গা, বরবাধা এসব নামগুলি আমাকে বড়োই নস্টালজিক করে তোলে রে। যাঁদের সঙ্গে এসব জায়গায় এসেছি, ঘুরেছি, একসময়ে শিকারও করেছি কচুগাঁও ডিভিশানে, শিকার তখন ছিলও প্রচুর এবং আইন মেনেই করেছি, সেইসব মানুষের একজনও তো আর নেই আজ। মন বড়ো ভারাক্রান্ত লাগে তাঁদের কথা মনে হলে। কত হাসি, গল্প, মজা, গান!

তারপর বলল, ইস। ভাবাই যায় না। ডিঙ্গডিঙ্গা কত বড়ো জায়গা হয়ে গেছে রে! আগে যখন ডিঙ্গডিঙ্গার হাটে আসতাম তখন কত ছোট্ট হাট লাগত এখানে।

এখন তো সব নামেই হাট। সপ্তাহে রোজই বাজার বসে বলতে গেলে। তবু হাটও বসে।

গুমা রেঞ্জের বরবাধার বাংলোর সামনে এসে যখন পৌঁছোনো গেল, ছোটো নদীটা পেরিয়েই পথ ডানদিকে মোড় নিয়েছে, ডানে বনবিভাগের বাংলো। রেঞ্জারের সঙ্গে আরও কয়েকটি ছোটো ছোটো ঘর দেখল। নতুন হয়েছে কি? আগে ছিল কি না মনে করতে পারল না। হয়তো অফিসই হবে।

চখার মনে পড়ে গেল আগল-খোলা শ্রাবণের একদিনে এই বরবারই রেঞ্জারের বাংলোতে একটি দুপুর কাটিয়ে গেছিল। ঝন্টুর জ্যাঠতুতো দিদি আরতিদির স্বামী শচীন জামাইবাবু তখন রেঞ্জার ছিলেন এখানকার। খাওয়া-দাওয়া, গান। মনে আছে চখার সমবয়েসি এবং ওর চেয়ে বয়েসে বড়ো অনেক মহিলারা ছিলেন। হয়তো ইতু, ববি, ভারতীদি, আবিদি, আরও কেউ কেউ। কেয়া আর কদমের গন্ধে ম ম করছিল দুপুর। বেতবন ছিল ওই ছোটো নদীটির ধারে ধারে। ঘন। সাপের আড্ডা ছিল বেতবনে। স্কুলের ছাত্র চখাকে যেতে মানা করেছিলনে জঙ্গলে একা একা শচীন জামাইবাবু। বলেছিলেন চিতা আর বড়ো বাঘ অনেক আছে। সাপের তো কথাই নেই।

তারও অনেকদিন পরে একরাত ছিল এই বাংলোতেই এসে আবু ছাত্তারের সঙ্গে। তখনও সে কলেজের ছাত্র। জোড়া চিতাবাঘ মেরেছিল ওরা সপসপে চাঁদ-ভেজা শ্রাবণের চকচকে সেই উদলা, উজলা রাতে।

কিন্তু জঙ্গল দেখে মন খারাপ হয়ে গেল চখার। কেটে সব সাফ করে দিয়েছে।

বাংলোর কাছে রাস্তার ধারে কিছু জায়গাতে ফিফটিন-টুয়েন্টি ডিপ আছে, শালের জঙ্গল। তার ওপাশেই ফাঁকা।

চানু বলল, আরও আগে গেলে আরও ফাঁকা।

চখা বলল, আরও আগে যাবার আর ইচ্ছে নেই। না এলেই ভালো করতাম। যখন স্কুলে পড়তাম তখন দিনের বেলাতেও এই পথ দিয়ে বন্দুক হাতে হাঁটতে গা ছমছম করত।

তারপরে স্বগতোক্তিরই মতন বলল, যমদুয়ারে যাওয়ার বড়োই ইচ্ছা রে ঝন্টু। যাওয়া কি যায় না, থাকা যায় না একরাত?

মানাস অভয়ারণ্য দেখতে গিয়ে এক শুক্লা চতুর্দশীর রাতে বড়পেটা রোডে মানাস ব্যাঘ্র প্রকল্পর অধিকর্তা সঞ্জয় দেবরায় সাহেবের বাংলোতে বসে সংকোশ নদী আর যমদুয়ারের প্রশংসা করে তাঁর ভীষণই বিরাগভাজন হয়ে গেছিল চখা। মানাস ছিল দেবরায় সাহেবের দেবভূমি। মা-বাবা, অনূঢ়া কন্যা, স্ত্রী সবই। যেকোনো দেশই অমন একজন কনসার্ভেটর এবং ফিল্ড-ডিরেক্টরকে নিয়ে অবশ্যই চিরদিন গর্ব করতে পারে। রাজ্য হিসেবে অসম তো অবশ্যই পারে। ভারতের নানা রাজ্যের অনেকই টাইগার প্রোজেক্টের ফিল্ড-ডিরেক্টরকে দেখেছে চখা, প্রত্যেকেরই নাম করতে চায় না কিন্তু তাঁদের মধ্যে দু-একজন পয়লা-নম্বরি চোর। বনের রক্ষক হয়েও ভক্ষক। এই ধরনের আমলাদের গুলি করে মারা উচিত উনিশশো বাহাত্তরের পরেও যাঁরা বন্যপ্রাণী ও পাখি শিকার করেন, সর্বার্থেই অশিক্ষিত সেইসব চোরাশিকারিদেরই সঙ্গে। কিন্তু মারছেটা কে? সরষের মধ্যেই ভূত ঢুকে গেছে। ভারতের সব বনই এখন তামিলনাড়ু আর মাইসোরের ভীরাপ্পানদের খপ্পরে। রাজ্যভেদে তাদের নাম আলাদা এই যা। প্রকৃতিই যে আমাদের মা, অন্য মা, অরণ্যই যে আমাদের শেষ আশ্রয়, প্রশ্বাস নেবার শেষ জায়গা, একজোড়া করে বন্যপ্রাণী ও পাখিরাও যে একজন মানুষ ও মানুষীর শেষের প্রহরে বাইবেলে বর্ণিত সেই Deluge-এর পরে Nuhas Arc-এ সঙ্গী হবে, একথা কী করে যে,অর্থগৃধু অদূরদৃষ্টিসম্পন্ন ন্যক্কারজনক ঘৃণ্য দেশবাসীদের এক বড় অংশই ভুলে যান, তা ভাবলেও চখার কপালের দু-পাশের শিরাতে রক্ত ঝুনুক-ঝুনুক করে। মনে হয়, স্ট্রোক হয়ে যাবে।

গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে বল এবারে ঝন্টু।

চখা বলল।

তারপরেই নিজেই ড্রাইভারকে বলল, ব্যাক করো পান্ডে, জায়গা দেখে। আর জঙ্গল দেখার সাধ নেই। ইশ।

চানু বলল, আপনারে লইয়া যাইতাম যমদুয়ারে কিন্তু তাগো বড়ো ঘাঁটি হইছে যে, এখন স্যা যাগা। সংকোশ নদী পারাইলেই ত ভুটান। তাই পুলিশেও কিছু কইরবার না পারে। টেররিস্টদের স্বর্গরাজ্য। আপনারে মাইরা ফ্যাইলাইলে আমাগো মুখগুলান কি দেখান যাইব কারও কাছেই? থুথু দিবে না মানষে?

চখা বলল, আমিও তো বিদ্রোহী। তারা আমাকে মারবেই বা কেন? সব বিদ্রোহী,সব টেররিস্টদের প্রতিই আমার সমর্থন আছে। উরুগুয়ের টুপামাররা সন্ত্রাসবাদীদের ম্যানিফেস্টোতে পড়েছিলাম যে, তারা বিশ্বারস করে, If the country does not belong to everyone, it will belong to no one. যে-দেশে গণতন্ত্র কেতাবি, আইন প্রহসন, ন্যায়বিচার এখনও স্বপ্নেরই বস্তু, সে-দেশে সম্ভবত টেররিজমই একমাত্র পথ অন্যায়ের প্রতিকার করার।

তোমরা যাই এল আর তাই এল, আমি আমার সমস্ত শিক্ষা, ভাবনা-চিন্তা এবং দায়িত্বজ্ঞান, সত্ত্বেও এই কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি। আর আইনও তো শুধু বড়োলোকেরই জন্যে। গরিবের কোন কাজে লাগে এই আইন?

চখার উত্তেজনা কমিয়ে দিয়ে কথা ঘোরাবার জন্যে দীপ বলল, চলুন, ফিরে যাই। মরনাই চা-বাগান যাবেন তো চখাদা?

চল, যেখানে নিয়ে যাবি যাব।

উত্তেজনা প্রশমিত করে বলল চখা।

মরনাই চা-বাগানের চা রাখে ধুবড়ির টাউন স্টোরস। খাঁটি চা।

রায়েদের টাউন স্টোরস? শচীন রায়, কানু রায়, আরও ভাইয়েরা ছিলেন না? শচীনবাবুর বাবা ছিলেন দূরদর্শী মানুষ।

দীপ বলল, তুমি জানলে কেমন করে?

বলিস কীরে? তোদের জন্মের অনেকই আগে থেকে আমি ওঁদের চিনি। টাউন স্টোরস-এর শচীনবাবু আর আমার বাবার সঙ্গে ধুবড়ির নেতাধোপানির ঘাটে থেকে ছইওয়ালা নৌকো করে বর্ষার দামাল ব্ৰহ্মপুত্ৰ পেরিয়ে শালমাড়া হয়ে ফুলবাড়ির আগে প্লাবিত নদীর মধ্যেই শরবনে ভরা একটি ডোবা-চরে রাত কাটিয়ে পরদিন জিঞ্জিরাম নদীতে গিয়ে পৌঁছেছিলাম একবার। চার-পাঁচ দিন নৌকোতেই ছিলাম জিঞ্জিরাম নদীতে। একদিকে গারো হিলস অন্যদিকে গোয়ালপাড়া। রাভাদের গ্রাম ছিল। রাভাতলা। আর কী বৃষ্টি, কী বৃষ্টি! ওই সময়েই জিঞ্জিরাম-এর মস্ত মস্ত দহতে বিরাট বিরাট কুমিরের আখড়া বসে।

আখড়া মানে?

দীপ বলল।

কুস্তি শেখে নাকি?

হয়তো শেখে। মার ঘড়িয়াল, ক্ৰকোডাইল। আরও কতরকমের কুমির। ঘটওয়ালা কুমির বলে ওখানকার এক ধরনের কুমিরকে। ছাত্তার অন্তত বলত। তারা নাকি এতই বুড়ো যে, মাথার ওপরের চামড়া কুঞ্চিত হয়ে ঘটের মতন হয়ে যায়। প্রতিগ্রাম থেকেই মানুষ নেয় কুমিরেরা। মানুষখেকো কুমির।

আমরা রাভাতলা নামের এক গ্রামে নেমে শুনেছিলাম আগের রাতে এক চাষার যুবতী বউকে কুমিরে নিয়ে যাওয়ার মর্মন্তুদ কাহিনি। মেয়েরাই বেশি যায় কুমিরের পেটে।

একটু চুপ করে থেকে বলল, আহা, কীসব ছায়াচ্ছন্ন সরু-নদীপথ! দু-পাশে বাঁশের মাচা বানানো ছিল সেই সরু, দ্রুত ধাবমানা নদীর ঘাটে ঘাটে, জলে না নামলেও যাতে চলে যায়। যখন একান্তই চলে না তখনই কুমিরের ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে সকলে। লম্বা লম্বা নলি-বাঁশের ছিপ হাতে করে তামা-রঙা রাভা যুবকেরা ছায়াতে দু-পাশ থেকে ঝুঁকেপড়া বনের প্রায়ান্ধকার শ্রাবণী দুপুরে বসে মাছ ধরছিল। এখনও যেন চোখে ভাসে। আর আমাদের নৌকোর দাঁড় পড়ছিল ছপছপ। ধীরে ধীরে। আর আমি বসেছিলাম নৌকোর ছইয়ের মাথার ওপরে, গলাতে সানগ্লাস আর কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে। রাতের অন্ধকার নেমে এলে ভাঙনি মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে শুয়ে নৌকোর ছইয়ের ওপরে অঝোরধারে বৃষ্টির শব্দ আর গারো পাহাড় থেকে আসা দামাল হাওয়ার দাপাদাপির আওয়াজ শুনতে শুনতে বাবার পাশে ঘুম।

আবিষ্ট গলাতে ওদের বলছিল চখা।

তখন আমি কলেজের ফাস্ট-ইয়ারের ছাত্র। আমার বাবার গায়ের গন্ধ এখনও যেন নাকে ভাসে। গন্ধটি কটু নয়, আবার মিষ্টিও নয়। একটা নিউট্রাল গন্ধ। odourless-ই বলা চলে। কিন্তু তবু ছিল odour! তার বাবার কোল-ঘেঁষে সারারাত বৃষ্টি-ঝরা শ্রাবণ-রাতে কুমিরে-ভরা কিন্তু প্রচন্ড গভীর জিঞ্জিরাম নদীর বুকে তীরের গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে-রাখা ছোট্ট দুই নৌকোতে যেসব ছেলে রাত না কাটিয়েছে, তারা হয়তো কোনোদিনও জানবে না যে, বাবার গায়ের গন্ধও, মায়ের গায়ের গন্ধরই মতন প্রত্যেক সন্তানেরই প্রিয়।

চানু বলল, পান্ডেজি, মরনাই-এ ঢোকো ডানদিকে। ডিঙ্গডিঙ্গার কোন সুন্দরী মেয়ে অটোগ্রাফ নিল চখাদার কলকাতার বইমলাতে, তার খোঁজ করা যাক একটু!

ওরা বাগানের অফিসের সামনে ঢুকে গাড়ি ঘুরিয়ে, গাড়িতেই বসল। চানু গেল খবর করতে। একটু পরে ফিরে এসে বলল, ম্যানেজার, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, ইঞ্জিনিয়র কেউ-ই নাই, এহনে লাঞ্চ আওয়ার। বাড়ি যাইবেন কি?

দুর। খাবার সময়ে মানুষকে বিরক্ত করব না।

তবে অফিস থিকাই খোঁজ নিয়া আসতাছি। আপনে বসেন।

ফিরে এসে চানু বলল, যা ভাবছিলাম তাই-ই। মাইয়ার নাম গোলাপ। গোলাপের মতনই সুন্দরী। ওর বাবারেও আমি চিনি। ওরা বাগানে থাকে না। ওদের বাড়ি এই ডিঙ্গাডিঙ্গাতেই। ফেরার সময়ে যামুঅনে অগো বাসায়। কিন্তু স্যা ত বিয়া হইয়া চইল্যা গেছে কলকাতা!

ঝন্টু বলল, মেয়ে গেছে তো কী হয়েছে–মা-বাবা তো আছেন। তাঁদেরও সারপ্রাইজ দেওয়া হবে। ডিঙ্গডিঙ্গাতে এসেও ডিঙ্গডিঙ্গার মেয়ের বাড়িতে না যাওয়াটা ভালো দেখায় না। সে এবং তার শাশুড়ি যখন চখাদার ভক্ত।

মরনাই বাগান পেরিয়ে ডিঙ্গডিঙ্গাতে এসে সামনে নানারঙা গোলাপ বাগানওয়ালা সুন্দর একটি বাড়ির সামনে এসে থামাতে বলল গাড়ি চানু, পান্ডে ড্রাইভারকে। তারপর ভেতরে গেল। পরক্ষণেই ভেতর থেকে একজন সুন্দরী প্রৌঢ়া মহিলা এবং তাঁর সুন্দর ছেলে বাইরে এসে আপ্যায়ন করলেন।

চখারা সকলেই গেল ভেতরে। কী যে খুশি হলেন মহিলা ও তাঁর পুত্র, তা বলার নয়! বললেন, মেয়ের বিয়ে হয়েছে অল্প কদিন আগে। ওর সুন্দরী শাশুড়িই নিশ্চয়ই ওকে নিয়ে বইমেলাতে গেছিলেন। আপনার অনেক লেখাতে ডিঙ্গডিঙ্গার উল্লেখ আছে, সে কারণেই উনি নিশ্চয়ই আমার মেয়েকে ডিঙ্গডিঙ্গার মেয়ে এবং কলকাতার বউ বলে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন।

তারপরে বললেন, মেয়ে আমার আসছে সাতদিন পরেই। আপনি স্বয়ং এসেছিলেন শুনলে কী যে করবে জানি না। আপনার এই বইটিতে সই করে দিয়ে, আজকের তারিখও দিয়ে যান দয়া করে। নইলে ও হয়তো বিশ্বাসই করবে না যে, আপনি এসেছিলেন!

বলে, চখার লেখা একটি-বই নিয়ে এলেন ভেতর থেকে।

মিষ্টি না খাইয়ে ছাড়লেন না মহিলা। ওঁরা খ্রিস্টান সম্ভবত। মিশনের দীক্ষিত। ওঁর স্বামী নামকরা ঠিকাদার ছিলনে এই অঞ্চলের। গোলাপের বাবা এই তো যথেষ্ট পরিচয়, নাম নাই বা মনে থাকল!

চানু বলল।

চখা গোলাপদের বাড়ি থেকে বেরোতে বেরোতে ভাবছিল, দু-কলম লিখে কীই বা এমন করেছে যে, এত মানুষের এত ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা এবং স্নেহ পেল এ জীবনে।

.

০৪.

ধুবড়ির সবুজের আসর থেকে এক ভদ্রলোক, হীরেন পাল, নিতে এসে গেলেন সাতটার জায়গাতে পাঁচটার সময়েই। সঙ্গে ইতু, পূর্ণজেঠুর মেয়ে। জিপ নিয়ে এসেছিলেন ওঁরা পথ খারাপ বলে।

ছেলেবেলাতে যখন আসত চখা, ধুবড়িতে, তখন ইতুর বয়েস হবে আট-দশ বা একটু বেশি। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ের Strand-এ হাঁটতে নিয়ে যেত ইতু চখাকে। অস্পষ্ট মনে আছে। ওর ভালো নাম রীতা। বিয়ে করেনি। ওর ছোটোবোন মানাও বিয়ে করেনি। বেশ আছে নদীপারের হু হু-হাওয়া, চর-পড়া গাঢ় সবুজের আস্তরণের ঘেরের কলুষহীন ধুবড়িতে। ইতু কাজ করে স্টেট ট্রান্সপোর্টে আর অবসর সময়ে অভিনয়ও করে। বড়ো রাস্তাগুলোতে যদি-বা ট্রাক বাস বা গাড়ি চলাচল কিছু আছে, ছাতিয়ানতলার গলি একেবারেই নিস্তরঙ্গ।

নিতে তো ওঁরা এসেছেন কিন্তু বরবাধা থেকে ফিরে দুপুরের খাওয়া খেয়ে ওঠার পরই পুরো তামাহাট যেন ভেঙে পড়েছে পিসিমার বাড়ির উঠোনে। কে যে আসেনি! দাতুর ছোটো, চলে-যাওয়া ভাই বাবুর বিধবা স্ত্রী তাপসী তার ছেলেকে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়ে এসেছে। ছেলেটি ভালো হবে। চখার মন বলল, তারমধ্যে ভালোত্বর সব লক্ষণ পরিস্ফুট। বড়ো হবে জীবনে। আশীর্বাদ করল মনে মনে। চানু, চানুর স্ত্রী মিঠু। বিনয়, বিনয়ের সুন্দরী শিশুকন্যা, বিনয়ের বাবা। তিনি এখন মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান। রতু জেঠুর ছোটোছেলে বাবলা এবং তার কবি-স্ত্রী নীলিমা। কুট্টিদা, সুরেন জেঠুর মেজোছেলে।

রাঙাপিসিও এসেছিলেন এবং আরও কত চেনা ও আধচেনা মানুষ। ঝন্টুর স্ত্রী কসমিক, শালা শক্তি আর তার স্ত্রী দেবী তো ছিলই মজুদ।

পিসিমা রুদ্রাক্ষর গাছটা হেঁটে ফেলার পরই বেলুদা মারা যান। তাই নিয়ে অনেক অনুশোচনা করলেন।

ভাবছিল চখা, কতরকমের সংস্কার থাকে মানুষের।

হাঁসেরা বাড়ি ফিরে এল, সার দিয়ে, প্যাঁক-প্যাঁক করে হেলতে-দুলতে। তক্ষক ডেকে উঠল লাটকা গাছে। জলপাই গাছের ডালে দিনশেষের আলো এসে পড়েছে। লালাবাবু বেলা যায়। যেতে হবে এবারে।

ধুবড়ির বইমেলার তরফের হীরেনবাবুও ভেতর-বাড়িতে এসে ঢুকলেন ইতুর সঙ্গে। বরকে। আরও বেশিক্ষণ ছেড়ে রাখার পক্ষপাতী তিনি নন। গোরুদের গোয়ালে ফেরার সময় হল, বরের সংসারে জুতবার। সংসারও তো এক খোঁয়াড়। কী বর আর কী বউ-এর!

পিসিমাকে প্রণাম করে উঠল চখা। অন্ধকার হয়ে গেছে। গদিঘরের সামনে ততক্ষণে ভিড় জমে গেছে। বাদল মিত্তিরের শালার ছেলে লেখক হয়েছে, তাকে নিতে এসেছেন সসম্মানে ধুবড়ি থেকে মানুষে, এ যেন তামাহাটের এক বিশেষ সম্মান। পরিচিত-অপরিচিত কত মানুষই যে দাঁড়িয়ে আছেন চখাকে বিদায় দেওয়ার জন্যে!

কে বলতে পারে! এই হয়তো তামাহাট থেকে চিরবিদায়। বহুবছর পরে এসেছে এবারে। আর কি এজন্মে আসা হবে? জীবন যে বড়োই ছোটো! কতখানি ছোটো, তা জীবনের বেলা পড়ে এলেই শুধু বোঝা যায়। টগবগে যৌবনে পথের শেষে পৌঁছোনোর কথা এবং সেই গন্তব্যর অনুভূতি সম্বন্ধে কোনো ধারণা করাও অসম্ভব।

ঝন্টু চলল চখার সঙ্গে, নিতবর হয়ে। আসলে, চখার দেখভাল করারই জন্যে। ছিপের পেছনে হীরেনবাবু, ঝন্টু এবং সেকেণ্ডারি স্কুলের হেডমাস্টারমশাই। তিনি পথে নেমে যাবেন গৌরীপুরে। তারপর বাস ধরে যাবেন গুয়াহাটি। দাতু এক-শো বিশ জর্দা দিয়ে পান খাওয়াল চখাকে জিপ ছাড়বার আগে। শেষদান।

এই কি গো শেষদান?

সকলের দিকে হাত তুলে চখা ছিপের সামনের বাঁ-দিকের সিট-এ বসল। ওর পাশে ইতু বসেছে। শিশুকালের অথবা ছেলেবেলার মতন। আশ্চর্য! তখন কত কাছাকাছি ঘেঁষাঘেঁষি বসা যেত সহজেই। কোনোই সংকোচ ছিল না। শিশুমাত্রই দেবশিশু। এখন আর তেমন করে বসা যায় না। সময়ই বড়োই বেরসিক। সে বড়োই দূরত্ব রচনা করে দেয় একে অন্যের মধ্যে, বিশেষ করে নারী ও পুরুষের মধ্যে। আড়ষ্ট হয়ে বসেছে ইতু। চখাও যতখানি পারে বাঁ-দিক ঘেঁষে বসেছে।

চখা বাঁ-হাতটি অস্ফুটে তুলে বলল, যাই।

ভিড়ের মধ্যে থেকে কে যেন বলে উঠলেন, কোনো গুরুজনই হবেন, মুখ দেখতে পেল না তাঁর, বললেন, যাওয়া নাই, আইস্যো। আবারও আইস্যো য্যান শিগগির। আমাগো ভুইল্যা যাইয়ো না চখা।

চখা সেই কথার পিঠে কিছু বলতে গেল। কিন্তু তার গলার কাছে কী যেন দলা পাকিয়ে উঠল। বলা হল না কিছু। বলা গেল না।

ছিপটা ছেড়ে দিল একটা ঝাঁকুনি তুলে, হেডলাইট জ্বেলে।

চখা ভাবছিল, কে জানে! আবার কোনোদিনও আসা হবে কি না। না-হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। যদি হয়ও, তবে কি আর পিসিমা, রাঙাপিসি, কুট্টিদা এবং আরও অনেকে এমনই থাকবেন? তাঁরা সকলেই তো তার নিজের চেয়েও বয়েসে অনেকই বড়ো।

ফিরে যাওয়ার বেলাতে যে আগে পরে নেই কোনো। সব হিসেবপত্র শুধু আসার সন তারিখ দিয়েই হয়। তবুও সকলেই তো লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েই আছেন। কখন যে কার ডাক পড়বে নদীপারে, শোর উঠবে, বল হরি হরি বোল, কে বলতে পারে! দুলতে দুলতে চলে যাবে অন্যদের কাঁধে। অবুঝ, শক্ত হয়ে-যাওয়া মাথাটা একবার এপাশ, আর একবার ওপাশ করবে। খই ছড়াতে ছড়াতে যাবে সামনে চানু, দাতু, বাবলা, দীপ আর খোল-কত্তাল বাজিয়ে গাইতে গাইতে যাবে আগে আগে কুমারগঞ্জের কেষ্ট, নে মা আমায় কোলে তুলে, আমি যে তোর খারাপ ছেলে।

Pages: 1 2 3

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress