Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পোল্যান্ডের কবিতা || Sankar Brahma

পোল্যান্ডের কবিতা || Sankar Brahma

পোল্যান্ডের কবিতা

[পোলিশ কবি তাদেউজ রজেভিচ ও তাঁর কিছু কবিতা]

(তাদেউজ রজেভিচ (Tadeusz Rozewicz;)

পোলিশ ভাষার কবি তাদেউজ রজেভিচ (Tadeusz Rozewicz) জন্মেছিলেন রাদোমস্কো, সদ্য স্বাধীন পোল্যান্ডে ৯/১০/১৯২১ সালে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোল্যান্ড আবার জার্মানীর পদানত হয়।
তখন তদিউস আর তার বড় ভাই জানিউস(যিনি নিজেও প্রতিভাবান কবি ছিলেন) দুজনেই প্রতিরোধ বাহিনীতে যোগ দেন।জানিউস গেস্টাপেদের হাতে ধরা পড়েন আর তাঁকে হত্যা করা হয়।তদিউস বেঁচে যান।
সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা তাঁর সব কবিতাতে ছায়া ফেলেছে।
প্রতীক, উপমা, শব্দব্যবহারের অভূতপূর্ব কলাপ্রকৌশলে পোলান্ডের কবিতার তথাকথিত লিরিকময়তাকে একেবারে বদলে দিয়েছেন তিনি। খুবই শক্তিশালী, অন্তর্ভেদী তার দৃষ্টি আর উপস্থাপনা। তিনি বলেছেন, “কবিতার তথাকথিত ছন্দোস্পন্দের বিষয়টি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিদের বন্দিশিবির সৃষ্টির মধ্য দিয়েই শেষ হয়ে গেছে।” যুদ্ধের বীভৎসতা, নির্যাতন আর যুদ্ধপরবর্তী সময়ের সংকট ও অপ্রাপ্তিকে তিনি তার কবিতার বিষয় করে তুলেছেন। রজেভিচকে মনে করা হয় যুদ্ধোত্তর পোলিশ কবিতার অন্যতম প্রধান কবি। তবে শুধু কবি নন, তিনি পোলিশ ভাষার একজন গুরুত্বপূর্ণ নাট্যকার, সমালোচক ও ছোটগল্পের রচয়িতা হিসেবেও তাঁর খ্যাতি এখন বিশ্ব জোড়া। ২০১৪ সালে তদিউস মারা যান।
পশ্চিমের অনেক সমালোচক প্রশ্ন তুলেছিলেন, ফ্যাসিবাদী রূঢ় বাস্তবতা আর নির্মমতার পর কী ভালো কবিতা রচনা করা সম্ভব? বিশেষ করে রাজনীতি যেখানে প্রধান ও প্রখর হয়ে ওঠে? রজেভিচ পোলিশ কবিতার ইতিহাসে ‘চতুর্থ সাহিত্য ঘরানা’র সৃষ্টি করে দেখিয়ে দিয়েছেন, রাজনীতি ও নির্মমতার ভেতর থেকেও নিয়ন্ত্রিত শৈলী, পরিমিত শব্দ ব্যবহার, অন্তর্গত অনুভবকে অবলম্বন করে ভালো কবিতা লেখা সম্ভব। কাব্যজীবনের প্রাথমিক পর্বে এই ধরনের কবিতা রচনার মধ্য দিয়েই পোলিশ সাহিত্যভুবনে তার আবির্ভাব ঘটে উদ্বেগ (১৯৪৭) ও লাল দস্তানা (১৯৪৮) কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে।
জীবনের প্রথম দিকে তীব্র সংকটের মুখোমুখি হয়েছিলেন রজেভিচ। গেস্টাপো বাহিনী তার বড়ো ভাইকে খুন করে, এই ভাইয়ের স্মৃতি তিনি কখনও ভুলতে পারেননি; নিজেও মৃত্যুর প্রান্ত থেকে ফিরে এসেছিলেন। কবিতায়, গল্পে, এমনকি নানা ধরণের গদ্যে সেই নির্মমতার কথা ঘুরে-ফিরে এসেছে। ফলে সমকালসম্পৃক্ত, আপাত অগভীর কবিতা রচনা করাই ছিল তার জন্যে স্বাভাবিক, কিন্তু তিনি প্রচলিত পথে না হেঁটে রচনা করতে থাকেন অন্তর্গত সংবেদনশীল কবিতা। তারই মাধ্যমে অস্তিত্বের জন্যেই বেঁচে থাকা—পোলিশ কবিতার ধারায় সংযুক্ত হলো এই নতুন সংবেদনশীলতা। শূন্যতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম হয়ে উঠলো তার কবিতার মর্মকথা। পরবর্তী সময়পর্বে রচিত রাজপুত্রের সঙ্গে কথপোকথন (১৯৬০), অনামা কণ্ঠস্বর (১৯৬১), একটি মুখ (১৯৬৪) তৃতীয় মুখ (১৯৬৮) ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থে এই বিষয়টিই প্রধান হয়ে উঠেছে।
রজেভিচের সময়ে আভাঁগার্দধর্মী কবিতার ধারাটি পোলান্ডে বেশ শক্তিশালী ছিল। এই ধরণের কবিতায় সরাসরি উপমা, বাক্প্রতিমা, শব্দের ব্যবহার ঘটতো। রজেভিচ সেই পথে না হেঁটে রচনা করেছেন মানব অস্তিত্বের স্মারক হয়ে উঠতে পারে এমন সব কবিতা, যা তার কথায় হয়ে উঠেছে জন্মের কার্যকারণ আর মৃত্যুর কার্যকারণে পরম্পরিত জীবনবেদ। কবিতায় এই জীবনের কথা সবটা বলা সম্ভব নয় ভেবে এই সময় তিনি গড়ে তোলেন ‘মুক্তমঞ্চ’, লিখে ফেলেন বেশ কিছু নাটক—কার্ডে লিপিবদ্ধ নির্ঘণ্ট (১৯৬৮), উপবিষ্ট অপেক্ষমান বৃদ্ধা (১৯৬৯), সেই চারজনকে নিয়ে (১৯৭২) ইত্যাদি।
সমালোচকদের মতে তার কানটি প্রখর, অর্থাৎ তার শ্রবণদক্ষতা ও তজ্জনিত প্রতিক্রিয়া চোখে পড়ার মতো। সমকালের নন্দনরীতি সম্পর্কে তিনি যেমন ছিলেন সচেতন, তেমনি সৃষ্টিশীলতার কোন নতুন রাস্তায় তাকে হাঁটতে হবে, সেটাও তিনি বেশ ভালোই জানতেন। নারীবাদ ও উত্তর-আধুনিকতার দ্বারা স্পৃষ্ট হয়ে এভাবেই তিনি রচনা করেন কাব্যগ্রন্থ ‘শ্বেতবিবাহ’ (১৯৭৫)।
রজেভিচ এখন আর আগের মতো সৃষ্টিশলিতায় সক্রিয় নেই, তবে তিনি লিখে চলেছেন তার কবিজীবননির্ভর আত্মজীবনী। কবিতা ও জীবন যে একাকার হয়ে থাকে, সেটাই হচ্ছে এই আত্মজীবনীর মূল বিষয়। রজেভিচ এমন এক কবি যিনি কবিতার সংজ্ঞাকে অগ্রাহ্য আর প্রবলভাবে প্রতিরোধ করেছেন। কবিতার যত ধরনের তথাকথিত ফাঁদ আছে, তার সবগুলো তিনি সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছেন। তাকে তাই বলা হয় নৈঃশব্দ্যের কবি, সংবেদনার কবি। অনেকে তাকে ‘প্রায়-মিস্টিক’ কবি বলেও আখ্যায়িত করেছেন। একই সঙ্গে তিনি ধ্রুপদী আভাঁগার্দ কবি হিসেবেও পরিচিত, উত্তর-আধুনিক কবির শিরোপাও জুটেছে তার।
যে’ভাবেই আখ্যায়িত করা হোক না কেন, রজেভিচের স্বর ও কাব্যশৈলী সরল কিন্তু স্নায়ুক্ষয়ী, সন্ত্রাস আর শূন্যতাকে তিনি ধরতে পারেন সহজেই। তিনি বলেছেন, আমার লক্ষ্য “পদ্য লেখা নয় ঘটনার বিবরণ দেয়া।” কিন্তু দেখা গেছে এই ঘটনার বিবরণই হয়ে উঠেছে এক-একটি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট অভূতপূর্ব কবিতা। তার শেষের দিকের লেখায় মানবজীবনের দ্বন্দ্ব, ক্ষোভ, হতাশা, আনন্দ, বেদনার ছবি বেশ স্পষ্ট। কবিতায় নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী আরেক পোলিশ কবি চেশোয়াভ মিউশ তাকে এসব কারণে চিহ্নিত করেছেন নৈরাজ্যের কবি বলে, “রজেভিচ হচ্ছেন নৈরাজ্যের কবি যিনি নস্টালজিয়া বা স্মৃতিকাতরতাকে বিন্যস্ত করে কবিতা লিখতে ভালোবাসেন।”
এ পর্যন্ত তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১৪। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় তার কবিতা অনূদিত হয়েছে।

(এখানে অনূদিত কবিতাগুলোর উৎস বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং জে. ডি. ম্যাকক্লাচির সম্পাদিত দ্য ভিনটেজ বুক অফ কনটেমপোর‌্যারি ওয়ার্ল্ড পোয়েট্রি (১৯৯৬) থেকে সংগৃহীত) –

অনুবাদ: মাসুদুজ্জামান

কবি কে

তিনিই কবি যিনি কবিতা লেখেন
আবার তিনিও কবি যিনি পদ্যটদ্য লেখেন না।

তিনিই আসলে কবি যিনি পায়ের বেড়ি খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেন
আবার তিনিও কবি যিনি এই শৃঙ্খলে আবদ্ধ হতে ভালোবাসেন

কবিকে আসলে বিশ্বাসী হতে হয়
তিনিও কবি যার কোনো কিছুতে বিশ্বাস নেই

কবি আসলে এমন মানুষ যাকে মিথ্যে কথা বলতে হয়
আবার তিনিও কবি যাকে বলা হয়েছে অনেক মিথ্যে কথা

তিনিই হলেন কবি যিনি টাল খেয়ে ভেঙে পড়েন
আবার তিনিও কবি যিনি উদ্ধত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ান

কবি তিনিই যাকে সবকিছু ছেড়েছুড়ে ফেলে দিতে হয়
আবার তিনিও কবি যিনি কোনো কিছুই ছেড়ে চলে যান না।


একটি আধুনিক প্রেমের কবিতার খসড়া

এখনও শাদা
একে শুধু ভালো করে বর্ণনা করা যায় ধূসরতার পটে
পাখিকে পাথর দিয়ে
সূর্যমুখি
ডিসেম্বরে

পুরনো প্রেমের কবিতা
মাংসের চমকপ্রদ বর্ণনায় ভরা
এটা-সেটা কত যে কচকচানি থাকে
যেমন চোখের পাতার

এখনও লাল
এটা বর্ণনা করা দরকার
ধূসরতা দিয়ে সূর্যকে বৃষ্টি দিয়ে
নভেম্বরের পপি
ঠোঁটকে রাত্রি দিয়ে

রুটির সবচেয়ে
স্পর্শকাতর বর্ণনা হলো
খিদের একটা বিবরণ দাঁড় করানো
রোমকূপের ভেজা অংশ
উষ্ণ অভ্যন্তর
রাতের বেলায় সূর্যমুখি
প্রজননের দেবী সিবিলির স্তন-পেট-উরু
জলের
একটি বসন্তস্বচ্ছ
পরিষ্কার বর্ণনা হলো
তৃষ্ণার বিবরণ
ছাই
মরুভূমি
সৃষ্টি করে দৃষ্টিবিভ্রম
মেঘ আর গাছ সরে এসে
ঢুকে পড়ে আয়নায়

খিদের অভাব
মাংসের
অনুপস্থিতি হলো
ভালোবাসার আরেকটি বর্ণনা
এই হলো সেই আধুনিক প্রেমের পদ্য


অনেক কাজের ভিড়ে

অনেক কাজের মাঝে
খুব জরুরি
আমি ভুলেই গিয়েছিলাম
এটাও খুব দরকারি

মরে যাওয়া

অকিঞ্চিৎকর
আমি এই বাধ্যবাধকতাকে অবহেলা করেছিলাম
অথবা একে পূরণ করছিলাম
হেলাফেলার সঙ্গে

আগামীকালের শুরুতে
সবকিছু বদলে যাবে
বিজ্ঞতার সঙ্গে আশা নিয়ে
সময়ক্ষেপণ না করে
আমি নিষ্ঠার সঙ্গে মরে যাওয়া শুরু করবো


দেবদূত বিষয়ক হোমওয়ার্ক

পতনোন্মুখ
দেবদূত

কিশলয়ের সঙ্গে
সাদৃশ্যময়
অ্যাবাকাস
বাঁধাকপির পাতগুলি
কালো চালের জন্যে ধুকছে
শিলাবৃষ্টির সঙ্গে মিল আছে এদের
লালবর্ণে আঁকা
নীল আগুন
সুবর্ণময় জিভ

পতনোন্মুখ দেবদূত
পিঁপড়ের সঙ্গে সাদৃশ্যবাচক
চাঁদ ঢুকিয়ে দেয়
মৃতের শরীরে তার সবুজ নখ

দেবদূতেরা স্বর্গে
সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত কিশোরীর
উরুর ভেতর অংশের সঙ্গে সাদৃশ্যময় স্বাদু

তারা ঠিক নক্ষত্রের মতো
লজ্জাজনক স্থানে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকে
তারা ত্রিভুজ আর গোলকের মতো বিশুদ্ধ
তাদের ভেতরটা যদিও
কঠিন

পতনোন্মুখ দেবদূত
শবগৃহের খোলা জানালার মতো
গরুর চোখের মতো
পাখির কঙ্কালের মতো
ভেঙেপড়া বিমানের মতো
মৃত সৈনিকের ফুসফুসে বসা মাছির মতো
শরতবৃষ্টির সুতার মতো
উড়ন্ত পাখির বদ্ধ ঠোঁটের মতো

রমণীর হাতের তালুতে
লক্ষ দেবদূত
পরিভ্রমণরত

তবে তাদের কোনো নাভিকুণ্ড নেই
সেলাই মেশিনে তারা শাদা পালে
টাইপ করে চলে আকারে দীর্ঘ এক-একটি কবিতা

তাদের শরীর হয়তো কোনো অলিভ গাছের কাণ্ডে
কলমের মতো করে ফের জন্ম দেয়া যাবে

তারা ছাদে ঘুমায়
তারা ফোটায় ফোটায় ঝরে পড়ে


জীবনের মধ্যপর্বে

পৃথিবীতে কেয়ামত আসা আর
আমার মৃত্যুর পর
দেখলাম জীবনের মধ্যপর্বে আমি দাঁড়িয়ে আছি
আমাকেই আমি সৃষ্টি করেছি
গড়ে নিয়েছি এই জীবন
মানুষ পশু প্রাকৃতিক দৃশ্য

আমি বলছি, এটা একটা টেবিল
একটা টেবিল
টেবিলের উপর সটান শুয়ে আছে রুটি ও একটা ছুরি
ছুরির কাজ হচ্ছে রুটি কাটা
মানুষ এই রুটি দিয়েই নিজেদের ঋষ্টপুষ্ট করে

সবারই মানুষকে ভালোবাসা উচিত
রাত্রি আর দিনের কাছ থেকে আমি এটাই শিখেছিলাম
একজন মানুষের কী কী ভালোবাসা উচিত

একজনের প্রশ্নের উত্তরে এই কথাগুলোই বলেছিলাম


ফেরা

হঠাৎ করে খুলে যাবে জানালা
মা ডেকে বলবেন
ঘরে ফেরার সময় হয়েছে

দেয়াল যাবে খুলে আর আমি
কাদামাখা জুতা পায়ে প্রবেশ করবো বেহেশতে

এরপর টেবিলের কাছে সরে আসবো
কোনো কথা জিজ্ঞেস করলে রেগেমেগে উত্তর দেবো

আমি ভালো আছি একা থাকতে
দাও। মাথায় হাত দিয়ে আমি
বসে থাকবো অপেক্ষায়। কেমন করে তাদের বলি
সেই দীর্ঘ
আর জটিল পথের কথা

এখানে এই বেহেশতে মা
বুনে চলেছেন সবুজ স্কার্ফ

চারদিকে মাছির মধুর গুনগুন

ছ’দিন একটানা কাজ করার পর
বাবা চুলার কাছে ঘুমঘুম চোখে ঢুলু ঢুলু

না, একেবারেই আমি তাদের বলতে পারবো না
মানুষ একজন আরেক জনের গলার
কাঁটা হয়ে আছে


বেঁচে যাওয়া মানুষ

আমার বয়স চব্বিশ
আমাকে কসাইখানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল
কিন্তু বেঁচে গেছি।

নিচের কথাগুলো শূন্যতার সমার্থক:
মানুষ আর পশু
প্রেম আর ঘৃণা
বন্ধু আর শত্রু
অন্ধকার আর আলো।

মানুষ আর পশুকে একই পদ্ধতিতে হত্যা করা হচ্ছিল
আমি এটা দেখিনি:
টুকরো টুকরো করে কাটা মানুষে বোঝাই সব ট্রাক
ওরা রক্ষা পায়নি।

আদর্শের কথা শুধুই কচকচি:
সদ্গুণ আর ষণ্ডামি
সত্য আর মিথ্যা
সুন্দর আর কদর্য
সাহস আর ভীরুতা।

সদ্গুণ আর ষণ্ডামিকে একই পাল্লায় মাপা হয়
আমি এটা দেখিনি;
মানুষ একই সঙ্গে কী করে
ষণ্ডামি আর সদ্গুণের অধিকারী হয়।

আমি একজন শিক্ষক ও গুরুজিকে খুঁজছি
হয়তো তিনি আমার দৃষ্টি আর বাচনের ক্ষমতাকে আবার ফিরিয়ে আনতে পারবেন
হয়তো তিনি আবার বস্তুর নাম ও আদর্শকে
অন্ধকার আর আলোকে আলাদা করে শিখিয়ে দিতে পারবেন

আমার বয়স চব্বিশ
আমাকে হত্যা করার জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল
কিন্তু আমি বেঁচে গেছি।


প্রুফ

মৃত্যুকে সংশোধন করা যাবে না
কবিতার একটা পঙ্‌ক্তিকেও নয়
ওই নারী কোনো প্রুফরিডার নন
তিনি কোনো সহৃদয় সংবেদী
মহিলা সম্পাদকও নন

একটা বাজে উপমা চিরজীবী হয়ে টিকে যেতে পারে

ঘিনঘিনে পোশাক পরা কবি যিনি মারা গেছেন
তিনি তো জবুথবু মৃত এক কবি

যিনি বিরক্তিকর তিনি মৃত্যুর পরেও বিরক্ত করেন
যিনি হাঁদারাম তিনি তো কবরের ভেতর থেকেও
বকবক করতেই থাকবেন

————————————-

আরও কয়েকটি কবিতা
(অনুবাদ – সৌম্যশঙ্কর মিত্র)

[তাদেউজ রজেভিচ (Tadeusz Rozewicz
এখানে তাঁর কয়েকটি ছোট কবিতার, যেগুলো পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে লেখা, ইংরেজী অনুবাদের বাংলা রূপান্তর দেওয়া হলো ।
পোলিশ ভাষা জানা নেই তাই ছন্দটা অনুবাদকের আরোপিত।]

অনেক পাগল দেখেছি জীবনে আমি

অনেক পাগল দেখেছি জীবনে যারা
হাঁটতে চেয়েছে মাঝদরিয়ার জলে
নিজবিশ্বাসে অটল থেকেই তারা
ডুবেছে আঁধার হিমসাগরের তলে৷
তারাই নাড়ায়-ঝাঁকায় সারাক্ষণ
আমার ছোট্ট অনিশ্চিৎ এ ভেলা
নিষ্ঠুর আমি টিঁকে থাকি প্রাণপণ
সরিয়ে তাদের কঠিন হাতের ঠ্যালা
সম্বৎসর ছাড়াই তাদের মরণ-আলিঙ্গন৷

ভীতি

তোমার ভীতি সে অসীম শক্তিশালী
জন্ম নিয়েছে অস্তিত্বের অধিবাদী চিন্তাতে
আমার ভীতি সে ছোটখাটো করণিক
হাতে পেটমোটা কালো চামড়ার ব্যাগ
সাথে ফিতে বাঁধা ধূসর রঙের ফাইল
আর হলুদ কাগজে ছাপানো প্রশ্নাবলী
জন্মেছিলাম কবে এই ধরণীতে
কারা দিয়েছিলো আশ্রয় খাওয়াপড়া
কী কাজ এখনো হয়নি আমার করা
কী ব্যাপারে আজো রয়েছি অবিশ্বাসী
এখানে এখন কী করছি আমি ঠিক
কবে আমি ভান করাটা করবো ত্যাগ
এরপর আমি কোথায় চাইছি যেতে ৷

সৌভাগ্য !

কী সৌভাগ্য এখনও কুড়িয়ে পাই
জঙ্গল থেকে লাল পাকা টোপা কুল
ভেবেছিলাম যে নিষ্ফলা সব জঙ্গল নির্মূল৷
কী সৌভাগ্য শুয়ে থাকতেও পারি
স্নিগ্ধ শীতল গাছের ছায়ার কোলে
ভেবেছিলাম যে ছায়া নেই বনতলে৷
কী সৌভাগ্য রয়েছি তোমার কাছে
হৄদয় আমার কাঁপছে যে থরো থরো
ভেবেছিলাম যে হৄদয় নেইকো কারো৷

মৃতদের পুনর্বাসন

মৃতদের ঠিকই মনে আছে আমাদের
ভাবলেশহীন উদাসীন মুখগুলো
মৃতদের ঠিকই মনে আছে আমাদের
নিশ্চুপ থাকা দুই কানে গুঁজে তুলো
মৃতদের ঠিকই মনে আছে আমাদের
অতি সাবধানী কথার উচ্চারণ
মৃতদের ঠিকই দেখা আছে আমাদের
নাকের তলার দেঁতো হাসি প্রাণপণ
মৃতেরা দেখেছে আঁখি মেলে আমাদের
ঘনিষ্ট প্রেমে শরীরের ঘষাঘষি
মৃতের শুনেছে কান পেতে মন দিয়ে
সব জিহ্বার ছড়ানো বাক্যরাশি
মৃতেরা পড়ছে আমাদের লেখা বই
শুনছে পুরোনো বাসি কথাগুলো ফের
যাচাই করছে বক্তৃতা সকলের
আগের দিনের তর্কে আনতে গতি
ঢুকে পড়ে তারা না নিয়েই অনুমতি
মৃতেরা দেখছে আমাদের হাতগুলি
ঊর্ধ্বে উঠেছে বাজাতে যে করতালি
মৃতেরা দেখছে ময়দানে জমায়েতে
বহুকন্ঠের ঐকতানের-উপাসনা সংগীতে
ছন্দে বাজছে দায় এড়ানোর সুর

জীবিত সকল মানুষই তো অপরাধী
যে সব শিশুরা হাতে দিয়েছিল তুলে
স্তবক—সাজানো সদ্যস্ফুটিত ফুলে
তারা অপরাধী, অপরাধী প্রেমিকেরা
যারা পলাতক মহাঅপরাধী তারা
পালায়নি যারা তারাওতো অপরাধী
অপরাধী তারা যারা রাজি হয়েছিল
গররাজি যারা তারাও সমপরাধী
অপরাধী তারা যারা নির্বাক ছিল

মৃতেরা এখন হিসাব নিচ্ছে জীবিত মানুষদের
মৃতেরা দেবেনা আর কোন জমি ছেড়ে
পুনর্বাসনে আমাদের।

আমার কাব্য

আমার কাব্য কিছুই পারেনা বোঝাতে
কোনো ঘটনারই ব্যাখ্যা দিতে সে অপারগ
সে তো কখনোই সাজেনি কথামৃতে
পারেনি ঘটাতে সার্বজনীন যোগাযোগ
জাগায় না সে জীবনে নতুন আশা
পুরোনো খেলায় আনেনা নতুন রীতি
হয় না সে কারো খেলার সঙ্গীসাথী–
শুধু এককোণে আছে তার ছোটবাসা
সেই দাবীটুকু মেটানোই তার দায়
যদি তার মুখে না ফোটে সান্ধ্যভাষা
যদি ছিরিছাঁদ নিঃস্ব স্বকীয়তায়
যদি সে কাব্যে না ধরে চমকনেশা
মানতেই হবে এমনই হবার কথা
মানবেই কবিতারা—নিজস্ব প্রয়োজন
নিজ পরিসর নিজ সীমা সমঝোতা
নিজের কাছেও সদা পরাজিত মন
অন্যকাব্যে রাজী নয় ঢুকে পড়তে
পোষাক বদলে সাজে না অন্য সাজে সে
নিজেকে যে মেলে দিয়েছে সে নিঃশর্তে
রহস্যহীন সহজ ও সাদামাটা যৎসামান্য সে
তবু তারও কিছু ইপ্সিত কাজ আছে
যেগুলো কখনও পারেনি যে শেষ করতে ।।

ভালোবাসা-১৯৪৪

আবরণহীন অসহায়
ঠোঁটের উপর রেখে ঠোঁট দুজনের
খুলে রেখে দুই শঙ্কিত জোড়া চোখ
আর কানখাড়া করে শুনতে শুনতে সব
আমরা চলেছি ভেসে
পার হয়ে এক
অশ্রুর আর শোণিতের অর্ণব।

————————————————-
[ সংগৃহীত ও সম্পাদিত]
ঋণ স্বীকার-
১). মাসুদুজ্জামান (arts.bdnews24.com)
(এখানে অনূদিত কবিতাগুলোর উৎস বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং জে. ডি. ম্যাকক্লাচির সম্পাদিত দ্য ভিনটেজ বুক অফ কনটেমপোর‌্যারি ওয়ার্ল্ড পোয়েট্রি (১৯৯৬) থেকে সংগৃহীত) –
২).সৌম্যশঙ্কর মিত্র (জল্পের পুরোনো সংখ্যা থেকে – জল্প প্রকাশ -বইয়ের তাক (জল ত্রয়োদশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *