পিঞ্জরে বসিয়া শুক (Pinjare Bosiya Shuk) : 03
আমরা জানি সকালে বিকালে সাঁওতাল পরগণা, তথা জঙ্গল মহলের প্রায় স্থান, বিশেষত রিখিয়া, অভাবনীয় রূপ ধারণ করে–ইহার যে কোনও স্থানে দাঁড়াইলেই, এই বিশ্বাস হইবেই, যে মানুষের বড় কাছে দূরত্ব সকল; তাই সকালে এখানে রেখাব খেলিয়া উঠে, কেননা অমরতার দেখা দিবে, সন্ধ্যায় শুদ্ধ ষড়জ জাগর হয় কেননা অমরতা এখনই আসিবে; শুকতারা আশ্চৰ্য্য হরিণ যেমন বা।
ইহার আকাশে চির ব্রাহ্মণ্য, মৃত্তিকা বিস্তার হয় উৎসবময়ী ফোয়ারা! এমনই বৈচিত্র্যের মধ্যে সকালে চেঞ্জাররাই ভ্রমণে বাহির হয়, বস্তু সমুদয় কিছু অবাক মুহূৰ্ত্ত হইয়া উঠিতে থাকে, ভ্রমণকারীরা তাহার সেই মুহূর্তের সহিত করমর্দন করে।
সুঘরাইও মনিব মহাশয়েদের সহিত রিখিয়ার হাট পার হওয়ত উত্তরে হিরণার টিলায়, এখানে হাওয়া বড় বেশী, এখানে মনিবরা আঃ বলিয়া উঠিলেন।
মনিব মহাশয় তাঁহার পাইপে মিকচার ভরিতে থাকিয়া কহিলেন,–দেখ, ফাঁকা কথাটি এই স্থান সম্পর্কে যথার্থ নহে, ইহা আরও কিছু, কোন স্রোত এখানে নাই ফুল নাই–এখানে আমরা আবার নূতন–স্লেট আমাদের পরিষ্কার। এ স্থান এমনি যে, যে এই হিরণার টিলা এমনি যে ইহার জন্য সহজেই আমি তোমার শয্যা ত্যাগ করিতে পারি।
মনিব পত্নী ঐ বাক্যের প্রতি কোনমতে চাহিলেন,–উহা কঠিন উহা আমোদের!–এই জন্য কোনমতে যে, ইদানীং তিনি কশ্চিৎ নীল পালকের হাওয়াতে ভর করত নামিয়া আসা দেখিতে আছিলেন, তাই চক্ষুযুগতে, যাহা পান ও গুবাককে সংজ্ঞাতে পরিণত করিয়াছে, মৎস্যকুমারীর গল্পর সংযম যাহাতে থাকে এবং উনি উৎসাহিত ছিলেন, যে, আঃ কে জানিত ঐ পালকে মদীয় নির্ভরতা থাকিবে।
আর যে সেই আশ্বাসে হৃদ্বয় সটান, এখন কহিলেন,–আহা বেচারী পালকটা! দেখ দেখ পালকটা, কি সুদোর! ইহা প্রকাশিতে তাঁহার দেহলতা এরূপ কম্পিত তিনি যেমন বলিয়াছেন–এমন একটি নীল আসন হয়…যাহাতে বসিয়া শ্রীশ্রীমা জননীকে ডাকি (স্বর্ণমৃগ দর্শনে সীতা স্বভাবত এইরূপ বলিয়াছিলেন); অথবা এখন সন্ধ্যা হইবে, শঙ্খ বাজিবে তাই।
স্বামীর কথা তাঁহার কানে ছিল, উত্তর করিলেন,-ব্রাকেটে উচ্চৈঃস্বরে (!) হাস্যধ্বনি! এবং বুঝলুম মশাইয়ের আমার উবরি মমতা অঢেল! এখন এই নীল পালকটার জন্যেই আমার মনে হচ্ছে…এ জায়গাটা বড় আত্মীয় সমান!
এমত সময় একদল সাঁওতাল সারিবদ্ধভাবে ঐ টিলা অতিক্রম করিতে ক্রমে উঠিল, তাহারা নির্জন প্রবাহ, তাহারা অদ্ভুত, পায়ে চলিতেছে, তাহারা তাঁহাদের ইতিমধ্যে দিয়া যায়, ইহাতে তাহাদের মধ্যে এক আজব আড়াল সৃজিত হইল, সম্ভবত এই ক্ষণিক বিচ্ছেদ হওয়ার জন্য ভবিষ্যতে কখনও তাঁহারা উৎকণ্ঠিত হইবেন।
এখন সাঁওতাল দল তাঁহাদের দুজনকে দুজনের কাছে স্পষ্ট করিতেই, দুজনেই চমৎকারভাবে হাসিয়াছিলেন, চেনা-মানুষকে দেখার হাসি যাহা! এবং ইহার অবিলম্বেই, খানিক ইহাতে সলজ্জ মনিব পত্নী স্বভাবতই সুঘরাইএর কারণে এখানে সেখানে দৃষ্টিপাত করিলেন; দেখিলেন সাঁওতাল দলের লাইন এবার বাঁকিয়াছিল; এবং শনৈঃ সানোয়ার পথে নামিতেই খাঁচা-হাতে সুঘরাই প্রতিবিম্বিত হইল, ইহা এক দৃশ্য বটে!
মনিব পত্নী তাহারে দেখিয়া বিস্ময়ে কহিলেন, ও মা তুই ওখানে, আমরা ভেবে মরি!…দেখ দেখ। ছোঁড়া যেন সদ্য জঙ্গল! সুঘরাই তখনও সেইভাবে আছে, তাহাতে মনিব পত্নীর সাধ হইয়াছিল, চেঞ্জারদের মত বলিয়া উঠিবেন, কি গ্র্যাণ্ড দেখাচ্ছে না! কিন্তু ইহাতে, ত্বরিতে আগাইয়া-র (গ্রাম)…বাবুর বাড়ী আগত মোক্ষদা ঘোষালের গিন্নীর কণ্ঠস্বর জিহ্বায় থমকাইল, যাহা মনিব পত্নী শুনিয়াছিলেন।
নিজ বাড়ীর উঠান হইতে মোদাবাবু, ইনি সদাশিব তুল্য, ইহার বক্ষঃদেশে নস্যর দাগ, হাতে একটি নস্য-মলিন ন্যাকড়া, ডাকিলেন,–চাঁপার মা শুনিতেছ! বলি ও গো শীঘ্রই আইস একবার।
চাঁপার মা অর্থাৎ ঘোষাল গিন্নী মনিব পত্নীর সহিত গল্প থামাইয়া,–যাই ভাই একটু ঝাঁকি দর্শন দিয়া আসি, বলিলেন।
এসময় পুনরায় মোদাবাবুর কণ্ঠ পুনরপি ধ্বনিত হইল,উহারেও লইয়া আইস…।
ইহারা দুইজনে উঠানে যাইতেই, মোদাবাবু ধ্যানঘন আবেশে অঙ্গুলি নির্দেশে ব্যক্ত করিলেন, দেখ দেখ কি গ্র্যাণ্ড! এবং তাঁহারা দেখিলেন মাকড়সার জালে জল-বিন্দু!
ইহা দেখিতে ঘোষাল গিন্নীর আশ্চৰ্য্য যে ঘোমটা স্খলিতই ছিল, তাঁহার কণ্ঠলগ্ন দশ ভরির পাটি-হার কিছু অস্থায়ী, এই পাটি-হার এখনও পাটি-হার আছে! ঘোষাল গিন্নি বলিয়াছিলেন, লোকে আমায় কত বলিয়া থাকে, ভাঙ্গিয়া অন্য কিছু গড়াও না কেন, কত নূতন প্যাটার্ন হইয়াছে,–আমি বলি প্যাটার্নের মুখে, সখের মুখে, ছাই! এক প্যাটার্ন করিলেই তখন প্যাটার্ন প্যাটার্ন বাই হইবে…স্যাকরা পোড়ারমুখোদিগের গর্ভ ভরাইতে ত জন্মাই নাই…এখনও দুইটি মেয়ে পার করিতে বাকি!
এখন ঘোষাল গিন্নীর স্বর সবিশেষ আপ্লুত, যেমন বা ফোলা, তদীয় মাড়ির আড়া দেখা যায়, জালস্থিত জল-বিন্দু প্রত্যক্ষে কহিলেন,-মাইরী কি গ্র্যাণ্ড না ভাই!
উপস্থিত এই টিলায় মনিব পত্নী সমক্ষে সুঘরাই বিষয়ে, ঐ রূপ ‘গ্র্যাণ্ড’ উক্তিটি বাধা দিল, নিশ্চয়ই ভাবিয়াছিলেন, সুঘরাইএর বিষয়ে মহা বিশ্রী শুনাইবে। ইত্যাকারে তিনি আপন স্বরগ্রামই তুলিয়াছিলেন।
কেননা স্বামী বলিয়াছিলেন, গ্র্যাণ্ড গ্র্যাণ্ড ড্যানচিবাবুরা (ড্যানচিবাবু: আগে চেঞ্জাররা ঐ সব দেশের খাদ্য সামগ্রীর দাম শুনিয়া হাটে মাঠে বলিতেন damn cheap) এমতভাবেই বলে, বেচারীরা বলে যাহাতে মনে হয়, সৌন্দৰ্য কুৎসিতের প্যারডি মাত্র, অদ্ভুত না?
অথচ তিনি এখনও সেই পালক-নির্ভরতা বৃত্তিতে থাকিয়া ছেলে মানুষটিতে মনঃসংযোগ করিয়াছিলেন; এখন সুঘরাই বিশদ, যে বহুদূরস্থিত অভিমানী ত্রিকূট নিঃসঙ্কোচে উহার কাছেতে আসিয়াছে, যে বহুদূর হইতে বন সমারোহ–তাহাও, যে ধান ক্ষেতের ঝরণার শুধু মৃদু-শব্দ-গান ইহাও, যে এবং খাঁচা হস্তে বালকের পশ্চাতে অনেক অনেক লাল পথ সকল ছুটাছুটি করিতে আছে!
আরও যে, দেখা যায়, যে এই সময়েতে সুঘরাই আপন জিহ্বা দ্বারা ছোট করিয়া আপন ঠোঁট লেহন করে। স্রোত উহার বাল্যকাল, ষড়ঋতু উহার ভবিতব্য হয়! যে এবং ঈদৃশ জ্ঞানে এমনও যে মনিব পত্নী নীল পালকটি ভুলিয়াছিলেন কেননা বিশ্বাস এখন হইয়াছিল যে সে বালক নিঃশঙ্কচিত্তে প্রদীপ জ্বালাইতে ও নিভাইতে পারে।
নিরহঙ্কার মনিব মহাশয় পাইপে মৃদু টান দিতে থাকিয়া, সহধর্মিণীর উচ্ছাসহেতু সপ্রশংস প্রবণতায়ে আপনকার প্রিয় ভৃত্যের প্রতি নজরেতেই, এইটুকু তাঁহাতে ঝটিতি খেলিয়াছিল, অভিনবতম ব্রতকথার উদ্দীপনা দেখিয়াছিলেন, যাহার উপচার ঐ পৰ্বতশীর্ষের বৃক্ষপত্র, কেননা সেখানেই প্রথম বৃষ্টি হয়, কেননা সেখানেই প্রথম দিন দেখা দেয়। এই ভাঙা পদটুকু বড় আপনার, যে ইহা বড় বৈদিক! আর সম্মুখে সুঘরাই, যে আর তাঁহার চক্ষুদ্বয় ছোট হইল এবং যে তিনি খুসী সহকারে দমকা উচ্ছল হইলেন,…হা! লাল লা! সন আফ এ বিচ, হারামজাদাকে সত্যি চমৎকার স্পেইলনডি দেখাইতেছে…মিসিং লিঙ্ক! মিসিং…।
মিমি-সিং লিংক!…ও হ্যাঁ হ্যাঁ কৈ?–বলিয়া মনিব পত্নী ঐ সূত্রে সুঘরাইকে নূতন করিয়া বুঝিতে উদ্যোগী, তাঁহাতে অপ্রার্থিত বহু অভিজ্ঞতা সঞ্চারিত হইল: উহার পশ্চাতে কোথাও গেরি, কোথাও হরিৎ, কোথাও বা কমলা রঙ, কোথাও বা চলমান-রঙ অর্থাৎ যাহারা চেঞ্জার তাহারা ভ্রমণ করে; যাহা তাহাদেরই বস্ত্র ছটা!
এবং ঐ সকল রঙ প্রভাবে বিচরণের কালো মহিষগুলিও রঙীন; যে আর যাহাদের ইতঃমধ্যে তীক্ষ্ণ তছনছে হাওয়া–ইহাতে এহেন ছবিতে, তাঁহার বাম আঁখি স্পন্দিত হইল, ক্রমে ইতঃপূৰ্ব্বকার উপলব্ধি হইতে তিনি কোথায় যেন বাঃ বনরাজি যেন সুঘরাইএর গা শুকিতেছে।
তিনি মনিব পত্নী কিয়ৎ অপ্রতিভ যে স্বামীর সংজ্ঞা বোধগম্য হয় নাই, ও বিনীতভাবে প্রকাশিলেন,–সে কি গো আমি ত ছোঁড়াতে শুধু অন্ধকার দেখছি! এই অন্ধকার কথাতে তিনি নিজেই যেন সত্যযুগে, ক্লাসিক পৰ্য্যায়ে চলিয়া গিয়াছেন।
আ! যথার্থ ধরিয়াছ, উহাই ত মিসিং লিংক!
ইহাতে এখন সত্যই মনিব পত্নী বহুদূর নিঃশব্দতায়ে অন্তর্হিত হইয়া থাকেন, যে তথাপি স্বামীর উচ্চারণের রকমে, যে স্পষ্টতই স্বভাবতই অনুধাবন করিলেন, যে তাহাতে-মনিব মহাশয়ের চোখে, মিসিং লিংক প্রাপ্তির কোনও আত্মম্ভরি উদ্বেলতা আহ্লাদ আদৌ ছিল না, বরং তাঁহার চক্ষুর্ঘয় যেমন বা কোন দিব্য বিগ্রহে আকৃষ্ট হইয়া আছে।
ও এ কারণেই তাঁহার পানে মনিব পত্নী এমত নিরীক্ষণরত, যে যাহাতে, যেন ইনি উহারে বুঝিয়া লইতে চাহিয়া কিছু দিন ইহাই যেন বলিয়া চলিয়াছেন যে যথা: সেদিন এই হিরণার টিলায়–এখানে উড়িতে থাকা কতক কাগজ-টুকরা প্রত্যক্ষে তুমি থমকাইলে, চমকিলে, তুমি স্তোভযুক্ত হও, তুমি আতঙ্কিত। ক্রমে তোমার নিরীহ ওষ্ঠ সংপুট স্ফীত হইল, এতই যে তুমি যেমন দারুণ হুঙ্কারে প্রতিবাদে দিচরাচরে দৃষ্টিসঞ্চালন করিয়াছিলে, দূর হইতে জেঙ্গীল পক্ষী তোমার রোষযুক্ত ভাব অনুমানে আমাদের মাথার উপরকার আকাশ অতিক্রম করে নাই, একমাত্র টিলার যে দেবতা–টিলার অন্তর আত্মা যিনি, তোমার ঐ বৈগুণ্যে নির্ঘাত হৰ্ষযুক্ত হইয়াছিলেন।
ততঃ অচিরাৎ তুমি বিপুলতর দাপটে নির্ঘোষিলে,…এখানেও কাগজ! তোমার বাচনভঙ্গিতে চমক আয়রনি, শ্লেষ ছিল; অথচ তুমি শান্ত, অথচ তুমি নাটকীয় ভাবে দাঁড়াইলে, শিশিরবাবু যেমন ফুটলাইটের সমক্ষে, ফলে তোমাকেই তুমি, তোমার ঐ বাচনভাবকে তুমি নির্বাক করিলে, তোমার সবকিছুতে কেমন এক দুৰ্ব্বার খামখেয়ালী-ফের; কিয়দংশে মজার মনে হইলেও, আমি উদ্বিগ্ন, আমি ধন্ধে আছিলাম, যে তোমার মনুষ্যজাত দর্পিত জিহ্বায় ঈদৃশ হাহন্ত বলিয়া উঠিল, যে, এই মহাস্থানের কুমারীত্ব বিনষ্ট হইয়াছে ঐ সকল কাগজের টুকরায় যে ইহার, এই টিলার পুণ্য যা কিছু ইহার গৌরীত্ব অহঙ্কার ধ্বংসপ্রাপ্ত হইয়াছে।
যে আমারে উদ্দেশ করত ইহাই ইঙ্গিত করিলে এবং, যে, হায় তুমি না একদা কামনা করিয়াছিলে– যে এরূপ মহিমার কূৰ্ম্মপৃষ্ঠ জমি কি শান্তরসাস্পদ! কি স্তব্ধতা!–এখানে এক সুবিশাল নয়নসুখ নবরত্ন মন্দির উৎসর্গ করিব-অবশ্য যদি এমন সুকৃতি থাকে, অবশ্য যদি আদিষ্ট হই কখনও কখনও, এখানে শ্রীশ্রীমায়ের মন্দির স্থাপন করিব! কিন্তু এখন এই টিলা ইহা এখন অশাস্ত্রীয় হইয়াছে, এই টিলারে কেহ আর নালিশ জানাইবে না, সাক্ষী মানিবে না…অত্যাশ্চর্য্য যে কেবলমাত্র কাগজটুকরো দর্শনেই তুমি এবম্ভূত মতিচ্ছন্নই!
তোমার সেই অপ্রাকৃতিক বিলাপ বচনে আমি অথৈ-তে, আমাতে যারপরনাই এক পরমাশ্চৰ্য্য ভীতি সঞ্চারিত হয়! যে আর তোমার ঐ দুঃখদশা আমারে বিষণ্ণ মুহ্যমান করিলেক। জানি তুমি ধার্মিক, তুমি অতীব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম, তুমি অভিমানী, কত কত তুচ্ছ কিছু তোমারে হিম করে,…সেই যে সেই মনে পড়ে…সুন্দর মহিমাময় গম্ভীর গভীর খদির বৃক্ষ পূর্ণ আইবুড়া কুজ্ঞটিকাময়ী জঙ্গলে, যেখানে পেচকের আওয়াজে শিকড়গুলি ভয়ঙ্কর, যেখানেতে লতাগুল্মে প্রায়ই হরিণের শিং আটকাইয়া যায়, এহেন সংস্থানে তথায়ে অনেক লজ্জাবতী ও বিবিধ ভূমি গুল্মের কাছেতে, সমক্ষে, এক টুকরা দৈনিক টাইমস কাগজ, সিভার্সের মারমালেড-জার ও সাদা-পিগ মুদ্রিত টিন ও IXL এপরিকট জ্যামের টিন দর্শনে তুমি কি পরিমাণ গ্ৰাম্য, তুমি নিশ্চিহ্ন, তুমি মর্মপীড়িত ম্রিয়মাণ হইয়াছিলে, তুমি তদানীন্তন কালে এক মৌমাছি দেখিলে যাহা ঐ বিকট (!) সংস্থানে পরিক্রমণরত, তাহারে তুমি নির্বোধ বলিলে, তুমি বীভৎস দুষমনী উহাতে দেখিয়াছিলে–তুমি ধার্মিক যেহেতু–অথচ মজার কথা এই হয় যে, তোমার তাঁবুতে ঐরূপ আধারের দোকান সাজান! হায় সেই দিন তুমি ও তোমার প্রিয় বন্ধুদ্বয় (জোসেফ কিরণ। চৌধুরী ও ভবানী সি. বাসু) হরিণের পশ্চাদ্ধাবন হইতে পর্যন্ত বিরত হইলে–সূক্ষ্ম তত্ত্বে তখন তুমি বাণবিদ্ধ, যে তুমি ভক্তিযুক্তমনে চরণামৃত পান কর সেই তুমি…তোমাকে যখন যখন মনে পড়ে আমি কীদৃশী অচিন বালিকা!
ঐ সকল কাগজের টুকরা সকল তখনও এই টিলায় উড়িতে আছে!
আঃ ক্ষণজীবী পতঙ্গ সকল! তুমি সুঘরাইকে এক টুকরা কুড়াইতে নির্দ্দেশ দিলে, টুকরা আনীত হইল,–তাজ্জব, তুমি আজন্ম সংস্কার ভুলিলে, তুমি কি নেটিভ!–আনীত টুকরা পাঠে তুমি অতিমাত্রায়ে বিক্ষুব্ধ, কি এক বেদনা তোমাতে ফুটমান হইতে চাহিল, তোমাতে বাক্য বৈখরী হইল, অথচ কিন্তু ঝাঁপটা হাওয়াতে উহা গোঙানির ন্যায় বুঝায়।
তোমার আদেশে তোমার প্রিয় ভৃত্য টুকরা সংগ্রহে প্রবৃত্ত হইল, এই স্থান বৃহৎ হইল, যে অন্যপক্ষে আমি স্ত্রীলোক মাত্র–সতত পৃথিবীরে দোষারোপ করিতে ইতস্তত থাকি, অবশ্য আমি মদীয় গণ্ডদেশে তর্জ্জনী স্পর্শ করিয়াও করি না, যে এবং তোমার পাইপ সত্ত্বেও আমি বিব্রত নহি, তোমারে আর আমি নেটিভ বলি নাই, আমি শুধু তোমার পাইপের হস্তীদন্তশ্বেত বিন্দু (কোন এক দামী পাইপে এইরূপ থাকে) নিষ্পলকে দেখি; যে সেই ডোম বালক ইতঃমধ্যে মহাউৎসাহে ছুটিয়া ছুটিয়া কাগজ সকল কুড়াইতে আছে, এ দৃশ্য ভয়ঙ্কর, ঐ দৃশ্য বিশ্রী! যে তাহার আদরের তিতির পাখীটি এখন খাঁচা ছাড়া উহাও মহা আমোদে তাহারে অনুসরণ করে ক্কচিৎ কখনও বা উড়িয়া কখনও পদব্রজে।
এ দৃশ্য দারুণ খেলা।
যে তুমি দুচারখানি টুকরা পাঠে ইহাই পড়িলে, ল্যভ লেটাঃ! আশ্চৰ্য্য ঐ কথার কোন প্রতিধ্বনি ছিল না। মেঘ সকল নিঃশঙ্কচিত্ত ছিল।
এবার তুমি যখন অস্পষ্টভাবে উচ্চারিলে ল্যভ লেটাঃ কিছু প্রতিধ্বনি শ্রুত হয়, যেই না তুমি নিরীহ শিশুকণ্ঠে ঘোষিলে ল্যভ লেটাঃ! এইবার দিকে দিকে সেই শব্দ প্রতিধ্বনিত হইল। শিশুস্বর নিবন্ধন উহাতে শ্লেষ ছিল নাই। আশ্চর্য মেঘ অপসারিত হইল, আমরা দুইজনে দূরে দূরে অজানিতেই অসহায়ভাবে নয়ন ফিরাইলাম, আমরা (?) বহুদূরাগত গন্ধসমূহ পাইলাম, যে এবং দুর্জয় অপরিমেয় অতুলনীয় ঘ্রাণশক্তি ক্রমে বহু যুগের অতীতের স্বর শুনিলাম! এক প্রমত্ত জোয়ান কাব্যবীজ! দুস্তর গোপনতা ভাঙ্গিয়া যাহা আসিতে আছে।
অতঃপর তুমি টিলার দিকে পুনৰ্ব্বার অবলোকন কর, তুমি সম্বলহীন! তবু আদৃত ভাবে এখানে সেখানের পারিপার্শ্বিকতার কত গাছ, কত লতা, ধূলা উড়া হৃদয়ঙ্গম করিলে…যে ও তুমি কেমন যেমন ব্যর্থতায়, ইহাতে যে আমি মা জননীকে স্মরণ করিতেছিলাম। তুমি মথ-এর (পতঙ্গ) তুল্য নিৰ্ব্বিকার, দারুভূত আছিলে!
তৎকালে আর সেই বালক কখনও কখনও তাৎপর্যপূর্ণ জিগীর দিতে থমকায়, কখনও আপনারে ধিক্কার দিতে আছে, কখনও বা হঠাৎ উৎফুল্ল, এই যে আর এক খণ্ড! আর এক খণ্ড! পুনরপি আর এক।
খোঁজে তোমার ঘ্রাণশক্তি, যাহা মানুষে কথঞ্চিৎ, তাহাই ক্রমবর্ধমান হইতেছে।
আবার পরিলক্ষিত হয়, বালকের ঘোট হাতখানি–সে নিজ ঢালু নিম্নে থাকার কারণে মানে তাহার শরীর দেখা যায় না!–এখন ওতপ্রোত এই বিরাট নশ্বরতার মধ্যে ফাঁকার মধ্যে উচ্চাইয়া উজাইয়া উঠে। তিলেক বাদেই সে ছুটিয়া আসে, যেমন তদীয় পক্ষী যেমন পোকা ঠোঁটে দৌড়ায়–খুব সাদা সাঁওতাল গীতের লাইনের ব্যঞ্জনা যেমত বা।
আর যে তুমি ঐ সকল সংগৃহীত টুকরা সুদক্ষ প্রতিভাধর মণিকারের ন্যায়, পরীর গল্প রচয়িতার প্রায়, বিচক্ষণতায়ে কাজল-টানার যতনে, সাজাইতে বসিলে প্রত্যেক খণ্ডে নুড়ি চাপা দিলে, এবার তুমি অধিকতর চাতুর্যে নির্মাণ করিতে লাগিলে ইত্যাকারে যে,–চিঠি সুবাসিত!
সম্ভবত খোঁপায় ছিল…উঁহু তৈল চিহ্ন নাই! ব্লাউজের অন্তরে, বুকের ঘামে অক্ষর তাই নির্ঘাত আর্দ্র-হওয়ত ছাত্র…মানে কিছুক্ষণ আগেই অর্থাৎ সদ্য ঘেঁড়া…এই চিঠি প্রথম না, কিছু উত্তরের পর…পুরুষের হস্তাক্ষর। পুরুষেরই…!
ও! প্লেটোনিক…..
ফ্যা…ব্রাউন ও নিশ্চয় ফ্যানী হইতেই হইবে…কলেজের কোন ছোকরা…বেশ কথা ভালবাসিতে চাহিতেছে আর মেয়েটি বোধ হয় লিখিয়াছিল…বিবাহিতা? হয়ত না! শেলীয়ান হাইটের তোড়…চমৎকার পেগানাইজ!
আঃ শেলীয়ান হাইটেও ইহা নূতন peganisation.
যে এবং এই পর্যন্ত বলিয়া তুমি আমার প্রতি নেত্রপাত করিলে।
আমি অসহিষ্ণু হইলেও তোমার ব্যবকলনে (deduction) খুসী, অবশ্য হোমস-স্মরণে (শার্লকহোমস) সমগ্র ব্যাপার শুদ্ধ করিয়া নহে বরঞ্চ তোমার এতাদৃশ বৈচিত্র্য আমার এমনিতেই বেশ লাগিতেছিল–নিশ্চয়ই আমিও কোন ঘঘারে ছিলাম!
এখন তুমি স্নায়ু-বিধ্বস্ত কেন না চিঠির মধ্যে ফাঁকা–খানিক স্থান টুকরাবিহীন–সেখানে টিলার জমি গর্জন করিতেছিল, পোকা, ঘাস, ফুল উদ্ধৃত, এই ফাঁক নিরখিয়া তুমি জড়, থ, তুমি আধ্যাত্মিক!
যে ঝটিতি ব্যক্ত করিলে, আঃ নিষ্ঠুরতা! পত্রলেখক এক বীভৎস নিষ্ঠুরতা প্রত্যাশী-হন্যে! নিষ্ঠুরতা তাহার স্বর্গ! ইহার পর তুমি প্রচণ্ড প্রসারিত, রিখিয়ার সভ্যতার দিকে ব্যর্থতায় তাকাইলে ‘আঃ রিখিয়া’ বলিয়া এবং যে তুমি মহাশক্তিতে শ্বাস গ্রহণ করিলে যাহাতে বহু দূরস্থিত বৃক্ষলগ্ন পরগাছা চমকিত হইল।
শনৈঃ যে আরও যোগ দিয়াছিলে…মনে কর পেগানাইজেশনের তোড়ে দুজনেই দুই জনকে, একে অন্যরে, কীদৃশী ভয় পাইতে চাহে! সমস্ত অস্তিত্ব কণ্টকিত!
আর আমারে জিজ্ঞাসিলে, না না আমার সায় প্রত্যাশায়ে কহিলে…কেন মানুষ এতেক নিষ্ঠুরতা চাহে…নিষ্ঠুরতাই কি প্রেমের মৃত্তিকা…একের নিষ্ঠুরতা ক্ষয় করিবার চায়…অনৈসর্গিক মরালিটি…ফুলের ঘায়ে যে মূর্হিত এখন সে দলিত হইতে প্রস্তুত!
এবং ঐ সময় সুঘরাইএর পক্ষীটি তোমার চিঠি সাজানর নিকটে পাছে উহা ভাঙে তাই তুমি তাহারে হেই বলিয়া তাড়া দিয়া আরবার মন্তব্য করিলে যে,…অবশ্য ইহাতে আমি মনস্তত্ত্বর যুক্তি বলি নাই।
তোমার উক্ত বাক্যালাপ আমার নিকট ঝাঁপসা অবশ্যই তাই বলিয়া আমি হেঁয়ালী নামে উহা সকল দূরে ঠেলি নাই–যেহেতু তখন আমি সন্ধ্যাকালীন শঙ্খের আওয়াজে অন্যমনস্কা, অবশ্য তোমার ঐ শেয়োক্তিটিতে আমার বারম্বার মনে হইতেছিল যে তুমি, শঙ্কা হইতেছিল যে তুমি, এখনই ললাটাঘাত বিষণ্ণতায় বলিবে, আঃ মনুষ্যজাতি! অবশ্যই নিরাশার যে উহা, ঐ কথা, অবশ্য বাবার (মনিব পত্নীর শ্বশুর) গলার স্বর ঐ ব্যঞ্জনায় নাই, তবু বাবার মতই বলিয়া উঠিবে আঃ মনুষ্য জাতি!
আঃ বাবার হাতে কি অমোঘ পরমায়ু! তাঁহার হাত ট্যালকের গুঁড়ায় কি অদ্ভুত অশরীরী–কি সাদা! হাতে ম্যাগনিফাইং গ্লাস, হাতে খোলামকুচি! হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়ে বাবা একবার বলিয়াছিলেন, অসট্রাকন! এক টুকরো খোলামকুচিতে কি বিদ্বেষ, কি অট্টহাস্য, সঞ্চিত ক্ষোভ।…আবার একটুকরাতে কি হদিশ, এমন একরেখা মোটিফ, এমন এক নিরবচ্ছিন্নতা…মিসিং লিঙ্ক! আর মনুষ্য জাতি!–
ইহা বলিতে থাকিয়া বাবার চক্ষুর্ঘয় আশায় বিস্ফারিত, আর তুমি আর এক, সেদিন তদ্রূপ উপলব্ধিতে আমি যথার্থই অশান্তিতে ছিলাম, আবার ইহাও যে, সন্দেহ হইতেছিল যে তুমি রহস্যপ্রিয়, যে কোন মুহূর্তই চমক দিয়া হা-হা হাসিতে আমাকে অপ্রতিভ, আমার রমণী স্বভাবকে অপদস্থ করিতে পার!
এখন, আজ উপস্থিত আপনার স্বামীকে সম্যক বুঝিবার চেষ্টা হইতে বিরত হওয়ত ইনি কপট বিরক্তি প্রকাশে তর্ক করিলেন,…আহা বললেই হ’ল কোথায় ঐ চোর চোর দেখতে ডোম ছোঁড়ার মধ্যে তোমায় সেই যে বলছিল–এবং ইহার সহিত প্রধান শিক্ষয়িত্রীর ধারায় বলিলেন,–একশোর মধ্যে জিরো…যাও!
কিন্তু পরক্ষণেই মনিব পত্নী আত্মস্থ হইলেন কেন না তাহাতে আভাসিত ইহা যে, সেই দিনকার সেই চিঠির টুকরার পাশে বসিয়া তাহার প্রেমাস্পদ স্বামী নিজ ভাবুকতার সূচনা করিয়াছিলেন, যথা…ধর…অবশ্য বলা যায় কোন এক অলিখিত অপেরার মহতী দৃশ্য…হয়ত তোমার মনে হইবে বড় খুকু কল্পনা…তবু…একদল স্টেজের অন্তে আসিল, অঙ্গুলিনির্দেশে খণ্ডিত পত্র সকল দেখাইল, তাহারা ক্রন্দিত নয়নে কুড়াইতে লাগিল, এই রূপ কুড়াইতে, হাত বহুবার চকিয়াছে এক এক খণ্ড চমকপ্রদ মনোভাব প্রকাশিয়াছে, কখন বা মসৃণ হাতকে ভ্রমবশত, যে উহা পত্র-খণ্ড, কতবারই না একে অন্যের হাত কেহ ধরিয়া থাকে।
খণ্ডিত পত্র সকল উড়িতেছে, দ্রুত পদক্ষেপে তাহারা আছে এখন তাহাদের বসন চেহারায় যেমন পাথর নির্ম্মিত, এইভাবে ক্রমে তাহাদের বসন পাংশু মলিন বর্ণ ধারণ করিল, তাহারা প্রেক্ষাগৃহের একুসটিকে নূতন বর্ণাঢ্য সংজ্ঞা তথাপি দিল। তাহারা সংগৃহীত খণ্ডিত পত্রগুলির চারি দিকে চক্রবৎ ঘুরিল, এবার তাহারা সজল নয়নে একদা সুমহৎ বৃক্ষের সন্নিধানে গেল, ক্ষমা ভিক্ষা করিয়া লতা ছিন্ন করিল এবং লতা দিয়া পরম রমণীয় এক সাজি নির্ম্মাণ করিল–কি আজব! কি কুহক! বিজোড় না হইলে চুপড়ি আধার অসম্ভব! চুপড়ি টুকরী ধামা–সবই বিজোড় বন্ধন!
তাহারা বেদনায় ঝঙ্কারিল, আমরা কোথাও বিজোড়, আমরা কোথাও বিজোড়! সাজিতে খণ্ডিত পত্রসকল রাখা হইল, এখন তাহারা শোভাযাত্রা করিয়া চলিল; অন্ধকার হইল, তাহাদের হাতে মশাল, তাহারা চলিতেছে দিকাভিমানী দেবতা সকল মুগ্ধ প্রীত হইলেন; তুমুল বরষণ হইল, তাহাদের মশাল নিভিল না, তাহারা ধীরে প্লাটিক (মনুষ্য) অঙ্গের সীমা অতিক্রম করিল, সম্মুখে বনরাজি, ক্রন্দনই তাহাদের নির্ভীকতা, সম্মুখে বনরাজি।
সেই বনস্থলী অলৌকিক, শিশুর হাততালিই এখানে পুষ্প, অপেক্ষমানারনয়নই ফল। এবং তাহারা সেই বনে আনীত খণ্ডিত পত্ৰসকল ছড়াইয়া দিল, বারম্বার কহিল, এই পত্র যদি সত্যযুগের হয় তাহা হইলে শূন্যস্থান ইহার পূর্ণ হউক! বনস্পতি নিশ্চয় শুনিলেন! নিথর বনভূমি! শুধু শ্রুত হইতেছিল সেই বনের পূর্বাঞ্চলে কোন গৃহাভিমুখী কাঠুরিয়ার দল কোন গীতের এক ছত্রই–এখনও অন্তরার বিবর্তন হয় নাই বার বার গাহিতেছে! সকলেই খণ্ডিত পত্র বাহকরা ভক্তিযুক্ত মনে দণ্ডায়মানা, আরক্তিম চোখে প্রতীক্ষায়।
এমত কালে সম্মুখের ঝোঁপ জ্বলিয়া উঠিল।
…অনেকটা তেমনিভাবে…মনে পড়ে যেমন দাবদাহর সূত্রপাত আমরা সেই হাজারীবাগ অঞ্চলে জায়নোফর বনে যেমন দেখি, উঃ কি দারুণ নয় সেই গাইডটা, নির্জন বনের মধ্যে অদ্ভুতভাবে মুখে হাত দিয়া দারুণ প্রলুব্ধকারী ডাক দিতে থাকিয়া হঠাৎ তর্জ্জনী সঙ্কেতে এক ঝোঁপ দর্শাইয়া ফিসফিস্ স্বরে জানাইল, খসখস ফট! শব্দ! শিকার!
আমিও শিকার ভাবিয়া বন্দুক তুলিলাম, পরক্ষণেই সেখানে ধিক ধিক অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হইল, আশ্চৰ্য। ধূমহীন একেবারে…ক্রমাগতই শিখা, গাইড সেইভাবে তখনও তাহার চক্ষুৰ্বয়ে ধন্ধ! আমি জলের বোতলের প্রতি নির্বোধের ন্যায় তাকাইলাম, ইস!…তারপর সেইদিন তোপচাঁচির বাঙলায় আমরা মনমরা, আমরা অবসন্ন…ভাগ্যে সেখানে আশ্চর্য্য যে খাদ্যের পাত্র সার্ভিস সবই রূপার নির্ম্মিত। তুমি সন্দেহে হল-মার্ক দেখিলে, কহিলে নিশ্চয় মেপিন এণ্ড ওইয়েব…বেশ পুরাতন ও লেইট ভিক্টোরিয়ান রৌপ্য।
–আঃ আমরা সেই ওবজে দ’আর (object d’art) পাত্রে ভোজন করিলাম, এসপারাগ্যাস সুপ ভুলিবার নহে, আমরা অনেক অনেক বাড়ী বাসনপত্রের গল্প করিতেছিলাম, তাহার পর, তাহার পর…হ্যাঁ ওইসটার না কি একটা খাইবার সময়…আমি মস্ত হাঁ করি, না না বিশ্রীভাবে চিবাইতে দাঁত দেখা যাইতেছিল, তুমি অবাক হইয়া আমারে সাবধান কর, কাঁটা ছুরির অজস্র শব্দ করিয়া থাকি, তুমি অবাক হইয়া আমায় সাবধান কর। কেননা, উহা ত ঘটিবার নহে।…ওবজে দ’আর-এ আমরা কি সেই দাবদাহ। সূত্রপাত ভুলিয়াছিলাম?…কিন্তু দেখ ভুলি নাই…।
ঠিক তেমনই ঐ বনের ঝোঁপ জ্বলিয়া উঠিল। যাহারা খণ্ডিত পত্র লইয়া আসিয়াছে তাহারা তৎপ্রবর্ত্তীত নতজানু হইল।
প্রজ্জ্বলিত ঝোঁপ হইতে এক কিশোর সুন্দর বনদেবতা দেখিতে সুঘরাইএর মত এক অভিনব চমৎকার ফড়িং দৰ্শাইয়া কহিলেন,–ইহা কি সেই?
তাহারা সভয়ে উত্তর দিল, প্রভু উহা তাম্রবর্ণের যে! তুমি ভাল জান!
তখন বনদেবতা অদৃশ্য হইলেন, কিয়ৎ পরেই তিনি হীরকপ্রভ এক শম্বুক দেখাইলেন, কহিলেন, ইহাই কি সেই?
তাহারা সভয়ে উত্তর দিল,–প্রভু উহা রৌপ্যবর্ণের যে! তুমি ভাল জান!
তখন বনদেবতা অদৃশ্য হইলেন, কিয়ৎ পরেই তিনি এক নবারুণ সদৃশ ক্কচিৎ পান্নার ঘটা গঠিত এক বিচিত্র ক্রৌঞ্চ দেখাইলেন, কহিলেন,–ইহাই কি সেই?
নতজানু সকলে আর্দ্র চোখে উত্তর দিল,–প্রভু তুমি ভাল জান।
বনদেবতাকে দেখিতে ঐ ছোঁড়ার মত!
সেইদিন তখন ঐ মনস্তাপ জাতীয় পরমাশ্চৰ্য্য উপাখ্যান শ্রবণে মনিব পত্নী হাসিয়াছিলেন, অথচ তামাশায়, কেননা যে এতাদৃশ লিরিসিজমকে শোভনীয়তা, ঔচিত্য, মানে বাস্তবতা দানে বহুকাল আগের ততাপচাঁচির ঘটনা উল্লিখিত হইয়াছে, প্রাচীন এক ক্ষোভ বিস্মৃতির কথা যাহা!
তিনি ইহাও সঠিক বুঝিলেন যে ঐ চিঠির ফাঁক স্বামীকে উৎচকিত করিয়াছে, তাই যুগপৎ তিনি, পত্নী, সমালোচনায় বলিয়াছিলেন যে,–ধর তোমার চিঠি মিলানো ঐ কাঁক অনেকটা এমনই মানে। অক্ষমতার ছাড় বা শিল্পীর ছাড় যেখানে তাহারা ভাবিতে পারে না।
মনিব মহাশয় তদ্বিষয়ে উত্তর দিলেন,–আঃ সে শুভ্রতা! সে শুভ্রতা!
আজ এখন সেইদিনকার সেই বালকবৎ ভীরু স্বামীকে স্মরণে অধুনা তীব্র কটাক্ষপাতে প্রতিবাদ করিলেন, মিসিং লিঙ্ক না ছাই পাঁশ…কোথায় ছোঁড়া তেমনটি চেয়ে দেখত…?
সাক্ষাৎ চোর-চোর বুঝিয়া তুমি সদ্য-জঙ্গল দেখিলে কি রূপে তাহা হইলে…।
তখন কেন জানি না জঙ্গুলে বলে মনে হ’ল…। মনিব পত্নী ইহার পর ছেলেমানুষের মত আব্দার করিলেন,–ওগো এইভাবে পোড়ারমুখো ছোঁড়ার তুমি একটা ফটো তুল…ওরে বাবা পালকটা কুড়ো কুড়ো…কিন্তু তোমার কি করে মনে হল?
তোমার মনে পড়ে, সেইবার ঘুটঘুটিয়ার জঙ্গলে পিকনিকে যখন যাই তখন তুমি হুপপী (কাঠ ঠোকরার মত দেখিতে এক রূপ সাদা কাল মিশ্রিত পাখী), দেখিতে চাও আমরা সুঘরাইকে কাজের। সাহায্যে রাখিয়া বহুদুর চানোয়ার তীর ধরিয়া পূর্বদিকে যাই! বেশ সময় বাদে, আমরা যখন ফিরিয়া আসি, তখন তুমি ভৃত্যকে না দেখিয়া উতলা হইয়া যাহারা রান্না তদারক করিতেছিলেন (অনেক চেঞ্জার এই পিকনিকে মিলিত হইয়াছিলেন) তাহাদের তুমি প্রশ্ন কর!
তাঁহারা কেহই, তাহার সংবাদ দিতে পারিলেন না, তুমি বড়ই শঙ্কিত যুগপৎ অপ্রসন্ন যে তোমার অনুপস্থিতিতে কেহ যদি বেচারীকে ডোম বলিয়া ছোট করিয়া থাকে, খেদাইয়া থাকে, রান্নার কাছ হইতে তুমি আমাদের অন্য ভৃত্যদের ও অন্য চেঞ্জার বাড়ীর বালকদের তাহার খোঁজ করিতে বলিলে।
তখন, তাহার নামে বন চমকাইতে লাগিল! অজস্র প্রজাপতি পার হইয়া অনেক গভীরে সেই ডাক প্রচারিত, এমত সময় মূর্তিমানের উদয় হইল, হাতে খাঁচা দেখিয়া তুমি তাহারে চিনিলে! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া জিজ্ঞাসিলে, মুখপোড়া জানোয়ার কোথায় ছিলি…এই ভয়ঙ্কর বন, তোর কি কোন ভয় ডর নেই র্যা…
আজও আমার মনে আছে, জানোয়ার মৃদুহাস্যে উত্তর করিল, মা গো, কোন ভয় করিবেন না, আমার জন্য এখানে–এই দীপ্তিময়ী বনে আপনকার কোনই শঙ্কার কারণ নাই…এবং অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করত কহিল, মাগো জানিবেন, মহতী বনস্থলী আমার গা শুকিয়াছে…।
যে এবং ইহা প্রকাশিয়া সুঘরাই সমস্ত লতা গুল্ম পত্রবিকাশের, পক্ষী রবে ছন্দিত যাহা, ঐশ্বৰ্য্যময়ী যাহা, তাহারই পানে সগর্বে নির্ভীকতায়ে মস্তক সঞ্চালনে দেখে–কি এক অহংতা এখন তাহাতে যে এবং সে কেমন এক শব্দ করিল আর যে সমস্ত বন ব্যাপিয়া নিথর প্রতিধ্বনি ঘটিল।
যে ইহা শ্রবণে তুমি নিশ্চল, এমনও যে ঐ বাক্যে স্বভাববশত স্বীয় কপালে ভক্তিভাবে হাত স্পর্শ করিতে ভুলিয়াছিলে! তখন আমরা দুজনেই হারামজাদার প্রভায় আচ্ছন্ন! অবশ্য অন্যান্যরা সারিবদ্ধভাবে যাহারা তাহাকে আধা ঘিরিয়া ছিল, তাহারা হাস্য করে, কিন্তু হঠাৎ তখনই বৃক্ষ পত্র খসিতে তাহারাও ঈষৎ থ!
শুধু জগুর পিসিমা, তিনি খানিক দোক্তা মুখে ফেলিতে, তাঁহার বাহুতে আড়াই প্যাঁচ সাপ মুখো, সাপটির চোখ চুনীদার, তাগা পরিলক্ষিত হইল, ইনি সাহসে মনিব পত্নীকে সম্বোধনে কহিলেন, ওগো বৌমা, বলি শোন, আমার পঞ্চা যখন পেটে তখন একবার ননদ বাড়ী যাই–তখন তাহাদের ঘাটে একজন একজনকে বলিতেছে শুনিয়াছি, যে সেই বলে না–
গরুর কুটুম চাট্লে চুট্লে
কুকুরের কুটুম শুঁকলে শাঁক্লে
মানুষের কুটুম্ এলে গেলে।
…তা তোমার সুঘরাইএর গাত্র শুকিবে না?…
ইনি সেই জগুর পিসিমা যিনি, ‘…’ নিবাসে-তে আগত চেঞ্জার ঘোষবাবুর পুত্রের, যে ছেলেটি বিশেষত ধরাগলায় নবযৌবনা যাহারা তাহাদের সমক্ষে, সৌন্দর্য্যের স্তুতি করার বহর স্মরণে, বিরক্তিতে বলে যাচ্ছিলেন,–ওমা সেদিন ভোর থাকিতে আমরা, আমি, মিনি, রাধা, নিভা, ইতি, চায়নারে লইয়া সিরিয়ার পাহাড়ে বেড়াইতে গিয়াছি, দেখি, ঘোষেদের সুপুত্র ছোঁড়াকে, আমারে দেখিয়াও, ঘোর কলি কি বলবি মাইরি, কোন হৃক্ষেপ নাই, খালি ব্যাখান…ইহা উহা সব কিছু সুন্দর, আবার বলিল, সঞ্জীববাবু না কে লিখিয়াছেন…ঝাড় মারি! সোমত্ত মেয়ে সব সঙ্গে লাজলজ্জা নেই, আমি বলি ছোঁড়া তোমাকে ছাড়া পৃথিবীটা…মরণ! লোকে আমায় আনকাচ্চার বলে বলুক, এত সুন্দরের কি দরকার!…ও ছোঁড়ার মনে পাপ আছে!
একদা আবার এই পিসিমাই তাঁহার ভাই-বৌ রাধা’র মাকে সঙ্গে লইয়া ‘…’ বাবুর বাড়ী পান্থপাদপ গাছ দেখিতে গিয়াছিলেন। সেখানে বেচারী রাধার মাও সুমহৎ বৃক্ষ সমক্ষে কম্পিত, রোমাঞ্চিত, তাহাতে ভাবান্তর, তাহাতে ঐ রমণীতে রাত্র সমাগত! তদীয় মুখমণ্ডলে আরক্তিম নাসাপুট অতীব জবা হইল, ননদিনীকে কোনক্রমে কহিলেন,…দিদি এই পান্থপাদপ অবলোকনে আমার দেহমনে এক। আলোড়ন সঞ্চারিত হইতেছে, এক অভিনব পুলক ঝাঁপটা দিয়া উঠিতেছে, এমন একটি সুকৃতির সন্তান। আমাতে আসে, সত্যই জন্ম সার্থক হয়! ইহাতে ঐ সরল বাক্যের সহিত রাধা’র মা-র ঘন শ্বাসের শব্দ প্রাচীরে প্রাচীরে লাগিয়াছে।
ইহাতে জগুর পিসিমা ভূতচালিতপ্রায় হাঁ হাঁ করিয়া উঠিয়া ভর্ৎসনায়ে বলিলেন,-ছ্যা ছ্যা মরণ দশা, গাছ দেখিয়া তোমার ভাব লাগিল যে, এই সেদিন না বিয়াইলি, আবার? তাহার শেষেরটির নাম রাখিলে চায়না…আগেরটি ইতি, তারপরও চায় না, আবার?–আর যে ইনি গল্পচ্ছলে পান্থপাদপ সম্বন্ধে এই মত নিম্ন স্বরে ব্যক্ত করেন যে, সত্যই বাপু…গাছটা যেন মরদপানা! এবং ইহা প্রকাশে তিনি বস্ত্র সংযত করার পরে ঘোমটায় ঠিক দিয়াছিলেন।