Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পাহাড় চূড়ায় আতঙ্ক (১৯৮১) || Sunil Gangopadhyay » Page 7

পাহাড় চূড়ায় আতঙ্ক (১৯৮১) || Sunil Gangopadhyay

বরফের মধ্যে ঢুকে যেতে যেতে সন্তু ভাবল, এই তার শেষ। কাকাবাবু আর মিংমা তাকে দেখতে পাচ্ছে না, তার আর বাঁচার আশা নেই।

কিন্তু মানুষ সব সময় বাঁচার জন্য শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে। সন্তুর দম আটকে আসছে, তবু সে পা দুটো বেঁকিয়ে নিজেকে তোলার চেষ্টা করতে লাগল। এক সময় তার মাথা ঠেকাল কিসে যেন। বরফের নীচে নিশ্চয়ই শক্ত পাথর আছে।

তখন সন্তু পায়ের চাপ দিয়ে মাথাটা তুলতে লাগল। সম্পূর্ণ মুখটা যখন বাইরে এল তখন মনে হল, আর এক মুহুর্ত দেরি হলে নিশ্বাসের অভাবে সন্তুর বুকটা বুঝি ফেটে যেত। সে হাঁপাতে লাগল জোরে জোরে।

আদৌ কিন্তু সন্তু বাঁচল না। আলগা বরফের মধ্যে গেথে যেতে লাগল তার পা দুটো। ঠিক যেমন চোরাবালির মধ্যে মানুষ আস্তে আস্তে ড়ুবে যায়। সন্তু চিৎকার করল, কাকাবাবু! মিংমা—

ওরা দুজনে অনেকটা দূরে চলে গিয়েছিল। ডাক শুনে ফিরে তাকাল। দেখে তিনি দৌড়ে আসতে গেলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে ধপাস করে পড়ে গেলেন তিনি নিজেই। তিনি বলে উঠলেন, মিংমা, আমাকে তোলবার দরকার নেই, তুমি সন্তুকে ধরে।

মিংমা। কিন্তু দাঁড়ায়নি। সে দৌড়বার বদলে লাফিয়ে লাফিয়ে এগোতে লাগল সন্তুর দিকে। মিংমা অনেক রকম কায়দা জানে। খানিকটা ঐভাবে এসে সে হঠাৎ শুয়ে পড়ল, তারপর গড়াতে গড়াতে সন্তুর কাছে এসে বলল, সন্তু সাব, হামারা হাত পাকাড়ো।

চোরাবালির মতন জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলেই বেশি বিপদ, তাই মিংমা শুয়ে পড়েছিল। সেই অবস্থায় সে সন্তুর হাত ধরে টেনে তুলল। তারপর দুজনেই গড়িয়ে গড়িয়ে চলে এল দূরে। কাকাবাবুও সেখানে চলে এসেছেন ততক্ষণে।

সন্তু বলল, ক্রেভিস! ওখানে ক্রেভিস আছে, আমি তার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম!

আবার ওদিকে গেলি কেন?

ওখানে একটা ফুলগাছ দেখেছিলাম।

ফুলগাছ? এই বরফের মধ্যে আবার ফুলগাছ আসবে কোথা থেকে?

হ্যাঁ, সত্যি সত্যি দেখেছিলাম। আমি হাত দিয়ে ধরেওছিলাম সেটাকে। তারপর বরফের মধ্যে ড়ুবে গেলাম।

মিংমা বলল, কভি কভি হোতা হ্যায়। একঠো দোঠো গাছ ইধার উদ্ধার হোতা হ্যায়।

কাকাবাবু বললেন, বরফের মধ্যেও এ-রকম চোরাবালির মতন ব্যাপার থাকে? এ তো খুব সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার! কেইন শিপটন তাহলে এ-রকমই একটা কিছুর মধ্যে পড়ে মারা যেতে পারে!

সন্তু বলল, কাকাবাবু, ওটা কিন্তু খুব গভীর নয়। আগে তো আমি উল্টেভাবে পড়েছিলুম, মাথাটা ঢুকে গিয়েছিল, তারপর মাথাটা এক জায়গায় ঠেকে গেল। নইলে তো আমি উঠতেই পারতুম না?

মিংমা বলল, মাথাটা ঢুকে গিয়েছিল? বহুত জোর বাঁচ গিয়া।

সন্তুর শরীরে কোথাও আঘাত লাগেনি বটে, কিন্তু তার সারা শরীর তখনও থরথর করে কাঁপছে। একদম মৃত্যুর মুখোমুখি হলে এ-রকম হয়। সে মিংমাকে শক্ত করে চেপে ধরে রইল।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সেই ফুলগাছটা কোথায় গেল?

সন্তু বলল, সেটা বরফের মধ্যে চাপা পড়ে গেছে।

কাকাবাবু একটুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, এখানে একটা কিছু চিহ্ন দেওয়া দরকার। আবার যাতে কেউ ভুল করে ওখানে না যায়-

কিন্তু কী দিয়ে চিহ্ন দেওয়া হবে? এখানে কোনও কাঠের টুকরো কিংবা পাথর-টাথরও কিছু নেই। মিংমাই বুদ্ধি বার করল একটা।

সে বসে পড়ে গুঁড়ো গুঁড়ো বরফ মুঠোয় ভরে টিপে টিপে শক্ত করে একটা মূর্তি বানাতে লাগল। দেখতে দেখতে সেটা বেশ একটা ছোটখাটো গেরিলা কিংবা বাঁদরের মতন মূর্তি হয়ে উঠল।

মিংমা হাসতে হাসতে বলল, দেখিয়ে সাব, এক টিজুটি বন গিয়া। নরবু কাঠের পুতুল বানায়, আমিও বরফের পুতুল বানাতে পারি।

সন্তু আপন মনেই বলে উঠল, ইয়েতির ছোটভাই টিজুতি!

মিংমা গলা থেকে তার লাল রঙের রুমালটা খুলে নিয়ে সেটা পরিয়ে দিল ঐ বরফের মূর্তিটার গলায়। তারপর সেই মূর্তিটাকে তুলে সাবধানে কিছুটা এগিয়ে এক জায়গায় বসিয়ে দিল।

কাকাবাবু বললেন, ওটা আর কতক্ষণ থাকবে। কাল রোদ্দুর উঠলেই তো গলে যাবে।

মিংমা বলল, কাল আমি এসে একঠো বড় ফ্ল্যাগ লাগিয়ে দিয়ে যাব ইধারে। কুলি লোগ আজ কেউ আসবে না। এ সাইডে।

কাকাবাবু বললেন, আজ আর কলাপাথরে যাওয়া যাবে না। এক্ষুনি সন্ধে হয়ে যাবে। চলো, বেস ক্যাম্পের দিকে ফিরে চলো?

গম্বুজে ফিরে এসে সন্তু স্যান্ডউইচ আর কফি খেয়ে শুয়ে পড়ল। তার শরীর এখনও দুর্বল লাগছে।

সন্তু ঘুমিয়েও পড়ল তাড়াতাড়ি। কাকাবাবু আলো জেলে পড়াশুনো করতে লাগলেন।

এক সময় একটা স্বপ্ন দেখল সন্তু।

সে এক চুপি চুপি কাকাবাবুকে না জানিয়ে গম্বুজ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে মাঝরাতে। তার এক হাতে একটা শাবল আর অন্য হাতে একটা টর্চ। গম্বুজের সামনের তাঁবুগুলোর পাশ দিয়ে সে এগিয়ে গেল নিঃশব্দে। মালবাহকরা সবাই ঘুমোচ্ছে। শুধু একটা তাঁবু থেকে ভেসে আসছে মাউথ অগানের আওয়াজ। নিশ্চয়ই মিংমা। শুয়ে শুয়েও সে মাউথ অগনি বাজায়।

সন্তু হাঁটতে হাঁটতে চলে এল বিকেলবেলার সেই জায়গাটায়। মিংমার তৈরি বরফের পুতুলটা ঠিকই আছে। গলায় বাঁধা লাল রুমাল। মিংমার কায়দায় সন্তুও সেখানে শুয়ে পড়ে, তারপর গড়াতে গড়াতে মূর্তিটা ছাড়িয়েও এগিয়ে গেল খানিকটা। তারপর শাবল দিয়ে বরফ খুঁড়তে লাগল। একটা দারুণ জিনিস আবিষ্কার করে কাকাবাবুকে সে চমকে দেবে! বরফ সরিয়ে সরিয়ে সে খুঁজতে লাগল ফুলগাছটা। অবশ্য শুধু ফুলগাছটা খুঁজতেই সে এখানে আসেনি। এ জায়গায় বরফের নীচে যে গর্ত, তা খুব গভীর নয়। এক জায়গায় সন্তুর মাথা ঠেকে গিয়েছিল। কিন্তু মাথা ঠেকে গিয়েছিল কিসে? তখন সে পাথর বলেই ভেবেছিল, কিন্তু পরে তার মনে হয়েছিল, সেটা যেন একটা লোহার পাত। লোহা ছুলে আর পাথর ছুলে আলাদা আলাদা রকম লাগে। জনমানবশূন্য জায়গায় বরফের নীচে লোহার পাত?…

খুঁড়তে খুঁড়তে সন্তু ঠং করে একটা শব্দ শুনতে পেল। আনন্দে লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে করল তার। তবে তো সে ঠিকই বুঝেছিল! কাকাবাবু যখন শুনবেন–; উৎসাহের চোখে সে আরও জোরে জোরে খোঁড়বার চেষ্টা করতেই শাবলটা তার হাত থেকে পড়ে গেল। গর্তের মধ্যে। সেটাকে তুলতে যেতেই সন্তুর মাথাটা আবার ঢুকে যেতে লাগল ভেতরে।

স্বপ্নের মধ্যেই সন্তু চেঁচিয়ে উঠল, আহ, আহ।

তারপরই সে ভাবল, আমি কি স্বপ্ন দেখছি? নিজেই আবার উত্তর দিল, কই, না তো, এই তো আমার মাথাটা ঢুকে যাচ্ছে বরফের মধ্যে, আমি মরে যাচ্ছি।

তারপর সে চোখ মেলে দেখল, আলো জ্বলছে! কোথাকার আলো? কিসের আলো? t

এবার ভাল করে সন্তুর ঘুম ভাঙল। সে বুঝতে পারল, সে শুয়ে আছে গম্বুজের মধ্যে, ক্লিপিং ব্যাগের মধ্যে। বাবাঃ, কী একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছিল সে! বরফের নীচে লোহার পাত, এ কখনও হয়?

পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল, কাকাবাবু তাঁর বিছানায় নেই।

আবার বুকের মধ্যে ধৰ্ক করে উঠল সন্তুর। এত রাতে কাকাবাবু কোথায় গেলেন? স্বপ্নের মধ্যে সন্তু একা একা বরফ খুঁড়তে গিয়েছিল। কিন্তু সত্যি সত্যি তো কেউ একা একা এখানে বাইরে যায় না। রাত্তির বেলা।

সে ডেকে উঠল, কাকাবাবু!

অমনি গম্বুজের ওপর থেকে কাকাবাবু উত্তর দিলেন, কী হল?

কাকাবাবু এত রাতেও গম্বুজের ওপর বসে আছেন? কোনও মনে হয়? উনি কি রাতে একটুও ঘুমোবেন না? এ-রকম করলে শরীর খারাপ হবে যে!

কাকাবাবু, এখন কটা বাজে?

সাড়ে নটা। কেন?

এখন রাত মোটে সাড়ে নটা? যাঃ! সন্তুর ধারণা সে বহুক্ষণ ঘুমিয়েছে। স্বপ্নটাই তো দেখল কতক্ষণ ধরে। কলকাতায় রাত সাড়ে নটার সময় কত রকম আওয়াজ। কলকাতা এখান থেকে কত দূরে!

খুব অস্পষ্টভাবে মাউথ অগানের শব্দ শোনা যাচ্ছে বাইরে। মিংমা বাজাচ্ছে। সন্তু স্বপ্নের মধ্যেও এই শব্দটা শুনেছিল। আশ্চর্য না!

সন্তু একবার ভাবল, কাকাবাবুকে স্বপ্নটার কথা বলবে। তারপরই আবার ভাবল, না, দরকার নেই। কাকাবাবু নিশ্চয়ই হেসে উঠবেন। বরফের নীচে লোহার পাত! কাকাবাবু তাকে পাগলও মনে করতে পারেন। অথচ, সন্তুর এখনও স্বপ্নটাকে ভীষণ সত্যি বলে মনে হচ্ছে।

একটু বাদে সে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।

যখন তার ঘুম ভাঙল, তখন ভোরের নীল রঙের আলো গম্বুজের জানলা দিয়ে ভেতরে এসে পড়েছে। কাকাবাবু গম্ভীরভাবে ঘুমিয়ে আছেন।

ক্লিপিং ব্যাগ থেকে বাইরে বেরিয়েই সন্তু লাফাতে লাগল। ঠিক স্কিপিং করার মতন। বিছানা ছাড়ার পর প্রথম যে শীতের কাঁপুনিটা লাগে, সেটা এইভাবে তাড়াতে হয়। বেশ কিছুক্ষণ লাফাতে শরীরটা আস্তে আস্তে গরম হয়ে ওঠে।

সন্তুর লাফালাফির শব্দ শুনে কাকাবাবুর ঘুম ভেঙে গেল। তিনি চোখ মেলে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, শরীর ভাল আছে তো?

সন্তু বলল, হ্যাঁ, খুব ভাল আছে।

কাল রাতে তুই একেবারে অঘোরে ঘুমিয়েছিস। তোকে দু-তিনবার ডাকালুম—

তুমি আমায় ডেকেছিলে?

হ্যাঁ। কাল আমি একটা আশ্চর্য জিনিস দেখেছি। তোকেও দেখতে চেয়েছিলাম—।

কাকাবাবু স্লিপিং ব্যাগের চেনী-টেনে খুললেন। তারপর উঠে বসে বললেন, আমার ক্রাচ দুটো এগিয়ে দে তো!

সন্তু ক্ৰাচ দুটো তাড়াতাড়ি নিয়ে এসে উত্তেজিতভাবে জিজ্ঞেস করল, কী দেখেছ, কাল রাত্রে?

দুটো আলোর বিন্দু। অনেক দূরে, প্রায় কালাপাথরের কাছটায়। চোখের ভুল নয়, ভাল করে দেখেছি।

আলোর বিন্দু? ওখানে আলো আসবে কোথা থেকে?

সেই তো কথা! আমাদের লোকরা রাত্রে অতদূরে যাবে না। আলোর বিন্দু দুটো খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে হঠাৎ আবার মিলিয়ে গেল। ধরা যাক, ইয়েতি বলে যদি কোনও প্ৰাণী থেকেও থাকে, তা হলেও, ইয়েতিরা আলো নিয়ে ঘোরাফেরা করে, এ-রকম কখনও শোনা যায়নি।

কাকাবাবু, আলেয়া নয় তো?

কাকাবাবু আপন মনে আস্তে আস্তে বললেন, বরফের মধ্যে আলেয়া? কী জানি! সেটাও ভাল করে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *