Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পাহাড় চূড়ায় আতঙ্ক (১৯৮১) || Sunil Gangopadhyay » Page 22

পাহাড় চূড়ায় আতঙ্ক (১৯৮১) || Sunil Gangopadhyay

সন্তু যেন একটা অন্ধকার সমুদ্রে ভাসছিল। একবার চোখ মেলেও সে কিছু দেখতে পেল না। বুঝতেও পারল না সে কোথায় আছে। মাথার ভেতরটা খুব ক্লান্ত, তার ইচ্ছে করল ঘুমিয়ে পড়তে।

হঠাৎ যেন কিছু চাঁচামেচির শব্দ এল তার কানে। তার মধ্যে কাকাবাবুর গলা। আমনি একটা ঝাঁকুনি লাগল। তার সারা শরীরে। সে পাশ ফিরে তাকাল।

প্রথমে তার মনে হল ভূত। কয়েকটা ভূত কাকাবাবুকে চেপে ধরেছে। তারপরেই বুঝতে পারল, ভূত-টুত কিছু নয়, কয়েকজন মুখোশ-পরা মানুষ।

সন্তু উঠে বসতে গেল। তার আগেই দুজন মুখোশধারী চেপে ধরল তাকে। তাদের একজনের হাতে ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ।

বন্দী অবস্থায় কাকাবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, সন্তু, পালা! যেমন করে হোক পালা!

সন্তু সঙ্গে-সঙ্গেই কিছু চিন্তা না করেই পা তুলে একজন মুখোশধারীর পেটে কষাল খুব জোরে এক লাথি। তাতে তার হাত থেকে কাচের সিরিঞ্জটা মাটিতে পড়ে গিয়ে ভেঙে গেল!

কেইন শিপটন রেগে বলে উঠল, ক্ল্যামজি ফুল! শিগগির আর একটা নিয়ে এসো!

কেইন শিপটন নিজে উঠে এগিয়ে আসবার আগেই সন্তু টেবিল থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল মাটিতে। তারপরই অন্ধের মতন দৌড়ল।

কাকাবাবু আবার চিৎকার করে উঠলেন, সন্তু, পালা পা-। তক্ষুনি তাঁর মুখ চাপা দিয়ে দিল কেউ।

সন্তু দিক-বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে গিয়ে দেখল সামনেই একটা লোহার রেলিং। মুখোশধারীরা তাকে তাড়া করে আসছে বুঝতে পেরে সে সেই রেলিং ধরে ভল্ট খেয়ে চলে গেল অন্যদিকে। সেইভাবে ঝুলতে-ঝুলতে তাকিয়ে দেখল, সেখানে একতলার সমান নীচে অনেক মেশিন-টেশিন রয়েছে। মুখোশধারীরা তাকে ধরে ফেলবার আগেই সে হাত ছেড়ে দিল, ধপাস করে পড়ল নীচে।

সন্তুকে পালাতে দেখে কেইন শিপটন কাকাবাবুর কোটের কলার ধরে টানতে-টানতে এনে শুইয়ে দিল পাথরের টেবিলের ওপর। তারপর রিভলভারের মতন দেখতে, কিন্তু সাধারণ রিভলভারের চেয়ে বেশ বড় একটা অস্ত্ৰ তুলে বলল, তুমি ঐ ছেলেটিকে এক্ষুনি ফিরে আসতে বলে। নইলে তুমি মরবে!

কাকাবাবু বললেন, না! সন্তু, ফিরে আসিস না!

কেইন শিপটন বলল, আমি ঠিক দশ গুনব! তার মধ্যে ফিরে আসতে বলো ঐ ছেলেটাকে। ওয়ান টু-

কাকাবাবু বললেন, সন্তু, তুই কিছুতেই ধরা দিবি না।

কেইন শিপটন বলল, থ্রি, ফোর…।

কাকাবাবু বললেন, তুমি আমাকে মৃত্যুর ভয় দেখাচ্ছ? তুমি তা হলে আমাকে কিছুই চেনো না, কেইন শিপটিন। তুমি আমায় মারতে পারো, কিন্তু তুমি কিছুতেই এখান থেকে আর বেরুতে পারবে না।

কেইন শিপতিন বলল, “ফাইভ, সিক্স…

কাকাবাবু গলা চড়িয়ে বললেন, সন্তু কিছুতেই আসবে না। তুমি যতই ভয় দেখাও…

সন্তু নীচে লাফিয়ে পড়ে প্রথমটায় ঝোঁক সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সামনের দিকে। তাতে অদৃশ্য কোনও কিছুতে ঠোকা লেগে গেল তার মাথায়। তারপরই সে বুঝতে পারল, মাঝখানের জায়গাটা শক্ত কাচ দিয়ে ঘেরা, সেই কাচে সে ধাক্কা খেয়েছে। কাচের দেয়ালের মধ্যে অনেকগুলো বড়-বড় যন্ত্র, সেগুলি থেকে নীল আলো বেরুচ্ছে।

পায়ে খানিকটা ব্যথা লেগেছে সন্তুর, কিন্তু এমন কিছু না। দ্রুত চোখ বুলিয়ে দেখল, গোল জায়গাটার চারদিকে চারটি সুরঙ্গ রয়েছে, সুড়ঙ্গগুলো অনেক লম্বা, শেষ পর্যন্ত দেখাই যায় না। এদিকে একটা ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে দুপদাপ করে নেমে আসছে কয়েকজন মুখোশধারী তাকে ধরবার জন্য।

সন্তু একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকে পালাতে গিয়েও শুরু তে পেল কেইন শিপটনের কথাগুলো আর কাকাবাবুর উত্তর। সে থমকে দাঁড়িয়ে গেল।

কেইন শিপটিন নাইন গোনার সঙ্গে-সঙ্গে সে চিৎকার করে বলল, ডোন্ট কিল মাই আংকল। আই অ্যাম কামিং

ঘোরানো সিঁড়ির ওপর দাঁড়ানো মুখোশধারী দুটির দিকেও হাত তুলে সে বলল, আই অ্যাম কামিং

ওপর থেকে কাকাবাবু বললেন, না, আসিস না, সন্তু। আমাদের দুজনকেই এরা মারবে। দুজনে এক সঙ্গে মরে লাভ নেই!

সন্তু সে-কথা গ্ৰাহ্য করল না। কাকাবাবুকে মৃত্যুর মুখে ফেলে সে কিছুতেই পালাতে পারবে না। সে আবার চেঁচিয়ে বলল, ইয়েস, আই অ্যাম কামিং

এক পা এক পা করে এগোতে লাগল সে। মুখোশধারী দুজন তাকে ধরবার জন্য অপেক্ষা করছে। ধড়াস ধড়াস শব্দ হচ্ছে সন্তুর বুকের মধ্যে। এরা কারা? এরা কি সত্যিই তাকে আর কাকাবাবুকে মেরে ফেলবে।

এগোতে এগোতে সন্তু দেখল, এক জায়গায় দেয়ালে ইলেকট্রিকের মিটারের মতন অনেকগুলে জিনিস। আর একটা লম্বা লিভার অর্থাৎ লোহার হাতলের মতন জিনিস সামনের দিকে বেরিয়ে আছে। সেটা বেশ খানিকটা উঁচুতে।

বিদ্যুৎ-চমকের মতন একটা চিন্তা খেলে গেল সন্তুর মাথায়। সে লাফিয়ে সেই লিভারটা ধরেই ঝুলে পড়ল।

সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত জায়গাটা ঘুটফুটে অন্ধকার হয়ে গেল! তারপর নানারকম চ্যাঁচামেচি আর হৈচৈ। ওপর থেকে কেইন শিপটন কড়া গলায় কী যেন হুকুম দিলেন। মুখোশধারী দুজন অন্ধকারের মধ্যেই আন্দাজে ছুটে এল সন্তুকে ধরবার জন্য।

লিভারটা ধরে ঝুলে দোল খেতে খেতে সন্তু সামনের দিকে লাথি চালাতেই তার জোড়া পায়ের লাথি লাগল। একজনের বুকে। সেই লোকটা ছিটকে গিয়ে পড়ল আর একজনের গায়ে। পেছনের লোকটা সেই ধাক্কায় পড়ে যেতে যেতেও সামলে নিয়ে আন্দাজে গুলি চালাল সন্তুর দিকে।

ততক্ষণে সন্তু লিভারটা ছেড়ে দিয়ে নীচে নেমে পড়েছে। গুলিটা লাগল লোহার লিভারটাতে, সেটা ভেঙে ছিটকে উড়ে গেল। আর আলো জুলবার কোনও উপায় রইল না।

কেইন শিপটন চিৎকার করতে লাগল, বোকার দল! ছেলেটাকে কেউ ধরতে পারলে না? শিগগির আলো জ্বলো, নইলে সব নষ্ট হয়ে যাবে! আমরা দম বন্ধ হয়ে মরব!

অন্ধকারে জড়াজড়ি করে সবাই ছুটে এল আলোর সুইচ-বোর্ডের দিকে। সন্তু একবার ভাবল, ওপরে কাকাবাবুর কাছে যাবে। কিন্তু আবার ভাবল, সিঁড়ি দিয়ে অনেকে নামছে। ওদিকে যেতে গেলে সে ধরা পড়ে যাবে। দেয়াল হাতড়ে-হাতড়ে সে উল্টো দিকে সরে যেতে লাগল। তারপর এক জায়গায় দেয়াল নেই টের পেয়ে বুঝল, এদিকে একটা সুড়ঙ্গ। সে ছুটিল সেই সুড়ঙ্গের মধ্যে। খানিকটা গিয়েই একবার হোঁচটি খেয়ে পড়ল, তারপর আবার উঠে ছুটিল।

কেইন শিপটন নিজেই নেমে এসেছে সুইচ বোর্ডের কাছে। সবাইকে গালাগালি দিতে দিতে বলল, ইডিয়েটের দল, একটা সামান্য বাচ্চা ছেলেকে ধরতে পারে না-টর্চ দাও, কার কাছে টৰ্চ আছে-

কারুর কাছেই টর্চ নেই, একজন একটা সিগারেটের লাইটার জ্বালল। সেই সামান্য আলোয় দেখা গেল, সুইচ বোর্ডের একদিক থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে।

ওদিকে কাকাবাবু যখন বুঝলেন তাঁর কাছাকাছি আর কেউ নেই, তিনি আস্তে আস্তে টেবিলটা থেকে নামলেন। তাঁর পক্ষে ছুটে পালানো সম্ভব নয়। এই অন্ধকারের মধ্যে তো আরও অসম্ভব। তিনি খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে গিয়ে দেয়াল ধরে দাঁড়ালেন। আগেই তিনি দেখেছিলেন যে, কেইন শিপটন যে-চেয়ারটায় বসেছিল, তার পেছনে একটা লোহার দরজা আছে। প্ৰথমে দিক ঠিক করে নিয়ে তিনি একটু-একটু করে এগোলেন সেই দরজাটার দিকে। এক সময় হাতের ছোঁয়াতেই দেয়ালের বদলে লোহা টের পেলেন।

দরজাটা খোলাই ছিল, একটু জোরে ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। কাকাবাবু ভেতরে ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করে দিলেন আবার। চারদিকে হাত ঝুলিয়ে দেখলেন, দরজাটা বেশ মজবুত। ছিটিকিনিও রয়েছে। ভেতর থেকে সেটাকে আটকে দিলেন শক্ত করে।

তারপর ঘরের মধ্যে ভাল করে তাকাতেই তিনি চমকে উঠলেন খুব।

একটু দূরে একটা টাকার সাইজের গোল লাল আলো খুব উজ্জ্বলভাবে জ্বলছে। সেই আলোটা দেখলেই ভয় হয়। মনে হয় যেন কোনও এক চক্ষু দানব দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারের মধ্যে।

কাকাবাবু বুঝলেন, ওটা কোনও যন্ত্র। কিন্তু সব দিক একেবারে নিশ্চিছদ্র অন্ধকার, তার মধ্যে এই যন্ত্রের লাল আলোটা জ্বলছে কী করে? নিশ্চয়ই ওটার জন্য কোনও আলাদা ব্যবস্থা আছে। কাকাবাবু যন্ত্রটার দিকে এগোতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তাঁর মনে পড়ল, কেইন শিপটন একবার বলেছিলেন, এখানে এমন যন্ত্র আছে, যাতে হাত ছোঁয়ালেই মৃত্যু অনিবার্য। এটা সে-রকম কোনও যন্ত্র নয় তো?

কাকাবাবু কান পেতে শুনলেন, যন্ত্রটার মধ্য থেকে শো-শোঁ শব্দ বেরুচ্ছে। তিনি আর যন্ত্রটার দিকে এগোলেন না। লাল আলোটা এমন তীব্ৰ যে, ওদিকে চেয়ে থাকাও যায় না। এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে তাঁর কষ্ট হচ্ছে বলে তিনি আস্তে-আস্তে বসে পড়লেন। পাশে হাত রাখতেই আবার চমকে উঠলেন তিনি। একটা কোনও লোমশ জিনিসে তাঁর হাত লাগল। অমনি নড়ে উঠল। সেই জিনিসটা, তারপরই ডেকে উঠল।

এটা সেই কুকুরটা। এই ঘরের মধ্যে এসে ঘুমিয়ে ছিল, কাকাবাবুর ছোঁয়া লাগতেই আবার জেগে উঠেছে। অন্ধকার ঘরের মধ্যেই এই দুষ্ট কুকুরটাকে নিয়ে কাকাবাবু আবার এক মহা মুশকিলে পড়লেন। কুকুরটা দেখতে ভারী সুন্দর, আকারেও বেশি বড় নয়, কিন্তু ঘেউ-ঘেউ করে সে তেড়ে কামড়াতে এল কাকাবাবুর দিকে। কাকাবাবুর ওপরে ওর রাগও আছে। কাকাবাবু প্রথম দুএকবার কুকুরটার কামড় খেলেন। তারপর বেশি সাহস পেয়ে কুকুরটা তাঁর বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই তিনি খপ করে সেটাকে ধরে ফেলেন। দুহাতে। কুকুরটা ছটফট করেও আর নিজেকে ছাড়াতে পারল না। কাকাবাবু এক হাতে কুকুরটার মুখ শক্ত করে চেপে ধরে অন্য হাত দিয়ে আদর করতে লাগলেন তাকে।

নীচের তলায় সন্তু একটা সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে ছুটতে ছুটতে এক ধাক্কা খেল। গুহাটা সেখানেই শেষ। আবার পেছন ফিরতে গিয়েই তার মনে হল, দূরে কিছু লোকের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ওরা কি এদিকেই আসছে?

কোণঠাসা ইদুরের মতন সন্তু দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল।

তারপরেই আলো জ্বলে উঠল। কেইন শিপটন এর মধ্যে আলোর সুইচ ঠিক করে ফেলেছে।

সন্তু দেখল, সুড়ঙ্গের মুখে দু-তিনজন মুখোশধারী দাঁড়িয়ে আছে, তাদের হাতে লম্বা পিস্তল। আর দেখল, তার ঠিক সামনেই.আর-একটা ছোট সুড়ঙ্গের পথ। সেটায় ঢুকতে গেলে সামনে একটুখানি দৌড়ে যেতে হবে, তাতে দূরের মুখোশধারীরা তাকে দেখে ফেলতে পারে। সেটুকু কুঁকি নিয়েই সন্তু এক দৌড়ে সেই সুড়ঙ্গটার মধ্যে ঢুকে গেল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *