Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পাহাড় চূড়ায় আতঙ্ক (১৯৮১) || Sunil Gangopadhyay » Page 13

পাহাড় চূড়ায় আতঙ্ক (১৯৮১) || Sunil Gangopadhyay

নীল কোট পরা লোকটা দুহাত তুলে তুলে ছুটে আসছে ওদের দিকে। ঠিক ছুটিতে পারছে না লাফিয়ে-লাফিয়ে আসছে। বরফের ওপর দিয়ে। রানা। আর ভার্মা লাইট মেশিনগান উঁচিয়ে আছেন লোকটির দিকে।

একটু কাছে আসতেই দেখা গেল, লোকটা মিংমা।

কাকাবাবু বললেন, এ তো আমাদের একজন শেরপা!

সন্তু বলল, আমি আগেই চিনতে পেরেছিলাম।

মিংমা কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে হাত জোড় করে বলল, সাব!

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? রাস্তায় তোমাদের কোনও বিপদ ঘটেছে? ফিরে এলে কেন?

মিংমা বলল, সাব, আমি মাফি মাঙতে এসেছি। আপনাদের ছেড়ে চলে যাবার পর আমার দিলের মধ্যে বহুত দুখ হচ্ছিল। আমি জবান দিয়েছিলাম আপনাদের সঙ্গে যাব, শেরপা কখনও জবান নষ্ট করে না, কখনও ভয় পায় না।

জং বাহাদুর রানা মিংমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে নেপালি ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আবার কেন ফিরে এসেছ, সত্যি করে বলো? যদি কোনও মতলব থাকে-

কাকাবাবু তাকে বাধা দিয়ে বললেন, থাক, এখানে আর কোনও নাটক করার দরকার নেই। মিংমা, তুমি কি আমাদের সঙ্গে যেতে চাও? তুমি না যেতে চাইলেও আমাদের কোনও ক্ষতি নেই। আর যদি যেতে চাও তো আসতে পারে।

মিংমা বলল, সাব, আমি আর আপনাদের সঙ্গ ছাড়ব না। আপনাদের জন্য আমি জান দিতেও তৈয়ার। আপনাদের ছেড়ে চলে যাবার পর, আজ সকালে আমার মন বলল, ওরে মিংমা, তুই এ কী করলি? একজন খোঁড়া বাঙ্গালী ভয় পেল না, আর তুই শেরপার বাচ্চা হয়ে জানের ডরে ভোগে এলি? ছিয়া ছিয়া ছিয়া!

কাকাবাবু বললেন, বেশি কথায় সময় নষ্ট করার কোনও দরকার নেই। চলো, তাহলে এগোনো যাক।

মিংমা কাকাবাবুর কাঁধের হাভারস্যাকটা প্রায় জোর করেই নিজে নিয়ে নিল। তারপর বলল, আংকল সাব, আপনার যদি হাঁটতে কষ্ট হয়, তা হলে এই মিংমা। আপনাকে কাঁধে করেও নিয়ে যেতে পারে।

কাকাবাবু তাকে ধমক দিয়ে বললেন, আবার বেশি কথা বলছ! এগোও! তোমরা সামনে সামনে চলো।

মিংমাকে পেয়ে সন্তু খুব খুশি। মিংমার মতন হাসিখুশি, ছটফট মানুষটি যে ভয় পেয়ে তাদের ছেড়ে পালাবে, এটা সে যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না।

সে মিংমার পাশে-পাশে চলতে-চলতে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কতদূর চলে গিয়েছিলে?

মিংমা বলল, সে-কথা থাক, সন্তু সাব। ও কথা ভাবতেই আমার সরম লাগছে। কাল রাতে তোমাদের কোনও বিপদ হয়নি তো?

সন্তু বলল, হ্যাঁ, দারুণ বিপদ! কারা যেন আমাদের গম্বুজের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল বাইরে থেকে।

মিংমা দারুণ অবাক হয়ে বলল, সে কী? এখানে কে দরজা বন্ধ করবে? আপনা। আপনি দরজা টাইট হয়ে যায়নি তো?

জং বাহাদুর রানা জিজ্ঞেস করলেন, বাইরে থেকে লোহার পাটি দিয়ে বন্ধ করা হয়েছিল। ইয়েটি তো এরকমভাবে দরজা বন্ধ করতে পারে না! তা হলে কে করেছিল? তোমরা করোনি তো?

মিংমা চোখ গোল গোল করে বলল, আমরা? কেন আমরা দরজা বন্ধ করব?

রানা বললেন, সাহেবদের মেরে ফেলতে পারলেই তো তোমাদের সুবিধে ছিল! তা হলে আর কেউ তোমাদের নামে দোষ দিতে পারত না?

মিংমা বলল, আমি পশুপতিনাথজীর নামে কিরিয়া কেটে বলছি, ওরকম কোজ আমরা কক্ষনো করি না। তাছাড়া, কাল রাতে আমরা বহুত দূরে ছিলাম!

ভার্মা জিজ্ঞেস করলেন, মিংমা, তুমি সত্যিই ইয়েতি দেখেছ?

মিংমা বলল, ইয়েটি ছিল কিংবা আউর কুছ ছিল, কেয়া মালুম! লেকিন একটা বহুত বড়া জানোয়ারকা মাফিক কুছু দেখা!

ঠিক কোন জায়গাটায় দেখেছিলে?

ঐ যে সামনে কালাপাথ্‌থর নামে পাহাড়টা দেখছেন, ঠিক ওর নজদিগে।

আমাদের সেই জায়গাটা দেখাতে পারবে?

হাঁ সাব!

আমরা তা হলে এখন ঐ জায়গাটা পর্যন্ত যাব! কী বলেন, মিঃ রায়চৌধুরী?

কাকাবাবু একটু পিছিয়ে পড়েছিলেন, দূর থেকে বললেন, হ্যাঁ। আপনারা এগিয়ে যান।

ভার্মা বললেন, আমরা মাঝে-মাঝে দাঁড়াচ্ছি। আপনার জন্য।

কাকাবাবু বললেন, তার দরকার নেই। আপনারা এগিয়ে যান, আমি ঠিক ধরে ফেলব আপনাদের। জানেন তো, স্লো অ্যান্ড স্টেডি, উইনস দা রেস!

রানা বললেন, তা ঠিক। আপনার বেশি কষ্ট করার দরকার নেই, মিঃ রায়চৌধুরী, আপনি আস্তে-আস্তে আসুন?

কাল সারা রাত তুষারপাতের জন্য খুব পাতলা কুরো-কুরো বরফ জমে আছে। চারদিকে। কাকাবাবুর ক্রাচ দুটো গেঁথে যাচ্ছে সেই বরফে। সেই জন্য হাঁটতে খুবই অসুবিধে হচ্ছে তাঁর। কিন্তু নিজের অসুবিধের কথা কারুকে জানতে দিতে চান না তিনি।

রোদ্দুরের তাপে এক-এক জায়গায় বরফ গলে জল হয়ে আছে। সেখানে যে-কোনও মুহুর্তে পা পিছলে যেতে পারে। জং বাহাদুর রানা একবার আছাড় খেয়ে পড়তেই মিংমা গিয়ে তাঁকে টেনে তুলল। তারপরই পড়লেন ভামা। কাকাবাবু কিন্তু একবারও আছাড় খেলেন না। সকলের থেকে খানিকটা পেছনে তিনি আসতে লাগলেন খুব সাবধানে, পা টিপে-টিপে।

সন্তু পাতলা শরীর নিয়ে বেশ এগিয়ে যাচ্ছে তরতর করে। আকাশ আজ খুবই পরিষ্কার। এই রকম দিনে এভারেস্টের চুড়া দেখা যায়। কালাপাথর পাহাড়টার জন্য এখান থেকে আড়াল পড়ে গেছে। সন্তু এখানে এসে কয়েকবার এভারেস্টের চুড়া দেখেছে, তার নিজের ক্যামেরায় ছবিও তুলেছে। তবু আর-একবার দেখতে পাবে বলে উত্তেজনা জাগছে তার শরীরে। বিশাল মহান কিছুর কাছাকাছি এলেই মানুষ একটু অন্যরকম হয়ে যায়।

মিংমা পেছন থেকে এসে সন্তুর হাত চেপে ধরে বলল, সন্তু সাব, অত সামনে-সামনে যেও না! ঐ দুই বড় সাবদের আগে যেতে দাও।

সন্তু বলল, কেন?

যদি ইয়েটি এসে তোমাকে আগে ধরে নিয়ে যায়?

সন্তু হাসতে গিয়েও হাসতে পারল না। এর মধ্যে ইয়েতির কথা সে ভুলে গিয়েছিল। আবার মনে পড়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে নিজের অজান্তেই একবার কেঁপে উঠল তার বুক।

জোর করে সাহস এনে সে বলল, দু খানা এল এম জি আছে আমাদের সঙ্গে। ইয়েতি কী করবে?

মিংমা ফিসফিস করে বলল, সন্তু সাব, ইয়েটি ভ্যানিশ করে নিয়ে যেতে পারে?

সন্তু খানিকটা অবিশ্বাসের সুরে বলল, যাঃ!

আমিও আগে মানতাম না। লেকিন নিজের আখসে তো দেখলাম কাল! এক দো সেকেন্ড ছিল, তারপরই ভ্যানিশ করে গেল! কেয়া ঠিক নেহি!

সন্তু বলল, হুঁ!

সন্তু সেই কালো-মতন বিরাট প্রাণীটাকে এক পলকের জন্য দেখেই ভয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। তারপর যখন আবার তাকিয়েছে, সেটা আর নেই। অন্ত তাড়াতাড়ি কোথায় পালাল? সত্যি কি কোনও প্রাণী অদৃশ্য হতে পারে?

মিংমা সন্তুকে ধরে দাঁড় করিয়ে রাখল। ভার্মা আর রানা খানিকটা পিছিয়ে পড়েছিলেন, ওঁরা এগিয়ে এলেন। সন্তুর বরফের ওপর দিয়ে হাঁটা বেশ অভ্যোস হয়ে গেছে, কিন্তু রানা আর ভার্মার অসুবিধে হচ্ছে বেশ। একবার করে আছাড় খেয়ে ওঁরা বেশি সাবধান হয়ে গেলেন। দু জনের হাতেই লাইট মেশিনগান, নামে লাইট হলেও খুব হালকা তো নয়!

ভার্মা সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, কী, দাঁড়িয়ে পড়লে যে! এখানেই ইয়েতি দেখেছিলে নাকি?

সন্তু বলল, না, আরও অনেক দূর আছে।

আমাদের সঙ্গে-সঙ্গে চলো। যদি সত্যিই ইয়েতি দেখতে পাই, গুলিতে তাকে একেবারে ফুড়ে দেব! জ্যান্ত হোক, মরা হোক, একটা ইয়েতি নিয়ে যদি দেখাতে পারি, তা হলে সারা পৃথিবীতে আমাদের নাম ছড়িয়ে যাবে! এ পর্যন্ত কেউ ইয়েতির অস্তিত্ব ঠিকভাবে প্ৰমাণ করতে পারেনি।

রানা বললেন, এই ছেলেটি নিজের চোখে দেখেছে, একে অবিশ্বাসই বা করা যায় কী করে! শেরপা কিংবা কুলিদের না হয় কুসংস্কার থাকতে পারে—

ভার্মা বললেন, আর এক যদি কোনও ভালুক-টালুকের মতন জানোয়ার দেখে থাকে-

রানা বললেন, এখানে ভাল্লুক আসবে কোথা থেকে? এ পথ দিয়ে কত অভিযাত্রী গেছে, কেউ কোনও দিন কোনও ভালুক দেখেনি।

ভার্মা বললেন, কেউ তো আগে ইয়েতিও দেখেনি!

রানা বললেন, কেইন শিপটন দেখেছিলেন। অন্তত তাঁর ডায়েরিতে সেই কথা লেখা আছে। আমার মনে হয়, তিব্বতের দিক থেকে ইয়েটিই হোক বা অন্য কোনও বড় জানোয়ারই হোক, এদিকে ছিটকে চলে এসেছে।

সন্তু বলল, কাকাবাবুও পায়ের ছাপ দেখেছেন। মোটেই ভালুকের মতন নয়, মানুষের মতন। তবে, চারটি আঙুল।

ভার্মা বললেন, তাও বটে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, ভার্মা সাহেব, আপনি এরকম ভাল বাংলা শিখলেন কোথা থেকে?

ভার্মা হেসে বললেন, আমি কলকাতায় লেখা-পড়া করেছি। আমি থাকতুম হার্ডিঞ্জ হোস্টেলে। তোমাদের বাড়ি ভবানীপুর, তাই না? সে জায়গাও চিনি।

রানা বললেন, আমি পড়েছি দাৰ্জিলিঙের নর্থ পয়েন্ট স্কুলে। আমার অনেক বাঙালি বন্ধুর বাড়িতে আমি দু তিনবার থেকেছি।

মিংমা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, সাব, দেখিয়ে।

তিনজনেই চমকে গিয়ে মিংমার দিকে তাকাল। মিংমা সামনে বরফের মধ্যে এক জায়গার দিকে আঙুল উঁচিয়ে আছে।

সেখানে একটা মস্ত বড় পায়ের ছাপ।

ভার্মা আর রানা সেখানে বসে পড়লেন। সন্তু পেছন ফিরে কাকাবাবুকে ডাকবার চেষ্টা করল, কিন্তু কাকাবাবুকে দেখতে পেল না।

ভার্মা বলল, একটা মাত্র পায়ের ছাপ? নিশ্চয়ই টাটকা, কারণ কাল রাত্তিরে তুষারপাত হয়েছিল, তার আগের হলে মিলিয়ে যেত।

রানা বললেন, মিঃ রায়চৌধুরীর আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাক এখানে। আরে—, মিঃ রায়চৌধুরী কোথায় গেলেন?

সন্তু বলল, কাকাবাবুকে দেখতে পাচ্ছি না।

ভার্মা বললেন, কোথাও বসে বিশ্রাম করছেন বোধহয়।

সন্তু বলল, বরফ তো উঁচু-নিচু নয়, কোথাও বসলেই বা দেখতে পাব না? বেশি দূরে তো ছিলেন না?

ভার্মা বললেন, হোচট খেয়ে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাননি তো? ফিরে গিয়ে আমাদের দেখা দরকার।

রানা বললেন, কিন্তু এখানে হঠাৎ এই একটা পায়ের ছাপ এল কী করে?

তিনি এল এম জি-টা উঁচিয়ে একবার চারদিকে ঘুরে তাকালেন।

মিংমা খুব জোরে চেঁচিয়ে ডাকল, আংকল সাব! আংকল সাব!

কোনও উত্তর এল না।

সন্তু বলল, আমি কাকাবাবুকে খুঁজে আসছি।

ভার্মা বললেন, আমি আর মিঃ রানা এখানে থাকছি, তুমি আর মিংমা দেখে এসো। উনি আহত হয়ে থাকলে আমাদের ডেকে।

সন্তু মাঝে-মাঝেই ঘাড় ফিরিয়ে কাকাবাবুর প্রতি লক্ষ রাখছিল। কাকাবাবু কখনও চোখের আড়াল হননি। দুশো আড়াই শো গজ দূরে ঠক ঠক করে আসছিলেন। ভার্মা আর রানার সঙ্গে কথা বলার সময় সন্তু কাকাবাবুর দিকে নজর রাখতে ভুলে গিয়েছিল। এরই মধ্যে কাকাবাবু কোথায় গেলেন।

খানিকটা ফিরে এসে এক জায়গায়। থমকে দাঁড়িয়ে সন্তু প্ৰায় কেঁদে উঠে বলল, মিংমা!

মিংমাও একই সঙ্গে দেখতে পেয়েছে।

বরফের ওপরে পড়ে আছে কাকাবাবুর একটা ক্ৰাচ আর খানিকটা টাটকা রক্ত। আর কিছু না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *