পালকমাতা
“কে? কে ওইখানে —খোকা? ” বলিয়া বুকটা চাপিয়া ধরিয়া কাশিতে থাকেন লীলাবতী বাড়ুয্যে।
অপরাহ্নের পড়ন্ত রৌদ্রকিরণ পশ্চিমের খিড়কি ভেদ করিয়া লীলাবতীর বিছানায় আসিয়া পড়িয়াছে।
দিনভর রৌদ্রের সাক্ষাৎ না পাইলেও এই সময় খানিতেই লীলাবতী বাড়ুয্যের অসূর্যস্পর্শা নামখানি ঘোঁচে।
বছর আশির লীলাবতী বাড়ুয্যের বর্তমান নিবাস বাড়ুয্যেনিকেতনের পশ্চিমদিকে গোয়ালঘর সংলগ্ন ঘরখানা।
আসবাব বলিতে বিবাহের যৌতুকের শিশুকাঠ দ্বারা নির্মিত এই পালঙ্কখানি। ঘরের একধারে একখানি মাটির কুঁজা।আর তারপাশে উল্টাইয়া রাখা কাঁসার থালা,বাটি ,গ্লাস।
বহুদিনের অযত্নে কাঁসার থালা, বাটি, গ্লাস পেতলের রূপ ধারণ করিয়াছে।
পাঁচবৎসর যাবৎ লীলাবতী বাড়ুয্যে শয্যাশায়ী।
প্রতহ্য সকালে, দুপুরে, রাত্রিতে রেবার মা আসিয়া লীলাবতীকে নিত্যকর্ম করাইয়া,পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করাইয়া খাবার খাওয়াইয়া যায়।
সারাদিনে রেবার মা ব্যতীত তেমন কেউ লীলাবতীর ঘরমুখো হয় না।হয় না কথাটি না বলিয়া ঘরমুখো হইবার প্রয়োজনবোধ করে না বলা ভালো।
শয্যায় পড়িয়া থাকিলেও লীলাবতীর স্মরণশক্তি প্রখররূপে বিরাজমান।
জীবনের ছোট, বড় ঘটনাই তাহার স্মৃতিতে উজ্জ্বল।
বৎসরের পর বৎসর চলনশক্তি হারাইয়া শয্যাগত থাকিবার কারনেই স্মৃতিরোমন্থন অধিকমাত্রায় করেন লীলাবতী।
বোধকরি সেইকারনেই জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ের সমস্তপরিচ্ছদ তাহার নিকট জলের ন্যায় স্বচ্ছ।
শৈশবের নারিকেলের মালা, মাটির প্রদীপ, পুরানা কৌটার ঢাকনা দিয়া রান্নাবাটি খেলা, পুতুল খেলা— ইহার পর বিনুনী বাঁধিয়া বিনোদবালার সহিত একাদোক্কা খেলা —-সমস্ত কিছু তাহার স্মৃতিপটে উজ্জ্বল।
এই সকল খেলার অভ্যেস পরিত্যাগ করিতে না করিতেই তাহার শ্বশুরবাড়িতে আগমন।
শাশুড়িমাতা ও খুড়শাশুড়ির তত্ত্ববধানে লীলাবতী বাড়ুয্যের সাংসারিক জীবনের পাঠ শুরু হইয়াছিলো।
গৃহে অতিথি আসিলে কি প্রকারে কতটা লম্বা ঘোমটা টানিতে হইবে , খাইবার সময় মুখগহ্বর কতটা খুলিতে হইবে। হাসিবার সময় কতটা আওয়াজ করিতে হইবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রথম প্রথম শ্বশুরালয়ে আসিবার পর সমবয়সী দেবর এবং ননদেরাই ছিলো খেলার সঙ্গী।
কতই না মারপিঠ করিয়াছেন তাহাদিগের সহিত কিন্তু হঠাৎ একদিন শাশুড়ি মাতা কহিলেন “তুমি এখন বড় হইয়াছো — এমন ধিঙ্গিপনা তোমার আর সাজে না।”
হঠাৎ করিয়া বড় হইবার হেতুটি অনুধাবন না করিতে পারিলেও লীলাবতী ইহা বুঝিয়াছিলেন — তাহার সাধের খেলা সাঙ্গ করিতে হইবে।
বাল্যকালের খেলা সাঙ্গ করিয়া সংসারজীবনের খেলা শুরু হইলো —
স্বামী মানুষটির সহিত সারাদিন মুখদর্শন না হইলেও রাত্রিবেলায় তিনি নিয়ম করিয়া লীলাবতীকে দর্শন দিতেন।
এমনি করিয়া বছর কয়েক যাইবার পর শাশুড়িমাতা স্থির করিলেন ” নিঃসন্তান নাম ঘুচাইতে ছেলের পুনঃবিবাহ দিবেন।”
অন্দরমহলের এই জল্পনার অবসান ঘটাইয়া একদিন লীলাবতীর জা কনকলতা বলিলো ” দিদি তোমার কপাল পুড়িলো —ভাসুর ঠাকুর এইমাসেই তোমার সতীন আনিবেন।”
সতীন বস্তুটির সহিত কপাল পোড়ার যোগসূত্রটি সঠিক কি বুঝিতে পারিলেন না লীলাবতী।
তবে মাস কয়েকের মধ্যে ইহা নজর করিলেন সতীন আসিবার পর হইতে স্বামী মানুষটি রাতেও দর্শন দিবার প্রয়োজন বোধ করিতেন না — মাসের কয়েকটি দিন ব্যতীত।
প্রথম প্রথম লীলাবতীর প্রতিরাতে স্বামী দর্শন না পাইবার কারনে মন উৎফুল্ল হইয়া উঠিতো —নিশ্চিন্ত মনে সারারাত অকাতরে ঘুমাইবার আনন্দ উপভোগ করিতেন।
বছর ঘুরিতে না ঘুরিতেই গৃহে নতুন অতিথি আসিবার স়়ংবাদে শাশুড়ি মাতা সহ পরিবারে সমস্ত সদস্যদের আনন্দের সীমা নাই।
লীলাবতীর সতীন কঙ্কাবতীকে সকলে মিলিয়া অধিক যত্নআত্তি করিতে শুরু করিলো —
কঙ্কাবতীকে আমমাখা ,চালতামাখা সকলে পরম আদরে খাইতে দিতো —দূর হইতে এইদৃশ্য দেখিয়া লীলাবতীর জিহ্বা হইতে জল ঝরিলেও চাইবার অনুমতি ছিলো না —
একদিন শাশুড়িমাতা লীলাবতীকে কঠোরভাবে বলিয়াছিলেন ” দেখ বাপু, নতুন বৌ মা হইতে চলিয়াছে তাহার খাদ্যে তোমার মতো বাঁজার নজর পড়ুক তাহা আমি সহ্য করিবো না।”
লীলাবতী ততদিনে ‘বাঁজা’ শব্দটি শুনিতে অভ্যস্থ হইয়া পড়িয়াছে।
সাড়ে নয় মাস ধরিয়া নতুন বৌকে বাড়িশুদ্ধ সকলে যত্ন আত্তি করিয়া বাড়ির উঠানের কোনায় পাতার ছাউনি দেওয়া আতুর ঘরে পাঠাইয়া স্বস্ত্বির নিঃশ্বাস ত্যাগ করিলো —
বহুক্ষণ ধরিয়া টানাপোড়েন চলিবার পর আতুর ঘর হইতে কান্নার আওয়াজ পাওয়া গেলো —
আতুরঘরের সামনে দন্ডায়মান স্বামী এবং শাশুড়িমাতার অপেক্ষার অবসান ঘটাইয়া ধাইমা কাপড়ে জড়ানো বস্তুটিকে হাতে তুলিয়া বলিলো প “খোকা হইয়াছে।”
খোকার আগমনে একাধারে শঙ্খধ্বনি, মিষ্টিমুখ হইতে থাকিলেও উঠানের পাতার ছাউনির আতুরঘরখানিতে নতুন বৌ এর তখন যমে মানুষে টানাটানি অবস্থা।
নতুন অতিথিকে পাইয়া নতুন বৌ এর প্রতি নজর দিবার মতো কেহ রহিলো না।
দূর হইতে লীলাবতী সব দেখিতেছিলো —
ধাইমা তাহার দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করিয়া বলিলো ” রোগিনীর অবস্থা ভালোবোধ করিতেছি না —দৌঁড়াইয়া যাও এক গামলা গরমজল লইয়া আসো আর বাড়ির সকলকে খবর দাও “—
লীলাবতীও যে নতুন বৌ এর প্রসবকালীন কোন কাজে লাগিতে পারে ভাবিয়া অন্দরমহলে গিয়া খবরখানি দিয়া গরমজল লইয়া আসিলো —
অদ্ভুতভাবে সকলে তখন খোকাকে লইয়া এমন ব্যাতিব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলো যে নতুন বৌ বাঁচিলো না মরিলো তাহাতে কাহারো তেমন উৎসাহ দেখা গেলো না।
একমাত্র লীলাবতীই উৎবিগ্ন হইয়া আতুরঘরের বাহিরে ঈশ্বরের নিকট নতুন বৌ এর সুস্থতা কামনা করিতে লাগিলো —
মাত্র একঘন্টার মধ্যে নতুন বৌ এর শরীরের সমস্ত জ্বালা জুড়াইলো — সে চিরকালের জন্য ঘুমাইয়া পড়িলো।
যাহারা এই নয়মাস নতুন বৌ এর এত যত্ন আত্তি করিয়াছিলো তাহারা পুতুলের মতো দাঁড়াইয়া নতুন বৌ এর কপালে একমুঠ সিঁদুর পড়াইয়া তাহাকে শেষ বিদায় জানাইয়া দায়িত্ব সারিলো —
ওইদিকে ঐ দুধের শিশুটি ক্ষুধার জ্বালায় প্রানপণ চিৎকার করিয়া চলিতেছে —
লীলাবতী সকলের অলক্ষ্যে শিশুটিকে বুকে জড়াইয়া ধরিলো —তাহার তপ্ত বক্ষের আবেশে শিশুটির সাময়িক আরাম হইলেও অভাববোধ রহিয়া গেলো মাতৃদুগ্ধের।
ইহার পর হইতে বাঁজা লীলাবতীর উপরই দায়িত্ব পড়িলো খোকার দেখাশুনা করিবার।
কাঁসার ঝিনুক বাটিতে দুগ্ধ খোকাকে যত্ন করিয়া খাওয়াইতে শিখিয়া গেলো লীলাবতী।
একের পর এক মাতার সমস্ত দায়িত্ব, কর্তব্য নিষ্ঠার সহিত পালন করিয়া খোকাকে যখন লীলাবতী বড় করিয়া তুলিলেন তখন সংসার খোকাকে বোঝাইলো “ইনি তোমার প্রকৃত মাতা নহেন ইনি পালকমাতা “–
খোকা তাহার পালকমাতার সহিত জন্মলগ্নেই হারাইয়া ফেলা জন্মদাত্রী মাতার কোন ফারাক খুঁজিয়া পাইলো না।
সমাজ, সংসার এমন পুত্রবাৎসল্য অথবা মাতৃপ্রেম মানিয়া লইবে কেন ?
শুরু হইলো মাতাপুত্রকে আলাদা করিবার ষড়যন্ত্র।
ষড়যন্ত্রের শিকার হইয়া লীলাবতী কোমর ভাঙিলেন।
শয্যাশায়ী এমন একজন আপদকে বাড়ুয্যেবাড়ির সদরে স্থান দেওয়া চলে না জ্ঞান করিয়াই তাহার এই বন্দোবস্ত।
মাতার জীবনযাত্রার সমস্যার তেমন সুরাহা করিতে না পারিলেও খোকার তাহার মাতার প্রতি মাতৃপ্রেম একবিন্দুও কমিলো না —
সারাদিন কর্মব্যস্ততার পর খোকাও যেমন তাহার মাতৃদর্শনের জন্য উৎসুক হইয়া থাকে ঠিক লীলাবতী বাড়ুয্যেও একই ভাবে বলিতে থাকেন
” কে? কে ওইখানে ?— খোকা আসিলো বুঝি?”