পাথরের ফুলদানি
গতকাল গভীর রাতে পেড্রো সমুদ্রতীর দেখেছিল। কয়েক মাস পর ওরা ডাঙার খোঁজ পেল। ফ্রান্সিসের বন্ধু রা খুশিতে তখন লাফালাফি করছে। ফ্রান্সিসেরও ঘুম ভেঙে গেল। মারিয়াও খুশি। বলল–ডাঙা দেখা গেছে। ঐ ডাঙায় যারা থাকে তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারলে জানা যাবে আমরা কোথায় এলাম। আমাদের দেশই বা কতদূরে।
–হ্যাঁ। তা জানা যাবে। ফ্রান্সিস বলল। তারপর বিছানা থেকে উঠে বলল– কিন্তু অজানা জায়গায় নামা বিপজ্জনক।
–সেই ভয় পেলে তো কিছুই করা যায় না। মারিয়া বলল।
তখনই দরজায় টোকা দেবার শব্দ হল। ফ্রান্সিস দরজা খুলল। হ্যারি দাঁড়িয়ে। হ্যারি হেসে বলল–ডাঙা দেখা গেছে। এখন এটাই ভাববার যে আমরা এখানে নামবো কি না।
ফ্রান্সিস বলল–নেমে লোকজনের দেখা পেলে তবে তো বুঝতে পারবো কোথায় এলাম।
–তা তো বটেই–ফ্রান্সিস বলল–এখন ভোর হয়ে আসছে। তৈরি হয়ে যেতে যেতে সকাল হয়ে যাবে। তখন ঐ ডাঙায় যাওয়া বিপজ্জনক।
তবে তো কাল রাত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। হ্যারি বলল।
তাই হবে। কাল রাত বাড়লে আমরা যাবো। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। হ্যারি মারিয়াকে বলল–রাজকুমারী কয়েক মাস ধরে আপনি নিশ্চয়ই খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন।
দুশ্চিন্তা হয় না? চারদিকে শুধু জল আর জল। মাটির দেখা নেই। এটা ভালো লাগে? রাজকুমারী মারিয়া বলল।
–তা তো বটেই। যাক গে–ডাঙার খোঁজ পাওয়া গেছে। এটাই বড় কথা। চলি।
হ্যারি চলে গেল। ফ্রান্সিস এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল। মারিয়াও নিশ্চিন্ত হয়ে শুয়ে পড়ল। অল্পক্ষণের মধ্যেই দুজনে ঘুমিয়ে পড়ল।
সকাল হল। সকালের খাওয়া দাওয়া চলল। তখনই রাঁধুনী হ্যারির কাছে এল। হ্যারি বলল–কী ব্যাপার?
ব্যাপার বড় চিন্তার। রাঁধুনী বলল।
–চিন্তার? কী হয়েছে? হ্যারি বলল।
–খাবার জল ফুরিয়ে এসেছে। দু’একদিনের মধ্যেই খাবার জল ফুরিয়ে যাবে। রাঁধুনি বলল।
বলো কি। হ্যারি বেশ চিন্তায় পড়ল। বলল–দেখি। ফ্রান্সিসকে বলছি।
হ্যারি ফ্রান্সিসের কেবিন ঘরের সামনে এল। দরজায় টোকা দিল। ফ্রান্সিস একটা থালায় সকালের খাবার নিয়ে যাচ্ছিল। যেতে যেতে বলল–দরজা খোলা। হ্যারি ঘরে ঢুকল। বলল–ফ্রান্সিস–ভীষণ সমস্যায় পড়লাম।
-কেন? কি হয়েছে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
রাঁধুনী বলে গেল-খাবার জল ফুরিয়ে আসছে হ্যারি বলল। ফ্রান্সিস একটু ভেবে নিয়ে বলল-জল কম খেতে হবে। একটু পরেই আমাদের ডাঙায় নামতে হবে। খাবার জলের খোঁজ করতে হবে। জল আনতে হবে।
–এই দিনের বেলাই যাবে? হ্যারি বলল।
–তাই যেতে হবে। উপায় নেই। রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করা চলবে না।
–দিনের বেলা যাবো? বিপদে পড়বো না তো? হ্যারি বলল।
–দেখা যাক। বিপদ হতে পারে। তার মোকাবিলা করবো। তরোয়ালের লড়াই এ নামতে হলে নামবো। তবে সবই করতে হবে খুব হিসেব করে। অবস্থা বুঝে। ফ্রান্সিস বলল।
তাহলে দেরি করে কি লাভ। এখুনি চলো। হ্যারি বলল।
–তুমি আর শাঙ্কো তৈরি হও। আমি আসছি। ফ্রান্সিস বলল।
অল্পক্ষণের মধ্যেই ফ্রান্সিস তরোয়াল কোমরে ঝুলিয়ে জাহাজের ডেক-এ উঠে এল। ততক্ষণে হ্যারি শাঙ্কো উঠে এসেছে।
ভাইকিং বন্ধুরা এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব খাবার জল ফুরিয়ে গেছে। আমরা খাবার জল আনতে যাচ্ছি। বিপদ আপদ হতে পারে। কিন্তু আমি তার পরোয়া করছি না। আমাদের যদি ফিরতে দেরি হয় তোমরা দুশ্চিন্তা করো না।
ওদিকে শাঙ্কো দুটো জলের পীপে জাহাজের দড়ি দড়া ধরে ধরে ছোট নৌকোয় তুলেছে। ফ্রান্সিস হ্যারি হালের দিকে আসছে তখন হ্যারি আস্তে বলল–ফ্রান্সিস রাজকুমারীকে একটু সান্ত্বনা দিয়ে যাও। ফ্রান্সিস ফিরে তাকাল। মারিয়া পেছনে পেছনে আসছিল। ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে পড়ল। মারিয়াকে বলল–মারিয়া দুশ্চিন্তা করো না। আমাদের কোন ক্ষতি হবে না।
দড়ির মই হালের কাছে নিচে নামিয়ে দেওয়া হল। ফ্রান্সিস আর হ্যারি মইয়ের সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে ছোট নৌকোটায় নেমে এল। শাঙ্কো নৌকোটার বাঁধা দড়ি খুলে দিল। নৌকোটা জাহাজের গা থেকে সরে এল। শাঙ্কো বৈঠা বাইতে লাগল। নৌকো তীরভূমির দিকে চলল।
ফ্রান্সিস ডাঙার দিকটা চোখ কুঁচকে দেখতে লাগল। রোদ বেশ চড়া। ডাঙার বাঁপাশে দেখল শুধু বালি। মাটি নেই। ডানপাশে মাটি দেখল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে নরম মাটি নয়। বেশ শক্ত মাটি। ঘরবাড়ি বা লোকজন দেখা গেল না। ফ্রান্সিসের তখন একটাই চিন্তা–এখানে তো নামবো কিন্তু এখানে খাবার জল পাবো তো? তখনই দেখল ডানদিকে একটা টিলার মত।
শাঙ্কো নৌকো তীরে ভেড়াল। তিনজনেই নামল। শাঙ্কো বৈঠা রেখে নৌকোটা টেনে তীরের বেশ কিছু ওপরে নিয়ে এসে রাখল। যদি খুব জোর জোয়ারও আসে নৌকোটা ভেসে যাবে না।
এবার তিনজনে খালি জলের পীপে নিয়ে চলল। ফ্রান্সিস বলল–বাঁ দিকটা মনে হচ্ছে মরুভূমি। ডানদিকে ঐ টিলাটার দিকে চল। তিনজনে দুটো পীপে নিয়ে চলল।
ওরা টিলার কাছে এল। ছোট টিলা। শুকনো খটখটে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার টিলার নিচটা কিচ্ছু ওপাশে ছোট বুনো গাছ ফার্ণ গাছ। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–হ্যারি এখানে জল আছে। টিলার ওপাশে চল। ওরা টিলাটা ঘুরে ওপাশে আসছে তখন খুব মৃদু জল পড়ার আওয়াজ শুনল। কাছাকাছি আসতেই দেখল টিলার মাঝামাঝি জায়গা থেকে জল বেরোচ্ছে। ঝর্ণা। জল নিচে পড়ে পড়ে গর্ত হয়ে গেছে। ফ্রান্সিস বলল–শাঙ্কো গর্ত মত জায়গাটাতে পীপে বসাও। তবে খুব বেশি জল পড়ছে না। পীপে ভরতে সময় লাগবে।
শাঙ্কো গর্তটায় পীপে বসাল। পীপেয় জল পড়তে লাগল। শাঙ্কো ওখানে দাঁড়িয়ে রইল। ফ্রান্সিস আর হ্যারি টিলার ছায়ায় বসে রইল।
একটা পীপে ভরে গেল। শাঙ্কো পীপেটা ধরে এক ঝাঁকুনি দিয়ে কাঁধে তুলে নিল। নিজেদের নোঙর করা জাহাজের দিকে চলল। ফ্রান্সিস অন্য পীপেটা বসাল। পীপেটা ধরে রেখে ঝর্ণার জল ভরতে লাগল।
হঠাৎ ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। তখনও পীপেটা জলে ভরে নি। ফ্রান্সিস চাপা গলায় বলল–হ্যারি আমরা বোধহয় বিপদে পড়লাম। পেছনের জংলা ডালপাতা ভাঙবার শব্দ হল। পাঁচ-ছ’জন ইনকা যোদ্ধা খোলা তরোয়াল হাতে ছুটে এল। ফ্রান্সিস আর হ্যারিকে ঘিরে দাঁড়াল। যোদ্ধাদের মাথায় ফেট্টির মতো বাঁধা তাতে নানা পাখির পালক গোঁজা। যোদ্ধাদের পরনে নানা রঙের পোশাক। তাতে রঙীন সুতোর কাজ করা। মাথায় লম্বা চুল। বেশ শক্ত সমর্থ চেহারা। তখনই ফ্রান্সিসের পীপেটা ভরে গেছে।
ইনকা যোদ্ধাদের দলনেতা এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস আর হ্যারির দিকে তাকিয়ে বলল–তোমরা কারা? কোত্থেকে এখানে এসেছো? হ্যারি বলল–আমরা ভাইকিং। আমাদের জাহাজে চড়ে আমরা নানা দেশ ঘুরে বেড়াই। গুপ্তধনের কথা শুনলে আমরা সেই গুপ্তধন উদ্ধার করি।
–তারপর গুপ্তধন নিয়ে পালাও। দলনেতা বলল।
–এই অভিযোগ মিথ্যে। ফ্রান্সিস বলল।
এবার দলপতি তরোয়াল কোষবদ্ধ করল। বলল–তোমাদের তরোয়ালও ফেলে দাও। ফ্রান্সিস আর হ্যারি তরোয়াল রেখে দিল বালির উপর। দলপতি বলল–এখন বলো তো, এখানে কেন এসেছো?
–আমাদের জাহাজে পানীয় জল ফুরিয়ে গেছে। এখানে ঝর্ণা থেকে জল নেব বলে এসেছিলাম। আমাদের কোন অসৎ উদ্দেশ্য নেই। ফ্রান্সিস বলল।
যা হোক–তোমাদের বন্দী করা হল। দলপতি বলল।
–আমরা তো কোন অপরাধ করি নি। তাছাড়া আমাদের জাহাজে আমাদের বন্ধুরা। সব তৃষ্ণার্ত। তাদের জন্যে এই জলভরা পীপে নিয়ে যাচ্ছিলাম। এটা জাহাজে পৌঁছে দিয়ে আমি চলে আসবো। ফ্রান্সিস বলল।
–যদি পালাও? দলপতি বলল।
–আমার বন্ধু হ্যারি রইল। বন্ধুকে ফেলে তো পালাতে পারবো না।
হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস শাঙ্কো আসছে। শাঙ্কো আস্তে আস্তে এগিয়ে এল। বুঝল ওরা বন্দী হল।
–শাঙ্কো তরোয়াল ফেলে দাও। শাঙ্কো ওদের কাছে এল। তরোয়াল কোমরের ফেট্টি থেকে বের করে বালির ওপর ফেলে দিল। দলপতি একজন ইনকা সৈন্যকে ইঙ্গিত করল। সেই সৈন্যটি তরোয়ালগুলো তুলে নিল। নিজের কোমরে প্যাচানো দড়ি খুলল। তরোয়ালগুলি বেঁধে ঝুলিয়ে নিল।
–তাহলে আমি জলের পীপেটা জাহাজে রেখে আসছি। ফ্রান্সিস বলল।
–তুমি যদি আর না ফেরো? দলপতি বলল।
দুই বন্ধুকে ফেলে পালাবো? ফ্রান্সিস বলল।
–তা পারো। দলপতি বলল।
–আমাদের বন্ধুত্ব অত ঠুনকো নয়! যাক গে বেলা বাড়ছে। আমি যাচ্ছি।
তুমি যদি না ফেরো তাহলে তোমার বন্ধুদের এখানেই হত্যা করা হবে। ফ্রান্সিস বলল–হ্যারি শাঙ্কো আমি জলের পীপে পৌঁছে দিয়ে আসছি। শাঙ্কো ওদের দেশী ভাষায় বলল–বন্ধুদের এনে লড়াই করতে পারি। এরা ছয় জন।
–না। ঐ দেখ। ঘোড়ায় চড়ে ইকা যোদ্ধারা আসছে! মানে সৈন্যাবাস কাছেই আছে।
দলপতি ফ্রান্সিসকে বলল–বেলা বাড়ছে। জল নিয়ে যাও। তারপর ফিরে এসো।
ফ্রান্সিস দেখল ঘোড়ায় চড়ে ইকা যোদ্ধারা এদিকেই আসছে। ফ্রান্সিস পীপেটা কাঁধে তুলে নিল। চলল ওদের জাহাজের দিকে।
টিলার পাশেই কয়েকটা পাথরের খণ্ড পড়ে ছিল। হ্যারি তার একটাতে বসল। শাঙ্কোও পাশে বসল! যোদ্ধারাও কয়েকজন পাথরে বসল। এখানে ঝর্ণাটা আছে বলে পাথরগুলো খুব গরম নয়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্রান্সিস নৌকো চালিয়ে তীরে উঠল। নৌকোও পারের ওপর দিকে টেনে এনে রাখল।
ফ্রান্সিস হ্যারিদের কাছে এসেছে তখনই সাত আটজন অশ্বারোহী যোদ্ধা ওখানে এল। টিলাটার ওধারে যোদ্ধারা বসেছিল। অশ্বারোহী যোদ্ধারা ওখানে এল। অশ্বারোহীদের মধ্যে সবচেয়ে সামনে আসছে একজন একটা ধবধবে সাদা ঘোড়ায় চড়ে।
যোদ্ধারা উঠে পরপর দাঁড়াল। বোঝা গেল অশ্বারোহী যোদ্ধাদের মধ্যে ঐ লোকটিই সেনাপতি। গায়ে সূতীর কাজ করা পোশাক। কপালে নীল রঙের ফেট্টি। তাতে পাখির পালক গোঁজা। কোমরে কোষবদ্ধ তরবারি। তারা সংখ্যায় সাত আটজন। তারা আগের যোদ্ধাদের সামনে এল। সেনাপতি দলনেতাকে বলল কাঁপাকের কোন খোঁজ পেলে? যোদ্ধারা মাথা নুইয়ে সেনাপতিকে সম্মান জানাল। দলপতি বলল– না। আমরা চারদিকে খোঁজখবর নিচ্ছি।
–হ্যাঁ। তল্লাশী চালিয়ে যাও। সেনাপতি বলল। তারপর ফ্রান্সিসদের দেখিয়ে বলল–এরা কারা?
–এরা ভাইকিং। দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়। গুপ্তধন আবিষ্কার করে।
–ও। ওদের বন্দী করে রাখো। ভাইকিংরা জলদস্যু। সেনাপতি বলল।
–এ আমাদের বিরুদ্ধে কুৎসা। যারা শৌর্যে বীর্যে আমাদের সঙ্গে পারে না তারা এসব কুৎসা রটনা করে। হ্যারি বলল।
তোমাদের কয়েদঘরেই থাকতে হবে। সেনাপতি বলল।
–কিন্তু কেন? আমরা কী অপরাধ করেছি? ফ্রান্সিস বলল।
–সেসব বিচার করবেন রাজা পাচাকুটি। সেনাপতি বলল।
সেনাপতি আর যোদ্ধারা ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল।
ফ্রান্সিস দলপতির দিকে তাকিয়ে বলল–আমাদের কী হবে?
দলপতি বলল–তোমরা তো বন্দী। আমাদের সঙ্গে যাবে রাজধানী কুজকোয়। রাজা পাচাকুটির রাজসভায় তোমাদের যেতে হবে। তারপরে বন্দী জীবন মেনে নিতে হবে। ফ্রান্সিস চড়া গলায় বলল–আমাদের কী পেয়েছো? তোমাদের দাস?
–বেশি মেজাজ দেখিও না। জানো তোমাদের এক্ষুনি খতম করতে পারি। দলনেতা বলল।
–আমাদের লড়াই করার সুযোগ না দিয়ে পারবে। কিন্তু যদি আমাদের হাতে তরোয়াল দাও–তোমরা ধূলোর মতো উড়ে যাবে। আমাদের হাতে তরোয়াল থাকলে স্বয়ং শয়তানও আমাদের ভয় করে। তোমরা তো শিশু। ফ্রান্সিস বলল। ফ্রান্সিসের কথা শেষ হবার আগেই শাঙ্কো বলে উঠল ফ্রান্সিস-লড়াই। যে সৈন্যের হাতে দড়িবাঁধা ওদের তিনটে তরোয়াল ছিল শাঙ্কো সেই সৈন্যটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সৈন্যটি ছিটকে পড়ে গেল। শাঙ্কো অতি দ্রুত একটা তরোয়াল খুলে ফ্রান্সিসের দিকে ছুঁড়ে দিল। ফ্রান্সিস তরোয়ালের হাতলটা ধরে ফেলল। শাঙ্কো নিজেও একটা তরোয়াল নিল। অন্যটা হ্যারিকে দিল। ওদিকে সৈন্যরাও তখন তরোয়াল কোষমুক্ত করেছে।
শুরু হল তরোয়ালের লড়াই। ফ্রান্সিস দলপতির সঙ্গে লড়াই করতে লাগল। তরোয়াল চালাতে চালাতে বলল–তোমরা অস্ত্র ত্যাগ কর। নইলে মরবে। জাহাজ থেকে যদি আমার বন্ধুরা আসে তোমরা কেউ বাঁচবে না। এখনও বলছি অস্ত্র ত্যাগ কর। আমরা জাহাজে ফিরে যাব। কিন্তু দলপতি তাতে কর্ণপাত করল না। তরোয়াল চালাতে লাগল। এবার ফ্রান্সিস তরোয়াল পেছন দিক থেকে ঘুরিয়ে এনে দলপতির তরোয়ালে এত জোরে ঘা মারল যে দলপতির হাত থেকে তরোয়াল ছিটকে গেল। ও বালির ওপর পড়ে গেল। ফ্রান্সিস হাঁপাতে হাঁপাতে তরোয়ালের গা-টা দলপতির গলায় ঠেকিয়ে বলল–বাঁচতে চাও না মরতে? সেনাপতি হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে দাঁড়াল। অন্য সৈন্যরাও লড়াই থামাল। দলপতি বলল–চল। অন্য সৈন্যরা তরোয়াল খাপে ঢুকিয়ে দলপতির পেছনে পেছনে চলল। মরুভূমির ওপর দিয়ে ওরা হেঁটে চলে গেল। ফ্রান্সিস বলল হ্যারি জাহাজে চল। তিনজনে সমুদ্রের দিকে নামতে লাগল। হ্যারির বাঁ কাঁধে তরোয়াল ছুঁয়ে গেছে। হ্যারি অল্পই আহত হয়েছে। তার কাঁধের কাছে পোশাক রক্তে ভিজে গেছে। ফ্রান্সিস শাঙ্কোর শরীরও অক্ষত নেই।শরীরে তরোয়ালের ফলায় কেটেটেটে গেছে।
তিনজনে নৌকোটার কাছে এল। নৌকো জলে নামাল। উঠে বসল। শাঙ্কো বৈঠা বাইতে লাগল। নৌকো জাহাজের দিকে চলল।
জাহাজ থেকে দড়ির মই ফেলা হল। ফ্রান্সিসরা জাহাজে উঠে এল। ফ্রান্সিস হ্যারিকে নিয়ে ভেন-এর কাছে এল। বলল–হ্যারির কাঁধ বর্শায় কেটে গেছে। ওষুধ দাও। ফ্রান্সিস চলে এল। ভেন হ্যারির জন্যে ওষুধ তৈরি করতে লাগল।
নিজের কেবিনঘরে ঢুকতে মারিয়া এগিয়ে এল। বর্শায় কেটে গেছে। নিশ্চয়ই তরোয়ালের লড়াই করেছো।
–আমাদের জীবনটাই তো এরকম। শুধু লড়াই। ফ্রান্সিস পোশাক খুলতে খুলতে বলল।
–না। তুমি আর তরোয়াল ধরতে পারবে না। মারিয়া বলল।
–এটা একটা কথা হল। বেঁচে থাকতে গেলে লড়াই করতেই হবে। কখনও বুদ্ধির লড়াই। কখনও শরীরের লড়াই। এই লড়াইয়ের মধ্যেই আমাদের থাকতে হয়। ফ্রান্সিস বলল।
–না। তুমি আর লড়াইয়ের মধ্যে যাবে না। মারিয়া বলল।
–মারিয়া তুমি তো এতদিনে আমাকে বুঝেছো। আমি সব লড়াই থামিয়ে গুপ্তধন আবিষ্কার না করে থাকবো কী করে? ফ্রান্সিস বলল।
–না। আমার ভয় করে। মারিয়া বলল।
ফ্রান্সিস হো হো করে হেসে উঠল। বলল–এতে ভয় পাওয়ার কী আছে। চার পাঁচজনের সঙ্গে একা লড়তে গেলে একটু চিন্তা হয় বৈকি। তখন লড়াইয়ের কৌশলটা পাল্টাতে হয়। তবে আমি ভয় পাই না। একটু থেমে বলল মারিয়া তুমি তো কখনও এত দুর্বল হও নি। হঠাৎ এত দুশ্চিন্তায় পড়লে কেন?
–না। দেশে ফিরে চল। মারিয়া বলল।
–দেশে ফিরে তো সেই খাও দাও ঘুমোও। এক নিশ্চিন্ত জীবন। এই জীবনকে মেনে নেওয়া আমার চরিত্রবিরোধী। আমি কক্ষনো মেনে নিতে পারবো না। ফ্রান্সিস বলল।
বয়েস তো হচ্ছে। মারিয়া বলল।
যতদিন পিরবোঘুরে বেড়াবো–এ দেশ ও দেশ দ্বীপ দেশ। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিস তোমার এবার বিশ্রাম নেওয়া উচিত। মারিয়া বলল।
–অসম্ভব। আমার জীবনে বিশ্রাম বলে কিছু নেই। ফ্রান্সিস বলল।
কথা শোন। এবার দেশে চলো। মারিয়া বলল।
-ঠিক আছে–তোমরা ফিরে যাও। আমার বন্ধুদের মধ্যে যারা আমার সঙ্গে কি থাকতে চায় তারা থাকবে। ফ্রান্সিস বলল।
–না। তোমাকে এই বিদেশে ফেলে রেখে আমি যাব না। মারিয়া বলল।
–আমিও সেটাই চাই। ফ্রান্সিস বলল। তারপর বলল–খিদেয় পেট জ্বলছে।
ফ্রান্সিস হ্যারি আর শাঙ্কোকে নিয়ে রান্নাঘরে এল। রাঁধুনি বন্ধুরা অতি দ্রুত ফ্রান্সিসদের খেতে দিল।
খেয়ে দেয়ে ফ্রান্সিসরা যে যার কেবিনে চলে গেল। ফ্রান্সিসও ওর কেবিনঘরে এল। তারপর টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল। মারিয়া একটা ন্যাকড়া হাতে নিয়ে এল। ফ্রান্সিস যখন পোশাক ছাড়ছে তখন দেখেছে ফ্রান্সিসের কাঁধে পিঠে তরোয়ালের কাটার দাগ। মারিয়া ভেন-এর কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে এসেছে। মারিয়া ফ্রান্সিসের গায়ে সেই ওষুধ লাগানো ন্যাকড়াটা চেপে চেপে ধরতে লাগল। সেইসব কাটা জায়গাগুলো ভীষণ জ্বালা করে উঠল। ফ্রানিস মুখে শব্দ করল–আ-আ। ফ্রান্সিসের গায়ে ওষুধ দেওয়া হলে মারিয়া হ্যারি শাঙ্কোর কাছেও গিয়ে ওষুধ লাগিয়ে এল। হ্যারির কেবিনঘরে গিয়ে দেখল–ভেন হ্যারির ডান কাঁধে ন্যাকড়া বাঁধছে। মারিয়া ভেনকে বলল–খুব বেশি কেটেছে?
–তেমন কিছু নয়। তবে নিয়মিত ওষুধ লাগাতে হবে। সাতদিন একেবারে বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে। ভেন বলল।
–ভেন, আপনি ওষুধ খাওয়ার নির্দেশ দিয়ে গেছেন তো? মারিয়া বলল।
–হ্যাঁ, হ্যারিকে সব নির্দেশ দিয়েছি। ভেন বলল। তারপর দুটো ওষুধের বোয়াম কাপড়ের ঝোলা হামানদিস্তা নিয়ে ভেন চলে গেল।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর বিস্কো কেবিনঘরে এল। বেশ গরম পড়েছে। কেবিনঘরে থাকা চলবে না। ও একটা মোটা কাপড়ের চাদর নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ডেক-এ উঠে এল। জোর হাওয়া বইছে। বিস্কো মাস্তুলের কাছে চাদরটা পাতল। তারপর শুয়ে পড়ল। আকাশের ছেঁড়া ছেঁড়া কালো মেঘ। আধখানা চাঁদ আকাশে। বিস্কো চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইল। চাঁদটা কখনো মেঘে ঢাকা পড়ছে। বেশ অন্ধকার তখন। মেঘ সরে যেতেই চাঁদ বেরিয়ে আসছে। তখন আলো। চাঁদ আবার মেঘে ঢাকা পড়ছে। বিস্কো চাঁদ আর মেঘের খেলা দেখতে লাগল। তারপর পাশ ফিরে শুল। একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ল।
বিস্কোর মত সাত আটজন ভাইকিং ডেক-এ ঘুমোচ্ছিল।
হঠাৎ একটা জোর শব্দ হতে বিস্কোর ঘুম ভেঙে গেল। বিস্কো এদিক ওদিক তাকালো। ভাবতে লাগল শব্দটা কোনদিকে হয়েছে? তখনই আবার শব্দ হল। বিস্কো এবার বুঝল শব্দ হয়েছে হালের দিকে। বিস্কো আস্তে আস্তে উঠে বসল। আস্তে আস্তে পা ফেলে চলল হালের দিকে। হালের কাছে আসতেই দেখল গায়ে, চাদর জড়ানো একটা লোক তখনই হাল থেকে জাহাজের ডেক-এ নামল। প্রায় অন্ধকারেই বিস্কো দেখল লোকটির কোমরে গোঁজা তরোয়াল। বিস্কো সাবধান হল। ভাবল ঐ লোকটা তরোয়াল বের করবার আগেই বিস্কো লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। লোকটা সাবধান হবার সুযোগই পেল না। চিৎ হয়ে ডেক-এর ওপর গড়িয়ে পড়ল। বিস্কো দ্রুত লোকটার কোমর থেকে তরোয়ালটা বের করে নিল। লোকটা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। বিস্কো বলল–তুমি কে? লোকটি ভাঙা গলায় বলল–দোহাই। তরোয়াল চালাবেন না। আমি সব বলছি।
–বেশ বলো।বিস্কো তরোয়াল নামিয়ে বলল। লোকটার গায়ে ইনকাদের পোষাক। বেশ ধূলো মাখা, মলিন।
বিস্কোদের কথাবার্তায় দুজন ভাইকিং বন্ধুর ঘুম ভেঙে গেল। দুজন বিস্কোদের কাছে এল। দেখল বিস্কো তরোয়াল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। বিস্কো এক বন্ধুকে বলল–যাও ফ্রান্সিসকে ডেকে নিয়ে এসো। বন্ধুটি ছুটে গেল। একটু পরেই ফ্রান্সিস এল। বিস্কোকে বলল কী ব্যাপার?
–এই লোকটা লুকিয়ে আমাদের জাহাজে উঠেছে। বিস্কো বলল।
ফ্রান্সিস লোকটার দিকে তাকাল। বলল, তুমি তো ইনকা?
হা। লোকটা মাথা ওঠানামা করল।
–তুমি আমাদের জাহাজে এসেছো কেন? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–আশ্রয় নিতে। লোকটি বলল।
–কেন? অন্য কোনখানে আশ্রয় নিতে পারতে। ফ্রান্সিস বলল।
–না। কোন ইনকার বাড়িতে আশ্রয় নেবার উপায় নেই। লোকটি বলল।
–কেন? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–সব বলছি। তার আগে আমাকে খেতে দিন। দুদিন যাবৎ না খেয়ে আছি। লোকটি বলল।
ফ্রান্সিস বিস্কোকে বলল–একে আমাদের রসুইঘরে নিয়ে যাও। পেট ভরে খেতে দাও। তারপর লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল–তোমার নাম কি?
কাপাক বলেই ডাকবেন। কাপাক বলল।
–বেশ। যাও। আমি তোমার ফেরার জন্যে অপেক্ষা করছি। ফ্রান্সিস বলল।
কাপাক খেতে গেল। তখনই হ্যারি এল। বলল–ফ্রান্সিস কী ব্যাপার?
–ঠিক বুঝতে পারছি না। এক ইনকা আমাদের জাহাজে লুকিয়ে উঠেছে। আমাদের কাছে আশ্রয় চায়। ও যেন বলতে চাইছে কোন ইনকা ওকে আশ্রয় দেবে না। কারণটা ও এখনও বলেনি। দুদিন না খেয়ে আছে। তাই আগে খেতে পাঠালাম। ফ্রান্সিস বলল।
–দেখা যাক–কথা বলে। হ্যারি বলল।
কিছুক্ষণ পরে বিস্কো কাপাককে নিয়ে এল। ফ্রান্সিসকে বলল কাপাক প্রায় তিনজনের খাবার খেয়েছে। বোঝাগেল ও সত্যিই খুব ক্ষুধার্ত ছিল।
ফ্রান্সিস বলল–কাপাক এবার তোমার পরিচয়টা দাও।
কাপাক বলতে লাগল–পেরুর বর্তমান রাজা পাচাকুটি। আমি তার ভাই।
-বলো কি? রাজার ভাই–তোমার এই দুর্দশা কেন? কোথাও থাকা, খাওয়ার জায়গা পাচ্ছো না! ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলো তো। ফ্রান্সিস বলল। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে কাপাক বলল-বড়ভাই আমাকে কিছু যোদ্ধার সঙ্গে পাঠিয়েছিল– তিতিকানা হ্রদের চারপাশে যে উপজাতিরা বাস করত তাদের যুদ্ধে হারিয়ে ঐ অঞ্চল ইনকা সাম্রাজ্যের মধ্যে আনতে। আমি যোদ্ধাদের নিয়ে তিতিকানা অঞ্চলে গেলাম। সেখানকার সব উপজাতিদের যুদ্ধে হারিয়ে দিলাম। অঞ্চলটা আনলাম ইঙ্কা সাম্রাজ্যের মধ্যে। উপজাতি সর্দারদের বন্দী করলাম। তিতিকানা অঞ্চলে একজন ইনকা আর কিছু সৈন্য রেখে আমরা ফিরে আসছিলাম। তখন কয়েকজন সৈন্য আমাকে মাজোর্কা নগরের কথা বলল। মাজোর্কা নগরের কথা আমি আগেও শুনেছিলাম। সৈন্য কয়েকজন বলল–তারা খবর পেয়েছে মাজোর্কার রাজা কুয়েক হুয়া এখন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ওখানে অরাজকতা চলছে। মন্ত্রী আর সেনাপতির মধ্যে মনোমালিন্য চলছে। সৈন্যরাও বুঝতে পারছে না কার হুকুম তারা মানবে–মন্ত্রীর না সেনাপতির? এই ডামাডোলের মধ্যে আমরা সহজেই মাজোর্কা জয় করতে পারব। আমি কিছুক্ষণ ভাবলাম। একটাই কথা ভাবলাম আমার দাদা মাজোর্কা জয় করতে বলে নি। বলেছিল তিতিকানা হ্রদের চারপাশের উপজাতিদের যুদ্ধে হারিয়ে রাজধানী কুজকোতে ফিরতে হবে। মাজোর্কা জয়ের নির্দেশ দাদা দেয় নি। তবু আমি ভাবলাম–যদি মাজোর্কা জয় করে আসি তাহলে দাদা বোধহয় মনঃক্ষুণ্ণ হবে না। ইনকাদের সাম্রাজ্যও তো বাড়বে এতে। কাজেই আমি সৈন্যদের নিয়ে যাত্রা করলাম মাজোর্কার দিকে। মারাত্মক ভুল করলাম। তখনও বুঝিনি এর ফল কী হবে।
–রাজা তখনও অসুস্থ? হ্যারি বলল।
–হ্যাঁ। আমরা খুব সহজেই মাজোর্কার সৈন্যদের হারিয়ে দিলাম। রাজপথের পাহারাদাররা পালিয়ে গেছে। মাজোর্কার লোকজন রাস্তায় নেই বললেই চলে। সবাই নিজেদের বাড়ির ভেতরে। আমরা বিনা বাধায় রাজবাড়ির সামনে এলাম। দেউড়ির বড় দরজাটা হাঁ করে খোলা।
আটদশজন রাজরক্ষী তরোয়াল উঁচিয়ে আমাদের দিকে ছুটে এল। আমি চাইনি আরো লড়াই হোক। তাই আমি চিৎকার করে ওদের বললাম– মিছিমিছি মরতে আসছো কেন? সমস্ত মাজোর্কা আমাদের অধীনে এখন। তোমরা অস্ত্র ত্যাগ কর। বিনা কারণে আর তোমাদের হত্যা করবো না। ওরা বুঝল ওরা পরাস্ত হয়েছে। এখন লড়াই করতে গেলে মৃত্যু অনিবার্য। ওরা অস্ত্র ত্যাগ করল।
-তারপর? হ্যারি জানতে চাইল।
–বলছি। কাপাক বলল। একটু চুপ করে থেকে কাপাক বলতে লাগল—
তখন সকাল হয়েছে। পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। রোদ ছড়িয়ে আছে চারদিকে।
–আমরা রাজবাড়িতে ঢুকলাম। সব পাহারাদার পালিয়েছে। বাইরের মন্ত্রণা ঘর পার হয়ে অন্তঃপুরে ঢুকলাম। একটা কাঠের বড় শয্যায় একজন গলা পর্যন্ত চাদরে ঢেকে শুয়ে আছেন। তার মাথার কাছে বসে আছেন একজন মহিলা। বুঝলাম এরাই রাজা আর রাণী। আমি বললাম–আপনারাই বোধহয় রাজা কুয়েক হুয়া আর রাণী।
অসুস্থ রাজা আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন। বললেন–আপনি ঠিকই বুঝেছেন। এখন আপনারা কি চান?
–আমি আপনাদের বন্দী করতাম। কিন্তু যা শুনেছিলাম তা ঠিক। আপনি গুরুতর অসুস্থ। আমি বললাম।
–হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন। আমার পুত্র কন্যাকে অন্যত্র রেখেছি। আপনি আমাদের হত্যা করতে পারেন।
আমি খোলা তরোয়াল কোষবদ্ধ করলাম। আমার সঙ্গীরাও তরোয়াল কোষবদ্ধ করল।
রাজা ক্ষীণস্বরে বললেন–ওষুধটা দাও। রাণী বিছানা থেকে উঠলেন। একটা চিনেমাটির গ্লাসে জল নিয়ে ওষুধের বড়িটা নিয়ে এগিয়ে এলেন। রাজাকে ওষুধ খাওয়ালেন।
আমি বললাম–মাননীয় রাজা আপনি অসুস্থ। আপনি এখানেই থাকবেন। ওষুধ খেয়ে সুস্থ হবার পর আপনাকে মাজোর্কা ছেড়ে চলে যেতে হবে। এটা আমার কথা বললাম। আমাদের রাজা পাচাকুটি এরপরে যা স্থির করবেন সেটাই করতে হবে। তবে আপনাদের গায়ে হাত দেওয়া হবে না এটা জেনে রাখুন। রাজার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মুখে দাড়ি গোঁফ চোখ দুটো কোটরে। সারা মুখ সাদাটে রক্তহীন। বুঝলাম রাজার আয়ু শেষ হয়ে এসেছে। ভাবছি কী করবো এখন।
রাজা কুয়েক হুয়া আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। বুঝলাম একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। অস্বস্তি হচ্ছিল। তাই বললাম–আপনি অমন করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? কাপাক থামল।
এসময় ফ্রান্সিস বলল–কাপাক আপনাকে তুমি করে বলা উচিত হয়নি। মাফ করবেন।
–না–না তাতে কী হয়েছে? কাপাক হেসে বলল।
হ্যারি বলল–আপনি কী যেন বলছিলেন।
-হা—-কাপাক বলল। তারপর বলতে লাগল–আমার কথা শুনে রাজা কুয়েক হুয়া আমাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন। আমি রাজার কাছে গেলাম। রাজা ফিস ফিস করে কী বললেন আমি ঠিক বুঝলাম না। রাজা বুঝল সেটা। আমাকে মাথা নামাতে ইঙ্গিত করল। আমি রাজার মুখের উপর ঝুঁকলাম। রাজা বললেন–আপনার সঙ্গের সৈন্যদের এখান থেকে দূরে যেতে বলুন। একটা খুব দরকারি কথা আপনাকে বলব। আমি সঙ্গের সৈন্যদের বললাম–তোমরা যাও। আমি আসছি। সৈন্যরা বেরিয়ে গেল।
রাণী ভেতরের ঘরে গিয়েছিলেন। তখনই রাণী ঘরে ঢুকলেন। রাজার শিয়রে গিয়ে বসলেন।
একটা কথা বলি।রাজা বললেন।
–কী কথা। রাণী বললেন।
–পুরুষানুক্রমে যে নক্সাটা গয়নার বাক্সে পড়ে আছে সেটা এঁকে দেব। রাজা বললেন।
–উনি কি পারবেন নক্সাটা ঠিক বুঝতে? রাণী বললেন।
–দেখা যাক। একটু থেমে বললেন–তাহলে নক্সাটা বের করে দাও। রাণী উঠে দাঁড়ালেন। রাজার মাথার বালিশের নিচে হাত ঢোকালেন। একটা চামড়ার ছোট্ট ব্যাগমত বের করলেন। রাজার হাতে দিলেন। রাজা ওটা হাতে নিলেন। ব্যাগটা আমাকে দিলেন। আমি ছোট্ট ব্যাগটা খুললাম। দেখি একটা গোল বিবর্ধক কাঁচ রয়েছে একটা খোপে। অন্য খোপ থেকে বেরুলো একটা নক্সাটা ছোট্ট চৌকোনো পার্চমেন্টের শক্ত কাগজ।
–ঐ কাগজে একটা নকশা আঁকা আছে। রাজা বললেন। আমি দেখেটেখে কিছুই বুঝলাম না।
–ঐ বিবর্ধক কঁচটা দিয়ে নক্সাটা দেখুন। রাজা বললেন।
একটু থেমে কাপাক বলল–আমি বিবর্ধক কাঁচটা দিয়ে দেখলাম–তাসের মতো চৌকোনো কাগজটার চারদিকে সোজা দাগ। চারদিকে চারটে করে ফুলদানি তাতে ফোঁটা ফুল বুঝলাম এই নকশার অর্থ বের করতে আমার সময় লাগবে। বললাম তাহলে এই নকশাটা আমাকে দিলেন?
-হ্যাঁ। আমার ঠাকুর্দার হাত থেকে বাবা পেয়েছিলেন। ঠাকুর্দা বলেছিলেন নক্সা দিলাম। এর অর্থ বের করতে পারলে তুমি প্রচুর হীরে মণি মুক্তোর অলংকার পাবে। সোনা, রূপো তো পাবেই। রাজা হাঁপাতে লাগলেন। আমি বললাম–আমি বুঝেছি। আর কথা বলবেন না। আমি চলি। আপনি বিশ্রাম করুন। আমি চলে এলাম।
ঘোড়ায় চড়ে সমস্ত মাজোর্কা ঘুরলাম। রাজার তৈরি সৈন্যাবাস ফাঁকা। কেউ নেই। আমি আমার সৈন্যদের সৈন্যাবাসে আসতে খবর পাঠালাম।
কিছুক্ষণের মধ্যে সৈন্যরা এল। আমি একটা ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। নক্সাটা কোমরে গোঁজা। বের করলাম। বিবর্ধক কাঁচ দিয়ে বিকেলের পড়ন্ত আলোয় নক্সাটা বেশ কিছুক্ষণ দেখলাম। কিন্তু প্রায় কিছুই বুঝলাম না।
-ঠিক আছে–নক্সাটা পরে দেখছি। তারপর কী করলেন? ফ্রান্সিস বলল।
রাতের খাবার খেয়ে ঘরে এলাম। ক্লান্ত শরীর। শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ একটা চিন্তা মাথায় এল। আচ্ছা–নকশাটা বোঝাচ্ছে রাজা কুয়েক হুয়ার ঠাকুর্দার ধনসম্পদ কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলেন? যদি গোপনেই রাখলেন তবে ছেলেকে মানে রাজা কুয়েক হুয়াকের বাবাকে বললেন না কেন? না-না। কাল সকালে একবার রাজার কাছে যেতে হবে। আরো কিছু জানার আছে। কথা বলা থামিয়ে কাপাক বলল–আপনাদের শুনতে একঘেয়ে লাগছে নিশ্চয়ই।
— না না ফ্রান্সিস বলল–আপনি বলুন।
কাপাক বলতে লাগল–আমি পরদিন সকালে রাজা কুয়েক হুয়ার কাছে গেলাম। সঙ্গে ঈগরকে নিয়ে গেলাম। রাজার শয়নঘরে ঢুকলাম। দেখি রাজা উঠে বসেছেন। রাণী তাকে সকালের খাবার খাইয়ে দিচ্ছেন।
–তা হলে আমি যাই। পরে আসবো। আমি বললাম।
–না–না। রাজা মুখ মুছতে মুছতে বললেন–বসুন। আমার হয়ে গেছে।
দেয়ালের কাছে রাখা আসনে দু’জন বসল। এবার আমি বললাম একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না।
–কোন কথা? রাজা বললেন।
–আপনার ঠাকুর্দা ধনসম্পদ গোপনে রেখেছিলেন কেন? আমি জানতে চাইলাম।
–এই মাজোর্কার নদীর ওপারে থাকে দুতিন গোষ্ঠীর বুনোমানুষরা। দুটি গোষ্ঠী সভ্য হয়েছে কিন্তু একটি গোষ্ঠী এখনও বুনো স্বভাবের। এরা মাঝে মাঝে এই মাজোর্কা নগরে এসে লুঠপাট করে পালিয়ে যায়। তাই এদের হাত থেকে বাঁচাতে ঠাকুর্দা গোপনে ধনসম্পদ রেখেছিলেন পরে পিতাকে বলে যাবেন বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু ঐ বুনোমানুষদের সঙ্গে লড়াইয়ে তিনি গুরুতর আহত হন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যান। বাবাকে কিছু বলে যেতে পারেন নি। আমিও অবশ্য ঐ ধনসম্পদের আশা ছেড়ে দিয়েছি।
–তা কেন? আমি দেখছি। আমি বললাম। কাপাক বলল।
দেখুন চেষ্টা করে। রাজা বললেন।
আমি বললাম–আপনার প্রাসাদরক্ষীরা কোথায় গেল?
–এই রাজবাড়ির পেছনদিকে একটা বড় ঘর আছে। ওটাই দ্বাররক্ষীদের থাকবার ঘর। ওরা বোধহয় বেরোতে সাহস পাচ্ছে না।
–ঠিক আছে। আমি ওদের ভরসা দিচ্ছি। আমি বললাম। রাজবাড়ির থেকে বাইরে এলাম। তারপর রাজবাড়ির পেছনে গেলাম। রাজার রক্ষীদের বললাম– কাজে যাও। কোন ভয় নেই। বিস্তৃত মাঠ পার হয়ে আমরা নগরে এলাম। ঈগরকে বললাম–গলা চড়িয়ে বলে দে আপনারা যে যার বাড়িতে চলে আসুন। আর লড়াই হবে না। ঈগর আমার কথাগুলো জোরে চেঁচিয়ে বলল। লোকজন আস্তে আস্তে ফিরে আসতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ ধরে এই প্রচার চালালাম তারপর আস্তানায় ফিরে এলাম।
–তারপর? হ্যারি বলল।
–বিকেলের দিকে আমি ঈগরকে নিয়ে নদীর দিকে গেলাম। তখন অন্ধকার হয়ে আসছে। দেখলাম নদীটি বেশ নীচে দিয়ে বয়ে চলেছে। ঢেউ নেই তেমন। তবে আন্দাজে বোঝা যাচ্ছে বেশ স্রোত আছে। হঠাৎই দেখলাম একটা নৌকো নদীতে দোল খাচ্ছে। আমি ভীষণভাবে চমকে উঠলাম–বুনোমানুষ! জোরে বললাম–ঈগর পালা। আমার কথা শেষ হওয়ামাত্র পিঠে বর্শার খোঁচা খেলাম। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। ছোটার চেষ্টা করলাম না। ছুটতে গেলে বর্শা পিঠে ঢুকে যাবে। ঈগর প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল—বুনোমানুষ।
–চুপ করে ওরা যেমন নির্দেশ দেয় সেভাবেই চলল। আমি বললাম।
চারপাঁচজন বুনোমানুষ বর্শা হাতে পাশের ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এল। একটা বুনোমানুষ আমাদের কাছে এসে কী বলল। কিছুই বুঝলাম না। বুনোমানুষদের দেখলাম। সারা গায়ে লোম। মুখে লালচে দাড়ি গোঁফ। মাথায় কঁকড়া লাল চুল। যে আমার পিঠে বর্শার মুখটা চেপে ধরেছিল সেই বর্শার মুখটা জোরে চেপে ধরল। বুনোমানুষরা তখন হাঁটতে শুরু করেছে। নদীর ঢালু পার দিয়ে আমরা নামতে লাগলাম। আমরা দুজনে কখনও কখনও হোঁচট খাচ্ছি। কিন্তু বুনোমানুষরা সোজা চলেছে। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার নয়। আকাশে ভাঙা চাঁদ। এই আবছা আলোতেও চারদিকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না।
ওরা ঠেলে নৌকোয় ওঠালো। সারাক্ষণ পিঠে বর্শার মুখ চেপে ধরা। সবাই নৌকোয় উঠল। ওরা এমনভাবে বসল দাঁড়ালো সহজে সবাই এঁটে গেল। অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে নৌকো চলল। নদীর জল ছুঁয়ে ঠাণ্ডা বাতাস বইল। একজন বৈঠা বাইতে লাগল।
ওপারে নৌকো এসে লাগলো। সবাই আস্তে আস্তে নেমে এল। আমার পিঠে বর্শার খোঁচা। আমি আর ঈগর চললাম। আবছা দেখলাম ঈগরের পিঠেও একজন বর্শা চেপে ধরে আছে। নদীর ওপারে উঠে গাছগাছালি পার হয়ে একটা উঠোনের মত জায়গায় এলাম। আমি শুধু চারদিকে নজর রেখে যাচ্ছি কীভাবে পালাবো। একটা কথা বুঝলাম না বুনোমানুষরা আমাদের ধরল কেন? আমাদের নিয়ে ওরা কী করবে?
ওরা উঠোনের একপাশে আমাদের দাঁড় করাল। প্রথমে একজন হাতে দড়ি নিয়ে এল। ঈগরের হাত বাঁধল। আমার কাছে আসতেই আমি ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠলাম। বুনোমানুষরা হকচকিয়ে গেল। আমি দুহাত নেড়ে বার বার কেঁদে উঠতে লাগলাম। বুনোমানুষরা হো হো করে হাসতে লাগল। আমি বাঁ হাতের কনুইটা বার বার দেখাতে লাগলাম। বুনোমানুষটা কী ভাবল জানি না। আমার হাত বাঁধলো না।
ওরা উঠোনের মাঝখানে আগুন জ্বালল। আগুনটা ঘিরে ওদের নাচ শুরু হল। দুটো কাঠ ঠুকে তাল দিতে লাগল কয়েকজন।নাচ চলল। রাত গম্ভীর হল। আমি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে নজর রাখছি। বুনোমানুষরা কে কী করছে।
একসময় দেখলাম একজন বুনোমানুষ একগাদা শুকনো কাঠ অগ্নিকুণ্ডে ফেলে দিল। আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। এবার বুনোমানুষটা ঈগরের কাছে এল। ঈগরের হাতে বাঁধন আর একটা দড়ি বাঁধাল। আমি চিৎকার করে বললাম–ঈগর পালাও। আমি কাছেই দাঁড়ানো এক বুনোমানুষের হাত থেকে বর্শাটা এক ঝাঁকুনি দিয়ে কেড়ে নিলাম। বললাম–ঈগর ছোটো। দুজনে ছুটতে শুরু করেছি তখনই একটা বর্শা। এসে সামনের একটা গাছের গায়ে গেঁথে গেল। ঈগর সঙ্গে সঙ্গে বর্শাটা খুলে নিয়ে ছুটল। আমরা বুনোমানুষদের ছাড়িয়ে যেতে পারছিলাম না।খুবই স্বাভাবিক। বুনোমানুষরা এই জঙ্গলেই থাকে। গাছের বাধা দ্রুত পার হয়ে ওরা ছুটতে অভ্যস্ত। আমি তবু হাল ছাড়লাম না। দু’একটা বর্শা আমাদের সামনে পেছনে পড়তে লাগল। সেই বর্শা খুঁজে বের করতে গিয়ে ওরা পিছিয়ে পড়ছিল।
হঠাৎ সামনে নদী। আমি চিৎকার করে বললাম–ঈগর–নৌকো। দুজনে নদীর পারে এসে গড়ানো পাথরের গায়ে বসে পড়লাম। দুজনেই দ্রুত গড়িয়ে চললাম। এইসময়ে একটা বর্শা আমার কাঁধ কেটে বেরিয়ে গেল। আমি দ্রুত পেছনে ফিরে এক বুনোমানুষের বুকে হাতের বর্শাটা ঢুকিয়ে দিলাম। বুনো মানুষটা হাত পা ছড়িয়ে পড়ে গেল। আমি ঈগরের হাতের বাঁধনটা খুলে দিলাম। ঢালু পার দিয়ে গড়াতে গড়াতে নৌকোটার সামনে এসে আমরা থামলাম। এই সময় একটা বর্শা ঈগরের হাঁটুর নিচে লেগে পড়ে গেল। আবছা অন্ধকারে দেখলাম রক্ত পড়ছে। ঈগরের হাত ধরে লাফিয়ে নৌকোয় উঠলাম। নৌকোর গলুইয়ে বৈঠা রাখা। বৈঠা নিয়ে বাইতে লাগলাম। নৌকো বেশ কিছুটা চলে এসেছে তখন জলে শব্দ শুনলাম। বৈঠা চালাতে চালাতে দেখলাম দুজন বুনোমানুষ বর্শা নিয়ে সাঁতার দিয়ে আসছে। আমাদের কাছাকাছি এসে একজন আমার দিকে বর্শা ছুঁড়ল। আমি দ্রুত মাথা নোয়ালাম। বর্শাটা আমার মাথার ওপর দিয়ে গিয়ে জলে পড়ল। আর একটা বুনোমানুষ বর্শা হাতে। আমাদের কাছে সাঁতরে এল। ও বর্শা ছোঁড়ার আগেই আমি বৈঠাটা ওর কান লক্ষ্য করে যত জোরে সম্ভব চালালাম। বুনোমানুষটি আর্ত চিৎকার করে জলে ডুবে গেল।
অল্পক্ষণ পরেই নৌকোটা তীরে এসে লাগল। আমরা দুজন লাফ দিয়ে নামলাম। তারপর পাড় বেয়ে উঠতে লাগলাম।
তখনই সূর্য উঠল। ভোরের স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে পড়ল। স্পষ্ট হল আকাশ নদী গাছপালা।
একটু থেমে কাপাক বলল–একটা বিনীত অনুরোধ–ঈগর হালে বসে আছে। তাকে উঠে আসতে অনুমতি দিন। শাঙ্কো বলল–আমি যাচ্ছি। শাঙ্কো চলে গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঈগরকে সঙ্গে নিয়ে এল। ঈগরের গায়ে সব পোশাক জলে ভেজা।
ফ্রান্সিস বলল–আগে আপনারা ভেজা পোশাক ছাড়ন।
–আসুন। শাঙ্কো বলল। দুজন শাঙ্কোর পিছু পিছু গেল।
হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস একটা কথা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
–কী কথা। ফ্রান্সিস বলল।
–ওরা রাজধানী কুজকোতে না গিয়ে এই বন্দরে এল কেন?
-হ্যাঁ। আমার মনে হয় রাজধানী কুজকোয় ওঁরা থাকতে পারে নি। আবার ওঁরাই কুজকোতে না গিয়ে এখানে এল কেন? উদ্দেশ্য একটা বিদেশী জাহাজে চড়ে দেশত্যাগ। ওঁরা আর এই পেরুতে কোনদিন ফিরে আসবে না। তবে ওরা দুজনে দেশত্যাগ করার সিদ্ধান্ত কেন নিলেন বোঝা যাচ্ছে না। ওঁদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। সব জানতে হবে। ফ্রান্সিস বলল। ফ্রান্সিসরা ডেক-এ বসে অপেক্ষা করতে লাগল।
বেশ কিছুক্ষণ পরে কাপাকরা এল। পরনে ভাইকিংদের পোশাক। দুজন বসল। ফ্রান্সিস বলল–কাপাক আপনারা রাজধানী কুজকোতে ফিরে গেলেন না কেন?
–তাহলে বলি–কাপাক বলতে লাগল কয়েকটি অঞ্চল বাদে প্রায় সারা পেরু অঞ্চল আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতা পাচাকুটির অধীন। কথা প্রসঙ্গে একদিন রাজা পাচাকুটি আমাকে বললেন-তিতিকানা হ্রদের চারপাশের অঞ্চল জয় করতে হবে। আমাদের অধীনে আনতে হবে। ইনকা সাম্রাজ্য আরও বিস্তৃত করতে হবে। কাপাক একটু থেমে বলতে লাগল–কিছু সৈন্যসামন্ত নিয়ে আমি যুদ্ধযাত্রা করলাম। তিতিকানা হ্রদের তিনদিককার দেশগুলো সহজেই জয় করলাম। কিন্তু একটি রাজ্য অধিকার করতে বেশ লড়াই করতে হল।
যা হোক সব যুদ্ধ জেতা রাজ্যে একজন করে নির্ভীক সৈন্যদের রাজা করে দিয়ে আমি কুজকো ফিরে চললাম। পথে কয়েকজন সৈন্য আর এই ঈগর আমাকে বলল কিছুদূরে একটি নগরী আছে মাজোৰ্কা। ফলে ফুলে সুশোভিত এই নগরের সবই সুন্দর। অন্য দুতিনজন সৈন্যও বলল ঐ সুন্দর নগরীর কথা।
সেদিন সকালে সব সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বললাম–আমরা এখন দেশে ফিরে যাবো না। মাজোর্কা নগর আমরা যুদ্ধ করে জয় করবো। ইনকা সাম্রাজ্যের অধীনে আনবো। কাজেই আমরা এখন মাজোর্কা জয় করতে যাবো। এখন দেশে ফিরবো না? সৈন্যরা অস্ত্র উঁচুতে তুলে আমাকে সমর্থন জানালো।
আমরা মাজোর্কার দিকে যাত্রা শুরু করলাম। দিন দুয়েকেরমধ্যে মাজোর্কা পৌঁছলাম। শুনলাম রাজা কুয়েক হুয়া অসুস্থ। যা হোক আমরা প্রায় বিনা বাধায় মাজোর্কা দখল করলাম।
ফেরার সময় কুজকোর কাছাকাছি এসে ঈগরকে পাঠালাম আমাদের কীভাবে অভ্যর্থনার আয়োজন হয়েছে এটা জানতে।
ঈগর বিরসমুখে ফিরে এল। বলল–রাজার অনুমতি না নিয়ে মাজোর্কা দখল করার জন্যে আপনাকে ফাঁসি দেওয়া হবে। রাজাজ্ঞা। সবাইকে মানতে হবে। আপনি কুজকো ঢুকলেই বিপদে পড়বেন।
–ঈগর আমাদের পালাতে হবে। তৈরি হও। কথাটা বলে চারদিকে তাকাতে লাগলাম।
তখন রাস্তার পাশে একটা খোলা মাঠে রাঁধুনিরা রান্নার আয়োজন করছে। সবাই ঘোড়া থেকে নেমেছে। মাঠের একদিকে আপেল গাছের সারি। ঈগরকে ইঙ্গিত করে ঐ বাগানের আড়ালে গেলাম। ঈগরও এল। আমি বললাম– ঈগর আমার পেছনে। আমি আপেল বাগানের পরেই একটা পায়ে চলা পথ পেলাম। দুজনে ঘোড়া ছোটালাম। গ্রামটাম পেলাম না।
বেশ কিছুক্ষণ ঘোড়া ছুটিয়ে একটা গ্রামের কাছে থামলাম। খাওয়া তো হয়নি। খুব খিদে পেয়েছে। আপেলের বাগান থেকে তিনটি পাকা আপেল নিয়ে এসেছিলাম। দুজনে তাই খেলাম।
প্রায় সন্ধ্যে পর্যন্ত ঘোড়া ছোটালাম। একটা গ্রামে এলাম। গ্রাম চার পাঁচটা পাথরের বাড়ি। কাছাকাছি বেশ কটা খামার। দেখে খুশি হলাম। এই গ্রামের লোকদের অবস্থা ভালই। খাওয়াতো শুধু আমাদের খাওয়া নয়। ঘোড়া দুটোকেও জল ছোলা খাওয়াতে হচ্ছিল। ঠিক করলাম আয়াচুচো গিয়ে ঘোড়া দুটো বিক্রি করে দেব। ওখানে ঘোড়া কেনাবেচার হাট বসে। গ্রামে সব ঘরের দরজাই কালো পাথরের। একটা বাড়ি দেখলাম সাদা পাথরের। সাদা পাথরের দাম বেশি।
ঘোড়া থেকে নেমে সাদা দরজার সামনে এলাম। আঙ্গুলঠুকে শব্দ করলাম। আর একবার ঠুকতেই দরজা খুলে গেল। দেখি একজন বয়স্কা মহিলা দাঁড়িয়ে। বললাম খুব সমস্যায় পড়ে আপনাদের সাহায্য চাইতে এসেছি। মাজোর্কা থেকে আসছি। যাবো– আয়াচুচো শহরে! এক বুড়ো বেরিয়ে এল। বলল–আপনারা কারা? কোথায় যাবেন? বুঝলাম আমাদের কথা বারবার বলতে হবে। কারণ বুঝলাম বুড়ো লোকটি কালা। অনেক কষ্টে ঘরে আসার অনুমতি পেলাম।
ভেতরের একটা ছোট ঘরে আমাদের বসতে বলল। আমরা মেঝেতে বসে রইলাম। মেঝের শুকনো ঘাস বিছানো। দড়ি দিয়ে বাঁধা বসে আরামই পেলাম। সন্ধ্যে হয় গেছে অনেকক্ষণ। অন্ধকার ঘরে মহিলাটি একটা জ্বলন্ত মোমবাতি রেখে গেল। তাতেই ঘরের চারধার যা দেখতে পাচ্ছিলাম।
সেই দুটো আপেল খাওয়ার পর থেকে উপোস করে আছি। খিদেয় প্রায় নেতিয়ে পড়লাম। ঘাসের বিছানায় শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ বাইরের দরজা খোলার শব্দ। কে ঢুকল। বয়স্কা মহিলাটির ছেলেই হবে। যে ঢুকল সে মার সঙ্গেই কথা বলছিল। মা সবই বলল।
ছেলেটি আমাদের ঘরে ঢুকল। আমাদের এক ঝলক দেখল। বলল- আপনারা কারা? কোত্থেকে আসছেন? কোথায় যাবেন?
কাপাক বলল–ঈগর তুই সামলা। ঈগর আস্তে আস্তে আমাদের কথা বলল। শেষে বলল–আমরা ভীষণ ক্ষুধার্ত। আগে খেতে দিন। তারপরে যা বলার বলবো।
— বেশ। যুবকটি বলল। তারপর বলতে বলতে চলল–মা-রান্না কদুর? ওদের খেতে দাও। সারাদিন না খেয়ে আছে। মার কথাও শুনলাম–আর কিছুক্ষণের মধ্যেই রাতের রান্না হয়ে যাবে। ওদের একটু অপেক্ষা করতে বল।
আমরা আর কোন কথা বললাম না। দুজনেই শুয়ে রইলাম। খেতে খেতে একটু রাতই হল। যুবকটি এল। কিছু কথাবার্তা হল। আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে গোল রুটির সঙ্গে আলুসেদ্ধ খেয়ে ঘোড়ায় উঠলাম। ঘোড়া ছোটালাম আয়াচুচোর দিকে।
কাপাক থামল। ফ্রান্সিস বলল তুমি অনেকক্ষণ কথা বলছো। একটু দম নাও। তুমি কুজকো গেলে না কেন সেই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি।
হা। আপনি বুঝেছেন। আপনাদেরও একঘেয়ে লাগছে বোধহয়।
–না-না। আপনি বলুন। হ্যারি বলল।
কাপাক বলতে লাগল–পরদিন সকালেই ঘোড়া ছোটালাম আয়াচুচোর দিকে। সন্ধ্যের আগেই আয়াচুচো পৌঁছলাম। সারাদিন খাওয়া জোটে নি। খিদে তৃষ্ণায় দুজনেই কাতর।
আয়াচুচো একটা ছোট শহর তবে লোকজনের সংখ্যা ভালোই। পাথরের বাড়িঘর। খুঁজে খুঁজে একটা ছোট সরাইখানা পেলাম। সেদিনের মত ঘোড়া বেচাকেনা হাটটা দেখে এলাম। এখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। হাট ভেঙে গেছে।
রাতটা সরাইখানায় কাটালাম।
পরদিন সকালের খাবার খেয়ে ঘোড়া দুটো নিয়ে চললাম ঘোড়া বেচাকেনার হাটে। লোকজনের বেশ ভিড়। ঘোড়া থেকে নামলাম। দুতিনজন প্রায় ছুটে এল। একজন বলল–আমাকে কিছু মুদ্রা দিন। আমি ঘোড়াদুটো ভাল দামে বিক্রি করিয়ে দেব। বাকিরাও একই কথা বলল। আমি বললাম–বেশ আগে বিক্রি কর–তারপর তোমাকে যা দেবার দেব। ওরা রাজি হল। এখন কাকে বিক্রি করতে দেব–এই নিয়ে ওদের মধ্যে ঝগড়া লেগে গেল। যে লোকটি আমার কাছে প্রথম এসেছিল তাকেই বিক্রি করতে দেব। আমি বললাম। ঝগড়া মিটল।
ঘোড়া দুটো দেখে লোকটি বলল–জিন বসার আসন পাদানি এসব বিক্রি করবেন কেন। নিজের কাছে রেখে দিন।
–কোন দরকার নেই। তুমিই নাও। আমি বললাম।
–বেশ। লোকটা এক গাল হেসে বলল।
লোকটা ঘোড়া দুটো নিয়ে হাটে ঢুকল।
আমরা ঘাসের জমির ওপর বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পরে লোকটি এল। দুই কাঁধে ঝুলছে ঘোড়ার সাজ সরঞ্জাম। কোমরের খুঁট থেকে সোনার মুদ্রা বের করল। হেসে বলল–ভাল দামে বিক্রি করেছি। নিন দাম। আমি সোনার মুদ্রাগুলো নিলাম। একটা সোনার মুদ্রা লোকটিকে দিলাম। লোকটি খুব খুশি।
লোকটি চলে গেল। আমরা সরাইখানায় ফিরে এলাম। সেই রাতটা ঐ সরাইখানায় কাটিয়ে পরদিন সকালেই এই পিসকো বন্দরে এলাম। দেখলাম দুতিনটে জাহাজ নোঙর ফেলে জলে ভাসছে। জাহাজের মাথায় যার যার দেশের পতাকা উড়ছে। তিনটে জাহাজেরই পতাকা দেখলাম। একটা ইংরেজদের অন্যটা ফরাসীদের। আপনাদের জাহাজে দেখলাম ডেনমার্কের পতাকা। অবশ্য আপনাদের দেশের পতাকা চিনতে বেশ কষ্টই হল। আমরা ঠিক করলাম এই জাহাজেই আমরা উঠবো। ডেনমার্ক অনেক দুরের দেশ। তবে আমাদের দেশের কাছে।
একটু রাত হতে আমরা জলে সাঁতার কেটে আপনাদের জাহাজে এলাম। তারপর তো আমরা কী করেছি আপনাদের দেখা।
–আপনাদের সব কথাই শুনলাম। একটু পরে ফ্রান্সিস বলল। তারপর বলল– আমাদের জাহাজে থাকবেন, খাবেন আমাদের কোন আপত্তি নেই। তবে কিছু খরচ দেবেন। আমরা খুব একটা বড়লোক নই।
–নিশ্চয়ই দেব। তা আপনারা আপনাদের দেশের দিকে কবে যাচ্ছেন? কাপাক বলল।
–সেটা এখনও স্থির করিনি। মাজোর্কার রাজা আপনাদের একটা নক্সা দিয়েছেন। আপনি নক্সাটা একটু দেখতে দিন।
নিশ্চয়ই। কথাটা বলে কাপাক কোমরের খুঁট থেকে নক্সাটা বের করল। ফ্রান্সিসের হাতে দিল।
ফ্রান্সিস বিবর্ধক কঁচটা নিয়ে নকশাটা দেখতে লাগল।
.
খুঁজে খুঁজে একটা সরাইখানা পেলাম। ছোট সরাইখানা। সরাইওয়ালাকে বললাম আমাদের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি পারেন খেতে দিন।
–কী খাবেন?
–মাংস রুটি। ব্যস আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। ঈগর বলল।
সরাইওয়ালার একজন লোক আমাদের ঘরটায় ঢুকতে বলল। ঢুকলাম এটাই শোবার ঘর। ঘাসপাতা বাঁধা বিছানা। মাথার বালিশ বলে কিছু নেই। কিন্তু আর অত ভাববার সময় নেই। হাতমুখ ধুয়ে এসে শুয়ে পড়লাম। আরো দু’জন লোকও ছিল।
ভোর হল। সরাইওয়ালাকে বললাম–ঘণ্টা খানেকের মধ্যে খেতে দেবার ব্যবস্থা। করতে হবে। চিনেমাটির থালা গ্লাসে জল কাজের ছেলেটি রোখ গেল। আমরা বসে পড়লাম। রাঁধুনি গোল করে কাটা রুটি আর আলু সবজির ঝোল দিল। তারপর মুর্গীর মাংস দিয়ে গেল। আমরা হাপুসহুপুস খেতে লাগলাম। তাড়াতাড়ি খেতে লাগলাম। পেট ভরে খেতে হবে। রাঁধুনি আরো রুটি দিতে এসে বলল–আস্তে খান। গলায় লাগবে। কে কার কথা শোনে। আমরা সমান গতিতে খেয়ে চললাম।
আজকেই পিসকো যাবো।
–ঠিক আছে। ঈগর বলল।
তৈরি হয়ে আমরা এই পিসকো বন্দরের দিকে আসতে লাগলাম। দুপুর তখন। চড়া রোদ গরম বাতাস। বেশ কাহিল হয়ে পড়লাম। এক গরীব চাষীর বাড়িতে বসার জায়গা পেলাম। এত খিদে পেয়েছে তখন যে ভদ্রতা টদ্ৰতা বিচার করতে পারছিলাম না। বললাম–আমরা খুব ক্ষুধার্ত। কিছু খেতে দিতে পারেন? চাষীর বৌ তাড়াতাড়ি আমাদের জন্যে কয়েকটা রুটি করল। আর আলুভাজা। আমরা গোগ্রাসে তাই খেলাম।
আর বিশ্রাম করলাম না। যাত্রা করলাম। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল পিসকো বন্দরে এসে বিদেশি জাহাজের খোঁজ করা। তারপর সেই জাহাজে চড়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া। রাত হয়ে গেলে জাহাজের পতাকা দেখতে পাবো না। তাই দ্রুত এসে বিকেল নাগাদ এই পিসকো বন্দরে এলাম। খুঁজে খুঁজে আপনাদের জাহাজটা দেখলাম।
জাহাজঘাটায় রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। তারপর আমরা অন্ধকার সমুদ্রে সাঁতরে সাঁতরে আপনাদের জাহাজে উঠলাম। ঈগর হালে বসে রইল। আমি এলাম। দেখলাম আপনারা ভালো মানুষ। বিদেশী আপনারা। তবু আপনাদের ব্যবহারে কথাবার্তায় খুবই ভালো লাগল। ঈগরকে খবর পাঠিয়ে আনালাম।
আমাদের সব কথাই আপনাদের বললাম। আমরা দস্যুও নই চোরও নই। এখন আপনাদের বিবেচনা আপনারা আমাদের আশ্রয় দেবেন কিনা। ফ্রান্সিস বলল– আপনাদের খাদ্য আশ্রয় দুটিই দেওয়া হবে। হ্যারি বলল–বুঝতে পারছি আপনারা সৎ ও নির্ভীক। আপনারা আমাদের জাহাজেই থাকবেন। একটু পরে কাপাক বলল–কী বলে যে আপনাদের কৃতজ্ঞতা জানাবো বুঝতে পারছি না।
ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। বলল–নক্সাটা আমি নিয়ে যাচ্ছি। নক্সাটা নিয়ে আমি দু’একদিন ভাববো। তারপর আপনাকে ফেরৎ দেব।
ঠিক আছে কাপাক বলল–আপনার কি মনে হয় এই গুপ্তধন উদ্ধার করা যাবে? কাপাক বলল।
–এখনই বলতে পারছি না। রাজবাড়িতে যাই। সব দেখে টেখে বুঝতে পারবো গুপ্তধন উদ্ধার করতে পারবো কিনা। আসল কথা হল নক্সাটার নির্দেশ মেনে এগোতে হবে। তার জন্যে একটু সময় লাগবে। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে আপনি কি মাজোর্কা যাবেন? কাপাক বলল।
নিশ্চয়ই যাবো। ফ্রান্সিস বলল।
–আমাদেরও যেতে ইচ্ছে করছে। কাপাক বলল।
যাবেন। রাজা কুয়েক হুয়া আপনাকেই নক্সাটা দিয়েছেন। কাজেই নকশা দেখে গুপ্তধন উদ্ধার করতে পারলে সেটা আপনারই প্রাপ্য। আমরা শুধু উদ্ধার করে দেব। তারপর রাজা কুয়েক হুয়া ও আপনি গুপ্তধন নিয়ে যা করার করবেন। ফ্রান্সিস বলল–
–আপনারা গুপ্তধন নেবেন না? কাপাক জানতে চাইল।
-না আমরা বুদ্ধির লড়াই পছন্দ করি। ভালো লাগে নকশার নির্দেশ বোঝা আর সেই অনুযায়ী ধীরে ধীরে এগিয়ে গুপ্তধন উদ্ধার করা। ফ্রান্সিস বলল।
–এতেই আপনারা খুশি? কাপাক বলল।
–হ্যাঁ। গুপ্তধন ও সম্পদের ওপর আমাদের কোন লোভ নেই। আমরা বুদ্ধি খাঁটিয়ে গুপ্তধন উদ্ধার করে যার প্রাপ্য তাকে দিয়েই আমরা আমাদের কর্তব্য শেষ করি।
–আপনাদের মত এরকম মানুষ আছে? কাপাক বলল।
–আছে–আছে। তাদের সন্ধান পান নি। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিস নকশাটা নিয়ে নিজের ঘরে এল। দেখল মারিয়া ছুঁচসুতো নিয়ে কী কাজ করছে। ফ্রান্সিস বিছানায় বসল। নক্সাটা বের করে দেখতে লাগল। মারিয়া বলে উঠল–আবার নক্সা? হায় যীশু!
-শোন শোন। অতীতের এক রাজার হাতে আঁকা এই নক্সাটা। ফ্রান্সিস বলল।
–নিশ্চয় গুপ্তধনের ব্যাপার আছে। মারিয়া বলল।
–অবশ্যই আছে। নইলে আমি দেখতে নেব কেন? ফ্রান্সিস বলল।
–কোন দেশের কোন রাজার গুপ্তধন? মারিয়া বলল।
–এই দেশটার নাম পেরু। উত্তরে এক রাজ্য আছে। নাম মাজোর্কা। সেখানকার রাজার নাম কুয়েক হুয়া। তাঁর পিতামহ তার ধনসম্পদ গোপনে রেখেছিলেন। ঐ রাজ্যের পরে একটা নদীর ওপারেই থাকে বুনো লোকদের রাজ্য। এরা যখন খুশি তখন দলবেঁধে মাজোর্কায় আসে। বাধা দেবার আগেই যা পায় চুরি করে নিয়ে যায়। এখন বর্তমান রাজার পিতামহ তাই তাঁর ধনসম্পদ একটা গোপন জায়গায় রেখেছিলেন। বুনোদের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় তিনি মারা যান। বর্তমান রাজা কুয়েক হুয়াকে কিছু বলে যেতে পারেন নি। এখন রাজা একজনকে নক্সাটা দিয়েছেন যদি তিনি এই নক্সার অর্থোদ্ধার করতে পারেন। আমি তার কাছ থেকে নক্সাটা নিয়েছি। ফ্রান্সিস বলল।
-বুঝলাম। আবার গুপ্তধন উদ্ধারে নামবে। মারিয়া বলল।
–অবশ্যই নামবো। আমাকে তো জানো এইসব নক্সার অর্থ খুঁজে খুঁজে উদ্ধার করার মধ্যে আমি সবচাইতে আনন্দ পাই। ফ্রান্সিস বলল।
–কিন্তু দেশে ফেরার কী হবে? কতদিন বাবা মাকে দেখি নি। তুমি এসব বোঝ না। মারিয়া বলল।
বুঝি। আমার তো মা নেই। বাবার জন্যেই চিন্তা হয়। কিন্তু এভাবে এসব ভাবলে মন দুর্বল হয়ে যায়। ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ তা হয়। মন দুর্বল হয়ে যায়। কিন্তু এই ভাবনা ছাড়তেও পারি না। মারিয়া বলল।
–সেটাই করতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
মারিয়া একটু রাগতস্বরেই বলল–আমি দেশে ফিরে যাব।
ফ্রান্সিস মারিয়ার মুখের দিকে তাকাল। দেখল মারিয়ার মুখটা কেমন লালচে হয়ে উঠেছে। তার মানে মারিয়া বেশ রেগে গেছে।
–তাহলে–ফ্রান্সিস বলল–এই পিসকো বন্দরে খোঁজ নিই।
–কেন? মারিয়া বলল।
–আমাদের দেশের দিকে যাবে এমন কোন জাহাজ পাই কিনা।
তার মানে? মারিয়া বলল।
–তোমাকে আর কয়েকজন বন্ধুকে সেই জাহাজে তুলে দেব। তোমরা দেশে ফিরে যাবে। ফ্রান্সিস বলল।
–আর তুমি? মারিয়া বলল।
–আমার জীবন যেমন চলছে তেমনি চলবে। ফ্রান্সিস বলল।
–আমি তোমাকে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে রেখে চলে যাবো? মারিয়া বলল।
তাছাড়া তো উপায় দেখছি না। ফ্রান্সিস বলল।
মারিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল। ফ্রান্সিস বুঝতে পারল না–কী বলবে? মারিয়ার কাঁধে হাত রেখে বলল– মারিয়া কেঁদো না।
ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মারিয়া বলল–আমি এই বিদেশে তোমাকে ফেলে যাব– এটা তুমি ভাবলে কী করে?
ঠিক আছে। ঠিক আছে। কথাটা তুলে নিলাম। ফ্রান্সিস বলল।
আমি যেদিন দেশে ফিরবো তোমাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরবো। আর যদি না ফিরি– মারিয়া আর বলতে পারল না।
–আহা–ফ্রান্সিস বলল–আজেবাজে ভাবনা ছাড়ো তো। দুজনের সকালের খাবারটা নিয়ে এসো। বড্ড খিদে পেয়েছে।
মারিয়া উঠে দাঁড়াল। খাবার আনতে চলল।
ফ্রান্সিস গভীর মনোযোগ দিয়ে নক্সাটা দেখতে লাগল। যে ছোট্ট ব্যাগটায় নক্সাটা রাখা তার চামড়াটা শক্ত। বুনো শেয়ালের চামড়া নিশ্চয়ই। নকশার কাগজটাও চামড়া মেশানো পার্চমেন্ট কাগজের।
মারিয়া খাবার আনল। দুজনে খেতে লাগল। মারিয়া নক্সাটা নিল। দেখতে দেখতে বলল–নকশাটার রহস্য বুঝতে পেরেছো?
–ভাবছি। দেখ–তিনটি চৌকোনো কিছু। বুঝলাম–তিনটে ঘর।কারণ মাঝখানে খাটের মত চৌকোনো কিছু। ওগুলো বিছানা বালিশ। প্রত্যেক ঘরেরই চারকোণায় ছোট কিছু আছে। ওগুলো কী ঠিক বুঝতে পারছি না। বেশ ভাবাচ্ছে। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে মারিয়া বলল–তিনটে ঘর। একটা একটু বড় আর একটা তার থেকে ছোট আর একটা সেটার থেকেও ছোট ঘর ছোট এই তো মনে হচ্ছে বিছানা বালিশ।
–হ্যাঁ। শোবার ঘরই কারণ মাঝখানটায় খাটের মত চৌকোনো বিছানা আছে। বালিশও আছে। ফ্রান্সিস বলল। তারপর নকশাটা যেন দেখে বলল–প্রত্যেকটি ঘরের চারকোণায় কী আছে বোঝা যাচ্ছে না।
মারিয়া নক্সার ওপর ঝুঁকে পড়ল। মুখ তুলে বলল–ঘরের চার কোণায় রয়েছে চারটি ফুলদানি। একটু চুপ করে থেকে ফ্রান্সিস বলল
–পাথরের বড় বড় ফুলদানি। তুমি ঠিক ধরেছো। ফ্রান্সিস বলল। তারপর বলল–কিন্তু ঘরগুলো কোথায় আছে?
সেটা জানতে হোলে খোঁজখবর করতে হবে। মারিয়া বলল।
–আমার মনে হয় এই ঘরগুলো হয় কুজকো বা মাজোর্কার রাজবাড়িতে আছে। ফ্রান্সিস বলল।
–তা হতে পারে। মারিয়া বলল।
ফ্রান্সিস ঘরটার বাইরে এল। দেখল এক ভাইকিং বন্ধু শুকনো কাপড় চোপড় নিয়ে যাচ্ছে। ফ্রান্সিস বলল–ভাই হ্যারিকে একটু ডেকে দাও।
ফ্রান্সিস এসে বিছানায় বসল। একটু পরেই হ্যারি এল।
–ডাকছো কেন? হ্যারি জানতে চাইল।
ফ্রান্সিস নক্সাটা হ্যারির হাতে দিল। বলল নক্সায় আঁকা চিহ্নগুলো দেখে আমি আর মারিয়া কিছু সিদ্ধান্তে এসেছি। এবার তুমি কী বল–তাই শুনবো।
নক্সাটা হাতে নিয়ে হ্যারি দেখতে লাগল। কিছু পরে বলল–ছোট বড় মিলিয়ে তিনটি শোবার ঘর। বিছানা বালিশ রয়েছে। হ্যারি বলল।
–অন্য কিছুও তো হতে পারে। ফ্রান্সিস বলল।
–না। তিনটিই শোবার ঘর। বালিশ থাকবে এটাই ঠিক বোঝা যাচ্ছে।
–এই ঘর তিনটের কোথায় থাকতে পারে? ফ্রান্সিস বলল।
মনে হয় রাজবাড়িতে। হ্যারি বলল।
–কোন্ রাজবাড়িতে? ফ্রান্সিস বলল।
–এই কুজকো অথবা মাজোর্কার রাজবাড়িতে। হ্যারি বলল।
–এটা কাপাক ঠিক বলতে পারবে। এখন প্রত্যেকটি ঘরের ঠিক চারদিকে চারটে কী আঁকা? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
হ্যারি নক্সাটা দেখতে দেখতে একটুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল–ঐ চারটে জিনিস ছোট ফুলদানি। পাথরের।
–হ্যারি–আমরাও ঐ সিদ্ধান্তেই এসেছি। ফ্রান্সিস হেসে বলল। তারপর বলল– হ্যারি কাপাককে ডেকে আনে। কাপাক কী বলে দেখা যাক।
হ্যারি বেরিয়ে গেল। অল্পক্ষণের মধ্যেই কাপাককে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এল।
ফ্রান্সিস কাপাককে বিছানাতেই বসতে বলল। কাপাক বসল। ফ্রান্সিস মারিয়াকে দেখিয়ে বলল ইনি আমাদের দেশের রাজকুমারী। কাপাক বেশ আশ্চর্য হল। বলল–আপনাদের তো ছন্নছাড়া এক জীবন। ইনি আপনাদের সেই জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পেরেছেন?
-হ্যাঁ পেরেছি। মারিয়া বলল–সব জেনেশুনেই এসেছি। কিছুদিনের মধ্যেই আমরা দেশে ফিরবো।
–সে তো খুব আনন্দের কথা। কাপাক বলল।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে ফ্রান্সিস বলল–কাপাক–আপনার কাছে কয়েকটা বিষয়ে জানতে চাই।
–বেশ। বলুন কী জানতে চান? কাপাক বলল।
–এখন মাজোর্কার রাজা কে? ফ্রান্সিস বলল।
কুয়েক হুয়া। কাপাক বলল।
তার সঙ্গে আপনার খুব হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল। ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
-হ্যাঁ। রাজা আমাকে খুব পছন্দ করতেন। আমারও রাজাকে ভালো লাগত। কাপাক বলল।
–রাজা আপনাকে গুপ্তধনের নক্সা দিয়েছিলেন? এটা আপনাকে বিশ্বাস করেই দিয়েছিলেন। ফ্রান্সিস বলল।
–নিশ্চয়ই। কাপাক বলল।
রাজবাড়িতে ক’টা ঘর? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–কোন ঘরের কথা জানতে চাইছেন? কাপাক বলল।
ধরুন রাজার শয়নকক্ষে রাণী ও ছেলেমেয়েদের ঘর। আরও একটা ঘর থাকতে পারে। কাপাক বলল–আর একটা ঘর দেখিনি।
–আপনি শুধু দুটো ঘর দেখেছেন? ফ্রান্সিস বলল।
–প্রথমে রাজার ঘরটাই ধরুন। সেখানে কি চারদিকে চারটে ফুলদানি আছে? ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ আছে। কাপাক বলল।
–দুটো ঘরেই? ফ্রান্সিস বলল।
–তা বলতে পারবো না। কাপাক বলল।
–এটা তো জানতেই হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–তা হলে রাজবাড়ি গিয়ে জানতে হবে। কাপাক বলল।
–হ্যাঁ রাজার বাড়ি ভালোভাবে দেখতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–নক্সাটা দেখে বুঝে এসব কথা বলছেন বোধহয়। কাপাক বলল।
—হ্যাঁ। নকশাটার ঘরগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ঠিক আছে। আপনাকে বিরক্ত করলাম। ফ্রান্সিস বলল।
-না-না। বরং আমার মনে আশা জাগছে যে আপনি এই নক্সার ধাঁধা বুঝবেন। গুপ্তধন উদ্ধার করতে পারবেন। কাপাক বলল।
–আপনাদের শুভেচ্ছা নিয়ে চেষ্টা করে দেখব। ফ্রান্সিস বলল।
কাপাক চলে গেল।
ফ্রান্সিসরা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। পরে ফ্রান্সিস বলল–আর দেরি করবো না। হ্যারি কাল রাতেই রওনা হব।
প্রথমে কোথায় যাবে? হ্যারি জানতে চাইল।
–মাজোর্কা। রাজা কুয়েক হুয়ার সঙ্গে দেখা করবো। আরো কিছু জানার আছে। তারপর কাজে নামা।ফ্রান্সিস বলল। একটু চুপ করে থেকে হ্যারি বলল তোমার কি দৃঢ় বিশ্বাস গুপ্তধন এই রাজবাড়িতেই আছে।
–হ্যাঁ। তবে রাজবাড়িতে গিয়ে সব বুঝতে পারব। ততদিন অপেক্ষা কর। ফ্রান্সিস বলল।
তখনই শাঙ্কো ঢুকল। বলল–ফ্রান্সিস তুমি কালকেই মাজোর্কা যাচ্ছ।
-হা-ফ্রান্সিস হেসে মাথা ওঠানামা করল। তারপর বলল শাঙ্কো–তুমি এখনও ও সুস্থ নও। তোমাকে আর হ্যারিকে নিয়ে যাবো না। শুধু বিস্কো আমার সঙ্গে থাকবে। হ্যারি আর শাঙ্কো কোন কথা বলল না। এসব ব্যাপারে ফ্রান্সিসের কথাই শেষ কথা। এসব ক্ষেত্রে ওরা ফ্রান্সিসের কথাই মেনে নেয়।
হ্যারি শাঙ্কো ঘর থেকে বেরিয়ে এল। মারিয়া বলল–শুধু একজন নিয়ে যাবে?
–উপায় নেই। হ্যারির তো জান–সহ্যশক্তি কম। ওকে সঙ্গে নেওয়া মানে ওকে কষ্ট দেওয়া। শাঙ্কোর অসুখ এখনও সারে নি। ভেনকে বলেছিলাম শাঙ্কোকে নিয়ে যাবো? ভেন বলেছে-শাঙ্কোর সুস্থ হতে এখনও এক সপ্তাহ লাগবে। কাজেই শাঙ্কোকে সঙ্গে নেবার প্রশ্নই ওঠে না। ফ্রান্সিস বলল।
–ওরা মনে দুঃখ পেল। মারিয়া বলল।
–এতে দুঃখ পাওয়ার কী আছে? অন্য কোন অভিযানে নিয়ে যাবো। ফ্রান্সিস বলল। তারপর ফ্রান্সিস চুপ করে রইল। কোন কথা বলল না।
পরদিন ফ্রান্সিস বিস্কোকে সঙ্গে নিল। কাপাক আর ঈগরও এল। চারজনে চলল আয়াচুচোতে ঘোড়া কিনতে।
ভর দুপুরে আয়াচুচোতে পৌঁছল। দরাদরি করে দুটো তেজি ঘোড়া কিনল। এবার ঘোড়ার সাজ। একটু দূরেই সারি সারি ঘোড়ার সাজের দোকান। ফ্রান্সিস প্রয়োজনীয় সব সাজই কিনল। দোকানি নিজেই সাজ পরিয়ে দিল।
খুব গরম পড়েছে। জিভ শুকিয়ে আসছে। ফ্রান্সিস একটা সরবতের দোকানে এল। সরবৎ খেল সবাই। এবার ফেরা। ঘোড়ায় চড়ে ফেরা।
ফ্রান্সিস আর বিস্কো একটা ঘোড়ায় উঠল। অন্য ঘোড়াটায় কাপাক আর ঈগর চড়ল। ওরা ঘোড়া ছোটাল।
সন্ধ্যের আগেই পিসকো বন্দরে পৌঁছল।
পরদিন থেকে ফ্রান্সিস আর কাপাক ঘোড়া ছুটিয়ে ছুটিয়ে মোটামুটি অভ্যেসটা ঝালিয়ে নিল। এক ঘোড়ায় দুজন। সেটা অভ্যেস করিয়ে নিল। সেদিন সকাল থেকেই ফ্রান্সিসরা ব্যস্ত। সব গোছগাছ করে নেওয়া বড় ঝোলা ব্যাগে শুকনো খাবারও নিল। চামড়ার ব্যাগে জল নিল। তরোয়াল দড়ি নিল। কখন কোনটার প্রয়োজন পড়ে।
কাপাক আর ঈগর আগে পাটাতনের ওপর দিয়ে হেঁটে সমুদ্রতীরে উঠল। বিস্কোও চলল পাতা পাটাতনের দিকে। ফ্রান্সিস তখন মারিয়াকে সান্ত্বনা দিচ্ছে কিছু ভেবো না–দিন কুড়ি পঁচিশের মধ্যে আমরা ফিরবো। মারিয়া একটু ফুঁপিয়ে উঠল। ফ্রান্সিস বলল–কান্নাকাটি করো না। আমার মন দুর্বল করে দিও না। মারিয়া শান্ত হল চোখ মুছল।
–হাসো। ফ্রান্সিস প্রায় আদেশের মত বলল।
মারিয়া ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে হাসল। ফ্রান্সিসও হাসল।
ফ্রান্সিস পাটাতনের ওপর দিয়ে হেঁটে সমুদ্রতীরে উঠল। দুজন দুজন করে দুটো ঘোড়ায় উঠল ফ্রান্সিসরা।
তারপর ঘোড়া ছোটাল। লক্ষ্যমাজোর্কা। দুপুরে ঘোড়া থামিয়ে কিছু শুকনো খাবার ওরা খেয়ে নিল। তারপর আবার চলল।
সন্ধ্যে হল। রাত হল। আকাশে গোল চাঁদ দেখা গেল। জ্যোৎস্নায় সবকিছুই দেখা যাচ্ছিল। তবে স্পষ্ট নয়। পথ দেখা যাচ্ছিল। দুটো ঘোড়া ছুটে চলল।
একটু রাত হল। ফ্রান্সিস ঘোড়া থামাল। বলল–আর নয়। এখানেই ঘোড়া থামাও। ফ্রান্সিস ডানপাশে একটা পুকুর দেখল। ফ্রান্সিস পুকুরটার কাছে এসে ঘোড়া থামাল। কাপাকও ঘোড়া থামাল।
বিস্কো শুকনো গাছের ডালপাতার জোগাড় করল। ঈগর ওকে সাহায্য করল। তিনটি পাথর বসিয়ে উনুন করা হল। পুকুরের জল এনে রান্না চলল। ফ্রান্সিস পুকুরপারের ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ল। বলল–বিস্কো–আজ তরকারিটা তুমিই কর। পরে রুটি করার সময় আমাকে ডেকো।
রান্না চলল। ছোট ব্যাগে আলুটালু ছিল–বিস্কো এনেছিল। সেসব দিয়ে তরকারি মত হল। সবশেষে রুটি। ফ্রান্সিস উঠে এল।
–ফ্রান্সিস–তুমি শুয়ে বিশ্রাম কর।
-বেশ। কিন্তু–ফ্রান্সিস বলতে গেল।
–কোন কিন্তু নয়। তুমি যাও। বিস্কো বলল।
তুমি যখন বলছো। ফ্রান্সিস ফিরে এসে আবার ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ল।
রাতের খাওয়া শেষ হল। ফ্রান্সিস বলল–রাতে আর ঘোড়ায় চড়বো না। কাল সকালে রওনা দেব। আজ এখানেই রাত কাটাবো। তাই হল। মোটা কাপড় ঘাসের ওপর পেতে বিছানা হল। ওরা শুয়ে পড়ল।
ফ্রান্সিসের ঘুম আসতে দেরি হল। একটা সূত্র-রাজবাড়ির খাট। শোবার ঘর। আর কিন্তু তিন নম্বর ঘরটায় এখনও যাওয়া হয় নি। আরো কিছু সূত্রের প্রয়োজন। এসব ভাবতে ভাবতে ফ্রান্সিস ঘুমিয়ে পড়ল।
সবাই ভোরে উঠল। রাতের কিছু রুটি বিস্কো রেখে দিয়েছিল। সকালের খাবার হিসেবে ঐ রুটিই মধু মিশিয়ে খাওয়া হল।
তারপর ঘোড়ার পিঠে উঠল সবাই। ঘোড়া ছোটাল মাজোর্কার দিকে।
তখন ভর দুপুর। ফ্রান্সিস চারদিকে তাকাতে লাগল। দেখল চারদিকেই বুনোগাছের ঝোঁপঝাড়। পুকুরও দেখল না। শুধু চারদিকে নজর রেখে চলল।
তখনই হঠাৎ বাঁপাশের গাছপালা থেকে ঘোড়ার ডাক শোনা গেল। ফ্রান্সিস গলা। চড়িয়ে বলল–আমরা বিপদে পড়লাম। ফ্রান্সিসের কথাটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঁদিকের জংলা গাছপালা থেকে ঘোড়ায় বসা সৈন্যরা বেরিয়ে এল। প্রায় পনেরজন সওয়ারি নিয়ে ঘোড়াগুলো পথের ওপর এল। ফ্রান্সিসরা ঘোড়া থামাল।
সবচেয়ে সামনের অশ্বারোহী ঘোড়া নিয়ে ফ্রান্সিসদের সামনে এল। কাঁপাকের কাছে এসে ঘোড়া দাঁড় করাল। হেসে বলল–অশুত। এগারো দিন আমরা এখানে ঘাঁটি গেড়ে অপেক্ষা করছিলাম। জেনেছিলাম–আপনি মাজোর্কা যাবেন। কাজেই এই মোড়ে অপেক্ষা করছি। কুজবাই যান অথবা মাজোর্কাই যান এই মোড়ে আপনাকে আসতেই হবে।
–তুমি সেনাপতি হয়েছে? কাপাক জানতে চাইল।
সেনাপতি হেসে বলল–রাজা আমাকে দায়িত্ব দিলেন। আমিও দায়িত্ব নিলাম।
কাপাক চিৎকার করে বলল–তোমার মত একটা ডাহা চোরকে দাদা সেনাপতি করলেন?
সেনাপতি কোন কথা না বলে তরোয়াল বের করল। কাপাক তরোয়াল বের করার আগেই সেনাপতি কাঁপাকের ওপর তরোয়াল চালাল। ফ্রান্সিস এরকমই ঘটবে বলে আঁচ করেছিল। ফ্রান্সিস তরোয়ালের খাপে তরোয়ালের হাতলে হাত দিয়ে ধরে রেখেছিল। ও দ্রুত তরোয়াল খুলে সেনাপতির তরোয়ালে ঘা মারল। সেনাপতির তরোয়াল প্রায় ছিটকে যাচ্ছিল। কোনভাবে সামলাল। ফ্রান্সিস বলল–আমি লড়াই চাই না। সেনাপতি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–এই চারজনকেই বন্দী কর। হাত বাঁধ। তারপর বলল-ঘোড়া থেকে নামো সব।
ফ্রান্সিসই নামল। বিস্কোকেও বলল নেমে আসতে। তারপর কাপাককে বলল নেমে আসুন। ওরা সংখ্যায় বেশি। লড়াই চলবে না। সেনাপতি গলা চড়িয়ে বলল নামুন। আপনাদের হেঁটে কুজকো যেতে হবে। কাপাক আর কোন কথা বলল না। ঈগরকে নামতে বলে নিজে ঘোড়া থেকে নামল। ফ্রান্সিসদের দুহাত পেছনে নিয়ে দুজন সৈন্য দড়ি দিয়ে বাঁধল। পেছনে হাত বাঁধা অবস্থায় ফ্রান্সিসরা হেঁটে চলল। ফ্রান্সিসদের ঘোড়া দুটোয় চারজন পদাতিক সৈন্য উঠল।
সেনাপতি তরোয়াল উঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল–কুজকো। সবার আগে একটা সাদা খয়েরি ঘোড়ার পিঠে সেনাপতি। তারপরে কিছু অশ্বারোহী সৈন্য। কিছু পদাতিক সৈন্য। পেছনে ফ্রান্সিসরা। ওদের পরে খোলা তরোয়াল হাতে কিছু পদাতিক সৈন্য।
শেষ বিকেলে ফ্রান্সিসরা কুজকো পৌঁছল। প্রধান প্রবেশ পথ দিয়ে ওরা নগরে ঢুকল। কিছু প্রহরী রয়েছে। সেনাপতিকে দেখে ওরা মাথা নিচু করে সন্মান জানাল।
ফ্রান্সিসরা নগরে ঢুকল। পথে বেশ ভিড়। অনেক লোক কেনাকাটা করছে। এদিকে ওদিকে ঘুরছে। অনেকেই সেনাপতির মিছিল দেখল।ওরা কাপাককে বন্দী অবস্থায় দেখে বেশ অবাক হল। ফ্রান্সিস আর বিস্কোকে ওদের দেশীয় পোশাকে দেখে লোকেরা নানা কথা বলতে লাগল। কাপাক মাথা নিচু করে হেঁটে চলল। কোনদিকে তাকাল না।
সদর রাস্তা দিয়ে ফ্রান্সিসদের মিছিল চলল। ফ্রান্সিস বিস্কো এই প্রথম ইকাদের রাজধানী কুজকো দেখল। সত্যি বেশ সাজানো গোছানো শহর। সদর রাস্তার ধার দিয়ে ফুলের গাছ। ফুল ফুটে আছে। মাঝে মাঝেই সদর রাস্তার মোড়ে মোড়ে বাগানে জলের ফোয়ারা। শেষ বিকেলের আলোয় খুব সুন্দর বাগান ঝর্ণা বাড়িঘর দেখা গেল।
ওরা ফ্রান্সিসরা একটা বড় মাঠ দেখল। মাঠের পাশে লম্বাটে বাড়ি। বিস্কো বলল সৈন্যাবাস। ফ্রান্সিস মুখে শব্দ করল।
মাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে ফ্রান্সিসরা এল লম্বাটে ঘরগুলোর একটা ঘরের সামনে। দুজন মশালবাহী সৈন্য ঘরের তালাটা খুলে দিল। ফ্রান্সিসরা ঘরে ঢুকল। মেঝে জুড়ে একটাই ঘাসপাতার বিছানা। ফ্রান্সিস বসল। তারপর শুয়ে পড়ল। কাপাক ফ্রান্সিসের পাশে এসে বসল। বলল–এটা কিন্তু সৈন্যাবাস। আমাদের এখান থেকে নিয়ে যাওয়া হবে মাচু পিচু নামের পাহাড়ে। ওখানে কয়েকটা গুহা আছে। গুহাতে কুজকোর গরীব মানুষজন থাকে। তারই মধ্যে একটা গুহায় কয়েদঘর। আমাদের সেখানে রাখা হবে।
–আজ রাতেই আমাদের নিয়ে যাবে? ফ্রান্সিস বলল।
হা। কিছু খেতে দেওয়া হবে। তারপর। কাপাক বলল।
কিছু পরে দু’জন সৈন্য একটা বড় কাঠের গামলায় মাংসের বড়া নিয়ে এল। ফ্রান্সিসরা খেতে লাগল। শরীর এত ক্লান্ত যে ফ্রান্সিসের খেতেই ইচ্ছে করছিল না। বিস্কো খেতে খেতে বুঝল সেটা। বলল–ফ্রান্সিস পেট পুরে খাও।
ফ্রান্সিস বলল–সারা রাস্তা এই গরমে ধূলো রোদখিদেটাই মরে গেছে যেন।
–তাহলেও খাও। আবার কখন খাবার জুটবে–মা মেরিই জানে। বিস্কো বলল।
–হু–শরীর ঠিক রাখতে হবে। ফ্রান্সিস খেতে খেতে বলল।
ফ্রান্সিসের খাওয়া শেষ হল। জল খাওয়ার পর ফ্রান্সিসরা একটু ধাতস্থ হল। শরীরে একটু জোরও পেল। ক্লান্ত ভাবটা কমল।
কিছুক্ষণ পরে সেনাপতি এল। ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে বলল–কী? ভালো আছ তোমরা?
–ওসব কথা অর্থহীন। আমাদের কয়েদখানায় নিয়ে চলুন। ফ্রান্সিস বলল।
–সে তো নেবই। তবে শরীরের অবস্থা এখন কেমন সেটাই জানতে চাইছিলাম। সেনাপতি বলল।
–এই নিয়ে আর কথা বলবেন না। ধূলো প্রচণ্ড রোদ আর ধূলো ওড়ানো বাতাস এসবের মধ্যে দিয়ে এলে লোকে যেরকম থাকে আমরা তেমনি আছি। এখন কয়েদ ঘরে নিয়ে চলুন। ফ্রান্সিস বলল।
–রাজা পাচাকুটির হুকুম এখনও পাইনি। রাজা এখানে একবার আসতেও পারেন। সেনাপতি বলল।
ফ্রান্সিসরা কেউ কোন কথা বলল না।
কিছুক্ষণ পরে সৈন্যদের মধ্যে বেশ ব্যস্ততা দেখা গেল। সেনাপতির উচ্চস্বরে বলা কথা শোনা গেল
–সবাই ঘরে ঢোক। বাইরের মাঠে থাকবে না। সব সৈন্য ঘরে ঢুকে পড়ল। মাঠের ওপর দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে রাজা পাচাকুটি এলেন। ধবধবে সাদা একটা ঘোড়ায় চড়ে। পেছনে তিনচারজন রাজার দেহরক্ষী।
রাজা ঘোড়া থেকে নামলেন। দেহরক্ষীরা নামল না। সেনাপতি রাজাকে ফ্রান্সিসদের ঘরে নিয়ে এল। রাজা ঘরে ঢুকে একবার চারদিকে চোখ বুলোলেন। ফ্রান্সিসরা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। এবার রাজা কাঁপাকের দিকে তাকালেন। একটু পরে বললেন–কাপাক তুমি আমার নির্দেশ অমান্য করেছো। তোমাকে ফাঁসি দেওয়া হবে।
–দাদা–আমি জেনেশুনে এই ভুল করিনি। তখন ভেবেছিলাম সুন্দর নগরী মাজোর্কা যদি জয় করতে পারি তাহলে তোমার রাজত্বের সীমাও বাড়বে। আবার একটা সুন্দর নগরীও তোমার অধিকারে আসবে। কাপাক বলল।
–ওসব আমি শুনতে চাই না। আমার নির্দেশ অমান্য করেছো এটাই তোমার অপরাধ। রাজা পাচাকুটি বললেন।
কিন্তু আমি যা করেছি তোমার জন্যেই করেছি। এ ব্যাপারে আমার কোন স্বার্থ ছিল না। কাপাক বলল।
–কে জানে? কোন ব্যক্তিগত স্বার্থ তোমার ছিল কিনা। রাজা বললেন।
একটু থেমে কাপাক বলল–কত যুদ্ধে জয়ী হয়ে তোমার সাম্রাজ্য বাড়িয়েছি। আজকে একটা সামান্য ভুলের জন্যে আমাকে হত্যা করবে?
–ওসব কথা তুলে লাভ নেই। ফাঁসি তোমার হবেই। রাজা বললেন।
এতক্ষণে রাজা পাচাকুচির নজর পড়ল ফ্রান্সিসদের ওপর। রাজা সেনাপতিকে জিজ্ঞেস করলেন–এরা কারা?
–বিদেশী। কাঁপাকোর সঙ্গী সব। সেনাপতি বলল।
–তোমরা কোন দেশের লোক। রাজা জিজ্ঞেস করলো।
–আমরা ভাইকিং। ফ্রান্সিস বলল।
–এখানে কী জন্যে এসেছো? চুরি ডাকাতির মতলব নেই তো? রাজা বললেন।
–ভাইকিংরা চুরি ডাকাতি করে না। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে এই দেশে এসেছো কেন? রাজা বললেন।
একটু চুপ করে থেকে ফ্রান্সিস বলল–মাজোর্কার রাজা কুয়েক হুয়া তাঁদের পারিবারিক সম্পদের সঙ্গে একটি নক্সা পেয়েছিলেন। তার পিতামহের আঁকা নকশাটিতে তাঁদের ধন সম্পদের নিশানা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু রাজা কুয়েক হুয়ার পিতা নক্সার অর্থ বের করতে পারেন নি। ওখানকার বুনো মানুষদের সঙ্গে লড়াইয়ে রাজা কুয়েক হুয়ার পিতামহ হঠাই মারা যান। নক্সা সম্বন্ধে কাউকে কিছু বলে যেতে পারেন নি। রাজা কুয়েক হুয়ার পিতা অনেক চেষ্টা করেও গুপ্ত ধনভাণ্ডারের হদিশ করতে পারেন নি। কুয়েক হুয়া নিজেও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পারেন নি। হতাশ হয়ে তিনি কাপাককে নক্সাটা দিয়ে দেন। কাপাকও পারে নি। নক্সাটা আমি পেলাম। এই ব্যাপারে আমরা মাজোর্কা যাচ্ছিলাম। পথে আপনার সেনাপতি আমাকে বন্দী করেন। সবই আপনাকে বললাম। আমাদের একটাই কথা–আমরা বন্দী হওয়ার মত কোন অপরাধ করি নি।
রাজা পাচাকুচি একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন–নক্সাটা তোমার কাছে আছে?
-হ্যাঁ। কাপাক বলল।
–আমাকে দাও। রাজা বললেন।
–কিন্তু–যদি মাজোর্কার রাজবাড়িতে খোঁজ করার সুযোগ পাই।
–ঐ সুযোগ তুমি কোনদিনই পাবে না। গুহার কয়েদখানায় থেকে থেকেই একদিন মারা যাবে। কাজেই ওটা আমাকেই দাও। রাজা বললেন।
–বেশ এই নিন। ফ্রান্সিস কোমরের ফেট্টির মধ্যে থেকে নক্সাটা বের করল। রাজার দিকে বাড়িয়ে ধরল। রাজা খপ করে যেন কেড়ে নিলেন। বললেন মন্ত্রীমশাইকে দেব। মন্ত্রীমশাই অত্যন্ত বুদ্ধিমান। এই নক্সার রহস্য উনি অনায়াসে ভেদ করতে পারবেন।
এবার ফ্রান্সিস বলল–আপনি তো নক্সা পেলেন। এবার আমাদের ছেড়ে দিন।
–না না–রাজা মাথা নাড়লেন–তোমরা গুপ্তধন চুরি করতে এসেছো তোমাদের ছাড়া হবে না। কাপাক বলল–দাদা–আমি অপরাধ করেছি নিজের অজান্তে আমাকে শাস্তি দাও, এরা বিদেশী, এদের কেন বন্দী করে রাখা হবে?
–তোমার সঙ্গী তাই। কাউকে ছাড়া হবে না। রাজা বললেন।
রাজা ঘরের বাইরে গেলেন। সাদা ঘোড়াটায় উঠলেন। পেছন পেছন সেনাপতি ঘোড়াটায় উঠলেন। দুজনে ঘোড়া চালালেন। পেছনে কয়েকজন দেহরক্ষী, অশ্বারোহী সৈন্য।
ফ্রান্সিস বিছানায় শুয়ে পড়ল। বিস্কো বলল–
–ফ্রান্সিস এটা কী করলে?
–কী করলাম? ফ্রান্সিস বলল।
–নক্সাটা দিয়ে দিলে? বিস্কো বলল।
-ওটা নকল। আসলটা হ্যারির কাছে আছে। ঐ নিয়েই সন্তুষ্ট হল। নইলে কাঁপাকের সঙ্গে আমাদেরও ফাঁসিতে ঝোলাত। রাজামশাই অত্যন্ত নিচুমনা মানুষ।
–ঠিকই বলেছেন। ও আমার দাদা। তবু আমি ওকে ঘৃণা করি। ওর সঙ্গে মতের মিল না হলেই ঝোলাও ফাঁসিতে। ওর হুকুমে ইতিপূর্বে দুজন মন্ত্রী ফাঁসিকাঠে ঝুলেছে। সেনাপতি মরেছে তিন জন। আমিই সবচেয়ে বেশিদিন সেনাপতি ছিলাম। এখন তো আমাকে ঝোলাবার ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছে। ভাই বলে রেহাই নেই।
ঘরের কোণায় রাখা মোমবাতিটার দিকে ফ্রান্সিস তাকিয়ে রইল। মাথায় চিন্তা। কবে নাগাদ ফিরতে পারবে। জাহাজে মারিয়া, বন্ধুরা নিশ্চয়ই খুব চিন্তায় পড়ে গেছে। ফ্রান্সিসের মনটা খারাপ হয়ে গেল। ফ্রান্সিসের চোখ জ্বালা করে উঠল। ও চোখ বন্ধ করল।
হঠাৎ কারর কথায় ও চোখ খুলল। দেখল একজন সৈন্য ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। সৈন্যটি বলল–চলো সব। কয়েদখানায় চল।
ফ্রান্সিসরা উঠে দাঁড়াল। ঘরের বাইরে এল। ছ’সাতজন সৈন্য আগে পিছে দাঁড়াল। চলল সবাই। রাস্তায় লোকজন চলাচল করছে। আকাশে চাঁদ আছে কি না ফ্রান্সিস তাকাল। চাঁদ কুয়াশা-ঢাকা চারদিক অন্ধকার রাস্তার লোকেরা ফ্রান্সিসদের দেখল।
নগরের পেছন দিককার দরজার কাছে এল। দরজায় সশস্ত্র প্রহরী পাহারা দিচ্ছে। সৈন্যটি প্রহরীদের কি বলল। প্রহরীরা সরে গেল। নগরের পেছন দিককার দরজা খুলে গেল। ফ্রান্সিসরা দরজা দিয়ে বাইরে এল। ওরা চলল।
এই অন্ধকারেও ফ্রান্সিস দেখল উত্তরদিকে একটা পাহাড়ের মত। খুব উঁচু নয়। এই রাস্তা গেছে ঐ পাহাড়ের দিকে। নগর ছাড়িয়ে এই রাস্তাটা পাথর ছড়ানো। এবড়ো খেবড়ো। হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। ফ্রান্সিসরা ঐ রাস্তা দিয়েই চলল।
পাহাড়ের নিচে এসে দেখল কয়েকটা গুহা। গুহার মুখে মশাল জ্বলছে। একটা গুহার মুখ বেশ বড়। গুহার মুখে দুপাশে দুটো মশাল জ্বলছে। চারজন প্রহরী তরোয়াল হাতে পাহারা দিচ্ছে।
ফ্রান্সিসরা গুহার মুখে এল। দেখল গুহায় একটু এগিয়েই পাথরে পোঁতা লোহার গরাদ। তাতে একটা ছোট দরজা, এক প্রহরী এগিয়ে এসে দরজার তালা খুলে দিয়ে ফ্রান্সিসদের ইঙ্গিতে ঢুকতে বলল। ফ্রান্সিসরা ঢুকল। একটু দূরে গুহার ভেতরের দিককার আর একটা গরাদ পোঁতা জায়গা। ঐ দুটি গরাদের মধ্যেই যতখানি জায়গা তাই বন্দীরা পাবে।
ফ্রান্সিস দেখল মেঝেয় ঘাসের বিছানা। ফ্রান্সিস দেখেই বুঝল শুয়েও বিশ্রাম করা যাবে না। পাথরকুচি ছড়িয়ে আছে। বসলে শুলে পাথরের কুচি ফুটবে। সেই অবস্থাতেই ফ্রান্সিস শুয়ে রইল। বিস্কোরাও বসল। দেখল–পেছনের দিকে একটা মাটির জালা। নিশ্চয়ই জল আছে ওটাতে। ও উঠে জালাটার কাছে গেল। জালার মুখ-ঢাকা কাঠটা সরাল। দেখল জল। ও পাশে রাখা একটা কাঁচের গ্লাশমত পেল। ও গ্লাশ ডুবিয়ে পরপর তিনবার জল ভরে খেল। ফিরে এসে ফ্রান্সিসকে বলল–যাও। জল আছে। ওখানে। ফ্রান্সিস একটু হেসে বলল–একটা পাত্রে করে এনে দাও। বিস্কো বুঝল ফ্রান্সিস খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ও গিয়ে গ্লাশের মত পাত্রটায় জল ভরে নিয়ে এসে। ফ্রান্সিসকে দিল। ফ্রান্সিসও পরপর তিনবার জল খেল। কাপাকরাও জল খেল।
ফ্রান্সিস চুপচাপ শুয়ে রইল। অনেক চিন্তা মাথায়। রাজা কুয়েক হুয়ার গুপ্তধন। এই বন্দীদশা। কবে ছাড়া পাবে তার কোন ঠিক নেই। দেরি করা চলবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাহাজে ফিরতে হবে।
একটু রাত্রে ফ্রান্সিসদের খাবার এল। দুজন সৈন্য ফ্রান্সিসদের সামনে প্রত্যেককে পাতা দিল। তারপর পোড়া রুটি আর তরিতরকারির ঝোল। ফ্রান্সিস চেয়ে চেয়ে নিয়ে নিল। বলল–বিস্কো পেট পুরে খাও। চেয়ে চেয়ে খাও। শরীর ঠিক রাখো। এটা বন্দী জীবনে ফ্রান্সিস বন্ধুদের বলে থাকে।
খাওয়া শেষ। রক্ষীরা চলে গেল। জল খেয়ে ফ্রান্সিস বলল–কাপাক আগেই শোবেন না। সবাই বিছানাটা তুলুন। বিছানাটা তোলা হল। ফ্রান্সিস এঁটো পাতাগুলি দিয়ে জায়গাটা থেকে পাথরের কুচিগুলো সরালো। তারপর বিছানা পাতা হল। এবার আর পাথরকুচি বিধছে না। ফ্রান্সিস ঘুমিয়ে পড়ল।
একটু সকালেই ফ্রান্সিসের ঘুম ভাঙল। ও উঠে বসল। ও বাইরের দিকে তাকাল। দেখল–চারজনের জায়গায় দু’জন প্রহরী। আর দুজন বোধহয় খাবার আনবে। ও লক্ষ্য করল দুই প্রহরী নিজেদের মধ্যে কী নিয়ে কথা বলছে।
হঠাই কুজকো নগরের দিক নগর থেকে চিৎকার হৈ-হল্লার শব্দ ভেসে এল। ফ্রান্সিস বলল–কাপাক কীসের শব্দ বলুন তো! কাপাক বলল–কুজকো নগরী আক্রান্ত।
তার মানে? কারা আক্রমণ করল? ফ্রান্সিস বলল।
–পাশের রাজ্যের সঙ্গে এই কুজকো রাজ্যের ঝগড়া চলছে বহুদিন ধরে। বর্তমান। রাজারাও লড়াইতে জড়িয়ে গেছে। লড়াই চলছে।
–তাহলে আমরা কী করবো? ফ্রান্সিস বলল।
–অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। কাপাক বলল।
ফ্রান্সিসরা চুপচাপ শুয়ে বসে রইল। ওদিকে অস্পষ্ট চিৎকার আর্তনাদ গোঙানির শব্দ আসতে লাগল।
বেলা বাড়তে লাগল। সকালের খাবার এল না। কাপাক গরাদের কাছে গেল। গরাদের ফাঁক দিয়ে মুখ বের করে বলল
–কী ভাই? আমাদের খাবারের কী হল?
প্রহরী ঘুরে দাঁড়াল। বলল–আমাদেরও খাবার জোটে নি।
–কারণ কী? ফ্রান্সিস বলল।
রাঁধতে টাধতে দেরি হচ্ছে আর কি। প্রহরী বলল।
–সত্যি কথাটা বল ভাই। পাশের রাজ্যের রাজা কুজকো অধিকার করতে এসেছে। দাদার সৈন্যরা লড়াই চালাচ্ছে। রাঁধুনীও লড়াইতে গেছে। কাপাক বলল।
প্রহরী সাদামাটা গলায় বলল–কতকটা ঐরকমই ব্যাপার।
–তোমার বন্ধুকে দেখছি না। কী ব্যাপার? ফ্রান্সিস বলল।
–খাওয়ার ব্যবস্থা করতে গেছে। প্রহরী বলল।
—তাহলে খাবার পাওয়া যাবে? ফ্রান্সিস বলল।
–দেখা যাক। প্রহরী বলল।
ফ্রান্সিস একটু ভাবল। পরে কাঁপাকের কাছে গেল। বলল–মাত্র একজন প্রহরী। ওকে সহজেই কাবু করা যায়। কী বলেন?
-হ্যাঁ। যায়। একটু অপেক্ষা করুন। দেখা যাক অন্য প্রহরীটা আসে কি না।
–কিন্তু সেইজন্য অপেক্ষা করতে যাব কেন? ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে। কাপাক উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে গিয়ে গরাদে হাত চেপে দাঁড়াল। বলল–ভাই একটু দেখবে?
–কী দেখবো? প্রহরী বলল।
–আমার চোখে কী পড়েছে। কাপাক বলল।
–তোমার বন্ধুদের বলো না। প্রহরী বলল।
–এই অন্ধকারে ওরা কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কাপাক বলল।
–আমিই কি দেখতে পাবো? প্রহরী বলল।
–আহা-তুমি দেখতেই পাবে একথা বলছি না। তবু দেখ।
প্রহরী হাতে বর্শা রেখে এগিয়ে এল। কাপাক গরাদের মধ্যে দিয়ে মাথাটা বের করল। বলল–দেখ। প্রহরী এগিয়ে এল। কাঁপাকের কাছে এল। মাথা নিচু করে চোখ দেখতে গেল তখনই কাপাক গরাদ দিয়ে হাত বাড়িয়ে প্রহরীর ঘাড় চেপে ধরল। প্রহরী মাথা নাড়তে লাগল। চেষ্টা করল সরে যেতে। কিন্তু পারল না। এবার ফ্রান্সিসরা গরাদের ফাঁক দিয়ে হাত বের করে প্রহরীর গলা মাথা চেপে রাখল। প্রহরী ওর মাথাটা টেনে নিতে চাইল। কিন্তু একটু পরেই বুঝল–এদের হাত ছাড়ানো যাবে না। অসম্ভব।
এবার ফ্রান্সিস বলল–চাবি বেরকর। দরজার তালা খুলে দাও।
–চাবি আমার কাছে নেই। প্রহরী বলল।
ফ্রান্সিস ওর গালে মুখে একটা চড় মারল।
–না। আমার কাছে নেই। প্রহরী বলল।
ফ্রান্সিস আবার চড় কষাল। প্রহরী বুঝল চাবি না দিলে এদের হাত থেকে নিষ্কৃতি নেই। ও কোমরের গোঁজা চাবির থোকাটা বের করল। ফ্রান্সিস ওর হাত থেকে চাবির থোকাটা নিয়ে নিল। কাপাক প্রহরীর গলা চেপে ধরল। টেনে নিয়ে চলল দরজার দিকে। দরজার সামনে এসে বলল–এইবার দরজার তালা খুলে দাও। প্রহরী ঘাড় কোমর সরিয়ে নিতে চেষ্টা করল। আবার ফ্রান্সিস প্রহরীর মুখে চড় মারল। প্রহরী গালে হাত বুলাতে বুলোতে চাবির তোড়াটা ফ্রান্সিসের কাছ থেকে নিল। চাবিটা বের করে কয়েদগুহার তালা খুলে দিল। ফ্রান্সিসরা বেরিয়ে এল। পুরোনো বন্দীরাও বেরুল। বেরিয়ে এসেই ছুটতে শুরু করল। তারপর ওরা কী করল। বন্দীদের আর দেখা গেল না।
কাপাক পাথুরে রাস্তায় নামল। বলল, এটাই একমাত্র রাস্তা বের হবার। চলুন। ফ্রান্সিসরা কাঁপাকের নির্দেশমতই চলল। কুজকো নগরের যত কাছে আসছে ফ্রান্সিসরা লড়াই এর শব্দ শুনতে লাগল। কিছুক্ষণ আগের থেকে এখন অনেক স্পষ্ট যুদ্ধের চিৎকার গোঙানি শোনা যাচ্ছে।
বোঝাই গেল লড়াই-এ জিগির চিৎকারে অনেক ভাটা পড়েছে। এখন আহতদের কান্না গোঙানি শোনা যাচ্ছে। পেছনের প্রবেশপথে মাত্র একটা মশাল জ্বলছে। প্রহরী কেউ নেই। ফ্রান্সিস বলল–এখন কী করা যায়। কাপাক বলল– অনেক বেলা হয়েছে সকাল থেকে না খেয়ে আছি। নগরের মধ্যে ঢোকা যাক। কিছু খাবার জোটে কিনা দেখা যাক।
–এখন তার আগে তো জানতে হবে কে জিতলো কে হারলো। ফ্রান্সিস বলল।
–ওটা নগরে ঢুকলেই বোঝা যাবে। কাপাক বলল।
–এখন খিদেটা না খেতে পেয়ে আরো বেড়েছে। প্রথমেই খেতে হবে।ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক। কাপাক বলল।
এবার ফ্রান্সিসরা প্রবেশ পথ ধরে এল। প্রবেশ পথের ধারে কাছে প্রহরীরা নেই। একটু এগোতেই লড়াইয়ের ভয়াবহয়তা দেখা গেল। সৈন্যরা মরে পড়ে আছে। সৈন্যাবাসের সামনের মাঠটায় মৃতরা পড়ে আছে। আহতেরা আর্তনাদ করে উঠছে। অনেক ঘোড়া মরে পড়ে আছে। নয় তো আহত হয়ে মাঠে কাতরে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে ডেকে উঠছে। একজন আহত সৈন্যকে কাপাক জিজ্ঞেস করল–ভাই রাগ করবেন না! বলুন তো কে জয়ী হল? সৈন্যটি আস্তে আস্তে বলল–
–পামার রাজ্যের রাজা চিমোর ইনকা হেরে গেছে।
–তুমি কোন রাজার যোদ্ধা?–পাচাকুটি না চিমোর ইনকার দেশের?
–আমি রাজা পাচাকুচির দেহরক্ষী।
ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করললড়াই কি এখনও চলছে?
–বসতি অঞ্চলে চিমোর ইনকার সৈন্যরা এখনো লড়াই করে যাচ্ছে। এরাই বেঁচে থাকা শেষ যোদ্ধা। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মরবে নয়তো বন্দী হবে। দেহরক্ষী বলল।
ফ্রান্সিসরা দাঁড়িয়ে আছে তখনই দেখল এক বৃদ্ধ আর একজন যুবক আহত সৈন্যদের কাটা জায়গায় ঝোলা থেকে ওষুধ বের করে লাগাচ্ছে! বেশ বোঝা গেল বৃদ্ধ । রাজবৈদ্য। যুবকটি তার সহকারী। তারা ঘুরে ঘুরে আহতদের ওষুধ দিচ্ছে! ফ্রান্সিস বলল-কাপাক এখন এখানে বসে থেকে লাভ নেই। প্রথমে খাবার চাই। খাওয়ার, শেষে আমরা আর অপেক্ষা না করে মাজোর্কার দিকে রওনা হব। সবাই এসো। চলো।
সবাই একত্র হল। ফ্রান্সিস আর কাপাক সকলের সামনে। দল বেঁধে চলল সব। হাঁটতে হাঁটতে ফ্রান্সিস বলল–বিস্কো ঈগর-কোন সরাইখানা দেখলে বলবে।
কিন্তু লড়াইয়ের এই ডামাডোলের মধ্যে কোন সরাইখানা কেউ খুলবে? বিস্কো বলল।
–এখন খুলবে। মানে দরজা আধভেজানো রাখবে। সবাই তো আর যুদ্ধে নামে নি। সকাল থেকে কারো কারো বাড়িতে রান্না হয় নি। সারা সকাল থেকে অনেকের উল্লাস চলছে। তারা তো খাবার খুঁজবে। খাবার পাবে সরাইখানায়। সরাইখানার মালিকরা তা ভালো করেই জানে। ওরা ব্যবসায়ী। ঠিক লুকিয়ে চুরিয়ে খাবার বিক্রি করবে। একটা বটগাছের তলায় একটা সরাইখানা দেখল বিস্কো। ফ্রান্সিসকে দেখাল। ফ্রান্সিস বলল–কাপাক চলুন। ফ্রান্সিস কাছে এসে ভেজানো দরজায় টোকা দিল। কোন সাড়া নেই। আবার টোকা দিল। ভেজানো দরজা খুলে গেল। সবটা নয়। বোধহয় সরাইখানার রাঁধুনি বা কাজের লোক মুখ বাড়াল। কাপাক এগিয়ে গেল। বলল– লড়াইয়ের জন্যে আমরা খেতে পারিনি। এখন ভীষণ খিদে। খেতে দাও। লোকটি দু’একবার গাঁইগুই করল। ফ্রান্সিস বলল–আমরা কিন্তু রাজা পাচাকুচির সৈন্য। আমাদের জয় হয়েছে। কাজেই
-না-না। ভেতরে আসুন। লোকটা বলল।
লোকটি দরজাটা আরো কিছুটা খুলল। ফ্রান্সিসরা কাত হয়ে ঢুকে পড়ল। টানা একটা কাঠের পাটাতনে বসল। তখনই মালিক এল। হেসে বলল আপনাদের কথা রাইট বলেছে। লড়াই চললে কী হবে? লোকের পেটের খিদে তো মিটবে না। তাই আমি লুকিয়ে চুরিয়ে ক্ষুধার্ত মানুষদের খাবার দিচ্ছি।
–সত্যি আপনি প্রশংসনীয় কাজ করছেন। ফ্রান্সিস বলল।
–যতটা পারি আর কি। সরাইওয়ালা হেসে বলল।
–এবার আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করুন। কাপাক বলল।
মালিক ডাকল-রবার্ট?
রবার্ট এগিয়ে এল।
রান্না কতদূর? এঁরা অভুক্ত। সরাইওয়ালা বলল।
রুটি হয়ে গেছে। তরকারিটা ফুটছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়ে যাবে। রবার্ট বলল।
-মাংসের ব্যবস্থা করেছো? মালিক বলল।
–না–মাংস জোগাড় করতে পারলাম না। রবার্ট বলল।
ফ্রান্সিস বলল–রবার্ট আমাদের রুটি দিয়ে যাও।
–শুধু রুটি? রবার্ট জানতে চাইল।
–হ্যাঁ সঙ্গে পেঁয়াজ আর নুন। ফ্রান্সিস বলল।
–আপনারা সবাই নুন পেঁয়াজ আর রুটি খাবেন? রবার্ট আবার বলল।
–না। তবে কেউ খেতে চাইলে খাবে। যা বললাম নিয়ে এসো। ফ্রান্সিস বলল। রবার্ট অবাক চোখে ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর চলে গেল। মালিক বলল–রবার্ট তো বলে গেল ঝোলটা তাড়াতাড়িই হবে।
–ঠিক আছে। আমাকে আমার ইচ্ছেমত খেতে দিন। ফ্রান্সিস বলল।
নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। মালিক হেসে বলল। তারপর চলে গেল।
রবার্ট খান চারেক রুটি আর পেঁয়াজ নিয়ে এল। ফ্রান্সিসের সামনে একটা পাতা পেতে দিল। তাতে রাখল সব। ফ্রান্সিস রুটি খেতে লাগল। পেঁয়াজটা কামড়ে কামড়ে খেতে লাগল। খেতে খেতে ডাকল–রবার্ট। রবার্ট এল।
–দুটো টমেটো দিয়ে যাও। ফ্রান্সিস বলল।
রবার্ট টমেটো দিয়ে গেল।
ফ্রান্সিস নির্বিকার মুখে সবই খেতে লাগল। ফ্রান্সিসের খাওয়া তখনও শেষ হয়নি। রবার্ট সবজির তরকারি দিয়ে গেল। ফ্রান্সিস খেয়ে চলল। এবার রবার্ট অন্যদের খাবার দিতে লাগল। বিস্কোরা খেতে লাগল।
খাওয়া শেষ। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রান্সিসরা এসে পাটাতনে বসল। কিছুক্ষণ ওরা চুপ করে বসে রইল। একসময় কাপাক বলল–ফ্রান্সিস আমাদের এখানকার কাজ হয়ে গেছে। এখন মাজোর্কা যেতে হবে। আর দেরি করা ঠিক নয়।
–বেশ চলুন। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। আর সবাইও উঠে দাঁড়াল।
ফ্রান্সিস দাম মেটাল। তারপর সবাই রাস্তায় এল। ফ্রান্সিস মাজোর্কার দিকটা বুঝে নিল। বলল–আমাদের পূর্বমুখো যেতে হবে।
যেতে যেতে দেখল রাস্তায় বাড়িঘরের সামনে অস্ত্রাঘাতে নিহত মানুষেরা পড়ে আছে। রাস্তায় কিছু লোকজন দেখা যাচ্ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সবাই বেশ ভীত, সন্ত্রস্ত।
সদর দেউড়ির কাছে এল ওরা। দেখল দরজার কাছে অনেক মৃতদেহ পড়ে আছে।
–থামবেন না। দ্রুত সদর দেউড়ি পার হয়ে যাবেন। কাপাক মৃদুস্বরে বলল। কিন্তু সবাই শুনতে পেল। ওরা দ্রুতপায়ে খেলা দেউড়ি পার হয়ে গেল। দু’তিনজন দ্বাররক্ষী ছিল। তারা বাধা দিল না। তাদের হাতে বল্লমও ছিল না। বোধহয় আহত।
বাইরে এসে ফ্রান্সিস বলল–কাপাক–দুটো ঘোড়া চাই। মাজোর্কা বেশ দূর।
-হ্যাঁ। হেঁটে গেলে থেমে থেমে যেতে হবে। দেরি হবে। কাপাক বলল।
–দেরি করা চলবে না। জাহাজে আমার বন্ধুরা সব রয়েছে। ওরা আমাদের জন্যে চিন্তায় আছে। আমাদের তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।
–তাহলে ঘোড়া জোগাড় করতে হয়। কাপাক বলল।
চেষ্টা করতে হবে। ফ্রান্সিস চারদিকে তাকাতে লাগল। তখনই দেখল একটু দুরে একটা শিশু গাছে তিনটে ঘোড়া বাঁধা। ফ্রান্সিস গলা চেপে বলল– কাপাক দেখেছেন তো?
-হ্যাঁ। কিন্তু ঘোড়াগুলোর গায়ে গলায় কোন সাজ পরানো নেই।
–কিন্তু একটা লাগাম পরানো আছে। বসার আসন টাসনের কথা এখন ভাববেন না। চলুন।
ফ্রান্সিসরা ঘোড়াগুলোর কাছে এল। শেষ বিকেলের আলো আছে। সবই দেখা যাচ্ছে।
কাপাক বলল–আগে আপনারা দুজন যান। আমরা পরে উঠব।
-বেশ। ফ্রান্সিস বলল। তারপর বিস্কোকে সঙ্গে নিয়ে একটা ঘোড়ার কাছে এল। দেখল ঘোড়াগুলোর গলায় লাগাম মত পরানো দড়ি। ঐ দড়ি গাছের সঙ্গে বাঁধা। ফ্রান্সিস বলল–বিস্কো গাছে বাঁধা দড়ি কাটো। বিস্কো বলল– কাপাক আপনাদের ঘোড়ার দড়ি কেটে দিলাম। আপনারা উঠুন। কাপাক লাফিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ল। ঈগরও এক লাফে ঘোড়ার পিঠে উঠে পেছন দিকে কাঁপাকের পেট জড়িয়ে ধরল।
ফ্রান্সিস আর কাপাক ঘোড়া চালাতে লাগল। বসার আসন নেই, পা দানি নেই। এভাবেই ফ্রান্সিসরা ঘোড়া চালাতে লাগল। মাঝে মাঝে ফ্রান্সিসদের ঘোড় জোরে ছুটতে শুরু করে। বেশ করে ঘোড়া দুটোকে সামলাতে হচ্ছে। দুদিন পরে তৃতীয় দিন সন্ধ্যেবেলা ওরা মাজোর্কা পৌঁছল।
কিছুক্ষণ পরে কাপাক বলল–আমরা এসে গেছি রাজবাড়ির আলো দেখা যাচ্ছে। সদর দেউড়ির দুপাশে দুটো বিরাট মশাল জ্বলছে। দুটো থামের ওপর রয়েছে সেই মশাল দুটো। মোটা কাপড়ের পলতে। তেলে চুবিয়ে সেই মোটা পলতেতে আগুন জ্বালানো হয়। চারদিকে বেশ উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে পড়ে।
হঠাৎ লড়াইয়ের শব্দ। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল-রাজবাড়ির সদর দেউড়ির কাছে লড়াই শুরু হয়েছে। মানুষের চিৎকার তরোয়ালে তরোয়ালে ঠোকাঠুকির শব্দ। শোনা গেল আহতদের গোঙানি। কান্না। ফ্রান্সিস বলল- কার সঙ্গে কার লড়াই হচ্ছে আমরা তা বুঝতে পারছি না। যাদের মধ্যেই লড়াই হোক আমরা কোন দলে যাবো না। লড়াই থামা পর্যন্ত চলে। বাঁ দিকে ঐ বড় ঝোঁপটার দিকে। ওখানেই আশ্রয় নেব আমরা।
ফ্রান্সিসরা বড় ঝোঁপটায় ঢুকল। ঝোঁপের মধ্যে তেমন চাঁদের আলো পড়েনি। ওর মধ্যেই কিছুটা ঝোঁপ জঙ্গল পরেই দেখা গেল কিছুটা ভোলা জায়গা। ফ্রান্সিস বলল আমরা এখানে থেকে লড়াইর শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। তারপর লড়াই শেষে রাজবাড়ি যাবো।
কাদের সঙ্গে কাদের যুদ্ধ একেবারেই বোঝা গেল না। যা হোক দেখা যাক। বিস্কো বলল।
ফ্রান্সিসরা ঐ খোলা জায়গাটুকুতে বসল। চাঁদের আলো অনুজ্জ্বল। ফ্রান্সিস ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ল। তখন আকাশে চাঁদ আর সাদা মেঘের খেলা চলেছে। চাঁদ সাদা মেঘে চাপা পড়েছে। মেঘ সরে যেতেই আবার চাঁদ।
ওদিকে রাজবাড়ির দিকে শোনা গেল সমবেত ধ্বনি-পাচাকুটি দীর্ঘজীবী হোন। এবার কাপাক বলল–দাদা আবার এই মাজোর্কা জয় করল। আমি জয় করেছিলাম। বেশ কিছু সৈন্য পালিয়ে গিয়েছিল। হয়তো ওরাই দাদার সৈন্যদের সঙ্গে লড়াইয়ে নেমেছে। দাদার নামে জয়ধ্বনি উঠছে। দাদার সাম্রাজ্য আরো কিছুটা বাড়ল। কতজনের প্রাণ গেল কে জানে। একটু থেমে বলল–এখনকার সেনাপতি অত্যন্ত নির্মম, নিষ্ঠুর। নির্বিচারে নরহত্যা ওর কাছে খুব মজার খেলা। সে অন্য পক্ষের সৈন্যদের বন্দী করে না হত্যা করে। এতেই তার আনন্দ।
সৈন্যদের হৈ হল্লা শোনা গেল। কিছুক্ষণ পরে হৈ হল্লা বন্ধ হল।
ওদিকে সেনাপতি দুজন রক্ষী নিয়ে রাজবাড়ির দরজার কাছে এল। দেখল দরজা খোলা। ধারে কাছে কেউ নেই। সেনাপতি হো হো করে হেসে উঠল। রক্ষীদের বলল–সব পালিয়েছে। চল। প্রথম মন্ত্রণা কক্ষটায় এল। একটা গোল ওক কাঠের টেবিল। চারপাশে বাঁকা পায়াওয়ালা চেয়ার। একপাশের পাথরের দেওয়ালে একটা মশাল জ্বলছে।
ভেতরের ঘরের দরজা খুলে একটি পরিচারিকা বেরিয়ে এল। বলল– আপনারা কি রাজামশাইর কাছে যাবেন?
-হ্যাঁ। সেনাপতি বলল।
–তাহলে এই ঘরে আসুন পরিচারিকা চলল।
সেনাপতিরা পরিচারিকার পিছু পিছু পরের ঘরটায় এল। দেখল বিছানায় রাজা কুয়েক হুয়া শুয়ে আছেন। রাজা অসুস্থ এটা ওরা শুনেছিল। রাজার মাথার কাছে রাণী বসে আছেন।
রাজা একটু ওঠার চেষ্টা করলেন। রাণী রাজার পিঠে হাত দিয়ে তুললেন। ঘাড়ে পিঠে মোটা বালিশ রাখলেন। রাজা স্বস্তি পেলেন। রাজা বললেন–আসুন। আপনার পরিচয়টা জানলে–সেনাপতি রাজাকে থামিয়ে দিয়ে বলল–আমি রাজা পাচাকুচির সেনাপতি। আপনি অসুস্থ এটা আমরা শুনেছি। তবে এতটা অসুস্থ বুঝতে পারিনি।
আপনাদের তো তেমন কোন লড়াই করতে হয়নি। আমার সৈন্যরা এই আকস্মিক আক্রমণে বোধহয় দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল। তাই পালিয়েছিল। রাজা বললেন।
-না। ওরা সহজে হার স্বীকার করে নি। শেষ শক্তিটুকু দিয়ে লড়েছে। যথার্থ বীর ওরা। অনেকেই পরাজয় সহ্য করতে না পেরে পেটে তরোয়াল ঢুকিয়ে আত্মহত্যা করেছে। সেনাপতি বলল।
কেন এসব করতে গেল? রাজা বললেন।
–আপনাকে ওরা দেবতার মত শ্রদ্ধা করে। আপনার জয় হল না। এই পরাজয় ওরা মেনে নিতে পারে নি। সেনাপতি বলল।
–হয়তো তাই। রাজা দুর্বলকণ্ঠে বললেন।
সেনাপতি সঙ্গের এক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিকে দেখাল।
রাজা একটু মাথা নামালেন। নতুন রাজাও মাথা একটু নুইয়ে ভদ্রতা দেখাল।
–এখন মাজোর্কার রাজা আর আপনি নন ইনি–হুঁয়ার্কই এখন রাজসিংহাসনে বসবেন। সেনাপতি বলল।
খুব ভালো কথা। আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। প্রজারা খুবই চিন্তায় পড়ল। আমিও রাজকার্য ঠিকভাবে চালাতে পারছিলাম না। আমিও একজন নতুন সুস্থ রাজা চাইছিলাম। এখন আপনারা নিজেরাই যখন আমাকে সিংহাসনচ্যুত করতে চাইছেন তখন আমি খুশিই হয়েছি। প্রজারা একজন নতুন রাজা পাবে। সত্যি বলতে কি এভাবে রাজা হয়ে থেকে প্রজা সাধারণের কোন উপকারই করতে পারবো না। রাজা বললেন।
–এখন আপনাদের তো রাজবাড়ি ছাড়তে হবে। সেনাপতি বলল।
রাণী বলে উঠলেন–তাহলে আমরা কোথায় থাকবো?
–আপনারা কি এই মাজোর্কাতেই থাকতে চান? সেনাপতি জানতে চাইল।
–হ্যাঁ। আমরা মাজোর্কা ছেড়ে অন্য কোথাও থাকবে না। রাজা বললেন।
–ঠিক আছে। সেই ব্যবস্থাই হবে। তবে আপনারা রাজার ব্যবহৃত রাজদণ্ড পতাকা পোশাক টোশাক নিয়ে যেতে পারবেন না। ওসব নতুন রাজাকে দেওয়া হবে। সেনাপতি বেশ গম্ভীর গলায় বলল। রাজা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বেশ ক্লান্তস্বরে বললেন–আমি ওসব কিছুই নেব না। তবে একটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ব্যাপারে আপনাকে বলছি। একটু থেমে বললেন–আমি পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে একটা গয়নার বাক্স পেয়েছিলাম। ওটার মধ্যে একটা নকশা পেয়েছিলাম। ওটা আমার রাজবৈদ্যকে দেখিয়েছিলাম। উনি নকশাটা নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। দেখে টেখে ফেরত দিলেন। উনিও বললেন–এই নকশা বোঝা অসম্ভব।
–ঐ নকশা এখন কোথায়? সেনাপতি বলল।
–দুজন ভাইকিং আমার বাড়িতে এসেছিল। নক্সাটা তাদেরই দিয়েছি।
সেনাপতি একটু গলা চড়িয়ে বলল–কেন আপনি ওদের নক্সা দিলেন?
–যোগাযোগের ব্যাপার। আমি পরিচিত অপরিচিত সবাইকেই এই নকশার কথা বলে থাকি। এই ভাইকিংদেরও বলেছিলাম। ওরা বেশ আগ্রহের সঙ্গেনক্সাটা নিয়েছিল। বলেছিল কয়েকদিন ভালো করে দেখে ফেরৎ দেবে। রাজা বললেন।
নক্সা দেবার আর তোক পেলেন না? ওরা নকশা নিয়ে এতক্ষণে ওদের জাহাজে চেপে অনেক দূরে চলে গেছে। সেনাপতি বলল।
–না-না। নিশ্চয়ই ফেরৎ দেবে। এই নক্সার রহস্য কেউ উদ্ধার করতে পারবে না। রাজা বললেন।
যাক গে। নাও যদি বলে যায় তাহলে এই মাজোর্কায় থেকে নক্সার গুপ্তধন খোঁজাখুঁজি করবে। পেলে আর এক মুহূর্তও এখানে থাকবে না। সেনাপতি বলল।
–দেখা যাক। রাজা বললেন।
–নক্সাটায় কি গুপ্তধন কোথায় রাখা হয়েছে তার নির্দেশ আছে? সেনাপতি জানতে চাইল।
-না। তেমনভাবে তেমন কিছু তো সূত্র নেই। রাজা বললেন।
সেনাপতি একটুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর চারদিক দেখে নিয়ে বলল–এই ঘরে তো চারটে ফুলদানি আছে। ফুল রাখা আছে। মনে হয় পাথরের।
–হ্যাঁ কালো পাথরের। ও পাশে আরও দুটো ঘর আছে। একটায় ছেলেমেয়েকে নিয়ে রাণী থাকেন। অন্য ঘরটা বন্ধই থাকে। অতিথি আত্মীয়রা এলে থাকেন। রাজা বললেন।
–সব ঘরেই ফুলদানি আছে? সেনাপতি জানতে চাইল।
তাঁ। সর্বমোট বারোটা ফুলদানি আছে।
সেনাপতি একটু ভাবল। তারপর বলল–সহজে এই ধাঁধা বোঝা যাবে না। পরে ভাবব।
সেনাপতি নতুন রাজা হুয়ার্কের দিকে তাকাল। বলল–মাননীয় রাজা, চলুন।
সবাই রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। চলল নিজেদের আস্তানায়। সেনাপতির সৈন্যরা এর মধ্যেই রাজা কুয়েক হুয়ার সৈন্যদের তাড়িয়ে দিয়ে ওদের থাকার ঘরগুলোর দখল নিয়েছে। হৈ-হুঁল্লোড় চলছে। যুদ্ধে জেতার আনন্দ।
ওদিকে সন্ধ্যে হল। ফ্রান্সিসদের চিন্তা হল রাতের খাবারের কী হবে। ফ্রান্সিস কাপাককে বলল সে কথা। কাপাক বলল–সৈন্যবাহিনীতে যে আমার রক্ষী ছিল তার মারফৎ খাবার জোগাড় করতে পারব।
একটু রাত হতে ফ্রান্সিস বলল–কাপাক আমি রাজা কুয়েক হুয়ার কাছে যাচ্ছি। নক্সাটার অর্থ বুঝতে রাজার মতামত জানা খুবই প্রয়োজন। আমি কথা বলে রাজার কাছ থেকে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য পেতে পারি।
কাপাক বলল–দেখুন যুদ্ধ শেষ হয়েছে। সেনাপতি এখনও দু’একদিন সাধারণ মানুষদের চলাফেরায় সাবধান করা হবে। এইসব কড়াকড়ির মধ্যে আপনি গ্রেপ্তার হতে পারেন।
–তাহলে আজ নয়। কাল রাতে যাবো। কালকের মধ্যে সেনাপতি অনেক সৈন্য কুজকো পাঠিয়ে দেবে। লড়াই তো শেষ। ফ্রান্সিস বলল। রাতটা ফ্রান্সিসরা প্রায় উপবাস করে রইল। ফ্রান্সিসের আনা একটা রুটি পাতায় করে খেল। ভোর হল। একটু বেলা হতে ফ্রান্সিস বলল–কাপাক একবার চেষ্টা করে দেখি রাজবাড়ির রাঁধুনির কাছ থেকে খাবার জোগাড় করতে পারি কি না।
ফ্রান্সিস ঝোঁপজঙ্গল থেকে বেরুলো। পেছন দিকদিয়ে রাজবাড়িতে ঢুকল। একেবারে রসুইঘরে চলে এল।
রাঁধুনি অবাক। বলল–আপনি কে?
–আমি বিদেশী। ভীষণ খিদে পেয়েছে। ফ্রান্সিস বলল।
–ঐ কোণায় বসে খেয়ে যান। রাঁধুনী বলল।
—আমার আরো তিনজন বন্ধু রয়েছে। ওরা না খেলে আমি খাই কী করে।
–তাহলে ঐ তিনজনকেও নিয়ে আসুন। খেয়ে যান। রাঁধুনী বলল।
ফ্রান্সিস বলে উঠল অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। বন্ধুদের আনতে যাচ্ছি।
ফ্রান্সিস ফিরে এল। কাপাকদের বলল সব কথা। কাপাক বলল–এইটা একটা ভাল কাজ করেছেন। বলতে গেলে খাওয়ার সমস্যা মিটল।
সবাই ঝোঁপজঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল। রাজবাড়ির দেয়ালের আড়াল দিয়ে তারা। এল। রসুইঘরে ঢুকল। একপাশে কাঠের তক্তায় বসল। কাজের লোকটি ওদের সামনে খাবার দিয়ে গেল। ফ্রান্সিস বলল–ভদ্রতা দেখাবেন না। প্রাণের আনন্দে খেয়ে যান। কাপাক সবচেয়ে বেশি খেল। ফ্রান্সিস হেসে বলল–আপনার কাছে আমরা ছেলেমানুষ। কাপাকও হেসে খেতে লাগল।
–প্রাণে যতটা চায় খেয়ে যাও। এটাই আমার কথা। যাহোক–এবার জঙ্গলে চলো।
চারজনে ঝোঁপজঙ্গলের সেই জায়গাটায় ফিরে এল।
দিন কাটল। রাত হল। ফ্রান্সিস বলল কাপাক–আমি রাজার কাছে যাচ্ছি। কতকগুলো তথ্য রাজার কাছ থেকে পাবো কিনা দেখি।
হু। কিন্তু সাবধানে যাবেন। রাজার বাড়ির সদর দেউড়িতে প্রাসাদরক্ষীরা থাকতে পারে। কাপাক বলল।
–সেটা ভেবেছি। ভাবছি ঈগরের পোশাকটা পরে যাই। বিদেশী পোশাক পড়লে বিপদ হতে পারে। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ তো। জামা খুলতে খুলতে ঈগর বলল। ফ্রান্সিসও জামাকাপড় খুলল। দুজনেই পোশক পাল্টালো।
ফ্রান্সিস চলল রাজবাড়ির দিকে। আকাশে ভাঙা চাঁদ। চাঁদের আলো খুব উজ্জ্বল নয়। তবে চারপাশ মোটামুটি দেখা যাচ্ছে।
রাজবাড়ির সামনে এল ফ্রান্সিস। সদর দেউড়িতে দেখল মাত্র দুজন প্রহরী। একজন বর্শা হাতে পাথর বাঁধানো জায়গায় বসে আছে। অন্যজন এদিক ওদিক ঘুরছে।
ফ্রান্সিস ওদের সামনে গেল। একজন এগিয়ে এল।
-কোথায় যাবেন?
রাজামশাইর সঙ্গে কথা বলতে। ফ্রান্সিস বলল।
রাজামশাই বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। দ্বাররক্ষী বলল।
–না। রাজামশাই একটু বেশি রাতেই ঘুমান! ফ্রান্সিস বলল।
–আপনি সেটা জানেন? রক্ষী বলল।
–হ্যাঁ। ফ্রান্সিস মাথা ওঠানামা করে বলল।
–আপনি কোথা থেকে আসছেন? বসে থাকা প্রহরী বলল।
কুজকো থেকে। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে যান। এখন তো উনি আর রাজা নন। দাঁড়িয়ে থাকা প্রহরী বলল।
–আমার কাছে উনি এখনও রাজা। ফ্রান্সিস বলল।
–আপনি যেমন বোঝেন। যান। বসে থাকা দ্বাররক্ষী বলল।
বাইরের মন্ত্রণাকক্ষ পার হয়ে ফ্রান্সিস রাজার শয়নকক্ষে ঢুকল। দেখল রাজা বিছানায় শুয়ে আছেন। মাথার কাছে রাণী বসে আছেন।
ফ্রান্সিসকে দেখে রাজা ম্লান হাসলেন।
–এখন কেমন আছেন? রাণীর দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিস বলল।
–একই রকম। কখনও কষ্ট কমছে কখনও বাড়ছে। রাণী বললেন।
এবার ফ্রান্সিস রাজাকে বলল–আপনি কাপাককে যে নকশাটা দিয়েছেন সেটা আমি দেখেছি। নকশার পেছনে দুটো পংক্তি লেখা আছে। আমি পড়তে পারি নি। লেখাটা কী যদি বলেন।
প্রাচীন স্পেনীয় ভাষায় লেখা–হোক না কালো পাথর
ফুলদানি বড় সুন্দর।
সবচেয়ে ভালো সাদা ফ্রান্সিস একটুক্ষণ মাথা নিচু করে ভাবল। মাথা তুলে বলল–এখানে তো তিনটে ঘর। তিনটে ঘরেই কি রাখা আছে? ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ। রাজা বললেন।
–ফ্রান্সিস বলল–তাহলে তিনটে ঘরে সব মিলিয়ে বারোটা ফুলদানি আছে।
একটা কথা–একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল–কাপাক ছাড়া আর কাউকে আপনার নকশা দেখতে দিয়েছিলেন?
–একজন কবিরাজকে। তিনি আমার চিকিৎসা করতেন। রাজা বললেন।
করতেন বলছেন। এখন কি আপনাকে চিকিৎসা করেন না? ফ্রান্সিস বলল। তারপর বলল
–নকশাটা কি উনি ফেরৎ দিয়েছিলেন? ফ্রান্সিস বলল।
–না। রাজা মাথা নেড়ে বললেন।
–এখন যে নকশাটা আছে? ফ্রান্সিস বলল।
–নকল করে রেখেছি। রাজা বললেন।
–কবিরাজ মশাই নকশা নিয়ে বেপাত্তা হয়ে গেলেন।
–আপনি তার খোঁজখবর করেছিলেন? ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ। কিন্তু তার কোনরকম হদিশই পাই নি। রাজা বললেন।
–উনি কোথায় থাকতেন? ফ্রান্সিস বলল।
কুজকো। ঘোড়ায় চড়ে আসতেন। রাজা বললেন।
বয়েস কম? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–না। মধ্যবয়স্ক। আপনি এত কথা জানতে চাইছেন কেন? রাজা বললেন।
–এসবের সঙ্গে আপনার পিতামহের রাখা গুপ্তধনের হদিশ বের করব। ফ্রান্সিস বলল।
–পারবেন? রাজা বললেন।
–সেই জন্যেই তো আপনার কাছ থেকে সব জানতে চাইছি। ফ্রান্সিস বলল।
–দেখুন চেষ্টা করে। রাজা বললেন।
তখনই একজন পাচাকুচির সৈন্য ঘরে ঢুকল। বলল–মাননীয় রাজা সেনাপতি এসেছেন। রাজা বললেন নিয়ে এসো।
রাজা ভালোভাবে উঠে বসলেন। রাণী রাজার কাঁধ ধরে রইলেন। সেনাপতি ঢুকল। সেই দাম্ভিক ভঙ্গী। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে দরজার দিকে যাচ্ছিল। সেনাপতির নজরে পড়ল। বলল–
–তুমি এদেশীয় পোশাক পরেছো। কিছু চুরির ধান্ধা। সেনাপতি বলল।
–আমরা চোর নই। ফ্রান্সিস বলল।
–না। মহাপুরুষ। সঙ্গের দুজন সৈন্যকে বলল–এই ধর তো বিদেশী ভূতটাকে। সেনাপতি বলল।
সৈন্য দুজন ফ্রান্সিসের দিকে এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস এগিয়ে এসে প্রথম সৈন্যটির চোয়াল লক্ষ্য করে ঘুষি মারল। সৈন্যটি উল্টেগিয়ে মেঝেয় পড়ল। অন্যটিকে পায়ে পা ঠেকিয়ে জোরে পা ঘোরাল। সৈন্যটিও মেঝের ওপর চিৎ হয়ে পড়ল।
ফ্রান্সিস দ্রুত বাইরের ঘরে এল। তারপর মন্ত্রণাকক্ষটি পার হয়ে সদর দেউড়িতে এল। সঙ্গে দেউড়ির আলোর বাইরে ছুটে এল। প্রহরী দু’জন চিৎকার করে উঠল। ততক্ষণে ফ্রান্সিস অন্ধকারে মিশে গেছে।
ফ্রান্সিস রাজবাড়ির তিনটে ঘর ভালো করে দেখতে চেয়েছিল। সেটা আর হলো না।
ফ্রান্সিস নদীর ধারে এল। জোর হাওয়া ছুটেছে। ফ্রান্সিসের ঘামে ভেজা গা জুড়োল।
হঠাৎ একটা খেজুর গাছের পেছন থেকে চারপাঁচজন বুনো মানুষ ছুটে এসে ফ্রান্সিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস এই আক্রমণের জন্যে তৈরি ছিল না। নিজেকে সামলাতে পারল না। মাটিতে পড়ে গেল। বুনোরা সবাই মিলে ফ্রান্সিসকে শক্ত হাতে চেপে রইল। নদীর ঢালে নিয়ে এল। ফ্রান্সিসকে ঢাল দিয়ে নামিয়ে নৌকোয় বসিয়ে দিল। বৈঠা দিয়ে একজন নৌকো চালাল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওপারে পৌঁছল। ফ্রান্সিস বার তিনেক জিজ্ঞেস করল–আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? কেউ কোন কথা বলল না।
নৌকো থেকে নেমে বুনোরা ফ্রান্সিসকে নিয়ে চলল। এতক্ষণ তবুনিস্তেজ জ্যোৎস্নায় কিছু কিছু দেখা যাচ্ছিল। এখন বনের মধ্যে ঢুকে চারদিক অন্ধকার।
কিছুক্ষণ পরে বুনোরা ফ্রান্সিসকে ওদের বসতি এলাকায় নিয়ে এল। একটা বেশ বড় উঠোনের মত। চারপাশে বাড়ি ঘর। কেউ কেউ ঘর থেকে মুখ বের করে ফ্রান্সিসকে দেখল।
ফ্রান্সিস দীর্ঘশ্বাস ফেলল–আবার কয়েদঘর। আবার বন্দীদশা।
কিন্তু আশ্চর্য। ফ্রান্সিসকে ওরা একটা গাছের ডালে তৈরি ঘরে নিয়ে এল। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঘর। ঘরে একটা তেলের আলো জ্বলছিল। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে একজন প্রহরী। হাতে বর্শা।
কিছুক্ষণ পরে দ্বাররক্ষী গলা চড়িয়ে বলল–রাজা আসছেন। তাকে সম্মান জানাও।
রাজা ঢুকল। বেশ দশাসই চেহারা। মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকতে হল। মাথায় লাল মোটা কাপড়ের ফেট্টি। তাতে বিচিত্র রঙের পাখির পালক গোঁজা। গলায় লালরঙের পাথরের মালা। মাথায় বড় বড় চুল। বেণীর মত বাঁধা।
দ্বাররক্ষী মাথা একটু নুইয়ে রাজাকে সম্মান জানাল। রাজা বলল–আমাদের পুরোহিত আমাদের জানিয়েছে যে বর্তমান রাজা অর্থাৎ আমি আর রাজা থাকতে পারব না। নতুন রাজা আসবে দক্ষিণ দিক থেকে। তার গায়ের রঙ হবে সাদা। লম্বা লম্বা চুল। পরনে থাকবে বিদেশী পোশাক। তরোয়াল চালাতে অত্যন্ত দক্ষ। রাজা থামলেন।
–কিন্তু আমি রাজা হব কী করে? ফ্রান্সিস বলল।
–আমরাই আপনাকে রাজা করব। রাজা বলল।
–কিন্তু আমি তো রাজা হতে চাই না। ফ্রান্সিস বলল।
তাহলে আপনাকে বন্দী করা হবে। থাকতে দেওয়া হবে কয়েদখানায়। ফ্রাসিস কিছু বলল না। চুপ করে রইল। বুঝল এই বুনোদের হাত থেকে মুক্তি নেই। ওরা ওকে নিয়ে যা খুশি করুক। ও আপত্তি করবে না। পাথরকুচি দিয়ে মেঝে তৈরি হয়েছে। তার ওপর বিছানা। বেশ পুরু বিছানা। এক বিশেষ নরম ঘাসে তৈরি।
ফ্রান্সিস বিছানায় বসল। কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। রাজা চলে গেল। রাজার সঙ্গে যারা এসেছিল তারাও চলে গেল।
কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। বিছানায় শুয়ে পড়ল। মারিয়া আর বন্ধুদের কথা মনে এল। এখানে এইভাবে রাজা হয়ে যাবে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। ঠিক করল বুনোরা যা করতে বলবে তাই ও করবে। বুনোদের চটাবে না। ওদের কথামতো না চললে ওর মৃত্যু হতে পারে। কাজেই বুনোরা যা করছে করুক ও সবই মেনে নেবে।
রাত বাড়ল। দরজা খোলা হল। তিনচারজন বুনো মানুষ ঘরে ঢুকল। মেঝের একপাশে আসন পাতল। কোন গাছের পাতা বড় গোল পাতা পাতল। জলভরা কাঠের গ্লাশ রাখল। তেলের আলোটা বসবার জায়গার কাছে রাখল। একজন বুনো সৈন্য। ফ্রান্সিসকে খাবারের জায়গায় এসে বসতে ইঙ্গিত করল।
ফ্রান্সিস উঠল। খেতে বসল। গোল রুটি, পাখির মাংস, তারপর ঝোলের মত কিছু। ফ্রান্সিস খেতে লাগল। মাংসটাই সবচেয়ে ভালো লাগছিল। ওটাই দুবার চেয়ে খেল।
খাওয়া শেষ। ফ্রান্সিস বিছানায় ফিরে এল। অনেক চিন্তা মাথায়। সেসব ভাবতে ভাবতে ফ্রান্সিস ঘুমিয়ে পড়ল।
ভোরে ঘুম ভাঙ্গল পাখির ডাকে। এখানে এত পাখি? ফ্রান্সিস হাত মুখ ধুয়ে বিছানায় এসে বসল। দুজন রক্ষী খাবার নিয়ে এল। কাঠের থালায় পোড়া রুটি কয়েকটা। একটা বাঁশের ছোট চোঙে কী এক তরল জিনিস।
খিদেও পেয়েছে বেশ। ফ্রান্সিস বেশ দ্রুতই খেতে লাগল। খাওয়া শেষ।
রক্ষীরা চলে গেল। দুপুরে মাংসের সঙ্গে রুটি। আরো কিছু লতাপাতা দিয়ে রান্না করা খাবার। সেসবও খেল।
সন্ধেয় ফ্রান্সিসকে এনে উঠোনের একপাশে বসান হল। সিংহাসন ফাঁকা। বুনোরা ঢোলের মত একটা বাদ্যযন্ত্র এনে বাজাতে শুরু করল। উঠোনে স্ত্রীপুরুষ নাচতে নাচতে এল। সেইসঙ্গে তীক্ষ্ণস্বরে গান।
নাচগান চলছে তখন আগের রাজা এল। একপাশে বসল। নাচগান কিছুক্ষণ চলল। তারপর নাচিয়েরা চলে গেল।
এবার আগের রাজা উঠে দাঁড়াল। গলায় বেশ জোর দিয়ে বলতে লাগল আমাদের রাজপুরোহিত স্বপ্নের মধ্যে দেখেছে এক যুবক দক্ষিণ দিক থেকে এসেছে। সেই যুবকের রাজা হবার সমস্ত লক্ষণই পুরোহিত দেখেছে। সেই যুবকই হবে আমাদের রাজা। সব লক্ষণ মিলে গেছে।
এই পর্যন্ত বলে রাজা ফ্রান্সিসের দিকে হাত বাড়াল।
ফ্রান্সিস আগের রাজার হাত ধরল। আগের রাজা বলল–উঠে আসুন। ফ্রান্সিস এগিয়ে গেল। পুরোহিতের নির্দেশমত আমরা এই যুবককেই রাজা বলে মেনে নিলাম। বুনোরা হৈ হৈ করে উঠল। হাতের বর্শা ওঠানামা করতে লাগল। আগের রাজা বলতে লাগল–প্রজা সাধারণ–এই নতুন রাজাকে তোমরা মেনে নেবে। এই বলে আগের রাজা ফ্রান্সিসকে আস্তে ধরে নিয়ে সিংহাসনে বসিয়ে দিল। আবার ধ্বনি উঠল–নতুন রাজা–বেঁচে থাকুন। বেশ হৈ চৈ চলল। আগের রাজা দুহাত ওপরে ওঠালো। গণ্ডগোল থেমে গেল।
পুরোহিত এগিয়ে এল। ফ্রান্সিসের সামনে এসে কীসব বিড়বিড় করে বলতে লাগল। তারপর ফ্রান্সিসের মাথায় ফুল রাখল। হাত সরিয়ে নিতে ফুলগুলো পড়ে গেল। আরো কিছুক্ষণ পরে পুরোহিত মন্ত্র পড়তে পড়তে কী যেন বলল। ফ্রান্সিসের অস্বস্তি লাগছিল। চুপ করে বসে থাকতেও পারছে না আবার কিছু বলতেও পারছে না। সিংহাসন থেকে উঠে যেতেও পারছে না।
ফ্রান্সিসের কাছে এসে পুরোহিত গলা নামিয়ে বলতে লাগল, আগের রাজা কিছুতেই ক্ষমতা ছাড়ছিলেন না। মন্ত্রী অমাত্যরা আমাকে দায়িত্ব দিলেন নতুন রাজা খুঁজে বের করুন। আমি আমাদের দেবতা আরুজুবার কাছে জানতে চেয়েছিলাম নতুন রাজাকে কীভাবে পাব। আমাদের দেবতা আরুজুবা বললেন- তোর কাছে পুজোর জন্যে যে পবিত্র জল আছে তাতে নতুন রাজার ছবি ফুটে উঠবে। আমি পবিত্র জলে আপনার ছবি দেখলাম। সৈন্যদের হুকুম দিলাম আপনাকে ধরে আনতে।
–কিন্তু আমি রাজা হব না। ফ্রান্সিস বলল।
–পারবেন না পালিয়ে যেতে। রাজা হয়েই আপনাকে এখানে থাকতে হবে। পুরোহিত বলল।
–দেখা যাক। ফ্রান্সিস বলল।
পুরোহিত চলে গেল। সমবেত জনতার মধ্যে মাঝে মাঝেই ধ্বনি উঠল– নতুন রাজা–দীর্ঘজীবী হোন। ভিড় কমতে লাগল। সেনাপতি এসে বলল– মাননীয় রাজা–চলুন বিশ্রাম করবেন।
ফ্রান্সিস সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়াল। মন্ত্রী ও সেনাপতিও উঠল। ফ্রান্সিস চারপাশে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। উপায় ভাবতে লাগল কেমন করে পালানো যায়। বুনোরা নতুন রাজার জয়ধ্বনি করল। একজন যোদ্ধা সামনে আর একজন পেছনে। প্রহরী দু’জন ফ্রান্সিসকে রাজগৃহে নিয়ে এল।
ফ্রান্সিসের জন্যে কিছু পরে প্রহরী দুজন খাবার নিয়ে এল। বেশ খিদে পেয়েছে। অন্যসময় হলে ও হাপুসহুপুস খেতো। কিন্তু এখন রাজা। এখন রাজার মতো আচরণ করতে হবে। এখন সবাই তার আচরণ ব্যবহার এসব দেখবে। কাজেই এখন যা খুশি তা করা চলবে না।
ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে খেতে লাগল। একজন প্রহরীকে হাতের ইশারায় ডাকল। প্রহরীটি এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস বলল–
–তোমার নাম কি? প্রহরীটি খুব খুশি। রাজাকে সম্মান দিয়ে একটু মাথা নিচু করল। তারপর বলল-বেচুয়া।
–হুঁ। তুমি কি সারারাত আমাকে পাহারা দাও? ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ। আমি একা নই। সঙ্গে আর একজন থাকে। বেচুয়া বলল।
–এত পাহারার কি দরকার? ফ্রান্সিস বলল।
মাননীয় রাজা–আপনার জানার কথা নয়। উত্তরে পাহাড়ী এলাকায় একটা দেশ আছে। ওখানে কালো পাহাড়ীদের দেশ। ওরা মাঝে মাঝেই আমাদের আক্রমণ করে। আমাদের সঙ্গে পেরে ওঠে না। পালিয়ে যায়। কিন্তু এরকম আক্রমণ বন্ধ রাখে না। ওদের লক্ষ্য শুধু আমাদের রাজাকে হত্যা করা। তাই আপনাকে সবসময় পাহারাদাররা পাহারা দিয়ে রাখে। বেচুয়া বলল।
–হু। দেখছি। এত পাহারা দিয়ে আমাকে আটকেই রাখা হয়। এই পাহারার ব্যবস্থা করেছেন কারা? ফ্রান্সিস বলল।
–মন্ত্রীমশাই, সেনাপতি আর অমাত্যরা। বেচুয়া বলল।
–ঠিক আছে। কিন্তু আমি এত পাহারা টাহারা পছন্দ করি না। সবসময় মনে হয় আমি যেন বন্দী হয়ে আছি। ফ্রান্সিস বলল।
–আমাদের যেমন হুকুম। আপনি মন্ত্রীমশাইকে বলে দেখুন। বেচুয়া বলল।
–তুমি বললে কালো পাহাড়ী। ওরা কারা? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–ঐ কালো পাহাড়ীদের গায়ের রং কালো। উত্তরে যে পাহাড়টা মাচিপিচুলাম ওখানেই ওদের রাজত্ব। ওদের গায়ের রং কালো। তাই আমরা কালোপাহাড়ী বলি। বেচুয়া বলল।
–ওরা বুঝি মাঝে মাঝেই আক্রমণ করে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–হ্যাঁ। উদ্দেশ্য তো বললাম–আমাদের রাজাকে মেরে ফেলা। বেচুয়া বলল।
–তাতে ওদের কি লাভ? ফ্রান্সিস বলল।
–আমরা তাহলে আমাদের মধ্যে মারামারি করব। এই দেশে অশান্তির আগুন জ্বলবে। আমরা দুর্বল হয়ে পড়বো।
তখন ওরা সহজেই এই রাজ্যজয় করতে পারবে। এই দেখুন না–আমাদের আগের রাজা কী বলশালী। তাকেও ওরা বন্দী করেছিল। ঘোড়ায় চাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল আমরাও ওদের চেয়ে দ্রুতবেগে ছুটে গিয়ে রাজাকে উদ্ধার করেছিলাম। রাজা সুস্থ হলেন কিন্তু বাঁহাতটা শুকিয়ে গেল। ওরা রাজার বামবাহুতে বড় ছোরা বসিয়েছিল। আস্তে আস্তে ঐ জায়গাটা দুর্বল হয়ে পড়ল। সেই রাজার বাঁ হাত অকেজো হয়ে গেল। কে জানে ছোরার মুখে বিষাক্ত কিছু মেশানো হয়েছিল কিনা? বেচুয়া বলল।
পরের দিন রাতে ফ্রান্সিস খেয়ে শুয়ে পড়ল। মাংসটা কোন পাখির অথবা জীবজন্তুর এটা বুঝতে পারল না। কিন্তু খুব সুস্বাদু লাগল। ফ্রান্সিস চেয়ে খেলো।
শুয়ে শুয়ে একটা চিন্তাই ওকে বড় বিচলিত করছিল। জাহাজে ফিরতে অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। উপায়ও নেই। সবসময়ই কাছে কাছে কোন না কোন প্রহরী।
ফ্রান্সিস এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল। হঠাৎ গভীর রাতে বুনোদের চিৎকার হৈ হল্লা। ফ্রান্সিস শুয়ে থেকে বুঝতে পারল–লড়াই শুরু হয়েছে। বুনোদের পায়ের শব্দ শুনে বুঝল-বুনোরা ছুটে যাচ্ছে।
ফ্রান্সিস দেখল–ঘরের দরজায় দুজন প্রহরী দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে অস্পষ্ট জ্যোত্সা। ঘরের মশাল নেভানো হয়েছে। মন্ত্রীমশাই ছুটতে ছুটতে অন্ধকার ঘরে ঢুকলেন। অন্ধকারেই বললেন–মান্যবর রাজা–আপনাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে।
-কোথায়? ফ্রান্সিস বলল।
–রক্ষী আপনাকে নিয়ে যাবে। আপনি কালকে পর্যন্ত ওখানেই থাকবেন। লড়াই থেমে গেলে আপনাকে আবার এই ঘরে নিয়ে আসা হবে। মন্ত্রী ছুটে বেরিয়ে গেলেন।
রক্ষী দুজন ঘরে ঢুকল। বেচুয়া বলল–মাননীয় রাজা–শিগগির তৈরি হন। আমাদের অন্য জায়গায় যেতে হবে।
ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। বলল–মশালটা জ্বালো। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। বেচুয়া মশালটা জ্বালল। ফ্রান্সিস আজ পোশাক পাল্টাল না। রাজার পোশাক যা পরনে ছিল তাই পরে নিয়েই দরজার দিকে চলল। ফ্রান্সিসের পিছু পিছু ঘর থেকে বেরিয়ে এল দুজন প্রহরীও। এবার বেচুয়া বলল–মাননীয় রাজা আপনি আমার পেছনে পেছনে আসুন। ফ্রান্সিস তাই চলল। কিছু দূরেই হৈ হৈ চিৎকার গোঙানি। জোর লড়াই চলছে।
বনের তলায় অন্ধকার। তবে গাছের পাতা ডালের ফাঁক দিয়ে অস্পষ্ট জ্যোৎস্নাভাঙা টুকরোর মত পড়েছে। তাতে অন্ধকার কাটে নি। অবশ্য মোটামুটি একটু আধটু দেখেটেখে পা ফেলে যাই।
ফ্রান্সিসের হঠাৎ মনে হল–এখন বাইরের পরিবেশ। যে কোন মুহূর্তে আক্রান্ত হতে পারে। তরোয়ালটা সঙ্গে থাকলে মনে অনেক জোর পাওয়া যায়। ফ্রান্সিস ডাকল–বেচুয়া!
–বলুন।
–আমার তরোয়ালটা কোথায় রাখা হয়েছে? ফ্রান্সিস বলল।
–আপনার ঘরে। বেচুয়া বলল।
–তাহলে তরোয়ালটা নিয়ে এসো। এখন একেবারে নিরস্ত্র থাকা বিপজ্জনক। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। বেচুয়া চলে যাচ্ছে তখন প্রহরীটি বলল–কোথাও দাঁড়িয়ে পড়া ঠিক নয়। আমরা যে গুহায় যাবো বেচুয়া তুমিও সেখানে চলে এস।
-ঠিক আছে। বেচুয়া চলে গেল। অন্ধকারে মিলিয়ে গেল যেন।
ফ্রান্সিসরা চলল। প্রহরীটি পিছু পিছু চলল।
একটা টিলার সামনে এল ওরা। একজন প্রহরী এগিয়ে গেল। অল্প জ্যোৎস্নায় দেখা গেল একটা গুহার মুখ। মুখে বড় পাথর চাপা দেওয়া। প্রহরীটি বলল–এই পাথরটা সরাতে হবে। একা পারবো না। আপনি আসুন। একজন প্রহরী বলল।
এবার দুজনে গুহামুখের পাথরটা ধাক্কা দিতে লাগল। পাথরটা নড়ল। আরো বার কয়েক ধাক্কা দিতেই পাথরটা একপাশে সরে গেল। ঢোকার মত জায়গা হল। দুজনে গুহাটায় ঢুকল।
নীর অন্ধকারে কিছুই দেখা গেল না। প্রহরীটি বলল–আপনি আমার হাত ধরে আসুন। দুজন অন্ধকারে চলল। কিছুটা এসে প্রহরীটি বলল–এখানে বসুন। ফ্রান্সিস হাত দিয়ে দেখল একটা পাথরের পাটামত। ফ্রান্সিস বসল। প্রহরীটি বসল।
বেশ গরম লাগছে। আস্তে আস্তে গরমটা সহনীয় হল। এখন বেচুয়ার জন্যে অপেক্ষা।
দুজনেই চুপ করে বসে রইল। চোখে অন্ধকারটা সয়ে এল। ফ্রান্সিস অস্পষ্ট দেখল পাথরের লম্বা পাটাটায় বিছানা মত কাপড় পাতা। ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল। এখন চিন্তা হল বেচুয়ার জন্যে ও নির্বিঘ্নে আসতে পারবে কিনা।
কিছুক্ষণ পরে দূর থেকে বেচুয়ার ডাকই মনে হল। প্রহরীটি গুহার মুখের দিকে দ্রুত ছুটে গেল। ফ্রান্সিসও পেছনে পেছনে ছুটল। গুহার মুখে পাথরের আড়াল থেকে দুজনে অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায় দেখল-বেচুয়া টলতে টলতে আসছে। ওর হাতে বর্শাটা নেই। হাতে একটা তরোয়াল। তখনই ফ্রান্সিসরা ভালো করে দেখল বেচুয়ার পিঠে একটা বর্শা বেঁধা। বেচুয়া আর বেশি দূর আসতে পারল না। উবু হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।
প্রহরীটি ছুটে বেচুয়ার কাছে গেল। এক হ্যাঁচকা টানে বর্শাটা বের করল। রক্ত বেরোতে লাগল। ফ্রান্সিস দেখল বেচুয়ার ডান হাতে তরোয়ালটা ধরা। ফ্রান্সিস নিচু হয়ে তরোয়ালটা তুলে নিল।
তখনই বন থেকে চার পাঁচজন যোদ্ধা বেরিয়ে এল। ওদের গায়ের রং কালো। ফ্রান্সিস বুঝল এরাই কালো পাহাড়ি। বুনোদের নতুন রাজাকে ধরতে এসেছে।
ওরা ফ্রান্সিসের গায়ে রাজার পোশাক দেখেই চিনল। উল্লাসে ওরা চিৎকার করে উঠল। ছুটে এল ফ্রান্সিসের সামনে। প্রথম যোদ্ধাটি ফ্রান্সিসের দিকে বর্শা ছুঁড়ল। ফ্রান্সিস দ্রুত সরে গেল। যোদ্ধাটির হাতে বর্শা নেই। ফ্রান্সিস লাফিয়ে সামনে গিয়ে যোদ্ধাটির বুকে তরোয়াল ঢুকিয়ে দিল। যোদ্ধাটি চিৎ হয়ে পাথুরে মাটিতে পড়ে গেল। আর একজন বর্শা হাতে এগিয়ে এল। প্রহরীটি ফ্রান্সিসকে বলল–আপনি যাবেন না–আমি যাচ্ছি। প্রহরীটি একজন যোদ্ধাকে লক্ষ্য করে বর্শা ছুঁড়ল। নিখুঁত নিশানা। বর্শাটা বুকে ঢুকে গেল। যোদ্ধাটি মাটিতে পড়ে গেল।
এবার ফ্রান্সিস তরোয়াল হাতে যোদ্ধাদের দিকে ছুটে এল। যোদ্ধারা পালাতে শুরু করল। সব যোদ্ধারা যখন বনে ঢুকে পড়ল তখন ফ্রান্সিস ফিরে এল। বেচুয়ার কাছে এসে প্রহরীটিকে বলল চলল। ওকে গুহায় নিয়ে যাবো। বিস্কো সব সময় ফ্রান্সিসের কাছাকাছি আছে।
দুজনে বেচুয়াকে ধরাধরি করে গুহার ভেতরে নিয়ে এল। পাথরের ওপর বিছানায় শুইয়ে দিল। প্রহরীটি রাখা জল নিয়ে এল। ফ্রান্সিস বেচুয়ার চোখেমুখে জল দিল। প্রহরীটি চকমকি পাথর ঠুকে মশাল জ্বালল। চারদিকে আলো ছড়ালো।
ফ্রান্সিস এতক্ষণে বুঝল–বেশ খিদে পেয়েছে। কিন্তু খাবার এখন কোথায় পাওয়া যাবে? বিস্কো এল। বলল-ফ্রান্সিস–একটু যে ঘুমিয়ে নেব তারও উপায় নেই। খালি পেটে ঘুমও আসছে না।
–উপায় নেই। এখন বাইরে লড়াই চলছে। বাইরে বেরোনো যাবে না। অপেক্ষা করতে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই লড়াই থেমে যাবে। তখন খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে ফ্রান্সিস বলল।
রাত শেষ। পাখির ডাক শোনা গেল। ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। হঠাৎ বেচুয়ার গোঙানি শোনা গেল। ফ্রান্সিস উঠে গিয়ে বেচুয়ার পাশে বসল। বলল–বেচুয়া শরীর খারাপ লাগছে?
-হ্যাঁ। শরীর অসম্ভব দুর্বল লাগছে। মাথা ঘুরে ঘুরে উঠছে। কথাটা আস্তে আস্তে বলে বেচুয়া বলল–আমি–বোধহয় বাঁচবো না।
–এইসব আজেবাজে চিন্তাকে প্রশ্রয় দিও না। নিজেকে সম্পূর্ণ সুস্থ ভাববে। ফ্রান্সিস বলল। তারপর হাত বাড়িয়ে বলল–দেখি তো জ্বরটা কেমন? ফ্রান্সিস বেচুয়ার হাতে নাড়ি টিপে দেখল। গাল গলায় উত্তাপ দেখল। বেশ জ্বর এখন।
ফ্রান্সিস বলল–জ্বর আছে এখনও। তবে একটু ওষুধ টষুধ পড়লে তুমি সুস্থ হয়ে যাবে। ততক্ষণে একটু জ্বর বাড়ল।
ফ্রান্সিস বলল–একটু কষ্ট সহ্য কর। বেচুয়া আর কথা বলল না। দু চোখ বুজে শুয়ে রইল।
এইবার খাদ্য চাই। ফ্রান্সিস কীভাবে খাদ্য জোগাড় করবে ভেবে পেল না। প্রহরী ফ্রান্সিসকে বলল সেকথা। প্রহরীটি বলল–একটু দূরে এক জমিদার থাকে। তার বাড়ি থেকে খাবার চুরি করতে হবে।
তার মানে আমাদের সারাদিনই না খেয়ে থাকতে হবে। একটাই বাঁচোয়া জলভরা পীপে আছে দুটো। সারাদিনই জল খেতে হবে। তাতে খিদেটা বেশ চাপা পড়ে যাবে। বিস্কো বলল।
দুপুরে প্রহরীটি বনজঙ্গল থেকে কিছু ফল নিয়ে এল। তাই ভাগ করে সবাই খেল।
সারা দিনটা গেল। সন্ধ্যে থেকেই বেচুয়ার গোঙানিটা শুরু হল। বোঝাই যাচ্ছে বেচুয়া ভীষণ কষ্ট সহ্য করছে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে। ফ্রান্সিস ভাবল যে বর্শায় বেচুয়া আহত হয়েছিল সেটার মাথায় বিষ মাখানো ছিল।
রাত বাড়তে লাগল। বেচুয়ার গোঙানি থেমে গেছে। বোধহয় আর গোঙানি করবার শক্তিও অবশিষ্ট নেই।
সকাল থেকে এই রাত পর্যন্ত ফ্রান্সিসরা শুধু জল খেয়ে। খাবার জোগাড় করতে বিস্কো আর প্রহরীটি একটু রাতে বেরুলো। নিচু দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকল। জ্যোৎস্না খুব উজ্জ্বল নয়। দেখেশুনে পা ফেলতে হচ্ছিল।
রসুই ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করা। অল্প আলোয় দেখল একটা তালা লাগানো। বিস্কোরা দেখল লোহার বড় তালা। বিস্কো বার কয়েক চেষ্টা করল খুলতে। কিন্তু পারল না।
বিস্কো বের করল ছোরার মুখটা তারপর তালার গর্তে ঢুকিয়ে আস্তে আস্তে চাপ দিতে লাগল। তারপর চাপ বাড়াল। শব্দ করে তালাটা ভেঙে গেল। একটু শব্দ হল।
ফ্রান্সিসরা চুপ করে দাঁড়িল রইল না। কারো ঘুম ভাঙে নি। ফ্রান্সিসরা রসুইঘরে ঢুকল। কাঠের ডেকচিতে রাখা ছিল মাংস। ফ্রান্সিস ডেকচিটা তুলে নিল। কেক রুটি সবই নিল দুজন।
দরজা ভেজিয়ে পাঁচিল টপকে বাইরে বেরিয়ে এল।
গুহায় ফিরে এল। বেচুয়া বাদে সবাই খাবার ভাগ করে নিয়ে খেতে লাগল। প্রায় দুদিন উপবাস। ফ্রান্সিস খাবারের দিকে চেয়ে রইল। খিদেটাই মারা গেছে। উপায় নেই। খাবার যেমনই লাগুক সব খাবার খেতে হবে। ফ্রান্সিস খেতে লাগল।
শেষ রাতের দিকে বেচুয়া সমস্ত শরীর মোচড়াতে লাগল। মুখে গোঁ গোঁ শব্দ করছে। সবাই বেচুয়ার চারপাশে ভিড় করে দাঁড়াল।
হঠাৎ বেচুয়ার শরীর স্থির হয়ে গেল। বেচুয়া মারা গেল। ফ্রান্সিসের চোখে জল এল। ও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
এবার বেচুয়াকে কবর দেওয়া যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। সূর্য ওঠার আগেই কবর দিতে হবে। লড়াইয়ের ফলাফল কী তা ওরা এখনও জানে না। রাজা পাচাকুচি যদি জয়ী হয় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে এই এলাকা ছেড়ে পালাতে হবে। যদি রাজা কুয়েক হুয়ার জয় হয় তাহলে নিশ্চিন্ত। কবরে দিয়ে সবাই মাজোর্কার উদ্দেশ্যে রওনা হবে।
বেচুয়ার শরীর এখানেই কোথাও কবর দিতে হবে।
বিস্কো আর প্রহরীটি জমিদার বাড়ির পেছনে এল। দেওয়াল। ওরা দুজনেই দেয়াল টপকে বাড়ির মধ্যে ঢুকলো। দুজনে রসুইঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল! দেখল তিনজন রাঁধুনি। এমন সময় বাড়ির কাজের স্ত্রীলোকটি ওখানে কাজে এল। বিস্কোদের দেখে গলা চড়িয়ে বলল–তোমরা কে গা? প্রহরীটি গলা চেপে বলল–তরোয়াল দিয়ে নাক কেটে দেবো। স্ত্রীলোকটি ও মাগো’ বলে বড়ঘরে গিয়ে ঢুকে পড়ল।
এবার বিস্কো গলার নিচে হাত ঢুকিয়ে ছোরাটা বের করল। ছুটে গিয়ে এক রাঁধুনির গলায় গিয়ে ছোরা ঠেকাল। বলল–একটু হাত নাড়লেই তুমি ভবের পার। অন্য দুই রাঁধুনিও কী বলবে বলে কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। বিস্কো তিনজনকেই ছোরাটা দেখাল। তারপর বলল–আমরা ডাকাত না। অবস্থা বিপাকে আমরা দুদিন যাবৎ না খেয়ে আছি। কাল রাতে তোমাদের এই রসুইঘর থেকে খাবার চুরি করে নিয়ে গেছি। আজকেও নেবো। একটু থেমে বিস্কো বলল রুটির থালা ভর্তি করে রুটি দাও কেক থাকলে দাও আর মাংসের হাঁড়িটা দাও। নইলে তোমাদের তিনজনের একজন মরবেই। এক্ষুনি।
রাঁধুনিরা নিজেদের বিপদ বুঝল। ওরা মাটির থালা মাংসের হাঁড়ি দিয়ে দিল।
বিস্কো চাপা সুরে বলল-পালাও। তারপর খাবার নিয়ে ছুটল পেছনের দেওয়ালের দিকে। দেয়ালটা পার হয়ে বাইরের বাগানে এল তারপর ছুটল বড় রাস্তার দিকে।
দুপুরে ক্ষুধার্ত ফ্রান্সিসরা খাওয়ার ব্যাপারে আর দেরি করল না।
এবার কবর দেওয়া। পেছনের একটা ঘরে ফ্রান্সিস এল। খুঁজে খুঁজে দুটো বেলচা পেল। দুটো কাঠের পাটাতন পেল। একটা বড় আর একটা ছোট। ও গলা চড়িয়ে ডাকল-বিস্কো, এদিকে এসো। বিস্কো এল। বলল কী ব্যাপার?
–এই লম্বা পাটাতনটায় বেচুয়াকে শুইয়ে দিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।
–উপায় কি। এখানে কফিন কোথায় পাবো। বিস্কো বলল।
–এখন কবরের জায়গা খোঁজা। চলো। ফ্রান্সিস বলল।
দুজনে গুহার বাইরে এল। প্রহরীটিকে বলল তুমি থাক। আমরা কবরের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি।
দুজনে বেরিয়ে এল। দেখল সামনেই একটা উপত্যকার মত। সবুজ ঘাসে ঢাকা। ফ্রান্সিস বলল–বেচুয়াকে কবর দিতে বেশি দূর যেতে পারব না। কাজেই এই উপত্যকা নরম মাটির। এখানেই কবর দেব।
দুজনে গুহায় ফিরে এল। ফ্রান্সিস প্রহরীটিকে সব বলল। তারপর কাঠের পাটাতনে বেচুয়াকে শুইয়ে নিয়ে চলল কবরের জায়গায়। একপাশে মৃতদেহ রেখে বেলচা দিয়ে ফ্রান্সিস আর বিস্কো মাটি খুঁড়তে লাগল। একটা লম্বাটে গর্ত মত হল।
তখন ভোর হয়েছে। ফ্রান্সিসরা আর দেরি করল না। গর্তে কাঠের পাটাতনসহ বেচুয়ার মৃতদেহ নামিয়ে দিল। তারপর ওরা কবরে মাটি ফেলতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই গর্ত খুঁজে গেল মাটিতে।
সবাই গুহায় ফিরে এল। ফ্রান্সিস পাথরের ওপর কাপড়ের বিছানায় শুল। গলা চড়িয়ে বলল–এবার খাওয়ার ব্যবস্থা কী হবে?
–ঐ মহিলার রসুই ঘর থেকে খাবার আনা। বিস্কো বলল।
–তাহলে প্রহরী আর বিস্কো যাও। আমি ভীষণ দুর্বল বোধ করছি। ফ্রান্সিস বলল।
তুমি বিশ্রাম কর। আমরা যাচ্ছি। বিস্কো বলল। তারপর দুজনে গুহা থেকে বেরিয়ে এল।
আবার জমিদারের রাঁধুনীদের ছোরা দেখিয়ে খাবার নিয়ে পালিয়ে এল। আবার ঐ খাবার খেল। প্রহরীও খেল।
সেই রাত কাটল। ফ্রান্সিসরা কালোদের সঙ্গে পাচাকুচির লড়াইয়ে কারা জিতল তা জানা গেল না।
ফ্রান্সিস প্রহরীর দিকে তাকিয়ে বলল–তুমি তো আগে আমাদের পাহারা দিতে।
–হ্যাঁ রাজার হুকুম। প্রহরী বলল।
কিন্তু মুস্কিল হয়েছে আমরা আর এখানে পড়ে থাকবো না। আজকেই চলে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে আমাকে হত্যা করে যেতে পারেন। প্রহরী বলল।
–তোমাকে আহত করেই পালাতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক বুঝলাম না। প্রহরী বলল।
–আমি তোমার পায়ে আর পিঠে আস্তে তরোয়াল চালিয়ে কেটে দেব। তোমার সেনাপতিকে বলতে পারবে তোমাকে আহত করে আমরা পালিয়েছি।
-হ্যাঁ। তা হতে পারে। প্রহরী বলল।
ফ্রান্সিস তরবারিটা কোষমুক্ত করল। প্রহরীর বাঁ পায়ে ডান পায়ে তরোয়াল দিয়ে একটু আস্তে ঘষে দিল। পিঠেও তরোয়াল কাটল। পা কেটে গেল। রক্ত পড়তে লাগল।
–তাহলে চলি। ফ্রান্সিস বলল। গায়ে রাজার পোশাকটা রয়ে গেছে। ফ্রান্সিস বিস্কো ঘোড়ায় চড়ে মাজোর্কা নগরে এল।
দুজনে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। ফ্রান্সিস লক্ষ্য করল লোকজন দাঁড়িয়ে পরে ওর রাজবেশ দেখছে। বুঝল এরকম হলে বিপদ।
হাতের কাছে একটা দর্জির দোকানে পেল। দুজনে দোকানে ঢুকল। ফ্রান্সিস বলল–আমার জামা বানিয়ে দিন। এক্ষুনি। দর্জি বেশি অর্থ চাইল। বিস্কো কোমরের ফেট্টিতে রাখা একটা সোনার চাকতি বের করে দিল। দর্জি খুব খুশি। বলল–আপনি বসুন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বানিয়ে দিচ্ছি।
দর্জি জামা সেলাই করতে লাগল। ফ্রান্সিস বিস্কো বসে রইল। পোশাক সেলাই হয়ে গেল। ফ্রান্সিস রাজবেশ ছেড়ে নতুন পোশাক পড়ল। রাজবেশটাও নিল। দামটাম চুকিয়ে ওরা রাস্তায় এল।
–এখন কী করবে? বিস্কো বলল।
–দুটো কাজ। এক ঝোঁপজঙ্গলে হ্যারিদের রেখে গিয়েছিলাম সেইখানে খোঁজ করতে যেতে হবে। দুই–রাজা কুয়েক হুয়ার কাছে যেতে হবে। এখন কোন কাজটা আগে করবো সেটাই ভাবছি।
-দেখ এই দুপুরে রাজার কাছে যাওয়া ঠিক নয়। বোধহয় অসুস্থ রাজা দেখাই করবেন না। তার চেয়ে হ্যারিদের খোঁজ করাই ভালো। আমাদের দেখে ওরা নিশ্চিন্ত হবে। আমরাও ওদের কোন বিপদ হয়নি জেনে খুশি হব। বিস্কো বলল।
–ঠিক আছে। তাহলে জংলা জায়গাটায় চলো। জঙ্গলে দুজনেই ঢুকল। ফাঁকা জায়গাটায় এল। হয়তো দেখা হবে। না। কেউ নেই। এদিক ওদিক দেখছে তখনই দেখল একটা জংলা গাছের ডালে একটা বড় কাগজ ঝুলছে। ফ্রান্সিস ছুটে গেল। কাগজটা ঐ গাছেরই সঙ্গে আটকানো। কাগজটা নিয়ে ফ্রান্সিস পড়ল–ফ্রান্সিস এখানে উত্তরে একটা বেশ বড় পোশাক টোশাকের দোকান আছে। তার উল্টোদিকের রাস্তার একটু ভেতরে একটা সরাইখানা পাবে। আমরা ওখানেই আছি।হ্যারি।
ফ্রান্সিস হেসে বলল–বিস্কো ওদের হদিশ পেয়েছি। কাগজটা বিস্কোকে দিল। বিস্কো পড়ে বলল–তাহলে ঐ দোকানের খোঁজে চল।
-হ্যাঁ। যেতে তো হবেই।
দুজনে উত্তরমুখো চলল। খুঁজতে খুঁজতে পোশাকের দোকানটা পেল। ঠিক তার উল্টোদিকে একটা বড় দোকান। ওটাই পোশাকের দোকান। রাস্তার উল্টোদিকে একটা সরাইখানা।
ফ্রান্সিস বিস্কোর দিকে তাকিয়ে হাসল। বিস্কোও হাসল। দু’জনে ছুটে রাস্তা পার হয়ে সরাইখানার সামনে এল। খোলা দরজা দিয়ে দেখল হ্যারিকে। হ্যারি পায়চারি করছে।
–হ্যারি? ফ্রান্সিস ডাকল। হ্যারি সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়াল। ছুটে গিয়ে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল। হ্যারির চোখে জল। ফ্রান্সিস ধমকের সুরে বলল–অ্যাই কাঁদবে না। ততক্ষণে সবাই এসে ফ্রান্সিসকে ঘিরে দাঁড়াল। সকলেই হাসছে। বিস্কো ধ্বনি তুলল– ও–হো-হো। সবাই চিৎকার করে ধ্বনি তুলল–ও হো হো
ভেতরের একটা ঘর থেকে মারিয়া বেরিয়ে এল। শুকনো মুখ। মাথার চুল অবিন্যস্ত। ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে হেসে এগিয়ে এল।
ওদিকে বিস্কো সকলকে বলতে লাগল ওরা কী কী করেছে–সেসব।
কিছু পরে ফ্রান্সিস আর বিস্কো খেয়ে নিল। ফ্রান্সিস মারিয়া আর বন্ধুদের অক্ষত দেহে দেখে খুব নিশ্চিন্ত হল।
বিকেলের দিকে ফ্রান্সিস মারিয়া আর হ্যারিকে ডাকল। ওরা ফ্রান্সিসের কাছে এল। ফ্রান্সিস বলল–রাজা কুয়েক হুয়ার কাছে যাব। তোমরাও চলো।
–রাজা কুয়েক হুয়া নিশ্চয়ই নিজের রাজবাড়িতেই আছেন। ফ্রান্সিস বলল।
–কোথাও চলে যেতেও পারেন। হ্যারি বলল।
না। উনি অসুস্থ। যেখানে যাবেন দেখেশুনে যাবেন। সেখানে চিকিৎসার সুবিধে আছে কিনা। এসব দেখেটেখে যাবেন।
–তাহলে তোমার কী মনে হয়? উনি এখনও রাজবাড়ি ছেড়ে যান নি? মারিয়া বলল।
–হ্যাঁ–আমার তাই মনে হয়। ফ্রান্সিস বলল।
–এখন কী করবে? হ্যারি জানতে চাইল।
–আমার মনে হচ্ছে রাজার সঙ্গে এক্ষুনি দেখা করা দরকার। ফ্রান্সিস বলল।
–কেন? মারিয়া বলল।
–সেই নক্সাটা ফিরিয়ে দিতে হবে! তারপর তাঁর পিতামহের ধন সম্পদ খুঁজে বের করতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–তার মানে আরো দুতিনদিন। মারিয়া বলল।
–হ্যাঁ–তাও লাগতে পারে। ফ্রান্সিস বলল।
মারিয়া কোন কথা না বলে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল।
হ্যারি বলল ফ্রান্সিস মারিয়া খুবই উদ্বেগের মধ্যে আছেন। তাকে সাহস দাও।
ফ্রান্সিস মারিয়ার ঘরে ঢুকল। দেখল মারিয়া বিষমুখে বিছানায় বসে আছে। কাছে। এসে ফ্রান্সিস বলল–
–আমি তো এসেছি। এখন তোমার দুশ্চিন্তা থাকার কথা নয়?
–দুশ্চিন্তা আমার কোনদিন যাবে না। মারিয়া আস্তে আস্তে বলল।
একটু চুপ করে থেকে ফ্রান্সিস বলল–মারিয়া তুমি এতদিন আমার সঙ্গে থেকে নিশ্চয়ই বুঝেছো যে আমি এক অন্যরকমের জীবন কাটাই। বাড়িতে নিশ্চিন্ত সুখের জীবন আমার জীবন নয়। তুমি যদি আমার জীবনটাই মেনে নাও তাহলে আমি খুশী হব। তুমি যদি আমার জীবনটা মেনে নিতে না পারো তবে বলো আমি তোমাকে দেশে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে দেবো।
–না। বেশ জোরেই বলল মারিয়া। তারপর ডানহাতটা বাড়িয়ে দিল। ফ্রান্সিস হেসে ওর হাতটা ধরল। মারিয়া একটু অঞরুদ্ধ স্বরে বলল–মৃত্যু পর্যন্ত আমি তোমার সঙ্গেই থাকবো। কোন শক্তি আমাদের বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না।
ফ্রান্সিস মারিয়ার হাতটা জড়িয়ে ধরে হেসে বলল তোমার কাছ থেকে ঠিক এই কথাটাই আশা করেছিলাম। যা হোক–তৈরি হয়ে নাও। আমরা রাজা কুয়েক হুয়ার কাছে যাবো। কথা আছে। তুমি হ্যারিও যাবে।
কিছু পরে ফ্রান্সিস মারিয়া আর হ্যারি তৈরি হয়ে নিল।
রাজা কুয়েক হুয়ার রাজবাড়ির সামনে ওরা। প্রবেশপথে কোন দ্বাররক্ষী নেই। মন্ত্রণাকক্ষ পার হচ্ছে তখনই একজন রক্ষী এল। বলল–আপনারা মাননীয় রাজার সঙ্গে দেখা করবেন?
–হ্যাঁ। ফ্রান্সিস মাথা ওঠানামা করল।
একটু দাঁড়ান। দ্বাররক্ষী বলল।
রক্ষী ঘরের ভেতরে চলে গেল। একটু পরে বেরিয়ে এসে বলল–আসুন।
ফ্রান্সিসরা রাজার শয়নকক্ষে ঢুকল। দেখল রাজা শুয়ে আছেন। শিয়রে রাণী বসে আছেন। একটি মেয়ে রাজার কপালে হাত বুলোচ্ছে। ফ্রান্সিস রাণীর দিকে তাকিয়ে বলল-রাণীমা–মাননীয় রাজার শরীর কেমন আছে?
-খুব ভাল না। রাণী বললেন।
রাজা চোখ বুজে ছিলেন। এবার চোখ খুলে ফ্রান্সিসদের দেখে বললেন ও আপনারা এসেছেন। বসুন।
খাটের কাছে দুটো কাঠের আসন রাখা। মারিয়া হ্যারি বসল। ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে রইল। এবার বলল–মাননীয় রাজা আপনাকে বিরক্ত করছি।
–ও কিছু না। বলুন। রাজা বললেন।
–আপনার পিতামহ তার সম্পদ কোথায় রেখে গেছেন তার কথা একটা নক্সায়। এঁকে রেখেছিলেন। ঐ নক্সাটা আপনি আমাকে দিয়েছিলেন। আমি মোটামুটি আঁচ করতে পেরেছি সেই সম্পদ কোথায় আছে। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বলল।
–আপনি খুঁজে পেয়েছেন? রাজা জানতে চাইলেন।
–না। এখনও পাই নি। তবে পাবো আশা করছি। আমি এই ঘরটা দেখেছি! অন্দরে আরো ঘর রয়েছে তো?
-হ্যাঁ। রাজা বললেন।
–ঐ দুটো ঘরে কে থাকেন?
–আমার স্ত্রী। ছেলেমেয়ে একটা ঘরে থাকেন। রাজা বললেন।
–আর একটা ঘরে? ফ্রান্সিস বলল।
–ওটা আমাদের অতিথিঘর বলতে পারেন। পরিচিত আত্মীয়স্বজন এলে থাকেন। রাজা বললেন।
–সব ঘরেই আছে? ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ। আমার ঠাকুর্দার শখ ছিল ফুলের। নানা রঙের ফুল তিনি পছন্দ করতেন। এই ফুলদানিগুলো তিনিই লোক রেখে করিয়েছিলেন। রাজা বললেন।
–প্রতিটি ফুলদানিতেই ফুল রাখা হয়? ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ। একজন মালী আছে। মালী প্রতিদিন ভোরে তাজা ফুল এনে রাখে ফুলদানীগুলোতে। রাজা বললেন।
–এবার একটা অনুরোধ। ভেতরের ঘরগুলো যদি দেখতে দেন। ফ্রান্সিস বলল।
–নিশ্চয়ই। মেয়েকে বললেন–অন্য ঘরদুটো ফ্রান্সিস সাহেবকে দেখিয়ে দে।
আন্না উঠে দাঁড়াল। রাজার বালিশের তলা থেকে একটা চাবি নিয়ে বলল– আসুন।
ফ্রান্সিস বলল–হ্যারি তোমরা থাকো। আমি যাচ্ছি।
আন্নার সঙ্গে প্রথম ঘরটায় গেল ফ্রান্সিস। ঘরে ঢুকল। কঁচ-ঢাকা আলো ঘরটায়। সবই মোটামুটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বড় বিছানা একটায়। অন্যটা ছোট বিছানা। বড়টায় বোধহয় ভাইবোনেরা থাকে। ছোটটায় রাণী।
ফ্রান্সিস ফুলদানিগুলো এক এক করে দেখতে লাগল। চারটে ফুলদানি। তাতে ফুল রাখা। ফ্রান্সিস দেখল প্রত্যেকটি ফুলদানিই বসানো আছে হাত তিনেক মোটা কাঠের ওপর। প্রত্যেকটি একইভাবে রাখা। কালো পাথরের সব ফুলদানি।
এবার ফ্রান্সিস বলল–আন্না তোমাদের অতিথিঘর কি খোলা?
-না। চাবি এনেছি। আন্না বলল।
অতিথি ঘরের সামনে এল ফ্রান্সিস। তালা ঝুলছে। আন্না তালা খুলল। বলল একটু দাঁড়ান আলো আনছি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আন্না একটা হলুদরঙের মোটা মোমবাতি নিয়ে এল।
ফ্রান্সিস ঘুরে ঘুরে ঘরটা দেখতে লাগল। একই রকম ঘর। তবে একটু বেশি সাজানো গুছনো। খাটের ওপর ফুলপাতা আঁকা মোটা একটা চাদর। বালিশ।
এবার ফ্রান্সিস ফুলদানিগুলো দেখতে লাগল। সেই গোল কাঠের পাটা তিন হাত মত এবং তার ওপর ফুলদানি রাখা। হঠাৎ ফ্রান্সিসের চোখে পড়ল পূবদিকের ফুলদানিটা। ও ফুলদানিটার কাছে গেল। ভালো করে দেখল ফুলদানির দুটো পাতা ভাঙা। ফুলদানিগুলো ফুলের পাতার ফুলের মত তৈরি করা। ভাঙা জায়গায় দেখল সাদাটে। ফ্রান্সিস হাত দিয়ে দেখল কালো রঙ উঠে এল। দেখা গেল সাদাটে পাথর। এই একটাই সাদা পাথরের। কালো রং করে রাখা।
ফ্রান্সিস ভাঙা পাতা দুটো দেখতে লাগল। তারপর ফুলদানিটা তুলল। গোল কাঠের ছোট্ট স্তম্ভ। ভেতরে কুঁদে একটা গর্তমত রাখা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্সিস বলে উঠল–থলি রাখা ছিল চুরি হয়ে গেছে। আন্না বলল–কী বললেন যেন।
-না-না। ও কিছু না। চলো তোমার বাবার কাছে।
ফ্রান্সিস বলল–আন্না চল। দুজনে বেরিয়ে এল। ফ্রান্সিস রাজার কাছে এল। বলল–মাননীয় রাজা-মণিমানিক্য অলঙ্কার রাখা ছিল যে থলিটায় সেটা চুরি হয়ে গেছে।
-বলেন কী? রাজা উঠতে গেলেন। রাণী শুইয়ে দিলেন। বললেন–একেবারে উত্তেজিত হবেন না।
এখন প্রশ্ন কে চুরি করল? ফ্রান্সিস বলল।
–আপনি কি নিশ্চিত গুপ্তভাবে রাখা মূল্যবান সবই চুরি হয়ে গেছে? রাজা বললেন।
–হ্যাঁ। এবার আপনাকে কিছু পুরোনো ঘটনা মনে করতে হবে। যেমন- ঐ অতিথি ঘরে আপনার অনাত্মীয় মানে যারা আপনার আত্মীয় নন তেমন কাউকে থাকতে দিয়েছিলেন?
সবাই তো রাতে থাকতো না। তবে অনাত্মীয় বলতে যাদের বোঝায় তাদের দুজনের কথা মনে পড়ছে–এক–বাবার এক প্রিয় বন্ধু। বড় বক বক করতেন। দুদিন ছিলেন। অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম। আর একজন আমার বৈদ্য– কবিরাজ। বেশিদিনের কথা নয়। মাস দুতিন আগে আমাকে সেদিন দেখতে এসেছিলেন। আমাকে দেখে যেতে তাঁর দেরি হয়ে গিয়েছিল। বাইরে ঝড় বৃষ্টি চলছিল। রাতের খাওয়া খেলেন। অতিথিঘরে রইলেন। পরদিন সকালে চলে গেলেন।
–আর? ফ্রান্সিস আরও জানতে চাইল।
–দাঁড়ান, দাঁড়ান মনে পড়েছে। দিন কয়েক পরে ঐ কবিরাজ আবার এলেন। সেদিন তার আসার কথা নয়। উনি আমাকে দেখলেন। ওষুধও পাল্টালেন না। রাত হয়ে গিয়েছিল। তিনি ঐ অতিথি আবাসে থাকলেন। কিন্তু ভোরবেলা কখন চলে গেছেন কেউ জানে না। শুধু মালী নাকি দেখেছিল।
–এঁরা ছাড়া আর কেউ? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–মনে পড়ছে না। রাজা বললেন।
–ইদানীং মানে মাস কয়েকের মধ্যে? ফ্রান্সিস বলল।
–না। আর কেউ অতিথিঘরে থাকেন নি।
এবার ফ্রান্সিস বলল–ঐ বকরবকর ভদ্রলোক–আপনার বাবার বন্ধু–আর কবিরাজের ঠিকানা চাই। দিতে পারবেন?
রাজা রাণীকে বললেন–বালিশের তলা থেকে মোটা বইটা বের কর তো?
রাণী বালিশের তলা থেকে মোটা বইটা বের করে রাজাকে দিলেন। রাজা নোট বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললেন–বাবার বন্ধুর নিজের হাতে তার ঠিকানা লিখে দিয়েছিলেন। তিনি–রাজা থেমে গেলেন। বললেন– পেয়েছি। ফ্রান্সিস আন্নাকে বললেন–এক টুকরো কাগজ আর কালি কলম নিয়ে এস। আমাকে ঠিকানা দুটো লিখে দাও। আন্না ভেতরের ঘরে চলে গেল।
–পেয়েছি, পেয়েছি। কবিরাজের ঠিকানাও পেয়েছি। রাজা বললেন।
আন্না কাগজ কলম নিয়ে এল। ফ্রান্সিস বলল–ঠিকানা দুটো আমাকে লিখে দাও। আন্না ঠিকানা লিখে দিল।
ঠিকানা লেখা কাগজটা ফ্রান্সিস পড়ল। বলল–কবিরাজ কুজকোতে থাকেন। প্রথমে তাকেই খুঁজবো তারপর আপনার পিতার বন্ধুকে খুঁজবো। কিন্তু উনি থাকেন চিলিতে। বেশ দূর। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল–তাহলে আমরা আজ চলি। আমি কালকেই কুজকো যাচ্ছি।
–ভালো। দেখুন গুপ্তধন উদ্ধার করা যায় কিনা। রাজা বললেন।
ফ্রান্সিস দেরি করতে চাইল না। জাহাজের বন্ধুরা নিশ্চয়ই ওদের জন্যে চিন্তান্বিত।
সকালে খেয়েই ফ্রান্সিস বলল–বিস্কো–রাজকুমারী রইলেন। একটু সাবধানে থেকো। আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসবো।
তিনজনে খেতে বসল। ফ্রান্সিস বলল–শাঙ্কো খেয়ে উঠেই তিনটে ঘোড়া ভাড়া করে আনবে।
-ঠিক আছে। শাঙ্কো ঘাড় কাত করে বলল।
খাওয়া হল। শাঙ্কো ঘোড়া ভাড়া করতে গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই শাঙ্কো তিনটে ঘোড়া নিয়ে এল।
ফ্রান্সিসরা তৈরি হয়ে ঘোড়ায় উঠল। তিনটি ঘোড়া সওয়ারি নিয়ে ছুটল কুজকোর এ দিকে।
শেষ দুপুরে কুজকো পৌঁছল। একটা মাঠের ওপর এল ওরা। অনেক ঘোড়া রয়েছে। ঘোড়া থেকে নেমে ফ্রান্সিস চলল ঘোড়ার মালিকের কাছে। নির্দেশমত পেলও তাকে। ঘোড়া জমা দিল। পরে ফিরে যাওয়ার অগ্রিমটাও লোকটাকে দিয়ে রাখল।
খিদে পেয়েছে। কিন্তু এখন খাওয়া নয়। যে কাজে এসেছে সেটা আগে করতে হবে।
ফ্রান্সিস কোমরের ফেট্টি থেকে কাগজটা বের করল। প্রথমে খুঁজে বের করতে হবে গীর্জাটা। তার বাঁদিকের ঘোট রাস্তা ধরে এগোতে হবে। চার্চের রাস্তা শেষ হতেই বাঁদিকের প্রথম বাড়িটা। রাজা কুয়েক হুয়ার এটাই নির্দেশ ছিল।
গীর্জা ছাড়িয়েই বাড়িটার সামনে এসে ওরা দাঁড়াল। দেখা গেল নতুন ঝকমকে একটা বাড়ি। অথচ রাজা বলেছিলেন বেশ পুরোন বাড়ি।
ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল–অলঙ্কার বিক্রি করে কবিরাজ এখন ধনী। বাড়িটি কেমন নক্সারমত তৈরি। হ্যারি হাসল।
ওরা সদর দরজার কাছে এল। একটা দড়িমতো ঝুলছে। ফ্রান্সিস দড়িটা নিচে টানল। বাড়ির ভেতরে সুরেলা আওয়াজ হল। একটু পরে একটা কাজের লোক এল। হ্যারি বলল–কবিরাজ মশাই আছেন?
–হ্যাঁ আছেন। কিন্তু বিকেলবেলা রোগী দেখেন না।
–ঠিক আছে। আমরা ঘুরে আসছি। হ্যারি বলল।
–আচ্ছা লোকটি দরজা বন্ধ করে দিল।
রাস্তায় এল ওরা। ফ্রান্সিস বলল–আমাদের একটা সুবিধে হল। এই ফাঁকে চলো খেয়ে নি।
কুজকো বেশ বড় শহর। ইনকা সাম্রাজ্যের রাজধানী। রাস্তায় ভিড়ও বেশ।
একটু খুঁজতেই একটা ভালো সরাইখানা পেল। চুল ওরা। হ্যারি মাংস মোটা রুটির জন্য বলল। খুব তাড়াতাড়িই খাবার এল। খেতে খেতে হ্যারি বলল–আচ্ছা। ফ্রান্সিস তুমি কোন অকাট্য যুক্তি পেয়েছো যে কবিরাজ চুরি করেছে বলছো।
–আমার সবচেয়ে বেশি সন্দেহ হয়েছে যখন শুনলাম কবিরাজ যেদিন চলে যান তখন খুব ভোরেই তিনি চলে এসেছিলেন। তারপর তিনচারমাস কেটে গেছে কবিরাজ আর যান নি। কেন? ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ এই প্রশ্ন উঠতে পারে। এখন কবিরাজকে নিয়ে কী করবে?
–কবিরাজ গুপ্তধন চুরি করেছে এই সত্যটা ওকে স্বীকার করতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–যদি স্বীকার না করে? হ্যারি বলল।
তবে রাজা কুয়েক হুয়া অবশ্য এখন আর রাজা নন–তবুও তাকে দিয়ে রাজা পাচাকুচির দরবারে নালিশ করাবো।
–তাতে কাজ হবে? শাঙ্কো বলল।
–হতে পারে আবার নাও হতে পারে। আমরা গুপ্তধনের হদিশ দেব। বাকি উদ্ধার করার দায়িত্ব আমাদের নয়। ফ্রান্সিস বলল।
বেশ। দেখ। হ্যারি বলল।
বিকেলে ওরা কবিরাজের বাড়িতে গেল। সেই লোকটি বাঁ পাশের ঘরটায় ফ্রান্সিসদের বসাল। আরো লোক বসে আছে।
লোকটি ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল–ঐখানে নাম লিখিয়ে বসুন। ফ্রান্সিস দেখল একটা কাঠের আসনে একজন কাগজ কালিকলম নিয়ে বসে আছে। সে নাম ডাকছে।
ফ্রান্সিস লোকটির কাছে গেল। নাম লেখাল।
ফ্রান্সিসরা বসে আছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে লোকটি ফ্রান্সিসের নাম ডাকল।
ফ্রান্সিস কবিরাজের ঘরে ঢুকল। কবিরাজকে দেখল। কবিরাজকে দেখেই ফ্রান্সিস বুঝল লোকটা ভীষণ ধূর্ত। এই লোকটার পক্ষে চুরি করা অসম্ভব নয়। চোখদুটোর তীব্র দৃষ্টি। কিন্তু মুখ ভাবলেশহীন।
–আপনাকে বিদেশী বলে মনে হচ্ছে। কবিরাজ একটু হেসে বললেন।
–হ্যাঁ আমরা ভাইকিং। ফ্রান্সিস বলল।
–ও। তা আপনার কী কষ্ট? কবিরাজ বললেন।
কষ্টের কথা বলতে আসিনি। ফ্রান্সিস বলল।
–তার মানে? কবিরাজ বললেন। অল্প হাসলেন।
–আপনি রাজা কুয়েক হুয়াকের চিকিৎসা করেছিলেন। ফ্রান্সিস বলল।
—হ্যাঁ। কবিরাজ বললেন।
–আচ্ছা–রাজা তার পিতামহের গুপ্তধনের কথা আপনাকে বলেছিলেন। ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ। এই গুপ্তধনের কথা অনেককেই বলতেন। এটা বলে বোধহয় তিনি আনন্দ পেতেন।
–যাই হোক–একদিন জলঝড়ে আপনি এই কুজকোয় ফিরতে পারেন নি। রাজার অতিথি ঘরে ছিলেন। ফ্রান্সিস বলল।
-হ্যাঁ। কবিরাজ বললেন।
–রাজা আপনাকে একটা নক্সা দেখিয়েছিলেন। ওটাতে গুপ্তধনের হদিশ ছিল। কিন্তু কেউ ওটার সমাধান ভেবে পায় নি। যা হোক–আপনি শোবার সময় নক্সাটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে বললেন–এখানকার তিনটি শয়নঘরের নক্সাটা আঁকা আছে। ফ্রান্সিস বলল।
–নকশাটা দেখলে তাই মনে হয়। কবিরাজ বললেন।
–আপনি অতিথিঘরটার ফুলদানিগুলো তুলে তুলে দেখেছিলেন গুপ্তধন রয়েছে। কিনা। হঠাৎই পেয়ে যান একটা থলি। থলি দেখে এতটা উত্তেজিত হয়ে পড়েন যে পাথরের ফুলের দুটো পাপড়ি ভেঙে ফ্যালেন। থলিটা খুলতে গিয়ে খোলেন নি। সেই রাতে ঐ পর্যন্ত। ফ্রান্সিস বলল।
–এসব কী বলছেন আপনি? কোথায় গুপ্তধন কোথায় থলিটলি এসব মানে। কি? কবিরাজ বললেন।
ফ্রান্সিস আগের মতই বলতে লাগল–পরে যেদিন রোগী দেখার কথা নয়– সেইদিন গেলেন। অতিথিঘরে রইলেন। ভোরের দিকে থলিটা নিয়ে প্রায় পালিয়ে, এলেন। কারো সঙ্গে দেখা না করেই চলে এসেছিলেন। একমাত্র মালী আপনাকে দেখেছিল।
কবিরাজ আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন–এসব মিথ্যে অপবাদ।
ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। বলল–আমরা বিদেশী। এক জায়গায় তো বেশিদিন থাকি না। যদি থাকতাম তাহলে আপনাকে কয়েদখানায় ঢোকাতাম।
বেরিয়ে যাও–বেরিয়ে যাও! কবিরাজ বললেন। ফ্রান্সিস বলল—আমি মাজোর্কা যাচ্ছি। রাজা কুয়েক হুয়াকে সব বলবো। উনি যদি আপনার নামে রাজা পাচাকুচির রাজদরবারে নালিশ করেন–শেষ পর্যন্ত আপনাকে সব স্বীকার করতে হবে। রাজা কুয়েক হুয়ার মত একজন উদারমনা মানুষকে ঠকালেন–এটাই দুঃখের। কবিরাজ তখনও চ্যাঁচাচ্ছেন–বেরিয়ে যাও–বেরিয়ে যাও। নাম লেখার লোকটি ঘরে ঢুকল। ফ্রান্সিসের ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস লোকটার ঘাড়ে এক রদ্দা কষাল। লোকটি মেঝেয় বসে পড়ল।
ফ্রান্সিস বাইরে এল। হ্যারি ছুটে এল ফ্রান্সিস তোমাকে মারধোর করে নি তো?
–দুর। দুঃখ কী জানো–কবিরাজকে কান ঘেঁষে মাথায় এক রদ্দা কষালে ভালো হত। ফ্রান্সিস বলল।
–চল–চল। আর নয়। হ্যারি বলল।
তিনজনে কবিরাজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল।
জাহাজে ওঠার সময় হয়ে আসছে। দুপুরে খাওয়ার সময় শাঙ্কো প্রস্তাব দিয়ে বলল–ফ্রান্সিস–আমাদের তো জাহাজে ফেরার সময় এসে গেছে। এখন আমাদের কিছু স্বর্ণমুদ্রা দাও। বাজারে গিয়ে দরকারী জিনিস টিনিস কিনে আনি।
ঠিক আছে। ফ্রান্সিস হেসে বলল। মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল–মারিয়া তুমিও যাবে। মারিয়া একটু চুপ করে থেকে বলল–আমারও কিছু কেনাকাটা ছিল! কিন্তু সকাল থেকে মাথার বাঁ পাশে ভীষণ ব্যথা শুরু হয়েছে। কখনও কমছে কখনও বাড়ছে। আমি যেতে পারবো না।
-ঠিক আছে। রাজকুমারী বিশ্রাম নিন। আমরা যাবো। তবে খুব বেশি ঘোরাঘুরি করবো না। তাড়াতাড়িই ফিরে আসবো। হ্যারি বলল। কেউ কিছু বলল না।
খাওয়া শেষ। ঘরে এসে সবাই পোশাক পাল্টাতে লাগল। মারিয়া ফ্রান্সিসকে বলল–তুমি কিছু কিনবে না। তুমি আর আমি কাল সকালে বেরিয়ে আমাদের দুজনের জিনিসপত্র কিনবো।
–কী কিনবে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–সেটা কাল সকালে ভাবা যাবে। মারিয়া বলল।
–তাহলে আজ আমি খাবো না। ফ্রান্সিস বলল। মারিয়া বলল–কেন। বন্ধুর সঙ্গে তুমিও যাও।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্রান্সিসরা তৈরি হল। হ্যারি বলল-রাজকুমারীকে একা রেখে যাওয়া চলবে না। বিস্কো এখানে থাকবে। ও কালকে ফ্রান্সিসদের সঙ্গে যাবে।
ফ্রান্সিস সবাইকে দুটো করে স্বর্ণমুদ্রা দিল। সকলেই খুশি।
পড়ন্ত বিকেলে ফ্রান্সিসরা কেনাকাটা করতে বাজারের দিকে চলল।
সরাইখানার বাইরে দাঁড়িয়ে বিস্কো দেখল সেটা। মারিয়া ঘর থেকে বেরোয় নি।
বিস্কো নিজেদের ঘরের দিকে চলল। ওর একটু অভিমান হয়েছিল। ওকে ফ্রান্সিসরা নিয়ে গেল না।
বিস্কো বিছানায় শুয়ে পড়ল। অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল।
মারিয়া বিছানায় শুয়েছিল। মাথার যন্ত্রণাটা একটু কমেছে। একা একা শুয়ে আছে। ভালো লাগল না।
সরাইখানার বাইরে এসে দাঁড়াল। রাস্তার লোকজন গাড়িঘোড়া মানুষের ব্যস্ততা এসব দেখতে লাগল। আবার একঘেঁয়ে লাগছে। ঘর থেকে আসবে কিনা ভাবছে। তখনই এক ঘোড়াসওয়ার ঠিক ওর সামনে এসে ঘোড়াটাকে দাঁড় করালো। মারিয়া আরোহীর দিকে তাকাল। লোকটার লম্বা লম্বা চুল। কপালে একটা লাল ফেট্টি বাঁধা। গাল পর্যন্ত জুলপি। কুকুতে চোখ। দেখেই কেমন গুণ্ডা গুণ্ডা মনে হল।
লোকটা ঘোড়াটা মারিয়ার আরো কাছে আনল। মারিয়া কিছু বোঝবার আগেই নিচু হয়ে হাত বাড়িয়ে মারিয়ার কোমর ধরে এক হ্যাঁচকা টানে ঘোড়ার ওপর তুলে নিল। সামনে বসিয়ে ঘোড়া ছোটাল উত্তরমুখো। রাস্তার লোকজন যারা দেখল তারা হৈ হৈ করে উঠল। তারপর ঘটনাটা দেখেছে এমন লোকেদের দুজন ছুটল ঘোড়সওয়ারকে ধরতে। কিন্তু তেজি ঘোড়ার গতির সঙ্গে তারা পারবে কেন। হাল ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে হাঁপাতে লাগল। ততক্ষণে ঘোড়া সওয়ারসহ অনেক দূরে।
বিস্কোর ঘুম ভেঙে গেল। হঠাৎ বাইরের একটা হৈ হৈ চিৎকার শুনল। ও উঠল। কী ব্যাপার দেখতে হয়। ও আস্তে আস্তে বাইরে এল। তখন অনেক লোক জমে গেছে। একজনকে জিজ্ঞেস করল কী ব্যাপার? লোকটি বলল– একটা গুণ্ডা ঘোড়ায় চড়ে। এসে একটি মেয়েকে তুলে নিয়ে গেল। এরকম হতে পারে। বিস্কো কিছু মনে করল না। নিজের ঘরে চলে আসছে তখনই দেখল মারিয়ার ঘরের দরজা হাট করে খোলা। বিস্কো দ্রুত ঘরে ঢুকল। ঘর শূন্য। রাজকুমারী নেই।
বিস্কো এক ছুটে বাইরে এল। তখনও কয়েকজন মিলে–এমনি সব ঘটনা নিয়ে বলাবলি করছিল। বিস্কো গিয়ে জিজ্ঞেস করল আপনারা দেখেছেন?
–আমাদের চোখের সামনে সমস্ত ব্যাপারটা ঘটেছিল। একজন বলল।
–বিস্কো–মেয়েটি কি পোশাক পরেছিল?
বিদেশী পোশাক। একজন বলল।
–তাহলে মেয়েটি বিদেশী? বিস্কো বলল।
–হ্যাঁ হ্যাঁ। আর একজন ঘাড় কাত করে বলল।
বিস্কো অস্ফুটস্বরে বলে উঠল তাহলে রাজকুমারী।
বিস্কো নিজের ঘরে ফিরে এল। কথা ছিল আমি রাজকুমারীর পাহারায় থাকবো। সেই আমি গর্ধভের মত ঘুমিয়ে পড়লাম। আমি যদি রাজকুমারীকে বলে রাখতাম আমার ঘুম পাচ্ছে। আপনি আমাকে না বলে সরাইখানার বাইরে যাবেন না। তাহলে রাজকুমারী নিশ্চয়ই বাইরে যেতেন না। এই ঘটনাটাও ঘটত না।
বিস্কো একা ঘরে চুপ করে বসে রইল। ফ্রান্সিসরা এলে কী বলবো? রাজকুমারীকে একটা গুণ্ডা ঘোড়ায় তুলে নিয়ে গেছে। আমার অসতর্কতার জন্যেই এটা ঘটল। বিস্কো ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল। আমার এই গাফিলতি ফ্রান্সিসরা মেনে নেবে না।
বিস্কো বসে থাকতে পারল না। আবার বাইরে এল। একজন বয়স্ক লোক তখনই সরাইখানায় ঢুকছিল। বিস্কোকে দেখে বলল–শুনছেন?
বিস্কো দাঁড়িয়ে পড়ল।
–শুনলাম মেয়েটি নাকি স্বামী ও বন্ধুদের সঙ্গে এদিকে বেড়াতে এসেছেন। বৃদ্ধ বললেন।
–হ্যাঁ। বিস্কো মাথা ওঠানামা করল।
–ঘটনাটার মধ্যে একটু ভাববার ব্যাপার আছে। কারণ যে উঠিয়ে নিয়ে গেছে সে এখানকার কুখ্যাত গুণ্ডা। তাই এসব নিয়ে কেউ বেশি কথা বলছে না। এবার গলা নামিয়ে লোকটা বলল–একটা কুখ্যাত গুণ্ডা ধরে নিয়ে গেছে। ঠিক আছে। কিন্তু গুণ্ডা মিছিমিছি একটি মেয়েকে তুলে নিয়ে যাবে কেন? মশাই এই ঘটনার মধ্যে বেশ জটিলতা আছে।
–আমারও তাই মনে হয়। বিস্কো বলল।
লোকটি একবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল
–কেউ গুণ্ডাটাকে লাগিয়েছে। অবশ্যই অর্থের বিনিময়ে।
–আমিও সেটাই ভাবছি। বিস্কো বলল।
–আপনারা তো বিদেশী। বৃদ্ধ বললেন।
–হ্যাঁ।
–কার সঙ্গে আপনাদের কী হয়েছে যে গুণ্ডা লাগিয়ে আপনাদের শায়েস্তা করতে চাইছে। বৃদ্ধ বললেন।
–কী জানি। কিছুই বুঝতে পারছি না। বিস্কো বলল।
খোঁজ নিয়ে দেখুন আপনাদের কেউ এ দেশের কাউকে চটিয়েছেন? বৃদ্ধ বললেন।
বিস্কো কিছু বলল না।
–বলুন ঠিক বলেছি কিনা। বৃদ্ধ বললেন।
–কী জানি বুঝতে পারছি না। বিস্কো বলল।
–ঐ মহিলাকে ফেরৎ পেতে বেশ কিছু অর্থব্যয় করতে হবে। লোকটি বলল।
–দেখা যাক। বিস্কো বলল। তারপর নিজের ঘরে চলে এল। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল ফ্রান্সিসদের জন্যে। বিস্কো সরাইখানার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ঢোকার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল। রাস্তার লোকজন গাড়ি ঘোড়া ওপর ওপর দেখতে লাগল। আসলে ওর চিন্তা যা হয়েছে হয়েছে। কিন্তু রাজকুমারীকে কি করে উদ্ধার করবে।
ফ্রান্সিসদের ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। ওরা বিস্কোকে সরাইখানার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। ফ্রান্সিস বললকী ব্যাপার? এখানে দাঁড়িয়ে আছো? ঘরে চলো।
–চলো। সকলেই ওদের ঘরে এল। কেনার জিনিস রাখল। সকলেই কে কী কিনল তাই নিয়ে কথা বলতে লাগল। পরস্পরকে কেনা জিনিস দেখাতে লাগল।
ফ্রান্সিস মারিয়াকে দেবার জন্যে সাদা ভালুকের চামড়ায় তৈরি পোশাকটা নিল। চলল। বিস্কো বলল–ফ্রান্সিস। একটা কথা ছিল। ফ্রান্সিস ফিরে দাঁড়াল। বলল, কী কথা?
–ঘণ্টা খানেক আগে এই শহরের এক গুণ্ডা ঘোড়ায় চড়ে এসে রাজকুমারীকে অপহরণ করেছে। বিস্কো হাঁপাতে হাঁপাতে বলল।
বলো কি। সমস্ত ঘটনাটা বলো তো। আমাদের ঘরে এসো। হ্যারি তখনই এল। বলল–
-ফ্রান্সিস পোশাক রাজকুমারীর পছন্দ হয়েছে তো?
–হ্যারি চলো কথা আছে। ফ্রান্সিস আস্তে বলল।
তিনজনে ওদের ঘরে ঢুকল। দেখল পছন্দের জিনিস কেনাকাটা করে সবাই আনন্দে আত্মহারা। জোরে জোরে কথা বলছে। ফ্রান্সিস বিরক্ত হল। বলল- আস্তে কথা বল। হ্যারি বলল-ফ্রান্সিস কী ব্যাপার বলো তো?
–কিছুক্ষণ আগে একটা গুণ্ডা মারিয়াকে নিজের ঘোড়ায় তুলে নিয়ে গেছে। ফ্রান্সিস বলল, সবাই চুপ করে রইল। ফ্রান্সিস বলল–বিস্কো তুমি যতটা এই ঘটনা জেনেছো বলো।
–বেশ। এবার বিস্কো আস্তে আস্তে সমস্ত ঘটনাটা যা জেনেছে বলল।
শাঙ্কো বলে উঠল–বিস্কো–তুমি এতটা দায়িত্ব বোধহীন নও। আজকে কী হল তোমার। রাজকুমারীর সব তুমি দেখাশুনো করবে এই ভরসায় তোমার হেফাজতে রাজকুমারীকে রেখে গেছিলাম আমরা। এ তুমি কী করলে?
হ্যারি বলল–বিস্কো–এখন তোমাকে কিছু বলা বৃথা। ভুল যা হবার হয়ে গেছে। বিস্কো সবই বলেছে। তারই ওপর ভিত্তি করে রাজকুমারীকে খুঁজতে হবে। এবার ফ্রান্সিস কিছু বলো। ফ্রান্সিস একটু চুপ করে থেকে বলল–প্রথমে দেখতে হবে এখানে কার সঙ্গে বা কাদের সঙ্গে আমাদের শত্রুতা জন্মেছে।
–আমরা আগ বাড়িয়ে তো কারুর ক্ষতি করি নি। হ্যারি বলল।
–তবু শত্রুতা জন্মেছে। রাজা কুয়েক হুয়ার নক্সা আমরা পেয়েছি। খোঁজাখুঁজি করে আমরাই প্রথম বলেছি যে গুপ্ত ধনভাণ্ডার চুরি হয়ে গেছে এবং চুরি করেছে রাজার চিকিৎসক মানে কবিরাজ মশাই। কবিরাজের সঙ্গে আমাদের সামনাসামনি কথা হয়েছে। এবং তিনিই যে গুপ্তধন চুরি করেছেন এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত। এইবার কবিরাজ আমাদের এদেশ থেকে তাড়াবার চেষ্টায় নামল। প্রথমেই মারিয়াকে অপহরণ করে আমাদের মনোবল ভাঙতে চাইলেন। উনি বোঝাতে চাইলেন–আমরা কত অসহায় আর উনি কত শক্তিধর। আমাদের ভোগাবেন। সেটা সহজেই পারবেন কারণ আমরা বিদেশী, আমাদের স্বপক্ষে কেউ দাঁড়াবেন না। কাজেই আমাদের ওপর চাপ বাড়াবেন এবং আমাদের এই দেশ ত্যাগ করতে আমাদের বাধ্য করবেন।
-কী ভাবে? শাঙ্কো বলল।
রাজকুমারীকে অপহরণ করে। এ জন্যে আমাকে অথবা আমাদের বন্ধুকে অপহরণ করাবেন। সুতরাং আমরা পেরু ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হব। সকলে চুপ করে রইল। হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস এই বিষয়ে ঠিক বলেছে। আমার তো মনে হয় আমরা যদি এখন কবিরাজের কাছে গিয়ে বলি–আমাদের রাজকুমারীকে মুক্তি দিন আমরা রাজকুমারীকে নিয়ে চলে যাব। কবিরাজ সঙ্গে সঙ্গে রাজকুমারীকে মুক্তি দেবে। সবাই হ্যারির কথা শুনল। হ্যারি ঠিকই বলেছে।
এবার ফ্রান্সিস বলল-রাজকুমারীর সন্ধান পেতে আমাদের সারা শহর খুঁজে দেখতে হবে। তার আগে কবিরাজের বাড়ি যাবো। কথায় কথায় কিছু সূত্র পেতে পারি। আমরা কবিরাজকে স্পষ্ট বলব–আপনি আমাদের জব্দ করতে রাজকুমারীকে হরণ করিয়েছেন। কবিরাজের মনোভাবটা কী দাঁড়ায় সেটা বোঝা যাবে। কবিরাজের বাড়ি চলো।
সবাই কবিরাজের বাড়ির দিকে চলল।
কবিরাজের বাড়ির সামনে এল। দেখল একজন দারোয়ান বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে পেতলের বর্শা। ফ্রান্সিস ওর কাছে গেল। দারোয়ানকে দেখল সন্দেহ নেই দারোয়ান বলিষ্ঠ। ফ্রান্সিস বলল–আমরা কবিরাজমশাইর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
তবে ভেতরে প্রথম ঘরটায় যান। দারোয়ান বলল।
ফ্রান্সিসরা সেই ঘরে ঢুকল। দেখল বেশ বড় ঘর। দেয়াল আলমারি ভর্তি অনেক কাঁচের বোয়াম। ফরাস পাতা। ফরাসে তিন চারজন লোক বসে রয়েছে। বোধহয় চিকিৎসার জন্য এসেছে।
ফ্রান্সিসরাও বসল। তখনই একজন লোক ঘরে ঢুকল। গলায় ঝোলানো একটা মুক্তো বসানো সোনার হার। লোকটার মাথার চুল বড় বড়। পরনে সিল্কের পোশাক। বলল–নতুন কে এলেন–নাম বলুন। কথাটা বলে যুবকটি কোমরে গোঁজা ছোট নোটবই মত বের করল। টেবিলের কাছে গিয়ে বলল- নতুন কে বা কারা এসেছেন বলুন। ফ্রান্সিস ফরাস থেকে উঠে দাঁড়াল। বলল– আমরা নতুন এসেছি।
রোগীর নাম বলুন। যুবকটি বলল।
–ফ্রান্সিস। ফ্রান্সিস বলল।
–হুঁ। যুবকটি নাম লিখতে লিখতে মুখে শব্দ করল–হু।
–আপনার সমস্যা কি? যুবক বলল।
–কাঁধে ভীষণ ব্যথা। ওষুধ নিতে এসেছি। রোগীটি বলল।
–আগে কবিরাজমশাই আপনাকে পরীক্ষা করে দেখবেন তারপর ওষুধ দেবেন। যুবকটি বলল।
–কবিরাজ কখন দেখবেন? নোটবই লিখতে লিখতে বলল।
উনি আয়াচুচো গেছেন। তিনি এসে বলবেন।
কখন ফিরবেন? হ্যারি বলল।
তার কিছু ঠিক নেই। অপেক্ষা করুন। যুবকটি বলল।
–এতো মুস্কিলের কথা। শাঙ্কো বলল।
–উপায় নেই। অপেক্ষা করুন। যুবকটি ভেতরে ঢুকে গেল। দুপুর থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। খিদে জলতেষ্টা পাচ্ছে। ফ্রান্সিস বলল–খিদেও পেয়েছে, জলতেষ্টাও পেয়েছে। এ দুটোর ব্যবস্থা করতে হয়।
ফ্রান্সিস ভেতরের দরজায় গিয়ে আঙ্গুল ঠুকলো৷ যুবকটি বেরিয়ে এল। বলল কী ব্যাপার?
–আমরা অনেকক্ষণ না খেয়ে আছি। কিছু খেতে চাই। ফ্রান্সিস বলল।
–এটা কি সরাইখানা? যান জল পাঠিয়ে দিচ্ছি।
একটু পরে বাড়ির কাজের লোক একটা জলভরা মাটির হাঁড়ি নিয়ে এল। হাতে কাঁচের গ্লাস। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–কে কে জল খাবেন খেয়ে যান।
হ্যারি, শাঙ্কো জল খেয়ে এল। যারা আগে এসেছিল তার মধ্যেও দুজন জল খেয়ে গেল। ফ্রান্সিস হাঁড়ি গ্লাস ফেরৎ দিল।
সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত। দুজন লোক রোগী নিয়ে চলে গেল। ফ্রান্সিসরা বসে রইল।
যুবকটি এল। কোনার টেবিল চেয়ারে বসল। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। একে একটু টোকা দিয়ে দেখা যাক। ফ্রান্সিস যুবকটির কাছে এল। যুবকটি বোধহয় ঝিমোচ্ছিল। ফ্রান্সিস সামনের টেবিলে আঙ্গুল ঠুকলো। যুবকটি ধড়ফড়িয়ে উঠল। বলল–আ আ–মানে আপনি কি চান?
–যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কবিরাজমশাইর দেখা পেতে চাই।
–অসুখটা কি?
–আমাদের কারো কোন অসুখ নেই।
–বলেন কী? তাহলে এসেছেন কেন?
–কবিরাজমশাইর সঙ্গে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে।
–কী এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা?
–আছে–আছে।
তার মানে? একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল–শুনুন–আমরা ভাইকিং। জাহাজ চালিয়ে দেশ বিদেশে যাই। গুপ্তধন উদ্ধার করি। বদলে একটা স্বর্ণমুদ্রাও নিই না।
–আশ্চর্য তো।
-হ্যাঁ। আমরা এমনিই। একটু থেমে বলল–মাজোর্কার রাজবাড়িতে আছে অতীতের রাজার গুপ্তধন। সেটাই আমরা নক্সা দেখে বুঝে নিয়ে উদ্ধারের চেষ্টা করেছি। কিন্তু ঐ গুপ্তধন আমাদের আগেই কেউ উদ্ধার করে পালিয়েছে।
–আপনারা বুঝতে পেরেছেন কে গুপ্তধন চুরি করেছে?
–হ্যাঁ। আমাদের স্থির বিশ্বাস গুপ্তধন চুরি করেছেন আপনাদের কবিরাজমশাই।
যুবকটি হকচকিয়ে গেল। বলে উঠল-আন্দাজে আমাদের কবিরাজ মশাইর ওপরে দোষ চাপাচ্ছেন।
–আরো আছে–ফ্রান্সিস বলল–আমাদের সঙ্গে আছেন আমাদের দেশের রাজকুমারী। আজ দুপুরের দিকে এক ঘোড়সওয়ার এসে রাজকুমারীকে হরণ করেছে।
ডাকাত টাকাত হবে।
না। একটা কুখ্যাত গুণ্ডা। যদি তার লুঠ করারই উদ্দেশ্য হত তাহলে সে ঘরে ঢুকে সোনার চাকতি দামি পাথর লুঠ করে নিত। কিন্তু সে তা করে নি। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে রাজকুমারীকে হরণ করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। এই ঘটনার সঙ্গে কবিরাজমশাইর যোগ আছে।
–কী আজেবাজে বলছেন। যুবকটি বলল।
–যা সত্য তাই বলছি।
–যত সব বাজে কথা। যুবকটি গলা চড়িয়ে বলল। শাঙ্কো যুবকটির গলার ওপর দিয়ে বলল–এই বিরাট বাড়িটা আমাদের খুঁজতে দেবেন?
-কী খুঁজবেন?
রাজকুমারীকে–আমাদের রাজকুমারীকে।
সব পাগলের দল।
–এদের পাল্লায় পড়ে আমি না পাগল হয়ে যাই।
–আমরা সেটাই চাই। ফ্রান্সিস বলল।
–আপনাদের সাহস তো কম নয়। কবিরাজমশাইকে চোর বলছেন। কবিরাজমশাইর কোন ক্ষতি আপনারা করতে পারবেন না। যুবকটি বলল।
–রাজা পাচাকুচির দরবারে আমরা কবিরাজের মুখোশ খুলে দেব।
কবিরাজমশাইর কত সন্মান আপনারা জানেন না। কোনভাবেই তাকে অপদস্ত করতে পারবেন না। বাড়ি যান।
বাড়ি নয়। সরাইখানা।
তাহলে সেখানেই যান।
–আমরা কবিরাজমশাইর সঙ্গে দেখা না করে যাব না। ফ্রান্সিস বলল।
–আমরা এখানেই থাকবো। শাঙ্কো বলল।
ভালো হয় আপনাদের চলে যাওয়া।
আমাদের ভাল আমরাই বুঝবো।
যুবকটি হঠাৎ লাফিয়ে উঠল। জোরে ডাকল–ফ্রেডি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘদেহী এক ঝাকড়াচুলো লোক ঘরে ঢুকল।
ফ্রান্সিসদের দেখিয়ে যুবকটি বলল–এরা কবিরাজমশাইকে অপমান করবে বলে এসেছে। এদের তাড়িয়ে দে। ফ্রেডি ফ্রান্সিসদের দিকে তাকাল। ছোট কুকুতে চোখে। তারপর কোমরে গোঁজা তরোয়াল খুলল। ফ্রান্সিসও তরোয়াল খুলল। লক্ষ্য করল ফ্রেডির তরোয়ালটা লম্বায় ওর তরোয়ালের চেয়ে বেশি লম্বা। ফ্রান্সিসের একটু চিন্তা হল। কীভাবে আত্মরক্ষা করবে কীভাবে লড়াই চালাবে তার ছক মনে মনে কষে নিল। শাঙ্কো আর বিস্কোও তরোয়াল খুলল। ফ্রান্সিস হাত বাড়িয়ে ওদের মানা করল।
ফ্রেডি একলাফে ফ্রান্সিসের সামনে চলে এল। হাতে খোলা তরোয়াল। ফ্রান্সিস সরে যেতে পারল না। ফ্রেডির তরোয়াল সোজা নেমে এল ফ্রান্সিসের মাথার ওপর। ফ্রান্সিস দ্রুত নিজের তরোয়াল দিয়ে নেমে আসা তরোয়ালটাকে ঠেকাল। তবু ফ্রান্সিস অক্ষত থাকলো না। ফ্রেডির তরোয়াল বাঁ কাঁধ কেটে নামল। রক্ত বেরিয়ে এল। রক্ত দেখে ফ্রান্সিস প্রচণ্ড রেগে গেল। ফ্রেডির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফ্রেডি মার ঠেকাবার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। ফ্রান্সিসের তরোয়াল সোজা নেমে এসে ঘা মারল ফ্রেডির বাম বাহুতে। তরোয়াল বাহুতে অনেকটা ঢুকে গেল। ফ্রেডি তরোয়াল ফেলে দিল। ডান হাত দিয়ে বাম বাহুটা চেপে ধরল। ফ্রান্সিসও তরোয়াল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস তরোয়ালের এক কোপে এখন ফ্রেডিকে মেরে ফেলতে পারে। কিন্তু ও এবার শান্ত হল। তরোয়াল কোষবদ্ধ করল।
শাঙ্কো ততক্ষণে কোমরের ফেট্টি ছিঁড়ে নিয়ে এল। ফ্রান্সিসের কাটা জায়গায় চেপে বেঁধে দিল। রক্ত পড়া বন্ধ হল।
–ফ্রেডি যাও–যুবকটি বলল।
ফ্রেডি উঠে দাঁড়াল। তরোয়াল কোষবদ্ধ করল। তারপর বাড়ির ভেতরে চলে গেল। শাঙ্কো ফ্রান্সিসকে ধরে নিয়ে ফরাসে বসাল। ফ্রান্সিসরা অপেক্ষা করতে লাগল।
একটু পরেই বাইরে ঘোড়ার ডাক শোনা গেল। একটা গাড়ি ঢোকার শব্দ হল। যুবকটি প্রায় ছুটে গেল বাইরের দরজার দিকে।
কবিরাজ ঢুকলেন। একবার ফ্রান্সিসদের ওপর দিয়ে চোখ বোলালেন। কবিরাজের পরনে হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা সিল্কের পোশাক। মাথায় হলদে রঙের টুপিমতে, গলায় মুক্তোর মালা। ঘরটায় একটা সুগন্ধ ছড়াল। দাড়ি গোঁফ কামানো। গায়ের রং লালচে।
কবিরাজ ভেতরে চলে গেলেন।
যুবকটি ফরাসের তাকিয়া ঠিকঠাক করল। ওষুধ বোঝাই তাকগুলোতে শিশি বোতল রূপোর কৌটো–এসব গোছগাছ করল।
বেশ কিছুক্ষণ পরে কবিরাজ ঘরে এলেন। পাতা ফরাসের একপাশে কয়েকটা তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে বসলেন। যুবক ফ্রান্সিসের নাম ডাকলেন। ফ্রান্সিস হাত ঘুরিয়ে বলল আমি সবশেষে। যুবকটি অন্য রোগীকে ডাকল।
কবিরাজ রোগী দেখতে লাগলেন। ওষুধ দিতে লাগলেন। যুবকটি ওষুধ তৈরি করতে লাগল। দিতে লাগল।
রোগী দেখা শেষ হল। রোগীরা চলে গেল। কবিরাজ এবার ফ্রান্সিসদের দিকে তাকালেন। বললেন–আপনাদের মধ্যে রোগী কে?
–আমরা সবাই সম্পূর্ণ সুস্থ। তবে অনেকক্ষণ না খেয়ে আছি তাই শরীরটা দুর্বল লাগছে। ফ্রান্সিস বলল।
-কেন? কবিরাজ বলল।
আপনার সঙ্গে দেখা করবো বলে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে। ফ্রান্সিস বলল।
–আপনারা তো রোগী নন। তবে আমার কাছে এসেছেন কেন? কবিরাজ বলল।
–আপনার সঙ্গে কথা আছে। ফ্রান্সিস বলল।
কী কথা? কবিরাজ বলল।
–আজ যে সরাইখানায় আমরা আছি সেখান থেকে এক অশ্বারোহী গুণ্ডা আমাদের রাজকুমারীকে অপহরণ করেছে। ফ্রান্সিস বলল।
–ও। কবিরাজ মুখে শব্দ করলেন।
–বোঝা যাচ্ছে কারো নির্দেশে অর্থের বিনিময়ে গুণ্ডাটা এই কাজ করেছে। এখন এ প্রশ্ন কার নির্দেশে এটা ঘটেছে? ফ্রান্সিস বলল।
কার নির্দেশে? কবিরাজ জানতে চাইল।
–আপনার নির্দেশে। ফ্রান্সিস বলল।
কবিরাজমশাই বেশ চমকে উঠলেন। তারপর সহজভঙ্গীতে বললেন–আমি এসব ব্যাপারে কিছুই জানি না। আমাকে এসবের সঙ্গে জড়াচ্ছেন কেন? কবিরাজ বলল।
-না জড়িয়ে উপায় নেই বলে। ফ্রান্সিস বলল।
–তার মানে? কবিরাজ বললেন।
-মাজোর্কার রাজা কুয়েক হুয়া পিতামহের রাখা একটা নক্সা পেয়েছিলেন। নক্সাটার গুপ্তধনের অবস্থিতির নির্দেশ আছে। আপনি বেশ চিন্তাভাবনা করে গুপ্তধন আবিষ্কার করেছিলেন। একদিন রাজাকে দেখে যদিও সেদিন আপনার যাওয়ার কথা। ছিল না আপনি অতিথি ঘরে ছিলেন। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল–গভীর রাতে একটা থলেতে রাখা বহুমূল্যবান গুপ্তধন বের করে নিজের থলেতে ভর নিয়ে খুব ভোরে রাজবাড়ি থেকে চলে এসেছিলেন। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল–কীভাবে আপনি গুপ্তধন চুরি করেছিলেন সবই বললাম। ফ্রান্সিস বলল।
কবিরাজ বলে উঠলেন–সব মিথ্যে অভিযোগ।
–একটি বর্ণও মিথ্যে নয়। হ্যারি বলল।
ফ্রান্সিস বলল–আপনার এই প্রাসাদের মত বাড়ি শুধু কবিরাজী করে হয় না। এর জন্যে যথেষ্ট ধনসম্পদ লাগে। সেই ধনসম্পদ আবিষ্কার করে আপনি রাজা কুয়েক হুয়াকে কিছু বলেন নি। রাজার চিকিৎসাও আর করেন নি। ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ–প্রয়োজন নেই বলে যাই নি। কবিরাজ বললেন।
–তা তো বটেই। কার্যোদ্ধার হয়ে গেছে। কাজেই অসুস্থ রাজাকে আর দেখতে যান। নি। ফ্রান্সিস বলল।
–সেটা আমার খুশি। কবিরাজ বললেন।
-তা তো বটেই। এবার ফ্রান্সিস বলল–আপনার বিরুদ্ধে আমাদের আরো অভিযোগ আছে।
–আমি আর শুনতে চাই না। কবিরাজ বলল।
–আপনাকে শুনতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–আপনাদের তাড়াতে হবে। এবার যুবকটি বলল।
ফ্রেডিকে ডাকো তো। কবিরাজ বলল।
ফ্রান্সিস হেসে বলল–আপনার ফ্রেডি এখন বিছানায় শুয়ে গোঙাচ্ছে!
তার মানে? কবিরাজ বললেন।
তার মানে আমি বলছি। ফ্রান্সিস যুবকটিকে দেখিয়ে বলল–ইনি আমাকে শায়েস্তা করার জন্যে ফ্রেডিকে দিয়ে আমাদের তাড়াতে চেয়েছিলেন। ফ্রেডির সঙ্গে কাজেই আমাদের তরোয়ালের লড়াই হয়েছিল। ফ্রেডি হেরে গিয়েছিল। আমি তাকে হত্যা করতে পারতাম। কিন্তু আমি তা করিনি। বাহুতে তরোয়ালের ঘা খেয়ে ফ্রেডি আহত হয়েছে মাত্র।
–ও। আপনারা অনেক দূর এগিয়েছেন। কবিরাজ বললেন।
—হ্যাঁ। এবার আমাদের রাজকুমারীকে মুক্তি দিন। ফ্রান্সিস বলল।
–আমি এই ব্যাপারে কিছুই জানি না। কবিরাজ বললেন।
–উঁহু। এই ব্যাপারটার সঙ্গে আপনি জড়িত। আপনি সব জানেন। রাজকুমারীকে আমরা উদ্ধার করবই। ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ-হ্যাঁ সেই চেষ্টাই করুন। কবিরাজ যেন খেঁকিয়ে উঠলেন।
–হ্যাঁ তাই করছি। তবে আপনাকেও আমরা ছাড়ছি না। তার জন্যে এখানে যদি থাকতে হয়–থাকবো। ফ্রান্সিস একটু থেমে বলল–আমরাও যাচ্ছি।
ফ্রান্সিস কবিরাজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। রাস্তায় এসে হ্যারি বলল- এখন কী করবে?
কবিরাজের এই বাড়ির ওপর নজর রাখতে হবে আমাদের। পালা করে নজর রাখতে হবে। কে বা কারা যাচ্ছে কারা আসছে–আমাদের সব দেখতে হবে। থাক গোপনে কথা হবে। এখন জলতেষ্টা পেয়েছে, খিদেও পেয়েছে। সরাইখানায় চল।
তার আগে এখানে একটা কাজ আছে।
–কী কাজ? শাঙ্কো বলল।
–কবিরাজের বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে ঐ দেখ একটা ফুলের দোকান। দোকানটায় এসো। হ্যারি বলল।
ফ্রান্সিসরা ঐ ফুলের দোকানে এল। ফুলওয়ালা ওদের দিকে এগিয়ে এল। বলল– খুব কম দামে ফুল পাবেন।
হ্যারি বলল–আমরা ফুল কিনতে আসিনি। একটা ব্যাপারে কথা আছে আপনার সঙ্গে।
–কী কথা? ফুলওয়ালা বলল।
জানলার ধারের জায়গাটা দেখিয়ে হ্যারি বলল–এখানে তো কিছু থাকে না।
–না। ফুলওয়ালা বলল।
–আপনি রাত্রে দোকানে থাকেন? হ্যারি জানতে চাইল।
–না বাড়িতে থাকি। আমার বাড়ি এখান থেকে ধরুন গে—
ফুলওয়ালাকে থামিয়ে দিয়ে হ্যারি বলল–এবার আপনাকে একটা অনুরোধ–ঐ জায়গাটুকুতে আমরা একটা চৌকি পাতব। দিনে রাতে আমরা একজন একজন করে থাকবো।
-কেন বলুন তো? ফুলওয়ালা বলল।
–সেটাই এখন বলতে পারব না। কয়েকদিন পরে সময়মত বলব। হ্যারি বলল। তারপর শাঙ্কোর দিকে হাত বাড়াল। শাঙ্কো কোমরের ফেট্টি থেকে একটা সোনার চাকতি বের করে দিল। হ্যারি সোনার চাকতিটা ফুলওয়ালার দিকে বাড়িয়ে ধরল। ফুলওয়ালা অবাক। বলল–মানে–আমি ঠিক–ওকে থামিয়ে দিয়ে হ্যারি বলল– এটা রাখুন। সময়মত আপনাকে সব বলা হবে। তার আগে কোন প্রশ্ন করবেন না। ফুলওয়ালা সোনার চাকতি পেয়ে খুব খুশি। হ্যারি বলল–একটা কাঠের তক্তা ওখানে রাখবেন। আমরা আসবো বসবো। রাত্রেও থাকবো। আমরাই রাত্রে আপনার পাহারাদারের কাজ করবো।
–ঠিক আছে। ঠিক আছে। ফুলওয়ালা হাসতে হাসতে বলল।
–এখন চলি। আজ সন্ধ্যে থেকে আমাদের লোক আসবে থাকবে। ঠিক আছে। হ্যারি বলল।
–ঠিক আছে। ঠিক আছে। ফুলওয়ালা একগাল হাসল।
ফ্রান্সিসরা সরাইখানায় এল। ওরা তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল। ঘরে এসে বসল সবাই। ফ্রান্সিস পাহারার জন্যে সবাইকে দায়িত্ব দিল। বলল–সকালে আমি যাবো। দুপুরে বিস্কো। সন্ধ্যে থেকে রাত হ্যারি। তারপর শাঙ্কো বলে উঠল–রাত থেকে সারারাত আমি। কাজ ভাগ করে দেওয়া হল। এবার কাজে নামা।
সন্ধ্যেবেলা হ্যারি ফুলের দোকানে গেল। দেখল ফুলওয়ালা ব্যবস্থা করেছে। একটা উঁচু পাটাতন এনে রেখেছে। ফুলওয়ালা হেসে বলল–আসুন–আসুন। হ্যারি গিয়ে পাটাতনটায় বসল। সামনেই একটা ছোট জানলা। জানলা দিয়ে কবিরাজের বাড়ির রাস্তায় গাড়ি ঘোড়া সবই দেখা যাচ্ছে। এখান থেকে ভালো নজরদারি চলবে। হঠাৎই দেখল কবিরাজের দারোয়ান বাড়ির বাইরে এল। একটু এদিক ওদিক ঘুরে ভেতরে চলে গেল। তাহলে আমাদের খুব সাবধানে নজর রাখতে হবে।
হ্যারি পাটাতনে আধশোয়া হল। বাইরে নজর রাখল। কবিরাজের বাড়ির রাস্তা গাড়ি ঘোড়া লোকজন দেখতে লাগল।
একটু রাতের দিকে হঠাৎ দেখল কবিরাজের বাড়ি থেকে একটা চারঘোড়ায় টানা গাড়ি বেরিয়ে এল। রাস্তায় এল। তারপর দ্রুত রাস্তা দিয়ে ছুটল। গাড়িতে দুজন লোককে দেখল। একজন কবিরাজ অন্যজনকে চিনল না। দুজনেই সন্ধ্যেবেলার শৌখিন পোশাক পরেছে।
এইবার হ্যারি ভাবল–কবিরাজ গাড়ি ছাড়া বেরুবে না। গাড়ি ছাড়া কবিরাজকে অনুসরণ করা যাবে না। একটা গাড়ি চাই।
ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো এল। ফ্রান্সিস বলল–হ্যারি কেমন নজর রেখেছিলে?
–ভালোই নজর রেখেছি। কিন্তু সমস্যা আছে একটা। কবিরাজ গাড়ি ছাড়া বেরোয় না। আজকে কিছুক্ষণ আগে কবিরাজ আর একজন গাড়িতে বসেছিল। চলে গেল। কেন কাকে কোথায় নিয়ে গেল কিছুই বুঝলাম না।
–হ্যাঁ এই সমস্যাটা হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–তাই বলছিলাম আমরাও একটা ঘোড়ার গাড়ি সারা দিন রাতের জন্য ভাড়া করে রাখি। তাহলে সহজে কবিরাজের গাড়ি অনুসরণ করতে পারি। তাহলে কবিরাজ কোথায় গেল জানতে পারবো। হ্যারি বলল।
–দাঁড়াও ঐ বেস্টনাট গাছের নীচে একটা ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে দেখলাম। চলো কথা বলে আসি। ফ্রান্সিস বলল।
ওরা বেস্টনাট গাছের নীচে এল। গাড়োয়ান গাড়ির মধ্যে বসার জায়গায় শুয়ে আছে। ফ্রান্সিস ডাকল–ও ভাই শুনছো?
গাড়োয়ানের ঘুম ভেঙে গেল। ও ধড়ফড় করে উঠে বসল। হ্যরি বলল
–ভাই বাইরে এসো। কথা আছে। গাড়োয়ান গাড়ি থেকে নামল।
ফ্রান্সিস বলল–কয়েকদিনের জন্যে তোমার গাড়িটা আমরা ভাড়া করবো। তুমি রাজি কিনা বল।
-হা হা। ভাড়া খাটবো। কিন্তু কোনসময় আর কতদিন।
–ধরো কাল থেকে পাঁচদিন।
–সারা দিন?
–হ্যাঁ–সারা দিনরাত।
–ঠিক আছে।
–আজ এখন থেকেই। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে। গাড়োয়ান মাথা ওঠানামা করল।
তখনই কবিরাজের বাড়ির সদর দেউড়িতে একটা দুই ঘোড়াটানা গাড়ি এসে থামল। দারোয়ান দরজা খুলে দিল। গাড়িতে দুজনে বসে আছে। একজন স্ত্রীলোক। গাড়ি বাইরে রেখে ওরা নামল। কবিরাজের বাড়িতে ঢুকল।
তখনই শাঙ্কো এল। ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে সব বলল। গাড়োয়ানকে কিছু দিতে বলল। শাঙ্কো কোমরের ফেট্টি থেকে একটা সোনার ছোট চাকতি বের করে গাড়োয়ানকে দিল। গাড়োয়ান খুব খুশি।
শাঙ্কো বলল–তোমরা একটা গাড়িতে যাদের দেখলে তার মধ্যে রাজকুমারী নেই তো?
–না নেই। হ্যারি বলল।
এবার ফ্রান্সিস বলল–এবার কবিরাজের গাড়ি অনুসরণ করা যাবে। তবে গাড়িতে বসে সারা দিনরাত নজর রাখা যাবে না। কবিরাজের দারোয়ানের মনে সন্দেহ হতে পারে। মাঝে মাঝে গাড়িটা চড়ে কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে আনতে হবে।
–ফুলের দোকান থেকেও নজর রাখতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
-শাঙ্কো গাড়োয়ানের কাছে এসে বলল–শোন ভাই। আমি এই ফুলের দোকানে থাকবো। কোন গাড়িকে অনুসরণ করতে হলে তোমাকে ডাকবো। তুমি সবসময় তৈরি থাকবে।
গাড়োয়ান মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে।
—তাহলে–শাঙ্কো আমরা যাচ্ছি। হ্যারি বলল।
-হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমরা যেভাবে আটঘাট বেঁধে এগোচ্ছি রাজকুমারীকে ঠিক উদ্ধার করবো। শাঙ্কো আস্তে বলল।
ফ্রান্সিস হ্যারি চলে গেল।
শাঙ্কো ফুলের দোকানে ঢুকল। ফুলওয়ালা হেসে বলল–আসুন আসুন। সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে।
শাঙ্কো কাঠের পাটাতনটা একটু ডানদিকে ঠেলে রাখল। জানলা দিয়ে সব স্পষ্ট এ দেখা যাচ্ছে।
বেশ কিছুক্ষণ পরে যে গাড়িটি এসেছিল একজন সুসজ্জিত পুরুষ আর এক স্ত্রীলোক সেও সুসজ্জিতা এসে সেই গাড়িতে উঠল। গাড়ি ছাড়ল। চলল পূবমুখো।
শাঙ্কো পাটাতনে আধশোয়া হল।
রাত বাড়তে লাগল।
একটু রাতেই কবিরাজের গাড়ি এল। দরোয়ান বড় দরজাটা খুলে দিল। গাড়ি ভেতরে ঢুকল। শাঙ্কো দেখল–কবিরাজ একা। তার সঙ্গীটি আসেনি।
শাঙ্কো তারপর সারা রাত পাটাতনে শুয়ে বসে সময় কাটাতে লাগল।
সেইরাতে আর কেউ কবিরাজের বাড়ির বাইরে বেরোল না–ঢুকলোও না।
ভোর হল। ফ্রান্সিস হ্যারি এল। শাঙ্কোকে বলল–মারিয়াকে দেখলে?
–না। শাঙ্কো বলল।
–ভোগাবে। কবিরাজ জানে আমরাই একমাত্র ওর গুপ্তধন চুরির ব্যাপারটা জানি। কাজেই যেমন করে হোক আমাদের এ দেশ ছাড়তে বাধ্য করবে। আমরা মারিয়াকে উদ্ধারের ব্যাপারে ব্যস্ত থাকবো কাজেই রাজা বা মন্ত্রীকে তার বিরুদ্ধে কিছু বলতে সময় পাব না। আমাদের একমাত্র কাজ হবে মারিয়াকে উদ্ধার করা। কাজেই মারিয়াকে বন্দী করে রেখে আমাদের মুখ বন্ধ করতে চায়। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে রাজা বা অমাত্যদের কাউকে আমরা কিছু বলতে সাহস পাবনা। যদি বলতে যাই রাজকুমারীর বন্দীদশার কথা তাহলে কবিরাজ রাজকুমারীকে হত্যা করতে পারে। কবিরাজ সাংঘাতিক লোক। কাজেই খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে। হ্যারি বলল।
শাঙ্কো বলল–ফ্রান্সিস এখন কী করবে?
–নজরদারি চালিয়ে যেতে হবে। মারিয়ার কোন হদিশ করতেই হবে। প্রয়োজনে কবিরাজের বাড়িতেও ঢুকবো। মারিয়াকে খুঁজে বের করবো। ফ্রান্সিস বলল।
-হ্যারি বলল–রাজকুমারীকে অন্য কোথাও রাখতে পারে?
–হ্যাঁ। পারে। তাই কবিরাজের গাড়ির পেছনে আমাদের গাড়ি চালাতে হবে। একটা সূত্র নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। ফ্রান্সিস বলল।
কবিরাজের বাড়ির দিকে ফ্রান্সিসরা নজরদারি চালাল।
কোথাও বেরোল না। তার যত যাওয়া আসা সন্ধ্যে থেকে রাত পর্যন্ত। সেদিন সন্ধ্যের কিছু পরে কবিরাজ গাড়িতে চেপে বের হল। হ্যারি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল ঘোড়ার গাড়ির দিকে। গাড়োয়ান নিজের জায়গায় বসে ঝিমোচ্ছিল। হ্যারি এসে বলল–ভাই জলদি গাড়ি চালাও। হ্যারি উঠে বসতে বসতে গাড়োয়ান গাড়ি চালাল।
হ্যারি সীট থেকে উঠে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আস্তে বলল–সামনের গাড়িটার পেছনে পেছনে চালাও। দরজা বন্ধ করে হ্যারি সীটে বসল।
দুটো গাড়িই চলল।
বেশ কিছুক্ষণ চলার পর কবিরাজদের গাড়িটা একটা বড় বাড়ির সামনে এল। দাঁড়াল। হ্যারি গাড়োয়ানকে আস্তে গাড়ি থামাতে বলল। একটু দূরে হ্যারির গাড়ি থামল।
হ্যারি মুখ বাড়িয়ে দেখল–কবিরাজ নামল। সঙ্গে একজন মহিলাও নামল। বাড়ির বাইরের আলোতে দেখে বুঝল রাজকুমারী নয়।
কবিরাজ আর মহিলাটি বাড়িতে ঢুকে গেল।
হ্যারি অপেক্ষা করতে লাগল। একটু পরে ভাবল এটা কার বাড়ি সেটা জানা যাক।
হ্যারি গাড়ি থেকে নেমে এল। দেখল চারিদিক অন্ধকার। একমাত্র ঐ বাড়িটার বাইরের ফটকে আলো আছে। সেই আলোতেই দেখল সামনে এক পোশাকের দোকান। হ্যারি দোকানে ঢুকল। একজন যুবক হাসিমুখে এগিয়ে এল। হ্যারি বলল– আমি পোশাক কিনবো না। একটা কথা জানতে এলাম–
–বলুন–কী কথা? লোকটি বলল।
হ্যারি বাড়িটা দেখিয়ে বলল–এটা কার বাড়ি?
মাননীয় সেনাপতির বাড়ি।
–ও। ঠিক আছে।
হ্যারি দোকানের বাইরে এল। হ্যারি বুঝলকবিরাজ আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে। যদি বিদেশীরা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তাই সেনাপতিকে ভুল বোঝাবে। ফ্রান্সিসদের অভিযোগ ধোপে টিকবে না।
ফিরে এসে হ্যারি গাড়িতে বসল।
কবিরাজ ও মহিলাটি বেশ কিছুক্ষণ পর ফিরে এল। গাড়িতে উঠল। গাড়ি চলল। পেছনে হ্যারির গাড়িও চলেছে।
কবিরাজের গাড়ি পূবমুখো চলল। পেছনে হ্যারির গাড়িও চলল।
একটা বেশ বড় বাড়ির সামনে এসে কবিরাজের গাড়ি থামল।
কবিরাজ আর মহিলাটি নামল। বাড়ির ভেতরে ঢুকল।
হ্যারি গাড়ি থেকে নামল। একটু এদিক ওদিক ঘুরছে তখনই একজন লোককে আসতে দেখল। হ্যারি বলল–একটা কথা বলছিলাম।
–বলুন। লোকটি বলল।
–এই বাড়িটা কার বাড়ি?
–ও। এটা তো মাননীয় মন্ত্রীমশাইয়ের বাড়ি।
–ও। হ্যারি মুখে শব্দ করল। ফিরে এসে গাড়িতে বসল। তাহলে বোঝা যাচ্ছে কবিরাজই গুণ্ডা লাগিয়ে রাজকুমারীকে অপহরণ করিয়েছে। এবার মন্ত্রী ও সেনাপতিকে হাতে রাখছে। গুপ্তধন চুরি রাজকুমারীকে অপহরণ এইসব নিয়ে কথা উঠলে মন্ত্রী ও সেনাপতিই তাকে রক্ষা করবে।
বেশ কিছুক্ষণ পরে কবিরাজ ও মহিলাটি বেরিয়ে এল। গাড়িতে উঠল। গাড়ি চলল। পেছনে হ্যারির গাড়ি।
কবিরাজ আর কোথাও গেল না। সোজা বাড়ি ফিরে এল। হ্যারিও ফিরে এল।
কবিরাজের গাড়ি তার বাড়িতে ঢুকে গেল। হ্যারি কিছুদূরে গিয়ে গাড়ি থামাল। গাড়ি থেকে নামল।
ফুলের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। তবে দোকানের তালার চাবি ফুলওয়ালা ফ্রান্সিসদের দিয়ে রেখেছিল। হ্যারি তালা খুলে দোকানে ঢুকল। পাতা পাটাতনে বসল। তারপর শুয়ে পড়ল।
হঠাৎ বাইরে শাঙ্কোর গলা শুনল–হ্যারি। হ্যারি দোকানের দরজা খুলে দিল। ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো এসেছে।
হ্যারি কী খবর বলো। ফ্রান্সিস বলল।
হ্যারি ওর অভিজ্ঞতার কথা বলল। তারপর বলল–এখন আমার মনে হয়, কবিরাজই নিজের বাড়িতে রাজকুমারীকে বন্দী করে রেখেছে।
ফ্রান্সিস একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল–আমি কবিরাজের বাড়িতে ঢুকবো। মারিয়াকে খুঁজবো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস মারিয়াকে কবিরাজ নিজের বাড়িতেই বন্দী করে রেখেছে।
-আজ রাতেই যাবে? হ্যারি বলল।
–হ্যাঁ আজ রাতেই। আমি একাই যাবো। ফ্রান্সিস বলল।
–না, না শাঙ্কোকে নিয়ে যাও। হ্যারি বলল।
–যদি মারিয়াকে পাই তাহলে ওকে নিয়ে পালিয়ে আসতে হবে। তখন একা মারিয়াকে নিয়ে পালাতে কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু শাঙ্কো গেলে একটা বাড়তি দায়িত্ব।
শাঙ্কো বলল ঠিক আছে ফ্রান্সিস তুমি যা সুবিধেজনক মনে হবে তাই কর।
ফ্রান্সিস কোমরের তরোয়ালটা ভালো করে কোমরে গুঁজল। তারপর দোকান থেকে বেরিয়ে এল।
ফ্রান্সিস বড় রাস্তাটা পার হল। আকাশে আধ ভাঙা চাঁদ। তাই জ্যোৎস্না খুব উজ্জ্বল নয়। কবিরাজের বাড়ির পেছনদিকে গেল। দেখল এখানেও একটা প্রবেশদ্বার লোহার তৈরি। ফ্রান্সিস প্রবেশদ্বারের কাছে গেল। দেখল। ওঠা যাবে। পারও হওয়া যাবে।
এবার আস্তে আস্তে প্রবেশদ্বারে উঠতে লাগল। প্রবেশদ্বারের মাথায় চড়ল। লোহায় ঘষা লেগে ফ্রান্সিসের হাতে পায়ে কিছু জায়গা কেটে গেল। যন্ত্রণা হচ্ছে। কিন্তু ফ্রান্সিস আমল দিল না। একটা বাগানে লাফ দিয়ে পড়ল। বাগানের গাছগাছালিতে জায়গাটা বেশ অন্ধকার।
ফ্রান্সিস সামনের দিকে তাকাল। পাথরে তৈরি খাড়া দোতলা। ফ্রান্সিস বাগানের মধ্যে দিয়ে সদর দরজায় এল। ফ্রান্সিস আস্তে দরজাটা ধাক্কা দিল। দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে গেল। ফ্রান্সিস দেখল এটা কবিরাজের রোগী দেখার ঘর। কিছুটা এগোতেই একটা দরজা। ভেজানো। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে দরজাটা একটু খুলল। দেখল এটা রাঁধুনীদের ঘর। দুজন শুয়ে আছে। একজন বাড়ির আলোতে মাথায় চিরুনি চালাচ্ছে।
ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে সরে এল। সামনেই দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। ফ্রান্সিস দোতলায়। উঠতে লাগল। দোতলায় উঠে দেখল–পরপর তিনটে ঘর।
প্রথমে ফ্রান্সিস প্রথম ঘরের সামনে এল। দরজা বন্ধ। একটু এগিয়েই একটা জানালা। আধখোলা। ফ্রান্সিস দেখল–ঘরটি সুন্দর সুসজ্জিত। মেঝেয় কার্পেট পাতা। দুটো বিছানা। দুজন শুয়ে আছে। অঘোরে ঘুমচ্ছে। কবিরাজ ও তার পত্নী।
ফ্রান্সিস আরো এগোল। আবার একটা ঘর। ফ্রান্সিস দেখল দরজাটা একটু ফাঁক। ফ্রান্সিস আঙ্গুল দিয়ে দরজার ফাঁক বাড়াল। তখনই একেবারে মুখোমুখি এক গুণ্ডার।
গুণ্ডাটা জল খাচ্ছিল। ফ্রান্সিসকে দেখে লাফিয়ে উঠল। সেইসঙ্গে চিৎকার–কে? কে? ওখানে? আর এক গুণ্ডা ঘুমিয়ে ছিল। আগের গুণ্ডার চিৎকার শুনে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস ভাবল–পালাবো। পরক্ষণেই ভাবল মারিয়া এই বাড়িতেই আছে কিনা সেটা জানতে হয়।
ততক্ষণে দুই গুণ্ডা তরোয়াল হাতে ফ্রান্সিসের দিকে এগিয়ে এল। ফ্রান্সিসও তরোয়াল খুলল। এক গুণ্ডা বলল–তুই কী চাস?
ফ্রান্সিস বলল–তোদের মুণ্ডু।
-তবে রে। একটা গুণ্ডা চেঁচিয়ে বলল।
–আয় তোরা তো কবিরাজমশাইর পোষা গুণ্ডা। তোরা এখানে বহাল তবিয়তে আছিস।
দুটো গুণ্ডাই ফ্রান্সিসকে আক্রমণ করল। ফ্রান্সিস ঘুরে ঘুরে ওদের মার ঠেকাতে লাগল। আক্রমণ করল না। তরোয়ালের লড়াই চলল।
ফ্রান্সিস শেষ ঘরটার কাছে এল। উচ্চস্বরে তরোয়াল চালাতে চালাতে ডাকল– মারিয়া–মারিয়া। ঘরটা থেকে কোন শব্দ শুনল না। লড়াই চালাতে চালাতে ফ্রান্সিস আবার হাঁপাতে হাঁপাতে ডাকল–মারিয়া। মারিয়া। বন্ধ ঘরটা থেকে মারিয়ার দুর্বল গলা শোনা গেল–ফ্রান্সিস। ফ্রান্সিস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এবার গুণ্ডাদুটোকে আহত করতে হয়। ফ্রান্সিস এবার একজন গুণ্ডাকে আক্রমণ করল। এতক্ষণ ফ্রান্সিস তরোয়ালের মার ঠেকিয়ে যাচ্ছিল। তাই গুণ্ডারাও ভেবেছিল–ফ্রান্সিস তরোয়াল চালাতে জানে না।
ফ্রান্সিস প্রথমেই মাথায় কালো কাপড়ের ফেট্টি বাঁধাকে ধরল। ও প্রায় লাফিয়ে এসে মাথায় ফেট্টি বাঁধার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কালো ফেট্টি কিছু বোঝবার আগেই ফ্রান্সিস ওর ডান কাঁধে তরোয়ালের কোপ বসাল। তরোয়াল বসে গেল। ফ্রান্সিস তরোয়ালটা খুলে নিল। কালো ফেট্টি গুণ্ডা বাঁ হাত দিয়ে ডান কাঁধটা ধরে বসে পড়ল।
অন্য গুণ্ডাটার সঙ্গে ফ্রান্সিস কিছুক্ষণ লড়ল। তারপর অতি দ্রুত একটা পাক খেয়ে প্রচণ্ড জোরে তরোয়াল চালাল। গুণ্ডাটার ঊরুতে তরোয়ালের ঘা পড়ল। ও বসে পড়ল।
ফ্রান্সিস হাঁপাতে লাগল। তখনই বারান্দার অন্ধকার কোনার দিক থেকে কবিরাজের গম্ভীর গলা শুনল।
-তাইলে বর্শার এই মার সামলাও। কবিরাজ বা ছুঁড়লেন। ফ্রান্সিস মাথা নামাতে নামাতে বর্শাটা ওর ঘাড় ছুঁয়ে গেল। কাটা জায়গা থেকে রক্ত পড়তে লাগল। ফ্রান্সিস বর্শাটা তুলে নিল। বলল–এইবার আপনি সামলান। ফ্রান্সিস দেহের সমস্ত শক্তি নিয়ে বর্শা ছুঁড়ল। অন্ধকারের মধ্যেও নিখুঁত নিশানা। বর্শাটা কবিরাজের বুকে গেঁথে গেল। কবিরাজ উল্টে মেঝেয় পড়ে গেলেন। কিছুক্ষণ মাথা এপাশ ওপাশ করতে করতে মারা গেল।
দুই গুণ্ডা তখন মেঝেয় শুয়ে আছে। একজন গোঙাচ্ছে। অন্যটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে চেষ্টা করছে।
ফ্রান্সিস ওদের কাছে এল। তরোয়াল কোমরে খুঁজতে খুঁজতে। মাথায় কালো ফেট্টিওয়ালাকে বলল–যদি বাঁচতে চাও ঐ ঘরের চাবিটা দাও। কালো ফেট্টিওয়ালা বলল–আমার কাছে নেই। ফ্রান্সিস অন্যটিকে বলল–চাবি কোথায়?
–আমি জানি না।
তাহলে তো উপায় নেই তোমাদের দুজনকেই হত্যা করতে হয়।
ফ্রান্সিস তরোয়ালের ডগাটা কালো ফেট্টিওয়ালার গলায় ঠেকাল। বলল– চাবি দাও। নইলে মরবে।
ফ্রান্সিস তরোয়ালের চাপ বাড়াল। বলল–তাহলে তুমি মরতে চাও। বেশ ফ্রান্সিস তরোয়ালটা কালো ফেট্টির গলায় কিছুটা ঢোকাল। কালো ফেট্টি দুহাত তুলে বলল–দিচ্ছি। আমাকে ছেড়ে দিন।
আগে চাবি চাই। ফ্রান্সিস বলল।
কালো ফেট্টি কোমর থেকে একটা চাবির গোছা বের করল।
দেখে দেখে ফ্রান্সিসকে চাবিটা দেখাল? ফ্রান্সিস চাবির গোছাটা নিয়ে শেষ ঘরটার কাছে গেল। গলা চড়িয়ে বলল–মারিয়া—-আমরা এসেছি। দরজা খুলে দিচ্ছি।
ফ্রান্সিস দরজা খুলে দিল। মারিয়া কেঁদে ফেলল। এখন কান্না নয়। চলো।
ফ্রান্সিস মারিয়াকে হাত ধরে ধরে সিঁড়ি দিয়ে নামাল। সদর দরজার কাছে এল। দারোয়ান হাঁ হাঁ মুখে শব্দ করতে করতে ফ্রান্সিসদের সামনে এল। বশী তুলল। তোমরা চোর।
-তোমার প্রভু কবিরাজমশাই অনেক বড় চোর। ফ্রান্সিস বলল-দরজাটা খুলে দাও।
–না। আমি দরজা খুলবো না।
–মিছিমিছি কথা বাড়াচ্ছো। বাড়ির দোতলায় ওঠ। দেখবে কবিরাজ মারা গেছে। গুণ্ডা দুটো এখনও গোঙাচ্ছে।
–না। আমি দরজা খুলবো না।
–অগত্যা তোমাকে একটু আহত করতে হয়। ফ্রান্সিস তরোয়াল খুলল। দারোয়ান বর্শা তুলল। তখনই ফ্রান্সিস তরোয়াল চালাল। বর্শা দু’টুকরো হয়ে ছিটকে পড়ল।
এবারে দরজা খোল। ফ্রান্সিস বেশ কড়া গলায় বলল।
দারোয়ান এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিল। ও তখনও ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে রইল। অবাক লাগল ওর বর্শাটা এত হালকা?
মারিয়ার হাত ধরে ফ্রান্সিস রাস্তায় এল। ফুলের দোকান থেকে হ্যারি শাঙ্কোরা ছুটে এল। হ্যারি মারিয়াকে বলল-রাজকুমারী আপনি সুস্থ আছেন তো?
-না। জ্বরটরে ভুগেছি। তবে এখন আমার শরীর ভালো হয়ে যাবে। রাজকুমারী একটু ম্লান হেসে বলল।
ফ্রান্সিসরা যখন সরাইখানায় ফিরে এল তখন ভোর হয় হয়। ফ্রান্সিস বলল– মারিয়া তুমি ঘুমিয়ে নাও। মারিয়া চলে গেল। ফ্রান্সিস বলল–হ্যারি তুমি যতক্ষণ পারো ঘুমিয়ে নাও। সবাই যতটা পারো ঘুমোও, বিশ্রাম নাও। আমি আর শাঙ্কো ঘোড়াভাড়া করতে যাচ্ছি। তিনটে ঘোড়াতেই আমাদের হয়ে যাবে। একটু বেলায় খেয়ে নেবো। তারপর ঘোড়া চালিয়ে সন্ধ্যে নাগাদ আয়াচুচো পৌঁছব। রাতটা বিশ্রাম নিয়ে আবার যাত্রা। সারারাত ঘোড়া চালাবো। সকালে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেল নাগাদ পিসকো বন্দরে পৌঁছব।
ফ্রান্সিসের নির্দেশ মেনে সবাই যখন পিসকো বন্দরে পৌঁছল সূর্য ডোবে ডোবে।
জাহাজঘাটায় ভাইকিং বন্ধুরা কয়েকজন জাহাজের রেলিং ধরে গল্পগুজব করছিল। একজন ভাইকিং ঘোড়ায় চড়ে আসা ফ্রান্সিসদের দূর থেকে দেখল। ও চিৎকার করে বলল–ভাইসব ফ্রান্সিসরা আসছে।
ফ্রান্সিসরা জাহাজঘাটায় এল। বন্ধুরা ধ্বনি তুলল–ও–হো-হো। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব–এবারও আমার হাত শূন্য।
-তোমরা অক্ষত ফিরে এসেছো এতেই আমরা খুশি। ভেন বলল।