পাতাল-খন্দক : 09 – বিজয়ের সংশয়
খেতে প্রায় রাত দশটা বেজে গেছে। ডাইনিং রুমে এরাতে জয়া খেল কর্নেল ও বিজয়ের সঙ্গে। জয়ের খাবার কলাবতী পৌঁছে দিয়ে এসেছে।
জয়া চলে গেলে কর্নেল বিজয়কে বললেন, “এসো বিজয়, কিছুক্ষণ গল্প করি। নাকি তোমার কবিতার মুড চলে যাচ্ছে?”
বিজয় হাসল। “নাঃ! কোনো মুড নেই আজ। আমার তো ঘরে ঢুকতেই ভয় হচ্ছে। ভাবছি, আপনার কাছে এসে শোব।”
“স্বচ্ছন্দে। গেস্টরুমে তো আরেকটা খাট আছে। অসুবিধে নেই।”
বিজয় খুশি হয়ে বারান্দায় গিয়ে ডাকল, “বুদ্ধ! শুনে যা!” বুদ্ধ এলে সে তাকে তার ঘরে তালা আটকে দিতে বলল। চাবি দিল। বুদ্ধ একটু পরে চাবিটা ফেরত দিয়ে গেল।
গেস্টরুমের দ্বিতীয় খাটে বিছানা পাতাই ছিল। বিজয় বলল “যাক্। নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।”
কর্নেল চুরুট টানছিলেন। ধোঁয়ার ভেতর হঠাৎ বললেন, “আচ্ছা বিজয়, জয় হঠাৎ কলকাতা থেকে পড়াশুনা ছেড়ে চলে এসেছিল কেন বলো তো?”
বিজয় বলল, “ছেড়ে ঠিক আসেনি। বি. এ. পাশ করেছিল। কিন্তু এম. এ. তে ভর্তি হয়নি।”
“শরদিন্দুর সহকর্মী পরিতোষকে তুমি কখনও দেখেছ?”
“না তো!” বিজয় অবাক হল। “কেন?”
“জয়ের সঙ্গে তার আলাপ ছিল।”
“বিজয় আরও অবাক হয়ে বলল, তাই বুঝি! জয়া বলছিল নাকি?”
কর্নেল চোখ বুজে বললেন, “হ্যাঁ।”
“সেটা সম্ভব। জয় শরদিন্দুর কলিগকে দেখে থাকবে। তবে আমি তাকে দেখা দূরের কথা, সবে আজ বিকেলে মাধবজির মুখে তার নাম শুনলাম।” বিজয় একটু পরে ফের বলল, “জয়া বলেছে দাদার সঙ্গে পরিতোষের আলাপ ছিল?”
“হ্যাঁ।”
“আমি বিশ্বাস করি না। জয়া বড্ড ভুলভাল কথা বলে।”
“তাহলে তুমি রমলাকেও চেনো না?”
বিজয় চমকে উঠল। “রমলা! সে আবার কে!”
“পরিতোষের বোন। জয়ের সঙ্গে তার একটু বিরতি দিয়ে চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে কর্নেল বললেন, “জয়ের সঙ্গে রমলার এমোশানাল সম্পর্ক। ছিল।”
“বলেন কী! জয়া বলেছে আপনাকে? নাকি জয়ের কাছ থেকে শুনলেন?”
“হ্যাঁ।” কর্নেল এমনভাবে হ্যাঁ বললেন, যাতে বোঝা যায় না কার কাছে। শুনেছেন।
বিজয় জোরে মাথা নেড়ে বলল, “জয়া বড্ড বানিয়ে বলে। এ আমি বিশ্বাস করি না।”
“কেন?”
বিজয় নড়ে বসল। “দাদার কোনো ব্যাপার আমার অজানা নেই। বিশেষ করে কলকাতায় হোস্টেলে থাকার সময় দাদার কোনো প্রেমের ব্যাপার থাকলে আমি নিশ্চয় জানতে পারতুম।”
কর্নেল একটু হাসলেন। “ছোটভাইকে ওসব কথা বলা যায় না–অথবা ছোটভাইয়ের চোখের আড়ালেই দাদার গোপন প্রেম করা স্বাভাবিক।”
বিজয় জোর গলায় বলল, “জয় সে-রকম দাদা নয়। মাত্র ছ’ঘণ্টা পরে আমার জন্ম। কাজেই আমার বন্ধুর মতো। ওকে আমি নাম ধরে ডাকি, নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন?”
কর্নেল হাসলেন। “কিন্তু ইদানীং জয়ের অনেক গোপন ব্যাপার তোমার জানা নেই। এবং নেই বলেই তুমি রহস্যের ধাঁধায় পড়ে আমার কাছে ছুটে গিয়েছিলে। আমাকে নিয়ে এসেছ তার জট ছাড়াতেই।”
“হ্যাঁ। ইদানীং শরদিন্দু মারা যাবার পর থেকে জয় আমাকে কিছুই জানতে দিচ্ছে না আগের মতো।”
“অথচ সেটাই তুমি জানতে চাইছ, এই তো?”
বিজয় একটু চুপ করে থেকে বলল, শুধু তাই নয়। আপনাকে বলেছি– আমার ভয় হচ্ছে জয় সুইসাইড না করে। ওর পাগলামি যে হারে বাড়ছে।”
কর্নেল একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন “জয়ের গোপন রহস্যের একটা আমি ধরতে পেরেছি।
“কী বলুন তো?”
“রাতে জয়ের ঘরে তুমি জয়কে কার সঙ্গে কথা বলতে শুনেছিলে এবং এক রাত্রে কাউকে ব্যালকনির ওই ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে দেখেছিলে। আশা করি, কে সে এবার বুঝতে পারছ।”
বিজয় শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, “পরিতোষ?”
“ঠিক ধরেছ। তুমি বুদ্ধিমান।”
বিজয় চাপা স্বরে বলল, “পরিতোষের সঙ্গে জয়ের কী ব্যাপার চলছে বলে মনে হয় আপনার?”
“এখনও এতটা এগোতে পারিনি। তবে–”
বিজয় দ্রুত বলল, “পরিতোষ কি তার বোন রমলার ব্যাপারে জয়কে ব্ল্যাকমেইল করেছে?”
“বোঝা যাচ্ছে না ঠিক। আরও একটু গোপন তদন্ত দরকার।”
“কর্নেল, আমার মনে হচ্ছে, তাহলে পরিতোষকে জয় এ বাড়িতে গোপন আশ্রয় দিয়েছে। তিনটে ঘর বন্ধ আছে ওপরে। তারই কোনোটাতে পরিতোষ লুকিয়ে থাকতে পারে।”
বিজয় খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। কর্নেল বললেন, “তাও সম্ভব। বিপ্রদাসবাবু না ফিরলে তো ওসব ঘরের চাবিও পাওয়া যাবে না। দেখা যাক।”
বিজয় দমআটকানো গলায় বলল, “সব স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কর্নেল। আজ পরিতোষই তাহলে জয়াকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে কৌটো হাতিয়েছে। নিশ্চয় ওর মধ্যে কিছু দামি জিনিস ছিল!”
“চাবি!”,
“কিন্তু কিসের চাবি?” বিজয় একটু হাসল। “হা–হরটিলায় তখন আপনি চাবির কথা বলেছিলেন।”
কর্নেল আস্তে বললেন, “হরটিলার মন্দিরের ভেতর যে শিবলিঙ্গ আছে, তার বেদিটা সম্ভবত একটা গোপন সিন্দুক। চাবিটা সেই সিন্দুকের। চাবিচোর তাড়াতাড়ি জোর করে সিন্দুকের তালা খোলবার চেষ্টা করতে গিয়ে চাবিটা ভেঙে ফেলেছিল।”
“সর্বনাশ! আপনি দেখেছেন?”
“হ্যাঁ।” কর্নেল একটু হাসলেন। “তবে ব্যাপারটা কীভাবে জয়ও জেনে গেছে। সে তার কুকুরটাকে হরটিলায় পাহারায় রেখেছে দেখে এসেছি।”
বিজয় চমকে উঠল। তারপর বলল “চাবি-চোর পরিতোষ। পরিতোষই জয়কে বলেছে, ওখানে গুপ্তধন আছে। ভাগ দেবে বলে লোভ দেখিয়েছে। সত্যি, জয় এমন বোকা হবে ভাবতে পারিনি। যাতে অন্য কেউ টের পেয়ে ওখানে হানা দেয়, তাই সনিকে পাহারায় রেখেছে। সনি তো পরিতোষকে কিছু বলে না। তাই তার অসুবিধে নেই।”
কর্নেল হাসলেন। “আচ্ছা বিজয়, সিন্দুকের ভেতর যদি গুপ্তধনের বদলে অন্য কিছু থাকে?”
“আর কী থাকবে? পরিতোষকে নিশ্চয়ই জয়ই নেশার ঘোরে বলেছে ওর ভেতরে আমাদের পূর্বপুরুষের গুপ্তধন আছে। জয় বড় বোকা। গায়ের জোর ছাড়া আর কিছু নেই ওর।”
“বিজয়, যদি সিন্দুকের ভেতর একটা ডেডবডি লুকোনো থাকে?”
বিজয় ভীষণ চমকে গেল। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল, “ডেডবডি? কার ডেডবডি?”
“ধরো পরিতোষের বোন রমলার?”
বিজয় শিউরে উঠে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, “প্লিজ! প্লিজ কর্নেল! এসব কথা বললে আমি হার্টফেল করে মারা পড়ল। আমার হাত-পা কাঁপছে!”
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “নাঃ। জাস্ট কথার কথা। শুয়ে পড়ো। এগারোটা বাজে।”
বিজয় মশারি টেনে দিয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর বলল, “আজ রাতে আমার ঘুম হবে না।”
ফ্যানের স্পিড বাড়িয়ে মশারি খাঁটিয়ে শুয়ে কর্নেল ফের বললেন, “ঘুমোও।”
একটু পরে বিজয় ডাকল, “কর্নেল!”
“বলো ডার্লিং!”
“পদ্যটা তাহলে পরিতোষই লিখেছে তাই না! বাংলা তার মাতৃভাষা। কাজেই–”
“আচ্ছা বিজয়!”
“বলুন।”
“তুমি দাড়ি রাখতে শুরু করেছ কবে থেকে?”
“তা অনেকদিন হয়ে গেল। কেন?”
“এমনি জিজ্ঞেস করছি। ঘুমোও।”
তারপর কর্নেলের নাক ডাকতে থাকল। বিজয় ডাকাডাকি করে আর সাড়া পেল না।