Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পাতাল-খন্দক || Syed Mustafa Siraj » Page 8

পাতাল-খন্দক || Syed Mustafa Siraj

বুদ্বুরাম ফিরে এসে খবর দিয়েছিল, মাধবজি দোঁহা আওড়াতে আওড়াতে রোটি পাকাচ্ছেন। তবিয়ত ঠিক আছে। বুদ্বুরামের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল সে বিরক্ত হয়েছে কর্নেলের ব্যাপার-স্যাপার দেখে। এই বুড়ো ভদ্রলোক এসে তার ঝামেলা বাড়াচ্ছেন, যেন এরকম তার মনোভাব। খামোকা তাকে ভাগলপুর পাঠাতে চাওয়া! দৌড়ুতে দৌড়ুতে ঠাকুরদালানে পাঠানো! হয়েছেটা কী এত?

কথাটা রঙ্গিয়া চুপিচুপি জয়াকে বলতে এসেছিল, কর্নেল তখনও জয়ার কাছে বসে কথা বলছিলেন তার ঘরে। জয়া বলেছিল, “বুদ্বুটা খুব কুঁড়ে আসলে। নছি সিংয়ের সঙ্গে দাবা খেলতে পেলে আর কিছু চায় না। কিছুক্ষণ পরে, কর্নেল নিচের তলায় উঁকি মেরে দেখলেন, তাই বটে। সদর দরজার পাশের ছোট্ট ঘরটায় নছি সিং আর সে থাকে। সেই ঘরে দুজনে দাবা নিয়ে বসেছে।

বিজয় তখন তার ঘরের দরজা বন্ধ করে কবিতা লিখতে বসেছে ফের। কর্নেল গেস্টরুমে কিছুক্ষণ একা গুম হয়ে বসে থাকলেন। তারপর টর্চ নিয়ে বেরুলেন। বাড়ি একেবারে সুনসান। কিচেনে কলাবতী, রঙ্গিয়া আর বৈজু ঠাকুরকে চাপা গলায় কথা বলতে দেখা যাচ্ছিল। নানকুর ঘরের দরজা বন্ধ। ভেতরে আলো জ্বলছে। সে কী করছে বোঝা গেল না। বিজয় বলেছে, নানকু রাতের খাওয়া সেরে নিয়ে চিড়িয়াখানার আউট-হাউসে শুতে যায় ইদানীং শরদিন্দুর মৃত্যুর পর তার ওপর জয়ের নাকি এই হুকুম।

বৈজুর ঘর আর নানকুর ঘরের মাঝামাঝি খিড়কিরাস্তার করিডোর। কর্নেল নিঃশব্দে সেই দরজা খুলে এবং ভেজিয়ে দিয়ে বেরুলেন। সেপ্টেম্বরের নক্ষত্রজ্বলা আকাশের নিচে জংলা জমি জুড়ে যেন রহস্য থমথম করছে। ভ্যাপসা গরম। বেশ কিছুদিন এ তল্লাটে বৃষ্টি হয়নি। কর্নেল টর্চ জ্বালতে গিয়ে জ্বাললেন না। জয়ের ঘরের ব্যালকনি থেকে নেমে আসা ঘোরানো লোহার সিঁড়ির কাছে গিয়ে একটু দাঁড়ালেন। অমনি জয়ের কুকুরটার গজরানি কানে এল। কিন্তু কুকুরটা ওপরে গজরাচ্ছে না, সামনের দিকে জংলা জমিতেই সে কোথাও আছে। জয়ের ঘরে আলো জ্বলছে। কুকুরটা কি সারারাত বাইরে ছাড়া থাকে?

কর্নেল নালা ও পুকুরের সঙ্গমস্থলে যেতেই ফের কুকুরটা গরগর করে উঠল। পুকুরপাড় ধরে একটু এগিয়ে কর্নেল বুঝলেন, কুকুরটা হরটিলার ওখানে। আছে। কারণ তিনি যত এগোচ্ছিলেন, তত তার গজরানি বাড়ছিল। তারপর তার গায়ে টর্চের আলো পড়ল। কর্নেল থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, “জয় নাকি?”

টর্চ নিভে গেল। কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন, “এখানে কী করছ জয়।?”

অন্ধকার থেকে জয় বলল, “যাই করি, আপনার কী মশাই? আপনাকে সাবধান করে চিচ্ছি–এক পা এগোবেন না। সনিকে লেলিয়ে দেব।”

“সনি আমাকে ভয় পায়। তুমি চেষ্টা করে দ্যাখো ডার্লিং, যদি ওকে–”

“ডার্লিং? গায়ে পড়ে আত্মীয়তা আমার বরদাস্ত হয় না বলে দিচ্ছি।”

“অভ্যাস–নিছক অভ্যাস ডার্লিং বলা।” কর্নেল হাসলেন। “যাই হোক, আশাকরি বুঝতে পারছ সনি আমাকে ভয় পায়।”

জয় ধমক দিল। “সনি! সনি! কী হয়েছে তোর?”

হরটিলার সিঁড়ির ওপরদিকে সনির ডাক শোনা গেল। এবার যেন নিরাপদে পৌঁছে কর্নেলকে যাচ্ছেতাই গালাগালি দিতে শুরু করেছে। জয় বলল, “আশ্চর্য তো!”

“জয়! তার চেয়ে আশ্চর্য তোমার এখানে দাঁড়িয়ে থাকা। তুমি কি হরটিলার মন্দির পাহারা দিচ্ছ?”

জয়ের গলার স্বর বদলে গেল। “আপনি কেমন করে জানলেন”?

“জানি। তোমার বুদ্ধির প্রশংসা করি, ডার্লিং!

জয় দাঁড়িয়েছিল একটা পাথরের কাছে। কয়েক পা এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়াল। কর্নেল চাপা স্বরে বললেন ফের, “কিছুক্ষণ আগে জয়া তোমাকে যা সব বলে এসেছে, তা আমারই পরামর্শে। ভেবেছিলুম, তুমি ওর কথায় পাত্তা দেবে না। কিন্তু পাত্তা দিয়েছ এবং সরাসরি কাজে নেমেছ দেখে আমি খুশি হয়েছি, ডার্লিং!”

“কে আপনি? আমাদের ব্যাপারে আপনার কেন মাথাব্যথা বলুন তো?”

“আমি তোমাদের হিতৈষী।”

একটু চুপ করে থাকার পর জয় বলল, “আপনি পুলিশের লোক?”

“মোটেও না।” কর্নেল তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “সনি পাহারা দিক। ততক্ষণ আমরা ভোলা জায়গায় গিয়ে কথা বলি, যাতে আড়ি পেতে কেউ না শোনে। এস।”

জয় কথা মানল। নালার ধারে কিছুটা এগিয়ে অনেকটা জায়গা জুড়ে খোলামেলা ঘাসজমি। চারদিকে আলো ফেলে নিশ্চিন্ত হয়ে কর্নেল চাপা স্বরে বললেন, “হরটিলার শিবলিঙ্গের বেদির তলায় কী আছে, তুমি জানো জয়”?

জয় খুব আস্তে বলল, “আমার সন্দেহ হচ্ছে—

“হু–বলো ডার্লিং!”

“রমলার ডেডবডি লুকোনো আছে হয়তো।”

কর্নেল চমকে উঠলেন। “কে রমলা!”

“স্কাউড্রেল পরিতোষের বোন।”

“পরিতোষ মানে–যে ছিল শরদিন্দুর ব্যাংকের সহকর্মী?”

“হ্যাঁ। পরিতোষ জুয়াড়ি চোর বদমাস। কিন্তু তার বোন রমলা ছিল উল্টো।” বলে জয় ওঠার চেষ্টা করল। “না, এর বেশি আমার বলা চলে না। আমার মুখ। বন্ধ।”

কর্নেল তাকে টেনে বসতে বাধ্য করলেন। জয় একটু অবাক হয়ে বলল, “আপনার গায়ে দেখছি সাংঘাতিক জোর। আপনাকে ভীষণ বুড়ো দেখে ভেবেছিলুম। আপনি কেন এসব সাংঘাতিক ব্যাপারে নাক গলাচ্ছেন?”

“প্লিজ ডার্লিং। আমি তোমার হিতৈষী বন্ধু। আমাকে কিছু গোপন কোরো না। তাতে তোমার জীবন নিরাপদ হবে।”

“কেন? আমাকে কি কেউ রমলার বা শরদিন্দুর মতো মেরে ফেলবে?”

“তাহলে তুমি জানো শরদিন্দু চিতাবাঘের হাতে মারা পড়েনি?”

জয় গলার ভেতর বলল, “হ্যা!”

“শরদিন্দুকে কে মেরেছে বলে তোমার ধারণা, জয়?”

“বলব না। মুখ বন্ধ।”

“বেশ কীভাবে ওকে মারা হয়েছিল, সেটা অন্তত বলো।”

“বাঘনখ দেখেছেন কি? আগের যুগে এসব অস্ত্র ব্যবহার করা হত।”

“দেখেছি–অনেক রাজবাড়ির অস্ত্রাগারে আছে।”

“ইতিহাসে পড়েছি শিবাজি বাঘনখ দিয়ে আফজল খাঁকে মেরে ফেলেছিলেন। বাঘনখ আমাদের বাড়িতেও আছে। মানে ছিল। আর নেই। শরদিন্দু মারা যাওয়ার পর আর দেখতে পাচ্ছি না।”

“কোন ঘরে তোমাদের অস্ত্রাগার?”

“আমার ঘরের পাশের ঘরে। বাইরে তালাবন্ধ। কিন্তু আমার ঘর দিয়ে ঢাকা যায়।”

“শরদিন্দু কেন অত রাতে চিড়িয়াখানায় গিয়েছিল?”

“আমি পরিতোষের সঙ্গে ওর মিটমাট করিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। পরিতোষ ব্যাংকের চুরিকরা টাকার একটা শেয়ার হিসেবে চৌষট্টি হাজার টাকা দিতে রাজি হয়েছিল। চুরিকরা টাকার অর্ধেকটা পরিতোষের কাছে মজুত ছিল। পরিতোষ চোর, জুয়াড়ি, স্কাউন্ড্রেল। কিন্তু বোনকে ভীষণ ভালবাসত। বোনের খোঁজেই সে এখানে–”।

জয় থামলে কর্নেল বললেন, “হুঁ! বলো ডার্লিং!”

“রমলার কথা বলব না। অন্য কথা জানতে চাইলে বলব।”

“বেশ। বললো, শরদিন্দু কীভাবে মারা পড়ল?”

জয় একটু চুপ করে থাকার পর বলল, “পরিতোষের নামেও হুলিয়া ঝুলছে পুলিশের। ব্যাংকে চুরির পর শরদিন্দুকে ধরল। তার জেল হল। কিন্তু পুলিশ পরিতোষকেও সন্দেহ করেছিল। তাই সে গা ঢাকা দিয়েছিল ব্যাপারটা আঁচ করেই।”

“শরদিন্দু কীভাবে মারা পড়ল বলো?”

“আউট-হাউসে পরিতোষের থাকার কথা ছিল। রাত এগারোটা নাগাদ আমি শরদিন্দুকে সঙ্গে নিয়ে চুপিচুপি গেলুম। মিটমাট হয়ে গেল। শরদিন্দু আমার অনুরোধে একটু হুইস্কি খেতে গিয়ে শেষে বেশ কয়েক পেগ খেয়ে ফেলেছিল। তখন সে বেশ মাতাল হয়ে পড়েছে। আসলে মদ খাওয়ার অভ্যাস বেচারার সত্যি ছিল না। সে মাতাল অবস্থায় অনেক কথা বলছিল। টাকাগুলো পাপের। কিন্তু সে মিছিমিছি জেল খেটেছে। কাজেই টাকাগুলো তার ধর্মত পাওনা। টাকা পেয়ে সে কলকাতা নিয়ে যাবে জয়াকে। এবাড়িতে তার থাকা তার নিজের পক্ষে এবং জয়া বা আমাদের সবার পক্ষেই অপমানজনক। কারণ লোকে স্ক্যান্ডাল ছড়াচ্ছে শরদিন্দু-জয়াকে নিয়ে।…এইসব বলার পর হঠাৎ সে বলে বসল, রমলাকে খুন করা হয়েছে। কে খুন করেছে এবং কোথায় ডেডবডি লুকোনো আছে সে জানে। তবে এখন বলবে না। পরিতোষ টাকা দিলেই সে। বলবে। এদিকে পরিতোষ আর আমি ওর কথা শুনে তো ভীষণ উত্তেজিত। সাধাসাধি করেই ওর কাছে কথাটা আদায় করা গেল না। শরদিন্দু গোঁ ধরে। বলল, পরদিন এমনি সময় পরিতোষ যখন টাকা নিয়ে আসবে, টাকা আগে গুনে নিয়ে তবে সে সেকথা ফাস করবে। যাইহোক পরিতোষ গেল গঙ্গার পাড় দিয়ে। আমি তাকে এগিয়ে দিয়ে আউট-হাউসের দরজা বন্ধ করছি, তখনই শরদিন্দুর চাপা গোঙানি শুনতে পেলাম। তখন চিতাবাঘের খাঁচাটা ছিল বাইরে। খাঁচার সামনে শরদিন্দু পড়ে ধড়ফড় করছে আর তার খুনী পালিয়ে যাচ্ছে। একে রমলাকে খুন করা হয়েছে শুনে আমার মাথার ঠিক নেই, তার ওপর ওই সাংঘাতিক ঘটনা। আউট-হাউসের যে ঘরে আমরা কথা বলছিলুম, সেই ঘরের জানালা দিয়ে আলো আসছিল। সেই আলোয়–থাক। আমার মাথা ঘুরছে।”

জয় দুহাতে মাথা আঁকড়ে ধরে দুহাঁটুর ফাঁকে মুখ নামাল। কর্নেল তার পিঠে হাত রেখে বললেন, “জয়! ডার্লিং! মন শক্ত করো।”

জয় মাথা তুলে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, “আমার বোন আমারই দোষে বিধবা হয়ে গেছে কর্নেল! আমার আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না। অথচ মরতেও পারি না। খালি মনে হয়, রমলা হয়তো বেঁচে আছে। শরদিন্দু হয়তো টাকা পাওয়ার লোভে মিথ্যা বলেছিল। হয়তো রমলাকে কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে। কর্নেল, এই ধাঁধার জন্যই আমার মরা হল না। নইলে কবে আমি-”

হরটিলার মন্দিরে জয়ের কুকুরটার ডাক ভেসে এল। জয় অমনি “সনি” বলে চেঁচিয়ে উঠে দৌড়ে গেল।

কর্নেল ভাবলেন তাকে অনুসরণ করবেন। কিন্তু করলেন না। মনে হল, জয় এখন নিরাপদ–অন্তত তিনি যতক্ষণ কানাজোলে আছেন। শুধু একটাই উদ্বেগ আপাতত বিপ্রদাসের জন্য। ভৌতিক ছড়াটা নিছক রসিকতা না হতেও পারে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress