পাতাল-খন্দক : 11 – বামুন গেছে যমের বাড়ি
নানকুর যেন জন্তুদের ইন্দ্রিয়। চিড়িয়াখানার তারের বেড়ার কাছে পৌঁছে কর্নেল দেখলেন, সে গিনিপিগের খাঁচায় ঘাস ঠেলে দিচ্ছে পিঠ এদিকে। বন্ধ গেটের সামনে কর্নেল দাঁড়ালে সে ঘুরল এবং সেলাম করে উঠে দাঁড়াল। বলল, “আসুন স্যার!”
লোহার মজবুত গরাদ দেওয়া গেট খুলে দিল সে। কর্নেল সোজা আউট হাউসের বারান্দায় গিয়ে উঠলেন। পেছনে নানকু জিজ্ঞাসার সুরে “স্যার” বলল। ডাইনে প্রথম ঘরটা খোলা এবং ভেতরে চিতাবাঘের খাঁচা রয়েছে। বাঁদিকের ঘরের দরজা বন্ধ ভেতর থেকে। সামনে করিডোরের পর দেয়াল। কর্নেল বাঁদিকের দরজায় নক করে কোনো সাড়া পেলেন না। নানকু অবাক হয়ে নিচের খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। একবার বলল, “বড়কুমারসাব তো রাজবাড়িতে আছেন স্যার।” কিন্তু কর্নেল তাকে গ্রাহ্য করলেন না।
তারপর পেছনদিকে দরজা খোলার চাপা শব্দ হতেই করিডর দিয়ে এগিয়ে দেখেন বাঁদিকে একটা বারান্দা রয়েছে এবং সেই বারান্দা থেকে একটা লোক সবে নেমে যাচ্ছে। বারান্দার নিচেই বড়বড় পাথর এবং খানিকটা দূরে গঙ্গা। কর্নেল ছুটে গিয়ে ডাকলেন, “পরিতোষবাবু! পরিতোষবাবু!”
সে পাথরের স্তূপের আড়ালে লুকিয়ে গেল। তখন কর্নেল রিভলবার বের করে বারান্দা থেকে একলাফে একটা পাথরে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, “পালানোর চেষ্টা করলে গুলি ছুঁড়তে বাধ্য ইর পরিতোষবাবু!”
পরিতোষ গুঁড়ি মেরে তাড়াখাওয়া প্রাণীর মতো বসে ছিল। দাঁত বের করে উঠে দাঁড়াল। তারপর নমস্কার করে বলল, “পালাইনি স্যার, এখানকার বাথরুমটা ভেঙে গেছে। তাই”।
“আসুন। ঘরে গিয়ে বসি।”
পরিতোষ একটু ইতস্তত করে বারান্দায় ফিরে এল এবং ঘরে ঢুকল। কর্নেল ঘরে ঢুকে এদিকের দরজা বন্ধ করে দিলেন এবং করিডরের দিকের দরজাটা খুলে দিলেন। ঘরের ভেতর একটা তক্তাপোশে যেমন তেমন করে বিছানা পাতা রয়েছে। কয়েকটা ভাঙা বেতের চেয়ার আর একটা টেবিল রয়েছে একপাশে। পরিতোষ কোণঠাসা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কর্নেল নোংরা বিছানাটা সরিয়ে বসে বললেন, “বসুন পরিতোষবাবু।”
পরিতোষ বসে বলল, “আমাকে আপনি চেনেন স্যার?”
কর্নেল সে কথার জবাব না দিয়ে বললেন, “আপনার নামে তো পুলিশের হুলিয়া আছে।”
পরিতোষ মুখ নামিয়ে আঙুল খুঁটতে থাকল।
“নিখোঁজ বোনের খোঁজে কানাজোল এসেছিলেন আপনি। তারপর যখন জানতে পারলেন যে তাকে খুন করে লাশ লুকিয়ে রাখা হয়েছে, তখন কী উদ্দেশ্যে কানাজোলে থেকে গেলেন আপনি? উঁহু-আমিই বলছি। বোনের হত্যার প্রতিশোধ নিতে। কেমন? ঠিক বলছি তো?”
পরিতোষের হাত কাঁপছিল। মুখ তুলে আস্তে বলল, “আমি খারাপ। কিন্তু আমার বোন রমলা–” সে তোক গিলে ফের বলল, “রমলা ছিল খুব ভাল মেয়ে। সরল বলেই ভীষণ বোকা। আমার একমাত্র বোন কর্নেল! আমি চোর, মহাপাপী, কিন্তু রমলা তো পাপী ছিল না! তবুও কেন তাকে এমন করে মরতে হল?” পরিতোষ দুহাতে মুখ ঢেকে বসে রইল।
কর্নেল বললেন, “পরিতোষবাবু, বড়কুমার জয়াদিত্যের সঙ্গে আপনার কীভাবে পরিচয় হয়েছিল?”
পরিতোষ রুমাল বের করে চোখ মুছে বলল, “শরদিন্দু ব্যাংকে আমার কলিগ, সে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। আমি কমবয়স থেকেই মদ খাওয়া ধরেছিলাম। তাই ভেবেছিলাম রাজামহারাজা লোকের ছেলে জয়াদিত্য। তার সঙ্গে ভাব করলে বিনাপয়সায় রোজ মদ খাওয়া যাবে। তাই জয়কে প্রথম আলাপের দিনই বারে নিয়ে গিয়েছিলাম। শরদিন্দু মদ খাওয়া পছন্দ করত না। যাই হোক, জয় প্রথমদিকে মদের মজাটা পেয়ে গেল। সে নিজেই প্রোপোজ করল, পরদিন সব খরচ তার, এটাই নিয়ম। পরদিন কথামতো পার্কস্ট্রিটের সেই বারে গিয়ে দেখি জয় হাজির। তারপর থেকে সে রোজ সন্ধ্যা ছটায় বারে হাজির থাকতো। কিছুদিন পরে দুদিন সে এলো না। তখন শরদিন্দুর কাছে খোঁজ নিয়ে তার হোস্টেলে গেলুম। কিন্তু তখনও আমি জানি না ওরা যমজ ভাই–যদিও শরদিন্দু বা জয় বলে বিজয়ের কথা, কিন্তু ওরা বলেনি যে জয়। ও বিজয় যমজ ভাই। তাই হোস্টেলের গেটে জয় ভেবে যাকে বারে নিয়ে যাবার জন্য সাধছি, সে বিজয় তা জানতুম না। আপনি নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন, দুভাইয়ের গলার স্বর, হাবভাব প্রায় একইরকম–মেজাজ বা স্বভাবচরিত্র যা আলাদা। শুধু আলাদা নয়, উল্টো।”
“ঠিক তাই। তারপর?”
“বিজয় ব্যাপারটা ফস করে বলল, আপনি আমাকে জয় ভেবেছেন। জয়কে আপনিই তাহলে মদ ধরিয়েছেন। এইসব বলে বিজয় আমাকে খুব শাসাল। ব্যাপারটা শরদিন্দুকে বললে সে খুব হাসল। যাই হোক, তার দিনকতক পরেই সকালে জয় আমার বাসায় হাজির। আমার ঠিকানা সে শরদিন্দুর কাছে যোগাড় করেছে। সে বিজয়ের হয়ে ক্ষমা চাইলো। তাকে খুব খাতির করে বসালাম। রাজকুমার শুনে মা–তখন মা বেঁচে ছিলেন, একেবারে অস্থির। রমলার সঙ্গে আলাপ হল জয়ের। সেই শুরু। এবার বাকিটা বুঝে নিন।”
“বিজয় এম. এ.-তে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু জয় বি. এ. পাশ করে চলে এল কেন জানেন?”
পরিতোষ মুখ নামিয়ে বলল, “সঠিক জানি না। তবে যে জানত, সে তো আর বেঁচে নেই।”
“রমলা জানত?”
পরিতোষ গলা ঝেড়ে একটু কেসে বলল, “আমার ধারণা রমলাকে নিয়ে দুভাইয়ে মনোমালিন্য হয়েছিল। তবে জয় গোঁয়ার, “পাগলাটে স্বভাবের ছেলে।”
“রমলারও নিশ্চয় আপনার মতো ভুল হয়ে থাকবে কে জয় বিজয় না চিনতে পেরে?”
পরিতোষ আস্তে বলল, “হ্যাঁ। রমলার ভুল করা স্বাভাবিক। সেজন্য আমি রমলাকে সাবধান করে দিইনি, তা নয়। কিন্তু রমলা বড্ড বোকা ছিল বরাবর। খুব সেন্টিমেন্টালও ছিল সে।”
“কিন্তু আপনি কি মনে করেন, রমলা যদি বিজয়কেই জয় বলে ভুল করে, বিজয় কি সেই সুযোগ নেবে?”
পরিতোষ গম্ভীর হয়ে গেল। একটু পরে বলল, “বিজয়ের সঙ্গে আদৌ মিশিনি। কাজেই জানি না কেমন স্বভাবের ছেলে। তবে জয় বিজয়ের প্রশংসাই করেছে বরাবর। বিজয় খুব নীতিবাগীশ।”
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে কয়েকটা আলতো টান মেরে ধোঁয়া ছাড়লেন। তারপর বললেন, “আপনি বোনের হত্যার প্রতিশোধ নিতে এখনও কানাজোলে আছেন। কিন্তু আপনি কি জানেন, কে রমলাকে খুন করেছে?”
পরিতোষ গলার ভেতর বলল, “আমি খুঁজছি। এখনও বুঝতে পারছি না।”
“কাকে সন্দেহ বেশি?”
‘কমবেশির প্রশ্ন নয়, স্যার! আমার সন্দেহ এ বাড়ির সকলকেই।”
“জয়কেও?”
“হুউ।”
“বিজয়কে?”
“হুউ।”
কর্নেল বললেন, “জয় আপনাকে বলেনি তার, কাকে সন্দেহ?”
“জয় তো রমলাকে ভালবাসত।”
“বাসত বটে।”
“তাহলে রমলা তার কাছে এলে কেন সে তাকে খুন করবে?”
পরিতোষ চুপ করে রইল।
কর্নেল বললেন, “বলুন পরিতোষবাবু!”
পরিতোষ আস্তে বলল, “আপনার কথা আমি কাগজে প্রচুর পড়েছি। আমি জানি, আপনি একজন বিখ্যাত প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আপনাকে রাজবাড়িতে দেখে আমি মনে বল পেয়েছি স্যার। রমলাকে যেই খুন করুক, আপনি তাকে খুঁজে বের করবেন, আমি বিশ্বাস করি। দয়া করে আমার কাছে জানতে চাইবেন না আর।”
কর্নেল হাসলেন। “আমার কোনো অলৌকিক শক্তি নেই পরিতোষবাবু! আমি বাস্তব তথ্য থেকে যুক্তির সাহায্যে সিদ্ধান্তে আসি। আমি আপনার কাছে তথ্য চাইছি।”
পরিতোষ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, “জয় কলকাতা ছেড়ে যখন চলে আসে, তখন রমলা প্রেগন্যান্ট ছিল।”
“মাই গুডনেস!” কর্নেল সোজা হয়ে বসলেন।
“রমলা পেটের বাচ্চাটা নষ্ট করেনি। মা তাকে রাজি করাতে পারেনি। শেষে সেই শোকে মা মারা গেল। রমলাকে আমি ভীষণ স্নেহ করতুম। তাই আমি ওকে কিছু বলিনি।”
“তারপর কী হল, বলুন?”
“রমলার একটি মেয়ে হল নার্সিংহোমে। জয়কে চিঠি লিখলুম। জয় অপমানজনক ভাষায় জবাব দিল যে রমলার সন্তান তার নয়। এমন কি লিখল রমলাকে সে ঘৃণা করে।”
“তারপর?”
“তারপর আর কী! রমলা মেয়েকে মানুষ করতে লাগলো। রমলা স্টেনো টাইপিস্টের চাকরি পেয়েছিল। আলাদা বাসা নিয়ে থাকত।”
“রমলার মেয়ের এখন বয়স কত?”
“বছর আট-নয় হবে বোধ করি। ক্লাস ফোরে পড়ে।”
“এখন সে কোথায়?”
পরিতোষ এতক্ষণে সিগারেট ধরালো। কিছুক্ষণ সিগারেট টানার পর বলল, “আমার ভাগ্নীর ডাক নাম ছিল মিমি। আসল নাম জয়িতা। রমলা কেন এ নাম রেখেছিল, বুঝতে পারছেন তো?
“পারছি। মিমি এখন কোথায়?”
“মিমিকে বালিগঞ্জে একটা আবাসিক স্কুলে রেখেছিল রমলা। মাঝেমাঝে দেখে আসত। আমার নামে হুলিয়া। লুকিয়ে বেড়াচ্ছি। সম্প্রতি কলকাতা গিয়ে রমলার সঙ্গে দেখা করতে গেলুম। গিয়ে দেখি, তার ফ্ল্যাট তালাবন্ধ। পাশের ফ্ল্যাটে খোঁজ নিলুম। এক ভদ্রমহিলা বললেন, রমলা কদিন থেকে নেই। কোথায় গেছে বলে যায়নি। মিমিদের স্কুলে গেলুম। মিমি, আমাকে দেখে কাঁদতে শুরু করল। বলল, মাম্মি কেন আসছে না। তখন আমার সন্দেহ হল, কানাজোলে যায়নি তো? মিমির স্কুলে পরদিন থেকে পুজোর ছুটি শুরু হচ্ছে। সুপারিন্টেন্ডেন্ট মহিলা”
কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন, “মিমি আপনাকে চিনত?”
“হ্যাঁ। আমি ফেরারি হয়ে বেড়ালেও মাঝেমাঝে গিয়ে রমলা আর মিমির খোঁজ নিতুম। রমলার সঙ্গে বারকতক মিমিকে দেখতে গেছি। তাই সুপারিন্টেন্ডেন্ট মহিলা আমাকে চিনতেন। তবে জানতেন না আমি ফেরারি আসামি।” পরিতোষ থেমে আঙুল খুঁটতে থাকল।
”বেশ। বলুন।”
“ভদ্রমহিলা বললেন, “বরং মিমিকে নিয়ে যান। কাল থেকে হোস্টেল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ওর মা আজও এলেন না। আমি তো সমস্যায় পড়েছি কী করব ওকে নিয়ে।”
“আপনি মিমিকে নিয়ে এলেন?”
“হ্যাঁ। সোজা কানাজোলে চলে এলুম। রাজবাড়িতে বিপ্রদাসবাবুর সঙ্গে আলাপ হল। ওঁকে সব কথা বললুম। উনি প্রথমে তো পাত্তাই দিলেন না। তারপর জয়কে ডেকে পাঠালেন।”
“কোন তারিখে এবং কখন?”
“১২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টা-টাতটা হবে।”
“তারপর কী হল বলুন?”
“জয় এসে আমাকে দেখে চমকে গেল। তারপর মিমিকে কোলে তুলে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল।”
“একমিনিট।” বলে কর্নেল জানালার দিকে লক্ষ্য করে বললেন, “জয় আসছে। ও আসার আগে সংক্ষেপে বলুন।”
পরিতোষ রুমালে নাক ঝেড়ে বলল, “জয় মিমিকে কিছুতেই ছাড়বে না। কিন্তু বিপ্রদাসবাবু বললেন–কেন বললেন এখনও বুঝতে পারিনি, মিমিকে রাজবাড়িতে রাখা আপাতত ঠিক হবে না। ভাগলপুরে ওঁর বোনের কাছে কিছুদিন রেখে আসা ভাল। তখনও জানি না, রমলা খুন হয়েছে। তো জয় বিপ্রদাসবাবুর কথায় সায় দিল। তখনই বিপ্রদাসবাবু আমাকে আর মিমিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। আটটার ট্রেনে আমরা ভাগলপুর গেলুম। বিপ্রদাসবাবুর বোনের বাড়িতে রাত্তিরটা আমি থাকলুম। বিপ্রদাসবাবু সেই রাত্তিরেই ফিরে এলেন কানাজোল। মিমি ওখানেই থাকল। আমি পরদিন চলে এলুম-কানাজোলে। এই আউটহাউসে জয়ের সঙ্গে দেখা হল। তখন জয় বলল, ৯ তারিখে রমলা আসবে লিখেছিল। স্টেশনে তাকে থাকতে বলেছিল। কিন্তু স্টেশনে যেতে দেরি হয়ে যায়। তারপর রমলার কী হয়েছে, সে জানে না। শুনেই আমার বুকটা–”।
বাইরে জয়ের সাড়া পাওয়া গেল। সনি গরগর করে উঠল। জয় সোজা এসে ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল।
কর্নেল হাসলেন। “এস জয়। তুমি তো রমলার দাদার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দাওনি। তাই নিজে থেকেই পরিচয় করতে এসেছিলুম।”
জয় ভুরু কুঁচকে বলল, “আপনি কেমন ডিটেকটিভ মশাই, আপনার নাকের ডগায় আবার একটা খুনখারাপি হয় আর আপনি শুধু বকরবকর করে ঘুরে বেড়ান?”
কর্নেল মুহূর্তে শক্ত হয়ে বললেন, “মাধবজি খুন হয়েছেন কি?”
জয় বিকৃতস্বরে বলল, “আপনার মাথা! বিজয়টা একটা বুদ্বু। তাই কার পরামর্শে আপনার মতো একটা গবেট গোয়েন্দা ভাড়া করে এনেছে। যান, গিয়ে দেখুন কাকাবাবুর ঘরে কাকাবাবুর ডেডবডি পড়ে আছে। পচা গন্ধে অস্থির। আপনার নাকও নেই মশাই! কলাবতী টের না পেলে–”
কর্নেল সবেগে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।