Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পরিযায়ী || Buddhadeb Guha » Page 3

পরিযায়ী || Buddhadeb Guha

০৭.

রাতে ওরা খেতে বসেছিল।

পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে হুড-খোলা জিপে, সামনে উইণ্ডস্ক্রিনের কাচ বনেটের ওপরে নামিয়ে দিয়ে গেলে এপ্রিল মাসেও শীত লাগে। আর এখন তো অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহ। জঙ্গলে তো বটেই এমন উদলা-উদোম জিপেও তো ওরা অভ্যস্ত নয়। তাই হাড়-মজ্জার মধ্যেও শীত ঢুকে গেছে। হি-হি করছে ওরা শীতে। মনে হচ্ছে, ব্যানার্জিসাহেবের কন্যাদের রাফিংয়ের শখ বোধ হয় একরাতেই উবে যাবে। তবে কর্বুর তৈরি হয়েই গিয়েছিল। ব্যানার্জিসাহেবকেও সকন্যা তৈরি হয়েই আসতে বলেছিল কাকুর মাধ্যমে। তবুও তাঁরা একটি করে হালকা শাল নিয়ে এসেছেন শুধু। তার-ই অর্ধেক মাথায় জড়িয়ে আর বাকি অর্ধেক ঊর্ধ্বাঙ্গে পাক মেরে তাঁরা কোনোক্রমে প্রাণ বাঁচিয়েছেন।

নয়নতারা মেয়েদের পাছে সর্দি লাগে, তাই ফিরে এসেই গরম জলে একটি করে ভিএসওপি কনিয়াক গিলিয়ে দিয়েছেন তাদের। নিজেও পাতিয়ালা পেগ ঢেলে খেয়েছেন। জবরদস্ত পুরুষমানুষ।

মদ খেলেই কেউ জবরদস্ত পুরুষমানুষ হন না। তবে কিছু কিছু পুরুষ আছেন যাঁরা অন্যের ওপরে কোনো জবরদস্তি করেন না বলেই সহজেই বোঝা যায় যে, তাঁরা জবরদস্ত। ব্যানার্জিসাহেব নিজে কোনোই গরম জামা নিয়ে আসেননি। গলায় একটি সিল্কের স্কার্ফ। ফেডেড জিনসের টপ এবং ট্রাউজার তাঁর পরনে ছিল। মাথার আধখানাই টাক তাই মাথার ওপরে সাদা রঙা টুপি ছিল। তাও গলফ-খেলার টুপি–। গরম টুপি নয়। জিপে ওঠার আগে অবশ্য একটি ডাবল স্কচ মেরে গিয়েছিলেন। হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ভূত আমার পুত, পেতনি আমার ঝি, হুইস্কি-সোড়া পেটে আছে শীতে করবে কী? জন হেইগ-ই ওঁর প্রিয় স্কচ। থাকবেন তিনরাত কিন্তু পাছে অতিথ-বিতিথ আসে এবং কর্বুর বেশি খায়, তাই অ্যাজ আ মিজার অফ অ্যাবাডান্ট প্রিকশান, আধ কেস অর্থাৎ ছ-বোতল হুইস্কিই নিয়ে এসেছেন।

কর্বুর ওসব খায় না শুনে তিনি হতাশ হয়েছেন। বলেছেন, তুমি কী গো ছেলে! ইফ উই ডোন্ট ড্রিঙ্ক দেন হোয়াটস দ্যা পয়েন্ট ইন লিভিং?

কর্বুর হেসে বলেছিল, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ। আই হ্যাভ আ লট অফ আদার রিজনস ফর লিভিং।

দ্যাটস ভেরি গুড। তুমি অপছন্দ করো না তো, যাঁরা খান তাঁদের?

–বারে :, তা কেন করব? যে যাঁর নিজস্ব মতে চলবেন।

উনি বলেছিলেন, ফাইন। তুমি তো দেখছি সিগারেটও খাও না। কোনো নেশা নেই? বুড়োবয়সে তো তুমি রক্ষিতা রাখবে দেখছি। যৌবনের বেশি-ভালোরা প্রৌঢ়ত্বে এসে বেশি খারাপ হয়।

–কী হচ্ছে বাপি। তুমি ওঁর লোকাল গার্ডিয়ান, না উনি তোমার সমবয়েসি? তোমাকে নিয়ে সত্যিই চলে না। তুমি সত্যিই ইনকরিজিবল।

–সরি সরি। আই অ্যাপলোজাইজ। তুমি কিছু মনে করলে না তো ভায়া?

–না, না।

হেসে বলল কর্বুর।

ভাবল, পোটেনশিয়াল জামাইকে কেউ ভাই বলে এমন শোনেনি কখনো আগে।

তখনও কন্যারা ভীষণ-ই উত্তেজিত ছিল। তাদের বাবাও কম নন। রহমত চাচা আর চৌকিদার মিলে রান্না করেছে। ওরা সকলে খাবার টেবিলে এসে বসল খাবার ঘরে। মুচমুচে করে আটা ও ময়দা মেশানো পরোটা, ঝাল-ঝাল আলুর তরকারি, মেটে-চচ্চড়ি, মধ্যে টিনের আনারস দেওয়া, শুখা-শুখা বেগুন ভাজা এবং শেষে ফুটপুডিং।

মেনুটা অবশ্য কর্বুর-ই ঠিক করেছে। বাজারও করিয়েছিল। ওই-ই মেয়েদের জন্যে পেপসির বোতল এনেছে বড়ো বড়ো।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, পাঁঠার মাংস তো অনেক-ই আছে। কাল আমি দুপুরে তোমাদের হাঙ্গারিয়ান গুলাশ বেঁধে খাওয়াব।

-বেশ।

ঐশিকার শীত যেন তখনও কাটেনি। ওকে শীতে কষ্ট পেতে দেখে কর্বুরের শরীরে এক ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। কোনো যুবতী শীতে কষ্ট পাচ্ছে আর কোনো যুবক তা দেখেও তাকে উষ্ণ করে তোলার চেষ্টা করছে না, এই অবস্থাটা সেই পুরুষের পক্ষে বড়োই কষ্টকর। ওর ইচ্ছে করছিল ঐশিকাকে বুকের মধ্যে খুব জোরে জড়িয়ে ধরে, খুব করে চুমু খেয়ে দিয়ে তার দু-হাতের পাতা নিজের দু-হাতের পাতা দিয়ে ঘষে-ঘষে তাকে উষ্ণ করে তোলে। এমন যে, কখনো হতে পারে, তা আগে জানেনি কখনো। কর্বুর তার জাগতিকার্থে অসামাজিক, অতিপরিশীলিত, সুরুচিসম্পন্ন, বিদগ্ধ সত্তাকে নিয়ে অত্যন্তই গর্বিত ছিল এতগুলো বছর। কাকির ঘনিষ্ঠ সঙ্গ, তাদের টাটিঝারিয়ার নির্জন পরিবেশে মাঝে মাঝে শরীরের মধ্যে একরকম ছটফটানি যে, বোধ করেনি তা নয়, গরমের দুপুরে ধুলোবালির মধ্যে পুরুষ চড়াইয়ের ছটফটানির মতো, কিন্তু সেই আর্তি এমন তীব্র কোনোদিন-ই ছিল না।

পরিবেশ-ই কি এজন্যে দায়ী? হয়তো তাই। এই শারদরাতের শিশিরভেজা পাহাড়বেষ্টিত বনে, ঝিঁঝিদের একটানা ঝি-ঝি শব্দের মধ্যে বন থেকে ওঠা এক নিবাত নিষ্কম্প নিষিদ্ধ মিশ্রগন্ধের প্রতিবেশে ওরও শরীর বলে যে, একটি যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার আছে, যে ব্যাপারটিকে সে আবাল্য, অজানিতে অনবধানে বয়ে বেড়িয়েছে তার মঞ্জরিত সুগন্ধি মনের-ই সঙ্গে, সে কথা আজ এই ভরা-যৌবনের আতরগন্ধী শীতার্ত দূতাঁকে দেখে সে যেন হঠাৎ করেই বুঝতে পেরেছে। এবং পেরে অপ্রতিভ এবং লজ্জিতও হয়েছে।

পৃথু ঘোষ হয়তো ঠিক বলেছিল, একজন মানুষের মধ্যে অনেক-ই মানুষ থাকে। তার ভেতরের কোন মানুষটি যে, কখন কোন পরিবেশে এবং প্রতিবেশে হঠাৎ তার মগ্নসত্তার বাইরে বেরিয়ে এসে অন্য মানুষটিকে হকচকিয়ে দেয়, তা পূর্বমুহূর্তেও জানা থাকে না। মানুষ হয়ে জন্মানো এক মস্ত ব্যাপার। সব মানুষ-ই কি তাদের মনের মধ্যে এবং শরীরের মধ্যেরও এইসব মনুষ্যজনোচিত ক্রিয়া-বিক্রিয়া, ঘাত-প্রতিঘাত, ভয় ও বিস্ময়কে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে পারে? নাকি, জানোয়ারের-ই মতো ভক্ষণ-শয়ন-রমণের বৃত্তর মধ্যে জীবন কাটিয়েই চলে যায়, মানুষ হয়ে জন্মাবার ও বেঁচে থাকার আশ্চর্য সব পরস্পর-বিরোধী অনুভূতির শরিক না হয়েই?

কে জানে! সব প্রশ্নের উত্তর তো কর্বুরের কাছে নেই। সব প্রশ্নের উত্তর যার জানা আছে, সেই রবীন্দ্রনাথ বা ঐশিকার ভাষায়, রবে ঠাকরের গান অটো-রিভার্স কম্প্যাক্ট ডিস্কের-ই মতো কে যেন বাজিয়ে দিল তার বুকের মধ্যে। আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না, ফুরাবে না/সেই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা/কত জনম মরণেতে তোমায় এই চরণেতে/ আপনাকে যে দেব তবু বাড়বে দেনা/আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না।

তখনও ওরা খাবার টেবিলেই বসে। চৌকিদার এসে তার বহুদিনের পরিচিত কর্বুরকে বলল, কবু দাদা, আপনারা যখন ঘুমিয়ে থাকবেন তখন যদি সেই হাতিটা আসে বাংলোর পাশে, তখন ঘুম ভাঙিয়ে দেব কি?

–আমার ঘুম ভাঙিয়ো না। তবে মেমসাহেবকে ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ো। হাতি তো দেখতে পাননি ওঁরা। রাতের বেলা না দেখতে পেয়ে ভালোই হয়েছে। রাতে তাই হাতি এসে এঁদের দেখা দিয়ে গেলেই আমাদের মান থাকবে।

-দেখি দাদা। কালও তো এসেছিল। ব্যাটা রোজ এককাঁদি করে কলা বা অন্য যা কিছু পায় সাবড়ে দিয়ে যায় গুঁড়ে করে। নিতান্ত কলা-হারাম না হলে আজকেও এসে আমাদের ইজ্জত তো বাঁচানো উচিত।

ব্যানার্জিসাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কথাটা কী বলল চৌকিদার?

-কলা-হারাম।

কর্বুর বলল।

ওরা সকলে হেসে উঠলেন।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, সেন্স অফ হিউমার আছে।

–আচ্ছা ওই যে কাঠ-কয়লার আগুনের মতো লালচোখো পাখিগুলো জিপের চাকার-ই নীচে পড়ে, গেল গেল করতে করতেও জিপ তাদের চাপা দেওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে পথ থেকে প্রায় জিপের বনেট ফুড়ে সোজা উঠে ডান বা বাঁ-পাশের দুদিকে উড়ে যাচ্ছিল সেই কিম্ভুতুড়ে পাখিগুলোরনাম কী? ভারি সুন্দর লাগে কিন্তু ওদের লাল চোখগুলো।

গৈরিকা প্রশ্ন করল।

–হ্যাঁ তা লাগে। ওদের নাম নাইটজার। যদি বড়ো বাঘের সঙ্গে আমাদের দেখা হত তবে দেখতেন চোখ কতখানি ভূতুড়ে হতে পারে। অনেক-ই বড়ো বড়ো চোখ, তবে ঠিক নাইটজারের চোখের মতোই লাল। আর যখন মাথা ঘোরায় বাঘ, সেই আলো যেন কোনো অদৃশ্য পুরুষ এসে অন্ধকার দিয়ে মুছিয়ে দেন। নিভিয়ে দেন না কিন্তু। মুছিয়ে দেন। নিজের চোখে না দেখলে ঠিক বুঝতে পারবেন না।

–যে প্রকান্ড সাপটা আস্তে আস্তে পথ পেরোচ্ছিল তার তো কোনো ফণা ছিল না। ওটা কী সাপ?

ঐশিকা বলল।

তারপর বলল, মুখে যে কলুপ এঁটে থাকার অর্ডার দিয়েছিলেন, তাই তখন তো কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারিনি।

–সব সাপের তো ফণা থাকে না। যাদের থাকে, তারাও মানুষদের মধ্যে যাঁরা পন্ডিত, তাঁদের পান্ডিত্যের ফণার মতো সবসময়েই তো ফণা উঁচিয়ে থাকে না। তবে যে সাপটিকে আজ আমরা দেখলাম তাদের ফণা থাকেই না। সাপটা পাইথন। বাংলায় যার নাম অজগর।

–অ-য় অজগর আসছে তেড়ে। সেই অজগর?

গৈরিকা বলল।

–হ্যাঁ।

–একটা পাখি যে, ডাকল হার্ট-ফেইল করিয়ে দিয়ে দুরগুম-দুরগুম-দুরগুম শব্দ করে। নদীর ধারের ঘন বনের মধ্যে থেকে, সেটা কী হে?

–সেটা তো পেঁচা।

–পেঁচা? পেঁচা হতেই পারে না।

ঐশিকা বলল।

তারপর বলল, পেঁচার ডাক তো আমাদের জামশেদপুরের নীলডিতেও শুনতে পাওয়া যায়। যায় না বাপি?

-তা যায়।

-পেঁচা ডাকে কিচি-কিচি-কিচর-কিচি–কিচর। ঘুরে ঘুরে উড়ে ঝগড়া করে। আমাদের ওখানে কখনো-কখনো লক্ষ্মীপেঁচাও আসে। দুধসাদা। যাঁদের বাড়ি আসে, তাঁরা খুব খুশি হন। না?

কর্বুর বলল, তা ঠিক। কিন্তু যে, পেঁচার ডাক শুনলেন আজ বনের গভীর থেকে সে অলক্ষ্মী পেঁচা। ওইসব শহর-গ্রামের পেঁচাঁদের চেয়ে অনেক-ই বড়ো হয় দেখতে তারা। ওই পেঁচার নাম-ইকাল-পেঁচা। গভীর জঙ্গলের মধ্যে নিশুতি রাতে তারা যখন ডাকে তখন শুধু আপনাদের বুক কেন, অনেক সাহসীর বুক-ই দুরদুর করে ওঠে।

-আমরা কি ভীরু?

সাহস আর ভয় ব্যাপারটা আপেক্ষিক।

ঐশিকা বলল, বুরু মানে কী? সব নামের পেছনেই দেখছি একটা করে বুরু যোগ হয়।

কর্বুর হেসে বলল, বুরু মানে পাহাড়। কেউ কেউ আবার বলেন জঙ্গল। আমি ঠিক বলতে পারব না। কাকু যেমন কিরিবুরু থেকে বুরু বাদ দিয়েই শুধুই কিরি নাম রেখেছে ছেলের। গুয়াতে যে লোহার খাদান আছে ওগুলো স্টিল অথরিটি অফ ইণ্ডিয়া হওয়ার আগে সব ইণ্ডিয়ান আয়রন অ্যাণ্ড স্টিলের-ই, মানে ইসফোর ছিল। স্যার বীরেন মুখার্জির বাবা স্যার রাজেন মুখার্জির পত্তন করা। লোহা, ম্যাঙ্গানিজ এসব-ই সারফেস-মাইনস। অথবা ওপেন-কাস্টও বলে। কয়লা তামা বা অভ্রর খাদানের মতো মাটির নীচে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে তা তুলে আনতে হয় না। ধরুন বনম মানে উই ঢিপি। যে পাহাড়ে অনেক উইটিপি তার নাম বনম বুরু। হঞ্জর মানে হচ্ছে কুঁজ। যে পাহাড়ের ওপরে কুঁজের মতো একটি পাথর ঝুলে আছে। তার নাম হয়ে গেল হঞ্জর-বুরু। যে পাহাড়ে বনদেবতা বা মারাং থাকেন তার নাম মারাংবুরু। আমগাছকে মুণ্ডা ভাষায় বলে উলম। যে পাহাড়ে অনেক উইটিপি আর আমগাছও আছে তার নাম বনম-উলি-বুরু। বঙ্গসন্তানেরা সন্ধি করে তার নাম করে দিয়েছিলেন হয়তো বনমালিবুরু। এইসব ব্যাপার আর কী!

–এই সারাণ্ডার বনে বুঝি অনেকরকম আকর, মানে মিনারাল ওরস পাওয়া যায়?

গৈরিকা শুধোল।

-হ্যাঁ যায় তো। বিহারের সিংভূম খুব-ই বড়োলোক এ বাবদে। এইসব পাহাড়ের মৃত্তিকা-ত্বকে প্রচুর লাল-নীল-হলুদ-রঙা গুঁড়োর মতো আয়রন অক্সাইড আছে। আকরিক লোহাও আছে। গুয়া, নোয়ামুন্ডি, বাদামপাহাড় এইসব অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে লোহার আকর আর আয়রন অক্সাইড। ম্যাঙ্গানিজ আছে জামদা থেকে রাউরকেল্লার পথে কিছুটা গিয়ে বাঁদিকে জঙ্গলের বুক ফুড়ে চলে গেলে, ভুতরা মাইনস-এ। আছে, আমাদের ধুতরা মাইনস এ। তা ছাড়াও আরও অনেক খাদান আছে। ভুতরা মাইনস, ওড়িশা ম্যাঙ্গানিজ কোম্পানির খাদান। সেখানে কুড়ারি নদী বয়ে গেছে ছায়াচ্ছন্ন গিরিখাতের মাঝে মাঝে।

–মহলশুখার চিঠি বলে একটি বই পড়েছিলাম, তাতে মহলশুখা আর ভুতরা মাইনসের কথা আছে।

ঐশিকা বলল।

প্রকাশক কে?-

-আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড।

তারপর বলল, এদিকের নদী-নালাতে সোনাও পাওয়া যায়। মেয়েরা পাহাড়ের বুকে কোনো কোনো নির্জন জায়গায়, যেখানে নদী বয়ে যায় নিভৃতে, সেখানে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে সোনার চিকচিকে গুঁড়ো ছেঁকে তোলে।

-কেন? সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে কেন?

নিশ্চয়ই কোনো প্রথা আছে আদিবাসীদের। শুধু মেয়েরাই সেই সোনার গুঁড়ো ঘেঁকে তোলে। পুরুষদের সেখানে যাওয়া মানা।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, জায়গাটা জানো নাকি? চলো, ভায়া, তুমি-আমি চলে যাই।

ঐশিকা চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, বাবা! বিহেভ ইয়োরসেলফ।

–এদিকে মুণ্ডা, হো ছাড়া আর কোনো উপজাতি আছে?

–কোলেরাও আছে। বীরহোড়। কোলেরা গুয়ার কাছে একটি পাহাড়ের কোলে থাকে, তাই তাকে বলে কোল-টুংরি। লোহা খাদানের লাল-হলুদ মাটি এনে ওরা মাটির ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে ফুল, পাতা, নানা পশুপাখি, মেয়ে-মরদের সুন্দর সুন্দর সব ছবি আঁকে।

-সত্যি। আমাদের এই ট্রাইবাল-আর্টের কোনো তুলনা নেই।

গৈরিকা বলল।

লোহা, সোনা, ম্যাঙ্গানিজ ছাড়াও আছে সিসে, তামা, রুপো। এখানের নদীর মতো সুন্দর বহুবর্ণা নদীও পৃথিবীর খুব কম জায়গাতেই দেখতে পাওয়া যায়। দেখাব আপনাদের। দেখে গাইতে ইচ্ছে করবে, সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে।

একদিক দিয়ে এঁকেবেঁকে ঘন বনের মধ্যে দিয়ে ছিপছিপে লাল নদী এসে অন্যদিক থেকে আসা নীল নদীর সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। কোথাও বা হলুদ নদী মিলেছে সবুজ নদীর সঙ্গে। সে দৃশ্য দেখার মতো।

তারপর ও বলল, বড়োবিলে বড়োজামদাতে নানা ইনস্পেকশন কোম্পানির অফিস আছে। যেমন মিত্র. এস. কে. প্রাইভেট লিমিটেড, ব্রিগস কোম্পানি ইত্যাদি ইত্যাদি। এঁরা ল্যাবরেটরিতে বিভিন্ন ধাতুর আকর পরীক্ষা করে করে কোন আকরে কত শতাংশ আছে সেই ধাতু এবং তাদের অন্য গুণাগুণ কী, এইসব-ই যাচাই করে সার্টিফিকেট দেন। ওই সার্টিফিকেটকে মেনেই রপ্তানি ও আমদানিকারকরা ব্যাবসা করেন।

একসময়ে ওদের খাওয়া শেষ হল।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, এই জঙ্গলে এমন পুডিং, ভাবা যায় না।

গৈরিকা বলল, সত্যি। কিন্তু এবারে কি শয়নে পদ্মনাভ?

–বাংলোর পাশে ভিউপয়েন্টে গরমের রাত হলে গিয়ে বসতে পারতাম।

-তার চেয়ে কাল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উঠে জঙ্গলে কিছুদূর হেঁটে বেড়ালে খুব ভালো লাগবে।

ঐশিকা বলল।

–শরৎকালের সৌন্দর্য যে কী তা গ্রামের সৌন্দর্য যাঁরা জানেন তাঁরা জানেন, কিন্তু এই জঙ্গলের সৌন্দর্য একেবারেই অন্যরকম। অন্ধকার রাতের রূপও কিন্তু অন্যরকম। তা পুরুষের রূপ। আর চাঁদনি রাতের রূপ, নারীর রূপ।

বাবা : তুমি তো দেখছি কবি হে কবু।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন।

–আমরা তার প্রমাণ আগেই পেয়েছি।

ঐশিকা বলল।

কবু বলল, একটা কাজ করলে মন্দ হয় না।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, কী?

-কাল ভোরে উঠে, এককাপ করে চা খেয়ে টোয়েবু ফলস-এ যাওয়া যেতে পারে। সঙ্গে করে গ্যাসের ছোটোউনুন আর ব্রেকফাস্টের রসদ ওখানে নিয়ে গেলে ওখানে বসেই ব্রেকফাস্টও খাওয়া যেতে পারে। তারপর বাংলোতে ফিরে অথবা না-ফিরেও থলকোবাদ যাওয়া যেতে পারে। থলকোবাদ, টোয়েবু থেকে কাছেই।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, সেটা মন্দ হয় না।

তারপর বললেন, তোমরা তিনজনে যাও সকালে। ট্রান্সপোর্ট তো দুটি আছেই। আমি তোমাদের জন্যে সব বন্দোবস্ত করে মালপত্র নিয়ে গিয়ে পৌঁছোব সেখানে। কী যেন নাম। বললে ফলসটার? গোয়েবু?

-না টোয়েবু।

-হ্যাঁ। হ্যাঁ। টোয়েবু। জিনিসপত্রও সব গুছিয়ে নেব। চান-টানও সেরে নেব। যাতে ওখান থেকেই থলকোবাদ চলে যেতে পারি। তোমরা না হয় থলকোবাদে গিয়েই চান কোরো।

-কেন?

–এনজয় ইয়োরসেলভস।

–আমরা টোয়েবুতেও তো চান করতে পারি।

গৈরিকা বলল।

–তাও পারো। অ্যাজ ইউ লাইক ইট।

–ঠিক আছে। এ কি অফিস যাওয়া! যা মনে হবে, মানে সকালে উঠে যা করতে ভালো লাগবে তাই-ই করা যাবে। ছুটিতে এসেও এত আগে থাকতে সব ঠিক-ঠাক, এমন টাইট স্কেডিউল আমার ভালো লাগে না।

গৈরিকা বলল।

কর্বুর লক্ষ করল যে, Schedule-এর আমেরিকান উচ্চারণ করল গৈরিকা, স্কেডিউল। এই আমেরিকানরাই এতদিনের পৃথিবীব্যাপী ঐতিহ্যমন্ডিত ইংরেজি ভাষাটিকে কী বিকৃতই করে দিল। যাঁদের ঐতিহ্য থাকে না, অতীত থাকে না, নিজস্ব ভাষা থাকে না, তারাই গাজোয়ারি করে নিজেদের ঐতিহ্য তৈরি করতে চায়।

চেয়ার পেছনে ঠেলে উঠতে ঐশিকা বলল, আমার গা এখনও ছমছম করছে। রাতের জঙ্গলের মধ্যেই মনে হয় কত জীবজন্তু সব বুঝি গা-ঠাকা দিয়ে বসে রইল। দেখা হল না।

কর্বুর বলল, তাই-তো হয়। যতটুকু অদেখা থাকে, যতটুকু অন্ধকার, ততটুকু রহস্যে মোড়া থাকে। সেখানে কী আছে? তা জানার জন্যে মন আনচান করে। যেটুকু সহজে দেখা যায়, বা যা আলোকিত, তা তো সহজে দেখাই যায়।

–ঠিক তাই।

কর্বুর বলল।

-তাহলে গুডনাইট।

–গুডনাইট তো বটে কিন্তু আমাদের খুবই খারাপ লাগবে।

কর্বুর বলল, কেন?

–না। আপনি এই বসার ঘরের সোফাতে, আর আমরা ঘরে।

সোফাতে কেন? পা-তোলা চেয়ারে আরামে ঘুমোব কম্বল মুড়ি দিয়ে। আপনাদের পাহারাও দেওয়া হবে। আমি তো দারোয়ানি করতেই এসেছি।

যদি কোনো জানোয়ার বা সরীসৃপ অথবা চোর আসে তারাও সবাই ওই ড্রইংরুম দিয়েই ঢুকবে বলছেন!

ঐশিকার কথাতে সবাই হেসে উঠলেন একসঙ্গে।

ঘুমোবই যে, তার-ই বা কী মানে আছে? আমি তো জেগেও থাকতে পারি। আপনারাও জেগে থাকলে পারতেন। রাতের জঙ্গল থেকে কতরকম আওয়াজ ভেসে আসবে। শুনতেন বসে বসে। চোখ যখন দেখতে পায় না তখন কান-ই চোখ হয়ে যায়। আওয়াজ শুনেই বোঝা যায়, কোন জানোয়ার, কত দূরে, কী করছে বা সে কী দেখে ডাকছে?

গৈরিকা বলল, থাক। আমার ঘুম পাচ্ছে। জঙ্গলের সব-ই একদিনে শিখে ফেলতে গেলে একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। হজম হবে না। আমি চললাম শুতে। আপনাকে বালিশ দিয়েছে কি?

–আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যান। কোনো চিন্তা নেই।

কর্বুর বলল।

যেতে যেতে ফিরে দাঁড়িয়ে ঐশিকা বলল, আপনি কীরকম লোক যে, অন্য কারও সঙ্গে শুতে পারেন না? বাপির সঙ্গেও পারবেন না? তাহলে বিয়ে যখন করবেন তখন কী করবেন?

–আলাদা ঘরে শোব। বিয়ে করলেই যে, একই বিছানাতে এক মশারির তলাতে অন্যজনকে জাপটে-সাপটে প্রতিরাতে শুতেই হবে তার কী মানে আছে, জানি না আমি। আমি তো আমাদের ধুতরা খাদানের কাছে একটি জঙ্গলময় টিলা দেখেছি। তাতে মনোরম দুটি ছোটো সেলফ-কনটেইনড কটেজ বানাব। একটাতে আমি থাকব, অন্যটাতে বউ। মধ্যে একটা চাঁপা-রঙা টাইলের পথ থাকবে যোগসূত্র হিসেবে। তার দু-পাশে থাকবে পারিজাত আর স্থলপদ্মর গাছ। মিয়া-বিবির আলাদা আলাদা বাবুর্চি থাকবে। আলাদা খাস বেয়ারা। এবং আয়া। একদিন আমার বাড়ি বউকে নেমন্তন্ন করব, আর একদিন সে করবে আমাকে নিমন্ত্রণ।

-আপনার ঘরে আতরদানি থাকবে তো?

–কোনো যবন-কন্যাকে বিয়ে করলে, তাও থাকবে।

–সেটি তো হবে না। যবন-কন্যাকে বিয়ে করতে হলে তো আপনাকেও যবন হতে হবে। ধর্মান্তরিত না হলে তো বিয়ে হবে না। আপনার নাম হয়তো কর্বুর সেন থেকে হয়ে যাবে জনাব মুর্গমসল্লম খাঁ।

কর্বুর হেসে বলল, এটা যা বলেছেন! পৃথিবীতে আর কোনো ধর্মই বোধ হয় এমন জবরদস্তি করে না অন্যের ওপরে।

–সেইজন্যেই আপনার ওই লাইনে না-যাওয়াটাই সেফ হবে।

–তা ঠিক। নিজের মা-বাবার ধর্ম বিসর্জন দিয়ে বিয়ে করতে যাব কোন দুঃখে। দেশে স্বধর্মের মেয়ের কি অভাব পড়েছে?

–সেকথা ঠিক। দেশে সবকিছুর আকাল থাকলেও অনূঢ়া কন্যাদের গোন-গুনতি নেই। কী সম্মান-ই না দিলেন আমাদের। আমরা যেন গোরু-ছাগল। ভাবছেন তাই?

তারপর বলল, আপনি স্যার তাহলে আপনার সেই না-বাগানো বউদের স্বপ্নে কুঁদ হয়ে জেগে থাকুন, আমরা ঘুমোই গিয়ে। কলা-হারাম হাতিটা যদি আসে, আপনি সঙ্গে না থাকলে কিন্তু আমরা সাহস করে দেখতে যেতে পারব না।

–আমিই কি আপনাদের সাহস?-

-হ্যাঁ স্যার। তবে শুধুমাত্র কোনো কোনো ব্যাপারে।

ঐশিকা বলল।

বলেই, দুষ্টুমিভরা হাসি হেসে, ঘরে গিয়ে দুয়ার দিল। কর্বুরের মনে হল, ও যেন কর্বুরের মুখের ওপর-ই দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করে দিল। না-বন্ধ করলে, কর্বুর কি ওদের ঘরে যেত?

ভারি অসম্মানজনক ব্যাপার-স্যাপার!

কর্বুর ভাবল যে, সে অনবধানেই বড়ো তাড়াতাড়ি একটু বেশি মাখোমাখো হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা ডেঞ্জারাস। যদিও সব মেয়েই ডেঞ্জারাস। আরও প্রশ্রয় দিলেই মাথায় চড়ে বসবে। মা-কাকি-কাকুর পছন্দ হলেই যে, কর্বুরের ঐশিকাকে বিয়ে করতেই হবে তার কী মানে আছে! ঐশিকাও মনে হয়, তার সুন্দর তর্জনী আর বুড়ো আঙুলে টোকা মেরে আজ অবধি অনেক ছেলেকেই টাকা-কেন্নোর মতো ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেছে। কর্বুর নিজের ছোট্ট জগতেই সুখী ছিল। তার পক্ষে বড়োেজামদার শিখীই ভালো। ঘরোয়া মেয়ে। ঐশিকা তাকে পছন্দ করলেও তাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে সারাজীবন। তেমন অবস্থার কথা ভাবলেও আতঙ্ক হয়। অমন বোকামি কর্বুর করবেই না।

কলা-হারাম হাতিটা আসেনি কাল রাতে।

.

পুবের আকাশ ফর্সা হতেই রহমত চাচার কাছ থেকে চেয়ে দু-কাপ চা খেয়ে হাত-মুখ ধুয়ে কর্বুর বেরিয়ে পড়ল। সাহেব আর মিসি-বাবারা নিশ্চয়ই দেরি করে উঠবেন। ওঠামাত্র যাতে গরম জল পান হাত-মুখ ধোয়ার জন্যে এবং গরম চা-ও পান তার বন্দোবস্ত ঠিকঠাক করেই ও বেরোল দূরবিনটা গলায় ঝুলিয়ে। একসময়ে প্রায় প্রতিসপ্তাহেই আসত সারাণ্ডাতে। আজকাল কাজে-কর্মে এমনভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে যে, সময়ই পায় না। তার ওপর পুজোর দু মাস আগে থেকে তো নাটকের মহড়া নিয়েই ছিল এ বছরে।

মহড়া উপন্যাসটির লেখক হয়তো ঠিক-ই বলেছেন। আমাদের অধিকাংশ মানুষের জীবনটাই এক-একটা মহড়াই। মহড়া দিতে দিতেই জীবন শেষ। জীবনের নাটক খুব কম মানুষ-ই মঞ্চস্থ করতে পারেন। এই দুর্বুদ্ধিজীবীতে গিস-গিস করা দিনে, প্রকৃত বুদ্ধিজীবী তক্ষ রায়ের চরিত্রটা এঁকেছেন লেখক অসাধারণ। কুদর্শন তক্ষ রায়ের প্রেমে পড়ে গেছে কর্বুর।

মহড়া দিতে দিতেই শিখীকে কাছ থেকে জেনেছে কর্বুর। ভারি ভালো মেয়ে। নরম, লাজুক, ভালো গান গায় এবং দারুণ ভুনিখিচুড়ি আর কড়াইশুটির চপ রান্না করতে পারে। একেবারে তার চলে যাওয়া ঠাকুমার-ই মতো। জামশেদপুরের ঐশিকার সঙ্গে বড়োজামদার শিখীর অবশ্য তুলনাই চলে না। ঐশিকার ক্লাস অন্য। ও জন্মেছেই কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সি.ই. ও অ্যাণ্ড এম. ডি.-র স্ত্রী হওয়ার জন্যে। বড়োবিল-এর টাটিঝারিয়া আর ধুতরা খাদানের পাহাড়ের কটেজে ও আঁটবে না। ওর পটভূমির সঙ্গে শিখীর পটভূমির অনেক-ই তফাত আছে। ভবিষ্যতের তো আছেই। বিয়ের জন্য মা-বাবা-কাকু-কাকি অনবরত জোর দিচ্ছেন। নানা সেন্টিমেন্টাল কথাবার্তা বলছেন। তবে এ ব্যাপারে বলতে হয়, ওঁদের আক্কেলের অভাব আছে। কী করে ওঁরা ভাবতে পারলেন যে, ঐশিকার মতো মেয়ের এই বড়োবিল-এর খাদান-মালিক কর্বুরকে ভালো লাগবে। কর্বুর কোনো দিক দিয়েই ওর যোগ্য নয়।

যদিও বিয়ের বয়েস তার হয়েছে কিন্তু বিয়ে করলেই তো স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল সব। এলিজিবল, সচ্ছল ব্যাচেলার হিসেবে যেখানেই যায় সেখানেই যে, একটা আলাদা খাতির! সেসব আর থাকবে না। তার বাজারদরের জন্যেই নয়, কার না ভালো লাগে সমাজে তার চাহিদা যেন অব্যাহত থাকে তা দেখতে। বিয়ে-টিয়ে নিয়ে বিশেষ ভাবেওনি। নানা ভাবনা নিয়ে তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। বাবা-মা তাঁদের ছেলের ঘরের নাতি দেখতে অহেতুক উৎসুক হলেই যে, তাকে বিয়ে করতে হবে এক্ষুনি এবং জনক হতেই হবে এ কেমন কথা! আসলে সব মানুষ-ই স্বার্থপর। সন্তানেরা যেমন, তেমন অনেকক্ষেত্রে বাবা-মায়েরাও। নিজেদের ইচ্ছাপূরণের কথাই ভাবেন শুধু তাঁরা। অন্যের কথা ভাবেন না আদৌ।

কিছুটা গিয়েই ও আবার ফিরল। ভাবল, বাঁধের দিকে গিয়ে দেখে, কাল শেষদুপুরে যে, কটন-টিল-এর ঝাঁকটা এখানে নামল এসে, সংখ্যায় তারা কত?

কুমেডি বাংলোটা পেরিয়ে গেল। সেখানে ঘুম-ভাঙা কারওকেই দেখল না। ভালোই হল, ভাবল ও। তাও একা থাকা যাবে কিছুক্ষণ। জঙ্গলে এসে একা না থাকতে পারলে আসার কোনো মানেই হয় না।

বাঁধের পাশে পৌঁছে আশ্চর্য হল কর্বুর। একটি হাঁসও নেই। তারা হয়তো সকালের আলো-ফোঁটার আগেই চলে গেছে, নাকি কাল-ই বিকেলে গেছে, কে জানে! চারদিক শিশিরে ভিজে আছে। কোথাওই বসার জায়গা নেই। বাঁধের ওপারের জঙ্গল থেকে নানা পাখির মিশ্রস্বর ভেসে আসছে। এমন সময়ে ধনেশ ডাকল একটা। কুমডির আশপাশে আগে ধনেশ দেখেনি কখনো। ও ঝুলিয়ে-রাখা দূরবিনটা তুলে নিয়ে সেদিকে খুঁজতে লাগল পাখিটাকে। ধনেশ উঁচু গাছের ওপরের দিকের ডালে বসে থাকতে ভালোবাসে। চুপ করে থাকা ওদের কুষ্ঠিতে নেই। সব সময়েই হ্যাঁক হুক হুক করছে। নাক্সভমিকা গাছে বসতে ভালোবাসে ওরা। ওই গাছের ফলও খেতে ভালোবাসে। ওড়িশাতে ওই গাছগুলোকে বলে কুচিলা। আর কুচিলা খায় বলেই ওদের নাম সেখানে কুচিলা খাঁই।

দূরবিনটা নামাতে যাবে এমন সময়ে কে যেন পাশ থেকে হাত বাড়িয়ে সেটা নিতে চাইল। মুখে বলল, পাখি রইল বাঁ-দিকে আর স্যার দেখছেন ডানদিকে।

-তাই?

কর্বুর খুশি ঐশিকাকে দেখে।

-বলল, কখন ওঠা হল রাজকুমারীর?

–কী যে বলেন স্যার। আমি হলাম বাঁদি। রাজকুমার কেন যে, না বলে কয়ে বেরিয়ে এলেন তা বুঝলাম না। আপনি না আমাদের লোকাল গার্জেন!

–ঐশিকা ব্যানার্জির লোকাল গার্জেনি করি এতবড়ো ধৃষ্টতা কি আমার হতে পারে!

–কী পাখি ওটা? বিচ্ছিরি ডাক কিন্তু যাই-ই বলুন।

–ওদের বাংলা নাম বড়োকি ধনেশ। ইংরেজিতে বলে, দ্যা গ্রেটার ইণ্ডিয়ান হর্ন বিল। ওড়িয়া নাম, কুচিলা খাঁই।

–ছোটোও হয় বুঝি?

–হয় বই কী। সেগুলো অনেক-ই ছোটো হয়। ওড়িশাতে সেগুলোকে বলে ভালিয়া খাঁই।

-কেন?

–ভালিয়া বলে একরকমের ফল হয়। ওরা সেই ফল খেতে ভালোবাসে বলে।

–তাহলে কি বাপিকে আমরা গুলাশ খাঁই বলে ডাকতে পারি।

গুলাশ মানে?

–আরে বাপি কাল বলল না, আজ মটন দিয়ে হাঙ্গারিয়ান গুলাশ রান্না করবে থলকোবাদে গিয়ে।

কর্বুর হেসে ফেলল।

বলল, ব্যানার্জিসাহেব খুব খাদ্যরসিক আছেন। তাই না?

–শুধুই খাদ্যরসিক কেন, পানীয়-রসিক, জীবন-রসিক। আমার বাপি একজন এপিকিউরিয়ান। বাট হি ইজ আ গ্রেট গাই। আই অ্যাডোর হিম!

বলেই বলল, পাখিগুলোকে কাছ থেকে দেখব বলে এলাম, আর তারা গেল কোথায়? আমাকে বোধ হয় পছন্দ হয়নি। কখন গেল? আমাকে আসতে দেখেই!

আমিও তো ওদের দেখতেই এসেছিলাম। এসে দেখছি, চলে গেছে। কোনো বড়োজলাতে গিয়ে বসেছে হয়তো।

-মাইগ্রেটরি।

স্বগতোক্তি করল ঐশিকা।

তারপর-ই বলল, বাংলাটা যেন কী বলেছিলেন?

–পরিযায়ী।

–রাইট। পরিযান থেকে পরিযায়ী?

-আমি কি অত জানি! আমি তো ধানবাদের মাইনিং এঞ্জিনিয়ার। পাথর চিনি, আকর চিনি। আটারলি বেরসিক।

-তাই নাকি? কে বলে? আপনি আটারলি-বাটারলি-রসিক।

তারপর আবারও নিজের মনেই বলল, পরিযায়ী। পরিযায়ী। পরিযায়ী।

পরক্ষণেই হঠাৎ চমকে উঠে বলল, ওটা কী পাখি ডাকল? মেটালিক সাউণ্ড। মেটালিক এর বাংলা কী?

-মেটাল হচ্ছে ধাতু। মেটালিক হচ্ছে ধাতব।

–সত্যি! আই শুড বি অ্যাশেমড অফ মাইসেলফ।

বলেই বলল, আপনি আমাকে বাংলা পড়াবেন?

বাংলা পড়ানো শব্দ দুটি ধানবাদ মাইনিং স্কুলের গোপেন সামন্ত অন্য অর্থে ব্যবহার করত। কর্বুরের হাসি পেয়ে গেল। ঐশিকার মুখে শব্দ দুটি শুনে। কিন্তু হাসল না।

বলল, ওই পাখিটার নাম র‍্যাকেট-টেইলড ড্রঙ্গো। ফিঙে জাতীয় পাখি।

–পাখিটা যে গাছে বসে আছে সেটা কী গাছ?

–গামহার।–

-বাঃ, সুন্দর নাম তো।

-পাশের গাছটা কী গাছ?

–ওটা বিড়ো। বাংলাতে বলে পিয়াশাল।

–আর ওগুলো।

–ওগুলো সব শাল। সারাণ্ডা তো শালের জন্যেই বিখ্যাত।

–কোথায় একটু বসা যায় বলুন তো। সব জায়গাই তো এখনও ভিজে।

–নাই বা বসলেন।

-ওই ঝোপগুলো কীসের ঝোপ? কমলা কমলা ছোটো ছোটো ফুল ফুটেছে। বিচ্ছিরি গন্ধ কিন্তু ঝাড়গুলোতে এবং ফুলগুলোতেও।

–হ্যাঁ, তা ঠিক। ওগুলোর নাম Lantana, হিন্দিতে বলে পুটুস। গাড়োয়াল পাহাড়ে এদের-ই বলে লালটায়েন। জিম করবেট এবং অন্যান্য সাহেবদের মুখে Lantana শুনে থাকবে স্থানীয় মানুষরা, তার-ই অপভ্রংশ লালটায়েন।

-ফুলের বা গাছের-ই মতো পাখির নামও কি প্রদেশ ভেদে আলাদা আলাদা হয়ে যায়?

–যাবে না? আমাদের এই ভারতবর্ষ কত বড়ো দেশ। কত ভাষাভাষী, কত রাজ্য, কিন্তু সব মিলিয়ে আমরা এক-ই। এই বিরাটত্ব এবং মিলন-ই তো ভারতীয়ত্ব।বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান।

-আবার সাতসকালে জ্ঞান দিতে শুরু করলেন স্যার? বাপি তো আছেই। তার ওপরে আপনি। কিন্তু আপনার যা বয়েস তাতে তো আপনার অজ্ঞানাবস্থাই থাকা উচিত এখনও। এত জ্ঞান, আসে কোত্থেকে বলুন তো স্যার?

-জ্ঞান কি আর হেলিকপ্টার থেকে পড়ে ম্যাডাম? জ্ঞান পড়াশুনো এবং অভিজ্ঞতা দিয়ে অর্জন করতে হয়। অনেক-ই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

–আপনার মধ্যে যতখানি জায়গা আছে তা জ্ঞানে ভরতি হয়ে গেলে কী হবে? আপনি কি বেলুনের মতো ফেটে যাবেন? না, কলসির জলের মতো সে জ্ঞান উপচে পড়ে যাবে। না, পথে-প্রান্তরে পড়ে নষ্ট হবে?

-জানি না। কালকে যে গানটা শোনাবেন বললেন, সেটা শোনান না।

–কোনটা?

-ওই যে Savaging The Civilized বইটির মধ্যে যে, গানটি লেখা ছিল সেটা।

–ছিঃ। আপনি তো ভারি নিষ্ঠুর। একজন ভালোবেসে একটা গানের কলি লিখে প্রেম নিবেদন করল, আর সেই গান আপনি অন্যের মুখে শুনতে চাইছেন? তার মুখেই শুনবেন। গান তো রূপমতী চমৎকার গায়। এবার থেকে শিখীকে রূপমতী বলেই ডাকবেন।

–সে আমি বুঝব।

সামান্য বিরক্তির গলাতে বলল, কর্বুর।

–না তো কি আমি বুঝব? আপনার পাঁঠা আপনি ল্যাজে কাটবেন না মাথায়, তাতে আমার কী?

–বড়োবাজে কথা বলেন আপনি। বেচারি আপনার কী ক্ষতি করেছে যে, তার পেছনে লেগেছেন?

-ওমা! আমি ক্ষতি করতে যাব কেন? আমি তো তার অ্যাডমায়রার হয়ে গেছি, যেমনি হয়েছি আপনারও।

–এত অ্যাডমিরেশানের বন্যা কেন?

–কী করব স্যার। অব্যেশ।

আবার স-কে ইচ্ছে করে শ বলল ঐশিকা।

-আপনার বাপি আদরে আদরে আপনাকে এক্কেবারে গোবর করেছেন।

–আমাকে গোবর করেছেন। জানি তো! এককথা আর কতবার বলবেন স্যার। তার চেয়ে এইটা শুনুন। ভৈরবীতে বাঁধা।

একটু চুপ করে থেকে বলল, নিধুবাবুর নাম শুনেছেন? না শুনে থাকলে, রূপমতাঁকে জিজ্ঞেস করবেন, বলে দেবে। সে অবশ্যই শুনেছে। আপনাকে দেওয়া বইটিতে কী করে কলঙ্কে যদি গানটা লিখেছেন যিনি। তাঁর-ই লেখা গান।

–আমি জানি।

–কী জানেন?

–নিধুবাবুর নাম। রামনিধি গুপ্ত তো!

–সত্যি! আপনাকে যতই দেখছি স্যার ততই অবাক হচ্ছি।

–কেন?

সামান্য বিরক্তির গলাতে বলল, কর্বুর।

–আপনি কী যে জানেন না! মানে কোন বিষয়ে আপনার জ্ঞান নেই? আপনি তো। সব্যসাচী।

–তার মানে? আমি সবজান্তা বলছেন?

–সবজান্তা শব্দটা প্রশংসাসূচক নয়। বরং বলা যাক আপনি সর্বজ্ঞ।

–গানটা গাইবেন কি?

–গাইছি।

বলেই, ঐশিকা ধরে দিল : প্রণয় পরম রত্ন, যত্ন করে রেখো তারে/বিচ্ছেদ তস্করে আসি, যেন কোনও রূপে নাহি হরে/অনেক প্রতিবাদী তার হারালে আর পাওয়া ভার/কখন যে সে হয় কার, কে বা বলিতে পারে/প্রণয় পরম রত্ন, যত্ন করে রেখো তারে।

অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকল কর্বুর। নিধুবাবুর এটি একটি বিখ্যাত গান। ভৈরবীতে বাঁধা। শরতের সকালবেলার রোদ, শিশিরভেজা সুগন্ধি গাছপালার গন্ধের মধ্যে কারও নদীর পাশে দাঁড়িয়ে গাওয়া সেই ভৈরবীর সুর যেন, এই বনভূমির সকালের সব রন্ধ্র ভরে দিল।

এই গানটি কর্বুর শিখীর গলাতেও শুনেছিল। কিন্তু শিখীর গলা ঐশিকার গলার সঙ্গে আদৌ তুলনীয় নয়। ঐশিকার গলা তো নয়, যেন কোকিল কথা বলছে। সুরে একেবারে ভরপুর। কলকাতার আনন্দবাজারের প. ব.-র ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, সুরঋদ্ধ। তার ওপরে গানের ভাব, গানের বাণীর প্রতিটি শব্দ যেন প্রাণ পেল ঐশিকার গায়কির-ই জন্যে।

কর্বুরকে চুপ করে থাকতে দেখে ঐশিকা বলল, নিজে থেকেই জোর করে গান শোনালাম স্যার, ভদ্রতা করেও তো মানুষে কিছু একটা বলে বানিয়ে বানিয়েও। তাও বললেন না। আচ্ছা, বিয়ে করতে আসা জামাইকে দেখে, সে যতই হতকুচ্ছিৎ হোক না কেন, অথবা কারও গান শুনে, সে গায়িকা যতই খারাপ গান করুক না কেন, আজ অবধি কেউই কি কখনো খারাপ বলেছে? আপনি কী নিষ্ঠুর মানুষ স্যার।

তুমি তো গান গাইলেই পারতে।

কর্বুর, ঐশিকার ছদ্ম-বিনয় ছেঁটে দিয়ে বিস্ময়াভিভূত গলায় বলল।

-তুমি বলে ফেলেই লজ্জিত হল কর্বুর। বলল, সরি, মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। তবে গুণপনাতে বড়ো হলেও বয়সে তো আমার চেয়ে ছোটোই আপনি!

চোখ বড়ো বড়ো করে ভর্ৎসনার স্বরে ঐশিকা বলল, খুব-ই অন্যায় হয়েছে। গুণপনাতে গুরুজনকে তুমি বলে কেউ কখনো? তা ছাড়া, আমার বয়স কত তা আপনি জানলেন কী করে।

তারপর-ই বলল, আচ্ছা স্যার! আপনি এতক্ষণ আপনি চালিয়ে গেলেন কী করে? অসীম আপনার ক্ষমতা। ঐশী ক্ষমতা। আপনি ইচ্ছে করলে লালুপ্রসাদ যাদব হতে পারতেন। আমার তো দমবন্ধ হয়ে আসছিল প্রথম থেকেই। আপনি সত্যিই প্রি-হিস্টরিক।

–এসব কথা থাক। তুমি এমন গান গাও, তো গানকেই প্রফেশন কেন করলে না?

–কোনো কিছুকেই প্রফেশন করা কি অত সোজা আজকাল স্যার? দলে না ভিড়তে পারলে, গোরু-ছাগলের মতো যূথবদ্ধ হয়ে গায়ে-গা ঘষতে না পারলে, আজকাল কিছুই হয় না। প্রকৃত গুণীরা এখন তাঁদের অভিমান নিয়ে বাড়িতেই বসে থাকেন আর ভূশন্ডীর মাঠের ভূত-পেতনিরা চারধারে হুলা-হুঁলা, হনু-হনু নৃত্য করে বেড়ায়। দলে-বলে যারা আছে, তারাই আজকাল সব পেয়েছির দেশের বাসিন্দা। রসে-বশে দিন কাটায়।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, ক্ল্যাসিকাল গানের কথা হয়তো আলাদা। অন্য অধিকাংশ গানের-ই এখন জনগণায়ন হয়ে গেছে। গণতান্ত্রিক শিল্পী সংঘর মাধ্যমেই আপনাকে পা ফেলতে হবে, নইলেই পদস্খলন। নিজেকে অত নীচে টেনে নামাতে রুচিতে বাধে। তেমন শিক্ষাও তো পাইনি। তাই অনেকরকম কষ্ট করেও, বাপিকে একা ফেলে রেখেও দু-বোনে বাইরে বাইরে পড়াশুনো করেছি। আজকাল স্বাবলম্বী না হলে তো চলে না। আমার মনে হয়, মহারাজকে বিয়ে করলেও সে মেয়ের স্বাবলম্বী হয়েই করা উচিত। ভালোবাসাটা, আদরটা, উপরি পাওনা। কিন্তু নিজের খাওয়া-পরাটার বন্দোবস্ত, নিজের স্বেচ্ছার্জিত রোজগারেই করা উচিত। মানে, তেমন প্রয়োজনে যেন করা যায়, সে সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া উচিত।

গৃহবধূ হয়ে থাকা বলছ কোনো শিক্ষিত মেয়ের পক্ষেই আজকাল সম্ভব নয়?

–সম্ভব নয় কেন? আমার বা আমার দিদির চেয়েও অনেক বেশি শিক্ষিত লক্ষ লক্ষ মেয়ে কি গৃহবধু হয়ে নেই? অবশ্যই আছে। এবং তারা সুখেই আছে। হয়তো অনেক সম্মানেও আছে। কিন্তু আমরা বড়ো ভয় পাই। আপনারা পুরুষেরা যে, অনেক বছর আমাদের খেলনার মতো ব্যবহার করেছেন। পরাশ্রয়ী স্বর্ণলতাকে আঁকশি বাড়ালেই পেড়ে ফেলা যায়। সে নিজে তো গাছ নয়, লতা নয়, তার নিজের তো কোনো শিকড় নেই। নিরাপত্তার বোধটা বড়োবেশি বিঘ্নিত হয় তাতে। সেটা কোনো দম্পতির সুস্থ দাম্পত্যর পক্ষেও প্রার্থনার নয়।

–বা : তুমি তো বাংলাটাও ভালো ভালো শব্দ দিয়ে গেঁথে বলতে পারো।

–পারি না কিছুই। তবে পারা উচিত ছিল। আমাদের বাপি, আমাদের যা শেখাতে চেয়েছিল তার পাঁচ ভাগও শেখা হয়নি আমাদের। বাপিই শিশুকাল থেকে শিখিয়েছিল যে, যাই করো না কেন জীবনে, একনম্বর হওয়ার সাধনা করো। দু-নম্বর হয়ে বাঁচা আর না বাঁচাতে কোনো তফাত নেই। বাপি বলত, মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন।

-আশ্চর্য। আমার বাবাও ঠিক এই কথাই বলেন।

এমন সময়ে গৈরিকা আর ব্যানার্জিসাহেবকেও আসতে দেখা গেল। সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি পরে শুয়েছিলেন উনি। তার-ই ওপরে ফেডেড জিনসের টপটা চাপিয়ে নিয়েছেন। আধ-টেকো মাথাতে টুপি। ভদ্রলোক একেবারে ওরিজিনাল মানুষ। কোনো বাহ্যিক ভড়ং নেই, যদিও থাকলে মানিয়ে যেতে পারত। গৈরিকার গায়ে হালকা খয়েরি রঙা শাল। ওঁরা নীচে নামলেন না। কিছুটা এসেই দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন ব্যানার্জিসাহেব, ওগো কবু? গোয়েবু ফলস-এ যাওয়ার কী হল?

ঐশিকা বলল, গোয়েবু না বাপি টোয়েবু।

-সেটা মন্দ বলিসনি। গৈরিকা গলা তুলে দূর থেকেই বলল, কী রে ওই। তোর শীত-টিত করছে না? শালটাও নিয়ে এলি না!

ঐশিকা ফিসফিস করে বলল, কর্বুরকে, আপনাকে কী অপমান। এরকম উষ্ণ পুরুষের কাছে থাকলে কি কোনো মেয়ের শীত লাগা উচিত? আপনিই বলুন?

–আমাকে বা আপনি করে বলা কেন?

গৈরিকা আবার চেঁচিয়ে বলল, আপনার কলা-খেকো হাতি তো আপনাকে ডিসওবলাইজ করল মশাই। উঠে আসুন। হাতি তো দেখাতে পারলেন না কিন্তু প্রোগ্রাম তো ঠিক করতে হবে।

-তাই তো দেখছি। চেঁচিয়ে বলল কর্বুর।

ওঁরা বেশ দূরেই ছিলেন।

ভালো শুনতে না পেয়ে কর্বুর বলল, মানে?

-মানে, ডিসওবলাইজ করল।

কে?

-কে আবার?

–হাতি।

ঐশিকাকে বলল, চলো। যাওয়া যাক।

–দিদিটা সারাজীবন আমার সঙ্গে শত্রুতা করে গেল।

–কেন একথা বলছ?

–বলব না? আমরা যে, একটু একা গল্প করছি তা সহ্য হল না।

ঐশিকার মুখে ওই বাক্যটি শুনে এক অনাবিল আনন্দে কর্বুরের মন ভরে গেল। প্রাপ্তিটার রকম না জেনেই খুশিতে ডগমগ হল।

–তোমাকে আমি ওই বলেই ডাকব, গৈরিকার মতন-ই।

–ওই যাঃ-ও বলতে পারতেন।

ঐশিকার রসবোধে নতুন করে নিশ্চিন্ত হল কর্বুর।

ওপরে উঠতেই ব্যানার্জিসাহেব বললেন, ব্রেকফাস্টে কী খাবে ভাই কবু? আমি ভাবছি, অরেঞ্জ জুস। তারপর কষে প্যাঁজ আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে ডাবল-ডিম-এর ওমলেট, সঙ্গে বেকন ভাজা, উইথ মাস্টার্ড। নিয়ে এসেছি তো আমরা সঙ্গে করে। ঠাণ্ডাতে খারাপ হবে না। রুটিও তো তুমি এনেছ। তবে আর কী! ক্রিসপ টোস্ট, উইথ অরেঞ্জ মার্মালেড। আর কিছু কি তুমি সাজেস্ট করছ? বড়োজামদার দোকানের কড়াপাকের সন্দেশও আছে। এতেই চলে যাবে? কী বলছ তুমি?

–বাপি, আমরা কি এখানে খেতেই এসেছি?

-সেটা মন্দ বলিসনি। তবে খেতেও তো এসেছি এবং খাওয়াতেও। ছেলেটাকে তোরা তো দেখাশোনাই করছিস না। তা আমার তো কিছু করতে হয়।

–ছেলেটা কি কিণ্ডারগার্টেনের ছাত্র বাপি?

গৈরিকা বলল।

সকলে জোরে একসঙ্গে হেসে উঠল সেই কথায়। সকালের শিশিরভেজা বনপথে আর শরতের জঙ্গলে সেই হাসির অনুরণন উঠল। কতকগুলো ব্যাবলার উচ্চকিত হাসিতে ভয় পেয়ে ছিঃ ছিঃ ছিঃ। করতে করতে দল বেঁধে উড়ে চলে গেল। ডানদিক থেকে বাঁ দিকের জঙ্গলে।

ঐশিকা বলল, কর্বুরকে। আচ্ছা, পাখিগুলো কি ব্রাহ্ম?

কর্বুর অবাক হয়ে বলল কেন?

–না। আমরা দাঁত দেখিয়ে মুখ হাঁ করে হেসেছি বলে হয়তো বিরক্তিতে ছিঃ ছি : করতে করতে চলে গেল।

গৈরিকা বলল, ভালো হচ্ছে না কিন্তু ওই।

–ওই যা।

বলল, ঐশিকা।

তারপর গৈরিকাকে শুনিয়েই বলল, মিস্টার ব্ৰহ্মকৃপা দাস ব্রাহ্ম।

–তিনি কে?

–দিদির হবু স্বামী। হবুই বা বলি কেন, বলি গবু। রেজিস্ট্রি তো হয়েই গেছে।

ওরা দুজনে হেঁটে পথে উঠে ব্যানার্জিসাহেবের সঙ্গে বাংলোতে পৌঁছোল। গৈরিকা এল পেছন পেছন। ঐশিকার ওপরে একটু বিরক্ত হয়েছে বলে মনে হল। সম্ভবত আনন্দের আতিশয্যে ঐশিকা একটু বাড়াবাড়িও করে ফেলেছিল। পরে দু-বোনে বুঝে নেবেখন।

ভাবল, কর্বুর।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, খাওয়া, ক-দিন জঙ্গল দেখা সব-ই মিলিয়ে-মিশিয়ে করতে হবে ততা! প্রত্যেক ক্রিয়া-কর্মকে ওয়াটারটাইট কম্পার্টমেন্টে বদ্ধ করে রাখলে কী করে হবে। এটার সঙ্গে ওটা, ওটার সঙ্গে সেটা, তবে না মজা!

বলেই বললেন, তুমি কী বলো ভায়া কবু?

-একদম-ই ঠিক বলেছেন আপনি!

-দেখেছিস! দ্যাখ তোরা। তোরা তোদের বাড়াবাড়িতে আনন্দটাকেও কর্তব্য করে তুলিস। এইখানেই আমার আপত্তি। নিয়মানুবর্তিতা খুব বড়োগুণ। কিন্তু আমেরিকান প্যাকেজ ট্যুর বেড়োতে-আসা ট্যুরিস্টরা যেমন বেড়ানো কাকে বলে তার কিছুমাত্রই জানে না, তোরাও তা জানিস না। আরে নিয়ম ভাঙাটাই তো হচ্ছে ছুটির মূলমন্ত্র। এই সরল সত্যটা বোঝে কজনে?

–বাঃ। ভারি চমৎকার করে বললেন কিন্তু আপনি। আমার মনের কথাটি বলেছেন। ডায়েরিতে লিখে রাখব।

.

০৮.

ওরা চানটান সেরে ব্রেকফাস্ট করেই বেরিয়েছিল কুমডি থেকে। টোয়েবু ফলস থলকোবাদ থেকে পাঁচ কিমি। আর থলকোবাদ কুমডি থেকে চল্লিশ কিমি। থলকোবাদ থেকে সিমলিপালেও যাওয়া যায়। হাটগামারিয়া তেতাল্লিশ কিমি থলকোবাদ থেকে।

ওরা মানে, ওরাই। রহমত এবং বিহারি জিপটা নিয়ে সোজা চলে যাবে থলকোবাদে। গিয়ে রান্নাবান্নার বন্দোবস্ত করবে।

থলকোবাদ বাংলোতে কুমডির চেয়েও বেশি অরণ্যপ্রেমী আসেন কারণ থলকোবাদের টাওয়ারটি ভালো। বাংলোটিও পাহাড়চুড়োয়। তবে বন্যপ্রাণী দেখতে হলে সবচেয়ে সুবিধে প্রখর গ্রীষ্মে আসা। কষ্ট খুব-ই হয় তখন। অসুস্থ হয়ে পড়ার আশঙ্কাও থাকে কিন্তু তখন পর্ণমোচী বনের অধিকাংশ পাতা ঝরে যাওয়ায় নজর চলে বহুদূর অবধি। আর বন্যপ্রাণীরা যেখানে জল থাকে তার আশপাশেই থাকে তখন। জলপান করার জন্যে যেমন, তেমন গরমের হাত থেকে বাঁচার জন্যে জলে গা-ডুবিয়ে থাকার জন্যেও। বর্ষার পর থেকে জঙ্গলের মধ্যে অনেক জায়গাতেই প্রায় জল থাকে, তাই প্রাণীরাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে।

সাড়ে এগারোটা বাজে, এমন সময়ে ওরা গিয়ে পৌঁছোল।

–এই আপনার টোয়েবু ফলস?

গৈরিকা বলল, ফলস-এর সামনে দাঁড়িয়ে।

-কেন? পছন্দ হল না।

–নাঃ ফলস দিলেন।

গৈরিকা হেসে বলল।

–এই দেখার জন্যে না এলেও হত। তার চেয়ে বনের মধ্যে কোথাও দাঁড়িয়ে বা বসে আপনার জ্ঞান অথবা গান শোনা যেত। তাতে আমাদের জ্ঞান বাড়ত। প্রাণ স্নিগ্ধ হত।

গৈরিকা বলল, সত্যি! আপনার গান তো শোনাই হল না। শোনান এক্ষুনি।

-লাঞ্চ-এর আগে হাতে অনেক-ই সময় আছে। এখন কবু যা দেখাতে নিয়ে এল তোদের আদর করে, তাই দেখ। গান বরং পরে শুনিস।

বলেই বললেন, যাই বলো কবু, ভদকা খাওয়ার এমন জায়গা আর হয় না। ওই–যা তো মা, গাড়ি থেকে ভদকার আর জলের বোতলটা নিয়ে আয়।

আমিই এনে দিচ্ছি।

কবু বলল।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, সেটা মন্দ নয়।

–ফার্স্ট ক্লাস। তোমার মতো যদি জামাই থাকত একটা আমার। সব দুঃখহরণ করতে পারত।

কবু ওঁর ভদকা আর জলের বোতল এবং গ্লাস নিয়ে এল। বিহারি সব-ই বেতের বাক্সে প্যাক করে দিয়েছে।

-বা-ব্বা! ব্ৰহ্মকৃপা পেয়েছ, তাতেও তোমার দুঃখহরণ হচ্ছে না।

ঐশিকা বলল, রাগ দেখিয়ে।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, শুধু ব্ৰহ্মকৃপাতে কি আমার মতো পাপী তরবে রে মা। যিশুখ্রিস্ট, মা কালী সকলের কৃপাই আমার দরকার। তাই তো এখন মা কালীর সেবায় লাগব।

-মানে?

–মানে ভদকা খাব।

–পৃথিবীর কোন কোন জলপ্রপাত দেখেছ তুমি কবু? স্টেটস আর কানাডার সীমান্তে নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখেছ?

কর্বুর বলল, আমি কখনো দেশের বাইরেই যাইনি। একবার শুধু বাংলাদেশে গেছিলাম। যদিও বাংলাদেশকে বিদেশ বলা যায় অবশ্য। আমার নিজের দেশ-ই এতবড়ো ও এত সুন্দর যে, আগে স্বদেশ-ই ভালো করে দেখি। তারপরে বিদেশে যাব।

–এটা তুমি ঠিক বললে না, হরিশরণ।

–কী বলছ বাবা কাকে? উনি তো কর্বুর।

-ইয়েস। ইয়েস। ভুল হয়ে গেছে। স্মিরনফ ভদকাটা বড় কড়া! শ্বশুরের নামও ভুলিয়ে দেয়। সরি, হরিশরণ, আই মিন কর্বুর। তারপর বললেন, ট্রাভেলিং ইজ এডুকেশন। নিজের দেশকে ভালোবাসতে হলে, নিজের দেশের কীভাবে উপকার করা যায়, তা জানতে হলে বিদেশ অবশ্যই দেখা দরকার। না দেখলে, তুলনা করবে কী করে। বিদেশ না দেখলে নিজের দেশকেই পৃথিবী বলে ভুল করাও অসম্ভব নয়। সেইজন্যেই প্রত্যেক শিক্ষিত মানুষের পক্ষেই বিদেশ দেখাটা খুব জরুরি।

–যাব কখনো। সময় হয়নি। তাগিদও হয়নি।

–যেয়ো এখন। তাড়া কীসের? অঢেল সময় পড়ে আছে। তুমি তো ছেলেমানুষ!

–হ্যাঁ। কিণ্ডারগার্টেনের ছাত্র।

ঐশিকা বলল এবার।

কর্বুর তাকাল খুনশুটি করা ঐশিকার দিকে। মুখে কিছুই বলল না।

ঝরনার ঝরঝরানি শব্দ, হাওয়া-লাগা, গাছপালার ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে এসে পড়া শরতের সোনালি রোদের ঝিলিমিলির মধ্যে পনিটেইল করা ঐশিকাকে দারুণ দেখাচ্ছিল। কারও চুলের মধ্যে এতখানি যৌনতা থাকতে পারে তা আগে কখনো জানেনি কর্বুর। তার ওপর আতরের গন্ধ। ঝরনার স্রোতে ঝরাপাতা হয়ে খুশিতে ভেসে যেতে ইচ্ছে করছিল ওর।

গৈরিকা বলল, কুমড়ি দেখলাম, তারপর থলকোবাদে যাব। আর কোন কোন বনবাংলো আছে সারাণ্ডাতে?

এমন সময় ঐশিকা আঙুল দিয়ে একটি ঝোঁপের দিকে দেখিয়ে কর্বুরকে বলল, ওগুলো কী ফুল স্যার?

-কোনগুলো? ওগুলো তো…

–না, না। ওগুলো নয়, বাঁ-দিকে, আরও বাঁ-দিকে দেখুন। আমার আঙুল দেখুন। আজকে ঐশিকা মরচে-রঙা জিনস পরেছে, গায়ে মরচে-রঙা শাল। মরচে-রঙা স্পোর্টস গেঞ্জির ওপরে। চুলটাকে পনিটেইল করেছে। ভাগ্যিস আজও চুল ছেড়ে দেয়নি। কাল সারারাত কর্বুর ঐশিকার চুলের মধ্যে, চুলের গন্ধে হাবুডুবু খেয়েছে। ঘুমোতে পারেনি একটুও।

আর গৈরিকা হালকা নীলরঙা শাড়ি পরেছে, নীল-রঙা শাল। দু-বোনের মধ্যে ঐশিকাই বেশি সুন্দরী। দু-জন সুস্নাতা যুবতীর শরীরের সাবানের, পারফিউমের আর আতরের গন্ধে ঝরঝরিয়ে পড়া জলের পাশের প্রজাতির আর কাচপোকা-ওড়া এই উজ্জ্বল সকাল সুগন্ধে যেন উদবেল হয়ে উঠেছে।

কর্বুর বলল, ওঃ। ওই ফুলগুলো! ওগুলোর নাম হেল।

-ওঃ হেল।

গৈরিকা বলল, কপট বিরক্তি ঝরিয়ে।

–এখানে কি হেভেনও আছে নাকি?

–না। হেভেন নেই। শুধুই হেল।

তারপর বলল, নামটা বোধ হয় মিথ্যে নয়, কারণ ওই গাছের ফল বেটে পাহাড়ি নদীতে আদিবাসীরা যখন দেয়, তখন নদীর সব মাছ মরে গিয়ে ভেসে ওঠে। তখন তাদের ধরতে ভারি সুবিধে হয় আদিবাসীদের। এই ফলগুলো বিষ। খেলে, মানুষও মরে যেতে পারে।

–বিষক্রিয়ায় যে মাছ মরে, তা খেয়ে মানুষের কিছু হয় না?

–না, হয় না। কেন হয় না, বলতে পারব না।

–আমি তোমার পাশের এই পাথরে একটু বসি হরিহরণ? পাইপটা একটু জম্পেশ করে

ধরাই। আমার তো বেশ দারুণ লাগছে জায়গাটা। এই জলপ্রপাত, এই রোদ, এই মিষ্টি শীত, এই রাশান ভদকা, আর তুমি এই হরিশরণ। দারুণ। আমি কিন্তু তোমাকে হরিশরণ বলেই ডাকব।

তারপর মেয়েদের দিকে চেয়ে বললেন, তোদের বুঝি ভালো লাগছে না?

পুষ্পবনে পুষ্প নাহিরে, পুষ্প আছে অন্তরে।

কর্বুর বলল।

–দেখেছ বাপি। যত ফুল সব উনি তোমার মধ্যে খুঁজে পেলেন।

গৈরিকা বলল।

-তা কী করা যাবে! ও নিজে গুণী তাই অন্য গুণীকে সহজে চিনল। তোদের মতো তো নয়। তা বলুন না বন-বাংলোর নামগুলো এবারে।

গৈরিকা আবার বলল।

–বলছি। তার আগে বলব, এর পরের বার এলে গুয়াতে ক-দিন থেকে যাবেন। কিরিবুরু থেকে নীচের সারাণ্ডা ভারি সুন্দর দেখায়। কিরিবুরুও সুন্দর জায়গা। সেখানে এবং মেঘাতিবুরুতে তো ভালো আরামপ্রদ গেস্ট হাউসও আছে। থলকোবাদের কাছ থেকে কারও নদী গিয়ে কোয়েলে মিশেছে। তবে এই কোয়েলে আর পালামৌর কোয়েলে অনেক তফাত। পালামৌর কোয়েল অনেক-ইবেশি সুন্দর।

-গেস্ট হাউস কাদের?

বোকারো স্টিল-এর। গেস্ট হাউসের কাছেই ভিউ পয়েন্ট আছে। সেখানে থেকে ইচ্ছে করলে সারাণ্ডার সাতশো পাহাড়কে আলাদা করে গোনা যায়, যদি কারও ধৈর্য থাকে।

-আরও বনবাংলোর কথা বলুন। কোথায় কোথায় আছে?

সারাণ্ডা ফরেস্ট ডিভিশনে তিনটি রেঞ্জ আছে। কিরিবুরু, কয়না আর সামটা রেঞ্জ। এই কিরিবুরু রেঞ্জ-এর অধীনে পড়ে কুমডি, বরাইবুরু আর করমপদা। কয়না রেঞ্জ-এর অধীনে পড়ে পোঙ্গা, ছোটোনাগরা, অনুকুয়া, সালাই আর মনোহরপুর। এই মনোহরপুর ছিল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রিয় জায়গা। বনবিভাগের একজন আমলার সঙ্গে ওঁর বন্ধুত্ব হয়েছিল। তিনিই তাঁকে সারাণ্ডার অনেক জায়গা ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেন।

–বিভূতিভূষণ তো সাধারণ মানুষ ছিলেন না আমাদের মতো যে, ওমলেট উইথ বেকন মাস্টার্ড দিয়ে খাওয়ার জন্যেই জঙ্গলে আসতেন। তিনি ছিলেন সাধক।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন।

–তা ঠিক।

কর্বুর বলল।

–এই গাছটি কী গাছ ভায়া?

–কোন গাছ?

–আরে আমি যার নীচে শিলাসনে বসে ভদকা খাচ্ছি আর পাইপ ফিল করছি।

–ও। এটা তো কদম গাছ।

ঐশিকা বলল, হোয়াট আ পিটি, বাপি! যদি বা জীবনের অনেক পথ হেঁটে কদমতলে এসে পৌঁছালে তাও রাধার বদলে কর্বুর সেন।

সকলেই ঐশিকার কথাতে একসঙ্গে হেসে উঠলেন। সেই হাসির দমকে ঝরনার জল যেন আরও জোর পেয়ে এগিয়ে গেল।

–অন্য বাংলোগুলোর কথা তো বললেন না? বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা ওঠাতে সব কিছু গোলমাল হয়ে গেল।

–হ্যাঁ। বলছি। সামটা রেঞ্জ-এর অধীনে আছে সেরাইকেলা, তিরিলপোসি, আর থলকোবাদ। থলকোবাদে তো আমরা যাচ্ছিই।

-এই রেঞ্জ ব্যাপারটা কী বলুন তো স্যার?

ঐশিকা বলল।

বনবিভাগের হায়ারার্কি জানলে পরে, বুঝতে সুবিধে হবে। সবচেয়ে ওপরে বনমন্ত্রী, বনমন্ত্রীর পরে ফরেস্ট সেক্রেটারি, তাঁর নীচে প্রিন্সিপাল চিফ কনসার্ভেটর অফ ফরেস্টস, সংক্ষেপে পি.সি.এফ. এবং তাঁর অধীনে আবার চিফ কনসার্ভেটর। সি.এফ. তাঁর অধীনে আবার একাধিক কনসার্ভেটর।

একাধিক কেন?

–মানে, নানা বিভাগের একজন করে চিফ। ওয়াইল্ড লাইফ, সিলিভি কালচার, ফরেস্টস, গেম-পার্ক, প্ল্যানিং ইত্যাদি ইত্যাদি। তা ছাড়া অঞ্চল হিসেবেও আছে। যেমন, নর্থ বিহার, সাউথ বিহার ইত্যাদি ইত্যাদি। এক একজন চিফ কনসার্ভেটর-এর অধীনে থাকেন একাধিক কনসার্ভেটর। একজন কনসার্ভেটরের অধীনে থাকেন কয়েকজন ডি.এফ.ও. অর্থাৎ ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার। আবার এক একজন ডি.এফ.ও.-র অধীনে থাকেন কয়েকজন রেঞ্জার, এক একটি রেঞ্জ-এর দায়িত্বে।

–আর রেঞ্জারের নীচে কেউ থাকেন না?

–থাকেন বই কী! রেঞ্জারের নীচে ফরেস্টার। একাধিক-ই থাকেন। তাঁদের নীচে ফরেস্ট গার্ড।

বাবা। এ দেখি বন্যপ্রাণীর চেয়েও সংখ্যাতে আমলা বেশি।

গৈরিকা বলল।

-হ্যাঁ। সেইরকম-ই ব্যাপার।

হেসে বলল, কর্বুর।

–এখানে একরকমের ফুলে ফোটে তাদের নাম হুঁতিতি।

–কী বললেন? তাই? অদ্ভুত নাম তো!

-হ্যাঁ। শুধু নামেই নয়, চরিত্রেও অদ্ভুত। আট বছর বাদে ফোটে। পৃথিবীর খুব কম প্রাণী অথবা উদ্ভিদের গর্ভাবস্থা এতদীর্ঘ। যদি বা থেকেও থাকে, তবে তা আমার অজানা। আমি আর কতটুকুই বা জানি।

–বাবাঃ। গলা তো শুকিয়ে গেল আপনার। কফি খাবেন নাকি? এনেছি তো ফ্লাস্কে

করে।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, দে-দে। এনেছিস তো দিচ্ছিস না কেন?

–আপনার টোব্যাকোর গন্ধটা ভারি সুন্দর।

কর্বুর বলল, ব্যানার্জিসাহেবকে।

–গোল্ডব্লক। ইংলিশ টোব্যাকো। আমার বন্ধু রনাল্ড রায়ান পাঠায় কানাডা থেকে, এর তার হাতে, নিয়মিত। ভেরি সুইট এবং সুইট স্মেলিং টোব্যাকো।

–ইচ্ছে আছে থলকোবাদে আজকের দিনটা আর রাতটা থেকে আপনাদের নিয়ে সালাই যাব। একটি নির্জন মালভূমির একেবারে ওপরে দু-কামরা আর একটি আউট হাউসের বাংলো। মালভূমিতে রাতে জিপ নিয়ে ঘুরলে, আশা করি অনেক জানোয়ার দেখাতে পারব।

–তা তো পারবে। এখন লাঞ্চের মেনুটা কী তা বলো তো দেখি।

-পোঁছোতে তো দেরি হবে। তাই বলছি পাতলা করে মুসুর ডালের খিচুড়ির সঙ্গে কড়কড়ে করে আলুভাজা আর বেগুনি।

–বাঃ। ফার্স্ট ক্লাস। ভদকার সঙ্গে যা জমবে না।

–কী কী জানোয়ার দেখতে পাব আমরা?

ঐশিকা শুধোল।

–হাতি তো এখানে যত্রতত্রই দেখা যায়। কাল রাতে হাতিটা এল না কেন জানি না। তবে একটা হাতিতে ইন্টারেস্টেড নই। একটা হাতি মানেই ঝামেলার ব্যাপার। লেপার্ড ওয়াইল্ড ডগস বা ভারতীয় ঢোল দেখা যায়।

কুকুরের নাম ঢোল?

ঐশিকা জিজ্ঞেস করল।

তাদের দলের সর্দারের কী নাম?

এবারে গৈরিকা জিজ্ঞেস করল।

-ঢোলগোবিন্দ।

কর্বুর বলল।

তারপর বলল, হ্যাঁ। বুনো-কুকুরের-ই নাম। লাল লাল দেখতে। দলে থাকে। দিশি কুকুরের চেয়ে বড়ো হয়। আবার অ্যালশেসিয়ানদের চেয়ে ছোটো হয়। এরা পনেরো মিনিটের মধ্যে বড়ো শম্বরকে শেষ করে কঙ্কালটি রেখে যাবে। এরা যে জঙ্গলে ঢোকে, সেই জঙ্গল থেকে বাঘও ভয়ে পালায়।

-তাই?

–হ্যাঁ।

–আর মানুষদের?

-ভরসার কথা এই যে, আজ অবধি মানুষদের কখনো আক্রমণ করেনি। যেদিন মানুষের ভয় এদের ভেঙে যাবে, সেদিন থেকে বনচারী মানুষের-ই বড়ো বিপদ।

তারপর বলল, এত অল্প সময়ের জন্যে এলে কি বন দেখা যায়? কুমডির কাছেই বীরহোড়দের একটি বস্তি আছে। সেখানে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল আপনাদের। এখনও আদিম আছে তারা। চাষবাস করে না। বনের ফলমূল কান্দা-গেঠি খেয়ে থাকে। মহুয়ার ফুল, ফল, শালেরও। উইপোকাকে ওরা বলে বানর-ডুমরি, ওদের ভাষাতে। উইপোকা খায় ওরা, মহুল-ফুলও, ভাল্লুকের সঙ্গে লড়াই করে। ভাল্লুকেরও তো ওসব খুবই প্রিয় খাদ্য। মহুয়ার মদকে ওরা বলে আরকি। আর হাঁড়িয়া বা পচাইকে বলে ভিয়েন।

শুনেছি, মহুয়া ডক্টরড করে খেলে দারুণ হয়। তবে তোমার সঙ্গে এসব নিয়ে আলোচনা করে লাভ কী? কুরুবককে বলব ভাইপো দেখে এলাম বটে তোমার। সেই সেযুগে ছিল যুধিষ্ঠির আর এযুগে কন্টুর। মাঝে ধু-ধু সমুদ্র। যদি বা কিছু থাকতেও পারত কর্বুর তা কর্পূর করে হাওয়া করে দিয়েছে।

–হাওয়া-করা আবার কী কথা বাপি?

গৈরিকা বলল।

-আরে, আমি মিস্ত্রি মানুষ। আমি ওইরকমভাবেই কথা বলি। আমি কি আর তোদের মতো সংস্কৃতিসম্পন্ন?

–কর্বুরও তো মিস্ত্রিই। এঞ্জিনিয়ার যদি মিস্ত্রি হন।

গৈরিকা বলল।

কর্বুরের সঙ্গে আমার তুলনা। সে তো লাখে এক। এমন একটি কোথাও খুঁজে পাবে। নাকো তুমি, সে যে মোদের কর্বুর গো, কবুবাবু তুমি।

কর্বুর হেসে ফেলল।

-আচ্ছা, সালাই কতদূর? থলকোবাদ থেকে?

ঐশিকা প্রশ্ন করল এবারে।

-চল্লিশ কিমি মতো হবে। তবে জঙ্গলের পথ তো। সময় লাগে যেতে।

তাহলে…বলেই, ভদকার গ্লাস বটমস-আপ করলেন।

ব্যানার্জিসাহেবের কথা শেষ হওয়ার আগেই উৎকর্ণ হয়ে কী যেন শুনল কর্বুর একমুহূর্ত। তারপর-ই স্বগতোক্তি করল, একটা মোটরসাইকেল আসছে।

–ডাকাত-টাকাত নয় তো?

গৈরিকা বলল উদবিগ্ন গলায়।

রেজিস্ট্রিটা হয়ে যাওয়ার পর থেকেই ওর বাঁচার শখটা হঠাৎ-ই তীব্র হয়েছে যেন। বুঝতে পারে গৈরিকা। আর নিজে যখন বোঝে, তখন অন্যেরাও বোঝে নিশ্চয়ই।

ঐশিকা বলল, তাতে কী হয়েছে? আমাদের লোকাল গার্ডিয়ানের কোমরে যন্ত্রও আছে।

-কী করে জানলে তুমি?

জিজ্ঞেস করল কর্বুর, ঐশিকাকে।

তুমি শুনে ব্যানার্জিসাহেব খুশি হলেন এবং খুশি যে হয়েছেন তা দেখবার জন্যে পূরিত গ্লাসটাতে বড়োচুমুক লাগালেন একটা।

-তুমি যখন ড্রাইভিং-সিট থেকে নামছিলে তখন দেখে নিয়েছি।

সেকথার উত্তর না দিয়ে কর্বুর বলল, তাই? তোমার চোখ তো খুব ভালো।

-সে বিষয়ে কি আপনার কোনো সন্দেহ আছে?

আমার নিজের গাড়িতে ড্রাইভিং সিট-এর পাশে দরজার সঙ্গেই লাগানো হোলস্টার আছে। সেখানেই পিস্তলটা থাকে, যখন-ই গাড়ি নিয়ে ঘোরাফেরা করি। তবে আজকালকার ডাকাতরা তো পিস্তল ব্যবহার করে না, তারা তো চাইনিজ এ. কে. ফর্টিসেভেন, ইজরায়েলি উজি, রাশিয়ান কালানিশভ অটোম্যাটিক ওয়েপনস ব্যবহার করে।

দেখতে দেখতে ভটভট শব্দটা জোর হতে লাগল।

কর্বুর স্বগতোক্তি করল, সাইলেন্সরটা ফাটা আছে, তাই আওয়াজ এতজোর হচ্ছে।

নিস্তব্ধ শারদসকালের গভীর বনের মধ্যে সেই ফাটা-সাইলেন্সার লাগানো মোটর সাইকেলের শব্দ চতুর্দিকে ঝরনার মতো অনুরণিত হচ্ছিল।

তারপর-ই কর্বুর উঠে দাঁড়াল। আবারও স্বগতোক্তি করল, ফটকা নয়তো!

ফটকা?

ঐশিকা জিজ্ঞেস করল।

–সে কীরকম ডাকাত যে, নাম তার ফটকা?

গৈরিকা বলল, তা ছাড়া আমাদের কাছে আছেটা কী যে, ডাকাতি করতে আসবে?

–ওরা ক-জন আছে তা তো জানি না। আপনারা দুই বোনেই তো যথেষ্ট। আর কীসের দরকার তাদের।

বলেই বলল, ডাকাতের নাম ফটকা নয়। ভালো মানুষের নামও ফুচকা নয়। আমাদের বড়োবিলের অফিসের এরাণ্ড বয়ের নাম হচ্ছে ফটকা। সর্বঘটে কাঁঠালি কলা। তার মোটর সাইকেলের সাইলেন্সরটা দশমীর দিন-ই ফেটেছে যে, তা আমি জানি। সেইজন্যই ভাবলাম…

দেখতে দেখতে শব্দটা কাছে এসে গেল এবং দেখা গেল একজন গাঁট্টাগোট্টা বাঁটুল চালাচ্ছে মোটরসাইকেল আর আর একজন রোগা-প্যাংলা লম্বা পেছনে বসে। তার হাতে একটা তেল-পাকানো মোটা লাঠি।

নমস্তে ছোটোবাবু।

চালক বলল, বাইকটা লাগাতে লাগাতে।

-ক্যারে ফটকা। বাত ক্যা?

উদবিগ্ন গলাতে পাথর থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কর্বুর।

–ফ্যাক্স আয়া। বড়োবাবু বলিন কি আভভি লেতে যা না।

–কাঁহাসে আয়া? কলকাত্তাসে?

–নেহি বাবু। টাট্টাসে।

বলে, সে পকেট থেকে ফ্যাক্স মেসেজটা বের করতে করতে এগিয়ে আসতে লাগল।

টোটালি আনকনসার্নড ব্যানার্জিসাহেব ফটকার সঙ্গীকে বললেন, লাঠি কাহে লেতে আয়া?

সে কাঁচুমাচু মুখ করে ওড়িয়াতে বলল, হাতি মারিবাকু পাঁই।

–বলে কী এ ছোকরা! লাঠি দিয়ে হাতি মারবে কী?

–রাস্তামে মিলাথা হুজৌর। এহি লাঠি দিখকেই তো ডরকে-মারে ভাগা জোর সে। ফটকা বলল।

–মিলা থা? হার্থি? কাঁহা মিলা থা?

–কুমডি বাংলো কি বগলহিমে।

কর্বুর ফটকার সঙ্গীর দিকে চেয়ে বলল, উও হ্যায় কৌন?

জামদা সে উসকো উঠাকে লায়া হ্যায় বাবু। পান-দুকানি কি ভাতিজা। জঙ্গলমে এবেলা আনেমে ডর লাগল থু।

-ক্যা নাম হ্যায় তুমহারা?

–নমস্কার আইগাঁ। ম নাম্ব ক্রপাসিন্ধু।

–তম ঘর কউটি?

পানপোষ আইগাঁ।

ফটকার হাত থেকে ফ্যাক্সটা নিয়েই পড়ল কর্বুর মনে মনে। ব্যানার্জিসাহেবের নামেই ফ্যাক্স। জামশেদপুর থেকে তাঁর সেক্রেটারি এম. এস. মানসুখানি পাঠিয়েছে। ইয়োর ফাদার ইন-ল এক্সপায়ার্ড লাস্ট নাইট। প্লিজ প্রসিড টু ক্যালকাটা। বডি বিইং কেপ্ট ইন মচুরারি। উইল বি ক্রিমেটেড ওনলি আফটার ইয়োর অ্যারাইভাল। সলিসিটর্স ওলসো ডেজায়ার্স সো। হ্যাড ওলসো সিেকন ষ্টু মিস্টার কে, সেন।

তারপরে পি. এস.প্লিজ টেক ইয়োর ডটার্স অ্যালাউড কনডোলেন্সেস-মীনা।

-কী ব্যাপার?

ব্যানার্জিসাহেব বললেন।

কর্বুরের কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে উনি বললেন, নির্ঘাত সে বুড়ো টেঁসেছে। সারাটাজীবন আমাকে জ্বালিয়ে গেল মানুষটা। দেড় বছর পর চারটে দিনের জন্য এসেছি…! সত্যি!

গৈরিকা আর ঐশিকা একসঙ্গে বলে উঠল, কে? দাদু?

মনে তো হচ্ছে, তাই। কর্বুর ফ্যাক্স মেসেজটা ওঁকে দিল।

উনি ফ্যাক্সটা জোরে জোরে পড়লেন।

তারপর বললেন কর্বুরকে, তুমি তোমার ফটকাকে বলে যে, আমাকে এক ঝটকাতে থলকোবাদে পৌঁছে দেবে মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে। তুমি, বুড়োর অগাধ সম্পত্তি যারা পাবে, তাদের কলকাতাতে পাঠাবার বন্দোবস্ত করো।

-বুঝলাম না। আপনি যাবেন না?

কর্বুর বলল।

-নো। নেভার। যে শ্বশুর জীবনে জামাইকে জামাই-ষষ্ঠী পর্যন্ত খাওয়ালেন না একদিন, তাঁর মৃত্যু তো আমার কাছে আনন্দের ঘটনা। আমি থলকোবাদেই যাব। আই উইল ড্রাউন মাই সরো দেয়ার। বুলকু চাটুজ্যের মুখে তোমরা গিয়ে আগুন দাও গে যাও। আমার স্ত্রী-ই চলে গেছেন কবে। তার আবার ফাদার-ইন-ল। ওয়ান পাইস ফাদার-মাদার ছিল হে কবু। চক্ষুচর্মহীন।

ঐশিকা বলল, কী হচ্ছে বাবা! এঁরা কি বুঝবেন যে, এটা তোমার ঠাট্টা!

-ঠাট্টা! তোমরাও ঠাট্টা ভাবলে নাকি?

তারপর বললেন, কর্বুর আমার পুত্রসম। কিছুই মনে করবে না। আর, ফটকা আর কৃপাসিন্ধু তো বাংলাই বোঝে না। ভারি বয়ে গেল। তোরা কোটি কোটি টাকা পাবি। তোরা

তারপর বললেন, –ওরে ওই, কী বুঝলি?

–কী?

তোর দিদির বর ব্রহ্মকৃপার কপালটা তো দারুণ রে। এ তো জ্যাকপট পাওয়ার কপাল। বিয়ের রেজিস্ট্রি হল কী সঙ্গে সঙ্গে অমর বুড়ো পটল তুলল! আমার তো ভয় ছিল আরও বছর বিশেক চালিয়ে যাবে স্ট্রেইট-ব্যাটে ব্লক করে করে।

তারপর বললেন, এই যে বাবা কর্বুর। একটা ফ্যাক্স মেসেজ লিখে দিচ্ছি, আমার জামাই বাবাজীবন ব্রহ্মকৃপাকে কনগ্রাচুলেট করে। পাঠাবার বন্দোবস্ত অবশ্যই কোরো।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress