পথের কাঁটা – ০৩
৩
পরদিন প্রাতঃকালে একজন অপরিচিত আগন্তুক দেখা করিতে আসিল।
সবেমাত্র চায়ের বাটি নামাইয়া রাখিয়া খবরের কাগজখানা খুলিবার যোগাড় করিতেছি, এমন সময় দরজার কড়া নাড়িয়া উঠিল।
ব্যোমকেশ সচকিত হইয়া বলিলে,–“কে? ভেতরে আসুন।”
একটি ভদ্রবেশধারী সুশ্রী যুবক প্রবেশ করিল। দাড়িগোঁফ কামানো, একহারা ছিপছিপে গড়ন, বয়স ত্রিশের মধ্যেই–চেহারা দেখিলে মনে হয়, একজন অ্যাথ্লেট। সম্মুখে আমাদের দেখিয়া স্মিতমুখে নমস্কার করিয়া বলিল,–“কিছু মনে করবেন না, সকালবেলাই বিরক্ত করতে এলাম। আমার নাম প্রফুল্ল রায়–আমি একজন বীমা কোম্পানীর এজেণ্ট।” বলিয়া অনাহূতভাবেই একখানা চেয়ার অধিকার করিয়া বসিল।
ব্যোমকেশ বিরস স্বরে বলিল,–“আমাদের জীবনবীমা করবার মত পয়সা নেই।”
প্রফুল্ল রায় হাসিয়া উঠিল। এক একজন লোক আছে, যাহাদের মুখ দেখিতে বেশ সুশ্রী, কিন্তু হাসিলেই মুখের চেহারা বদলাইয়া যায়। দেখিলাম, প্রফুল্ল রায়েরও তাহাই হইল। লোকটী বোধ করি অতিরিক্ত পানখোর, কারণ, দাঁতগুলো পানের রসে আরক্ত হইয়া আছে। সুন্দর মুখ এত সহজে এমন বিকৃত হইতে পারে দেখিয়া আশ্চর্য বোধ হয়।
প্রফুল্ল রায় হাসিতে হাসিতে বলিল,–“আমি বীমা কোম্পানীর লোক বটে, কিন্তু ঠিক বীমার কাজে আপনাদের কাছে আসিনি। অবশ্য আজকাল আমাদের আসতে দেখলে আত্মীয়-স্বজনরাও দোরে খিল দিতে আরম্ভ করেছেন; নেহাৎ দোষ দেওয়াও যায় না। কিন্তু আপনারা নিশ্চিত হতে পারেন, উপস্থিত আমার কোনও দুরভিসন্ধি নেই।–আপনারই নাম তো ব্যোমকেশবাবু?–বিখ্যাত ডিটেক্টিভ? আপনার কাছে একটু প্রাইভেট পরামর্শ নিতে এসেছি, মশায়। যদি আপত্তি না থাকে–”
ব্যোমকেশ বেজারভাবে মুখখানা বাঁকাইয়া বলিল,–“পরামর্শ নিতে হলে অগ্রিম কিছু দর্শনী দিতে হয়।”
প্রফুল্ল রায় তৎক্ষণাৎ মানিব্যাগ হইতে একখানা দশ টাকার নোট বাহির করিয়া টেবিলের উপর রাখিয়া বলিল,–“আমার কথা অবশ্য গোপনীয় কিছু নয়, তবু–” বলিয়া অর্থপূর্ণভাবে আমার পানে চাহিল।
আমি উঠিবার উপক্রম করিতেছি দেখিয়া ব্যোমকেশ বেশ একটু কড়া সুরে বলিল,–“উনি আমার সহকারী এবং বন্ধু। যা বলবেন, ওঁর সামনেই বলুন।”
প্রফুল্ল রায় বলিল,–“বেশ তো, বেশ তো। উনি যখন আপনার সহকারী, তখন আর আপত্তি কিসের? আপনার নামটি–? মাফ করবেন অজিতবাবু, আপনি যে ব্যোমকেশবাবুর বন্ধু, তা আমি বুঝতে পারিনি। আপনি ভাগ্যবান্ লোক মশায়, সর্বদা এত বড় একজন ডিটেক্টিভের সঙ্গে সঙ্গে থাকা, কত রকম বিচিত্র crime-এর মর্মোদ্ঘাটনে সাহায্য করা কম সৌভাগ্যের কথা নয়। আপনার জীবনের একটা মুহূর্তও বোধ হয় dull নয়! আমার এক এক সময় মনে হয়, এই একঘেয়ে বীমার কাজ ছেড়ে আপনার মত জীবন যাপন করতে যদি পারতাম–” বলিয়া পকেট হইতে পানের ডিবা বাহির করিয়া একটা পান মুখে দিল।
ব্যোমকেশ ক্রমেই অধীর হইয়া উঠিতেছিল, বলিল,–“এইবার আপনার পরামর্শের বিষয়টা যদি প্রকাশ করে বলেন,–তাহলে সব দিক্ দিয়েই সুবিধে হয়।”
প্রফুল্ল রায় তাড়াতাড়ি তাহার দিকে ফিরিয়া বলিল,–“এই যে বলি।–আমি বীমা কোম্পানীর এজেণ্ট, তা তো আগেই শুনেছেন। বম্বের জুয়েল ইন্সিওররেন্স্ কোম্পানীর তরফ থেকে আমি কাজ করি। কোম্পানীর হয়ে দশ বারো লাখ টাকার কাজ আমি করেছি, তাই কোম্পানী খুশী হয়ে আমাকে কলকাতা অফিসের চার্জ দিয়ে পাঠিয়েছেন। গত আট মাস আমি স্থায়িভাবে কলকাতাতেই আছি।
“প্রথম মাস দুই বেশ কাজ চালিয়েছিলাম মশাই, কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে এক আপদ এসে জুটল। কারুর নাম করবার দরকার নেই, কিন্তু অন্য বীমা কোম্পানীর একটা লোক আমার পেছনে লাগল। চুনোপুঁটির কারবার আমি করি না, দু’ চার হাজারের কাজ আমার অধীনস্থ এজেণ্টরাই করে, কিন্তু বড় বড় খদ্দেরের বেলা আমি নিজে কাজ করি। এই লোকটা আমার বড় বড় খদ্দের–ভাল ভাল লাইফ–ভাঙাতে আরম্ভ করলে। আমি যেখানে যাই, আমার পেছু পেছু সে-ও সেখানে গিয়ে হাজির হয়–কোম্পানীর নামে নানারকম দুর্নাম দিয়ে খদ্দের ভড়কে দেয়। শেষে এমন অবস্থা দাঁড়ালো যে, বড় বড় লাইফগুলো আমার হাত থেকে বেরিয়ে যেতে লাগল।
“এইভাবে চার পাঁচ মাস কাটল। কোম্পানী থেকে তাগাদা আসতে লাগল, কিন্তু কি করব, কেমন করে লোকটার হাত থেকে ব্যবসা বাঁচাব, কিছুই ঠিক করতে পারলাম না। মামলা-মোকদ্দমা করাও সহজ নয়–তাতে কোম্পানীর ক্ষতি হয়। অথচ ছিলে জোঁক পেছনে লেগেই আছে। আরও মাসখানেক কেটে গেল, লোকটাকে জব্দ করবার কোনও উপায়ই ভেবে পেলাম না।”
প্রফুল্ল রায় মানিব্যাগ হইতে সযত্নে রক্ষিত দু’টি চিরকুট বাহির করিয়া, ছোট টুকরাটি ব্যোমকেশের হাতে দিয়া বলিল,–“দিন বারো চোদ্দ আগে এই বিজ্ঞাপনটি হঠাৎ চোখে পড়ল। আপনার নজরে বোধহয় পড়েনি, পড়বার কথাও নয়। কিন্তু পাঁচ লাইনের বিজ্ঞাপন হলে কি হয়, মশাই, পড়বামাত্র আমার প্রাণটা লাফিয়ে উঠল! পথের কাঁটা আর কাকে বলে? ভাবলাম, দেখি তো আমার পথের কাঁটা উদ্ধার হয় কি না! মনের তখন এমনই অবস্থা যে, স্বপ্নাদ্য মাদুলী হলেও বোধ করি আপত্তি করতাম না।”
গলা বাড়াইয়া দেখিলাম, এ সেই পথের কাঁটার বিজ্ঞাপনের কাটিং। প্রফুল্ল রায় বলিল, “পড়লেন তো? বেশ মজার নয়? যা হোক, আমি তো নির্দিষ্ট দিনে অর্থাৎ গত শনিবারের আগের শনিবার–কদমতলায় কেষ্ট ঠাকুরের মত ল্যাম্পপোস্ট ধরে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে অস্বস্তির কথা আর কি বলব। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পায়ে ঝিঁঝি ধরে গেল, কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা–কোথাও কেউ নেই। ডিস্টাস্টেড হয়ে ফিরে আসছি, হঠাৎ দেখি পকেটে একখানা চিঠি!”
দ্বিতীয় কাগজখানা ব্যোমকেশকে দিয়া বলিল,–“এই দেখুন সে চিঠি।”
ব্যোমকেশ চিঠিখানা খুলিয়া পড়িতে লাগিল, আমি উঠিয়া আসিয়া তাহার পিঠের উপর ঝুঁকিয়া দেখিলাম–ঠিক আমার পত্রেরই অনুরূপ, কেবল রবিবারের পরিবর্তে আগামী সোমবার ১১ই মার্চা রাত্রি বারোটার সময় সাক্ষাৎ করিবার নির্দেশ আছে।
প্রফুল্ল রায় একটু থামিয়া চিঠিখানা পড়িবার অবকাশ দিয়া বলিতে লাগিল,–“একে তো পকেটে চিঠি এক কি করে, ভেবেই পেলাম না, তার ওপর চিঠি পড়ে অজানা আতঙ্কে ভেতরটা কেঁপে উঠল। আমি মিস্ট্রি ভালবাসি না মসাই, কিন্তু এ চিঠির যেন আগাগোড়াই মিস্ট্রি। যেন কি একটা ভয়ঙ্কর অভিসন্ধি এর মধ্যে লুকানো রয়েছে। নইলে সব তাতেই এত লুকোচুরি কেন? লোকটা কে, কি রকম প্রভৃতি, কিছুই জানি না, তার চেহারাও দেখিনি, অথচ সে আমাকে রাত দুপুরে একটা নির্জন রাস্তা দিয়ে একলা যেতে বলেছে। ভয়ঙ্কর সন্দেহের কথা নয় কি? আপনিই বলুন তো?”–বলিয়া সে আমার মুখের দিকে চাহিল।
আমি উত্তর দিবার পূর্বেই ব্যোমকেশ বলিল,–“উনি কি মনে করেন সে প্রশ্ন নিষ্প্রয়োজন! আপনি কোন্ বিষয়ে পরামর্শ আন, তাই বলুন।”
প্রফুল্ল রায় একটু ক্ষণ্ণ হইয়া বলিল,–“সেই কথাই তো জিজ্ঞাসা করছি। চিঠির লেখককে চিনি না অথচ তার ভাবগতিক দেখে সন্দেহ হয়, লোক ভাল নয়। এ রকম অবস্থায় চিঠির উত্তর নিয়ে আমার যাওয়া উচিত হবে কি? আমি নিজে গত দশ বারো দিন ধরে ভেবে কিছুই ঠিক করতে পারিনি; অথচ যেতে হলে মাঝে আর একটি দিন বাকী। তাই কি করব ঠিক করতে না পেরে আপনার পরামর্শ নিতে এসেছি।”
ব্যোমকেশ একটু চিন্তা করিয়া বলিল,–“দেখুন, আজ আমি আপনাকে কোনও পরামর্শ দিতে পারলুম না। আপনি এই কাগজ দু’খানা রেখে যান, এখনও যথেষ্ট সময় আছে, কাল সকালে বিবেচনা করে আমি আপনাকে যথাকর্তব্য বলে দেব।”
প্রফুল্ল রায় বলিল,–“কিন্তু কাল সকালে তো আমি আসতে পারব না, আমাকে এক জায়গায় যেতে হবে। আজ রাত্রে সুবিধে হবে না কি? মনে করুন, আটটা কি ন’টার সময় যদি আসি?”
ব্যোমকেশ মাথা নাড়িয়া বলিল,–“না, আর রাত্রে আমি অন্য কাজে ব্যস্ত থাক্ব–আমাকেও এক জায়গায় যেতে হবে–” বলিয়া ফেলিয়াই সচকিতে প্রফুল্ল রায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া কথাটা ঘুরাইয়া লইয়া বলিল,–“কিন্তু আপনার ব্যস্ত হবার কোনও কারণ নেই, কাল বিকেলে চারটে সাড়ে চারটের সময় এলেও যথেষ্ট সময় থাকবে।”
“বেশ, তাই আসব–” পকেট হইতে আবার ডিবা বাহির করিয়া দুটা পান মুখে পুরিয়া ডিবাটা আমাদের দিকে বাড়াইয়া দিয়া বলিল,–“পান খান কি? খান না!–আমরা এক একটা বদ অভ্যাস কিছুতেই ছাড়তে পারি না; ভাত না খেলেও চলে, কিন্তু পানের অভাবে পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায়। আচ্ছা–আজ উঠি তাহলে, নমস্কার।”
আমরা প্রতিনমস্কার করিলাম। দ্বার পর্যন্ত গিয়া রায় ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল,–“পুলিসে এ বিষয়ে খবর দিলে কেমন হয়? আমার ত মনে হয়, পুলিস যদি তদন্ত করে লোকটার নামধাম বিবরণ বের করতে পারে।”
ব্যোমকেশ হঠাৎ মহা খাপ্পা হইয়া বলিল,–“পুলিসের সাহায্য যদি নিতে চান, তাহলে আমার কাছে কোনও সাহায্য প্রত্যাশা করবেন না। আমি আজ পর্যন্ত পুলিসের সঙ্গে কাজ করিনি, করবও না।–এই নিয়ে যান আপনার টাকা।” বলিয়া টেবিলের উপর নোটখানা অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া দেখাইয়া দিল।”
“না না, আমি আপনার মতামত জানতে চেয়েছিলাম মাত্র। তা আপনার যখন মত নেই, আচ্ছা, আসি তাহলে–” বলিতে বলিতে প্রফুল্ল রায় দ্রুতপদে বাহির হইয়া গেল।
প্রফুল্ল রায় চলিয়া গেলে ব্যোমকেশও নোটখানা তুলিয়া লইয়া নিজের লাইব্রেরী ঘরে ঢুকিল, তারপর সশব্দে দরজা বন্ধ করিয়া দিল। সে মাঝে মাঝে অকারণে খিটখিটে হইয়া উঠে বটে, কিন্তু কিছুক্ষণ একাকী থাকিবার পর সেভাব আপনিই তিরোহিত হইয়া যায়, তাহা আমি জানিতাম। তাই মনটা বহু প্রশ্ন-কণ্টকিত হইয়া থাকিলেও অপঠিত সংবাদপত্রখানা তুলিয়া লইয়া তাহাতে মনঃসংযোগের চেষ্টা করিলাম।
কয়েক মিনিট পরে শুনিতে পাইলাম, ব্যোমকেশ পাশের ঘরে কথা কহিতেছে। বুঝিলাম কাহাকেও টেলিফোন করিতেছে। দু’ একটা ইংরাজী শব্দ কানে আসিল; কিন্তু কাহাকে টেলিফোন করিতেছে, ধরিতে পারিলাম না। প্রায় এক ঘণ্টা ধরিয়া কথাবার্তা চলিল, তারপর দরজা খুলিয়া ব্যোমকেশ বাহির হইয়া আসিল। চাহিয়া দেখিলাম, তাহার স্বাভাবিক প্রফুল্লতা ফিরিয়া আসিয়াছে।
জিজ্ঞাসা করিলাম,–“কাকে ফোন করলে?”
সে-কথায় উত্তর না দিয়া ব্যোমকেশ বলিল,–“কাল এস্প্ল্যানেড থেকে ফেরবার সময় একজন তোমার পিছু নিয়েছিল জানো?”
আমি চকিত হইয়া বলিলাম,–“না! নিয়েছিল না কি?”
ব্যোমকেশ বলিল,–“নিয়েছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু লোকটার কি অসীম দুঃসাহস, আমি শুধু তাই ভাবছি।” বলিয়া নিজের মনেই মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল।
আমাকে অনুসরণ করার মধ্যে এতবড় দুঃসাহসিকতা কি আছে, তা বুঝিলাম না; কিন্তু ব্যোমকেশের কথা মাঝে মাঝে এমন দুরুহ হেঁয়ালির মত হইয়া দাঁড়ায় যে, তাহার অর্থবোধের চেষ্টা পণ্ডশ্রম মাত্র। অথচ এ বিষয়ে তাহাকে প্রশ্ন করাও বৃথা, সময় উপস্থিত না হইলে সে কিছুই বলিবে না। তাই আমি আর বাক্যব্যয় না করিয়া স্নানাদির জন্য উঠিয়া পড়িলাম।
দ্বিপ্রহর ও সন্ধ্যাবেলাটা ব্যোমকেশ নিষ্কর্মার মত বসিয়াই কাটাইয়া দিল। প্রফুল্ল রায় সম্বন্ধে দু’ একটা প্রশ্ন করিলাম, কিন্তু সে শুনিতেই পাইল না, চেয়ারে চক্ষু বুজিয়া পড়িয়া রহল; শেষে চমকিয়া উঠিয়া বলিল,–“প্রফুল্ল রায়? ও, আজ সকালে যিনি এসেছিলেন? না, তাঁর সম্বন্ধে এখনও কিছু ভেবে দেখিনি।”
রাত্রিকালে আহারাদির পর নীরবে বসিয়া ধূমপান চলিতেছিল; ঘড়িতে ঠং করিয়া সাড়ে দশটা বাজিতেই ব্যোমকেশ চেহার হইতে লাফাইয়া উঠিয়া বলিল,-“উঠ বীরজায়া বাঁধ কুন্তল,–এবার সাজসজ্জার আয়োজন আরম্ভ করা যাক, নইলে অভিসারিকাদের সঙ্কেতস্থলে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে।”
বিস্মিত হইয়া বলিলাম,–“সে আবার কি?”
ব্যোমকেশ বলিল,–“বাঃ, ‘পথের কাটা’র নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে হবে, মনে নেই?”
আমি আশঙ্কায় উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলাম,–“মাফ কর। এই রাত্রে একলা আমি সেখানে যেতে পারব না। যেতে হয় তুমি যাও।”
“আমি তো যাবই, তোমারও যাওয়া চাই।”
“কিন্তু না গেলেই কি নয়? ‘পথের কাঁটা’র সম্বন্ধে এত মিথ্যে কৌতূহল কেন? তার চেয়ে যদি গ্রামোফোনের পিনের ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতে, তাহালে যে ঢের কাজ হত”
“হয়তো হত। কিন্তু ইতিমধ্যে একটা কৌতূহল চরিতার্থ করলেই বা মন্দ কি? গ্রামোফোন পিন তো আর পালাচ্ছে না। তা ছাড়া কাল প্রফুল্ল রায় পরামর্শ নিতে আসবে, তাকে পরামর্শ দেবার মত কিছু খবর তো চাই।”
“কিন্তু দু’জনে গেলে তো হবে না চিঠিতে যে মাত্র একজনকে যেতে বলেছে।”
“তার ব্যবস্থা আমি করেছি। এখন ওঘরে চল, সময় ক্রমেই সংক্ষেপ হয়ে আসছে।”
লাইব্রেরীতে লইয়া গিয়া ব্যোমকেশ ক্ষিপ্তহস্তে আমার মুখসজ্জা করিয়া দিল। দেয়ালে লম্বিত দীর্ঘ আয়ানাটায় উঁকি মারিয়া দেখিলাম, সেই গোঁফ এবং ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি ইন্দ্রজাল প্রভাবে ফিরিয়া পাইয়াছি, কোথাও এতটুকু তফাৎ নাই। আমাকে ছাড়িয়া দিয়া ব্যোমকেশ নিজের বেশভূষা আরম্ভ করিল; মুখের কোনও পরিবর্তন করিল না, দেরাজ হইতে কালো রঙের সাহেবী পোষাক বাহির করিয়া পরিধান করিল, পায়ে কালো রবার-সোল জুতা পরিল। তারপর আমাকে আয়নার সম্মুখে পাঁচ ছয় হাত দূরে দাঁড় করাইয়া নিজে আমার পিছনে গিয়া দাঁড়াইল। জিজ্ঞাসা করিল,–“আয়নায় আমাকে দেখতে পাচ্ছ?”
“না।”
“বেশ। এখন সামনের দিকে এগিয়া যাও–এবার দেখলে পেলে?”
“না।”
“ব্যাস্–কাম ফতে। এখন শুধু একটি পোষাক পরতে বাকী আছে।”
“আবার কি?”
ঘরে ঢুকিয়াই লক্ষ্য করিয়াছিলাম, ব্যোমকেশের টেবিলের উপর দু’টি চীনামাটির প্লেট রাখা আছে–হোটেলে যেরূপ আকৃতির প্লেটে মটন্ চপ খাইতে দেয়, সেইরূপ। সেই প্লেটে একখানা ব্যোমকেশ আমার বুকের উপর উপুড় করিয়া চাপিয়া ধরিয়া চওড়া ন্যাকড়ার ফালি দিয়ে শক্তভাবে বাঁধিয়া দিল। বলিল,–“সাবধান, খসে না যায়। ওর ওপর কোট পরলেই আর কিছু দেখা যাবে না।”
আমি ঘোর বিস্ময়ে বলিলাম,–“এ সব কি হচ্ছে?”
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল,–“কঞ্চুকী না পরলে চলবে কেন। ভয় নেই, আমিও পরছি।”
দ্বিতীয় প্লেটখানা ব্যোমকেশ নিজের ওয়েস্টকোটের ভিতরে পুরিয়া বোতাম লাগাইয়া দিল, বাঁধিবার প্রয়োজন হইল না।
এইরূপে বিচিত্র প্রসাধন শেষ করিয়া রাত্রি এগারটা কুড়ি মিনিটের সময় আমরা বাহির হইলাম। দেরাজ হইতে কয়েকটা জিনিস পকেটে পুরিতে পুরিতে ব্যোমকেশ বলিল,–“চিঠি নিয়েছ? কি সর্বনাশ, নাও নাও, শিগ্গির একখানা সাদা খামের মধ্যে পুরে নাও–”
শিয়ালদহের মোড়ের উপর একটা খালি ট্যাক্সি পাইয়া তাহাতে চড়িয়া বসিলাম। পথ জন-বিরল, দোকান-পাট প্রায় বন্ধ হইয়া গিয়াছে। আমাদের ট্যাক্সি নির্দেশমত হু হু করিয়া চৌরঙ্গীর দিকে ছুটিয়া চলিল।
কালীঘাট ও খিদিরপুরের ট্রাম-লাইন যেখানে বিভিন্ন হইয়া গিয়াছে, সেই স্থানে ট্যাক্সি হইতে নামিলাম। ট্যাক্সি-চালক ভাড়া লইয়া হর্ণ বাজাইয়া চলিয়া গেল। চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিলাম্ম প্রশস্ত রাজপথের উপর কোথাও একটি লোক নাই, চতুর্দিকে অসংখ্য উজ্জ্বল দীপ যেন এই প্রাণহীন নিস্তব্ধতাকে ভীতিপ্রদ করিয়া তুলিয়াছে। ঘড়িতে তখনও বারোটা বাজিতে দশ মিনিট বাকী।
কি করিতে হইবে, গাড়ীতে বসিয়া পরামর্শ করিয়া লইয়াছিলাম। সুতরাং কথা বলিবার প্রয়োজন হইল না। আমি আগে আগে চলিলাম, ব্যোমকেশ ছায়ার মত আমার পশ্চাতে অদৃশ্য হইয়া গেল। তাহার কালো পরিচ্ছদ ও শব্দহীন জুতা আমার কাছেও যেন তাহাকে কায়াহীন করিয়া তুলিল। আমার পায়ের সঙ্গে পা মিলাইয়া সে আমার ঠিক ছয় ইঞ্চি পশ্চাতে চলিয়াছে, তবু মনে হইল, যেন আমি একাকী। রাস্তার আলো অতি বিস্তৃত পথকে আলোকিত করিয়াছে বটে, কিন্তু সে আলো খুব স্পষ্ট ও তীব্র নহে। পথের দুই পাশে প্রাসাদ থাকিলে আলো প্রতিফলিত হইয়া উজ্জ্বলতর হয়, এখানে তাহা হইতেছে না। দুই দিকের শূন্যতা যেন আলোর অর্ধেক তেজ গ্রাস করিয়া লইতেছে।
এই অবস্থায় সম্মুখ হইতে আসিয়া কাহারও সাধ্য নাই যে বুঝিতে পারে, আমি এক নহি, আমার পশ্চাতে আর একটি অন্ধকার মূর্তি নিঃশব্দে চলিয়াছে।
পাশের ট্রাম-লাইনে ট্রামের যাতায়াত বহু পূর্বে বন্ধ হইয়া গিয়াছে। এ দিকে রেসকোর্সের সাদা রেলিং একটানা ভাবে চলিয়াছে। আমি রাস্তার মাঝখান ধরিয়া হাঁটিয়া চলিলাম। দূরে পশ্চাতে একটা ঘড়িতে ঢং ঢং করিয়া মধ্যরাত্রি ঘোষিত হইল। সঙ্গে সঙ্গে শহরের অন্য ঘড়িগুলোও বাজিতে আরম্ভ করিল, মধ্যরাত্রির স্তব্ধতা নানা প্রকার সুমিষ্ট শব্দে ঝঙ্কৃত হইয়া উঠিল।
ঘড়ির শব্দ মিলাইয়া যাইবার পর কানের কাছে ফিস্ফিস্ করিয়া ব্যোমকেশ বলিল,–“এইবার চিঠিখানা হাতে নাও।”
ব্যোমকেশ যে পিছনে আছে, তাহা ভুলিয়াই গিয়াছিলাম। চমকিয়া পকেট হইতে খামখানা বাহির করিয়া হাতে লইলাম।
আরও ছয় সাত মিনিট চলিলাম। খিদিরপুর পুল পৌঁছিতে তখনও প্রায় অর্ধেক পথ বাকী আছে, এমন সময় সম্মুখে বহু দূরে একটা ক্ষীণ আলোকবিন্দু দেখিয়া সচকিত হইয়া উঠিলাম। কানের কাছে শব্দ হইল,–“আসছে–তৈরী থাকো।”
আলোকবিন্দু উজ্জ্বলতর হইতে লাগিল। মিনিটখানেকের মধ্যে দেখা গেল, পিচঢালা কালো রাস্তার উপর কৃষ্ণতর একটা বস্তু দ্রুতবেগে অগ্রসর হইয়া আসিতেছে। কয়েক মুহূর্ত পরেই বাইসিক্ল-আরোহীর মূর্তি স্পষ্ট হইয়া উঠিল। আমি দাঁড়াইয়া পড়িয়া খামসমেত হাতখানা পাশের দিকে বাড়াইয়া দিলাম। সম্মুখে বাইসিক্লের গতিও মন্থর হইল।
রুদ্ধ-নিশ্বাসে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। বাইসিক্ল পঁচিশ গজের মধ্যে আসিল; তখন দেখিতে পাইলাম, কালো স্যুটপরিহিত আরোহী সম্মুখে ঝুঁকিয়া মোটর-গগ্লের ভিতর দিয়ে আমাকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে দেখিতেছে।
মধ্যম-গতিতে সাইক্ল যেন আমাকে লক্ষ্য করিয়ায় অগ্রসর হইতে লাগিল। আমাদের মধ্যে যখন আর দশ গজ মাত্র ব্যবধান, তখন কড়াং কড়াং করিয়া সাইক্লের ঘণ্টি বাজিয়া উঠিল, সঙ্গে সঙ্গে বুকে দারুণ ধাক্কা খাইয়া আমি প্রায় উল্টাইয়া পড়িয়া গেলাম। আমার বুকে বাঁধা প্লেটটা শত খণ্ডে ভাঙিয়া গিয়াছে বুঝিতে পারিলাম।
তারপর নিমিষের মধ্যে একটা কাণ্ড হইয়া গেল। আমি ঢলিয়া পড়িতেই ব্যোমকেশ বিদ্যুদ্বেবেগ সম্মুখদিকে লাফাইয়া পড়িল। বাইসিক্ল-আরোহী আমার পশ্চাতে আর একটা লোকের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না, তবু সে পাশ কাটাইয়া পলাইবে চেষ্টা করিল, কিন্তু পারিল না। ব্যোমকেশ তাহাকে এক ঠেলায় বাইসিক্ল সমেত ফেলিয়া দিয়া বাঘের মত তাহার ঘাড়ে লাফাইয়া পড়িল।
আমি মাটি হইতে উঠিয়া ব্যোমকেশের সাহায্যার্থে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, সে প্রতিপক্ষের বুকের উপর চাপিয়া বসিয়াছে এবং দুই বজ্রমুষ্টিতে তাহার দুই কব্জি ধরিয়া আছে। বাইসিক্লখানা একধারে পড়িয়া আছে।
আমি পৌঁছিতেই ব্যোমকেশ বলিল,–“অজিত, আমার পকেট থেকে সিল্কের দড়ি বার করে এর হাত দুটো বাঁধো–খুব জোরে।”
লিকলিকে সরু রেশমের দড়ি ব্যোমকেশের পকেট হইতে বাহির করিয়া ভূপতিত লোকটার হাত দুটা শক্ত করিয়া বাঁধিলাম। ব্যোমকেশ বলিল,–“ব্যস্, হয়েছে। অজিত, ভদ্রলোকটিকে চিন্তে পারছ না? ইনি আমাদের সকালবেলার বন্ধু প্রফুল্ল রায়! আরও ঘনিষ্ঠ পরিচয় যদি চাও, ইনিই গ্রামোফোনের পিন রহস্যের মেঘনাদ!” বলিয়া তাহার চোখের গগ্ল খুলিয়া লইল।
অতঃপর আমার মনের অবস্থা কিরূপ হইল, তাহা বর্ণনা করা নিষ্প্রয়োজন, কিন্তু সেই অবস্থাতে থাকিয়াও প্রফুল্ল রায় হিংস্র দন্তপংক্তি বাহির করিয়া হাসিল, বলিল,–“ব্যোমকেশবাবু, এবার আমার বুকের উপর থেকে নেমে বসতে পারেন, আমি পালাব না।”
ব্যোমকেশ বলিল,–“অজিত, এর পকেটগুলো ভাল করে দেখে নাও তো অস্ত্রশস্ত্র কিছু আছে কি না।”
এক পকেট হইতে অপেরা প্লাস ও অন্য পকেট হইতে পানের ডিবা বাহির হইল, আর কিছুই না। ডিবা খুলিয়া দেখিলাম্ম তাহার মধ্যে তখনও গোটা চারেক পান রহিয়াছে।
ব্যোমকেশ বুকের উপর হইতে নামিলে প্রফুল্ল উঠিয়া বসিল, ব্যোমকেশের মুখের দিকে কিছুক্ষণ নিষ্পলক দৃষ্টিতে চাহিয়া থাকিয়া আস্তে আস্তে বলিল,–“ব্যোমকেশবাবু, আপনি আমার চেয়ে বেশী বুদ্ধিমান। কারণ, আমি আপনার বুদ্ধিকে অবজ্ঞা করেছিলাম, কিন্তু আপনি করেননি। শত্রুর শক্তিকে তুচ্ছ করতে নেই, এ শিক্ষা একটু দেরিতে পেলাম, কাজে লাগাবার ফুরসত হবে না।” বলিয়া ক্লিষ্টভাবে হাসিল।
ব্যোমকেশ নিজের বুক-পকেট হইতে একটা পুলিস হুইস্ল বাহির কইয়া সজোরে তাহাতে ফুঁ দিল, তারপর আমাকে বলিল,–“অজিত, বাইসিক্লখানা তুলে সরিয়ে রাখো। কিন্তু সাবধান, ওর ঘণ্টিতে হাত দিও না, বড় ভয়ানক জিনিস!”
প্রফুল্ল রায় হাসিল,–“সবই জানে দেখছি, আপনি অসাধারণ লোক। আপনাকেই ভয় ছিল, তাই তো আজ এই ফাঁদ পেতেছিলাম। ভেবেছিলাম, আপনি একা আসবেন, নিভৃতে সাক্ষাৎ হবে। কিন্তু আপনি সব দিক দিয়েই দাগা দিলেন। ভাল অভিনয় করতে পারি বলে আমার অহঙ্কার ছিল; কিন্তু আপনি আরও উচ্চশ্রেণীর আর্টিস্ট। আপনি আমার ছদ্মবেশ খুলে আমার মনটাকে উলঙ্গ করে আজ সকালবেলা দেখে নিয়েছিলেন আর আমি শুধু আপনার মুখোশটাই দেখেছিলাম!–যাক, গলাটা বেজায় শুকিয়া গেছে। একটু জল পাব কি?”
ব্যোমকেশ বলিল,–“জল এখানে নেই, থানায় গিয়ে পাবেন।” প্রফুল্ল রায় ক্লিষ্ট হাসিয়া বলিল,–“তাও তো বটে, জল এখানে পাওয়া যায় কোথা!” কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া পানের ডিবাটার দিকে একটা সতৃষ্ণ দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল,–“একটা পান পেতে পারি না কি? অবশ্য আসামীকে পান খাওয়াবার রীতি নেই সে আমি জানি, কিন্তু পেলে তৃষ্ণাটা নিবারণ হত।”
ব্যোমকেশ আমাকে ইঙ্গিত করিল, আমি ডিবা হইতে দু’টা পান তাহার মুখে পুরিয়া দিলাম। পান চিবাইতে চিবাইতে প্রফুল্ল রায় বলিল,–“ধন্যবাদ; বাকী দুটো আপনারা ইচ্ছা করিলে খেতে পারেন।”
ব্যোমকেশ উৎকর্ণভাবে পুলিসের আগমনশব্দ শুনিতেছিল, অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়িল। দূরে মোটর-বাইকের ফট্ ফট্ শব্দ শুনা গেল। প্রফুল্ল রায় বলিল,–“পুলিস তো এসে পড়ল। আমাকে তাহলে ছাড়বেন না?”
ব্যোমকেশ বলিল,–“ছাড়ব কি রকম?”
প্রফুল্ল রায় ঘোলাটে রকম হাসিয়া পুনশ্চ জিজ্ঞাসা করিল,–“পুলিসে দেবেবই?”
“দেব বৈকি!”
“ব্যোমকেশবাবু, বুদ্ধিমান লোকেরও ভুল হয়। আপনি আমাকে পুলিসে দিতে পারবেন না–” বলিয়া রাস্তার উপর ঢলিয়া পড়িল।
একটা মোটর-বাইক সশব্দে আসিয়া পাশে থামিল, একজন ইউনিফর্ম-পরা সাহেব তাহার উপর হইতে লাফাইয়া পড়িয়া বলিল,–“What’s up? Dead?”
প্রফুল্ল রায় নিষ্প্রভ চক্ষু খুলিয়া বলিল,–“এ যে খোদ কর্তা দেখছি! টু লেট্ সাহেব, আমায় ধরতে পারলে না। ব্যোমকেশবাবু, পানটা খেলে ভাল করতেন, একসঙ্গে যাওয়া যেত। আপনার মত লোককে ফেলে যেতে সত্যিই কষ্ট হচ্ছে!” হাসিবার নিষ্ফল চেষ্টা করিয়া প্রফুল্ল রায় চক্ষু মুদিল। তাহার মুখখানা শক্ত হইয়া গেল।
ইতিমধ্যে এক লরি পুলিস আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। কমিশনার সাহেব নিজে হাতকড়ি লইয়া অগ্রসর হইতেই ব্যোমকেশ প্রফুল্ল রায়ের মাথার কাছ হইতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল,–“হাতকড়ার দরকার নেই। আসামী পালিয়েছে।”