ময়ূরাক্ষীর সর্বনাশা বন্যা
ময়ূরাক্ষীর সর্বনাশা বন্যার ভীষণ প্লাবনে অঞ্চলটা বিপর্যস্ত হইয়া গেল। গত পঁচিশ বৎসরের মধ্যে এই কালবন্যা—ঘোড়া বান আসে নাই। পঞ্চগ্রামের সুবিস্তীর্ণ মাঠখানায় শস্যের প্রায় চিহ্ন নাই। জলস্রোত কতক উপড়াইয়া লইয়া গিয়াছে। বাকি যাহা ছিল, তাহা হাজিয়া পচিয়া গিয়াছে; একটা দুৰ্গন্ধ উঠিতেছে। মাঠের জল পর্যন্ত হইয়া গিয়াছে সবুজ। বাঁধের ধারে যেদিক দিয়া জলস্রোতের প্রবাহ বহিয়া গিয়াছিল—সেখানকার জমিগুলির উপরের মাটিটুকু চাষীরা চষিয়া খুঁড়িয়া, সার ঢালিয়া, চন্দনের মত মোলায়েম এবং সন্তানবতী জননীর বুকের মত খাদ্যরস-সমৃদ্ধ। করিয়া তুলিয়াছিল—তাহার আর কিছুই নাই; স্রোতের টানে খুলিয়া গলিয়া ধুইয়া মুছিয়া চলিয়া গিয়াছে। জমিগুলার বুকে জাগিয়া উঠিয়াছে কঠিন অনুর্বর এঁটেল মাটি; কতক কতক জমির উপর জমিয়া গিয়াছে রাশীকৃত বালি।
গ্রামের কোলে কোলে যেখানে জলস্রোত ছিল না—সে জমিগুলি শেষে ড়ুবিয়ছিল এবং আগেই বন্যা হইতে মুক্ত হইয়াছে—সেখানে কিছু কিছু শস্য আছে। কিন্তু সে শস্যের অবস্থাও শোচনীয়; দুর্ভিক্ষ মহামারীর শেষে যে মানুষগুলি কোনোমতে বাঁচিয়া থাকে ঠিক তাদেরই মত। অবস্থা। এখন আবার পল্লীগুলির ঘর ধসিয়া ভাঙিয়া পড়িবার পালা পড়িয়াছে। কতক ঘর অবশ্য বন্যার সময়েই ভাঙিয়াছে; কিন্তু বন্যার পর ধসিতেছে বেশি। বন্যায় ঘর এইভাবেই বেশি ভাঙে। জলে যখন ড়ুবিয়া থাকে তখন দেওয়ালের ভিত ভিজিয়া নরম হয়, তারপর জল কমিলে রৌদ্রের উত্তাপ লাগিলেই ফুলিয়া গিয়া ধসিয়া পড়ে। প্রায় শতকরা পঞ্চাশখানা ঘর ভাঙিয়াছে। খড়বিচালি ভাসিয়া গিয়াছে, বন্যায় ড়ুবিয়া গোচর-ভূমির ঘাস পচিয়া গিয়াছে–গাই-বলদ-ছাগল-ভেড়াগুলার অনাহার শুরু হইয়াছে। তাহারা সুযোগ পাইবামাত্র ছুটিয়া চলিয়াছে উত্তর দিকে। পূর্ব-পশ্চিমে বহমান ময়ূরাক্ষীর তীরবর্তী গ্রামগুলির উত্তর দিকে সব মাঠ উঁচু; চিরকাল অবহেলার মাঠ; ওই মাঠ জলে ডোবে নাই। এবার অতিবৃষ্টিতেও মাঠের ফসল বেশ ভাল—গরু-ছাগল-ভেড়া ওই মাঠেই ছুটিয়া যাইতে চায়। এবার ওই উত্তরের মাঠেই মানুষের ভরসা; কিন্তু ওদিকে জমির পরিমাণ অতি সামান্য।
শ্ৰীহরি ঘোষ আপনার বৈঠকখানায় বসিয়া তামাক খাইতেছিল। তাহার কর্মচারী দাসজীর সঙ্গে এইসব কথাই সে বলিতেছিল। দাস আক্ষেপ করিয়া বলিতেছিল—বৃদ্ধির ব্যাপারটা আপোসে মিটমাট করা ভারি অন্যায় হয়েছে ভারি অন্যায়।
তাহার বক্তব্য–আপোসে মিটমাট না করিয়া মামলার সংকল্পে অবিচলিত থাকিলে আজ মামলাগুলি অনায়াসে একতরফা ডিক্রি অর্থাৎ প্রজাদের পক্ষ হইতে কোনোরূপ প্রতিদ্বন্দ্বিতা না হইয়া ডিক্রি হইয়া যাইত। এই অবস্থায় আদালতের মারফত আপোস করিলেও অনেক ভাল হইত। আদালতকে ছাড়িয়া আপোস বৃদ্ধিটাকায় দুই আনার বেশি হয় না, আদালত তাহা গ্রাহ্য করে না। কিন্তু মামলায় অথবা মামলা করিয়া আদালতের মারফতে আপোস করিলে বৃদ্ধি অনেক বেশি হইতে পারে। এমনকি টাকায় আট আনা পর্যন্ত বৃদ্ধির নজির আছে।
শ্ৰীহরির কথাটা মনে হইয়াছে। কিন্তু কঙ্কণার বড়বাবু যে ব্যাপারটা মাটি করিয়া দিলেন। কি কুক্ষণেই রহমের সঙ্গে হাঙ্গামাটা বাঁধাইলেন!
দাস বলিল ধর্মঘটের ঘট বানের জলে ভেসে যেত। পেটের জন্যেই তখন এসে গড়িয়ে পড়ত আপনাদের দরজায়। কলের মালিক তখন টাকা দান দিতে চেয়েছিল মাঠের ধান দেখে। কিন্তু এই বানের পরে সে একটি আধলাও কাউকে দিত না।
শ্ৰীহরি একটু হাসিল—পরিতৃপ্তির হাসি। সে কথা সে জানে। তাহার শান্-বাঁধানো উঁচু বাড়িতে বন্যার জলে ক্ষতি করিতে পারে নাই। ধানের মরাইগুলি অক্ষত পরিপূর্ণ অবস্থায় তাহার আঙিনা আলো করিয়া রহিয়াছে; সে কল্পনা করিল-পাঁচখানা-সাতখানা গ্রামের লোক তাহার খামারে ওই ফটকের সম্মুখে ভিক্ষুকের মত করজোড়ে দাঁড়াইয়া আছে। ধান চাই। তাহাদের স্ত্রী, পুত্ৰ, পরিবারবর্গ অনাহারে রহিয়াছে, মাঠে একটি বীজধানের চারা নাই।
ভাদ্র মাসের এখনও পনের দিন আছে, এখনও দিবারাত্রি পরিশ্রম করিলে অল্পস্বল্প জমি চাষ হইতে পারিবে। আছাড়ো করিয়া বীজ পড়িলে কয়েক দিনের মধ্যেই বীজের চারা উঠিয়া পড়িবে। সেই বীজ লইয়া যে যতখানি পারে চাষ করিতে পারিলে তবুও কিছুটা পাওয়া যাইবে। অন্তত প্রতি চারিটিতে একটি করিয়াও ধানের শীষ হইবে। শ্ৰীহরির নিজের জমি অনেক অমরকুণ্ডার মাঠের সর্বোৎকৃষ্ট জমিগুলি প্রায় সবই তাহার। সে-সব জমিতে যতখানি সম্ভব চাষ করিবার আয়োজন সে ইতিমধ্যেই করিয়া ফেলিয়াছে। যতটুকু হয়—সেটুকুই লাভ। আষাঢ়ে রোপণ নামকে—অর্থাৎ আষাঢ় মাসে চাষের উপযুক্ত জল খুব কমই হয় এবং রোয়ার কাজও খুব কম হয়—আষাঢ়ের চাষ নামেই আছে, কার্যত হয় না; হইলেও শস্য অপেক্ষা পাতাই হয় বেশি। শাঙনে রোপণ ধানকে—শ্ৰাবণের চাষে শস্য হয় ভাল এবং সাধারণত শ্রাবণেই উপযুক্ত বৃষ্টি এদেশে হয়। শ্রাবণের চাষই বাস্তব এবং ফলপ্রদ। ভাদুরে রোপণ শীষকে অর্থাৎ শ্রাবণ পর্যন্ত বৃষ্টি না হইয়া তাঁদ্রে বৃষ্টি নামিলে, সে বৃষ্টি অনাবৃষ্টির; ফসল হইবার তেমন কথাও নয়, এবং তাদ্রে রোয়া ধানগাছগুলি ঝাড়ে-গোছে বাড়িবার সময় পায় না। ফলে—যে কয়েকটা চারা পোঁতা হয়, সেই চারাগুলিতেই একটি করিয়া শীষ হয়। আর আশ্বিনে রোপণ কিস্কে? অর্থাৎ আশ্বিনে চাষ কিসের জন্য? এটা ভাদ্র মাস—এখনও ভাদ্রের পনেরটা দিন অবশিষ্ট; এখনও ধানের চারা রুইতে পারিলে, এক শীষ করিয়া ধান মিলিবে। চাষীদের বীজের ধান চাই, খাইবার ধান চাই।
শ্ৰীহরি নিষ্ঠুর হইবে না। সে তাহাদের ধান দিবে। সমস্ত মরাই উজাড় করিয়া ধান দিবে। কল্পনানেত্রে সে দেখিল—লোকে অবনত মুখে ধান-ঋণের খতে সই করিয়া দিল। মুক্তকণ্ঠে তাহার জয়ধ্বনি ঘোষণা করিয়া তাহারা আরও একখানি অদৃশ্য খত লিখিয়া দিল, তাহার নিকট আনুগত্যের খত। অকস্মাৎ সে এই সমস্তের মধ্যে অমোঘ বিচারের বিধান দেখিতে পাইল। গভীরভাবে সে বলিয়া উঠিল—হরি-হরি-হরি। তুমিই সত্য।
ভগবানের প্রতিভূ রাজা, সকল দেবতার অংশে রাজার জন্ম। ভগবানের পৃথিবী, ভগবানের প্রতিভূ রাজা পৃথিবী শাসন করেন। পৃথিবীর ভূমি তাহার, সকল সম্পদ তাহার। রাজার প্রতিভূ জমিদার। রাজাই জমিদারকে রাজার বিধান দিয়াছেন—তুমি কর আদায় করিবে, তাহাদের শাসন করিবে। তাহারই নিয়মে প্রজা ভূমির জন্য কর দেয়, রাজার মতই রাজার প্রতিভূকে মান্য করে। সে বিধানকে ইহারা অমান্য করিয়াছিল বলিয়াই এতবড় বন্যার শাস্তি তিনিই বিধান করিয়াছেন। এখন তাহার পরীক্ষা। প্রজার বিপর্যয়ে রাজার কর্তব্য তাহাদিগকে রক্ষা করা। রাজার প্রতিভূ হিসাবে সে কর্তব্য তাহার উপর আসিয়া বৰ্তিয়াছে। সে যদি সে-কর্তব্য পালন না করে, তবে তিনি তাহাকেও রেহাই দিবেন না। সে তাহাদিগকে ধান দিবে। তাহার কর্তব্যে সে অবহেলা করিবে না।
দুই হাত জোড় করিয়া সে ভগবানকে প্ৰণাম করিল। তিনি তাহার ভাণ্ডার পরিপূর্ণ। করিয়াছেন। দিতে বাকি রাখিয়াছেন কি? জমি, বাগান, পুকুর, বাড়ি; শেষ পর্যন্ত তাহার কল্পনাতীত বস্তু জমিদারি—সেই জমিদারিও তিনি তাহাকে দিয়াছেন। গোয়াল-ভরা গরু, খামার-ভরা মরাই, লোহার সিন্দুক-ভরা নোট, সোনা, টাকা—তাহাকে দুহাতে ঢালিয়া দিয়াছেন। তার জীবনের সকল কামনাই তিনি পরিপূর্ণ করিয়াছেন; পাপকামনা পূর্ণ করিয়াও অত্যাশ্চর্যভাবে সেই পাপ-প্রভাব হইতে তিনি তাহাকে র করিয়াছেন। অনিরুদ্ধের সঙ্গে যখন তাহার প্রথম বিরোধ বাধে, তখন হইতেই তাহার কামনা ছিল—অনিরুদ্ধের জমি কাড়িয়া লইয়া তাহাকে দেশান্তরী করিবে এবং তার স্ত্রীকে সে দাসী করিয়া রাখিবে। অনিরুদ্ধের জমি সে পাইয়াছে অনিরুদ্ধ দেশত্যাগী। অনিরুদ্ধের স্ত্রীও তাহার ঘরে স্বেচ্ছায় আসিয়া প্রবেশ করিয়াছিল। যাক্, সে পলাইয়া গিয়াছে-ভালই হইয়াছে, ভগবান তাহাকে রক্ষা করিয়াছেন।
এইবার দেবু ঘোষকে শায়েস্তা করিতে হইবে। আরও কয়েকজন আছে,জগন ডাক্তার, হরেন ঘোষাল, তিনকড়ি পাল, সতীশ বউরি, পাতু বায়েন, দুর্গা মুচিনী। তিনকড়ির ব্যবস্থা। হইয়াছে। সতীশ, পাতু ওগুলা পিঁপড়ে; তবে দুর্গাকে ভালমত সাজা দিতে হইবে। জগন, হরেনকে সে বিশেষ গ্রাহ্য করে না। কোনো মূল্যই নাই ও-দুটার। আর দেবুকে শায়েস্তা করিবার আয়োজনও আগে হইতেই হইয়া আছে। কেবল বন্যার জন্যই হয় নাই; পঞ্চগ্রামের সমাজের পঞ্চায়েতমণ্ডলীকে এইবার একদিন আহ্বান করিতে হইবে। দেবু অনেকটা সুস্থ হইয়াছে, আরও একটু সুস্থ হউক। দেখুড়িয়া হইতে বাড়িতে আসুক। চণ্ডীমণ্ডপে তাহাকে ডাকিয়া, পঞ্চগ্রামের লোকের সামনে তাহার বিচার হইবে।
কালু শেখ আসিয়া সেলাম করিয়া একখানা চিঠি, গোটাদুয়েক প্যাকেট ও একখানা খবরের কাগজ আনিয়া নামাইয়া দিল। কঙ্কণার পোস্টাপিসে এখন শ্ৰীহরির লোক নিত্য যায় ডাক আনিতে। এটা সে কঙ্কণার বাবুদের দেখিয়া শিখিয়াছে। খবরের কাগজ দেখিয়া, সে চিঠি লিখিয়া ক্যাটালগ আনায়; চিঠিপত্রের কারবার সামান্যইউকিল মোক্তারের নিকট হইতে মামলার খবর আসে। আর আসে একখানা দৈনিক সংবাদপত্র। চিঠিখানায় একটা মামলার দিনের খবর ছিল, সেখানা দাসজীকে দিয়া শ্ৰীহরি খবরের কাগজটা খুলিয়া বসিল। কাগজটার মোটা মোটা অক্ষরের মাথার খবরের দিকে চোখ বুলাইতে গিয়া হঠাৎ সে একটা খবর দেখিয়া চমকিয়া উঠিল। মোটা মোটা অক্ষরে লেখা ময়ূরাক্ষী নদীতে প্রবল বন্যা। … রুদ্ধনিশ্বাসে সে সংবাদটা পড়িয়া গেল।…
দেবুও অবাক হইয়া গেল।
সে অনেকটা সুস্থ হইয়াছে, তবে শরীর এখনও দুর্বল। কঙ্কণার হাসপাতালের ডাক্তারের চিকিৎসায়, জগন ডাক্তারের তদবিরে এবং স্বর্ণের শুশ্রুষায়—সে সুস্থ হইয়া উঠিয়াছে। গতকল্য সে অন্নপথ্য করিয়াছে। আজ সে বিছানার উপর ঠেস দিয়া বসিয়া ছিল। সে ভাবিতেছিল নিজের। কথা। একেবারে গেলেই ভাল হইত। আর সে পারিতেছে না। রোগশয্যায় দুর্বল ক্লান্ত শরীরে শুইয়া তাহার মনে হইতেছিল পৃথিবীর স্বাদগন্ধ-বৰ্ণ সব ফুরাইয়া গিয়াছে। কেন? কিসের জন্য তাহার বাঁচিয়া থাকা? বাঁচার কথা মনে হইলেই তাহার মনে পড়িতেছে তাহার নিজের ঘর। নিস্তব্ধ, জনহীন ধুলায় আচ্ছন্ন ঘর!… তিনকড়ির ছেলে গৌর হাঁপাইতে হাঁপাইতে ঘরে প্রবেশ করিল-পণ্ডিত-দাদা!
–গৌর? দেবু বিস্মিত হইল—কি গৌর? স্কুল থেকে ফিরে এলে?
গৌর জংশনের স্কুলে পড়ে; এখন স্কুলের ছুটির সময় নয়। গৌর একখানা খবরের কাগজ তাহার সামনে ধরিয়া বলিল—এই দেখুন।
—কি? বলিয়াই সে সংবাদটার উপর ঝুঁকিয়া পড়িল। ময়ূরাক্ষী নদীতে ভীষণ বন্যা। সংবাদপত্রের নিজস্ব সংবাদদাতা কেহ লিখিয়াছে। বন্যার ভীষণতা বৰ্ণনা করিয়া লিখিয়াছে : শিবকালীপুরের দেশপ্ৰাণ তরুণ কর্মী দেবনাথ ঘোষ বন্যার গতিরোধের জন্য বিপুল চেষ্টা করিয়াছিলেন কিন্তু কোনো ফল হয় নাই। উপরন্তু তিনি বন্যাস্রোতে ভাসিয়া যান। বহু কষ্টে তাহার প্রাণ রক্ষা পাইয়াছে। ইহার পরেই স্থানীয় ক্ষতির উল্লেখ করিয়া লিখিয়াছে এখানকার অধিবাসীরা আজ সম্পূর্ণ রিক্ত ও গৃহহীন। শতকরা যাটখানি বাড়ি ধসিয়া পড়িয়াছে, সমস্ত খাদ্যশস্য বন্যার প্লাবনে ভাসিয়া গিয়াছে, সাংসারিক সকল সম্বল নিশ্চিহ্ন, ভবিষ্যতের আশা কৃষিক্ষেত্রের খাদ্যসম্পদ বন্যায় পচিয়া গিয়াছে; অনেকের গরু-বাছুরও ভাসিয়া গিয়াছে। এই শেষ নয়, সঙ্গে সঙ্গে বন্যা ও দুর্ভিক্ষের চিরসঙ্গী মহামারীরও আশঙ্কা করা যাইতেছে। তাহাদের জন্য বর্তমানে খাদ্য ছাই, ভবিষ্যতে বাঁচিবার জন্য বীজধান চাই, মহামারী হইতে রক্ষার জন্য প্রতিষেধক ব্যবস্থা চাই; নতুবা দেশের এই অংশ শুশ্মশানে পরিণত হইবে। এই বিপন্ন নরনারীগণেক রক্ষার দায়িত্ব দেশবাসীর উপর ন্যস্ত; সেই দায়িত্বভার গ্রহণ করিতে সকলকে আহ্বান জানাইতেছি। এই স্থানে অধিবাসীগণের সাহায্যকল্পে একটি স্থানীয় সাহায্য সমিতি গঠিত হইয়াছে। ঐ অঞ্চলের একনিষ্ঠ সেবক উপরোক্ত শ্রীদেবনাথ ঘোষ সম্পাদক হিসাবে সমিতির ভার গ্রহণ করিয়াছেন। দেশবাসীর যথাসাধ্য সাহায্য-বিধাতার আশীর্বাদের মতই গৃহীত হইবে।
দেবু অবাক হইয়া গেল। এ কি ব্যাপার! খবরের কাগজে এ সব কে লিখিল? দেশপ্ৰাণ—দেশের একনিষ্ঠ সেবক! দেশময় লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে এ বার্তা কে ঘোষণা করিয়া দিল? খবরের কাগজটা এক পাশে সরাইয়া, সে খোলা জানালা দিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া চিন্তামগ্ন হইয়া রহিল।
গৌর কাগজখানা লইয়া বহুজনকে পড়িয়া শুনাইল। যে শুনিল সে-ই অবাক হইল। দেশের গেজেট দেবু পণ্ডিতের নামে জয়জয়কার করিয়াছে ইহাতে তাহারা খুশি হইল। শ্ৰীহরি দেবুকে পতিত করিবার আয়োজন করিতেছে, দায়ে পড়িয়া শ্ৰীহরির মতেই তাহাদিগকে মত দিতে হইবে; তবুও তাহারা খুশি হইল। বারবার নিজেদের মধ্যে বলাবলি করিলা, তা বটে। ঠিক কথাই লিখেছে। এর মধ্যে মিথ্যা কিছু নাই। দশের দুঃখে দুঃখী, দশের সুখে সুখী—দেবু তো আমাদের সন্ন্যেসী।
তিনকড়ি আস্ফালন করিয়া নির্মম নিষ্ঠুরভাবে তাহাদিগকে গালাগালি দিল—থান্ থান্ দুমুখখা সাপের দল, থাম্ তো। নেড়ী কুত্তার মতন যার কাছে যখন যাবে—তারই পা চাটবে আর ন্যাজ নাড়বে। দেবার প্রশংসা করবার তোরা কে? যা ছিরে পালের কাছে যা দল পাকিয়ে পতিত কগে দেবুকে। যা বেটারা, বল্ গিয়ে তোদের ডিরেকে—গেজেটে কি লিখেছে দেবুর নামে।
তিনকড়ির গালিগালাজ লোকে চুপ করিয়া শুনিল—মাথা পাতিয়া লইল। একজন শুধু বলিলমোড়ল, পেট হয়েছে দুশমনকি করব বল? তুমি যা বলছ তা ঠিক বটে।
—পেট আমার নাই? আমার ইস্তিরি-পুত্তু-কন্যে নাই?
এ কথার উত্তর তাহারা দিতে পারিল না। তিনকড়ি পেট-দুশমনকে ভয় করে না, তাহাকে সে জয় করিয়াছে—এ কথা তাহারা স্বীকার করে; এজন্য তাহাকে তাহারা প্রশংসা করে। আবার সময়বিশেষে নিজেদের অক্ষমতার লজ্জা ঢাকিতে তিনকড়ির এই যুদ্ধকে বাস্তববোধহীনতা বলিয়া নিন্দা করিয়া আত্মগ্লানি হইতে বাঁচিতে চায়। কতবার মনে করে তাহারাও তিনকড়ির মত পেটের কাছে মাথা নিচু করিবে না। অনেক চেষ্টাও করে; কিন্তু পেট-দুশমনের নাগপাশের এমনি বন্ধন যে, অল্পক্ষণের মধ্যেই তাহার পেষণে এবং বিষনিশ্বাসে জর্জরিত হইয়া মাটিতে লুটাইয়া পড়িতে হয়। তাই আর সাহস হয় না।
বাপ, পিতামহ, তাহাদেরও পূর্বপুরুষ ওই তিক্ত অভিজ্ঞতা হইতে সন্তান-সন্ততিকে বারবার সাবধান করিয়া দিয়া গিয়াছে—পাথরের চেয়ে মাথা শক্ত নয়, মাথা ঠুকিয়ো না। পেটের চেয়ে বড় কিছু নাই, অনাহারের যাতনার চেয়ে অধিকতর যাতনা কিছু নাই; উদরের অন্নকে বিপন্ন কোরো নাতাহাদের শিরায় শিরায় প্রবহমান। শ্ৰীহরির ঘরেই যে তাহাদের পেটের অন্ন, কেমন করিয়া তাহারা শ্রীহরিকে অমান্য করিবে? তবুও মধ্যে মধ্যে তাহারা লড়াই করিতে চায়। বুকের ভিতর কোথায় আছে আর একটা গোপন ইচ্ছা-অন্তরতম কামনা, সে মধ্যে মধ্যে ঠেলিয়া উঠিয়া বলে না আর নয়, এর চেয়ে মৃত্যুই ভাল!
এবার ধর্মঘটের সময়—সেই ইচ্ছা একবার জাগিয়া উঠিয়ছিল। তাহারা উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তাহারা ভাঙিয়া পড়িয়াছে। যেটুকু সময় দাঁড়াইয়া থাকিতে পারিত, পারিবার কথা—তাহার চেয়েও অল্প সময়ের মধ্যে তাহারা ভাঙিয়া পড়িয়াছে। কেমন করিয়া কোথা দিয়া শেখেদের সঙ্গে দাঙ্গা বাঁধিবার উপক্রম হইল; সদর হইতে আসিল সরকারি ফৌজ। পুরুষানুক্রমে সঞ্চয়-করা ভয়ে তাহারা বিহ্বল হইয়া পড়িল। সঙ্গে সঙ্গে শ্রীহরি দেখাইল দানার লোভ। আর তাহারা থাকিতে পারিল না। থাকিয়াই বা কি হইত? কি করি? এই বন্যার পর যে শ্ৰীহরি ভিন্ন তাহাদের বাঁচিবার উপায় নাই। কি করিবে তাহারা? শ্ৰীহরির কথায় সাদাকে কালো-কালোকে সাদা না বলিয়া তাহাদের উপায় কি? পেট-দুশমনের ভার কেহ নাও, পেট পুরিয়া খাইতে পাইবার ব্যবস্থা কর,দেখ তাহারা কি না পারে!
তিনকড়ির গালিগালাজের আর শেষ হয় না।—ভিতু শেয়াল, লোভী গরু, বোকা ভেড়া পেটে ছোরা মার্ গিয়ে! মরে যা তোরা! মরে যা! তেঁাড়া সাপ—এক ফোঁটা বিষ নেই! মরে যা তোরা মরে যা!
দেখুড়িয়ার অধিবাসী তিনকড়ির এক জ্ঞাতি-ভাই হাসিয়া বলিল—মরে গেলে তো ভালই হয় ভাই তিনু। কিন্তু মরণ হোক বললেই তো হয় না—আর নিজেও মরতে পারি না! তেজের কথা—বিষের কথা বলছিস? তেজ, বিষ কি শুধুই থাকে রে ভাই? বিষয় না থাকলে বিষও থাকে না, তেজও থাকে না।
তিনকড়ি মুখ খিঁচিয়া উঠিল—বিষয়! আমার বিষয় কি আছে? কত আছে? বিষয়—টাকা–!
সে বলিল–হ্যাঁ, হ্যাঁ, তিনু-দাদা বিষয়–টাকা। তেজ-বিষ আমারও একদিন ছিল। মনে আছে—তুমি আর আমি কঙ্কণার নিতাইবাবুকে ঠেঙিয়েছিলাম? রাত্রে আসত–দেঁতো গোবিন্দের বোনের বাড়ি! তাতে আমিই তোমাকে ডেকেছিলাম। আগে ছিলাম আমি। নিতাইবাবু মার খেয়ে ছমাস ভুগে শেষটা মরেই গেল—মনে আছে? সে করেছিলাম গায়ের ইজ্জতের লেগে। তখন তেজ ছিল—বিষ ছিল। তখন আমাদের জমজমাট সংসার। বাবার পঞ্চাশ বিঘে জমির চাষ, তিনখানা হাল; বাড়িতে আমরা পাঁচ ভাই–পাঁচটা মুনিষ; তখন তেজ ছিল—বিষ ছিল। তারপর পাঁচ ভাইয়ে ভিন্ন হলাম; জমি পেলাম দশ বিঘে, পাঁচটা ছেলেমেয়ে; নিজেরাই বা কি খাইছেলেমেয়েদিগের মুখেই বা কি দিই? শ্ৰীহরি ঘোষের দোরে হাত না পেতে করি কি বল? আর তেজ-বিষ থাকে?
আবার একটু হাসিয়া বলিল—তুমি বলবেতোমারই বা কি ছিল? ছিল কিনা তুমিই বল? আর জমিও তোমার আমাদের চেয়ে অনেক ভাল ছিল। তোমার তেজ-বিষ মরে নাই, আছে। তাও তো তেজের দণ্ড অনেক দিলে গো। সবই তো গেল। রাগ কোরো না, সত্যি কথা বলছি। ঠিক আগেকার তেজ কি তোমারই আছে?
তিনকড়ি এতক্ষণে শান্ত হইল। কথাটা নেহাত মিথ্যা বলে নাই। আগেকার তেজ কি তাহারই আছে? আজকাল সে চিৎকার করিলে লোকে হাসে। আর ওই ছিল—ছিরে, আগে চিৎকার করিলে লোকে সকলেই তো তাহার উত্তর করিত সামনাসামনি দাঁড়াইত। কিন্তু আজ ছিরে শ্ৰীহরি হইয়াছে। তাহার তেজের সম্মুখে মানুষ আগুনের সামনে কুটার মত কাপে; কুটা কাঁচা হইলে শুকাইয়া যায়, শুকনা হইলে জ্বলিয়া ওঠে।
লোকটি এবার বলিল—তিনু-দাদা, শুনলাম নাকি গেজেটে নিকেছে—দেবুর কাছে টাকা আসবে—সেইসব টাকা-কাপড় বিলি হবে?
তিনকড়ি এতটা বুঝিয়া দেখে নাই; সে এতক্ষণ আস্ফালন করিতেছিল—গেজেটে শ্রীহরিকে বাদ দিয়া কেবল দেবুর নাম প্রকাশিত হইয়াছে—এই গৌরবে। সে যে-কথাটা শ্ৰীহরিকে বারবার বলে—সেই কথাটা গেজেটেও বলিয়াছে—সেই জন্য। সে বলে—তুই বড়লোক আছিস আপনার ঘরে আছি, তার জন্যে তোকে খাতির করব কেন? খাতির করব তাকেই যে খাতিরের লোক। স্বর্ণের পাঠ্যপুস্তক হইতে কয়েকটা লাইন পর্যন্ত সে মুখস্থ করিয়া রাখিয়াছে–
আপনারে বড় বলে বড় সেই নয়,
লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।
বড় হওয়া সংসারেতে কঠিন ব্যাপার,
সংসারে সে বড় হয় বড় গুণ যার।
ধনী শ্ৰীহরিকে বাদ দিয়া গেজেট গুণী দেবুর জয়জয়কার ঘোষণা করিয়াছে—সেই আনন্দেই সে আস্ফালন করিতেছিল। হঠাৎ এই কথাটা শুনিয়া তাহারও মনে হইল, হ্যাঁ, গেজেট তো লিখিয়াছে! যে যাহা সাহায্য করিবেন, বিধাতার আশীর্বাদের মতই তাহা লওয়া হইবে।
তিনকড়ি বলিল-আসবে না? নিশ্চয় আসবে। নইলে গেজেটে নিখলে ক্যান?… তিনকড়ির সে বিষয়ে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ রহিল না। সে ওই কথাটা প্রচার করিবার জন্য তখনই ভল্লা পাড়ায় চলিয়া গেল। রামা, ও রামা! … তেরে! গোবিন্দে! ছিদ্মে! কোথা রে সব?
দেবু তখনও ভাবিতেছিল। এ কে করি? বিশু-ভাই নয় তো? কিন্তু বিশু বিদেশে থাকিয়া এ সব জানিবে কেমন করিয়া? ঠাকুরমহাশয় লিখিয়া জানাইলেন? হয়ত তাই। তাই সম্ভব। কিন্তু এ কি করিল বিশু-ভাই? এ বোঝা আর সহিতে পারিবে না! সে মুক্তি চায়। জীবন তাহার হাঁপাইয়া উঠিয়াছে। ক্লান্তি, অরুচি, তিক্ততায় তাহার অন্তর ভরিয়া উঠিয়াছে। আর দু-তিনটা দিন গেলেই সে তিনকড়ি-কাকার বাড়ি হইতে চলিয়া যাইবে। তিনকড়ির ঋণ তাহার জীবনে শোধ হইবার কথা নয়। রাম ভল্লা তাহাকে বন্যার স্রেত হইতে টানিয়া তুলিয়াছে। কুসুমপুরের ও-মাথা হইতে তিনখানা গ্রাম পার হইয়া দেখুড়িয়ার ধার পর্যন্ত সে ভাসিয়া আসিয়াছিল। তাহার পর হইতে তিনকড়ি তাহাকে নিজের ঘরে আনিয়া গোষ্ঠীসুদ্ধ মিলিয়া যে সেবাটা করিয়াছে তাহার তুলনা হয় না। তিনকড়ির স্ত্রী ও স্বর্ণ, নিজের মা-বোনের মত সেবা করিয়াছে; গৌরও সেবা করিয়াছে সহোদর ভাইয়ের মত। তিনকড়ি তাহাকে আপনার খুড়ার মত যত্ন করিয়াছে। কিন্তু এও তাহার সহ্য হইতেছে না, কোনোরকমে আপনার পা দুইটার উপর সোজা হইয়া দাঁড়াইবার বল পাইলেই সে চলিয়া যাইবে। এই অকৃত্রিম স্নেহের সেবাযত্ন তাহাকে অস্বচ্ছন্দ করিয়া তুলিয়াছে। এও তাহার ভাল লাগিতেছে না। ভোলা জানালা দিয়া দেখা যাইতেছে লোকের ভাঙা ঘর, বন্যার জলে হাজিয়া-যাওয়া শাক-পাতার ক্ষেত, পথের দুধারে পলি-লিপ্ত ঝোপঝাড়, গাছপালা, গ্রাম্য পথখানি যেখানে গ্রাম হইতে বাহির হইয়া মাঠে পড়িয়াছে সেইখান দিয়া পঞ্চগ্রামের মাঠের লম্বা একটা ফালি অংশ কাদায় জলে ভরা-শস্যহীন মাঠ। কিন্তু এসবের কোনো প্রতিফলন তাহার চিন্তার মধ্যে চাঞ্চল্য তুলিতেছে না। সে আর পারিতেছে না। সে আর পারিবে না।
–দেবু-দা! গৌর আসিয়া প্রবেশ করিল, তাহার হাতে সেই কাগজখানা। দেবু তাহার দিকে মুখ ফিরাইয়া বলিলবল!
—এটা কেন লিখেছে দেবু-দা? এই যে?
—কি?
—এই যে, এইখানটা। খবরের কাগজটা দেবুর বিছানার উপর রাখিয়া গৌর বলিল—এই যে!
দেবু হাসিয়া বুলিল—কি কঠিন যে বুঝতে পারলে না? কই দেখি!
গৌর অপ্রস্তুত হইয়া বলিল—আমি না। আমিও তো বললাম–ও আবার কঠিন কি? স্বন্ন।
বলছে!
—কোন জায়গাটা?
–এই যে এই সমস্ত বিপন্ন নরনারীকে রক্ষার দায়িত্ব দেশবাসীর উপর ন্যস্ত। সে দায়িত্বভার গ্রহণ করিতে সকলকে আহ্বান জানাইতেছি। তা স্বন্ন বলছেওই যে সুন্ন দাঁড়িয়ে আছে। আয় না, স্বন্ন, আয় না এখানে!
দেবুও সস্নেহে আহ্বান করিল—এস স্বর্ণ, এস!
স্বর্ণ আসিয়া কাছে দাঁড়াইল।
দেবু বলিল—এর মানে তো কিছু কঠিন নয়!
স্বর্ণ মৃৎস্বরে বলিল দায়িত্ব লিখেছে কেন তাই শুধোলাম দাদাকে। এ তো লোকের কাছে ভিক্ষা চাওয়া! যার দয়া হবে দেবে না হয় দেবে না। সে তো দায়িত্ব নয়!
কথাগুলি দেবুর মস্তিষ্কে গিয়া অদ্ভুতভাবে আঘাত করিল। তাই তো!
স্বর্ণ বলিল—আর আমাদের এখানে বান হয়েছে, তাতে অন্য জায়গার লোকের দায়িত্ব হতে যাবে কেন?
দেবু অবাক হইয়া গেল। সে বুদ্ধিমতী মেয়েটির অর্থবোধের সূক্ষ্ম তারতম্যজ্ঞানের পরিচয় পাইয়া সবিস্ময়ে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। দেবুর সে দৃষ্টি দেখিয়া স্বর্ণ কিন্তু একটু অপ্রতিভ হইল। বলিল—আমি বুঝতে পারি নাই … সে লজ্জিত হইয়াই চলিয়া গেল।… দেবু তখন অবাক হইয়া ভাবিতেছিল, এ কথাটা তো সে ভাবিয়া দেখে নাই! সত্যই তো—নাম নাজানা এই গ্রাম কয়খানির দুঃখ-দুর্দশার জন্য দেশ-দেশান্তরের মানুষের দয়া হইতে পারে, কিন্তু দায়িত্ব তাহাদের কিসের? দায়িত্ব। ওই কথাটা গুরুত্বে ও ব্যাপ্তিতে তাহার অনুভূতির চেতনায় ক্রমশ বিপুল হইয়া উঠিল। সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার এই পঞ্চগ্রামও পরিধিতে বাড়িয়া বিরাট হইয়া উঠিল।
সে ডাকিল—স্বৰ্ণ।
গৌর বসিয়া তখনও ওই লাইন কয়টি পড়িতেছিল। তাহার মনেও কথাটা লাগিয়াছে। সে বলিল—সুন্ন চলে গিয়েছে তো!
—ও। আচ্ছা, ডাক তো তাকে একবার।
ডাকিতে হইল না, স্বর্ণ নিজেই আসিল। গরম দুধের বাটি ও জলের গেলাস হাতে করিয়া আসিয়া বাটিটা নামাইয়া দিয়া বলিল—খান!
দেবু বলিল—তুমি ঠিক ধরেছ স্বর্ণ। তোমার ভুল হয় নাই। তোমার বুদ্ধি দেখে আমি খুশি হয়েছি।
স্বর্ণ লজ্জিত হইয়া এবার মুখ নামাইল।
দেবু বলিল—তুমি রবীন্দ্রনাথের নগরলক্ষ্মী কবিতাটি পড়ে–
দুর্ভিক্ষ শ্রাবস্তীপুরে যবে।
জাগিয়া উঠিল হাহারবে,–
বুদ্ধ নিজ ভক্তগণে শুধালেন জনে জনে
ক্ষুধিতেরে অন্নদান-সেবা
তোমরা লইবে বলো কেবা?
পড়েছ?
স্বর্ণ বলিল–না।
–গৌর, তুমি পড় নি?
—না।
–শোন তবে।
স্বর্ণ বাধা দিয়া বলিল-আগে আপনি দুধটা খেয়ে নিন। জুড়িয়ে যাবে। দুধ খাইয়া, মুখে জল দিয়া দেবু গোটা কবিতাটা আবৃত্তি করিয়া গেল।
স্বর্ণ বলিল-আমাকে লিখে দেবেন কবিতাটি?
দেবু বলিল—তোমাকে এই বই একখানা প্রাইজ দেব আমি।
স্বর্ণের মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল।
–পণ্ডিত মশায় আছেন। কে বাহির হইতে ডাকিল।
গৌর মুখ বাড়াইয়া দেখিয়া বলিল—ডাক-পিওন।
দেবু বলিল—এস। চিঠি আছে বুঝি?
–চিঠি—মনিঅৰ্ডার!
–মনি অর্ডার!
–পঞ্চাশ টাকা পাঠাচ্ছেন বিশ্বনাথবাবু।
বিশ্বনাথ চিঠিও লিখিয়াছে। তাহা হইলে এ সমস্ত বিশ্বনাথই করিয়াছে। লিখিয়াছে—দাদুর পত্রে সব জানিয়াছি, পঞ্চাশ টাকা পাঠাইলাম, আরও টাকা সংগ্ৰহ করিতেছি। তোমার কাছে অনেক মনিঅৰ্ডার যাইবে, আমরাও কয়েকজন শীঘ্ৰ যাইব। কাজ আরম্ভ করিয়া দাও।
টাকাটা লইয়া দেবু চিন্তিত হইয়া পড়িল। বিশ্বনাথ লিখিয়াছে—কাজ আরম্ভ করিয়া দাও। পঞ্চাশ টাকায় সে কী কাজ করিবে? গৌরকে প্রশ্ন করিল-কাকা কোথায় গেলেন দেখ তো গৌর!
দশে মিলি করি কাজ–হারি জিতি নাহি লাজ।
দেবু অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া দশজনের পরামর্শ লইয়াই কাজ করিল। এই কাজে আজ সে একটি পুরনো মানুষের মধ্যে এক নূতন মানুষকে আবিষ্কার করিল। খুব বেশি না হইলেও তবু সে খানিকটা আশ্চর্য হইল। তিনু-কাকার ছেলে গৌর। গৌর সুস্থ সবল ছেলে, কিন্তু শান্ত ও বোকা। বুদ্ধি সত্যই তাহার কম। সেই গৌরের মধ্যে এক অপূর্ব গুণ সে আবিষ্কার করিল। সে স্কুলে পড়ে, স্কুলের ছাত্রদের দেবু ভাল করিয়াই জানে। নিজেও সে উৎসাহী ছাত্র ছিল এবং পাঠশালার পণ্ডিতি করিয়া, গৌরের অপেক্ষা কমবয়সী হইলেও অনেক ছেলে লইয়া কারবার করিয়াছে। এক ধারার ছেলে আছে যাহারা পড়ায় ভাল, কাজকর্মেও উৎসাহী, আর এক ধারার ছেলে আছে যাহারা পড়ায় ভাল নয় অথচ দুর্দান্ত, কাজকর্মে প্রচণ্ড উৎসাহ। এ দুয়ের মাঝামাঝি ছেলেও আছে যাদের একটা আছে আর একটা নাই। আবার দুইটাতেই পিছনে পড়িয়া থাকে, কচ্ছপের মত যাহাদের জীবনের গতি এমন ছেলেও আছে। গৌর ওই শেষের ধরনের ছেলে বলিয়াই তাহার ধারণা ছিল। কিন্তু আজ সে নিজের অদ্ভুত পরিচয় দিল। এ পরিচয় অবশ্য তাহার পক্ষে স্বাভাবিক; সে তিনকড়ির ছেলে। দশে মিলিয়া কাজ করার আয়োজনটায় সে একা যেন। দশজনের শক্তি লইয়া আত্মপ্রকাশ করিল।
তিনকড়ি বলিয়াছিল—আমাদের তাবের লোক যারা, তাদিগেই দুচার টাকা করে দিয়ে কাজ আরম্ভ কর।
দেবু বলিল-দেখুন, পাঁচজনকে ডেকে যা হয় করা যাক। নইলে শেষে কে কি বলবে!
তিনকড়ি বলিলবলবে কচু। বলবে আবার কে কি কোন বেটার ধার ধরি আমরা? কারও বাবার টাকা? আর ডাকবেই বা কাকে?
দেবু হাসিল; তিনু-কাকার কথাবার্তা সে ভাল করিয়াই জানে। হাসিয়া বলিল-আমি বলছি। জগন ডাক্তার, হরেন, ইরসাদ, রহম এই জনকয়েককে।
–রহম? না রহমকে ডাকতে পাবে না। যে লোক দল ভেঙে জমিদারের সঙ্গে গিয়ে জুটেছে। তাকে ডাকতে হবে না।
–না তিনু-কাকা, আপনি ভেবে দেখুন। মানুষের ভুলচুক হয়। আর তা ছাড়া মানুষকে টেনে আপনার করে নিলেই মানুষ আপনার হয়, আবার ঠেলে ফেলে দিলেই পর হয়ে যায়।
তিনকড়ি চুপ করিয়া বসিয়া রহিল, কোনো উত্তর দিল না। কথাটা তাহার মনঃপূত হইল না।
দেবু বলিল—কাকে তা হলে পাঠাই বলুন দেখি? রামকে একবার পাওয়া যাবে না?
গৌর বসিয়া ছিল, সে উঠিয়া কাছে আসিয়া বলিল-আমি যাব দেবুদা।
—তুমি যাবে?
–হ্যাঁ। রাম তো জাতে ভল্লা। রাম ডাকতে গেলে কেউ যদি কিছু মনে করে?
তিনকড়ি গর্জিয়া উঠিল—মনে করবে? কে কি মনে করবে? কোন শালাকে খাবার নেমন্তন্ন করছি যে মনে করবে? তাহার মনের চাপা দেওয়া অসন্তোষটা একটা ছুতা পাইয়া ফাটিয়া পড়িল।
গৌর অপ্রস্তুত হইয়া গেল। দেবু বলিল না—না। গৌর ঠিকই বলেছে তিনু-কাকা।
–ঠিক বলেছে—যাক, মরুক।… বলিয়াই সে উঠিয়া চলিয়া গেল।
দেবু চুপ করিয়া রহিল। বাপের অমতে ছেলেকে যাইতে বলিতে দ্বিধা হইল তাহার।
গৌর বলিল-দেবু-দা! আমি যাই?
—যাবে? কিন্তু তিনু-কাকা—
–বাবা তো যেতে বললে।
–না, যেতে বললেন– কই? রাগ করে উঠে গেলেন তো।
স্বৰ্ণ ঘরে ঢুকিল, সে হাসিয়া বলিলনা, বাবা ওই ভাবেই কথা বলেন। মরগে যা, খালে যা–-এসব বাবার কথার কথা।
গৌর হাসিয়া বলিলবলে না কেবল সুন্নকে।
গৌর ফিরিয়া আসিয়া খবর দিল—সকলকেই খবর দেওয়া হইয়াছে। বুদ্ধি খরচ করিয়া সে বৃদ্ধ দ্বারিকা চৌধুরীকেও খবর দিয়া আসিয়াছে। দেবু খুশি হইয়া বলিল—বেশ করেছ। বৃদ্ধ চৌধুরী পাকা লোক, অথচ তাহার কথাটাই দেবুর মনে হয় নাই। গৌর বলিল—মহাগ্রামের ঠাকুরমশায়কেও খবর দিয়ে এসেছি দেবুদা।
দেবু সবিস্ময়ে বলিল—সে কি! তাকে কি আসতে বলতে আছে? এ তুমি করলে কি? কি বললে তুমি তাকে?
গৌর বলিলতার সঙ্গে দেখা হয় নাই। ওদের বাড়িতে বললাম আমাদের বাড়িতে মিটিং হবে আজ। বানের মিটিং। তাই বলতে এসেছি।
স্বর্ণ হাসিয়া সারা হইয়া গেল–বানের আবার মিটিং হল?
অপরাহ্নে সকলেই আসিয়া হাজির হইল। জগন, হরেন, ইরসাদ, রহম এবং তাহাদের সঙ্গে আরও অনেকে। সতীশ ও পাতু আসিয়াছে; দুর্গাও আসিয়াছে। সে নিত্যই আসে। তাহারই হাতে দেবুর বাড়ির চাবি। সে-ই ঘর-দুয়ার পরিষ্কার করে, দেখেশুনে। বৃদ্ধ দ্বারিকা চৌধুরীও আসিয়াছে। বৃদ্ধ হটিয়া আসিতে পারে নাই, গরুর গাড়ি জুড়িয়া আসিয়াছে; মুশকিল হইয়াছে–তিনকড়ি নাই। সে যে সেই বাহির হইয়াছে, এখনও ফেরে নাই।
বৃদ্ধ বলিলবাবা দেবু, খোঁজ তো দুবেলাই নি। নিজে আসতে পারি নাই।… কথার মাঝখানে হাসিয়া বলিল অন্য দিকে টানছে কিনা। এদিকে তাই পা বাড়াতে পারি না। তা তোমার তলব পেয়ে এ-দিকটার টানটা বাড়ল, হাঁটতে পারলাম না—গরুর গাড়ি করেই এলাম।
দেবু বলিল-আমার শরীর দেখছেন, নইলে
–হ্যাঁ, সে আমি জানি বাবা। তবে কাজটা একটু তাড়াতাড়ি সেরে নাও।
–এই যে কাজ সামান্যই। তিনকড়ি-কাকার জন্যে। তা হোক আমরা বরং আরম্ভ করি ততক্ষণ।
সমস্ত জানাইয়া কাগজ ও মনি-অর্ডারের কুপন দেখাইয়া টাকাটা সকলের সামনে রাখিয়া দেবু বলিলবলুন, এখন কি করব?
জগন বলিল–গরিবদের খেতে দাও। যাদের কিছু নাই তাদের।
হরেন বলিল—আই সাপোর্ট ইট।
দেবু বলিল–চৌধুরী মশায়?
চৌধুরী বলিল—কথা তো ডাক্তার ভাই বলেছেন। তবে আমি বলছিলাম—চাষের এখন পনের বিশ দিন সময় আছে। টাকাটায় বীজধান কিনে দিতে পারলে—
রহম ও ইরসাদ একসঙ্গে বলিয়া উঠিল—এ খুব ভাল যুক্তি।
জগন বলিল–গরিবগুলো শুকিয়ে মরবে তো?
দেবু বলিলপঞ্চাশ টাকাতে তাদের কদিন বাঁচাবে?
—এর পরেও টাকা আসবে।
–সেই টাকা থেকে দেবে তখন।
গৌর দেবুর কানের কাছে আসিয়া ফিসফিস করিয়া বলিল—দেবু-দা, আমরা সব ছেলেরা মিলে—যে-সব গাঁয়ে বান হয় নাই—সেই সব গাঁ থেকে যদি ভিক্ষে করে আনি!
গৌরের বুদ্ধিতে দেবু বিস্মিত হইয়া গেল।
ঠিক এই সময়েই প্রশান্ত কণ্ঠস্বরে বাহির হইতে ডাক আসিল–পণ্ডিত রয়েছেন?
ন্যায়রত্ন মহাশয়। সকলে ব্যস্ত হইয়া তাহাকে অভ্যর্থনা করিতে উঠিয়া দাঁড়াইল। ন্যায়রত্ন ভিতরে আসিয়া, একটু কুণ্ঠার হাসি হাসিয়া বলিলেন—আমার আসতে একটু বিলম্ব হয়ে গেল।
দেবু তাহাকে প্রণাম করিয়া বলিল—আমাকে মার্জনা করতে হবে। আমি আপনাকে খবর দিতে বলি নি। তিনকড়ি-কাকার ছেলে গৌর নিজে একটু বুদ্ধি খরচ করতে গিয়ে এই কাণ্ড করে বসেছে।
—তিনকড়ির ছেলেকে আমি আশীর্বাদ করছি। তোমরা দশের সেবায় পুণ্যার্জনের যজ্ঞ আরম্ভ করেছ, সে যজ্ঞভাগ দিতে আমাকে আহ্বান জানিয়ে এসে সে ভালই করেছে।
গৌর ঢিপ করিয়া তাহার পায়ে প্রণত হইল।
ন্যায়রত্ন বলিলেন কই, তিনকড়ির কন্যাটি কই? বড় ভাল মেয়ে।—আমার একটু জল চাই। পা ধুতে হবে।
স্বর্ণ তাড়াতাড়ি জলের বালতি ও ঘটি হাতে বাহির হইয়া আসিয়া প্ৰণাম করিয়া মৃদুস্বরে বলিল-আমি ধুয়ে দিচ্ছি চরণ।
ন্যায়রত্ন বলিলেন—আমি কিছু সাহায্য এনেছি পণ্ডিত। চাদরের খুঁটি খুলিয়া তিনি দশ টাকার নোট বাহির করিয়া দিলেন।
সমস্ত কথাবার্তা শুনিয়া তিনি বলিলেন প্রথমে বীজধান দেওয়াই উচিত। বীজের জন্য ধানও আমি কিছু সাহায্য করব পণ্ডিত।
সকলে উঠিলে দুর্গা বলিল—কবে বাড়ি যাবে জামাই-পণ্ডিত। আমি আর পারছি না। তোমার বাড়ির চাবি তুমি নাও।
দেবু বলিল—কাল কিংবা পরশুই যাব দুর্গা। দুদিন রাখ চাবিটা।
দুর্গা কাপড়ের অ্যাঁচলে চোখ মুছিল। বলিল—বিলু-দিদির ঘর, বিলু-দিদি নাই, খোকন নাই—যেতে আমার মন হয় না। তার ওপর তুমি নাই। বাড়ি যেন হা হা করে গিলতে আসছে।
এতক্ষণে তিনকড়ি ফিরিল; পিঠে ঝুলাইয়া আনিয়াছে প্রকাণ্ড এক কাতলা মাছ। প্ৰায়। আধমন ওজন হবে। আঠার সেরের কম তো কোনোমতেই নয়। দড়াম করিয়া মাছটি ফেলিয়া বলিলবাপরে, মাছটার পেছু পেছ প্রায় এক কোশ হেঁটেছি। যেয়ো না হে, যেয়ো না, দাঁড়াও; মাছটা কাটি, খানকতক করে সব নিয়ে যাবে। ডাক্তার, ইরসাদ, রহম! দাঁড়াও ভাই; দাঁড়াও একটুকুন!