Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নয়নপুরের মাটি (১৯৫২) || Samaresh Basu » Page 13

নয়নপুরের মাটি (১৯৫২) || Samaresh Basu

১৩. ভর দুপুরবেলা পরান এল

ভর দুপুরবেলা পরান এল মহিমকে ডাকতে।

অহল্যা খাওয়ার শেষে এঁটো থালাবাসন নিয়ে ডোবার দিকে যাচ্ছিল। পরানকে দেখে ঘোমটাটা একটু বাঁ হাতে টেনে দিয়ে বলল, পরানদা যে।

পরান বলল, হ্যাঁ, আসলাম তোমার দেওরকে ডাকতে। মহী কুনঠাঁই? ঘরে আছে। কে ডাকল, কত্তা নাকি?

না। ছেলের বউ।

অহল্যা পরানের দিকে তাকাল। পরানও তাকিয়ে হেসে বলল, তোমাদের মতো তো নয়, শহরের বই। বাপ তার একেবারে সায়েব। দেখো নাই কভু ছেলের বউকে?

অহল্যা বলল, দেখছি। তা, বউ ডাকল যে?

সে কথা মুই জানব কী করে বলো? হয় তো ফরমাস আছে কিছু। বলেই পরানের মুখে এক গাল হাসি ফুটে উঠল। বলল, তোমার দেওর ছাওয়ালটি বড় সোজা নয় বউ। দেখলাম তো সেদিন তারে টলানো বড় কঠিন। ফরমাস মতো কাজ সে করবে না।

অহল্যা নীরব রইল।

মহিম বেরিয়ে এল কাদামাটি হাতে! কী খবর পরানদা?

একবার যেতে হবে ভাই, বউমা ডাকছে তোমারে।

অহল্যা তাকিয়েছিল মহিমের মুখের দিকে। মহিম ক্ষণকাল নীরব থেকে বলল, চলে যাই। তার পর অহল্যাকে বলল, তা হইলে একবার ঘুরে আসি বউদি।

অহল্যা বলল, যাও। দেখো আবার খুঁজতে পাঠাতে না হয়। এবং তার চোরা হাসিটুকু মহিমের চোখ এড়াল না।

মহিম সেদিনের অন্ধকারের যমদূতের মতো ইমারতের মধ্যে আজ দিনের বেলা ঢুকল পরানের সঙ্গে। সেদিন মনে করছিল রাত্রের রূপের সঙ্গে দিনের তফাত থাকবে। কিন্তু না। কেমন যেন একটা তমসাচ্ছন্নভাব নিয়তই এখানে বিরাজ করছে। নিস্তব্ধ, খাঁ খাঁ। প্রথম মহলের সব দরজাগুলোই বন্ধ। দ্বিতীয় মহলের অবস্থাও তাই। তবে সব বন্ধ নয়।

পরান হঠাৎ অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে উঠেছে। বলল, দাঁড়াও একটু, আসছি।

এ মহলের চত্বরে হাওয়া বয়ে যায় না। ঘুরপাক খেয়ে উপরে উঠে যায় আবার। আর এক বিচিত্র শব্দ তুলে দিয়ে যায়। সে হাওয়া দেয়ালে খিলানে থামে আঘাত লেগে দীর্ঘনিশ্বাসের মতো হাহাকার শব্দ তোলে।

মহিমের মনে হল, এত বড় প্রাসাদ, কিন্তু কী সাংঘাতিক নীরব। আর যেন প্রতিটি বন্ধ দরজার জানালার আড়ালে আড়ালে জোড়া জোড়া চোখ উঠোনের মাঝখানে তাকে উগ্র চোরা দৃষ্টিতে দেখছে। সে তাড়াতাড়ি খোলা আকাশের দিকে তাকাল। তাকিয়ে চমকে দেখল, সেই একেবারে উঁচু আলসে থেকে এক রাশ দীর্ঘ চুল এলিয়ে ঝুলে রয়েছে।

কে ওখানে, কার ওই চুল? মহিম চোখ নামাতে পারল না, তাকিয়ে থাকতেও তার বুকের মধ্যে নিশ্বাস আটকে এল। এখুনি কি চলে যাওয়া যায় না এখান থেকে। পরানদা আসে না কেন? হঠাৎ চুল নড়ে উঠল আর আলসের মাথায় একখানি মুখ উঁকি মারল। সে মুখের বিশাল দুই চোখের খরদৃষ্টি তারই দিকে। পরমুহূর্তেই সেদিনের মতো নারীকন্ঠের খিলখিল চাপা হাসি শুনে তার কানের পাশ দিয়ে শিরদাঁড়া পর্যন্ত কী একটা সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেল।

পরান এসে ডাকল, কই, আসসা। কিন্তু মহিমকে উপরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে পরান হঠাৎ বজ্র ফাটানো গলায় একটা চিৎকার করে উঠতেই হাসি থেমে গেল, সেই মুখ, ও চুলও হল

অদৃশ্য।

মহিম এসে জিজ্ঞাসু চোখে পরানের দিকে তাকাল। পরান শান্ত গলায় বলল, পাগল একটা! আসসা বউমা বসে আছে।’ বলে তার মুখের ভাবটা এমনই হয়ে উঠল যে, মহিমের মনে হল আর দ্বিতীয় প্রশ্ন এখানে নিরর্থক।–সেদিন হেমবাবু যে ঘরে বসেছিলেন, সেই ঘরের ভিতর দিয়েই পরান মহিমকে নিয়ে দোতলায় উঠে এল। মহিম আশ্চর্য হল, ঘরে এত আলোর ছড়াছড়ি দেখে। অথচ বাইরে থেকে মনে হয় এ প্রাসাদের ঘর বুঝি সব অন্ধকার।

উমার ঘরে মহিমকে পৌঁছে দিয়ে পরান অদৃশ্য হল। একটা অদ্ভুত সুগন্ধ মহিমের নাসারন্ধ্র আচ্ছন্ন করে দিল। এ ঘরটির আসবাবপত্র সব কিছুই হেমবাবুর ঘরের সঙ্গে মূলত তফাত। দুটি মস্ত বড় জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে দিগন্তবিসারী মাঠ, খাল, ওপার, রাজপুরের সুস্পষ্ট রেখা। আজ জানালা যে মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডাক দেয়, তা বুঝি আগে কখনও জানত না মহিম।

মস্ত বড় খাটের শিয়রের দিকের রেলিং-এ কারুকার্যখচিত কাঠের ফ্রেমে যুগল দম্পত্তির ফটো। একজন উমা, পুরুষটি হেমবাবুর ছেলে হিরণ। আরও নানান রকম মস্ত বড় বড় ছবি দেয়ালে রয়েছে। কেউ ঘোড়ায় চড়ে, কেউ রাইফেল হাতে, মাথায় পাগড়ি, বিচিত্র টুপি, নানান রকম। তার মধ্যে নবাব সিরাজদ্দৌল্লার চিত্রটিই মহিমের চোখে একমাত্র পরিচিত মনে হল।

উমা এমনটিই আশা করেছিল মহিমের কাছ থেকে, এই বিস্মিত মুগ্ধ দৃষ্টি। কিন্তু শিল্পী তো তার দিকে একবারও তাকাল না। এ রুচিবোধের যে অধিকারিণী, ওই দৃষ্টি কি তারও প্রাপ্য নয়। ভাবল, এ হল নয়নপুরের চাষীর ছেলের সঙ্কোচ। কিন্তু সে একবারও এই শিশুর শিল্পীর দিক থেকে চোখ সরাতে পারল না। শিশু, একেবারেই শিশু। ওর চোখেও শিশুরই অতল রহস্য, গভীর দৃষ্টি। ঘাড় অবধি বেয়ে পড়া কোঁচকানো চুলের এখানে ওখানে কাদামাটির দাগ। পরনে একখানি ফতুয়া, মাটির দাগে ভরা ছোট ধুতি। শ্যামল নরম মিষ্টি শিল্পী। এক বিচিত্র রঙের আঁচ লাগিয়ে দিয়েছে শহুরে অভিজাত ঘরের বিদুষী উমার মনে। তবু ওর ঋজু শিরদাঁড়াটা চোখে যেন বড় লাগে। খাড়া, কঠিন, যেন নমনীয় হতে সে জানে না।

উমা বলল, বসো।

সম্বোধন শুনে চমকে ফিরল মহিম। সেই বঙ্কিম ঠোঁট, তবু মমতার আভাস, আবেগদীপ্ত চোখ, অনাড়ম্বর বেশ।

উমাও বুঝল, সম্বোধনে চমক লেগেছে মহিমের। হেসে বলল, তোমাকে তুমি বললাম জমিদারের ছেলের বউ বলে নয়। এত ছেলেমানুষ মনে হয়, কিছুতেই আপনি বলতে ইচ্ছে করে না।

উমার চোখ দেখে সে কথা বিশ্বাস করল মহিম। সে প্রণাম করতে গেল উমাকে। কিন্তু আজ আবার উমা দুহাতে তার হাত ধরে ফেলল। বলল, ছি, বারে বারে পায়ে হাত দিয়ো না। আমি তো তা বলে তোমার বড় নয়।

মহিমের বিস্ময় বেড়েই উঠল। অথচ সেদিন বিদায়ের সময়ে নিঃসঙ্কোচে উমা প্রণাম গ্রহণ করেছিল। সেটা ভেবেই উমা বলল, সেদিন তুমি দুঃখ পাবে ভেবে আর বাধা দিইনি। বসো।

কিন্তু সে বলতে পারল না, সেদিন তার মনে এক বিচিত্র আকাঙক্ষা ও কৌতূহল উদগ্র হয়ে উঠেছিল শিল্পীর হাতের স্পর্শ তার পায়ে লাগার জন্য।

এ ঘরে খদ্দরের কোনও চিহ্ন নেই। মহিম বসল একটি সোফায় সঙ্কোচ আর অত্যন্ত লজ্জায়। উমা তার খুব কাছেই একটি সোফায় বসে বলল, তোমার কথা সব আমি আমাদের কলকাতার বাড়িতে লিখে দিয়েছি। তোমার কলকাতার কাজের কিছু চিহ্ন আমাদের বাড়িতেও আছে। আমার ভাইবোনেরা তো সবাই তোমাকে দেখতে চেয়েছে।

মহিমের চোখে বিস্মিত আনন্দ লক্ষ করে উমার চোখেও খুশি ঝলকে উঠল। অভিমানের সুরে বলল, আমার শ্বশুর পুজোয় যেতে দিলেন না আমাকে। নইলে আমরা সকলে বিদেশে বেড়াতে যেতাম। তবে পুজোর পর নিশ্চয় যাব। তোমাকে নিয়ে গেলে ওরা ভারী খুশি হবে। বিশেষ, শান্তিনিকেতনে আমার যে বোন থাকে, সে তো লাফাবে। হঠাৎ একটু থেমে মুখ টিপে হাসল উমা। তার সপ্রতিভ মুখে একটা লজ্জার আভাস দেখা দিল। বলল, আমার সে বোনটি বড় ফাজিল। চিঠিতে লিখেছে, তোমার ওই নয়নপুরের শিল্পী আবিষ্কার তোমার জীবনে এক মহান কীর্তি। কামনা করি, শিল্পী যেন তার এ একান্ত ভক্তিমতী প্রাণে আরও সাড়া জাগায়। তবে একলা নয়, ভাগ দিয়ো।

না শোনালেও হয় তো চলত, কিন্তু এ কথাটুকু শোনানোর লোভ উমা কিছুতেই সম্বরণ করতে পারল না।

গুণমূল্য নিঃসন্দেহে কিন্তু অপরিসীম লজ্জার আনন্দে ও কৌতূহলে কেমন আচ্ছন্ন হয়ে রইল সে। কথা বলতে পারল না। ভক্তিমতী কথাটি তার প্রাণে এক নতুন অনুভূতির সৃষ্টি করল আর কলকাতার এক আলোকপ্রাপ্ত পরিবারের মধ্যে তার সম্পর্কে আলোচনা ও পত্র-বিনিময় গৌরবের নয় কি? তবু আরও কিছু ছিল উমার বোনের পত্ৰলেখায়, যে কথা উমা মুখে স্পষ্ট বললেও এক অচেনা প্রতিক্রিয়া হল মহিমের মনে।

উমা তার লজ্জার ভাবটুকু কাটিয়ে খানিকটা উদ্বেগের সঙ্গে বলল, সত্যি, সকলে কী মনে করে জানিনে, কিন্তু এতখানি প্রতিভা নিয়ে তুমি নয়নপুরে পড়ে থাকবে, এ ভাবতে আমি কিছুতেই পারিনে। তুমিই বলো, এত বড় দেশে সকলে তোমার কাজের পরিচয় পাবে এ কি তোমার কামনা

নয়?

অন্যদিকে তাকিয়েছিল মহিম। বলল, এমন করে তো ভাবি নাই কোনও দিন।

কিন্তু কেন ভাবো না? কেমন যেন উত্তেজনার লক্ষণ দেখা দিল উমার মধ্যে। বলল, শুনেছি এ দেশে শিল্পীর দুঃখের শেষ নেই, তাদের প্রতিভা বিকাশের পথ বন্ধ। এ আমি বিশ্বাস করিনে। প্রতিভাবান যে, তার মূল্য মানুষকে দিতেই হবে, কিন্তু শিল্পী নিজে যদি তার পথ করে না নেয় বা চেষ্টা না করে তা হলে কেমন করে তা বিকাশ পাবে। তোমার স্থান হল কলকাতা, তুমি পড়ে রইলে নয়নপুরে, তবে কেমন করে তুমি দশজনের মাঝে ছড়িয়ে পড়বে। আমার কথাগুলো হয় তো তোমার ভাল লাগছে না কিন্তু তুমি দেখো, যাঁরা বড় হয়েছেন তাঁরা সকলেই আজ রাজধানীর বুকে জমিয়ে বসে আছেন।

একেবারে অস্বীকার করার মতো কথা নয় অথচ কী জবাব দিতে হবে একথার খুঁজে না পেয়ে অসহায়ের মতো উমার দিকে তাকাল মহিম। একটু পরে বলল, মোরে কী করতে হইবে, বলেন?

উমা তার আরও কাছে সরে এল। নিজের এই আবেগকে সে নিজেই বোধ হয় চেনে না। বলল, তুমি নয়নপুর ছেড়ে চলল, চলো, কলকাতায়।

উমার নিজের কানেই কথাগুলো ভীষণ ঠেকল। কিন্তু নিজেকে সে কিছুতেই দমিয়ে রাখতে পারল না, চোখ ফেরাতে পারল না মহিমের উপর থেকে।

কিন্তু মহিমের বুকে যেন বাজ পড়ল। নয়নপুর ছেড়ে চললা—একথার চেয়ে নির্দয় বুঝি আর কিছু নেই। সে আবার অসহায়ের মতো তাকাল উমার দিকে। সেই আবেগদীপ্ত চোখ, সেই বঙ্কিম ঠোঁটে মমতার আভাস শুধু আর নয়, আরও যেন কী রয়েছে। তার শরীর ঝুঁকে পড়েছে। আঁচল খসা, প্রশস্ত কাঁধ ও বুকের অনেকখানি জায়গা খোলা জামা। সুগঠিত বুকের মাঝখানে এক অন্ধ রহস্য উঁকি মারছে। হৃৎপিণ্ডের শব্দ বুঝি শোনা যায়। স্পন্দিত সোনার হার।

নয়নপুরের খাল থেকে মাঠের উপর দিয়ে হু হু করে দমকা হাওয়া ছুটে এসে ঝাপিয়ে পড়ল ঘরের মধ্যে। এলোমেলো করে দিল সব যেন মনটার মধ্যে।

মহিম মুখ ফিরিয়ে সমস্ত ঘরের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বলল, মোরে খানিক ভাবতে দেন।

প্রশান্ত হয়ে উঠল উমার মুখ। ঠিক হয়ে বসে বলল, রবীন্দ্রনাথের একখানা মূর্তি তোমাকে আমি গড়তে বলেছি। শান্তিনিকেতনে গেলে তাঁকে দেখতে পাবে। তিনি তোমাকে আশীর্বাদ করবেন।

তার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাল, আমাদের ঘরে এমন একটি ছেলে থাকলে তাকে সারা পৃথিবী ঘুরিয়ে আনতাম।

মহিম বলল, আমি তা হইলে যাই?

উমা সে কথার জবাব না দিয়ে বোধ হয় তার আগেকে সংশোধন করার জন্য বলল, আমার কথাগুলো তোমার কাছে বড় অদ্ভুত লাগল, না? আমার শ্বশুরকে ধন্যবাদ, তিনি তোমাকে ডেকে এনেছিলেন।

এতক্ষণে মহিম জিজ্ঞেস করল, কর্তা কই?

তিনি গেছেন কয়েক দিনের জন্য এক দূরের তালুকে। তিনি তোমাকে এখানে এনে রাখতে চান।

মহিম জিজ্ঞেস করল, কেন?

জবাবে উমা বলল, শুনেছি, এ বাড়িতে আগের কালে একজন সাহেব ছবি-আঁকিয়ে ছিলেন মাইনে করা। এ-ঘরের সব ছবি তাঁরই আঁকা। তেমনি এই এস্টেটে তোমাকে আমার শ্বশুর এনে রাখতে চান। আসবে তুমি?

মহিম জানে, রাজা-মহারাজার বাড়িতে এমনই মাইনে করা অনেক বড় বড় শিল্পী থাকেন। বলল, তা তো জানি না। আমার দাদা বউদি রইছেন, অর্জুন পালমশাই আছেন, আমার গুরুমশাই, তাঁরাই বলতে পারেন।

যদি আসো–বলে হঠাৎ চুপ করে গিয়ে মহিমের দিকে তাকিয়ে রইল। এতে তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, কিছুই বোঝা গেল না।

মহিম উঠে দাঁড়াল। কিন্তু সে কিছুতেই উমার চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। তার প্রাণে হাওয়া লেগেছে। বুঝি নয়নপুরের তেপান্তরের দমকা হাওয়ার মতো।

উমা জিজ্ঞেস করল, গৌরাঙ্গবাবুর সঙ্গে তোমার দেখা হয়?

উনি তো মোর সঙ্গে দেখা করেন না। মোরে বুঝি ভালবাসেন না আর।

একটা যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল উমা, সেজন্য তোমার দুঃখের কিছু নেই। আমরা কি ভালবাসি না?

বাসে। কিন্তু সে ভালবাসা মহিমের কাছে অপরিচিত। সে নীরব রইল।

উমা বলল, তুমি এখন কী কাজ করছ? দেখতে ভারী ইচ্ছে হয়। সেই দক্ষনিধনের ক্ষিপ্ত শিব নাকি?

এক মুহূর্তে দ্বিধা করে মহিম বলল, হ্যাঁ। কিন্তু সে এখন থেকেই যে ধর্মদেবের ঘট তৈরি করছে সে কথা বলতে বাধল। সে আবার প্রণামের জন্য ঝুঁকে পড়তেই উমা তার দুহাত ধরে ফেলল।—এ কী, বারণ করলাম না পায়ে হাত দিতে। তা হলে তো দেখছি আপনি করে বলতে হবে।

বলে সে হাত ছেড়ে না দিয়ে যেন সত্যই ভক্তিমতীর মতো ঈশ্বর-অবলোকন করছে এমনিভো তাকিয়ে রইল।

আর উমার সর্বাঙ্গ থেকে বিচিত্র সুগন্ধ তার অনুভূতিতে এক অন্ধ বদ্ধ আবেগের উন্মাদনা এনে দিল, তার হাত কাঁপল উমার হাতের মধ্যে। এত কাছাকাছি উমার দিকে তাকাতে গিয়ে তার চোখের পাতা যেন অসম্ভব ভর হয়ে এল।

উমার চোখ উজ্জ্বল, নির্নিমেষ, দুর্বোধ্য হাসি। বলল, তুমি আমাকে হাত তুলে নমস্কার কর, আমিও তাই করব। ডাকলে এসো কিন্তু!

হাত ছেড়ে দিল সে।

মহিম দরজার কাছে থমকে দাঁড়াল। সঙ্কোচের সঙ্গে বলল, একটা কথা মোরে বলেন!

উমা কাছে এল। মহিম জিজ্ঞেস করল, মুই একটা হাসি শুনছি এ বাড়িতে, মেয়েমানুষের হাসি। উনি কে?

স্তম্ভিত বিস্ময়ে চমকে উঠল উমা, তুমি হাসি শুনেছ?

হ্যাঁ। ওনারে দেখেছি আমি।

কোথায়?

এ মহলের একেবারে উঁচা আল্‌সের ধারে।

মুহূর্তে নীরব থেকে অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বলল, উমা, এ কথা তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করো না। আবার একটু চুপ করে থেকে বলল, যদি তোমায় কখনও কলকাতায় পাই সেদিন বলব।

উমার চোখের মিনতি প্রায় ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল মহিমকে যে, মহিলাটি নয়নপুরের জমিদারের বিদুষী পুত্রবধূ।

সে বেরিয়ে গেল, গেল মনের মধ্যে কে নতুন প্রতিক্রিয়ার ঝড় নিয়ে। প্রথম দিনের চেয়ে আজ তা আরও বিচিত্র। উমার নতুন ভাব এবং এ বাড়ির সমস্ত কিছুই।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress