নৌকাডুবি (41-45)
নৌকাডুবি ৪১
সভাভঙ্গের পর অন্নদা হেমনলিনীকে লইয়া যখন ঘরে ফিরিলেন তখনো সন্ধ্যা হয় নাই। চা খাইতে বসিয়া অন্নদাবাবু কহিলেন, “আজ বড়ো আনন্দলাভ করিয়াছি।”
ইহার অধিক আর তিনি কথা কহিলেন না; তাঁহার মনের ভিতরের দিকে একটা ভাবের স্রোত বহিতেছিল।
আজ চা খাওয়ার পরেই হেমনলিনী আস্তে আস্তে উপরে চলিয়া গেল, অন্নদাবাবু তাহা লক্ষ্য করিলেন না।
আজ সভাস্থলে–নলিনাক্ষ–যিনি বক্তৃতা করিয়াছিলেন, তাঁহাকে দেখিতে আশ্চর্য তরুণ এবং সুকুমার; যুবাবয়সেও যেন শৈশবের অমলান লাবণ্য তাঁহার মুখশ্রীকে পরিত্যাগ করে নাই; অথচ তাঁহার অন্তরাত্মা হইতে যেন একটি ধ্যানপরতার গাম্ভীর্য তাঁহার চতুর্দিকে বিকীর্ণ হইতেছে।
তাঁহার বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘ক্ষতি’। তিনি বলিয়াছিলেন, সংসারে যে ব্যক্তি কিছু হারায় নাই সে কিছু পায় নাই। অমনি যাহা আমাদের হাতে আসে তাহাকে আমরা সম্পূর্ণ পাই না; ত্যাগের দ্বারা আমরা যখন তাহাকে পাই তখনই যথার্থ তাহা আমাদের অন্তরের ধন হইয়া উঠে। যাহা-কিছু আমাদের প্রকৃত সম্পদ তাহা সম্মুখ হইতে সরিয়া গেলেই যে ব্যক্তি হারাইয়া ফেলে সে লোক দুর্ভাগা; বরঞ্চ তাহাকে ত্যাগ করিয়াই তাহাকে বেশি করিয়া পাইবার ক্ষমতা মানবচিত্তের আছে। যাহা আমার যায় তাহার সম্বন্ধে যদি আমি নত হইয়া করজোড় করিয়া বলিতে পারি ‘আমি দিলাম, আমার ত্যাগের দান, আমার দুঃখের দান, আমার অশ্রুর দান’–তবে ক্ষুদ্র বৃহৎ হইয়া উঠে, অনিত্য নিত্য হয় এবং যাহা আমাদের ব্যবহারের উপকরণমাত্র ছিল তাহা পূজার উপকরণ হইয়া আমাদের অন্তঃকরণের দেবমন্দিরের রত্নভাণ্ডারে চিরসঞ্চিত হইয়া থাকে।
এই কথাগুলি আজ হেমনলিনীর সমস্ত হৃদয় জুড়িয়া বাজিতেছে। ছাদের উপরে নক্ষত্রদীপ্ত আকাশের তলে সে আজ স্তব্ধ হইয়া বসিল। তাহার সমস্ত মন আজ পূর্ণ; সমস্ত আকাশ, সমস্ত জগৎসংসার তাহার কাছে আজ পরিপূর্ণ।
বক্তৃতাসভা হইতে ফিরিবার সময় যোগেন্দ্র কহিল, “অক্ষয়, তুমি বেশ পাত্রটি সন্ধান করিয়াছ যা হোক। এ তো সন্ন্যাসী! এর অর্ধেক কথা তো আমি বুঝিতেই পারিলাম না।”
অক্ষয় কহিল, “রোগীর অবস্থা বুঝিয়া ঔষধের ব্যবস্থা করিতে হয়। হেমনলিনী রমেশের ধ্যানে মগ্ন আছেন; সে ধ্যান সন্ন্যাসী নহিলে আমাদের মতো সহজ লোকে ভাঙাইতে পারিবে না। যখন বক্তৃতা চলিতেছিল তখন তুমি কি হেমের মুখ লক্ষ্য করিয়া দেখ নাই?”
যোগেন্দ্র। দেখিয়াছি বৈকি। ভালো লাগিতেছিল তাহা বেশ বুঝা গেল। কিন্তু বক্তৃতা ভালো লাগিলেই যে বক্তাকে বরমাল্য দেওয়া সহজ হয়, তাহার কোনো হেতু দেখি না।
অক্ষয়। ঐ বক্তৃতা কি আমাদের মতো কাহারো মুখে শুনিলে ভালো লাগিত? তুমি জান না যোগেন্দ্র, তপস্বীর উপর মেয়েদের একটা বিশেষ টান আছে। সন্ন্যাসীর জন্য উমা তপস্যা করিয়াছিলেন, কালিদাস তাহা কাব্যে লিখিয়া গেছেন। আমি তোমাকে বলিতেছি, আর যে-কোনো পাত্র তুমি খাড়া করিবে হেমনলিনী রমেশের সঙ্গে মনে মনে তাহার তুলনা করিবে; সে তুলনায় কেহ টিঁকিতে পারিবে না। নলিনাক্ষ মানুষটি সাধারণ লোকের মতোই নয়; ইহার সঙ্গে তুলনার কথা মনেই উদয় হইবে না। অন্য কোনো যুবককে হেমনলিনীর সম্মুখে আনিলেই তোমাদের উদ্দেশ্য সে স্পষ্ট বুঝিতে পারিবে এবং তাহার সমস্ত হৃদয় বিদ্রোহী হইয়া উঠিবে। কিন্তু নলিনাক্ষকে বেশ একটু কৌশল করিয়া যদি এখানে আনিতে পার তাহা হইলে হেমের মনে কোনো সন্দেহ উঠিবে না; তাহার পরে ক্রমে শ্রদ্ধা হইতে মাল্যদান পর্যন্ত কোনোপ্রকারে চালনা করিয়া লইয়া যাওয়া নিতান্ত শক্ত হইবে না।
যোগেন্দ্র। কৌশলটা আমার দ্বারা ভালো ঘটিয়া ওঠে না–বলটাই আমার পক্ষে সহজ। কিন্তু যাই বল পাত্রটি আমার পছন্দ হইতেছে না।
নৌকাডুবি ৪১ (২)
অক্ষয়। দেখো যোগেন, তুমি নিজের জেদ লইয়া সমস্ত মাটি করিয়ো না। সকল সুবিধা একত্রে পাওয়া যায় না। যেমন করিয়া হোক, রমেশের চিন্তা হেমনলিনীর মন হইতে না তাড়াইতে পারিলে আমি তো ভালো বুঝি না। তুমি যে গায়ের জোরে সেটা করিয়া উঠিতে পারিবে, তাহা মনেও করিয়ো না। আমার পরামর্শ অনুসারে যদি ঠিকমত চল তাহা হইলে তোমাদের একটা সদ্গতি হইতেও পারে।
যোগেন্দ্র। আসল কথা, নলিনাক্ষ আমার পক্ষে একটু বেশি দুর্বোধ। এরকম লোকদের লইয়া কারবার করিতে আমি ভয় করি। একটা দায় হইতে উদ্ধার হইতে গিয়া ফের আর-একটা দায়ের মধ্যে জড়াইয়া পড়িব।
অক্ষয়। ভাই, তোমরা নিজের দোষে পুড়িয়াছ, আজকে সিঁদুরে মেঘ দেখিয়া আতঙ্ক লাগিতেছে। রমেশ সম্বন্ধে তোমরা যে গোড়াগুড়ি একেবারে অন্ধ ছিলে। এমন ছেলে আর হয় না, ছলনা কাহাকে বলে রমেশ তাহা জানে না, দর্শনশাসেত্র রমেশ দ্বিতীয় শংকরাচার্য বলিলেই হয়, আর সাহিত্যে স্বয়ং সরস্বতীর ঊনবিংশ শতাব্দীর পুরুষ-সংস্করণ! রমেশকে প্রথম হইতেই আমার ভালো লাগে নাই–ঐরকম অত্যুচ্চ-আদর্শ-ওয়ালা লোক আমার বয়সে আমি ঢের-ঢের দেখিয়াছি। কিন্তু আমার কথাটি কহিবার জো ছিল না; তোমরা জানিতে, আমার মতো অযোগ্য অভাজন কেবল মহাত্মা-লোকর্ ো করিতেই জানে, আমাদের আর কোনো ক্ষমতা নাই। যা হোক, এতদিন পরে বুঝিয়াছ মহাপুরুষদের দূর হইতে ভক্তি করা চলে, কিন্তু তাঁহাদের সঙ্গে নিজের বোনের বিবাহের সম্বন্ধ করা নিরাপদ নহে। কিন্তু কণ্টকেনৈব কন্টকম্। যখন এই একটিমাত্র উপায় আছে, তখন আর এ লইয়া খুঁত খুঁত করিতে বসিয়ো না।
যোগেন্দ্র। দেখো অক্ষয়, তুমি যে আমাদের সকলের আগে রমেশকে চিনিতে পারিয়াছিলে, এ কথা হাজার বলিলেও আমি বিশ্বাস করিব না। তখন নিতান্ত গায়ের জ্বালায় তুমি রমেশকে দু চক্ষে দেখিতে পারিতে না; সেটা যে তোমার অসাধারণ বুদ্ধির পরিচয় তাহা আমি মানিব না। যাই হোক, কলকৌশলের যদি প্রয়োজন থাকে তবে তুমি লাগো, আমার দ্বারা হইবে না। মোটের উপরে, নলিনাক্ষকে আমার ভালোই লাগিতেছে না।
যোগেন্দ্র এবং অক্ষয় উভয়ে যখন অন্নদার চা খাইবার ঘরে আসিয়া পৌঁছিল, দেখিল, হেমনলিনী ঘরের অন্য দ্বার দিয়া বাহির হইয়া যাইতেছে। অক্ষয় বুঝিল, হেমনলিনী তাহাদিগকে জানালা দিয়া পথেই দেখিতে পাইয়াছিল। ঈষৎ একটু হাসিয়া সে অন্নদার কাছে আসিয়া বসিল। চায়ের পেয়ালা ভর্তি করিয়া লইয়া কহিল, “নলিনাক্ষবাবু যাহা বলেন একেবারে প্রাণের ভিতর হইতে বলেন, সেইজন্য তাঁহার কথাগুলা এত সহজে প্রাণের মধ্যে গিয়া প্রবেশ করে।”
অন্নদাবাবু কহিলেন, “লোকটির ক্ষমতা আছে।”
অক্ষয় কহিল, “শুধু ক্ষমতা! এমন সাধুচরিত্রের লোক দেখা যায় না।”
যোগেন্দ্র যদিও চক্রান্তের মধ্যে ছিল তবু সে থাকিতে না পারিয়া বলিয়া উঠিল, “আঃ, সাধুচরিত্রের কথা আর বলিয়ো না; সাধুসঙ্গ হইতে ভগবান আমাদিগকে পরিত্রাণ করুন।”
যোগেন্দ্র কাল এই নলিনাক্ষের সাধুতার অজস্র প্রশংসা করিয়াছিল, এবং যাহারা নলিনাক্ষের বিরুদ্ধে কথা কহে তাহাদিগকে নিন্দুক বলিয়া গালি দিয়াছিল।
অন্নদা কহিলেন, “ছি যোগেন্দ্র, অমন কথা বলিয়ো না। বাহির হইতে যাঁহাদিগকে ভালো বলিয়া মনে হয় অন্তরেও তাঁহারা ভালো, এ কথা বিশ্বাস করিয়া বরং আমি ঠকিতে রাজি আছি, তবু নিজের ক্ষুদ্র বুদ্ধিমত্তার গৌরবরক্ষার জন্য সাধুতাকে সন্দেহ করিতে আমি প্রস্তুত নই। নলিনাক্ষবাবু যে-সব কথা বলিয়াছেন এ-সমস্ত পরের মুখের কথা নহে; তাঁহার নিজের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার ভিতর হইতে তিনি যাহা প্রকাশ করিয়াছেন আমার পক্ষে আজ তাহা নূতন লাভ বলিয়া মনে হইয়াছে। যে ব্যাক্তি কপট সে ব্যক্তি সত্যকার জিনিস দিবে কোথা হইতে? সোনা যেমন বানানো যায় না এ-সব কথাও তেমনি বানানো যায় না। আমার ইচ্ছা হইয়াছে নলিনাক্ষবাবুকে আমি নিজে গিয়া সাধুবাদ দিয়া আসিব।”
নৌকাডুবি ৪১ (৩)
অক্ষয় কহিল, “আমার ভয় হয়, ইঁহার শরীর টেঁকে কি না।”
অন্নদাবাবু ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “কেন, ইঁহার শরীর কি ভালো নয়?”
অক্ষয়। ভালো থাকিবার তো কথা নয়; দিনরাত্রি আপনার সাধনা এবং শাসত্রালোচনা লইয়াই আছেন, শরীরের প্রতি তো আর দৃষ্টি নাই।
অন্নদা কহিলেন, “এটা ভারি অন্যায়। শরীর নষ্ট করিবার অধিকার আমাদের নাই; আমরা আমাদের শরীর সৃষ্টি করি নাই। আমি যদি উঁহাকে কাছে পাইতাম তবে নিশ্চয়ই অল্পদিনেই আমি উঁহার স্বাসেথ্যর ব্যবস্থা করিয়া দিতে পারিতাম। আসলে স্বাসথ্যরক্ষার গুটিকতক সহজ নিয়ম আছে, তাহার মধ্যে প্রথম হচ্ছে–”
যোগেন্দ্র অধৈর্য হইয়া কহিল, “বাবা, বৃথা কেন তোমরা ভাবিয়া মরিতেছ? নলিনাক্ষবাবুর শরীর তো দিব্য দেখিলাম; তাঁহাকে দেখিয়া আজ আমার বেশ বোধ হইল, সাধুত্ব-জিনিসটা স্বাসথ্যকর। আমার নিজেরই মনে হইতেছে, ওটা চেষ্টা করিয়া দেখিলে হয়।”
অন্নদা কহিলেন, “না যোগেন্দ্র, অক্ষয় যাহা বলিতেছে তাহা হইতেও পারে। আমাদের দেশে বড়ো বড়ো লোকেরা প্রায় অল্প বয়সেই মারা যান, ইঁহারা নিজের শরীরকে উপেক্ষা করিয়া দেশের লোকসান করিয়া থাকেন। এটা কিছুতে ঘটিতে দেওয়া উচিত নয়। যোগেন্দ্র, তুমি নলিনাক্ষবাবুকে যাহা মনে করিতেছ তাহা নয়, উঁহার মধ্যে আসল জিনিস আছে। উঁহাকে এখন হইতেই সাবধান করিয়া দেওয়া দরকার।”
অক্ষয়। আমি উঁহাকে আপনার কাছে আনিয়া উপস্থিত করিব। আপনি যদি উঁহাকে একটু ভালো করিয়া বুঝাইয়া দেন তো ভালো হয়। আর, আমার মনে হয়, আপনি সেই-যে শিকড়ের রসটা আমাকে পরীক্ষার সময় দিয়াছিলেন সেটা আশ্চর্য বলকারক। যে-কোনো লোক সর্বদা মনকে খাটাইতেছে তাহার পক্ষে এমন মহৌষধ আর নাই। আপনি যদি একবার নলিনাক্ষবাবুকে–
যোগেন্দ্র একেবারে চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া পড়িয়া কহিল, “আঃ অক্ষয়, তুমি জ্বালাইলে। বড়ো বাড়াবাড়ি করিতেছ। আমি চলিলাম।”
নৌকাডুবি ৪২
পূর্বে যখন তাঁহার শরীর ভালো ছিল তখন অন্নদাবাবু ডাক্তারি ও কবিরাজি নানাপ্রকার বটিকাদি সর্বদাই ব্যবহার করিতেন–এখন আর ওষুধ খাইবারও উৎসাহ নাই এবং নিজের অস্বাসথ্য লইয়া আজকাল তিনি আর আলোচনামাত্রও করেন না, বরঞ্চ তাহা গোপন করিতেই চেষ্টা করেন।
আজ তিনি যখন অসময়ে কেদারায় ঘুমাইতেছিলেন তখন সিঁড়িতে পদশব্দ শুনিয়া হেমনলিনী কোল হইতে সেলাইয়ের সামগ্রী নামাইয়া তাহার দাদাকে সতর্ক করিয়া দিবার জন্য দ্বারের কাছে গেল। গিয়া দেখিল, তাহার দাদার সঙ্গে সঙ্গে নলিনাক্ষবাবু আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। তাড়াতাড়ি অন্য ঘরে পালাইবার উপক্রম করিতেই যোগেন্দ্র তাহাকে ডাকিয়া কহিল, “হেম, নলিনাক্ষবাবু আসিয়াছেন, ইঁহার সঙ্গে তোমার পরিচয় করাইয়া দিই।”
হেম থমকিয়া দাঁড়াইল এবং নলিনাক্ষ তাহার সম্মুখে আসিতেই তাহার মুখের দিকে না চাহিয়া নমস্কার করিল। অন্নদাবাবু জাগিয়া উঠিয়া ডাকিলেন, “হেম!” হেম তাঁহার কাছে আসিয়া মৃদুস্বরে কহিল, “নলিনাক্ষবাবু আসিয়াছেন।”
যোগেন্দ্রের সহিত নলিনাক্ষ ঘরে প্রবেশ করিতেই অন্নদাবাবু ব্যস্তভাবে অগ্রসর হইয়া নলিনাক্ষকে অভ্যর্থনা করিয়া আনিলেন। কহিলেন, “আজ আমার বড়ো সৌভাগ্য, আপনি আমার বাড়িতে আসিয়াছেন। হেম, কোথায় যাইতেছ মা, এইখানে বোসো। নলিনাক্ষবাবু, এটি আমার কন্যা হেম–আমরা দুজনেই সেদিন আপনার বক্তৃতা শুনিতে গিয়া বড়ো আনন্দলাভ করিয়া আসিয়াছি। আপনি ঐ-যে একটি কথা বলিয়াছেন–আমরা যাহা পাইয়াছি তাহা কখনোই হারাইতে পারি না, যাহা যথার্থ পাই নাই তাহাই হারাই, এ কথাটির অর্থ বড়ো গভীর। কী বলো মা হেম? বাস্তবিক, কোন্ জিনিসটিকে যে আমার করিতে পারিয়াছি আর কোন্টিকে পারি নাই তাহার পরীক্ষা হয় তখনি যখনি তাহা আমাদের হাতের কাছ হইতে সরিয়া যায়। নলিনাক্ষবাবু, আপনার কাছে আমাদের একটি অনুরোধ আছে। মাঝে মাঝে আপনি আসিয়া যদি আমাদের সঙ্গে আলোচনা করিয়া যান তবে আমাদের বড়ো উপকার হয়। আমরা বড়ো কোথাও বাহির হই না–আপনি যখনি আসিবেন আমাকে আর আমার মেয়েটিকে এই ঘরেই দেখিতে পাইবেন।”
নলিনাক্ষ আলজ্জিত হেমনলিনীর মুখের দিকে একবার চাহিয়া কহিল, “আমি বক্তৃতাসভায় বড়ো বড়ো কথা বলিয়া আসিয়াছি বলিয়া আপনারা আমাকে মস্ত একটা গম্ভীর লোক মনে করিবেন না। সেদিন ছাত্ররা নিতান্ত ধরিয়া পড়িয়াছিল বলিয়া বক্তৃতা করিতে গিয়াছিলাম–অনুরোধ এড়াইবার ক্ষমতা আমার একেবারেই নাই-কিন্তু এমন করিয়া বলিয়া আসিয়াছি যে, দ্বিতীয় বার অনুরুদ্ধ হইবার আশঙ্কা আমার নাই। ছাত্ররা স্পষ্টই বলিতেছে, আমার বক্তৃতা বারো-আনা বোঝাই যায় নাই। যোগেনবাবু, আপনিও তো সেদিন উপস্থিত ছিলেন-আপনাকে সতৃষ্ণনয়নে ঘড়ির দিকে তাকাইতে দেখিয়া আমার হৃদয় যে বিচলিত হয় নাই, এ কথা মনে করিবেন না।”
যোগেন্দ্র কহিল, “আমি ভালো বুঝিতে পারি নাই সেটা আমার বুদ্ধির দোষ হইতে পারে, সেজন্য আপনি কিছুমাত্র ক্ষুব্ধ হইবেন না।”
অন্নদা। যোগেন, সব কথা বুঝিবার বয়স সব নয়।
নলিনাক্ষ। সব কথা বুঝিবার দরকারও সব সময়ে দেখি না।
অন্নদা। কিন্তু নলিনবাবু, আপনাকে আমার একটা কথা বলিবার আছে। ঈশ্বর আপনাদিগকে কাজ করাইয়া লইবার জন্য পৃথিবীতে পাঠাইয়াছেন, তাই বলিয়া শরীরকে অবহেলা করিবেন না। যাঁহারা দাতা তাঁহাদের এ কথা সর্বদাই সমরণ করাইতে হয় যে, মূলধন নষ্ট করিয়া ফেলিবেন না, তাহা হইলে দান করিবার শক্তি চলিয়া যাইবে।
নলিনাক্ষ। আপনি যদি আমাকে কখনো ভালো করিয়া জানিবার অবসর পান তবে দেখিবেন, আমি সংসারে কোনো-কিছুকেই অবহেলা করি না। জগতে নিতান্তই ভিক্ষুকের মতো আসিয়াছিলাম, বহুকষ্টে বহুলোকের আনুকূল্যে শরীর-মন অল্পে অল্পে প্রস্তুত হইয়া উঠিয়াছে। আমার পক্ষে এ নবাবি শোভা পায় না যে, আমি কিছুকেই অবহেলা করিয়া নষ্ট করিব। যে ব্যক্তি গড়িতে পারে না সে ব্যক্তি ভাঙিবার অধিকারী তো নয়।
নৌকাডুবি ৪২ (২)
অন্নদা। বড়ো ঠিক কথা বলিয়াছেন। আপনি কতকটা এই ভাবের কথাই সেদিনকার প্রবন্ধেও বলিয়াছিলেন।
যোগেন্দ্র। আপনারা বসুন, আমি চলিলাম–একটু কাজ আছে।
নলিনাক্ষ। যোগেনবাবু, আপনি কিন্তু আমাকে মাপ করিবেন। নিশ্চয় জানিবেন, লোককে অতিষ্ঠ করা আমার স্বভাব নয়। আজ নাহয় আমি উঠি। চলুন, খানিকটা রাস্তা আপনার সঙ্গে যাওয়া যাক।
যোগেন্দ্র। না না, আপনি বসুন। আমার প্রতি লক্ষ করিবেন না। আমি কোথাও বেশিক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতে পারি না।
অন্নদা। নলিনাক্ষবাবু, যোগেনের জন্য আপনি ব্যস্ত হইবেন না। যোগেন এমনি যখন খুশি আসে যখন খুশি যায়, উহাকে ধরিয়া রাখা শক্ত।
যোগেন্দ্র চলিয়া গেলে অন্নদাবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “নলিনবাবু, আপনি এখন কোথায় আছেন?”
নলিনাক্ষ হাসিয়া কহিল, “আমি যে বিশেষ কোথাও আছি তাহা বলিতে পারি না। আমার জানাশুনা লোক অনেক আছেন, তাঁহারা আমাকে টানাটানি করিয়া লইয়া বেড়ান। আমার সে মন্দ লাগে না। কিন্তু মানুষের চুপ করিয়া থাকারও প্রয়োজন আছে। তাই যোগেনবাবু আমার জন্য আপনাদের বাড়ির ঠিক পাশের বাড়িতেই স্থান করিয়া দিয়াছেন। এ গলিটি বেশ নিভৃত বটে।”
এই সংবাদে অন্নদাবাবু বিশেষ আনন্দপ্রকাশ করিলেন। কিন্তু তিনি যদি লক্ষ্য করিয়া দেখিতেন তো দেখিতে পাইতেন যে, কথাটা শুনিবামাত্র হেমনলিনীর মুখ ক্ষণকালের জন্য বেদনায় বিবর্ণ হইয়া গেল। ঐ পাশের বাসাতেই রমেশ ছিল।
ইতিমধ্যে চা তৈরির খবর পাইয়া সকলে মিলিয়া নীচে চা খাইবার ঘরে গেলেন। অন্নদাবাবু কহিলেন, “মা হেম, নলিনবাবুকে এক পেয়ালা চা দাও।”
নলিনাক্ষ কহিল, “না অন্নদাবাবু, আমি চা খাইব না।”
অন্নদা। সে কি কথা নলিনবাবু! এক পেয়ালা চা–নাহয় তো কিছু মিষ্টি খান।
নলিনাক্ষ। আমাকে মাপ করিবেন।
অন্নদা। আপনি ডাক্তার, আপনাকে আর কী বলিব। মধ্যাহ্নভোজনের তিন-চার ঘণ্টা পরে চায়ের উপলক্ষে খানিকটা গরম জল খাওয়া হজমের পক্ষে যে নিতান্ত উপকারী। অভ্যাস না থাকে যদি, আপনাকে নাহয় খুব পাতলা করিয়া চা তৈরি করিয়া দিই।
নলিনাক্ষ চকিতের মধ্যে হেমনলিনীর মুখের দিকে চাহিয়া বুঝিতে পারিল যে, হেমনলিনী নলিনাক্ষের চা খাইতে সংকোচ সম্বন্ধে একটা কী আন্দাজ করিয়াছে এবং তাহাই লইয়া মনে মনে আন্দোলন করিতেছে। তৎক্ষণাৎ হেমনলিনীর দিকে চাহিয়া নলিনাক্ষ কহিল, “আপনি যাহা মনে করিতেছেন তাহা সম্পূর্ণ ঠিক নয়। আপনাদের এই চায়ের টেবিলকে আমি ঘৃণা করিতেছি বলিয়া মনেও করিবেন না। পূর্বে আমি যথেষ্ট চা খাইয়াছি, চায়ের গন্ধে এখনো আমার মনটা উৎসুক হয়–আপনাদের চা খাইতে দেখিয়া আমি আনন্দবোধ করিতেছি। কিন্তু আপনারা বোধ হয় জানেন না, আমার মা অত্যন্ত আচারপরায়ণা–আমি ছাড়া তাঁহার যথার্থ আপনার কেহ নাই–সেই মার কাছে আমি সংকুচিত হইয়া যাইতে পারিব না। এইজন্য আমি চা খাই না। কিন্তু আপনারা চা খাইয়া যে সুখটুকু পাইতেছেন আমি তাহার ভাগ পাইতেছি। আপনাদের আতিথ্য হইতে আমি বঞ্চিত নহি।”
ইতিপূর্বে নলিনাক্ষের কথাবার্তায় হেমনলিনী মনে মনে একটু যেন আঘাত পাইতেছিল। সে বুঝিতে পারিতেছিল, নলিনাক্ষ নিজেকে তাহাদের কাছে ঠিকভাবে প্রকাশ করিতেছিল না। সে কেবলই বেশি কথা কহিয়া নিজেকে ঢাকিয়া রাখিবারই চেষ্টা করিতেছিল। হেমনলিনী জানিত না, প্রথম পরিচয়ে নলিনাক্ষ একটা একান্ত সংকোচের ভাব কিছুতেই তাড়াইতে পারে না। এইজন্য নূতন লোকের কাছে অনেক স্থলেই সে নিজের স্বভাবের বিরুদ্ধে জোর করিয়া প্রগল্ভ হইয়া উঠে। নিজের অকৃত্রিম মনের কথা বলিতে গেলেও তাহার মধ্যে একটা বেসুর লাগাইয়া বসে। সেটা নিজের কানেও ঠেকে। সেইজন্যই আজ যোগেন্দ্র যখন অধীর হইয়া উঠিয়া পড়িল তখন নলিনাক্ষ মনের মধ্যে একটা ধিক্কার অনুভব করিয়া তাহার সঙ্গে পালাইবার চেষ্টা করিয়াছিল।
কিন্তু নলিনাক্ষ যখন মার কথা বলিল তখন হেমনলিনী শ্রদ্ধার চক্ষে তাহার মুখের দিকে না চাহিয়া থাকিতে পারিল না, এবং মাতার উল্লেখমাত্রে সেই মুহূর্তেই নলিনাক্ষের মুখে যে একটি সরস ভক্তির গাম্ভীর্য প্রকাশ পাইল তাহা দেখিয়া হেমনলিনীর মন আর্দ্র হইয়া গেল। তাহার ইচ্ছা করিতে লাগিল নলিনাক্ষের মাতার সম্বন্ধে তাহার সঙ্গে আলোচনা করে, কিন্তু সংকোচে তাহা পারিল না।
অন্নদাবাবু ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “বিলক্ষণ। এ কথা পূর্বে জানিলে আমি কখনোই আপনাকে চা খাইতে অনুরোধ করিতাম না। মাপ করিবেন।”
নলিনাক্ষ একটু হাসিয়া কহিল, “চা লইতে পারিলাম না বলিয়া আপনাদের স্নেহের অনুরোধ হইতে কেন বঞ্চিত হইব?”
নলিনাক্ষ চলিয়া গেলে হেমনলিনী তাহার পিতাকে লইয়া দোতলার ঘরে গিয়া বসিল এবং বাংলা মাসিক পত্রিকা হইতে প্রবন্ধ বাছিয়া তাঁহাকে পড়িয়া শুনাইতে লাগিল। শুনিতে শুনিতে অন্নদাবাবু অনতিবিলম্বে ঘুমাইয়া পড়িলেন। কিছুদিন হইতে অন্নদাবাবুর শরীরে এইরূপ অবসাদের লক্ষণ নিয়মিতভাবে প্রকাশ পাইতেছে।
নৌকাডুবি ৪৩
কয়েক দিনের মধ্যেই নলিনাক্ষের সহিত অন্নদাবাবুদের পরিচয় ঘনিষ্ঠ হইয়া আসিল। প্রথমে হেমনলিনী মনে করিয়াছিল, নলিনাক্ষের মতো লোকের কাছে কেবল বড়ো বড়ো আধ্যাত্মিক বিষয়েই বুঝি উপদেশ পাওয়া যাইবে; এমন মানুষের সঙ্গে যে সাধারণ বিষয়ে সহজ লোকের মতো আলাপ চলিতে পারে তাহা মনেও করিতে পারে নাই। অথচ সমস্ত হাস্যালাপের মধ্যে নলিনাক্ষের একটা কেমন দূরত্বও ছিল।
একদিন অন্নদাবাবু ও হেমনলিনীর সঙ্গে নলিনাক্ষের কথাবার্তা চলিতেছিল, এমন সময়ে যোগেন্দ্র কিছু উত্তেজিত হইয়া আসিয়া কহিল, “জান বাবা, আজকাল আমাদিগকে সমাজের লোকে নলিনাক্ষবাবুর চেলা বলিতে আরম্ভ করিয়াছে। তাই লইয়া এইমাত্র পরেশের সঙ্গে আমার খুব ঝগড়া হইয়া গেছে।”
অন্নদাবাবু একটু হাসিয়া বলিলেন, “ইহাতে আমি তো লজ্জার কথা কিছু দেখি না। যেখানে সকলেই গুরু, কেহই চেলা নয়, সেই দলে মিশিতেই আমার লজ্জাবোধ হয়; সেখানে শিক্ষা দিবার হুড়োমুড়িতে শিক্ষা পাইবার অবকাশ থাকে না।”
নলিনাক্ষ। অন্নদাবাবু, আমিও আপনার দলে; আমরা চেলার দল। যেখানে আমাদের কিছু শিখিবার সম্ভাবনা আছে সেইখানেই আমরা তলপি বহিয়া বেড়াইব।
যোগেন্দ্র অধীর হইয়া কহিল, “না না, কথাটা ভালো নয়। নলিনবাবু, কেহই যে আপনার বন্ধু বা আত্মীয় হইতে পারিবে না, যাহারা আপনার কাছে আসিবে, তাহারাই আপনার চেলা বলিয়া খ্যাত হইয়া যাইবে, এমন বদনামটা হাসিয়া উড়াইয়া দিবার নহে। আপনি কী সব কাণ্ড করেন, ওগুলা ছাড়িয়া দিন।”
নিলনাক্ষ। কী করিয়া থাকি বলুন।
যোগেন্দ্র। ঐ-যে শুনিয়াছি প্রাণায়াম করেন, ভোরের বেলায় সূর্যের দিকে তাকাইয়া থাকেন, খাওয়াদাওয়া লইয়া নানাপ্রকার আচার-বিচার করিতে ছাড়েন না, ইহাতে দশের মধ্যে আপনি খাপছাড়া হইয়া পড়েন।
যোগেন্দ্রের এই রূঢ়বাক্যে ব্যথিত হইয়া হেমনলিনী মাথা নিচু করিল। নলিনাক্ষ হাসিয়া কহিল, “যোগেনবাবু দশের মধ্যে খাপছাড়া হওয়াটা দোষের। কিন্তু তলোয়ারই কী, আর মানুষই কী, তাহার সবটাই কি খাপের মধ্যে থাকে? খাপের ভিতরে তলোয়ারের যে অংশটা থাকিতে বাধ্য সেটাতে সকল তলোয়ারেরই ঐক্য আছে-বোহিরের হাতলটাতে শিল্পীর ইচ্ছা ও নৈপুণ্য-অনুসারে কারিগরি নানা রকমের হইয়া থাকে। মানুষেরও দশের খাপের বাহিরে নিজের বিশেষ কারিগরির একটা জায়গা আছে, সেটাও কি আপনারা বেদখল করিতে চান? আর, আমার কাছে এও আশ্চর্য লাগে, আমি সকলের অগোচরে ঘরে বসিয়া যে-সকল নিরীহ অনুষ্ঠান করিয়া থাকি তাহা লোকের চোখেই বা পড়ে কী করিয়া, আর তাহা লইয়া আলোচনাই বা হয় কেন?”
যোগেন্দ্র। আপনি তা জানেন না বুঝি? যাহারা জগতের উন্নতির ভার সম্পূর্ণ নিজের স্কন্ধে লইয়াছে তাহারা পরের ঘরে কোথায় কী ঘটিতেছে তাহা খুঁজিয়া বাহির করা কর্তব্যের মধ্যেই গণ্য করে। যেটুকু খবর না পায় সেটুকু পূরণ করিয়া লইবার শক্তিও তাহাদের আছে। এ নহিলে বিশ্বের সংশোধনকার্য চলিবে কী করিয়া? তা ছাড়া নলিনবাবু, পাঁচ জনে যাহা না করে তাহা চোখের আড়ালে করিলেও চোখে পড়িয়া যায়, যাহা সকলেই করে তাহাতে কেহ দৃষ্টিপাত করে না। এই দেখুন-না কেন, আপনি ছাদে বসিয়া কী সব কাণ্ড করেন তাহা আমাদের হেমের চোখেও পড়িয়া গেছে–হেম সে কথা বাবাকে বলিতেছিল–অথচ হেম তো আপনার সংশোধনের ভার গ্রহণ করে নাই।
হেমনলিনীর মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল; সে ব্যথিত হইয়া একটা-কী বলিবার উপক্রম করিবামাত্র নলিনাক্ষ কহিল, “আপনি কিছুমাত্র লজ্জা পাইবেন না; ছাদে বেড়াইতে উঠিয়া সকালে-সন্ধ্যায় আপনি যদি আমার আহ্নিককৃত্য দেখিয়া থাকেন, সেজন্য আপনাকে কে দোষী করিবে? আপনার দুটি চক্ষু আছে বলিয়া আপনি লজ্জিত হইবেন না; ও দোষটা আমাদেরও আছে।”
অন্নদা। তা ছাড়া হেম আপনার আহ্নিক সম্বন্ধে আমার কাছে কোনো আপত্তি প্রকাশ করে নাই। সে শ্রদ্ধাপূর্বক আপনার সাধনপ্রণালী সম্বন্ধে আমাকে প্রশ্ন করিতেছিল।
যোগেন্দ্র। আমি কিন্তু ও-সব কিছু বুঝি না। আমরা সাধারণে সংসারে সহজ রকমে যে ভাবে চলিয়া যাইতেছি তাহাতে কোনো বিশেষ অসুবিধা দেখিতেছি না–গোপনে অদ্ভুত কাণ্ড করিয়া বিশেষ কিছু যে লাভ হয় আমার তাহা মনে হয় না–বরং উহাতে মনের যেন একটা সামঞ্জস্য নষ্ট হইয়া মানুষকে একঝোঁকা করিয়া দেয়। কিন্তু আপনি আমার কথায় রাগ করিবেন না–আমি নিতান্তই সাধারণ মানুষ, পৃথিবীর মধ্যে আমি নেহাত মাঝারি রকম জায়গাটাতেই থাকি; যাঁহারা কোনোপ্রকার উচ্চমঞ্চে চড়িয়া বসেন আমার পক্ষে ঢেলা না মারিয়া তাঁহাদের নাগাল পাইবার কোনো সম্ভাবনা নাই। আমার মতো এমন অসংখ্য লোক আছে, অতএব আপনি যদি সকলকে ছাড়িয়া কোনো অদ্ভুতলোকে উধাও হইয়া যান তবে আপনাকে অসংখ্য ঢেলা খাইতে হইবে।
নৌকাডুবি ৪৩ (২)
নলিনাক্ষ। ঢেলা যে নানা রকমের আছে। কোনোটা বা স্পর্শ করে, কোনোটা বা চিহ্নিত করিয়া যায়। যদি কেহ বলে, লোকটা পাগলামি করিতেছে, ছেলেমানুষি করিতেছে, তাহাতে কোনো ক্ষতি করে না; কিন্তু যখন বলে, লোকটা সাধুগিরি-সাধকগিরি করিতেছে, গুরু হইয়া উঠিয়া চেলা-সংগ্রহের চেষ্টায় আছে, তখন সে কথাটা হাসিয়া উড়াইবার চেষ্টা করিতে গেলে যে পরিমাণ হাসির দরকার হয় সে পরিমাণ অপর্যাপ্ত হাসি জোগায় না।
যোগেন্দ্র। কিন্তু আবার বলিতেছি, আমার উপরে রাগ করিবেন না নলিনবাবু। আপনি ছাদে উঠিয়া যাহা খুশি করুন, আমি তাহাতে আপত্তি করিবার কে? আমার বক্তব্য কেবল এই যে, সাধারণের সীমানার মধ্যে নিজেকে ধরিয়া রাখিলে কোনো কথা থাকে না। সকলের যেরকম চলিতেছে আমার তেমনি চলিয়া গেলেই যথেষ্ট; তার বেশি চলিতে গেলেই লোকের ভিড় জমিয়া যায়। তাহারা গালি দিক বা ভক্তি করুক, তাহাতে কিছু আসে যায় না; কিন্তু জীবনটা এইরকম ভিড়ের মধ্যে কাটানো কি আরামের?
নলিনাক্ষ। যোগেন্দ্রবাবু, যান কোথায়? আমাকে আমার ছাদের উপর হইতে একেবারে সর্বসাধারণের শানবোঁধানো এক তলার মেঝের উপর সবলে হঠাৎ উত্তীর্ণ করিয়া দিয়া পালাইলে চলিবে কেন?
যোগেন্দ্র। আজকের মতো আমার পক্ষে যথেষ্ট হইয়াছে, আর নয়। একটু ঘুরিয়া আসি গে।
যোগেন্দ্র চলিয়া গেলে পর হেমনলিনী মুখ নত করিয়া টেবিল-ঢাকার ঝালরগুলির প্রতি অকারণে উপদ্রব করিতে লাগিল। সে সময়ে অনুসন্ধান করিলে তাহার চক্ষু-পল্লবের প্রান্তে একটা আর্দ্রতার লক্ষণও দেখা যাইত।
হেমনলিনী দিনে দিনে নলিনাক্ষের সহিত আলাপ করিতে করিতে আপনার অন্তরের দৈন্য দেখিতে পাইল এবং নলিনাক্ষের পথ অনুসরণ করিবার জন্য ব্যাকুলভাবে ব্যগ্র হইয়া উঠিল। অত্যন্ত দুঃখের সময় যখন সে অন্তরে-বাহিরে কোনো অবলম্বন খুঁজিয়া পাইতেছিল না, তখনই নলিনাক্ষ বিশ্বকে তাহার সম্মুখে যেন নূতন করিয়া উদ্ঘাটিত করিল। ব্রহ্মচারিণীর মতো একটা নিয়মপালনের জন্য তাহার মন কিছুদিন হইতে উৎসুক ছিল–কারণ, নিয়ম মনের পক্ষে একটা দৃঢ় অবলম্বন; শুধু তাহাই নহে, শোক কেবলমাত্র মনের ভাব আকারে টিঁকিতে চায় না, সে বাহিরেও একটা কোনো কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্যে আপনাকে সত্য করিয়া তুলিতে চেষ্টা করে। এ পর্যন্ত হেমনলিনী সেরূপ কিছু করিতে পারে নাই, লোকচক্ষুপাতের সংকোচে বেদনাকে সে অত্যন্ত গোপনে আপনার মনের মধ্যেই পালন করিয়া আসিয়াছে। নলিনাক্ষের সাধনপ্রণালীর অনুসরণ করিয়া আজ যখন সে শুচি আচার ও নিরামিষ আহার গ্রহণ করিল তখন তাহার মন বড়ো তৃপ্তিলাভ করিল। নিজের শয়নঘরের মেজে হইতে মাদুর ও কার্পেট তুলিয়া ফেলিয়া বিছানাটি এক ধারে পর্দার দ্বারা আড়াল করিল; সে ঘরে আর-কোনো জিনিস রাখিল না। সেই মেজে প্রত্যহ হেমনলিনী স্বহস্তে জল ঢালিয়া পরিষ্কার করিত-একটি রেকাবিতে কয়েকটি ফুল থাকিত; স্নানান্তে শুবিস্ত্র পরিয়া সেইখানে মেজের উপরে হেমনলিনী বসিত; সমস্ত মুক্ত বাতায়ন দিয়া ঘরের মধ্যে অবারিত আলোক প্রবেশ করিত এবং সেই আলোকের দ্বারা, আকাশের দ্বারা, বায়ুর দ্বারা সে আপনার অন্তঃকরণকে অভিষিক্ত করিয়া লইত। অন্নদাবাবু সম্পূর্ণভাবে হেমনলিনীর সহিত যোগ দিতে পারিতেন না; কিন্তু নিয়মপালনের দ্বারা হেমনলিনীর মুখে যে-একটি পরিতৃপ্তির দীপ্তি প্রকাশ পাইত তাহা দেখিয়া বৃদ্ধের মন সিনগ্ধ হইয়া যাইত। এখন হইতে নলিনাক্ষ আসিলে হেমনলিনীর এই ঘরেই মেজের উপরে বসিয়া তাঁহাদের তিন জনের মধ্যে আলোচনা চলিত।
যোগেন্দ্র একেবারে বিদ্রোহী হইয়া উঠিল–”এ-সমস্ত কী হইতেছে? তোমরা যে সকলে মিলিয়া বাড়িটাকে ভয়ংকর পবিত্র করিয়া তুলিলে–আমার মতো লোকের এখানে পা ফেলিবার জায়গা নাই।”
আগে হইলে যোগেন্দ্রের বিদ্রূপে হেমনলিনী অত্যন্ত কুণ্ঠিত হইয়া পড়িত–এখন অন্নদাবাবু যোগেন্দ্রের কথায় মাঝে মাঝে রাগ করিয়া উঠেন, কিন্তু হেমনলিনী নলিনাক্ষের সঙ্গে যোগ দিয়া শান্তসিনগ্ধভাবে হাস্য করে। এখন সে একটি দ্বিধাহীন নিশ্চিন্ত নির্ভর অবলম্বন করিয়াছে–এ সম্বন্ধে লজ্জা করাকেও সে দুর্বলতা বলিয়া জ্ঞান করে। লোকে তাহার এখনকার সমস্ত আচরণকে অদ্ভুত মনে করিয়া পরিহাস করিতেছে তাহা সে জানিত; কিন্তু নলিনাক্ষের প্রতি তাহার ভক্তি ও বিশ্বাস সমস্ত লোককে আচ্ছন্ন করিয়া উঠিয়াছে–এইজন্য লোকের সম্মুখে সে আর সংকুচিত হইত না।
নৌকাডুবি ৪৩ (৩)
একদিন হেমনলিনী প্রাতঃস্নানের পর উপাসনা শেষ করিয়া তাহার সেই নিভৃত ঘরটিতে বাতায়নের সম্মুখে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া আছে, এমন সময় হঠাৎ অন্নদাবাবু নলিনাক্ষকে লইয়া সেখানে উপস্থিত হইলেন। হেমনলিনীর হৃদয় তখন পরিপূর্ণ ছিল। সে তৎক্ষণাৎ ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রথমে নলিনাক্ষকে ও পরে তাহার পিতাকে প্রণাম করিয়া পদধূলি গ্রহণ করিল। নলিনাক্ষ সংকুচিত হইয়া উঠিল। অন্নদাবাবু কহিলেন, “ব্যস্ত হইবেন না নলিনবাবু, হেম আপনার কর্তব্য করিয়াছে।”
অন্যদিন এত সকালে নলিনাক্ষ এখানে আসে না। তাই বিশেষ ঔৎসুক্যের সহিত হেমনলিনী তাহার মুখের দিকে চাহিল। নলিনাক্ষ কহিল, “কাশী হইতে মার খবর পাওয়া গেল, তাঁহার শরীর তেমন ভালো নাই; তাই আজ সন্ধ্যার ট্রেনে কাশীতে যাইব স্থির করিয়াছি। দিনের বেলায় যথাসম্ভব আমার সমস্ত কাজ সারিয়া লইতে হইবে, তাই এখন আপনাদের কাছে বিদায় লইতে আসিয়াছি।”
অন্নদাবাবু কহিলেন, “কী আর বলিব, আপনার মার অসুখ, ভগবান করুন তিনি শীঘ্র সুস্থ হইয়া উঠুন। এই কয়দিনে আমরা আপনার কাছে যে উপকার পাইয়াছি তাহার ঋণ কোনোকালে শোধ করিতে পারিব না।”
নলিনাক্ষ কহিল, “নিশ্চয় জানিবেন, আপনাদের কাছ হইতে আমি অনেক উপকার পাইয়াছি। প্রতিবেশীকে যেমন যত্নসাহায্য করিতে হয় তাহা তো করিয়াইছেন–তা ছাড়া যে-সকল গভীর কথা লইয়া এতদিন আমি একলা মনে মনে আলোচনা করিতেছিলাম, আপনাদের শ্রদ্ধার দ্বারা তাহাকে নূতন তেজ দিয়াছেন–আমার ভাবনা ও সাধনা আপনাদের জীবন অবলম্বন করিয়া আমার পক্ষে আরো দ্বিগুণ আশ্রয়স্থল হইয়া উঠিয়াছে। অন্য মানুষের হৃদয়ের সহযোগিতায় সার্থকতালাভ যে কত সহজ হইয়া উঠিতে পারে, তাহা আমি বেশ বুঝিয়াছি।”
অন্নদা কহিলেন, “আমি আশ্চর্য এই দেখিলাম, আমাদের একটা-কিছুর বড়োই প্রয়োজন হইয়াছিল, কিন্তু সেটা যে কী আমরা জানিতাম না; ঠিক এমন সময়েই কোথা হইতে আপনাকে পাইলাম এবং দেখিলাম আপনাকে নহিলে আমাদের চলিত না। আমরা অত্যন্ত কুনো, লোকজনের কাছে যাতায়াত আমাদের বড়ো বেশি নাই; কোনো সভায় গিয়া বক্তৃতা শুনিবার বাতিক আমাদের একেবারে নাই বলিলেই হয়–যদি বা আমি যাই, কিন্তু হেমকে নড়াইতে পারা বড়ো শক্ত। কিন্তু সেদিন এ কী আশ্চর্য বলুন দেখি–যেমনি যোগেনের কাছে শুনিলাম আপনি বক্তৃতা করিবেন, আমরা দুজনেই কোনো আপত্তি প্রকাশ না করিয়া সেখানে গিয়া উপস্থিত হইলাম–এমন ঘটনা কখনো ঘটে নাই। এ-সব কথা মনে রাখিবেন নলিনবাবু। ইহা হইতে বুঝিবেন, আপনাকে আমাদের নিঃসন্দিগ্ধ প্রয়োজন আছে, নহিলে এমনটি ঘটিতে পারিত না। আমরা আপনার দায়স্বরূপ।”
নলিনাক্ষ। আপনারাও এ কথা মনে রাখিবেন, আপনাদের কাছে ছাড়া আর কাহারো কাছে আমি আমার জীবনের গূঢ়কথা প্রকাশ করি নাই। সত্যকে প্রকাশ করিতে পারাই সত্য সম্বন্ধে চরম শিক্ষা। সেই প্রকাশ করিবার গভীর প্রয়োজন আপনাদের দ্বারাই মিটাইতে পারিয়াছি। অতএব আপনাদিগকে আমার যে কতখানি প্রয়োজন ছিল সে কথাও আপনারা কখনো ভুলিবেন না।
হেমনলিনী কোনো কথা কহে নাই; বাতায়নের ভিতর দিয়া রৌদ্র আসিয়া মেজের উপরে পড়িয়াছিল, তাহারই দিকে তাকাইয়া সে চুপ করিয়া বসিয়া ছিল। নলিনাক্ষের যখন উঠিবার সময় হইল তখন সে কহিল, “আপনার মা কেমন থাকেন সে খবর আমরা যেন জানিতে পাই।”
নলিনাক্ষ উঠিয়া দাঁড়াইতেই হেমনলিনী পুনর্বার তাহাকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিল।
নৌকাডুবি ৪৪
এ কয়দিন অক্ষয় দেখা দেয় নাই। নলিনাক্ষ কাশীতে চলিয়া গেলে আজ সে যোগেন্দ্রের সঙ্গে অন্নদাবাবুর চায়ের টেবিলে দেখা দিয়াছে। অক্ষয় মনে মনে স্থির করিয়াছিল যে, রমেশের সমৃতি হেমনলিনীর মনে কতখানি জাগিয়া আছে তাহা পরিমাপ করিবার সহজ উপায় অক্ষয়ের প্রতি তাহার বিরাগপ্রকাশ। আজ দেখিল, হেমনলিনীর মুখ প্রশান্ত; অক্ষয়কে দেখিয়া তাহার মুখের ভাব কিছুমাত্র বিকৃত হইল না; সহজ প্রসন্নতার সহিত হেমনলিনী কহিল, “আপনাকে যে এতদিন দেখি নাই?”
অক্ষয় কহিল, “আমরা কি প্রত্যহ দেখিবার যোগ্য?”
হেমনলিনী হাসিয়া কহিল, “সে যোগ্যতা না থাকিলে যদি দেখাশোনা বন্ধ করা উচিত বোধ করেন, তবে আমাদের অনেককেই নির্জনবাস অবলম্বন করিতে হয়।”
যোগেন্দ্র। অক্ষয় মনে করিয়াছিল একলা বিনয় করিয়া বাহাদুরি লইবে, হেম তাহার উপরেও টেক্কা দিয়া সমস্ত মনুষ্যজাতির হইয়া বিনয় করিয়া লইল, কিন্তু এ সম্বন্ধে আমার একটুখানি বলিবার কথা আছে। আমাদের মতো সাধারণ লোকই প্রত্যহ দেখাশোনার যোগ্য–আর যাঁরা অসাধারণ, তাঁহাদিগকে কদাচ-কখনো দেখাই ভালো, তাহার বেশি সহ্য করা শক্ত। এইজন্যই তো অরণ্যে-পর্বতে-গহ্বরেই তাঁহারা ঘুরিয়া বেড়ান-লোকালয়ে তাঁহারা স্থায়িভাবে বসতি আরম্ভ করিয়া দিলে অক্ষয়-যোগেন্দ্র প্রভৃতি নিতান্তই সামান্য লোকদের অরণ্যে-পর্বতে ছুটিতে হইত।
যোগেন্দ্রের কথাটার মধ্যে যে খোঁচা ছিল, হেমনলিনীকে তাহা বিঁধিল। কোনো উত্তর না দিয়া তিন পেয়ালা চা তৈরি করিয়া সে অন্নদা অক্ষয় ও যোগেন্দ্রের সম্মুখে স্থাপন করিল। যোগেন্দ্র কহিল, “তুমি বুঝি চা খাইবে না?”
হেমনলিনী জানিত, এবার যোগেন্দ্রের কাছে কঠিন কথা শুনিতে হইবে, তবু সে শান্ত দৃঢ়তার সহিত বলিল, “না, আমি চা ছাড়িয়া দিয়াছি।”
যোগেন্দ্র। এবারে রীতিমত তপস্যা আরম্ভ হইল বুঝি! চায়ের পাতার মধ্যে বুঝি আধ্যাত্মিক তেজ যথেষ্ট নাই, যা-কিছু আছে, সমস্তই হর্তুকির মধ্যে? কী বিপদেই পড়া গেল! হেম, ও-সমস্ত রাখিয়া দাও। এক পেয়ালা চা খাইলেই যদি তোমার যোগ-যাগ ভাঙিয়া যায়, তবে যাক-না–এ সংসারে খুব মজবুত জিনিসও টেঁকে না, অমন পলকা ব্যাপার লইয়া পাঁচ জনের মধ্যে চলা অসম্ভব।
এই বলিয়া যোগেন্দ্র উঠিয়া স্বহস্তে আর-এক পেয়ালা চা তৈরি করিয়া হেমনলিনীর সম্মুখে রাখিল। সে তাহাতে হস্তক্ষেপ না করিয়া অন্নদাবাবুকে কহিল, “বাবা, আজ যে তুমি শুধু চা খাইলে? আর কিছু খাইবে না?”
অন্নদাবাবুর কণ্ঠস্বর এবং হাত কাঁপিতে লাগিল, “মা, আমি সত্য বলিতেছি, এ টেবিলে কিছু খাইতে আমার মুখে রোচে না। যোগেনের কথাগুলো আমি অনেকক্ষণ পর্যন্ত নীরবে সহ্য করিতে চেষ্টা করিতেছি। জানি আমার শরীর-মনের এ অবস্থায় কথা বলিতে গেলেই আমি কী বলিতে কী বলিয়া ফেলি–শেষকালে অনুতাপ করিতে হইবে।”
হেমনলিনী তাহার পিতার চেয়ারের পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “বাবা, তুমি রাগ করিয়ো না। দাদা আমাকে চা খাওয়াইতে চান, সে তো ভালোই; আমি তো কিছু তাহাতে মনে করি নাই। না বাবা, তোমাকে খাইতে হইবে–খালি-পেটে চা খাইলে তোমার অসুখ করে আমি জানি।”
এই বলিয়া হেম আহার্যের পাত্র তাহার বাপের সম্মুখে টানিয়া আনিল। অন্নদা ধীরে ধীরে খাইতে লাগিলেন।
নৌকাডুবি ৪৪ (২)
নৌকাডুবি ৪৪ (২)
হেমনলিনী নিজের চৌকিতে ফিরিয়া আসিয়া যোগেন্দ্রের প্রস্তুত চায়ের পেয়ালা হইতে চা খাইতে উদ্যত হইল। অক্ষয় তাড়াতাড়ি উঠিয়া কহিল, “মাপ করিবেন, ও পেয়ালাটি আমাকে দিতে হইবে, আমার পেয়ালা ফুরাইয়া গেছে।”
যোগেন্দ্র উঠিয়া আসিয়া হেমনলিনীর হাত হইতে পেয়ালা টানিয়া লইল এবং অন্নদাকে কহিল, “আমার অন্যায় হইয়াছে, আমাকে মাপ করো।”
অন্নদা তাহার কোনো উত্তর করিতে পারিলেন না, দেখিতে দেখিতে তাঁহার দুই চোখ দিয়া জল গড়াইয়া পড়িল।
যোগেন্দ্র অক্ষয়কে লইয়া আস্তে আস্তে ঘর হইতে সরিয়া গেল। অন্নদাবাবু আহার করিয়া উঠিয়া হেমনলিনীর হাত ধরিয়া কম্পমান চরণে উপরের ঘরে গেলেন।
সেই রাত্রেই অন্নদাবাবুর শূলবেদনার মতো হইল। ডাক্তার আসিয়া পরীক্ষা করিয়া বলিল, তাহার যকৃতের বিকার উপস্থিত হইয়াছে–এখনো রোগ অগ্রসর হয় নাই, এইবেলা পশ্চিমে কোনো স্বাসথ্যকর স্থানে গিয়া বৎসরখানেক কিংবা ছয় মাস বাস করিয়া আসিলে শরীর নির্দোষ হইতে পারিবে।
বেদনা উপশম হইলে ও ডাক্তার চলিয়া গেলে অন্নদাবাবু কহিলেন, “হেম, চলো মা, আমরা কিছুদিন নাহয় কাশীতে গিয়াই থাকি।”
ঠিক একই সময়ে হেমনলিনীর মনেও সে কথা উদয় হইয়াছিল। নলিনাক্ষ চলিয়া যাইবামাত্র হেম আপন সাধনসম্বন্ধে একটু দুর্বলতা অনুভব করিতে আরম্ভ করিয়াছিল। নলিনাক্ষের উপস্থিতিমাত্রই হেমনলিনীর সমস্ত আহ্নিকক্রিয়াকে যেন দৃঢ় অবলম্বন দিত। নলিনাক্ষের মুখশ্রীতেই যে একটা স্থির নিষ্ঠা ও প্রশান্ত প্রসন্নতার দীপ্তি ছিল তাহাই হেমনলিনীর বিশ্বাসকে সর্বদাই যেন বিকশিত করিয়া রাখিয়াছিল, নলিনাক্ষের অবর্তমানে তাহার উৎসাহের মধ্যে যেন একটা মলান ছায়া আসিয়া পড়িল। তাই আজ সমস্ত দিন হেমনলিনী নলিনাক্ষের উপদিষ্ট সমস্ত অনুষ্ঠান অনেক জোর করিয়া এবং বেশি করিয়া পালন করিয়াছে। কিন্তু তাহাতে শ্রান্তি আসিয়া এমনি নৈরাশ্য উপস্থিত হইয়াছিল যে, সে অশ্রুসংবরণ করিতে পারে নাই। চায়ের টেবিলে দৃঢ়তার সহিত সে আতিথ্যে প্রবৃত্ত হইয়াছিল, কিন্তু তাহার মনের মধ্যে একটা ভার চাপিয়া ছিল। আবার তাহাকে তাহার সেই পূর্বসমৃতির বেদনা দ্বিগুণবেগে আক্রমণ করিয়াছে–আবার তাহার মন যেন গৃহহীন-আশ্রয়হীনের মতো হা হা করিয়া বেড়াইতে উদ্যত হইয়াছে। তাই যখন সে কাশী যাইবার প্রস্তাব শুনিল তখন ব্যগ্র হইয়া কহিল, “বাবা, সেই বেশ হইবে।”
পরদিন একটা আয়োজনের উদ্যোগ দেখিয়া যোগেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “কী, ব্যাপারটা কী?”
অন্নদা কহিলেন, “আমরা পশ্চিমে যাইতেছি।”
যোগেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “পশ্চিমে কোথায়?”
অন্নদা কহিলেন, “ঘুরিতে ঘুরিতে একটা কোনো জায়গা পছন্দ করিয়া লইব।” তিনি যে কাশীতে যাইতেছিলেন এ কথা এক দমে যোগেন্দ্রের কাছে বলিতে সংকুচিত হইলেন।
যোগেন্দ্র কহিল, “আমি কিন্তু এবার তোমাদের সঙ্গে যাইতে পারিব না। আমি সেই হেড্মাস্টারির জন্য দরখাস্ত পাঠাইয়া দিয়াছি, তাহার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করিতেছি।”
নৌকাডুবি ৪৫
রমেশ প্রত্যুষেই এলাহাবাদ হইতে গাজিপুরে ফিরিয়া আসিল। তখন রাস্তায় অধিক লোক ছিল না, এবং শীতের জড়িমায় রাস্তার ধারের গাছগুলা যেন পল্লবাবরণের মধ্যে আড়ষ্ট হইয়া দাঁড়াইয়া ছিল। পাড়ার বস্তিগুলির উপরে তখনো একখানা করিয়া সাদা কুয়াশা, ডিম্বগুলির উপরে নিস্তব্ধ-আসীন রাজহংসের মতো স্থির হইয়া ছিল। সেই নির্জন পথে গাড়ির মধ্যে একটা মস্ত মোটা ওভারকোটের নীচে রমেশের বক্ষঃস্থল চঞ্চল হৃৎপিণ্ডের আঘাতে কেবলই তরঙ্গিত হইতেছিল।
বাংলার বাহিরে গাড়ি দাঁড় করাইয়া রমেশ নামিল। ভাবিল, গাড়ির শব্দ নিশ্চয়ই কমলা শুনিয়াছে, শব্দ শুনিয়া সে হয়তো বারান্দায় বাহির হইয়া আসিয়াছে। স্বহস্তে কমলার গলায় পরাইয়া দিবার জন্য এলাহাবাদ হইতে রমেশ একটি দামি নেকলেস কিনিয়া আনিয়াছে; তাহারই বাক্সটা রমেশ তাহার ওভারকোটের বৃহৎ পকেট হইতে বাহির করিয়া লইল।
বাংলার সম্মুখে আসিয়া রমেশ দেখিল, বিষন-বেহারা বারান্দায় শুইয়া অকাতরে নিদ্রা দিতেছে–ঘরের দ্বারগুলি বন্ধ। বিমর্ষমুখে রমেশ একটু থমকিয়া দাঁড়াইল। একটু উচ্চস্বরে ডাকিল, “বিষন!” ভাবিল, এই ডাকে ঘরের ভিতরকার নিদ্রাও ভাঙিবে। কিন্তু এমন করিয়া নিদ্রা ভাঙাইবার যে অপেক্ষা আছে, ইহাই তাহার মনে বাজিল; রমেশ তো অর্ধেক রাত্রি ঘুমাইতে পারে নাই।
দুই-তিন ডাকেও বিষন উঠিল না; শেষকালে ঠেলিয়া তাহাকে উঠাইতে হইল। বিষন উঠিয়া বসিয়া ক্ষণকাল হতবুদ্ধির মতো তাকাইয়া রহিল। রমেশ জিজ্ঞাসা করিল, “বহুজি ঘরে আছেন?”
বিষন প্রথমটা রমেশের কথা যেন বুঝিতেই পারিল না; তাহার পরে হঠাৎ চমকিত হইয়া উঠিয়া করিল, “হাঁ, তিনি ঘরেই আছেন।”
এই বলিয়া সে পুনর্বার শুইয়া পড়িয়া নিদ্রা দিবার উপক্রম করিল।
রমেশ দ্বার ঠেলিতেই দ্বার খুলিয়া গেল। ভিতরে গিয়া ঘরে ঘরে ঘুরিয়া দেখিল, কেহ কোথাও নাই। তথাপি একবার উচ্চৈঃস্বরে ডাকিল, “কমলা!” কোথাও কোনো সাড়া পাইল না। বাহিরের বাগানে নিমগাছতলা পর্যন্ত ঘুরিয়া আসিল; রান্নাঘরে, চাকরদের ঘরে, আস্তাবল-ঘরে সন্ধান করিয়া আসিল; কোথাও কমলাকে দেখিতে পাইল না। তখন রৌদ্র উঠিয়া পড়িয়াছে–কাকগুলা ডাকিতে আরম্ভ করিয়াছে এবং বাংলার ইঁদারা হইতে জল লইবার জন্য কলস মাথায় পাড়ার মেয়ে দুই-একজন দেখা দিতেছে। পথের ওপারে কুটিরপ্রাঙ্গণে কোনো পল্লিনারী বিচিত্র উচ্চ সুরে গান গাহিতে গাহিতে জাঁতায় গম ভাঙিতে আরম্ভ করিয়াছে।
রমেশ বাংলাঘরে ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, বিষন পুনরায় গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন। তখন সে নত হইয়া দুই হাতে খুব করিয়া বিষনকে ঝাঁকানি দিতে লাগিল; দেখিল তাহার নিশ্বাসে তাড়ির প্রবল গন্ধ ছুটিতেছে।
ঝাঁকানির বিষম বেগে বিষন অনেকটা প্রকৃতিস্থ হইয়া ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। রমেশ পুনর্বার জিজ্ঞাসা করিল, “বহুজি কোথায়?”
বিষন কহিল, “বহুজি তো ঘরেই আছেন।”
রমেশ। কই, ঘরে কোথায়?
বিষন। কাল তো এখানেই আসিয়াছেন।
রমেশ। তাহার পরে কোথায় গেছেন?
বিষন হাঁ করিয়া রমেশের মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল।
এমন সময় খুব চওড়া পাড়ের এক বাহারে ধুতি পরিয়া চাদর উড়াইয়া রক্তবর্ণচক্ষু উমেশ আসিয়া উপস্থিত হইল। রমেশ তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “উমেশ, তোর মা কোথায়?”
উমেশ কহিল, “মা তো কাল হইতে এখানেই আছেন।”
রমেশ জিজ্ঞাসা করিল, “তুই কোথায় ছিলি?”
উমেশ কহিল, “আমাকে মা কাল বিকালে সিধুবাবুদের বাড়ি যাত্রা শুনিতে পাঠাইয়াছিলেন।”
গাড়োয়ান আসিয়া কহিল, “বাবু, আমার ভাড়া।”
নৌকাডুবি ৪৫ (২)
রমেশ তাড়াতাড়ি সেই গাড়িতে চড়িয়া একেবারে খুড়ার বাড়িতে গিয়া উপস্থিত হইল। সেখানে গিয়া
দেখিল, বাড়িসুদ্ধ সকলেই যেন চঞ্চল। রমেশের মনে হইল, কমলার বুঝি কোনো অসুখ করিয়াছে। কিন্তু তাহা নহে। কাল সন্ধ্যার কিছু পরেই উমা হঠাৎ অত্যন্ত চীৎকার করিয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিল এবং তাহার মুখ নীল ও হাত-পা ঠাণ্ডা হইয়া পড়ায় সকলেই অত্যন্ত ভয় পাইয়া গেল। তাহার চিকিৎসা লইয়া কাল বাড়িসুদ্ধ সকলেই ব্যতিব্যস্ত হইয়া ছিল। সমস্ত রাত কেহ ঘুমাইতে পায় নাই।
রমেশ মনে করিল, উমির অসুখ হওয়াতে নিশ্চয়ই কাল কমলাকে এখানে আনানো হইয়াছিল। বিপিনকে কহিল, “কমলা তা হইলে উমিকে লইয়া খুবই উদ্বিগ্ন হইয়া আছে?”
কমলা কাল রাত্রে এখানে আসিয়াছিল কি না বিপিন তাহা নিশ্চয় জানিত না, তাই রমেশের কথায় একপ্রকার সায় দিয়া কহিল, “হাঁ, তিনি উমিকে যেরকম ভালোবাসেন, খুব ভাবিতেছেন বৈকি। কিন্তু ডাক্তার বলিয়াছে, ভাবনার কোনো কারণই নাই।”
যাহা হউক, অত্যন্ত উল্লাসের মুখে কল্পনার পূর্ণ উচ্ছ্বাসে বাধা পাইয়া রমেশের মনটা বিকল হইয়া গেল। সে ভাবিতে লাগিল, তাহাদের মিলনে যেন একটা দৈবের ব্যাঘাত আছে।
এমন সময় রমেশের বাংলা হইতে উমেশ আসিয়া উপস্থিত হইল। এখানকার অন্তঃপুরে তাহার গতিবিধি ছিল। এই বালকটাকে শৈলজা স্নেহও করিত। বাড়ির ভিতরে শৈলজার ঘরের মধ্যে সে প্রবেশ করিতেছে দেখিয়া উমির ঘুম ভাঙিবার আশঙ্কায় শৈল তাড়াতাড়ি ঘরের বাহির হইয়া আসিল।
উমেশ জিজ্ঞাসা করিল, “মা কোথায় মাসিমা?”
শৈল বিসিমত হইয়া কহিল, “কেন রে, তুই তো কাল তাহাকে সঙ্গে লইয়া ও বাড়িতে গেলি। সন্ধ্যার পর আমাদের লছমনিয়াকে ওখানে পাঠাইবার কথা ছিল, খুকির অসুখে তাহা পারি নাই।”
উমেশ মুখ মলান করিয়া কহিল, “ও বাড়িতে তো তাঁহাকে দেখিলাম না।”
শৈল ব্যস্ত হইয়া কহিল, “সে কী কথা! কাল রাত্রে তুই কোথায় ছিলি?”
উমেশ। আমাকে তো মা থাকিতে দিলেন না। ও বাড়িতে গিয়াই তিনি আমাকে সিধুবাবুদের ওখানে যাত্রা শুনিতে পাঠাইয়াছিলেন।
শৈল। তোরও তো বেশ আক্কেল দেখিতেছি। বিষন কোথায় ছিল?
উমেশ। বিষন তো কিছুই বলিতে পারে না। কাল সে খুব তাড়ি খাইয়াছিল।
শৈল। যা যা, শীঘ্র বাবুকে ডাকিয়া আন্।
বিপিন আসিতেই শৈল কহিল, “ওগো, এ কী সর্বনাশ হইয়াছে?”
বিপিনের মুখ পাংশুবর্ণ হইয়া গেল। সে ব্যস্ত হইয়া কহিল, “কেন, কী হইয়াছে?”
শৈল। কমল কাল ও বাংলায় গিয়াছিল, তাহাকে তো সেখানে খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছে না।
বিপিন। তিনি কি কাল রাত্রে এখানে আসেন নাই?
শৈল। না গো। উমির অসুখে আনাইব মনে করিয়াছিলাম, লোক কোথায় ছিল? রমেশবাবু কি আসিয়াছেন?
বিপিন। বোধ হয় ও বাংলায় দেখিতে না পাইয়া তিনি ঠিক করিয়াছেন কমলা এখানেই আছেন। তিনি তো আমাদের এখানেই আসিয়াছেন।
শৈল। যাও যাও, শীঘ্র যাও, তাঁহাকে লইয়া খোঁজ করো গে। উমি এখন ঘুমাইতেছে–সে ভালোই আছে।
বিপিন ও রমেশ আবার সেই গাড়িতে উঠিয়া বাংলায় ফিরিয়া গেল এবং বিষনকে লইয়া পড়িল। অনেক চেষ্টায় জোড়াতাড়া দিয়া যেটুকু খবর বাহির হইল তাহা এই–কাল বৈকালে কমলা একলা গঙ্গার ধারের অভিমুখে চলিয়াছিল। বিষন তাহার সঙ্গে যাইবার প্রস্তাব করে, কমলা তাহার হাতে একটা টাকা দিয়া তাহাকে নিষেধ করিয়া ফিরাইয়া দেয়। সে পাহারা দিবার জন্য বাগানের গেটের কাছে বসিয়া ছিল, এমন সময়ে গাছ হইতে সদ্যঃসঞ্চিত ফেনোচ্ছল তাড়ির কলস বাঁকে করিয়া তাড়িওয়ালা তাহার সম্মুখ দিয়া চলিয়া যাইতেছিলে-তাহার পর হইতে বিশ্বসংসারে কী যে ঘটিয়াছে তাহা বিষনের কাছে যথেষ্ট স্পষ্ট নহে। যে পথ দিয়া কমলাকে গঙ্গার দিকে যাইতে দেখিয়াছিল বিষন তাহা দেখাইয়া দিল।
নৌকাডুবি ৪৫ (৩)
সেই পথ অবলম্বন করিয়া শিশিরসিক্ত শস্যক্ষেত্রের মাঝখান দিয়া রমেশ বিপিন ও উমেশ কমলার সন্ধানে চলিল। উমেশ হৃতশাবক শিকারি জন্তুর মতো চারি দিকে তীক্ষ্ম ব্যাকুল দৃষ্টি প্রেরণ করিতে লাগিল। গঙ্গার তটে আসিয়া তিন জনে একবার দাঁড়াইল। সেখানে চারি দিক উন্মুক্ত। ধূসর বালুকা প্রভাতরৌদ্রে ধু-ধু করিতেছে। কোথাও কাহাকেও দেখা গেল না। উমেশ উচ্চকণ্ঠে চীৎকার করিয়া ডাকিল, “মা, মা গো, মা কোথায়?” ও পারের সুদূর উচ্চতীর হইতে তাহার প্রতিধ্বনি ফিরিয়া আসিল–কেহই সাড়া দিল না।
খুঁজিতে খুঁজিতে উমেশ হঠাৎ দূরে সাদা কী একটা দেখিতে পাইল। তাড়াতাড়ি কাছে আসিয়া দেখিল, জলের একেবারে ধারেই এক গোছা চাবি একটা রুমালে বাঁধা পড়িয়া আছে। “কি রে ওটা কী?” বলিয়া রমেশও আসিয়া পড়িল। দেখিল, কমলারই চাবির গোছা।
যেখানে চাবি পড়িয়াছিল সেখানে বালুতটের প্রান্তভাগে পলিমাটি পড়িয়াছে। সেই কাঁচা মাটির উপর দিয়া গঙ্গার জল পর্যন্ত ছোটো দুইটি পায়ের গভীর চিহ্ন পড়িয়া গেছে। খানিকটা জলের মধ্যে একটা কী ঝিক্ ঝিক্ করিতেছিল, তাহা উমেশের দৃষ্টি এড়াইতে পারিল না; সে সেটা তাড়াতাড়ি তুলিয়া ধরিতেই দেখা গেল, সোনার উপরে এনামেল-করা একটি ছোটো ব্রোচ–ইহা রমেশেরই উপহার।
এইরূপে সমস্ত সংকেতই যখন গঙ্গার জলের দিকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করিল তখন উমেশ আর থাকিতে পারিল না–”মা, মা গো” বলিয়া চীৎকার করিয়া জলের মধ্যে ঝাঁপ দিয়া পড়িল। জল সেখানে অধিক ছিল না; উমেশ বারংবার পাগলের মতো ডুব দিয়া তলা হাৎড়াইয়া বেড়াইতে লাগিল, জল ঘোলা করিয়া তুলিল।
রমেশ হতবুদ্ধির মতো দাঁড়াইয়া রহিল। বিপিন কহিল, “উমেশ, তুই কী করিতেছিস? উঠিয়া আয়।”
উমেশ মুখ দিয়া জল ফেলিতে ফেলিতে বলিতে লাগিল, “আমি উঠিব না, আমি উঠিব না। মা গো, তুমি আমাকে ফেলিয়া যাইতে পারিবে না।”
বিপিন ভীত হইয়া উঠিল। কিন্তু উমেশ জলের মাছের মতো সাঁতার দিতে পারে, তাহার পক্ষে জলে আত্মহত্যা করা অত্যন্ত কঠিন। সে অনেকটা হাঁপাইয়া-ঝাঁপাইয়া শ্রান্ত হইয়া ডাঙায় উঠিয়া পড়িল এবং বালুর উপরে লুটাইয়া পড়িয়া কাঁদিতে লাগিল।
বিপিন নিস্তব্ধ রমেশকে স্পর্শ করিয়া কহিল, “রমেশবাবু, চলুন। এখানে দাঁড়াইয়া থাকিয়া কী হইবে! একবার পুলিসকে খবর দেওয়া যাক, তাহারা সমস্ত সন্ধান করিয়া দেখুক।”
শৈলজার ঘরে সেদিন আহারনিদ্রা বন্ধ হইয়া কান্নার রোল উঠিল। নদীতে জেলেরা নৌকা লইয়া অনেক দূর পর্যন্ত জাল টানিয়া বেড়াইল। পুলিস চারি দিকে সন্ধান করিতে লাগিল। স্টেশনে গিয়া বিশেষ করিয়া খবর লইল, কমলার সহিত বর্ণনায় মেলে এমন কোনো বাঙালির মেয়ে রাত্রে রেলগাড়িতে ওঠে নাই।
সেই দিনই বিকালে খুড়া আসিয়া পৌঁছিলেন। কয়দিন হইতে কমলার ব্যবহার ও আদ্যোপান্ত সমুদয় বৃত্তান্ত শুনিয়া তাঁহার সন্দেহমাত্র রহিল না যে, কমলা গঙ্গার জলে ডুবিয়া আত্মহত্যা করিয়া মরিয়াছে।
লছমনিয়া কহিল, “সেইজন্যই খুকি কাল রাত্রে অকারণে কান্না জুড়িয়া এমন একটা অদ্ভুত কাণ্ড করিল, উহাকে ভালো করিয়া ঝাড়াইয়া লওয়া দরকার।”
রমেশের বুকের ভিতরটা যেন শুকাইয়া গেল; তাহার মধ্যে অশ্রুর বাষ্পটুকুও ছিল না। সে বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল–’একদিন এই কমলা এই গঙ্গার জল হইতে উঠিয়া আমার পাশে আসিয়াছিল, আবার পূজার পবিত্র ফুলটুকুর মতো আর-এক দিন এই গঙ্গার জলের মধ্যেই অন্তর্হিত হইল।”
সূর্য যখন অস্ত গেল তখন রমেশ আবার সেই গঙ্গার ধারে আসিল; যেখানে চাবির গোছা পড়িয়া ছিল সেখানে দাঁড়াইয়া সেই পায়ের চিহ্ন ক’টি একদৃষ্টে দেখিল; তাহার পরে তীরে জুতা খুলিয়া, ধুতি গুটাইয়া লইয়া, খানিকটা জল পর্যন্ত নামিয়া গেল এবং বাক্স হইতে সেই নূতন নেকলেসটি বাহির করিয়া দূরে জলের মধ্যে ছুঁড়িয়া ফেলিল।
রমেশ কখন যে গাজিপুর হইতে চলিয়া গেল, খুড়ার বাড়িতে তাহার খবর লইবার মতো অবস্থা কাহারো রহিল না।