Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

নৌকাডুবি (51-56)

নৌকাডুবি ৫১ (১)

কমলা যখন গঙ্গাতীরে গিয়া পৌঁছিল, শীতের সূর্য তখন রশ্মিচ্ছটাহীন মলান পশ্চিমাকাশের প্রান্তে নামিয়াছেন। কমলা আসন্ন অন্ধকারের সম্মুখীন সেই অস্তগামী সূর্যকে প্রণাম করিল। তাহার পরে মাথায় গঙ্গাজলের ছিটা দিয়া নদীর মধ্যে কিছুদূর নামিল এবং জোড়করপুটে গঙ্গায় জলগণ্ডূষ অঞ্জলি দান করিয়া ফুল ভাসাইয়া দিল। তার পর সমস্ত গুরুজনদের উদ্দেশ করিয়া প্রণাম করিল। প্রণাম করিয়া মাথা তুলিতেই আর একটি প্রণম্য ব্যক্তির কথা সে মনে করিল। কোনোদিন মুখ তুলিয়া তাঁহার মুখের দিকে সে চাহে নাই; যখন একদিন রাত্রে সে তাঁহার পাশে বসিয়াছিল তখন তাঁহার পায়ের দিকেও তাহার চোখ পড়ে নাই, বাসরঘরে অন্য মেয়েদের সঙ্গে তিনি যে দু-চারিটা কথা কহিয়াছিলেন তাহাও সে যেন ঘোমটার মধ্য দিয়া, লজ্জার মধ্য দিয়া, তেমন সুস্পষ্ট করিয়া শুনিতে পায় নাই। তাঁহার সেই কণ্ঠস্বর সমরণে আনিবার জন্য আজ এই জলের ধারে দাঁড়াইয়া সে একান্তমনে চেষ্টা করিল, কিন্তু কোনোমতেই মনে আসিল না।
অনেক রাত্রে তাহার বিবাহের লগ্ন ছিল; নিতান্ত শ্রান্তশরীরে সে যে কখন কোথায় ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল তাহাও মনে নাই; সকালে জাগিয়া দেখিল, তাহাদের প্রতিবেশীর বাড়ির একটি বধূ তাহাকে ঠেলিয়া জাগাইয়া খিল্‌ খিল্‌ করিয়া হাসিতেছে–বিছানায় আর কেহই নাই। জীবনের এই শেষ মুহূর্তে জীবনেশ্বরকে সমরণ করিবার সম্বল তাহার কিছুমাত্র নাই। সে দিকে একেবারে অন্ধকার–কোনো মূর্তি নাই, কোনো বাক্য নাই, কোনো চিহ্ন নাই। যে লাল চেলিটির সঙ্গে তাঁহার চাদরের গ্রনিথ বাঁধা হইয়াছিল তারিণীচরণের প্রদত্ত সেই নিতান্ত অল্পদামের চেলির মূল্য তো কমলা জানিত না; সে চেলিখানিও সে যত্ন করিয়া রাখে নাই।
রমেশ হেমনলিনীকে যে চিঠি লিখিয়াছিল সেখানি কমলার আঁচলের প্রান্তে বাঁধা ছিল; সেই চিঠি খুলিয়া বালুতটে বসিয়া তাহার একটি অংশ গোধূলির আলোকে পড়িতে লাগিল। সেই অংশে তাহার স্বামীর পরিচয় ছিল–বেশি কথা নয়, কেবল তাঁহার নাম নলিনাক্ষ চ-োপাধ্যায়, আর তিনি যে রঙপুরে ডাক্তারি করিতেন ও এখন সেখানে তাঁহার খোঁজ পাওয়া যায় না, এইটুকুমাত্র। চিঠির বাকি অংশ সে অনেক সন্ধান করিয়াও পায় নাই। ‘নলিনাক্ষ’ এই নামটি তাহার মনের মধ্যে সুধাবর্ষণ করিতে লাগিল; এই নামটি তাহার সমস্ত বুকের ভিতরটা যেন ভরিয়া তুলিল; এই নামটি যেন এক বস্তুহীন দেহ লইয়া তাহাকে আবিষ্ট করিয়া ধরিল; তাহার চোখ দিয়া অবিশ্রাম ধারা বাহিয়া জল পড়িয়া তাহার হৃদয়কে সিনগ্ধ করিয়া দিল–মনে হইল, তাহার অসহ্য দুঃখদাহ যেন জুড়াইয়া গেল। কমলার অন্তঃকরণ বলিতে লাগিল, ‘এ তো শূন্যতা নয়, এ তো অন্ধকার নয়-আমি দেখিতেছি, সে যে আছে, সে আমারই আছে।’ তখন কমলা প্রাণপণ বলে বলিয়া উঠিল, ‘আমি যদি সতী হই, তবে এই জীবনেই আমি তাঁহার পায়ের ধুলা লইব, বিধাতা আমাকে কখনোই বাধা দিতে পারিবেন না। আমি যখন আছি তখন তিনি কখনোই যান নাই, তাঁহারই সেবা করিবার জন্য ভগবান আমাকে বাঁচাইয়া রাখিয়াছেন।
এই বলিয়া সে তাহার রুমালে বাঁধা চাবির গোছা সেইখানেই ফেলিল এবং হঠাৎ তাহার মনে পড়িল, রমেশের দেওয়া একটা ব্রোচ তাহার কাপড়ে বেঁধানো আছে। সেটা তাড়াতাড়ি খুলিয়া জলের মধ্যে ফেলিয়া দিল। তাহার পরে পশ্চিমে মুখ করিয়া সে চলিতে আরম্ভ করিল–কোথায় যাইবে, কী করিবে, তাহা তাহার মনে স্পষ্ট ছিল না; কেবল সে জানিয়াছিল, তাহাকে চলিতেই হইবে, এখানে তাহার এক মুহূর্ত দাঁড়াইবার স্থান নাই।
শীতের দিনান্তের আলোকটুকু নিঃশেষ হইয়া যাইতে বিলম্ব হইল না। অন্ধকারের মধ্যে সাদা বালুতট অস্পষ্টভাবে ধূ ধূ করিতে লাগিল, হঠাৎ এক জায়গায় কে যেন বিচিত্র রচনাবলীর মাঝখান হইতে সৃষ্টির খানিকটা চিত্রলেখা একেবারে মুছিয়া ফেলিয়াছে। কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার রাত্রি তাহার সমস্ত নির্নিমেষ তারা লইয়া এই জনশূন্য নদীতীরের উপর অতি ধীরে নিশ্বাস ফেলিতে লাগিল।

নৌকাডুবি ৫১ (২)

কমলা সম্মুখে গৃহহীন অনন্ত অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখিতে পাইল না, কিন্তু সে জানিল, তাহাকে চলিতেই হইবে–কোথাও পৌঁছিবে কি না তাহা ভাবিবার সামর্থ্যও তাহার নাই।
বরাবর নদীর ধার দিয়া সে চলিবে, এই সে স্থির করিয়াছে; তাহা হইলে কাহাকেও পথ জিজ্ঞাসা করিতে হইবে না এবং যদি বিপদ তাহাকে আক্রমণ করে, তবে মুহূর্তের মধ্যেই মা গঙ্গা তাহাকে আশ্রয় দিবেন।
আকাশে কুহেলিকার লেশমাত্র ছিল না। অনাবিল অন্ধকার কমলাকে আবৃত করিয়া রাখিল, কিন্তু তাহার দৃষ্টিকে বাধা দিল না।
রাত্রি বাড়িতে লাগিল। যবের খেতের প্রান্ত হইতে শৃগাল ডাকিয়া গেল। কমলা বহুদূর চলিতে চলিতে বালুর চর শেষ হইয়া মাটির ডাঙা আরম্ভ হইল। নদীর ধারেই একটা গ্রাম দেখা গেল। কমলা কম্পিতবক্ষে গ্রামের কাছে আসিয়া দেখিল, গ্রামটি সুষুপ্ত। ভয়ে ভয়ে গ্রামটি পার হইয়া চলিতে চলিতে তাহার শরীরে আর শক্তি রহিল না। অবশেষে এক জায়গায় এমন একটা ভাঙাতটের কাছে আসিয়া পৌঁছিল যেখানে সম্মুখে আর কোনো পথ পাইল না। নিতান্ত অশক্ত হইয়া একটা বটগাছের তলায় শুইয়া পড়িল, শুইবামাত্রই কখন নিদ্রা আসিল জানিতেও পারিল না।
প্রত্যুষেই চোখ মেলিয়া দেখিল, কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের আলোকে অন্ধকার ক্ষীণ হইয়া আসিয়াছে এবং একটি প্রৌঢ়া স্ত্রীলোক তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতেছে, “তুমি কে গা? শীতের রাত্রে এই গাছের তলায় কে শুইয়া?”
কমলা চকিত হইয়া উঠিয়া বসিল। দেখিল, তাহার অদূরে ঘাটে দুখানা বজরা বাঁধা রহিয়াছে–এই প্রৌঢ়াটি লোক উঠিবার পূর্বেই স্নান সারিয়া লইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া আসিয়াছেন।
প্রৌঢ়া কহিলেন, “হাঁ গা, তোমাকে যে বাঙালির মতো দেখিতেছি।”
কমলা কহিল, “আমি বাঙালি।”
প্রৌঢ়া। এখানে পড়িয়া আছ যে?
কমলা। আমি কাশীতে যাইব বলিয়া বাহির হইয়াছি। রাত অনেক হইল, ঘুম আসিল, এইখানেই শুইয়া পড়িলাম।
প্রৌঢ়া। ওমা, সে কী কথা! হাঁটিয়া কাশী যাইতেছ? আচ্ছা চলো, ঐ বজরায় চলো, আমি স্নান সারিয়া আসিতেছি।
স্নানের পর এই স্ত্রীলোকটির সহিত কমলার পরিচয় হইল।
গাজিপুরে যে সিদ্ধেশ্বরবাবুদের বাড়িতে খুব ঘটা করিয়া বিবাহ হইতেছিল, তাঁহারা ইঁহাদের আত্মীয়। এই
প্রৌঢ়াটির নাম নবীনকালী। এবং ইঁহার স্বামীর নাম মুকুন্দলাল দত্ত–কিছুকাল কাশীতেই বাস করিতেছেন। ইঁহারা আত্মীয়ের বাড়ি নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করিতে পারেন নাই, অথচ পাছে তাঁহাদের বাড়িতে থাকিতে বা খাইতে হয় এইজন্য বোটে করিয়া গিয়াছিলেন। বিবাহবাড়ির কর্ত্রী ক্ষোভপ্রকাশ করাতে নবীনকালী বলিয়াছিলেন, ‘জানই তো ভাই, কর্তার শরীর ভালো নয়। আর ছেলেবেলা হইতে উঁহাদের অভ্যাসই একরকম। বাড়িতে গোরু রাখিয়া দুধ হইতে মাখন তুলিয়া সেই মাখন-মারা ঘিয়ে উঁহার লুচি তৈরি হয়–আবার সে গোরুকে যা-তা খাওয়াইলে চলিবে না’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
নবীনকালী জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার নাম কী?”
কমলা কহিল, “আমার নাম কমলা।”
নবীনকালী। তোমার হাতে লোহা দেখিতেছি, স্বামী আছে বুঝি?
কমলা কহিল, “বিবাহের পরদিন হইতেই স্বামী নিরুদ্দেশ হইয়া গেছেন।”
নবীনকালী। ওমা, সে কী কথা! তোমার বয়স তো বড়ো বেশি বোধ হয় না।
তাহাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া কহিলেন, “পনেরোর বেশি হইবে না।”
কমলা কহিল, “বয়স ঠিক জানি না, বোধ করি, পনেরোই হইবে।”

নৌকাডুবি ৫১ (৩)

নবীনকালী। তুমি ব্রাহ্মণের মেয়ে বটে?
কমলা কহিল, “হাঁ।”
নবীনকালী কহিলেন, “তোমাদের বাড়ি কোথায়?”
কমলা। কখনো শ্বশুরবাড়ি যাই নাই, আমার বাপের বাড়ি বিশুখালি।
কমলার পিত্রালয় বিশুখালিতেই ছিল, তাহা সে জানিত।
নবীনকালী। তোমার বাপ-মা–
কমলা। আমার বাপ-মা কেহই নাই।
নবীনকালী। হরি বলো! তবে তুমি কী করিবে?
কমলা। কাশীতে যদি কোনো ভদ্র গৃহস্থ আমাকে বাড়িতে রাখিয়া দু-বেলা দুটি খাইতে দেন, তবে আমি কাজ করিব। আমি রাঁধিতে পারি।
নবীনকালী বিনা-বেতনে পাচিকা ব্রাহ্মণী লাভ করিয়া মনে মনে ভারি খুশি হইলেন। কহিলেন, “আমাদের তো দরকার নাই–বামুন-চাকর সমস্তই আমাদের সঙ্গে আছে। আমাদের আবার যে-সে বামুন হইবার জো নাই–কর্তার খাবারের একটু এদিক-ওদিক হইলে আর কি রক্ষা আছে। বামুনকে মাইনে দিতে হয় চৌদ্দ টাকা, তার উপরে ভাত-কাপড় আছে। তা হোক, ব্রাহ্মণের মেয়ে, তুমি বিপদে পড়িয়াছ–তা, চলো, আমাদের ওখানেই চলো। কত লোক খাচ্ছে-দাচ্ছে, কত ফেলা-ছড়া যায়, আর-এক জন বাড়িলে কেহ জানিতেও পারিবে না। আমাদের কাজও তেমন বেশি নয়। এখানে কেবল কর্তা আর আমি আছি। মেয়েগুলির সব বিবাহ দিয়াছি; তা, তাহারা বেশ বড়ো ঘরেই পড়িয়াছে। আমার একটিমাত্র ছেলে, সে হাকিম, এখন সেরাজগঞ্জে আছে, লাটসোহেবের ওখান হইতে দু-মাস অন্তর তাহার নামে চিঠি আসে। আমি কর্তাকে বলি, আমাদের নোটোর তো অভাব কিছুই নাই, কেন তাহার এই গেরো। এতবড়ো হাকিমি সকলের ভাগ্যে জোটে না, তা জানি, কিন্তু বাছাকে তবু তো সেই বিদেশে পড়িয়া থাকিতে হয়। কেন? দরকার কী? কর্তা বলেন, ‘ওগো সেজন্য নয়, সেজন্য নয়। তুমি মেয়েমানুষ, বোঝ না। আমি কি রোজগারের জন্য নোটোকে চাকরিতে দিয়াছি? আমার অভার কিসের? তবে কিনা, হাতে একটা কাজ থাকা চাই, নহিলে অল্প বয়স, কি জানি কখন কী মতি হয়।’
পালে বাতাসের জোর ছিল, কাশী পৌঁছিতে দীর্ঘকাল লাগিল না। শহরের ঠিক বাহিরেই অল্প একটু বাগানওয়ালা একটি দোতলা বাড়িতে সকলে গিয়া উঠিলেন।
সেখানে চৌদ্দ টাকা বেতনের বামুনের কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না–একটা উড়ে বামুন ছিল, অনতিকাল পরেই নবীনকালী তাহার উপরে একদিন হঠাৎ অত্যন্ত আগুন হইয়া উঠিয়া বিনা বেতনে তাহাকে বিদায় করিয়া দিলেন। ইতিমধ্যে চৌদ্দ টাকা বেতনের অতি দুর্লভ দ্বিতীয় একটি পাচক জুটিবার অবকাশে কমলাকেই সমস্ত রাঁধা-বাড়ার ভার লইতে হইল।
নবীনকালী কমলাকে বারবার সতর্ক করিয়া কহিলেন, “দেখো বাছা, কাশী শহর ভালো জায়গা নয়। তোমার অল্প বয়স। বাড়ির বাহিরে কখনো বাহির হইয়ো না। গঙ্গাস্নান-বিশ্বেশ্বরদর্শনে আমি যখন যাইব তোমাকে সঙ্গে করিয়া লইব।”
কমলা পাছে দৈবাৎ হাতছাড়া হইয়া যায় নবীনকালী এজন্য তাহাকে অত্যন্ত সাবধানে রাখিলেন। বাঙালি মেয়েদের সঙ্গেও তাহাকে বড়ো-একটা আলাপের অবসব দিতেন না। দিনের বেলা তো কাজের অভাব ছিল না–সন্ধ্যার পরে একবার কিছুক্ষণ নবীনকালী তাঁহার যে ঐশ্বর্য, যে গহনাপত্র, যে সোনারুপার বাসন, যে মখমলেিকংখাবের গৃহসজ্জা চোরের ভয়ে কাশীতে আনিতে পারেন নাই, তাহারই আলোচনা করিতেন। ‘কাঁসার থালায় খাওয়া তো কর্তার কোনোকালে অভ্যাস নাই, তাই প্রথম-প্রথম এ লইয়া তিনি অনেক বকাবকি করিতেন। তিনি বলিতেন, নাহয় দু-চারখানা চুরি যায় সেও ভালো, আবার গড়াইতে কতক্ষণ। কিন্তু টাকা আছে বলিয়াই যে লোকসান করিতে হইবে সে আমি কোনোমতে সহ্য করিতে পারি না। তার চেয়ে বরঞ্চ কিছুকাল কষ্ট করিয়া থাকাও ভালো। এই দেখো-না, দেশে আমাদের মস্ত বাড়ি, সেখানে লোক-লশকর যতই থাক্‌ আসে যায় না, তাই বলিয়া কি এখানে সাত গণ্ডা চাকর আনা চলে? কর্তা বলেন, কাছাকাছি নাহয় আরো একটা বাড়ি ভাড়া করা যাইবে। আমি বলিলাম, না, সে আমি পারিব না–কোথায় এখানে একটু আরাম করিব, না কতকগুলো লোকজন-বাড়িঘর লইয়া দিনরাত্রি ভাবনার অন্ত থাকিবে না।’ ইত্যাদি।

নৌকাডুবি ৫২

নবীনকালীর আশ্রয়ে কমলার প্রাণটা যেন অল্পজল এঁদো-পুকুরের মাছের মতো ব্যাকুল হইয়া উঠিতে লাগিল। এখান হইতে বাহির হইতে পারিলে সে বাঁচে, কিন্তু বাহিরে গিয়া দাঁড়াইবে কোথায়? সেদিনকার রাত্রে গৃহহীন বাহিরের পৃথিবীকে সে জানিয়াছে; সেখানে অন্ধভাবে আত্মসমর্পণ করিতে আর তাহার সাহস হয় না।
নবীনকালী যে কমলাকে ভালোবাসিতেন না তাহা নহে, কিন্তু সে ভালোবাসার মধ্যে রস ছিল না। দুই-এক দিন অসুখ-বিসুখের সময় তিনি কমলাকে যত্নও করিয়াছিলেন, কিন্তু সে যত্ন কৃতজ্ঞতার সহিত গ্রহণ করা বড়ো কঠিন। বরঞ্চ সে কাজকর্মের মধ্যে থাকিত ভালো, কিন্তু যে-সময়টা নবীনকালীর সখীত্বে তাহাকে যাপন করিতে হইত সেইটেই তার পক্ষে সব চেয়ে দুঃসময়।
একদিন সকালবেলা নবীনকালী কমলাকে ডাকিয়া কহিলেন, “ওগো, ও বামুন-ঠাকরুন, আজ কর্তার শরীর বড়ো ভালো নাই, আজ ভাত হইবে না, আজ রুটি। কিন্তু তাই বলিয়া একরাশ ঘি লইয়ো না। জানি তো তোমার রান্নার শ্রী, উহাতে এত ঘি কেমন করিয়া খরচ হইবে তাহা তো বুঝিতে পারি না। এর চেয়ে সেই যে উড়ে বামুনটা ছিল ভালো, সে ঘি লইত বটে, কিন্তু রান্নায় ঘিয়ের স্বাদ একটু-আধটু পাওয়া যাইত।”
কমলা এ-সমস্ত কথার কোনো জবাবই করিত না; যেন শুনিতে পায় নাই, এমনি-ভাবে নিঃশব্দে সে কাজ করিয়া যাইত।
আজ অপমানের গোপনভারে আক্রান্তহৃদয় হইয়া কমলা চুপ করিয়া তরকারি কুটিতেছিল, সমস্ত পৃথিবী বিরস এবং জীবনটা দুঃসহ বোধ হইতেছিল, এমন সময় গৃহিণীর ঘর হইতে একটা কথা তাহার কানে আসিয়া কমলাকে একেবারে চকিত করিয়া তুলিল। নবীনকালী তাঁহার চাকরকে ডাকিয়া বলিতেছিলেন, “ওরে তুলসী, যা তো, শহর হইতে নলিনাক্ষ ডাক্তারকে শীঘ্র ডাকিয়া আন্‌। বল্‌, কর্তার শরীর বড়ো খারাপ।”
নলিনাক্ষ ডাক্তার! কমলার চোখের উপরে সমস্ত আকাশের আলো আহত বীণার স্বর্ণতন্ত্রীর মতো কাঁপিতে লাগিল। সে তরকারি-কোটা ফেলিয়া দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। তুলসী নীচে নামিয়া আসিতেই কমলা জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় যাইতেছিস তুলসী?” সে কহিল, “নলিনাক্ষ ডাক্তারকে ডাকিতে যাইতেছি।”
কমলা কহিল, “সে আবার কোন্‌ ডাক্তার?”
তুলসী কহিল, “তিনি এখানকার একটি বড়ো ডাক্তার বটে।”
কমলা। তিনি থাকেন কোথায়?
তুলসী কহিল, “শহরেই থাকেন, এখান হইতে আধ ক্রোশটাক হইবে।”
আহারের সামগ্রী অল্পস্বল্প যাহা-কিছু বাঁচাইতে পারিত, কমলা তাহাই বাড়ির চাকর-বাকরদের ভাগ করিয়া দিত। এজন্য সে ভর্ৎসনা অনেক সহিয়াছে, কিন্তু এ অভ্যাস ছাড়িতে পারে নাই। বিশেষত গৃহিণীর কড়া আইন অনুসারে এ বাড়ির লোকজনদের খাবার কষ্ট অত্যন্ত বেশি। তা ছাড়া কর্তা-গৃহিণীর খাইতে বেলা হইত; ভৃত্যেরা তাহার পরে খাইতে পাইত। তাহারা যখন আসিয়া কমলাকে জানাইত ‘বামুন-ঠাকরুন, বড়ো ক্ষুধা পাইয়াছে’ তখন সে তাহাদিগকে কিছু-কিছু খাইতে না দিয়া কোনমতেই থাকিতে পারিত না। এমনি করিয়া বাড়ির চাকর-বাকর দুই দিনেই কমলার একান্ত বশ মানিয়াছে।

নৌকাডুবি ৫২ (২)

উপর হইতে রব আসিল, “রান্নাঘরের দরজার কাছে দাঁড়াইয়া কিসের পরামর্শ চলিতেছে রে তুলসী? আমার বুঝি চোখ নাই মনে করিস? শহরে যাইবার পথে এক বার বুঝি রান্নাঘর না মাড়াইয়া গেলে চলে না? এমনি করিয়াই জিনিসপত্রগুলো সরাইতে হয় বটে! বলি বামুন-ঠাকরুন, রাস্তায় পড়িয়া ছিলে, দয়া করিয়া তোমাকে আশ্রয় দিলাম, এমনি করিয়াই তাহার শোধ তুলিতে হয় বুঝি!”
সকলেই তাঁহার জিনিসপত্র চুরি করিতেছে, এই সন্দেহ নবীনকালীকে কিছুতেই ত্যাগ করে না। যখন প্রমাণের লেশমাত্রও না থাকে তখনো তিনি আন্দাজে ভর্ৎসনা করিয়া লন। তিনি স্থির করিয়াছেন যে, অন্ধকারে ঢেলা মারিলেও অধিকাংশ ঢেলা ঠিক জায়গায় গিয়া পড়ে আর তিনি যে সর্বদা সতর্ক আছেন ও তাঁহাকে ফাঁকি দিবার জো নাই, ভৃত্যেরা ইহা বুঝিতে পারে।
আজ নবীনকালীর তীব্রবাক্য কমলার মনেও বাজিল না। সে আজ কেবল কলের মতো কাজ করিতেছে, তাহার মনটা যে কোন্‌খানে উধাও হইয়া গেছে তাহার ঠিকানা নাই।
নীচে রান্নাঘরে দরজার কাছে কমলা দাঁড়াইয়া অপেক্ষা করিতেছিল। এমন সময় তুলসী ফিরিয়া আসিল, কিন্তু সে একা আসিল। কমলা জিজ্ঞাসা করিল, “তুলসী, কই ডাক্তারবাবু আসিলেন না?”
তুলসী কহিল, “না, তিনি আসিলেন না।”
কমলা। কেন?
তুলসী। তাঁহার মার অসুখ করিয়াছে।
কমলা। মার অসুখ? ঘরে আর কি কেহ নাই?
তুলসী। না, তিনি তো বিবাহ করেন নাই।
কমলা। বিবাহ করেন নাই, তুই কেমন করিয়া জানিলি?
তুলসী। চাকরদের মুখে তো শুনি, তাঁহার স্ত্রী নাই।
কমলা। হয়তো তাঁহার স্ত্রী মারা গেছে।
তুলসী। তা হইতে পারে। কিন্তু তাঁহার চাকর ব্রজ বলে, তিনি যখন রঙপুরে ডাক্তারি করিতেন, তখনো তাঁহার স্ত্রী ছিল না।
উপর হইতে ডাক পড়িল, “তুলসী!” কমলা তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল এবং তুলসী উপরে চলিয়া গেল।
নলিনাক্ষ–রঙপুরে ডাক্তারি করিতেন–কমলার মনে আর তো কোনো সন্দেহ নাই। তুলসী নামিয়া আসিলে পুনর্বার কমলা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “দেখ্‌ তুলসী, ডাক্তারবাবুর নামে আমার একটি আত্মীয় আছেন– বল্‌ দেখি, উনি ব্রাহ্মণ তো বটেন?”
তুলসী। হাঁ, ব্রাহ্মণ, চাটুজ্জে।
গৃহিণীর দৃষ্টিপাতের ভয়ে তুলসী বামুন-ঠাকরুনের সঙ্গে অধিকক্ষণ কথাবার্তা কহিতে সাহস করিল না, সে চলিয়া গেল।
কমলা নবীনকালীর নিকট গিয়া কহিল, “কাজকর্ম সমস্ত সারিয়া আজ আমি একবার দশাশ্বমেধঘাটে স্নান করিয়া আসিব।”
নবীনকালী। তোমার সকল অনাসৃষ্টি। কর্তার আজ অসুখ, আজ কখন কী দরকার হয়, তাহা বলা যায় না– আজ তুমি গেলে চলিবে কেন?

নৌকাডুবি ৫২ (৩)

কমলা কহিল, “আমার একটি আপনার লোক কাশীতে আছেন খবর পাইয়াছি, তাঁহাকে একবার দেখিতে যাইব।”
নবীনকালী। এ-সব ভালো কথা নয়। আমার যথেষ্ট বয়স হইয়াছে, আমি এ-সব বুঝি। খবর তোমাকে কে আনিয়া দিল? তুলসী বুঝি? ও ছোঁড়াটাকে আর রাখা নয়। শোনো বলি বামুন-ঠাকরুন, আমার কাছে যতদিন আছ ঘাটে একলা স্নান করিতে যাওয়া, আত্মীয়ের সন্ধানে শহরে বাহির হওয়া, ও-সমস্ত চলিবে না তাহা বলিয়া রাখিতেছি।
দারোয়ানের উপর হুকুম হইয়া গেল, তুলসীকে এই দণ্ডে দূর করিয়া দেওয়া হয়, সে যেন এ বাড়িমুখো হইতে না পারে।
গৃহিণীর শাসনে অন্যান্য চাকরেরা কমলার সংস্রব যথাসম্ভব পরিত্যাগ করিল।
নলিনাক্ষ সম্বন্ধে যতদিন কমলা নিশ্চিত ছিল না ততদিন তাহার ধৈর্য ছিল; এখন তাহার পক্ষে ধৈর্যরক্ষা
করা দুঃসাধ্য হইয়া উঠিল। এই নগরেই তাহার স্বামী রহিয়াছেন অথচ সে এক মুহূর্তও যে অন্যের ঘরে আশ্রয় লইয়া থাকিবে, ইহা তাহার পক্ষে অসহ্য হইল। কাজকর্মে তাহার পদে পদে ত্রুটি হইতে লাগিল।
নবীনকালী কহিলেন, “বলি বামুন-ঠাকরুন, তোমার গতিক তো ভালো দেখি না। তোমাকে কি ভূতে পাইয়াছে? তুমি নিজে তো খাওয়াদাওয়া বন্ধ করিয়াছ, আমাদিগকেও কি উপোস করাইয়া মারিবে? আজকাল তোমার রান্না যে আর মুখে দেবার জো নাই।”
কমলা কহিল, “আমি এখানে আর কাজ করিতে পারিতেছি না, আমার কোনোমতে মন টিকিতেছে না। আমাকে বিদায় দিন।”
নবীনকালী ঝংকার দিয়া বলিলেন, “বটেই তো! কলিকালে কাহারো ভালো করিতে নাই। তোমাকে দয়া করিয়া আশ্রয় দিবার জন্যে আমার এতকালের অমন ভালো বামুনটাকে ছাড়াইয়া দিলাম, একবার খবর লইলাম না তুমি সত্যি বামুনের মেয়ে কি না। আজ উনি বলেন কিনা, আমাকে বিদায় দিন। যদি পালাইবার চেষ্টা কর তো পুলিসে খবর দিব না! আমার ছেলে হাকিম–তার হুকুমে কত লোক ফাঁসি গেছে, আমার কাছে তোমার চালাকি খাটিবে না। শুনেইছ তো–গদা কর্তার মুখের উপরে জবাব দিতে গিয়াছিল, সে বেটা এমনি জব্দ হইয়াছে, আজও সে জেল খাটিতেছে। আমাদের তুমি যেমন তেমন পাও নাই।”
কথাটা মিথ্যা নহে–গদা চাকরকে ঘড়িচুরির অপবাদ দিয়া জেলে পাঠানো হইয়াছে বটে।
কমলা কোনো উপায় খুঁজিয়া পাইল না। তাহার চিরজীবনের সার্থকতা যখন হাত বাড়াইলেই পাওয়া যায়, তখন সেই হাতে বাঁধন পড়ার মতো এমন নিষ্ঠুর আর কী হইতে পারে। কমলা আপনার কাজের মধ্যে, ঘরের মধ্যে কিছুতেই আর তো বদ্ধ হইয়া থাকিতে পারে না। তাহার রাত্রের কাজ শেষ হইয়া গেলে পর সে শীতে একখানা র‌্যাপার মুড়ি দিয়া বাগানে বাহির হইয়া পড়িত। প্রাচীরের ধারে দাঁড়াইয়া, যে পথ শহরের দিকে চলিয়া গেছে সেই পথের দিকে চাহিয়া থাকিত। তাহার যে তরুণ হৃদয়খানি সেবার জন্য ব্যাকুল, ভক্তিনিবেদনের জন্য ব্যগ্র, সেই হৃদয়কে কমলা এই রজনীর নির্জন পথ বাহিয়া নগরের মধ্যে কোন্‌ এক অপরিচিত গৃহের উদ্দেশে প্রেরণ করিত–তাহার পর অনেকক্ষণ স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া তাহার শয়নকক্ষের মধ্যে ফিরিয়া আসিত।
কিন্তু এইটুকু সুখ, এইটুকু স্বাধীনতাও কমলার বেশি দিন রহিল না। রাত্রির সমস্ত কাজ শেষ হইয়া গেলেও একদিন কী কারণে নবীনকালী কমলাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। বেহারা আসিয়া খবর দিল, “বামুন-ঠাকরুনকে দেখিতে পাইলাম না।”
নবীনকালী ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া কহিলেন, “সে কী রে, তবে পালাইল নাকি?”

নৌকাডুবি ৫২ (৪)

নবীনকালী নিজে সেই রাত্রে আলো ধরিয়া ঘরে ঘরে খোঁজ করিতে আসিলেন, কোথাও কমলাকে দেখিতে পাইলনে না। মুকুন্দবাবু অর্ধনিমীলিতনেত্রে গুড়গুড়ি টানিতেছিলেন; তাঁহাকে গিয়া কহিলেন, “ওগো, শুনছ? বামুন-ঠাকরুন বোধ করি পালাইল।”
ইহাতেও মুকুন্দবাবুর শান্তিভঙ্গ করিল না; তিনি কেবল আলস্যজড়িত কণ্ঠে কহিলেন, “তখনই তো বারণ করিয়াছিলাম; জানাশোনা লোক নয়। কিছু সরাইয়াছে নাকি?”
গৃহিণী কহিলেন, “সেদিন তাহাকে যে শীতের কাপড়খানা পরিতে দিয়াছিলাম, সেটা তো ঘরে নাই, এ ছাড়া আর কী গিয়াছে, এখনো দেখি নাই।”
কর্তা অবিচলিত গম্ভীরস্বরে কহিলেন, “পুলিসে খবর দেওয়া যাক।”
এখজন চাকর লণ্ঠন লইয়া পথে বাহির হইল। ইতিমধ্যে কমলা তাহার ঘরে ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, নবীনকালী সে ঘরের সমস্ত জিনিসপত্র তন্ন-তন্ন করিয়া দেখিতেছেন। কোনো জিনিস চুরি গেছে কি না তাহাই তিনি সন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। এমন সময় কমলাকে হঠাৎ দেখিয়া নবীনকালী বলিয়া উঠিলেন, “বলি, কী কাণ্ডটাই করিলে? কোথায় যাওয়া হইয়াছিল?”
কমলা কহিল, “কাজ শেষ করিয়া আমি একটুখানি বাগানে বেড়াইতেছিলাম।”
নবীনকালী মুখে যাহা আসিল তাহাই বলিয়া গেলেন। বাড়ির সমস্ত চাকরবাকর দরজার কাছে আসিয়া জড়ো হইল।
কমলা কোনোদিন নবীনকালীর কোনো ভর্ৎসনায় তাঁহার সম্মুখে অশ্রুবর্ষণ করে নাই। আজও সে কাঠের মূর্তির মতো স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
নবীনকালীর বাক্যবর্ষণ একটুখানি ক্ষান্ত হইবামাত্র কমলা কহিল, “আমার প্রতি আপনারা অসন্তুষ্ট হইয়াছেন, আমাকে বিদায় করিয়া দিন।”
নবীনকালী। বিদায় তো করিবই। তোমার মতো অকৃতজ্ঞকে চিরদিন ভাত-কাপড় দিয়া পুষিব, এমন কথা মনেও করিয়ো না। কিন্তু কেমন লোকের হাতে পড়িয়াছ সেটা আগে ভালো করিয়া জানাইয়া তবে বিদায় দিব।
ইহার পর হইতে কমলা বাহিরে যাইতে আর সাহস করিত না। সে ঘরের মধ্যে দ্বার রুদ্ধ করিয়া মনে মনে এই কথা বলিল, যে লোক এত দুঃখ সহ্য করিতেছে ভগবান নিশ্চয় তাহার একটা গতি করিয়া দিবেন।
মুকুন্দবাবু তাঁহার দুইটি চাকর সঙ্গে লইয়া গাড়ি করিয়া হাওয়া খাইতে বাহির হইয়াছেন। বাড়িতে প্রবেশের দরজায় ভিতর হইতে হুড়কা বন্ধ। সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছে।
দ্বারের কাছে রব উঠিল, “মুকুন্দবাবু ঘরে আছেন কি?”
নবীনকালী চকিত হইয়া বলিয়া উঠি গো, নলিনাক্ষ ডাক্তার আসিয়াছেন। বুধিয়া, বুধিয়া!”
বুধিয়া-নামধারিণীর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। তখন নবীনকালী কহিলেন, “বামুন-ঠাকরুন, যাও তো, শীঘ্র দরজা খুলিয়া দাও গে। ডাক্তারবাবুকে বলো, কর্তা হাওয়া খাইতে বাহির হইয়াছেন, এখনি আসিবেন; একটু অপেক্ষা করিতে হইবে।
কমলা লণ্ঠন লইয়া নীচে নামিয়া গেল–তাহার পা কাঁপিতেছে, তাহার বুকের ভিতর গুর্‌ গুর্‌ করিতেছে, তাহার করতল ঠাণ্ডা হিম হইয়া গেল। তাহার ভয় হইতে লাগিল, পাছে এই বিষম ব্যাকুলতায় সে চোখে ভালো করিয়া দেখিতে না পায়।
কমলা ভিতর হইতে হুড়কা খুলিয়া দিয়া ঘোমটা টানিয়া কপাটের অন্তরালে দাঁড়াইল।
নলিনাক্ষ জিজ্ঞাসা করিল, “কর্তা ঘরে আছেন কি?”
কমলা কোনোমতে কহিল, “না, আপনি বসুন।”
নলিনাক্ষ বসিবার ঘরে আসিয়া বসিল। ইতিমধ্যে বুধিয়া আসিয়া কহিল, “কর্তাবাবু বেড়াইতে গেছেন এখনি আসিবেন, আপনি একটু বসুন।”
কমলার নিশ্বাস প্রবল হইয়া তাহার বুকের মধ্যে কষ্ট হইতেছিল। যেখান হইতে নলিনাক্ষকে স্পষ্ট দেখা যাইবে, অন্ধকার বারান্দার এমন একটা জায়গা সে আশ্রয় করিল, কিন্তু দাঁড়াইতে পারিল না। বিক্ষুব্ধ বক্ষকে শান্ত করিবার জন্য তাহাকে সেইখানে বসিয়া পড়িতে হইল। তাহার হৃৎপিণ্ডের চাঞ্চল্যের সঙ্গে শীতের হাওয়া যোগ দিয়া তাহাকে থরথর করিয়া কাঁপাইয়া তুলিল।

নৌকাডুবি ৫২ (৫)

নলিনাক্ষ কেরোসিন-আলোর পাশে বসিয়া স্তব্ধ হইয়া কী ভাবিতেছিল। অন্ধকারের ভিতর হইতে বেপথুমতী কমলা নলিনাক্ষের মুখের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল। চাহিতে চাহিতে তাহার দুই চক্ষে বার বার জল আসিতে লাগিল। তাড়াতাড়ি জল মুছিয়া সে তাহার একাগ্রদৃষ্টির দ্বারা নলিনাক্ষকে যেন আপনার অন্তঃকরণের গভীরতম অভ্যন্তরদেশে আকর্ষণ করিয়া লইল। ঐ-যে উন্নতললাট স্তব্ধ মুখখানির উপরে দীপালোক মূর্ছিত হইয়া পড়িয়াছে, ঐ মুখ যতই কমলার অন্তরের মধ্যে মুদ্রিত ও পরিস্ফুট হইয়া উঠিতে লাগিল ততই তাহার সমস্ত শরীর যেন ক্রমে অবশ হইয়া চারি দিকের আকাশের সহিত মিলাইয়া যাইতে লাগিল; বিশ্বজগতের মধ্যে আর-কিছুই রহিল না, কেবল ঐ আলোকিত মুখখানি রহিল–যাহার সম্মুখে রহিল সেও ঐ মুখের সহিত সম্পূর্ণভাবে মিশিয়া গেল।
এইরূপে কিছুক্ষণ কমলা সচেতন কি অচেতন ছিল, তাহা বলা যায় না; এমন সময় হঠাৎ সে চকিত হইয়া দেখিল, নলিনাক্ষ চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে এবং মুকুন্দবাবুর সঙ্গে কথা কহিতেছে।
এখনি পাছে উঁহারা বারান্দায় বাহির হইয়া আসেন এবং কমলা ধরা পড়ে এই ভয়ে কমলা বারান্দা ছাড়িয়া নীচে তাহার রান্নাঘরে গিয়া বসিল। রান্নাঘরটি প্রাঙ্গণের এক ধারে, এবং এই প্রাঙ্গণটি বাড়ির ভিতর হইতে বাহির হইয়া যাইবার পথ।
কমলা সর্বাঙ্গমনে পুলকিত হইয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল, ‘আমার মতো হতভাগিনীর এমন স্বামী! দেবতার মতো এমন সৌম্য-নির্মল প্রসন্ন-সন্দুর মূর্তি! ওগো ঠাকুর, আমার সকল দুঃখ সার্থক হইয়াছে।’
বলিয়া বার বার করিয়া ভগবানকে প্রণাম করিল।
সিঁড়ি দিয়া নীচে নামিবার পদশব্দ শোনা গেল। কমলা তাড়াতাড়ি অন্ধকারে দ্বারের পাশে দাঁড়াইল। বুধিয়া আলো ধরিয়া আগে আগে চলিল, তাহার অনুসরণ করিয়া নলিনাক্ষ বাহির হইয়া গেল।
কমলা মনে মনে কহিল, ‘তোমার শ্রীচরণের সেবিকা হইয়া এইখানে পরের দ্বারে দাসত্বে আবদ্ধ হইয়া আছি, সম্মুখ দিয়া চলিয়া গেলে, তবু জানিতেও পারিলে না।’
মুকুন্দবাবু অন্তঃপুরে আহার করিতে গেলে কমলা আস্তে আস্তে সেই বসিবার ঘরে গেল। যে চৌকিতে নলিনাক্ষ বসিয়াছিল তাহার সম্মুখে ভূমিতে ললাট ঠেকাইয়া সেখানকার ধূলি চুম্বন করিল। সেবা করিবার অবকাশ না পাইয়া অবরুদ্ধ ভক্তিতে কমলার হৃদয় কাতর হইয়া উঠিয়াছিল।
পরদিন কমলা সংবাদ পাইল, বায়ুপরিবর্তনের জন্য ডাক্তারবাবু কর্তাকে সুদূর পশ্চিমে কাশীর চেয়ে স্বাসথ্যকর স্থানে যাইতে উপদেশ করিয়াছেন। তাই আজ হইতে যাত্রার আয়োজন আরম্ভ হইয়াছে।
কমলা নবীনকালীকে গিয়া কহিল, “আমি তো কাশী ছাড়িয়া যাইতে পারিব না।”
নবীনকালী। আমরা পারিব, আর তুমি পারিবে না! বড়ো ভক্তি দেখিতেছি।
কমলা। আপনি যাহাই বলুন, আমি এইখানেই থাকিব।
নবীনকালী। আচ্ছা, তা কেমন থাক দেখা যাইবে।
কমলা কহিল, “আমাকে দয়া করুন, আমাকে এখান হইতে লইয়া যাইবেন না।”
নবীনকালী। তুমি তো বড়ো ভয়ানক লোক দেখিতেছি। ঠিক যাবার সময় বাহানা ধরিলে। আমরা এখন তাড়াতাড়ি লোক কোথায় খুঁজিয়া পাই! আমাদের কাজ চলিবে কী করিয়া?
কমলার অনুনয়-বিনয় সমস্ত ব্যর্থ হইল; কমলা তাহার ঘরে দ্বার বন্ধ করিয়া ভগবানকে ডাকিয়া কাঁদিতে লাগিল।

নৌকাডুবি ৫৩ (১)

যেদিন সন্ধ্যার সময় নলিনাক্ষের সহিত বিবাহ লইয়া হেমনলিনীর সঙ্গে অন্নদাবাবুর আলোচনা হইয়াছিল সেইদিন রাত্রেই অন্নদাবাবুর আবার সেই শূলবেদনা দেখা দিল।
রাত্রিটা কষ্টে কাটিয়া গেল। প্রাতঃকালে তাঁহার বেদনার উপশম হইলে তিনি তাঁহার বাড়ির বাগানে রাস্তার নিকটে শীতপ্রভাতের তরুণ সূর্যালোকে সম্মুখে একটি টিপাই লইয়া বসিয়াছেন, হেমনলিনী সেইখানেই তাঁহাকে চা খাওয়াইবার ব্যবস্থা করিতেছে। গতরাত্রের কষ্টে অন্নদাবাবুর মুখ বিবর্ণ ও শীর্ণ হইয়া গেছে, তাঁহার চোখের নীচে কালি পড়িয়াছে, মনে হইতেছে যেন এক রাত্রির মধ্যেই তাঁহার বয়স অনেক বাড়িয়া গেছে।
যখনই অন্নদাবাবুর এই ক্লিষ্ট মুখের প্রতি হেমনলিনীর চোখ পড়িতেছে তখনই তাহার বুকের মধ্যে যেন ছুরি বিঁধিতেছে। নলিনাক্ষের সহিত বিবাহে হেমনলিনীর অসম্মতিতেই যে বৃদ্ধ ব্যথিত হইয়াছেন, আর তাঁহার সেই মনোবেদনাই যে তাঁহার পীড়ার অব্যবহিত কারণ, ইহা হেমনলিনীর পক্ষে একান্ত পরিতাপের বিষয় হইয়া উঠিয়াছে। সে যে কী করিবে, কী করিলে বৃদ্ধ পিতাকে সান্ত্বনা দিতে পারিবে, তাহা বার বার করিয়া ভাবিয়া কোনোমতেই স্থির করিতে পারিতেছিল না।
এমন সময় হঠাৎ খুড়াকে লইয়া অক্ষয় সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল। হেমননিলী তাড়াতাড়ি চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেই অক্ষয় কহিল, “আপনি যাইবেন না, ইনি গাজিপুরের চক্রবর্তীমহাশয়, ইঁহাকে পশ্চিম-অঞ্চলের সকলেই জানে–আপনাদের সঙ্গে ইঁহার বিশেষ কথা আছে।”
সেই জায়গাটাতে বাঁধানো চাতালের মতো ছিল, সেইখানে খুড়া আর অক্ষয় বসিলেন। খুড়া কহিলেন, “শুনিলাম, রমেশবাবুর সঙ্গে আপনাদের বিশেষ বন্ধুত্ব আছে, আমি তাই জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছি তাঁহার স্ত্রীর খবর কি আপনারা কিছু পাইয়াছেন?”
অন্নদাবাবু ক্ষণকাল অবাক হইয়া রহিলেন, তাহার পরে কহিলেন, “রমেশবাবুর স্ত্রী!”
হেমনলিনী চক্ষু নত করিয়া রহিল। চক্রবর্তী কহিলেন, “মা, তোমরা আমাকে বোধ করি নিতান্ত সেকেলে অসভ্য মনে করিতেছ। একটু ধৈর্য ধরিয়া সমস্ত কথা শুনিলেই বুঝিতে পারিবে, আমি খামকা গায়ে পড়িয়া পরের কথা লইয়া তোমাদের সঙ্গে আলোচনা করিতে আসি নাই। রমেশবাবু পূজার সময় তাঁহার স্ত্রীকে লইয়া স্টীমারে করিয়া যখন পশ্চিমে যাত্রা করিয়াছিলেন, সেই সময়ে সেই স্টীমারেই তাঁহাদের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। আপনারা তো জানেন, কমলাকে যে একবার দেখিয়াছে, সে তাহাকে কখনো পর বলিয়া মনে করিতে পারে না। আমার এই বুড়াবয়সে অনেক শোকতাপ পাইয়া হৃদয় কঠিন হইয়া গেছে, কিন্তু আমার সেই মালেক্ষ্মীকে তো কিছুতেই ভুলিতে পারিতেছি না। রমেশবাবু কোথায় যাইবেন, কিছুই ঠিক করেন নাই–কিন্তু এই বুড়াকে দুই দিন দেখিয়াই মা কমলার এমনি স্নেহ জন্মিয়া গিয়াছিল যে, তিনি রমেশবাবুকে গাজিপুরে আমার বাড়িতেই উঠিতে রাজি করেন। সেখানে কমলা, আমার মেজো মেয়ে শৈলর কাছে আপন বোনের চেয়ে যত্নে ছিল। কিন্তু কি যে হইল, কিছুই বলিতে পারি না–মা যে কেন আমাদের সকলকে এমন করিয়া কাঁদাইয়া হঠাৎ চলিয়া গেলেন তাহা আজ পর্যন্ত ভাবিয়া পাইলাম না। সেই অবধি শৈলর চোখের জল আর কিছুতেই শুকাইতেছে না।”
বলিতে বলিতে চক্রবর্তীর দুই চোখ বাহিয়া জল পড়িতে লাগিল। অন্নদাবাবু ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন; কহিলেন, “তাঁহার কী হইল, তিনি কোথায় গেলেন?”
খুড়া কহিলেন, “অক্ষয়বাবু, আপনি তো সকল কথা শুনিয়াছেন, আপনিই বলুন। বলিতে গেলে আমার বুক ফাটিয়া যায়।”
অক্ষয় আদ্যোপান্ত সমস্ত ব্যাপারটি বিস্তারিত করিয়া বর্ণনা করিল। নিজে কোনোপ্রকার টীকা করিল না, কিন্তু তাহার বর্ণনায় রমেশের চরিত্রটি রমণীয় হইয়া ফুটিয়া উঠিল না।
অন্নদাবাবু বার বার করিয়া বলিতে লাগিলেন, “আমরা তো এ-সমস্ত কথা কিছুই শুনি নাই। রমেশ যেদিন হইতে কলিকাতার বাহির হইয়াছেন, তাঁহার একখানি পত্রও পাই নাই।”

নৌকাডুবি ৫৩ (২)

অক্ষয় সেইসঙ্গে যোগ দিল, “এমন-কি, তিনি যে কমলাকে বিবাহ করিয়াছেন এ কথাও আমরা নিশ্চয় জানিতাম না। আচ্ছা চক্রবর্তীমহাশয়, আপনাকে জিঞ্চাসা করি, কমলা রমেশের স্ত্রী তো বটেন? ভগ্নী বা আর কোনো আত্মীয়া তো নহেন?”
চক্রবর্তী কহিলেন, “আপনি বলেন কী অক্ষয়বাবু? স্ত্রী নহেন তো কী! এমন সতীলক্ষ্মী স্ত্রী কয়জনের ভাগ্যে জোটে?”
অক্ষয় কহিল, “কিন্তু আশ্চর্য এই যে, স্ত্রী যত ভালো হয় তাহার অনাদরও তত বেশি হইয়া থাকে। ভগবান ভালো লোকদিগকেই বোধ করি সব চেয়ে কঠিন পরীক্ষায় ফেলেন।”
এই বলিয়া অক্ষয় একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।
অন্নদা তাঁহার বিরল কেশরাশির মধ্যে অঙ্গুলিচালনা করিতে করিতে বলিলেন, “বড়ো দুঃখের বিষয় সন্দেহ নাই, কিন্তু যাহা হইবার তা তো হইয়াই গেছে, এখন আর বৃথা শোক করিয়া ফল কী?”
অক্ষয় কহিল, “আমার মনে সন্দেহ হইল, যদি এমন হয়, কমলা আত্মহত্যা না করিয়া ঘর ছাড়িয়া চলিয়া আসিয়া থাকেন। তাই চক্রবর্তীমহাশয়কে লইয়া কাশীতে এখবার সন্ধান করিতে আসিলাম। বেশ বুঝা যাইতেছে, আপনারা কোনো খবরই পান নাই। যাহা হউক, দু-চারদিন এখানে তল্লাশ করিয়া দেখা যাক।”
অন্নদাবাবু কহিলেন, “রমেশ এখন কোথায় আছেন?”
খুড়া কহিলেন, “তিনি তো আমাদিগকে কিছু না বলিয়াই চলিয়া গেছেন।”
অক্ষয় কহিল, “আমার সঙ্গে দেখা হয় নাই, কিন্তু লোকের মুখে শুনিলাম, তিনি কলিকাতাতেই গেছেন। বোধ করি আলিপুরে প্র্যাক্‌টিস করিবেন। মানুষ তো আর অনন্তকাল শোক করিয়া কাটাইতে পারে না, বিশেষত তাঁহার অল্প বয়স। চক্রবর্তীমহাশয়, চলুন, শহরে একবার ভালো করিয়া খোঁজ করিয়া দেখা যাক।”
অন্নদাবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “অক্ষয়, তুমি তো এইখানেই আসিতেছ?”
অক্ষয় কহিল, “ঠিক বলিতে পারি না। আমার মনটা বড়োই খারাপ হইয়া আছে অন্নদাবাবু। যত দিন কাশীতে আছি, আমাকে এই খোঁজেই থাকিতে হইবে। বলেন কী, ভদ্রলোকের মেয়ে, যদিই তিনি মনের দুঃখে ঘর ছাড়িয়া চলিয়া আসিয়া থাকেন, তবে আজ কী বিপদেই পড়িয়াছেন বলুন দেখি। রমেশবাবু দিব্য নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিতে পারেন, কিন্তু আমি তো পারি না।”
খুড়াকে সঙ্গে লইয়া অক্ষয় চলিয়া গেল।
অন্নদাবাবু অত্যন্ত উদ্‌বিগ্ন হইয়া এখবার হেমনলিনীর মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলেন। হেমনলিনী প্রাণপণে নিজেকে সংযত করিয়া বসিয়াছিল। সে জানিত, তাহার পিতা মনে মনে তাহার জন্য আশঙ্কা অনুভব করিতেছেন।
হেমনলিনী কহিল, “বাবা, আজ একবার ডাক্তারকে দিয়া তোমার শরীরটা ভালো করিয়া পরীক্ষা করাও। একটুকুতেই তোমার স্বাসথ্য নষ্ট হইয়া যায়, ইহার একটা প্রতিকার করা উচিত।”
অন্নদাবাবু মনে মনে অত্যন্ত আরাম অনুভব করিলেন। রমেশকে লইয়া এতবড়ো আলোচনাটার পর হেমনলিনী যে তাঁহার পীড়া লইয়া উদ্‌বেগ প্রকাশ করিল, ইহাতে তাঁহার মনের মধ্য হইতে একটা ভার নামিয়া গেল। অন্য সময় হইলে তিনি নিজের পীড়ার প্রসঙ্গ উড়াইয়া দিতে চেষ্টা করিতেন; আজ কহিলেন, “সে তো বেশ কথা।” শরীরটা নাহয় পরীক্ষা করানোই যাক। তাহা হইলে আজ নাহয়

নৌকাডুবি ৫৩ (৩)

নলিনাক্ষ সম্বন্ধে হেমনলিনী একটুখানি সংকোচে পড়িয়া গেছে। পিতার সম্মুখে তাহার সহিত পূর্বের ন্যায় সহজভাবে মেলা তাহার পক্ষে কঠিন হইবে, তবু সে বলিল, “সেই ভালো, তাঁহাকে ডাকিতে লোক পাঠাইয়া দিই।”
অন্নদাবাবু হেমের অবিচলিত ভাব দেখিয়া ক্রমে সাহস পাইয়া কহিলেন, “হেম, রমেশের এই সমস্ত কাণ্ড–”
হেমনলিনী তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে বাধা দিয়া কহিল, “বাবা, রৌদ্রের ঝাঁজ বাড়িয়া উঠিয়াছে–চলো, এখন ঘরে চলো।” বলিয়া তাঁহাকে আপত্তি করিবার অবসর না দিয়া হাত ধরিয়া ঘরে টানিয়া লইয়া গেল। সেখানে তাঁহাকে আরাম-কেদারায় বসাইয়া তাঁহার গায়ে বেশ করিয়া গরম কাপড় জড়াইয়া দিয়া তাঁহার হাতে একখানি খবরের কাগজ দিল এবং চশমার খাপ হইতে চশমাটি বাহির করিয়া নিজে তাঁহার চোখে পরাইয়া দিয়া কহিল, “কাগজ পড়ো, আমি আসিতেছি।”
অন্নদাবাবু সুবাধ্য বালকের মতো হেমনলিনীর আদেশ পালন করিতে চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কোনোমতেই মনোনিবেশ করিতে পারিলেন না। হেমনলিনীর জন্য তাঁহার মন উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিতে লাগিল। অবশেষে এক সময় কাগজ রাখিয়া হেমের খোঁজ করিতে গেলেন; দেখিলেন, সেই প্রাতে অসময়ে তাহার ঘরের দরজা বন্ধ।
কিছু না বলিয়া অন্নদাবাবু বারান্দায় পায়চারি করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। অনেকক্ষণ পরে আবার একবার হেমনলিনীকে খুঁজিতে গিয়া দেখিলেন, তখনো তাহার দরজা বন্ধ রহিয়াছে। তখন শ্রান্ত অন্নদাবাবু ধপ্‌ করিয়া তাঁহার চৌকিটার উপর বসিয়া পড়িয়া মুহুর্মুহু মাথার চুলগুলাকে করসঞ্চালনদ্বারা উচ্ছৃঙ্খল করিয়া তুলিতে লাগিলেন।
নলিনাক্ষ আসিয়া অন্নদাবাবুকে পরীক্ষা করিয়া দেখিল এবং যথাকর্তব্য বলিয়া দিল এবং হেমকে জিজ্ঞাসা করিল, “অন্নদাবাবুর মনে কি বিশেষ কোনো উদ্‌বেগ আছে?”
হেম কহিল, “তা থাকিতে পারে।”
নলিনাক্ষ কহিল, “যদি সম্ভব হয়, উঁহার মনের সম্পূর্ণ বিশ্রাম আবশ্যক। আমার মার সম্বন্ধেও ঐ এক মুশকিলে পড়িয়াছি; তিনি একটুতেই এমনি ব্যস্ত হইয়া পড়েন যে, তাঁহার শরীর সুস্থ রাখা শক্ত হইয়া পড়িয়াছে। সামান্য কী-একটা চিন্তা লইয়া কাল বোধ হয় সমস্তরাত্রি তিনি ঘুমাইতে পারেন নাই। আমি চেষ্টা করি যাহাতে তিনি কিছুমাত্র বিচলিত না হন, কিন্তু সংসারে থাকিতে গেলে তাহা কোনোমতেই সম্ভবপর হয় না।”
হেমনলিনী কহিল, “আপনাকেও আজ তেমন ভালো দেখাইতেছে না।”
নলিনাক্ষ। না, আমি বেশ ভালোই আছি। মন্দ থাকা আমার অভ্যাস নয়। তবে কাল বোধ হয় কিছু রাত জাগিতে হইয়াছিল বলিয়া আজ আমাকে তেমন তাজা দেখাইতেছে না।
হেমনলিনী। আপনার মাকে সেবা করিবার জন্য সর্বদা যদি একটি স্ত্রীলোক তাঁহার কাছে থাকিত, তবে বোধ হয় ভালো হইত। আপনি একলা, আপনার কাজকর্ম আছে, কী করিয়া আপনি উঁহার শুশ্রূষা করিয়া উঠিবেন?

নৌকাডুবি ৫৩ (৪)

এ কথাটা হেমনলিনী সহজ ভাবেই বলিয়াছিল, কথাটা সংগত, সে বিষয়েও কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু বলার পরেই হঠাৎ তাহাকে লজ্জা আক্রমণ করিল, তাহার মুখ আরক্তিম হইয়া উঠিল। তাহার সহসা মনে হইল, নলিনাক্ষবাবু যদি কিছু মনে করেন। অকসমাৎ হেমনলিনীর এই লজ্জার আবির্ভাব দেখিয়া নলিনাক্ষও তাহার মার প্রস্তাবের কথা মনে না করিয়া থাকিতে পারিল না।
হেমনলিনী তাড়াতাড়ি সারিয়া লইয়া কহিল, “উঁহার কাছে একজন ঝি রাখিলে ভালো হয় না?”
নলিনাক্ষ কহিল, “অনেকবার চেষ্টা করিয়াছি, মা কিছুতেই রাজি হন না। তিনি শুদ্ধাচার সম্বন্ধে অত্যন্ত সতর্ক বলিয়া মাহিনা-করা লোকের কাজে তাঁহার শ্রদ্ধা হয় না। তা ছাড়া, তাঁহার স্বভাব এমন যে, কেহ যে দায়ে পড়িয়া তাঁহার সেবা করিতেছে ইহা তিনি সহ্য করিতে পারেন না।”
ইহার পরে এ সম্বন্ধে হেমনলিনীর আর কোনো কথা চলিল না। সে একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, “আপনার উপদেশমতো চলিতে চলিতে মাঝে মাঝে এক-একবার বাধা আসিয়া উপস্থিত হয়, আবার আমি পিছাইয়া পড়ি। আমার ভয় হয়, আমার যেন কোন আশা নাই। আমার কি কোনোদিন মনের একটা স্থিতি হইবে না, আমাকে কি কেবলই বাহিরে আঘাতে অস্থির হইয়া বেড়াইতে হইবে?”
হেমনলিনীর এই কাতর আবেদনে নলিনাক্ষ একটু চিন্তিত হইয়া কহিল, “দেখুন, বিঘ্ন আমাদের হৃদয়ের সমস্ত শক্তিকে জাগ্রত করিয়া দিবার জন্যই উপস্থিত হয়। আপনি হতাশ হইবেন না।”
হেমনলিনী কহিল, “কাল সকালে আপনি একবার আসিতে পারিবেন? আপনার সহায়তা পাইলে আমি অনেকটা বল লাভ করি।”
নলিনাক্ষের মুখে এবং কণ্ঠস্বরে যে-একটি অবিচলিত শান্তির ভাব আছে তাহাতে হেমনলিনী যেন একটা আশ্রয় পায়। নলিনাক্ষ চলিয়া গেল, কিন্তু হেমনলিনীর মনের মধ্যে একটা সান্ত্বনার স্পর্শ রাখিয়া গেল। সে তাহার শয়নগৃহের সম্মুখের বারান্দায় দাঁড়াইয়া একবার শীতরৌদ্রালোকিত বাহিরের দিকে চাহিল। তাহার চারি দিকে বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে সেই রমণীয় মধ্যাহ্নে কর্মের সহিত বিরাম, শক্তির সহিত শান্তি, উদ্‌যোগের সহিত বৈরাগ্য একসঙ্গে বিরাজ করিতেছিল; সেই বৃহৎ ভাবের ক্রোড়ে সে আপনার ব্যথিত হৃদয়কে সমর্পণ করিয়া দিল–তখন সূর্যালোক এবং উন্মুক্ত উজ্জ্বল নীলাম্বর তাহার অন্তঃকরণের মধ্যে জগতের নিত্য-উচ্চারিত সুগভীর আশীর্বচন প্রেরণ করিবার অবকাশ লাভ করিল।
হেমনলিনী নলিনাক্ষের মার কথা ভাবিতে লাগিল। কী চিন্তা লইয়া তিনি ব্যাপৃত আছেন, তিনি কেন যে রাতের ঘুমাইতে পারিতেছেন না, তাহা হেমনলিনী বুঝিতে পারিল। নলিনাক্ষের সহিত তাহার বিবাহ-প্রস্তাবের প্রথম আঘাত, প্রথম সংকোচ কাটিয়া গেছে। নলিনাক্ষের প্রতি হেমনলিনীর একান্ত নির্ভরপর ভক্তি ক্রমেই বাড়িয়া উঠিয়াছিল, কিন্তু ইহার মধ্যে ভালোবাসার বিদ্যুৎসঞ্চারময়ী বেদনা নাই–তা নাই থাকিল। ঐ আত্মপ্রতিষ্ঠ নলিনাক্ষ যে কোনো স্ত্রীলোকের ভালোবাসার অপেক্ষা রাখে, তাহা তো মনেই হয় না। তবু সেবার প্রয়োজন তো সকলেরই আছে। নলিনাক্ষের মাতা পীড়িত এবং প্রাচীন, নলিনাক্ষকে কে দেখিবে? এ সংসারে নলিনাক্ষের জীবন তো অনাদরের সামগ্রী নহে; এমন লোকের সেবা, ভক্তির সেবাই হওয়া চাই।
আজ প্রভাতে হেমনলিনী রমেশের জীবন-ইতিবৃত্তের যে একাংশ শুনিয়াছে তাহাতে তাহার মর্মের মাঝখানে এমন একটা প্রচণ্ড আঘাত লাগিয়াছে যে, এই নিদারুণ আঘাত হইতে আত্মরক্ষা করিবার জন্য তাহার সমস্ত মনের সমস্ত শক্তি আজ উদ্যত হইয়া দাঁড়াইয়াছে। আজ এমন অবস্থা আসিয়াছে যে, রমেশের জন্য বেদনা বোধ করা তাহার পক্ষে লজ্জাকর। সে রমেশকে বিচার করিয়া অপরাধী করিতেও চায় না।

নৌকাডুবি ৫৩ (৫)

কত শতসহস্র লোক ভালোমন্দ কত কী কাজে লিপ্ত রহিয়াছে, সংসারচক্র চলিতেছে–হেমনলিনী তাহার বিচারভার লয় নাই। রমেশের কথা হেমনলিনী মনেও আনিতে ইচ্ছা করে না। মাঝে মাঝে আত্মঘাতিনী কমলার কথা কল্পনা করিয়া তাহার শরীর শিহরিয়া উঠে; তাহার মনে হইতে থাকে, ‘এই হতভাগিনীর আত্মহত্যার সঙ্গে আমার কি কোনো সংস্রব আছে?’ তখন লজ্জায়, ঘৃণায়, করুণায় তাহার সমস্ত হৃদয় মথিত হইতে থাকে। সে জোড়হাত করিয়া বলে, ‘হে ঈশ্বর, আমি তো অপরাধ করি নাই, তবে আমি কেন এমন করিয়া জড়িত হইলাম? আমার এ বন্ধন মোচন করো, একেবারে ছিন্ন করিয়া দাও। আমি আর কিছুই চাই না, আমাকে তোমার এই জগতে সহজভাবে বাঁচিয়া থাকিতে দাও।’
রমেশ ও কমলার ঘটনা শুনিয়া হেমনলিনী কী মনে করিতেছে, তাহা জানিবার জন্য অন্নদাবাবু উৎসুক হইয়া আছেন, অথচ কথাটা স্পষ্ট করিয়া পাড়িতে তাঁহার সাহস হইতেছে না। হেমনলিনী বারান্দায় চুপ করিয়া বসিয়া সেলাই করিতেছিল, সেখানে এক-একবার গিয়া হেমনলিনীর চিন্তারত মুখের দিকে চাহিয়া তিনি ফিরিয়া আসিয়াছেন।
সন্ধ্যার সময় ডাক্তারের উপদেশমত অন্নদাবাবুকে জারকচূর্ণমিশ্রিত দুগ্ধ পান করাইয়া হেমনলিনী তাঁহার কাছে বসিল। অন্নদাবাবু কহিলেন, “আলোটা চোখের সামনে হইতে সরাইয়া দাও।”
ঘর একটু অন্ধকার হইলে অন্নদাবাবু কহিলেন, “সকালবেলায় যে বৃদ্ধটি আসিয়া-ছিলেন তাঁহাকে দেখিয়া বেশ সরল বোধ হইল।”
হেমনলিনী এই প্রসঙ্গ লইয়া কোনো কথা কহিল না, চুপ করিয়া রহিল। অন্নদাবাবু আর অধিক ভূমিকা বানাইতে পারিলেন না। তিনি কহিলেন, “রমেশের ব্যাপার শুনিয়া আমি কিন্তু আশ্চর্য হইয়া গেছি–লোকে তাহার সম্বন্ধে অনেক কথা বলিয়াছে, আমি আজ পর্যন্ত তাহা বিশ্বাস করি নাই, কিন্তু আর তো–”
হেমনলিনী কাতরকণ্ঠে কহিল, “বাবা, ও-সকল কথার আলোচনা থাক্‌।”
অন্নদাবাবু কহিলেন, “মা, আলোচনা করিতে তো ইচ্ছা করেই না। কিন্তু বিধির বিপাকে অকসমাৎ এক-একজন লোকের সঙ্গে আমাদের সুখদুঃখ জড়িত হইয়া যায়, তখন তাহার কোনো আচরণকে আর উপেক্ষা করিবার জো থাকে না।”
হেমনলিনী সবেগে বলিয়া উঠিল, “না না, সুখদুঃখের গ্রনিথ অমন করিয়া যেখানে সেখানে কেন জড়িত হইতে দিব। বাবা, আমি বেশ আছি, আমার জন্য বৃথা উদ্‌বিগ্ন হইয়া আমাকে লজ্জা দিয়ো না।”
অন্নদাবাবু কহিলেন, “মা হেম, আমার বয়স হইয়াছে, এখন তোমার একটা স্থিতি না করিয়া তো আমার মন স্থির হইতে পারে না। তোমাকে এমন তপস্বিনীর মতো কি আমি রাখিয়া যাইতে পারি?”
হেমনলিনী চুপ করিয়া রহিল। অন্নদাবাবু কহিলেন, “দেখো মা, পৃথিবীতে একটা আশা চূর্ণ হইল বলিয়াই যে আর-সমস্ত দুর্মূল্য জিনিসকে অগ্রাহ্য করিতে হইবে, এমন কোনো কথা নাই। তোমার জীবন কিসে সুখী হইবে, সার্থক হইবে, আজ হয়তো মনের ক্ষোভে তাহা তুমি না জানিতেও পার, কিন্তু আমি নিয়ত তোমার মঙ্গলচিন্তা করি–আমি জানি তোমার কিসে সুখ, কিসে মঙ্গল–আমার প্রস্তাবটাকে একেবারে উপেক্ষা করিয়ো না।”

নৌকাডুবি ৫৩ (৬)

হেমনলিনী দুই চোখ ছল্‌ছল্‌ করিয়া বলিয়া উঠিল, “অমন কথা বলিয়ো না, আমি তোমার কোনো কথাই উপেক্ষা করি না। তুমি যাহা আদেশ করিবে আমি নিশ্চয় তাহা পালন করিব, কেবল একবার অন্তঃকরণটা পরিষ্কার করিয়া একবার ভালোরকম করিয়া প্রস্তুত হইয়া লইতে চাই।”
অন্নদাবাবু সেই অন্ধকারে একবার হেমনলিনীর অশ্রুসিক্ত মুখে হাত বুলাইয়া তাহার মস্তক স্পর্শ করিলেন। আর কোনো কথা কহিলেন না।
পরদিন সকালে যখন অন্নদাবাবু হেমনলিনীকে লইয়া বাহিরে গাছের তলায় চা খাইতে বসিয়াছেন, তখন অক্ষয় আসিয়া উপস্থিত হইল। অন্নদাবাবু নীরব প্রশ্নের সহিত তাহার মুখের দিকে চাহিলেন। অক্ষয় কহিল, “এখনো কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না।” এই বলিয়া এক পেয়ালা চা লইয়া সে সেখানে বসিয়া গেল।
আস্তে আস্তে কথা তুলিল, “রমেশবাবু ও কমলার জিনিসপত্র কিছু-কিছু চক্রবর্তী মহাশয়ের ওখানে রহিয়া গেছে, সেগুলি তিনি কোথায় কাহার কাছে পাঠাবেন, তাই ভাবিতেছেন। রমেশবাবু নিশ্চয়ই আপনাদের ঠিকানা বাহির করিয়া শীঘ্রই এখানে আসিবেন, তাই আপনাদের এখানে যদি–”
অন্নদাবাবু হঠাৎ অত্যন্ত রাগ করিয়া উঠিয়া কহিলেন, “অক্ষয়, তোমার কাণ্ডজ্ঞান কিছুমাত্র নাই। রমেশ আমার এখানেই বা কেন আসিবে, আর তাহার জিনিসপত্র আমিই বা কেন রাখিতে যাইব?”
অক্ষয় কহিল, “যা হোক, অন্যায় করুন আর ভুল করুন রমেশবাবু এখন নিশ্চয়ই অনুতপ্ত হইয়াছেন, এ সময়ে কি তাঁহাকে সান্ত্বনা দেওয়া তাঁহার পুরাতন বন্ধুদের কর্তব্য নয়? তাঁহাকে কি একেবারেই পরিত্যাগ করিতে হইবে?”
অন্নদাবাবু কহিলেন, “অক্ষয়, তুমি কেবল আমাদের পীড়ন করিবার জন্য এই কথাটা লইয়া বার বার আন্দোলন করিতেছ। আমি তোমাকে বিশেষ করিয়া বলিয়া দিতেছি, এ প্রসঙ্গ তুমি আমাদের কাছে কখনোই তুলিয়ো না।”
হেমনলিনী সিনগ্ধস্বরে বলিল, “বাবা, তুমি রাগ করিয়ো না, তোমার অসুখ করিবে–অক্ষয়বাবু যাহা বলিতে চান বলুন-না, তাহাতে দোষ কী।”
অক্ষয় কহিল, “না না, আমাকে মাপ করিবেন, আমি ঠিক বুঝিতে পারি নাই।”

নৌকাডুবি ৫৪

মুকুন্দবাবু সপরিজনে কাশী ত্যাগ করিয়া মিরাটে যাইবেন, স্থির হইয়া গেছে। জিনিসপত্র বাঁধা হইয়াছে, কাল প্রভাতেই ছাড়িতেই হইবে। কমলা নিতান্ত আশা করিয়াছিল, ইতিমধ্যে এমন একটা-কিছু ঘটনা ঘটিবে যাহাতে তাহাদের যাওয়া বন্ধ হইবে। ইহাও সে একান্তমনে আশা করিয়াছিল যে, নলিনাক্ষ ডাক্তার হয়তো, আর দুই-একবার তাঁহার রোগীকে দেখিতে আসিবেন। কিন্তু দুইয়ের কোনোটাই ঘটিল না।
পাছে বামুন-ঠাকরুন যাত্রার উদ্‌যোগের গোলেমালে পালাইয়া যাইবার অবকাশ পায়, এই আশঙ্কায় নবীনকালী তাহাকে কয়দিন সর্বদাই কাছে কাছে রাখিয়াছেন, তাহাকে দিয়াই জিনিসপত্র বাঁধাছাঁদার অনেক কাজ করাইয়া লইয়াছেন।
কমলা একান্তমনে কামনা করিতে লাগিল, আজ রাত্রির মধ্যে তাহার এমন একটা কঠিন পীড়া হয় যে, তাহাকে সঙ্গে লইয়া যাওয়া নবীনকালীর পক্ষে অসম্ভব হইয়া উঠে। সেই গুরুতর পীড়ার চিকিৎসাভার কোন্‌ ডাক্তারের উপর পড়িবে তাহাও সে মনে মনে ভাবে নাই এমন নহে। এই পীড়ায় যদি অবশেষে তাহার মৃত্যু ঘটে, তবে আসন্ন মৃত্যুকালে সেই চিকিৎসকের পায়ের ধুলা লইয়া সে মরিতে পারিবে, ইহাও সে চোখ বুজিয়া কল্পনা করিতেছিল।
রাত্রে নবীনকালী কমলাকে আপনার ঘরে লইয়া শুইলেন। পরদিন স্টেশনে যাইবার সময় নিজের গাড়ির মধ্যে তুলিয়া লইলেন। কর্তা মুকুন্দবাবু রেলগাড়িতে সেকেণ্ড্‌ ক্লাসে উঠিলেন, নবীনকালী বামুন-ঠাকরুনকে লইয়া ইণ্টার্‌মিডিয়েটে স্ত্রীকক্ষে আশ্রয়লাভ করিলেন।
অবশেষে গাড়ি কাশী স্টেশন ছাড়িল; মত্ত হস্তী যেমন করিয়া লতা ছিঁড়িয়া লয়, তেমনি করিয়া রেলগাড়ি গর্জন করিতে করিতে কমলাকে ছিঁড়িয়া লইয়া চলিয়া গেল। কমলা ক্ষুধিতচক্ষে জানলা হইতে বাহিরের দিকে চাহিয়া রহিল। নবীনকালী কহিলেন, “বামুন-ঠাকরুন, পানের ডিপেটা কোথায় রাখিলে?”
কমলা পানের ডিপেটা বাহির করিয়া দিল। ডিপে খুলিয়া নবীনকালী কহিলেন, “এই দেখো, যা ভাবিয়াছিলাম, তাই হইয়াছে। চুনের কৌটোটা ফেলিয়া আসিয়াছ? এখন আমি করি কী। যেটি আমি নিজে না দেখিব সেটিতে একটা-না-একটা গলদ হইয়া আছেই। এ কিন্তু বামুন-ঠাকরুন, তুমি শয়তানি করিয়া করিয়াছ। কেবল আমাকে জব্দ করিবার মতলবে। ইচ্ছা করিয়া আমাদের হাড় জ্বালাইতেছ। আজ তরকারিতে নুন নাই, কাল পায়েসে ধরা গন্ধ–মনে করিতেছ, এ-সমস্ত চালাকি আমরা বুঝি না। আচ্ছা, চলো মিরাটে, তার পরে দেখা যাইবে তুমিই বা কে আর আমিই বা কে।”
গাড়ি যখন পুলের উপর দিয়া চলিল, কমলা জানলা হইতে মুখ বাড়াইয়া গঙ্গা-তীরবর্তী কাশী শহরটা একবার দেখিয়া লইল। ঐ শহরের মধ্যে কোন্‌ দিকে যে নলিনাক্ষের বাড়ি তাহা সে কিছুই জানে না। এইজন্য রেলগাড়ির দ্রুতধাবনের মধ্যে ঘাট, বাড়ি, মন্দিরচূড়া যাহা-কিছু তাহার চক্ষে পড়িল, সমস্তই নলিনাক্ষের আবির্ভাবের দ্বারা মণ্ডিত হইয়া তাহার হৃদয়কে স্পর্শ করিল।
নবীনকালী কহিলেন, “ওগো, অত করিয়া ঝুঁকিয়া দেখিতেছ কী? তুমি তো পাখি নও, তোমার ডানা নাই যে উড়িয়া যাইবে।”
কাশী নগরীর চিত্র কোথায় আচ্ছন্ন হইয়া গেল। কমলা স্থিরনীরব হইয়া বসিয়া আকাশের দিকে চাহিয়া রহিল।
অবশেষে গাড়ি মোগলসরাইয়ে থামিল। কমলার কাছে স্টেশনের গোলমাল, লোকজনের ভিড়, সমস্তই ছায়ার মতো, স্বপ্নের মতো বোধ হইতে লাগিল। সে কলের পুতলির মতো এক গাড়ি হইতে অন্য গাড়ি উঠিল।
গাড়ি ছাড়িবার সময় হইয়া আসিতেছে, এমন সময় কমলা হঠাৎ চমকিয়া উঠিয়া শুনিতে পাইল তাহাকে কে পরিচিত কণ্ঠে “মা” বলিয়া ডাকিয়া উঠিয়াছে। কমলা প্ল্যাট্‌ফর্মের দিকে মুখ ফিরাইয়া দেখিল–উমেশ।
কমলার সমস্ত মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল; “কহিল, কী রে উমেশ!”
উমেশ গাড়ির দরজা খুলিয়া দিল এবং মুহূর্তের মধ্যে কমলা নামিয়া পড়িল। উমেশ তৎক্ষণাৎ ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া কমলার পায়ের ধুলা মাথায় তুলিয়া লইল। তাহার সমস্ত মুখ আকর্ণপ্রসারিত হাসিতে ভরিয়া গেল।
পরক্ষণেই গার্ড কামরার দরজা বন্ধ করিয়া দিল। নবীনকালী চেঁচামেচি করিতে লাগিলেন, “বামুন-ঠাকরুন, করিতেছ কী ! গাড়ি ছাড়িয়া দেয় যে ! ওঠো, ওঠো !”
কমলার কানে সে কথা পৌঁছিলই না। গাড়িও বাঁশি ফুঁকিয়া দিয়া গস্‌গস্‌ শব্দে স্টেশন হইতে বাহির হইয়া গেল।
কমলা জিজ্ঞাসা করিল, “উমেশ, তুই কোথা হইতে আসিতেছিস ?”
উমেশ কহিল, “গাজিপুর হইতে।”
কমলা জিজ্ঞাসা করিল, “সেখানে সকলে ভালো আছেন তো ? খুড়ামশায়ের কী খবর ?”
উমেশ কহিল, “তিনি ভালো আছেন।”
কমলা। আমার দিদি কেমন আছেন ?
উমেশ। মা, তিনি তোমার জন্য কাঁদিয়া অনর্থ করিতেছেন।
তৎক্ষণাৎ কমলার দুই চোখ জলে ভরিয়া গেল। জিজ্ঞাসা করিল, “উমি কেমন আছে রে ? সে তার মাসিকে কি মাঝে মাঝে মনে করে ?”
উমেশ কহিল, “তুমি তাহাকে যে এক-জোড়া গহনা দিয়া আসিয়াছিলে সেইটে না পরাইলে তাহাকে কোনোমতে দুধ খাওয়ানো যায় না। সেইটে পরিয়া সে দুই হাত ঘুরাইয়া বলিতে থাকে ‘মাসি গ-গ গেছে’, আর তার মার চোখ দিয়া জল পড়িতে থাকে।”
কমলা জিজ্ঞাসা করিল, “তুই এখানে কী করিতে আসিলি ?”
উমেশ কহিল, “আমার গাজিপুরে ভালো লাগিতেছিল না, তাই আমি চলিয়া আসিয়াছি।”
কমলা। যাবি কোথায় ?
উমেশ কহিল, “মা, তোমার সঙ্গে যাইব।”
কমলা কহিল, “আমার কাছে একটি পয়সাও নাই।”
উমেশ কহিল, “আমার কাছে আছে।”
কমলা। তুই কোথায় পেলি ?
উমেশ। সেই যে তুমি আমাকে পাঁচটা টাকা দিয়াছিলে, সে তো আমার খরচ হয় নাই।
বলিয়া গাঁট হইতে পাঁচটা টাকা বাহির করিয়া দেখাইল।
কমলা। তবে চল্‌ উমেশ, আমরা কাশী যাই, কী বলিস ? তুই তো টিকিট করিতে পারিবি ?
উমেশ কহিল, “পারিব।” বলিয়া তখনি টিকিট কিনিয়া আনিল। গাড়ি প্রস্তুত ছিল, গাড়িতে কমলাকে উঠাইয়া দিল; কহিল, “মা, আমি পাশের কামরাতেই রহিলাম।”
কাশী স্টেশনে নামিয়া কমলা উমেশকে জিজ্ঞাসা করিল, “উমেশ, এখন কোথায় যাই বল্‌ দেখি ?”
উমেশ কহিল, “মা, তুমি কিছুই ভাবিয়ো না; আমি তোমাকে ঠিক জায়গায় লইয়া যাইতেছি।”
কমলা। ঠিক জায়গা কী রে ! তুই এখানকার কী জানিস বল্‌ দেখি।
উমেশ কহিল, “সব জানি। দেখো তো কোথায় লইয়া যাই।”
বলিয়া কমলাকে একটা ভাড়াটে গাড়িতে তুলিয়া দিয়া সে কোচবাক্সে চড়িয়া বসিল। একটা বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়াইলে উমেশ কহিল, “মা, এইখানে নামো।”
কমলা গাড়ি হইতে নামিয়া উমেশের অনুসরণ করিয়া বাড়িতে প্রবেশ করিতেই উমেশ ডাকিয়া উঠিল, “দাদামশায়, বাড়ি আছ তো ?”
পাশের একটা ঘর হইতে সাড়া আসিল, “কে ও, উমেশ না কি ! তুই কোথা থেকে এলি ?”
পরক্ষণেই হুঁকা হাতে স্বয়ং চক্রবর্তী-খুড়া আসিয়া উপস্থিত। উমেশ সমস্ত মুখ পরিপূর্ণ করিয়া নীরবে হাসিতে লাগিল। বিস্মিত কমলা ভূমিষ্ঠ হইয়া চক্রবর্তীকে প্রণাম করিল। খুড়ার খানিকক্ষণ মুখে আর কথা সরিল না; তিনি কী যে বলিবেন, হুঁকাটা কোন্‌খানে রাখিবেন, কিছুই ভাবিয়া পাইলেন না। অবশেষে কমলার চিবুক ধরিয়া তাহার লজ্জিত নতমুখ একটুখানি উঠাইয়া কহিলেন, “মা আমার ফিরে এল ! চলো চলো, উপরে চলো।”
“ও শৈল, শৈল ! দেখে যা, কে এসেছে।”
শৈলজা তাড়াতাড়ি ঘর হইতে বাহির হইয়া বারান্দায় সিঁড়ির সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। কমলা তাহার পায়ের ধুলা লইয়া প্রণাম করিল। শৈল তাড়াতাড়ি তাহাকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া তাহার ললাট চুম্বন করিল। চোখের জলে দুই কপোল ভাসাইয়া দিয়া কহিল, “মা গো মা ! আমাদের এমন করিয়াও কাঁদাইয়া যাইতে হয়!”
খুড়া কহিলেন, “ও-সব কথা থাক্‌ শৈল, এখন উঁহার নাওয়া-খাওয়া সমস্ত ঠিক করিয়া দাও।”
এমন সময় উমা ‘মাসি মাসি’ করিয়া দুই হাত তুলিয়া ছুটিয়া বাহির হইয়া আসিল। কমলা তৎক্ষণাৎ তাহাকে কোলে তুলিয়া লইয়া বুকে চাপিয়া ধরিয়া চুম খাইয়া খাইয়া অস্থির করিয়া দিল।
শৈলজা কমলার রুক্ষ কেশ ও মলিন বস্ত্র দেখিয়া থাকিতে পারিল না। তাহাকে টানিয়া লইয়া গিয়া যত্ন করিয়া স্নান করাইল, নিজের ভালো কাপড় একখানি বাহির করিয়া তাহাকে পরাইয়া দিল। কহিল, “কাল রাত্রে বুঝি ভালো করিয়া ঘুম হয় নাই। চোখ বসিয়া গেছে যে। ততক্ষণ তুই বিছানায় একটু গড়াইয়া নে। আমি রান্না সারিয়া আসিতেছি। ”
কমলা কহিল, “না দিদি, তোমার সঙ্গে, চলো, আমিও রান্নাঘরে যাই।”
দুই সখীতে একত্রে রাঁধিতে গেল।
চক্রবর্তী-খুড়া অক্ষয়ের পরামর্শে যখন কাশীতে আসিবার জন্য প্রস্তুত হইলেন শৈলজা ধরিয়া পড়িল, “বাবা, আমিও তোমাদের সঙ্গে কাশী যাইব।”
খুড়া কহিলেন, “বিপিনের তো এখন ছুটি নাই।”
শৈল কহিল, “তা হোক, আমি একলাই যাইব। মা আছেন, উঁহার অসুবিধা হইবে না।”
স্বামীর সহিত এরূপ বিচ্ছেদের প্রস্তাব শৈল পূর্বে কোনোদিন করে নাই।
খুড়াকে রাজি হইতে হইল। গাজিপুর হইতে যাত্রা করিলেন। কাশী স্টেশনে নামিয়া দেখেন, উমেশও গাড়ি হইতে নামিতেছে।–“আরে তুই এলি কেন রে !” সকলে যে কারণে আসিয়াছেন তাহারও সেই একই কারণ। কিন্তু উমেশ আজকাল খুড়ার গৃহকার্যে নিযুক্ত হইয়াছে; সে এরূপ অকস্মাৎ চলিয়া আসিলে গৃহিণী অত্যন্ত রাগ করিবেন জানিয়া সকলে মিলিয়া অনেক চেষ্টা করিয়া উমেশকে গাজিপুরে ফিরাইয়া পাঠান। তাহার পরে কী ঘটিয়াছে তাহা সকলেই জানেন। সে গাজিপুরে কোনোমতেই টিকিতে পারিল না। গৃহিণী তাহাকে বাজার করিতে পাঠাইয়াছিলেন, সেই বাজারের পয়সা লইয়া সে একেবারে গঙ্গা পার হইয়া স্টেশনে আসিয়া উপস্থিত। চক্রবর্তী-গৃহিণী সেদিন এই ছোকরাটির জন্য বৃথা অপেক্ষা করিয়াছিলেন।

নৌকাডুবি ৫৫

দিনের মধ্যে অক্ষয় এক সময় চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছিল। তিনি তাহাকে কমলার প্রত্যাবর্তন সম্বন্ধে কোনো কথাই বলিলেন না। রমেশের প্রতি অক্ষয়ের যে বিশেষ বন্ধুভাব নাই, তাহা খুড়া বুঝিতে পারিয়াছেন।

কমলা কেন চলিয়া গিয়াছিল, কোথায় চলিয়া গিয়াছিল, এ সম্বন্ধে বাড়ির কেহ কোনো প্রশ্নই করিল না— কমলা যেন ইঁহাদের সঙ্গেই কাশী বেড়াইতে আসিয়াছে, এমনিভাবে দিন কাটিয়া গেল। উমির দাই লছমনিয়া স্নেহমিশ্রিত ভর্ৎসনার ছলে কিছু বলিতে গিয়াছিল, খুড়া তৎক্ষণাৎ তাহাকে আড়ালে ডাকিয়া শাসন করিয়া দিয়াছিলেন।

রাত্রে শৈলজা কমলাকে আপনার বিছানায় লইয়া শুইল। তাহার গলা জড়াইয়া ধরিয়া তাহাকে বুকের কাছে টানিয়া লইল, এবং দক্ষিণ হস্ত দিয়া তাহার গায়ে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল। এই কোমল হস্তস্পর্শ নীরব প্রশ্নের মতো কমলাকে তাহার গোপন বেদনার কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল।

কমলা কহিল, “দিদি, তোমরা কী মনে করিয়াছিলে ? আমার উপরে রাগ কর নাই ?”

শৈল কহিল, “আমাদের কি বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু নাই ? আমরা কি এটা বুঝি নাই, সংসারে তোর যদি কোনো পথ থাকিত তবে তুই এই ভয়ানক পথ লইতিস না। আমরা কেবল এই বলিয়া কাঁদিয়াছি, ভগবান তোকে কেন এমন সংকটে ফেলিলেন। যে লোক কোনো অপরাধ করিতে জানে না, সেও দণ্ড পায় !”

কমলা কহিল, “দিদি, আমার সব কথা তুমি শুনিবে ?”

শৈল স্নিগ্ধস্বরে কহিল, “শুনিব না তো কি বোন ?”

কমলা। তখন যে তোমাকে কেন বলিতে পারি নাই, তাহা জানি না। তখন আমার কোনো কথা ভাবিয়া দেখিবার সময় ছিল না। হঠাৎ মাথায় এমন বজ্রাঘাত হইয়াছিল যে, লজ্জায় তোমার কাছে মুখ দেখাইতে পারিতেছিলাম না। সংসারে আমার মা-বোন কেহ নাই, দিদি, তুমি আমার মা বোন দু’ই— তাই তোমার কাছে সব কথা বলিতেছি, নহিলে আমার যে কথা তাহা কাহারো কাছে বলিবার নয়।

কমলা আর শুইয়া থাকিতে পারিল না, উঠিয়া বসিল। শৈলও উঠিয়া তাহার সন্মুখে বসিল। সেই অন্ধকার বিছানার মধ্যে বসিয়া কমলা বিবাহ হইতে আরম্ভ করিয়া তাহার জীবনের কাহিনী বলিতে লাগিল।

কমলা যখন বলিল, বিবাহের পূর্বে বা বিবাহের রাত্রে সে তাহার স্বামীকে দেখে নাই তখন শৈল কহিল, “তোর মতো বোকা মেয়ে তো আমি দেখি নাই। তোর চেয়ে কম বয়সে আমার বিবাহ হইয়াছিল— তুই কি মনে করিস, লজ্জায় আমি আমার বরকে কোনো সুযোগে দেখিয়া লই নাই !”

কমলা কহিল, “লজ্জা নয় দিদি ! আমার বিবাহের বয়স প্রায় পার হইয়া গিয়াছিল। এমন সময়ে হঠাৎ যখন আমার বিবাহের কথা স্থির হইয়া গেল, তখন আমার সমস্ত সঙ্গিনীরা আমাকে বড়োই খ্যাপাইতে আরম্ভ করিয়াছিল। অধিক বয়সে বরকে পাইয়া আমি যে সাত রাজার ধন মানিক পাই নাই, ইহাই দেখাইবার জন্য আমি তাঁহার দিকে দৃকপাতমাত্র করি নাই। এমন-কি, তাঁহার জন্য কিছুমাত্র আগ্রহ মনের মধ্যে অনুভব করা আমি নিতান্ত লজ্জার বিষয়, অগৌরবের বিষয় বলিয়া মনে করিয়াছিলাম। আজ তাহারই শোধ দিতেছি।”

এই বলিয়া কমলা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তাহার পরে আরম্ভ করিল, “বিবাহের পর নৌকাডুবি হইয়া আমরা কী করিয়া রক্ষা পাইলাম, সে কথা তো তোমাকে পূর্বেই বলিয়াছি। কিন্তু যখন বলিয়াছিলাম তখনো জানিতাম না যে, মৃত্যু হইতে রক্ষা পাইয়া যাঁহার হাতে পড়িলাম, যাঁহাকে স্বামী বলিয়া জানিলাম, তিনি আমার স্বামী নহেন।”

শৈলজা চমকিয়া উঠিল; তাড়াতাড়ি কমলার কাছে আসিয়া তাহার গলা ধরিয়া কহিল, “হায় রে পোড়া কপাল— ও, তাই বটে। এতক্ষণে সব কথা বুঝিলাম। এমন সর্বনাশও ঘটে !”

কমলা কহিল, “বল্‌ দেখি দিদি, যখন মরিলেই চুকিয়া যাইত তখন বিধাতা এমন বিপদ ঘটাইলেন কেন ?”

শৈলজা জিজ্ঞাসা করিল, “রমেশবাবুও কিছুই জানিতে পারেন নাই ?”

কমলা কহিল, “বিবাহের কিছুকাল পরে তিনি একদিন আমাকে সুশীলা বলিয়া ডাকিতেছিলেন, আমি তাঁহাকে কহিলাম, ‘আমার নাম কমলা, তবু তোমরা সকলেই আমাকে সুশীলা বলিয়া ডাক কেন ?’ আমি এখন বুঝিতে পারিতেছি, সেইদিন তাঁহার ভুল ভাঙিয়াছিল। কিন্তু দিদি, সে-সকল দিনের কথা মনে করিতেও আমার মাথা হেঁট হইয়া যায়।” এই বলিয়া কমলা চুপ করিয়া রহিল।
শৈলজা একটু একটু করিয়া কথায় কথায় সমস্ত বৃত্তান্ত আগাগোড়া বাহির করিয়া লইল। সমস্ত কথা শোনা হইলে সে কহিল, “বোন, তোর দুঃখের কপাল, কিন্তু আমি এই কথা ভাবিতেছি, ভাগ্যে তুই রমেশবাবুর হাতে পড়িয়াছিলি। যাই বলিস, বেচারা রমেশবাবুর কথা মনে করিলে বড়ো দুঃখ হয়। আজ রাত অনেক হইল, কমল, তুই আজ ঘুমো। ক’দিন রাত জাগিয়া কাঁদিয়া মুখ কালি হইয়া গেছে। এখন কী করিতে হইবে, কাল সব ঠিক করা যাইবে।”

রমেশের লিখিত সেই চিঠি কমলার কাছে ছিল। পরদিন সেই চিঠিখানি লইয়া শৈলজা তাহার পিতাকে নিভৃত ঘরে ডাকিয়া পাঠাইল এবং চিঠি তাঁহার হাতে দিল। খুড়া চশমা চোখে তুলিয়া অত্যন্ত ধীরে ধীরে পাঠ করিলেন; তাহার পরে চিঠি মুড়িয়া, চশমা খুলিয়া কন্যকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাই তো, এখন কী কর্তব্য ?”

শৈল কহিল, “বাবা, উমির কয়দিন হইতে সর্দিকাসি করিয়াছে, একবার নলিনাক্ষ ডাক্তারকে ডাকিয়া আনাও-না। কাশীতে তাঁহার আর তাঁর মার তো খুব নাম শোনা যায়। একবার তাঁকে দেখিই-না।”

রোগীকে দেখিবার জন্য ডাক্তার আসিল এবং ডাক্তারকে দেখিবার জন্য শৈল ব্যস্ত হইয়া উঠিল। কহিল, “কমল, আয়, শীঘ্র আয়।”

নবীনকালীর বাড়ি যে কমলা নলিনাক্ষকে দেখিবার ব্যগ্রতায় প্রায় আত্মবিস্মৃত হইয়া উঠিয়াছিল, সেই কমলা আজ লজ্জায় উঠিতে চায় না।

শৈল কহিল, “দেখ্‌ পোড়ারমুখী, আমি তোকে বেশিক্ষণ সাধিব না, তা আমি বলিয়া রাখিতেছি— আমার সময় নাই— উমির ব্যামো কেবল নামমাত্র, ডাক্তার বেশিক্ষণ থাকিবে না— তোকে সাধাসাধি করিতে গিয়া মাঝে হইতে আমার দেখা হইবে না।”

এই বলিয়া কমলাকে জোর করিয়া টানিয়া লইয়া শৈলজা দ্বারের অন্তরালে আসিয়া দাঁড়াইল। নলিনাক্ষ উমার বুক-পিঠ ভালো করিয়া পরীক্ষা করিয়া ওষুধ লিখিয়া দিয়া চলিয়া গেল।

শৈল কমলাকে কহিল, “কমল, বিধাতা তোকে যতই দুঃখ দিন, তোর ভাগ্য ভালো। এখন দুই-একদিন, বোন তোকে একটু ধৈর্য ধরিয়া থাকিতে হইবে— আমরা একটা ব্যবস্থা করিয়া দিতেছি। ইতিমধ্যে উমির জন্যে ঘন ঘন ডাক্তারের প্রয়োজন হইবে, অতএব নিতান্ত তোকে বঞ্চিত হইতে হইবে না।”

খুড়া একদিন এমন সময় বাছিয়া ডাক্তার ডাকিতে গেলেন যখন নলিনাক্ষ বাড়িতে থাকে না। চাকর কহিল, “ডাক্তারবাবু নাই।”

খুড়া কহিলেন, “মাঠাকরুন তো আছেন, তাঁহাকে একবার খবর দাও। বলো একটি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে চায়।”

উপরে ডাক পড়িল। খুড়া গিয়া কহিলেন, “মা আপনার নাম কাশীতে বিখ্যাত। তাই আপনাকে দেখিয়া পুণ্যসঞ্চয় করিতে আসিলাম। আমার আর-কোনো কামনা নাই। আমার একটি দৌহিত্রীর অসুখ, আপনার ছেলেকে ডাকিতে আসিয়াছিলাম, তিনি বাড়ি নাই ; তাই মনে করিলাম শুধু-শুধু ফিরিব না, একবার আপনাকে দর্শন করিয়া যাইব।”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “নলিন এখনি আসিবে, আপনি ততক্ষণ একটু বসুন। বেলা নিতান্ত কম হয় নাই, আপনার জন্য কিছু জলখাবার আনাইয়া দিই।”

খুড়া কহিলেন, “আমি জানিতাম, আপনি আমাকে না খাওয়াইয়া ছাড়িবেন না— আমার যে ভোজনে বেশ একটুখানি শখ আছে তাহা আমাকে দেখিলেই লোকে টের পায়, এবং সকলেই এ বিষয়ে আমাকে একটু দয়াও করে।”
ক্ষেমংকরী খুড়াকে জল খাওয়াইয়া বড়ো খুশি হইলেন। কহিলেন, “কাল আমার এখানে আপনার মধ্যাহ্নভোজনের নিমন্ত্রণ রহিল; আজ প্রস্তুত ছিলাম না, আপনাকে ভালো করিয়া খাওয়াইতে পারিলাম না।”

খুড়া কহিলেন, “যখনই প্রস্তুত হইবেন এই ব্রাহ্মণকে স্মরণ করিবেন। আপনাদের বাড়ি হইতে আমি বেশি দূরে থাকি না। বলেন তো আপনার চাকরটাকে লইয়া আমার বাড়ি দেখাইয়া আসিব।”

এমনি করিয়া খুড়া দুই-চারি দিনের যাতায়াতেই নলিনাক্ষের বাড়িতে বেশ একটু জমাইয়া লইলেন।

ক্ষেমংকরী নলিনাক্ষকে ডাকিয়া কহিলেন, “ও নলিন, তুই চক্রবর্তীমশায়ের কাছ থেকে ভিজিট নিস নে যেন।”

খুড়া হাসিয়া কহিলেন, “মাতৃ-আজ্ঞা উনি পাইবার পূর্ব হইতেই পালন করিয়া আসিতেছেন, আমার কাছ হইতে উনি কিছুই নেন নাই। যাঁহারা দাতা তাঁহারা গরিবকে দেখিলেই চিনিতে পারেন।”

দিন-দুয়েক পিতায় ও কন্যায় পরামর্শ চলিল। তাহার পরে একদিন সকালে খুড়া কমলাকে কহিল, “চলো মা, আমরা দশাশ্বমেধে স্নান করিতে যাই।”

কমলা শৈলকে কহিল, “দিদি, তুমিও চলো-না।”

শৈল কহিল, “না ভাই, উমির শরীর তেমন ভালো নাই।”

খুড়া যে পথ দিয়া স্নানের ঘাটে গেলেন স্নানান্তে সে পথ দিয়া না ফিরিয়া অন্য এক রাস্তায় চলিলেন। কিছু দূর গিয়াই দেখিলেন, একটি প্রবীণা স্নান সারিয়া পট্টবস্ত্র পরিয়া ঘটিতে গঙ্গাজল লইয়া ধীরে ধীরে আসিতেছেন।

কমলাকে সম্মুখে আনিয়া খুড়া কহিলেন, “মা, ইঁহাকে প্রণাম করো, ইনি ডাক্তারবাবুর মাতা।”

কমলা শুনিয়া চকিত হইয়া উঠিয়া, তৎক্ষণাৎ ক্ষেমংকরীকে প্রণাম করিয়া তাঁহার পায়ের ধুলা লইল।

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “তুমি কে গা ! দেখি দেখি, কী রূপ ! যেন লক্ষ্মীটির প্রতিমা !”

বলিয়া কমলার ঘোমটা সরাইয়া তাহার নতনেত্র মুখখানি ভালো করিয়া দেখিলেন। কহিলেন, “তোমার নাম কী বাছা ?”

কমলা উত্তর করিবার পূর্বেই খুড়া কহিলেন, “ইঁহার নাম হরিদাসী। ইনি আমার দূরসম্পর্কের ভ্রাতুষ্পুত্রী। ইহার মা-বাপ কেহ নাই, আমার উপরেই নির্ভর।”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “আসুন-না চক্রবর্তীমশায়, আমার বাড়িতেই আসুন।”

বাড়িতে লইয়া গিয়া ক্ষেমংকরী একবার নলিনাক্ষকে ডাকিলেন। নলিনাক্ষ তখন বাহির হইয়া গেছেন।

খুড়া আসন গ্রহণ করিলেন, কমলা মেজের উপরে বসিল। খুড়া কহিলেন, “দেখুন, আমার এই ভাইঝির ভাগ্য বড়ো মন্দ। বিবাহের পরদিনই ইহার স্বামী সন্ন্যাসী হইয়া বাহির হইয়া গেছেন, ইঁহার সঙ্গে আর দেখা-সাক্ষাৎ নাই। হরিদাসীর ইচ্ছা ধর্মকর্ম লইয়া তীর্থবাস করে— ধর্ম ছাড়া উঁহার সান্ত্বনার সামগ্রী আর তো কিছুই নাই। এখানে আমার বাড়ি নয়, আমার চাকরি আছে— উপার্জন করিয়া আমাকে সংসার চালাইতে হয়। আমি যে এখানে আসিয়া ইঁহাকে লইয়া থাকিব, আমার এমন সুবিধা নাই। তাই আপনার শরণাপন্ন হইয়াছি। এটিকে আপনার মেয়ের মতো যদি কাছে রাখেন তবে আমি বড়ো নিশ্চিন্ত হই। যখনই অসুবিধা বোধ করিবেন গাজিপুরে আমার কাছে পাঠাইয়া দিবেন। কিন্তু আমি বলিতেছি দুদিন ইঁহাকে কাছে রাখিলেই মেয়েটি কী রত্ন তাহা বুঝিতে পারিবেন, তখন মুহূর্তের জন্য ছাড়িতে চাহিবেন না।”

ক্ষেমংকরী খুশি হইয়া কহিলেন, “আহা, এ তো ভালো কথা। এমন মেয়েটিকে আপনি যে আমার কাছে রাখিয়া যাইতেছেন, এ তো আমার মস্ত লাভ। আমি কতদিন রাস্তা হইতে পরের মেয়েকে বাড়িতে আনিয়া খাওয়াইয়া পরাইয়া আনন্দ করি, কিন্তু তাহাদের তো রাখিতে পারি না। তা, হরিদাসী আমারই হইল, আপনি ইহার জন্য কিছুমাত্র ভাবিবেন না। আমার ছেলের কথা অবশ্য আপনারা পাঁচজনের কাছে শুনিয়া থাকিবেন-নলিনাক্ষ— সে বড়ো ভালো ছেলে। সে ছাড়া বাড়িতে আর কেহ নাই।”
খুড়া কহিলেন, “নলিনাক্ষবাবুর নাম সকলেই জানে। তিনি এখানে আপনার কাছে থাকেন জানিয়া আমি আরো নিশ্চিন্ত। আমি শুনিয়াছি, বিবাহের পর দুর্ঘটনায় তাঁহার স্ত্রী জলে ডুবিয়া মারা যাওয়াতে তিনি সেই অবধি একরকম ব্রহ্মচারীর মতোই আছেন।”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “সে যাহা হইয়াছে হইয়াছে, ও কথা আর তুলিবেন না— মনে করিলেও আমার গায়ে কাঁটা দিয়া ওঠে।”

খুড়া কহিলেন, “যদি অনুমতি করেন তবে মেয়েটিকে আপনার কাছে রাখিয়া এখন বিদায় হই। মাঝে মাঝে আসিয়া দেখিয়া যাইব। ইঁহার একটি বড়ো বোন আছে, সেও আপনাকে প্রণাম করিতে আসিবে।”

খুড়া চলিয়া গেলে ক্ষেমংকরী কমলাকে কাছে টানিয়া লইয়া কহিলেন, “এসো তো মা, দেখি। তোমার বয়স তো বেশি নয়। আহা, তোমাকে ফেলিয়া যাইতে পারে, জগতে এমন পাষাণও আছে ! আমি আশীর্বাদ করিতেছি, সে আবার ফিরিয়া আসিবে। বিধাতা এত রূপ কখনো বৃথা নষ্ট করিবার জন্য গড়েন নাই।”

বলিয়া কমলার চিবুক স্পর্শ করিয়া অঙ্গুলির দ্বারা চুম্বন গ্রহণ করিলেন।

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “এখানে তোমার সমবয়সী সঙ্গিনী কেহ নাই, একলা আমার কাছে থাকিতে পারিবে তো ?”

কমলা তাহার দুই বড়ো বড়ো স্নিগ্ধ চক্ষে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন করিয়া কহিল, “পারিব মা !”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “তোমার দিন কাটিবে কী করিয়া আমি তাই ভাবিতেছি।”

কমলা কহিল, “আমি তোমার কাজ করিব।”

ক্ষেমংকরী। পোড়াকপাল ! আমার আবার কাজ ! সংসারে ঐ তো আমার একটিমাত্র ছেলে, সেও সন্ন্যাসীর মতো থাকে— কখনো যদি বলিত ‘মা, এইটে আমার দরকার আছে, আমি এইটে খেতে চাই, আমি এইটে ভালোবাসি’, তবে আমি কত খুশি হইতাম— তাও কখনো বলে না। রোজগার ঢের করে, হাতে কিছুই রাখে না ; কত সৎকাজে যে কত দিকে খরচ করে তাহা কাহাকে জানিতেও দেয় না। দেখো বাছা, আমার কাছে যখন তোমাকে চব্বিশ ঘন্টা থাকিতে হইবে তখন এ কথা আগে হইতেই বলিয়া রাখিতেছি, আমার মুখে আমার ছেলের গুণগান বার বার শুনিয়া তোমার বিরক্ত ধরিবে, কিন্তু ঐটে তোমাকে সহ্য করিয়া যাইতে হইবে।

কমলা পুলকিতচিত্তে চক্ষু নত করিল।

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “আমি তোমাকে কী কাজ দিব, তাই ভাবিতেছি। সেলাই করিতে জান।”

কমলা কহিল, “ভালো জানি না মা !”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “আচ্ছা, আমি তোমাকে সেলাই শিখাইয়া দিব।”

ক্ষেমংকরী জিজ্ঞাসা করিলেন, “পড়িতে জান তো ?”

কমলা কহিল, “হাঁ, জানি।”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “সে হইল ভালো। চোখে তো আর চশমা নহিলে দেখিতে পাই না, তুমি আমাকে পড়িয়া শোনাইতে পারিবে।”

কমলা কহিল, “আমি রাঁধাবাড়া ঘরকন্নার কাজ সমস্ত শিখিয়াছি।”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “অমন অন্নপূর্ণার মতো চেহারা, তুমি যদি রাঁধাবাড়ার কাজ না জানিবে তো কে জানিবে। আজ পর্যন্ত নলিনকে আমি নিজে রাঁধিয়া খাওয়াইয়াছি— আমার অসুখ হইলে বরঞ্চ স্বপাক রাঁধিয়া খায়, তবু আর কাহারো হাতে খায় না। এবার হইতে তোমার কল্যাণে তাহার স্বপাক খাওয়া আমি ঘোচাইব। আর, অক্ষম হইয়া পড়িলে আমাকেও যদি চারটিখানি হবিষ্যান্ন রাঁধিয়া খাওয়াও তো আমার তাহাতে অনভিরুচি হইবে না। চলো মা, তোমাকে আমার ভাঁড়ার-ঘর রান্নাঘর সমস্ত দেখাইয়া আনি।”
এই বলিয়া ক্ষেমংকরী তাঁহার ক্ষুদ্র ঘরকন্নার সমস্ত নেপথ্যগৃহ কমলাকে দেখাইলেন। কমলা ইতিমধ্যে একটা অবকাশ বুঝিয়া আস্তে আস্তে আপনার দরখাস্ত জারি করিল। কহিল, “মা, আমাকে আজকে রাঁধিতে দাও-না।”

ক্ষেমংকরী একটুখানি হাসিলেন। কহিলেন, “গৃহিণীর রাজত্ব ভাঁড়ারে আর রান্নাঘরে— জীবনে অনেক জিনিস ছাড়িতে হইয়াছে, তবু ওটুকু সঙ্গে সঙ্গে লাগিয়াই আছে। তা মা, আজকের মতো তুমিই রাঁধো— দুই-চারিদিন যাক, ক্রমে সমস্ত ভার আপনিই তোমার হাতে পড়িবে, আমিও ভগবানে মন দিবার সময় পাইব। বন্ধন একেবারেই তো কাটে না— এখনো দুই-চারিদিন মন চঞ্চল হইয়া থাকিবে, ভাঁড়ার ঘরের সিংহাসনটি কম নয়।”

এই বলিয়া ক্ষেমংকরী, কী রাঁধিতে হইবে, কি করিতে হইবে, কমলাকে সমস্ত উপদেশ দিয়া পূজাগৃহে চলিয়া গেলেন। ক্ষেমংকরীর কাছে আজ কমলার ঘরকন্নার পরীক্ষা আরম্ভ হইল।

কমলা তাহার স্বাভাবিক তৎপরতার সহিত রন্ধনের সমস্ত আয়োজন প্রস্তুত করিয়া, কোমরে আঁচল জড়াইয়া, মাথায় এলোচুল ঝুঁটি করিয়া লইয়া রাঁধিতে প্রবৃত্ত হইল।

নলিনাক্ষ বাহির হইতে বাড়িতে ফিরিলেই প্রথমে তাহার মাকে দেখিতে যাইত। তাহার মাতার স্বাস্থ্য সম্বন্ধে চিন্তা তাহাকে কখনোই ছাড়িত না। আজ বাড়িতে প্রবেশ করিবামাত্র রান্নাঘরের শব্দ এবং গন্ধ তাহাকে আক্রমণ করিল। মা এখন রান্নায় প্রবৃত্ত আছেন মনে করিয়া নলিনাক্ষ রান্নাঘরের দরজার সামনে আসিয়া উপস্থিত হইল।

পদশব্দে চকিত কমলা পিছন ফিরিয়া চাহিতেই একেবারে নলিনাক্ষের সহিত তাহার চোখে চোখে সাক্ষাৎ হইয়া গেল। তাড়াতাড়ি হাতাটা রাখিয়া ঘোমটা টানিয়া দিবার বৃথা চেষ্টা করিল— কোমরে আঁচল জড়ানো ছিল— টানাটানি করিয়া ঘোমটা যখন মাথার কিনারায় উঠিল বিস্মিত নলিনাক্ষ তখন সেখান হইতে চলিয়া গেছে। তাহার পর কমলা যখন হাতা তুলিয়া লইল তখন তাহার হাত কাঁপিতেছে।

পূজা সকাল-সকাল সারিয়া ক্ষেমংকরী যখন রান্নাঘরে গেলেন, দেখিলেন, রান্না সারা হইয়া গেছে। ঘর ধুইয়া কমলা পরিষ্কার করিয়া রাখিয়াছে; কোথাও পোড়াকাঠ বা তরকারির খোসা বা কোনোপ্রকার অপিরচ্ছন্নতা নাই। দেখিয়া ক্ষেমংকরী মনে মনে খুশি হইলেন; কহিলেন, “মা, তুমি ব্রাহ্মণের মেয়ে বটে।”

নলিনাক্ষ আহারে বসিলে ক্ষেমংকরী তাহার সম্মুখে বসিলেন; আর-একটি সংকুচিত প্রাণী কান পাতিয়া দ্বারের আড়ালে দাঁড়াইয়া ছিল, উঁকি মারিতে সাহস করিতেছিল না— ভয়ে মরিয়া যাইতেছিল, পাছে তাহার রান্না খারাপ হইয়া থাকে।

ক্ষেমংকরী জিজ্ঞাসা করিলেন, “নলিন, আজ রান্নাটা কেমন হইয়াছে ?”

নলিনাক্ষ ভোজ্যপদার্থ সম্বন্ধে সমজদার ছিল না, তাই ক্ষেমংকরী এরূপ অনাবশ্যক প্রশ্ন কখনো তাহাকে করিতেন না; আজ বিশেষ কৌতূহলবশতই জিজ্ঞাসা করিলেন।

নলিনাক্ষ যে অদ্যকার রান্নাঘরের নূতন রহস্যের পরিচয় পাইয়াছে তাহা তাহার মা জানিতেন না। ইদানীং মাতার শরীর খারাপ হওয়াতে নলিনাক্ষ রাঁধিবার জন্য লোক নিযুক্ত করিতে মাকে অনেক পীড়াপীড়ি করিয়াছে, কিন্তু কিছুতেই তাঁহাকে রাজি করিতে পারে নাই। আজ নূতন লোককে রন্ধনে নিযুক্ত দেখিয়া সে মনে মনে খুশি হইয়াছে। রান্না কিরূপ হইয়াছে তাহা সে বিশেষ মনোযোগ করে নাই, কিন্তু উৎসাহের সহিত কহিল, “রান্না চমৎকার হইয়াছে মা !”
আড়াল হইতে এই উৎসাহবাক্য শুনিয়া কমলা আর স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিতে পারিল না। সে দ্রুতপদে পাশের একটা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া আপনার চঞ্চল বক্ষকে দুই বাহুর দ্বারা পীড়ন করিয়া ধরিল।

আহারান্তে নলিনাক্ষ আপনার মনের মধ্যে কী-একটা অস্পষ্টতাকে স্পষ্ট করিবার চেষ্টা করিতে করিতে প্রাত্যহিক অভ্যাস-অনুসারে নিভৃত অধ্যয়নে চলিয়া গেল।

বৈকালে ক্ষেমংকরী কমলাকে লইয়া নিজে তাহার চুল বাঁধিয়া সীমন্তে সিঁদুর পরাইয়া দিলেন; তাহার মুখ একবার এ পাশে, একবার ও পাশে ফিরাইয়া ভালো করিয়া দেখিলেন— কমলা লজ্জায় চক্ষু নত করিয়া বসিয়া রহিল। ক্ষেমংকরী মনে মনে কহিলেন, ‘আহা, আমি যদি এইরকমের একটি বউ পাইতাম !’

সেই রাত্রেই ক্ষেমংকরীর আবার জ্বর আসিল। নলিনাক্ষ উদ্‌‍বিগ্ন হইয়া উঠিল। কহিল, “মা, তোমাকে আমি কিছুদিন কাশী হইতে অন্য কোথাও লইয়া যাইব। এখানে তোমার শরীর ভালো থাকিতেছে না।”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “সেটি হবে না বাছা ! দু-চারদিন বাঁচাইয়া রখিবার আশায় আমাকে যে কাশী ছাড়িয়া অন্য কোথাও লইয়া মারিবি, সেটি হবে না। ও কি মা, তুমি যে দরজার পাশে দাঁড়াইয়া আছ ! যাও যাও, শুতে যাও। সমস্ত রাত অমন জাগিয়া কাটাইলে চলিবে না। আমি যে-কয়দিন ব্যামোতে আছি তোমাকেই তো সব দেখিতে শুনিতে হইবে। রাত জাগিলে পারিবে কেন ? যা তো নলিন, একবার ও ঘরে যা তো।”

নলিনাক্ষ পাশের ঘরে যাইতেই কমলা ক্ষেমংকরীর পদতলে বসিয়া তাঁহার পায়ে হাত বুলাইতে লাগিল। ক্ষেমংকরী কহিলেন, “আর-জন্মে নিশ্চয়ই তুমি আমার মা ছিলে মা ! নহিলে কোথাও কিছু নাই তোমাকে এমন করিয়া পাইব কেন ? দেখো, আমার একটা অভ্যাস আছে, আমি বাজে কোনো লোকের সেবা সহিতে পারি না, কিন্তু তুমি আমার গায়ে হাত দিলে আমার গা যেন জুড়াইয়া যায়। আশ্চর্য এই যে, মনে হইতেছে , তোমাকে আমি যেন কতকাল ধরিয়া জানি। তোমাকে তো একটুও পর মনে হয় না। তা, শোনো মা, তুমি নিশ্চিন্তমনে ঘুমাইতে যাও। পাশের ঘরে নলিন রহিল— মার সেবা সে আর কারো হাতে ছাড়িয়া দিতে পারিবে না— তা, হাজার বারণ করি আর যাই করি— ওর সঙ্গে পারিয়া উঠিবে কে বলো। কিন্তু ওর একটি গুণ আছে, রাত জাগুক আর যাই করুক, ওর মুখ দেখিয়া কিছু বুঝা যাইবে না— তার কারণ, ও কখনো কিছুতে অস্থির হয় না। আমার ঠিক তার উলটা। মা, তুমি বোধ করি মনে মনে হাসিতেছ। ভাবিতেছ, নলিনের কথা আরম্ভ হইল, এবারে আর কথা থামিবে না। তা মা, এক ছেলে থাকিলে ঐরকমই হয়। আর নলিনের মতো ছেলেই বা কজন মায়ের হয় ? সত্য বলিতেছি, আমি এক-একবার ভাবি — নলিন তো আমার বাপ, ও আমার জন্যে যতটা করিয়াছে আমি কি উহার জন্যে ততটা করিতে পারি। ঐ দেখো, আবার নলিনের কথা ! কিন্তু আর নয়, যাও মা, তুমি শুইতে যাও। না না, সে কিছুতেই হইতে পারিবে না, তুমি যাও— তুমি থাকিলে আমার ঘুম আসিবে না। বুড়োমানুষ, লোক কাছে থাকিলেই কেবল বকিতে ইচ্ছা করে।”

পরদিন কমলাই ঘরকন্নার সমুদয় ভার গ্রহণ করিল। নলিনাক্ষ পূর্ব দিকের বারান্দায় এক অংশ ঘিরিয়া লইয়া মার্বেল দিয়া বাঁধাইয়া একটি ছোটো ঘর করিয়া লইয়াছিল, ইহাই তাহার উপাসনাগৃহ ছিল, এবং মধ্যাহ্নে এইখানেই সে আসনের উপর বসিয়া অধ্যয়ন করিত। সেদিন প্রাতে সে ঘরে নলিনাক্ষ প্রবেশ করিয়াই দেখিল, ঘরটি ধৌত, মার্জিত, পরিচ্ছন্ন; ধুনা জ্বালাইবার জন্য একটি পিতলের ধুনুচি ছিল, সেটি আজ সোনার মতো ঝক্‌ ঝক্‌ করিতেছে। শেল্‌‌ফের উপরে তাহার কয়েকখানি বই ও পুঁথি সুসজ্জিত করিয়া বিন্যস্ত হইয়াছে। এই গৃহখানির যত্নমার্জিত নির্মলতার উপরে মুক্তদ্বার দিয়া প্রভাতরৌদ্রের উজ্জ্বলতা পরিব্যাপ্ত হইয়াছে, দেখিয়া স্নান হইতে সদ্যঃপ্রত্যাগত নলিনাক্ষের মনে বিশেষ একটি তৃপ্তির সঞ্চার হইল।

কমলা প্রভাতে ঘটিতে গঙ্গাজল লইয়া ক্ষেমংকরীর বিছানার পাশে আসিয়া উপস্থিত হইল। তিনি তাহার স্নাতমূর্তি দেখিয়া কহিলেন, “একি মা, তুমি একলাই ঘাটে গিয়াছিলে ? আমি আজ ভোর হইতে ভাবিতেছিলাম, আমার অসুখ, তুমি কাহার সঙ্গে স্নানে যাইবে। কিন্তু তোমার অল্প বয়স, এমন করিয়া একলা— ”
কমলা কহিল, “মা, আমার বাপের বাড়ির একটা চাকর থাকিতে পারে নাই, আমাকে দেখিতে কাল রাত্রেই এখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। তাহাকে সঙ্গে লইয়াছিলাম।”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “আহা, তোমার খুড়িমা বোধ হয় অস্থির হইয়া উঠিয়াছেন, চাকরটাকে পাঠাইয়া দিয়াছেন। তা, বেশ হইয়াছে— সে তোমার কাছেই থাক্‌-না, তোমার কাজে-কর্মে সাহায্য করিবে। কোথায় সে, তাহাকে ডাকো-না।”

কমলা উমেশকে লইয়া হাজির করিল। উমেশ গড় হইয়া ক্ষেমংকরীকে প্রণাম করিতে তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোর নাম কী রে ?”

সে কহিল, “আমার নাম উমেশ।”

বলিয়া অকারণ-বিকশিত হাস্যে তাহার মুখ ভরিয়া গেল।

ক্ষেমংকরী হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “উমেশ, তোর এই বাহারে কাপড়খানা তোকে কে দিল রে ?”

উমেশ কমলাকে দেখাইয়া কহিল, “মা দিয়াছেন।”

ক্ষেমংকরী কমলার দিকে চাহিয়া পরিহাস করিয়া কহিলেন, “আমি বলি, উমেশ বুঝি ওর শাশুড়ির কাছ হইতে জামাইষষ্ঠী পাইয়াছে।”

ক্ষেমংকরীর স্নেহ লাভ করিয়া উমেশ এইখানেই রহিয়া গেল।

উমেশকে সহায় করিয়া কমলা দিনের বেলাকার সমস্ত কাজকর্ম শেষ করিয়া ফেলিল। স্বহস্তে নলিনাক্ষের শোবার ঘর ঝাঁট দিয়া, তাহার বিছানা রৌদ্রে দিয়া, তুলিয়া, সমস্ত পরিচ্ছন্ন করিয়া রাখিল। নলিনাক্ষের ময়লা ছাড়া-ধুতি ঘরের এক কোণে পড়িয়া ছিল। কমলা সেখানি ধুইয়া, শুকাইয়া ভাঁজ করিয়া আলনার উপরে ঝুলাইয়া রাখিল। ঘরের যে-সব জিনিস কিছুমাত্র অপরিষ্কার ছিল না তাহাও সে মুছিবার ছলে বার বার নাড়াচাড়া করিয়া লইল। বিছানার শিয়রের কাছে দেয়ালে একটা গা-আলমারি ছিল; সেটা খুলিয়া দেখিল তাহার মধ্যে আর-কিছুই নাই, কেবল নীচের থাকে নলিনাক্ষের এক জোড়া খড়ম আছে। তাড়াতাড়ি সেই খড়ম জোড়াটি তুলিয়া লইয়া কমলা মাথায় ঠেকাইল, এবং ছোটো শিশুটির মতো বুকের কাছে ধরিয়া অঞ্চল দিয়া বার বার তাহার ধুলা মুছাইয়া দিল।

বৈকালে কমলা ক্ষেমংকরীর পায়ের কাছে বসিয়া তাঁহার পায়ে হাত বুলাইয়া দিতেছে, এমন সময় হেমনলিনী একটি ফুলের সাজি লইয়া ঘরে প্রবেশ করিল এবং ক্ষেমংকরীকে প্রণাম করিল।

ক্ষেমংকরী উঠিয়া বসিয়া কহিল, “এসো এসো, হেম, এসো, বোসো। অন্নদাবাবু ভালো আছেন ?”

হেমনলিনী কহিল, “তাঁহার শরীর অসুস্থ ছিল বলিয়া কাল আসিতে পারি নাই, আজ তিনি ভালো আছেন।”

কমলাকে দেখাইয়া ক্ষেমংকরী কহিলেন, “এই দেখো বাছা, শিশুকালে আমার মা মারা গেছেন; তিনি আবার জন্ম লইয়া এতদিন পরে কাল পথের মধ্যে হঠাৎ আমাকে দেখা দিয়াছেন। আমার মা’র নাম ছিল হরিভাবিনী, এবারে হরিদাসী নাম লইয়াছেন। কিন্তু হেম, এমন লক্ষ্মীর মূর্তি আর কোথাও দেখিয়াছ ? বলো তো।”

কমলা লজ্জায় মুখ নিচু করিল। হেমনলিনীর সঙ্গে আস্তে আস্তে তাহার পরিচয় হইয়া গেল।

হেমনলিনী ক্ষেমংকরীকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘মা, আপনার শরীর কেমন আছে ?”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “দেখো, আমার যে বয়স হইয়াছে এখন আমাকে আর শরীরের কথা জিজ্ঞাসা করা চলে না। আমি যে এখনো আছি, এই ঢের। কিন্তু তাই বলিয়া কালকে চিরদিন ফাঁকি দেওয়া তো চলিবে না। তা, তুমি যখন কথাটা পাড়িয়াছ ভালোই হইয়াছে— তোমাকে কিছুদিন হইতে বলিব বলিব করিতেছি, সুবিধা হইতেছে না। কাল রাত্রে আবার যখন আমাকে জ্বরে ধরিল তখন ঠিক করিলাম, আর বিলম্ব করা ভালো হইতেছে না। দেখো বাছা, ছেলেবয়সে আমাকে যদি কেহ বিবাহের কথা বলিত তো লজ্জায় মরিয়া যাইতাম— কিন্তু তোমাদের তো সেরকম শিক্ষা নয়। তোমরা লেখাপড়া শিখিয়াছ, বয়সও হইয়াছে, তোমাদের কাছে এ-সব কথা স্পষ্ট করিয়া বলা চলে। সেইজন্যই কথাটা পাড়িতেছি, তুমি আমার কাছে লজ্জা করিয়ো না। আচ্ছা, বলো তো বাছা, সেদিন তোমার বাপের কাছে যে প্রস্তাব করিয়াছিলাম তিনি কি তোমাকে বলেন নি ?”
হেমনলিনী নতমুখে কহিল, “হাঁ, বলিয়াছিলেন।”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “কিন্তু তুমি, বাছা, সে কথায় নিশ্চয়ই রাজি হও নাই। যদি রাজি হইতে তবে অন্নদাবাবু তখনি আমার কাছে ছুটিয়া আসিতেন। তুমি ভাবিলে, আমার নলিন সন্ন্যাসী-মানুষ, দিবারাত্রি কী-সব যোগযাগ লইয়া আছে, উহাকে আবার বিবাহ করা কেন ? হোক আমার ছেলে তবু কথাটা উড়াইয়া দিবার নয়। উহাকে বাহির হইতে দেখিলে মনে হয়, উহার যেন কিছুতেই কোনোদিন আসক্তি জন্মিবার সম্ভবনা নাই। কিন্তু সেটা তোমাদের ভুল। আমি উহাকে জন্মকাল হইতে জানি, আমার কথাটা বিশ্বাস করিয়ো। ও এত বেশি ভালোবসিতে পারে যে, সেই ভয়েই ও আপনাকে এত করিয়া দমন করিয়া রাখে। উহার এই সন্ন্যাসের খোলা ভাঙিয়া যে উহার হৃদয় পাইবে সে বড়ো মধুর জিনিসটি পাইবে তাহা আমি বলিয়া রাখিতেছি। মা হেম, তুমি বালিকা নও, তুমি শিক্ষিত, তুমি আমার নলিনের কাছ হইতেই দীক্ষা লইয়াছ, তোমাকে নলিনের ঘরে প্রতিষ্ঠিত করিয়া আমি যদি মরিতে পারি তবে বড়ো নিশ্চিন্ত হইয়া মরিতে পারিব। নহিলে, আমি নিশ্চয় জানি, আমি মরিলে ও আর বিবাহই করিবে না। তখন ওর কী দশা হইবে ভাবিয়া দেখো দেখি। একেবারে ভাসিয়া বেড়াইবে। যাই হোক, বলো তো বাছা, তুমি তো নলিনকে শ্রদ্ধা কর আমি জানি, তবে তোমার মনে আপত্তি উঠিতেছে কেন ?”

হেমনলিনী নতনেত্রে কহিল, “মা, তুমি যদি আমাকে যোগ্য মনে কর তবে আমার কোনো আপত্তি নাই।”

শুনিয়া ক্ষেমংকরী হেমনলিনীকে কাছে টানিয়া লইয়া তাহার মাথায় চুম্বন করিলেন। এ সম্বন্ধে আর কোনো কথা বলিলেন না।

“হরিদাসী, এ ফুলগুলো”— বলিতে বলিতে পাশে চাহিয়া দেখিলেন, হরিদাসী নাই। সে নিঃশব্দপদে কখন উঠিয়া গেছে।

পূর্বোক্ত আলোচনার পর ক্ষেমংকরীর কাছে হেমনলিনী সংকোচ বোধ করিল, ক্ষেমংকরীও বাধো-বাধো করিতে লাগিল। তখন হেম কহিল, “মা, আজ তবে সকাল-সকাল যাই। বাবার শরীর ভালো নাই।”

বলিয়া ক্ষেমংকরীকে প্রণাম করিল। ক্ষেমংকরী তাহার মাথায় হাত দিয়া কহিলেন, “এসো মা, এসো।”

হেমনলিনী চলিয়া গেলে ক্ষেমংকরী নলিনাক্ষকে ডাকিয়া পাঠাইলেন; কহিলেন, “নলিন, আর আমি দেরি করিতে পারিব না।”

নলিনাক্ষ কহিল, “ব্যাপারখানা কী ?”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “আমি আজ হেমকে সব কথা খুলিয়া বলিলাম ; সে তো রাজি হইয়াছে, এখন তোমার কোনো ওজর আমি শুনিতে চাই না। আমার শরীর তো দেখিতেছিস। তোদের একটা স্থিতি না করিয়া আমি কোনোমতেই সুস্থির হইতে পারিতেছি না। অর্ধেক রাত্রে ঘুম ভাঙিয়া আমি ঐ কথাই ভাবি।”

নলিনাক্ষ কহিল, “আচ্ছা মা, ভাবিয়ো না, তুমি ভালো করিয়া ঘুমাইয়ো, তুমি যেমন ইচ্ছা কর তাহাই হইবে।”

নলিনাক্ষ চলিয়া গেলে ক্ষেমংকরী ডাকিলেন, “হরিদাসী !”

কমলা পাশের ঘর হইতে চলিয়া আসিল। তখন অপরাহ্ণের আলোক ম্লান হইয়া ঘর প্রায় অন্ধকার হইয়া আসিয়াছে। হরিদাসীর মুখ ভালো করিয়া দেখা গেল না। ক্ষেমংকরী কহিলেন, “বাছা, এই ফুলগুলিতে জল দিয়া ঘরে সাজাইয়া রাখো।”

বলিয়া বাছিয়া একটি গোলাপ তুলিয়া ফুলের সাজিটি কমলার দিকে অগ্রসর করিয়া দিলেন।

কমলা তাহার মধ্যে কতকগুলি ফুল তুলিয়া একটি থালায় সাজাইয়া নলিনাক্ষের উপাসনাগৃহের আসনের সম্মুখে রাখিল। আর-কতকগুলি একটি বাটিতে করিয়া নলিনাক্ষের শোবার ঘরে টিপাইয়ের উপর রাখিয়া দিল। বাকি কয়েকটি ফুল লইয়া সেই দেয়ালের গায়ের আলমারিটা খুলিয়া এবং সেই খড়মজোড়ার উপর ফুলগুলি রাখিয়া তাহার উপরে মাথা ঠেকাইয়া প্রণাম করিতেই তাহার চোখ দিয়া আজ ঝর্ ঝর্ করিয়া জল পড়িতে লাগিল। এই খড়ম ছাড়া জগতে তাহার আর-কিছুই নাই— পদসেবার অধিকারও হারাইতে বসিয়াছে।

এমন সময় হঠাৎ ঘরে কে প্রবেশ করিতেই কমলা ধড়্‌ফড়্‌ করিয়া উঠিয়া পড়িল। তাড়াতাড়ি আলমারির দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া দেখিল, নলিনাক্ষ। কোনো দিকে কমলা পালাইবার পথ পাইল না— লজ্জায় কমলা সেই আসন্ন সায়াহ্নের অন্ধকারে মিশাইয়া গেল না কেন।

নলিনাক্ষ ঘরের মধ্যে কমলাকে দেখিয়া বাহির হইয়া গেল। কমলাও আর বিলম্ব না করিয়া দ্রুতপদে অন্য ঘরে চলিয়া গেল। তখন নলিনাক্ষ পুনর্বার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। মেয়েটি আলমারি খুলিয়া কী করিতেছিল, তাহাকে দেখিয়া তাড়াতাড়ি বন্ধ করিলই বা কেন ? কৌতূহলবশত নলিনাক্ষ আলমারি খুলিয়া দেখিল, তাহার খড়ম-জোড়ার উপর কতকগুলি সদ্যসিক্ত ফুল রহিয়াছে। তখন সে আবার আলমারির দরজা বন্ধ করিয়া শয়নগৃহের জানলার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। বাহিরে আকাশের দিকে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে শীতসূর্যাস্তের ক্ষণকালীন আভা মিলাইয়া আসিয়া অন্ধকার ঘনীভূত হইয়া উঠিল।

নৌকাডুবি ৫৬

হেমনলিনী নলিনাক্ষের সহিত বিবাহে সম্মতি দিয়া মনকে বুঝাইতে লাগিল, ‘আমার পক্ষে সৌভাগ্যের বিষয় হইয়াছে।’ মনে মনে সহস্রবার করিয়া বলিল, ‘আমার পুরাতন বন্ধন ছিন্ন হইয়া গেছে, আমার জীবনের আকাশকে বেষ্টন করিয়া যে ঝড়ের মেঘ জমিয়া উঠিয়াছিল তাহা একেবারে কাটিয়া গেছে। এখন আমি স্বাধীন, আমার অতীতকালের অবিশ্রাম আক্রমণ হইতে নির্মুক্ত।’ এই কথা বারংবার বলিয়া সে একটা বৃহৎ বৈরাগ্যের আনন্দ অনুভব করিল। শ্মশানে দাহকৃত্যের পর এই প্রকাণ্ড সংসার তাহার বিপুল ভার পরিহার করিয়া যখন খেলার মতো হইয়া দেখা দেয় তখন কিছুকালের মতো মন যেমন লঘু হইয়া যায়, হেমনলিনীর ঠিক সেই অবস্থা হইল— সে নিজের জীবনের একাংশের নিঃশেষ অবসান-জনিত শান্তি লাভ করিল।

বাড়িতে ফিরিয়া আসিয়া হেমনলিনী ভাবিল, ‘মা যদি থাকিতেন, তবে তাঁহাকে আজ আমার এই আনন্দের কথা বলিয়া আনন্দিত করিতাম, বাবাকে কেমন করিয়া সব কথা বলিব।’

শরীর দুর্বল বলিয়া আজ অন্নদাবাবু যখন সকাল-সকাল শুইতে গেলেন, তখন হেমনলিনী একখানি খাতা বাহির করিয়া রাত্রে তাহার নির্জন শয়নগৃহে টেবিলের উপর লিখিতে লাগিল, ‘আমি মৃত্যুজালে জড়াইয়া পড়িয়া সমস্ত সংসার হইতে বিযুক্ত হইয়াছিলাম। তাহা হইতে উদ্ধার করিয়া ঈশ্বর আবার যে একদিন আমাকে নূতন জীবনের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করিবেন তাহা আমি মনেও করিতে পারিতাম না। আজ তাঁহার চরণে সহস্রবার প্রণাম করিয়া নূতন কর্তব্যক্ষেত্রে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত হইলাম। আমি কোনোমতেই যে সৌভাগ্যের উপযুক্ত নই তাহাই লাভ করিতেছি। ঈশ্বর আমাকে তাহাই চিরজীবন রক্ষা করিবার জন্য বলদান করুন। যাঁহার জীবনের সঙ্গে আমার এই ক্ষুদ্র জীবন মিলিত হইতে চলিল, তিনি আমাকে সর্বাংশে পরিপূর্ণতা দিবেন, তাহা আমি নিশ্চয়ই জানি; সেই পরিপূর্ণতার সমস্ত ঐশ্বর্য আমি যেন সম্পূর্ণভাবে তাঁহাকেই প্রত্যর্পণ করিতে পারি, এই আমার একমাত্র প্রার্থনা।
তাহার পরে খাতা বন্ধ করিয়া হেমনলিনী সেই নক্ষত্রখচিত অন্ধকারে নিস্তব্ধ শীতের রাত্রে কাঁকর-বিছানো বাগানের পথে অনেকক্ষণ পায়চারি করিয়া বেড়াইতে লাগিল। অনন্ত আকাশ তাহার অশ্রুধৌত অন্তঃকরণের মধ্যে নিঃশব্দ শান্তিমন্ত্র উচ্চারণ করিল।

পরদিন অপরাহ্নে যখন অন্নদাবাবু হেমনলিনীকে লইয়া নলিনাক্ষের বাড়ি যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতেছেন, এমন সময় তাঁহার দ্বারের কাছে এক গাড়ি আসিয়া দাঁড়াইল। কোচবাক্সের উপর হইতে নলিনাক্ষের এক চাকর নামিয়া আসিয়া খবর দিল, “মা আসিয়াছেন।”

অন্নদাবাবু তাড়াতাড়ি দ্বারের কাছে আসিয়া উপস্থিত হইতেই ক্ষেমংকরী গাড়ি হইতে নামিয়া আসিলেন। অন্নদাবাবু কহিলেন, “আজ আমার পরম সৌভাগ্য।”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “আজ আপনার মেয়ে দেখিয়া আশীর্বাদ করিয়া যাইব, তাই আসিয়াছি।”

এই বলিয়া তিনি ঘরে প্রবেশ করিলেন। অন্নদাবাবু তাঁহাকে বসিবার ঘরে যত্নপূর্বক একটা সোফার উপরে বসাইয়া কহিলেন, “আপনি বসুন, আমি হেমকে ডাকিয়া আনিতেছি।”

হেমনলিনী বাইরে যাইবার জন্য সাজিয়া প্রস্তুত হইতেছিল, ক্ষেমংকরী আসিয়াছেন শুনিয়া তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া তাঁহাকে প্রণাম করিল; ক্ষেমংকরী কহিলেন, “সৌভাগ্যবতী হইয়া তুমি দীর্ঘায়ু লাভ করো। দেখি মা, তোমার হাতখানি দেখি।”

বলিয়া একে একে তাহার দুই হাতে মকরমুখো মোটা সোনার বালা দুইগাছি পরাইয়া দিলেন। হেমনলিনীর কৃশ হাতে মোটা বালাজোড়া ঢল্‌ঢল্‌ করিতে লাগিল। বালা পরানো হইলে হেমনলিনী আবার ভূমিষ্ঠ হইয়া ক্ষেমংকরীকে প্রণাম করিল; ক্ষেমংকরী দুই হাতে তাহার মুখ ধরিয়া তাহার ললাটচুম্বন করিলেন। এই আশীর্বাদে ও আদরে হেমনলিনীর হৃদয় একটি সুগম্ভীর মাধুর্যে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল।

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “বেয়াইমশায়, কাল আমার ওখানে আপনাদের দুজনেরই সকালে নিমন্ত্রণ রহিল।”

পরদিন প্রাতঃকালে হেমনলিনীকে লইয়া অন্নদাবাবু যথানিয়মে বাহিরে চা খাইতে বসিয়াছেন। অন্নদাবাবু রোগক্লিষ্ট মুখ এক রাত্রির মধ্যেই আনন্দে সরস ও নবীন হইয়া উঠিয়াছে। ক্ষণে ক্ষণে হেমনলিনীর শান্তোজ্জ্বল মুখের দিকে চাহিতেছেন আর তাঁহার মনে হইতেছে, আজ যেন তাঁহার পরলোকগতা পত্নীর মঙ্গলমধুর আবির্ভাব তাঁহার কন্যাকে পরিবেষ্টিত করিয়া রহিয়াছে এবং সুদূরব্যাপ্ত অশ্রুজলের আভাসে সুখের অত্যুজ্জ্বলতাকে স্নিগ্ধগম্ভীর করিয়া তুলিয়াছে।

অন্নদাবাবুর আজ কেবলই মনে হইতেছে, ক্ষেমংকরীর নিমন্ত্রণে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইবার সময় হইয়াছে, আর দেরি করা উচিত নহে। হেমনলিনী তাঁহাকে বার বার করিয়া স্মরণ করাইতেছে, এখনো অনেক সময় আছে, এখনো সবে আটটা। অন্নদাবাবু কহিতেছেন, “নাহিয়া প্রস্তুত হইয়া লইতে তো সময় চাই। দেরি করার চেয়ে বরঞ্চ একটু সকাল-সকাল যাওয়া ভালো।”

ইতিমধ্যে কতকগুলি তোরঙ্গ বিছানা প্রভৃতি বোঝাই-সমেত এক ভাড়াটে গাড়ি আসিয়া বাগানের প্রবেশপথের সম্মুখে থামিল।

সহসা হেমনলিনী “দাদা আসিয়াছেন” বলিয়া অগ্রসর হইয়া গেল। যোগেন্দ্র হাস্যমুখে গাড়ি হইতে নামিল; কহিল, “কী হেম, ভালো আছ তো ?”

হেমনলিনী জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার গাড়িতে আর-কেহ আছে নাকি ?”

যোগেন্দ্র হাসিয়া কহিল, “আছে বৈকি। বাবার জন্য একটি ক্রিস্ট্‌মাসের উপহার আনিয়াছি।”

ইতিমধ্যে রমেশ গাড়ি হইতে নামিয়া পড়িল। হেমনলিনী একবার মুহূর্তকাল চাহিয়াই তৎক্ষণাৎ পশ্চাৎ ফিরিয়া চলিয়া গেল।

যোগেন্দ্র ডাকিল, “হেম, যেয়ো না, কথা আছে, শোনো।”

এ আহ্বান হেমনলিনীর কানেও পৌঁছিল না, সে যেন কোন্‌ প্রেতমূর্তির অনুসরণ হইতে আত্মরক্ষা করিবার জন্য দ্রুতবেগে চলিল।

রমেশ ক্ষণকালের জন্য একবার থমকিয়া দাঁড়াইল; অগ্রসর হইবে কী ফিরিয়া যাইবে ভাবিয়া পাইল না। যোগেন্দ্র কহিল, “রমেশ, এসো, বাবা এইখানে বাহিরেই বসিয়া আছেন।” বলিয়া রমেশের হাত ধরিয়া তাহাকে অন্নদাবাবুর কাছে আনিয়া উপস্থিত করিল।

অন্নদাবাবু দূর হইতেই রমেশকে দেখিয়া হতবুদ্ধি হইয়া গেছেন। তিনি মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে ভাবিলেন, এ আবার কী বিঘ্ন উপস্থিত হইল !

রমেশ অন্নদাবাবুকে নত হইয়া নমস্কার করিল। অন্নদাবাবু তাহাকে বসিবার চৌকি দেখাইয়া দিয়া যোগেন্দ্রকে কহিলেন, “যোগেন, তুমি ঠিক সময়েই আসিয়াছ। আমি তোমাকে টেলিগ্রাফ করিব মনে করিতেছিলাম।”

যোগেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “কেন ?”

অন্নদাবাবু কহিলেন, “হেমের সঙ্গে নলিনাক্ষের বিবাহ স্থির হইয়া গেছে। কাল নলিনাক্ষের মা হেমকে আশীর্বাদ করিয়া দেখিয়া গেছেন।”

যোগেন্দ্র। বল কী বাবা, বিবাহ একেবারে পাকাপাকি স্থির হইয়া গেছে ? আমাকে একবার জিজ্ঞাসা করিতেও নাই ?”

অন্নদাবাবু। যোগেন্দ্র, তুমি কখন কী বল তার কিছুই স্থির নাই। আমি যখন নলিনাক্ষকে জানিতামও না তখন তোমরাই তো এই বিবাহের জন্য উদ্‌‌যোগী ছিলে।

যোগেন্দ্র। তখন তো ছিলাম, কিন্তু তা যাই হোক, এখনো সময় যায় নাই। ঢের কথা বলিবার আছে। আগে সেইগুলো শোনো, তার পরে যা কর্তব্য হয় করিয়ো।

অন্নদাবাবু কহিলেন, “সময়মত একদিন শুনিব, কিন্তু আজ আমার তো অবকাশ নাই। এখনি আমাকে বাহির হইতে হইবে।”

যোগেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় যাইবে।”

অন্নদাবাবু কহিলেন, “নলিনাক্ষের মা’র ওখানে আমার আর হেমের নিমন্ত্রণ আছে। যোগেন্দ্র, তোমার তা হইলে এখানেই আহারের— ”

যোগেন্দ্র কহিল, “না না। আমার জন্যে ব্যস্ত হবার দরকার নেই। আমি রমেশকে সঙ্গে লইয়া এখানকার কোনো হোটেলে খাওয়া-দাওয়া করিয়া লইব। সন্ধ্যার মধ্যে তোমরা ফিরিবে তো ? তখনি আমরা আসিব।”

অন্নদাবাবু কোনোমতেই রমেশের প্রতি কোনোপ্রকার শিষ্টসম্ভাষণ করিতে পারিলেন না। তাহার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করাও তাঁহার পক্ষে দুঃসাধ্য হইয়া উঠিল। রমেশও এতক্ষণ নীরবে থাকিয়া, যাইবার সময় অন্নদাবাবুকে নমস্কার করিয়া চলিয়া গেল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress