নোবেল বিজেতা পোলিশ কবি ভিসওয়াভা সিম্বোরস্কা
ভিসওয়াভা সিম্বোরস্কা ১৯৯৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। তাঁর কবিতা বাংলাভাষায় খুব একটা অনুবাদিত হয়নি। নোবেল কমিটি পুরস্কার প্রদান সংক্রান্ত ঘোষণাপত্রে স্বনামধন্য এ কবিকে ‘কাব্যজগতের মোৎসার্ট’ হিসেবে অভিহিত করেছিল। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল সিম্বোরস্কা তার কাব্যধারায় ভাষার মাধুর্যকে সুরে সুশোভিত করেছেন।
নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর দ্য নিউইয়র্ক টাইমস কবির একটি সাক্ষাৎকার নেয়। সেখানে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “অবশ্যই রাজনীতি জীবনের সঙ্গে যুক্ত, কিন্তু আমার কবিতার সব বিষয় রাজনৈতিক নয়, বরং আমার কবিতা খুব বেশি মানুষ এবং জীবনঘনিষ্ঠ।”
তাঁকে রোমান্টিক কবিতার নায়িকা বলা হয়ে থাকে।
তিনি ১৯২৩ সালের ২ জুলাই পোল্যান্ডের পোজনান শহরের কাছাকাছি কোরনিক-এ এ্যানা মারিয়া নি রোটেরমান্ড এবং ভিনসেন্ট সিম্বোরস্কী দম্পতির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিলো ১৯৪৯ সালে। কিন্তু সমাজতন্ত্রীদের শর্ত পূরণ করতে না পারায় গ্রন্থটি প্রকাশের অনুমতি মেলেনি। যুদ্ধ-উত্তর পোল্যান্ডে অন্যান্য আরো অনেক সমাজতন্ত্রীদের মতো দলের দাপ্তরিক আদর্শ মেনে নিয়ে সিম্বোরস্কা গণপ্রজাতন্ত্রী পোল্যান্ডকে স্বাগত জানান। এরই ধারাবাহিকতায় ৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯৫০ সালে রাজনৈতিক দলে যোগদানের জন্য আবেদনপত্র জমা দেন। এরপর ১৯৫২ সালে ‘দ্যাটস হোয়াই উই আর এলাইভ’ নামে সিম্বোরস্কার প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়। এই বছর বইটি ১১৪০ কপি বিক্রি হয়। বইটির এই বিশাল বিক্রির জন্য সিম্বোরস্কা পোলিশ রাইটার্স ইউনিয়নের (তখচ)-এর সদস্য হতে পেরেছিলেন খুব সহজে।
সিম্বোরস্কার কবিতা সর্ম্পকে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনের এর EDWARD HIRSCH বলেছেন, সিম্বোরস্কা তার কবিতায় সামগ্রিক চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আত্মবিশ্বাসের একটি মর্যাদাপূর্ণ বিদগ্ধ যুক্তি দৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করেছেন। সম্ভবত তার কবিতা পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারবে না। কিন্তু সিম্বোরস্কা কবিতা লেখার পরে এই পৃথিবীটা ঠিক আগের অবস্থায় থাকবে না। তিনি আমাদের শেখানোর চেষ্টা করেছেন, আমরা এই পৃথিবীর যে নাম দিয়েছি তাকে কীভাবে এবং কোন কৌশলে উপেক্ষা করা যায়।’
ভিসওয়াভা সিম্বোরস্কার কবিতা অস্তিত্ববাদ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। এই বিষয়টি তার কবিতার ধরণের মধ্যে অন্যতম যার শ্রেণীকরণ ধার করা যায় না। সিম্বোরস্কা কোনো একটি বিষয়কে প্রাণপণে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে মানুষের অস্তিত্বের গভীরতম স্থানে নিয়ে যায়। যাকে ঘিরে আছে এখনকার ক্ষণস্থায়ী সময় এবং প্রতিদিনের জীবন। তিনি বর্তমানের কোনো অভিজ্ঞতা ও উপকরণকে যন্ত্রের মতো বুনন করে রাখেন। চারিত্রিকভাবে তার কবিতাগুলো সরল। সিম্বোরস্কার ব্যক্তিগত ভাষা ঠিক সমসাময়িক ভাষার মতো না। সিম্বোরস্কার কবিতায় চেতনা এবং সহানুভূতিগুলো প্রকাশিত হয় সামান্য ঘুরপাক খেয়ে। যার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় আধ্যাত্মিকতার আকর্ষণীয় সমন্বয়।
সিম্বোরস্কার কবিতা সবসময় প্রতিনিধিত্ব করে দ্বন্দ্বমূলক এক বিস্ময়কর ঘটনার, যা তার কবিতার পাঠককে চমকিয়ে দেয়। এই বুদ্ধিদীপ্ত, চুপচাপ অন্তর্মুখী প্রবণতা তাঁর কবিতায় একটি বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দাঁড় করিয়েছে। কবিতায় সিম্বোরস্কার সরল প্রকাশভঙ্গি পণ্ডিতদের জ্ঞানকে উপেক্ষা করে কবিতাগুলোকে করে তুলেছে নিখুঁত ও প্রাণবন্ত যা সহজে পঠিত হচ্ছে সমসাময়িক পাঠকের কাছে। সমালোচকদের সমালোচনা এবং গণমাধ্যমের সহযোগিতা ছাড়াই সিম্বোরস্কার কবিতা পাঠকের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরই।
তাঁর কয়েকটি কবিতা
(অনুবাদক – অনন্ত উজ্জ্বল)
————————————–
কুয়াশা প্রহর
আসন্ন শীতে কুয়াশা হয়ে যাবো; শিরা উপশিরায়
নিশিথের চাঞ্চল্য মেখে-
খুঁজবো দূরতম নক্ষত্রের ইশারা !
ফাঁকে ফাঁকে তুষারের দীর্ঘশ্বাস অবাক কথা কয়ে যাবে
নির্লিপ্ত সময়ের কানে।
কান পেতে শোন;
নিজের সাথে একা একা হয়ে যাচ্ছে অনেক কথা
তারপরও বহুকথা জেগে আছে ঐ নির্জন মৃত্যুর আড়ালে!
বিষন্ন সময়
এতো আর কিছু নয়;
আমার শরীর মিসে আছে দেবতার নামে মানুষের কান্নায়
বিষন্ন সময়ের নগ্নতা
হাত তুলে বলে, কলহ করে কে?
ঈশ্বরের নামে বলছি, তারা অচেনা!
আমরা তাদের নাম পরিচয় জানি না।
দহনের কাল
নাবিক, ঠিক ঠিক জানো তো, কোন তিথিতে কলহ?
বাণিজ্য সূত্র, জলের মন্ত্র?
নাকি প্রচীন চিত্রের পথ ভুলে খুঁজে ফেরো
শ্যাওলা ঢাকা সেই দেয়াল- যেখানে পরশ পাথর ঝিলিক দিলে
রক্তের কণিকায় ভেসে উঠে দহনের কাল!
সম্পর্কগুলো অবাক হয়ে- তাকিয়ে দেখে,
নেশাতুর সময় কিভাবে বয়ে যায়
বেসামাল পূর্ণিমায়।
একসঙ্গে অসংখ্য দুঃখ
সোনা রুপা কাহিনি- বেশ তো হলো
তার ফাঁকে মহাজন-এক দঙ্গল
কলহ শেষে, রকমারি বেশে
ভাসিয়ে দিয়েছে অহমিকা মন।
ডাক হরকরা
জানে ভুল ঠিকানা
আকুলিবিকুলি বিরহ প্রহর
ভিড় করে, জমে উঠে থৈ থৈ জলে
তুমি কি সে কাহিনি লিখ, হরকরা বেশে?
আশ্চর্য সে জলে মুখ দেখে রুপাঞ্জলি- চাঁদের তিথি!
কোনো কিছুই দ্বিতীয়বার হয় না
কোনো কিছুই দ্বিতীয়বার হয় না এবং কখনো হবে না, যার ফলে আমরা অদক্ষ হয়ে আছি পৃথিবীতে এবং একঘেয়েমি ছাড়াই চলে যাব যদি সেই পৃথিবীর স্কুলে আমরা সব থেকে বেশি বোকা ছাত্র হই, শীত বা গরমকাল কখনও আমরা পুনরাবৃত্তি করব না।
কোনও একদিন গতকালের মতো হবে না, কোনও রাত্রি আগের রাত্রির মতো হয় না,
কোনও চুমো আগের মতোও হয় না,
চোখের দৃষ্টি দুইবার একই রকমও হয় না।
সম্ভাবনা
আমি বেশি পছন্দ করি অসামরিক পৃথিবী
আমি বেশি পছন্দ করি পরাজিত দেশ জয়ী দেশ থেকে আমি বেশি পছন্দ করি সন্দেহে থাকা। আমি বেশি পছন্দ করি বিশৃঙ্খলতার নরক বিনাশের নরক থেকে।
আমি বেশি পছন্দ করি সংবাদপত্রের প্রথম পাতা থেকে গ্রীম ভাইদের রূপকথা।
আমি বেশি পছন্দ করি ফুলহীন পাতা, পাতাহীন ফুল থেকে আমি বেশি পছন্দ করি লেজ না কাটা কুকুর।
আমি বেশি পছন্দ করি হালকা রঙের চোখ, যেহেতু আমার চোখ কালো।
———————————————-
[সংগৃহীত ও সম্পাদিত।
ঋণস্বীকার –
অনন্ত উজ্জ্বল – কবি ও অনুবাদক]