Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নীড় || Neer by Jasimuddin

নীড় || Neer by Jasimuddin

গড়াই নদীর তীরে,
কুটিরখানিরে লতা-পাতা-ফুল মায়ায় রয়েছে ঘিরে।
বাতাসে হেলিয়া, আলোতে খেলিয়া সন্ধ্যা সকালে ফুটি,
উঠানের কোণে বুনো ফুলগুলি হেসে হয় কুটি কুটি।
মাচানের পরে সীম-লতা আর লাউ কুমড়ার ঝাড়,
আড়া-আড়ি করি দোলায় দোলায় ফুল ফল যত যার।
তল দিয়ে তার লাল নটেশাক মেলিছে রঙের ঢেউ,
লাল শাড়ীখানি রোদ দিয়ে গেছে এ বাড়ির বধূ কেউ।
মাঝে মাঝে সেথা এঁদো ডোবা হতে ছোট ছোট ছানা লয়ে,
ডাহুক মেয়েরা বেড়াইতে আসে গানে গানে কথা কয়ে!
গাছের শাখায় বনের পাখিরা নির্ভয়ে গান ধরে,
এখনো তাহারা বোঝেনি হেথায় মানুষ বসত করে।

মটরের ডাল, মসুরের ডাল, কালিজিড়া আর ধনে,
লঙ্কা-মরিচ রোদে শুখাইছে উঠানেতে সযতনে।
লঙ্কার রঙ মসুরের রঙ, মটরের রঙ আর,
জিড়া ও ধনের রঙের পাশেতে আলপনা আঁকা কার।
যেন একখানি সুখের কাহিনী নানান আখরে ভরি,
এ বাড়ির যত আনন্দ হাসি আঁকা জীবন- করি।
সাঁঝ সকালের রঙিন মেঘেরা এখানে বেড়াতে এসে,
কিছুখন যেন থামিয়া রয়েছে এ বাড়িরে ভালবেসে।
সামনে তাহার ছোট ঘরখানি ময়ূর পাখির মত,
চালার দুখানা পাখনা মেলিয়া তারি ধ্যানে আছে রত।
কুটিরখানির একধারে বন, শ্যাম-ঘন ছায়াতলে,
মহা-রহস্য লুকাইয়া বুকে সাজিছে নানান ছলে।
বনের দেবতা মানুষের ভয়ে ছাড়ি ভূমি সমতল,
সেথায় মেলিছে অতি চুপি চুটি সৃষ্টির কৌশল;
লতা-পাতা ফুল ফলের ভাষায় পাখিদের বুনো সুরে।
তারি বুকখানি সারা বন বেড়ি ফিরিতেছে সদা ঘুরে।
ইহার পাশেতে ছোট গেহ-খনি, এ বনের বন-রাণী,
বনের খেলায় হয়রান হয়ে শিথিল বসনখানি;
ইহার ছায়ায় মেলিয়া ধরিয়া শুয়ে ঘুম যাবে বলে,
মনের মতন করিয়া ইহারে গড়িয়াছে নানা ছলে।

সে ঘরের মাঝে দুটি পা মেলিয়া বসিয়া একটি মেয়ে ,
পিছনে তাহার কালো চুলগুলি মাটিতে পড়েছে বেয়ে।
দুটি হাতে ধরি রঙিন শিকায় রচনা করিছে ফুল,
বাতাসে সরিয়া মুখে উড়িতেছে কভু দু একটি চুল।
কুপিত হইয়া চুলেরে সরাতে ছিড়িছে হাতের সূতো,
চোখ ঘুরাইয়া সুতোরে শাসায় করিয়া রাগের ছুতো।
তারপর শেষে আপনার মনে আপনি উঠিছে হাসি,
আরো সরু সরু ফুল ফুটিতেছে শিকার জালেতে আসি।
কালো মুখখানি, বন-লতা পাতা আদর করিয়া তায়,
তাহাদের গার যত রঙ যেন মেখেছে তাহার গায়।
বনের দুলালী ভাবিয়া ভাবিয়া বনের শ্যামল কায়া;
জানে না, কখন ছড়ায়েছে তার অঙ্গে বনের ছায়া।
আপনার মনে শিকা বুনাইছে, ঘরের দুখানা চাল,
দুখানা রঙিন ডানায় তাহারে করিয়াছে আবডাল।
আটনের গায়ে সুন্দীবেতের হইয়াছে কারুকাজ
বাজারের সাথে পরদা বাঁধন মেলে প্রজাপতি সাজ।
ফুস্যির সাথে রাঙতা জড়ায়ে গোখুরা বাঁধনে আঁটি,
উলু ছোন দিয়ে ছাইয়াছে ঘর বিছায়ে শীতল পাটি।
মাঝে মাঝে আছে তারকা বাঁধন, তারার মতন জ্বলে,
রুয়ার গোড়ায় খুব ধরে ধরে ফুলকাটা শতদলে।
তারি গায় গায় সিদুরের গুড়ো, হলুদের গুড়ো দিয়ে,
এমনি করিয়া রাঙায়েছে যেন ফুলেরা উঠেছে জিয়ে।
একপাশে আশে ফুলচাং ভাল বলা যায়নাক ত্বরা।
তার সাথে বাঁধা কেলী কদম্ব ফুল-ঝুরি শিকা আর,
আসমান-তারা শিকার রঙেতে সব রঙ মানে হার।
শিকায় ঝুলানো চিনের বাসন, নানান রঙের শিশি,
বাতাসের সাথে হেলিছে দুলিছে রঙে রঙে দিবানিশি।
তাহার নীচেতে মাদুর বিছায়ে মেয়েটি বসিয়া একা,
রঙিন শিকার বাঁধনে বাঁধনে রচিছে ফুলের লেখা।

মাথার উপরে আটনে ছাটনে বেতের নানান কাজ,
ফুলচাং আর শিকাগুলি ভরি দুলিতেছে নানা সাজ।
বনের শাখায় পাখিদের গান, উঠানে লতার ঝাড়
সবগুলো মিলে নির্জ্জনে যেন মহিমা রচিছে তার।
মেয়েটি কিন্তু জানে না এ সব, শিকায় তুলিছে ফুল,
অতি মিহি সুরে গান সে গাহিছে মাঝে মাঝে করি ভুল।
বিদেশী তাহার স্বামীর সহিত গভীর রাতের কালে,
পাশা খেলাইতে ভানুর নয়ন জড়াল ঘুমের জালে।

ঘুমের ঢুলুনী, ঘুমের ভুলুনী-সকালে ধরিয়া তায়,
পাল্কীর মাঝে বসাইয়া দিয়া পাঠাল স্বামীর গাঁয়।
ঘুমে ঢুলু আঁখি, পাল্কী দোলায় চৈতন হল তার,
চৈতন হয়ে দেখে সে ত আজ নহে কাছে বাপ-মার।
এত দরদের মা-ধন ভানুর কোথায় রহিল হায়,
মহিষ মানত করিত তাহার কাঁটা যে ফুটিলে পায়।
হাতের কাঁকনে আঁচড় লাগিলে যেত যে সোনারু বাড়ি,
এমন বাপেরে কোন দেশে ভানু আসিয়াছে আজ ছাড়ি।
কোথা সোহাগের ভাই-বউ তার মেহেদী মুছিলে হায়,
সাপন সীথার সিদুর লইত ঘষিতে ভানুর পায়।
কোথা আদরের মৈফল-ভাই ভানুর আঁচল ছাড়ি,
কি করে আজিকে দিবস কাটিছে একা খেলাঘরে তারি।

এমনি করিয়া বিনায়ে বিনায়ে মেয়েটি করিছে গান,
দূরে বন পথে বউ কথা কও পাখি ডেকে হয়রান।
সেই ডাক আরো নিকটে আসিল, পাশের ধঞ্চে-খেতে
তারপর এলো তেঁতুলতলায় কুটিরের কিনারেতে
মেয়েটি খানিক শিকা তোলা রাখি অধরেতে হাসি আঁকি,
পাখিটিরে সে যে রাগাইয়া দিল বউ কথা কও ডাকি।
তারপর শেষে আগের মতই শিকায় বসাল মন,
ঘরের বেড়ার অতি কাছাকাছি পাখি ডাকে ঘন ঘন।
এবার সে হল আরও মনোযোগী, শিকা তোলা ছাড়া আর,
তার কাছে আজ লোপ পেয়ে গেছে সব কিছু দুনিয়ার।
দোরের নিকট ডাকিল এবার বউ কথা কও পাখি,
বউ কথা কও, বউ কথা কও, বারেক ফিরাও আঁখি।
বউ মিটি মিটি হাসে আর তার শিকায় যে ফুল তোলে,
মুখপোড়া পাখি এবার তাহার কানে কানে কথা বলে।
যাও ছাড়-লাগে, এবার বুঝিনু বউ তবে কথা কয়,
আমি ভেবেছিনু সব বউ বুঝি পাখির মতন হয়।
হয়ত এমনি পাখির মতন এ ডাল ও ডাল করি,
বই কথা কও ডাকিয়া ডাকিয়া জনম যাইবে হরি,
হতভাগা পাখি! সাধিয়া সাধিয়া কাঁদিয়া পাবে না কূল,
মুখপোড়া বউ সারাদিন বসি শিকায় তুলিবে ফুল।
ইস্যিরে মোর কথার নাগর! বলি ও কি করা হয়,
এখনি আবার কুঠার নিলে যে, বসিতে মন না লয়?
তুমি এইবার ভাত বাড় মোর, একটু খানিক পরে,
চেলা কাঠগুলো ফাঁড়িয়া এখনি আসিতেছি ঝট করে।

কখনো হবে না, আগে তুমি বস, বউটি তখন উঠি,
ডালায় করিয়া হুড়ুমের মোয়া লইয়া আসিল ছুটি।
একপাশে দিল তিলের পাটালী নারিকেল লাড়ু আর
ফুল লতা আঁকা ক্ষীরের তক্তি দিল তারে খাইবার।
কাঁসার গেলাসে ভরে দিল জল, মাজা ঘষা ফুরফুরে
ঘরের যা কিছু মুখ দেখে বুঝি তার মাঝে ছায়া পূরে।
হাতেতে লইয়া ময়ূরের পাখা বউটি বসিল পাশে,
বলিল, এসব সাজায়ে রাখিনু কোন দেবতার আশে?
তুমিও এসো না! হিন্দুর মেয়ে মুসলমানের সনে
খাইতে বসিয়া জাত খোয়াইব তাই ভাবিয়াছ মনে?
নিজেরই জাতিটা খোয়াই তাহলেবড় গম্ভীর হয়ে,
টপটপ করে যা ছিল সোজন পুরিল অধরালয়ে।

বউ ততখনে কলিকার পরে ঘন ঘন ফুঁক পাড়ি,
ফুলকি আগুন ছড়াইতেছিল দুটি ঠোট গোলকরি।
দুএক টুকরো ওড়া ছাই এসে লাগছিল চোখে মুখে,
ঘটছিল সেথা রূপান্তর যে বুঝি না দুখে কি সুখে।
ফুঁক দিতে দিতে দুটি গাল তার উঠছিল ফুলে ফুলে,
ছেলেটি সেদিকে চেয়ে চেয়ে তার হাত ধোয়া গেল ভুলে।
মেয়ে এবার টের পেয়ে গেছে, কলকে মাটিতে রাখি,
ফিরিয়া বসিল ছেলেটির পানে ঘুরায়ে দুইটি আঁখি।

তারপর শেষে শিকা হাতে লয়ে বুনাতে বসিল ত্বরা,
মেলি বাম পাশে দুটি পাও তাতে মেহেদীর রঙ ভরা।
নীলাম্বরীর নীল সায়রেতে রক্ত কমল দুটি,
প্রথমভোরের বাতাস পাইয়া এখনি উঠিছে ফুটি।
ছেলেটি সেদিক অনিমেষ চেয়ে, মেয়েটি পাইয়া টের,
শাড়ীর আঁচলে চরণ দুইটি ঢাকিয়া লইল ফের।

ছেলেটি এবার ব্যস্ত হইয়া কুঠার লইল করে,
এখনি সে যেন ছুটিয়া যাইবে চেলা ফাড়িবার তরে।
বউটি তখন পার আবরণ একটু লইল খুলি,
কি যেন খুঁজিতে ছেলেটি আসিয়া বসিল আবার ভুলি।
এবার বউটি ঢাকিল দুপাও শাড়ীর আঁচল দিয়ে,
ছেলেটি সজোরে কলকে রাখিয়া টানিল হুকোটি নিয়ে।
খালি দিনরাত শিকা ভাঙাইবে? হুকোয় ভরেছ জল?
কটার মতন গন্ধ ইহার একেবারে অবিকল।
এক্ষুণি জল ভরিণু হুকায়। দেখ! রাগায়ো না মোরে,
নৈচা আজিকে শিক পুড়াইয়া দিয়েছিলে সাফ করে?
কটর কটর শব্দ না যেন মুন্ড হতেছে মোর,
রান্নাঘরেতে কেন এ দুপুরে দিয়ে দাও নাই দোর?
এখনি খুলিলে? কথায় কথায় কথা কর কাটাকাটি,
রাগি যদি তবে টের পেয়ে যাবে বলিয়া দিলাম খাঁটি!

মিছেমিছি যদি রাগিতেই সখ, বেশ রাগ কর তবে,
আমার কি তাতে, তোমারি চক্ষু রক্ত বরণ হবে।
রাগিবই তবে? আচ্ছা দাঁড়াও মজাটা দেখিয়া লও,
যখন তখন ইচ্ছা মাফিক যা খুশী আমারে কও!
এইবার দেখ! না! না! তবে আর রাগিয়া কি মোর হবে,
আমি ত তোমার কেউ কেটা নই খবর টবার লবে?

বউটি বসিয়াশিকা ভাঙাইতেছে, আর হাসিতেছে খালি,
প্রতিদিন সে ত বহুবার শোনে এমনি মিষ্ট গালি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress