Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নীল-লোহিত || Pramatha Chaudhuri

নীল-লোহিত || Pramatha Chaudhuri

আমাকে যখন কেউ গল্প লিখতে অনুরোধ করে তখন আমি মনে মনে এই বলে দুঃখ করি যে, ভগবান কেন আমাকে নীল-লোহিতের প্রতিভা দেন নি। সে প্রতিভা যদি আমার শরীরে থাকত তা হলে আমি বাঙলার সকল মাসিক পত্রের সকল সম্পাদক মহাশয়দের অনুরোধ একসঙ্গে অক্লেশে রক্ষা করতে পারতুম।

গল্প বলতে নীল-লোহিতের তুল্য গুণী আমি অদ্যাবধি আর দ্বিতীয় ব্যক্তি দেখি নি।

অনেক সময়ে মনে ভাবি যে, তাঁর মুখে যে-সব গল্প শুনেছি, তারই গুটিকয়েক লিখে গল্প লেখার দায় হতে খালাস হই। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সে-সব গল্প লেখবার জন্যও লেখকের নীল-লোহিতের অনুরূপ গুণিপণা থাকা চাই। তাঁর বলবার ভঙ্গিটি বাদ দিয়ে তাঁর গল্প লিপিবদ্ধ করলে সে গল্পের আত্মা থাকবে বটে, কিন্তু তার দেহ থাকবে না। তিনি যে গল্প বলতেন, তাই আমাদের চোখের সুমুখে শরীরী হয়ে উঠত এবং সাঙ্গোপাঙ্গমূর্তি ধারণ করত। এমন খুঁটিয়ে বর্ণনা করবার শক্তি আর কারো আছে কি না জানি নে। কিন্তু আমার যে নেই, তা নিঃসন্দেহ। এ বর্ণনার ওস্তাদি ছিল এই যে, তার ভিতর অসংখ্য ছোটখাটো জিনিস ঢুকে পড়ত। অথচ তার একটিও অপ্রাসঙ্গিক নয়, অসংগত নয়, অনাবশ্যক নয়। সুনিপুণ চিত্রকরের তুলির প্রতি আঁচড় যেমন চিত্রকে রেখার পর রেখায় ফুটিয়ে তোলে, নীল-লোহিতও কথার পর কথায় তাঁর গল্প তেমনি ফুটিয়ে তুলতেন। তাঁর মুখের প্রতি কথাটি ছিল ঐ চিত্র-শিল্পীর হাতেরই তুলির আঁচড়।

তার পর, কথা তিনি শুধু মুখে বলতেন না। গল্প তাঁর হাত পা বুক গলা সব একত্র হয়ে একসঙ্গে বলত। এক কথায় তিনি শুধু গল্প বলতেন না, সেই গল্পের অভিনয়ও করতেন। যে তাঁকে গল্প বলতে না শুনেছে, তাকে তাঁর অভিনয়ের ভিতর যে কি অপূর্ব প্রাণ ছিল, তেজ ছিল, রস ছিল, তা কথায় বোঝানো অসম্ভব। তিনি যখন কোনো ধ্বনির বর্ণনা করতেন, তখন তাঁর কানের দিকে দৃষ্টিপাত করলে মনে হত যে, তিনি যেন সে শব্দ সত্য সত্যই স্বকর্ণে শুনতে পাচ্ছেন। তাজি ঘোড়াকে ছারতকে ছাড়লে সে চলতে চলতে যখন গরম হয়ে ওঠে, আর তার নাকের ডগা যেমন ফুলে ওঠে ও সেই সঙ্গে একটু একটু কাঁপতে থাকে, নীল-লোহিত গল্প বলতে বলতে গরম হয়ে উঠলে তাঁর নাকের ডগাও তেমনি বিস্ফারিত ও বেপথুমান হত। আর তাঁর চোখ?— এমন অপূর্ব মুখর চোখ আমি আর কোনো লোকের কপালে আর কখনো দেখি নি। গল্প বলবার সময় তাঁর দৃষ্টি আকাশে নিবদ্ধ থাকত, যেন সেখানে একটি ছবি ঝোলানো আছে, আর নীল-লোহিত সেই ছবি দেখে দেখে তার বর্ণনা করে যাচ্ছেন। সে চোখের তারা ক্রমান্বয়ে ডান থেকে বাঁয়ে আর বাঁ থেকে ডাইনে যাতায়াত করত; যাতে করে ঐ আকাশপটের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত তার সমগ্র রূপটা এক মুহূর্তের জন্যও তাঁর চোখের আড়াল না হয় এই উদ্দেশ্যে। তারপর তাঁর মনে যখন তীব্র কোমল প্রসন্ন বিষণ্ন সতেজ নিস্তেজ ভাব উদয় হত, তাঁর চক্ষুদ্বয়ও সেই ভাবের অনুরূপ কখনো বিস্ফারিত, কখনো সংকুচিত, কখনো ত্রস্ত, কখনো প্রকৃতিস্থ, কখনো উদ্দীপ্ত, কখনো স্তিমিত হয়ে পড়ত। আর কথা তাঁর মুখ দিয়ে এমনি অনর্গল বেরোত যে, আমাদের মনে হত যে, নীল-লোহিত মানুষ নয় একটা জ্যান্ত গ্রামোফোন। আর তাতে ভগবান নিজ হাতে দম দিয়ে দিয়েছেন।

বন্ধুবান্ধবরা সবাই বলতেন যে, নীল-লোহিতের তুল্য মিথ্যাবাদী পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় নেই। যদিচ আমার ধারণা ছিল অন্যরূপ, তবুও এ অপবাদের আমি কখনো মুখ খুলে প্রতিবাদ করতে পারি নি। কেননা, এ কথা কারো অস্বীকার করবার জো ছিল না যে, বন্ধুবর ভুলেও কখনো সত্য কথা বলতেন না। কথা সত্য না হলেই তো তা মিথ্যা হতে হবে, এই হচ্ছে সাধারণত মানুষের ধারণা; আর এ ধারণা যে ভুল, তা প্রমাণ করতে হলে মনোবিজ্ঞানের তর্ক তুলতে হয়, আর সে তর্ক আমার বন্ধুরা শুনতে একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না।

লোকে নীল-লোহিতকে কেন মিথ্যাবাদী বলত জানেন? তাঁর প্রতি গল্পের hero ছিলেন স্বয়ং নীল-লোহিত, আর নীল-লোহিতের জীবনে যত অসংখ্য অপূর্ব ঘটনা ঘটেছিল, তার একটিও লাখের মধ্যে একের জীবনেও একবারও ঘটে না।

তাঁর গল্পারম্ভের ইতিহাস এই। যদি কেউ বলত যে, সে বাঘ মেরেছে, তা হলে নীল-লোহিত তৎক্ষণাৎ বলতেন যে তিনি সিংহ মেরেছেন এবং সেই সিংহ শিকারের আনুপূর্বিক বর্ণনা করতেন। একদিন কথা হচ্ছিল যে, হাতি ধরা বড়ো শক্ত কাজ। নীল- লোহিত অমনি বললেন যে তিনি একবার মহারাজ কিরাতনাথের সঙ্গে গারো পাহাড়ে খেদা করতে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়েই ‘দায়দার’দের সঙ্গে তিনিও একটি পোষমানা ‘কুনকি’র পিঠে চড়ে বসলেন। তাঁর দুঃসাহস দেখে মহারাজ কিরাতনাথ হতভম্ব হয়ে গেলেন, কেননা, ‘দায়দার’রা জীবনের ছাড়পত্র লিখে, তবে বুনোহাতি ভোলানো ঐ মাদী হাতির পিঠে আসোয়ার হয়। তারপর ঐ কুনকি জঙ্গলে ঢুকতেই সেখান থেকে বেরিয়ে এল এক প্রকাণ্ড দাঁতলা— মেঘের মতো তার রঙ, আর পাহাড়ের মতো তার ধড়, আর তার দাঁত দুটো এত বড়ো যে তার উপর একখানা খাটিয়া বিছিয়ে মানুষ অনায়াসে শুয়ে থাকতে পারে। ঐ দাঁতলাটা একেবারে মত্ত হয়েছিল, তাই সে জঙ্গলের ভিতর প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড শালগাছগুলো শুঁড় দিয়ে জড়িয়ে ধরে উপড়ে ফেলে নিজের চলবার পথ আবিষ্কার করে আসছিল। তার পর কুনকিটিকে দেখে সে প্রথমে মেঘগর্জন করে উঠল। তার পর সেই হস্তিরমণীর কানে কানে ফুসফুস করে কত কি বলতে লাগল। তারপর হস্তিযুগলের ভিতর শুরু হল, ‘অঙ্গ হেলাহেলি গদগদ ভাষ’। ইতিমধ্যে ‘দায়দার’রা কুনকির পিঠ থেকে গড়িয়ে পড়ে তার পিছনের পা ধরে ঝুলছিল, আর নীল লোহিত তার লেজ ধরে। এ অবস্থায় ‘দায়দার’দের অবশ্যকর্তব্য ছিল যে, মাটিতে নেমে চটপট শোণের দড়ি দিয়ে ঐ দাঁতলাটার পাগুলো বেঁধেছেঁদে দেওয়া। কিন্তু তারা বললে, ‘এ হাতি পাগলা হাতি, ওর গায়ে হাত দেওয়া আমাদের সাধ্য নয়— যদি রশি দিয়ে পা বেঁধেও ফেলি, তারপর যখন ওর পিঠে বসব, তখন সে দড়ি ছিঁড়ে জঙ্গলের ভিতর এমনি ছুটবে যে, গাছের ধাক্কা লেগে আমাদের মাথা চুর হয়ে যাবে।’ এ কথা শুনে নীল-লোহিত ‘দায়দার’দের dammed coward বলে, এক ঝুলে কুনকির লেজ ছেড়ে দাঁতলার লেজ ধরে সেই লেজ বেয়ে উঠে তার কাঁধে গিয়ে চড়ে বসলেন। মানুষের গায়ে মাছি বসলে তার যেমন অসোয়াস্তি হয়, দাঁতলাটারও তাই হল, আর সে তখনি তার শুঁড় ওঁচালে ঐ নবরূপী মাছিটাকে টিপে মেরে ফেলবার জন্য। এ বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার জন্য নীল-লোহিত কি করেছিলেন, জানেন? তিনি তিলমাত্র দ্বিধা না করে উপুড় হয়ে পড়ে দাঁতলাটার কানে মুখ দিয়ে নিধুবাবুর একটা ভৈরবীর টপ্পা গাইতে শুরু করলেন, আর সেই মদমত্ত হস্তী অমনি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে চক্ষু নিমীলিত করে গান শুনতে লাগল। ঐ প্রণয় সংগীত শুনে হাতি বেচারা এমনি তন্ময়, এমনি বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিল যে ইত্যবসরে ‘দায়দার’রা যে তার চারটি পা মোটা মোটা শোণের দড়ি দিয়ে আটেঘাটে বেঁধে ফেলেছে, তা সে টেরও পেলে না। ফলে দাঁতলার নড়বার চড়বার শক্তি আর রইল না। সে হাতি এখন মহারাজ কিরাতনাথের হাতিশালায় বাঁধা আছে।

মহারাজ কিরাতনাথ কে?— এ প্রশ্ন করলে নীল-লোহিত ভারি চটে যেতেন। তিনি বলতেন, ওরকম করে বাধা দিলে তিনি গল্প বলতে পারবেন না। আর যেহেতু তাঁর গল্প আমরা সবাই শুনতে চাইতুম, সেইজন্য পাছে তিনি গল্প বলা বন্ধ করে দেন, এই ভয়ে ঐ-সব বাজে প্রশ্ন করা আমরা বন্ধ করে দিলুম। কারণ, সকলে ধরে নিলে যে নীল লোহিতের গল্প সর্বৈব মিছে; ও গল্প শোনবার জিনিস, কিন্তু বিশ্বাস করবার জিনিস নয়। কেননা, এ কথা বিশ্বাস করা শক্ত যে, নীল-লোহিত সতেরো বার ঘোড়া থেকে পড়েছিলেন, আর তার একবার দার্জিলিঙে ঘোড়াসুদ্ধ দু হাজার ফুট নীচে খাদে, অথচ তাঁর গায়ে কখনো একটি আঁচড়ও যায় নি, যদিচ পড়বার সময় তিনি সঘোটক শূন্যে দুবার ডিগবাজি খেয়েছিলেন। নীল-লোহিত তিনবার জলে ডুবেছিলেন। যেখানে তিস্তা এসে ব্রহ্মপুত্রে মিশেছে, সেখানে একবার চড়ায় লেগে জাহাজের তলা ফেসে যায়, সকলে ডুবে মারা যায়, একমাত্র নীল-লোহিত পাঁচ মাইল জল সাঁতরে শেষটা রোউমারিতে গিয়ে উঠেছিলেন। আর এক বার মেঘনায় জাহাজ ঝড়ে সোজা ডুবে যায়। সেবারও তিনি তিন দিন তিন রাত ঐ জাহাজের মাস্তুলের ডগায় পদ্মাসনে বসে ধ্যানস্থ ছিলেন; অন্য জাহাজ এসে তাঁকে তুলে নিলে। আর শেষবার মাতলার মোহনায় জাহাজ উল্টে যায়, তিনি ঐ জাহাজের নীচেই চাপা পড়েছিলেন, কিন্তু ডুব-সাঁতার কাটতে তিনি ঐ জাহাজের হাল ধরে ফেললেন, আর ঐ হাল বেয়ে তিনি ঐ জাহাজের উল্টো পিঠে গিয়ে চড়ে বসলেন। ঐ উল্টানো জাহাজ ভাসতে ভাসতে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। তারপর একখানা জার্মান মানোয়ারী জাহাজ তাঁকে তুলে নেয়, আর সেই জাহাজেই কাইজারের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। কাইজার নাকি বলেছিলেন যে, নীল-লোহিত যদি তার সঙ্গে জার্মানীতে যান তা হলে তিনি তাঁকে সাবমেরিনের সর্বপ্রধান কাপ্তেন করে দেবেন। যে মাইনে কাইজার তাঁকে দিতে চেয়েছিলেন, তাতে তাঁর পোষায় না বলে তিনি সে প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেন। এসব নীল-লোহিতের কথাবস্তুর নমুনাস্বরূপ উল্লেখ করলুম, কিন্তু তাঁর কথারসের বিন্দুমাত্র পরিচয় দিতে পারলুম না। তুফানের বর্ণনা, সমুদ্রের বর্ণনা তাঁর মুখে না শুনলে— গুণীর হাতে পড়লে জলের ভিতর থেকে যে কি আশ্চর্য রৌদ্ররস বেরোয় তা কেউ আন্দাজ করতে পারবেন না।

নীল-লোহিতকে দিয়ে গল্প লেখাবার চেষ্টা করেছিলুম, কেননা গল্প তিনি আর ‘বলেন না। তিনি আমার অনুরোধে একটি গল্প লিখেওছিলেন। কিন্তু সেটি পড়ে দেখলুম তা একেবারে অচল। সে গল্প প্রথম থেকে শেষ লাইন তক পড়ে দেখি যে, তার ভিতর আছে শুধু সত্য, একেবারে আঁকষা সত্য, কিন্তু গল্প মোটেই নেই। সুতরাং বুঝলুম যে তাঁর দ্বারা আমাদের সাহিত্যে কোনোরূপ শ্রীবৃদ্ধি হবার সম্ভাবনা নেই। তিনি কেন যে গল্প বলা ছেড়ে দিলেন তার ইতিহাস এখন শুনুন।

বাঙলায় যখন স্বদেশী ডাকাতি হতে শুরু হল তখন পাঁচজন একত্র হলেই ঐ ডাকাতির বিষয় আলোচনা হত। খবরের কাগজে ঐরকম একটা ডাকাতির রিপোর্ট পড়ে অনেকের কল্পনা অনেক রকমে খেলত। কথায় কথায় সে রিপোর্ট ফেঁপে উঠত, ফুলে উঠত। কেউ বলতেন, ছেলেরা একটানা বিশ ক্রোশ দৌড়ে পালিয়েছে, কেউ বলত, তারা তেতলার ছাদ থেকে লাফ মেরে পড়ে পিটটান দিয়েছে। একদিন আমাদের আড্ডায় এইসব আলোচনা হচ্ছে, এমন সময় নীল-লোহিত বললেন যে, “আমি একবার এক ডাকাতি করি, তার বৃত্তান্ত শুনুন।” তাঁর সে বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত লিখতে গেলে একখানি প্রকাণ্ড উপন্যাস হয়, সুতরাং ডাকাতি করে তাঁর পালানোর ইতিহাসটি সংক্ষেপে বলছি।

নীল-লোহিত উত্তরবঙ্গে এক সা-মহাজনের বাড়ি ডাকাতি করতে যান। রাত দশটায় তিনি সে বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। এক ঘণ্টার ভিতর সেখানে গ্রামের প্রায় হাজার চাষা এসে বাড়ি ঘেরাও করলে ডাকাত ধরবার জন্য। নীল-লোহিত যখন দেখলেন যে, পালাবার আর উপায় নেই, তখন তিনি চট করে তাঁর পল্টনি সাজ খুলে ফেলে একটি বিধবার পরনের একখানি সাদা শাড়ি টেনে নিয়ে সেইখানি মালকোঁচা মেরে পরে, পা টিপে টিপে খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। লোকে তাঁকে বাড়ির চাকর ভেবে আর বাধা দিলে না। একটু পরেই লোকে টের পেলে যে, ডাকাতের সর্দার পালিয়েছে, অমনি দেদার লোক তাঁর পিছনে ছুটতে লাগল। মাইল-দশেক দৌড়ে যাবার পর তিনি দেখলেন যে রাস্তার দুপাশের গ্রামের লোকরাও তাঁকে তাড়া করেছে। শেষটায় তিনি ধরা পড়েন—পড়েন— এমন সময় তাঁর নজর পড়ল যে একটা বর্মা-টাট্টু একটা ছোলার ক্ষেতে চরছে, তার পিছনের পা দুটো দড়ি দিয়ে ছাঁদা। নীল-লোহিত প্রাণপণে ছুটে গিয়ে তার পায়ের দড়ি খুলে, তার মুখের ভিতর সেই দড়ি পুরে দিয়ে, তাতে এক পেঁচ লাগিয়ে সেটিকে লাগাম বানালেন। তার পর সেই ঘোড়ায় চড়ে— দে ছুট! রাত বারোটা থেকে রাত দুটো পর্যন্ত সে টাট্টু বিচিত্র চালে চলতে লাগল, কখনো কদমে, কখনো দুলকিতে, কখনো চার-পা তুলে লাফিয়ে। জীবনে এই একটিবার তিনি ঘোড়া থেকে পড়েননি। তারপর সে হঠাৎ থেমে গেল। নীল-লোহিত দেখলেন, সুমুখে একটা প্রকাণ্ড বিল— অন্তত এক মাইল চওড়া। অমনি ঘোড়া থেকে নেমে নীল-লোহিত সেই বিলের ভিতর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। পাছে কেউ দেখতে পায়, এই ভয়ে প্রথম মাইল তিনি ডুব-সাঁতার কেটে পার হলেন, দ্বিতীয় মাইল এমনি সাঁতার, আর তৃতীয় মাইল চিৎ সাঁতার দিয়ে— এইজন্য যে, পাড় থেকে কেউ দেখলে ভাববে যে একটা মড়া ভেসে যাচ্ছে। নীল-লোহিত যখন ও পারে গিয়ে পৌঁছলেন তখন ভোর হয় হয়। ক্লান্তিতে তখন তাঁর পা আর চলছে না। সুতরাং বিলের ধারে একটি ছোটো খোড়ো ঘর দেখবামাত্র তিনি ‘যা থাকে কুল-কপালে’ বলে সেই ঘরের দুয়ারে গিয়ে ধাক্কা মারলেন। তৎক্ষণাৎ দুয়ার খুলে গেল, আর ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একটি পরমাসুন্দরী যুবতী। তার পরনে সাদা শাড়ি, গলায় কণ্ঠী, আর নাকে রসকলি। নীল-লোহিত বুঝতে পারলেন যে, স্ত্রীলোকটি হচ্ছে একটি বোষ্টমী, আর সে থাকে একা। নীল-লোহিত সেই রমণীকে তাঁর বিপদের কথা জানালেন। শুনে তার চোখে জল এল, আর সে তিলমাত্র দ্বিধা না করে নীল-লোহিতের ভালোবাসায় পড়ে গেল। আর সেই সুন্দরীর পরামর্শে নীল- লোহিত পরনের ধুতি শাড়ি করে পরলেন। আর সেই যুবতী নিজ হাতে তাঁর গলায় কন্ঠী পরালে, আর তার নাকে রসকলি-ভঞ্জন করে দিলে। গুল্ফ-শ্মশ্রুহীন নীল- লোহিতের মুখাকৃতি ছিল একেবারে মেয়ের মতো। সুতরাং তাঁর এ ছদ্মবেশ আর কেউ ধরতে পারলে না। তার পরে তারা দু-সখীতে দুটি খঞ্জনি নিয়ে ‘জয় রাধে’ বলে বেরিয়ে পড়ল; তার পর পায়ে হেঁটে ভিক্ষে করতে করতে বৃন্দাবন গিয়ে উপস্থিত হল। তার পর কিছুদিন মেয়ে সেজে বৃন্দাবনে গা-ঢাকা দিয়ে থাকবার পর, পুলিসের গোলমাল যখন থেমে গেল, তখন তিনি আবার দেশে ফিরে এলেন। আর তাঁর সেই পথে-বিবর্জিতা বোষ্টমী মনের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে বাঘনাপাড়ায় চল গেল— কোনো দাঁড়িওয়ালা বোষ্টমের সঙ্গে কন্ঠীবদল করতে।

নীল-লোহিতের এই রোমান্টিক ডাকাতির গল্প মুখে মুখে এত প্রচার হয়ে পড়ল যে, শেষটায় পুলিসের কানে গিয়ে পৌঁছল। ফলে নীল-লোহিত ডাকাতির চার্জে গ্রেফতার হলেন। এ আসামীকে নিয়ে পুলিস পড়ল মহা ফাঁপরে, কারণ নীল-লোহিতের মুখের কথা ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে ডাকাতির আর কোনোই প্রমাণ ছিল না। পুলিস তদন্ত করে দেখলে যে, যে গ্রামে নীল-লোহিত ডাকাতি করেছেন, উত্তরবঙ্গে সে নামে কোনো গ্রামই নেই। যে সা-মহাজনের বাড়িতে তিনি ডাকাতি করেছেন, উত্তরবঙ্গে সে নামের কোনো সা-মহাজন নেই। যে দিনে তিনি ডাকাতি করেছেন— সেদিন বাঙলা দেশে কোথাও কোন ডাকাতি হয় নি। তারপর এও প্রমাণ হল যে, নীল-লোহিত জীবনে কখনো কলকাতা শহরের বাইরে যান নি, এমন কি, হাওড়াতেও নয়। বিধবার একমাত্র সন্তান বলে নীল-লোহিতের মা নীল লোহিতকে গঙ্গা পার হতে দেন নি— পাছে ছেলে ডুবে মরে, এই ভয়ে। অপরপক্ষে নীল-লোহিতের বিপক্ষে অনেক সন্দেহের কারণ ছিল। প্রথমত, তার নাম। যার নাম এমন বেয়াড়া, তার চরিত্রও নিশ্চয় বেয়াড়া। তারপর লোহিত রক্তের রঙ— অতএব ও নামের লোকের খুন-জখমের প্রতি টান থাকা সম্ভব; দ্বিতীয়ত, তিনি একে কুলীন ব্রাহ্মণের সন্তান, তার উপর তাঁর ঘরে খাবার আছে, অথচ তিনি বিয়ে করেন নি, যদিচ তাঁর বয়স তেইশ হবে; তৃতীয়ত, তিনি বি.এ. পাস করেছেন, অথচ কোনো কাজ করেন না; চতুর্থত, তিনি রাত একটা-দুটোর আগে কখনো বাড়ি ফেরেন না— যদিচ তাঁর চরিত্রে কোনো দোষ নেই। মদ তো দূরে থাক, পুলিস-তদন্তে জানা গেল যে, তিনি পান-তামাক পর্যন্ত স্পর্শ করেন না; আর নিজের মা-মাসি ছাড়া তিনি জীবনে আর কোনো স্ত্রীলোকের ছায়া মাড়ান নি।

এ অবস্থায় তিনি নিশ্চয় interned হতেন, যদি না আমরা পাঁচজনে গিয়ে বড়োসাহেবদের বলে-কয়ে তাঁকে ছাড়িয়ে আনতুম। আমরা সকলে যখন একবাক্যে সাক্ষী দিলুম যে, নীল-লোহিতের তুল্য মিথ্যাবাদী পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় নেই, আর সেইসঙ্গে তাঁর গল্পের দু-একটি নমুনা তাঁদের শোনালুম, তখন তাঁরা নীল-লোহিতকে অব্যাহতি দিলেন এই বলে যে— “যাও, আর মিথ্যে কথা বোলো না।” যদিচ কাইজারের সঙ্গে নীল-লোহিতের বন্ধুত্বের গল্প শুনে তাঁদের মনে একটু খটকা লেগেছিল। এরপর থেকে নীল-লোহিত আর মিথ্যা গল্প করেন না, ফলে গল্পও করেন না। কেননা তাঁর জীবনে এমন কোনো সত্য ঘটনা ঘটে নি, ঐ এক গ্রেপ্তার হওয়া ছাড়া— যার বিষয় কিছু বলবার আছে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রতিভা একেবারে অন্তর্হিত হয়েছে।

আসল কথা কি জানেন? তিনি মিথ্যে কথা বলতেন না, কেননা ও-সব কথা বলায় তাঁর কোনোরূপ স্বার্থ ছিল না। ধন-মান-পদমর্যাদা সম্বন্ধে তিনি সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন। তিনি বাস করতেন কল্পনার জগতে। তাই নীল-লোহিত যা বলতেন, সে সবই হচ্ছে কল্পলোকের সত্য কথা। তাঁর সুখ, তাঁর আনন্দ, সবই ছিল ঐ কল্পনার রাজ্যে অবাধে বিচরণ করায়। সুতরাং সেই কল্পলোক থেকে টেনে তাঁকে যখন মাটির পৃথিবীতে নামানো হল তখন যে তাঁর প্রতিভা নষ্ট হল শুধু তাই নয়, তাঁর জীবনও মাটি হল। —দিনের পর দিন তার অবনতি হতে লাগল।

গল্প বলা বন্ধ করবার পর তিনি প্রথমে বিবাহ করলেন, তার পর চাকরি নিলেন। তারপর তাঁর বছর বছর ছেলেমেয়ে হতে লাগল। তারপর তিনি বেজায় মোটা হয়ে পড়লেন, তাঁর সেই মুখর চোখ মাংসের মধ্যে ডুবে গেল। এখন তিনি পুরোপুরি কেরানীর জীবন যাপন করছেন— যেমন হাজার হাজার লোক করে থাকে। লোকে বলে যে, তিনি সত্যবাদী হয়েছেন; কিন্তু আমার মতে তিনি মিথ্যার পঙ্কে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়েছেন। তাঁর স্বধর্ম হারিয়ে, যে জীবন তাঁর আত্মজীবন নয়, অতএব তাঁর পক্ষে সম্পূর্ণ মিথ্যা জীবন— সেই জীবনে তিনি আবদ্ধ হয়ে পড়েছেন। তার আত্মীয়স্বজনেরা এই ভেবে খুশি যে, তিনি এতদিনে মানুষ হয়েছেন— কিন্তু ঘটনা কি হয়েছে জানেন? নীল-লোহিতের ভিতর যে মানুষ ছিল, তার মৃত্যু হয়েছে— যা টিকে রয়েছে তা হচ্ছে সংসারের সার ঘানি ঘোরাবার একটা রক্তমাংসের যন্ত্র মাত্র।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *