প্রথম থেকেই মিটিং
১১.
প্রথম থেকেই মিটিং-এ বেড়াল কুকুরের ডাক আর টেবিল চাপড়ানি চলছিল। কর্মী বৈঠকে এরকম মাঝে মাঝে হয়ও। কিন্তু আজকের মিটিংয়ের টেম্পাে প্রথম থেকেই অ্যায়সা চড়েছিল যে, কারও কোনও কথা কেউ শুনতে পাচ্ছিল না। দলের রাজ্য কমিটির সেক্রেটারি, প্রেসিডেন্ট, ট্রেজারার থেকে শুরু করে জনা দশ-বারো নেতা পার্টি অফিসের বড় ঘরের মেঝেয় দেয়ালে ঠেস দিয়ে শতরঞ্চিতে অসহায়ভাবে বসা। তার মধ্যে মদনদাও। সবাই কথা বলার চেষ্টা করে হেদিয়ে পড়েছে। সেক্রেটারি বার তিন চার চেষ্টা করেছিলেন, একবার একটা গোল করে পাকানো সিগারেটের প্যাকেট এসে তার কপালে লাগল, সেই সঙ্গে চিকার, বসে পড়ো চাদু। সেক্রেটারি সেই যে বসে পড়েছেন আর ওঠেননি। ট্রেজারার একবার বাথরুমে যেতে চেয়েছিলেন, তিন-চারটে ষণ্ডা ছোকরা কাঁধ চেপে বসিয়ে দিল ওসব হবে না। গুরুপবাজির হিল্লে করে নাও আগে, তারপর হিসি টিসি।
জয় খুব ভিতরে সেঁধোতে পারেনি, দরজা দিয়ে ঢুকে প্রচণ্ড ভিড়ে দেয়ালে সেঁটে গেছে। পাশে হরি গোঁসাই, জয় ফিসফিস করে একবার বলল, বড় বড় নেতারা এভাবে হেকেল হচ্ছে, এ খুব অন্যায়।
হরি খিক করে হেসে বলে, চেপে যা। হচ্ছে হোক। একটু হওয়া দরকার।
মদনটা কোনও ইনিসিয়েটিভ নিচ্ছে না, দেখেছ?
চালাক লোক। পাবলিকের চোখে ইমেজ রাখছে।
কিন্তু মদনা দাঁড়ালে সব সমাধান হয়ে যাবে।
হলে এতক্ষণে মদনদা দাঁড়াত রে। তা নয়। কালকের ক্লোজডোর মিটিং-এ বসে নেতারা এককাট্টা হতে পারেনি।
বিমর্ষ মুখে জয় বলল, আজকাল নেতারা একদম এককাট্টা হতে পারছে না হরিদা। কী হবে বলো তো?
দল ভাঙবে। আবার কী? বাঁ কোণে নিত্য ঘঘাষ বসে আছে কেমন বেড়ালের মতো মুখ করে দেখছিস?
জয় একটা শ্বাস ফেলে বলল, দেখেছি। কিন্তু নিত্যদা আলাদা দল করতে চাইলেই কি হবে? নিত্যদার যে সেই ইয়েটা, কী যেন বলে, সেইটে নেই।
কিয়েটা?
ওই যে!–জয় সহজ ইংরিজি শব্দটা হাতড়াতে হাতড়াতে বলে, ওই যে ইনফ্লুয়েন্স না কী যেন!
তোর মাথা। এই মিটিং-এ বারো আনাই নিত্য ঘোষের লোক!
সে বুঝেছি। কিন্তু কী করে হয় বলো তো হরিদা। নিত্যদা তিনবার অ্যাসেমব্লিতে দাঁড়িয়ে হেরে গেছে। ওকে কে পোঁছে?
সবাই কি ভোটে জেতে? জিতলেই যে তাকে সবাই পোঁছে এমনও নয়।
আমি বলছি হরিদা, একবার মদনদা যদি সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করে তা হলে
কী বোঝাবে?
এটা যে নিত্য ঘোষের চক্রান্ত সেই কথাটা।
বিপদ আছে রে।
কী বিপদ?
তখন নিত্য ঘোষও উঠে দাঁড়িয়ে মদনদার আর-একটা চক্রান্ত ফাঁস করে দেবে। ওরা কেউ কাউকে ঘাঁটাতে চাইছে না এখন। দল ভাগ হলে তখন কোমর বেঁধে লড়বে। এখন ক্যাডার কালেকশন।
মদনদার চক্রান্তের কথা নিত্য ঘোষ কী বলবে? মদনদার আবার চক্রান্ত কী? তুমি যে কী বলল হরিদা।
হরি গোঁসাই কী একটু বলার জন্য চুলবুল করেও সামলে গেল, বলার তো ট্যাকসসা লাগে না। পাবলিকের সামনে একটা কিছু টক ঝাল বললেই পাবলিক খেয়ে নেয়। আর পলিটিক্সওয়ালাদের কটা কথা সত্যি? চক্রান্ত না থাকে তো বানিয়ে একটা বলে দেবে।
লোকে বিশ্বাস করবে না।
চেঁচামেচি বাড়ছিল। আগের দিকে খুব একটা ঠেলাঠেলি চলেছে। একটা ছোকরা কী একটা বলছিল চেঁচিয়ে, তিন-চারজন তাকে ধরে খুব ঝাকাচ্ছে। ধাক্কা মেরে মেরে ভিড় ঠেলে বের করে আনছে। হরি গোঁসাই আর জয় দুজনেই ছোকরাকে চিনল। মদনদার বডিগার্ড শ্ৰীমন্ত।
জয় উত্তেজিত হয়ে বলে, স্টেট আর সেন্ট্রাল লিডারদের সামনে কী হচ্ছে দেখো হরিদা!
কিছু করার নেই। দেখে যা।বলে হরি গোঁসাই জয়ের হাতে একটু চাপ দেয়।
এরপর কি পার্টি মিটিং-এও পুলিশ ডাকতে হবে নাকি? প্রেস্টিজ বলে কিছু থাকল না।
গলা উঁচুতে তুলিস না। লোকে তাকাচ্ছে।চাপা গলায় হরি গোঁসাই বলে।
মদনদা তবু কিছু করছে না, দেখেছ?
কী করবে? এতগুলো অ্যান্টি লোক।
সবাই অ্যান্টি? পার্টি ভাগ হলে মদনদা কোনদিকে থাকবে তা জানো?
হরি গোঁসাই ঠোঁট উলটে বলে, কে জানবে? নিত্য ঘোষ ডিসিডেন্ট, একটু জানি। দিল্লির একটা ফ্যাকশন নিত্য ঘোষকে অ্যাপ্রুভ্যালও দিয়েছে। যে গ্রুপ স্ট্রং হবে মদনা সেই দিকেই থাকবে মনে হয়।
জয় কথাটা শুনে খুশি হল না। একটু টেরিয়া হয়ে বলল, মদনদা কি সেই ধাঁচের লোক? যেদিকে আগুন দেখবে সেদিকেই হাত সেঁকবে?
দূর বোকা! উলটো বুঝেছিস। বলতে চেয়েছিলাম, মদনদা যেদিকে জয়েন করবে সেদিকটাই আলটিমেটলি স্ট্রং হবে। চল, বাইরে গিয়ে শ্রীমন্তকে ধরি। ব্যাপারটা একটু বোঝা যাবে।
জয়ের ইচ্ছে ছিল না। সে এই মিটিং-এর শেষটা দেখতে চায়। কিন্তু সামনের দিকে হুড়োহুড়ি বাড়ছে। ঠেলাঠেলি চলছে ভীষণ। দেখা যাচ্ছে না ভাল, তবে বোঝা যাচ্ছে সামনে আর-একটা মারপিট লেগেছে। মদনদার কিছু হবে না তো?
হরি গোঁসাইয়ের পিছু পিছু জয় বেরিয়ে আসে।
পার্টি অফিসের সামনে বারান্দা। বারান্দার নীচে একটু বাঁধানো জায়গা। কোথাও তিল ধারণের জায়গা নেই। বিস্তর চেনা অচেনা আধচেনা পার্টি ওয়ার্কার দাঁড়িয়ে আছে।
শ্ৰীমন্ত ভিড় ছাড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছে। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানেই একটা জিপ। একটা লোক জিপের সামনের সিটের ওপর একটা ভোলা ফার্স্ট এইড বক্স থেকে তুলোয় কী একটা ওষুধ তুলে শ্ৰীমন্তর কবজিতে লাগাচ্ছে।
শ্ৰীমন্ত! কী ব্যাপার?—হরি গোঁসাই খুব সন্তর্পণে জিজ্ঞেস করে।
শ্ৰীমন্ত একবার বাঘা-চোখে তাকায়। বাবারে, কী চোখ! লাল, জ্বলজ্বলে আগুনে। শ্ৰীমন্ত বিগড়োলে খুব গড়বড়, সবাই জানে। হরি গোঁসাই দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করার সাহস পেল না।
জিপের লোকটা শ্ৰীমন্তর হাতে একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়ে গম্ভীরভাবে বলে, একটা সিকুইল খেয়ে নিস। এখন বাড়ি গিয়ে বসে থাক। সন্ধের পর যাব।
জিপের লোকটাকে জয় আবছা চেনে। কালো, পেটানো চেহারা, মাথায় টাক, বছর চল্লিশেক বয়স। পরনে খুব ঝা চকচকে প্যান্ট আর দামি হাওয়াই শার্ট। শ্ৰীমন্তর হাতে ব্যান্ডেজ করে দেওয়ার পর সে একবার খুব তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের চাউনিতে জয় আর হরি গোঁসাইকেও দেখল।
শ্ৰীমন্ত রাগে ফুসছে। গলার শিরা ফুলে আছে, চোখে সেই খ্যাপা দৃষ্টি। বলল, মা কালীর দিব্যি বলছি নদুয়াদা, হেলার লাশ আমি নামাব। না হলে নাম পালটে রেখো।
নদুয়া নামের লোকটা সাপের মতো একটা হিসস শব্দ করে গালের পানটা একটু চিবিয়ে নিয়ে বলল, রি-অরগানাইজেশন হচ্ছে। তখন দেখা যাবে। এখন বাড়ি যা।
শ্ৰীমন্ত একবার পার্টি অফিসের দিকে ক্রুদ্ধ চোখে চেয়ে মুখ ফিরিয়ে হাঁটতে থাকে।
পিছনে সঙ্গ ধরে হরি গোঁসাই। জয় এগোয় না। কয়েক পা সরে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। নদুয়াকে সে চেনে। এর গোডাউন থেকে কয়েক বছর আগে বন্যার সময় মদনদা গম বের করেছিল। গমের মাপ নিয়ে খুব লেগেছিল মদনদার সঙ্গে। নদুয়া বলেছিল, রিলিফের জিনিস আর মাপব কী, ওরকম নিয়ম নেই। যে মাপ বলে দেব সেইটেই ঠিক মাপ। কিন্তু মদনদা ছাড়েনি। বলেছে সরকার যখন দাম দেবে তখন গুনে নেবেন না? তখন চোখ বুজে থাকবেন? শেষ পর্যন্ত দলের ছেলেরা গুদাম ঘেরাও করার ভয় দেখানোয় সব মাল মাপা হয়েছিল। বিস্তর কম ছিল ওজনে। এ সেই লোক। সম্পূর্ণ করাপটেড। তবে পলিটিক্যাল লাইন আছে, টাকা আছে, জিপ গাড়ি আছে, গুন্ডা আছে। শিয়ালদার যে করাপটেড লোকটা যাত্রীদের কাছ থেকে ভড়কি দিয়ে টিকিট নিচ্ছিল তাকে ধমকানো যত সোজা একে ধমকানো তত সোজা নয়। লোকটা বুকে হাত রেখে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে চারদিকে চোখ রাখছে। জিপে ড্রাইভার বসা। প্রস্তুত। মনে হচ্ছে কাউকে তুলে নিয়েই হাওয়া হবে। কাকে তা অবশ্য জয় জানে না!
এত গোলমালে জয়ের মাথা ধরে গেছে; মনটা বড় ভার। মাত্রই সে বিভিন্ন জায়গায় পার্টির বক্তৃতা দেওয়ার সুযোেগ পেতে শুরু করেছে। হিঙ্গলগঞ্জে দলের সংগঠনে তাকে পাঠানোর কথা হচ্ছিল। দু-চার বছর পরেই সে অ্যাসেমব্লির টিকিট পেয়ে যেত। মদনদার মতো করেই নিজেকে তৈরি করছিল সে। আয়না দেখে দেখে বক্তৃতা দেওয়া এবং সেই সঙ্গে নানারকম এক্সপ্রেশন দেওয়া প্র্যাকটিস করছিল। গলার ওঠা-নামা, হাততালির জন্য ঠিক জায়গায় জুতসই আবেগকম্পিত ভাবালু কথা লাগিয়ে তুঙ্গে উঠে যাওয়া, এ সবই অভ্যাস হয়ে যাচ্ছিল তার। স্বয়ং ডিস্ট্রিক্ট সেক্রেটারি ক’বার পিঠ চাপড়ে বলেছেন, তুমি বেশ তৈরি হচ্ছ। কিন্তু হঠাৎ এ হল কী? পাটি যে ভাঙবে তা সে নিজেদু’ মাস আগেও কেন জানতে পারেনি?
হরি গোঁসাই ফিরে এসে বলল, চল।
শ্ৰীমন্তদার সঙ্গে কথা হল?
হল। চল, বলছি।
একটু এগিয়ে গিয়ে হরি গোঁসাই বলে, শ্ৰীমন্ত মদনার কাজ ছেড়ে দিয়েছে।
কেন?
তা বলল না। শুধু বলল, অনেক ব্যাপার আছে।
কবে ছাড়ল? কালও তো আঠা হয়ে লেগে ছিল সঙ্গে।
কবে ছাড়ল জেনে কী হবে? আজকাল হকে নকে এ ওকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
জয় গভীর মুখে একটু ভাবল। তারপর বলল, শ্ৰীমন্তদা ছাড়বে জানতাম।
কী করে জানলি?
হাবভাব দেখে। কদিন আগে আমাকে একবার কথায় কথায় বলেছিল, মদনদার বেস ওয়ার্ক ভাল হচ্ছে না। স্টেট লিডাররা নাকি মদনদার ওপর খুশি নয়। তখনই সন্দেহ হয়েছিল, শ্ৰীমন্তদা গোপনে অন্যদিকে তাল দিচ্ছে। শ্ৰীমন্তকে যারা ম্যানহ্যান্ডেল করল তারা কারা জানো? মদনদার লোক নয় কিন্তু।
না, মদনদার লোক হবে কেন? হেলার নাম শুনলি না? হেলা হচ্ছে নিত্য ঘোষের
জানি জানি।–ধৈর্য হারিয়ে জয় বলে, কিন্তু তাই বা হয় কী করে? শ্ৰীমন্তদা মদনদাকে ছেড়ে দিলে আর একটা গ্রুপে তো তাকে ভিড়তে হবে। সেই গ্রুপটা তো নিত্যদার। তা হলে নিত্যদার লোক ওকে মিটিং থেকে বের করে দেবে কেন?
বুঝতে পারছি না। এখন বাড়ি চল।
গিয়ে?
গিয়ে আবার কী? এখন কেটে পড়াই ভাল।
মদনদা একা রইল যে! যদি কিছু হয়?
কিছু হবে না।
আমাদের দেখা উচিত।
দেখে লাভ নেই। মদনদাকে দেখার লোক আছে। চলল।
হরি গোঁসাইয়ের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে জয় বলে, আমার মনে হয় কী জানো? দলে ভাল লোক কেউ থাকবে না।
হরি গোঁসাই চিন্তিত মুখে বলে, তাই তো দেখছি। মদনদা যদি পাওয়ারে না থাকে তবে বিশুটাকে মেডিক্যালে দেওয়া হয়ে গেল। ওদিকে এই সময়ে নবটাও জেল থেকে বেরিয়েছে। কীযে হবে!
সারা পথ জয় সেই অতীতের সুদিনের কথা ভাবতে ভাবতে এল। বাসে প্রচণ্ড ভিড়। তার মধ্যে রড ধরে তেড়াবেঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে সে ভাবছিল, সেই কবে পালবাজার অবধি একটা সাইকেলে ডবলক্যারি করেছিল তাকে মদনদা। একটা মিটিং সেরে ফিরছিল তারা। রডে বসে মদনদার শ্বাস নিজের ঘাড়ে টের পেতে পেতে, আর এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় ঝাকুনি খেতে খেতে বারবার মনে হয়েছিল, মদনদা একদিন খুব ওপরে উঠবে! সেজদিকে খুব পছন্দ ছিল মদনদার। সেজদিরও মদনদাকে। বাড়িতে এলেই সেজদির সঙ্গে ছাদে গিয়ে পুটর পুটর কথা বলত। জয় টের পেয়ে আনন্দে কণ্টকিত হয়েছে কতবার। মদনদা যদি সেজদিকে বিয়ে করে তো কী দারুণ হয়! হয়নি কেন তা জানে না জয়। একদিন এক পলিটেকনিক পাশ সরকারি চাকরের সঙ্গে সেজদির বিয়ে হয়ে গেল! মদনদা তার বছর চারেক বাদে এম পি হয়।
বাস থেকে নেমে জয় আনমনে মোড়টা পেরিয়ে গলিতে ঢুকল। এ পাড়া দারুণ নির্জন। একধারে জলা, পুকুর জঙ্গল অন্য ধারে কিছু ছাড়া ছাড়া বাড়িঘর। তবে এরকম থাকবে না। নতুন প্ল্যানিং-এ চল্লিশ ফুট চওড়া রাস্তা হবে। জমজম করবে জায়গাটা।
ঝুপসি একটা গাছতলা থেকে সরু একটা শিস শোনা গেল। তারপর চাপা গলায় কে ডাকল, জয়দ্রথ!
কে?
এদিকে শোন। ভয় নেই।
কে বলো তো?—জয় এগোতে সাহস পেল না। তবে দাঁড়াল।
আমি।-বলে ছায়া থেকে রাস্তায় একটা লোক এগিয়ে আসে।
শরতের রোদ অল্প বেলাতেই মরে গেছে। চারদিকটা ঘোর ঘোর। বেশ ঠাহর করে চিনতে হয়। তবু এক নজরেই চিনল জয়।
নব?
কসবায় পিলু নামে একটি নকশাল ছেলেকে খুন করেছিল নব! পিলুর কাছ থেকে সিগারেট নিয়ে ধরিয়ে ইয়ারকি ঠাট্টা করতে করতে, ঠোঁটে সেই সিগারেট নিয়েই আচমকা কোমর থেকে দোধার ছোরা টেনে এনে খুব স্নেহের সঙ্গে তলপেটটা ফাঁক করে দিল সাঁঝবেলায়। পিলু যখন মাটিতে পড়ে বুকফাটা চেঁচিয়ে উঠল তখন শান্তভাবে তার হাঁ মুখে হকিবুটসুদ্ধ পা চেপে ধরে সিগারেটে মৃদু মৃদু টান দিচ্ছিল নব। তারপর খুব হিসেব-নিকেশ করে আর-একবার ছোরা চালিয়ে পাঁজরার ফাঁক দিয়ে হৃৎপিণ্ডটা ফুড়ে দিল। তখনও সিগারেটটা জ্বলছে ঠোঁটে। পিলুরই দেওয়া সিগারেট। পিলু নিথর ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার পরও কিছুক্ষণ সিগারেটটা জ্বলছেনবর ঠোঁটে। ঘটনাটা স্বচক্ষে দেখেছিল হাসিম, তার কাছ থেকে জয়ের শোনা। নবর ওই ‘ভয় নেই’ কথাটাকে জয় তাই বিশ্বাস করে না।
এখনও নবর ঠোঁটে একটা সিগারেট জ্বলছে। সেটা নামিয়ে নব আর এক হাতে জয়ের একখানা হাত ধরে বলল, আড়ালে আয়। কথা আছে।
জয় জানে ভয় পেয়ে লাভ নেই, সাহস দেখিয়েও লাভ নেই। নব যা ভেবে এসেছে তাই করবে। এক ধরনের খারাপ রক্ত নিয়ে নবর মতো লোক দুনিয়ায় জন্মায়। যেখানে থাকে সেই জায়গা জ্বালিয়ে দেয়, যাদের সঙ্গে কাজকারবার করে তাদের সুখ শান্তি বলে কিছু থাকে না।
গাছতলার ছায়ায় জয়কে টেনে এনে নব বলে, বোস। ঘাস একটু ভেজা আছে।
জয় চারদিকে চেয়ে বলে, এ জায়গায় পরশু দিনও কেউটে সাপ বেরিয়েছে। এই গাছটার ফঁাপা শেকড়ের মধ্যে আস্তানা।
নব কথাটা কানে না তুলে বলে, শোন, ক’দিন আগে একজন লোক জেলখানায় আমার সঙ্গে গিয়ে দেখা করেছিল! নাম বলেছিল গোপাল বিশ্বাস। চিনিস?
চিনি।
কোথায় থাকে?
ঠিকানা জানি না। পার্টি অফিসে আসে।
ঠিকানা জোগাড় করে আজই তার সঙ্গে লাইন করতে হবে। চল।
বলে নব আবার জয়ের হাতটা ধরে।
জয় দোনোমোননা করে বলে, এখনই?
এখনই।–বলে নব একটু হাসে।
জয় বলল, চলো।
.
১২.
মদন আপন মনে ফিক ফিক করে হাসছিল। ব্যাপারটা এমন মজার!
রাজ্য শাখার সেক্রেটারি মানুষটা ভাল। দলের কাজে মেতে থাকায় বিয়েটা পর্যন্ত করেননি। বিমর্ষ মুখে হলঘরের দিকে শূন্য চোখে চেয়ে ছিলেন। মদনের দিকে তাকিয়ে খুব মৃদু স্বরে বললেন, হাসছ? হাসো, খুব হাসসা। আজ হাসারই দিন। না খেয়ে, না ঘুমিয়ে মারধোর খেয়ে জেল খেটে চল্লিশ বছর ধরে যে স্যাক্রিফাইস করলাম তা কার জন্য? ভেবে আমারও হাসিই আসার কথা, কিন্তু আসছে না কেন বলো তো?
আপনার বয়স কত বলুন তো সুহৃদদা? ষাট বাষট্টি হবে?
পঁয়ষট্টি চলছে। কেন বলো তো?
তা হলে এখনও বিয়ের বয়স আছে। এবার একটা বিয়ে করুন।
ইয়ারকি করছ? এটা কি ইয়ারকির সময়?—ভারী হতাশা মাখানো মুখে সুহৃদ চৌধুরী বললেন।
বিয়ে না করলে কে আপনাকে দেখবে?
যম দেখবে হে। আর কে দেখবে? এইসব ছেলে-ছোকরারা রাজনীতিতে ঢোকার পর থেকে যে ভূতের নৃত্য শুরু হয়েছে তা আর চোখে দেখা যায় না। শিশুপাল, সব শিশুপাল।
মদন হাসতেই থাকে, ফিক ফিক। সেক্রেটারি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, তাই ভাবছিলাম কার জন্য এই স্যাক্রিফাইস! বিয়াল্লিশে পুলিশ এমন মেরেছিল গোড়ালিতে, আজও একটু খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়। জেলে থেকেই গ্যাসট্রিক। বনগ্রামের যে বাড়িটা পার্টির নামে লিখে দিয়েছিলাম বিশ বছর আগে, বাজার যাচাই করে দেখেছি সেটার দাম এখন লাখখানেক টাকা।
মদন হাসছিল ফিক ফিক।
হলঘরে তুমুল কাণ্ড হয়েই যাচ্ছে। এক ছোকরা আর একটা ষণ্ডামার্কার কাঁধে দাঁড়িয়ে দেয়াল থেকে এক সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতার বাঁধানো ছবি নামিয়ে ঝপাৎ করে আছাড় মারল। কয়েকবারই জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরো এসে নেতাদের শতরঞ্চিতে পড়েছে। প্রেসিডেন্ট তার চটি দিয়ে সেগুলো নিভিয়েছেন। এবারও আর একটা জ্বলন্ত সিগারেট উড়ে এসে ট্রেজারারের কেঁচায় পড়ল। উনি অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে কোচাটা টেনে নিলেন, প্রেসিডেন্ট হাতে চটি নিয়েই বসে আছেন, অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সিগারেটটার মুখ ভোতা করে দিলেন এক বাড়ি মেরে। ট্রেজারার বললেন, শতরঞ্চিটা বাহাত্তর টাকায় কেনা সেই বিশ বছর আগে। আর কি এ দামে পাওয়া যাবে প্রকাশদা?
প্রেসিডেন্ট প্রকাশ চাটুজ্জে গম্ভীরমুখে বললেন, সবই গেল, আর শতরঞ্চি! তোমার যে বাথরুম পেয়েছিল তার কী করলে?
ট্রেজারার ব্যথিত মুখে বললেন, কী করব? চেপে বসে আছি। পুরনো ডায়াবেটিসের রুগি, বেশিক্ষণ চেপে রাখাও যাবে না। এক সময়ে হয়ে যাবে আপনা থেকেই। শতরঞ্চিটা
মদন মৃদু স্বরে বলে, ভেসে যাক, ভেসে যাক, বেগটা ছেড়ে দিন।
ট্রেজারার বেদনায় নীল হয়ে বলেন, কী যে বলো ঠিক নেই। এই শতরঞ্চিতে কত বড় বড় নেতা বসে গেছেন জানো? তার ওপর এটা ত্রিশ ফুট বাই ত্রিশ ফুট, আধ ইঞ্চি পুরু। একবার বোয়া হয়েছিল, চড়া রোদেই শুকোতে লেগেছিল পনেরো-যোলো দিন।
দু’ গোছ রজনীগন্ধা রাখা ছিল মাঝখানে। দুটো ছেলে এসে পটাপট তুলে নিয়ে গেল। দেখা গেল অদূরেই তিন-চারজন রজনীগন্ধার উঁটি বাগিয়ে ধরে তলোয়ার খেলছে।
কী হচ্ছে বলুন তো মদনদা!—একজন মফসসলের এম এল এ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে।
বলতে না বলতেই ফুলশূন্য দুটো উঁটি তীরবেগে উড়ে এসে পড়ল নেতাদের মাঝখানে। প্রবীণ সদস্য যদুবাবু হাত দিয়ে মুখ আড়াল না করলে তার চশমায় লাগত।
জমেছে। মদন আপন মনে বলে উঠল।
নেতাদের মধ্যে একমাত্র নিত্য ঘোষই একটু আলাদা হয়ে বসে আছে। কথা বলছে না। একটার পর একটা পান মুখে দিচ্ছে। পিকদানির অভাবে একটা অ্যাশট্রেতে পিক ফেলছিল এতক্ষণ। সেই অ্যাশট্রেটাও ভরে এল প্রায়।
মদন শূন্য ফুলদানি দুটোর একটা এগিয়ে দিয়ে বলে, নিত্যদা, এটাতে ফেলুন।
ট্রেজারার দেখতে পেয়ে হা হা করে ওঠেন, ওটা খাঁটি জয়পুরি জিনিস। বিশেষ অকেশনে বের করা হয়।
মদন ঠান্ডা গলায় বলে, কতক্ষণ থাকতে হবে তার ঠিক নেই। দেরি হলে নিত্যদার পানের পিক আপনার শতরঞ্চি ভাসাবে যে!
ট্রেজারার উদ্বেগের সঙ্গে জিজ্ঞেস করেন, কতক্ষণ থাকতে হবে মানে? মিটিং শেষ করে দিলেই চলে যাব।
মিটিং অনেকক্ষণ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা বেরোতে পারছি না।
ওরা কি আমাদের আটকে রেখেছে?
আটকেই রেখেছে।
ঘেরাও নাকি?
অনেকটা তাই।
ট্রেজারার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, ঘেরাও করে লাভ কী? আমরা সাতদিন বসে ডিসিশনে আসতে পারব না।
এই সময়ে সারা ঘরের হুলস্থুল হঠাৎ একটু মিইয়ে গেল। কয়েকটা ছেলে বেশ সুসংগঠিতভাবে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে। তাদের হাতে কয়েকটা কাগজ, মুখ চোখ সিরিয়াস!
সবার আগে যে ছেলেটি, তার চেহারা খুবই চোখা চালাক, সপ্রতিভ। সে কাছে এসে নেতাদের দিকে চেয়ে নরম গলায় বলে, আপনারা যারা আমাদের পক্ষে নন তারা দয়া করে দল থেকে পদত্যাগ করুন। যাঁরা পদত্যাগ করবেন তাদের আমরা আটকাতে চাই না। যাঁরা দলে থেকেও আলাদা ফ্যাকশন করতে চান আমরা তাদের কনফ্রন্ট করব। আমাদের কাছে টাইপ করা পদত্যাগপত্র আছে। কার চাই বলুন!
কেউ কিছু বলতে চায় না। ভাবছে। দিল্লিতে দলে ভাঙন দেখা দিয়েছে, সুতরাং এখানেও ভাঙবে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই ডামাডোলে কেউ আগে নিজের রং চেনাতে চায় না। অবশ্য নিজের রং যে কী তাও অনেকে বুঝতে পারছে না।
মদন হাত বাড়িয়ে বলল, আমাকে দাও একখানা।
আপনি পদত্যাগ করবেন মদনদা?—ছেলেটা যেন ঠিক বিশ্বাস করছে না।
করব। কারণ আমার দারুণ খিদে পেয়েছে। দাও।
বলে ছোকরার হাত থেকে কাগজ নিয়ে মদন তলায় সই করে ফেরত দিল। দেখাদেখি ট্রেজারার, প্রেসিডেন্ট, গেঁয়ো এম এল এ এবং আরও কয়েকজন হাত বাড়াল।
পাশের দরজা দিয়ে টুক করে বেরিয়ে পড়ে মদন। পদত্যাগ করেছে বলেই বোধহয় কেউ আটকায় না। পিছন দিকে একটা সরু গলি আছে, সেইটে খুঁজতে একটু সময় লাগে। তারপর বড় রাস্তা।
চারদিকে মরা আলোর ভারী নরম একটা বিকেল। খোলা হাওয়ায় বুক ভরে শ্বাস টানে মদন। বাইরে এসে সে এমনই মোহিত হয়ে পড়ে যে, লক্ষই করে না পার্টি অফিস থেকে একশো-দেড়শো গজ দূরে একটা জিপ গাড়ির গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো কালো ষণ্ডামার্কা টেকো একটা লোক দূর চোখে তাকে দেখছে। হালদারের যে গাড়িতে সে এসেছে তা পার্টি অফিসের উলটোদিকে ফুটপাথ ঘেঁষে পঁড় করানো। কিন্তু মদন গাড়িটার কাছে যাওয়ার কোনও চেষ্টাই করে না। পার্টি অফিসের সামনে এখন অগুন্তি লোক। ওদিকে গেলেই ঘিরে ফেলবে। মদন কালীঘাটের ট্রাম ধরতে এসপ্লানেডের দিকে হাঁটতে থাকে।
ফুটপাথে থিকথিক করছে হকার, বে-আইনি দোকানপাট, ফুটপাথের বাসিন্দাদের সংসার। ট্যানা-পড়া এক মেয়েছেলে কাঠের জ্বালে তরকারির খোসা দিয়ে রান্না চাপিয়েছে। গন্ধে গা গুলোয়। বাস মোটর গাড়ির চলন্ত চাকা থেকে দু’-তিন হাত দূরেই হামা টানছে তার কোলের বাচ্চা।
রিজাইন করেছেন শুনলাম!—একদম কানের কাছে মুখ এনে প্রেমিকার মতো মোলায়েম করে কে যেন জিজ্ঞেস করে।
মদন চোখের কোনা দিয়ে শচীকে একটু মেপে নিয়ে বলল, ওই একরকম বলতে পারো।
তা হলে আপনারাই নতুন দল করবেন?
ঠিক নেই।
শচী শেয়ালের মতো হাসল, কথা দিচ্ছি দাদা, কাল আপনার স্টেটমেন্ট আমাদের কাগজের ফ্রন্ট পেজে বেরোবে।
তোমাদের ফ্রন্ট পেজ ক’টা?
কী যে বলেন?—শচী মাথা চুলকে হাসল, ফ্রন্ট পেজ একটাই, এবার আপনাকে আমরা বড় কভারেজ দেবই।
একটা সত্যি কথা বলবে শচী?
কী, বলুন দাদা!
তোমরা কার দলে?
আমাদের আবার দল কী?
মদন শান্ত স্বরেই বলে, কালকের কাগজে তোমরা আমার স্টেটমেন্ট ছাপবে ঠিকই, কিন্তু মাথার ওপর নিত্য ঘোষের বিবৃতি বসাবে। এ সবই আমি জানি। এখন নিত্য ঘোষেব পালেই হাওয়া। তোমাদের দোষ নেই।
শচী এ নিয়ে কচলাল না। বলল, আপনাদের নতুন দলের কী নাম হবে ভেবেছেন?
একটা কিছু হবে। অল ইন্ডিয়া বেসিসেই হবে। আমরা ডিসিশন নেওয়ার কে?
তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু আপনি তো পার্টির অল ইন্ডিয়া লিডার। আমরা জানি হাই কমান্ডই আপনাকে হেস্তনেস্ত করতে দিল্লি থেকে এখানে পাঠিয়েছে। আমরা জানি আপনি মালদা মুর্শিদাবাদ বীরভূমের ক্যাডারদের সাপোর্ট পেয়ে গেছেন। ভিতরে ভিতরে দল ভাগ হতে শুরু হয়ে গেছে। দিল্লি থেকে আপনি নিশ্চয়ই কিছু শুনে এসেছেন।
ধর্মতলার মোড়ে অফিসভাঙা ভিড়ে দাঁড়িয়ে মদন তার সিগারেটের প্যাকেট বের করল এবং শচীকে অফার না করেই নিজে একটা ধরাল। অভ্যাসবশে শচী হাত বাড়িয়েছিল। মাঝপথে হাতটা ফেরত নিয়ে বলল, আপনাদের ক্যাডাররাই কি মেজরিটি?
জানি না।
শচী ভিড়ের মধ্যে কানের কাছে মুখ এনে বলল, একটা কথা বলি দাদা। নিত্য ঘোষ যতই লাফাঁক, আপনি যেদিকে থাকবেন সেদিকেই পাল্লা ঝুঁকবে। আমরা আপনার দিকেই তাকিয়ে আছি।
কত কথাই যে জানো তোমরা!
দেখে নেবেন। বলে দিলাম।বলে শচী আবার হাতটা বাড়ায়।
মদন পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে ওর হাতে দিয়ে দেয়। বলে, কত কায়দাই যে জানো শচী। কিন্তু এবার নিজের পয়সায় সিগারেটটা খেতে শেখো, তাতে খানিকটা সেলফ-রেসপেক্ট আসবে।
কথাটা গায়ে না মেখে শচী বলে, আপনি যে ফোরফ্রন্টে চলে এসেছেন তা সবাই টের পাচ্ছে। নইলে আপনি আসার পর এই গণ্ডগোলটা হল কেন? নিত্য ঘোষ যেটা করছে সেটা পাওয়ার পলিটিক্স। কিন্তু আলটিমেটলি
কার্জন পার্কের ট্রাম গুমটি ছাড়িয়ে, রাজভবনের গাছপালার ডগার ওপর দিয়ে, রঞ্জি স্টেডিয়ামের পিছনে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। এসপ্লানেড ইস্টে আজও নিত্যকার মতো কারা ধর্না দিয়ে বসে আছে, সামনে পুলিশ ব্যারিকেড। একটা ফেরেব্বাজ কলমওয়ালা চোরাই কলম বেচার ভাবভঙ্গি কবে কানের কাছে এসে বলে গেল, চাইনি-ই-জ।
মদন ভুলে গেল যে, সে এম পি বা পলিটিক্সওয়ালা। হঠাৎ বলল, ফুচকা খাবে শচী? ওই লেনিন স্ট্যাচুর নীচে একটা ফুচকাওয়ালাকে দেখা যাচ্ছে। চলো।
বলতে বলতেই শচীর হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে রাস্তা পেরোয় মদন।
একজন ভি আই পি হয়ে কী যে করেন মদনদা!—হাত ছাড়িয়ে শচী হাসল, আর একটু হলে নীল বঙের অ্যামবাসাডারটার মুখে পড়ে যেতাম দুজনে।
পলিটিশিয়ান আর রিপোর্টাররা কখনও টাইমলি মরে না হে শচী। মরলে দেশটা সোনার দেশ হত। ওহে ফুচকাওলা, শুরু করো, শুরু করো! জলদি!
.
১৩.
দক্ষিণগামী বাসের দোতলায় এক ছোকরা হঠাৎ বলে উঠল, এই যে দাদারা! এত তাড়াতাড়ি সব বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন? শুনেছেন কি, কাল রাতে লাশকাটা ঘরে নিয়ে গেছে তারে? বধূ শুয়ে ছিল পাশে, শিশুটিও ছিল, তবু মরিবার হল তার সাধ। অথচ দেখুন কবি গেয়ে গেছেন, মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে। আজ নিজের জীবনের একটা গল্প বলব বলে আপনাদের কাছে এসেছি। গল্প নয়, ঘটনা, বুঝলেন দাদা, বেঁচে থাকার কোনও পথ না পেয়ে আমরা দুই ভাই ব্যাবসা করতে গিয়েছিলাম। বাঙালি ব্যাবসা করতে জানে না এই বদনাম ঘোচাতে দাদা, শ্যামবাজারের মোড়ে আমি আর আমার দাদা একটা দোকানঘর ভাড়া নিতে গেলাম। পেয়েও গেলাম একটা। কিন্তু দাদা, বাড়িওলা পঞ্চাশ হাজার টাকা সেলামি চায়। সেই শুনে আমরা পালিয়ে আসি। কিন্তু বাঁচতে তো হবে! মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে। তাই দাদা বাঁচার শেষ চেষ্টা করতে গিয়ে আমরা দুই ভাই অল্প পুঁজি নিয়ে একটা ব্যাবসা শুরু করলাম। এ লড়াই বাঁচার লড়াই, এ লড়াই করতে গিয়ে আমরা তৈরি করেছি একটি ধূপকাঠি। এই বাসে আমাকে প্রায়ই দেখতে পান আপনারা। রেগুলার অনেকেই এই ধূপ ব্যবহার করেছেন। যারা করেছেন তাদের কাছে নতুন করে বলার কিছু নেই। যারা জানেন না তারা জেনে রাখুন, একটি স্টিক জ্বলে পঁয়তাল্লিশ মিনিট, কাঠি শেষ হয়ে যাওয়ার পরও এক ঘণ্টা ঘরে তার গন্ধ ছড়িয়ে থাকে। আমার হাতে যে স্টিক জ্বলছে সেই একই স্টিক সব প্যাকেটে পাবেন। দোকানে বাজারে কিনতে যান, একটি প্যাকেটের দাম পড়বে পঁয়ত্রিশ পয়সা। কিন্তু বাসে কনসেশন রেটে এক প্যাকেট চার আনা, দু’প্যাকেট আট আনা, চার প্যাকেট এক টাকা।এক টাকা! এক টাকা! এক টাকা।…
মদনের নাকের ডগায় চারটে প্যাকেট ধরে বার কয়েক নাড়ে ছোকরা, এক টাকা! এক টাকা!
মদন অলস চোখে চেয়ে বলে, গল্পটা পালটাও। এ পর্যন্ত দশজনের মুখে শুনেছি একই গল্প।
ছোকরা প্যাকেটগুলো ঝট করে টেনে নিয়ে পরের সিটের এক যাত্রীর নাকের ডগায় ধবল, এক টাকা! এক টাকা!
মদনের পাশের লোকটা খিক খিক করে হেসে বলল, বেশ বলেছেন। এরপর লজেন্সওয়ালা উঠেও একই গল্প ঝাড়বে। শুধু কি তাই? গুপিযন্ত্র নিয়ে এক বাচ্চা ছোকরা উঠে ধরবে, তোমার সঙ্গে দেখা হবে বাবুর বাগানে। রোজ ওই বাবুর বাগানে’ কঁহাতক শোনা যায় বলুন দেখি! কিছু বলাও যায় না, দেশে বেকার সমস্যা। ভাবি, দুটো করে খাচ্ছে খাক। নেতারা তো আৰ এদের জন্য কিছু করবে না…
তা ঠিক, তা ঠিক।–মদন তাড়াতাড়ি বলল এবং পলিটিক্স এড়াতে দু’ স্টপেজ আগে নেমে পড়ল। হাজরার কাছাকাছি একটা ওষুধের দোকান থেকে ফোন করল মাধবকে, একটু দেরি হবেরে!
সে বুঝতেই পারছি।
তুই একা একা স্কচ চালাচ্ছিস নাকি?
না মাইরি।—একটা হেঁচকি তুলে মাধব বলে, ঝিনুক কেটে পড়েছে, জানিস!
চিরতরে নাকি?
বোঝা যাচ্ছে না। একেবারে আনপ্রেডিকটেবল মহিলা। সঙ্গে বৈশম্পায়ন।
বলিস কী?
দে আর হেড অ্যান্ড ইয়ারস ইন লাভ।
দুস শালা! তুই খাচ্ছিস।
একটুখানি। এই মোটে খুললাম।
কত নম্বর বোতল?
এক নম্বর মাইরি বিশ্বাস কর।
তোকে বিশ্বাসের কী? গিয়ে যদি দেখি সব ফাঁক করেছ তা হলে
আরে না না। অনেক আছে। চলে আয়।
অনেক নেই রে মাধব, অনেক নেই। তুই অন্তত হাফ পাইট সাফ করেছিস।
অতটা হবে না। কী জানিস, ঝিনুকটা তো আজ পালিয়ে গেল, দুঃখে দুঃখে খানিকটা খেয়ে ফেললাম।
পালিয়ে গেছে আর ইউ শিয়োর?
তা ছাড়া আর কী হবে? সঙ্গে বৈশম্পায়ন। দুইয়ে দুইয়ে চার।
তা হলে দুঃখের কী? সেলিব্রেট কর।
তাই করছি আসলে। দুঃখ প্লাস সেলিব্রেশন। তবে বড় একা লাগছে। চলে আয়। আর কত দেরি করবি?
স্নান করে জামাকাপড় পালটেই আসছি।
.
১৪.
গড়িয়াহাটে ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে দু’জনে সূর্যাস্ত দেখল।
আপনার কোনও ডাকনাম নেই?–ঝিনুক আস্তে করে জিজ্ঞেস করে।
বৈশম্পায়ন ফিসফিস করে বলে, আছে। মন্টু।
আমার এক ভাইয়ের নামও মন্টু। ভারী মিষ্টি নাম।
আপনার ভাল লাগলেই ভাল।
কিন্তু আপনি ভারী অদ্ভুত। ওর কোনও বন্ধুই আমাকে আপনি করে বলে না। শুধু আপনি বলেন। কেন বলুন তো!
বৈশম্পায়ন একটু লাল হয়ে বলে, এমনি৷
না। আমার ওসব আপনি-আজ্ঞে ভাল লাগে না। বলুন তুমি! বলুন শিগগির।
তু-তুমি।
শুধু তুমি বললেই হবে না। পুরো একটা বাক্য বলুন।
বলব?
বলতেই তো বলছি।
ঝিনুক! তুমি কী সুন্দর।
বাঃ, বেশ বলেছেন!—ঝিনুক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর আবেগ ভরা গলায় বলে, কতকাল আমাকে কেউ সুন্দর কথা বলেনি। আমি যে সুন্দর সে কথা মনে করিয়ে দেয়নি।
মাধব? মাধবও নয়।
মাধব। মাধব আমাকে একটুও ভালবাসে না। বউকে ভালবাসলে কেউ মদ খায় বলুন!
যুক্তিটা ঠিক বুঝতে পারে না বৈশম্পায়ন, তবে এ নিয়ে আর কথা বাড়াতেও সে আগ্রহ বোধ করে না। তার মুখ গরম, চোখ জ্বালা করছে, গা ঘামছে। অদ্ভুত এক ভালবাসাই এসব ঘটাচ্ছে। সে ঢোক গিলে বলল, ঝিনুক, আমাদের তো খুব বেশি সময় নেই। একটা কথা বলে নেব?
ঝিনুক খুব অবাক হয়ে ফিরে তাকায় বৈশম্পায়নের দিকে, সময় নেই। কীসের সময় নেই বলুন তো!
আয়ুর সময় যে কেটে যাচ্ছে ঝিনুক। যৌবন যায়, বয়স যায়, লগ্ন যায়।
আপনি যে কী সুন্দর কথা বলেন। আমিও ঠিক এসব কথাই ভাবি। আমরা বোধহয় খুব বেশিদিন বাঁচব না, না? আমার তো এমনিতেই মাঝে মাঝে খুব মরে যেতে ইচ্ছে করে।
কেন ঝিনুক?
কেবল মনে হয়, একদিন খুব বন্যা হয়ে আমরা সবাই ড়ুবে যাব। কিংবা কেউ আকাশ থেকে অ্যাটম বোমা ফেলবে। না হয় তো ওই যে কী একটা রোগ হচ্ছে বাঁকুড়ায়, এনকেফেলাইটিস না কী যেন, সেই রোগটা কলকাতায় ছড়িয়ে পড়বে আর আমরা সবাই মাথায় রক্ত উঠে মরে যাব। এত ভয় নিয়ে বাঁচা যায়, বলুন তো! তার ওপর গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে যেতে পারে, ভূমিকম্প হতে পারে, গুন্ডা বদমাশ ডাকাত এসে ঘরে ঢুকে খুন করে যেতে পারে, বলুন!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বৈশম্পায়ন বলে, তা ঠিক। তবে ওসব কিছু না হলেও এমনিতেই আমরা আস্তে আস্তে বয়স্ক বুড়ো হয়ে যাব ঝিনুক।
আপনার বয়স কত?
বত্রিশ-তেত্রিশ।
যা গম্ভীর হয়ে থাকেন, আপনাকে আরও বেশি দেখায়।
আমি আর মাধব একবয়সি।
জানি জানি। আপনাকে আমি মোটেই বুড়ো বলিনি।
কিন্তু বুড়ো তো একদিন হব ঝিনুক। তুমি হবে, আমি হব, মাধব হবে। সময় বয়ে যাচ্ছে, টের পাচ্ছ না?
আচ্ছা আচ্ছা বুঝেছি, বয়স নিয়ে আর ভয় দেখাতে হবে না।
তুমি কি ভয় পাও ঝিনুক!
বুড়ো হতে, মরতে কে না ভয় পায় বলুন। কিন্তু কী একটা কথা বলতে চাইছিলেন যে! হাবিজাবি কথায় সেটা হারিয়ে যাচ্ছে।
কথাটা হারিয়ে গেলেই হয়তো ভাল ছিল ঝিনুক। বলব?
ঝিনুক মৃদু একটু লজ্জার পরাগে মাখা মুখটি মিষ্টি করে নামায়, তারপর মৃদুস্বরে বলে, বলুন না।
কিন্তু বলবে কী করে বৈশম্পায়ন? খুব কাছ ঘেঁষে একটা পায়জামা পরা লোক কখন এসে দাঁড়িয়ে হাই তুলতে তুলতে পাছা চুলকোচ্ছে। কিছু লোকের কাণ্ডজ্ঞানের এত অভাব!
বৈশম্পায়ন একটু বিরক্তির গলায় বলে, চলো আর কয়েক পা দুরে গিয়ে দাঁড়াই।
কয়েক পা হেঁটে তারা লোকটার কাছ থেকে নিরাপদ দুরতে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এই যে একটা বাধা পড়ল এতেই মুডটা একদম নষ্ট হয়ে গেল বৈশম্পায়নের। সে অনেকক্ষণ রেলিং-এ ভর রেখে দূরের আকাশের দিকে চেয়ে রইল। অনেকদিন আগে ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডার দিয়ে শেষবারের মতো দেখা, বলাই সিংহী লেনে লাহাবাড়ির দেয়ালের পটভূমিতে স্কুলের ইউনিফর্ম পরা সেই মেয়েটিকে তো আর কখনও পৃথিবীতে দেখা যাবে না। কিছুতেই ফিরবে না বয়স। কিছুতেই উজানে যাবে না তো নদী। নদী শুধু বয়ে যেতে জানে একমুখে। তার কলধ্বনিতে শুধু মৃত্যুর গান। তার ফঁকা শুন্য উপত্যকায় সাদা আর নিশ্চল হিম পাথরেরা পড়ে থাকে।
খুব হাওয়া দিচ্ছিল আজ। বজবজের একটা ট্রেন প্রায় নিঃশব্দে পায়ের তলা দিয়ে চলে গেল।
বৈশম্পায়ন বলল, ঝিনুক?
উ!
কী ভাবছ?
কত কী! এইমাত্র ইচ্ছে করছিল ওই ট্রেনটায় উঠে অনেক দূর চলে যাই।
কিন্তু ট্রেনটা তত বেশি দূর যাবে না। মাত্র বজবজ পর্যন্ত।
বজবজ কি সমুদ্রের কাছে?
না। গঙ্গার কাছে।
সমুদ্রের কাছে কোনও ট্রেন যায় না?
যাবে না কেন! অনেক ট্রেন যায়। তুমি কি সমুদ্র দেখোনি?
বহুবার। শুধু পুরীতেই গেছি পাঁচবার; ওয়ালটেয়ার, মাদ্রাজ, বম্বে, ঘরের কাছে দিঘা
তবু যেতে ইচ্ছে করে?
করে। কে যে আমার নাম ঝিনুক রেখেছিল। আমার কেবলই মনে হয় সমুদ্রের কাছে আমার অনেক ঋণ!
তোমাকে ডাকে সমুদ্র, আর আমাকে ডাকে এক নদী।
তাই নাকি?
তবে সে এক মৃত্যুর নদী। এক নির্জন উপত্যকা দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। চারদিকে সাদা পাথর। আর কী যে করুণ সেই নদীর গান।
ঝিনুক ছলছলে চোখ তুলে বলে, সত্যি?
বৈশম্পায়ন একটু থমকাল। ঝিনুক যেভাবে চেয়ে আছে তাতে মনে হয় সে বৈশম্পায়নের নদীটাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। একজন প্রাপ্তবয়স্কা পরিণতবুদ্ধির মহিলার পক্ষে যেটা খুব স্বাভাবিক নয়।
একটু থেমে বৈশম্পায়ন বলে, দু’ধারে খুব উঁচু উঁচু পাহাড়। ভীষণ সাদা, শূন্য এক উপত্যকা, সেইখানে এলোচুল বিছিয়ে নদী সারাদিন গুনগুন করে গায়। সাদা সাদা ঠান্ডা পাথর ছড়িয়ে পড়ে আছে চারদিকে। অদ্ভুত না ঝিনুক? শুনলে লোকে আমাকে পাগল ভাববে!
ঝিনুক মাথা নেড়ে বলে, মোটেই না।
বৈশম্পায়ন একটু হতাশ হয়। এত সহজে আর কেউ নদীটাকে মেনে নেবে এরকম আশা সে করেনি। সে বলল, তোমার অদ্ভুত লাগছে না?
না তো! এরকম হতেই পারে।
বৈশম্পায়ন খুবই অবাক হয়ে বলে, হতে পারে?
নীলু যখন মারা গেল তখন কিছুদিন আমারও মৃত্যুর হাওয়া লেগেছিল।-বলে একটু আনমনা হয়ে গেল ঝিনুক। একটু চুপ করে থেকে গলাটা এক পরদা নামিয়ে বলল, জানেন তো, নীলুকে আর আমাকে নিয়ে একটা বিচ্ছিরি কথা রটেছিল!
বৈশম্পায়ন একটু চমকে উঠে বলে, তাই নাকি?
খুব বিচ্ছিবি। যতদূর নোংরা হতে হয়। সেটা রটিয়েছিল আমার এক দূর সম্পর্কের ননদ।
কী রটিয়েছিল ঝিনুক?
ঝিনুক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, একজন ছেলের সঙ্গে একজন মেয়েকে জড়িয়ে যা রটানো যায়। অবশ্য নীলুর সঙ্গে আমার খুব বনত। বিয়ের পর নতুন নতুন শ্বশুরবাড়িতে কাউকেই তেমন ভাল লাগত না। একমাত্র নীলু, কী নরম, কী ভদ্র, কী বুদ্ধি! বেঁচে থাকলে নীলু সবাইকে ছাড়িয়ে যেত। এক এক সময়ে তো আমার মনে হত, নীলু একদিন দেশের প্রধানমন্ত্রীও হবে।
বৈশম্পায়ন মাথা নাড়াল, নীলু ছিল এক্সেপশনাল, আমি জানি।
তা হলেই বলুন! নীলুকে ভাল না বেসে পারা যায়? কিন্তু ভালবাসা মানেই কি খারাপ কিছু? আমি নীলুর সঙ্গে গঙ্গার ঘাটে গেছি, ছবির একজিবিশন দেখেছি, সারা রাত ক্লাসিকাল গানের আসরে গান শুনেছি, এতে কি দোষ? অথচ
এতদিন বাদেও অভিমানে একবার ঠোঁটদুটো ফুলে উঠল ঝিনুকের। একটু সামলে নিয়ে সে বলল, আমার শ্বশুরবাড়ির লোকগুলো ভীষণ অদ্ভুত। আমাকে একদম সহ্য করতে পারত না, আমি সুন্দর বলে। আর নীলুকেও সহ্য করতে পারত না। কেন জানেন? নীলু ভীষণ ব্রাইট বলে। ওদের ধারণা ছিল নীলু সম্পর্কে সবাই নাকি বাড়িয়ে বলে।
মাধব নীলুকে খুব ভালবাসত। বৈশম্পায়ন বলে।
বাসত কি না কে বলবে! আসলে নীলুর যেটুকু সম্পর্ক ছিল বাড়ির সঙ্গে তা আমার জন্যেই। নইলে নীলুর তখন অন্য কোথাও চলে যাওয়ার কথা। ও আমাকে প্রায়ই বলত, পায়ে হেঁটে সারা ভারতবর্ষের গ্রামে গঞ্জে শহরে ঘুরে বেড়াবে। বলত, দেশের প্রবলেমগুলো ধরতে হবে বউদি, অনেক মানুষের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দিতে হবে, এই বুকের মধ্যে সব মানুষকে আমার টেনে নিতে ইচ্ছে করে।
বৈশম্পায়ন চুপ করে থাকে। প্রসঙ্গটা অস্বস্তিকর।
ঝিনুক রেলিং-এ আর একটু ঝুঁকে বলে, আমার শ্বশুরবাড়ির কাছেই নীলু খুন হল সন্ধেবেলায়। উঃ, সে কী সাংঘাতিক কাণ্ড! তরতাজা, ছটফটে, ভীষণরকমের জ্যান্ত নীলু মরে গেছে, ভাবা যায়! তিনদিন আমি একদম বোবা হয়ে ছিলাম। কথা বলতে গেলে মুখ দিয়ে কেবল বুবু শব্দ বেরোত। তারপর থেকেই একটা মৃত্যুর হাওয়া এল। ঘরে বসে থাকতাম, মনে হত বাইরে হঠাৎ একটা হাওয়া। ছেড়েছে। আর সেই হাওয়া কী যেন বলতে চাইছে আমাকে। দৌড়ে যেতাম বাইরে। ছাদে বসে আছি, হঠাৎ মনে হল আমার চারদিকে যেন বাতাসটা ভারী হয়ে ঘুরছে, কিছু একটা ইঙ্গিত করছে। এক এক সময়ে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যেত, মনে হত, একটা হাওয়া এসে আমার দরজায় জানালায় ধাক্কা দিচ্ছে, ডাকছে, বউদি। বউদি।
এ কি ভৌতিক কিছু ঝিনুক?
না, না, একদম তা নয়। আসলে আপনার ওই নদীর মতোই এও এক মৃত্যুর হাওয়া। বেঁচে থাকতে আর মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে অত ভালবাসত নীলু, অথচ সে-ই তো মরে গেল! তাই বোধহয় এই হাওয়াটা এসে আমাকে বলতে চাইত, তোমরা কেন বেঁচে আছ? তোমাদের বেঁচে থাকার কী অধিকার? যে পৃথিবীতে নীলু থাকতে পারল না, সেই পৃথিবীতে তোমরাই বা থাকবে কেন? জানেন, সেই সময়ে আমার বেশ কয়েকবার সুইসাইড করতে ইচ্ছে হয়েছে।
বৈশম্পায়ন আস্তে জিজ্ঞেস করল, নীলু সম্পর্কে তুমি কি সবটুকু জানো ঝিনুক?
ঝিনুক স্থির হয়ে সামনের নির্মীয়মান একটি ফ্ল্যাটবাড়ির কাঠামোর মধ্যে ঘনীভূত অন্ধকারের দিকে চেয়ে বলল, নীলুর সবটুকু কে-ই বা জানে! তবে ও মরে যাওয়ার পর আমার যখন ওরকম মানসিক অবস্থা, তখন একদিন খুব বিরক্ত হয়ে মাধব বলেছিল, নীলু ওর ভাই নয়।
বৈশম্পায়ন একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলল। ঝিনুক জানে।
ঝিনুক মাথা নুইয়ে বলে, জানলাম নীলু ওদের বাড়িতে সেই ছোট্টবেলায় এসেছিল। চাকরের কাজ করত। বাপের পদবি জানা ছিল না বলে মাধবদের পদবি নেয়। একটু বড় হওয়ার পর যখন দেখা গেল যে, সে অত্যন্ত মেধাবী আর বুদ্ধিমান তখন মাধবদের বাড়ির লোকেরা ওকে বাড়ির ছেলে হিসেবে পরিচয় দিত। পরে সে বাড়ির ছেলেই হয়ে ওঠে। মাধব আজও নীলুকে ভাই বলে মানে। এসব জানি মন্টু।
.
১৫.
দিদির বাসার সামনে ফুটপাথে গৌরী দাঁড়িয়ে আছে। কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ, টিনের সুটকেসটা পাশে নামানো।
মদনকে দেখে দু’পা এগিয়ে এসে স্নান একটু হেসে বলল, দু’ঘণ্টার ওপর দাঁড়িয়ে আছি।
ভিতরে গিয়েই তো বসতে পারতে।
ভিতরে অনেক লোক। জায়গা নেই। আমি আজই দিল্লি রওনা হচ্ছি।
গৌরীর আজ দিল্লি যাওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু মদন সে কথা জিজ্ঞেস করল না। গৌরী কেন পালাচ্ছে তা সে খানিকটা জানে। শুধু বলল, একা পারবে?
পারব। গরিবরা সব পারে।
গিয়ে কোথায় উঠবে?
আমার এক দূর সম্পর্কের দিদি থাকে কলকাজির কাছে। সেখানে উঠব।
বাচ্চারা?
নিচ্ছি না। দিদির বাসায় কীরকম রিসেপশন পাব জানি না তো! বাচ্চারা সঙ্গে থাকলে অসুবিধে।
মা ছাড়া ওদের অসুবিধে হবে না?
ওরা মাকে থোড়াই কেয়ার করে।
তোমার কষ্ট হবে না?
গৌরী একটু হাসল, মানুষ তো! একটু হবে! তবে সেটা সহ্য করা যাবে। ওসব সেন্টিমেন্ট নিয়ে আপনি ভাবলেন না। আমি এখন পালাতে চাই। পরে সুযোগ-সুবিধে বুঝে ছেলেমেয়েকে নিয়ে যাব।
চারদিকে আজকাল খুব বউ পালাচ্ছে। খুব দুশ্চিন্তার কথা। মদন ফিচেল হাসি হেসে বলে, আর নবর জন্য মন কেমন করবে না? নব যদি বাড়ি ফিরে দেখে, তুমি নেই, তা হলে?
গৌরী কেমন বিবশ হয়ে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, কার জন্য এতকাল মন কেমন করেছে তা কি এম পি সাহেব জানেন?
না। কার জন্য গৌরী?
দিল্লিতে গিয়ে বলব।
নবর কাছে আর কখনও ফিরে আসবে না গৌরী?
নব আমার কে? ওর কাছে ফিরে আসব কেন?
নব যদি ভাবে তুমি আমার সঙ্গে পালিয়ে গেছ?
আমি কার সঙ্গে পালালাম তাতে ওর বড় বয়েই গেল।
তা ঠিক। তবে প্রেস্টিজের ব্যাপারও তো আছে। বউ পালালে কোনও পুরুষ খুশি হয়?
আমি তো চাকরি করতে যাচ্ছি। পালাচ্ছি কে বলল?
তুমিই তো এইমাত্র বললে!
সে আপনার কাছে সত্যি কথাটা বললাম, ওর বাড়ির লোক অন্যরকম জানে।
মদন একটু গম্ভীর হয়ে বলে, ব্যাপারটা একটু জটিল হয়ে গেল।
গৌরী উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, কিচ্ছু জটিল হয়নি মদনদা। এটাই সবচেয়ে ভাল হয়েছে। আপনি চলে আসার পর আমি অনেকক্ষণ ধরে ভাবলাম।
মদন ফিচিক করে হেসে বলে, বুড়ি তোমাকে খুব ধোয়াচ্ছিল।
আপনিই তো দুষ্টুমি করে লাগিয়ে দিয়ে এলেন। তবে ওসব শুনতে শুনতে আমার অনুভূতি ভোতা হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে পাথর হয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আজ হঠাৎ সব অন্যরকম হয়ে গেল। পাষাণী অহল্যাকে জাগাতে রামচন্দ্র এলেন। আজ আপনি যেই গেলেন অমনি ভিতরে সব ঘুমন্ত বোধ জেগে উঠল। দুঃখ, অপমান, হতাশা, সেইসঙ্গে ভালভাবে বাঁচার ইচ্ছে। অন্ধকারে থেকে থেকে আলোর কথা ভুলে গিয়েছিলাম। আজ হঠাৎ আলো দেখে বুঝতে পারলাম, কী অন্ধকারেই না পড়ে আছি।
আমি কি তোমার আলো গৌরী? আবার রামচন্দ্রও?
গৌরী এই প্রকাশ্য ফুটপাতে, চারদিকে চলন্ত লোকজনের ভিড়েও কেমন বিহ্বল হয়ে গেল। আবেগে ঠোঁট কাপল, গলা রুদ্ধ হয়ে গেল। কোনওক্রমে বলল, আলো! আপনি ছাড়া আমার জীবনে আর কোনও আলো নেই।
এ কথায় খুব হোঃ হোর করে হাসতে ইচ্ছে করছিল মদনের। বদলে সে আচমকা গম্ভীর হয়ে গেল। মৃদুস্বরে বলল, তোমার জীবনে আর একটা আলো ছিল গৌরী। আমি জানি।
গৌরীর স্বপ্নাচ্ছন্ন মুখ থেকে স্বপ্নের ক্রিমটুকু কে মুছে নিল। একটা ঢোক গিলল সে। মাটির দিকে চেয়ে বলল, আপনি কখনও অতীতকে ভোলেন না কেন এম পি সাহেব?
মদন তেতো একটু হেসে বলে, ভুলতে পারি না গৌরী। আমার যে কেন সব মনে থাকে! আর তার জন্যই মাঝে মাঝে কষ্ট পাই।
গৌরী যখন মুখ তুলল তখন তার চোখ ছলছল করছে। একটু ধরা গলায় বলল, আপনি কি এখনও নীলুকে হিংসে করেন? আমার জন্য?
মদন গম্ভীর গলায় বলে, নীলুকে হিংসে করব কেন গৌরী? নীলুর এমন কী ছিল যাকে হিংসে করা যায়?
গৌরী মাথা নেড়ে বলল, আমিও তো তাই ভেবে অবাক হচ্ছিলাম। নীলু কোনওদিন আমাকে ফিরেও দেখেনি। নীলুকে কেন আপনি হিংসে করবেন?
মদন মাথা নেড়ে বলে, নীলুকে হিংসে করি না গৌরী, শুধু জীবনের সত্য দিকগুলির দিকে তোমার চোখ ফিরিয়ে দিতে চাই। তোমার জীবনের আলো ছিল নীলু। বিয়ে করার জন্য তাকে তুমি অনেক জ্বালিয়েছ। বিষ খাবে বলে ভয় দেখিয়েছ। নীলুর ওপর শোধ নিতেই কি তুমি নবর সঙ্গে ঝুলেছিলে? নীলু অন্তত তাই বলত।
ওসব কথা থাক মদনদা। আজ থাক। নীলু তো বেঁচে নেই।
মদন একটু হাসল, আস্তে করে বলল, কিংবা হয়তো খুব বেশি বেঁচে আছে।
নীলুর জন্য আমাকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে মদনা, সে আমার আলো হবে কেন?
মদন চুপ করে রইল। মুখটা গম্ভীর।
গৌরী হঠাৎ নিচু হয়ে তাকে একটা প্রণাম করে বলল, আমার গাড়ির সময় হয়ে গেছে। আমি আসি।
টিনের সুটকেসটা তুলে নিয়ে গৌরী নিরাশ্রয় অসহায়ের মতো যখন রাস্তাটা পেরিয়ে গেল তখন মদনের ভারী কষ্ট হল গৌরীর জন্য।
এতক্ষণ এম পি ছিল না মদন, দিদির বাসার বাইরের ঘরে পা দিয়েই হল। কণা নামে একজন মহিলা বসে আছেন। স্বামী দুশ্চরিত্র। ঘ্যানর ঘ্যানর অনেক কথা শুনে যেতে হল তাকে। আশ্বাস দিল গিয়েই ব্যবস্থা করবে।
সারাক্ষণ ভারী ক্লান্ত লাগছে তার। স্কচের বোতল খুলে বসে আছে মাধব। গিয়ে এক্ষুনি ড়ুব দিতে হবে। সব ভুলে যেতে হবে, ভাসিয়ে দিতে হবে। সে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করল। তারপর জামাকাপড় পালটে বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরল একটা।
.
সহদেব বিশ্বাস তার ওকালতির চেম্বারে চেয়ারে হাঁটু তুলে বসা, মাথায় টাক, মুখে ক্ষুরধার বিষয়বুদ্ধি। খুব পসারের সময়েই ওকালতি ছেড়ে দিয়েছে। এখন কালেভদ্রে উপরোধে বা পার্টির দরকারে কেস করে। তার চেয়ারের দু’ধারে কেঁদো বাঘের মতো দুই রুস্তম বসে আছে। তাদের গায়ের টি শার্ট ছিড়ে শরীরের মাসল ঠিকরে বেরোচ্ছে, মুগুরের মতো হাত, খোলা জামা দিয়ে বুকের ঘন লোম দেখা যাচ্ছে। দু’জনেরই চোখ নবর দিকে স্থির। দুজনকেই চেনে নব। বেলেঘাটার বিখ্যাত মস্তান যমজ দুই ভাই কেলো আর বিশে। দিনকাল পালটে গেছে, এখন মস্তানরা লিডারদের দেখে, লিডাররা দেখে মস্তানদের। কিন্তু ফালতু ব্যাপারে নবর মনোেযাগ দেওয়ার সময় নেই। তিন জায়গায় ঠোক্কর খেয়ে সে সহদেব বিশ্বাসের কাছে আসতে পেরেছে।
সহদেব মৃদু স্বরে কথা বলছিল। শোকতাপা মানুষকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো গলায়। নব অবশ্য সান্ত্বনা পাচ্ছে না। সহদেব বলল, এ সময়ে পলিটিক্যাল শেলটার দেওয়ার অনেক ঝুঁকি আছে হে নব। আজই পার্টির মিটিং-এ বিরাট ব্যাপার হয়ে গেছে। আজ হোক, কাল হোক, দল ভাঙছে। স্টেট সেক্রেটারি, প্রেসিডেন্ট, আরও অনেক লিডার রেজিগনেশন দিয়েছে। এখন আমরা রিস্ক নিতে চাই না।
রিস্ক কীসের?
তুমি কনডেমনড খুনি। শেলটার দিলে হাজার রকমের প্রশ্ন উঠবে।
কিন্তু পুলিশ তা হলে আমাকে পালাতে দিল কেন?
সহদেব বিচক্ষণ একটু হেসে বলে, কথাটা দু’বার বললে, ওটা তোমার ভুল ধারণা। পুলিশ তোমাকে পালাতে দেয়নি। কোনও কারণে গার্ডরা অন্যমনস্ক ছিল। তুমি সেই সুযোগটাকেই মনে করছ গটআপ ব্যাপার।
নব কথা না বাড়িয়ে অধৈর্যভাবে কাধ কঁকিয়ে বলে, ঠিক আছে। কিন্তু এখন আমি কী করব?
গা ঢাকা দিয়ে থাকো যদি পারো।
কতদিন?
যতদিন না ভাঙচুরটা ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছে।
নিত্যদার কাছে গেলে কিছু হবে?
নিত্যদা খুব ব্যস্ত। আজ রাতেই বোধহয় উনি পার্টির সেক্রেটারি হচ্ছেন। মিটিং চলছে। তোমাকে সময় দিতে পারবেন না।
আমার সঙ্গে পার্টির যে লোক দেখা করেছিল জেলখানায়, যে বলেছিল—
সহদেব সহজে ধৈর্য হারায় না। এখনও হারাল না, মৃদু হাসি হেসে বলে, সে কেন দেখা কবেছে তা সে-ই জানে। দল থেকে তাকে পাঠানো হয়নি।
নব টেবিলে ভর রেখে ঠান্ডা গলায় বলে, আপনি তো জানেন পলিটিক্যাল শেলটার না পেলে পুলিশ আমাকে কুকুরের মতো খুঁজে বের করবেই। এ বাজারে পলিটিক্যাল পার্টি ছাড়া কেউ আমাকে কোনও প্রােটেকশন দিতে পারবে না। আপনি এও তো জানেন সহদেবদা, আমি মাগনা প্রােটেকশন চাইছি না। কোনও শালা কখনও আমার জন্য মাগনা কিছু করেওনি। প্রােটেকশন দিলে কাজ করে দেব, দরকার হলে লাইফের রিস্ক নিয়েই।
কেলো আর বিশে তাকাতাকি করে নেয়। তারপর আবার নবর দিকে স্থির চোখে চেয়ে থাকে।
সহদেব হাতের নখ খুঁটতে খুঁটতে বলে, সবই জানি। কিন্তু শেলটার বা প্রােটেকশন কোনওটাই দেওয়া এখন সহজ নয়। আমাদের সময়টা খারাপ যাচ্ছে।
নব ধৈর্য হারাচ্ছিল। সে বেশিক্ষণ গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। বেশি কথা বলার দমও তার নেই। একটু গরম হয়ে বলে, নীলু হাজরার কেসটায় আমাকে ফাসানো হয়েছিল, আপনি জানেন? নীলুকে আমি মারিনি।
কেলো আর বিশে আর-একবার তাকাতাকি করে, চোখের কোণ দিয়ে সেটা লক্ষ করে নব।
সহদেব নির্বিকারভাবে জিজ্ঞেস করে, কে তোমাকে ফাসিয়েছিল?
নাম বলে লাভ কী? আপনারা তো জানেন।
সহদেব বুঝদারের মতো মাথা নেড়ে বলে, তাতেও আমাদের কিছু করার নেই।
নব একটু হেসে বলে, করার অনেক আছে, কিন্তু আপনারা করবেন না। ঠিক আছে, আমি আমার। রাস্তা করে নেব।
বলে নব ওঠে। সহদেব নিজের হাতের দিকে চেয়ে বসে থাকে।
বাইরে দেয়ালে ঠেস দিয়ে পাজামা পাঞ্জাবি পরা জয় তখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে ক্লান্তি, চোখে ভয়। ইচ্ছে করলে সে নবর হাত এড়িয়ে এতক্ষণে পালিয়ে যেতে পারত। কিন্তু সে এও জানে, পালিয়ে কোনও লাভ নেই। নব তাকে খুঁজে বের করবেই।
জয় বলল, কিছু হল?
নব রক্তঝরা চোখে চেয়ে বলল, খানকির ছেলেরা ফেঁটা কেটে বোষ্টম সাজছে।
তোমার সঙ্গে জেলখানায় যে দেখা করেছিল তাকে তুমি ঠিক চেনো?
আলবত। শালা কোথায় যে গায়েব হয়ে গেল!
দু’জনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতেই পেছন থেকে কেলো বেরিয়ে এসে সোডার বোতল খোলার মতো শিসটানা গলায় ডাকল, নব।
নব ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো ঘুরে দাঁড়ায়।
কেলো পাহাড়ের মতো দরজায় দাঁড়ানো। কোমরে হাত, এরকম বিশাল চেহারা সচরাচর চোখে পড়ে না। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, শোন।
নব সতর্কভাবে কাছে এগিয়ে যায়, কী বলছ?
কথা আছে।-বলে নবর একটা হাত শক্ত করে ধরে ভিতরে নিয়ে যায়।
ঘরে এখন সহদেব নেই। শুধু কেলো আর বিশে। বিশের হাতে খোলা ছ’ঘরা রিভলবার।
কেলো রুমাল দিয়ে টাকের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, একটা কাজ আছে। কিন্তু এর মধ্যে পার্টি নেই।
প্যাঁচ মেরো না। কেস করতে হবে তো? বললা। কিন্তু তার আগে বলো, শেলটার দেবে কি না।
কেসটা কর। দেখা যাবে।
তোমাদের কথায় হবে না। আমাকে কোনও লিডারের সঙ্গে লাইন করে দাও।
লিডাররা এর মধ্যে নেই।
সহদেবদা নিজের মুখে বলুক তা হলে।
সহদেবদা বলবে না। আমরাই বলছি। রাজি থাকলে বল, না হয় তো কেটে পড়।
নব করাল চোখে দুই যমজ ভাইকে দেখে নিল। আপাতত তার কিছু করার নেই। তারা উভয়পক্ষই যে দুনিয়ায় ঘুরে বেড়ায় তাতে কেউ কাউকে ফালতু ভয় খেয়ে সময় বা শরীর নষ্ট করে না। কাটে কাটে পড়ে গেলে কে কার লাশ নামাবে তার কোনও ঠিক নেই। তবে নব একটু টাইট জায়গায় আছে বটে। সে বলল, ফালতু বাত ছাড়ো কেলোদা, কেস আমি করে দেব, সে তোমরা জাননা। কিন্তু তারপর কী?
কেলো নির্বিকারভাবে বলে, কেস হয়ে গেলে বাড়ি গিয়ে বসে থাকবি।
বাড়িতে লালবাজারের খোঁচড়েরা নেই?
অন্য জায়গায় তোর ঠেক আছে?
আছে।
তা হলে সেইখানেই চলে যা। পরশু পার্টি অফিসে দুপুরের পর দেখা করিস।
কিছু মালকড়ি ছাড়ো কেনোদা।
কেলো একটু হাসল, তুই মালকড়ি ছাড়া নড়বি না তা জানি। বোস, ব্যাপারটা বুঝে নে। সঙ্গের ছোকরাটা কে?
ফালতু। কেলো একটু গম্ভীর মুখ করে মোটা আঙুল মুখে পুরে সঁতের ফাঁক থেকে বোধহয় দুপুরের খাওয়া মাংসের আঁশ বের করে আনল। তারপর চোখ ছোট করে বলল, বিশে বলবে। শুনে নে।