Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নীলমূর্তি রহস্য (১৯৯২) || Sunil Gangopadhyay » Page 9

নীলমূর্তি রহস্য (১৯৯২) || Sunil Gangopadhyay

স্টেশন থেকে বেরোবার সময় সন্তু লক্ষ করল, এটা সম্বলপুর স্টেশন নয়। যদিও ট্রেনের খাকি পোশাক পরা লোকটি বলেছিল, তাদের সম্বলপুরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই জায়গাটার নাম ধওলাগড়। ছোট স্টেশন, তার বাইরে সুরকির রাস্তা। সেখানে দু-তিনটি সাইকেল রিকশা আর-একটা টাঙ্গা দাঁড়িয়ে। সন্তু আগে থেকেই বুঝতে পারল, টাঙ্গাটা এসেছে তাদের জন্যই। সাধারণ ভাড়ার টাঙ্গা নয়। বেশ ঝকমকে তকতকে, ঘোড়াটিও বেশ তেজী।

সিল্কের পাঞ্জাবি পরা লর্ড নামের লোকটি সামনের দিকে উঠে বসল গাড়োয়ানের সামনে। দুবার শিস দিয়ে ডাকল, টম! টম! কুকুরটি এক লাফ দিয়ে চলে এল তার পাশে। তারপর লর্ড সন্তু আর জোজোদের দিকে। ফিরে বলল, তোমরা ভাই পেছন দিকে উঠে পড়ো।

সন্তু উঠতে যাচ্ছিল, জোজো তার হাত ধরে টেনে নামাল। তারপর সে সামনের দিকে এসে জিজ্ঞেস করল, আপনি যে আমাদের নিতে স্টেশনে এসেছেন, আপনাকে কে পাঠিয়েছে?

লর্ড বলল, কেউ তো পাঠায়নি, আমি নিজেই এসেছি।

জোজো বলল, আপনি কী করে জানলেন আমরা এই ট্রেনে আসব? আমাদের দুজনের নামই বা জানলেন কী করে?

এসব সামান্য ব্যাপার জানা এমন কী শক্ত? মানুষের নামের সঙ্গে চেহারার খুব মিল থাকে। তোমার নাম জোজো, তোমাকে দেখলেই বোঝা যায়, তোমার নাম কিছুতেই সন্তু হতে পারে না। আর তোমার বন্ধুটিকে দেখলে বোঝা যায় সে খুব শান্ত-শিষ্ট ছেলে, তাই তার নাম সন্তু! আর আমাকে দেখলেই কি মনে হয় না, আমার নাম লর্ড?

এই কথা বলে সে হেসে উঠল হা-হা করে। জোজো কিন্তু হাসল না, ভুরু কুঁচকে বলল, সরি, আমার তা মনে হয়নি। যাই হোক, আপনি এখন আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?

লর্ড বলল, ওই যে বললাম, তোমার পিসেমশাই আর ওর কাকাবাবুর কাছে! অর্থাৎ মিঃ অংশুমান চৌধুরী আর মিস্টার রাজা রায়চৌধুরীর কাছে।

ওঁরা দুজনে একই জায়গায় আছেন?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই!

আই ডোন্ট বিলিভ ইউ?

তারপর সে সন্তুর দিকে তাকিয়ে বলল, সাউন্ডস ভেরি ফিসি, বুঝলি? আমার পিসেমশাই আর তোর কাকাবাবু একই জায়গায় রয়েছেন। এটা বিশ্বাস করা যায়?

পকেট থেকে একটা দামি সিগারেটের প্যাকেট বার করে ধরাতে ধরাতে লর্ড বলল, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কী আছে? আমার সঙ্গে গেলেই তো দেখতে পাবে।

জোজো বলল, আমরা যদি আপনার সঙ্গে না যেতে চাই?

লর্ড ভুরু তুলে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে তাকিয়ে রইল জোজোর দিকে। গাড়োয়ানটির দিকে ফিরে দুর্বোধ্য ভাষায় কী সব বলল। তারপর আবার জোজোর দিকে ফিরে বলল, না যদি যেতে চাও, তা হলে কী আর জোর করে ধরে নিয়ে যাব? মিঃ রায়চৌধুরী আর মিঃ চৌধুরী বললেন, এই ছেলেদুটি বেড়াতে ভালবাসে, আজ বিকেলবেলা জঙ্গলে যাওয়া হবে…

জোজো জিজ্ঞেস করল, আপনি বলুন তো, অংশুমান চৌধুরীকে কী রকম দেখতে?

লর্ড আবার শব্দ করে হেসে উঠে বলল, পরীক্ষা করা হচ্ছে আমাকে? এ তো বেশ মজার ব্যাপার! আমার কত কাজ নষ্ট করে তোমাদের নিতে এলুম। এখানে, আর এখন আমাকেই তোমরা অবিশ্বাস করছ? মিঃ অংশুমান চৌধুরী বেশ লম্বা, আমার চেয়েও লম্বা, গায়ের রং ফর্সা, মাথায় একটা টুপি, সেই টুপিটা খুললেই অমনি দেখা গেল মাথায় একটাও চুল নেই!

জোজো সন্তুর চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল, কী রে, কী করবি?

সন্তু বলল, চল, যাওয়া যাক?

দুজনে উঠে বসল টাঙ্গার পেছনে। সেটা একটু বাদেই বেশ জোরে দৌড়তে লাগল। রাস্তা ভাল নয়। ঝাঁকুনির চোটে ওদের লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে হচ্ছে।

সেই অবস্থাতেই জোজো সন্তুর কাছে ফিসফিস করে বলল, এই লোকটা নিঘাত স্পাই?

সন্তু জিজ্ঞেস করল কাদের স্পাই?

তা জানি না। তবে স্পাই হতে বাধ্য। দেখছিস না, কী রকম পলিণ্ড চেহারা, আর মিটিমিটি হাসছে।

স্পাইরা সিল্কের জামা পরে মিটিমিটি হাসে কি না, সে সম্পর্কে সন্তুর কোনও ধারণা নেই। জোজো তো যাকে-তাকে যখন-তখন স্পাই বানিয়ে ফেলে। তবে একটা জিনিস অদ্ভুত লাগছে। এ-পর্যন্ত কেউ তার ওপর একবারও জোর জবরদস্তি করেনি। প্রথমে যে লোকদুটো কাকাবাবুর নাম করে তাকে ডেকে নিয়ে গেল, তাদের অবিশ্বাস করে সন্তু তো না যেতেও পারত! তারপর হাওড়া স্টেশনে আসা, ট্রেনে ওঠা…কেউই তাকে জোর করে আনেনি। অবশ্য জোজোকে এরা অজ্ঞান করে এনেছে। সত্যি কি পিঠের মধ্যে কিংবা জোজোর হাতে সিরিঞ্জ ফুটিয়ে অজ্ঞান করে দিয়েছিল? মুশকিল হচ্ছে, জোজোর মুখ থেকে ঠিক ঠিক ঘটনাটি জানাই শক্ত।

টাঙ্গাটা যে রাস্তা দিয়ে চলছে, সেদিকে কোনও বাড়ি-ঘর নেই। ফাঁকা এবড়ো-খেবড়ো মাঠ। দূরে একটা পাহাড়ের রেখা। এরা কোথায় চলেছে কে জানে!

একটা জায়গায় দেখা গেল কয়েকটা দোকানপাট। সেখানে টাঙ্গাটা থেমে গেল হঠাৎ। লর্ড পেছন ফিরে বলল, এখানে খুব ভাল জিলিপি পাওয়া যায়। একটু জিলিপি, খাওয়া যাক, কী বলে? তোমাদের নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে?

রাত্তিরে ভাত-টাত কিছু খাওয়া হয়নি। দুএকটা মাত্র স্যান্ডউইচ। সন্তুর খিদে পেয়েছে খুবই। জিলিপির নাম শুনেই যেন তার খিদে আরও বেড়ে গেল।

লর্ড নেমে পড়ল জিলিপি নেওয়ার জন্য। তার কুকুরটাও লাফ দিয়ে নামল তার সঙ্গে সঙ্গে। এত বড় চেহারার একটা কুকুর। কিন্তু মুখ দিয়ে কোনও শব্দ করে না। শুধু সে খুব জোরে জোরে ল্যাজ নাড়ে।

জিলিপি ভাজার গন্ধ নাকে আসছে। জোজো হঠাৎ বলল, ওই দ্যাখ সন্তু! রাস্তার ওপাশের বাড়িটা?

সেটা একটা একতলা টালির বাড়ি। তার গায়ে ইংরেজিতে লেখা পুলিশ চৌকি। সামনে একটা ভাঙা লরি দাঁড়িয়ে আছে।

জোজো বলল, ওই তো থানা। ওখানে একটা খবর দিতে হবে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, থানায় কী বলবি?

জোজো সে কথার কোনও উত্তর না দিয়ে তোক করে নেমে গেল টাঙ্গা থেকে। সন্তু নামল না। থানায় গিয়ে কী বলা হবে? এই লোকটা তাদের জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে? এ কথা শুনলে পুলিশরা হাসবে না? যারা জোর করে নিয়ে যায়, তারা কখনও থানার কাছে গাড়ি থামিয়ে জিনিস কেনে?

জোজো বেশি দূর যেতে পারল না। রাস্তাটা পার হতেই টম তীব্রভাবে ছুটে গিয়ে সোজা তার বুকের ওপর দুটো থাবা মেলে দাঁড়াল। জোজো চেঁচিয়ে উঠল,ওরে বাবারে, ওরে বাবারে, সেইভ মি! সেইভ মি!

লর্ড দৌড়ে যেতে যেতে হুকুমের সুরে বলল, টম, টম, কাম ব্যাক! কাম হিয়ার!.

প্রভুর হুকুম শুনে টম ছেড়ে দিল জোজোকে। ততক্ষণে সন্তুও নেমে পড়েছে। টমকে দেখেই সে বুঝতে পেরেছে, খুব ট্রেনিং পাওয়া কুকুর। সহজে কামড়াবে না, শুধু ভয় দেখাবে।

লর্ড জোজোকে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার, হঠাৎ তুমি দৌড়তে গেলে কেন? টম কারও দৌড়নো পছন্দ করে না।

জোজো বলল, আমার ছোট বাথরুম পেয়েছে।

লর্ড হেসে বলল, ও, এই ব্যাপার! তা আমাকে আগে বললেই হত। ওই যে বড় গাছটা দেখা যাচ্ছে, তার পাশ দিয়ে মাঠে নেমে যাও। আস্তে-আস্তে যাও, দৌড়বার দরকার নেই।

টম সন্তুর কাছে এসে তার গায়ের গন্ধ শুঁকে তারপর সন্তুর উরুতে মাথা ঘষতে লাগল। যেন সে সন্তুর কাছ থেকে আদর চাইছে। সন্তু তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।

লর্ড জিজ্ঞেস করল, তোমার বাড়িতে কুকুর আছে বুঝি?

সন্তু মাথা হেলিয়ে বলল, হ্যাঁ।

তোমার গায়ের গন্ধ শুঁকে টম ঠিক টের পেয়েছে। তুমি যখন কুকুর ভালবাস, তোমার সঙ্গে টমের খুব সহজেই বন্ধুত্ব হয়ে যাবে। চলো জিলিপি খেতে শুরু করি!

জোজো একটু বাদে ফিরে এল। সন্তু লক্ষ করল, জোজো থানায় ঢুকল। জিলিপি খাওয়ার পর্ব শেষ হওয়ার পর ওরা আবার চাপল টাঙ্গায়।

চলতে শুরু করে জোজো বলল, তুই ভাবিস না, আমি কুকুরটাকে দেখে ভয় পেয়েছি। ওটা আমার অভিনয়, বুঝলি। স্রেফ অভিনয়। আসলে আমি শেষ মুহূর্তে মাইন্ড চেঞ্জ করলুম। ভেবে দেখলুম, থানায় গিয়ে কী হবে? এই মিস্ট্রিটা আমরাই সম্ভ করব। তুই আর আমি, পুলিশের সাহায্যের কোনও দরকার নেই। সম্বলপুর কোন্ স্টেটের মধ্যে রে?

ওড়িশায়?

ওঃ, তবে তো কোনও চিন্তার নেই। ওড়িশার পুলিশের একজন আই, জি, আমার ছোট কাকার বন্ধু। আমাদের বাড়িতে কতবার এসেছেন। একবার তাঁকে খবর পাঠালেই…তাঁর নাম শুনলেই এরা ঘাবড়ে যাবে।

কী নাম তাঁর?

চুপ! এখন বলব না, এই লোকটাকে এক্ষুনি কিছু জানাবার দরকার নেই। তুই ঘাবড়ানি, সন্তু, আমি যখন সঙ্গে আছি, তোর কোনও চিন্তা নেই।

ভাগ্যিস তুই এই কথাটা বললি, জোজো। সত্যি আমি একটু একটু ঘাবড়ে যাচ্ছিলাম।

আর আধঘণ্টা পরে টাঙ্গাটা এসে থামল একটা বাগানবাড়ির সামনে। দোতলা সাদা রঙের বাড়ি, অনেক কালের পুরনো, কোথাও কোথাও দেওয়াল ভেঙে পড়েছে। বাগানটারও বিশেষ যত্ন নেই।

টাঙ্গা থামতেই টম লাফিয়ে পড়ে ছুটে গেল বাগানের মধ্যে। সেখানে আর দুটো ছোটখাটো চেহারার কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছিল। নিশ্চয়ই বাইরের কুকুর, টমকে দেখেই তারা ল্যাজ গুটিয়ে পালাল।

জোজো লর্ডকে জিজ্ঞেস করল, আমার পিসেমশাই এই বাড়িতে রয়েছেন?

লর্ড বলল, হ্যাঁ, সেই রকমই তো কথা!

ইমপসিবল! এখানে এত কুকুর! ইউ আর এ লায়ার!

এবারে রেগে গেল লর্ড। তার ঠোঁট থেকে হাসি মুছে গেল। সে কড়া গলায় বলল, কী, তুমি আমাকে লায়ার বললে? ঠিক আছে, বিশ্বাস করতে না চাও, এসো না। তোমাকে কি আমি ধরে রেখেছি? তোমার যেখানে খুশি চলে যেতে পারো।

তারপর সে তো গটগট করে ঢুকে গেল বাড়ির মধ্যে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *