নীলবসনা সুন্দরী : পঞ্চম খণ্ড – ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – কণ্ঠহার
দেবেন্দ্রবিজয় চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া গিয়া সোৎসাহে ড্রয়ারগুলি টানিয়া দেখিতে লাগিলেন; সকলগুলিই চাবি-বন্ধ-একটাও খুলিতে পারিলেন না। তখন দেবেন্দ্রবিজয় একান্ত হতাশভাবে নিজের চেয়ারে বসিয়া বলিলেন, “না-সুবিধা হইল না দেখিতেছি, সকলগুলিই চাবি দেওয়া। তালা ভাঙ্গিয়া খানা-তল্লাসী করিবার অধিকার এখন আমার নাই।”
জোহেরা বলিল, “সে অধিকার থাকিলেও আপনি এ দেরাজ হইতে সেই কণ্ঠহার বাহির করিতে পারিবেন না। ইহাতে এমন একটি গুপ্তস্থান, তাহা কেহই জানে না, অথচ সেই গুপ্তস্থান বিনা চাবির সাহায্যে খুলিতে পারা যায়। যদি মুন্সী সাহেব কণ্ঠহার গোপন করিতে ইচ্ছা করিয়া থাকেন, খুব সম্ভব-সেই গুপ্তস্থানে রাখিয়া দিয়াছেন।”
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেরাজের আপনাদমস্তক নিরীক্ষণ করিতে করিতে দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এই দেরাজে এমন একটা গুপ্তস্থান আছে না কি?”
জোহেরা কহিল, “হাঁ, আমি একদিন সৃজান বিবির কাছে এই দেরাজের সুখ্যাতি শুনিয়াছিলাম। কথায় কথায় সৃজান বিবি সেই গুপ্তস্থানের কথা বলিয়া ফেলিলেন। সে গুপ্তস্থানের কথা বাড়ীর আর কেহই জানে না; এমন কি নিজে মুন্সী সাহেবও জানেন না। এ দেরাজটি সৃজান বিবির পিতার ছিল। কন্যার বিবাহের সময়ে তিনি কন্যাকে এই দেরাজটি পাঠাইয়া দিয়াছিলেন।”
হরিপ্রসন্ন বাবু কহিলেন, “সে গুপ্তস্থান কোথায়?”
জোহেরা কহিল, “তাহা আমি জানি না। সে গুপ্তস্থান কোথায়, কিরূপভাবে খুলিতে হয়, সে সম্বন্ধে সৃজান বিবি আমাকে কিছুতেই বলেন নাই। এই দেরাজের মধ্যে এমন একটা গুপ্তস্থান আছে, কেবল এই কথাই বলিয়াছেন।”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “তুমি নিজে অন্য কোন সময়ে সৃজান বিবির অসাক্ষাতে সেই গুপ্তস্থান খুঁজিয়া বাহির করিবার চেষ্টা করিয়াছিলে?”
জোহেরা কহিল, “হাঁ, দুই-তিন দিন করিয়াছিলাম; স্ত্রীলোকের মনে কৌতূহলের প্রভাব বড় বেশি; কিন্তু চেষ্টা সফল হয় নাই।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “ভাল আমি একবার চেষ্টা করিয়া দেখি; সেই গুপ্তস্থানের কথাটা যদি মিথ্যা না হয়, আমি ঠিক সন্ধান করিয়া বাহির করিব।” বলিয়া আসন ত্যাগ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “বৃথা পরিশ্রমের ফল কি, দেবেন্দ্র বাবু? যদি আপনি সন্ধান করিয়া বাহির করিতে পারেন, তাহাতে বিশেষ কি ফল হইবে? জোহেরা মুখেই ত শুনিলেন, এই সৃজান বিবি ছাড়া মুন্সী সাহেবও সে গুপ্তস্থানের কথা জানেন না-তাহা হইলে তিনি কিরূপে সেখানে সেই কণ্ঠহার রাখিবেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “পূর্ব্বে-বোধ হয়, মুন্সী সাহেব সে গুপ্তস্থানের কথা জানিতেন না; সম্ভব, পরে তিনি কোন রকমে জানিতে পারেন। একবার চেষ্টা করিয়া দেখিতে দোষ কি আছে? হয় ত সেই গুপ্তস্থানে এই সকল ড্রয়ার খুলিবার চাবি পাওয়া যাইতে পারে।”
দেবেন্দ্রবিজয় উঠিয়া দেরাজটির চারিদিক্ বিশেষ মনোযোগের সহিত দেখিতে লাগিলেন। সেই গুপ্তস্থান আবিষ্কারের কোন সুযোগ দেখিতে পাইলেন না। দেরাজের উপরে কাঠের উদ্ভিন্ন ফুললতামোড়ের অনেক কারুকার্য্য ছিল। পরিশেষে দেবেন্দ্রবিজয় সেইগুলি পরীক্ষা করিয়া দেখিতে আরম্ভ করিলেন। একস্থানে দেখিলেন, সেই সকল কাঠের ফুললতার মধ্যে একটা ফুল কিছু মলিন, বারংবার হাত লাগিলে পালিসের ঔজ্জ্বল্যের যেরূপ হ্রাস হয়, এবং একটা দাগ পড়িয়া যায়, সেই ফুলটিতে ঠিক সেই রকমের একটা দাগ পড়িয়া গিয়াছিল। দেখিয়া দেবেন্দ্রবিজয় মনে আশার সঞ্চার হইল। তিনি সেই কাঠের ফুলটি ঘুরাইয়া, ফিরাইয়া, টিপিয়া টানিয়া অনেক রকমে পরীক্ষা করিয়া দেখিতে লাগিলেন। কিছুতেই সেটা একটু সরিল না-নড়িল না। তথাপি তিনি হতাশ হইলেন না, সেই ফুলটি লইয়া তিনি ক্রমাগত নাড়াচাড়া করিতে লাগিলেন। বারংবার এইরূপ করিতে হঠাৎ একটা ‘ক্রিং’ শব্দ হইল; এবং সেই সঙ্গে সেই ফুলের পার্শ্বসংলগ্ন একটা কাঠের পাতা উল্টাইয়া ঝুলিয়া পড়িল; সেখানে একটি রূপার ছোট হাতল রহিয়াছে। দেখিয়া বুঝিতে পারিলেন, তাঁহার চেষ্টা সফল হইয়াছে-সেই হাতল ধরিয়া ধীরে ধীরে টানিতে লাগিলেন-নিঃশব্দে একটি ক্ষুদ্র ড্রয়ার বাহির হইল। দেবেন্দ্রবিজয় বিস্ময়ব্যাকুলনেত্রে দেখিলেন, সে ড্রয়ারের মধ্যে একছড়া হীরামুক্তাখচিত কণ্ঠহার-আরও একটা তীক্ষ্ণমুখ তীরের ফলা পড়িয়া রহিয়াছে। তা’ ছাড়া আর কিছুই নাই।