নীলবসনা সুন্দরী : পঞ্চম খণ্ড – পঞ্চম পরিচ্ছেদ – তদন্তে
মনিরুদ্দীনের বাটী হইতে মুন্সী জোহিরুদ্দীন সাহেবের বাটী বেশি দূরে নহে। এক বাড়ীর ছাদ হইতে অপর বাড়ী বেশ দেখা যায়। দেবেন্দ্রবিজয় অনতিবিলম্বে মুন্সী সাহেবের বাটীতে গিয়া উপনীত হইলেন। দ্বার-রক্ষক ভৃত্যের মুখে শুনিলেন, মুন্সী সাহেব তখন বাটীতে নাই-প্রাতেই বাহির হইয়া গিয়াছেন।
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “জোহেরা বিবি অভী কাঁহা হৈঁ? উন্কি সাথ্ মোলাকাৎ হো সক্তা হৈঁ?”
ভৃত্য বলিল, “জী হুজুর! হো সক্তা! উন্নে অভী উকীল বাবুকে সাথ্ বৈঠকখানামে বাত্চিৎ কর্তে হৈঁ।”
দেবেন্দ্রবিজয় দ্রুতপদে দ্বিতলে উঠিয়া বৈঠকখানা ঘরের দ্বার-সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন। গৃহমধ্যে জোহেরা ও বৃদ্ধ উকীল হরিপ্রসন্ন বাবু। দুইজনে দুইখানি চেয়ারে বসিয়া আছেন। সম্মুখস্থ টেবিলের উপরে অনেকগুলি কাগজ পত্র ছড়ান রহিয়াছে।
দেবেন্দ্রবিজয়কে দেখিয়া জোহেরা বলিয়া উঠিল, “এই যে আপনি আসিয়াছেন, ভালই হাইয়াছে। সৃজান বিবির খুনের সম্বন্ধে আমাদের কথাবার্ত্তা হইতেছিল। ঘটনা যেরূপ দেখিতেছি, তাহাতে আপনার সাহায্য বিশেষ আবশ্যক!”
দেবেন্দ্রবিজয় একখানি চেয়ার টানিয়া বসিয়া বলিলেন, “আমার দ্বারা আপনাদিগের যতদূর সাহায্য হইতে পারে, তাহা আমি সাগ্রহে করিব। আমারই ভ্রমে মজিদ খাঁ আজ বিপদ্গ্রস্ত; যাহাতে এখন তাঁহাকে উদ্ধার করিতে পারি, সেজন্য আমি সর্ব্বতোভাবে চেষ্টা করিব। তাঁহার এই বিপদে আমি যথেষ্ট অনুতপ্ত।”
হরিপ্রসন্নবাবু বলিলেন, “আপনি আপনার কর্ত্তব্য কর্ম করিয়াছেন, ইহাতে আর অনুতাপ কি? মজিদের বিরুদ্ধে যে সকল অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গিয়াছিল, তাহাতে আপনি কেন-সকলেই তাহাকে দোষী স্থির করিয়াছিল। এখন আবার মুন্সী সাহেবের বিরুদ্ধে যে সকল প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে-”
বাধা দিয়া দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “খুবই অকাট্য। মনিরুদ্দীন ও মজিদ খাঁ উভয়েই মুন্সী সাহেবকে তাঁহার পত্নীর অনুসরণ করিতে দেখিয়াছেন। বিশেষতঃ মজিদ খাঁ তাহাকে সৃজান বিবির গলা হইতে কণ্ঠহার ছিনাইয়া লইতে দেখিয়াছেন। ঘটনা খুব সত্য-তথাপি আমাদিগকে এ সম্বন্ধে দুই-একটা প্রমাণ সংগ্রহ করিতে হইবে। এখন আমাদিগকে সন্ধান করিয়া দেখিতে হইবে, মুন্সী সাহেব তাঁহার স্ত্রীর গলদেশ হইতে যে কণ্ঠহার ছিনাইয়া লইয়াছেন, কোথায় তাহা রাখিয়াছেন; তাহার পর যে বিষাক্ত ছুরিতে সৃজান বিবিকে হত্যা করিয়াছেন, তাহাও সন্ধান করিয়া বাহির করিবার চেষ্টা করিতে হইবে। সেই উদ্দেশ্যেই আমি তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছি।”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “কি আশ্চর্য্য! আপনি কি মনে করেন, খুনের এমন ভয়ানক প্রমাণগুলি তিনি নিজের সর্ব্বনাশ করিবার জন্য-এখনও নিজের কাছে রাখিয়াছেন? আমার ত ইহা বিশ্বাস হয় না।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “বিশ্বাস না হইবার কোন কারণ নাই। এই হত্যাপরাধটা যে তাঁহার স্কন্ধে পড়িবে, এমন সম্ভাবনা তাঁহার মনে একবারও হয় নাই-দৈবাৎ মনিরুদ্দীন ও মজিদ খাঁ অলক্ষ্যে তাঁহাকে সেইদিন মেহেদী-বাগানে দেখিয়াছেন-এইমাত্র। নিজে তিনি তাহাও জানেন না। তা’ যাহাই হউক, যদি তিনি ছুরিখানি না রাখিতে পারেন, কিন্তু সেই কণ্ঠহার – কণ্ঠহার নিশ্চয়ই তিনি কোনখানে লুকাইয়া রাখিয়াছেন।”
জোহেরা জিজ্ঞাসা করিল, “তাহার কারণ কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কণ্ঠহার লইয়া যে ভবিষ্যতে একটা গোলযোগ উপস্থিত হইবে, ইহা মুন্সী সাহেবের স্বপ্নাতীত। কে বিশেষ লক্ষ্য করিয়া দেখিতে গিয়ছে যে, সৃজান বিবি সেদিন রাত্রিতে কণ্ঠহার পরিয়া বাহির হইয়াছিল কি না?”
জোহেরা বলিল, “তিনি দিনরাত্রি সেই কণ্ঠহার পরিতেন। আমি তাঁহাকে সর্ব্বদাই সেই কণ্ঠহার গলায় রাখিতে দেখিয়াছি।”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “কণ্ঠহার ছড়াটা কিরূপ দেখিতে?”
জোহেরা বলিল, “সাবেক ধরণের; আজ-কাল সে রকম ধরণের কণ্ঠহার বড় একটা দেখিতে পাওয়া যায় না। বড় বড় হীরা-মুক্তা দিয়া পরিপাটী সাজান – দামও অনেক হইবে; মাঝখানে একখানা হীরার খুব বড় ধুক্ধুকী।”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “অনুমান করিয়া আপনি বলিতে পারেন, মুন্সী সাহেব এখন সেই কণ্ঠহার কোথায় রাখিয়াছেন?”
জোহেরা কহিল, “কোথায় তিনি রাখিয়াছেন, তিনিই জানেন; আমি কিরূপে বলিব? হয় ত নিজের শোবার ঘরে রাখিয়া থাকিবেন-কি এখানেও তিনি রাখিতে পারেন।”
দেবেন্দ্রবিজয় ও হরিপ্রসন্ন বাবু চমকিতভাবে বলিয়া উঠিলেন, “এখানে!”
জোহেরা বলিল, “হাঁ, এখানেও তিনি সেই কণ্ঠহার রাখিতে পারেন-এই ঘরেই তিনি সদাসর্ব্বদা বসেন। তাঁহার দলিল-দস্তাবেজ, জমিদারীর কাগজ-পত্র সকলেই এই দেরাজে রাখিয়া থাকেন; তাঁহার সেই সকল দরকারী কাগজ-পত্র কেহ হাত দিতে যাইবে না, মনে করিয়া তিনি ইহারই একটা টানার মধ্যে সেই কণ্ঠহার ছড়াটাও হয়ত রাখিয়াছেন।”
জোহেরা যে দেরাজটি তাঁহাদিগকে দেখাইয়া দিল, তেমন সুন্দর গঠনের প্রকাণ্ড দেরাজ এখন বড়-একটা দেখিতে পাওয়া যায় না-দৈর্ঘ্যে প্রায় ছাদতলস্পর্শী। উপর হইতে নীচ পর্য্যন্ত ছোট বড় অনেকগুলি ড্রয়ারে পরিশোভিত। এবং প্রত্যেক ড্রয়ারে দুইটি করিয়া উজ্জ্বল স্ফটিক-গোলক সংলগ্ন রহিয়াছে।