নীলবসনা সুন্দরী : দ্বিতীয় খণ্ড – তৃতীয় পরিচ্ছেদ – আত্মসংযম
মজিদ বজ্রস্তম্ভিত হইয়া গেলেন । তীক্ষ্ণকণ্ঠে জুজ্ঞাসা করিলেন, “কে আপনাকে বলিল ?”
দে । সে কথা পরে হইবে । মোবারকের সহিত সেখানে আপনার দেখা হইয়াছিল কি ?
ম । দেখা হইয়াছিল ।
দে । আপনি বরাবর এখানে না আসিয়া মেহেদী-বাগানে তখন কোন্ অভিপ্রায়ে গিয়াছিলেন ?
মজিদ একটু চিন্তিত হইলেন । ক্ষণপরে, “রাত্রি অধিক হইয়াছিল; পাছে সেই স্ত্রীলোকটি অন্ধকার রাত্রিতে পথ ভুল করে, অথবা কোন বিপদে পড়ে মনে করিয়া, আমি তাহার অনুসরণে মেহেদী-বাগানে গিয়েছিলাম । অনেকক্ষণ সন্ধান করিয়া তাহাকে আর দেখিতে পাইলাম না । সেখান হইতে ফিরিবার সময়ে মোবারক-উদ্দীনের সহিত সাক্ষাৎ হয় ।”
দে । পথে বাহির হইয়া আপনি কি আর সেই স্ত্রীলোকটিকে একবারও দেখিতে পান নাই ?
ম । (নতমুখে) না,-আর তাহাকে দেখি নাই ।
দেবেন্দ্রবিজয় মনে মনে বুঝিলেন, কথাটা একেবারে মিথ্যা । মজিদের মুখের দিকে কঠিন দৃষ্টিনিক্ষেপপূর্ব্বক বলিলেন, “আমি আপনার নিকটে আমার সকল প্রশ্নের উত্তর পাইয়াছি; কিন্তু এখনও একটি বাকী আছে ।”
মজিদ বলিলেন, “কিছুই বাকী নাই; যাহা কিছু বলিবার সকলই আমি বলিয়াছি । যাহা অপ্রকাশ্য-তাহা বলি নাই । বলিতেও পারিব না ।”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসিলেন, “তাহা হইলে আপনি কিছুতেই সেই স্ত্রীলোকটির নাম বলিবেন না ?”
মজিদ দৃঢ়স্বরে কহিলেন, “কিছুতেই না ।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনি অস্বীকার করিলে চলিবে না-গনির মা দেখিয়াছে, সেই স্ত্রীলোক দিলজান ।”
মজিদ বলিলেন, “আমি ত আপনাকে পূর্ব্বেই বলিয়াছি, গনির মার ভ্রম হইয়াছে ।”
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, সোজা অঙ্গুলিতে ঘৃত বাহির হইবে না । কর্ত্তৃত্বের তীক্ষ্ণকণ্ঠে কহিলেন, “আপনি জানেন, আমি মনে করিলে আপনাকে এখনই গ্রেপ্তার করিতে পারি ?”
মজিদ বলিলেন, “পারেন না । আমি কি করিয়াছি ?”
দেবেন্দ্রবিজয় দৃঢ়কণ্ঠে বলিলেন, “আপনিই দিলজানকে শেষ-জীবিত দেখিয়াছেন ।”
মজিদ বলিলেন, “আমি অস্বীকার করিব ।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “অস্বীকার করিলে চলিবে না; গনির মা তাহা সপ্রমাণ করিবে ।”
অত্যন্ত বিরক্তির সহিত অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া মজিদ বলিলেন, “তাহাই তাহাকে করিতে বলিবেন ! ”
মজিদের এইরূপ অপূর্ব্ব আত্মসংযম ও দৃঢ়তা দেখিয়া দেবেন্দ্রবিজয় মনে মনে অত্য্ন্ত রুষ্ট হইলেন । বলিলেন, “আপনি বড় ভাল কাজ করিতেছেন না; আপনাকেই ইহার ফলভোগ করিতে হইবে ।”
মজিদ খাঁ সেইরূপ দৃঢ়স্বরে বলিলেন, “তাহাতে আমি রাজি আছি । যাহা আমি করিতেছি, ভাল কি মন্দ বিবেচনা করার ক্ষমতা আমার নিজের যথেষ্ট আছে; আপনার নিকটে সে পরামর্শ আমি চাহি না ।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তাহা হইলে আপনি গত বুধবার রাত্রিতে মনিরুদ্দীনের বাড়ী হইতে বাহির হইয়া নিজের বাসায় ফিরিবার পূর্ব্বে কোথায় গিয়াছিলেন, কি করিয়াছিলেন, সে সকল কথা কিছুতেই কি আমার কাছে প্রকাশ করিবেন না ?”
মজিদ বলিলেন, “কিছুতেই না ।”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “সময়ে আপনাকে সকলই প্রকাশ করিতে হইবে ।”
মজিদ বলিলেন, “যখন করিতে হইবে-করিব ।”
দেবেন্দ্রবিজয় উঠিলেন । মজিদের বিনত মুখের দিকে একবার তীক্ষ্ণদৃষ্টিক্ষেপ করিয়া বলিলেন, “সেই কথাই ভাল । আমি আপনাকে সহজে ছাড়িব না ।” বলিয়া তিনি সেই কক্ষ ত্যাগ করিয়া বাহিরে আসিলেন ।
পথিমধ্যে আসিয়া আপন মনে অস্ফুটস্বরে বলিলেন, “আমার অনুমান ঠিক, মজিদ বড় সহজ লোক নহে; খুনের সকল খবরই মজিদ জানে; কিন্তু সে সকল কথা সহজে তাহার কাছে পাওয়া যাইবে না-আমিও সহজে ছড়িব না; দেখা যাউক, কোথাকার জল কোথায় দাঁড়ায় । এখন মজিদকে নজরের উপরে রাখিতে হইবে, কিছুতেই চোখের বাহির করা হইবে না । ধূর্ত্ত শ্রীশ ছোঁড়াটাকে এইবার দরকার হইবে দেখিতেছি ।”