Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

পুরন্দর চৌধুরী আবার বলতে লাগলেন

পুরন্দর চৌধুরী আবার বলতে লাগলেন।

মাসখানেকের মধ্যেই পুরন্দর চৌধুরী দেখলেন এবং বুঝতেও পারলেন, লিং সিংয়ের দোকানটা বাইরে থেকে একটা কিউরিও শপ মনে হলেও এবং সেখানে বহু বিচিত্র খরিদ্দারদের নিত্য আনাগোনা থাকলেও, আসলে সেটা একটা দুষ্প্রাপ্য অথচ রহস্যপূর্ণ চোরাই মাদক দ্রব্য কারবারেরই আড্ডা।

লিং সিংয়ের কিউরিওর বেচা-কেনাটা একটা আসলে বাইরের ঠাট মাত্র। এবং চোরাই মাদক দ্রব্যের কারবারটাই ছিল লিং সিংয়ের আসল কারবার। কিন্তু সদা সতর্ক ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেও পুরন্দর কিন্তু অনেকদিন পর্যন্ত জানতেই পারেননি যে, লিং সিংয়ের সেই মাদক দ্রব্যটি আসলে কি? এবং কোথায় তা রাখা হয় বা কি ভাবে বিক্রি করা হয়।

মধ্যে মধ্যে পুরন্দর কেবল শুনতেন, এক-আধজন খরিদ্দার এসে বলত আসল সিঙ্গাপুরী মুক্তা চায়।…

লিং সিং তখন তাঁকে দোতলায় তার শয়নঘরের সংলগ্ন ছোট্ট একটি কামরার মধ্যে, ডেকে নিয়ে গিয়ে কামরার দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিত। মিনিট পনের-কুড়ি পরে খরিদ্দার ও লিং সিং কামরা থেকে বের হয়ে আসত।

অবশেষে পুরন্দরের কেমন যেন সন্দেহ হয় ঐ সিঙ্গাপুরী মুক্তার মধ্যে নিশ্চয়ই কোন রহস্য রয়েছে। নচেৎ ঐ মুক্তার ব্যাপারে লিং সিংয়ের অত সতর্কতা কেন।

ফলে পুরন্দর কাজ করতেন, কিন্তু তাঁর সজাগ সতর্ক দৃষ্টি সর্বদা মেলে রাখতেন যেমন করেই হোক আসল সিঙ্গাপুরী মুক্তা রহস্যটা জানবার জন্য।

আরও একটা ব্যাপার পুরন্দর লক্ষ্য করেছিলেন, লিং সিংয়ের কিউরিও শপে বেচাকেনা যা হত, সেটা এমন বিশেষ কিছুই নয় যার দ্বারা লিং সিংয়ের একটা মোটা রকমের আয় হতে পারে। এবং লিং সিংয়ের অবস্থা যে বেশ সচ্ছল, সেটা বুঝতে অন্ধেরও কষ্ট হত না।

পুরন্দর চৌধুরী লক্ষ্য করেছিলেন, মুক্তা সন্ধানী যারা সাধারণত কিউরিও শপে লিং সিংয়ের কাছে আসত তারা সাধারণত স্থানীয় লোক নয়।

চীন-মালয়, জাভা, সুমাত্রা, ভারতবর্ষ প্রভৃতি জায়গা থেকেই সব খরিদ্দারেরা আসত।

তারা আসত জাহাজে চেপে, কিন্তু সিঙ্গাপুরে থাকত না তারা।

পুরন্দর চৌধুরী চাকরি করতেন বটে লিং সিংয়ের ওখানে, কিন্তু একতলা ছেড়ে দোতলায় ওঠবার তাঁর কোন অধিকার ছিল না। লিং সিংয়ের বউই সাধারণত নীচে পুরন্দরের খাবার পৌঁছে দিয়ে যেত প্রত্যহ।

যেদিন তিনি আসতেন না, যে ছোরা মালয়ী চাকরটা ওখানে কাজ করত সে-ই নিয়ে আসত তাঁর খাবার।

এমনি করে দীর্ঘ আট মাস কেটে গেল।

এমন সময় হঠাৎ লিং সিং অসুস্থ হয়ে পড়ল কদিন। লিং সিং আর নীচে নামে না। পুরন্দর একা-একাই লিং সিংয়ের কিউরিও শপ দেখাশোনা করেন।

সকাল থেকেই সেদিন আকাশটা ছিল মেঘলা, টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। পুরন্দর একা কাউন্টারের ওপাশে বসে একটা ইংরেজী নভেল পড়ছেন। এমন সময় দীর্ঘকায় এক সাহেবী পোশাক পরিহিত, মাথায় ফেল্টক্যাপ, গায়ে বর্ষাতি এক আগন্তুক এসে দোকানে প্রবেশ করল।

গুড মর্ণিং!

পুরন্দর বই থেকে মুখ তুলে তাকালেন। আগন্তুকের তামাটে মুখের রঙ সাক্ষ্য দিচ্ছে। বহু রৌদ্র-জলের ইতিহাসের মুখে তামাটে রঙের চাপদাড়ি।

ভাঙা ভাঙা ইংরেজীতে আগন্তুক জিজ্ঞাসা করল, লিং সিং কোথায়?

পুরন্দর বললেন, যা বলবার তিনি তাঁর কাছেই বলতে পারেন, কারণ লিং সিং অসুস্থ।

আগন্তুক বললে, তার কিছু সিঙ্গাপুরী মুক্তার প্রয়োজন।

সিঙ্গাপুরী মুক্তা! সঙ্গে সঙ্গে একটা মতলব পুরন্দরের মনের মধ্যে স্থান পায়।

আগন্তুককে অপেক্ষা করতে বলেপুরন্দর এগিয়ে গিয়ে দরজার পাশেকলিং বেলটা টিপলেন।

একটু পরেই লিং সিংয়ের স্ত্রীর মুখ সিঁড়ির উপরে দেখা গেল।

পুরন্দর বললেন, তোমার স্বামীকে বল সিঙ্গাপুরী মুক্তার একজন খরিদ্দার এসেছে।

খানিক পরে লিং সিংয়ের স্ত্রী এসে আগন্তুক ও পুরন্দর দুজনকেই উপরে ডেকে নিয়ে গেল লিং সিংয়ের শয়ন ঘরে। এই সর্বপ্রথম লিং সিংয়ের বাড়ির দোতলায় উঠলেন পুরন্দর এখানে আসবার পর। শয্যার উপরে লি সিং শুয়েছিল।

পুরন্দরের সামনেই লি সিং তার শয্যার তলা থেকে একটা চৌকো কাঠের বাক্স বের করে ডালাটা খুলতেই পুরন্দর দেখলেন সত্যিই বাক্সে ভর্তি ছোট ছোট সব সাদা মুক্তা। একটা প্যাকেটে করে কিছু মুক্তা নিয়ে পরিবর্তে একগোছা নোট গুণে দিয়ে আগন্তুক চলে গেল।

সেই রাত্রেই আবার পুরন্দরের ডাক এল লিং সিংয়ের শয়নঘরে দোতলায়।

আমাকে ডেকেছ?

হ্যাঁ, বসো। শয্যার পাশেই লিং সিং একটা খালি চেয়ার দেখিয়ে দিল পুরন্দরকে বসবার জন্য।

পুরন্দর বসলেন।

ঘরের মধ্যে একটা টেবিল-ল্যাম্প জ্বলছে। বাইরে শুরু হয়েছে ঝোড়ো হাওয়া। ঘরের বন্ধ কাঁচের জানলা সেই হাওয়ায় থরথর করে কেঁপে কেঁপে উঠছে।

লিং সিংয়ের পায়ের কাছে তার প্রৌঢ়া স্ত্রী নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার ঈষৎ হলদে চ্যাপ্টা মুখে বাতির আলো কেমন ম্লান দেখায়।

দেখ পুরন্দর, লিং সিং বলতে লাগল, তোমাকে আমি এনেছিলাম সামান্য ঐ একশো ডলার মাইনের চাকরির জন্যে নয়। আমার এবং আমার স্ত্রীর বয়স হয়েছে, ক্রমশ দেহের শক্তিও আমাদের কমে আসছে। আমাদের কোন ছেলেপিলে নেই। তাই আমি এমন একজন লোক কিছুদিন থেকে খুঁজছিলাম যাকে পুরোপুরি আমরা বিশ্বাস করতে পারি। হোটেলে তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় হওয়ার পর থেকেই তোমার উপরে আমার নজর পড়েছিল। তোমাকে আমি যাচাই করছিলাম। দেখলাম, তোমার মধ্যে একটা সং অথচ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কষ্টসহিষ্ণু মানুষ আছে। আমাদেরও একজন দেখাশোনা করবার মত সৎ ও বিশ্বাসী লোক চাই। মনে হল, তোমাকে দিয়ে হয়তো আমাদের সে আশা যেন মিটতে পারে। চাকরি দিয়ে তোমাকে তাই নিয়ে এলাম। দীর্ঘ আটমাস তোমাকে দিনের পর দিন আমি পরীক্ষা করেছি। বুঝেছি, লোক নির্বাচনে আমি ঠকি নি।

এই পর্যন্ত একটানা কথাগুলো বলে লিং সিং পরিশ্রমে যেন হাঁপাতে লাগল। পুরন্দর বললেন, লিং সিং, তুমি এখন অসুস্থ। পরে এসব কথা হবে। আজ থাক।

না। আমার যা বলবার আজই আগাগোড়া সব তোমাকে আমি বলব বলেই ডেকে এনেছি এখানে। শোন পুরন্দর। কিওরিও শপটাই আমার আসল ব্যবসা নয়াআমার আসল ব্যবসাটি হচ্ছে বিচিত্র এক প্রকার মিশ্র মাদক দ্রব্য বৈচা। বিশেষ সেই দ্রব্যটি এমনই প্রক্রিয়ায় তৈরী যে, একবার তাতে মানুষ অভ্যস্থ হলে পরবর্তী জীবনে আর তাকে ছাড়তে পারবে না। এবং তখন যে কোন মূল্যের বিনিময়েও তাকে সেই মাদক দ্রব্যটি সংগ্রহ করতেই হবে। বিশেষ ঐ বিচিত্র মাদক দ্রব্যটির তৈরীর প্রক্রিয়া আমি শিখেছিলাম আমার ঐ স্ত্রীর বাপের কাছ থেকে। মরবার আগে সে আমাকে প্রক্রিয়াটি শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। সেইটি তোমাকে আমি শিখিয়ে দিয়ে যাব, কিন্তু তোমাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে যতদিন আমরা বেঁচে থাকব আমাদের দেখাশোনা তুমি করবে। আমাদের মৃত্যুর পর অবশ্য তুমি হবে সব কিছুর মালিক।

পুরন্দর জবাবে বললেন, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের দেখব। তুমি আমাকে বিশেষ ওই মাদক দ্রব্য তৈরীর প্রক্রিয়া শিখিয়ে না দিলেও তোমাদের আমি দেখতাম এবং দেখবও।

আমি জানি পুরন্দর। তোমাকে আমি চিনতে পেরেছি বলেই তোমাকে আমার ঘরে এনে আমি স্থান দিয়েছি, হ্যাঁ শোন, যে মাদক দ্রব্যটির কথা বলছিলাম তারই নাম সিঙ্গাপুরী মুক্তা। কয়েক প্রকার বুনন গাছের ছাল, শিকড়, আফিং ও সর্পবিষ দিয়ে তৈরী করতে হয় সেই বিশেষ আশ্চর্য মাদক দ্রব্যটি। এবং পরে জিলাটিন দিয়ে কোটিং দিয়ে তাকে মুক্তার আকার দিই।

.

১৭.

পুরন্দর চৌধুরী বলতে লাগলেন, লিং সিংয়ের মৃত্যুর পর সেই মাদক দ্রব্য বেচে আমি অথোপার্জন করতে লাগলাম।

ঐভাবে ব্যবসা করতে করতে একদিন আমার মনে হল, শুধু ঐভাবে সিঙ্গাপুরে বসে কেন, আমি তো মধ্যে মধ্যে কলকাতা এসেও ঐ মাদক দ্রব্যের ব্যবসা করতে পারি। তাতে করে আমার আয় আরও বেড়ে যাবে। এলাম কলকাতা। কলকাতায় এসেই কয়েকটি শাঁসালো পুরাতন বন্ধুকে খুঁজে খুঁজে বের করলাম। যাদের অর্থ আছে, শখ আছে। ঠিক সেই সময় একদিন মার্কেটে বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে বহুকাল পরে আমার দেখা হল।

বহুদিন পরে দুই পুরোন দিনের বন্ধুর দেখা। সে আমায় তার এই বাড়িতে টেনে নিয়ে এলো। দেখলাম বিনয়েন্দ্র প্রভূত অর্থের মালিক হয়েছে তার মাতামহের দৌলতে। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হল, এই বিনয়েন্দ্রকে যদি আমি গাঁথতে পারি তো বেশ মোটা টাকা উপার্জন করতে পারব। বিনয়েন্দ্র দিবারাত্রই বলতে গেলে তার গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত। এবং প্রচুর পরিশ্রম করতে হয় বলে রাত্রে শয়নের পূর্বে সে সামান্য একটু ড্রিঙ্ক করত। তাকে বোঝালাম, নেশাই যদি করতে হয় তো লিকার কেন। লিকার বড় বদ নেশা। ক্রমে ক্রমে লিভারটি একেবারে নষ্ট করে ফেলবে। বিনয়েন্দ্র তাতে জবাব দিল, কি করি ভাই বল। শুধু যে পরিশ্রমের জন্যই আমি ড্রিঙ্ক করি তা নয়। যতক্ষণ নিজের গবেষণা ও পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকি, বেশ থাকি। কিন্তু নির্জন অবসর মুহূর্তগুলি যেন কাটতেই চায় না। নিজের এমন একাকীত্ব যেন জগদ্দল পাথরের মত আমাকে চেপে ধরে। আপন জন থেকেও আমার কেউ নেই। জীবনে বিয়ে-থা করি নি, একদিন যারা ছিল আমার আপনার, যাদের ভালবেসে যাদের নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম, যাদের আঁকড়ে ধরে ভেবেছিলাম এ জীবনটা কাটিয়ে দের, তারাও, আজ আমাকে ভুল বুঝে দূরে সরে গিয়েছে। দেখা করা তত দূরে থাক, একটা খোঁজ পর্যন্ত তারা আমার নেয় না, বেঁচে আছি কি মরে গেছি। এওঁ একপক্ষে আমার ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়। না হলে দাদামশাই বা তাঁর উইলটা বিচিত্র করে যাবেন কেন! আর করেই যদি গেলেন তো তারাই বা আমাকে ভুল বুঝে দূরে সরে যাবে কেন! আমাকে অনাত্মীয়ের মত ত্যাগ করবে কেন! অথচ তারা ছাড়া তো আমার এ সংসারে আপনার জনও আর কেউ নেই। আমার মৃত্যুর পর তারাই তো সব কিছু পাবে। সবই হবে, অথচ আমি যতদিন বেঁচে থাকব তারা আমার কাছেও আসবে না। এই সব নানা কারণেই ড্রিঙ্ক করে আমি ভুলে থাকি অবসর সময়টা। আমি তখন তাকে বললাম, বেশ তো, ঐ লিকার ছাড়া ভুলে থাকবার আরও পথ আছে। তখন আমিই নিজের তাগিদে তাকে সিঙ্গাপুরী মুক্তার সঙ্গে পরিচয় করালাম। প্রথমটায় অনিচ্ছার সঙ্গেই সে আমার প্রস্তাবে ঠিক রাজী নয়, তবে নিমরাজী হয়েছিল। পরে হল সে ক্রমে ক্রমে আমার ক্রীতদাস। সম্পূর্ণ আমার মুঠোর মধ্যে সে এল। ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করতে শুরু করলাম। কলকাতায় তিনখানা বাড়ি তো গেলই–নগদ টাকাতেও টান পড়ল তার।

.

মিঃ বসাক পুরন্দর চৌধুরী বর্ণিত কাহিনী শুনে স্তম্ভিত হয়ে যান। লোকটা শুধু শয়তানই নয়, পিশাচ। অবলীলাক্রমে সে তার দুষ্কৃতির নোংরা কাহিনী বর্ণনা করে গেল।

পুরন্দর চৌধুরী তাঁর কাহিনী শেষ করে নিঃশব্দে বসেছিলেন।

ধীরে ধীরে আবার একসময় মাথাটা তুললেন, অর্থের নেশায় বুদ হয়ে অন্যায় ও পাপের মধ্যে বুঝতে পারে নি এতদিন যে, আমার সমস্ত অন্যায়, সমস্ত দুস্কৃতি একজনের অদৃশ্য জমাখরচের খাতায় সব জমা হয়ে চলেছে। সকল কিছুর হিসাবনিকাশের দিন আমার আসন্ন হয়ে উঠেছে। কড়ায় গণ্ডায় সব—সব আমাকে শোধ দিতে হবে।

কথাগুলো বলতে বলতে শেষের দিকে পুরন্দর চৌধুরীর গলাটা ধরে এল। কয়েকটা মুহূর্ত চুপ করে থেকে যেন তিনি বুকের মধ্যে উদ্বেলিত ঝড়টাকে একটু প্রশমিত করবার চেষ্টা করতে লাগলেন।

আরও কিছুক্ষণ পরে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, জন্মের পর জ্ঞান হবার সঙ্গে সঙ্গেই দুঃখ ও দারিদ্র্য আমার পদে পদে পথ রোধ করেছে। তাই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ছলে-বলে-কৌশলে যেমন করে থোক অর্থ উপার্জন করতেই হবে। আশ্রয়দাতা লিং সিংয়ের দয়ায় সেই অর্থ যখন আমার হাতে এল, বাংলাদেশে এসে বেলাকে আমি বিবাহ করে সঙ্গে করে সিঙ্গাপুরে নিয়েগেলাম।

বেলা আমার প্রতিবেশী গাঁয়ের এক অত্যন্ত গরীব ব্রাহ্মণের মেয়ে। বেলাকে আমি ভালবাসতাম এবং বেলাও আমাকে ভালবাসত। চিরদিনের মত শেষবার গ্রামে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে যখন চলে আসি, তাকে বলে এসেছিলাম, যদি কোনদিন ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে ফেলতে পারি এবং তখনও সে যদি আমার জন্য অপেক্ষা করে তো ফিরে এসে তাকে আমি তখন বিয়ে করব।

কলকাতা ছাড়বার চার বছর পরে ভাগ্য যখন ফিরল বেলার বাবাকে একটি চিঠি দিলাম। চিঠির জবাবে জানলাম, বেলার বাপ মারা গেছে, বেলা তখন তার এক দূর-সম্পকীয় কার সংসারে দাসীবৃত্তি করে দিন কাটাচ্ছে।

সঙ্গে সঙ্গে এলাম কলকাতায় ও গ্রামে গিয়ে বেলাকে বিবাহ করলাম।

জীবন আমার আনন্দে ভরে উঠল। দুবছর বাদে আমাদের খোকা হল। সুখের পেয়ালা কানায় কানায় ভরে উঠল। ভেবেছিলাম, এমনি করেই বুঝি আনন্দ আর সৌভাগ্যের মধ্যে বাকি জীবনটা আমার কেটে যাবে।

বেলা কিন্তু মধ্যে মধ্যে আমাকে বলতো, ওই মাদক দ্রব্যের ব্যবসা ছেড়ে দিতে। কিন্তু দুস্কৃতির নেশা তখন মদের নেশার মতই আমার দেহের কোষে কোষে ছড়িয়ে গিয়েছে। তা থেকে তখন আর মুক্তি কোথায়! তাছাড়া পাপের দণ্ড। কতজনকে হৃতসর্বস্বকরেছি, কতজনকে জোঁকের মত শুষে শুষে রক্তশূন্য করে তিলে তিলে চরম সর্বনাশের মধ্যে ঠেলে দিয়েছি, তার ফল ভোগ করতে হবে না!

আবার একটু থেমে যেন নিজেকে একটু সামলে নিয়ে পুরন্দর বলতে লাগলেন, পূর্বেই আপনাকে বলেছি ইনসপেক্টার, ওই সিঙ্গাপুরী মুক্তা তৈরীকরবার জন্য সর্পবিষ বাস্নেক-ভেনমের প্রয়োজন হতো। সেই কারণে জ্যান্ত সাপই খাঁচায় রেখে দিতাম।

সাপের বিষ-থলি থেকে বিষ সংগ্রহ করতাম। সিঙ্গাপুরে ভাল বিষাক্ত সাপ তেমন মিলত বলে জাভা, সুমাত্রা ও বোর্ণিয়োর জঙ্গল থেকে বিষধর সব সাপ একজন চীনা মধ্যে মধ্যে ধরে এনে আমার কাছে বিক্রি করে যেত। সেবারে সে একটা প্রকাণ্ড গোখরো সাপ দিয়ে গেল। অত বড় জাতের গোখররা ইতিপূর্বে আমি বড় একটা দেখি নি। খাঁচার মধ্যে সাখটার সে কি গর্জন। মনে হচ্ছিল ছোবল দিয়ে খাঁচাটা বুঝি ভেঙেই ফেলবে।

চীনাটা বারবার আমাকে সতর্ক করে গিয়েছিল যে সাপটা একটু নিস্তেজ না হওয়ার আগে যেন তার বিষ সংগ্রহের আমি চেষ্টা না করি।

উপরের তলার একটা ছোট ঘরে সিগাপুরীমুক্তা তৈরীর সবমালমশলা ও সাপের খাঁচাগুলো থাকত। সাধারণত সে ঘরটা সর্বদা তালা দেওয়াই থাকতো।

যে দিনকার কথা বলছি সে দিন কি কাজে সেই ঘরে ঢুকছি এমন সময় একজন খরিদ্দার। আসায় তাড়াতাড়ি নিচে নেমে গেছি এবং তাড়াহুড়ায় সেই ঘরের তালাটা বন্ধ করতে ভুলে গেছি। খরিদ্দারটি আমার অনেক দিনকার জানাশোনা। সে মধ্যে মধ্যে এসে অনেক টাকার মুক্তা নিয়ে যেত। সে বললে, এখুনি তার সঙ্গে যেতে হবে একটা হোটেলে। একজন পাঞ্জাবী ভদ্রলোকের সঙ্গে আমাকে আলাপ করিয়ে দেবে, যে লোকটি আমার সঙ্গে মুক্তার কারবার করতে চায়। গাড়ি নিয়েই এসেছিল খরিদ্দারটি। আমার স্ত্রী রান্নাঘরে ছিল, তাকে বলে খরিদ্দারটির সঙ্গে বের হয়ে গেলাম।

বের হবার সময়ই ভুলে গেলাম যে সেই ঘরটা তালা দিতে হবে। ফিরতে প্রায় ঘণ্টা দুই দেরী হয়ে গেল। যে কাজে গিয়েছিলাম তাতে সফল হয়ে পকেট ভর্তি নোট নিয়ে বাড়ি ফেরবার পথে ভাবতে ভাবতে আসছিলাম এবারে আর মাসকয়েক কারবার করে স্ত্রীপুত্রকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসব এবং কারবার একেবারে গুটিয়ে ফেলব। কিছুদিন থেকেই বেলা বলছিল কলকাতায় ফিরে যাবার জন্য। এখানে তার কোন সঙ্গী সাথী ছিল না একা একা। তার দিন যে খুব কষ্টে কাটে তা বুঝতে পেরেছিলাম।

বাড়িতে ঢুকেই উচ্চকণ্ঠে ডাকলাম, বেলা! বেলা!

কিন্তু বেলার কোন সাড়া পাওয়া গেল না। বাচ্চা চাকরটা আমার ডাক শুনে উপর থেকে ছুটতে ছুটতে এসে বললে, সর্বনাশ হয়ে গেছে। দেখবেন চলুন।

সে বেচারীও কিছু জানত না। বেলা তাকে কি কিনতে যেন বাজারে পাঠিয়েছিল, সে আমার মিনিট পনের আগে মাত্র ফিরেছে।

চারটার সঙ্গে ছুটতে ছুটতে উপরে গেলাম।

কি থেকে কী ভাবে দুর্ঘটনা ঘটেছিল সে-ও জানে না আমিও আজ পর্যন্ত জানি না। তবে যে ঘরে সাপগুলো থাকত সে ঘরে ঢুকে দেখি, বেলা আর থোকন মেঝেতে মরে পড়ে আছে।

সর্বাঙ্গ তাদের নীল হয়ে গেছে। আর নতুন কেনা গোখরো সাপটা যে খাঁচার মধ্যে ছিল, সেটা মেঝেতে উন্টে পড়ে আছে এবং সেই সাপটা ঘরের মধ্যে কোথাও নেই।

কয়েকটা মুহূর্ত আমার কণ্ঠ দিয়ে কোন শব্দ বের হল না।

ঘটনার আকস্মিকতায় ও আতঙ্কে আমি যেন একদম বোবা হয়ে গিয়েছিলাম।

কাঁদবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কাঁদতে পারলাম না।

সমস্ত জীবনটাই এক মুহূর্তে আমার কাছে মিথ্যে হয়ে গেল। সমস্ত আশা আকাঙ্ক্ষা ও চাওয়া-পাওয়ার যেন একেবারে শেষ হয়ে গেল। গত সাত বছর ধরে এই যে তিলে তিলে অর্থ সংগ্রহ করে ভাগ্যকে জয় করবার দুস্তর প্রচেষ্টা সব—সব যেন মনে হল শেষ হয়ে গেছে।

বেলাকে স্ত্রীরূপে পেয়ে জীবন আমার ভরে গিয়েছিল। জীবনে থোকন এনেছিল এক অনাস্বাদিত আনন্দ, এক মুহূর্তে ঈশ্বর যেন তাদের দুজনকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আমাকে জগতের সর্বাপেক্ষা নিঃস্ব ও রিক্ত করে ভিক্ষুকেরও অধম করে দিয়ে গেলেন। সমস্ত দিন সেই দুটি বিষজর্জরিত নীল মৃতদেহকে সামনে নিয়ে হতবাক, মুহ্যমানের মত বসে রইলাম।

ক্ৰমে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এল।

ছোকরা চাকরটাও বোধ হয় কেমন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। উপরের সিঁড়িতে রেলিংয়ের গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাকতে থাকতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছিল।

ধীরে ধীরে মৃতদেহের পাশ থেকে এক সময় উঠে দাঁড়ালাম। অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে বেলা ও খোকনের। পুলিস জানতে পারলে ময়না ঘরে টেনে নিয়ে যাবে। নিষ্ঠুরের মত ডাক্তার বেলার ঐ দেহে এবং আমার সাধের খোকনের নবনীত ঐ দেহে ছুরি চালাবে। সহ্য করতে পারব না।

তারপর শুধু তাই নয়, ক্রিমেশন গ্রাউন্ডে নিয়ে গিয়ে তাদের শেষ কাজ করতে হবে। তার জন্যও তো কোন ডাক্তারের সার্টিফিকেট চাই। এবং আরও আছে, জানাজানি হলে। ব্যাপারটা পুলিস আসবে। তখন নানা গোেলমালও শুরু হবে। তার চাইতে এই বাড়ির উঠানেই, মা ও ছেলেকে মাটির নিচে শুইয়ে রেখে দিই।

আমার জীবনের সবচাইতে দুটি প্রিয়জন আমার বাড়ির মধ্যেই মাটির নিচে শুয়ে থাক। ঘুমিয়ে থাক।

চাকরটাকে জাগিয়ে নীচে নেমে এলাম।

কখন এক সময় বৃষ্টি থেমে গেছে। বর্ষণক্লান্ত আকাশে এখনও এদিক-ওদিক টুকরো টুকরো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। তারই ফাঁকে ফাঁকে কয়েকটি তারা উঁকি দিচ্ছে।

চাকরটার সাহায্যে দুজনে মিলে উঠানের এক কোণে যে বড় ইউক্যালিপটাস গাছটা ছিল তার নীচে পাশাপাশি দুটি গর্ত খুঁড়লাম। তারপর সেই গর্তের মধ্যে শুইয়ে দিলাম বেলা আর খোনকে।

মাটি চাপা দিয়ে গর্ত দুটো যখন ভরাট হয়ে গেল, তখন রাত্রি-শেষের আকাশ ফিকে আলোয় আসন্ন প্রভাতের ইঙ্গিত জানাচ্ছে।

তারপর সাতটা দিন সাতটা রাত কোথা দিয়ে কেমন করে যে কেটে গেল বুঝতেও পারলাম না। সমস্ত জীবনটাই যেন মিথ্যা হয়ে গেছে। কিছুই আর ভাল লাগে না। আর কি হবে এই দূর দেশে একা পড়ে থেকে। ব্যবসা-পত্র সব বন্ধ করে দিয়েছি।

মাঝে মাঝে খরিদ্দার এলে তাদের ফিরিয়ে দিই।

দোকান সর্বদা বন্ধই থাকে।

মনের যখন এই রকম অবস্থা, উত্তরপাড়া থেকে বিনয়েন্দ্রর চিঠি পেলাম। জরুরী চিঠি, চলে আসবার জন্য।

পরের দিনই প্লেনে একটা সীট পেয়ে গেলাম। রওনা হয়ে পড়লাম। মনে মনে ঠিক করলাম, এখানে এসে একটা ব্যবস্থা করে দু-চারদিনের মধ্যেই আবার সিঙ্গাপুর ফিরে সেখানকার সব কাজ-কারবার বন্ধ করে চিরদিনের মত এখানে চলে আসব।

কিন্তু হায়! তখন কি জানতাম যে, এখানে এসে এ বাড়িতে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই এই দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে যাব।

এই পর্যন্ত বলে পুরন্দর চৌধুরী যেন একটা বড় রকমের দীর্ঘশ্বাস কোনমতে রোধ করলেন।

.

১৮.

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আবার এক সময় পুরন্দর চৌধুরী বললেন, কিন্তু এখনও পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারছি না ইন্সপেক্টার, সত্যি কথা বলতে কি, এ দুর্ঘটনা কি করে ঘটল। আপনি বলছেন, বিনয়েন্দ্রকে কেউ হত্যা করেছে। কিন্তু আমি তো বুঝে উঠতে পারছি না বিনয়েন্দ্রকে কেউ হত্যা করতে পারে।এ যেন কেমন অবিশ্বাস্য বলে এখনও আমার মনে হচ্ছে।

কেন বলুন তো? ইন্সপেক্টর প্রশ্ন করলেন।

প্রথমত বিয়েকে আমি খুব ভাল করেই জানতাম। ইদানীং বিনয়েন্দ্র আমার প্ররোচনায় মুক্তার নেশায় জড়িয়ে পড়েছিল সত্য, কিন্তু ওই একটি মাত্র নেশার বদ অভ্যাস ছাড়া তার চরিত্রে আর কোন দোষই তো ছিল না। মিতভাষী, সংযমী, স্নেহপ্রবণ, সমঝদার এবং যথেষ্ট বুদ্ধিমান লোক ছিল সে। এবং যতদূর জানি, তার কোন শত্রুও এ দুনিয়ায় কেউ ছিল বলে তো মনে হয় না। তার জীবনের অনেক গোপন কথাও আমার অজানা নয়তবু বলব, তাকে কেউ হত্যা করতে পারে এ যেন সম্পূর্ণই অবিশ্বাস্য।

আচ্ছা পুরন্দরবাবু, ইন্সপেক্টার প্রশ্ন করলেন, এ বাড়ির পুরাতন ভৃত্য রামচরণের মুখে যে বিশেষ একটি মহিলার কথা শুনলাম, তার সম্পর্কে কোন কিছু আপনি বলতে পারেন?

কি আপনি ঠিক জানতে চাইছে ইন্সপেক্টার?

কথাটা আমার কি খুব অস্পষ্ট বলে বোধ হচ্ছে পুরন্দরবাবু?

মিঃ বসাকের কথায় কিছুক্ষণ পুরন্দর চৌধুরী তাঁর মুখের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন। তারপর মৃদুকণ্ঠে বললেন, না ইন্সপেক্টার।

আপনি যা সন্দেহ করছেন বিনয়েন্দ্রর সে রকম কোন দুর্বলতাই ছিল না।

প্রত্যুত্তরে এবারে ইন্সপেক্টার আর কোন কথা বললেন না, কেবল মৃদু একটা হাসি তাঁর ওষ্ঠপ্রান্তে জেগে উঠল।

পুরন্দর চৌধুরীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নাইন্সপেক্টারের ওষ্ঠপ্রান্তেরক্ষীণ হাসির আভাসটা।

তিনি বললেন, আপনি বোধ হয় আমার কথাটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারলেন নাইন্সপেক্টার। কিন্তু সত্যিই আমি বলছি দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব আমাদের। তাকে আমি খুব ভালভাবেই জানতাম। স্ত্রীলোকের ব্যাপারে তার, সত্যি বলছি,কোন প্রকার দুর্বলতাই ছিল না।

এবারে মৃদুকণ্ঠে বসাক বললেন, বু আপনার কথা আমি পুরোখুরি বিশ্বাস করতে পারলাম পুরন্দরবাবু।

কেন বলুন তো?

নেশার কাছে যে মানুষ নিজেকে বিক্রি করতে পারে তার মধ্যে আর যে গুণই থাক কেন, নারীর প্রতি তার দুবর্লতা কখনও জাগবে না, এ যেন বিশ্বাস করতেই মন চায় না। কিন্তু যাক সে কথা। আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করছিলাম, সেই মিস্টিরিয়াস স্ত্রীলোকটি সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন কিনা।

খুববেশী জানবার অবকাশও আমার হয়নি। কারণবেশীক্ষণ তাকে দেখবার আমার অবকাশও হয়নি এবং তার সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগও আমি পাইনি।

আপনি তাকে এ বাড়িতে দেখেছিলেন তা হলে?

হ্যাঁ।

কবে?

মাসদেড়েক আগে বিশেষ একটা কাজে কয়েক ঘণ্টার জন্য আমাকে কলকাতায় আসতে হয় সেই সময়।

তাহলে মাসদেড়েক আগে আপনি আর একবার কলকাতায় এসেছিলেন এর আগে?

হ্যাঁ।

তারপর?

সেই সময় রাত, বোধ করি, তখন দশটা হবে। বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে এখানে দেখা করতে আসি।

অত রাত্রে এসেছিলেন যে?

পরের দিনই ভোরের প্লেনে চলে যাব, তাছাড়া সমস্ত দিনটাই কাজে ব্যস্ত ছিলাম। তাই রাত্রে ছাড়া সময় করে উঠতে পারিনি।

আচ্ছা, আপনি যে সে দিন রাত্রে এসেছিলেন এ বাড়িতে রামচরণ জানত?

হ্যাঁ। জানে বৈকি। সে-ই তো আমার আসার সংবাদ বিনয়েন্দ্রকে দেয় রাত্রে।

যাক। তারপর বলুন।

বিনয়েন্দ্র আমাকে এই ঘরেই ডেকে পাঠায়। ইদানীং বৎসর খানেক ধরে বিনয়েন্দ্র একটা বিশেষ কি গবেষণা নিয়ে সর্বদাই ব্যস্ত থাকত, কিন্তু ঘরে ঢুকে দেখলাম—

এই পর্যন্ত বলে পুরন্দর চৌধুরী যেন একটু ইতস্তত করতে লাগলেন।

বলুন। থামলেন কেন?

এই ঘরে ঢুকে দেখলাম ঘরের এক কোণে একটা আরাম-কেদারার উপর বিনয়েন্দ্র গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে পড়ে আছে। আর একটি তেইশ-চব্বিশ বছরের তরুণী অ্যাপ্রন গায়ে ঐ টেবিলটার সামনে দাঁড়িয়ে কি যেন একটা এক্সপেরিমেন্ট করছেন-হাতে একটা তরল পদার্থপূর্ণ টেস্ট টিউব নিয়ে। আমার প্রবেশ ও পদশব্দ পেয়েও বিনয়েন্দ্র কোন সাড়া না দেওয়ায় আমিই তার সামনে এগিয়ে গেলাম। ডাকলাম, বিনু।

কে? ও, পুরন্দর। এস। তারপর কী সংবাদ? বলে অদূরে কার্যরত তরুণীকে সম্বোধন করে বললে, লতা, সল্যুশনটা হল?

সম্বোধিতা তরুণী বিনয়েন্দ্রর ডাকে ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, না। এখনও সেডিমেন্ট পড়ছে।

কথাটা বলে তরুণী আবার নিজের কাজে মনঃসংযোগ করলেন।

বস পুরন্দর। দাঁড়িয়ে রইলে কেন? বিনয়েন্দ্র বললে।

ঘরের মধ্যে উজ্জ্বল আলো জ্বলছিল। সেই আলোয় বিনয়েন্দ্রর মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম।

চোখ দুটো বোজা। সমস্ত মুখখানিতে যেন একটা ক্লান্ত অবসন্নতা। চোখ খুলে যেন তাকাতেও তার কষ্ট হচ্ছে।

বুঝতে আমার দেরি হল না, আমারই যোগান দেওয়া সিংহলী মুক্তার নেশায় আপাতত বিনয়েন্দ্রন্দ্ৰ কুঁদ হয়ে আছে।

শুধু তাই নয়, মাসচারেক আগে শেষবার যে বিনয়েন্দ্রকে আমি দেখেছিলাম এ যেন সে বিনয়েন্দ্র নয়। তার সঙ্গে এর প্রচুর প্রভেদ আছে।

আরো একটু কৃশ, আরো একটু কালো হয়েছে সে। চোখের কোলে একটা কালো দাগ গভীর হয়ে বসেছে। কপালের দুপাশে শিরাগুলো একটু যেন শীত। নাকটা যেন আরও একটু স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

কেন জানি না ঠিক ঐ মুহূর্তে বিয়েকে দেখে আনন্দ হওয়ার চাইতে মনে আমার একটু যেন দুঃখই হল।

বুঝলাম, পুরোপুরিভাবেই আজ বিনয়েন্দ্র নেশায় কবলিত। এর আগে দেখেছি, সে রাত বারটা সাড়ে বারটার পর শুতে যাবার পূর্বে সাধারণত নেশা করত কিন্তু এখন দেখছি সে সময়ের নিয়ম-পালন বা মর্যাদা আর অক্ষুন্ন নেই। এতদিন নেশা ছিল তার সময়বাঁধা, ইচ্ছাধীন। এখন সেই হয়েছে নেশার ইচ্ছাধীন। নেশার গ্রাসে সে আজ কবলিত।

বিনয়েন্দ্র আমাকে বসতে বললে বটে, কিন্তু তার তখন আলোচনা কিছু করবার বা কথা বলবার মত অবস্থা নয়।

কিছুক্ষণ বসে থেকে আবার ডাকলাম, বিনু!

অ্যাঁ? অতি কষ্টে যেন চোখ মেলে তাকাল বিনয়েন্দ্র। তারপর বললে, তুমি তো রাতটা আছ। খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নাও। কাল সকালে শুনব তোমার কথা।

বললাম, রাত্রে আমি থাকব না। এখুনি চলে যাব।

ও, চলে যাবে। যাও এবারে কিছু বেশী করে পার্লস পাঠিয়ে দিও তো, একটা দুটোয় আজকাল আর শানাচ্ছে না হে।

বিনয়েন্দ্রর কথায় চমকে উঠলাম। এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় ফিরে তাকালাম অদূরে দণ্ডায়মান সেই তরুণীর দিকে।

তরুণীর দিকে তাকাতেই স্পষ্ট দেখলাম, সে যেন আমাদের দিকেই তাকিয়ে ছিল, অন্যদিকে মুখটা ঘুরিয়ে নিল। সে যে আমাদের কথাবার্তা শুনছিল বুঝতে আমার কষ্ট হল না।

নেশার ঘোরে আবার হয়ত বেফাঁস কি বলে বসবে বিনয়েন্দ্র, তাই আর দেরি না করে ফিরে আসবার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই বিনয়েন্দ্র আবার চোখ মেলে তাকিয়ে বললে, চললে নাকি পুরন্দর?

হ্যাঁ। ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখেছি। তাছাড়া কাল খুব ভোরে আমার প্লেন ছাড়ছে।

তা যাও। তবে বলছিলাম—

কী?

দামটা কিছু কমাও না। একেবারে যে চীনে জোঁকের মত শুষে নিচ্ছ। এমন বেকায়দায় তুমি ফেলবে জানলে কোন্ আহাম্মক তোমার ঐ ফাঁদে পা দিত!

ছেড়ে দিলেই তো পার। কথাটা কেমন যেন আমার আপনা থেকেই মুখ দিয়ে হঠাৎ বের হয়ে গেল।

কি বললে! ছেড়ে দেব? হ্যাঁ, এইবার খাঁটি ব্যবসাদারী কথা বলছ। কি করব, অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুতেই নেশাটা ছাড়তে পারলাম না। নইলে দেখিয়ে দিতাম তোমায়।

বিনয়েন্দ্রর কথায় দুঃখও হল, হাসিও পেল।

কিন্তু বুঝতে পারছিলাম ঘরের মধ্যে উপস্থিত ঐ মুহূর্তে তৃতীয় ব্যক্তিটি আর যাই করুক, কাজের ভান করলেও তার সমস্ত শ্রবণেন্দ্রিয় প্রখর করে আমাদের উভয়ের কথাগুলো শুনছে।

তাড়াতাড়ি তাই কথা আর না বাড়তে দিয়ে দরজার দিকে অগ্রসর হলাম।

দরজা বরাবর এসে কি জানি কেন নিজের কৌতূহলকে আর দাবিয়ে রাখতে পারলাম না। ফিরে তাকালাম।

সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম একজোড়া শাণিত ছুরির ফলার মত দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ। দরজা খুলে বের হয়ে এলাম, কিন্তু মনে হতে লাগল সেই শাণিত ছুরির ফলার মতো চোখের দৃষ্টিটা যেন আমার পিছনে পিছনে আসছে।

কথাগুলো একটানা বলে পুরন্দর চৌধুরী থামলেন।

তারপর?

তারপর? আবার বলতে শুরু করলেন, সেই কয়েক মুহূর্তের জন্য তাকে দেখেছিলাম। আর দেখিনি। এবং ঐ কয়েক মুহূর্তের জন্য দেখাই। পরিচয় হয়নি। এবং পরিচয়ের অবকাশও ঘটেনি। তারপর তো এবারে এসে শুনলাম, কিছুদিন আগে হঠাৎ তিনি কাউকে কিছু না জানিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছেন।

এবারে ইন্সপেক্টার কথা বললেন, যাক। তবু সেই মিস্টিরিয়াস ভদ্রমহিলাটির নামের একটা হদিস পাওয়া গেল। আর একটা কথা মিঃ চৌধুরী?

বলুন।

এত রাত্রে আপনি এ ঘরে এসেছিলেন কেন চোরের মত গোপমে, সন্তর্পণে?

সবই যখন আপনাকে বলেছি সেটুকু বলবারও আমার আর আপত্তি থাবার কি থাকতে পারে ইন্সপেক্টার। বুঝতে হয়তো পারছেন, আমি এসেছিলাম সেই সিংহলী মুক্তা যদি এখনও অবশিষ্ট পড়ে থাকে তো সেগুলো গোপনে সরিয়ে ফেলবার জন্য। কারণ মাত্র দিন কুড়ি আগে একটা পার্সেল ডাকযোগে আমি পাঠিয়েছিলাম। ঠিক আমার স্ত্রী ও পুত্র যেদিন সপাঘাতে মারা যায় তারই আগের দিন সকালবেলা।

পুরন্দর চৌধুরীর কথা শুনে ইন্সপেক্টার কয়েক মুহূর্ত আবার ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর মৃদু কণ্ঠে বললেন, কিন্তু আপনার মুখেই একটু আগে শুনেছি মিঃ চৌধুরী, সেগুলো এমনি হঠাৎ দেখলে কারও পক্ষেই সাধারণ বড় আকারের মুক্তা ছাড়া অন্য কিছুই। ভাবা সম্ভব নয়; তবে আপনি সেগুলো সরাবার জন্য এত ব্যস্ত হয়েছিলেন কেন। আর এ ঘরেই যে সেগুলো পাবেন তাই বা আপনি ভাবলেন কি করে?

এ তো খুব স্বাভাবিক ইন্সপেক্টার। এই ল্যাবরেটরী ঘরের মধ্যেই তার বেশীর ভাগ সময় দিন ও রাত্রি কাটত। তাছাড়া এই ঘরে আলমারিতে তার গবেষণার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নানাপ্রকার ওষুধপত্র থাকতো, সেদিক দিয়ে সেগুলো এখানে রাখাই তো স্বাভাবিক।

হুঁ। একেবারে অসম্ভব নয়।

আর তাছাড়া হঠাৎ ওষুধপত্রের মধ্যে ঐ মুক্তা জাতীয় বস্তুগুলো কেউ দেখতে পেলে পুলিসের পক্ষে সন্দেহ জাগাও কি স্বাভাবিক নয়?

পুরন্দর চৌধুরীর যুক্তিটা খুব ধারালো না হলেও ইন্সপেক্টার আর কোন তর্কের মধ্যে গেলেন না। ইতিমধ্যে রাত্রিও প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল।

খোলা জানালাপথে অন্ধকারমুক্ত আকাশের গায়ে আলো একটু একটু করে তখন ফুটে উঠছে। ঘরের আলোটা নিবিয়ে দিয়ে দুজনে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই ঝিরঝিরে প্রথম ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়া জাগরণক্লান্ত চোখে-মুখে যেন স্নিগ্ধ চন্দনস্পর্শের মত মনে হল ইন্সপেক্টারের।

ক্ষণপূর্বে শোনা পুরন্দর চৌধুরীর বিচিত্র কাহিনীটা তখনও তাঁর মস্তিষ্কের মধ্যে পাক খেয়ে খেয়ে ফিরছে। সত্য হোক বা মিথ্যা হোক, সত্যিই পুরন্দর চৌধুরীর কাহিনী বিচিত্র।

বাড়ির কেউ হয়তো এখনও জাগে নি। সকলেই যে যার শয্যায় ঘুমিয়ে।

পুরন্দর চৌধুরীকে সত্যিই বড় ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। তিনি ইন্সপেক্টারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ধীর মন্থর পদে তাঁর নির্দিষ্ট ঘরের দিকে চলে গেলেন।

.

রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি মাথার মধ্যে তখনও যেন কেমন দপ দপ করছে। একাকী দোতলার বারান্দায় পায়চারী করতে করতে ইন্সপেক্টার আগাগোড়া সমগ্র ঘটনাটা যেন পুনরায় ভাববার চেষ্টা করতে লাগলেন। এবং তখনও সেই চিন্তার সবটুকু জুড়েই যেন পুরন্দর চৌধুরীর বর্ণিত কাহিনীটাই আনাগোনা করতে থাকে।

বিনয়েন্দ্র রায়ের হত্যার ব্যাপারটা মিঃ বসাক যতটা সহজ ভেবেছিলেন, এখন যেন ক্রমেই মনে হচ্ছে ততটা সহজ নয়। রীতিমত জটিল।

বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিয়ে কেটে যাচ্ছিল দিন, অবিবাহিত বিনয়েন্দ্রর এবং একটিমাত্র রহস্যময়ী নারীর মাস দুয়েকের সংস্পর্শ ব্যতীত অন্য কোন নারীঘটিত ব্যাপারের কোন হদিসই আপাতত পাওয়া যাচ্ছে না। এবং সেই রহস্যময়ী নারীটির সঙ্গে তার কতখানি ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল এবং আগে কোন ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল কিনা তারও কোন সঠিক সংবাদ এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

বিনয়েন্দ্রর অর্থের অভাব ছিল না। এবং বিশেষ করে ব্যাচিলর অবস্থায় প্রচুর অর্থ হাতে থাকায় সাধারণত যে দুটি দোষ সংক্রামক ব্যাধির মতই সঙ্গে দেখা দেয় প্রায় সর্বক্ষেত্রেই নারী ও নেশা, তার প্রথমটি সম্পর্কে কোনও কিছু এখন পর্যন্ত সঠিক না জানা গেলেও শেষোক্তটি সম্পর্কে জানা যাচ্ছে সে-ব্যাধিটির কবলিত বেশ রীতিমতভাবেই হয়েছিলেন বিনয়েন্দ্র। এবং সে ব্যাপারের জন্য মূলত দায়ী তারই অন্যতম কলেজ-জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ঐ পুরন্দর চৌধুরী।

পুরন্দর চৌধুরী!

সঙ্গে সঙ্গেই যেন নতুন করে আবার পুরন্দর চৌধুরীর চিন্তাটা মনের মধ্যে জেগে ওঠে ইন্সপেক্টারের। লোকটার বুদ্ধি তী, ধূর্ত, সতর্ক এবং প্রচণ্ড সুবিধাবাদী ও স্থিরপ্রতিজ্ঞ।

প্রথম দিকে ভদ্রলোক একেবারেই মুখ খোলেননি বা খুলতে চাননি।

অতর্কিতে ল্যাবরেটরী ঘরে রাত্রির অভিসারে ধরা পড়ে গিয়েই তবে মুখ খুলেছেন। এবং শুধু মুখ খোলাই নয়, বিচিত্র এক কাহিনীও শুনিয়েছেন।

লোকটা কিন্তু তথাপি এত সহজ বা সরল মনে হচ্ছে না ইন্সপেক্টারের।

সহসা এমন সময় ইন্সপেক্টারের চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে গেল সিঁড়িতে একটা দ্রুত স্খলিত পদশব্দ শুনে। কে যেন সিঁড়িপথে উঠে আসছে।

ফিরে তাকালেন ইন্সপেক্টার সিঁড়ির দিকে।

.

১৯.

যে ব্যক্তিটি সিঁড়ি দিয়ে উঠে ভোরের আলোয় তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল সে আর কেউ নয় ঐ বাড়ির একজন ভৃত্য রেবতী।

রেবতীর চোখে মুখে একটা স্পষ্ট ব্যস্ততা ও আতঙ্ক।

রেবতীই কথা বললে প্রথমে উত্তেজিত কণ্ঠে, ইন্সপেক্টার সাহেব, রামচরণ বোধ হয় মারা গেছে।

কথাটা শুনেই মিঃ বসাক রীতিমত যেন চমকে ওঠেন। তাঁর বিস্মিত কষ্ঠ হতে আপনা হতেই যে কথাগুলো বের হয়ে এল, মারা গেছে রামচরণ! সে কি!

হ্যাঁ। আপনি একবার শীগগিরই নীচে চলুন।

চল্‌ তো দেখি।

কোনরূপ সময়ক্ষেপ না করে রেবতীর পিছু পিছু সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলেন ইন্সপেক্টার। একতলার একেবারে দক্ষিণ প্রান্তের শেষ ঘরটির দরজাটা তখনও খোলাই ছিল।

রেবতীই প্রথমে গিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল খোলা দরজাপথে।

মিঃ বসাক তার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকলেন।

ঘরের আলোটা তখনও জ্বলছে। যদিও পশ্চাতের বাগানের দিককার খোলা জানলাপথে ভোরের পর্যাপ্ত আলো ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করেছে।

ভোরের সেই স্পষ্ট আলোয় যে দৃশ্যটি ইন্সপেক্টারের চোখে পড়ল ঘরে প্রবেশ করেই, তা যেমন বীভৎস তেমনি করুণ।

জানলার প্রায় লাগোয়া একটা চৌকির উপরে রামচরণের দেহটা চিত হয়ে পড়ে আছে।

মুখটা দরজার দিকেও একটু কাত হয়ে আছে।

চোখের পাতা খোলা, চোখের মণি দুটো যেন ঠেলে বের হয়ে এসেছে।

মুখটা ঈষৎ হাঁ হয়ে আছে। এবং সেই দ্বিধাবিভক্ত, হাঁ করা ওষ্ঠের প্রান্ত বেয়ে নেমে এসেছে লালামিশ্রিত ক্ষীণ একটা রক্তের ধারা।

সমস্ত মুখখানা যেন নীল হয়ে আছে। খালি গা, পরিধানে একটি পরিষ্কার ধুতি, প্রসারিত দুটি বাহুশয্যার উপরে মুষ্টিবদ্ধ।

প্রথম দর্শনেই বোঝা যায় সে দেহে প্রাণ নেই।

কয়েকটা মুহূর্ত সেই বীভৎস দৃশ্যের সামনে নির্বাক স্থাণুর মতই দাঁড়িয়ে রইলেন মিঃ বসাক।

এ যেন সেই গতকাল সকালের বীভৎস করুণ দৃশ্যেরই হুবহু পুনরাবৃত্তি।

আশ্চর্য, চবিবশ ঘণ্টাও গেল না প্রথম বাড়ির মালিক তারপর বাড়ির পুরাতন ভৃত্য সম্ভবতঃ একইভাবে নিষ্ঠুর হত্যার কবলিত হল।

কে জানত গতকাল রাত্রে এগারোটার সময় সকলকে খাইয়ে দাইয়ে যে লোকটা সকলের শয়নের ব্যবস্থা পর্যন্ত করে দিয়ে বিদায় নিয়ে এসেছিল তার মৃত্যু এত নিকটে ঘনিয়ে এসেছে!

কে জানত মৃত্যু তার একেবারে ঠিক পশ্চাতে এসে মুখব্যাদন করে দাঁড়িয়েছে। প্রসারিত করেছে তার করাল বাহ!

আকস্মিক ঘটনা পরিস্থিতির বিহ্বলতাটা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন ইন্সপেক্টার তাঁর প্রায় পাশেই দণ্ডায়মান রেবতীর দিকে।

রেবতী, কখন তুমি জানতে পেরেছ এই ব্যাপারটা?

সকালে উঠেই এ ঘরে ঢুকে।

সকালে উঠেই এ ঘরে এসেছিলে কেন?

উনুনে আগুন দিয়ে চায়ের ব্যবস্থা করব কিনা জিজ্ঞাসা করতে এসেছিলাম।

ঘরের দরজাটা খোলাই ছিল?

হ্যাঁ। তবে কপাট দুটো ভেজানো ছিল।

রামচরণ কি সাধারণত ঘরের দরজা খুলেই শুত রেবতী?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

তুমি কোন্ ঘরে থাক?

ঠিক এর পাশের ঘরটাতেই।

কাল রাত্রে শেষ কখন তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল রামচরণের, রেবতী।

কত রাত তখন ঠিক আমি বলতে পারব না, আপনাদের খাওয়াদাওয়ার পরই রামচরণ রান্নাঘরে আসে, আমি তখন রান্নাঘর পরিষ্কার করছিলাম। আমাকে ডেকে বললে, তার শরীরটা নাকি তেমন ভাল নয়, আর ক্ষুধাও নেই, সে শুতে যাচ্ছে।

বলেছিল তার শরীরটা ভাল নয়?

হ্যাঁ। অবিশ্যি কথাটা শুনে আমি একটু অবাকই হয়েছিলাম সাহেব।

কেন বল তো?

তা আজ্ঞে আজ পাঁচ বছর হল এ বাড়িতে আমি আছি, কখনও তো রামচরণকে অসুস্থ হতে দেখিনি। তবে কাল রাত্রে বোধ হয়—

কথাটা সম্পূর্ণ শেষ না করে যেন একটু ইতস্তত করেই থেমে গেল রেবতী।

কাল রাত্রে বোধ হয় কী রেবতী? চুপ করলে কেন?

আজ্ঞে, রামচরণ নেশা করত।

নেশা করত? কতকটা যেন চমকিতভাবেই ইন্সপেক্টার প্রশ্নটা করলেন রেবতীকে। হঠাৎ তাঁর মনে পড়ে গিয়েছিল সিংহলী মুক্তার কথা।

প্রভু ভৃত্য দুজনেই কি তবে মুক্তার নেশায় অভ্যস্ত ছিল নাকি!

কি নেশা করত রামচরণ?

আজ্ঞে, রামচরণ আফিং খেত।

আফিং! কথাটা বলে মিঃ বসাক তাকালেন রেবতীর মুখের দিকে।

আজ্ঞে হ্যাঁ। সন্ধ্যার দিকে তাকে রোজ একটা মটরের দানার মত আফিং খেতে দেখতাম। তবে কাল রাত্রে বোধ হয় তার আফিংয়ের মাত্রাটা একটু বেশীই হয়েছিল আমার মনে হয়।

কি করে বুঝলে?

কাল যেন রামচরণের একটু ঝিমঝিম ভাব দেখেছি।

ইন্সপেক্টর কিছুক্ষণ অতঃপর চুপ করে কি যেন ভাবলেন।

তারপর আবার প্রশ্ন করলেন, তুমি তো পাশের ঘরেই ছিলে রেবতী, রাত্রে কোনরকম শব্দ বা গোলমাল কিছু শুনেছ?

আজ্ঞে না!

কোন কিছুই শোননি?

না।

কাল কত রাত্রে শুতে গিয়েছিলে ঘরে?

রামচরণ কথা বলে চলে আসবার পরই খাওয়াদাওয়া সেরে এসে শুয়ে পড়ি।

.

২০.

একটা চাদর দিয়ে রামচরণের মৃতদেহটা ঢেকে রেবতীকে নিয়ে ইন্সপেক্টার বসাক ঘর থেকে বের হয়ে এলেন।

দরজাটা বন্ধ করে রেবতীতে বললেন, ঠাকুর আর করালীকে ডেকে নিয়ে তুমি ওপরে এস রেবতী।

দোতলায় এসে ইন্সপেক্টার দেখলেন মধ্যবয়স্ক একজন ভদ্রলোক দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। উভয়ের চোখাচোখি হল। দোহারা চেহারা হলেও বেশ বলিষ্ঠ গঠন ভদ্রলোকের!

মাথার এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে বেশ মসৃণ চকচকে একখানি টাক।

মাথার বাকি অংশে যে কেশ তাও বিরল হয়ে এসেছে।

উঁচু খাঁড়ার মত নাক। প্রশস্ত কপাল। ভাঙা গাল, গালের হনু দুটো যেন বয়ের আকারে ঠেলে উঠেছে। গোল গোল চোখ। চোখে কালো মোটা ফ্রেমের সেলুলয়েডের চশমা। পুরু লেন্সের ওধার হতে তাকিয়ে আছেন ভদ্রলোক। উপরের ওষ্ঠ পুরু একজোড়া গোঁফে প্রায় ঢাকা বললেও অত্যুক্তি হয় না। নীচের পুরু কালচে বর্ণের ওষ্ঠটা যেন একটু উটে আছে। পুরুষ্টু গোঁফের অন্তরাল হতেও দেখা যায় উপরের দাঁত্রে সারি। উঁচু দাঁত। পরিধানে ধুতি ও গলাবন্ধ মুগার চায়না কোট। পায়ে চকচকে কালো রংয়ের ডার্বি শু।

আপনি? প্রথমেই প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টার।

আমার নাম প্রতুল বোস। এ বাড়ির সরকার। আপনি বোধ হয় পুলিসের কেউ হবেন?

হ্যাঁ। পুলিস ইন্সপেক্টার প্রশান্ত বসাক।

গেটেই পুলিস প্রহরী মোতায়েন দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। তার মুখেই একটু আগে সব শুনে এলাম, কিন্তু ব্যাপারটা যে কিছুতেই এখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারছিনা ইন্সপেক্টর। সত্যিই কি বিনয়েন্দ্রবাবুকে কেউ মাডার করেছে?

হাঁ। ব্যাপারটা যতই অবিশ্বাস্য হোক, সত্যি। আর শুধু তাই নয় প্রতুলবাবু, গত রাত্রে ইতিমধ্যেই আরও একটি হত্যাকাণ্ড এ বাড়িতে সংঘটিত হয়েছে।

তার মানে! কী আপনি বলছেন ইন্সপেক্টার? আবার কাকে কে হত্যা করল কাল রাত্রে এ বাড়িতে!

কে হত্যা করেছে তা জানি না। তবে হত্যা করেছে এ বাড়ির পুরাতন ভৃত্যকে।

কে! রামচরণ!

হ্যাঁ। সে-ই নিহত হয়েছে।

এ সব আপনি কি বলছেন ইন্সপেক্টার! বাড়ির চার পাশে পুলিস প্রহরী, আপনি নিজে উপস্থিত ছিলেন এখানে; এমন দুঃসাহস?

দুঃসাহস বটে প্রতুলবাবু।

ইন্সপেক্টার বসাকের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় দরজা খুলে প্রথমে রজত ও তারপরই সুজাতা যে-যার নির্দিষ্ট ঘর থেকে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল।

বসাকের শেষের কথাটা রজতের কানে গিয়েছিল, সে এগিয়ে আসতে আসতে প্রশ্ন করল, কি দুঃসাহসের কথা বলছিলেন ইন্সপেক্টার?

এই যে রজতবাবু! আসুন কাল রাত্রেও আবার একটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এ বাড়িতে।

সে কি! অস্ফুট আর্ত চিৎকারে কথাটা বলে রজত, আবার! আবার কে নিহত হল?

রামচরণ। রামচরণ!

হ্যাঁ।

সুজাতার মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হয় না। সে ফ্যাল ফ্যাল করে সদ্য-ঘুমভাঙা চোখে বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এবং হঠাৎ যেন কেমন তার মাথাটা ঘুরে ওঠে। ঢুলে পড়ে যাচ্ছিল সুজাতা, ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গেই ইন্সপেক্টার বসাক চকিতে এগিয়ে এসে দুহাত বাড়িয়ে সুজাতার পতনোম্মুখ দেহটা সযত্নে ধরে ফেললেন।

কী হল! কী হল সুজাতা! সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে আসে রজতও। সুজাতার দু চোখের পাতা যেন নিমীলিত। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শিথিল। ইতিমধ্যে ইন্সপেক্টারবাকপাঁজা-কোলে সুজাতার শিথিল দেহটা প্রায় বুকের উপর তুলে নিয়ে এগিয়ে যান সামনের খোলা দরজাপথে ঘরের মধ্যে।

ঘরের মধ্যে খাটের উপর পাতা শয্যাটার উপরে এসে সযত্নে ইন্সপেক্টার সুজাতার দেহটা শুইয়ে দিলেন।

রজত পাশেই এসে দাঁড়িয়েছিল। তার দিকে তাকিয়ে ইন্সপেক্টার বললেন, দেখুন তো ঘরের কোণে ঐ কুঁজোতে বোধ হয় জল আছে।

কুঁজোর পাশেই একটা কাঁচের গ্লাস ছিল, প্রতুলবাবুই গ্লাসে করে তাড়াতাড়ি কুঁজো থেকে জল ঢেলে এনে দিলেন।

কী হল! একজন ডাক্তার কাউকে ডাকলে হত না? রজত ব্যগ্র কণ্ঠে বলে।

গ্লাস থেকে জল নিয়ে শায়িত সুজাতার চোখে-মুখে জলের মৃদু ঝাপটা দিতে দিতে সুজাতার নিমীলিত চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ইন্সপেক্টার বসাক বললেন, না। ব্যস্ত হবেন না রজতবাবু। একেগতকালের ব্যাপার থেকে হয়অেস্ট্রেনযাচ্ছিল, তার উপর আজকের নিউজটা একটা শক্ দিয়েছে। তাই হয়তো জ্ঞান হারিয়েছে। আপনি বরং পাখার সুইচটা অনুগ্রহ করে অন্ করে দিন।

রজত এগিয়ে পাখার সুইচটা অন করে দিল।

মৃদু মিষ্টি একটা ল্যাভেণ্ডারের গন্ধ নাসারন্ধ্রে এসে প্রবেশ করছে। জলবিন্দুশোভিত কোমল চার কপালটি, তার আশেপাশে চুর্ণকুন্তলের দু-এক গাছি স্থানভ্রষ্ট হয়ে জলের সঙ্গে কপালে জড়িয়ে গিয়েছে। নিমীলিত আঁখির জলসিক্ত পাতা দুটি মৃদু কাঁপছে। বাম গণ্ডের উপরে কালো ছোট্ট তিলটি।

অনিমেষে চেয়ে থাকেন ইন্সপেক্টার বসাক মুখখানির দিকে। শুধু কি মুখখানিই! নিটোল চিবুক, ঠিক তার নীচে শঙ্খের মত সুন্দর গ্রীবা। গ্রীবাকে বেষ্টন করে চিকচিক করছে সরু সোনার একটি বিছে হার। গলাকাটা ব্লাউজের সীমানা ভেদ করে থেকে থেকে নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলিত হচ্ছে যেন সুধাভরা দুটি স্বর্ণকুম্ভ।

চোখের দৃষ্টি যেন ঘুরিয়ে নিতে পারেন না ইন্সপেক্টার বসাক। সত্যিই আজ বুঝি সুপ্রভাত।

সব কিছু ভুলে গিয়ে যেন ইন্সপেক্টার চেয়ে রইলেন বসে সেই মুখখানির দিকে।

এবং বেশ কিছুক্ষণ পরে কম্পিত ভীরু চোখের পাতা দুটি খুলে তাকাল সুজাতা।

সুজাতাদেবী! স্নিগ্ধ কণ্ঠে ডাকেন ইন্সপেক্টার বসাক।

বিস্রস্ত বেশ ঠিক করে উঠে বসবার চেষ্টা করে সুজাতা, কিন্তু বাধা দেন ইন্সপেক্টার বসাক, উঠবেন না, আর একটু শুয়ে থাকুন। চলুন রজতবাবু, আমরা বাইরে যাই। উনি একটু বিশ্রাম নিন।

ইন্সপেক্টার বসাকের ইঙ্গিতে সকলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

দরজাটা নিঃশব্দে ভেজিয়ে দিলেন বসাক।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *