নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে (Neelkantho Pakhir Khoje) – প্ৰথম খণ্ড : 04
একটা হাড়গিলে পাখি অনবরত সেই থেকে ডাকছে। বাড়িটার উত্তরে মোত্রা ঘাসের জঙ্গলে। এখন সেখানে নানারকমের কীটপতঙ্গ উড়ে বেড়াচ্ছে। বড় বড় কুমীরের মতো দুটো গোসাপ ঝোপের ভিতর ঢুকে গেল। পাখিটা তবু ডাকছে, অনবরত ডাকছে। মালতী আতাফল গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে সব শুনল। সে জঙ্গলের কাছে যেতে সাহস পাচ্ছে না। একাদশীর পরদিন, বেশ ঝালটাল খেতে ইচ্ছা হচ্ছে। বেতের ডগা সেদ্ধ খেতে ইচ্ছা হচ্ছে। নরম নরম ডগা একটু সর্ষের তেল এবং কাঁচা লঙ্কা হলে তো কথাই নেই। মালতী নরম বেতের ডগা কাটার জন্য আতাফল গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে থাকল। বেতঝোপে বোলতার চাক, ঝোপের ভিতর পাখিটা ডাকছে অথবা সাপে যদি ছানা খায়, পাখি গিলে খায়—এমন ভয়ে মালতী গাছটার নিচে থেকে নড়তে পারল না। মালতীর হাতে একটা লম্বা বাঁশ। বাঁশের ডগায় সে একটা পাতলা দা বেঁধে রেখেছে। সে কেবল ইতস্তত করছিল। গাছে আতাফুলের গন্ধ।
ছোট একটা বেগুন খেত অতিক্রম করে আভারানীর রান্নাঘর। নরেন দাসের সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁতের ঘরে অমূল্য তাঁত বুনছে। মাঝে মাঝে ওর মেঘভাসি গান ভেসে আসছিল। নরেন দাসের বৌ আভারানী বারান্দায় বসে বসে ডাঁটা কুটছে। মালতী এখনও বেতের ডগা নিয়ে ফিরছে না—সে ডাকল, মালতী অ মালতী ব্যালা বাড়ে না কমে।
মালতী আতাফুলের গন্ধ শুকতে শুকঁতে কেমন বিভোর। ঝোপের ভিতর পাখিটার কেমন থেকে থেকে কান্না। দূরে জব্বর হাল চাষ করছে জমিতে। এটা কি মাস, ফাল্গুন হতে পারে, মাঘের শেষ হতে পারে। মালতী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হিসেব করল। এখন জব্বর অকারণে উঠে আসতে পারে, এসে বলতে পারে, মালতী দিদি এক বদনা পানি দ্যান। মালতী এমন সব দৃশ্য দেখতে দেখতে অথবা শুনতে শুনতে হাঁকল, বৌদি, আমার জঙ্গলে ঢুকতে ডর করে। হাড়গিলে পাখিটা সেই থাইকা ডাকতাছে।
—হাড়গিলা পাখি ডাকতাছে ত তর কি?
—মনে হয় পাখিটারে সাপে গিলতাছে।
—তরে কইছে?
মালতী আর কথা বাড়াল না। দেখল মালতী, গোপাট পার হয়ে সামু এদিকে হেঁটে আসছে। এসে একটা কাগজের মতো কিছু ফেলুকে দিয়ে গাছের গুঁড়িতে সেঁটে দিচ্ছে। মালতী ডাকল সা…মু…উ…, অ…সা…মু…উ।
সামু বুঝল মালতী স্বামীর শোক ভুলে যাচ্ছে। বুঝল শৈশবে মালতী যেমন ওকে দিয়ে ঝোপজঙ্গল থেকে চুকৈর ফল আনিয়েছে, বেত ফল আনিয়েছে অথবা শাপলা-শালুকের দিনে যেমন সামু কত ফুল ফল তুলে দিত, তেমনি আজ হয়তো কিছু তুলে আনতে বলবে—সে গাছের নিচ থেকেই হাত তুলে জবাব দিল। বলল, আইতাছি। ইস্তাহারটা ঝুলাইতে দে।
মালতী সেই আগের মতো গলা ছেড়ে কথা বলল, কিসের ইস্তাহার রে সামু?
—লীগের ইস্তাহার।
—অরে আমার লীগ। আগে শোনত, পরে লীগ করবি।
সামু কাছে এলে বলল, দুইটা বেতের ডগা কাইটা দে। বলে, দা এবং বাঁশটা সে সামুকে এগিয়ে দিল।
সামুসুদ্দিন দাটা বাঁশের আগায় শক্ত করে বাঁধল। তারপর ঝোপের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। হাড়গিলে পাখিটা আর ডাকতে পারছে না। কেমন নিভে আসছে। থেকে থেকে অনেকক্ষণ পর পর ডাকছে। ঝোপজঙ্গল ভেঙে ভিতরে ঢুকলে কিছু পোকা উড়ল এবং মুখে শরীরে বসল। সে পোকামাকড় শরীর থেকে উড়িয়ে দিয়ে দুটো কচি বেতের ডগা কেটে আনল।–দ্যাখ, আর লাগব নাকি?
—না। মালতী দা-টা এবং বাঁশটা সামুকে মাটিতে রাখতে বলল।
সামু বাঁশটা মাটিতে রেখে দিল। মালতী আলগা করে তুলে নিয়ে হাঁটছে। সামু পেছনে পেছনে আসছে, মালতী মুখ না ঘুরিয়েও তা টের পেল। দা-টা সামু বাড়ি রেখে যাক—মালতীর এমন ইচ্ছা। যেতে যেতে মালতীর মনে হল শরীরে ব্লাউজ নেই—খালি গা, পিঠ বুক খালি, বার বার সে কাপড় সামলেও যেন শরীর ঢেকে রাখতে পারছে না। মানুষটা পেছনে আসতে আসতে ওর শরীর থেকে আতাফুলের সুবাস নিচ্ছে, সুবাস নিতে নিতে মানুষটা কতদূর পর্যন্ত যাবে টের পাচ্ছে না। মালতী তাড়াতাড়ি কাপড়ের আঁচলটা চাদরের মতো করে শরীর ঢেকে দিল। পেছনে সামু আসছে ভাবতেই, শরীরে কী যে এক কোড়াপাখি আছে—সময়ে অসময়ে কেবল ডাকে, কোড়াপাখিটা ডেকে উঠতেই মালতীর গা কাঁটা দিল। সুতরাং সে পিছনের দিকে না তাকিয়েই বলল, সামুরে, সামু, তর আর আসতে হইব না। তুই বাড়ি যা।
সামু নিঃশব্দে দা-টা নরেন দাসের বারান্দায় রেখে মাঠে নেমে গেল। মালতী বেতের খোল তুলতে তুলতে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। কচি কচি নরম শাঁস। সেদ্ধ দিলে একবারে মাখনের মতো নরম। আতপ চালের সুগন্ধ, সামান্য ঘি আর বেতের ডগা সেদ্ধ বৈধব্যের এক মনোরম ভোজ্যদ্রব্য। একাদশীর পরদিন এমন নরম ডগা পেয়ে মালতীর জিভে জল এসে গেল। সঙ্গে সঙ্গে শৈশবের কিছু ছবি ওর চোখের উপর ভেসে উঠল। সামসুদ্দিন, রসো, রঞ্জিত কতদিন মালতীকে মাঠ থেকে মেজেন্টা রঙের চুকৈর ফল এনে দিয়েছে। তারপর কোন কোন ঋতুতে বেতফল, লটকন ফল এমন কি বকুল ফুল সংগ্রহের জন্য ওরা পরস্পর প্রতিযোগিতা করত। এমন সব সুখস্মৃতিতে দিনটা কাটলেও রাত কাটতে চায় না মালতীর। জানালা খোলা রেখে কেবল সাদা জ্যোৎস্নায় মাঠ দেখতে ভালবাসে। মাঝে মাঝে সেই জ্যোৎস্নায় এক দানবের মতো মহাকাল—কি যে এক মহাকাল, কি যে তার মুখব্যাদান, রাঙাজবার লাখান চক্ষে ঠোঁট ব্যাদান কইরা রাখে–রাক্ষুসি এক, তারে তাড়া কইরা মারে। সারারাত তখন ঘুম আসে না মালতীর। শেষ রাতের দিকে ঘুম আসে। যখন ঘুম ভাঙে তখন ভোরের সূর্য অনেক উপরে। আভারানী ডেকে ডেকে হয়রান। নরেন দাস তাঁতঘর থেকে হাঁকবে—অরে ঘুমাইতে দ্যাও। এতবড় শোকটা অরে ভুলতে দ্যাও। ঘুমের ভিতর এক সুখপাখি মালতীর কেবল কাইন্দা কাইন্দা মরে-জলে নাও ভাসাওরে, আমারে লইয়া যাও বিলের জলে, ডুইবা মরি আনধাইরে।
মালতী আতা বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখল, সামু নিঃশব্দে কখন চলে গেছে। তাঁত ঘরে চরকার শব্দ, মাকুর শব্দ। উঠোনে ধানের মলন দিচ্ছে মনজুর। চারটা বড় বড় মেলার গরু মলনে তুলে দিচ্ছে।
দীর্ঘ দু’মাস পর মালতীর চোখ এই আকাশ এবং ধরণীকে প্রীতিময় ভেবে খুশি। ভোরে সেজন্য সামুকে চিৎকার করে ডাকতে পারল। কতকাল পর যেন সে এই মাটির মতো ফের সুজলা সুফলা অথবা যেন দুঃখের ভারে নিয়ত ভুগতে নেই—সে খুব খুশি খুশি মুখে অনেকদিন পর আঁচলে মুখ মুছল। অনেকদিন পর সে ছুটে গেল পুকুরের পাড়ে, পেয়ারা গাছের নিচে। গাব গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে দেখল গাছে কোনও পাকা গাব আছে কিনা–থাকলে সে কোটা দিয়ে গাব পাড়বে, তারপর গাবের বিচি চুষতে চুষতে স্বামীর ঠোঁট অথবা জিভে কি ভয়ঙ্কর স্বাদ—সে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে একটা পাকা গাব খুঁজে পেলে ফুৎফাৎ বিচি বাতাসে ওড়াবে। গাবের পাকা পিছল বিচি আর স্বামীর ঠাণ্ডা জিভ চুষতে যেন এক রকমের। একটা পাকা গাব খাবার জন্য ওর সুন্দর কচি মুখটা কেমন লাল হয়ে উঠল। বিধবা মালতী গাছের নিচে দাঁড়িয়ে এখন গাছ দেখছে কি পাখি দেখছে বোঝা যাচ্ছে না।
না, গাছে একটাও পাকা গাব নেই। শীতকাল শেষ হলে পাকা গাব আর গাছে থাকে না। সে বাড়ি উঠে এলে দেখল আভারানী, মালতী কি খাবে, কি খেতে ভালবাসে—বিধবা মানুষের কি আর রান্না, তবু যত্ন নিয়ে সাদা পাথরে মালতীর তরকারী কেটে রাখছে। মালতী চুপচাপ বৌদির পাশে ঘন হয়ে বসল, বলল—সামু আগের মতই আছে বৌদি। ডাকলাম আর দৌড়াইয়া আইসা পড়ল। বেতের ডগা কাইটা দিল।
আভারানী বলল, সামু কি একটা পাস দিল না ল?
—সামু অর মামার বাসায় থাইকা পাস দিল। তোমাগ জামাইর কাছে কত দিন ঘুরছে একটা চাকরির লাইগা। চাকরি একটা দেখছিল, কিন্তু বৌদি কি যে হইল…মালতী এই পর্যন্ত বলে আর প্রকাশ করতে পারল না, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল—বৌদি আমার যে আর বাঁচতে ইচ্ছা হয় না।
আভারানী বলল, কান্দিস না।
বৌদিকে মালতী কাজে সাহায্য করছে। ধীরে ধীরে সে কিছু বেতের ডগা কুচি করে নিল। এইসব করতে করতে মনের ভিতর সেইসব বিসদৃশ ঘটনা উঁকি মারলে চুপচাপ হয়ে যায় মালতী। বড় বড় চোখে সংসারের সব কিছু দেখে। এবং বড় অর্থহীন মনে হয়। চুপচাপ বসে থাকলেই স্বামীর নানারকমের ছোটখাটো মান-অভিমানের কথা মনে হয়। জলে চোখের কোণটা ভিজে যায়। মালতীর এখন আর কিছুই ভালো লাগল না। সুতরাং বারান্দা থেকে উঠে ফের বেগুন খেত অতিক্রম করে যেখানে হাড়গিলে পাখিটা ডাকছিল সেদিকে হেঁটে গেল। নির্জন এই জায়গাটুকু ওর ভালো লাগছে। সে অন্যমনস্কভাবেই লেবু গাছ থেকে দুটো পাতা ছিঁড়ল। পাতাদুটো মুচড়ে গন্ধ নিল। এবং অকারণ জঙ্গলে বসে প্রিয়তমের চোখ মুখ ভাবতে ভাবতে, আহাঃ, কত বিচিত্র সব মধুর স্মৃতি—শেষে আরও কী সব ভেবে ভেবে উদাস।
এখান থেকে হিজল গাছটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পথ ধরে যারা গেল তারা সকলেই ইস্তাহারটা ঝুলতে দেখল। যারা পড়তে পারছে, তারা দাঁড়িয়ে ইস্তাহারটা পড়ছে। সামু বেকার, সুতরাং লীগের পাণ্ডা। সামু গাছে গাছে মুসলমান গাঁয়ে গাঁয়ে এই ইস্তাহার ঝুলিয়ে শান্তি পাচ্ছে। মালতীর বড় ভয়ঙ্কর ইচ্ছা ইস্তাহারটা পড়ে দেখে—সামু ইস্তাহারে কী লিখেছে অথবা ধীরে ধীরে গিয়ে সকলের অলক্ষে সন্তর্পণে ছিঁড়ে দেয়। দিলে কেউ টের পাবে না। সামু টের পেলে শুধু বলবে, এডা করলি ক্যান?
—ক্যান করুম না। দেশটা কেবল তর জাতভাইদের?
—ক্যান আমার জাতভাইদের হইব। দেশডা তর আমার সকলের।
—তবে কেবল ইসলাম ইসলাম করস ক্যান?
—করি আমার জাতভাইরা বড় বেশি গরু-ঘোড়া হইয়া আছে। একবার চোখ তুইল্যা দ্যাখ, চাকরি তগ, জমি তগ, জমিদারী তগ। শিক্ষা দীক্ষা সব হিন্দুদের।
—হইছে। মনে মনে মালতী ফয়সালা করে ইস্তাহারটার দিকে হাঁটতে থাকল। ইস্তাহারটা ঝুলছে। সামনের দুটো ধানজমি পার হলেই গাছটা। গাছটা নরেন দাসের। যেন এই গাছে ইস্তাহার ঝোলানোর উদ্দেশ্য, মালতীও একবার পড়ে দেখুক—ইসলাম বিপন্ন। এই বিপন্ন সময় থেকে জাতিকে উদ্ধার করতে হবে।
এখন মাঠ ফাঁকা। ধান গাছ, কলাই গাছ, এমন কি মটরের জমি ফাঁকা। কিছু তামাকের খেত, পেঁয়াজের খেত। সে হেঁটে যাবার জন্য আলে আলে গেল না। সবাই জমি চাষ করে রেখেছে। শুকনো জমি। বড় বড় ডেলা মাটির। জমি ভেঙে সে সোজা হেঁটে গেল। হাঁটুর উপর কাপড় তুলে, দ্রুত গাছটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মাটিতে পায়ের ছাপ, এবং আকাশ কতদিন পর নীল স্বচ্ছ। মালতী গাছটার দিকে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। হাওয়ায় চুল উড়ছে। পাশের জমিতে একদা রসো এবং বুড়ি ডুবে মরেছিল এমন এক স্মৃতির উদয় হতে সে স্বল্প সময়ের জন্য এখানে দাঁড়াল। যেন কোনও এক অশ্রুজল নিরপেক্ষ ভালোবাসার বৃত্ত এই জমিতে দীর্ঘদিন পত্তন করে রেখেছে মানুষেরা।
সে হাঁটতে থাকল। ইস্তাহারটা এখনও বাতাসে নড়ছে। গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে মালতী ইস্তাহারটা পড়তে পড়তে উত্তেজিত। হক সাহেব নতুন নতুন কথা বলছেন। নাজিমুদ্দিন সাহেবের একটা ছবি ইস্তাহারের এক কোণে। মালতী এ-সময়ে দেখল দূরের সব জমিতে হাল চাষ হচ্ছে। ওরা হাল চাষ করছে এবং গান গাইছে। সামসুদ্দিনের এই বিদ্বেষ মালতীর ভালো লাগল না। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে সন্তর্পণে ইস্তাহারটা গাছ থেকে টেনে তুলে ফেলল। তারপর হনহন করে বাড়িতে উঠে এসে যেখানে হাড়গিলে পাখিটা সেই সকাল থেকে ডাকছে—সেখানে দাঁড়িয়ে থাকল। স্বামীর মুখ মনে হতেই সে চিৎকার করে বলতে চাইল—আমি ঠিক করছি। সামুরে, তর সর্দারি আমার ভাল লাগে না। তুই তো ভাল মানুষ আছিলি রে।
হাড়গিলে পাখিটা আবার ডাকতে শুরু করেছে। কুহক্ কুহক্ ডাকছে। ঝোপের কোথায় যে শব্দটা উঠছে—কিসের জন্য যে পাখিটা অনবরত ডাকছে মালতী বুঝতে পারল না। শব্দটা মনে হয় বড় দূর থেকে ভেসে আসছে। মোত্রাঘাসের জঙ্গলে জল নেই। জল নেমে গেছে, গাছের গুঁড়িতে হলদে মতো দাগ। সে, ডাকটা কোথায় উঠছে, কেন পাখিটা নিরন্তর ডেকে চলেছে দেখার জন্য বেগুন খেতে বসে ঝোপের ভিতর উঁকি দিল। পাখিটা ডাকছে, অনবরত ডাকছে—নিশ্চয়ই ওর কোনও অসহ্য কষ্ট। সে নানাভাবে উঁকি দিতে থাকল—কখনও বেত পাতা সরিয়ে, কখনও জঙ্গল ফাঁক করে, কখনও মাটির সঙ্গে মিশে গিয়ে ঝোপে জঙ্গলে পাখিটা কোথায় আছে দেখার জন্য উদগ্রীব হল। সে মোত্রাঘাসের জঙ্গলে ঢুকে গোড়ালি তুলে উঁকি দিল—ওখানে নেই পাখিটা, শব্দটা যেন ঝোপের গহন অবস্থান থেকে আসছে। সে বাড়ি থেকে কোটা এনে ভিতরটা খোঁচা দিয়ে দেখবে এই ভেবে চোখ ফেরাতেই দেখল ভীষণ কালো রঙের একটা পানস সাপ ঠেলে ঠেলে ঘন ঝোপে ঢুকে যাবার চেষ্টা করছে, কিন্তু নড়তে পারছে না। কেমন লাল ঠিক বেদানার কোয়ার মতো চোখ নিয়ে মালতীকে দেখছে। পাখিটার প্রায় অর্ধেকটা শরীর সাপটার মুখে এবং গলায়। এতবড় পাখিটাকে কি করে গিলছে দ্যাখ! মালতী ভয়ে চিৎকার করে উঠল, বৌদি, দ্যাখেন আইসা কাণ্ড! হাড়গিলা পাখিরে পানস সাপটা কি কইরা গিলতাছে।
—আল মরা, তরে খাইব। বলে আভারানী ছুটে এসে হাত ধরে টেনে আনল মালতীকে। আর মালতী জমিতে উঠেই দেখল সামু এ দিকেই হনহন করে আসছে। মুখে ওর কার্তিক ঠাকুরের মতো সরু গোঁফ এবং সমস্ত অবয়বে অভিমানের চিহ্ন। সামসুদ্দিন মালতীর মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। নরেন দাসের বৌ অদূরে ভীত-সন্ত্রস্ত। অথচ দেখল সামু অত্যন্ত বিনীত। ক্ষত-বিক্ষত, এমন স্বর গলায়—বলছে, তুই ইস্তাহারটা ছিঁড়লি ক্যান মালতী?
—ছিঁড়লাম, হইছেডা কি?
—তুই জানস না, ঢাকা থাইকা কত কষ্ট কইরা এগুলি আনাইতে হয়। কোন দিন আর ছিঁড়বি না!
—ছিঁড়ুম, একশবার ছিঁড়ুম, এমন কথা বলার ইচ্ছা হল মালতীর। কিন্তু সামুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারল না। সে এবার কি ভেবে বলল, দ্যাখছস কতবড় হাড়গিলা পাখিটারে সাপটা ধইরা খাইতাছে।
সামসুদ্দিন তাড়াতাড়ি পিছনের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। এবং দেখল সাপটা এবার পাখিটাকে প্রায় গিলে এনেছে এবং গিলে ফেলতে পারলেই টেনে টেনে শরীরটা এদিকে নিয়ে আসবে। আর যদি কোনও কারণে সাপের মুখ থেকে পাখি ফসকে যায়—তবে আর নিস্তার নেই। সামু, এবার ধমক দিল, এই ছেরি, ভয়-ডর নাই? যা বাড়ি যা।
—আরে আমার শাসকরে। মালতী কিঞ্চিৎ দজ্জাল মেয়েমানুষের মতো গলার স্বর করতে চাইল—কিন্তু না পেরে হোহো করে হেসে দিল।
—হিটকানি থাকব না মালতী। মুখ থাইক্যা আহার ছুইটা গেলে সাপের মাথা ঠিক থাকে না।
—মানুষের মাথা ঠিক থাকে?
সামসুদ্দিন কেমন চোখ ছোট করে তাকাল। মালতীকে দেখল। মালতীর শরীরে পুবের দেশ থেকে বন্যা আসার মতো অথবা উজানি নদীর মতো রূপলাবণ্যে ঢল নেমেছে। বিধবা হলে কি যুবতী মাইয়ার শরীর রূপের সাগরে ভাইস্যা যায়! মালতীকে সামু শেষ পর্যন্ত বলল, যা বাড়ি যা। জঙ্গলে আর খাড়াইয়া থাকতে হইব না।
মালতী নড়ল না। মালতী ফের ঝোপটার ভিতর উঁকি দিল। একটা শুকনো ডালে সাপটা শরীর পেঁচিয়ে রেখেছে। লাল চোখ দুটো বেদানার কোয়ার মতো উজ্জ্বল। ওরা একটু দূরে এসে দাঁড়াল। ওরা এখন কথা বলছে না—পাখিটাকে সাপের গলায় অন্তর্হিত হতে দেখছে। গলাটা ফুলে ফুলে সহসা সরু হয়ে গেল। তারপর সাপটা মৃতের মতো ডালে ঝুলতে থাকল একসময়।
পরদিন ভোরে মালতী সকালে উঠে হাঁসগুলোকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে পুকুরে ফেলল। একটা গাছের গুঁড়িতে বসে জলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখল। শরীরে সাদা থান, শরীরের লাবণ্য এই কাপড়ের বিসদৃশ রঙে চাপা পড়ছে না। মালতীর সোনার শরীর—প্রজাপতির মতো মন অথচ রাতে গভীর ঘুমের জন্য এ-সময় গাছের গুঁড়িটার মতো মনটা বড় নির্বোধ। পায়ের পাতা ডুবিয়ে গাছের গুঁড়িতে বসে আছে। হাঁসগুলি জলে নেমেই এখন সাঁতার কাটবে, এবং এক রকমের খেলা—ওরা জলে ভেসে ভেসে অথবা ডুবে ডুবে অনেক নিচে চলে যাচ্ছে এবং ভেসে উঠেই পুরুষ হাঁসটা অন্য হাঁসগুলিকে তাড়া করছে অথবা পুরুষ হাঁসটা ছুটে ছুটে—যেমন তার মানুষ তাকে ছুটে ছুটে ঘরের ভিতর অথবা বাগানের ভিতর এবং রাত গভীর হলে লুকোচুরি খেলা—ছুইছুই খেলা—খেলতে খেলতে যখন আর ছুটতে পারত না তখন মানুষটা তাকে সাপ্টে ধরত এবং পাঁজাকোলা করে নিয়ে যেন কোন এক পাহাড়ে অথবা নদীর পাড়ে চলে যেতে চাইত—কী যে সুখ সুখ খেলা-হাঁসগুলি এখন তেমনি সুখ সুখ খেলা খেলছে। মালতীর পা ক্রমে স্থির হয়ে আসছে—শরীর শক্ত হয়ে আসছে। সুন্দর পা ওর জলের নিচে মাছরাঙার মতো ক্রমে ডুবে যাচ্ছিল। কেবল থেকে থেকে রঞ্জিতের কথা মনে পড়ছে। সে তখন বালক ছিল। ঠাকুরবাড়ির বড়বৌর ছোট ভাই। সে এখন কোথায় আছে কে জানে! শুনেছে সে এখন নিরুদ্দেশ। কেউ তার খোঁজ রাখে না।
পুকুরের ও-পাশের ঝোপটায় একটা বড় মাছ নড়ে উঠল। কৈশোরে মালতী মাছ ধরত—যখন বর্ষাকাল, যখন গয়না নৌকায় বাদাম উড়ত, ঝোপেজঙ্গলে টুনি ফুল ফুটে থাকত, তখন এই ঘাটে কত যে চেলা মাছ, ডারকীনা মাছ এবং শাড়ি-পরা পুঁটি মাছ—মালতী সরু ছিপ দিয়ে বর্ষাকালে শাড়ি-পরা পুঁটি মাছ ধরত। একদিন নির্জন বিকেলে রঞ্জিত পাশে দাঁড়িয়ে মাছ ধরতে ধরতে ফিসফিস করে বলেছিল—যাবি? যাবি মালতী?
মালতী জানত রঞ্জিত এই কথায় কী বলতে চায়। সে অবুঝের মতো চোখে মুখে এক বোকা ভাব ছড়িয়ে রাখত। রঞ্জিত আর বলতে সাহস পেত না।
মালতী গাছের গুঁড়িতে বসে থাকল। উঠতে ইচ্ছা করছে না। পুকুরের জল নিচে নেমে গেছে। সুতরাং গাছের গুঁড়িটাকেও গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে নামানো হয়েছে। গাছের গুঁড়িটা ছিল সিঁড়ির মতো—সেই কবে গুঁড়িটা এখানে ছিল। রসো, রঞ্জিত, সামু বর্ষায় গুঁড়ি থেকে জলে লাফ দিয়ে পড়ত, ডুবত, ভাসত অথবা সাঁতার কেটে বর্ষার জলে ঝোপে জঙ্গলে লুকিয়ে মালতীকে ভয় দেখাত। রাতের কিছু কিছু স্বপ্ন, পুকুরের জল, হাঁসগুলির সুখী জীবন, সামনের মাঠ এবং যব-গমের খেত, কিছু কৃষকের এক সুরে ফসল কাটার গান সব মিলে মালতীকে কেমন আচ্ছন্ন করে রাখছে। রাতের কিছু স্বপ্ন অস্পষ্ট ‘স্মৃতির মতো—প্রিয়তমের মুখ গন্ধপাদালের ঝোপ থেকে যেন উঁকি মারছে। প্রকৃতির নীরবতা এবং ভোরের এই মাধুর্য মালতীকে ক্লিষ্ট করছে—হিজল গাছে সামু ইস্তাহার ঝোলাল—দেশটা দিন দিন কি যে হয়ে যাচ্ছে! মালতী এবার পুকুর থেকে হাতমুখ ধুয়ে উঠে এল। প্রিয়তমের মুখ স্মৃতির অতল থেকে তুলে এনে ঈশ্বরের নাম স্মরণ করতে গিয়ে দেখল চোখে জল মালতীর।
নরেন দাস ফিরছে পশ্চিমপাড়া থেকে। ওর হাতে গলদা চিংড়ি। সে দেখল, মালতী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেমন নিবিষ্ট মনে হাঁসগুলির সাঁতারকাটা দেখছে। কেমন অন্যমনস্ক মালতী। নরেন দাস ইচ্ছে করেই গলায় এক রকমের উপস্থিতির শব্দ করল এবং যখন দেখল সংকোচে মালতী এতটুকু হয়ে গেছে—কি যেন তার ধরা পড়ে গেছে ভাব—এই যে খেলা, হাঁসের খেলা—খেলা তার ইহজীবনে আর বুঝি হবে না—সব শেষ। কেমন সে বিহ্বলভাবে তাকাল। নরেন দাসও কেমন সরল বালকের মতো, যেন কিছু বুঝতে পারেনি এমন এক চোখ নিয়ে তাকল। বলল, দ্যাখ দ্যাখ, কতবড় ইছা মাছ ধইরা আনলাম। মাছগুলি ভাতে সিদ্ধ দেইস। কিন্তু তখনই মনে হল, দাসের বোন মালতী বিধবা। সে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস চেপে বাড়িতে উঠে গেল।
মালতী দাদার সঙ্গে পুকুরপাড় থেকে উঠে যাবার সময় বলল, দাদারে, সামু হিজল গাছটাতে ইস্তাহার ঝোলায়, অরে বারণ কইরা দেইস।
—বারণ কইরা দিলে অন্যখানে ঝোলাইব।
মালতী বুঝল প্রতিবাদে নরেন দাস যথার্থই অক্ষম। সুতরাং মাসখানেক পর সামসুদ্দিন যখন ফের ইস্তাহার ঝোলাতে এল, মালতী মাঠ পার হয়ে নেমে গেল। বলল, ইস্তাহার ঝুলাইবি না।
—ক্যান?
—গাছটা আমার দাদার।
—তা হয়েছে কি!
—তর গাছ থাকলে সেখানে ঝুলইয়া দে।
—আমার গাছ এডা। তুই যা করতে পারিস করবি।
—বড় বড় কথা কইবি না সামু। অদিনের পোলা, অখনই মাতব্বর হইয়া গেছস! নাকে তর দুধের গন্ধ আছে।
—তর নাকে কিসের গন্ধ ল ছেরি। বলে ইস্তাহরাটাকে গাছে উঠে অনেক উপরে ঝুলিয়ে দিল।—নে পাড়। কত তর ক্ষ্যামতা দেখি।
—আইচ্ছা! মালতী হনহন করে বাড়ি উঠে গেল। গাব গাছটার নিচে এসে দাঁড়াল।
সামু মালতীর এই রাগ দেখে মনে মনে হাসল। মালতী আগের মতেই জেদী একগুঁয়ে মালতী। কিন্তু মনের ভিতর কী এক শপথ সব সময় কাজ করছে। গাঁয়ে উঠে যাবার সময় ওর চোখমুখ দৃঢ় দেখাল। অথচ গাঁয়ের সবুজ বন ঝোপ দেখে মনটা আর্দ্র হয়ে উঠেছে। মালতীর শস্যদানার মতো রঙ শরীরের—তাছাড়া শৈশবের কিছু কিছু প্রীতিপূর্ণ ঘটনা, স্বামীর সাম্প্রদায়িক মৃত্যু এবং বৈধব্য বেশ, সব মিলে মনে এক অপার বেদনা সঞ্চার করছে সামুর। এই উগ্র জাতীয়তাবোধ ওর ভাল লাগল না। সে ছুটতে থাকল। সে আর হিজল গাছে ইস্তাহার ঝোলাবে না, অন্য কোনখানে গিয়ে ইস্তাহারটা টাঙিয়ে দেবে। সে ছুটে মাঠে নেমে দেখল, হিজল গাছের নিচে মালতী—একটা লম্বা বাঁশ দিয়ে—মনে হয় ওর সেই বাঁশটা, যা দিয়ে বেতের ডগা কেটে দিয়েছিল—মালতী টেনে ইস্তাহারটা নামাচ্ছে। কেমন পায়ের রক্ত সব সামুর মাথায় উঠে এল। উত্তেজনায় অধীর সামু স্থির থাকতে পারল না। কাছে এসে রুষ্ট মুখে দাঁড়াতেই মালতী হেসে দিল।—কি দ্যাখলি, পাড়তে পারি কিনা!
মালতীর এই উচ্ছ্বলতাকে অপমান করার স্পৃহা সামুর। এই প্রবঞ্চনামূলক ঘটনাতে সে নিজের দুর্বলতাকে দায়ী করে অত্যন্ত দৃঢ় এবং রুক্ষ কণ্ঠে বলল, তুই না বিধবা হইছস মালতী। এই হাসি ত তর মুখে ভাল লাগে না।
—সামু…রে! মালতী, ইস্তাহারসহ ঢলে পড়ার মতো গাছের গুঁড়িতে বসে পড়ল। এক শিশুসুলভ কান্নায় ভেঙে পড়ছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বিধবা মানুষের হাসতে নেই। মালতী বিধবা, সামু বার বার কথাটা যেন মনে করিয়ে দিল। সামু মালতীর এমন চোখমুখ সহ্য করতে না পেরে গাঁয়ের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। মালতী ক্রমে শান্ত হয়ে এল। পায়ের কাছে ইস্তাহার। মাঠ ফাঁকা। সে এবার মুখ তুলে দেখল সামু নেই—দূরে সে গ্রামের দিকে উঠে যাচ্ছে। কিছু মেলার গরু যাচ্ছে! গলায় ওদের ঘণ্টা বাজছে। কিছু লটকন গাছ, এখন বসন্তকাল বলে গাছে কোনও ফল নেই। নানারকম পাখি উড়ে এসেছে এ দেশটায়। বিলের জল কমে গেছে, সেই বড় বিলে, বাবুদের হাতি আসার কথা, কারণ এ-সময়ে বিলের জলে নানারকমের হাঁস উড়ে আসবে। ওর মনে হল, অনেক দিন ধরে সে সেই হাতি, মুড়াপাড়ার হাতির গলায় ঘণ্টা বাজতে শুনছে না। এই হাতি দেখলে সে সাহস পায়।
তারপর এ অঞ্চলের ঘাস ফুল পাখি চৈত্রের গরম বাতাস সহ্য করে কাল-বৈশাখীর অপেক্ষাতে থাকল। এখন মাঠ খাঁ খাঁ করছে। আকাশ কাঁসার বাসনের মতো রঙে ধূসর হয়ে আছে। কিছু পাখপাখালি আকাশে উড়লে মনে হয় খড়কুটো উড়ছে। যেন এই মাঠ এবং নদী আর তরমুজ খেত সব পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। সূর্যের রঙ কমলার খোসার মতো। পলাশ গাছ নেড়া নেড়া। শিমুল গাছে নতুন পাতা এসেছে। ধানের খেত, কলাইর খেত সব এখন চাষবাসের উপযোগী। এ সময়ে চাষ দিয়ে রাখলে ফলন ভালো হবে, আগাছা জন্মাবে না। ঠাকুরবাড়ির ছোট ঠাকুর জমিতে হালচাষ কেমন হচ্ছে দেখে ফিরছেন। মালতী, ঠাকুরবাড়ির ধনকর্তার ছোট ছেলে সোনাকে কোলে নিয়ে আ আ করে তু তা করে, কি আমার সোনারে ধনরে বলে, গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বিকেলের হাওয়া খাচ্ছিল। মাঝিবাড়ির শ্রীশ চন্দ দন্দির হাটে যাবে, নরেন দাসকে এক বাণ্ডিল সূতা কিনে দেবে—সেসব জেনে যাবার জন্য এদিকে হেঁটে আসছে। মালতীকে দেখে বলল, তর দাদায় কই। মালতী বলল, দাদায় তানা হাঁটতাছে। আপনের শরীর ভাল ত কাকা?
জবাবে শ্রীশ চন্দ বলল, এই আছে একরকম। হাটের সুখ এখন নাই ল মা। পরাপরদীর বাজারে সব মুসলমানরা এককাট্টা। অরা ঠিক করছে হিন্দুগ দোকান থাইকা আর কিছু কিনব না
—কি যে হইল দেশটাতে! মালতী একটা পলাশ গাছ দেখতে দেখতে এমন ভাবল। সোনা ওর বুকে লেপ্টে আছে। ঘুমাবে বোধ হয়। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে সর্বত্র। শরীর ঠাণ্ডা হচ্ছে। শরীর এবং মন দুই-ই হালকা বোধ হচ্ছে। সামু ঢাকা গেছে। এ-পাড়াতে সামু অনেকদিন আসছে না। হয়তো অনুশোচনার জন্য আসছে না। এমন যখন ভাবছিল মালতী তখনই দেখল একজন মিঞা মাতব্বর গোছের মানুষ হিজল গাছটার নিচে এসে দাঁড়াল। লম্বা একটা ইস্তাহার গাছে ঝুলিয়ে দিল।
মিঞার পরনে তফন, গায়ে জোব্বা এবং গালে দাড়ি। মালতী বাড়ির শেষ সীমানা পর্যন্ত এল অথচ মাঠে নেমে যেতে সাহস পেল না। ইস্তাহারটা ঝুলিয়ে মানুষটি নিজের গাঁয়ে উঠে গেল না। কে এই মানুষ! মালতী দূর থেকে কিছুতেই চিনতে পারল না। ইস্তাহারটি এখন গাছের উপর নিশানের মতো উড়ছে। মানুষটা মালতীদের বাড়ির দিকে উঠে আসছে। নরেন দাসের ভিতর বাড়ির রাস্তা ধরে উঠে আসছে। মালতী ভাবল, দাদাকে ডাকবে। বলবে, দ্যাখছস দাদা, একটা মিঞা মানুষ বাড়িতে উইঠা আইতাছে। কিন্তু কাছে আসতেই—ওমা! একি তাজ্জব! সামু ওর কার্তিক ঠাকুরের মতো গোঁফ চেঁচে ফেলে গোটা গালে মৌলবী-সাবের মতো দাড়ি রেখেছে। মালতী সহসা কোনও কথা বলতে পারল না। সামুকে আর সামু বলে চেনা যাচ্ছে না। সে যেন কেমন ওর কাছে একেবারে অপরিচিত মানুষ হয়ে গেছে। সামু পর্যন্ত মালতীকে চিনছে না এমন ভাব চোখেমুখে। সে সোজা উঠে আসছিল, কথা বলছিল না; চোখমুখ শান্ত। সে কেমন বুক ফুলিয়ে হেঁটে গেল। মালতী এবার রাগে দুঃখে চিৎকার করে উঠল, দাদারে দেইখ্যা যা—কোনখানকার এক মিঞা বাড়ির ভিতর দিয়া যাইতাছে।
নরেন দাস দূরে তানা হাঁটছিল। সে দূর থেকে কে মানুষটা চিনতে পারল না। সে ফ্রেমটা মাটিতে রেখে গাবগাছটার নিচে তাকাতেই দেখল, যথার্থই একজন মিঞা মানুষ মোত্রাঘাসের জঙ্গল পার হয়ে বাড়ির দিকে উঠে আসছে। সে চিৎকার করে ডাকল, অঃ মিঞা, ঠ্যাং ভাইঙা দিমু। পথ দেইখা হাঁটতে পার না। সদর অন্দর নাই তোমার!
আর মালতী গাবগাছটার গুঁড়িতে দাঁড়িয়ে হা হা করে হেসে উঠল। মালতী প্রতিশোধের ভঙ্গিতে গাছের কাণ্ডে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সারা মুখে মনে প্রতিশোধের স্পৃহা। সোনা সেই হাসি শুনে কেমন চমকে গেল ঘুমের ভিতর। সে কোলের ভিতর ধড়ফড় করে জেগে উঠল। সোনা এখন কাঁদছে। এবং কয়েক মাস আগে এই জঙ্গলে একটা পানস সাপ একটা হাড়গিলে পাখিকে গিলে অনেকক্ষণ শুকনো ডালে মৃতের মতো পড়েছিল। এইসব দৃশ্য মনে হওয়ায় মালতীর আকাশ দেখার ইচ্ছা হল—নিচে এই মাঠ, ধরণীর সুখ-দুঃখ, মৃত পলাশের ডাল আর কোলে ধনকর্তার ছোট ছেলে সোনা সব মিলে মালতীকে কেমন অসহায় করে তুলছে। সামসুদ্দিন ততক্ষণে সদর রাস্তায় উঠে গেছে। সে একবার ফিরে পর্যন্ত তাকাল না। মালতীর মনে হল অনেকদিন পর বড় মাঠ পার হতে গিয়ে সে পথ হারিয়ে ফেলেছে।
এভাবে এ-দেশে বর্ষাকাল এসে গেল। বর্ষাকাল এলেই যত জমি-জায়গা খাল-বিল সব জলে ডুবে যায়। শুধু গ্রামগুলো দ্বীপের মতো ভাসতে থাকে। বর্ষাকাল এলেই গ্রাম থেকে বড় বড় নৌকা যায় উজানে। খাল-বিল-মাঠে বড় বড় মাছ উঠে আসে। ধানখেতে কোড়া পাখি ডিম পাড়ার জন্য বাসা বানায়; আত্মীয় কুটুম যা কিছু এ অঞ্চলের, এ-সময় বাড়ি বাড়ি আসতে থাকে। শাপলা শালুক ফুটে থাকে জলে। জলপিপি শালুক ফুলের উপর সন্তর্পণে এক পা তুলে শিকারের আশায় জলের দিকে চেয়ে থাকে।
বর্ষাকাল এলেই বুড়োকর্তা মহেন্দ্রনাথ ঘরে আর বসে থাকতে পারেন না। তিনি ধীরে ধীরে বৈঠকখানার বারান্দায় এসে বসেন। একটা হরিণের চামড়ার উপর বসে বিকেলবেলাটা কাটিয়ে দেন। বয়স তাঁর আশির উপর। চোখে আজকাল আর একেবারেই দেখতে পান না। তবু বাড়ির উঠোনে, শেফালী গাছে এবং বাগানে যে সব নানারকম গাছ আছে, কোথায় কোন গাছ আছে, কি ফুল ফুটে আছে তিনি এখানে এসে বসলেই তা টের পান। তিনি এখনে বসলেই ধনবৌ সোনাকে রেখে যায় পাশে। একটা মাদুরের উপর সোনা হাত পা নেড়ে খেলে। মহেন্দ্রনাথ মাঝে মাঝে ওর সঙ্গে কথা বলেন। ওর কোমরে রুপোর টায়রা, হাতে সোনার বালা, এই ছেলে হেসে হেসে বৃদ্ধকে নানা বয়সের ছবির কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি এই অতি পরিচিত বিকেলের গন্ধ নিতে নিতে সোনার সঙ্গে বিগত দিনের গল্প করেন—প্রায় যেন সমবয়সী মানুষ, একে অপরের অসহায় অবস্থা বোঝে। সোনা অ…আ…ত-ত করে আর বুড়ো মানুষটা তখন যেন দেখতে পান, পাট কাঠির আঁটি উঠোনের উপর দাঁড় করানো। উঠোন পার হলে দক্ষিণের ঘর। তার দরজা। ফড়িঙেরা নিশ্চয়ই এ বাদলা দিনে উড়ছে। এটা শরৎকাল। শরৎকাল এলেই ভূপেন্দ্রনাথ নৌকা পাঠাবে মুড়াপাড়া থেকে। অষ্টমীর দিন সে মহাপ্রসাদের আস্ত একটা কাটা পাঁঠার ছাল ছাড়ানো ধড় নিয়ে আসবে।
তখন বড়বৌ এদিকে এল। হাতে গরম দুধ। শ্বশুরের সামনে দুধের বাটি রেখে পায়ের কাছে বসল। সামনে পুকুর। আম-জাম গাছের ছায়া। তারপর মাঠ। বর্ষাকাল বলে শুধু জল আর জল। যেখানে পাটের জমি—পাট কাটা হয়ে গেছে বলে সমুদ্রের মতো অথবা বড় বিলের মতো, যেন সেই এক বিল — রূপকথার রাজকন্যা জলে ভেসে যায়। বড়বৌ নদী মাঠ এবং জল দেখলে এইসব মনে করতে পারে। বড় বিলের কথা মনে হয়।—বিয়ের দিন বড় নৌকা করে সে এ-অঞ্চলে এসেছিল। এত বড় বিলে পড়ে বড়বৌর বুকটা ধড়ফড় করে উঠল, কারা যেন এ-বিলের কথা বলতে বলতে যায়—কিংবদন্তীর পাঁচালীর মতো বলতে বলতে যায়—এক সোনার নৌকা রূপোর বৈঠা এ-বিলের তলায় ডুবে আছে। রাজকন্যার নাম সোনাই বিবি। বড়বৌ মেঘলা আকাশ দেখতে দেখতে সেই প্রথম দিন স্বামীর মুখে বিলের গল্প মনে করতে পেরে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল। স্বামীর মাথার ভিতর কি গণ্ডগোলের পোকা তখনই ঢুকে গেছিল। নতুবা বাদলা দিনে হাটুরে মানুষের মতো এমন গল্প বলবেন কেন!
বড়বৌ সোনার মুখের আদলটা দেখল ভাল করে। দেখতে দেখতে মনে হল এই মুখ ধনকর্তার মতো নয়, ধনবৌর মতো নয়। এ-মুখ বাড়ির পাগল মানুষটার মতো। বড়বৌ কলকাতায় বড় হয়েছে, কিছুকাল কনভেন্টে পড়েছে। পাগল ঠাকুরকে তার এখন আর পাগল বলে মনে হয় না। যেন সে তার কাছে এখন প্রায় মোজেসের মতো অথবা কোন গ্রীক পুরাণের বীর নায়ক—যুদ্ধক্ষেত্রে হেরে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছে। বড়বৌ বলল, সোনার মুখ আপনার বড়ছেলের মতো হবে বাবা।
মহেন্দ্রনাথ একটু হাসলেন! তারপর কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেলেন। বললেন—মণির সাড়াশব্দ পাইতাছি না।
—পুকুরপাড়ে বসে আছে।
মহেন্দ্রনাথ অনেকদিন থেকেই একটা কথা বলবেন বলে ভাবছিলেন। বড়বৌকে কিছু বলার ইচ্ছা ছিল। যেন বড়বৌর বাপের বাড়ির দিকের মানুষের একটা ধারণা–হয়তো মনে মনে বড়বৌ নিজেও সেটা বিশ্বাস করে, কিন্তু আমি তো জীবনে মিছা কথা কই নাই, তঞ্চকতা করি নাই। আমি এই বয়সে তোমারে একটা কথা কই—বিশ্বাস কর, না কর, কই! এমন ভেবে বললেন, বড়বৌমা, আমার ত সময় ফুরাইছে। তোমারে একটা কথা কমু ভাবছিলাম বৌমা।
বড়বৌ সামান্য হাসল। বলল, বলুন না।
—জান বৌমা, মণি যখন ছুটি নিয়া বাড়ি আসত আমি গর্বে বুক ফুলাইয়া থাকতাম। এ-তল্লাটে এমন উপযুক্ত পোলা আর কার আছে কও। সুতরাং আমি তোমার বাবারে কথা দিলাম। মাইনসে কয় আমার পোলা পাগল হইছে আমি নাকি বিয়ার আগেই জানতাম।
বড়বৌ কোনও জবাব দিল না। সে বুড়ো মানুষটার পাশে সোনাকে কোলে নিয়ে বসে থাকল।
—বোঝলা বৌমা, মণি যে-বারে এন্ট্রাস পরীক্ষায় জলপানি পাইয়া প্রথম হইল—সব্বাইরে কইলাম নারায়ণ আমার মুখ রাখছে। আর বিয়ার পরই যখন পাগল হইল তখন কইলাম নারায়ণ আমার তামাশা দেখছে। তিনি যেন এ-সময় কি খুঁজতে থাকলেন হাত বাড়িয়ে।
চক্ষু স্থির, ঘোলা ঘোলা চোখ। চুল এত সাদা, গালের দাড়ি এত সাদা যে মানুষটাকে সান্তাক্লজের মতো মনে হয়। চামড়া শিথিল। বড়বৌ বলল, আপনার লাঠিটা দেব?
—না বৌমা, তোমার হাতটা দ্যাও।
বড়বৌ হাতটা বাড়িয়ে দিলে বৃদ্ধ সেই দু’হাত চেপে ধরে বললেন, বৌমা তুমি অন্তত বিশ্বাস কইর মণি তোমার বিয়ার আগে পাগল হয় নাই। জাইনা শুইনা আমি পাগলের সঙ্গে তোমারে ঘর করতে আনি নাই। বলে বৃদ্ধ একেবারে চুপ মেরে গেলেন। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। মুখের রেখাতে এতটুকু ভাঁজ নেই। এক ভাবলেশহীন মুখ, মুখে কোনও আর ইচ্ছার রেখা ফুটে নেই, শুধু উদাস আর উদাস। মহাকালের যাত্রী হবার জন্য যেন পৃথিবীর এক পান্থশালায় জলছত্র খুলে বসে আছেন, সারাজীবন ধরে সকলকে জল দিয়েছেন, অবশেষে সেই জলের তলানিটুকু দিয়ে হাতমুখ প্রক্ষালন করে দূরের তীর্থযাত্রী হবার জন্য উন্মুখ। বৃদ্ধ অনেক দূর থেকে যেন কথা বলছেন, মণির মার কথা শুনলে বুঝি এমন হইত না। দ্যাখ বড়বৌ, আমি বাড়ির কর্তা, মণি আমার বড় পোলা—সে কিনা ভাব কইরা ম্লেচ্ছ মাইয়া বিয়া করব—ঠিক না বৌমা! এইটা ঠিক কথা না।
বড়বৌ এ-সব কথা শুনলে আর স্থির থাকতে পারে না। চোখ ভার হয়ে আসে। সোনার টুকরো ছেলে ভালবেসে পাগল। কথা বললেই যেন এখন দরদর করে চোখে জল চলে আসবে। সে অন্য কথা বলল, চলুন বাবা, আপনাকে ঘরে দিয়ে আসি।
—আমি আর একটু বসি বৌমা। বসলে মনটা ভাল থাকে। বারান্দায় বইসা থাকলে বর্ষার শাপলা শালুকের গন্ধ পাই। মনে হয় তখন ঈশ্বরের খুব কাছাকাছি আছি। তোমার মায় কই?
—মা গেছেন পদ্মপুরাণ শুনতে। আপনার পদ্মপুরাণ শুনতে ইচ্ছে হয় না বাবা?
—পদ্মপুরাণ ত আমি নিজেই। মাগো—সারাজীবন আমি চাঁদ সদাগরের পাঠ করছি, তুই বেহুলার। বৃদ্ধ টেনে টেনে বললেন, যেন এই বয়সে কেবল বর দেওয়া যায়—এখন এমন এক বয়স আর এমন এক মানুষ তিনি—সংসারে, এ-মানুষ প্রায় ঈশ্বরের শামিল যেন—তিনি টেনে টেনে যেন অনেক দূর থেকে বলছেন—বৌমা, তুমি আমার সতী সাবিত্রী। শাঁখা সিঁদুর অক্ষয় হউক মা তর।
গভীর রাতে বড়বৌ ঘুমে আচ্ছন্ন! একটা আলো ঘরে নিবু নিবু হয়ে জ্বলছে। জানালা খোলা। বর্ষার জলজ বাতাস ঘরে ঢুকে বড়বৌর বসনভূষণ আলগা করে দিচ্ছে। বড়বৌ হাত দুটো বুকের উপর প্রায় প্রার্থনার ভঙ্গিতে রেখেছে। দেখলে মনে হবে, সে ঘুমের ভিতরও তার মানুষের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্ৰাৰ্থনা করছে। তখন মণীন্দ্রনাথ ঘরে পায়চারি করছিলেন। ওঁর চোখে ঘুম নেই। তিনি দরজা খুলে ফেললেন সহসা। নদীর ওপারে তিনি কাকে যেন ফেলে এসেছেন মনে হল।
আকাশে এখনও কিছু কিছু নক্ষত্র জেগে আছে। ঠাকুরঘরের পাশেই সেই শেফালি গাছ, ফুলেরা ঝরছে, ঝরে আছে, এবং কিছু কিছু বোঁটায় সংলগ্ন। ওরা ভোরের জন্য অথবা রোদের জন্য প্রতীক্ষা করছে। মণীন্দ্রনাথ দুই হাতে গাছের নিচ থেকে কিছু ফুল সংগ্রহ করে বোঁটার হলুদ রঙ হাতে মাখলেন। রাত নিঃশেষ হয়ে আসছে। তিনি কি ভেবে এবার বাঁশঝাড়ের নিচে এসে দাঁড়ালেন। সামনে ঘাট–বর্ষার জল উঠোনে উঠে আসবে বুঝি, তিনি ছোট কোষা নৌকায় উঠে লগিতে ভর দিতেই নৌকাটা জলে নেমে গেল—কিছু গ্রাম মাঠ ঘুরে সেই নদীর পাড়ে চলে যাবেন—যেখানে তাঁর অন্য ভুবন নিঃসঙ্গ নির্জন নদীতীরে খেলা করে বেড়াচ্ছে।
মাথার ভিতর এক অ-দৃষ্ট যন্ত্রণা মণীন্দ্রাথকে সর্বদা নিরুপায় করে রাখে। মণীন্দ্রনাথ কেবল নির্জনতা চান।
কোষা নৌকা ক্রমশ গ্রাম মাঠ এবং ধানখেত অতিক্রম করে বিশাল বিলের জলে অদৃশ্য হচ্ছে। চারিদিকের গ্রামগুলি খুব ছোট মনে হচ্ছে। আকাশের সঙ্গে সব গ্রামগুলি যেন ছবির মতো হয়ে ফুটে আছে। কোনও শব্দ নেই—ভয়ানক নির্জন নিঃসঙ্গ প্রান্তর। দূরে সোনালী বালির নদীর রেখা অল্পে অল্পে দৃশ্যমান হচ্ছে। মণীন্দ্রনাথ পদ্মাসন করে বসে থাকলেন—সাধুপুরুষের মতো ভাব চোখে-মুখে। বিলের জমিতে গভীর জল—এক লগির চেয়ে বেশি হবে। মণীন্দ্রনাথ চুপচাপ বসে এই জলের ভিতর পলিনের মুখ যেন দেখতে পাচ্ছেন। পলিন কি করে যেন তার নদীর জলে হারিয়ে গেল। নদীর পাড়ে খেলা ছিল, কত খেলা! হায়, তখন কেবল সেই দূর্গের কথা মনে হয়! বড় মাঠ, মাঠের পাশে দূর্গ, দূর্গে কেবল থেকে থেকে জালালি কবুতর উড়ত। মণীন্দ্রনাথ এবার মুক্ত কণ্ঠে পরমপুরুষের মতো কবিতা আবৃত্তি করতে থাকলেন। কবিতার অবয়বে সেই এক স্মরণচিহ্ন—কীটস নামে এক কবি ছিলেন—তিনি বেঁচে নেই। পলিন মণীন্দ্রনাথের মুখে কবিতার আবৃত্তি শুনতে শুনতে এক সময় দূর্গের গম্বুজের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে যেত।
কিছু হিজল গাছ অতিক্রম করলে নন্দীদের ঘাট। ঘাট পার হলে মুসলমান গাঁ। অনেকদিন পর যেন তিনি ঘাটে নৌকা বাঁধলেন। সর্বত্র গ্রামের ঘাটে ঘাটে পাট পচানো হয়েছে—পচা গন্ধ উঠছে, ইতস্তত কচুরিপানার ঝাঁক-নীল সাদা রঙের কচুরি ফুল এবং পাতিহাঁস ঘাটে নড়ছে। ঘাটে ঘাটে কুমড়োর মাচান, মাচানের নিচে কুমড়োলতা নেমে গেছে। তিনি সব কিছু দেখে শুনে সতর্ক পা ফেলে উপরে উঠে গেলেন। এক তকতকে উঠোনে উঠে যেতেই ধান গোলার ফাঁক থেকে হামিদ বের হয়ে এল। বলল—সব বলাই অবশ্য নিরর্থক, তবু এত বড় মানুষটা, মানুষটার আর বয়স কত, সেই যে, যবে একবার হামিদ, হাসান পীরের দরগাতে এই মানুষকে বসে থাকতে দেখেছিল—মানুষটা যেন চোখের ওপর শৈশব পার করে যৌবনে পা দিয়েছে, যৌবন থেকে কিছুতেই নড়ছে না, শক্ত বাঁধুনি, শরীরের গঠন একেবারে আস্ত একটা দ্রুতগামী অশ্বের মতো—সে বলল, আমাগ কথা এতদিনে মনে হইল বড়ভাই!
মণীন্দ্রনাথ বড় বড় চোখে হামিদকে দেখলেন। একটু হাসলেন।
হামিদ বলল, একটু বইসা যান বড়ভাই।
মণীন্দ্রনাথ ওর উঠোনে উঠে গেলে হামিদ একটা জলচৌকি দিল বসতে।—বসেন বড়ভাই। সে সকলকে ডেকে বলল, কে কোন খানে আছ দ্যাখ আইসা, বড়ভাই আইছেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে হামিদের মা এল, হামিদের দুই বিবি এসে হাজির হল। বেটা, বিবিরা সকলে। এবং গ্রামে যেন বার্তা রটি গেল—সকলে এসে ঘিরে দাঁড়াল মণীন্দ্রনাথকে। সকলে আদাব দিল। মণীন্দ্রনাথ কোনও কথা বলছেন না, যতক্ষণ না বলেন ততক্ষণই ভালো। একসময় হামিদ ভিড়টাকে সরে যেতে বলল। মণীন্দ্রনাথ সকলের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছেন। হামিদ তখন তার ছোট বিবিকে বলল, বড়ভাইয়ের নৌকায় একটা কুমড়া তুইলা দিঅ। যেন গাছের যা কিছু ভালো, নতুন যা কিছু, এই মানুষকে না দিয়ে খেতে নেই।
গ্রামের উপর দিয়ে এক সময় হাঁটতে থাকলেন মণীন্দ্রনাথ। পিছনে গাঁয়ের ছোট বড় উলঙ্গ শিশুরা এবং বালক বালিকারা আখ খেতে খেতে মণীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করছে। তিনি ওদের কিছু বলছেন না। ছোট-বড় গর্ত, বাঁশঝাড় এবং কর্দমময় পিচ্ছিল পথ অতিক্রম করে তিনি হাজি সাহেবের বাড়ির সামনে দাঁড়ালেন। বৃদ্ধ হাজি সাহেব হুঁকোর নলে মুখ রেখে কোলাহল শুনে ধরতে পারলেন, পাগল ঠাকুর আজ এ-গাঁয়ে অনেকদিন পর উঠে এসেছে। হাজি সাহেব হুঁকো ফেলে ছুটে এলেন। বললেন, ঠাকুর বইসা যাও। এদিকে আর আস না। হাজি সাহেব জানেন, এইসব কথা পাগল ঠাকুরের সঙ্গে নিরর্থক তবু এত বড় মানী ঘরের ছেলে–কোনও কথা বলবেন না তিনি—পাগল ঠাকুর এই পথ ধরে চলে যাবে—কেমন যেন ঠেকছে।
মণীন্দ্রনাথ এখানে বসলেন না। কয়েকবার চোখ তুলে হাজি সাহেবকে দেখলেন তারপর সেই এক উচ্চারণ—গ্যাৎচোরেৎশালা।
হাজি সাহেব হাসলেন এবং চাকরকে ডেকে বললেন, পাগল ঠাকুরের নৌকায় দুই ফালা সবরীকলা রাইখা আসবি। হাজি সাহেব মণীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে যেন বলতে চাইলেন–ঠাকুর, কলাগুলি নিয়া যাও, পাকলে খাইয়। গাছের কলা—তোমারে না দিয়া খাইলে মনটা খুঁতখুঁত করবে। তারপর হাজি সাহেব আল্লার কাছে যেন নালিশের ভঙ্গিতে বলতে থাকলেন, বুড়া কর্তার কপালে এই আছিল খোদা!
বর্ষাকাল। ঘন ঘন বৃষ্টি হচ্ছিল বলে পথ ভয়ানক কর্দমাক্ত। কোথাও হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যাচ্ছে—সুতরাং মণীন্দ্রনাথের কষ্ট হচ্ছিল হাঁটতে। পথের দু’পাশে আবর্জনা, মলমূত্রের দুর্গন্ধ। মণীন্দ্রনাথ এ-সবের কিছুই টের করতে পারছেন না। গ্রামের মুসলমান বিবিরা পাগল ঠাকুরকে দেখে পলকে ঘরে নিজেদের আড়াল করে দিচ্ছে। ওরা বড় নিঃস্ব। সুতরাং শরীরে পর্যাপ্ত আবরণ নেই। পুরুষেরা এখন প্রায় সকলেই মাঠে অথবা অন্যত্র পাট কাটতে গেছে। ওরা বিকেলে ফিরবে। মণীন্দ্রনাথ গ্রামটাকে চক্কর মেরে ফের ঘাটে এসে বসলেন নৌকায়। তারপর উদ্যোগী পুরুষের মতো সংগৃহীত বস্তুসকলকে একপাশে সাজিয়ে রেখে নৌকা বাইতে থাকলেন বর্ষার জলে। ঘাটে উলঙ্গ শিশুরা, বালক-বালিকারা পাগল ঠাকুরকে নেচে গেয়ে বিদায় জানাল। আর এ-সময়ই তিনি মনে করতে পারলেন বড়বৌ অপেক্ষা করতে থাকবে এবং বড়বৌর জন্য মনটা কেমন করে উঠছে। বড়বৌর সেই গভীর চোখ মণীন্দ্রনাথকে বাড়িমুখো করে তুলল। অথচ বিলের ভিতর পড়েই মণীন্দ্রনাথের বাড়ি ফেরার স্পৃহা উবে গেল। তিনি বিলের ভিতর চুপচাপ বসে থাকলেন। কতক্ষণ এভাবে বসে থাকলেন, কতক্ষণ তিনি সকালের সূর্য দেখলেন, বিশ্বাসপাড়া, নয়াপাড়ার উপর একদল কাকের উপদ্রব এবং ধানখেতে ঢুব ঢুব শব্দ কতক্ষণ তাঁকে অন্যমনস্ক করে রেখেছিল তিনি জানেন না। তিনি জলে নেমে গেলেন এবং স্বচ্ছ জলে সাঁতরাতে থাকলেন, শরীরের সর্বত্র গরম—এতবার ডুব দিয়েও তাঁর শরীরের ভিতরে যে কষ্ট, কষ্টটাকে দূর করতে পারছেন না। এই নির্জন বিলে এসে চুপচাপ বসে থেকে তিনি কতবার ভেবেছেন অপরিচিত সব শব্দ অথবা অশ্লীল উচ্চারণ থেকে বিরত হবেন। কিন্তু পারছেন না। সব কেমন ক্রমশ ভুল হয়ে যাচ্ছে। সব কেমন স্মৃতির অতলে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। জীবনধারণের জন্য কি করা কর্তব্য—অনেক ভেবেও কোনও পথ ঠিক করতে পারছেন না। তখন ভয়ঙ্কর বিরক্তভাব ওঁকে আরও প্রকট করে তোলে। দুহাত ওপরে তুলে চিৎকার করতে থাকেন—আমি রাজা হব।
বিকেলের দিকে ভূপেন্দ্রনাথ এলেন কর্মস্থল থেকে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ক’দিন থেকেই বাপের জন্য মনটা খারাপ লাগছিল। বুড়ো মানুষটার জন্য ভূপেন্দ্রনাথের বড় টান। এখনও যেন তিনি সকলকে আগলে আছেন। যৌবনে ভূপেন্দ্রনাথের কিছু আদর্শ ছিল। এখন আর তা নেই। স্বাধীনতা আসবে, স্বাধীন ভারতবর্ষের স্বপ্ন চোখে ভাসত। কিন্তু বড়দা পাগল হয়ে গেল—এত বড় সংসার শুধু জমি এবং যজমানিতে চলে না, ভূপেন্দ্রনাথ স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেলেন। বুড়ো মানুষটার জন্য, এত বড় সংসারের জন্য তিনি পায়ে হেঁটে নতুন ধানের ছড়া আনতে চলে গেলেন। সংসারে তাঁর জীবন প্রায় এক উৎসর্গীকৃত প্রাণ যেন। বিবাহ করা হয়ে উঠল না। চন্দ্রনাথের বিয়ে দিলেন; এখন শুধু কাজের ফাঁকে ফাঁকে এই দেশে চলে আসা এবং বুড়ো মানুষটার পাশে সংসারের গল্প, জোতজমির গল্প, কোন জমিতে কোন ফসল দিলে ভালো হবে—এমন সব পরামর্শ। মনেই হয় না মানুষটার জীবনে অন্য কিছুর প্রয়োজন আছে।
ভূপেন্দ্রনাথ নৌকা থেকে নামতেই বাড়ির সকলে যেন টের পেয়ে গেল—মুড়াপাড়া থেকে নৌকা এসেছে, চাল, চিনি, কলা, কদমা এবং বর্ষাকাল বলে বড় বড় আখ এসেছে। ধনবৌ তাড়াতাড়ি ঘোমটা টেনে ঘরে ঢুকে গেল। তিনি এখন এ-পথেই উঠে আসবেন।
তিনি প্রথমেই বাড়িতে উঠে ছড়িটা বারান্দায় রেখে যে-ঘরে বুড়ো মানুষটা চুপচাপ বসে থাকেন সেখানে উঠে গেলেন। বাবাকে, মাকে প্রণাম করলেন। বুড়ো মানুষটা তাঁর কুশল নিলেন। মনিবের কুশল নিলেন। শরীর কেমন, এ-সব জিজ্ঞাসাবাদের পর মনে হল উঠোনে কে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝি বড়বৌ। বড়বৌকে প্রণাম করতে হয়। উঠোনে নেমে বাড়িটার কী কী পরিবর্তন হয়েছে লক্ষ করতে গিয়ে মনে হল বাড়িটার সেই শুকনো ভাবটা নেই। বাড়ির চারদিকে ঝোপঝাড়গুলি বেড়ে উঠেছে। উত্তরের ঘর পার হয়ে কামরাঙা গাছের পাশে ছোট একটা মাচান। মাচানে কিছু শশার লতানে গাছ, হলদে ফুল। কচি শশা দুটো-একটা ঝুলছে। পাশে ঝিঙের মাচান, করলার মাচান। চন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই ওগুলো লাগিয়ে গেছে। সেই দুই নাবালককে খুঁজতে থাকলেন তিনি। ওরা এখন বাড়িতে নেই—কোথায় গেল! গোটা বাড়িটা এই দুই নাবালক—লালটু পলটু চিৎকার চেঁচামেচি করে জাগিয়ে রাখে। ওদের জন্য সে হলদে রঙের পুরুষ্ট আখ এনেছে। মোটা এবং সরস। নরম এই আখ ওদের খুব প্রিয়। নিজে ভেঙে দিতে পারলে কেমন যেন মনটা ওঁর ভরে যায়। অরা গেল কৈ! এমন একটা প্রশ্ন মনে মনে।
সেই দুই বালক তখন ছুটছিল। মেজকাকা এসেছে। পলটুর মেজকাকা লালটুর মেজ জ্যাঠামশাই—ওরা গ্রামের ওপর দিয়ে ছুটছে। ওরা খবর পেয়ে গেছে মুড়াপাড়া থেকে নৌকা এসেছে। নৌকা আসা মানে ওদের জন্য আখ এসেছে, কমলার দিনে কমলা, তিলা-কদমার দিনে তিলা-কদমা। অথবা আম-জাম জামরুলের দিনে নানারকমের ফল। ওরা এসে দেখল, অলিমদ্দি মাথায় করে সব চাল-ডাল-তেল অথবা করলা-ঝিঙে নামাচ্ছে। একটা বড় মাছ এনেছেন, সেটা গলুইর নিচে, লালটু পলটু দু’জনে মাছটাকে টেনে তুলে আনছে। প্রায় এখন যেন উৎসবের মতো বাড়ি। কেবল বড়বৌ বিষণ্ণ চোখে চারদিকে কাকে যেন সারাদিন থেকে খুঁজছে। কে যেন তার চলে গেছে, আসার কথা, আসছে না। বড়বৌর বড় বড় অসহায় চোখ দেখে ভূপেন্দ্রনাথ ধরতে পারলেন—বড়দা আবার নিরুদ্দেশে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে যেন ভিতরে কী এক কষ্ট ভেসে উঠল। বড়বৌর মুখের দিকে আর তাকাতে পারলেন না।
বিকেলের দিকে বুড়ো মানুষটা ভূপেন্দ্রনাথের কাছ থেকে নানারকম খবর নেবার জন্য বারান্দায় বসে থাকলেন। ভূপেন্দ্রনাথ পায়ের কাছে বসে সব বলছিলেন—এটা স্বভাব তাঁর। মুড়াপাড়া থেকে এলেই বাবাকে পৃথিবীর সব খবর দিতে হয়। বাবুরা অর্ধসাপ্তাহিক আনন্দবাজার কাগজ পড়েন। বাবুদের পড়া হয়ে গেলে ভূপেন্দ্রনাথ প্রায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব মুখস্থ করে ফেলেন। কেউ এলে তখন পত্রিকার খবর, যেন তার নখদর্পণে এই জগৎ সংসার। বাড়িতে এলে প্রাজ্ঞ ব্যক্তির মতো দেশের কথা বর্ণনা করেন। কাগজ থেকে কিছু খবরের কথা উল্লেখ করে বললেন, এবারে লীগপন্থীরা যে-ভাবে উইঠাপইড়া লাগছে তাতে আবার রায়ট লাগল বইলা।
বৃদ্ধ অত্যন্ত আস্তে আস্তে বললেন, হাফিজদ্দির পোলা সামুরে তুই ত চিনস! সে নাকি টোডারবাগে লীগের ডেরা করছে। গাছে গাছে ইস্তাহার ঝুলাইতাছে। দেশটা দিন দিন কি হইয়া যাইতাছে বুঝি না।
ভূপেন্দ্রনাথ বললেন, বাবা, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দ্যাখলাম, গারো পাহাড় থেকে শহরে একজন সন্ন্যাসী আইছে। ভূত-ভবিষ্যৎ সব কইতে পারে। ভাবছিলাম বড়দারে নিয়া যামু।
—যাও, যা ভাল বোঝ কর।
—সঙ্গে ঈশম চলুক।
বড়বৌ ঘরের ভিতর বসে বসে চাল, প্রায় দু’বস্তা চাল, ঝেড়ে তুলে রাখছে। সবজি যা এসেছে সাজিয়ে রাখছে। পাগল মানুষটাকে নিয়ে যাবে ওরা। সামান্য আশার আলো মনের ভিতরে জ্বলে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই কেমন তা নিভে গেল। মানুষটাকে নিরাময় করার জন্য কত চেষ্টা—দেখতে দেখতে প্রায় দশ বছর কেটে গেল। মানুষটা কিছুতেই ভালো হচ্ছে না।
—আজকাল ত মণি দুই তিনদিন বাড়ি আসে না। কই থাকে, খায় ঈশ্বরই জানে।
ভূপেন্দ্রনাথ যেন বলতে চেয়েছিলেন—এ ভাবে না খেয়ে ঘুরছে, কোথায় থাকছে, কোথায় রাত কাটাচ্ছে কেউ কিছু বলতে পারছে না—বরং বেঁধে রাখা ভালো। কিন্তু বলতে পারলেন না, কারণ এই ঘরে এখন মা আছেন, বড়বৌ আছে—ওরা সকলে এমন কথা বিশ্বাসই করতে পারবে না, তা’হলে যেন বাবা যে দু’দিন আরও বাঁচতেন তাও বাঁচবেন না। সুতরাং তিনি অন্য কথা বললেন, সোনারে আনেন দেখি, দ্যাখতে কেমন হইল দ্যাখি।
বড়বৌ সোনাকে কোলে দিলে কেমন তাজ্জব হয়ে গেলেন তিনি। একেবারে বড়দার মুখ পেয়েছে। সোনাকে কাঁধে করে বারবাড়িতে চলে এলেন। সোনা যেমন অ আ ত ত করে কথা বলে তেমনি কথা বলছিল। অপরিচিত মানুষ দেখে সে এতটুকু কাঁদেনি। বরং মাঝে মাঝে কুটুস কুটুস দাঁতে কামড়াচ্ছিল। সোনার দুটো ছোট ইঁদুরের মতো দাঁত উঠেছে।—পোলা, তোমার অসুখ হইব দ্যাখতাছি। বলে দাঁতে দুটো টোকা দিলেন। যেন এই শিশুকে দাঁতে আঘাত করে ওর কঠিন অসুখ থেকে রক্ষা করছেন ভূপেন্দ্রনাথ। সোনা ভয়ঙ্করভাবে কেঁদে উঠতেই পাশের বাড়ির দীনবন্ধু পিছন থেকে ডাকল, মাইজা ভাই, ঢাকায় নাকি আবার রায়ট লাগব শুনছি।
—তা লাগতে পারে।
—কেডা জিতব মনে হয়?
—কী কইরা কই! হার জিতের কি আছে ক?
—কী দুর্ধর্ষ দ্যাখেন, দুধের পোলা, হালার হালা কথা নাই বার্তা নাই চাকু চালায়।
—তুই দ্যাখছস নাকি?
—তা দ্যাখমু না ক্যান। মালতীর বিয়ার সময় একবার ঢাকা শহরে গেছিলাম। ঘুইরা ফিরা দ্যাখলাম শহরটা। এলাহি কাণ্ড—না!—রমনার মাঠে গ্যালাম, সদর ঘাটের কামান দ্যাখলাম।
সন্ধ্যার পর ধনবৌ পশ্চিমের ঘরে হারিকেন জ্বেলে রেখে গেল। হাত-পা ধোওয়ার জল রেখে গেল। একটা জলচৌকি, ঘটি এবং গামছা রেখে দিল। তিনি হাত-পা ধুয়ে ঘরে ঢুকে যাবেন। আর বের হবেন না। কারণ গ্রামে খবরটা রটে গেছে। মুড়াপাড়া থেকে মাইজা কর্তা এসেছেন। বিশ্বের খবর তাঁর জানা আছে। গ্রামের পালবাড়ি থেকে মাঝিবাড়ি অথবা চন্দদের বাড়ি থেকে প্রৌঢ়গণ হাতে লাঠি এবং লণ্ঠন নিয়ে খড়ম পায়ে ঠাকুরবাড়ি এসে ডাকল, ভূপেন আছ? মাইজা কর্তা আছেন?
ভূপেন্দ্রনাথ তখন হয়তো তক্তপোশে বসে ঈশ্বরের নাম নিচ্ছিলেন অথবা ঈশমের কুশলবার্তা। তখন তিনি এক দুই করে খড়মের শব্দ শুনতে পেলেন। গ্রামের বয়স্ক মানুষেরা এখন এসে ভিড় করবে। আড্ডা দেবে এবং পত্রিকার খবর নেবে। দেশের খবর, বিদেশের খবর, গান্ধীজী কি ভাবছেন, এমন সব খবরের জন্য ওরা উন্মুখ হয়ে থাকে। তিনি এই আড্ডার প্রাণ। তিনি তখন ঈশ্বরের চেয়েও বড়, তার কথা এদের কাছে ঈশ্বরের শামিল—এই বিশ্বাস লোকগুলির মনে। তিনি তখন বলবেন, দেশের বড় দুরবস্থা হারান।
—ক্যান কাকা?
—কাইল সারা বাজার ঘুইরা বাবুরহাটের একটা শাড়ি পাইলাম না।
ক্যান এমন হইল?
—কি জানি! মহালে তর আদাই নাই। এদিকে তোমার সারা ভারতে আইন অমান্য আন্দোলন চালাইতেছেন গান্ধী। ইংরাজরাও ছাইড়া কথা কইতাছে না। লাঠি চালাইতেছে। গুলি করতাছে। এদিকে তোমার বিলাতের প্রধানমন্ত্রী লীগের পক্ষ নিছে। সুতরাং বুঝতেই পারছ লীগের পোয়াবার।
মাঝিবাড়ির শ্রীশ চন্দ্র বলল, ঘোর কলিকাল আইসা গেল মাইজা ভাই।
ভূপেন্দ্রনাথ বললেন, চারিদিকে তর একটা ষড়যন্ত্র। আনন্দময়ী কালীবাড়ির পাশে বনজঙ্গলের ভিতর পুরানো একটা বাড়ি আছে, একটা দিঘি আছে। কেউ খবর রাখে না। এখন তর চরের মৌলভি-সাব কয় ওটা নাকি মসজিদ। মুসলমানরা কয় নামাজ পড়ব।
—তা হইলে গণ্ডগোল একটা লাগব কন!
—বাবুরা কি ছাইড়া দিব? জায়গাটা অমর্ত্যবাবুর! পাশে আনন্দময়ী কালীবাড়ী। আগুন জ্বলতে কতক্ষণ।
—অঃ, আমার হোমন্দির পো’ রে, দেশে আর বিচার নাই। আমাগ জাতধর্ম নাই। পূজা-পাৰ্বণ নাই। মাকালী নিব্বংশ কইরা দিব। তখনই সে দেখল উঠোনে ঈশম বসে তামাক টানছে। মাইজা কর্তা এলে একটু দেরি করে সে গোয়ালে গরু বাছুর তোলে। ঈশমকে দেখে সে কেমন জিভে কামড় দিয়ে ফেলল। উঠোনে মানুষটা বসে আছে সে খেয়ালই করেনি। এবার কেমন গলা নামিয়ে দুঃখের সঙ্গে বলল, আমার দোকান থাইকা মাইজা ভাই মুসলমান খরিদ্দার সওদা করতে চায় না। কতদিনের সব খরিদ্দার। কত বিশ্বাসের সব—অরা সরিবদ্দির দোকানে খায়।
এ-সময় সকলেই চুপ হয়ে গেল। কেউ কোনও কথা বলতে পারল না। শ্রীশ চন্দ তার দুঃখের কথা বলে চুপ হয়ে গেছে। ভূপেন্দ্ৰনাথ হুঁকা টানছেন। জোর হাওয়ার জন্য আলোটা মৃদু-মৃদু কাঁপছিল। দূরে সোনালী বালির নদী থেকে গয়না নৌকার হাঁক আসছে। শচীন্দ্রনাথ ঠাকুরঘরে শীতল ভোগ দিচ্ছেন। ঘণ্টার শব্দ, গয়না নৌকার হাঁক এবং ঈশমের ব্যাজার মুখ সকলকেই কেমন পীড়িত করছে। বুড়ো মানুষটা ঘরে শুয়ে শুয়ে কাঁদছেন। কোথায় এখন তাঁর পাগল ছেলে হেঁটে বেড়াচ্ছে অথবা গাছের নিচে শুয়ে আছে কে জানে। বড়বৌ পুবের ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে আছে। সামনে কামরাঙা গাছ, গাছ পার হলে বেতের ঝোপ এবং ডুমুরের গাছটা পার হলে মাঠ। বড় চাঁদ উঠে আসছে গাছটার মাথায়। এখন সাদা জ্যোৎস্না সর্বত্র। গাছগুলি স্পষ্ট। ফাঁকা মাঠে ধানগাছে সামান্য কুয়াশার পাতলা আবরণ। সে পথের দিকে তাকিয়ে আছে—যদি কোনও মানুষের ছায়া এই পথে উঠে আসে, যদি মানুষটা লগি বাইতে থাকে সামনের মাঠে অথবা নৌকার শব্দ পেলেই চমকে ওঠে—এই বুঝি এল, সাধু-সন্ন্যাসীর মতো এক উদাসীন মানুষ বুঝি বাড়ি ফিরে এল। পাগল মানুষটার প্রতীক্ষাতে বড়বৌ দাঁড়িয়ে আছে। ওর মানুষটার জন্য কেন জানি কেবল কান্না পাচ্ছিল।
.
কিছুদূর এসেই মণীন্দ্রনাথের বাড়ি ফেরার স্পৃহা উবে গেল। তিনি বার বার ধানখেতের চারপাশে ঘুরতে থাকলেন এবং মাঝে মাঝে নৌকাকে ঘুরিয়ে দিয়ে লগিটাকে মাথার উপর লাঠিখেলার মতো ঘোরাতে থাকলেন। এই যে নক্ষত্রপুঞ্জ আছে, আকাশ রয়েছে এবং বিলের জলে কোড়া পাখি ডাকছে সব কিছুর ভিতর কোন এক অদৃশ্য সংগ্রাম তাঁর। পাটাতনে লাফ দিচ্ছিলেন। হাতে ধরে কি যেন আয়ত্তে এনেছেন, তারপর গলা টিপে হত্যা। যত তিনি লাঠিটা ঘোরাচ্ছিলেন তত বন-বন শব্দ হচ্ছে। দূরে যারা পাট কাটছিল তারা দেখল বিলের জলে নৌকা ভাসছে আর পাগলঠাকুর মথার উপর লগি ঘোরাচ্ছে। কি মানুষটা কি হইয়া গ্যাল এমন সব চিন্তা।
তিনি অনেক দূরে চলে এসেছিলেন নৌকা বাইতে বাইতে। সুতরাং ঘরে ফিরতে বেশ দেরি হবে। বড়বৌর বড় এবং গভীর চোখ দুটো তাকে এখন কষ্ট দিচ্ছে এই ভেবে যখন ধানখেত ভেঙে ঘরে ফেরার স্পৃহাতে লগি তুলছেন তখনই দেখতে পেলেন, সোনালী বালির নদীর বুকে একটা বড় পানসি নাও। তার কেন জানি মনে হল—এই নৌকায় পলিন আছে। পলিনকে নিয়ে এই নাও কোন এক অদৃশ্যলোকে হারিয়ে যাচ্ছে। তিনি পাটাতনের নিচ থেকে বৈঠা বের করে জলে বড় বড় ঢেউ তুলতেই নৌকাটি গিয়ে হুমড়ি খেয়ে নদীতে পড়ল। স্রোতের মুখে তিনি ভেসে চলেছেন। এখন কোনও বেগ পেতে হচ্ছে না মণীন্দ্রনাথকে—তিনি পানসি নৌকাটার পেছনে হাল ধরে শুধু বসে আছেন।
পানসি নৌকার মানুষেরা দেখল পিছনে পিছনে একটা নৌকা আসছে। হালে বসে আছে উদোম গায়ে গৌরবর্ণ এক সুপুরুষ। রোদে পুড়ে রঙটা তামাটে হয়ে গেছে। হালে মানুষটা প্রায় যেন চোখ বুজে আছে। এই বর্ষা এবং তার স্রোত যেদিকে নিয়ে যায় যাবে—মানুষগুলি দেখে হাসাহাসি করছিল। ভিতরে জমিদার পুত্র এবং বাঈজী বিলাসী একঘরে এক বিছানায়। গান শেষে কিছু কিছু কৌতুকের কথাবার্তা। এবং সরোদের টুংটাং শব্দ। বিলাসী তারে হাত রেখে পা দুটো ছড়িয়ে-হায় সজনিয়া, এমন এক ভঙ্গি টেনে পড়ে আছে। চোখমুখ জড়িয়ে আসছিল, নেশায় ওরা পরস্পর তাকাতে পারছে না। মণীন্দ্রনাথ দীর্ঘপথ ওদের কেবল অনুসরণ করলেন। তিনি সরোদের গম্ভীর আওয়াজের ভিতর কেবল যেন এক মেয়ের মুখ দেখতে পান—তিনি পলিনের অবয়ব এবং তার মুখ, তার প্রেম সম্পর্কিত সকল ঘটনা এই ধানখেতের ফাঁকে ফাঁকে সোনালী বালির নদীর চরে, জলে সর্বত্র দেখতে পাচ্ছেন। অথচ এক সময় আবার সবই কেমন গুলিয়ে গেল। কেন যে এত দীর্ঘ পথ পানসি নৌকার পিছনে অনুসরণ করলেন, মনে করতে পারছেন না। কোন পথ ধরে ঘরে ফিরতে হবে সব যেন ভুলে গেলেন। তিনি এবার নদী থেকে চরে উঠে আসার জন্য নৌকার মুখ ফেরালেন, কাশবনের ভিতর ঢুকে আর পথ পেলেন না। সূর্য পশ্চিমে হেলে গেছে—এবার সূর্যাস্ত হবে—কিছু গগনভেরী পাখির আর্তনাদ আকাশের প্রান্তে শোনা যাচ্ছিল এবং দূরে হাটফেরত মানুষেরা ঘরে ফিরছে। তিনি নৌকার পাটাতনে এবার শুয়ে পড়লেন। শরীরের কোথায় কী যেন কষ্ট। তৃষ্ণার্ত এবং ক্ষুধার্ত। অথচ কী করলে এই কষ্ট থেকে পরিত্রাণ পাবেন বুঝতে পারছেন না। সুতরাং চুপচাপ শুয়ে থেকে গগনভেরী পাখির আর্তনাদ কোথায় কোন আকাশে উড়ছে খুঁজতে থাকলেন। আকাশ একেবারে নিঃসঙ্গ। কোথাও একটা পাখি একটা ফড়িঙ পর্যন্ত উড়ছে না। তিনি ক্লান্ত গলায় যেন বলতে চাইলেন, পলিন, আমি তোমার কাছে যাব।
দূরে কোন গ্রাম—সেখান থেকে কাঁসর-ঘণ্টার শব্দ ভেসে আসছে। কোন মুসলমান গ্রাম থেকে আজানের শব্দ। কিছু কিছু নক্ষত্র আকাশে ফুলের মতো ফুটে উঠছে। এখন আকাশটাকে তত আর নিঃসঙ্গ মনে হয় না। কতদূর এইসব নক্ষত্রের জগৎ—ইচ্ছা করলে ওদের ধরা যায় না! এইসব নক্ষত্রের জগতে অথবা নীহারিকাপুঞ্জে নৌকায় পাল তুলে ঘুমিয়ে থাকলে কেমন হয়! তিনি কত বিচিত্র চিন্তা করতে করতে সবকিছুর খেই হারিয়ে সহসা কেমন উত্তেজনা বোধ করেন।
কিছু জোনাকি জ্বলছে ধানগাছের পাতার আড়ালে। জ্যোৎস্নায় এই ধরণী শান্ত এবং স্থির। অল্প অল্প হাওয়া দিচ্ছে। সমস্ত দিনের ক্লান্তি এই মিষ্টি হাওয়ায় কেমন উবে গেল। ফের পলিনের মুখ মনে পড়ছে। মণীন্দ্রনাথ কাৎ হয়ে শুয়েছিলেন এবং বিড়বিড় করে বকছিলেন। দেখলে মনে হবে না—তিনি এখন সুদূর কলকাতায় কোনও ইউরোপীয় পরিবারের সঙ্গে আলাপ করছেন। মনে হবে বিড়বিড় করে কি শুধু বকে যাচ্ছেন। জোরে জোরে উচ্চারণ করলে ইংরেজির স্পষ্ট উচ্চারণে সব ধরা পড়ত, কিন্তু হাতের ওপর মাথা রেখে অথবা এইসব কথা তাকে শুধু পাগল বলেই প্রতিপন্ন করছে। আমি পলিনকে ভালবাসি—এই উক্তি পরিবারের সকলের কাছে চিৎকার করে বলতে পারলে যেন খুশি হতেন। অথচ অঘটন ঘটে গেল। মণীন্দ্রনাথ যেন পিতৃসত্য পালনে বনবাসে গমন করলেন। পিতৃ আজ্ঞা শিরোধার্য করতে গিয়ে দ্বিধা এবং দ্বন্দ্বে অবশেষে বলেই ফেললেন, গ্যাৎচোরেৎশালা।
মণীন্দ্রনাথ যখন দেখলেন মাঠে অথবা নদীর জলে কোথাও কোনোও নৌকার শব্দ উঠছে না তখন তিনি দাঁড়িয়ে বলতে চাইলেন, পলিন, আমি পাগল হইনি। আমাকে সবাই অযথা পাগল বলছে। আমি তোমার কাছে গেলেই ভালো হয়ে যাব। এইসব কথা এখন মাঠে মাঠে জলে জলে বনে বনে ঘাসে ঘাসে সর্বত্র প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরছে—আমি পাগল হইনি। সবাই অযথা আমাকে পাগল বলছে।
রাত বাড়ছে। লালটু পলটু পড়ছে দক্ষিণের ঘরে। ঈশম আজ বুঝি বাড়ি যাবে না, গেলেও রাত করে যাবে। সে দক্ষিণের ঘরে মাদুর পেতে শুয়ে আছে। ধনবৌ হেঁশেলে। শশীবালা দরজায় বসে, কোলে সোনা ঘুমিয়ে পড়েছে। তিনি তালপাতার পাখা নাড়ছেন। গরম পড়েছে বেশ। পশ্চিমের ঘরে যারা এতক্ষণ বসে রাজাউজির মারছিল, রাত গভীর হলে এক এক করে সকলে চলে গেল। দীনবন্ধু কেবল যায়নি। সে মেজকর্তার পায়ের কাছে বসে হুঁকো টানছিল। এবং জমিদারী সেরেস্তার গল্প শুনে কর্তার মন জয় করার তালে ছিল। দীনবন্ধু এতদিন যে জমিটা ভোগ করছে ভাগে, সে কর্তাকে খুশি করে জমিটার ভোগদখল চাইছে।
শশীবালা রান্না হলে সকলকে খেতে ডাকলেন। বড়বৌ কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি পেতে দিল। লালটু পলটুর জন্য ছোট পিঁড়ি। জল দিল। বড় দোচালা ঘর। মুলি বাঁশের বেড়া সিমেণ্ট বাঁধানো মেঝে। শশীবালা এখন দরজার কাঠে হেলান দিয়ে ছেলেদের খাওয়া দেখবেন। বড়বৌ পরিবেশন করবে, ধনবৌ হেঁশেলে ঘোমটা টেনে বসে থাকবে—মাঝে মাঝে কানের কাছে কথা ধনবৌর, ফিসফিস করে কথা—এটা ওটা বড়বৌকে এগিয়ে দেবে।
খেতে বসেই ভূপেন্দ্রনাথের মনটা ভারি হয়ে উঠল। বড়দার আসন পড়েনি। একটা দিক খালি! সেদিকে তাকিয়ে ভূপেন্দ্রনাথ বললেন, বড়দা কখন বাইর হইছে?
শচীনাথ পঞ্চদেবতার উদ্দেশে নিবেদন করছিলেন তখন, জলটা গণ্ডুষ করবে, ঠিক তখন মুখ তুলে তাকালেন। তাঁর এখন খেয়াল থাকে না—বড়দার আসন খালি, তিনি জলটা গণ্ডুষ-করে বললেন, পরশু ভোরে বৌদি উইঠা দেখে দরজা খোলা। ঘাটে গিয়া দেখি কোষাটা নাই। হাসিমের বাপ কইছে তাইন নাকি দুপুরে বিলের দিকে নৌকা বাইয়া নাইমা গ্যাছে।
—কাইল একবার চল দেখি—অলিমদ্দিরে লইয়া যাই।
—চলেন। তবে মনে লয় পাইবেন না। কই থাকে কই যায় কেউ জানে না।
বড়বৌ কোনও কথা বলছিল না। বসে বসে শুনছিল। এবং চোখে জল এসে গেলে ঘোমটা সামান্য টেনে দিল। কোন নালিশ নেই এমন ভাব চোখে-মুখে। কোনওদিন সুপুরুষ লোকটি আদর করে কথা বলেনি। কোনও প্রেম সম্পর্কিত সুখী ঘটনা ইদানীং আর ঘটছে না। শুধু মাঝে মাঝে তাও ক্বচিৎ কখনও বুকের কাছে টেনে এনে দস্যুর মতো কি এক আদিম প্রেরণা যেন, চোখমুখ ঘোলা ঘোলা—মানুষ বলে চেনা যায় না। বুকের কাছে নিয়ে একেবারে বন্যজীবের মতো করতে থাকে; বড়বৌ শরীর ছেড়ে দেয়—যা খুশী করুক—পাগল মানুষটাকে সে শিশুর মতো, অথবা সন্তানের মতো, অথবা তুমি যে এক আদিম মানুষ সে কথা তুমি কি করে ভুলে যাও—আমাকে দ্যাখো, খেলা কর। বন্যজীবের মতো বুকের কাছে টেনে নেবার ঘটনাও সে আঙুলে গুনে বলতে পারে—কত দিন, কতবার—জ্যোৎস্না রাত ছিল, না অন্ধকার রাত ছিল, সব বলে দিতে পারে।
দু’দিনের উপর হয়ে গেছে। মানুষটা ফিরছে না। বড়বৌ পাগলঠাকুরকে আপনার ধন বলে জানে। মণীন্দ্রনাথ নামক ব্যক্তিটি বড় অপরিচিতি। বিয়ের পিঁড়িতে সে যেন এই পাগল মানুষটাকেই দেখেছিল। অশান্ত পুরুষ, জীবন থেকে তাঁর সোনার হরিণ হারিয়ে গেছে—মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে আছেন, অভিশাপ দেবার বাসনা যেন এবং মনে হচ্ছিল তিনি তাঁর লাবণ্যময়ীকে গিলে খাবেন। এত লোকজন, এত আলো আর সমারোহ, তবু বড়বৌর সেদিন ভয় করছিল। রাতে দিদিকে ডেকে বলেছিল, দিদি আমার বড় ভয় করছে। মানুষট। যেন আমাকে গিলে ফেলবে। আমাকে তোমরা কি দেখে বিয়ে দিলে! এমন গ্রাম জায়গায় আমি থাকবো কী করে! পরে বড়বৌ বুঝেছিল,—মানুষটি নিরীহ এবং মস্তিষ্ক বিকৃতি আছে। ততদিনে সে এই সুপুরুষ ব্যক্তিটিকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবেসে ফেলেছে। সুতরাং দুঃখকে জীবনের নিত্য অনুগামী ভেবে আজ-কাল আর নিজের জন্য আদৌ ভাবে না—মানুষটার জন্য রাতে কেবল ঘুম আসে না, কেবল জেগে বসে থাকে মানুষটা কখন ফিরবে।
রাত ঘন হচ্ছিল। ঘাটে বড়বৌ বাসন মাজছে। সোনা কাঁদছিল বলে ধনবৌকে পাঠিয়ে দিয়েছে। সে এখন একা এই ঘাটে। শশীবালা খেয়েদেয়ে এইমাত্র বড়ঘরে ঢুকে গেছেন। নির্জন রাতে এমন কি বুড়ো মানুষটার কাশির শব্দও ভেসে আসছে না। বোধ হয় এখন সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। নৌকাটা অলিমদ্দি ঘাটে রাখেনি। ঘাটের কিছুটা দূরে লগিতে বেঁধে ঘুমিয়ে পড়েছে। বড়বৌর বাসন মাজা হয়ে গেছে, তবু উঠতে ইচ্ছা করছে না। ঘাটের একপাশে লণ্ঠনের আলোতে বড়বৌর মুখ বিষণ্ণ। জ্যোৎস্না রাত বলে দূরের মাঠ দিয়ে নৌকা গেলে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আজ আর কুয়াশা ভাবটা নেই। বড়বৌ এই ঘাটে সেই নিরুদ্দিষ্ট মানুষের জন্য বসে আছে। তিনি হয়তো আসছেন, এক্ষুনি এসে পড়বেন। বড়বৌর কথা মনে ভেসে উঠলে মানুষটা পাগলের মতো ঘরের দিকে ছুটতে থাকেন।
রাত বাড়ছে। একা একা ঘাটে বসে থাকতে আর সাহস পেল না বড়বৌ। শুধু ঝোপ জঙ্গলে কিছু অপরিচিত পাখ-পাখালি, কীট-পতঙ্গ রাতের প্রহর ঘোষণায় মত্ত। আলকুশি লতার ঝোপে ঢুব-ঢুব আওয়াজ। গন্ধপাদাল ঝোপে ঝিঁঝিঁ-পোকা ডাকছে। রাত গভীর হলে, নিশীথের প্রাণীরা কত হাজার হবে লক্ষ হবে এবং লক্ষ কোটির প্রাণের সাড়া এই ভুবনময়। গভীর রাতে জেগে থেকে টের পায় বড়বৌ, যেন মানুষটা এখন নিশীথের জীব হয়ে জলে-জঙ্গলে ঘোরাফেরা করছে।
রান্নাঘরে বাসনকোসন রেখে পুবের ঘরে উঠে যাবার মুখেই মনে হল ঘাটে লগির শব্দ। বড়বৌর বুকটা কেঁপে উঠল। তাড়াতাড়ি ছুটে গেল ঘাটে। মানুষটা লাফ দিয়ে নৌকা থেকে নামছে। নৌকোটাকে টেনে প্রায় জমিতে তুলে ফেলল। কোন দিকে দৃকপাত নেই। লম্বা উঁচু মানুষটা—কী যে লম্বা আর কী যে রহস্যময় চোখ—এই সুদৃশ্য জ্যোৎস্নায় যেন এক দেবদূত আকাশ থেকে নেমে এসেছেন। বড়বৌ দেখল মানুষটার শরীরে কোনও বসন নেই। একেবারে প্রায় উলঙ্গ এবং শিশুর মতো বড়বৌকে জেগে থাকতে দেখে হাসছে। নৌকায় কচু কুমড়া কলা। যার যা কিছু প্রথম গাছে হয়েছে, মানুষটাকে দিয়ে দিয়েছে। বড়বৌ বিস্ময়ে কোনও কথা বলতে পারল না। যেন এক সন্ন্যাসী দীর্ঘদিন তীর্থ-ভ্রমণের পর নিজের ডেরাতে হাজির হয়েছে। অন্যদিন হলে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে কাপড় পেড়ে আনত। আজ কিছুই ইচ্ছা হল না, এই সাদা জ্যোৎস্নায় এমন এক শিশুর মতো যুবকটিকে নিয়ে কেবল খেলা করে বেড়াতে ইচ্ছা হচ্ছে।