Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নিশুতি রাতের ডাক || Syed Mustafa Siraj » Page 9

নিশুতি রাতের ডাক || Syed Mustafa Siraj

পারমিতা মুখ নামিয়ে আস্তে বললেন বিশ্বাস করুন, আজ সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত স্বপনকে আমি চিনতুম না। হঠাৎ ও এসে পরিচয় দিল! জোর করে ঘরে ঢুকে নিজেই দরজা বন্ধ করে দিল।

স্বপন হাসল।–মিতুদি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। এবার বুঝি ওঁকে খুন করতে এসেছি ভেবে।

পারমিতা বললেন–তারপর ও আমার পা জড়িয়ে ধরল। আমি তো…

স্বপন বলল–এ ছাড়া উপায় ছিল না। তবে মিতুদি আমাকে ভুলে গেছেন। আমার বোন রাখীকে ওঁদের কলেজে ভর্তি করানোর জন্য একবার আমি ওঁর কাছে এসেছিলুমবাবার পরামর্শে। রাখীর নম্বর খুব কম ছিল।

পারমিতা মুখ তুলে বললেন–স্বপন কথাটা মনে পড়িয়ে না দিলে মনে পড়ত না। রাখীর জন্য চেষ্টা করেছিলুম। কিন্তু আর কেউ আসেনি আমার কাছে স্বপন, না রাখী।

স্বপন গলার ভেতর থেকে বলল–তখন রাখী গোল্লায় যেতে বসেছে বাবা মায়ের প্রশ্রয় পেয়ে। রাগ করে আর আসিনি।

কর্নেল চুরুট কামড়ে লক্ষ্য করছিলেন স্বপনকে। দাড়ি রেখেছে স্বপন। চোখ দুটো কোটরগত। কিন্তু তীব্রতায় জ্বলজ্বল করছে। প্রতিভাশালী একজন যুবক পাপের ছোঁয়ায় কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে আজ! বললেন–তুমি মিতার কাছে এলে কেন স্বপন?

স্বপন বলল–সরাসরি আপনার সঙ্গে যোগাযোগের সাহস পাইনি। আমার পিসতুতো দাদা মনোরঞ্জন পুলিসের আই বি অফিসার। তার কাছে আমি আছি। মনোদার পক্ষে আমার জন্য কিছু করা সম্ভব নয়। তাই মনোদা আজ আপনার সঙ্গে গোপনে দেখা করতে বলল আমাকে। কিন্তু আপনি কী ধরনের লোক আমি জানতুম না। হঠাৎ আমার মিতুদির কথা মনে পড়ে গেল। স্বপন একটু হাসল আবার।–বানের জলে ভাসতে ভাসতে খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো আমার অবস্থা। ভাবলুম, মিতুদি শিক্ষিত মহিলা কলেজের অধ্যাপিকা। রাখীর জন্য বলতে এসে ওঁর অমায়িক ব্যবহার খুব ভাল লেগেছিল। এমন সিম্প্যাথেটিক মানুষ আর কখনও দেখিনি। ওঁকে যদি হাতে পায়ে ধরে আপনার কাছে পাঠাতে পারি–উনি আপনাকে সব বুঝিয়ে বলবেন। তারপর আমাকে নিয়ে যাবেন আপনার কাছে। এই ভেবে মরিয়া হয়ে আর ওঁর কাছে এসেছিলুম।

কর্নেল চোখ বুজে শুনছিলেন। হুঁ, স্বপন জানত না–এখনও জানে না যে অমিয় বকসীর সঙ্গে পারমিতার কী সম্পর্ক ছিল। জানলে কখনও ওঁর কাছে। আসত না। বললেন–ঠিক আছে। তোমার মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধার ব্যাপারটা বল। বলছিলে, তোমাকে নাকি গত রাতে খুনের চেষ্টা করেছিল কেউ।

স্বপন দ্রুত বলল–কেউ না, খুনী। যে অমিয় বকসী আর বাবাকে খুন করেছে। মনোদার কাছে আজ সকালে শুনেছি, অমর্ত্যদাও একইভাবে খুন হয়েছেন ক্লাবের মাঠে। একই লোকের কাজ। এবার আমার ব্যাপারটা বলি। ওই যে বললুম বানের জলে হেল্পলেস হয়ে ভাসছি। কাল ভেবে-ভেবে ঠিক করলুম, অমর্ত্যদার হেল্প নেব নাকি। তাকে আমি চন্দ্রার ব্যাপারে মারধর করেছিলুম। কিন্তু আফটার অল, মানুষ তো! একসময় আমাকে নিজের ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন। গিয়ে যদি হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে নিই, উনি কি আমাকে হেল্প করবেন না? আপনি নিশ্চয় জানেন কর্নেল, অমর্ত্যদা খুব প্রভাবশালী লোক। সাংঘাতিক কোনো ব্যাপার চাপা দেবার ক্ষমতা ওঁর আছে।

হু–। তারপর? গেলে তার কাছে।

স্বপন শ্বাস ছেড়ে বলল-সন্ধ্যার একটু পরে গেলুম। গিয়ে দেখি ক্লাবের গেটের ওখানে একটা পুলিস ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। তখন স্টেডিয়ামের পেছন দিকটায় চলে গেলুম। এদিন ক্লাবের রেস্ট ডে আমি জানি। অমর্ত্যদা রেস্ট ডে-তে টেন্টে থাকবেনই। ওঁর এই একটা ভীষণ খারাপ দিক। কলগার্ল বা ব্রথেলগার্লদের

পারমিতার দিকে তাকিয়েই সে থামলে কর্নেল বললেন–জানি। তুমি কী করলে তাই বল।

–আমার খুব চেনা জায়গা। প্রতিটি ইঞ্চি আমি চিনি। স্টেডিয়ামের পেছনে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটা অংশ আছে। ওখান দিয়ে ওঠা যায়। তারপর ওপারে গিয়ে পড়লে দর্শকের জন্য তক্তার ধাপ। ওখানটাতে আলো ছিল না। চোখে পড়ল, মাঠে প্রদীপ মৈত্র নামে রাইট ব্যাক বল প্র্যাকটিস করছে-জাস্ট ড্রিপলিং! ভেতরে নেমে গিয়ে ভাবলুম, প্রদীপকে দেখা দেব নাকি তাকে দিয়েই অমর্ত্যদাকে টেন্ট থেকে ডেকে পাঠানো যায়। কিন্তু প্রদীপটা বড্ড বোকা ধরনের ছেলে। আমাকে দেখে ওর কী প্রতিক্রিয়া হবে বলা কঠিন। কিন্তু অবাক লাগছিল, প্রদীপ এখনও বল প্র্যাকটিশ করছে কেন–আজ রেস্ট ডে-তে? অমর্ত্যদা নিয়ম কানুনের ব্যাপারে খুব কড়া। তাহলে কি উনি নেই? এই সব ভাবছি, হঠাৎ পেছনে চাপা মচমচ শব্দ শুনলুম যেন। ঘুরে কিছু দেখতে পেলুম না প্রথমবার। দু নম্বর প্যাসেজের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলুম। একটু পরে আবার শব্দ হল। চমকে গিয়ে ঘুরে দেখি, আমার মতই কেউ গুঁড়ি মেরে একইভাবে নেমে আসছে ওপর থেকে। ভীষণ ভয় পেয়ে গেলুম। পুলিস আমাকে ফলো করে এসেছে নাকি? কিন্তু পুলিস ওভাবে আসবে কেন? সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে প্যাসেজের ভেতর অন্ধকারে বসে পড়লুম। দৌড়ে পালাতে গেলে প্রদীপ চেঁচাবে। টেন্টের লোকেরা এসে যাবে। ওদিকে গেটে পুলিসের গাড়ি দেখেছি। আমাকে পালাতে হলে স্টেডিয়াম ডিঙিয়েই যেভাবে এসেছি, সেই ভাবে পালাতে হবে। কারণ আর কোনো পথ নেই।

স্বপন দম নিয়ে আবার বলতে থাকল–আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। বসে আছি তা আছি। মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিমে একটু আলো পড়েছে–সেখানে প্রদীপ আপনমনে বলের সঙ্গে খেলছে, আর খেলছে বাচ্চা ছেলের মতো। হঠাৎ আমার পেছনে একটা শব্দ হল। যেই ঘুরেছি, পাশের কাঠের তক্তার ওপর খটাস করে কী পড়ল। আবছা দেখতে পেলুম একটা লোককে। একেবারে পিঠের কাছে। তার হাতে কী একটা আছে–সেটাই তক্তার ওপর খটাস করে মেরেছে। সে হাত তুলতেই মাথাটা সরিয়ে নিলুম-খুব সংকীর্ণ প্যাসেজ তো!

কর্নেল তীক্ষ্ণদৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন-তারপর?

–আমার মাথার বাঁ পাশে লেগে পিছলে গেল কি একটা শক্ত ভোতা জিনিস। আমি সেটা ধরে ফেললুম। কিন্তু আঁটো জায়গা। লোকটা আচমকা আমার পেটে প্রচণ্ড জোরে লাথি মারল। ঠোক্কর খেয়ে পড়লুম পাশের কাঠের খুঁটিতে। সামলে নিয়েই আমি ড্যাগার বের করলুম। কিন্তু আর তাকে দেখতে পেলুম না। দর্শকের আসনের নিচে সবটাই ফাঁকা। অজস্র কাঠের খুঁটি আছে শুধু। প্রচণ্ড অন্ধকার হয়ে আছে ভেতরটা। সেখানে ঢুকে গেছে লোকটা। এদিকে মাথায় হাত দিয়ে দেখি চটচট করছে। কাঁধ, পিঠ জ্বালা করছে। মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। অতি কষ্টে আবার গুঁড়ি মেরে দর্শকের আসন দিয়ে উঠে যে পথে এসেছিলুম, সেই পথে নেমে গেলুম। প্রদীপ তখনও আপনমনে খেলছিল।

–কোথায় ব্যান্ডেজ বাঁধলে?

–সোজা চৌরঙ্গি রোডে পৌঁছে একটা ফার্মেসিতে ঢুকে পড়লুম। বললুম, বাস থেকে পড়ে গেছি। একটু ডেটল-ফেটল লাগিয়ে দিন তো, দাদা! কাউন্টারের লোকটি ভাল। খানিকটা তুলো, ডেটল আর গজ দিয়ে বেঁধে দিয়ে বলল, এক্ষুণি কোনো হসপিটালে চলে যান। যাইনি। ট্যাক্সি করে মনোদার বাড়িতে চলে গেলুম। মনোদা সবে নাইট ডিউটিতে বেরুচ্ছিল। খুব বকল। বউদি সব রক্ত-টক্ত ধুইয়ে নতুন করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল। বউদি আর. জি. কর হসপিটালের একজন সিস্টার। এ. টি. এস. ইনজেকশন দিল। আমার–

–হুঁ, তোমার কেন মনে হল ওই লোকটাই খুনী?

স্বপন একটু চুপ করে থেকে বলল–মনোদার কাছে শুনেছিলুম, অমিয় বকসী আর বাবাকে মাথায় হাতুড়ি মেরে খুন করা হয়েছে বলে ফরেন্সিক আর মর্গ থেকে সাজেস্ট করেছে। আমার মাথায় লোকটা যে জিনিসটা দিয়ে আঘাত করেছে, সেটাও একটা হাতুড়ি। হাতুড়িটা আমি ধরে ফেলেছিলুম। পেটে লাথি না মারলে কেড়ে নিতে পারতুম।

একটি কিশোরী চা আর স্ন্যাকসের প্লেট রেখে গেল। সে কিচেনের দরজায় গিয়ে ঘুরে অবাক চোখে এদিকে তাকালে পারমিতা বললেন তুই কী দেখছিস হাঁ করে? গ্যাস জ্বলছে। নিভিয়ে দিতে হবে না?

মেয়েটি ফিক করে হেসে ভেতরে ঢুকে গেল। স্বপন চায়ের কাপ তুলে বলল-আমার আর থাকা উচিত হবে না, কর্নেল! চা খেয়েই কেটে পড়ব– কারেন্ট আসার আগে।

কর্নেল একটু হাসলেন।–না। তুমি আমার সঙ্গে যাবে।

স্বপন ভড়কে গিয়ে বলল–কোথায়?

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন–মাই ডিয়ার ইয়ংম্যান, তোমার মনোদার চেয়ে আমার আস্তানা আরও নিরাপদ তোমার পক্ষে। তোমার মনোদাকে চাকরি যাওয়া–এমন কি জেল খাটার রিস্ক নিতে বাধ্য কর না আর।

–কিন্তু আপনিও তো পুলিসের

জোরে মাথা নেড়ে কর্নেল বললেন-আমি কারুর বেতনভোগী নই, ডার্লিং! পুলিস হওয়া তো দূরের কথা।

–কিন্তু আপনি তো ডিটেকটিভ!

–সে অর্থে নই। জাস্ট অপরাধ-বিজ্ঞানের একজন কৌতূহলী বুড়ো ছাত্র বলতে পার। মানুষের শিখতে শিখতে জীবন কেটে যায় যায় বলে একটা কথা আছে না? পুলিস আমার সাহায্য চায় মাঝে মাঝে, একথা ঠিকই। কিন্তু আমার পথে আমি নিঃসঙ্গ। আমার হবি হল, প্রকৃত অপরাধীকে দেখিয়ে দেওয়া। তার সাজা হল না হল, সেটা দেখার দায়িত্ব আমার নয়। আইন রক্ষকদের এবং ব্যাপক অর্থে–সমাজের হাতে সে দায়িত্ব ন্যস্ত আছে। সোজা কথায় এটা আমার এক ধরনের অন্বেষণ। মাত্র তিনটি ব্যাপার আমার এই অন্বেষণে সাহায্য করে। টেকনিক্যালি বলতে গেলে তা হল : মার্ডার উইপন, মোডুস অপারেন্ডি এবং মোটিভ। কী দিয়ে হত্যা করা হয়েছে, হত্যার পদ্ধতি বা পরিকল্পনা এবং হত্যার উদ্দেশ্য। পুরো ব্যাপারটা অঙ্কের নিয়মে আমি সাজিয়ে নিই! তথ্য থেকে ডিডাকশান পদ্ধতিতে সিদ্ধান্তে পৌঁছই। এই কেসে গোড়া থেকেই আমার সিদ্ধান্তের সঙ্গে স্বপন, তোমাকে খাপ খাওয়াতে পারছিলুম না। আসলে অঙ্কেই ভুল ছিল। কারণ তথ্যের মধ্যে একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছিল। অনুমান দিয়ে সেই ফাঁক পূরণ করার ফলেই গণ্ডগোলটা বেধেছিল। এবার সেই অনুমানকে হটিয়ে তথ্য দাঁড় করাতে পেরেছি। একটা হাতুড়ি, ডার্লিং, জাস্ট একটা হাতুড়ি। পুরো কেসটা দাঁড়িয়ে আছে একটা হাতুড়ির ওপর। নাও, ওঠ। দ্বিধা কোর না। এ বুড়ো যাকে রক্ষা করতে চায়, তাকে প্রাণ দিয়েও রক্ষা করতে প্রস্তুত।

কর্নেল চায়ের কাপ নামিয়ে রাখলেন। পারমিতা ব্যস্তভাবে বললেন– আমাকে কী জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলেন। কই, জিজ্ঞেস করলেন না তো?

–আর দরকার হচ্ছে না, মিতা। দা অ্যান্সার বুক ইজ হিয়ার। বলে স্বপনের কাঁধে হাত রাখলেন কর্নেল। তারপর নিজের রসিকতায় নিজেই হো হো করে হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালেন–ওই যে আজকাল স্কুলের বই বেরোয়–একের ভেতর তিন। থ্রি ইন ওয়ান। স্বপন, এস ডার্লিং ।

অরিজিৎ লাহিড়ী এলেন পরদিন বেলা এগারোটা নাগাদ। সে বললেন, ফোন না করেই এসে পড়লুম। কারণ আপনার আস্তানা থেকে সামান্য দূরে জাস্ট ফিটিন মিনিটস ওয়াকিং ডিস্ট্যান্সে পুলিস অপারেশন ছিল। সেখান থেকে সোজা চলে এলুম।

কর্নেল উদ্ভিদ বিজ্ঞানের কেতাব বুজিয়ে রেখে বললেন, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে মিঃ জেভিয়ারের বাড়িতে।

দ্যাটস রাইট। অরিজিৎ মিটিমিটি হেসে বললেন কাল বিকেলে আপনি কেটির ঘরে ঢুকেছিলেন!

কর্নেল অট্টহাস্য করলেন।এ বুড়ো বয়সে কি কেলেঙ্কারি! যাই হোক, আসল কথাটা বল।

–জেভিয়ারের ঘরে হানা দিয়ে চন্দ্রার জিনিসপত্র সিজ করেছি। বুঝতে পেরেছি কেন ওর সঙ্গে অমর্ত্যবাবু ঝগড়া করতে গিয়েছিলেন।

কর্নেল আগ্রহী হয়ে বললেন কী পেয়েছ আগে তাই বল।

–চন্দ্রার কাপড়-চোপড়, বেডিংপত্র আর চারটে ফটো। ফটোগুলো ইন্টারেস্টিং। দেখাচ্ছি।

অ্যাটাচি থেকে খাম বের করলেন অরিজিৎ। খামের ভেতর থেকে চারটে ছবি বের করে বললেন, এই ছবিটা ইন্টারেস্টিং নয়? আমি তো কল্পনাও করিনি যে অমিয়বাবুর সঙ্গে এই মেয়েটিরও সম্পর্ক ছিল।

কর্নেল ছবিটা হাতে নিয়ে দেখতে থাকলেন। তেরো-চোদ্দ বছরের একটি সুন্দর ফুটফুটে মেয়েকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে চেয়ারে বসে আছেন যিনি, তিনি অমিয় বকসী। মেয়েটি তার কোলে বসেছে। তার কাঁধে চিবুক অমিয়বাবুর। গালে গাল ঠেকে আছে। মেয়েটির মুখে হাসি। কিন্তু এ হাসি কি স্বাভাবিক? লজ্জা আর বিব্রত বোধ করলে যেমন ভাব ফুটে ওঠে এবং যেন বিরক্তিতে। কর্নেল বললেন–এই কি ভ্রা?

–হ্যাঁ। কারণ গত বছরের তারিখ লেখা স্বপনের পাশে তার এই ছবিটা দেখুন!

কর্নেল দেখলেন। সেই কিশোরীই এ ছবিতে যুবতী। পাশে তার কাঁধে হাত রেখে স্বপন।

এবার এই ছবিটা দেখুন। বাচ্চা চন্দ্রার প্রোফাইল।

কর্নেলের মুখে বিষণ্ণতা ফুটে উঠল। নিষ্পাপ হাসিখুশি এক শিশু-মুখে স্বর্গের সুষমা। পাপের হাত পড়েছিল তার গায়ে। জোর শ্বাস ছেড়ে বললেন– কী শোচনীয় পরিণতি হতভাগিনীর।

–এই ছবিটা একটু গোলমেলে। দুপাশে দুটো চেয়ারে এই ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা নিশ্চয় চন্দ্রার বাবা-মা। মধ্যিখানে ছোট্ট মেয়েটি চন্দ্রা। কিন্তু ভদ্রমহিলাকে খুব চেনা লাগে। উজ্জ্বলবাবুর সঙ্গে যে মহিলার ছবি আছে, তার সঙ্গে কেমন মিল আছে না? ছবিটা তো আপনার কাছে আছে! মিলিয়ে দেখুন না!

কর্নেল ড্রয়ার থেকে ছবিটা এনে পাশে রেখেই শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বলে উঠলেন–অরিজিৎ! এই হতভাগ্য মেয়েটা–এই চন্দ্রা কে, তা বুঝতে পারছ। কী এবার?

অরিজিৎ চমকে উঠলেন। –কে?

অপালা। অমিয় বকসীর স্ত্রী মৃদুলার আগের স্বামীর ঔরসজাত সন্তান। কর্নেল উত্তেজিত হলেন আবার। অপালা তার মায়ের আত্মহত্যার পর নিরুদ্দিষ্ট হয়েছিল। অমিয় তার জন্য কেন পাগল হয়ে খুঁজতে বেরিয়েছিলেন কেন তিনটে বছর সিনেমা ছেড়ে দিয়েছিলেন, পরিষ্কার হয়ে গেল।

–খুব স্নেহ করতেন তাহলে!

–স্নেহ? কর্নেলের চোখ দুটো জ্বলে উঠল। –অরিজিৎ! অমিয় বকসী ছিলেন একটি কামার্ত পশু! ওই ছবিটা দেখে কি তোমার মনে হচ্ছে পিতৃতুল্য কোনো মানুষ ওইভাবে কিশোরী কন্যাকে অশালীনভাবে জড়িয়ে ধরে ছবি তুলতে পারেন? সৎ বাবার অত্যাচারে অপালা ঘর ছেড়েছিল, এটা স্পষ্ট। তার মায়ের আত্মহত্যার কারণও হয়তো তাই।

অরিজিৎ বললেন–স্বপনকে আর ঈশ্বরের সাধ্য নেই বাঁচায়। চন্দ্রা ছিল তার প্রেমিকা। চন্দ্রার কাছে সব কথা জানার পর সে অমিয়বাবুকে—

কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন–এই ছবিগুলো আমার চাই।

–এগুলো কোর্টে একজিবিট করতে হবে। ঠিক আছে, কাল ফেরত দেবেন।

–দেব। সীমন্তর কাছে এগুলোর কপি করিয়ে নেব আজই। চিন্তা কর না। এই সময় ফোন বাজল। কর্নেল হাত বাড়িয়ে ফোন তুলে সাড়া দিলেন। তারপর ঘুরে বললেন–তোমার ফোন অরিজিৎ!

অরিজিৎ বিরক্ত হয়ে বললেন-জ্বালাতন! এখানে আছি কে বলল ওদের?

কর্নেল সকৌতুকে বলেন–গোয়েন্দা কর্তার পেছনও গোয়েন্দা ঘুরছে, ডার্লিং!

অরিজিৎ ফোন তুলেই কড়া ধমক দিলেন। এখানে আছি কে বলল আপনাকে? …তারপর একটু ঘুরে কর্নেলের দিকে কটাক্ষ করলেন। হ্যাঁ, বলুন। ..ইজ ইট? … সে কি! আশ্চর্য তো! …ওক্কে! ওই ভদ্রলোককে ধরে আনার ব্যবস্থা করুন! ইয়েস, দ্যাট ব্লাডি কন্ট্রাক্টারকে। কী যেন নাম ব্যাটার? .হ্যাঁ, সরল সেন। নাম সরল, লোকটা মোটেও সরল নয় দেখা যাচ্ছে। ইয়েস, মিসলিড করেছে। …হ্যাঁ, ডেলিবারেটলি করেছে এটা। ওকে অ্যারেস্ট করুন। ..নো, নো। আই ডোন্ট কেয়ার বালক অর নাবালক এনি ড্যাম পার্সন হু এভার হি ইজ! …শুনুন, আপনার ওই বালক নাবালক যাদ ট্রাবল পাকায়, তাকেও অ্যারেস্ট করুন! মাই রেসপনসিবিলিটি। তঁতোর চোটে বেরিয়ে আসবে সব কথা! …ওকে। ছাড়ছি।

অরিজিতের মুখ লাল হয়ে গেছে রাগে। ফোন ছেড়ে বসতেই কর্নেল বললেন–মেদিনীপুরের সেই গ্রামে বনবিহারী দাস নামে কোনো লোককে পাওয়া যায়নি। তাই তো?

অরিজিৎ সিগারেট ধরিয়ে বললেন, কিন্তু আবার যে সব জট পাকিয়ে গেল!

–মোটেও না। পুরো জট খুলে গেল। সরলবাবুর দৌলতে সব সরল হয়ে গেল।

অরিজিৎ ভুরু কুঁচকে বললেন বুঝতে পারছি না।

কর্নেল সোজা হয়ে বসে বললেন ভুয়ো ঠিকানা দেওয়াতে কি প্রমাণিত হল না যে সরলবাবুর সঙ্গে যে ইলেকট্রিশিয়ান এসেছিল, সেই অমর্ত্যবাবুকে খুন করেছে? সে হাওড়া স্টেশনে যাবার নাম করে সরলবাবুর সঙ্গে ফিরে যায়নি স্টেডিয়ামের পেছন দিয়ে খুঁটি বেয়ে উঠে

–প্রমাণ কী?

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললে–প্রমাণ আমার হস্তগত হয়েছে। আপাতত আমি তুরুপের তাসটি কাউকে দেখাতে চাইনে অরিজিৎ! এ বুড়োর ওপর ক্রুদ্ধ হয়ো না। দুটো দিন অপেক্ষা কর। আমি এই সব হত্যাকাণ্ডের নায়ককে হাতেনাতে ধরিয়ে দেব। যাই হোক, এমনও তো হতে পারে অরিজিৎ, সরল সেন তোমাদের ঠিকই ঠিকানা দিয়েছিলেন–আসলে বনবিহারী তাঁকে ভুয়া ঠিকানা দিয়েছিল–তাই সরলবাবুর কোনো দোষ নেই।

–ধোলাই খেলে সেটা বেরিয়ে পড়বে।

–না অরিজিৎ। খামোকা এসব করতে যেও না। কোনো লাভ হবে না।

–আপনার বুদ্ধিসুদ্ধি ক্ষমতার ওপর আমার ভরসা আছে। বাট দিস ইজ জাস্ট এ প্রফেসি!

–ডার্লিং, তুমি উত্তেজিত। শান্ত হও। এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি মাথা ঠাণ্ডা রাখা। নইলে খুনীকে আবার ভিড়ে হারিয়ে ফেলব। আর তার দেখা পাব না।

অরিজিৎ একটু হাসলেন। ওকে।

কর্নেল হাঁক দিলে–ষষ্ঠী! তোর নালবাজারের নাহিড়ীসায়েবকে একটা কোল্ড ড্রিংক দিয়ে যা বাবা!

ষষ্ঠী ওত পেতে দাঁড়িয়েছিল। সে উদ্বিগ্ন। বাবামশাই তাকে মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা যুবকটির ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন। ঝটপট ফ্রিজ থেকে একটা কোল্ড ড্রিংক দিয়ে গেল।

অরিজিৎ গ্লাসে ঢেলে চুমুক দিয়ে বললেন–আসলে খবরের কাগজগুলো বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। বিশেষ করে আপনার স্নেহধন্য জয়ন্তবাবুর দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা। আজ কী সম্পাদকীয় লিখেছে পড়েছেন? জয়ন্তবাবু থাকলে ওঁকে বলতুম—

জয়ন্ত এখন স্টেটসে মার্কিন সুন্দরীদের সান্নিধ্যে স্বর্গবাস করছে। মিয়ামি বিচে শুয়ে আছে। কাল ওর চিঠি পেলুম।

কর্নেল সিরিয়াসলি বলছি। শিগগির এই কেসের ফয়সালা করতে না পারলে আমি রেজিগনেশান দেব–দিতে বাধ্য হব। ইতিমধ্যে কথা উঠেছে আমি সিনেমা মহলের কাউকে নাকি গার্ড দিচ্ছি। কেসটা চাপা দেওয়ার তাল করছি। কারণ আমি একসময় সিনেমা লাইনে ঘোরাঘুরি করতাম। ডকুমেন্টারি করেছিলুম গোটাদুই।

–তা তো করেছই। কার আর্ট ফিল্মে সুরকারও ছিলে যেন?

-হ্যাঁ। কিছু দেশী-বিদেশী মিউজিক পাঞ্চ করে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক কম্পোজ করেছিলুম। কিন্তু পুলিসে ঢুকেছি তার কত্তো পারে!

–সুতরাং ডার্লিং, লোকে পাঁচ কথা বলতেই পারে। কান দিও না। ওয়েট ওনলি ফর টু ডেজ। আমি একটা ফাঁদ তৈরি করছি। কর্নেল দুটো আঙুল তুলে হাসলেন। তারপর গম্ভীর হলেন আগের মতো। হ্যাঁ, একটা ফাঁদ। খুব রিস্ক আছে। তবু উপায় নেই। সমস্যা শুধু, এই ফাঁদ তৈরি করার জন্যই খুনীর মোটিভ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দরকার। মোটিভ জানতে হলে লোকটার আসল পরিচয় জানা দরকার। এই পরিচয় জানার জন্যই দুটো দিন সময় নিতে চাই। আশাকরি আটচল্লিশ ঘণ্টা সময়ই সেজন্য যথেষ্ট। ..

অরিজিৎ লাহিড়ী চলে গেলে কর্নেল বাইরের দরজা বন্ধ করে এলেন নিজের হাতে। ষষ্ঠীই কাজটা করে। ড্রয়িংরুম হয়ে ল্যাবরেটরিতে ঢুকলেন। তারপর পর্দা তুলে পেছনের দিকে বেডরুমে গেলেন। স্বপন একটা ক্যাম্পখাটে শুয়ে কাগজের খেলার পাতা পড়ছিল। উঠে বসল। নার্ভাস ভঙ্গিতে হাসল সে-ষষ্ঠী বলছিল লালবাজারের কোন অফিসার এসেছে।

–ভয় পেয়েছিলে তো?

–একটু যে পাইনি, তা নয়।

কর্নেল বসে বললেন–এই ছবিগুলো দেখ। চন্দ্রার জিনিসপত্রের সঙ্গে ছিল।

স্বপন ছবিগুলো দেখেই বলল–আমার দেখা ছবি!

–এই ছবিটা বাবা-মায়ের সঙ্গে চন্দ্রার।

–হ্যাঁ। ওর ছোটবেলার ছবি। আমি একটা কারণে খুব অবাক হয়েছিলুম। ওর মাকে চিনতে পেরে। আমার বাবার সঙ্গে ভদ্রমহিলাকে দেখেছিলুম যেন .. বারকয়েক। আমার অবশ্য ভুল হতেও পারে।

–তোমার ভুল হয়নি।

–চন্দ্রা বলত ওর মা অ্যাকট্রেস ছিল। খুব বড়লোক ছিলেন নাকি ওর দাদামশাই। মদ আর জুয়া খেলে সর্বস্বান্ত হয়ে মারা যান। তবে চন্দ্রার খুব একটা শ্রদ্ধা ছিল না মায়ের সম্পর্কে। খুব ঘেন্না করে মায়ের কথা বলত। বলত, মা ছিল আমার চেয়ে বেশি নষ্ট মেয়ে। তখন চন্দ্রার ব্লাডক্যান্সার ধরা পড়েছে। তবু কিছুতেই হসপিটালে যাবে না।

হু। সে সব কথা তো বলেছ। ওর বাবার সম্পর্কে খুব অভিমান ছিল। তাই না?

ভীষণ। তবে বাবার জন্য সে কেঁদেও ফেলত।

–ওর বাবার নাম মনে করতে পারলে?

–মাথায় চোট খেয়ে কী যেন হয়েছে। কিছুতেই মনে পড়ছে না। পেটে আসছে, মুখে আসছে না। অথচ নামটা অত্যন্ত কমন। সু-সুনীল, না সুরেশ উঁহু। অন্য কিছু।

–তন্দ্রা তোমাকে বলেছিল, ওর মা ওর বাবাকে ডিভোর্স করেছিল কেন?

কাল রাতে তো বললুম। আসলে ভদ্রলোক–মানে স্ট্রার বাবা ওসব পছন্দ করতেন না।

অভিনয়ের লাইনে যাওয়া?

হা। খুব সাদাসিধে লোক ছিলেন। ধর্মভীরু টাইপ। ফ্যাশান সহ্য করতে পারতেন না। বাবার ভয়ে চন্দ্রা একটু সাজতেও ভয় পেত। বাবা ওকে খুব বকাবকি করতেন। চন্দ্রা বলত, দাদামশাইয়ের অবস্থা পড়ে না এলে তার বাবার সঙ্গে তার মায়ের বিয়েই হত না।

-কেন?

–ওর বাবা সামান্য একজন ইলেকট্রিক মিস্তিরি ছিলেন।

কর্নেল নড়ে বসলেন। –একথাটা তো বলনি!

স্বপন কাচুমাচু মুখে হাসল। সব কথা খেয়াল করা যাচ্ছে না। মাথায় চোট খেয়ে কী একটা হয়েছে। সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে খালি।

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন হঠাৎ। ফের বললেন–চন্দ্রা বলেছিল ওর বাবা ইলেকট্রিক মিস্তিরি ছিলেন?

–হ্যাঁ। স্পষ্ট মনে আছে।

কর্নেল আস্তে বললেন–ঠিক আছে। তুমি স্নান করে ফেল। না–ব্যান্ডেজ থাক। গলা অব্দি যথেষ্ট। বাথটাবে অসুবিধে হবে না তো? আলরাইট।

যেতে যেতে একটু হেসে বলে গেলেন ফের–হু। বাথটাবে জলের ভেতর শুয়ে থাকতে থাকতে দেখ যদি মনে পড়ে নামটা।

খবর পেয়ে দুটোর মধ্যে এসে গেল সীমন্ত। কর্নেল বললেন–তোমাকে একটা ফটো রিপ্রিন্ট করতে দেব। সেজন্য ডেকেছি।

বলে খাম খুলে বাবা-মায়ের সঙ্গে চন্দ্রার ছবিটা বের করলেন।

সামন্ত বলল-কাদের ছবি?

কর্নেল হাসলেন। প্রশ্ন কর না। আর একটা কথা। তোমার স্টুডিও থেকে বড্ড ছবি চুরি যায়। কাজেই এটা যতক্ষণ রিপ্রিন্ট না হবে, ততক্ষণ আমি বসে পাহারা দেব।

সীমন্ত অপ্রতিভ হয়ে বলল–সে তো ওই একবার। বজ্জাত স্বপনটা—

কর্নেল ঠোঁটে আঙুল রেখে বললেন–চুপ, চুপ। দেয়ালের কান আছে? হুঁ, শুধু এই ভদ্রলোকের ছবিটাই রিপ্রিন্ট করতে হবে বড় আকারে। এই মহিলা আর বাচ্চাটাকে বাদ দিয়ে। কতক্ষণ লাগবে? হাতে সময় কম। কত কম সময়ে। পার, বল? নইলে অন্যত্র

সীমন্তের আঁতে লাগল। ঝটপট বলল–তিন ঘণ্টা যথেষ্ট। আমার যে মডার্ন লেটেস্ট ইকুইপমেন্ট আছে, কলকাতায় কারুর নেই। বাচ্চুদার সঙ্গে খিদিরপুর এরিয়ার এক স্মাগলারের প্রচণ্ড জানাশোনা আছে। বাচ্চুদাকে ধরে গত মাসে কিছু জিনিস যা যোগাড় করেছি, কেউ কল্পনা করতে পারবে না।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন–কিন্তু আমি উপস্থিত থাকব।

সীমন্ত উৎসাহে উঠে দাঁড়াল। দ্যাটস মাই অনার। চলুন।

সীমন্ত গাড়ি এনেছিল। কর্নেল ওর গাড়িতেই চললেন। গড়িয়াহাটে মুনলাইট স্টুডিওতে পৌঁছে সীমন্ত ছবি তোলার কেবিনে ঢুকল। কর্নেল ওর কর্মচারী দুজনের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন।

কর্নেল অন্যের মুখ খুলে দিতে সিদ্ধহস্ত। একজন কর্মচারী খদ্দের সামলাতে সামলাতে আলোচনায় যোগ দিচ্ছিল। ফটো নিতে আসছে যারা, তারা বিরক্ত। অন্যজন মুখ খুলে দিয়েছে। তার কথায় পূর্ববঙ্গীয় টান দেখেই কর্নেল সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাখি মাছ, ধানখেতের একটু প্রশংসাজনক উল্লেখ করা মাত্র তার নস্টালজিয়া এসে গেছে। সে অনর্গল ফরিদপুরের কথা বলে চলেছে। অন্যজন ময়মনসিংহের লোক। তরিতরকারির সূত্র পেয়েই সে ফুঁসে উঠল– হাঃ! বাইগনের কথা কী কইলেন ধরণীদা? বাইগন আছিল আমাগো জেলায়। পাক্কি তিন সের ওজন একেকটা।…

কর্নেল জানেন, কাউকে কথা বলাতে হলে তার দুর্বল জায়গাটা খুঁজে বের করতে হয়। এই মানুষগুলো কবে দেশ ছেড়ে চলে এসেছে। তখন হয়তো কিশোর বা বালক মাত্র। কিন্তু ওই বয়সের যা কিছু স্মৃতি, মানুষকে বড় আচ্ছন্ন রাখে। এরা বাধ্য হয়ে চলে এসেছে অবস্থার চাপে। তাই মায়া কাটাতে পারেনি। অবচেতনায় সেই মায়া বণাঢ্য হয়ে রয়েছে। একটু ফাঁক পেলেই উৎসারিত হয় সেই মায়ারঞ্জিত স্মৃতি। হৃদয় খুলে দেয় অবাধে।

সময় কাটানো দরকার। তিন ঘণ্টা সময়। সেই ফাঁকে নিজের মধ্যেও ডুবে যাচ্ছেন। বনবিহারী দাসকে লক্ষ্য করছেন মনের ভেতর। একজন ইলেকট্রিশিয়ান তার হাতুড়ি নিয়ে পা টিপে টিপে এগিয়ে যাচ্ছে তাদের দিকে, যারা তার সাধের সংসারকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে–জেনে বা না জেনে। তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে ভুলিয়ে নিয়ে গেছে। তার আদরের মেয়েকে নষ্ট করেছে। পাপের পথে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে ওদের। সে লোকগুলোকে ক্ষমা করতে পারছে না। অমিয় বকসী, তারপর উজ্জ্বলকুমার, তারপর অমর্ত্য রায়, এবং স্বপন অধিকারী। স্বপনকে সে কায়দা করতে পারেনি। আঘাত হেনেছিল। ফসকে গেছে দৈব্যাৎ। স্বপন এখন বেঁচে আছে।

হু–স্বপনকে আপাতত সে পাচ্ছে না। স্বপন নিরাপদ দুর্গে আছে বলা যায়! তবে ষষ্ঠীটা একটু বোকা। সেজন্যই ভাবনা হয়।

চমকে উঠলেন কথাটা ভেবেই। কাউন্টারে টেলিফোন আছে। ফোন তুলে ডায়াল করলেন। ষষ্ঠীর সাড়া পেয়ে বললেন বাবামশাই বলছি রে! কোনো খবর আছে?

বাবামশাই? কোত্থেকে বলছেন?

–আঃ! খবর আছে কিছু?

-আজ্ঞে না।…আজ্ঞে হ্যাঁ, হ্যাঁ। এইমাত্তর নালবাজারের নাহিড়ী সাহেব ফেং করেছিলেন। বললেন, ফিরলে ফোং করতে বল।

আর কিছু?

না।

–তোর দাদাবাবু কী করছে?

ছাদে বসে কফি খাচ্ছেন। খেতে খেতে ম্যাগাজিং পড়ছেন।

–ঠিক আছে। কেউ এলে বলবি– কী বলবি?

–নেই বলব। মানে– বাবামশাই নেই।

–আর?

–মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেব। সে নালবাজারের নাহিড়ী সায়েব হোক, আর নাটসায়েব তোক।

–ঠিক আছে কর্নেল ফোন রাখলেন।

সীমন্ত উত্তেজিতভাবে বেরিয়ে এল এনলার্জ করা ভিজে ছবি নিয়ে।– এ কী কর্নেল! এ তো দেখছি সরলদার কর্মচারী বনবিহারী। ইলেকট্রিশিয়ান, মায়াপুরী স্টুডিওতে থাকে। ঘর পাচ্ছিল না বলে সরলদাকে ধরে ম্যানেজ করেছে। এর ছবি কী হবে বলুন তো?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress