Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

অনেকদিন লিখেনি পলাশ। শর্মি সেদিন মেইল বক্স খুলে দেখে পলাশের চিঠি। আমেরিকায় আসার পর বন্ধুদের মাঝে একমাত্র পলাশই একটা ক্ষীণ যোগাযোগের সুতা ধরে রেখেছে। পলাশ লিখেছে অবশেষে তোর আমীর ভাইকে খুঁজে পেয়েছি শর্মি। সে এখন রাঙ্গামাটির এক দুর্গম পাহাড়ের উপত্যকায় উপজাতি ডেরায় অভিবাসী। আদিবাসীদের প্রিয় মানুষ। নাম ভাঁড়িয়ে সেজেছে মংরু সর্দার। পাহাড়ী ঢালের ঝুম চাষী। জঙ্গল পুড়িয়ে ধানের ক্ষেতি করে। পিঠে তীর ধনুক ঝুলিয়ে অরণ্যে শূকর শিকারে বেরোয়। বন মোরগের বাসা থেকে ডিম চুরি করে গ্রামের হাটে বিক্রি করে। মংরু সর্দারের হলুদ চামড়া বোঁচা নাকের পাঁচটি ছেলেমেয়ে। দু’টি মাঘী পূর্ণিমার মেলায় গিয়ে কুড়িয়ে পাওয়া। বাকী তিনটি এসেছে বাই ডিফল্ট লখিয়ার পিছু পিছু। তোর আমীর ভাই এখন পরিত্যাক্ত আদিবাসী রমণী লখিয়ার সাথে ঘোর সংসারী।
পলাশ লিখেছে চারুকলা মিলনায়তনে বার্ষিক উপজাতি উৎসবে আদিবাসীদের অনুষ্ঠান দেখছিলাম। নাচের প্রোগ্রাম দেখতে দেখতে স্টেজের মাঝখানের লোকটাকে খুব চেনা লাগছিল। আমীর না? হ্যাঁ আমীরই তো! কাছ থেকে খুব খেয়াল করে না দেখলে ওকে এখন আর চিনতে পারবি না। এমনিতেই লম্বা গড়নের। শুকিয়ে গিয়ে আরো ঢ্যাঙ্গা। উরু পর্যন্ত উদোম পা। খালি গা। লুঙ্গিতে মালকোচা মারা। হাড্ডিসার বুকে খড়িমাটি দিয়ে কঙ্কাল আঁকা। মুখে চুনকালির আঁকাবুকি। গলাভর্তি শামুকের মালা। মাথায় পালকের মুকুট। জাস্ট ইমাজিন শর্মি। চিকন চিকন লম্বা ঠ্যাং ছুড়ে একঝাঁক চাকমা মেয়ের সাথে স্টেজের ওপর নৃত্য করছে তোর আমীর ভাই! নাচ শেষ হতে গ্রিন রুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই শালা টের পেয়ে গেছিল চিনে ফেলেছি। হন্যে হয়ে পেছনের দরজা দিয়ে পালাবার পথ খুঁজছিল। কাছে গিয়ে খপ করে হাতে ধরে ফেলতেই একেবারে লেজেগোবরে সারেন্ডার। ময়লা দাঁত বের করে খিক খিক হেসে আমীর হোসেন মিনতি করেছে, প্লিজ দোস্ত এসব শর্মিকে বলবিনা!
নে শর্মি! গতবার আমেরিকায় যাবার সময় খুব করে বলে গিয়েছিলি বেঁচে থাকলে তোর আমীর ভাইকে যেন খুঁজে বের করি।পলাশের চিঠি পড়তে পড়তে ফোনের কাছে দৌড়ে গিয়ে টেরেসার অফিসের নাম্বার ডায়াল করে শর্মি। এই মুহূর্তটা টেরেসার সাথে শেয়ার করতে না পারলে জান ফেটে যাবে ওর।
শিগগির চলে আয় টেরি। দারুণ খবর আছে।
– ফোনে বল। আমি এখন ভীষণ ব্যস্ত!
টেরেসা পাত্তা দেয় না শর্মির কথার।
– ফোনে বলা যাবে না। তুই এক্ষুণি আয়।
শর্মি তাড়া দেয়।
– আমি সত্যিই ব্যস্ত শর্মি। এখনই আসতে পারছিনা।
তুরুপের তাসটা এবার চালতেই হলো শর্মিকে।
– আমীর হোসেনের খবর আছে!
– মাইগড! ওহ্ মাই গড! এক্ষুণি আসছি শর্মি।
– টেলিফোনে টেরেসার চিকন গলার বিকট চিৎকার ভেসে আসে। টেরেসাদের ডে কেয়ার সেন্টারটা বাসা থেকে খুব একটা দূরে নয়। একটু পরেই পাশের রাস্তায় গাড়ির হার্ড ব্রেকের শব্দ। রাস্তার পাশে গাড়ি ফেলে টেরেসা এক দৌড়ে চলে এলো শর্মিদের বারান্দায়।
– বল শর্মি। টেরেসার তব সইছিল না।
শর্মি টেরেসাকে পলাশের চিঠির পুরোটা ট্রান্সলেট করে শোনালো। টেরেসা খুব মন দিয়ে শুনল। তারপর আস্তে করে বলল-
– হাউ সুইট!
টেরেসাকে একটু অন্যমনস্ক লাগছিল। এই মুহূর্তে ওর তো খুব লাফালাফি করার কথা। মন খারাপ নাকি? প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য শর্মি বলল,
– তোর ড্যানির খবর বল।
টাইমিংটা বুঝি ঠিক হলো না। কে জানে কেন এমন খিঁচড়ে ছিল টেরেসার মন। ড্যানির নাম বলতেই একেবারে বোমার মতো ফেটে পড়ল। টেরেসা এমনিতে শান্ত স্নিগ্ধ মিঠে ভাষার বুলবুলি। কিন্তু এখন মুখ দিয়ে খিস্তি খেউরের খই ফুটতে শুরু করল। দাঁত কিড়মিড়িয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে ইংরেজিতে টেরেসা যা বলছিল তার অর্থ করলে দাঁড়ায়-
– ড্যানির কথা বলছিস? শালার ওই বেজন্মাটার পাছায় লাথি মেরে ঘর থেকে বের করে দেব একদিন। ছেলেটা আমার এখনো অনেক ছোট বলে কিছু বলছি না। এরিকটা আবার ওই হারামজাদাটার নেওটা। বাপ ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না। একটু বড় হলে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাপ প্রীতিটা ছাড়িয়ে দেব। তারপর ওই নারীখেকোটাকে দেখাবো রঙ্গ কাহাকে বলে।
– এত ক্ষেপলি কেন? গালমন্দ কি ভালো জিনিস? হাজার হলেও নিজের সোয়ামী বলে কথা।শর্মি তখনো ঠাট্টা করছিল।
হেল উ্ইথ ইয়োর সোয়ামী! শালার বাইরে গিয়ে রুজি করার মুরোদ নেই। ঘরে বসে নিজের পোলার বেবিসিটিং করে। বউয়ের পয়সায় কেনা সিগারেটে সুখটান দিয়ে বত্রিশ দাঁত কেলিয়ে হাসতে ভাউড়াটার এতটুকু লজ্জা করে না। ওই লুজারটা মনে করে ওর ঔরসে বাচ্চা পয়দা করে জনমের লাগি ফেঁসে গেছি আমি!
– নিষ্কর্মা বেকারটাকে কেন যে বিয়ে করতে গিয়েছিলি? শর্মি কণ্ঠে সহানুভুতি মেশায়।
– বেজন্মাটার রূপ যৌবনে মজে গিয়েছিলাম রে। শালার ওই হাল্ক মার্কা শরীরের নেশায় মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এক উইক এন্ডে নাইট ক্লাবে পরিচয়। পরের দিনই ডেটিং। সেকেন্ড ডেটিংয়েই সব কিছু হয়ে গেল। মেয়েদের কাছে হারামজাদাটা তখন দ্য মোস্ট ডিজায়ার্ড ব্যাচেলর ইন টাউন। বান্ধবীর কাছে হেরে যাবার ভয়ে শালার সাত দিনের মাথায় ধ্রাম করে অই কুত্তার বাচ্চাকে বিয়ে করে ফেললাম। ঐ বয়সে অত কিছু কি আর খেয়াল থাকে! ভাউড়াটা এখনো ওর প্রাক্তন মাগীদের পিছে ঘুর ঘুর করে। মনে করে আমি কিছু বুঝি না।
শর্মি ভাবল টেরেসা যেভাবে তেতে উঠেছে পরিবেশটা একটু হালকা করা দরকার। মজা করার জন্য বলল,
– হ্যাগোর লগে বেয়াদপী কইর না বইন। ভুইলোনা হ্যাগোর পাঁজরার হাড্ডি থনে আমরা পয়দা অইছি। হি হি হি।
টেরেসা হেসে ফেলে। দারুণ মজায় পেয়ে বসে দুই বান্ধবীকে। বিছানায় মুখোমুখি জোড়াসীন, দুই হাতের মুঠোয় থুতনি ঠেকিয়ে তারা পতি অর্চনায় মশগুল হয়ে পড়ে। গালে হাত দিয়ে চোখ পিট পিট করে টেরেসা বলে,
– হ্যারা পতি গোত্রের খাস বান্দা। আমরা বিবিরা দুই নম্বরী। হি হি হি।
– শুধু তো পতিই না রে বইন। অধিপতিও বটেন।শর্মির কপালজুড়ে নকল দুশ্চিন্তার ভাঁজ।
– তুমি খুব পেঁচাইয়া পেঁচাইয়া কথা কও শর্মি আফা। পতি আর অধিপতির ফারাক তো মালুম অয় না। টেরেসা জেনুইনলি কনফিউজড।
– ধুত্তরি! মোদের পতি অইল অগতির গতি। যার লাগি উকিল বাবার সামনে মোরা ঘোমটা দুলিয়ে কবুল বলেছি। চার্চের ফাদারের পাশে দাঁড়িয়ে তোমরা আই ডু কয়েছ। হেই পতিরা আমাগো ভাত পানি শাড়ি বেলাউজ সোনো পাউডারের সাপ্লায়ার।
– বুচ্চি বুচ্চি।পতির শানে নজুল অইল যে তেনারা সোয়ামীর পদাধিকার বলে আমাগো দেহ মন জীবন যৌবনের একমাত্র স্বত্বাধিকারী। অতএব অধিপতি।
– তেনাদের স্ট্যাটাস কইলেম আসমানি দেবতা বরাবর।
– আর মোদের জান্নাতের অ্যাপার্টমেন্টের সিঁড়িডা কইলেম হ্যাগোর পায়ের তলায়।
– ওই সিঁড়ি বাইয়া আমরা কোমর দুলায়ে জান্নাতে প্রবেশ করব।
– তেনারা সেখানে সোন্দর সোন্দর হুর গো লগে মৌজে লবেজান হবেন। আমাগো ছুট্টি!
হি হি হি।
দুই বান্ধবী গলা ধরে হেসে লুটিয়ে পড়ে।
ঠিক তখনই ঝপাং করে ঘরের ভেজানো দরজাটা খুলে যায়।
– আম্মুনি!
দরজায় দাঁড়িয়ে বুলা।
বুলার গা জড়িয়ে অপটু হাতের এলোমেলো প্যাঁচে অনিচ্ছায় বন্দি শর্মির বিয়ের লাল বেনারসি। কনুই পর্যন্ত ঝুলে পড়েছে ওভার সাইজ ব্লাউজের ঢলঢলে হাফ স্লিভ। মুখ জুড়ে মাখমাখি হয়ে আছে তাড়াহুড়োর এলেবেলে প্রসাধন। কপালে লিপস্টিকের লাল টিপ। শাড়ির কোনা টেনে মাথায় অগোছালো ঘোমটা। গুচ্ছের কাচের চুড়িতে ঝলমলে সুডৌল দু’হাত মেলে মডেল মেয়ের ভঙ্গিতে কোমর বেঁকিয়ে খিক্ খিক্ হাসছে বুলা। শর্মি দেখছে কনেবেশী বুলাকে। বুলার মসৃণ টিকালো নাকে বেলী ফুলের পাপড়ির সোনালি আভা ছড়াচ্ছে আমীর হোসেনের নাকফুল।
বহু বছর আগের সেই দৃশ্যটা আবারো শর্মির বুকের পাঁজরে আছাড় খেতে খেতে রিপ্লে হয়ে চলেছে। আজাহার মামার হাতে মার খেয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অটোয় উঠে যাচ্ছে আমীর ভাই। পালিয়ে যাচ্ছে ভীরু প্রাণের এক তরুণ প্রেমী, অপমান আর লজ্জাকে সারা জীবনের সঙ্গী করে। অটোয় বসে আমীর ভাইয়ের ঘাড়টা ঝুলে পড়েছে প্রায় বুকের কাছে। শর্মিদের গাছপালায় ঘেরা বাড়িটার অলিগলিতে কখন যে সন্ধ্যা নেমে এসেছিল একটুও টের পায়নি শর্মি। জানালার শিক ধরে ঝাপসা হয়ে যাওয়া শর্মির চোখ দু’টি তখনো খুঁজছে দূরে বড় রাস্তার মোড়ে দ্রুত আড়াল হয়ে যাওয়া অটোটাকে।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *