নিমাইয়ের দেশত্যাগ – ষষ্ঠ ঋতু
এ যেন সেই বন্যার জলে ভেসে-যাওয়া খড়কুটোর মতো। কোথায় ঠেকে, কোথায় পড়ে, হেজে পচে যায় তার কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই।
গাঁ ছেড়ে, ভিটে ছেড়ে সবাই যায়। নিমাইও যায়। থাকবে কার কাছে। জ্ঞান হয়ে শুনেছে মা মরে গেছে তার। বাপের কাছে মায়ের গল্প শুনত নিমাই। লোকে আবার তার বাপকে ভাল বলত না। বাপ নাকি তার মনিষ্যি নয়। ভিটে নেই, মাটি নেই। গোষ্ঠ কামারদের হাপর-ঘরের পাশে খড়ের ছাউনি দিয়ে নিমাইকে নিয়ে তার বাপ থাকত। বেতের ধামা, সাজি, এ সব বুনত, গড়ত। সেই বেচেই দিন চালাত। তাও কি সে পয়সাতে বাপ ব্যাটার চলতে পারে? পারে না। সময়ে অসময়ে নিমাইকে তাই হাপরে কাজ করতে হত, কামারদের ফাই-ফরমায়েস খেটে ছোট্টবেলাটি থেকে পেটের ধান্দায় থাকতে হয়েছে নিমাইকে।
তারপরে সেই বাপই একদিন উধাও হল। দাঙ্গা-হাঙ্গামার দিন কাটাকাটি খুনোখুনি, লুটপাট। কে কোথায় যায়, ঠিক নেই তার কিছু। বেজেরহাটির বাজার যেদিন লুট হয়ে গেল, নিমগাঁয়ের কাক-পক্ষীও সেদিন পালাতে লাগল। বাপ তার পালিয়ে গেল। সবাই পালাচ্ছে। নিমাইকে ডেকেও কেউ জিজ্ঞেস করে না কিছু। যে ছেলেকে বাপই দুটো কথা বলল না, তাকে ডেকে কথা বলবে লোকে!
সবার আড়ালে গিয়ে নিমাই খুব খানিক কাঁদল, আর তার পায়ের কাছে বসে হাঁ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কামার বাড়ির কুকুর ভোলা। ওর-ও কেউ নেই যে!
কেউ আসাম, কেউ কুচবিহার, কেউ কইলকাত্তা।
কামাররা হাপর হাতুড়ি নিয়ে ঘর ছাড়ল। নিমাই আর ভোলা উঠানে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের বিদায় দিল। … কিন্তু নিমাইকে খেতে দেবে কে? নিমগাঁ আর তাদের দেশ নয়, দেশ নাকি কইলকাত্তা। ইস্, কইলকাত্তাই নিজের দেশ! কয় কী!
কামারবাড়ির বুড়ো কর্তা আর বুড়ি গিন্নি ঘর আগলে পড়ে রইল। নিমাই বাঁধল তার ছোট্ট পুঁটলি। জামা একখানা, পাঁচ হাত ধুতি একখানা, একটা লাল-নীল পেনসিল, নিব, কয়েকটা শিশি, ভক্ত-প্রহ্লাদ বই, এমনি সব নানানখানা।
পুঁটলি বেঁধে তার উপর মুখ রেখে নিমাই কেঁদে উঠল। কোথায় যাবে সে! কইলকাত্তা! এ দেশ আর তাদের নয়। পুঁটলি বগলে বুড়ো কামারের কাছে এসে দাঁড়াল।–কর্তা, আমি যাইগা।
কর্তারও তো বড় সাধ নয় অমন করে দুধের শিশু গাঁ ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু কোনও উপায় তো নেই। দুমুঠো ভাত আজ আর ঘরে নেই কর্তার। তা ছাড়া, ওই ছেলেকে যদি ডাকাতরা কেটেই ফেলে, তার জবাবদিহি করবে কে? এ দেশকে যে আর বিশ্বাস করা যায় না। জিজ্ঞেস করল : কই যাইবা গো?
কইলকাত্তা।
কইলকাত্তা? খাইবা কী বাসি সেই শহর বিদ্যাশে?
এত লোক যায়, খায় কী?
হঠাৎ কিছু জবাব দিতে পারল না কর্তা। সত্যি, এত লোক যায়, খায় কী? আর সে দেশ সম্পর্কে বুড়ো কিছু জানেও না। নিজের মহকুমাটি ছেড়ে তো সে তার জীবনে কোথাও বেরোয়নি। বলল : তবে আসো গিয়া।
বলতে বলতে বুড়ো কর্তার চোখে জল এল। মা-মরা হতভাগ্য বাপের ছেলেটা যে তারই ভিটেয় থেকে এতবড়টি হয়েছে। দেশের মাটি যাকে রাখল না, তার কী ক্ষমতা আছে নিমাইকে রাখে।
সবাই ছাড়ে, ভোলা তো ছাড়ে না নিমাইকে। পথ আগলে দাঁড়ায় আর লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে কোলের উপর। শেষটায় ভোলার গলা জড়িয়ে ধরে নিমাই বলল : মিছা কথা ভোলা, কইলকাত্তা আমাগো দেশ না। নিমগাঁও আমাগো দেশ। হাঙ্গামা যাউক, ফিরে আসুম। তোর লেইগ্যা একখানা চামড়ার বেল্ট লইয়া আসুম, হ।
কিন্তু তাতে এ দু বন্ধুর চোখের জল বাধা মানল না।
নীরব গ্রাম। হতাশায়, বেদনায় সব যেন কান্নায় কেমন ঝিম ধরে আছে। বুঝি গ্রামে মানুষ নেই। ভাল মানুষ শরাফত শেখ, পরের মাঠে লাঙল চালিয়ে খায়। নিমাইকে পুঁটলি নিয়ে যেতে দেখে হুতাশে ছুটে আসে মাঠ থেকে পথে। জিজ্ঞেস করে : কই যাও বাপজান, তুমি কই যাও?
হ, এমন মানুষ যদি সবাই হত! এই শরাফত শেখের মতো। বাপের মতো পরমাত্মীয় শেখ, নিমাইকে বড় ভালবাসে। চোখ মুছে নিমাই বলল :কইলকাত্তা।
হ। এতবড় হয়ে ওঠে শেখের চোখ। কিন্তু কিছু বলতে পারল না। সে তো রাখতে পারবে না নিমাইকে।
বড় বিলের ধার দিয়ে কয়েকটি পরিবার লটবহর নিয়ে চলেছে। শিশু, বৃদ্ধ, মেয়ে পুরুষ। গ্রাম-ছাড়া, ভিটে-ছাড়ার দল।
শেখ বলে নিমাইয়ের গাল টিপে : আমার ব্যাটা, তোমার দোস্ত মনুর লগে দেখা করবা না বাপ?
শেখের আদর পেয়ে বুকটার মধ্যে মুচড়ে ওঠে নিমাইয়ের। এই শেখ, বুড়ো কর্তা, মনু, রোশনারা, আন্না— এদের সবাইকে ছেড়ে কোথায় চলেছে সে! কোথায়! সে দেশ কেমন। ভয় হয়, কান্না পায়।
বিলধারের দলটার পড়িমরি করে ছোটা দেখে নিমাই বলে ওঠে : যাইগা শরাফত কাকা!
শেখ নিমাইয়ের চিবুকটি ধরে গুনগুন করে গেয়ে ওঠে :
মা গো কহিতে পরান যায়
মুখে নাহি বাহিরায়,
সোনার নদে আঁধার করে
নিমাইচান্দ চলে যায়।
হ, তুমি আমাগো নিমাই।
হাহাকার করে ওঠে নিমাইয়ের বুকটার মধ্যে। মা, মা গো!
শেখের দিকে পিছন ফিরে তাড়াতাড়ি চলতে আরম্ভ করে সে। চোখের জলে ঝাপসা গ্রামখানি তরতর করে কাঁপতে লাগল তার চোখের সামনে। মা, মা গো! চোখে না-দেখা মায়ের জন্য মন পাগল হয়ে ওঠে নিমাইয়ের। গাঁয়ের ধারে ননী সাহার গোলাবাড়ি শূন্য পড়ে আছে। তারা নেই। এর পুব ভিটের ঘরখানিই ছিল নিমাইদের ভিটে। সেই ঘরেই জন্মেছিল সে। আম কাঁঠালের ছায়াঘেরা বেড়াভাঙা ঘর।
ভাঙা বেড়ায় হাত রেখে নিমাই ডাকল মা, মা!
মায়ের নিশ্বাসের মতো বাতাস ঝরে পড়ে নিমাইয়ের মাথায়। ছাতা-পড়া, মাকড়সার জালে ভরা তলতা বাঁশের বেড়ায় চোখের জল পড়ে। নিমাই বলে : আমি দেশান্তরী অইলাম, দুঃখ কইরো না মা।
তারপর সে এক যুদ্ধ। পথে পথে বাসে, রেলে, স্টিমারে পুলিশের লোক, কাস্টমসের লোক, টিকিটবাবু। সে এক এলাহি কাণ্ড। এর বাক্স ধরে টান দেয়, ওর প্যাঁটরা ধরে। এর হাত ধরে তো ওর ঘাড় ধরে।
দেশের মানুষ যায়, তার সঙ্গে দেশের সম্পদও যায়। যুদ্ধ করে রাজায় রাজায়, উলুখড়ের প্রাণ যায়। গরিব মানুষের হাঁড়িকুড়ি নিয়ে কাড়াকাড়ি, প্রাণ নিয়ে টানাটানি। কী আপদ! আইন বড় দড়। নিমাইয়ের পুঁটলিটাও খুলে ছড়িয়ে কাস্টমসের লোকেরা দেখল।
রাত আর পোহায় না। গাড়ি চলেছে তো চলেইছে। নিমাই কেবলই একে ওকে জিজ্ঞেস করে, কইলকাত্তা আইল?
শুনে শুনে সবার ব্যাজার লাগে। বলে, থামরে বাপু। কইলকাত্তা কি হাতের কাছে?
কিন্তু নিমাই তো আর অতশত জানে না। তার ভয় কলকাতা বুঝি পেরিয়ে যাবে গাড়ি।
এক জায়গায় এসে গাড়ি দাঁড়াতে অনেক লোককে নামতে দেখে নিমাইয়ের তর সইল না। সেও নেমে পড়ল। তখন সবে সূর্য দেখা দিয়েছে পুব আকাশে।
এইটা কইলকাত্তা? সবাইকে জিজ্ঞেস করে সে। যে যার নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। জবাব দেবে কে?
একজন বলল : আরে দূর বোকা। এইটা তো নৈহাটী।
কোনও কালেও এমন নাম শোনেনি সে। নৈহাটী। এখানে কার কাছে কোথায় যাবে সে? প্ল্যাটফমের উপর হাঁড়িকুড়ি, বিছানা-পত্র ছড়িয়ে-বসা লোকগুলো দেখলেই সে চিনতে পারে, এরা তার দেশেরই লোক। কিন্তু ডেকে কেউ কথাটিও বলে না। সেই সবার কাছে যায়, ফন্দিফকির জিজ্ঞেস করে।
কেউ বলে, কাজ খোঁজ। বাড়ির চাকর, দোকানের চাকর। না হয় তো ভিক্ষা।
ভিক্ষা! ক্যান? বড় মুষড়ে পড়ে নিমাই। কই এ দেশ যে খারাপ, তা তো তারে কেউ বলেনি। সে শুধু শুনেছে, এ দেশে এলে বিপদ কাটবে, এখানে এলেই সব বাঁচবে। কিন্তু কেমন করে?
পথে পথে ঘোরে নিমাই। যাকে-তাকে ধরে জিজ্ঞেস করে : চাকর নিবেন কর্তা, আমারে নেন।
পথচারী মানুষ অবাক হয়, বিরক্ত হয়, হাসে। বলে, না রে বাপু, নিজেরাই খেতে পাই না।
হ, কয় কী? নিমাইও অবাক মানে। সম্বল কয়েকটি পয়সা একটি দিনেই শেষ হয়ে গেল।
স্টেশনের সামনে ঝকঝকে হাওয়া-গাড়িতে সুন্দর সুন্দর মানুষ দেখে নিমাই এগিয়ে যায়—চাকর নিবেন বাবু? মা গো, চাকর নেন আমারে! বাসন মাজুম, কাপড় ধুমু ছোট ছওয়াল কোলে রাখুম।
ড্রাইভার গাল দিয়ে ওঠে, নিকালো শুয়ার।
শুয়ার! হতবাক নিমাই। গালি দেয় কেন?
দোকানে দোকানে ঘোরে সে। নিজের কথা বলে, খাটতে পারি, যে কাম কইবেন, স–ব রকম। ফাঁকি দিমু না। দুই মুঠা খাইতে দিয়েন।
সবাই হাত নেড়ে মাথা নেড়ে ফিরিয়ে দেয়।
দক্ষিণের বড় সড়ক ধরে এগিয়ে চলে নিমাই। পথের ধারে বড় বড় কারখানা। লোকে বলে, চটকল।
পুঁটলি বগলে ভয়ে ভয়ে কারখানার গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় নিমাই। মস্তবড় পাকানো গোঁফ তুলে চোখ পাকিয়ে তাকায় দারোয়ান। কোনও রকমে নিমাই জিজ্ঞেস করে ফেলে : দেখেন, আপনে গো এইখানে একটা কাম দিতে পারেন?
কেয়া বোলতা? নিমাই অবাক হয়ে দেখল অমন গোঁফ আর চোখ নিয়েও, মানুষটা হাসতে পারে। দুনিয়ামে কাম নেহি যায়। হাত নেড়ে বলে দিল দারোয়ান, ভাগ যাও।
হ, দুনিয়ায় নাকি কাম নাই? দক্ষিণে এগিয়ে চলে নিমাই। খিদে পায়। খাবে কী? কে খেতে দেবে?
দিন যায়, রাত্রি আসে। পথের ধারে শুয়ে রাত্রি কাটে নিমাইয়ের।
সকালবেলা নিমাই ভাবে, এ দেশে কি ছাই কামারের দোকানও নেই একটা।
আছে। জগদ্দল ছাড়িয়ে, নতুন বাজার পেরিয়ে এক কামারের দোকানের দেখা পেল সে। পাশে বিচলি কাটার মেশিন-ঘর।
মস্তবড় টিকিওয়ালা হিন্দুস্থানী কামারের কাছে এগিয়ে যায় সে :কর্তা একটা কাম দেবেন? হাপর টানতে পারি, ছোটখাটো মাল বানাইতে পারি, ঘরের আর সব কামই করুম।
কামার তার কথা সব বুঝতেই পারল না। জবাব দিল :কুছ নেই মিলেগা।
তবে যে আমার কোনও গতি হয় না কর্তা? বলতে বলতে বুঝি বা কান্না ফোটে নিমাইয়ের গলায়।
খিদেয় পেট জ্বলে। মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে।
কামার হাত দেখিয়ে বলল : আগে দেখো।
নিমাই এগোয়। আগে কোথায় দেখব? সবাই একই কথা বলে, পথ দেখিয়ে দেয়।
পথ, পথ আর পথ। পথের তো শেষ নেই। এদিকে পায়ে কাঁপুনি ধরে, পেটে খিঁচ লাগে। মনে পড়ে রোশনারার মাকে, কামারবাড়ির বড় বউকে। যাদের কাছে গেলে মায়ের দুঃখ ঘুচত তার। বাপের কথা মনে পড়তেই অভিমানে বেদনায় ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে ওঠে নিমাই। ছেলে ফেলে উধাও হল বাপ। বাপ তো! আর তার নিমাই ছেলে লায়েক হয়েও ওঠেনি।
জগৎ বড় কঠিন। নিমাইয়ের দু ফোঁটা চোখের জলে কি তা ভিজবে। রাত থনায়। নিমাই আর পারে না। পথের ধারে দাঁড়িয়ে ধোঁকে। এমনি উপোস নিমগাঁয়ে থাকলেও হত বা। কিন্তু সে তো গাঁয়ের মাটিতে; এমন নিদারুণ কষ্ট হত কি?… নিমগাঁ… নিমগাঁ সে দেশ নাকি আর তাদের নয়। কইলকাত্তা হল দেশ! ইস্! কয় কী।
অন্ধকারে একটা পাঁচিলের গায়ে হেলান দিয়ে নিমাই দাঁড়ায়, পুঁটলিটা চেপে ধরে বুকে। বেচবার মতোও তো কিছু নেই তার। অর এ সংসারে একটা চাকরেরও কারও দরকার নেই।
এই দ্যাখো, এক ছোঁড়া এখানে দাঁড়িয়ে ধুঁকছে। একটা লোক আপন মনেই কথাটা বলে একটা আনি নিমাইয়ের হাতে গুঁজে দিল। নেরে নে। তোদের জ্বালায় তো আর পথ চলা যায় না।
ভিক্ষা! ভিক্ষা কি চেয়েছে নিমাই? তার ক্ষুধাক্লান্ত মাথাটায় যেন আগুন লাগল। আনিটা হাতে চটকে চটকে ছুড়ে ফেলে দিল অন্ধকারে। পাঁচিল ধরে ধরে এগোয় আর দাঁত দাঁত চেপে বকবক করে নিমাই।
ভিক্ষা দেয়! দেশ নাই, তার দেশ? কইলকাত্তা দেশ।
ইস! আমার দেশ কই?