নিঝুম রাতের আতঙ্ক
স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে একগাল হেসে গজপতি আঙুল তুলে বললেন,–ওই যে জঙ্গলমতো জায়গা দেখতে পাচ্ছ, ওখানেই। সূর্য ডুবতে চলেছে, শিগগির পৌঁছতে হবে কিন্তু।
ভবভূতি ট্রেনটা চলে না-যাওয়া অবধি কোনও কথা বললেন না। গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। ঠোঁটের কোনায় সেই অবিশ্বাসের বাঁকা হাসিটা এখনও রেখে দিয়েছেন অবশ্য। ট্রেনটা দূরের বাঁকে গাছপালার আড়ালে মিশে গেলে তখন বললেন, ইয়ে, একটুখানি চা পেলে ভালো হত।
চা!–গজপতি হাসলেন। চারপাশে তাকিয়ে দেখ তো, এখানে চায়ের দোকান দূরের কথা, আমরা বাদে জনমনিয্যি আর দেখতে পাচ্ছো নাকি?
ভবভূতি দেখলেন। তাই বটে। প্ল্যাটফর্ম খাঁ-খাঁ। শুধু এই স্টেশনঘর–তার মানে একটা টিনের গুমটিঘরের মতো, তা ছাড়া আর কোনও ঘরবাড়িও নেই। গাছপালা-ঝোঁপজঙ্গল নিঝুম হয়ে ঘিরে আছে স্টেশনটা। কেমন যেন থমথমে অস্বস্তিকর হাবভাব। নিঝুম রাতের আতঙ্ক
তারপর হঠাৎ চোখে পড়ল ঝোঁপের আড়ালে দুজন লোক হনহন করে চলে যাচ্ছে। অমনি ভবভূতি বলে উঠলেন,–এই তো দুজন লোক।
গজপতি তা দেখে নিয়ে বললেন,–, এই স্টেশনেরই লোক। স্টেশনমাস্টার আর পয়েন্টসম্যান। কিন্তু ওরা পালাচ্ছে।
পালাচ্ছে, মানে? ভবভূতি অবাক!
স্টেশনে থাকতে চায় না। গজপতি জানালেন। রেলের কোয়ার্টার পর্যন্ত এখানে তৈরি করা সম্ভব হয়নি। করেছে খানিকটা দূরে। ওরা এখন পালিয়ে সেই কোয়ার্টারে ঢুকবে। পরের ট্রেন আসার সময় হলে স্টেশনে আসবে। ফের পালাবে।
অবিশ্বাসী ভবভূতি বললেন, তাহলে এই স্টেশনঘরটা তৈরি হল কীভাবে শুনি?
সে অনেক হাঙ্গামা করে হয়েছিল। সায়েব ইঞ্জিনিয়াররা এসে বানিয়েছিল। ওরা খুব ডানপিটে ছিল বলেই পেরেছে। গজপতি পা বাড়িয়ে ফের বললেন, আর ট্রেনটা কেমন ঝটপট একটু দাঁড়িয়েই তক্ষুনি লেজ তুলে কেটে পড়ল, দেখলে না? তুমি ঠাহর করলে দেখতে, ড্রাইভার-ফায়ারম্যান-গার্ডসায়েব–এমন কি যাত্রীরাও এ স্টেশনে এসে চোখ বুজে থাকে। ওই সিগন্যাল পেরুলে তখন চোখ খোলে।
আমরা কিন্তু চোখ বুজে নেই। ভবভূতি বাঁকা হাসিটা আরও একটু লম্বা করে দিলেন।
গজপতি বললেন, আমাদের ক্ষতি হওয়ার কারণ নেই বলেই চোখ খুলে রেখেছি। তুমি নিশ্চিন্তে থেকো, আমাদের গায়ে আঁচড় লাগা দূরে থাক, আমাদের উঁকিঝুঁকি মেরে ওরা দেখতে সাহসও পাবে না। কারণ এত বড় প্রজেক্টের চার্জে আছে আমার ভাগ্নে ভূতনাথ। ভূতনাথকে ওরা কী ভয় যে পায়!
প্রজেক্ট। অর্থাৎ বাংলায় যাকে বলে প্রকল্প। এই প্রকল্পের কথা শুনে ভবভূতি কলকাতায় গজপতির ড্রয়িংরুমে যতটা জোরে হেসেছিলেন, এখানে পৌঁছে ততটা পারলেন না। খুকখুক শব্দ হল মাত্র। গজপতির পিছনে-পিছনে রেললাইন বরাবর এগোতে থাকলেন। সূর্য গাছপালার আড়ালে অস্ত যাচ্ছে। আশ্বিন মাস। ঘন সবুজ চেকনাই দেওয়া সেইসব গাছপালার গায়ে নীলচে কুয়াশা জমতে শুরু করেছে। পাখপাখালি তুমুল হল্লা করছে। ভবভূতি টের পেলেন, কেমন যেন অস্বস্তি তাকে পেয়ে বসছে ক্রমশ। হলেও হতে পারে কিংবা থাকলেও থাকতে পারে গোছের ভাবনা মগজে সুড়সুড় করে বেড়াচ্ছে। বারবার এদিক-ওদিক দেখতে-দেখতে যাচ্ছেন।
.
এই প্রকল্পের কথাটা উঠেছিল সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের কথায়। গতকাল সন্ধ্যায় জোর বৃষ্টি নেমেছিল। রাস্তায় একহাঁটু জল জমে গিয়েছিল। তার সঙ্গে লোডশেডিং। গজপতির ড্রয়িংরুমে মোমবাতির আলোয় বাঘ নিয়ে কথা হচ্ছিল। ভবভূতি যৌবনে। দুর্দান্ত শিকারি ছিলেন। তাই ওঁর সব কথায় বাঘ আসবেই। ওঁর আপশোস, বাঘ মেরে বড় ভুল করেছেন এতকাল। এখন বাঘবংশ দেশ থেকে লোপ পেতে বসেছে। তাই সুন্দরবনে বাঘ প্রকল্প করে সরকার একটা কাজের মতো কাজ করেছেন। বেচারিরা শান্তিতে ওখানে খেয়েপরে বাঁচুক আর বংশবৃদ্ধি করুক।
সেই কথার জের টেনে গজপতি বলেছিলেন–আর ভূতবংশের কথাটা ভাবো ভায়া! আজকাল আর তত ভূত কেউ দেখতে পায়? ভূতেরাও তো লোপ পেতে বসেছে। আমাদের ছেলেবেলায় দেখেছি…
বাধা দিয়ে ভবভূতি বলেছিলেন,–ভূত! তুমি ভূত বিশ্বাস করো?
–আলবাত করি। গজপতি দৃঢ়ভাবে জবাব দিয়েছিলেন। সেই তো বলতে যাচ্ছি! হাত তুলে ভবভূতি বলেছিলেন, উঁহু, শুনব না! সব গুল। ভূত নেই।
নেই! গজপতি ফুঁসে উঠেছিলেন। আলবাত আছে। চলো, এক্ষুনি চলো– আছে না নেই টের পাইয়ে দিচ্ছি।
কোথায় যাব শুনি? –ভবভূতি হাসতে-হাসতে বলেছিলেন। কোনও পোড় বাড়িতে, নয়তো শ্মশানে–এই তো? আমি ওসব জায়গা চষে ফেলেছি একসময়। ভূতের টিকিও দেখিনি।
গজপতি রেগে গিয়েছিলেন,–ঠিক জায়গায় গেলে তো দেখবে। তাছাড়া বললুম তো, আজকাল আর তত ভূত নেই। আগে যেমন পাড়াগাঁয়ে যখন-তখন বাঘ দেখা যেত এখন কি যায়? যায় না। আর তুমিই তো বললে, বাঘবংশ লোপ পাচ্ছে বলে সুন্দরবনে বাঘ প্রকল্প করা হয়েছে।
–হয়েছে। প্রকল্প না বলে বলো, বাঘেদের অভয়ারণ্য।
–হুঁ, ঠিক তাই বলতে যাচ্ছিলুম তোমায়। শুনবে, না খালি গোঁ ধরবে। রামচন্দ্রপুর নামে স্টেশন আছে শুনেছ কখনও? শোননি।
ভবভূতি বাঁকা হেসে বলেছিলেন, না শুনিনি। তা হয়েছে কী?
–রামচন্দ্রপুরে ঠিক তোমার সুন্দরবনের বাঘেদের অভয়ারণ্যের মতো ভূতেদেরও বংশরক্ষার জন্য অভয়ারণ্য করা হয়েছে জানেন? আর তার প্রজেক্ট অফিসার কে জানো?
–জানি না। কারণ এমন প্রজেক্টের কথা কস্মিনকালে শুনিনি।
গজপতি গর্জে বলেছিলেন, তুমি যা জানো না বা শোননি, তা নিয়ে তক্কো করতে এসো না। রামচন্দ্রপুর ভূত প্রকল্পের চার্জে যে অফিসার আছে, তার নাম ভূতনাথ; আমার আপন ভাগ্নে। সে রীতিমতো মেক্সিকোতে ট্রেনিং নিয়ে এসেছে ভূতের ব্যাপরে।
ভবভূতি অবাক হয়ে বলেছিলেন, বলো কী!
–হ্যাঁ। মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূততত্ত্বে ডক্টরেট ডিগ্রি দেয়। আমাদের ভূতো সেই ডিগ্রি পেয়ে এখন ভারতের নামকরা ঘোস্ট-এক্সপার্ট অর্থাৎ ভূত-বিশেষজ্ঞ হয়েছে। গতবছর যখন রামচন্দ্রপুর ঘোস্ট প্রজেক্ট-থুড়ি, ভূতেদের অভয়ারণ্য চালু হল, তখন তার উদ্বোধন করেছিলেন কে জানো তো? ভূত বিষয়ক দফতরের মন্ত্রী মিসেস এস সি হাড়মটমটিয়া।
ভবভূতি আরও অবাক,–এমন সরকারি দপ্তরের নাম তো শুনিনি! আর এস সি হাড়মটমটিয়া…উঁহু, শুনিনি।
গজপতির উল্লাস দেখে কে,–এই তো! কিছু খবর রাখো না। রাখবে কী করে? সারাজীবন তো বনবাদাড়ে বাঘের লেজ ফলো করেই কাটালে। শুনে রাখো, এমন দপ্তর একটা আছে। তবে গোপনীয় দপ্তর। তাই কেউ জানে না। আমার ভাগ্নের খাতিরেই আমি জেনেছি।
হুঁ। তাহলে ওই মন্ত্রীমহোদয়ার পুরো নাম বুঝি মিসেস শাকচুন্নী হাড়মটমটিয়া? ভবভূতি ফের হেসে উঠেছিলেন।
গজপতির আবার রাগ হয়েছিল। বলেছিলেন, ঠিক আছে। কালই আমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ো। রামচন্দ্রপুর ভূতারণ্যে গিয়ে স্বচক্ষে সব দেখবে। এও বুঝবে, স্টেশনের নাম রামচন্দ্রপুর রাখার কারণই বা কী?
–কী কারণ শুনি?
–ওটা ভূতারণ্যের বর্ডার। রাম শব্দে ভূতেরা জব্দ। বুঝলে না? পাছে অভয়ারণ্য বা ভূত প্রকেল্পর দু-একটা পাজি ভূত এলাকা ছাড়িয়ে বাইরে গাঁ-গেরামে গিয়ে হানা দেয়, তাই ওই ব্যবস্থা। তোমার সোঁদরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের দু-একটা বাঘ কি এমন করে না মাঝে-মাঝে?
রেল লাইনের ধারে ধারে কিছুটা এগিয়ে ডানদিকে সরু একফালি রাস্তায় নামলেন গজপতি। সামনে একটা ছোট্ট নদী দেখা যাচ্ছিল। তার ওপর কাঠের পোল আছে। সেই পোলে পৌঁছবার পর বললেন, এবার আমরা ভূতেদের অভয়ারণ্যের এলাকায় ঢুকছি। ওই দেখ, কাঠের ফলকে দেখা আছে : রামচন্দ্রপুর ভূত প্রকল্প। দেখতে পাচ্ছ তো?
ভবভূতি থমকে গেলেন। মুখের বাঁকা হাসিটা মিলিয়ে গেল। কাঠের ফলকটার সামনে দাঁড়িয়ে চশমা খুলে চোখ দুটো মুছে নিলেন। তারপর চশমার কাঁচ ভালোভাবে মুছে হেঁট হলেন। কিন্তু না। বড় বড় হরফে সত্যি লেখা আছে? রামচন্দ্রপুর ভূত প্রকল্প। এবং তলায় ব্রাকেটের মধ্যে : তেরটি প্রজাতির ভূতের অভয়ারণ্য। তার পাশে আরেকটা বড় ফলকে নোটিশ?
সাবধান, কেহ উহাদের উত্ত্যক্ত করিবেন না। ঘাড় মটকাইয়া দিলে সরকার দায়ী হইবেন না। তবে কেহ-কেহ আদর করিয়া উহাদের কিছু খাওয়াইতে চাহেন, তাহাতে আপত্তি নাই। কিন্তু নিচের এই তালিকার খাদ্যগুলি ছাড়া আর কোনও প্রকার খাদ্য খাওয়াইবেন না। জরিমানা করা হইবে।
ভবভূতি একটু ঝুঁকে খাদ্য তালিকায় ঝটপট চোখ বুলিয়ে নিলেন। (১) দুধ (২) রসগোল্লা। (৩) হাড়গোড় (৪) শুকনো গোবর (৫) খাঁটি সরিষার তৈল (৬) পাকা কলা (৭) টিকটিকির ডিম ও লেজ (৮) নানারকম মাছ (সিঙ্গি বাদে) (৯) আরশোলার ঠ্যাং…।
গজপতি ওঁর পিঠে হাত রেখে চাপাস্বরে বললেন,–দেরি হয়ে যাচ্ছে। সন্ধে হয়ে গেল। আমার ভাগ্নের অফিসে গিয়ে ওসব জেনে নেবে। এসো।
ভবভূতি গুম হয়ে গেছেন। মুখে রা-বাক্যি নেই। তার ওপর গজপতির একরকম চাপা গলায় কথা বলা শুনে তার গা ছমছম করছে এবার।
দুধারে ঘন ঝোঁপজঙ্গল, মাঝখানে একফালি পিচের পথ। কিছুটা চলার পর বড়-বড় গাছের জঙ্গল দেখা গেল। তার মধ্যে একটা আলো দেখা যাচ্ছিল। গজপতি তেমনি চাপাগলায় বললেন,–ওই যে শ্রীমানের অফিস। মানে আমার ভাগ্নের।
ভবভূতি এখন মোটামুটি অনেকটা বিশ্বাস করে ফেলেছেন। খুঁতখুতে গলায় বললেন,–ওদের জন্যে কিছু খাবার আনা উচিত ছিল।
গজপতি ঠোঁটে আঙুল রেখে বললেন, চুপ! খাবারের নাম করো না। এক্ষুনি পিছু নেবে। সেবার আমি কী বিপদেই না পড়েছিলুম এসে।
–পিছু নিয়েছিল নাকি?
–হুঁউ। ওই অফিস অব্দি পিছনে খালি বলে,-কী এনেছিস, দিঁয়ে যাঁ।
–বলো কী! আচ্ছা, ওরা নাকিস্বরে কথা বলে কেন বলো তো?
–নাক নেই যে! কংকালের মুণ্ডু দেখনি? নাক আছে?
–ঠিক বলেছ। নাকের জায়গায় গর্ত আছে বটে!
এই সময় আলো অনেক কমেছে। ভবভূতি অস্বস্তিতে হাঁটছেন। আর অনবরত এদিক-ওদিক চাইছেন। হঠাৎ তার মনে হল সামনে বাঁদিকে একটা গাছের প্রকাণ্ড মরা ও শুকনো ডালে কালোরঙের এবং দেখতে কতকটা হনুমানের মতো, কী যেন বসে আছে। তারপর সেই অদ্ভুত প্রাণীটা বারকতক আপন খেয়ালে উল্লুকের মতোই শুকনো ডালটা ধরে চরকিঘোরা হয়ে ঘুরল। ভবভূতি শিউরে উঠে বললেন,–ওটা কী?
গজপতি দেখেই চাপাস্বরে বললেন,–বলো রাম রাম রাম রাম—
ভবভূতি আওড়াতে শুরু করলেন, রাম রাম রাম রাম রাম–
সাবধানে পা টিপেটিপে জায়গাটা পেরিয়ে গিয়ে গজপতি জানালেন,–এই প্রজাতির নাম গেছে। এরা গাছে থাকে। এদের বড় বদ অভ্যেস। টুপটাপ করে ঢিল ছোড়ে। মাথা ন্যাড়া দেখলে তো আর রক্ষে নেই।
রাস্তাটা ডাইনে ঘুরছে এবার। সামনে গেট দেখা যাচ্ছে। তার ওপাশে বাংলো মতো একটা বাড়ি। গেটের কাছাকাছি যেতেই ভবভূতি দেখলেন, আচমকা কী একটা ঢ্যাঙা লিকলিকে মূর্তি সটান ঝোঁপ ঠেলে রাস্তায় এল এবং তাদের সামনে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে গেল। ভবভূতি ফিসফিস করে উঠলেন,–গজু! ওটা কী?
গজপতি দাঁড়িয়ে গেছেন। তেমনি ফিসফিসিয়ে বললেন,–এই সেরেছে। কিছু খাবার আনা উচিত ছিল। তাই তো! অন্তত একটুখানি শুকনো গোবর…।
মুখের কথা মুখেই থাকল গজপতির, সেই মূর্তিই হি হি হি হি করে বেজায় হেসে উঠল। ভবভূতি বিড়বিড় করতে থাকলে, ট্রাম ট্রাম ট্রাম ট্রাম…
তারপর টের পেলেন রামের বদলে ট্রাম বলছেন। তক্ষুনি শুধরে নিয়ে রামনাম শুরু করলেন। আর গজপতি বিকট চেঁচিয়ে আর্তনাদের সুরে বলে উঠলেন–ও ভূতো ও-ও, ভূতো রে-এ-এ! তোর ঘটোৎকচকে সামলে নে! বেরিয়ে পড়েছে-এ-এ!
বাংলো বাড়ি থেকে আলো হাতে বেরিয়ে কে সাড়া দিল, কোন বেটারে? নাম ধরে ডাকছিস! স্পর্ধা তো কম নয়।
গজপতি বললেন, বাবা ভূতো, আমি–আমি তোর মামা গজপতি।
আলো হাতে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এল একটা লোক। তাকে দেখে রাস্তা আটকে দাঁড়ানো সেই মূর্তিটা একলাফে ঝোঁপঝাড় ডিঙিয়ে পালিয়ে গেল। কিছুক্ষণ আচমকা যেন ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল। গজপতি ফিসফিস করে জানালেন, পাহাড়ি দেশের ভূত, বুঝলে তো? তারপর ভবভূতির হাত ধরে পা বাড়িয়ে বললেন,-বাবা ভূতত, তোকে খবর দিয়ে আসতে পারিনি। এদিকে ট্রেনটাও লেট করেছিল।
গেট খুলে ডঃ ভূতনাথ বললেন, মামা নাকি? আসুন, আসুন! কী সৌভাগ্য। উনি কে?
–আমার বন্ধু ভবভূতি পতিতুন্ডু। তোকে এনার কথা বলেছি, মনে নেই হয়তো। ইনি একসময় নামকরা শিকারি ছিলেন। আর ভবভূতি এ হচ্ছে সেই ডঃ ভূতনাথ পাত্র।
ডঃ ভূতনাথ নমস্কার করে বললেন, আসুন, আসুন! কী সৌভাগ্য!…
বাংলোঘরের মধ্যে একটা হাজাগ জ্বলছে। লণ্ঠনটার দম কমিয়ে বারান্দায় রেখে ডঃ ভূতনাথ ওঁদের নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। কোনার টেবিলে একটা কালো বেঁটে মোটাসোটা হাঁড়িমুখো লোক খাতায় কী সব লেখালেখি করছিল। একবার মুখ তুলে দেখল। ভবভূতির গা শিরশির করে উঠল লোকটাকে দেখে। মানুষ বটে তো? কেমন যেন ভুতুড়ে চেহারা।
পাশের ঘরের দরজা খুলে ডঃ ভূতনাথ বললেন–এক মিনিট। মোমবাতিটা জ্বেলে নিই।
ভবভূতি বললেন,–লোডশেডিং বুঝি?
না। এখানে ইলেকট্রিসিটির বালাই নেই। কেন নেই, পরে বলবখন। বলে ভূতনাথ মোমবাতি জ্বেলে দিলেন। ডাকলেন, আসুন মামা! আপনারা ভেতরে এসে বসুন। আমি চায়ের জোগাড় করি।
ঘরটা বেশ বড়। ভবভূতি ও গজপতি আরাম করে বসলেন। ডঃ ভূতনাথ বাইরে চলে গেলেন। বাইরে তার গলা শোনা গেল। কাকে ডাকাডাকি করছেন।
গজপতি বললেন, ইলেকট্রিসিটি কেন নেই জানো? ভূতদের ওই আলো সয় না। লণ্ঠন, হ্যাঁজাক অব্দি বড়জোর সয়। ওই ইলেকট্রিসিটির জ্বালায় তো ভূতবংশ লোপ পেতে বসেছে।
ভবভূতি দমে গেছেন এখন। সায় দিয়ে মাথাটা নাড়লেন শুধু। তারপর বারবার জানলার দিকে তাকাতে থাকলেন। বলা যায় না, কখন কী বিতিকিচ্ছিরি ভুতুড়ে চেহারা জানলায় উঁকি দিয়ে ওইরকম একখানা পিলে-চমকানো হাসি হাসবে হয়তো। মনে হচ্চে, রাইফেলটা আনলে ভালো হতো। কিন্তু রাইফেল কি এরা ছুঁড়তে দিত? তার চেয়ে বড় কথা রাইফেলের গুলি ভূতের গায়ে লাগত কি না তাই বা কে জানে। কখনও তো পরীক্ষার সুযোগ পাননি।…
কিছুক্ষণ পরে চা খেতে-খেতে ভবভূতি এই অভয়ারণ্যের ভূতবৃত্তান্ত বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন।
গজপতির ভাগ্নে ডঃ ভূতনাথ পাত্র অমায়িক মানুষ। রোগা সিঁড়িঙে চেহারা। গায়ের রং কুচকুচে কালো। চুলগুলো ছোট এবং সজারুর কাটার মতো খাড়া। গোঁফটাও তাই। এই শরতের ভ্যাপসা গরমেও স্যুট-টাই পরে আছেন। গজপতির চোখ নাচছে অনবরত। যেন বলতে চাইছেন, দেখছ তো–আমি কেমন ভাগ্নের মামা? ভাগ্নে পাকা সায়েব।
ডাঃ ভূতনাথ বলেছিলেন–আপনি তো শিকারি মিঃ পতিতুণ্ডু। আপনি ব্যাপারটা বুঝবেন ভালো। আপনার যেমন বন্যপ্রাণী বিশেষ করে বাঘের ব্যাপারে তীব্র কৌতূহল ছিল বললেন–আমারও ছেলেবেলা থেকে ভূতের ব্যাপারে ভীষণ আগ্রহ ছিল। যাই হোক, হঠাৎ একদিন কাগজে দেখলুম মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূততত্ত্বে গবেষণার জন্যে সেখানকার সরকার বৃত্তি দিচ্ছেন। অমনি কপাল ঠুকে দরখাস্ত করে দিলুম। ইন্টারভিউয়ে ডাক পড়ল। পাস করে গেলুম। তারপর তো দেখতেই পাচ্ছেন। শুনেও থাকবেন। সাগ্রহে ভবভূতি বললেন,–শুনেছি। কিন্তু এই প্রকেল্প কীভাবে ভূত এনে জড়ো করেছ, সেই কথা বলো তো বাবা, শুনি।
ডঃ ভূতনাথ একটু হেসে বললেন,–সে অনেক হাঙ্গামা। কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে হয়েছিল–কেউ কোথাও ভূতের খোঁজ পেলে জানান, পুরস্কৃত করা হবে। বিস্তর চিঠি এসেও ছিল। কিন্তু বেশিরভাগ জায়গায় গিয়ে দেখি, মিথ্যে ভোগাচ্ছে। তবে কিছু জায়গায়–যেমন ধরুন, কলকাতার পুরোনো কয়েকটা বাড়ির ছাদ, চিলেকোঠা, সিঁড়ি হাতড়ে তিনরকম প্রজাতির ভূত পেয়েছিলুম। এরা সবাই কিন্তু মানুষ ভূত। কেউ আত্মহত্যা করে ভূত হয়েছে। কেউ দুর্ঘটনায় মারা গেছে। কেউ খুন হয়ে মরেছে।
গজপতি বললেন,–ভালোভাবে না বোঝালে ভবভূতি বুঝতে পারবে না।
–তাহলে শুনুন। ভূতজাতি মূলত তিনটি উপজাতিতে বিভক্ত। মানুষভূত অর্থাৎ যাকে বলা হয় প্রেত। আর প্রকৃত ভূত–যারা মানুষ বা কোনও জন্তুর অশরীরী আত্মা নয়। স্রেফ ভূত। তৃতীয় উপজাতি হচ্ছে প্রাণীজ ভূত অর্থাৎ মানুষ বাদে অন্যান্য প্রাণী মরে যে ভূতের জন্ম। যেমন ধরুন, গরু মরে যে ভূত হয়েছে, তার নাম গোদানো।
ভবভূতি আরও কৌতূহলী হয়ে বললেন, সবরকম ভূতই তো এখানে রয়েছে?
ভূতনাথ বললেন, উ। তবে সবসময় দেখা পাওয়া মুশকিল। আপনি তো সুন্দরবন অভয়ারণ্যে গেছেন। কবার বাঘ দেখতে পেয়েছেন, বলুন?
ভবভূতি সায় দিয়ে বললেন, আমি শিকারি। ও কি নতুন কথা আমার কাছে?
শুনুন গ্রামাঞ্চলে কীভাবে ভূত খুঁজে এনেছি। গ্রামে খবরের কাগজ কজন পড়ে? তাই উঁাড়া পিটিয়ে জানিয়ে দেওয়াও হয়েছিল। তার ফলে অসংখ্য জায়গা থেকে নানারকম ভূতের খোঁজ পাওয়া গেল। যেমন ধরুন, বীরভূমের একটা দিঘির এক কোনায় শাকচুন্নীর খোঁজ পেলুম। তক্ষুনি বেরিয়ে পড়লুম।
–কিন্তু ওদের ধরে আনলে কীভাবে?
ডঃ ভূতনাথ একটু হেসে বললেন,–খুবই সোজা, খুবই সোজা। শুধু জানতে হয়, কোন প্রজাতির ভূতের কী খাদ্য। ব্যস! বীরভূমের সেই শাকচুন্নীর আড্ডায় একরাত্রি গিয়ে বসে রইলাম। ওর প্রধান খাদ্য মাছ। মাছ দেখে তক্ষুনি ওর নোলায় জল ঝরতে লাগল। ঘোমটার ফাঁকে বলল,–ঐকটা মাছ পেঁ না ভাই। আমি অমনি উঠে চলতে শুরু করলুম। সারাপথ ও পেছনে চাইতে-চাইতে আসে, আর আমি বলি–আর একটু গিয়ে দেব, চলে আয়! ব্যস! এই করে এখানে নিয়ে এলুম। এখানে পুকুর বানিয়ে অঢেল মাছ ছেড়েছি। শাকচুন্নীরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যা খাওয়ার খাচ্ছে। বাকিটা আমরা কলকাতায় চালান দিচ্ছি।
এই শুনে গজপতি মন্তব্য করলেন,–সেইসব মাছই তো কলকাতার বাজারে বিক্রি হচ্ছে। স্বাদেই বোঝা যায়। শাকচুন্নীরা এঁকে ফেলে দেয়, তাই ওরকম। বুঝলে তো?
ভবভূতি বললেন,–আচ্ছা বাবা ভূতনাথ! দুধ রসগোল্লা, পাকা কলা এসব সুখাদ্য কোন ভূতে খায়?
ভূত নয় ভূতিনী বলুন। এরা প্রেত উপজাতির অন্তর্গত। অর্থাৎ কোনও পেটুক মেয়ে মরে ভূত হয়েছে।
যেই কথাটা বলা, অমনি জানালার বাইরে থেকে খ্যানখ্যানে গলায় কে বলে উঠল, কী, কী কী বঁললি? শুধু মেয়েরাই সব খায়?
ভবভূতি আঁতকে উঠে দেখলেন, নির্ঘাৎ ভূতিনীই বটে, চুলের যা ছিরি– তার পরনে শাড়ি, কতরকম গয়নাও পরা, জানালায় দাঁড়িয়ে চোখ কটকটিয়ে তাকিয়ে আছে।
ডঃ ভূতনাথ ধমক দিয়ে বললেন,–পেঁচোর মা! এখন চলে যাও তো এখান থেকে! আমরা কথা বলছি, দেখছ না? কিছু বলার থাকলে পরে এসো। না হয়, দরখাস্ত কোরো।
ভূতিনী জিভ বের করে, কেন কে জানে ভবভূতির দিকেই ভেংচি কেটে সরে গেল। গজপতি খিকখিক করে হেসে বললেন,–পেঁচোর মা সেবার আমাকে বাগবাজারের রসগোল্লা আনতে বলেছিল। ভুলে গেছে নিজেই।
পেঁচোর মা! মানে? ভবভূতি জিগ্যেস করলেন। জবাবটা দিলেন ডঃ ভূতনাথ। ওর ছেলে পেঁচোও যে ভূত। তার মানে, প্রেত। ট্রেনে চাপা পড়ে মারা গেছে।
ভবভূতি বললেন-আচ্ছা বাবা ভূতনাথ, এত যে ভূত রেখেছ অভয়ারণ্যে, তুমি কিংবা তোমার কর্মচারীরা কেউ কখনও বিপদে পড়োনি তো?
ডঃ ভূতনাথ বললেন না। বুঝতে পারছেন না? বেছে বেছে কর্মচারী রাখা হয়েছে। রীতিমতো ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। ভূত নিয়ে কাজ করা তো সহজ নয়!
এই সময় ভবভূতির মনে হল তার পাঞ্জাবির পকেটে কী যেন ঢুকেছে। ঘুরেই আঁতকে উঠলেন। চেয়ারের পেছনে ঘাপটি মেরে বসে একটা বছর নয়-দশ বয়সের ছেলে–কিন্তু সত্যি কি ছেলে?
তার পকেটে একটা কালো কুচকুচে লিকলিকে হাত ঢুকিয়ে হাতড়াচ্ছে। ভবভূতি কঁপতে কাঁপতে বললেন,-কে, কে?
ডঃ ভূতনাথ ধমকে দিলেন,–অ্যাই পেঁচো! কী হচ্ছে?
শ্ৰীমান পেঁচো বলল, চকোলেট খুঁজছি ভুতুমামা!
হাত বের কর বলছি! বের করে নে হাত! –ডঃ ভূতনাথ উঠে দাঁড়ালেন। ছিঃ! ওই নোংরা হাত তুই কোন আক্কেলে পকেটে ঢোকালি? মুখে চাইলেই পারতিস!
পেঁচো হি-হি করে হেসে হাত বের করে নিল। তারপর চেয়ারের পেছন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ভবভূতির গলায় দুহাত আঁকড়ে আব্দার-গলায় বলল,–ওঁকটা চকোলেট দাঁও নাঁ দাদু। সেই সঙ্গে বেজায়রকম কাতুকুতুও দিতে থাকল।
কী প্রচণ্ড ঠান্ডা হাত! ভবভূতির দম আটকে যাচ্ছে। ভয়ে কাঁপতে-কাঁপতে গোঁ গোঁ করতে করতে শেষপর্যন্ত ভূতের মতোই হি হি হি হি হি হিঁক করে হেসে উঠলেন।
ভবভূতি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর উঠে বসলেন। দেখলেন নিজের ঘরে শুয়ে আছেন। ঘরে সকালের রোদ ঢুকেছে। তাঁর নাতি রুনু বলল,–ও দাদু, এখনও ঘুমোচ্ছ তুমি? আমি কখন উঠেছি।
ভবভূতি আগে ভালোভাবে দেখে নিলেন রুনু, না পেঁচো। তারপর শুধু বললেন,–হুঁ।
–ও দাদু, একটা চকোলেট দাও না।
ভবভূতি চমকে উঠলেন,-এও যে চকোলেট চায়।
কিন্তু না, মনের ভুল। স্বপ্নই দেখছিলেন বটে। কাল সন্ধ্যায় গজপতির সঙ্গে ভূত নিয়ে বেজায় তর্ক হয়েছিল, মনে পড়ছে।