Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নিকারাগুয়ার কবিতা || Sankar Brahma

নিকারাগুয়ার কবিতা || Sankar Brahma

নিকারাগুয়াকে বলা হয় ‘কবিদের দেশ’। নিকারাগুয়ার কবিতা রাজনীতি আর নিসর্গ’-র মিশ্রিত অভিঘাতের কারণে তুমুল পরীক্ষা নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে লেখা হয়েছে।
উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ থেকেই আমেরিকার হস্তক্ষেপে বারবার আলোড়িত হয়েছে নিকারাগুয়া। নিকারাগুয়ার জলপথের অধিকার হরণ করতেই আমেরিকা প্রাথমিকভাবে এই আক্রমণগুলো করত। পরে ‘পানামা ক্যানেল’-এর কর্তৃত্ব নিজেদের কব্জায় রাখার জন্য তাদের নৌ-সেনারা ১৯১২ থেকে ১৯৩৩ পর্যন্ত নিকারাগুয়াকে দখলে রাখে।
১৯২৭ সালে ‘অগুস্তো সিজার স্যান্ডিনো’ এই দখলদারির বিরুদ্ধে গেরিলা সংগঠন গড়ে তুলে প্রতিবাদী আক্রমণ শুরু করে দেয়।
নিকারাগুয়ার কবিতায় প্রবাদপ্রতিম কবি ‘রুবেন দারিও’(১৮৬৭-১৯১৬) এই দখলদারীকে নৈর্সগিক অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে দেখছিলেন অনেক আগে থেকেই। মাত্র বারো বছর বয়সে তিনি তাঁর নিজের এলাকায় কবি হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। ষোলো বছর হতে না হতেই সারা দেশে তাঁর কবিখ্যাতি ছড়িয়ে যায়। তাঁর কবিতায় স্প্যানিশের সাঙ্গীতিক মূর্ছনার প্রয়োগ ছিল। আর ছিল ভাষাগত অস্তিত্বের সঙ্কটের সঙ্গে রাজনৈতিক সঙ্কটের মিথষ্ক্রিয়া।

‘রুবেন দারিও’-কে বলা হয় নিকারাগুয়ার আধুনিক কবিতার জনক।
নিকারাগুয়া লাতিন আমেরিকার অন্য দেশগুলোর মতই নানা রকমের জটিল সামাজিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। ১২০০০ খৃঃপূঃ’-র সময়ে ‘পেলিও-আমেরিকান’রা নিকারাগুয়ায় বসবাস করতে শুরু করে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে ‘মেসো আমেরিকান’ সংস্কৃতিই (আজটেক ও মায়া সভ্যতা) নিকারাগুয়ার মূলধারা হয়ে ওঠে। ভাষাগতভাবে দুটি ‘ডায়লেক্ট’ ওই সময় প্রধান ছিল।
১৮৮৫ সালে নিকারাগুয়ার রুবেন দারিও, কিউবার হোসে মার্তি প্রমুখ কবির নেতৃত্বে ফরাসি শিল্প-সাহিত্যপ্রভাবিত ‘মদের্নিসমো’ নামের এক আধুনিক কাব্য-ধারার গোড়াপত্তন ঘটে। আবার এ-ধারার বিপরীতে একটি শক্তিশালী সংরক্ষণবাদী ধারারও আবির্ভাব ঘটে, যারা স্বদেশ, দেশের মানুষ ও ঐতিহ্যকে কবিতার বিষয় করে তুলেছিলেন। ব্যাপকার্থে কাব্য-সাহিত্যের এই আন্তর্জাতিকতাবাদী ও জাতীয়তাবাদী ধারার বিপরীতমুখী অবস্থানের মধ্যে, বাস্তবতায় আবার জন্ম নিল এক প্রগাঢ় নিরীক্ষাভিত্তিক ‘avant grade’ বা ‘অগ্রগামী সাহিত্য’, যা পূর্বোক্ত দু’ধারার সংশ্লেষণও বটে।
‘মদের্নিসমো’-পরবর্তী বিশ শতকের পাঁচ বিখ্যাত কবি হলেন গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল, হোর্হে লুইস বোর্হেস, কার্লোস দ্রামন্দ দে আন্দ্রাদে, পাবলো নেরুদা এবং অক্টাভিও পাস। তাঁদের মধ্যে মিস্ত্রাল, নেরুদা ও অক্টাভিও পাস নোবেল পুরুস্কার পেয়েছেন। তাঁদের পাশাপাশি আরও অনেকের কবিতা আজ বিশ্ব-কবিতার অংশ।
‘ম্যানগুয়ে’ আর ‘নৌহাট’। ১৫০২ সালে কলম্বাসের নেতৃত্বে প্রথম স্পেনিয় বাহিনী নিকারাগুয়ায় অভিযান চালায়। তবে বছর কুড়ি পরে গঞ্জালেস দ্যাভিলার নেতৃত্বে সফল ঔপনিবেশিক অভিযান শুরু হয়।
১৫২৪ সালে ফ্রান্সিস্কো হারান্‌ডেজ দ্য করডোবা প্রথম স্প্যানিশ সেটেলমেন্ট-এর প্রতিষ্ঠা করে নাম দেন ‘গ্রানাডা’। এরপরের প্রাউ তিনশো বছরের ইতিহাস হল লুঠ, শোষণ, অত্যাচার, প্রতিরোধ আর ভাষাগত এবং জাতিগত সংকরায়নের ইতিহাস। স্প্যানিশ এবং স্থানীয় অ্যাথনিক সৃষ্টি হয়েছে ‘মেসিৎজো’ জাতিসত্ত্বার, যারা এখনকার নিকারাগুয়ার প্রধান ভাষিক এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় বহন করে চলেছে।
নিকারাগুয়ান সাহিত্য এই সামাজিক রূপান্তরের ভেতরেই বিবর্তিত হয়েছে। ‘উত্তর কলোম্বিয়ান’ যুগের প্রথম লিখিত সাহিত্য হল ‘এল গুয়েগুয়েনেজ’। তার আগে ‘মৌখিক’ কথা, গল্প আর পদ্যই প্রচলিত ছিল। ১৮২১ সালে নিকারাগুয়া স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ‘রুবেন দারিও’র প্রস্তাবনায় ‘মর্ডানিজম’ ধারার লেখালিখি শুরু হয়। সঙ্গে ছিলেন, ‘সালমন ডি লা সিলভা’, ‘কারলোস মার্টিনেজ রিভাস’ প্রমুখ কবিরা। ‘মর্ডানিজোমো’ ছিল মূলতঃ ‘রোমান্টিসিজম’, ‘পারনাস্‌সিয়ানিজম’ এবং ‘সিম্বলিজম’ থেকে অনুপ্রাণিত। রুবেন দারিওর কবিতা এই তিনধারাকে মিলিয়েই লেখা হয়েছে। আধুনিকতার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র আর সীমায়ত ‘এলিটিসিজম’ রুবেন দারিওর কবিতাকে অনন্য করে তুলেছিল। এবার ‘রুবেন দারিও’র কিছু কবিতা –

অমোঘ নিয়তি

বৃক্ষেরা সুখী কারণ তারা নিশ্চেতন বললেই চলে
কঠিন শিলা সংবেদনহীন বলে আরও বেশি সুখী
বেঁচে থাকার মতো এত বিপুল যন্ত্রণা কিছুতে নেই
সজ্ঞান জীবনের মতো কোনও বোঝা এত ভারী নয়।

কী যে হবো জানা নেই, জ্ঞান নেই, এটা সেটা ত্রুটি
যা আছি তাতেই ভয়, যা হবে আতংক তার…
কালকেই পটল তোলার সুনিশ্চিত বিভীষিকা,
আজীবন কষ্ট পাওয়া, অন্ধকার পার হওয়া
পার হওয়া যা জানি না, যা সন্দেহও করি না
এবং যে মাংস শীতল আঙুরগুচ্ছের সাথে আমাদের টানে,
যে কবর শেষকৃত্যের শুচিজলের অপেক্ষায় থাকে
এবং যে আমরা জানি না কোথায় যাব
এবং জানি না কোথা থেকে আমরা এসেছি!…

স্পেনের ব্যাগপাইপ

ব্যাগপাইপ ওই স্পেনের, গান শোনাতেই পারে
মধুরতম গান আমাদের বাসন্তিকা গান
খুশির আবহাওয়াতে শুরু, যন্ত্রণাতে শেষ
তোমার গানে তোমারই সব আমরা কোথাও নেই

বললে, এটা বর্ষা, গাও বৃষ্টি একে একে
আমি তখন প্রবল খরায় লিখছি দাহ্যতাকে
সোলোমনের কথায় আছে, পড়োনি ব্যাগপাইপ
যে ঋতুরও বহু প্রকার আছে, আলাদা সবিশেষ

গাছের ঋতু, বপন ঋতু, ঋতু কর্ষণের
রোঁয়ার ঋতু, ফসল-ঋতু, হাসি ও কান্নার
ভিন্ন ঋতুর গানে গানে আশা নিরাশার
মাঝেই আসে প্রেমের ঋতু, ঋতু সঙ্গমের
জন্ম আসে, প্রতি ঋতু্র প্রতিটি জন্মদিনে…

হেমন্তে

আমি জানি,অনেকেই বলে থাকে, সেই মধুরতম গান
সে গায় না কেন? তার প্রশাখাশিহরে বুনো মর্মর আর
শোনা যায়না কেন? তারা কিন্তু একটি ঘন্টার শ্রম বা
এক মিনিটের কাজে হয়ে ওঠা ওই গানের বিস্ময়
না দেখেই এসব বলছে

আমার বয়স অনেক।যখন ছোট ছিলাম, বাতাস ছুঁলেই
বেজে উঠতাম আমি, তারুন্যে আনন্দধারা বইতো, ছুঁলেই
গাছের শব্দেও বয়েস ছাপ ফেলে যায়, সে চায় গাইতে, আর তার গানে
থেকে থেকে ঝড় তোলে ‘হারিকেনে—এর ঘূর্ণী!

রুজভেল্টের প্রতি

বাইবেলের উচ্চারণ আর হুইটম্যানের কবিতা নিয়ে
আমরা তোমার কাছে পৌঁছব, শিকারী!
পুরনো আর নতুন,সহজ এবং জটিল কিছুটা ওয়াশিংটনের অংশ নিয়ে
কিছুটা নিমরডের, আমরা পৌঁছব!
তুমি, তুমিই আমেরিকা
ভবিষ্যতের আক্রমণকারী আর সেই গ্রাম্য আমেরিকান যার রক্ত ‘ইণ্ডিয়ান’-এর
যে যীশুবাবার পুজো করে, তারাই আমরা
আমরা কথা বলি
স্প্যানিশে
তুমি গর্বিত প্রতীক, আমেরিকার! তুমি সংস্কৃতি বোঝো, বুদ্ধিমান
টলস্টয়ের বিরোধীতা করো, চালাক খুব, তুমি ঘোড়া বা বাঘ
কাউকে রেয়াত করোনা, তুমি প্রতীক হে!
হে যুবরাজ আলজেন্দ্রো নেবুচান্দনেজ্জার (তুমি শক্তি আর স্ফূর্তির অধ্যাপক, পাগল উবাচ), তুমি জীবনকে ভাবো আগুন
প্রগতিকে বিস্ফোরণ
আর বুলেট রেখে বলো, সভ্যতা রাখলাম
না
আমেরিকা বড়, আমেরিকার জোরও বড়
একটু কাঁপলেই ভূমিকম্প হয়
না, আন্দেজের শিরদাঁড়ায় তখন গর্জন শুরু হয় সিংহে
সেই গর্জন শোনো, হে প্রতীক, ভুলে যেওনা হিউগো গ্রান্টকে বলেছিলেন, তুমি ধনী, অগণিত তারার সাম্রজ্য তোমার(সূর্য আর্জেন্টিনায় ওঠে আর তারা চিলিতে), তুমি ধনী, মনে করো হারকিউলিস আর বৈদ্যুতিক আলোর সংযোগ, যে আলোয় লিবার্টি মূর্তি হল
হাতে জ্বলল ‘নিউ-ইয়র্ক’-এর মশাল
সবই আমাদের (অংশ)।
১৯১৬ সালে ‘রুবেন দারিও’ মারা যান। ‘নিকারাগুয়া’র কবিতায় আরেক পরিবর্তন আসে এর পরেই। ১৯২৭ সাল নাগাত ‘ভ্যানগার্ডিয়া’ নামের একটি গ্রুপ বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেয় নিকারাগুয়ার কাব্যিক পরিমণ্ডলে। এর সাম্নের সারিতে ছিলেন পরবর্তীকালের পৃথিবীবিখ্যাত কবি ‘পাবলো আন্তোনিও কুয়াদ্রা’(১৯১২-২০০২)।কিছু তরুণ গ্রানাডাবাসী আমেরিকা থেকে ‘আভা গার্দ’ আন্দোলনের রূপকথা নিয়ে এল নিকারাগুয়ায়। পরে একটি নিবন্ধে এদের এভাবে বর্ণনা করা হয়েছিলঃ

“A couple of the young Granadino poets went abroad and came home bearing news of the latest in literature and art from France (Cocteau, Apollinaire, Claudel) and the United States (Whitman, Amy Lowell and “imagism,” Pound). And by 1930 little Granada, in its sophistication, had blossomed into a center of the avant-garde. The then boys in the bell tower proclaimed themselves “The Nicaraguan AntiAcademy.” They drew up a manifesto, which was written by Pablo Antonio, calling for a review, banquets, and a theater. They were mischievous. They announced an intention to conquer public attention “by means of artistic coups d’etat, intellectual scandal, aggressive criticism, literary battle, impudent exhibition of modern art, accusation against sterility, anemia, malaria, and other infirmities of academic literature.” They rented a cafe for their proposed new Cafe of the Arts and drew up a menu starting with “Cocktail Cocteau,” but the cafe owner, having noticed their decorations, threw them out. “Cubism,” Cuadra recalled many years later, “had lost its first battle in Nicaragua.” They took over a page of Granada’s Sunday newspaper, El Correo, and made it their own, the “Vanguard Corner.”
[ কয়েকজন তরুণ গ্রানাডিনো কবি বিদেশে গিয়েছিলেন এবং ফ্রান্স (ককটিউ, অ্যাপোলিনায়ার, ক্লাউডেল) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (হুইটম্যান, অ্যামি লোয়েল এবং “কল্পনা,” পাউন্ড) থেকে সাহিত্য ও শিল্পের সর্বশেষ খবর নিয়ে বাড়িতে এসেছিলেন। এবং 1930 সাল নাগাদ ছোট্ট গ্রানাডা, তার পরিশীলনে, অ্যাভান্ট-গার্ডের একটি কেন্দ্রে প্রস্ফুটিত হয়েছিল। বেল টাওয়ারের তৎকালীন ছেলেরা নিজেদেরকে “নিকারাগুয়ান এন্টিএক্যাডেমি” বলে ঘোষণা করেছিল। তারা একটি ইশতেহার তৈরি করেন, যা পাবলো আন্তোনিও লিখেছিলেন, একটি পর্যালোচনা, ভোজসভা এবং একটি থিয়েটারের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তারা দুষ্ট ছিল।তারা জনসাধারণের মনোযোগ জয় করার অভিপ্রায় ঘোষণা করেছিল “শৈল্পিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে, বুদ্ধিবৃত্তিক কেলেঙ্কারি, আক্রমণাত্মক সমালোচনা, সাহিত্য যুদ্ধ, আধুনিক শিল্পের অযৌক্তিক প্রদর্শনী, বন্ধ্যাত্বের বিরুদ্ধে অভিযোগ, রক্তশূন্যতা, ম্যালেরিয়া এবং একাডেমিক সাহিত্যের অন্যান্য দুর্বলতা।” তারা তাদের প্রস্তাবিত নতুন ক্যাফে অফ দ্য আর্টসের জন্য একটি ক্যাফে ভাড়া নিয়েছিল এবং “ককটেল ককটেউ” থেকে শুরু করে একটি মেনু তৈরি করেছিল, কিন্তু ক্যাফে মালিক, তাদের সাজসজ্জা লক্ষ্য করে, তাদের ফেলে দেয়। “কিউবিজম,” কুয়াড্রা অনেক বছর পরে স্মরণ করেছিলেন, “নিকারাগুয়ায় তার প্রথম যুদ্ধে হেরেছিল।” তারা গ্রানাডার রবিবারের সংবাদপত্র, এল কোরিও -এর একটি পৃষ্ঠা দখল করে নেয় এবং এটিকে নিজের করে নেয়, “ভ্যানগার্ড কর্নার”। (পল বারম্যান/ আ চাইল্ড অফ হিজ সেঞ্চুরি)]

কুয়াদ্রার জীবন আধুনিক, উত্তরাধুনিক সময়ের সীমাভাঙা জীবন। তিনি ১৯০৯-৩৩ সাল পর্যন্ত আমেরিকান হস্তক্ষেপ দেখেছেন। ‘অগুস্তো স্যান্দিনো সিজার’-এর গেরিলা লড়াই দেখেছেন। এই সান্দিনো’র নাম নিয়েই ষাট দশকের ‘স্যানদিস্তা’ আন্দোলন গড়ে উঠবে। যেখানে তখনকার নিকারাগু্যার’র সবচেয়ে বড় সাহিত্যপত্রিকার ‘ লা-পেন্সা’র সম্পাদক কুয়েদ্রার সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকবে। তবে সেই ১৯২৭ সালের ‘ভ্যানগার্ডিয়া’ দলটির প্রথম লক্ষ্য ছিল ‘রুবেন দারিও’র আধুনিক পরিসরের যাবতীয় সীমাবদ্ধতাকে ভেঙে দিয়ে বস্তুনিষ্ঠ কবিতাকে প্রাধান্য দেয়া। ‘রুবেন দারিও’র সবরকম ‘টুল’গুলো কুয়াদ্রা অস্বীকার করলেন। বিমূর্ততা, রহস্যময়তা, চিত্রকল্প সহ সবকিছু থেকে বেরিয়ে চাইলেন। তাঁর কবিতায় লোকায়ত প্রাকৃতিক নিকারাগুয়ার সঙ্গে যোগসূত্র ঘটলো এখনকার বাস্তবিক নিকারাগুয়ার। জল, গাছ, পাহাড়, সমুদ্র, নাবিক, শোষণ, প্রতিবাদ, হতাশা এইসব কিছুই এক নতুন আঙ্গিকে উঠে এল।
১৯২৯-১৯৭৯’র স্বেচ্ছাচারী ‘সামোজা’ পরিবারের শাসন থেকে স্যান্দিস্তা আন্দোলন এবং ‘স্যান্দিস্তা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টে’র উদ্ভব তিনি সক্রিয় বৌদ্ধিকতায় দেখেছেন লিখেছেন। স্বৈরাচারী ‘সামোজা’ সরকারের উৎখাতে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। এখনকার শাসক দল ‘এফ.এস.এন.এল’-এর সঙ্গেই তিনি ১৯৮০’র শেশদিক পর্যন্ত ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসে একটি মতের প্রাধান্য কখোনই ছিলনা। তিনি বহুমতের স্বাধীনতায় আমৃত্যু বিশ্বাসী ছিলেন। আর এই কারণে ‘দ্যানিয়েল’ওর্টেগা’র সরকার তাঁর কাছে যখন একটি দলেই আধিপত্যের প্রতীক হয়ে উঠলো কুয়াদ্রা দেশত্যাগ করে থকতে লাগলেন কোস্টারিকা এবং টেক্সাসে ২০০২ সালে ‘মুয়ানাগুয়া’ শহরে তাঁর মৃত্যু হয়। এবার ‘পাবলো আন্তোনিও কুয়াদ্রা’র কিছু কবিতা –

দুঃসাহসী একটি লোকের আঁকা সরিসৃপ

আমি পাহাড়ের মাথায় উঠে এলাম
চাঁদ উঠল যখন
সে শপথ করে বলেছিল যে আসবে
দক্ষিণের রাস্তা দিয়ে
একটা সাঁঝানো চিল
সেই রাস্তাটাই তুলে নিল
তার ধারালো নখ দিয়ে

২.
সাইফার, তার স্বপ্নে, শুনতে পেল সমুদ্রশামুকের চিৎকার, তখন ভোর, কুয়াশায়।
সে দেখলো নৌকোটাকে, স্থির, ঢেউ-এ আটকানো।
– যদি তুমি মাহজরাতের ঘন অন্ধকারে শোন, উঁচু ঢেউ পেরনো কোন চিৎকার জিগগেস করছে বন্দরের নাম, রাডারটা ঘুরিয়ে কেটে পড়ো…
ফেনারেখায় টানা জাহাজের আভাস, চিবোনো অন্ধকার,(“নাবিক নাবিক” তারা চেঁচাচ্ছে), ছেঁড়া দড়ি দুলছে কালো অন্ধকারের ভেসে যাওয়ায় (-‘নাবিক, আমরা নাবিক!’)
সাইফার দাঁড়ালো, মাস্তুল ছুঁয়ে

-যদি চাঁদের আলোয় তাদের আলোকিত ছাই ছাই দাড়িগোঁফের মুখগুলো তোমায় জিগগেস করে, ‘নাবিক, আমাদের বন্দরের রাস্তাটা ব’লে দাও..উত্তর দিওনা, রাডারটা ঘরাও আর কেটে পড়ো…
তারা জাহাজ ভাসিয়েছিল সেই কবে
তারা ভসেসে চলেছে শতাব্দী পুরনো স্বপ্নে
আর এসবই তোমার সেই নানারকমের জিজ্ঞাসা, যা তুমি কোন একটা সময়ে হারিয়ে ফেলেছ

‘The film ended without the final kiss.
She was found dead in her bed with her hand on the phone.
And the detectives never learned who she was going to call.
She was like someone who had dialed the number of the only
friendly voice and only heard the voice of a recording
that says: WRONG NUMBER.

Or like someone who had been wounded by gangsters reaching
for a disconnected phone.

Lord

whoever it might have been that she was going to call
and didn’t call (and maybe it was no one
or Someone whose number isn’t in the Los Angeles phonebook)
You answer that telephone!’
[ চূড়ান্ত চুম্বন ছাড়াই ছবিটি শেষ হয়েছে।
ফোনে হাত দিয়ে তাকে বিছানায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
এবং গোয়েন্দারা কখনই জানতে পারেনি যে তিনি কাকে ডাকতে যাচ্ছেন।
তিনি এমন একজনের মতো ছিলেন যিনি একমাত্র নম্বরটি ডায়াল করেছিলেন
বন্ধুত্বপূর্ণ ভয়েস এবং শুধুমাত্র একটি রেকর্ডিং এর ভয়েস শুনেছি
যে বলছে: ভুল সংখ্যা।

অথবা যে কেউ গ্যাংস্টারদের কাছে পৌঁছে আহত হয়েছে
একটি বিচ্ছিন্ন ফোনের জন্য।

প্রভু

যাকেই হতে পারে যে সে ফোন করতে যাচ্ছে
এবং কল করেনি (এবং সম্ভবত এটি কেউ ছিল না
অথবা যার নাম লস এঞ্জেলেস ফোনবুকের মধ্যে নেই)
তুমি ওই টেলিফোনের উত্তর দাও! ’ ]

শেষ লাইনটা অদ্ভুত, না? কে এভাবে, এত নিরিবিচ্ছিন্ন ভাবে ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলতে পারেন?স যিনি অভ্যস্ত, অর্থাৎ একজন যাজক!কিন্তু যাজক তো নিয়মের বাইরে যাবেন না। কবিতা করবেন না। সেক্ষেত্রে একজন যাজক কবির কথা ভাবা যেতে পারে। এই মুহূর্তে যাজক-কবি এরনেস্তো কার্দেনাল ছাড়া আর কে আছেন? এই অংশটা তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘প্রেয়ার ফর মেরিলিন মনরো’ থেকে নেয়া। তবে তিনি শুধু কবিই নন, বিপ্লবীও বটে। নিকারাগুয়ার স্বৈরাচারী সামোজা পরিবারের বিরুদ্ধে এই মানবদরদী যাজকের অবস্থান বরাবরই খুব দৃঢ় ছিল। ‘কেনটাকি’তে যাজকত্ব পাওয়ার আগে ছাত্রাবস্থাতেই তিনি কবিতা এবং কবিদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।১৯৬০ শুরু হওয়া ‘সামোজা’ বিরোধী ‘স্যন্ডিস্তা’ আন্দোলনের তিনি ছিলেন থিওলজিক্যাল মার্ক্সবাদের প্রতিনিধি এবং একজন এমন কবি যাঁকে পাবলো এন্তোনিও কুয়াদ্রার সঙ্গেই একাসনে রাখা হয়। Lawrence Ferlinghetti noted in Seven Days in Nicaragua Libre. “And with [Cardenal’s] vision of a primitive Christianity, it was logical for him to add that in his view the Revolution would not have succeeded until there were no more masters and no more slaves. ‘The Gospels,’ he said, ‘foresee a classless society. They foresee also the withering away of the state’ [Ferlinghetti’s emphasis].”
( লরেন্স ফার্লিংগেটি নিকারাগুয়া লিবারে সাত দিনে উল্লেখ করেছেন। “এবং একটি আদিম খ্রিস্টধর্মের [কার্ডেনালের] দৃষ্টিভঙ্গির সাথে, তার পক্ষে যুক্ত করা যুক্তিযুক্ত ছিল যে তার দৃষ্টিতে বিপ্লব সফল না হত যতক্ষণ না আর কোন প্রভু এবং দাস না থাকত। ‘গসপেলস,’ তিনি বলেছিলেন, ‘একটি শ্রেণীহীন সমাজের পূর্বাভাস দিন। তারা রাজ্যের বিলুপ্তির পূর্বাভাসও দেয় “[ফারলিংগেটির জোর]”) লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি তাঁর ‘‘সেভেন ডেজ ইন নিকারাগুয়া ‘লিবের’’’-এ লিখেছেনঃ “And with [Cardenal’s] vision of a primitive Christianity, it was logical for him to add that in his view the Revolution would not have succeeded until there were no more masters and no more slaves. ‘The Gospels,’ he said, ‘foresee a classless society. They foresee also the withering away of the state’. ( এবং একটি আদিম খ্রিস্টধর্মের [Cardenal’s] দৃষ্টিভঙ্গির সাথে, তার পক্ষে যুক্ত করা যুক্তিযুক্ত ছিল যে, তার দৃষ্টিতে বিপ্লব সফল না হত যতক্ষণ না আর কোন প্রভু এবং দাস না থাকত। ‘গসপেলস,’ তিনি বলেছিলেন, ‘একটি শ্রেণীহীন সমাজের পূর্বাভাস দিন। তারা রাজ্যের বিলুপ্তির পূর্বাভাসও দেয়।) এটাই হল ‘এরনেস্তো কার্দেনাল’-এর একক বৈশিষ্ট। ‘থিওলজি’কে যে সমাজনীতির সঙ্গে একীভূত করা যায় তার প্রামাণ্য উদাহরণ হলেন ‘বিদ্যাসাগর’। তবে তিনি কবি ছিলেন না। ‘এরনেস্তো কার্দেনাল’ কবি ছিলেন। পার্থিব দুঃখ কষ্ট নিয়ে রোমাণ্টিক হা হুতাশ করাটাই তাঁর লক্ষ্য হতে পারতো। ১৯২৫-এ জন্মানো এই কবি তা করেন নি। ১৯৭০ এ কিউবায় গিয়ে তিনি মার্ক্সবাদকে খৃষ্ট-দর্শনের সঙ্গে মিলিয়ে এক নতুন উপযোগী আদর্শে্র কথা ভাবতে শুরু করেন।গসপেল অনুযায়ি শ্রেণীহীন এবং রাষ্ট্রহীন সমাজের স্বপ্ন তিনি মার্ক্সীয় দর্শনের নিরিখে সম্ভব বলে লিখতে ও বলতে শুরু করেন।‘স্যান্দিস্তা বিপ্লব’-এর পরে ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৭ অবধি তিনি তিনি নিকারাগুয়ার সংস্কৃতি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পোপ জন পল (২) তাঁকে তাঁর ’লিবারেশন থিওলজি’র জন্য সমালোচনা করেন। তবে ‘এরনেস্তো কার্দেনাল’ কখোনই বামপন্থা থেকে বিচ্যুত হননি। দানিয়েল ওর্তেগার নেতৃত্বে মন্ত্রীত্ব করলেও ১৯৯৪ সাল থেকে তিনি তাঁর সমালোচক হয়ে ওঠেন এবং বিরোধীতা করেন একনায়কসুলভ আচরণের। মনে রাখতে হবে কুয়েদ্রা বা কার্দেনাল এঁরা দুজনেই লাতিন আমেরিকার সামগ্রীক কবিতাধারা এবং ভাবনা থেকে বিছিন্ন ছিলেন না। অ্যালেজো কার্পেন্তিয়র থেকে পাবলো নেরুদা পুরো লাতিন আমেরিকার সাহিত্য বরাবরই পরস্পরকে সাপ্লিমেন্ট করেছে। এবার ‘এরনেস্তো কার্দেনাল’-এর কবিতা –

ফর্সা দেবী

তো, এটা একটা বই, বিশেষ বই মহিলাদের নিয়ে, যে
পুরুষটি লিখেছে, সে প্রেমিক-স্বামী, মহিলাটির।
যার সম্পর্কে কিছুদিন আগে ‘টাইম’ লিখেছিল, ‘ইনি দুনিয়ার অন্যতম শিক্ষিত এবং সুভদ্র একজন মানুষ’ আর আমি
সেই বইটি পড়ছি
সূর্যস্নাত ডেকে বসে দেখছি সুমুদ্রঈশ্বর ‘পোসেইডনের’ ঢেউ ঢেউ কোঁকড়া চুল
যা সেই ফরাসী নৌকোয় ছিল
আমি যাচ্ছিলাম ‘নিউ ইয়র্ক’ থেকে ‘লা-হার্ভের’ দিকে, আমার প্রথম
ইওরোপ যাত্রা, আর তাই
আমি এখন নীল ভূমধ্যসাগরের উজ্জ্বল দিনটিতে একটা খাপছাড়া গ্রামে হাঁটছি
গ্রামটার নাম ‘দেয়া মাজোরকা’
এখানে ‘রবার্ট গ্রেভস’ থাকেন, আর তাই বই হাতে নিয়ে আমি টোকা মারলাম
তাঁর দরজায়
গ্রেভস দরজা খুলে নিজেই কার্দেনালকে ডেকে নিলেন ঘরের ভেতরে, আর সেই বিদ্বান মানুষটির স্ত্রী জোর করতে লাগলেন তাদের সঙ্গে চিকেন-স্যুপের লাঞ্চ করার জন্য
গ্রেভস গ্লোব নিয়ে এলেন বসার ঘরে
ঘুরিয়ে দিলেন
একসময় নিকারাগুয়ার উপরে তাঁর আঙুল থামলো
গ্লোবও থামলো, তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদের বলে উঠলেন, এই যে ছোট্ট বিন্দুটা
এটাই নিকারাগুয়া, আর আমরা এই যে এখানে
ছেলেমেয়রা ঝুঁকে দেখতে লাগল তারা ঠিক কোন বিন্দুতে রয়েছে
আর সেই ছোট্ট বিন্দু নিকারাগুয়াস
কতদূরে
তারা খুব মজা পাচ্ছিল…

সেলফোন

তুমি তোমার সেলফোনে কথা বলো
ব’লেই যাও
হাসো, সেলফোনেই
এটা না জেনেই যে সেলফোন কিভাবে তৈরি হয়েছিল
বা কিভাবে এটা কাজ করে
তবে সমস্যা এটাই যে, তুমি জানো না
যেভাবে আমিও জানিনা যে কংগোতে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়
এই সেলফোনের জন্য
কংগোর পাহাড়ে সোনা আর হীরে ছাড়াও ‘কোল্টান’ নামের খনিজ পদার্থ আছে
যা সেলফোনের কনডেনসারে কাজে লাগে…

(‘কোল্টান’ এমনি এক খনিজ যা প্রায় সব ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিতে ব্যবহৃত হয়। কঙ্গোতে এর অফুরন্ত ভাণ্ডার। এরফলে সেই দেশের আর্থিক বিকাশ চূড়ান্ত রকমের হওয়ার কথা ছিল। হয়নি। বরং কতিপয় ব্যবসায়ী রাজনৈতিক নেতা এই সম্পদের দখল নিতে গিয়ে হাজার হাজার মানুষকে ‘গ্যাং-ওয়ার’-এর নামে মেরে ফেলেছে!)

নীল, জানলা থেকে দেখা
————-
ছোট্ট গোল জানলা থেকে সবই নীল
নীলজমি, নীল-সবুজ, নীল(আকাশ)
নীল, সবই নীল
নীল ঝিল, নীল-লেগুন, নীল আগ্নেয়গিরি
অনেকটা দূরে নীলদ্বিপ নীল লেকের কাছে নীল নীল
এই হল মুক্তি পাওয়া দেশের মুখ
যেখানে মানুষ লড়াই করেছিল, আমার তো মনে হয়, ভালবাসার জন্য
শোষণছাড়া জীবনের জন্য
আর এই সুন্দরকে ভালবাসার জন্য সুন্দরের মধ্যে দাঁড়িয়ে, কারণ
তারা নিজেরাই সুন্দর
তারা সাধারণ মানুষ, সবচেয়ে সুন্দর তারাই, আর তাই
ঈশ্বর এই জমিটুকু দিয়েছেন
সমাজকে ভাল করার ইচ্ছে দিয়েছেন আর তারা লড়াই করেছে
একটা দেশ ভালবাসার হবে বলে
এই দেশ ভালবাসার হবে বলে
একটা জায়গায় নীল গভীর হয়ে উঠেছে
এখানে হয়ত তীব্র লড়াই হয়েছিল, আর আমি ভাবছি, মুক্তির যুদ্ধগুলো দেখা যাচ্ছে
এই জানলা দিয়ে
এই ছোট্ট জানলা দিয়ে যাচ্ছে নীল, নীল আর নীল..

নিকারাগুয়ার ‘স্যান্দিস্তা বিপ্লবে’র আগুনে পুড়ে খাঁটি সোনা হয়ে উঠেছে সেখানকার কবিতাও! এখনকার প্রেসিডেন্ট দানিয়েল ওর্তেগার স্ত্রী একদিকে যেমন প্রথিতযশা কবি অন্যদিকে দেশের ভাইস প্রেসিডেন্টও বটে। বিপ্লবের সঙ্গে বিরাসতি রাজনৈতিক ক্ষমতার কোন যোগ আছে কিনা জানিনা তবে ‘রোজারিও মারিল্লো’(জন্ম ১৯৫১) কিন্তু ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই কবিতায় সক্রিয় ছিলেন। বিপ্লবে সক্রিয় করার সময়েই কুয়েদ্রা সম্পাদিত নিকারাগুয়ার শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পত্রিকায় রোজারিও’র লেখা নজর কেড়েছিল। রোজারিও বিপ্লবের অগ্রণী সৈনিক ছিলেন, এখন তিনি নিকারাগুয়ার ফার্স্ট লেডি এবং উপরাষ্ট্রপতি।

রোজারিও মারিল্লো’র কবিতা

আমার বন্ধুরা এবং রাস্তার হৈ হৈ
——————
আমার কিছু বন্ধু আছে, তাদের ফেরানো যাবেনা।একটা কালো রঙের পাখি যে খুব ভোরে গান গায়। একটা উড়তে থাকা পতাকা দরজার ওপারে আর একটি দ্রুত পায়ে চলে যাওয়া মেয়ে।আর সেই ছেলেটা যার চোখদুটো দেখলেই আমার মনে পড়ে যেত ঝিলের আয়ানার পড়ে থাকা রামধনুর রঙ। তার পা প্রকৃত কাদারন প্রলেপে। বাজার খোলে সকাল সকাল, জীবনও। একটা ব্যাগ যেতে চাইছে না। একটা স্লোগান দেয়ালে। মনে হয় অক্ষরগুলো আমার গর্ভ আঁচড়াচ্ছে। এরাই আজ আমার বন্ধু। তারা ভোরের এই আড়ভাঙা ব্যায়ামগুলো সাজাবার চেষ্টা করছে।

যখন তোমার ক্লান্ত চোখদুটো ঘুমোতে যায়
—————————–
যখন তোমার ক্লান্ত চোখদুটো ঘুমোতে যায়
শেষ না হওয়া অপেক্ষা নিয়ে
যখন আরেকবার হাসি ফিরে আসে
আর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমাদের মাঝখানে
আমরা সময় নিই
পুরনো ওকে গাছটার পেছনের রাস্তাটায়ন
যেখানে আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম, আমাদের যেতে হবে
আমরা মনে করবো আবার সেই আতঙ্কের দিনগুলো
আমরা কথা বলবো সেইসব ঘ্রাণ নিয়ে
একে অপরকে বলবো যুদ্ধের দিনগুলো কিভাবে কাটিয়ে ছিলাম আমরা…


আর্নেস্তো কার্দেনাল
—————————-
জন্ম ১৯২৫ সালে। নিকারাগুয়া তথা লাতিন আমেরিকার স্বনামখ্যাত কবি আর্নেস্তো কার্দেনাল মার্তিনেজ। তিনি একজন ধর্মযাজক হয়েও নিকারাগুয়ার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিপ্লবের ধর্মতত্ব বা লিবারেশন থিয়োলজির অন্যতম জনক তিনি। সান্দানিস্তা বিপ্লবের পর কার্দেনাল নিকারাগুয়ার সংস্কৃতিমন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করেন। এই মার্কসবাদী ধর্মযাজকের সঙ্গে পোপ দ্বিতীয় জন পলের বিরোধ বাধে, কার্দেনাল যাজক হিসেবে গুরুত্ব হারান। পরে সান্তানিস্তা সরকারের, সরকার পরিচালন ত্রুটি নিয়ে সমালোচনা করে মন্ত্রীত্বও ছেড়ে দেন কবি।

তোতাপাখিরা

আমার বন্ধু মাইকেল হন্ডুরাস সীমান্তের
উত্তর সোমোতোর একজন সেনা অফিসার,
তিনি আমাকে বলেছিলেন, তিনি কিছু
বে-আইনি তোতার খোঁজ পেয়েছিলেন
যেগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চোরাচালান হবার জন্য
অপেক্ষা করছিল, সেখানে গিয়ে ইংরিজি বুলি শেখানো হবে।
*
সেখানে ১৮৬টি তোতাপাখি ছিল
যার মধ্যে ৪৭টি তখনই খাঁচার ভেতর মারা গিয়েছিল।
যেখান থেকে তাদের ধরা হয়েছিল সেখানে
তিনি ওদের ফিরিয়ে নিয়ে আসছিলেন
কিন্তু সেই লরি এসে যেই প্রবেশ করল সেই সমতলে
*
ঐ পর্বতমালার কাছে, যেখানে ছিল তোতাদের বাসা
(সমতলভূমির পিছনেই দাঁড়িয়েছিল বিরাট পর্বতসারি)
পাখিগুলো উত্তেজিত হয়ে উঠল, শুরু করল ডানা ঝাপটাতে
ধাক্কা দিতে লাগলো খাঁচার গায়ে।
*
যখন খাঁচাগুলো খুলে গেল
তারা ঠিক যেন তীর বৃষ্টির মতো ছুটে গেল
সোজা তাদের পাহাড়গুলোর দিকে।
*
আমার মনে হয় বিপ্লব ঠিক এইন কাজটাই করে :
সে খাঁচা থেকে আমাদের মুক্ত করে
যেখানে ওরা আমাদের ইংরিজি বুলি শেখাতে ফাঁদবন্দি করেছিল
সেখান থেকে সে আমাদের স্বদেশে ফিরিয়ে আনে
যেখান থেকে আমাদের উৎখাত করা হয়েছিল,
তাদের সবুজ পাহাড়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠা দেয় তাদেরই সবুজ তোতাসাথীরা।
*
কিন্তু সেখানে ছিল আরো ৪৭টি, যারা নিহত হয়েছে।

গিয়াকোন্দা বেল্লি
————————–
বেল্লির জন্ম ১৯৪৮ সালে নিকারাগুয়ার মানাগুয়ায়। উচ্চশিক্ষিত এবং বিত্তবান পরিবার থেকে আসা নিকারাগুয়ার একজন গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবী তিনি। বেল্লি ১৯৭০ সালে এ সামোজা স্বৈর সরকারের বিরুদ্ধে নিকারাগুয়ার সান্দানিস্তা ন্যাশানাল লিবারেশন ফ্রন্টের নেতৃত্বে শুরু হওয়া জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। বিপ্লবের পরেও তিনি একজন সাহসী গণতান্ত্রিক কন্ঠ হিসেবে সমালোচনা করেছেন সরকারের অনৈতিক কার্যকলাপের।

হরতাল

আমি একটা হরতাল চাই যেখানে আমরা কেউ ঘরে থাকব না।
এ হবে কাঁধ, মাথা, চুলের হরতাল,
শরীরে শরীরে জন্ম নেবে যে হরতাল।
আমি একটা হরতাল চাই
শ্রমিকের ঘুঘুপাখির
চালকের ফুলের
কারিগরের শিশুর
চিকিৎসকের মায়ের

আমি একটা বিরাট হরতাল চাই
যাতে এমনকি থাকবে প্রেমও
একটি হরতাল যাতে সব কিছু স্তব্ধ হয়ে যাবে
ঘড়ি কারখানা
নার্সারি ইউনিভারসিটি
বাস হাসপাতাল
রাজপথ বন্দর
এ হবে চোখের, হাতের, চুম্বনেরও হরতাল,
এমন একটি হরতাল যেখানে নিষিদ্ধ থাকবে শ্বাস চলাচল

একটি হরতাল যেখানে নীরবতার জন্ম হবে
স্বৈরাচারীর পলায়নরত পায়ের শব্দ শোনার জন্য।

জ্যাসপার গার্সিয়া লাভিয়ানা
—————————————–
নিকারাগুয়ার স্পেনীয়-রোমান ধর্মযাজক, কবি জ্যাসপার গার্সিয়া লাভিয়ানার জন্ম ১৯৪১ সালে। তিনি গ্রামের কৃষক ও দরিদ্র জনসাধারণের ভেতরে কাজ করতে গিয়ে অবর্ণনীয় শোষণ অত্যাচার প্রত্যক্ষ করে সেসবের প্রচন্ড সমালোচক হয়ে ওঠেন। লিবারেশন থিয়োলজিতে বিশ্বাসী লাভিয়ানাকে সামোজার ন্যাশানাল গার্ড দুবার গোপনে হত্যার চেষ্টা চালায়। তিনি দেশত্যাগ করে কোস্টারিকায় পালিয়ে আসতে বাধ্য হন। এখানে এসে তাঁর পরিচয় হয় দেশত্যাগী সান্দানিস্তা ন্যাশানাল ফ্রন্টের বিপ্লবীদের সঙ্গে। তিনি তাঁদের চিন্তা ও আদর্শের সাথে নিজের ভাবনার মিল খুঁজে পান এবং FLSN এ যোগ দেন। কিন্তু ১৯৭৮ সালে কোস্টারিকা সীমান্তে সান্দানিস্তা গেরিলা বাহিনীর যে ইউনিটে তিনি ছিলেন, সেটি বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়, লাভিয়ানা নিহত হন। বিপ্লবের পরে নিকারাগুয়ার খ্যাতনামা কবি আর্নেস্তো কার্দেনালের তত্বাবধানে তাঁর লেখাপত্র ও কবিতাগুলি সংকলিত হয়।

সরোবরে ধ্যান

নদীতীরে ধ্যানস্থ এই তোমার থেকে আমি অনেক দূরে
সুরচ্যুত স্বরলিপি বাঁধছি এখন আবার সুরে সুরে
অবিরাম ঢেউ বুনছি নিবিড় শব্দ পুরে ছন্দে এবং ভাষায়
যেমন ছিল সেই সে লিপি পেলাম ফেরত তরঙ্গরা আসায়
সরোবর ফের পাঠ বলে যায়
জল নাচিয়ে ফেনায় ফেনায়
আবার বলে এবং আবার কন্ঠে তুমুল সেই অবিরাম নাম
মুক্তি মুক্তি মুক্তি মুক্তি মুক্তির সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম!

—————————————-
[সংগৃহীত ও সম্পাদিত]
কৃতজ্ঞতা ও ঋণস্বীকার
১). অনুবাদক – মৃন্ময় চক্রবর্তী
২). স্বপন রায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress