নারী স্বাধীনতা – এখনো অধরা কলমে
প্রখ্যাত সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের ভাষায় – ” মেয়েরা গণেশের মত, মা দুর্গার চারপাশে পাক দিয়ে যে জগৎ দেখে তাতেই তৃপ্তি আর পুরুষরা কার্তিকের মত সারা পৃথিবী ঘুরে আসে অথচ কি দেখে তা তারাই জানে না।”
হয়তো এই জন্যই হুমায়ূন আজাদ বলেছেন – “গত দুশো বছরে গবাদি পশুর অবস্থার যতোটা উন্নতি ঘটেছে নারীর অবস্থার ততোটা উন্নতি ঘটেনি।”
প্রথম কথাটি অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হলেও দ্বিতীয় কথার সম্পূর্ণ সত্যটা নিয়ে সন্দেহ আছে।
নারী ঘরকুনো কারণ ছোটো থেকেই তাকে বাড়ির মধ্যে থাকার অভ্যাস তৈরি করে দেওয়া হয়। ছোটো থেকে মা কে বাড়িতে আর বাবাকে বাইরে যেতে দেখে তারা । তাই নিজেদের মনের মধ্যে ছোটো থেকেই একটা চিত্র বানিয়ে ফেলে তারাও।
কথাটা একটু বুঝতে আমরা চলে যাই সেই সময়ে – যে সময় আর্য – অনার্যদের, যে সময় যাযাবর জাতিদের । আমরা দেখেছি যাযাবর নারী ও পুরুষ সমানভাবেই কাজ করত। পশু শিকার করেছে, খাদ্য সংগ্রহ করেছে। – এই পথে যাযাবর জাতির নারীরা যখন সন্তান সম্ভবা হত , তখন তাদের থাকতে হত ঘরেই। কারণ ওই অবস্থায় শিকার বা অন্যকাজে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। তবুও ওই সময়টুকু ছাড়া মেয়েরা পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সব অসম্ভব সম্ভব করেছে। তাছাড়া সন্তান জন্মের পর তাদের দেখা শোনার জন্য , বন্য পশু ঠিক বাঁচানোর জন্য নারীদের থাকতে হত তাদের সন্তানের সাথেই।
এই রেশ টেনে পরবর্তীতে একটি অতি প্রচলিত কথা উঠে আসে – নারী সামলাবে ঘর আর পুরুষ বাইরেটা। সমানভাবে নিজেদের মধ্যে হয়েছিল দায়িত্ত্ব বণ্টন। যাযাবর জাতির বেচেঁ থাকার জন্য বাইরে গিয়ে খাদ্য সংগ্রহের প্রয়োজন । তাই কাউকে না কাউকে বাইরে যেতেই হত। আর ঈশ্বর প্রদত্ত আশীর্বাদে মেয়েদের জন্মগত ক্ষমতা হল সন্তান ধারণ , যা কিন্তু পুরুষদের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। তাই সেই সময়টা মেয়েরা বাইরে বেরিয়ে কাজ করতে পারত না। এমনকি সন্তান প্রসবের পরেও নিজের শরীর সেরে উঠতে এবং সন্তানের খেয়াল রাখতে যে কোন এক অভিভাবককে সন্তানের সাথে থাকার প্রয়োজনে নারীকে থাকতে হল ঘরে। এখানে উল্লখ্য সন্তান মায়ের বুকের দুধ খেয়ে বড় হয়, তাই প্রাকৃতিক এই উপায়ে মেয়েরা সন্তানদের সাথে এমনি এমনিই জুড়ে যায়। এখানে উল্লেখ্য আদিম সমাজের মায়েরা নিজের বাচ্চাকে পিঠে বেঁধে শিকারে যেত – এই দৃষ্টান্তও কিন্তু বিরল নয়। ঠিক যেমন চা বাগানের মহিলা কর্মীরা তাদের সন্তানদের বুকে বেঁধে নেয়।
শুধু তাই নয় মেয়েদের ঘর বন্দীর মূলত কারণ কিন্তু ছিল পশুপালন আর চাষবাস। যখন থেকে পোষ মানানো পশুকে পুষতে লাগল মানুষ এবং চাষবাস শুরু করল একটা নির্দিষ্ট জায়গায় জুড়ে বসতি স্থাপন করার জন্য তখন থেকেই মেয়েদের পায়ে পড়ল শিকল। মানব সমাজের এই নিয়ম মেয়েদের জন্য কাল হয়ে উঠল। এই নিয়মে চলতে চলতে বাইরে বেরোনো যখন পুরুষদের একচ্ছত্র অধিকার হয়ে উঠল তখন নারীদের তারা ঘরের মধ্যে বন্দী ও বাইরের কাজে অক্ষম মনে করতে লাগল।
এটা তো গেল প্রয়োজনের কথা। এবার আসি দৃষ্টিভঙ্গিতে। মানুষ মা কিন্তু সন্তান পালন জন্ম ও তাদের পালনের সাথে সাথে বাইরের খাদ্য সংগ্রহেও সমানভাবে দক্ষ বা পটু। কিন্তু এই অধিকার বা এই স্বাধীনতা যদি তাদেরকে না দেওয়া হয় তবে কি তারা সারাজীবন ঘর বন্দী হয়েই রয়ে যাবে? এখানে প্রশ্ন উঠবে – নারী কোনো নিজের অধিকার বা নিজের স্বাধীনতা নিজের হাতে নেয় না, কেনো অন্যের অনুমতির প্রয়োজন হয়? এখানেও উত্তর আছে , আছে উদাহরণ। নারী নিজের স্বাধীনতা নিজের হাতে নিয়ে বাইরে বেরিয়েছে, যুগ যুগ ধরে ঘরে ও বাইরে সমান ভাব সামলিয়েছে।
শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে মেয়েরা ঘরে বসে পশম পাকাত অর্থাৎ পশম বুনত। এটা তাদের ঘরে বসে জীবিকা নির্বাহের একটি পথ ছিল। ঋগবেদের যুগে নারী করেছে যুদ্ধ। আমরা মুদ্ গলিনীর যুদ্ধ বৃত্তান্ত জানি। যুদ্ধে বিশপলা তার একটি পা হারান আর বধ্রিমতী হারান একটি হাত। গার্গী, আত্রেয়ী ও মৈত্রেয়ী নিজেদের স্বাধীন চিন্তাভাবনায় করেছে নারীদের মুখোজ্জ্বল। স্বামীর সাথে পাল্লা দিয়ে মুনি বিশিষ্টপত্নী অরুন্ধতী বেদের ছয় অধ্যয়নের অন্তে উৎসর্গ দিবসে অন্যান্য শ্রদ্ধার্ঘ্য দের মধ্যে নিজের আসনের অধিকার নিয়েছিলেন জয় করে। ব্যতিক্রমী হলেও পুরুষ পিতা দিয়েছেন তার কন্যাকে শিক্ষার অধিকার। বিশ্বব্যারা, ঘোষা, গোধা, অপালা – এই অধিকারে অধিকারী। আস্তনের কন্যা বাক্ – যিনি বিখ্যাত ‘ সোহহম’ তত্ত্বের ঋত্রি , যে তত্ত্ব উপনিষদের শিক্ষা ও বেদান্তের বীজ। কিন্তু এর মধ্যেই ছিল আর এক সত্য – যা পরবর্তী সমাজ ও নারী জীবনকে করেছিল প্রভাবিত। বিদ্বান ও বিদুষী নারী তর্ক সভায় যুক্তি সঙ্গত ভাবে তর্ক করতে পারে, কোণঠাসা করতে পরে লব্ধ প্রতিষ্ঠ ঋষিকে। আর সমাজের রক্ষণশীল মনোভাবের প্রতি হানতে পারে আঘাত।
ব্যাকরণ গ্রন্থে স্ত্রী প্রত্যয় যোগ করা হয়। কাশাকৃৎস্না আপিশালার সাথে পরিচিত হই আমরা – যিনি ছিলেন মীমাংসা ও ব্যাকরণে পারদর্শী। কিন্তু এর পরেও নারীর অধিকার হল খর্ব। কেড়ে নেওয়া হল উপনয়নের অধিকার, স্বাধ্যায় হয়ে উঠল নারীর কাছে অগম্য, কেড়ে নেওয়া হল শিক্ষা। আর্যরা যখন অনার্য পত্নী গ্রহণ করতে শুরু করল তখন থেকেই এই নিয়ম হল চালু।
নারীরা হল ঘরবন্দী। নিজ সংসারেই নির্বাসিতা।
বিবাহের পূর্বে পিতা, বিবাহের পরে স্বামী এবং বৃদ্ধা অবস্থায় পুত্রের অধিকারে। কিন্তু ঋগ্বেদে নববধূকে আশীর্বাদ করা হত – “তোমার শ্বশুর কুলের সবার সম্রাজ্ঞী হও।” রাজার বিবাহ করে আনা নববধূ অর্থাৎ রাজার পরেই তার অধিকার। কিন্তু সেই অধিকার, সেই স্বাধীনতা শুধুমাত্র দায়িত্বেই সীমাবদ্ধ ছিল। ব্রিটিশ সরকারের নব ঘোষিত আইনের মত – ” ক্ষমতাহীন দায়িত্ত্ব” । এই দায়িত্বে রানী রাজ্যের পরবর্তী রাজার জন্ম দেবে এবং তার লালন পালন করবে। এই হল নারীর জীবন। কিন্তু তখনও রাজার কন্যাদের অস্ত্রচালনা ও বিদ্যা শিক্ষার স্বাধীনতা ছিল।
ভারতের মাটিতে আর্যেরা বসতি গড়ার পর মোটামুটি দুই শতক অবধি নারী তার সেই স্বাধীনতার শেষটুকুও হারিয়েছে, তার ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের সব অধিকারের সাথে সাথে। নারীকে বলা হল ” ভার্যা” – অর্থাৎ ভরণীয় বা যাকে ভরণ করতে হয়। যার স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। অথর্ববেদে যেখানে নারীদের বহুবিবাহের কথা উল্লেখ ছিল , সেখানে – নারীর পতি মৃত্যুর পর শুরু হল সহমরণের মত জঘন্য কাহিনী। ঋগবৈদিক যুগে যেখানে নারীদের বিবাহ বাধ্যতা মূলক ছিল না , সেখানে নয় – দশ বছরের শিশুকন্যাকে দেওয়া হতে লাগল আশি বছরের বৃদ্ধের সাথে বিবাহ। কুল – জাতি – ধর্মীয় সংস্কার – কুসংস্কার – এই সবের দোহায় দিয়ে এক শ্রেণী (পুরুষ) আর এক শ্রেণীর ( নারী) অধিকার , স্বাধীনতা করতে লাগল খর্ব।
বেদ পরবর্তী যুগে নারীর অবস্থার যে অবনতি হয় , তার প্রভাব পড়েছিল সর্বত্র। সাহিত্য থেকে সংস্কৃতি প্রতিটি জায়গায় তার উদাহরণ স্পষ্ট। বৌধায়নের ধর্মশাস্ত্রে, মনু ও অন্যান্য স্মৃতিশাস্ত্রকারদের রচনায়, কৌটিল্যের “অর্থশাস্ত্র”, বাৎস্যায়নের “কামসূত্র” , কালিদাসের বিভিন্ন নাটক, বানভট্টের ” কাদম্বরী” ও ” হর্ষচরিত” , হর্ষবর্ধনের ” রত্নাবলী” – বিভিন্ন গ্রন্থে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান সুস্পষ্ট হয়েছে। এই সময়ে নারীদের কোনো স্বাধীনতা ছিল না। বেদপাঠ নিষিদ্ধ, খেলাধূলা নিষিদ্ধ, উৎসবে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ, সতীদাহ প্রথার প্রকোপ – প্রভিতিতে বিষাক্ত ছিল নারী জীবন। এমনকি স্ত্রীদের তিরস্কার ও মারধোর ও করা হত।
এই ধারণা বহন করে গড়ে উঠেছিল রানীর জীবন, রাজমাতার জীবন। সন্তান না হওয়ায় পুরুষের একাধিক বিবাহ। নারীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও তা মেনে নেওয়া – এসবই ভারতবর্ষের মজ্জায় মজ্জায় গাঁথা আছে। রাণী তখন শুধুমাত্র বংশধর দেওয়ার যন্ত্র।
এরপর ইংরেজ আসে কালাসাগর পাড় করে। এই সাদা চামড়ার পুরুষরাও নারীদের উপর অত্যাচার করে প্রচুর। কিন্তু তাও শত খারাপের মধ্যেও ছিল কিছু ভালো, যারা সত্যি চেয়েছিলেন এই দেশের মেয়েদের উন্নতি ঘটাতে। তাই বিশেষ বিশেষ বঙ্গসন্তানের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন এনারা। নারী স্বাধীনতার নতুন পথ খোঁজেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। তৈরি করেন বেথুন কলেজ। তিনি জানতেন শিক্ষাই একমাত্র নারী মুক্তি ঘটতে পারে, দিতে পারে নারী স্বাধীনতার নতুন পথের হদিস। ওদিকে রাজা রামমোহন রায় তৎকালীন গোড়া সমাজের বিপক্ষে গিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করেন সতী প্রথা রোধের এবং তিনি সফল ও হন। তৈরি হয় নতুন আইন। সতী প্রথা রোধের পর বিদ্যাসাগর মহাশয় সেই বিধবা মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে দিলেন তাদের দ্বিতীয় সুযোগ, বাঁচার সুযোগ। নিজ পুত্রের সাথে একজন বিধবার বিবাহ দিয়ে আরও এক পথের সন্ধান দিলেন। তৈরি হল বিধবা বিবাহ আইন। তবে এই সময় নারীর অবস্থার উন্নতি শুধু ইতিহাসের পাতায় নয় – তখনকার দিনে একটু অর্থবান শিক্ষিতের ঘরে , বিশেষ করে ব্রাহ্ম সমাজে সত্যিই নারী স্বাধীনতা লক্ষ্য করা যায়। নারী তখন গান শিখত, শিখত ইংরাজি ভাষা, বাংলা সাহিত্যের রঙ তখন প্রতিটি শিক্ষিত নারীর চোখে। তবুও তখনও অধিকাংশ নারীই ছিল পরাধীন – পুরুষের অধীন।
এরপর এসেছে আর এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ভারতের উত্তরাংশের রাজ্য ঝাঁসি এবং এই মারাঠা সাম্রাজ্যের রানী লক্ষ্মীবাঈ এর জীবন্ত কাহিনী। ছেলেমানুষ করা থেকে দেশ চালানো, ঘর সামলানো থেকে তরবারি হাতে ইংরেজদের সম্মুখ সমরে আহ্বান। ১৮৫৭ সালটি স্মরণীয় আছে এই নারীর কৃতিত্তেও।
এরপর ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীরা স্বাধীন ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। নিজেরা পরাধীন থেকেই আসল স্বাধীনতার মানে অনুভব করেছে। তাই দেশের স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গ করেছেন নিজের সর্বস্ব। গুপ্ত সমিতির সদস্য পদ গ্রহণ থেকে সেই সমিতির সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেওয়া, বিধবা নারীর তার শেষ সম্বল শেষ অলঙ্কারটুকুও দেশের জন্য নিবেদন করা – নিজের পরাধীনতার গ্লানি দূর করেছে সে এভাবে। বিভিন্ন সভা – সমিতি, বিভিন্ন আন্দোলনে, পদসভায় নারীরা থেকে সবার অগ্রে। উদাহরণ – আমাদের প্রণম্য মাতিঙ্গিনি হাজরা। এরকম হাজারো উদাহরণ পাওয়া যাবে সেই সময়ের মেয়েদের যারা নিজেরা পরাধীন কিন্তু মনে ছিল স্বাধীনতার পূর্ণ নদী।
গান্ধীজি থেকে নেতাজী সকলেই কিন্তু ভারতমাতার পরাধীনতা ঘোচাতে ভারতবর্ষের মায়েদের ডাক দিয়েছিলেন –
” না জাগিলে সব ভারত – ললনা,
এ ভারতের আর জাগে না জাগে না।
অতএব জাগো জাগো ভগিনী,
হও বীরজায়া, বীর – প্রসবিনী।
শুনাও সন্তানে , শুনাও তখনি,
বীর- গুণগাঁথা, বিক্রম – কাহিনী।
স্তন্য দুগ্ধ যবে পিয়াও জননী।
বীর গর্বে তার নাচুক ধমনী।
তোরা না করিলে এ মহা সাধনা,
এ ভারতের আর জাগে না জাগে না।”
শত পরাধীনতার মধ্যেও নারী স্বাধীনতার বড়ো নিদর্শন আজাদ – হিন্দ – ফৌজের ঝাঁসির রানী লক্ষ্মী ব্রিগেড। ভারতের স্বাধীনতায় নারী কৃতিত্ব অসীম। বাহিনীর সর্বাধিনায়িকা লক্ষ্মী স্বামীনাথন ও দ্বিতীয় পদাধিকারী জানকী থেবার নহপ্পন ছাড়াও অসংখ্য মা বোন ছিলেন এই বাহিনীতে। যারা করেছে পুরুষ সহযোদ্ধাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ, দিয়েছে দেশের জন্য প্রাণ।
স্বাধীনতা পরবর্তীতে ভারতবর্ষের চতুর্থ এবং দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নারী স্বাধীনতার উৎকৃষ্ট নিদর্শন। ১৯৮০ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হন। দিয়েছেন তাবড় তাবড় রাষ্ট্র প্রধানদের হুশিয়ারি। ভারতবর্ষের ১৫তম রাষ্ট্রপতি এবং প্রথম মহিলা রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল । ছিলেন দেশের প্রথম নাগরিক। এছাড়াও বিভিন্ন রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রী , যারা রাজ্যের প্রধান হয়ে নির্দেশ দিয়েছেন আপামর পুরুষ জাতিকে। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী সুচেতা কৃপালনি, মায়াবতী, ওড়িশার নন্দিনী শতপথী, গোয়ার শশিকলা কাকোড়কার, আসামের সৈয়দা আনোয়ারা তৈমূর, তামিলনাড়ুর জয়ললিতা, ভি এন জানকী, পাঞ্জাবের রাজিন্দর কউর ভাট্টাল, বিহারের রাবড়ি দেবী, দিল্লির সুষমা স্বরাজ, শীলা দীক্ষিত, মধ্যপ্রদেশের উমা ভারতী, রাজস্থানের বসুন্ধরা রাজে, গুজরাটের আনন্দী বেন প্যাটেল, জম্মু ও কাশ্মীরের মেহবূবা মুফতি এবং বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের মহিলা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
নারী নির্যাতন, নারীর অধিকার খর্ব, ঘরবন্দী – সমস্ত রকম বাঁধা কাটিয়ে এনারা নারী স্বাধীনতার পথ করেছেন প্রশস্ত।
শুধুমাত্র রাজনীতিই নয়, ক্রিয়াজগতেও নারীর কৃতিত্ব অসীম। ক্রিয়াজগতেও নানা পরাধীনতার মধ্যে নারী নিজের অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে । পি টি ঊষা থেকে শুরু করে সানিয়া মির্জা, সাইনা নেহাল – নামের তালিকা দীর্ঘ। অলিম্পিক পদকজয়ী দুই মহিলা ক্রিয়াবিদ – সাক্ষী মালিক ও পি ভি সিন্ধু। উল্লেখযোগ্য দীপা কর্মকারের নামও। সামাজিক বাধা, বিপত্তি জয় করে ইতিহাসে নিজেদের নাম লিখিয়েছেন মিতালী রাজ, ঝুলন গোস্বামী, মেরি কম, হিমা দাসের মত তেজস্বী নারীরা। সকলেই আমাদের কাছে আজ অনুপ্রেরণা। ভয়কে জয় করে এগিয়ে আসা, সমাজের কু-প্রথার উপরে জল ঢেলে পর্দার আড়াল থেকে বেড়িয়ে এসেছে নিজেদের অধিকার আর নিজেদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে।
তবে এখনো ভারতবর্ষে নারীরা অবহেলিত, লাঞ্ছিত, বর্জিত। এখনো নারীরা ঘরের কোণে চোখের জল ফেলে। এখনো সন্ধ্যের আগে মহিলাদের বাড়ি ফিরতে হয়, এখনো নারীরা ধর্ষিতা হয় পথে – ঘাটে – মাঠে। এখনো নারীরা পরাধীন বাবার ঘরে, পরাধীন স্বামীর ঘরে। আর তাই নারীদের নিজের কোনো ঘর নেই, নিজের কোনো বাড়ি নেই। স্কুল – কলেজের শিক্ষিকা, আর্মির অফিসার, ডাক্তার, পাইলট হয়েও কোথাও না কোথাও তারা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত। কোনো না কোনো ভাবে তারা পরাধীন – তাদেরই নিজের লোকের কাছে। তাইতো অন্যের জমিতে ধান বুনতে আসা পিছিয়ে পড়া সমাজের মেয়ে বউরা সারাদিন জলে ভিজে, রোদে পুড়ে যখন কিছু টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরে – তখন কারোর স্বামী, তো কারোর বাবা, তো কারোর ভাই বা দাদা তাদের থেকে সেই টাকা ছিনিয়ে নেয়। অন্যের রক্ত জল করা সেই টাকা দিয়ে তারা পাড়ার ঠেক থেকে মদ খেয়ে নেশায় ধুত হয়ে মধ্যরাতে বাড়ি ফেরে এবং তখন যদি বাড়ি ফিরে কোনো খাবার না পায় তাহলে চলে বাড়ির মেয়ে বউ এর উপর অকথ্য অত্যাচার।
নিজের পরিশ্রমের টাকা নিজের কাছে রাখার অধিকার বা স্বাধীনতা কোনোটাই নেই তাদের। এই আমার দেশের মেয়ে আর এই হল তাদের স্বাধীনতা।
*********সমাপ্ত*********