পিঙলা শ্ৰান্ত হয়ে পড়েছিল
পিঙলা শ্ৰান্ত হয়ে পড়েছিল তার কাহিনী বলতে বলতে। একটা ছেদ পেয়ে সে থামলে। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে—আঃ মা—
শিবরাম বলেন-কুপিত বায়ু ঝড়ের রূপে উড়িয়ে নিয়ে চলে মেঘের পুঞ্জ, ভেঙে দিয়ে যায় বনস্পতির মাথা। তারপর এক সময় আসে তার প্রতিক্রিয়া। সে শ্রান্ত হয়ে যেন মন্থর হয়ে পড়ে। শীতল হয়ে আসে। পিঙলারও সে সময়ের অবস্থা ঠিক তাই হয়েছিল। অবসাদে সে ভেঙে পড়ল। যেন। উত্তেজনার উপাদান তার ফুরিয়ে গিয়েছে।
একটু থেমে সেদিনের স্মৃতিপটের দিকে তাকিয়ে ভাল করে স্মরণ করে শিবরাম বলেন– বিশ্বপ্রকৃতিও যেন সেদিন পিঙলার কাহিনীর সঙ্গে বিচিত্রভাবে সাম্য রেখে অপরূপ পটভূমি রচনা। করেছিল।
ঊর্ধ্বাকাশে যে ঝড় চলছিল, সে ঝড় হিজল বিল পার হয়ে চলে গেল। গঙ্গার পশ্চিম কূলকে পিছনে রেখে গঙ্গা পার হয়ে পূর্ব দিকে চলে গেল। কালো মেঘের পুঞ্জ আবর্তিত হতে হতে প্রকৃতির কোন বিচিত্র প্রক্রিয়ায়—টুকরো টুকরো হয়ে দূরে দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ল ছিন্নপক্ষ জটায়ুর মত; কালো মেঘস্তরেরও পিছনে ছিল একটা সাদা মেঘের স্তর, তারই বুকে ভাসতে লাগল; এদিকে পশ্চিম দিগন্ত থেকে আবার একটা মেঘস্তর উঠে এগিয়ে আসছে। এ স্তরটা শূন্যমণ্ডলের নিচে নেমে এসেছে। ধূসর মন্থর একটি মেঘস্তর পশ্চিম থেকে আসছে, বিস্তীর্ণ হচ্ছে উত্তর-দক্ষিণে যেন জটায়ু দম্পতির কোনো অজ্ঞাতনামা সহোদর। সে তার বিশাল পক্ষ দুখানিকে। উত্তর এবং দক্ষিণে দিগন্ত পর্যন্ত আবৃত করে বেদনার্ত বুকে, চোখের জল ফেলতে ফেলতে চলেছে—ছিন্নপক্ষ জটায়ুর সন্ধানে। পাখার বাতাসে বাজছে তার শোকার্ত স্নায়ুমণ্ডলীর ধ্বনি, তার স্পর্শে রয়েছে শোকার্ত হৃদয়ের সরল আভাস, সজল শীতল মন্থর বাতাসে ভেসে আসছে ধূসর মেঘস্তরখানি। অতি মৃদু রিমিঝিমি বর্ষণ করে আসছে। কুয়াশার মত সে বৃষ্টি।
হিজলের সর্বত্র এই পরিবর্তিত রূপের প্রতিফলন জেগে উঠল। কিছুকাল পূর্বের ঝড়ের রুদ্রতাওবে জলে স্থলে ঝাউবনে ঘাসবনে মেশানো এই বিচিত্ৰ ভূমিখণ্ডের সর্বাঙ্গে—অকাল রাত্রির আসন্নতার মত যে কুটিল কৃষ্ণ ছায়া নেমেছিল, যে প্রচণ্ড আক্ষেপ জেগেছিল—ক্ষণিকে তার রূপান্তর হয়ে গেল।
শিবরামের মনে পড়ল মনসার ব্ৰতকথা।
কাহিনীর বণিক-কন্যা দক্ষিণ দুয়ার খুলে আতঙ্কে বিষনিশ্বাসে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ল; সে দেখল বিষহরির বিষম্ভরী রূপ–নাগাসনা, নাগভূষণা, বিষপানে কুটিলনো নাগকেশী—রুদ্ররূপ–বিষসমুদ্র উথলিত হচ্ছে। পড়ল সে ঢলে। মুহূর্তে মায়ের রূপের পরিবর্তন হল। দেবী এলেন শান্ত রূপে, সস্নেহ স্পৰ্শ বুলিয়ে জুড়িয়ে দিলেন বিষ বাতাসের জ্বালা।
হিজলবিলের জলে ঢেউ উঠেছিল। তার রঙ হয়েছিল বিষের মত নীল।
এখন সেখানে ঢেউ থেমে গিয়েছে, থরথর করে কাঁপছে, রঙ হয়েছে ধূসর, যেন কোনো তপস্বিনীর তৈলহীন রুক্ষ কোঁকড়ানো একরাশি চুলতার শোভায় উদাস বিষণ্ণতা। ঝাউবনের ঘাসবনের মাথাগুলি আর প্রবল আন্দোলনে আছড়ে পড়ছে না, স্থির হয়েছে, কাঁপছে, মন্থর শেশো শব্দ উঠছে বিষ দীর্ঘনিশ্বাসের মত।
পিঙলা ক্লান্ত দেহে শুয়ে পড়ল ঘাসবনের উপর। মুখে তার ফিনফিনে বৃষ্টির ধারা ঝরে। পড়ছিল। সে চোখ বুজে বললে—আঃ, দেহখানা জুড়াল গ।
সত্যই দেহ যেন জুড়িয়ে যাচ্ছিল। জ্যৈষ্ঠের সারাদিনের প্রচণ্ড উত্তাপের পর এই ঠাণ্ডা বাতাসে ও ফিনফিনে বৃষ্টিতে শিবরামও আরামে চোখ বুজলেন। এ বর্ষণসিঞ্চনে যেন একটি মাধুরীর স্পর্শ আছে।
—এইবারে দুখিনী বহিনের, মন্দভাগিনী বেদের কন্যের, গোপন দুখটা শুন আমার ধরম ভাই; শবলাদিদি গঙ্গার কূলে দাঁড়ায়ে বিষহরিরে সাক্ষী রেখ্যা তুমার সাথে ভাইবহিন সম্বন্ধ পাতালছে। আমাকে বল্যা গেছে, যে-দুখের কথা কারুকে বুলতে আরবি, সে কথা বুলিস ওই ভাইকে। বুকের আঙার বুকে রাখিলি বুক পোড়ায়, অন্যেরে দিলি পরে ওই আঙার তুর ঘরে গিয়া তুকেই পুড়ায়ে মারে। ই আঙার দিবার এক ঠাঁই হল বিষহরির চরণ। তা বিষহরি নিদয়া হছেন, দেখা যায় না। আর ঠাঁই! মই অ্যানেক ছুঁড়ে ছুঁড়ে এই ঠাঁই পেয়েছি রে পিঙলা, ওই ধরম-ভাইয়ের ঠাঁই;এই আঙার তারে দিস, তুর পুরানটা জুড়াবে, কিন্তুক অনিষ্ট হবে নাই। আমার বুকের আঙার তুমি লাও, ধর ভাই।
পিঙলার ঠোঁট দুটি থরথর করে কেঁপে উঠল। চোখের কোণে কোণে জল টলমল করে উঠল। সে স্তব্ধ হয়ে গেল। আবেগে সে আর বলতে পারছিল না।
অপেক্ষা করে রইলেন শিবরাম। অন্তরে অন্তরে শিউরে উঠলেন। কি বলবে পিঙলা? সে কি তবে দেহ-প্রবৃত্তির তাড়নায় নাগিনী কন্যের ধর্ম বিসর্জন দিলে—?
সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল, শবলা তাকে একদিন বলেছিল-নাগিনী কন্যাদের প্রবৃত্তি যখন উগ্র হয়ে ওঠে, তখন তারা উন্মাদিনীর মত নিশীথ রাত্রে ঘুরে বেড়ায় হিজলের ঘাসবনে। কখনও বাঘের হাতে জীবন যায়, আর কখনও হাঙরমুখীর খালে শিকার প্রতীক্ষণ কুমির অতর্কিতে পায়ে ধরে টেনে নেয়; নিশীথ রাত্রে হিজলের কূলে শুধু একটা আর্ত চিৎকার জেগে ওঠে। পরের দিন থেকে নাগিনী কন্যাদের সন্ধান মেলে না। আবার কোনো নাগিনী কন্যা শোনে বশির সুর। দূরে হিজলের মাঠে চাষীরা কুঁড়ে বেঁধে থাকে, মহিষগরুর বাথান দিয়ে থাকে শেখেরা ঘোষেরা, তারাই বাঁশি বাজায়। সে বাঁশি শুনে নাগিনী কন্যা এগিয়ে যায়, সুরের পথ ধরে।
শবলা বলেছিল—তার থেক্যা বড় সৰ্ব্বনাশ আর য় না ধরম-ভাই। সেই হইল মাবিষহরির অভিশাপ! তাতে হয় পরানটা যায়—লয় ধরম যায়, জাতি যায়, কুল যায়।
পিঙলা আত্মসংবরণ করে চোখের জল মুছলে, তারপর অতি মৃদুস্বরে বললে; এখানে এই জনহীন হিজল বিলের বিষহরির ঘাটে স্বর মৃদু করবার প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু পিঙলার বোধহয় কীটপতঙ্গ, পশুপাখি, গাছপাতাকেও ভয়, তাই বোধহয় মৃদুস্বরে বললে—কিন্তুক ভাই, এইবার যে আমার বুকে চাপা ফুল ফুটল।
চমকে উঠলেন শিবরাম।
পিঙলা বললে—আমার ঘরে, রাত্রি দুপহরে, চঁপার ফুলের বাস ওঠে। ঘরটা যেন ভরা যায় ভাই। মুই থরথর করা কাঁপতে থাকি। পেথম যেদিন ঘানটা নাকে ঢুকল ভাই, সেদিন মুই যেন পাগল হয়্যা গেলছিলম। ঠিক তখুন রাত দুপহর। হিজলের মাঠে শিয়ালগুলান ডেক্যা উঠিল, সাঁতালীর পশ্চিম দিকে রাঢ়ের পথটার দুধারের তালগাছের মাথায় মাথায় পেঁচা ডেকে ই গাছ থেক্যা উ গাছে গিয়া বসিল। সাঁতালীর উত্তরে হুইখানে আছে বাদুড়ঝুলির বটগাছ, শ দরুনে বাদুড় সেথা দিনরাত্রি ঝুলে, চা-চঁ্যা রবে চিল্লায়, সেগুলান জোরে চোচায়ে রব তুল্যা, একবার পাখা ঝটপট কর্যা আকাশে পাক খেলে। ঘরের মধ্যে ঝাপিতে সাপগুলান বারকয়েক ফুঁসায়ে উঠল। মুই পোড়াকপালী, আমার চোখে ঘুম বড় আসে না ধরম-ভাই। সেই যে বাবুদের বাড়ি থেক্যা ফিরলম—মোর মধ্যে কালনাগিনীর জাগরণ হইল, সেই থেক্যাই ঘুম আমার নাই। তারপরেতে ঠাকুর এল, বল্যা গেল—আমার খালাস নিয়া আসবেক; তখন থেক্যা বিদায় দিছি ঘুমেরে; ঘরে পড়া থাকি, পহর গুনি, কান পেত্যা শুনি কত দূরে উঠিছে পায়ের ধ্বনি। সেদিনে আপনমনে জেগ্যা জেগাই ওই ভাবনা ভাবছিলম। দুপহর এল, মনে মনে পেনাম করলম বিষহরিরে। এমন সময়, ধরমভাই
আবার কাঁপতে লাগল পিঙলার ঠোঁট। সকরুণ সজল দৃষ্টিতে সে শিবরামের দিকে তাকিয়ে রইল। তেজস্বিনী মেয়েটি যেন তেজশক্তি সব হারিয়ে ফেলে একান্ত অসহায়ভাবে শিবরামের কাছে আশ্বাস ভিক্ষা করছে—সাহস প্রার্থনা করছে।
ঠিক সেই মধ্যরাত্রির লগ্নটিতে নাগিনী কন্যা যদি জেগে থাকে, তবে তাকে উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে মনে মনে বিষহরিকে ডাকতে হয়। ওই লগ্ন নাগিনী কন্যার বুকে নিশির নেশা জাগিয়ে তোলে। কুহকমায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে সে—এই বেদেদের বিশ্বাস।
খাঁচায় বন্দি বাঘকে দেখেছ মধ্যরাত্রে? এই লগ্নে? রাত্রির স্তব্ধতা ভঙ্গ করে নিশিঘোষণা বেজে ওঠে দিকে দিকে, খাঁচার ঘুমন্ত বাঘ চকিত হয়ে জেগে ওঠে, ঘাড় তুলে রাত্রির অন্ধকারের দিকে তাকায়, আকাশের দিকে তাকায়, সে দৃষ্টি স্থির অথচ উত্তেজনায় অধীর। মুহূৰ্তে মুহূর্তে চোখের তারা বিস্ফারিত হয়, আবার সঙ্কুচিত হয়।
ঠিক তেমনি নিশির মায়ার উত্তেজনায় নাগিনী কন্যাও আত্মহারা হয়। সাঁতালীর বিষবেদেদের কুলশাসনের বিধিবিধানে বারবার করে কন্যাকে বলেছে—এই লগ্নে, হে কন্যা, তুমি সাবধান। যদি জেগে থাক, তবে মাটি অ্যাঁকড়ে পড়ে থাকবে, মনে মনে মাকে স্মরণ করবে।—কদাচ উঠো না, কদাচ উঠো না।
রাত্রির দ্বিপ্রহর এল সেদিন। রোজই আসে। ঘুম তো নাই পিঙলার চোখে। অনন্ত ভাবনা তার মনে। সে ভাবে-নাগিনী কন্যার ঋণের কথা, সে হিসাব করে জন্ম জন্ম ধরে কত নাগিনী কন্যা সাঁতালীর বেদেকুলে জন্ম নিয়ে কত পূজা বিষহরিকে দিয়েছে, আজন্ম পতি-পুত্র ঘর-সংসারে বঞ্চিত থেকে ব্ৰত তপস্যা করে বেদেকুলের মায়াবিনী কুহকিনী কন্যা-বধূদের সকল স্থলনের পাপ ধুয়ে মুছে দিয়েছে। বেদেকুলের মান-মর্যাদা রেখেছে। তবু কি শোধ হয় নাই দেনা?
শোধের সংবাদ নিয়ে আসবে নাগু ঠাকুর। শোধ না হলে তো তার ফিরবার পথ নাই।
কাহিনীতে আছে নদীর জলে ভেসে যায় সোনার চাপা ফুল। রাজা পণ করেছেন, ওই চাপার গাছ তাকে যে এনে দেবে তাকেই দেবেন তার নন্দিনীকে। রাজনন্দিনীকে রেখেছেন সাতমহলার শেষ মহলায়, মহলায় মহলায় পাহারা দেয় হাজার প্রহরী। রাজপুত্ররা আসেতারা কন্যাকে দেখে, তারপর চলে যায় তারা নদীর কূলে কূলে; কোথায় কোন কূলে আছে সোনার চাপার গাছ; চলে চলে—তারপর তারা হারিয়ে যায়, পিছনের পথ মুছে যায়। সোনার চাপার গাছ যে পাবে খুঁজে, সে-ই পাবে ফিরবার পথ। পিঙলার কাহিনীও যে ঠিক সেই রকম।
ঠাকুর কি ফিরবার পথ পাবে?
এমন সময় এল ওই মধ্যরাত্রির ক্ষণ। পিঙলা চকিত হয়ে উপুড় হয়ে শুল। মনে মনে স্মরণ করলে বিষহরিকে। সঙ্গে সঙ্গে বললে—মুক্তি দাও মা, দেনা শোধ কর জননী।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে সে।
সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠল। এ কি? এ কিসের গন্ধ?
দীর্ঘনিশ্বাসের সঙ্গে একটি মিষ্ট মধুর গন্ধে তার বুক ভরে গেল। শ্বাস আর বিষণ্ণ আক্ষেপে সে ফেলতে পারলে না; শ্বাসরুদ্ধ করে সে চমকে মাথা তুললে। ফুলের গন্ধ! চাপার গন্ধ! কোথা থেকে এল? নিশ্বাস ফেলে সে আবার শ্বাস গ্রহণ করলে। আবার মধুর গন্ধে বুক ভরে গেল।
ধড়মড় করে সে উঠে বসল।
কোথা থেকে আসছে এ গন্ধ? তবে কি? সে বার বার এঁকে দেখলে নিজের দেহ। গন্ধ আসছে, কিন্তু সে কি তার দেহ থেকে? না তো!
সে তাড়াতাড়ি আলো জ্বাললে। চকমকি ঠুকে খড়ের নুটিতে ফুঁ দিয়ে আগুন জ্বলে নিমফল-পেষা তেলের পিদিম জ্বেলে চারিদিকে চেয়ে দেখলে। ধোঁয়ার গন্ধে ভরে উঠেছে খুপরি ঘরখানা, কিন্তু তার মধ্যেও উঠছে সেই মিষ্ট সুবাস।
কোথায় ফুটল চাপার ফুল?
সাঁতালীর কোথাও তো নাই চাপার গাছ। তবে?
তাড়াতাড়ি সে একটা ঝাপির উপর ঝুঁকে তঁকে দেখলে। ঝাঁপিটায় আছে একটা সাপিনী। কাঁপিতে বন্দি সাপিনীর অঙ্গে বাস বড় একটা ওঠে না; নাগিনীর মিলনের কালও এটা নয়; সে কাল আরম্ভ হবে বর্ষার শুরুতে; অম্বুবাচিতে মা-বসুমতী হবেন পুষ্পবতী, কামরূপে পাহাড়ের মাথায় মা-কামাখ্যা এলোচুলে বসবেন, আকাশ ঘিরে আসবে সাত সমুদ্রের জল নিয়ে সম্বর পুষ্কর মেঘের দল; মাকে স্নান করাবে। নদীতে নদীতে তার ঢেউ উঠবে। কেয়া গাছের কচি পাতার ঘেরের মধ্যে ফুলের কুঁড়ির মুখ উঁকি মারবে। সাপিনীর অঙ্গে অঙ্গে জাগবে আনন্দ। সে আনন্দ সুবাস হয়ে ছড়িয়ে পড়বে। চাপার গন্ধ! নাগকুল উল্লসিত হয়ে উঠবে।
সে কালও তো এ নয়। এ তে সবে চৈত্রের শেষ
গাজনের ঢাক বাজছে রাঢ়ের গায়ে গায়ে। শেষরাতে আজও বাতাস হিমেল হয়ে ওঠে; নাগ-নাগিনীর অঙ্গের জরার জড়তা আজও কাটে নাই। রাত্রির শেষ প্রহরে আজও তারা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। শিব উঠবেন গাজনে, তার অঙ্গের বিভূতির পরশ পেয়ে নাগ-নাগিনীর নবকলেবর হবে। নূতন বছর পড়বে; বৈশাখ আসবে, সাপ-সাপিনীর হবে নবযৌবন।
তবু সে ঝুঁকে পড়ে শুকলে সাপিনীর ঝাঁপিটা।
কোথায়? কই?—সেই চিরকেলে সাপের কটু গন্ধ উঠছে।
তবে এ গন্ধ কোথা থেকে আসছে? প্রদীপের সলতে উসকে দিয়ে আলোর শিখাকে উজ্জ্বলতর করে তুলে শঙ্কাতুর মনে দৃষ্টি বিস্ফারিত করে বসে রইল সে।
হঠাৎ একটা কথা তার মনে পড়ে গেল। আজই সন্ধ্যায় গঙ্গারাম কথাটা তাকে বলেছিল। তখন পিঙলা মুখ বেঁকিয়ে ঘেন্নার দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়েছিল, গঙ্গারাম বলেছিল—দু দিন ছিলম না, ইয়ার মধ্যে এ কি হল?
দুদিন আগে গঙ্গারাম গিয়েছিল শহরে। কামাখ্যা মায়ের ডাকিনীর কাছে গঙ্গারাম শুধু জাদুবিদ্যা মোহিনীবিদ্যা বাণবিদ্যাই শিখে আসে নি, চিকিৎসাবিদ্যাও জানে সে। বেদেদের চিকিৎসাবিদ্যা আছে, সে বিদ্যা জানে ভাদু নটবর নবীন। সাঁতালীর আশপাশের গাছ-গাছড়া নিয়ে সে চিকিৎসা। জন্তু-জানোয়ার তেল-হাড় নিয়ে সে চিকিৎসা। নাগিনী কন্যার কাছে আছে। জড়ি আর বিষহরির প্রসাদ নির্মাল্য, তাই দিয়ে কবচ মাদুলি নিয়ে সে চিকিৎসা। গঙ্গারামের চিকিৎসা অন্য রকম। ওষুধের মশলা সংগ্রহ করে আনে সে শহর-বাজারের দোকান থেকে। ধন্বন্তরিভাইদের কবিরাজি ওষুধের মত পচন বড়ি দেয়। বিশেষ করে জ্বর-জ্বালায় গঙ্গারামের ওষুধ খুব খাটে। সেই মশলা আনতে সে মধ্যে-মাঝে শহরে যায়। নিয়ে যায় শুশুকের তেল, বাঘের চর্বি, বাঘের পজর নখ, কুমিরের দাত, শজারুর কাটা আর নিয়ে যায় মা-মনসার অব্যর্থ ঘায়ের প্রলেপ মলম। নিয়ে আসে ওষুধের মশলা আর সঙ্গে চুড়ি, ফিতে, মাদুলীর খোল, পুঁতির মালা, সূচ-সুতো, বড়শি, ছুরি, কাটারি, কাঁকুই—হরেক রকম জিনিস। গঙ্গারাম শিরবেদে সাঁতালী গাঁয়ে নতুন নিয়ম প্রবর্তন করেছে—শিরবেদে হয়ে বেনেী বৃত্তি নিয়েছে।
ওই ব্যবসায়ে সে দুদিন আগে গিয়েছিল শহরে। ফিরেছে আজই সন্ধ্যায়। তখন মায়ের আটনের সামনে বেদেরা এসে জমেছে। হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে। ভাদু বাজাচ্ছে চিমটে, নটবর বাজাচ্ছে বিষম-ঢাকি;পিঙলা করছিল আরতি। গঙ্গারাম ফিরেই ধুলোপায়ে মায়ের থানে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। মায়ের আরতি শেষ করে সেই প্রদীপ নিয়ে বেদেদের দিকে ফিরিয়ে পিঙলা বার কয়েক ঘুরিয়ে নামিয়ে দিলে। বেদেরা একে একে সেই প্রদীপের শিখার তাপে হাতের তালু তাতিয়ে নিয়ে কপালে স্পর্শ নেবে। গঙ্গারামের প্রথম অধিকার। সে এসে যেন থমকে দাঁড়িয়ে গেল, ভুরু কুঁচকে বার দুয়েক ঘ্রাণ নেওয়ার মত ঘনঘন শ্বাস টেনে উঃ শব্দ করেছিল, তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলেছিল—এ কি? কিসের বাস উঠছে লাগছে যেন?
পিঙলার ঠোঁট দুটি বেঁকে গিয়েছিল এই কুটিল লোকটির প্রতি অবজ্ঞায়। চাপা রাগে নাকের ডগাটা ফুলে উঠেছিল, চোখের দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছিল ঘেন্না; সে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। তাকে কিছু বলতে হয় নাই; গঙ্গারামের পর অধিকার ভাদুর, সে এসে তাকে ঠেলা দিয়ে বলেছিল–বাস উঠছে তুর নাসায়। বাস উঠছে! আছিস শহর থেক্যা, পাকীমদ খেয়েছি তারই বাস তুর নাসাতে বাসা বেঁধে রইছে। লে, সর। ঢং করি না। পিদিম নিভিয়ে যাবে। দাঁড়ায়ে আছে গোটা পাড়ার মানুষ।
গঙ্গারাম ভাদুর দিকে কঠিন দৃষ্টিতে ফিরে চেয়ে প্রদীপের তাপ কপালে ঠেকিয়ে সরে গিয়েছিল। তার পর পিঙলা লক্ষ্য করেছিল—সে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ক্রমাগত শ্বাস টেনে কিসের গন্ধ নিচ্ছে।
যাবার সময় পিঙলার দিকে তাকিয়ে একটু যেন ঘাড় দুলিয়ে কিছু বলে গিয়েছে। শাসন, সন্দেহ, তার সঙ্গে যেন আরও কিছু ছিল।
পিঙলার ঠোঁট দুটি আবার বেঁকে গিয়েছিল।
এই নিশীথ রাত্রে এই ক্ষণটিতে হঠাৎ সেই কথা পিঙলার মনে পড়ে গেল। তবে কি তখন গঙ্গারাম এই গন্ধের আভাস পেয়েছিল? গঙ্গারাম পাপী, সে ভ্ৰষ্ট, সে ব্যভিচারী। জটিল তার চরিত্র, কুটিল তার প্রকৃতি। সে ডোমন-করেত। বেদেপাড়ায় সে অবাধে চালিয়ে চলেছে তার পাপ। কিন্তু এক ভাদু ছাড়া বেদেদের আর কেউ তাকে কিছু বলতে সাহস করে না। আর পারে পিঙলা। আজ দীর্ঘ দশ বছর সে তার সঙ্গে লড়াই করে আসছে। কিন্তু এতদিন কিছু করতে পারে নাই। এইবার তার জাগরণের পরে আশা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বেদেপাড়াতেও খানিকটা সাহস দেখা দিয়েছে। তার জাগরণের ছোঁয়ায় তারাও যেন জেগেছে। ভাদুর সঙ্গে তারা দু-তিনবার গঙ্গারামের কথার উপর কথা বলেছে। কিন্তু গঙ্গারামের বাঁধন বড় জটিল। বেদেপাড়াকে সে শুধু শাসনের দড়িতে বাধে নাই, তার সঙ্গে বেঁধেছে পয়সার দড়িতে কিনেছে ধারের কড়িতে। গঙ্গারাম টাকা-পয়সা ধার দেয়। সুদ আদায় করে। মহাদেব শিরবেদেকে পিঙলার মনে আছে। সে কথায় কথায় টুঁটি টিপে ধরত। গঙ্গারাম তা ধরে না। গঙ্গারাম মানুষের ঘাড় নুইয়ে ধারের পাথর চাপিয়ে দেয়। মানুষ মাটির দিক ছাড়া মুখের দিকে চোখ তুলতে পারে না। এই সুযোগে গঙ্গারাম বেদেদের ঘরে ঘরে অবাধে চালিয়ে যায় তার ব্যভিচার। এ আচার বেদেদের মধ্যে চিরকাল আছে। বেদের কন্যে অবিশ্বাসিনী, বেদের কন্যে মিথ্যাবাদিনী, বেদের কন্যে পোড়াকপালী, পোড়ারমুখী, তার রঙ কালো; কিন্তু তারও উপর সে কালামুখী। বেদের কন্যে কুহকিনী। বেদের কন্যের আচার মন্দ; সে বিচারভ্রষ্টা। বেদের পুরুষও তাই। তবু এমন ছিল না কোনো কালে। সাঁতালীর পাপের বোঝা সকল পাপ চিরকাল নাগিনী কন্যের দুঃখের দহনে। পুড়ে ছাই হয়েছে; তার চোখের জলে সকল কালি ধুয়ে গিয়েছে। এবার গঙ্গারামের পাপের বোঝা হয়ে উঠেছে পাহাড়, তাই তার জীবনে এত জ্বালা। এত জ্বালাতেও কিন্তু সে পাপের পাহাড় পুড়ে শেষ হচ্ছে না। তাই সময় সময় পাগলের মত হয়ে সে, অজ্ঞান হয়ে পড়ে। বুকের নাগিনী তার মুখ দিয়ে বলে—বিচার কর মা, বিচার কর। মুক্তি দাও। বলে—আমার মুক্তি হোক বা না হোক, ওই পাপীকে শেষ কর। কত দিন মনে মনে সংকল্প করেছে—শেষ পর্যন্ত নিজে সে মরবে, কিন্তু ওই পাপীকে সে শেষ করবে।
সেই পাপী গঙ্গারাম, সে কি সন্ধান পেয়েছিল এই গন্ধের?
পাপী হলেও সে শিরবেদে। শিরবেদের আসনের গুণে পেয়েছিল হয়ত। ভোজরাজার আসন। ছিল, সে আসনে যে বসত সে-ই তখন হয়ে উঠত রাজার মত গুণী। তার উপর গঙ্গারাম ডাকিনীবিদ্যা জানে।
সে জেনেছে, সে বুঝেছে, সে এ গন্ধের আভাস পেয়েছে সব চেয়ে আগে। তার অঙ্গে গন্ধের সন্ধান সে নিজেও পায় নাই—শিরবেদেই পেয়েছে তার আসনের গুণে।
সমস্ত রাত্রি সে আলো জ্বলে বসে রইল। সকালবেলা আবার একবার তনুতন্ন করে খুঁজলে ঘর। কিসের গন্ধ! কোথা থেকে আসছে গন্ধ! গন্ধ রয়েছে ঘরে, কিন্তু কোথা থেকে উঠছে বা আসছে বুঝতে পারলে না। ঘর বন্ধ করে ছুটে এসে পড়ল বিলের জলে। সর্বাঙ্গ ধুয়ে সে ঘরে ফিরল। ঘরে তখনও গন্ধ উঠছে। তবে ক্ষীণ হয়ে এসেছে।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ঘরের দাওয়ার উপর শুয়ে অঙ্গ এলিয়ে দিলে। ঘুমিয়ে পড়ল।
আবার।
পরদিন মধ্যরাত্রিতে আবার উঠল গন্ধ।
পিঙলা ধড়মড় করে উঠে বসল। আলো জ্বাললে। মদির গন্ধে ঘর ভরে উঠেছে। তার নিশ্বাস যেন রুদ্ধ হয়ে আসছে। চাপা ফুল কোথায় ফুটেছে? তার বুকে? নইলে এই লগ্নে কেন উঠছে সে গন্ধ?
উন্মাদিনীর মত সে নিজেই নিজের দেহগন্ধের শ্বাস টানতে লাগল। কিছু বুঝতে পারলে না, কিন্তু আছাড় খেয়ে মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে ডাকলে দেবতাকে।
আমার পাপ তুমি হরণ কর জননী, কন্যের শরম তুমি ঢাক মা। ঢেক্যা দাও! মুখ রাখ।
—মনে মনে শুধু জনীরেই ডাকি নাই ধন্বন্তরিভাই। তারেও ডাকি।
শীর্ণ মুখ তার চোখের জলে ভিজে গিয়েছিল। শিবরামের চোখেও জল এসেছিল। বায়ুরোগপীড়িতা মেয়েটির কষ্টের যে অন্ত নাই, মস্তিষ্ক থেকে হৃদপিণ্ড পর্যন্ত অহরহ এই যন্ত্রণায় নিপীড়িত হচ্ছে, সে তথ্য ধূর্জটি কবিরাজের শিষ্যটির অনুমান করতে ভুল হয় নাই এবং সে যন্ত্রণার পরিমাণও তিনি অনুভব করতে পারছিলেন। সেই অনুভূতির জন্যই চোখের পাতা সিক্ত হয়ে উঠেছিল তার।
চোখের জলে অভিষিক্ত বেদনার্ত শীর্ণ মুখে একটা হাসি ফুটে উঠল। পিঙলা বললে—তারে ডাকি। গু ঠাকুরকে। সে যদি মুক্তির আদেশ আনে, তবে তো মুই বাঁচলাম। লইলে মরণ। আমার বুকে চাপ ফুল ফুটিছে, ই লাজের কথা দশে জানার আগে মুই মরব। কিন্তুক আগুন জ্বালায়ে যাব। আগুন জ্বালাব নিজের অঙ্গে, সেই আগুনে–
পিঙলার দু পাটি দাঁত সেই মেঘছায়াচ্ছন্ন অপরাহ্রে কালো মুখের মধ্যে বিদ্যুতের মত ঝলকে উঠল। শিবরাম আশঙ্কা করলেন, এইবার হয়ত চিৎকার করে উঠবে পিঙলা। কিন্তু তা করলে না সে। উদাস নেতে চেয়ে রইল সম্মুখের মেঘমেদুর আকাশের দিকে। কিছুক্ষণ পর সে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে উঠল। বললে—দুখিনী বহিনের কথা শুনলা ভাই; যদি শুন, বহিন মরেছে তবে অভাগিনীর তরে কাঁদিও। আর যদি মুক্তি আসে–
একটি প্রসন্ন হাসিতে তার শীর্ণ মুখখানি উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। বললে—দেখা করিব। তুমার সাথে দেখা করিব। মুক্তি আসিলে তোমার সাথে দেখা করিব। এখুন যাও ভাই, আপন লায়ে। মুই জলে নামিব।
এতক্ষণ অভিভূতের মতই বসে ছিলেন শিবরাম। চিকিৎসকের কৌতুহল আর ওই বন্য আদিম মানুষের একটি কন্যার অন্ধ-সংস্কারাচ্ছন্ন জীবন-কাহিনীর বৈচিত্র্য তাকে প্রায় মুগ্ধ করে রেখেছিল। শেষ হতেই দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে তিনি উঠলেন।
একদিন সে দিনের খুব দেরি নাই—পিঙলার মস্তিষ্কের কুপিত বায়ু হতভাগিনীকে বদ্ধ উন্মাদ করে তুলবে। সর্বত্র এবং অহরহ সে অনুভব করবে চাপার গন্ধ। শঙ্কিত ত্রস্ত হয়ে সে গভীর নির্জনে লুকিয়ে থাকবে। হয়ত ওই কল্পিত গন্ধ ঢাকবার জন্য দুর্গন্ধময় পঙ্ককে মাখবে চন্দনের মত আগ্ৰহে।
ভাই। অ ধন্বন্তরিভাই! পিছন থেকে ডাকলে পিঙলা। কণ্ঠস্বরে তার উত্তেজনা—উল্লাস।
ফিরলেন শিবরাম। দেখলেন, দ্রুতপদে প্রায় ছুটে চলেছে পিঙলা। পিঙলা আবার একবার মুহূর্তের জন্য মুখ ফিরিয়ে বললে—যাইও না। দাঁড়াও।
সে একটা ঘন জঙ্গলের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। শিবরাম ভ্রূ কুঞ্চিত করে দাঁড়িয়ে রইলেন। কি হল? মেয়েটা শেষ পর্যন্ত তাকেও পাগল করে তুলবে?
কিছুক্ষণ পর পিঙলা আবার বেরিয়ে এল জঙ্গলের আড়াল থেকে। তার হাতে ঝুলছে একটি কালো সাপ-সত্যকারের লক্ষণযুক্ত কৃষ্ণসর্প।
–মিলেছে ভাই; মা-বিষহরি আমার কথা শুনিছেন। মিলিবে—আরও মিলিবে।
পিঙলা নামল জলে। শিবরাম ফিরলেন বেদেপাড়ায়।
বেদেপাড়ায় তখন কোলাহল উঠছে। গঙ্গায় শুশুক পেয়েছে দুটো। গঙ্গারাম তার হলদে। দাঁতগুলি বার করে বললে—যাত্যা তুমার ভাল কবিরাজ। শুশুকের ত্যাল, কালোসাপ অ্যানেক। মিলিল এক যাত্যায়।
বিদায়ের সময় পিঙলা ঘাটের উপর দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখে জল টলমল করছিল, ঠোঁট দুটি কাঁপছিল। তারই মধ্যে ফুটেছিল এক টুকরা হাসি।
শিবরাম বললেন–এবার কিন্তু আমার ওখানে যাবে তোমরা! যেমন যেতে গুরুর ওখানে। আমাকে বিষ দিয়ে আসবে।
গঙ্গারাম বললে—উ কন্যে তো আর যাবে নাই ধন্বন্তরি, উয়ার তো মুক্তি আসিছে। হুই। রাঢ়ের পথ দিয়া ঠাকুর গেলছে মুক্তি আনিতে। না, কি গ কন্যে?
পিঙলা লেজ-মাড়ানো সাপিনীর মত ঘুরে দাঁড়াল।
গঙ্গারাম কিন্তু চঞ্চল হল না, সে হেসে বললে আসিছে, সে আসিছে। চাপা ফুলের মালা গলায় পর্যা সে আসিছে। মুই তার বাস পাই যেন!
স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইল পিঙলা।
শিবরামের নৌকা মোড় ফিরল, হাঙরমুখীর খাল থেকে কুমিরখালার নালায় গিয়ে পড়ল। সোত এখানে অগভীর-সন্তৰ্পণে চলল নৌকা। শিবরাম ছইয়ের পরে বসে ছিলেন। পিঙলাকে আর দেখা গেল না। শিবরাম একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। পিঙলার সঙ্গে আর দেখা হবে না। হয়ত মাস কয়েকের মধ্যেই রুদ্ধ কুপিত বায়ু কালবৈশাখীর ঝড়ের মত বেগে আলোড়ন তুলবে, জীবনটাকে তার বিপর্যস্ত করে দেবে। উন্মাদ পাগল হয়ে যাবে হতভাগিনী।
শিবরামের ভুল হয় নাই। পিঙলার সঙ্গে আর তার দেখা হয় নাই। কিন্তু আশ্চর্য, তার চিকিৎসকের অনুমান ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে। পিঙলা পাগল হয় নাই।