Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নবীগঞ্জের দৈত্য || Shirshendu Mukhopadhyay » Page 3

নবীগঞ্জের দৈত্য || Shirshendu Mukhopadhyay

নবীগঞ্জে হইচই

ভোর হতে-না-হতেই নবীগঞ্জে হইচই পড়ে গেল। কেউ বলে ভূত, কেউ বলে ডাকাত, কেউ বলে রাক্ষস, কেউ বলে যমদূত। মাধব ঘোষাল গাঁয়ের সবচেয়ে বিচক্ষণ মানুষ, সবাই তাঁকে গাঁয়ের মাতব্বর বলে মানে।

ভোরবেলা নবীগঞ্জের লোক এসে সব জড়ো হল মাধব ঘোষালের বৈঠকখানায়। যারা দেখেছে তারাও, যারা শুনেছে তারাও।

হারু ভটচাজ বলল, “নবীগঞ্জে অভাব-অভিযোগ মেলা আছে বটে, কিন্তু রাক্ষসের উৎপাত কোনওকালে ছিল না। বিজ্ঞানের এই অগ্রগতির যুগে রাক্ষসটা এল কোত্থেকে তাই ভাবছি। এ তো বড় চিন্তার কথা হল ঘোষালমশাই।”

ভজনলাল বলে উঠল, “উ তো সবাইকে খেয়ে লিবে। হামাকেই খেয়ে বিচ্ছিল। তো হামি হাতজোড় করে বললাম, ‘রাক্ষসজি, একটু বইসুন, আমি থোড়া ডাল-রোটি খেয়ে লেই, তারপর যদি আপনি আমাকে খান তো খেতে মিষ্টি লাগবে।”

পাঁচু একটু পেছনে ছিল। সে বলল, “রাক্ষস-টাক্ষস নয়, আমার সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। ঘোষালজ্যাঠা, আমার মনে হয় এ হল বিভীষণ। বিভীষণের তো মৃত্যু নেই। কোথাও ঘাপটি মেরে ছিল এতদিন। হঠাৎ বেরিয়ে এসেছে। তবে কাকে যেন খুঁজছিল। ঠিক বুঝতে পারলাম না।”

ভজনলাল বলল, “ও বাত ঠিক। রাক্ষসজি কাউকে টুড়ছে।”

হঠাৎ রাস্তা দিয়ে দৌড়তে-দৌড়তে এসে দুঃখবাবু ভিড় ঠেলে ঢুকলেন। হাঁফাতে-হাঁফাতে বললেন, “একটা কথা টক করে বলে দিয়ে যাই ঘোষালমশাই, ভূতটা কাতুকুতু পছন্দ করে না। একটা বেঁটে, মোটা, লম্বা, রোগা, ফরসা আর কালো লোককে খুঁজে বেড়াচ্ছে। খুবই জটিল ব্যাপার। কিন্তু আমার আর দাঁড়ানোর সময় নেই! উঃ…ওই আবার গাঁট্টা পড়ল। যাই…।”

সকাল থেকে কান ফের বন্ধ হয়ে গেছে পুঁটে সর্দারের। লোকের মুখ দেখে বক্তব্য অনুমান করার চেষ্টা করতে করতে সে বলল, “যমদূত বাবাজিকে কাল রাতে এমন ঠকান ঠকিয়েছি যে, আর বলার নয়। ধরে নিয়ে যাচ্ছিল আর কি! মুখে-মুখে হিসেব কষে দেখিয়ে দিলাম যে, আমার মরার বয়সই হয়নি। তখন আর রা কাড়ে না। মিনমিন করে বলল, ‘যাই হোক একটা ধরে নিয়ে যেতেই হবে, নইলে যমরাজা রেগে যাবেন। কিন্তু কাকে যে নিয়ে গেল, বুঝতে পারছি না! সকালে উঠে সারা নবীগঞ্জে টহল দিয়ে দেখলাম, সবাই দিব্যি বেঁচেবর্তে আছে।”

হরিহর পণ্ডিত মাথার ঘাম মুছে বলল, “খুব ফাঁড়াটা গেছে রাত্তিরে। গাছে উঠে বসে আছি, তাতেও নিস্তার নেই। গাছ ধরে এমন ঝাঁকাচ্ছিল যে, পাকা আমটির মতো আমার খসে পড়ার কথা। গায়ত্রী জপ করতে থাকায় পড়িনি।”

নয়ন বোস একটা আংটি অদৃশ্য করে হাতের তেলোয় একটা বলের আবির্ভাব ঘটিয়ে বলল, “আমার জানলার শিক তো বেঁকিয়েই ফেলেছিল প্রায়। আমি তাকে হিপনোটাইজ করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু ব্যাটা খুব চালাক। আমার চোখে ভয়ে চোখই রাখছিল না।”

হাবু ঘোষ একটু খেচিয়ে উঠে বলল, “আর কেরানি দেখিও না। তাকে দেখে তো মূর্ছা গিয়েছিলে।”

নয়ন গম্ভীর হয়ে বলল, “আপনি ওসব বুঝবেন না। হিপনোটাইজ করার চেষ্টা করেও যদি না পারা যায় তা হলে সেটা নিজের ওপরেই বর্তায়। ওকে বলে হিপনোটিক ব্যাকল্যাশ। সোজা কথা, আমি নিজের হিপনোটিজমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম।”

হাবু ঘোষ গরম হয়ে বলল, “দ্যাখো, কথায় কথায় ইংরেজিতে গালমন্দ কোরো না। রাসকেল, ইডিয়ট বলল ঠিক আছে। সে তবু সওয়া যায়। কিন্তু ওই ব্যাকল্যাশ-ট্যাকল্যাশ খুব খারাপ কথা।”

ইতিমধ্যে ভিড় দেখে হরিদাস চিনেবাদাম ফিরি করতে চলে এসেছে। পঞ্চানন চায়ের কেটলি আর ভাঁড় নিয়ে এসে চা বিক্রি করতে লেগেছে। বাউল চরণদাস গান গেয়ে ভিক্ষে চাইছে।

মাধব ঘোষাল খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললেন, “এত মানুষ যখন তাকে দেখেছে তখন ঘটনাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু লোকটা গেল কোথায়? ভাল করে খোঁজা হয়েছে?”

সবাই প্রায় সমস্বরে জানাল যে, সারা গাঁ আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও তাকে পাওয়া যায়নি।

মাধব ঘোষাল চিন্তিত মুখে বললেন, “আপনারা সবাই বাড়ি যান। রাতে সবাই মিলে পালা করে গাঁ পাহারা দিতে হবে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, রাক্ষস, খোকস, দৈত্য, দানো যেই হোক, ক্ষতি করার হলে কাল রাতেই করত। তা যখন করেনি তখন ভয় পাওয়ার দরকার নেই। একটু সাবধান থাকলেই হবে।”

ধীরে-ধীরে সবাই চলে গেল। কিন্তু মাধব ঘোষালের কপাল থেকে দুশ্চিন্তার রেখাগুলো মুছল না। তিনি উঠে ধুতি-জামা পরলেন। তারপর খিড়কির দরজা দিয়ে বেরোলেন।

মাধব ঘোষাল জানেন, গাঁয়ের লোক সব জায়গায় খুঁজলেও একটা জায়গায় খোঁজেনি, সেই জায়গাটার কথা কারও মাথাতেও আসবে না। সেটা হল রাজবাড়ি।

আর কেউ না গেলেও রাজবাড়িতে মাধব ঘোষালের যাতায়াত আছে। তাঁর পূর্বপুরুষেরা রাজবাড়ির কুলপুরোহিত ছিলেন। এখন সেই প্রথা উঠে গেলেও সম্পর্কটা বজায় আছে। মাধব বীরচন্দ্রকে খুবই স্নেহ করেন। বীরচন্দ্রের অনেক গুণ, কিন্তু মুখচোরা আর লাজুক বলে জীবনে তেমন কিছুই করতে পারেনি, শুধু বীণা বাজায়। মাধবের ভয় হচ্ছিল, দৈত্য বা দানো যেই হোক সে বীরচন্দ্রের কোনও ক্ষতি করেনি তো!

একটু ঘুরপথে লোকের চোখ এড়িয়ে মাধব এসে রাজবাড়িতে ঢুকলেন।

ভুজঙ্গ হালদার আজও বাজারে যাচ্ছিলেন। মাধবকে দেখে তটস্থ হয়ে বললেন, “পরেশ ভটচাজমশাই যে! ভাল আছেন তো!”

মাধব ঘোষাল একটু হেসে বললেন, “ভালই আছি হে ভুজঙ্গ। তা তোমাদের খবরটবর কী?”

ভুজঙ্গ ঠোঁট উলটে বললেন, “খবর আর কি? সেই থোড়বড়ি-খাড়া। ডাল-চচ্চড়ি খেয়ে কোনওরকমে বেঁচে থাকা। আজ আবার যজ্ঞিবাড়ির বাজারের হুকুম হয়েছে। কে জানে বাবা কারা খাবে। তা রাজামশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এলেন নাকি নগেনবাবু? যান ওপরে চলে যান।”

মাধব ঘোষাল বুঝলেন, তাঁর অনুমানই ঠিক। এখানেই আছে। নইলে মোটা বাজারের হুকুম হত না। চারদিকটা চেয়ে দেখলেন মাধব। একসময়ে রাজবাড়িটা ছিল বিশাল। এখন সামনের মহলটা ভেঙে পড়ে ভগ্নস্তূপ হয়ে আছে। অন্দরমহলের অনেকটাই ভাঙাচোরা। আগে এই রাজবাড়ির কত জাঁকজমক ছিল। হাতিশাল, আস্তাবল, গোয়াল। সেপাই-সান্ত্রি, দাস-দাসী। নহবতখানা থেকে রোজ সকালে শিঙা বাজত। তার এখন কিছুই নেই। বীরচন্দ্র খুবই কায়ক্লেশে থাকে। ভাল করে খাওয়া জোটে না, নতুন পোশাক কেনার সামর্থ্য নেই বলে ছেঁড়া-ময়লা পরে থাকে। বীরচন্দ্র মাধবকে কয়েকবারই বলেছে, আমার যদি টাকা থাকত তা হলে বাবুগিরি না করে আমি এই নবীগঞ্জের উন্নতি করতাম।

মাধব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মহল্লায় গিয়ে ঢুকলেন। তারপর ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলেন।

দোতলার বিশাল বৈঠকখানায় বীরচন্দ্র একা বসে বিষমুখে কী যেন ভাবছিল। মাধবকে দেখে তটস্থ হয়ে উঠে দাঁড়াল, “আসুন জ্যাঠামশাই।”

মাধব স্বস্তিবাচন উচ্চারণ করে বললেন, “তোমার কাছে একটা বিশেষ দরকারে এলাম। কাল রাতে কি কোনও ঘটনা ঘটেছে? সারা গাঁয়ে তো হুলুস্থুল পড়ে গেছে, গাঁয়ে নাকি একটা রাক্ষস বা দানো বা ভূত কিছু একটা ঢুকেছে। অনেকেই দেখেছে তাকে।”

বীরচন্দ্র একটু হাসল। বলল, “সবাই খুব ভয় পেয়েছে বুঝি?”

“ভীষণ, সারা গাঁয়ে এখন ওই একটাই আলোচনা।”

বীরচন্দ্র ফের বিষণ্ণ হয়ে বলল, “ভয় পেলে লোকে ভুল দেখে। ভাল করে লক্ষ করলে বুঝতে পারত, লোকটা দৈত্য, দানো, অপদেবতা কিছুই নয়, তবে খুব বড়সড় চেহারার একজন মানুষ!”

“সে কি তোমার কাছে আছে এখন?”

বীরচন্দ্র মাথা নেড়ে বলল, “আছে। তাকে আমি লুকিয়ে রেখেছি।”

“তোমার দুর্জয় সাহস। লোকটা কেমন না জেনে আশ্রয় দেওয়া কি ঠিক হয়েছে বিরু?”

বীরচন্দ্র বিষণ্ণমুখে বলল, “লোকটা পাগলাটে ধরনের হলেও বোধ হয় বিপজ্জনক নয়। স্মৃতিশক্তি খুবই দুর্বল। আমি আশ্রয় না দিলে আজ সকালে নবীগঞ্জের লোকেরা ওকে হয়তো রাক্ষস বা দৈত্য মনে করে সবাই মিলে পিটিয়ে মেরে ফেলত। লোকে ভয় পেলে তো আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না।”

মাধব একটু চিন্তা করে বললেন, “বোধ হয় তুমি বিচক্ষণের মতোই কাজ করেছ। লোকটার পরিচয় কিছু জানতে পারলে? কী চায় ও?”

বীরচন্দ্র চিন্তিত মুখে বলল, “ও একজন লোককে খুঁজছে। কিন্তু সে যে কে, তা ঠিকঠাক বলতে পারছে না। চেহারার বিবরণ এক-একবার এক-একরকম দেয়, নামও নানারকম বলছে। কিন্তু মনে হচ্ছে, লোকটার ওপর ওর খুব রাগ। ওর ধারণা, লোকটা নবীগঞ্জে এসেছে বা শিগগিরই আসবে। আমি সেইজন্যই একটু চিন্তিত জ্যাঠামশাই।”

“কেন বলো তো! চিন্তার কী আছে?”

“ওর কথা শুনে মনে হচ্ছে, যার সন্ধানে ও এসেছে সেই লোকটা খুবই খারাপ ধরনের। একটা কোনও মতলব হাসিল করতে এসেছে। সেই লোকটা বোধ হয় এরও কোনও ক্ষতি করেছিল কখনও। কিন্তু কী ক্ষতি করেছিল তা বলতে পারছে না। ওর মনে নেই। শুধু মনে আছে, ক্ষতি একটা করেছিল।”

“নামধাম কিছু জানতে পারলে? কেমন লোক এ?”

“নাম বলছে কিঙ্কর। চেহারা দেখে মনে হয়, কুস্তিটুস্তি করত। গায়ে খুব জোরও আছে। সম্ভবত মাথায় চোট পেয়ে স্মৃতি নাশ হয়েছে।”

“কিঙ্কর নাম? পদবি কী?”

“কিঙ্কর সেনাপতি।”

মাধবের ভ্রূ কুঁচকে গেল, “সেনাপতি! আশ্চর্যের বিষয়, তোমার বাবা পূর্ণচন্দ্রের দরবারে একজন কুস্তিগির ছিল, তার নাম শঙ্কর সেনাপতি। তারও বিশাল চেহারা ছিল, নামডাকও ছিল খুব। এই কিঙ্কর সেই শঙ্করের কেউ হয় না তো?

বীরচন্দ্র মাথা নেড়ে বলে, “তা তো জানি না।”

“লোকটা কোথায়?”

“চলুন, ওই কোণের দিকের একটা ঘরে ঘুমোচ্ছে।” বীরচন্দ্র মাধবকে দোতলার শেষপ্রান্তে একটা ঘরে নিয়ে এল। ভেজানো দরজা ঠেলে দুজনে ভেতরে ঢুকলেন।

রাজবাড়ির সব জিনিসই আকারে বেশ বড়। এই কোণের ঘরটায় খাট-পালঙ্ক না থাকলেও বিশাল একখানা চৌকি আছে। অতি মজবুত শালকাঠে তৈরি। তার ওপর শতরঞ্চিতে শুয়ে বিশাল চেহারার লোকটা অকাতরে ঘুমোচ্ছে। গায়ে হাতকাটা

গেঞ্জি আর পরনে পাজামা। বোধ হয় বিরুর দেওয়া।

মাধব তার মুখের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, “মনে হচ্ছে এ শঙ্করেরই ছেলে। চেহারার আদল একই রকম।”

দু’জনে ফের বৈঠকখানায় ফিরে এসে মুখোমুখি বসলেন।

মাধব বললেন, “ওকে দেখে গাঁয়ের লোক এত ভয় পেল কেন, তা বুঝলাম না। চেহারাটা বিরাট ঠিকই, কিন্তু বিকট তো নয়।”

“কিঙ্করের পোশাক তো আপনি দেখেননি, ও পরে ছিল কালো সার্টিনের ওপর জরির কাজ করা পোশাক। অনেকটা রাজাটাজাদের মতো। তাইতেই লোকে ভড়কে গিয়ে থাকবে।”

মাধব গম্ভীর মুখে বললেন, “হু, অন্ধকার রাত্রি, জরির পোশাক এবং বিরাট চেহারা। সব মিলিয়েই কাণ্ডটা ঘটেছে। এখন একে নিয়ে তুমি কী করবে?”।

“আপাতত আমার কাছেই রেখে দেব, মুশকিল হচ্ছে, ছেলেটা মাঝে-মাঝে খুব চঞ্চল হয়ে উঠছে। একটা কিছু বোঝাতে চাইছে, কিন্তু পেরে উঠছে না। ও ঘুমিয়ে পড়ার ফলে রাতে আমি ওর মাথাটা দেখেছি। সন্দেহ ছিল মাথার চোট থেকেই স্মৃতিভ্রংশ হয়ে থাকতে পারে। মাথার পেছন দিকটায় দেখলাম, মস্ত বড় একটা ক্ষতচিহ্ন শুকিয়ে আছে। দেখে বোঝা যায়, খুব বেশিদিন আগেকার চোট নয়, সম্প্রতিই হয়েছে।”

মাধব মাথা নেড়ে বললেন, “বুঝেছি। ওর কাছ থেকে আরও কিছু কথা বের করতে হবে। আমি একটা বিপদের গন্ধ পাচ্ছি।”

“সেটা আমিও পাচ্ছি। কিন্তু কীরকম বিপদ হতে পারে বলে আপনার মনে হয়?”

মাধব একটু ভেবে বললেন, “বিপদ অনেক রকমেরই হতে পারে। এই তোমার কথাই ধরো। তুমি রাজবংশের ছেলে। রাজাগজাদের ওপর অনেকের রাগ থাকে।”

বীরচন্দ্র একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “সতর্ক থাকতে বলছেন?”

“থাকা ভাল। তোমার অস্ত্রশস্ত্র কী আছে?”

“কিছুই প্রায় নেই। বন্দুক, পিস্তল যা ছিল সব সরকারকে দিয়ে দিয়েছি। দু’খানা ভাল দোধারওলা বিলিতি তলোয়ার আছে। আর সামান্য কয়েকটা ছোরাছুরি।”

“তলোয়ার চালাতে পারো?”

“আগে পারতাম। এখন ভুলে গেছি।”

“যা জানো তাতেই হবে। তোমার রক্তেই শিক্ষাটা আছে। চিন্তা কোরো না।”

বীরচন্দ্র একটু হেসে বলল, “আমি নিজের জন্য কখনওই চিন্তা করি না। অযথা ভয়ও পাই না। তবে আপনি যখন বলছেন তখন সতর্ক থাকব।”

“আমি লোকটার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। অবশ্য তোমার আপত্তি না থাকলে।”

“আপত্তি কিসের? আপনি বিচক্ষণ মানুষ, হয়তো ওর কথার সূত্র ধরে কিছু অনুমান করতে পারবেন। ও যে শঙ্কর সেনাপতির ছেলে, এটা তো আমি আবিষ্কার করতে পারিনি, আপনি বসুন, আমি ওকে ডেকে আনছি।”

বীরচন্দ্র উঠে গেল এবং কিছুক্ষণ পর তার পিছু পিছু প্রকাণ্ড চেহারার কিঙ্কর এসে ঘরে ঢুকে দাঁড়াল। মাধব ঘোষাল তার আপাদমস্তক ভাল করে লক্ষ করলেন। হ্যাঁ, এ কুস্তিগিরই বটে। কিন্তু ছোট-ঘোট দুখানা চোখে বুদ্ধির দীপ্তি নেই। কেমন একটা অস্থির, উদ্বেগাকুল চাউনি।”

মাধব হাসিমুখে বললেন, “বোসো কিঙ্কর।” কিঙ্কর একখানা চেয়ারে বাধ্য ছেলের মতো বসল, একটু জড়োসড়ো ভাব। দিনের আলোতে লোকটাকে এত নিরীহ লাগছিল যে, এই লোকটাই কাল রাতে গাঁয়ে দৌরাত্ম্য করে বেড়িয়েছে সেটা বিশ্বাস হয় না।

মাধব তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখ রেখেই বললেন, “নবীগঞ্জে তুমি আগে কখনও এসেছ?”

কিঙ্কর একটু হতবুদ্ধির মতো বসে থেকে ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে বলল, “না।”

“একসময়ে তোমার বাবা শঙ্কর সেনাপতি কিন্তু এখানে থাকত। এই রাজবাড়িতেই হাতিশালের পেছনে তার ঘর ছিল। জানো?”

কিঙ্করের চোখে কি একটু স্মৃতির ঝলকানি দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল? একটা ঢোক গিয়ে সে বলল, “কিন্তু লোকটা কোথায়?”

“তুমি কি একটা বজ্জাত লোককে খুঁজছ?”

কিঙ্কর হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে দু হাত মুঠো পাকিয়ে শক্ত হয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “তাকে পেলে আমি…”

মাধব হাসলেন, “উত্তেজিত হোয়ো না। সে হয়তো এখনও নবীগঞ্জে এসে পৌঁছয়নি। এখন বলল তো, লোকটা কেন নবীগঞ্জে আসছে?”

কিঙ্কর কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে হঠাৎ বলে উঠল, “মারবে। কিন্তু তাকে আমি…”

মাধব বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, “কাকে মারবে?” কিঙ্কর আবার ঠাণ্ডা হয়ে মাথা চুলকে একটু ভাবল। তারপর বলল, “একজনকে মারবে।”

“তোমাকে কি তার জন্যই এখানে পাঠানো হয়েছে? কে পাঠাল তোমাকে?”

কিঙ্কর হঠাৎ বলে উঠল, “বাবা।”

“তোমার বাবা শঙ্কর? সে এখন কোথায়?” কিঙ্কর সজোরে ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে বলল, “নেই। মেরে ফেলেছে। বন্দুক দিয়ে।”

“বন্দুক দিয়ে?”

“দুম করে, ওঃ, কী শব্দ!” বলে যেন সভয়ে একবার চারদিকে চেয়ে দেখে নিল কিঙ্কর।

মাধব বললেন, “আমাদের বন্দুক নেই। ভয় পেও না।”

“ওই লোকটার আছে। দুমদুম করে শব্দ হয়। বন্দুক খুব খারাপ জিনিস।”

“তোমাকে লোকটা কী দিয়ে মারল?”

“বন্দুক দিয়ে।” বলে কিঙ্কর একবার ডান হাতটা তুলে মাথার পেছন দিককার ক্ষতস্থানটিতে হাত বুলিয়ে নিল।

মাধব আর বীরচন্দ্র নিজেদের মধ্যে একটু দৃষ্টিবিনিময় করে নিলেন। মাধব মৃদুস্বরে বললেন, “বজ্জাত লোকটা এখানে কাকে মারতে আসবে?”

“একজনকে।”

“কয়েকটা নাম বলছি। মনে করে দ্যাখো তো, এদের মধ্যে কেউ কি না। মাধব ঘোষাল, সত্যেন রায়, পুঁটে সর্দার, হরিহর পণ্ডিত, বীরচন্দ্র রায়চৌধুরী। এদের মধ্যে কেউ?”

কিঙ্কর মাথা নেড়ে বলল, “এরা নয়। অন্য লোক।”

“নামটা মনে নেই বুঝি?”

“রা রাজু।”

মাধব ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “রাজু! এখানে রাজু নামে আবার কে আছে? আমার নাতির নাম রাজু বটে, কিন্তু সে তো বাচ্চা ছেলে।”

কিঙ্কর হঠাৎ বলে উঠল, “আমার খিদে পাচ্ছে।”

বীরচন্দ্র তাড়াতাড়ি উঠে গেল এবং একটু বাদেই বনমালী একখানা গামলার সাইজের রাজকীয় কাঁসার বাটিতে বিপুল পরিমাণে চিড়ে-দই আর সন্দেশের ফলার নিয়ে এল।

কিঙ্কর যে খেতে খুবই ভালবাসে, সেটা তার খাওয়ার ভঙ্গি দেখেই বোঝা গেল। গপাগপ করে তিন মিনিটে বাকিটা শেষ করে সে একঘটি জল খেয়ে হঠাৎ বলল, “সোনা।”

মাধব একটু ঝুঁকে পড়লেন, “কিসের সোনা? কোথায় সোনা?”

“আছে। লোকটা জানে।”

মাধব একবার বীরচন্দ্রের দিকে তাকালেন। বীরচন্দ্রের মুখে কোনও ভাবান্তর নেই।

মাধব বললেন, “কিছু বুঝতে পারছ বিরু?”

“আজ্ঞে না জ্যাঠামশাই। হয়তো আবোল-তাবোল।”

“একটা ষড়যন্ত্রের আভাস বলে মনে হচ্ছে না?”

বীরচন্দ্র একটু হাসল, বলল, “আপনি উদ্বিগ্ন হচ্ছেন কেন? কিঙ্করের বুদ্ধি স্থির নেই। স্মৃতিশক্তিও কাজ করছে না। বিচ্ছিন্ন কথা থেকে কিছু তো বোঝার উপায় নেই।”

মাধব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বিচ্ছিন্ন কথাগুলোকে জোড়া দিলে কিন্তু একটা ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যায়। একটা পাজি লোক শঙ্করকে খুন করেছে, কিঙ্করকে জখম করেছে। তারপর এখানে রাজু নামে কাউকে খুন করতে আসছে। রাজুর কাছে হয়তো সোনাদানাও আছে।”

বীরচন্দ্র গম্ভীর হয়ে বলল, “সেটা অসম্ভব নয়। তবে গাঁয়ে তো রাজু নামে কেউ নেই বলছেন।”

মাধব বললেন, “আমার চেনাজানার মধ্যে হয়তো নেই। ভাল করে খুঁজে দেখতে হবে।”

মাধব কিঙ্করের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা কিঙ্কর, তুমি কী কী খেতে ভালবাসো?”

কিঙ্কর এই প্রশ্নটা শুনে যেন খুশি হল। বলল, “লাল চেঁকিছাঁটা চালের ভাত, ঘন মুগ ডাল, খাসির মাংস, পায়েস আর রসগোল্লা।”

মাধব সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “কখনও কখনও স্মৃতি বেশ কাজ করছে দেখছি। আচ্ছা, কিঙ্কর, কোন দোকানের রসগোল্লা সবচেয়ে ভাল?”

“চারু ময়রা।”

“চারু ময়রার দোকানটা কোথায়?”

“কেন, বাজারে।”

“কোথাকার বাজার?”

“রসুলপুর।”

মাধব বীরচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, “রসুলপুর খুব একটা দূরে নয়। সেখানে আমার যজমান আছে। আজ বিকেলেই খবর পেয়ে যাব। মনে হচ্ছে ঘটনার সূত্র সেখানেই পাওয়া যাবে।”

মাধব উঠে পড়লেন। মুখে দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ। বাড়ি ফেরার পথে তিনি দুটো কাজ করলেন। নিমাই আর নিতাইকে পাঠালেন, গাঁয়ে রাজু নামে কেউ আছে কিনা তা ভাল করে খুঁজে দেখতে। দ্বিতীয় কাজটা দুঃখহরণের সঙ্গে একটা গোপন সাক্ষাৎকার।

মাধবের প্রস্তাব শুনে দুঃখবাবু একটু আঁতকে উঠে বললেন, “বারো মাইল! ও বাবা, বারো মাইল দৌড়লে আমি মরেই যাব।”

মাধব প্রশান্ত মুখে বললেন, “ভূতের গাঁট্টা খেয়ে তোমার অনেক উন্নতি হয়েছে দুঃখহরণ। কিন্তু সেটা তুমি বুঝতে পারছ

। বারো মাইল কিছুই না। এ-বেলা রসুলপুরে যাওয়ার কোনও গাড়ি নেই। এখন তুমিই ভরসা। খবরটা জরুরি কিনা।”

দুঃখবাবু দুঃখিতভাবে বললেন, “আমি রোগা, দুর্বল মানুষ। আমার ওপর অনেক অত্যাচারও হচ্ছে। কাতুকুতু, সুড়সুড়ি, গাঁট্টা, কিছু আর বাকি নেই। এর ওপর আপনি বারো মাইল দৌড় করালে আমি কি আর বাঁচব?”

“খুব বাঁচবে। তুমি রোগা আর দুর্বল ছিলে বটে, কিন্তু এখন তোমার হাত-পা সবল হয়েছে, ফুসফুঁসের ক্ষমতা বেড়েছে, তুমি সেটা পরীক্ষা করে দ্যাখো। মনে রেখো, তুমিও একজন কুস্তিগিরের বংশধর। কুলাঙ্গার হওয়া কি ভাল?”

দুঃখবাবু রাজি হচ্ছিলেন না, বললেন, “ও আমি পারব না মশাই। আপনি অন্য লোক দেখুন।”

বলেই হঠাৎ একটা আর্তনাদ করে লাফিয়ে উঠলেন দুঃখবাবু, “ওঃ, এখন আবার গাঁট্টা পড়ছে কেন? এ-সময়ে তো গাঁট্টা পড়ার কথা নয়। সকালে যে চার-পাঁচ মাইল দৌড়ে এলাম। উঃ, ওই আবার।”

মাধব গম্ভীর মুখে দুঃখবাবুর দিকে চেয়ে বললেন, “তা হলে তুমি যাবে না?”

দুঃখবাবু দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললেন, “যাচ্ছি মশাই, যাচ্ছি! না গিয়ে উপায় আছে? যা দুখানা গাঁট্টা ঝেড়েছে যে, মাথা ঝিমঝিম

করছে। তা কিসের খবর আনতে হবে? তাড়াতাড়ি বলুন, আমার সময় নেই।”

মাধব বললেন, “রসুলপুরে শঙ্কর সেনাপতির খোঁজ কোরো। তার একটা ছেলে আছে, নাম কিঙ্কর, তাদের সব খবর আমার চাই। তাদের সম্পর্কে কোনও গুজব থাকলে তাও শুনে এসো।”

দুঃবাবু দৌড় শুরু করে দৌড়তে-দৌড়তেই বললেন, “ঠিক আছে মশাই, ঠিক আছে। আমার আর দাঁড়ানোর উপায় নেই। শিলাবৃষ্টির মতো গাঁট্টা পড়তে লেগেছে।”

মুহূর্তের মধ্যে দুঃখবাবু হাওয়া হয়ে গেলেন। মাধব বাড়ি ফিরে বাগানে একটা গাছের ছায়ায় বসে গম্ভীর মুখে ভাবতে লাগলেন। শঙ্কর সেনাপতিকে তিনি চিনতেন। খুবই ডাকাবুকো লোক। রাজা পূর্ণচন্দ্রের আমলেই রাজবাড়ির সুদিন শেষ হয়ে যায়। সরকারের ঘরে বিস্তর দেনা জমে গিয়েছিল। সেসব মেটাতে গিয়ে পূর্ণচন্দ্র সর্বান্ত হন। পোষ্যদের বিদায় করে দিতে হয়। দাসদাসীদের বেতন দেওয়ার ক্ষমতাও তাঁর আর ছিল না। রাজবাড়ি সংকারের অভাবে ভেঙে পড়ছিল, তা সারানোর ক্ষমতাও তাঁর তখন নেই। বসতবাড়ি আর সামান্য দেবত্র সম্পত্তি ছাড়া সবই ক্রোক হয়ে যাওয়ার পর রাজবাড়ি একেবারে ভূতের বাড়ির মতো হয়ে গেল। পূর্ণচন্দ্রের মৃত্যুর পর নাবালক বীরচন্দ্রকে ঠকিয়ে আমলা কর্মচারী এবং আত্মীয়রা অস্থাবর যা কিছু ছিল সব হাত করে নেয়। সেটা তো ইতিহাস। কিন্তু শঙ্কর সেনাপতির কী হল তা মাধব জানেন না। রাজুটাই বা কে? কিঙ্করের অসংলগ্ন কথাবাতাকেই বা কতখানি গুরুত্ব দেওয়া উচিত? কিঙ্কর যদি পাগল হত, তা হলে মাধব গুরুত্ব দিতেন না। কিন্তু কিঙ্কর পাগল নয়, স্মৃতিভ্রষ্ট মাত্র। তা ছাড়া শঙ্কর সেনাপতির ছেলে। মাধবের মনটা কুডাক ডাকছে।

দুঃখবাবু দৌড়ে যখন রসুলপুর পৌঁছলেন তখন বেলা সাড়ে দশটার বেশি হয়নি। তিনি হাঁফিয়ে পড়লেও নেতিয়ে পড়েননি। ধুতির খুঁটে ঘাড়-গলার ঘাম মুছে একটু জিরিয়ে নিলেন। গাঁট্টা বন্ধ হয়ে গেছে। খিদেও পেয়েছে। রসুলপুর বড় একখানা গঞ্জ। মেলা দোকানপাট, বাড়িঘর, বহু মানুষের বাস। বাজারটাও বেশ বড়। চারু ময়রার মিষ্টির দোকানে বসে দুঃখবাবু গোটাদশেক গরম বড়বড় রসগোল্লা খেলেন। তারপর দোকানিকে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁ মশাই, এখানে শঙ্কর সেনাপতির বাড়িটা কোনদিকে বলতে পারেন?”

দোকানি মুখোনা তোম্বা করে বলল, “শঙ্কর সেনাপতি! তাকে আর খুঁজে কী হবে? তাকে তো কয়েকটা গুণ্ডা এসে নিকেশ করে গেছে।”

দুঃখবাবু অবাক হয়ে বলেন, “খুন নাকি?”

“খুন বলে খুন? একেবারে ঝাঁঝরা করে দিয়ে গেছে। ছেলেটাও মরছিল। তবে বরাতজোরে প্রাণটা রক্ষে হয়েছে। এই তো সবে পরশু হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে কোথায় চলে গেছে যেন।”

“বাড়িতে আর কেউ নেই?”

“না। বাপব্যাটায় থাকত। কুস্তিটুস্তি করে বেশ নাম হয়েছিল কিঙ্করের। এমনিতে নিরীহ মানুষ ছিল তারা। কেন হামলা হল কেউ জানে না।”

“খুনি ধরা পড়েনি?”

“না মশাই। গভীর রাতে এসে কাজ সেরে পালিয়ে গেছে।”

“তাদের খবর কোথায় পাই বলতে পারেন?”

“খুনির খবর খুঁজছেন?” দুঃখবাবু আঁতকে উঠে বললেন, “না-না। আমি বাপব্যাটার খবর নিতেই এসেছি।”

“খবর ওইটুকুই।”

দোকানের একটা বেঞ্চে বসে একটা লোক ঘাপটি মেরে কথা শুনছিল। হঠাৎ বলে উঠল, “শঙ্করের কাছে একখানা খবর ছিল। সেই খবর চেপে রেখেছিল এতদিন। সেইজন্যই তো বেঘোরে প্রাণটা গেল।”

দুঃখবাবু বললেন, “কিসের খবর?”

“তা অত জানি না। পাঁচজন পাঁচ কথা বলে।”

“সেই কথাগুলো একটু শুনতে পাই?”

“তা পান। তবে এককাপ চা খাওয়াতে হবে।”

দুঃখবাবুর দুঃখের শেষ নেই। বললেন, “খাওয়াব। বলুন।”

“শঙ্কর কোনও এক রাজবাড়িতে মাইনে করা কুস্তিগির ছিল বলে শোনা যায়। তা সেই রাজবাড়ির কোনও গুপ্ত খবর সে জেনে ফেলে। কিসের খবর তা আমি বলতে পারব না। তবে লুকনো খবরই হবে। গুণ্ডাগুলো অনেকদিন ধরেই নাকি তাকে শাসাচ্ছিল।”

“ও বাবা! এ যে সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড!”

“খুবই সাঙ্ঘাতিক। চারদিকেই সাঙ্ঘাতিক-সাঙ্ঘাতিক সব কাণ্ড হচ্ছে, আজকাল আর কারও প্রাণের কোনও দাম নেই। চায়ের দামটা দিয়ে দেবেন কিন্তু। আজ চলি। ও হ্যাঁ, ভাল কথা, তা আপনার কোথা থেকে আগমন হচ্ছে?”

“আজ্ঞে নবীগঞ্জ।”

“নবীগঞ্জ? বাঃ, বেশ। নবীগঞ্জ ভাল জায়গা। জলহাওয়া ভাল, ঝুটঝামেলা নেই।”

দুঃখবাবু দুঃখের সঙ্গে বললেন, “ভাল জায়গা?, ভাল জায়গার নিকুচি করেছে। অতি যাচ্ছেতাই জায়গা মশাই। কাতুকুতু, সুড়সুড়ি, গাঁট্টা, কী নেই সেখানে?”

দোকানির কাছে হদিস জেনে নিয়ে দুঃখবাবু শঙ্কর সেনাপতির বাড়িটাও দেখলেন। গঞ্জের শেষ প্রান্তে নদীর ধারে একখানা ছোট বাড়ি। সামনের বাগানে একটা কুস্তির আখড়া। বাড়িটা তালা-দেওয়া হলেও আখড়ায় কয়েকজন কুস্তি প্র্যাকটিস করছিল। দুঃখবাবু কুস্তি-টুস্তি পছন্দ করেন না। তবু পায়ে-পায়ে ভেতরে ঢুকে একপাশে দাঁড়িয়ে কুস্তি দেখতে লাগলেন। কেউ তাঁকে বিশেষ লক্ষ করল না। খানিকক্ষণ কুন্তি দেখার পর জিনিসটা তাঁর বেশ ভাল লাগতে লাগল। উত্তেজনা বোধ করতে লাগলেন। একজন পালোয়ান আর-একজন পালোয়ানকে কাবু করেও সামান্য ভুলের জন্য হারাতে পারছিল না দেখে দুঃখবাবু হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, “আরে বাঁ পায়ে লেঙ্গি মারুন না। ডান পায়ে ভর দিন, তারপর…”

আশ্চর্যের বিষয়, পালোয়ানটা তাই করল এবং প্রতিদ্বন্দ্বীকে চিত করে উঠে দাঁড়িয়ে দুঃখবাবুর দিকে চেয়ে বলল, “আপনি তো ওস্তাদ লোক মশাই! আসুন, ল্যাঙট পরে নিয়ে নেমে পড়ন তো! আমাদের শেখানোর কেউ নেই। শঙ্কর ওস্তাদ খুন হওয়ার পর থেকে আমাদের কিছু হচ্ছে না। আপনি নেমে পড়ন তো!”

দুঃখহরণবাবু সভয়ে তিন হাত পিছিয়ে গিয়ে বললেন, “পাগল নাকি? আমি তো ফুয়ে উড়ে যাব।”

যারা চারধারে বসে কুস্তি দেখছিল, মাটিমাথা শরীরে সেইসব ছেলে-ছোঁকরা হঠাৎ উঠে হইচই করে এসে তাঁকে ঘিরে ফেলল। বলল, “আপনি ওস্তাদ লোক, দেখেই বুঝেছি। আপনাকে ছাড়ছি না।”

একরকম জোর করেই তাঁকে তারা ল্যাঙট পরতে বাধ্য করল। দুঃখবাবু কাঁপতে কাঁপতে আখড়ায় নামলেন। কুস্তির ক-ও তিনি

জানেন না। কিন্তু উপায় কী? মাধব ঘোষালের পাল্লায় পড়ে বেঘোরে না প্রাণটা যায়!

কুস্তি করতে এল নিতান্ত ছোঁকরা এক কুস্তিগির। বেশ লম্বাচওড়া চেহারা। তার দুখানা হাত যেন সাঁড়াশির মতো এসে জাপটে ধরল দুঃখবাবুকে। তিনি চোখে অন্ধকার দেখলেন। তবে আত্মরক্ষার তাগিদে আঁকুপাঁকুও করতে লাগলেন। হঠাৎ মাথায় খটাং করে একটা গাঁট্টা এসে লাগল। কে যেন কানে কানে বলল, “বাঁ হাতটা তুলে ওর ঘাড়টা ধর। অন্য হাত দিয়ে থুতনির তলায় চেপে উলটে দে।”

দুঃখবাবু তাই করলেন। এবং ছেলেটা পটাং করে তাঁকে ছেড়ে উলটে পড়ে গেল। চারদিকে সপ্রশংস হর্ষধ্বনি উঠল, “হ্যাঁ, ওস্তাদ বটে।”

দুঃখবাবু হাঁফাতে-হাঁফাতে পালানোর পথ খুঁজছিলেন। কিন্তু। পালাবেন কি! সবাই একেবারে ঘিরে ধরেছে তাঁকে।

পালানোর উপায় নেই। ফলে আবার একজনের সঙ্গে কুস্তি করতে হল দুঃখবাবুকে। এবার কেউ কানে কানে প্যাঁচ মারার কায়দা শেখাল না। দুঃখবাবু নিজেই একটা প্যাঁচ আবিষ্কার করে দ্বিতীয় জনকেও হারিয়ে দিয়ে খুবই অবাক হয়ে গেলেন।

চারদিকে একটা হইহই পড়ে গেল। দুঃখবাবু আর তেমন দুঃখ-দুঃখ ভাবটা টের পাচ্ছিলেন না। আজ তাঁর ঘাড়ে একটা কিছুর ভর হয়ে থাকবে। তিনি তিন নম্বর লড়াইতেও ভালই লড়লেন এবং জিতে গেলেন। অথচ এই কুস্তিগিরদের হাতে তাঁর মারা যাওয়ার কথা।

কুস্তির আসরটা একসময়ে শেষ হল। দুঃখবাবুকে মাঝখানে রেখে সবাই ঘিরে বসল তাঁকে। একজন বলল, “এতদিন কোথায় ছিলেন ওস্তাদ? আপনাকে পেলে আমাদের আর শঙ্কর ওস্তাদের কথা মনেই থাকবে না।”

দুঃখবাবু শঙ্কর সেনাপতির কথা ভুলেই গিয়েছিলেন। নামটা শুনে মনে পড়ল। বললেন, “দ্যাখো ভাই, আমি একটা জরুরি কাজে এসেছি। শঙ্কর সেনাপতি কীভাবে খুন হল, তা কেউ জানো?”

একজন বলল, “খুনটা হয়েছে মাঝরাতে। কেউ তখন জেগে ছিল না। বন্দুকের শব্দে যখন পাড়া-প্রতিবেশীর ঘুম ভাঙে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। কিঙ্করের মাথায় চোট হয়েছিল। তাকে হাসপাতালে আমরাই নিয়ে যাই। তবে সে বেঁচে গেছে।”

“সে এখন কোথায়?”

“তা কেউ জানে না। পরশুদিন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই সে কোথায় যেন চলে গেছে। তবে হাসপাতালে যে নার্স তার দেখাশোনা করত সে বলেছে কিঙ্কর নাকি বিকারের ঘোরে একটা রাজবাড়ির কথা বলত।”

“তোমরা আর কেউ কিছু জানো না?”

একজন বলে উঠল, “আমি জানি। শঙ্কর ওস্তাদের কাছে মাসখানেক যাবৎ একটা লোক আনাগোনা করছিল। সেই লোকটা যাতায়াত শুরু করার পর থেকেই ওস্তাদের একটা ভাবান্তর লক্ষ করতাম। কেমন যেন গম্ভীর, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। একদিন আমাকে ডেকে বলল, ওরে, আমি হঠাৎ মারা পড়লে তোরা কেউ একজনকে একটা খবর দিতে পারবি? আমি বললাম, ‘হঠাৎ মারা যাওয়ার কী হল? ওস্তাদ বলল, কারণ আছে বলেই বলছি। গতিক সুবিধের নয়। আমার পেছনে লোক লেগেছে।”

আর-একটা ছেলে বলে উঠল, “ওস্তাদ আমাকেও একদিন বলেছিল, কারা যেন একটা গুপ্ত খবরের জন্য তাকে ভয় দেখাচ্ছে।”

আগের ছেলেটাকে দুঃখবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “যে-লোকটা যাতায়াত করত তার চেহারা কেমন?”

“লম্বাচওড়া, কালো চেহারা। খুব ভয়ঙ্কর দু’খানা চোখ।”

“নাম জানো?”

“না। তাকে একদিনই দেখেছিলাম। দেখলেই ভয় হয়।”

দুঃখবাবু উঠে পড়লেন। বললেন, “আমাকে নবীগঞ্জে ফিরতে হবে। তোমাদের সঙ্গে মিশে আমার বড় ভাল লাগল।”

“আবার কবে আসবেন?”

“কালই হয়তো আসব। রোজই আসতে পারি।” সবাই হর্ষধ্বনি করে উঠল।

দুঃখবাবু ফেরার পথে দৌড়তে-দৌড়তে গুনগুন করে গান গাইতে লাগলেন। মনে ভারী আনন্দ।

মাধব ঘোষাল দুঃখবাবুর সব কথা মন দিয়ে শুনলেন এবং খুশি হয়ে বললেন, “এই তো চাই। তোমাকে কুলাঙ্গার বলে ভাবতাম। এখন দেখছি তুমি মোটেই তা নও।”

দুঃখবাবু একটু কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, “সবই তো হল ঘোষালমশাই, এখন এই ভুতুড়ে গাঁট্টার একটা বিহিত হওয়া দরকার।”

মাধব ঘোষাল শশব্যস্তে বললেন, “তাড়া কিসের? ওটা চলছে চলুক না। আমি তো লক্ষণ ভালই দেখছি।”

দুঃখবাবু বিদায় নিলে মাধব ঘোষাল ঘটনার টুকরোগুলোকে ফের মনে-মনে সাজাতে শুরু করলেন। জিগ শ পাজলের মতো ভগ্নাংশ জুড়ে ছবিটা যদি পুরো করা যায়।

নিমাই আর নিতাই গোটা নবীগঞ্জ আর আশপাশের গাঁ ঘুরে এসে জানাল, “আমরা বারোজন রাজু পেয়েছি। কিন্তু কারও বিশেষ সোনাদানা নেই। শুধু খিজিরপুরের রাজু ব্যাপারির পয়সা

আছে। তার তামাকের ব্যবসা। বুড়ো মানুষ।”

মাধবের রাজু ব্যাপারিকে পছন্দ হল না। তিনি বললেন, “আরও খোঁজো। অনেকের হয়তো পোশাকি নাম রাজু নয়, ডাকনাম রাজু। এসবও খুঁজে বের করতে হবে।”

“যে আজ্ঞে।” বলে দুই বন্ধু চলে গেল।

মাধব রাজুকে নিয়ে ভাবতে লাগলেন। কিন্তু কোনও কূলকিনারা পেলেন না। বিকেলের দিকে তিনি ফের রাজবাড়ি রওনা হলেন। কিঙ্করের সঙ্গে আরও কথা হওয়া দরকার।

গিয়ে দেখলেন, কিঙ্কর রাজবাড়ির দোতলার বারান্দায় ডন-বৈঠক করছে। বীরচন্দ্র দাঁড়িয়ে দেখছে।

মাধবকে দেখে বীরচন্দ্র এগিয়ে এসে বলল, “কোনও খবর আছে?”

“ওকে ডন-বৈঠক করাচ্ছ নাকি?”

বীরচন্দ্র হেসে বলল, “কাচ্ছি। মনে হচ্ছে এসব করলে ও স্বাভাবিক থাকবে। ডন-বৈঠক করার অভ্যাস তো?”

“তা বটে। আমি ওর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।”

মাধব ঘরে বসলেন। একটু বাদে বীরচন্দ্র ঘর্মাক্ত কিঙ্করকে নিয়ে এল।

সস্নেহে মাধব বললেন, “বোসো কিঙ্কর।” কিঙ্কর বসল।

মাধব তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে থেকে বললেন, “লোকটা কালো, লম্বা আর খুব স্বাস্থ্যবান। না?”

কিঙ্কর কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ বাঘের মতো লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল, “কোথায় সে?”

মাধব তাড়াতাড়ি বললেন, “বোসো, বোসো। উত্তেজিত হোয়ো না। সে এখনও এসে পৌঁছয়নি। কিন্তু চেহারাটা তোমার মনে পড়ছে তো?”

কিঙ্কর ফের বসল এবং ভাবতে লাগল। অনেকক্ষণ ভেবে বলল, “হারিয়ে যাচ্ছে।”

“কী হারিয়ে যাচ্ছে?”

“চেহারাটা।”

“ভাল করে ভাবো। লম্বা, জোয়ান, দুখানা ভয়ঙ্কর চোখ।”

একটু শিউরে উঠে কিঙ্কর বলল, “খুব ভয়ঙ্কর।”

“মনে পড়ছে?”

“চোখ দুখানা ভয়ঙ্কর।”

“আর কিছু?”

“আর বন্দুক। দুম।”

“তার একটা দল আছে না?” কিঙ্কর একটু ভেবে বলল, “আছে।”

“এখন বলো তো, শঙ্কর মারা যাওয়ার আগে তোমাকে কী বলে গিয়েছিল!”

কিঙ্কর একটু উত্তেজিত হয়ে বলল, “বলেছিল, সাবধান! সাবধান।”

“আর কিছু নয়?”

কিঙ্কর কপালে আঙুল চেপে মনে করার চেষ্টা করতে করতে বলল, “বলেছিল, সাবধান! সাবধান! নবীগঞ্জে যাও। রা-রাজুকে বোলো ওরা আসছে।”

“রাজুকে তুমি চেনো?”

কিঙ্কর মাথা নেড়ে বলল, “না।”

“তুমি তো তোতলা নও, তবে রাজু উচ্চারণ করার সময় রা রাজু বলছ কেন?”

কিঙ্কর চেয়ে রইল, কিন্তু কিছু বলল না।

বীরচন্দ্র বলল, “জ্যাঠামশাই, আপনি বড্ড উদ্বিগ্ন হচ্ছেন। এত ভয় পাওয়ার হয়তো কিছুই নেই। শেষ অবধি হয়তো পর্বতের মূষিক প্রসব হবে।”

“তাই যেন হয়। তবে সাবধানের মার নেই। সমস্যা হচ্ছে রাজু। কে এই রাজু তা বুঝতে পারছি না।”

কিঙ্কর হঠাৎ বলে উঠল, “রাজু একটা উঁচু জায়গায় বসে থাকে।”

মাধব আবার ঝুঁকে বললেন, “উঁচু জায়গা? কীরকম উঁচু জায়গা?”

“তা জানি না।”

“পাহাড়? টিলা?”

“ভুলে গেছি।” মাধব আর-একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় বনমালী এসে খবর দিল, রায়বাবু দেখা করতে এসেছেন।

মাধব ভ্রূ কুঁচকে বীরচন্দ্রের দিকে চেয়ে বললেন, “রায়বাবুর সঙ্গে তোমার আলাপ আছে নাকি?”

বীরচন্দ্র বলল, “না, ঠিক আলাপ নেই। তবে মাসদুয়েক আগে আর-একবার উনি এসেছিলেন। কুশল প্রশ্ন করে গিয়েছিলেন।”

বীরচন্দ্র কিঙ্করকে কোণের ঘরে রেখে এল। তারপর বনমালীকে বলল, “নীচের বৈঠকখানায় বসাও। আমি যাচ্ছি।”

মাধব বললেন, “তুমি একাই যাও। আমি যে এখানে আছি তা বলার দরকার নেই।”

“তাই হবে।” বলে বীরচন্দ্র চলে গেল।

রায়বাবু খুবই অমায়িক মানুষ। বীরচন্দ্র বৈঠকখানায় ঢুকতেই তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালেন।

বীরচন্দ্র লজ্জা পেয়ে বলল, “আপনি উঠলেন কেন? বসুন।”

রায়বাবু হাতজোড় করে বললেন, “মানীর মান রক্ষা করতে হবে না? বয়সে ছেলেমানুষ হলে কী হয়, আপনি যে রাজা তা ভুলি কী করে?”

বীরচন্দ্র হেসে ফেলল। রায়বাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “মরা হাতি লাখ টাকা।”

মুখোমুখি বসে বীরচন্দ্র বলল, “রাজাদের দিন চলে গেছে। আমি আর রাজাটাজা নই।”

রায়বাবু একটু হেসে বললেন, “সে তো আপনি বলবেনই। তবে শুনেছি রাজদর্শনে পুণ্য হয়। তা শরীরগতিক সব ভাল তো?”

“ভালই।”

“এদিকে গাঁয়ে যে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, সে-বিষয়ে আপনি কিছু শুনেছেন?”

বীরচন্দ্র অবাক হয়ে বলে, “কিসের আতঙ্ক?”

“আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না, কিন্তু নবীগঞ্জের অনেকেই তাকে কাল রাতে দেখেছে। দৈত্য বা রাক্ষস কিছু একটা। দৈত্য বা রাক্ষসের অস্তিত্ব নেই, জানি। কিন্তু এত লোকে যখন বলছে তখন কিছু একটা হবেই। আপনি কিছু শোনেননি?”

বীরচন্দ্র একটু হাসল। বলল, “শুনেছি। তবে গুরুত্ব দিইনি।”

“তাকে কিন্তু আজ কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। খুবই আশ্চর্যের বিষয় নয়?”

“হয়তো পালিয়ে গেছে।”

রায়বাবু মাথা নেড়ে বললেন, “পালিয়ে গেছে! কিন্তু সে যে একজনকে খুঁজতে এসেছিল। যাকে খুঁজছে তাকে খুন করতেই এসেছে সে। কিন্তু তার চেহারা কেমন, নাম কী, কিছু বলতে চাইছে না। ব্যাপারটা খুবই ভয়ের হয়ে দাঁড়াল। কাকে খুনটুন করে বসে তার ঠিক কী?”

বীরচন্দ্র একটু চুপ করে থেকে বলল, “শুনেছি গাঁয়ে আজ রাত থেকে পাহারা দেওয়া হবে। সবাই সতর্ক থাকলে তত ভয়ের কিছু নেই।”

“আমি একটু ঘাবড়ে গেছি। কাল রাতে আমার বাড়িতে কেউ এসেছিল। আমার কুকুরকে ওষুধমেশানো মাংস খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে চুরির চেষ্টা করেছিল। বাগানে খুব ভারী আওয়াজও শুনেছি। ভাবছি কদিনের জন্য নবীগঞ্জ ছেড়ে বাইরে গিয়ে থেকে আসব।”

বীরচন্দ্র হাসল। বলল, “সেটাও একটা সমাধান বটে!” রায়বাবু হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, “রাজবাড়িতে কি চোরটোর হানা দেয় না?”

বীরচন্দ্র ঠোঁট উলটে বলল, “দেয় হয়তো। তবে রাজবাড়িতে তো কিছু নেই। সবাই জানে।”

“তবু আপনার সতর্ক থাকা ভাল। সেই রাক্ষসটাই যদি হানা দেয় তা হলে কী করবেন?”

“তা তো জানি না।”

“অনেকে বলে, আপনি নাকি গভীর রাতে বীণা বাজান। এ-কথা কি সত্যি?”

লাজুক বীরচন্দ্র মুখ নামিয়ে হেসে বলল, “ওইটেই আমার সময় কাটানোর উপায়।”

“ভাল। কিন্তু অত নিশ্চিন্ত থাকা ভাল নয়। একটু সতর্ক থাকবেন।”

বীরচন্দ্র বিনয়ের সঙ্গে বলল, “আচ্ছা।”

রায়বাবু তাঁর রুপোবাঁধানো লাঠিটা তুলে পাশের একটা বন্ধ দরজার দিকে নির্দেশ করে বললেন, “ওটা কিসের ঘর বলুন তো?”

বীরচন্দ্র লজ্জায় একটু লাল হয়ে বললেন, “ওটা একসময়ে দরবার ছিল।”

“দরবার! বাঃ, বেশ। তা সিংহাসন-টন নেই এখন?”

বীরচন্দ্র মাথা নেড়ে বলল, “না। অনেকদিন আগেই সব বিক্রি হয়ে গেছে।”

“ঘরটা তালাবন্ধ থাকে বোধ হয়?”

“হ্যাঁ। তবে ভোলা রাখলেও ক্ষতি নেই। ইঁদুরবাদুড় ঢুকবে বলে বন্ধ করে রাখা হয়েছে।”

“অ।” বলে রায়বাবু উঠে পড়লেন।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress