জ্ঞানপাগলা
জ্ঞানপাগলা আজকাল তাঁর বাড়ির বারান্দাতেই রাতে এসে শোয়। তাই আজ নরহরি সজাগ ছিলেন। জ্ঞান যে সোজা লোক নয় তা আজ তিনি ভাল করেই বুঝে গেছেন। গিন্নিকে বললেন, “ওগো, জ্ঞান কিন্তু ছদ্মবেশী লোক। বোধ হয় পাগল হওয়ার আগে প্রফেসর টফেসর কিছু ছিল। হেলাফেলা করা ঠিক হবে না। অমন শক্ত শব্দটার অর্থ কেমন পট করে বলে দিল বলে দিকিনি। এক কাজ করো, আজ রাতে পাগলটাকে ভাল করে ভাতটাত খাওয়াও। আর বাইরের ঘরে একটা বস্তা আর চাঁদর পেতে বিছানাও করে দাও। বাইরে এই বৃষ্টিবাদলায় শুয়ে অসুখ করলে আমাদের পাপ হবে।”
গিন্নি পাপকে ভারী ভয় পান। বললেন, “তার তো আবার বড় দেমাক, এটোকাঁটা খাবে না।”
“এঁটোকাঁটা দেওয়ার দরকার কী? ভাল করেই খাওয়াও।”
নরহরি তক্কে তক্কে ছিলেন। রাত দশটা নাগাদ গজানন একটা ছাতা মাথায় ধরে জ্ঞানকে পৌঁছে দিয়ে যেতেই নরহরি বেরিয়ে এসে বিগলিত হয়ে বললেন, “ওরে জ্ঞান, আজ আর বাইরের বারান্দায় কষ্ট করে শুতে হবে না বাবা, আয় ঘরে তোর বিছানা পেতেছি।”
জ্ঞান তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলল, “দুর! ঘরে শুলে এতবড় রাজ্যপাট দেখবে কে? চারদিকে নজর রাখতে হবে না?”
“ও বাবা! তাও তো বটে! তুই তো আবার নয়নগড়ের যুবরাজ! তা হলে বারান্দাতেই না হয় কিছু পেতেটেতে দিই।”
“কী দেবে? চট তো! ওসবে আমার সম্মান থাকে না। তার চেয়ে এই মেঝেতে বেশ বসে আছি। ভূমির অধিপতি ভূমিতে বসলে মান যায় না।”
নরহরি একটু অপ্রতিভ হলেন।
তাঁর গিন্নি ভাতের থালা নিয়ে এলে জ্ঞানপাগলা বলল, “দাঁড়াও, দাঁড়াও, আজ তো তোমাদের পালা নয়! আজ গজাননের পালা ছিল। তোমাদের যদি একান্তই ইচ্ছে হয় তা হলে পরশুদিন খাওয়াতে পারো। আর শোনো, ওইসব ঘ্যাঁট ম্যাট হেঁচকি টেচকি আমি খাই না। খাওয়ালে ঘি দিয়ে ভাজা পরোটা আর আলুর দম খাওয়াবে।”
নরহরি আর চাপাচাপি করলেন না। ঘরে দোর দিয়ে শুয়ে পড়লেন। জ্ঞানপাগলা বারান্দায় বসে রইল।
দৃশ্যটা উলটো দিকের বাড়ি থেকে গবাক্ষবাবু দেখছিলেন। ওই যে জ্ঞানপাগলা বসে আছে, এটা তাঁর একটা অস্বস্তির কারণ হচ্ছে আজ। এক কথা হল, জ্ঞানপাগলা যে হাতা ন্যাতা পাগল নয় তা আজ গবাক্ষবাবু বুঝে গেছেন। দ্বিতীয় কথা হল, জ্ঞানপাগলা নয়নগড়ের রাজপুত্তুর শুনে সজনীবাবু যেন হঠাৎ একটু গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন আজ। ভয় পেলেন কিনা বোঝা গেল না, তবে যেন একটু চিন্তায় পড়লেন। গবাক্ষবাবু একটু রহস্যের গন্ধ পাচ্ছেন। অস্বস্তিটা সেই কারণেও।
জানলার ফাঁক দিয়ে তিনি আবছা অন্ধকারে খানিকক্ষণ জ্ঞানপাগলাকে লক্ষ করলেন। নরহরির ঘরের আলো নিভে যেতেই জমাট অন্ধকারে আর কিছুই দেখা গেল না।
গবাক্ষবাবু বুক ঠুকে আজ শস্তায় একখানা টর্চ কিনেছেন। তাঁর ঘোরতর সন্দেহ, যে-ছুঁচটা তিনি কুড়িয়ে পেয়েছেন সেটা এলেবেলে জিনিস নয়। তন্ত্রমন্ত্রের কোনও বিশেষ প্রক্রিয়ায় বোধ হয় জিনিসটার দরকার হয়। না হলে তারা তান্ত্রিক তার চোর-চেলাদের ঘরে ঘরে পাঠিয়ে জিনিসটা তল্লাশ করত না। গবাক্ষবাবুর অনুমান, তাঁর ঘরে চোরেরা আবার হানা দিতে পারে। সুতরাং টর্চখানা হাতের কাছে থাকলে সুবিধে হয়।
আজ ভাল করে জানলা দরজা এঁটে তবে শুতে গেলেন গবাক্ষবাবু। তবে জানলা দরজার ওপর বিশেষ ভরসা নেই, কারণ সেগুলো খুবই পলকা। তাই শুয়ে সজাগই থাকলেন তিনি।
রাত একটু গম্ভীর হওয়ার পর তিনি উঠে টর্চ জ্বেলে তোশকের ফুটো দিয়ে হাত ঢুকিয়ে কাঁচের শিশিটা বের করলেন। ছুঁচের রহস্যটা কী তা জানার কৌতূহল হচ্ছে খুব। তেমন গুরুতর জিনিস হলে এটা বেচে কিছু টাকাপয়সাও পাওয়া যেতে পারে।
ছুঁচটা শিশি থেকে বের করার আগে তিনি ঘরের চারপাশটা ভাল করে টর্চ জ্বেলে দেখে নিলেন। সামনের জানলার একটা পাট খুলে টর্চের ফোকাস ফেলে দেখলেন, নরহরির বারান্দায় জ্ঞানপাগল দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঘাড় কাত করে ঘুমোচ্ছে। বৃষ্টি এখনও পড়ছে। হাওয়াও দিচ্ছে খুব।
জানলাটা বন্ধ করে টর্চের আলোয় শিশিটা ভাল করে দেখলেন গবাক্ষবাবু। শিশিটা ছয় ইঞ্চির মতো লম্বা হবে। তার ভেতরে বেশ মোটাসোটা একটা ছুঁচ। তবে ছুঁচ হলেও মুখ তেমন ছুঁচলো নয়, আর অন্য প্রান্তে সুতো পরানোর ফুটোও নেই। বেশ চকচক করছে জিনিসটা। মরচে টরচে ধরেনি। শিশিটার একটা দিকে কাঁচেরই একটা ছিপি লাগানো। গবাক্ষবাবু সেটা টানা হ্যাঁচড়া করে দেখলেন, বড্ড শক্ত করে আঁটা রয়েছে। একটু নাড়াচাড়া করে দেখলেন, ছুঁচটা নড়ছে না। জিনিসটা শিশির মধ্যে কিছুতে আটকানো আছে।
ধৈর্যশীল গবাক্ষবাবু ছিপিটা একটা ন্যাকড়া দিয়ে চেপে ধরে প্রাণপণে মোচড় দিতে লাগলেন। আর তাই করতে গিয়ে আচমকা শিশিটা হাত থেকে শানের ওপর ছিটকে পড়ে গেল। কিন্তু আশ্চর্য! শিশিটা ভাঙল না।
এ কীরকম কাঁচ, কে জানে বাবা! শিশিটা তুলে ফের ছিপিটা খোলার চেষ্টা করতে লাগলেন তিনি। ভয় হল, শিশির মধ্যে তান্ত্রিকের কোনও ভূতপ্রেত আছে কিনা। আর দু নম্বর, ছুঁচটা মন্ত্রপূত কিনা, যদি ছুঁচটা বেরিয়ে এসে পট করে তান্ত্রিকের বাণ হয়ে যায়, তা হলেই বিপদ।
অনেকক্ষণ গলদঘর্ম হওয়ার পর তিনি রান্নাঘর থেকে লোহার সাঁড়াশিটা এনে ন্যাকড়া জড়িয়ে ছিপিটা চেপে ধরে প্যাঁচ কষতে লাগলেন।
হঠাৎ ফট করে একটা শব্দ হয়ে ছিপিটা খুলে গেল। শব্দটা শুনে গবাক্ষ বুঝলেন, শিশিটা বায়ুশূন্য ছিল। ছিপিটা আলগা হওয়ায় হঠাৎ বাতাস ঢুকে শব্দটা হয়েছে। শিশিটা উপুড় করে ছুঁচটা বের করার চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু সেটা ভেতরে আটকেই রইল।
তারপর যে কাণ্ডটা হল তাতে গবাক্ষবাবুহাঁ হয়ে গেলেন। শিশির ছিপিটা খোলার কয়েক সেকেন্ড পর হঠাৎ ভেতরকার ছুঁচটা দপ করে জ্বলে উঠল। প্রথমে একটু লালচে, তারপর নীলবর্ণ হয়ে সমস্ত ঘরটা আলোয় ভরে গেল। এ যে ভৌতিক কাণ্ড তাতে গবাক্ষবাবুর সন্দেহ রইল না। কিন্তু তাঁর গলায় স্বর ফুটল না বলে চেঁচাতে পারলেন না, আর ভয়ে হাত-পা অবশ হয়ে পড়ায় ছুটে পালাতেও পারলেন না। বড় বড় চোখ করে শুধু হাতের শিশিটার দিকে চেয়ে রইলেন।
আশ্চর্যের বিষয়, অত উজ্জ্বল আলো সত্ত্বেও শিশিটা তেমন গরম হল না। আলোটা এতই উজ্জ্বল হয়ে উঠল যে, ঘরটা দিনের আলোর মতো আলো হয়ে গেল।
হাতে পায়ে সাড় ফিরতে একটু সময় লাগল গবাক্ষবাবুর। তিনি তাড়াতাড়ি শিশির মুখে ছিপিটা এঁটে বসিয়ে দিলেন। ভূতের ভয়ের সঙ্গে তাঁর মাথায় একটা মতলবও খেলা করছিল। সন্ধের পর আর মোমবাতি বা কেরোসিনের পয়সা খরচা করতে হবে না। ভূতের আলো হলেও তো আলোই। সন্ধের পর এই আলোতেই সব কাজকর্ম সেরে ফেলা যাবে।
কিন্তু চিন্তার বিষয় হচ্ছে, এই জিনিসটি তাঁর নয়। তারা তান্ত্রিক জিনিসটা খুঁজে বের করতে তার চোরছ্যাঁচোড় চেলাচামুণ্ডাদের লাগিয়ে দিয়েছে। সুতরাং জিনিসটাকে রক্ষা করতে হলে বুদ্ধি খাটানো দরকার। ছিপিটা বন্ধ করার পর আলোটা ধীরে ধীরে কমে এল, এবং মিনিট তিনেক পর একদম নিভে গেল।
হাঁফ ছেড়ে শিশিটা ফের তোশকের ফুটোয় ঢুকিয়ে দিয়ে গবাক্ষবাবু ভাবতে বসলেন। মাথাটা গরম। ভয়ে বুকটা একটু ঢিপঢিপও করছে। প্রথম ভয় তারা তান্ত্রিককে। সে কেমন লোক জানেন না। দ্বিতীয় ভয়, ভৌতিক ছুঁচটাকে। কীরকম ভূত ছুঁচটায় ভর করে তাও তাঁর জানা নেই। আদপে ভূত সম্পর্কে কোনও অভিজ্ঞতাই গবাক্ষবাবুর ছিল না এতকাল। তারা তান্ত্রিক আর ভূতেরা মিলে কতটা উপদ্রব করবে তাও আন্দাজ করতে পারছেন
গবাক্ষবাবু। এখন উপায় হল জিনিসটা নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে ভিন গাঁয়ে রেখে আসা। সেখানে মেলা লোকলশকর আছে। চট করে বেহাত হওয়ার ভয় নেই।
হঠাৎ শিরশিরে ঠাণ্ডা একটা বাতাস ঘাড়ে মাথায় কানে এসে লাগতেই গবাক্ষবাবু শিউরে উঠলেন। পেছনে তাকিয়ে দেখলেন, জানলাটা দুহাট করে খোলা। কী করে খুলল তা বুঝতে না পেরে গবাক্ষ হাঁ করে চেয়ে রইলেন। একটু শব্দও হয়নি তো! ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল তাঁর। কাঁপতে কাঁপতে টর্চটা তুলে
জানলায় ফেললেন। কেউ নেই।
টর্চটা নিভিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় গবাক্ষবাবু শক্ত হয়ে বসে রইলেন। জানলায় উঁকি দিয়ে কেউ কাণ্ডটা দেখে ফেলল নাকি? সে কি তারা তান্ত্রিকের চর! না কি ছুঁচের ভূত!
অন্ধকার জানলাটার দিকে সম্মোহিতের মতো চেয়ে রইলেন গবাক্ষবাবু। জানলা থেকে চোখ সরাতে চেষ্টা করেও পারলেন না।
আচমকাই অন্ধকার জানলায় একটা আবছা মূর্তি দেখা দিল।
গবাক্ষবাবুর হাত-পা অবশ। তবু প্রাণপণে টর্চটা তুলে আলো ফেলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু শস্তার টৰ্চবাতির সুইচটা ঠিক এই সময়েই গণ্ডগোল করল। টর্চ জ্বলল না।
গবাক্ষবাবু গর্জন করার চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু গলা চিরে ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজ বেরোল। প্রায় ফিসফিস করেই তিনি বললেন, “কে? কে ওখানে?”
জানলার অন্ধকারে হঠাৎ এক জোড়া চোখ বাঘের মতো দপ করে জ্বলে উঠেই নিভে গেল।
গবাক্ষবাবু প্রাণপণে “রাম রাম রাম রাম” জপ করতে লাগলেন। বুক ঢিপঢিপ করতে করতে দামামার শব্দ হতে লাগল বুকে। গলা শুকিয়ে কাঠ। গবাক্ষবাবুর মনে হল এবার মূর্ছা গেলে ভয়ের হাত থেকে বাঁচা যায়। কিন্তু মূৰ্ছা যাওয়ার চেষ্টা করে দেখলেন, মুছাটাও কেমন যেন আসতে চাইছে না।
জানলার গা ঘেঁষে বাইরে একটা করবী ফুলের গাছ আর কামিনী ফুলের ঝোঁপ। ডালপালা আর ঝোঁপঝাড়ে হঠাৎ একটা আলোড়ন উঠল। ক্ষীণ হলেও একজোড়া ভারী পায়ের শব্দ দূরে চলে যেতে শুনলেন গবাক্ষবাবু।
হাঁফ ছেড়ে গবাক্ষবাবু বলে উঠলেন, “গেছে!”
একটা ক্ষীণ প্রতিধ্বনিও বলে উঠল, “গেছে!” গবাক্ষবাবু ফের শোয়ার তোড়জোড় করতে করতে হঠাৎ থমকালেন। প্রতিধ্বনি তো হওয়ার কথা নয়?
গবাক্ষবাবু পরখ করার জন্য ফের বললেন, “গেছে তা হলে!”
সঙ্গে সঙ্গে ক্ষীণ একটা গলা বলে উঠল, “আজ্ঞে, গেছে। জোর বেঁচে গেছেন কর্তা।”
গবাক্ষবাবু শুতে যাওয়ার ভঙ্গি থেকে পট করে সোজা হয়ে বললেন, “কে? কে রে?”
জানলার বাইরে থেকে ক্ষীণ সরু গলায় কে বলল, “এই আমি।”
“আমিটা কে?”
“একজন লোক।”
গবাক্ষবাবু বুঝলেন অশরীরী নয়, মানুষই বটে, সাহস পেয়ে বললেন, “লোক মানে? কেমন লোক?”
“আজ্ঞে ভালও বলতে পারেন, মন্দও বলতে পারেন। ভাল মন্দ মিশিয়ে আর কী!”
“কোনদিকের পাল্লা ভারী? ভাল দিকে না মন্দের দিকে?”
“তা এই মন্দের দিকেই বোধ হয় একটু ভারী।”
“চোর নাকি তুই?”
“আহা, প্রথম আলাপেই হুট করে চোরছ্যাঁচোড় বলাটা কি উচিত হচ্ছে মশাই? ধীরেসুস্থে ভেবেচিন্তে তারপর হাতের কাজ দেখে না হয় বলবেন।”
“অ। প্রেস্টিজে লাগল বুঝি?”
“আজ্ঞে, পেটের দায়ে দু-একটা অপকর্ম করি বটে, কিন্তু গায়ে তো এখনও মানুষের চামড়াখানা আছে। সত্যি কিনা বলুন।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গবাক্ষ বললেন, “তা বটে।”
“তা টর্চটা নতুন কিনলেন বুঝি?”
টর্চটা সঙ্গে সঙ্গে শক্ত করে ধরে গবাক্ষ বললেন, “কেন, টর্চের কথা উঠছে কেন?”
“না, জিজ্ঞেস করছিলাম, কত দিয়ে কিনলেন। আজকাল টর্চবাতির যা দাম হয়েছে মশাই, তা আর কহতব্য নয়।”
গবাক্ষ সতর্ক হয়ে বললেন, “দামি জিনিস নয় রে বাপু, কেলোর দোকান থেকে শস্তায় কেনা।”
“তাই বলুন, তবে কিনা টর্চবাতির মতিগতির কোনও ঠিক নেই। আমারও একখানা ছিল বটে, কিন্তু কম্মের নয়। যখন ইচ্ছে হল জ্বলল, যখন ইচ্ছে না হল মুখোনা কালো করে রইল। বড্ড নেমকহারাম জিনিস মশাই। অত ভেজাল দেখে আমার বড় সম্বন্ধীকে টর্চখানা দিয়ে দিলুম। এখন ঝাড়া হাত-পা। অন্ধকারেই চোখ বেশ সাবুদ হয়ে গেছে।”
“তা টর্চ নিয়ে এত কথা উঠছে কেন জানতে পারি?”
“আজ্ঞে, সেই কথাটাই বলছি। এই পথ ধরেই একটা বাণিজ্য করতে বেরিয়েছিলুম। দিনটাও ভাল। বৃষ্টি পড়ছে, অন্ধকার রাত, ঘরে ঘরে মানুষজন দিব্যি মুড়িসুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছ। বড্ড ভাল দিন ছিল আজ। তা হঠাৎ দেখলুম আপনার ঘরে এত রাতেও দিব্যি ফটফট করছে আলো। দেখে ভাবলুম, গবাক্ষকর্তা কি বিজলি বাতি জ্বালালেন নাকি ঘরে, না কি হ্যাজাক লণ্ঠন। উঁকি মেরে দেখতে এসে দেখি, আপনি একখানা টর্চবাতি নিয়ে বসে আছেন। ভাবলুম, বাঃ, টর্চবাতির এলেম তো কম নয়? আর তারপরেই কাণ্ডখানা হল।”
“কী কাণ্ড?”
“হুড়মুড়িয়ে তিনি এসে হাজির।”
“তিনিটা কে?”
“আজ্ঞে, তা বলি কী করে? শুধু জানি দশাসই চেহারা। এসে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরপানে চেয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। আমি একটু গা-ঢাকা দিয়ে পেছনেই ছিলুম। দেখলুম ভয়ে আপনার প্রাণ ছাড়ার উপক্রম। আর তখন আপনার নেমকহারাম টর্চবাতিটাও কেমন বেইমানি করল বলুন। জ্বলল না, জ্বললে তেনাকে দেখতে পেতেন।”
“তিনিটা কে জানো?”
“আজ্ঞে না। কস্মিনকালেও দেখিনি।”
“ইনি তারা তান্ত্রিক নন তো?”
“তারা তান্ত্রিক? মানে সেই জটেশ্বরের জঙ্গলের বামাঠাকুরের কথা বলছেন নাকি?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। তিনি নন তো৷”
“আজ্ঞে, এই পাপচোখে তো তাঁর দর্শন হয়নি এখনও। দিন চারেক গিয়ে ধরনা দিয়ে পড়ে ছিলাম। তা বাবাঠাকুর নাকি সূক্ষ্ম দেহ ধারণ করে সারাক্ষণ দুনিয়া চষে বেড়ান। তাই তাঁকে চোখের দেখাটা হয়ে ওঠেনি। তবে তিনি কি আর ওই শস্তার টর্চবাতির জন্য রাতবিরেতে পঞ্চমুণ্ডির আসন ছেড়ে উঠে আসবেন?”
“তবে লোকটা কে?”
“বলা কঠিন মশাই। নবাবগঞ্জে নতুন নতুন সব জিনিস আসছে। ভয়ের কথাই হল।”
“এখন বলল তো তুমি কে?”
“শুনে কী করবেন? পুলিশে খবর দেবেন নাকি? সে গুড়ে বালি। আমাদেরও যে শ্রীকৃষ্ণের মতো একশো আটটা করে নাম।”
“আহা, পুলিশের কথা উঠছে কেন? নবাবগঞ্জের পুলিশদের আমি ভাল করেই চিনি। চোর ডাকাতের কথা শুনলে তারা সবার আগে হামাগুড়ি দিয়ে খাটের তলায় গিয়ে লুকোয়।”
“যে আজ্ঞে। তারা বুদ্ধিমান। আমার নাম হল গদাই দাস।”
“বাঃ, বেশ নাম।”
ভারী লজ্জার গলায় গদাই বলে, “কী যে বলেন। গদাই আবার একটা নাম হল! তবে কিনা পিতৃদত্ত নাম। তার মর্যাদাই আলাদা। এই পঞ্চার কথাই ধরুন। এমন আহাম্মক দুটি দেখিনি! পিতৃদত্ত নামটা অপছন্দ হওয়ায় কাছারিতে গিয়ে নাম পালটে কী যেন একটা হয়ে এল, তাও আবার পয়সা খরচ করে।”
“হ্যাঁ, জানি। প্রিয়ংবদ।”
“তাই হবে। কোনও মানে হয়? তা আপনি তাকে চেনেন নাকি?”
“তল্লাটের সব চোরকেই চিনি। শুধু গদাই দাসকেই চিনতুম
।”
“আজ্ঞে, নতুন আসা। জামালগঞ্জ গাঁয়ে ছিলুম, তা সেখানে তেমন সুবিধে হচ্ছিল না। ওইটুকু একটা গাঁয়ে আটচল্লিশজন চোর, ভাবতে পারেন? চোরে চোরে একেবারে ধূল পরিমাণ। সরু চোর, মোটা চোর, ট্যারা চোর, কানা চোর, ঢ্যাঙা চোর, বেঁটে চোর, কালো চোর, ধলা চোর, বাঁকা চোর, সিধে চোর–চোরের চিড়িয়াখানা যেন। রাতে পথে বেরোলে চোরে চোরে ধাক্কা লাগত মশাই। শেষে চোরের বাড়িতেও চুরি করতে চোর ঢুকতে শুরু করল। তখন আমার মনে হল, এ তো অধর্ম হয়ে যাচ্ছে। চোরের বাড়িতে চুরি করা তো মহাপাপ।”
“তাই এই গাঁয়ে এসে থানা গাড়লে বুঝি?”
“যে আজ্ঞে। আশীর্বাদ করবেন যেন কাজেকর্মে একটু সুবিধে করে উঠতে পারি। আপনাদের শ্রীচরণই ভরসা।”
“তা তো বটেই। তবে আমাদের শ্রীচরণের চেয়ে নিজের দু’খানা শ্রীহস্তের ওপরেই ভরসা করাই ভাল।”
“কী যে বলেন গবাক্ষকর্তা। আমরা হলাম আপনাদের পায়ের নীচে পড়ে থাকা সব মানুষ। তা ইয়ে টর্চবাতিটা কি আর একবার জ্বালাবেন নাকি কর্তা?”
গবাক্ষ আবাক হয়ে বললেন, “কেন হে, টর্চ জ্বালব কেন?”
“সত্যি কথা বলতে কী গবাক্ষকর্তা, জীবনে অনেক টর্চবাতি দেখেছি বটে, কিন্তু এমন তেজালো আলো আর কোনও টর্চ বাতিতে দেখিনি। তাই আর একবার দেখে চোখটা সার্থক করতে চাই। কেলোর দোকানে পাওয়া যায় বলছেন? আজ রাতেই দোকানটায় হানা দিতে হবে।”
গবাক্ষ প্রমাদ গুনলেন। গদাই দাস যে আলো দেখেছে তা টর্চবাতির আলো নয়। কিন্তু সেটা তো আর কবুল করা যায় না। তাই বললেন, “না হে গদাই, টর্চটা বোধ হয় গেছে। জ্বলতে চাইছে না। টর্চবাতি সম্পর্কে তুমি যা বলেছ সেটা অতি খাঁটি কথা। কখন যে জ্বলবে, কখন যে জ্বলবে না তার কোনও ঠিক নেই। বরং আর একদিন এসো, দেখাব।”
অমায়িক গদাই দাস বলল, “যে আজ্ঞে। তা হলে ওই কথাই রইল।”
গদাই দাস বিদায় নেওয়ার পর গবাক্ষ জানলাটা বন্ধ করে দিলেন। রাতে আর ঘুম হবে না। মাথাটা গরম।
.
টুং করে একটা মৃদু ঘণ্টার শব্দ হল। মাঝরাত্তিরে সজনীবাবু বিছানা ছেড়ে উঠলেন। দেওয়াল ঘড়িতে রাত দুটো বাজে। ল্যাম্পের আলোটা উসকে দিয়ে তিনি চারদিকটা দেখলেন। না, সব ঠিকঠাক আছে। বেশি ধনসম্পদ থাকার এই এক অসুবিধে। সবসময়ে একটা ভয় থাকে। নিশ্চিন্তে ঘুমোনো যায় না। সজনীবাবুর আজকাল ঘুম বিশেষ হতে চায় না সেই কারণেই। তার ওপর নতুন একটা দুশ্চিন্তা যোগ হয়েছে সন্ধে থেকে। জ্ঞানপাগলা নামে উটকো লোকটা কোত্থেকে এসে জুটল? ভেবে ভেবে মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছে।
অবশ্য ভয়ের কিছু নেই। তাঁর বাড়ি দুর্গের মতোই নিরাপদ। ঘরের দরজা জানলা আঁটা, বাইরে পাইক বরকন্দাজ পাহারায় আছে, আছে পোষা কুকুর। তা সত্ত্বেও নিশ্চিন্তে থাকাটা তাঁর আর হয়ে উঠল না।
ধনসম্পদ তো তাঁর শুধু একটা ঘরেই নয়, বিভিন্ন ঘরে বিভিন্ন কৌশলে সব লুকিয়ে রাখা আছে। সব ঠিকঠাক আছে কি না তা পরখ করে দেখার সবচেয়ে ভাল সময় হল মধ্যরাত।
ল্যাম্পটা উসকে নিয়ে তার আলোয় নিজের ঘরের সিন্দুকটা আগে খুললেন সজনীবাবু। হিরের বাক্সে গোটা পঞ্চাশেক ছোট বড় হিরে, মুক্তোর বাক্সে শতখানেক মুক্তো, মোহরের বাক্সে শ’ পাঁচেক মোহর ইত্যাদি সব ঠিকঠাকই আছে। আলমারি খুলে সোনা আর রুসোর অন্তত শ’দুয়েক থালা বাসন দেখে নিলেন।
ল্যাম্প রেখে দিয়ে একটা বড় টর্চ হাতে বেরিয়ে হলঘরে পা দিলেন। হলঘরের দেওয়ালে বড় বড় অয়েল পেন্টিং। অনেক পুরনো সব ছবি, সাহেবদের আঁকা। এসব ছবিরও লাখো লাখো টাকা দাম। ছবিগুলোর পেছনে গুপ্ত সব কুলুঙ্গিতে কোনওটাতে গয়না, কোনওটাতে পুরনো পুঁথিপত্র, দলিল দস্তাবেজ, কোনওটাতে পুরনো আমলের অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রাখা। ছবিগুলো একটু করে সরিয়ে দেখে নিলেন সজনীবাবু। না, সব কুলুঙ্গিই চাবি দেওয়া রয়েছে।
হল পেরিয়ে পেছন দিকের নির্জন ঠাকুরদালানে এসে পড়লেন সজনীবাবু। নিঃশব্দে তালা খুলে দোতলার মস্ত ঠাকুরঘরে ঢুকলেন। নিরেট রুপোর মস্ত সিংহাসনে সোনায় বাঁধানো হামা দেওয়া গোপালের মূর্তি। সূক্ষ্ম নেটের মশারিতে ঢাকা।
তিনি দেওয়ালের পেরেকে টাঙানো চামরটা নামিয়ে আনলেন। চামরটার হাতল রুপোয় বাঁধানো। সজনীবাবু হাতলটা ঘোরাতে লাগলেন। হাতলটার প্যাঁচ খুলে যেতে লাগল।
হাতলটা খুলে ফাঁপা অভ্যন্তরে টর্চের আলো ফেললেন সজনীবাবু। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ফাঁপা হাতলের ভেতরটা আজও ফাঁকা। হাতলটা আবার জুড়ে দিয়ে চামরটা যথাস্থানে রেখে সজনীবাবু বেরিয়ে এলেন। পেছনের দরদালান পার হয়ে একটা অব্যবহৃত সরু সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে সিঁড়ির তলায় পেছনের একটা ছোট্ট দরজার হুড়কো খুললেন, বাইরে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে।
সজনীবাবু চাপা গলায় বললেন, “কী খবর রে লক্ষ্মীকান্ত?”
“আজ্ঞে, মনে হচ্ছে সন্ধান পেয়েছি।” সজনীবাবু সিধে হয়ে উত্তেজিত গলায় বললেন, “পেয়েছিস? কোথায় সেটা? কার কাছে?”
“আজ্ঞে, গবাক্ষবাবুর কাছে।”
“কী করে বুঝলি?
“আপনার কথামতো বাড়ি বাড়ি আঁতিপাঁতি করে রোজ খুঁজে বেড়াচ্ছি। আজ মাঝরাতে অলিন্দবাবুর বাড়িতে ঢোকার জন্য জানলার শিক খুলছিলাম, তখন হঠাৎ দেখি গবাক্ষবাবুর বাড়ি থেকে একটা তেজালো আলো বেরোচ্ছে।”
“হ্যাজাক বা টর্চের আলো নয় তো!”
“আজ্ঞে না। ওসব আলো আমরা ভালই চিনি। এ অন্যরকম আলো। খুব তেজি আলো, আর খুব মিঠে।”
সজনীবাবু সোল্লাসে বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওরকমই আলো হওয়ার কথা। তারপর কী করলি?”
“তাড়াতাড়ি গবাক্ষবাবুর গবাক্ষে গিয়ে হাজির হলাম। কিন্তু আলো ততক্ষণে নিভে গেছে।”
“জিনিসটা হাতিয়ে আনতে পারলি না? একখানা রদ্দা মারলেই তো গবাক্ষর হয়ে যেত।”
“আজ্ঞে, সুবিধে হল না। কারণ সেই সময়ে একটা সা জোয়ান লোক কোথা থেকে হুড়মুড়িয়ে ছুটে এসে জানলার ওপর হামলে পড়ল।”
“কে লোকটা?”
“কস্মিনকালেও দেখিনি, তবে বিরাট চেহারা। আমি গা-ঢাকা দিয়েছিলাম।”
“চিনতে পারলি না! সে কী রে! কী করল লোকটা?”
“আজ্ঞে, জানলার সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরপানে খানিকক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর হুড়মুড়িয়ে চলে গেল।”
“এই রে! তা হলে তো অন্যেরও নজর পড়েছে! আর দেরি করা মোটই উচিত হবে না। তা লোকটা চলে যাওয়ার পর তো তুই ঘরে ঢুকে জিনিসটা কেড়ে আনতে পারতিস।”
“তারও অসুবিধে ছিল। উলটোদিকের নরহরিবাবুর বারান্দায় জ্ঞানপাগলা বসে ছিল যে! লোকে বলে সে নাকি ছদ্মবেশী রাজপুত্তুর আর খুব জ্ঞানী লোক।”
সজনীবাবু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললেন, “জ্ঞানপাগলা লোকটা কে বল তো! গত সন্ধে থেকে তার কথা শুনছি। লোকটা কোথা থেকে এসে উদয় হল?”
“তা জানি না।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সজনীবাবু বললেন, “তা তাকেও তো একটা রদ্দা কষাতে পারতিস!”
“আজ্ঞে, সেটাই মতলব ছিল। ভাবলাম, গবাক্ষবাবুর ঘরে ঢোকার আগে পাগলাটার ব্যবস্থা করে নিই। গবাক্ষবাবুর সঙ্গে কিছুক্ষণ আগডুম বাগড়ম কথা কয়ে পরিস্থিতিটা বুঝে নিলাম। মনে হল, গবাক্ষবাবু রাতে সজাগ থাকবেন। আর সজাগ গেরস্তর ঘরে ঢুকতে গেলে একটু সাড়াশব্দ হবেই। পাগলটা ঘুমোচ্ছিল। সোজা গিয়ে তার মাথায় একটা ঘেঁটে লাঠি জোরে বসিয়ে দিলাম।”
“বাঃ বাঃ, পাগলটা চোখ ওলটাল বুঝি?”
“আজ্ঞে না। ব্যাপারটা অত সোজা নয়। লাঠি বসাতেই পাগল বাঁ হাতে কোন কায়দায় কে জানে– লাঠিটা কপ করে ধরে ফেলল, তারপর ডান হাতে একখানা যা ঘুসি ঝাড়ল, বাপের জন্মে ওরকম ঘুসি খাইনি।”
“বলিস কী!”
“টর্চবাতিটা আমার মুখে ফেলুন। দেখছেন তো বাঁ গালের হনুটা কেমন লাল হয়ে ফুলে আছে। ঝরঝর করে রক্ত পড়ছিল।”
“তারপর?”
“ঘুসি খেয়ে ছিটকে বারান্দা থেকে জলকাদায় পড়ে গেলাম। অন্য কেউ হলে মুছা যেত। আমি লক্ষ্মীকান্ত–এককালে বিস্তর পুলিশের গুতো খেয়েছি বলে হাড় পেকে গেছে। কোনওরকমে উঠে দৌড়ে পালিয়ে এসেছি।”
“সর্বনাশ! তা হলে পাগলটাও কি টের পেল?”
“আপনাকে একটা কথা বলি কর্তা। আপনি আমাকে ছিচকে চুরি ছাড়িয়ে আপনার কাজে বহাল করার পর থেকে এ-তল্লাটের চোরেরা আমায় এড়িয়ে চলে। দোকানদার বলেই তারা আমাকে জানে। তাতেই তারা নাক সিঁটকোয়। যদি জানত যে দোকানটা আসলে একটা মুখোশ, তলায় তলায় আমি আপনার হয়ে চোরের ওপর বাটপাড়ি করি তা হলে তারা আমার ছায়াও মাড়াত না।”
“আহা, ওসব কথা উঠছে কেন? তোকে কি আমি খারাপ রেখেছি?”
“আজ্ঞে না, ভালই রেখেছেন। মাস গেলে বাঁধা মাইনে পাই। দোকান থেকেও আয় হয়। কিন্তু বাজারে আমার মানমর্যাদা নেই। সে যাকগে, ওসব দুঃখের কথা বলে কী হবে! আসল কথা হল চোরেরা আমাকে আজকাল আর কোনও গুপ্ত খবরটবর দেয় না। তবু কানাঘুষো শুনছি, ওই বিটকেল ছুঁচটা নাকি তারা তান্ত্রিকও খুঁজছে।”
সজনীবাবু আর্তনাদ করে উঠলেন, “অ্যাঁ।”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। তার চেলাচামুণ্ডারা সব বাড়ি বাড়ি ঢুকে ছুঁচ খুঁজে বেড়াচ্ছে।”
“সর্বনাশ! এ তো একেবারে ঢোলশোহরত হয়ে গেছে দেখছি। ছুঁচটা বেহাত হওয়ার আগেই যে ওটা আমার হেফাজতে আসা দরকার।”
“কর্তা, অপরাধ যদি না নেন তবে একটা কথা জিজ্ঞেস করি।”
“কী কথা?”
“এই বিটকেল ভুতুড়ে ছুঁচটা আসলে কার? কোথা থেকে এল?”
সজনীবাবু গর্জন করে বলে উঠলেন, “আমার ছুঁচ, আর কার? একজন সাধু আমাকে দিয়েছিল। বলেছিল, যত্ন করে রাখতে। কিছুদিন আগে ওটা চুরি যায়।”
লক্ষ্মীকান্ত একটু করুণ হাসল। “গত দশ বছরের মধ্যে আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোনও চোর এ বাড়িতে ঢুকেছে বলে শুনিনি। যদি ঢুকতে পারে তা হলে তাকে নিখিল নবাবগঞ্জ দলিত তস্কর সমাজ থেকে সোনার মেডেল দেওয়া হবে।”
“অ্যাঁ! এতদুর আস্পর্ধা তাদের!”
“কোনও চোর আপনার বাড়িতে ঢুকলে সে-খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ত।”
নিজেকে সামলে নিয়ে সজনীবাবু গম্ভীর গলায় বললেন, “বাইরের চোর নাও হতে পারে। বাড়ির ভেতরকার কারও কাজ হওয়া অসম্ভব নয়। বাড়ি ভর্তি কাজের লোক, পাইক-বরকন্দাজ। সর্ষের মধ্যেই তো ভূত থাকে। কিন্তু জিনিসটা আজ রাতেই উদ্ধার করতে হবে। পারবি? হাজার টাকা বকশিশ। “
করুণ একটু হেসে লক্ষ্মীকান্ত বলল, “পারব কিনা জানি না। তবে শেষ চেষ্টা একটা করে দেখতে পারি।
“দ্যাখ বাবা, দ্যাখ।”
লক্ষ্মীকান্ত বিদায় হলে সজনীবাবু ওপরে উঠে নিজের ঘরে এলেন। লক্ষ্মীকান্ত ভয় খেয়েছে। ভয়-খাওয়া লোককে দিয়ে কার্যোদ্ধারের আশা কম। সজনীবাবু তাড়াতাড়ি বেরোনোর পোশাক পরে নিলেন। বাইরে বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। তবে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে বেশ। একটা বাঁদুরে টুপি পরে হাতে মোটা বেতের লাঠিগাছটা নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন। সদর দরজা দিয়ে বেরোলে দরোয়ান দেখতে পারে। রাত মোটে দুটো বেজে কুড়ি মিনিট, এসময়ে তো আর কেউ প্রাতভ্রমণে বেরোয় না। সুতরাং দরোয়ানরা যাতে কিছু সন্দেহ না করে সেইজন্য পেছনের দরজা দিয়ে চুপিসারে বেরিয়ে এলেন। টর্চ জ্বেলে রাস্তাটা দেখে নিলেন একটু। জনমনিষ্যির চিহ্ন নেই। ভাঙাচোরা কাঁচা রাস্তা, দু’ধারে বড় বড় গাছ আর ঝোঁপঝাড়। সজনীবাবু খুশিই হলেন। যে কাজে যাচ্ছেন তার বেশি সাক্ষীসাবুদ না থাকাই ভাল।
বেশ জোরকদমেই এগোচ্ছিলেন, হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন ভারী বিনয়ী গলায় বলে উঠল, “সজনীবাবু যে! কী সৌভাগ্য! তা প্রাতভ্রমণে বেরোলেন নাকি?”
সজনীবাবু ধাঁ করে ঘুরে টর্চের আলো ফেলে দেখলেন, ধুতি আর জামা পরা, মাথায় গামছা বাঁধা বেঁটেখাটো একটা লোক। মুখে বিগলিত হাসি। হাত দুটো জোড় করে আছে। সজনীবাবু গম্ভীর মুখে শুধু বললেন, “হুম।”
“তা ইয়ে সজনীবাবু, বলছিলাম কী, সুয্যিঠাকুর কি আজ একটু তাড়াতাড়িই উঠে পড়বেন বলে আপনার মনে হয়?”
“কেন বলো তো?”
“এই ভাবছিলাম যে, সজনীবাবু যখন প্রাতভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছেন তখন সুয্যিঠাকুরও আজ বুঝি একটু পা চালিয়েই এসে পড়বেন।”
“তাতে কি তোমার সুবিধে হয়?”
“তা একটু হয় বটে। গোরুটা সন্ধেবেলা ঘরে ফেরেনি, সেই কখন থেকে বেটিকে গোরুখোঁজা করে খুঁজছি। অন্ধকারে কোথায় সেঁধিয়ে বসে আছে কে জানে! আলোটা ফুটলে একটু সুবিধেই হবে।”
“তা বটে।” বলে সজনীবাবু হাঁটতে লাগলেন।
লোকটা সঙ্গ ছাড়ল না। পিছু পিছু আসতে আসতে বলল, “তবে কিনা সুয্যিঠাকুরের তো শুধু এই নবাবগঞ্জ নিয়েই কারবার নয়। আরও পাঁচটা গাঁ গঞ্জও তো আছে। সব জায়গায় আলো ফেলতে গেলে পাল্লাটা তো নেহাত কম দাঁড়াবে না। কী বলেন?”
“তা বটে। তা হলে তুমি এবার তোমার গোরু খুঁজতে শুরু করো। দিনকাল ভাল নয়, গোরুচোরেরও খুব উপদ্রব হয়েছে। তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করে ফেলল। আমি বরং এগোই।”
“যে আজ্ঞে, যে আজ্ঞে।”
কিন্তু দশ পা যেতে-না-যেতেই প্যান্ট শার্ট পরা একটা ফচকে চেহারার ছেলের সামনা-সামনি পড়ে গেল। জ একটু কুঁচকে বলল, “মিস্টার চৌধুরী যে! এ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ! মর্নিং ওয়াকে বেরোলেন নাকি? ভেরি গুড, ভেরি গুড। কিন্তু এই কোল্ড ওয়েদারে আবার সর্দি ক্যাচ করে ফেলবেন না তো? ওয়াকিং স্টিকের বদলে একটা আমব্রেলা নিয়ে বেরোলেই তো পারতেন।”
সজনীবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, “হুম। তা তুমি এত রাতে পথে বেরিয়েছ কেন হে ছোঁকরা?”
“আর বলবেন না। লাইফটাই ডিসগাস্টিং। ঘরে ক্যান্টাং কারাস ওয়াইফ থাকলে যা হয়। ডিফারেন্স অব ওপিনিয়ন থেকে একটা শো-ডাউন হয়ে গেল। তাই মাথাটা ঠাণ্ডা করতে একটু ওপেনিং-এ বেরিয়েছি।”
“বেশ, বেশ, মাথাটা ভাল করে ঠাণ্ডা করো। আমি এগোই।”
“নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। বাই মিস্টার চৌধুরী।”
সজনীবাবু তৃতীয় বাধাটা পেলেন আরও বিশ গজ হাঁটার পর। একজন আধবুড়ো মানুষ দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকছিল। তাঁকে দেখেই বিড়িটা ফেলে দিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, “কে যায় রে! আরে এ যে গরিবের মা-বাপ সজনীরাজা। তাই বলি, আমরা কি যার-তার রাজ্যে বাস করি রে রেমোর মা? এ হল সজনীরাজার রাজত্ব। চারদিকে খেয়াল রাখেন। চারদিকে কান, চারদিকে চোখ, চার হাতে আগলান আমাদের, চার পায়েনা না এটা ভুল হয়ে যাচ্ছে।”
সজনীবাবু কটমট করে লোকটার দিকে চেয়ে বললেন, “থাক থাক, আর তেল দিতে হবে না।”
লোকটা অবাক হয়ে বলে, “বলেন কী বাবা। তেল না দিলে কি মেশিন চলে? তাও তেল আর দিতে পারি কই? অত পাইক বরকন্দাজ পেরিয়ে দেউড়িতে ঢুকতে পারলে তো! আর ঢুকলেই কি সুবিধে হবে? ভেতরে মোড়ল মুরুব্বিরা যে রাজাবাবাকে একেবারে ভেঁকে ধরে বসে থাকে। যেন পাকা কাঁঠালে ভোমা মাছি। তা প্রাতঃকৃত্যে বেরিয়েছেন নাকি বাবা?”
“না হে বাপু, প্রাতর্ভ্রমণে।”
“ওই একই হল। যার নাম চালভাজা তারই নাম মুড়ি।”
লোকটার দিকে আর ভ্রুক্ষেপ না করে সজনীবাবু তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলেন।
“রামজিকি কৃপা। আরে ই তো সোজোনীবাবু আছে। রাম রাম সোজোনীবাবু, শরীর দেমাক সব তন্দুরস্ত আছে তো?”
এ-পর্যন্ত যেক’টা লোকের দেখা পেয়েছেন তাদের একজনকেও সজনীবাবু চেনেন না। নবাবগঞ্জ ছোট জায়গা, এখানে সবাইকে সবাই চেনে। সজনীবাবুও চেনেন। কিন্তু এ লোকগুলোকে চেনা ঠেকছে
কেন, তা ভেবে পাচ্ছেন না। আসলে যে মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে তার মাথায় বিড়ের মতো একটা পাগড়ি গোছের, গায়ে গলাবন্ধ কোট, পরনে ধুতি। খুবই বশংবদের মতো হাত জড়ো করে দাঁড়িয়ে।
সজনীবাবু লোকটিকে কাটানোর জন্য বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, সব ভাল।”
“রামজিকি কৃপা, লেকিন হুজুর, কলিযুগ কি খতম হয়ে গেলো নাকি?”
‘কেন বলুন তো?”
“আমি তো ভাবছিলাম কি, কলিযুগ খতম হোতে আউর ভি দু-চার বরষ লাগবে। কিন্তু আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে কলিযুগ সায়দ খতম হোয়েই গিয়েছে।”
সজনীবাবু ক্রমশ চটছেন। এবার খ্যাঁক করে উঠলেন, “আমার সঙ্গে কলিযুগের সম্পর্ক কী মশাই?”
“আমার বুঢ়া দাদাজি বলত, বুঢ়া দাদাজি সমঝলেন তো? হামার পিতাজি কি পিতাজি, বুঝলেন?”
“বুঝলাম।”
“তো বুঢ়া দাদাজি কহতা থা কি, কলিযুগ যখন খতম হোবে তখন রাত মে দিন হোবে আউর দিন মে রাত। উস লিয়ে বলছিলাম কি সোজোনীবাবু, এখুন কি দিন না রাত। আপনি তো সবেরকা ঘুমনা শুরু কর দিয়া। তাই ভাবলাম, সোজোনীবাবু পণ্ডিত লোক আছে, কলিযুগ খতম হলে উনি ঠিক টের পাবেন।”
সজনীবাবু লোকটার দিকে কটমট করে একবার চেয়ে বললেন, “হুম। যত্তসব।”
বলে আবার জোর কদমে হাঁটতে লাগলেন। না, আর কোনও উদ্ভট লোকের উদয় হল না। তবে মোড়ের কাছ বরাবর যখন। এসেছেন তখন পাশের ঝোঁপের আড়াল থেকে কে যেন মৃদুস্বরে চাপা গলায় ডাকল, “একটা কথা ছিল কর্তা।”
সজনীবাবু বিরক্তিকর সঙ্গে বললেন, “আমার সময় নেই।”
“আমি ওদের দলের লোক নই।”
“তুমি কে?”
একজন মাঝারি মাপের মানুষ ঝোঁপের আড়াল থেকে কুঁজো হয়ে বেরিয়ে এল। গায়ে গেঞ্জি, পরনে হেঁটো ধুতি, চোখে-মুখে একটু ভয়-ভয় ভাব। হাতজোড় করে বলল, “আজ্ঞে, আমি শ্রীদাম।”
এই প্রথম একটা লোককে চেনা ঠেকল সজনীবাবুর। এ লোকটা তাঁর বাগান পরিষ্কার করেছিল গত বছর। বিরক্তির সঙ্গে সজনীবাবু বললেন, “তুই আবার কী চাস? একটা কাজে যাচ্ছি, পদে পদে বাধা পড়ছে।”
“আজ্ঞে, কর্তা, আমাদের ওপর বড় অবিচার হচ্ছে।”
“অবিচার। কীরকম অবিচার?”
“আমরা ভুমিপুত্তুর কিনা বলুন।”
“ভূমিপুত্তর। সে আবার কী রে?”
“আজ্ঞে, এটাই আমাদের জন্মভূমি বটে তো! নবাবগঞ্জেই তো জন্মে ইস্তক এত বড়টি হলাম। তাকেই তো বলে ভূমিপুত্তুর।”
“ভূমিপুত্র নাকি। হ্যাঁ, কথাটা শুনেছি বটে। সন অব দ্য সয়েল।”
“আজ্ঞে, ইংরিজিতে তাই বলে বটে। সং অব্দি সয় লো। তা এই ভূমিপুত্তুরেরও উপায় নেই?”
“তা থাকবে না কেন?”
“আজ্ঞে, সেইটেই তো সমস্যা দাঁড়াচ্ছে। সারাদিন খেটেখুটে যা জোটে তাতে পেট চলে না। তাই রাতের দিকে দুটো বাড়তি পয়সা রোজগার করতে বেরোতে হয়। সত্যি কথাটা কবুল করলাম বলে অপরাধ নেবেন না কর্তা।”
“হুম। তা সমস্যাটা কোথায়?”
“কিন্তু পয়সা রোজগারের কি জো আছে? কোথা থেকে উটকো সব লোক এসে নবাবগঞ্জ ভরে ফেলল। রাতবিরেতে পথেঘাটে যত্রযত্র তাঁরা দাঁত বের করে দেখা দিচ্ছে।”
“বটে!”
“পরশুদিন হরিপদ সরখেলের বুড়ি পিসির সোনার হারখানা হাতাব বলে খিড়কির দরজাটা সবে আলগা করেছি, অমনই এক ছোঁকরা এসে হাজির। বলে কী, এঃ হেঃ, দরজা কি ওরকম আনাড়ির মতো খুলতে হয়? দেখি তোমার যন্ত্রপাতি। ইস, এইসব মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতি নিয়ে তোমরা চুরি করতে বেরোও নাকি? তোমরা খুবই পিছিয়ে আছ হে। এই আধুনিক পৃথিবীতে কত নতুন নতুন যন্ত্র তৈরি হয়েছে। তোমরা কি একটু বিজ্ঞান-টিজ্ঞানও পড়ো
নাকি…বলে সে কী লেকচার। যেন ইস্কুলের ক্লাস নিচ্ছে। চেঁচামেচিতে হরিপদবাবু উঠে, “কে, কে বলে চেঁচাতে পালিয়ে বাঁচি।”
সজনীবাবু হাঁটা বজায় রেখেই বললেন, “ছোঁকরাটা কে?”
“সেই কথাই তো বলছি। ছোঁকরা ভূমিপুত্তুর নয়, উটকো লোক। এই যে আপনার সঙ্গে চার-চারজন মশকরা করছিল, কাউকে চিনলেন?”
সজনীবাবু একটু থমকে গিয়ে বললেন, “না। কারা ওরা?”
“ভূমিপুত্তুর নয় কর্তা, উড়ে এসে জুড়ে বসেছে সব। দিনদিন সংখ্যা বাড়ছে।”
সজনীবাবু এবার সত্যিই থমকালেন এবং একটু চমকালেনও। বললেন, “কবে থেকে দেখছিস এদের?”
“দিন দুই-তিন হল। দিনমানেও দেখবেন বাজারে সড়কে এরা ঘোরাফেরা করছে, জটলা পাকাচ্ছে।”
“কোথা থেকে আসছে এরা! কী চায়?”
“ছোঁকরাকে জিজ্ঞেস করেছিলুম তার বাড়ি কোথায়। বলল তো নয়নগড় না কী যেন। নয়নগড় কোথায় কে জানে বাবা, জন্মে শুনিনি।”
“নয়নগড়? ঠিক শুনেছিস?”
“সেরকমই তো বলল যেন।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সজনীবাবু বললেন, “কী চায় এরা?”
“আমাদের ভাত মারতে চায়, আর কী চাইবে?”
সজনীবাবু পেছন ফিরে টর্চ জ্বেলে পথটা দেখলেন। চারজনের কাউকেই দেখা গেল না। সজনীবাবু চিন্তিত মুখে বললেন, “আমার দরোয়ান আর পাইকদের একটু হুঁশিয়ার করে দিয়ে আয় তো। ব্যাপারটা আমার সুবিধের ঠেকছে না। যা, দুটো টাকা দেব’খন।”
“যে আজ্ঞে। তবে দু’ টাকায় আজকাল এক পো চালও হয় না কর্তা।”
“যা, পাঁচ টাকাই পাবি।”
“তা হলে চালের সঙ্গে ডালটা হল। কিন্তু বাঙালির যে একটু আঁশটে গন্ধও লাগে কর্তামশাই, না হয় পুঁটিমাছের দামটাই দিলেন।”
“অ। তুই তো ঘঘাড়েল দেখছি। আচ্ছা, দশ টাকাই দেব।”
“ওঃ, অনেকটা ওপরে উঠেছেন কর্তা। আর দু’ ধাপ উঠলে ওইসঙ্গে একটু নুন-লঙ্কাও হয়ে যায়।”
“দু’ ধাপ বলতে?”
“দুটো টাকা মাত্র। ও আপনি টেরও পাবেন না। পানের পিক ফেলার মতো, নাকের সিকনি ঝাড়ার মতো ফেলে দিলেই হবে।”
“হাতি কাদায় পড়লে চামচিকেও লাথি মারে দেখছি।”
“আজ্ঞে, চামচিকের তো ওইটাই মওকা কিনা। তাকেও তো হাতযশ দেখাতে হয়।”
“হুম। তুই বুদ্ধি রাখিস বটে! আচ্ছা যা, বারো টাকাই দেব।”
“তা হলে আগাম ফেলুন, দৌড়ে যাই।”
পকেট থেকে টাকা বার করে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে লোকটার হাতে দিয়ে বললেন, “কিন্তু কাজটা ঠিকমতো করিস, নইলে কালই পাইক পাঠিয়ে ধরে আনব।”
“প্রাণটা তো আপনার কাছেই গচ্ছিত রয়েছে।”
শ্রীদাম দৌড়ে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর সজনীবাবু খুব জোর পায়ে হেঁটে গবাক্ষর বাড়ি অবধি পৌঁছে গেলেন। চারদিক নিঝঝুম। কারও কোনও সাড়াশব্দ নেই। টর্চ জ্বেলে দেখলেন, নরহরি মাস্টারের বারান্দায় পাগলাটাকে দেখা যাচ্ছে না। টর্চের আলো যতদূর যায়, জনমনিষ্যি নেই।
লক্ষ্মীকান্ত কি কাজ সেরে চলে গেছে? কিন্তু গবাক্ষর ঘরের দরজা বন্ধ। কোনও ঘটনা ঘটেছে বলে মনেই হচ্ছে না।
তিনি ধীরে ধীরে গবাক্ষবাবুর ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। দরজাটা ঠেলে দেখলেন, ভেতর থেকে বন্ধ। জানলাগুলোও খোলা নেই।
দরজায় টোকা দিয়ে তিনি মৃদুস্বরে ডাকলেন, “গবাক্ষবাবু, ও গবাক্ষবাবু।”
কেউ সাড়া দিল না। সজনীবাবু ঘড়ি দেখেলেন। তিনটে বাজে। এই সময়ে যদি কেউ তাঁকে এখানে দেখে ফেলে তবে সন্দেহ করতে পারে। এ তো ঠিক প্রাতভ্রমণের সময় নয়।
কিন্তু কাজটাও জরুরি। জিনিসটা উদ্ধার হল কি না তা হলে জানাটাও ভীষণ দরকার। অগত্যা সজনীবাবু ঘরের জানলাগুলো বাইরে থেকে ঠেলেঠুলে দেখতে লাগলেন।
পুবদিকের জানলাটা ঠেলতেই খুলে গেল। সজনীবাবু ভেতরে টর্চ ফেলে দেখলেন, গবাক্ষ চাঁদরমুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। তিনি চাপা স্বরে ‘গবাক্ষবাবু, গবাক্ষবাবু’ বলে দু’বার ডাকলেন।
তারপরই তাঁর হঠাৎ নজরে পড়ল গবাক্ষবাবুর গায়ে যে চাঁদরটা চাপা দেওয়া রয়েছে তাতে যে লাল রঙের ছোপগুলোকে তিনি চাঁদরের নকশা বলে প্রথমে ভেবেছিলেন তা আসলে রক্তের দাগ। জিনিসটা যে রক্তই তা আরও ভাল করে বুঝলেন মেঝেতে আলো ফেলে। সেখানেই খানিকটা রক্ত পড়ে জমাট বেঁধে আছে।
সর্বনাশ! শেষে লক্ষ্মীকান্ত কি গবাক্ষকে খুন করে গেল নাকি? তো ঘটনা অনেকদূর গড়াবে। অকুস্থলে ধরা পড়লে তাঁরও বিপদ। সজনীবাবু টর্চটা নিভিয়ে তাড়াতাড়ি স্থানত্যাগের জন্য পা বাড়াতেই ফের বিপদ।
পাশের দোতলা বাড়ির ওপরের বারান্দা থেকে গবাক্ষর ভাই অলিন্দ গদগদ স্বরে বলে উঠল, “সজনীখুড়ো যে। তা আজ কি দাদাকে শব্দার্থ জিজ্ঞেস করতে এসেছেন? খুব ভাল। বেশ কঠিন দেখে শব্দ বেছে এনেছেন তো! একেবারে গুতুলের মতো হওয়া চাই কিন্তু। ঠঙাত করে গিয়ে মাথায় লাগবে আর সঙ্গে সঙ্গে কুপোকাত। ওঃ, কাল নরহরিবাবুকে একখানা যা ঝেড়ে গেছেন, যেন আধলা ইট।”
সজনীবাবু পালানোর মতো মূর্খামি করলেন না। অলিন্দ তাঁকে দেখে ফেলেছে, এখন পালালে সন্দেহ করবে। বিপদের সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখাই হল বুদ্ধিমানের মতো লক্ষণ।
তিনি খুব ভালমানুষের মতো বললেন, “তা তুমি আজ তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছ বুঝি।”
“না খুড়ো, মাঝরাতে ওঠার অভ্যাস নেই। কিন্তু নবাবগঞ্জের যা অবস্থার অবনতি হচ্ছে তাতে ঘুমোয় কার সাধ্যি! রাত হতে-না-হতেই চোর-ছ্যাঁচড়ের যেন হাট বসে যায়। এই কেউ দৌড়ে গেল, এই কেউ দরজায় ঠকাত করে শব্দ করল, এই কেউ ফিসফিস করে কারও সঙ্গে শলা-পরামর্শ করতে লাগল। আড়াইটে পর্যন্ত এপাশ-ওপাশ করে এই বারান্দায় এসে একটু হাওয়া খাচ্ছি। আপনারও কি সেই অবস্থা?”
“আর বলল কেন, একটু আগেই চোর ঢুকেছিল বাড়িতে। শুনছি নয়নগড় না কোথা থেকে একদল খুনে গুণ্ডা আর লুঠেরা নবাবগঞ্জে ঢুকে পড়েছে। তা আমার তো একটা দায়িত্ব আছে। তাই ঘুরে ঘুরে চেনাজানা লোকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি।”
“তা হলে তো খুব ভয়ের কথা হল খুড়ো। সেইজন্যেই আজকাল রাতবিরেতে উৎপাত বেড়েছে। তা নয়নগড় জায়গাটা কোথায়?”
“জানি না। লোকমুখে শোনা কথা।”
“সেই জায়গাটা কি বদমাশদের বীজতলা?”
“তাই তো মনে হয়।”
“আরে দাঁড়ান, দাঁড়ান, জ্ঞানপাগলা যেন কোথাকার রাজপুত্তুর! হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে তো নয়নগড়ের রাজপুত্তুরই তো বলে নিজেকে।”
সজনীবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “সাবধানে থেকো। কাউকে বিশ্বাস করা ঠিক নয়। কে কোন ভেক ধরে আসছে তার ঠিক কী?”
“তাই তো। এ যে বেশ ভয়-ভয় লাগছে। জ্ঞানপাগলা কি ওই দলের সর্দার?”
“বিচিত্র কী?”
“তা হলে কী করা যায় খুড়ো?”
“রাত পোহালেই মহেশ দারোগাকে একটা খবর দিয়ে রাখো। আর তোমরাও তৈরি থাকো। সবাই মিলে জোট বেঁধে লোকগুলোকে না তাড়ালেই নয়।”
সজনীবাবু আর দাঁড়ালেন না। লক্ষ্মীকান্ত যে ভজঘট্ট পাকিয়েছে তার সুরাহার কথা এখনই গিয়ে ভাবতে হবে। সে কার্যোদ্ধার করেছে কিনা সেটাও দেখা দরকার।
বুড়ো শিবতলার কাছে বাঁধানো বটগাছের কাছে এসে থমকালেন সজনীবাবু। কে একটা বসে আছে। টর্চের আলো ফেলে দেখলেন, দাড়ি গোঁফওয়ালা একটা অল্পবয়সী ছেলে, মাথায় রঙিন টুপি। বসে আপনমনে বিড়বিড় করে কী বকছে। এই কি জ্ঞানপাগলা? তাই হবে। পথেঘাটে একে এক-আধবার দেখেছেন, মনে পড়ল।
সজনীবাবু ধীরে ধীরে তার কাছে এগিয়ে গেলেন, তারপর মোলায়েম গলায় বললেন, “নয়নগড়ের রাজপুত্তুর নাকি?”
ছোঁকরা মিটমিট করে ধাঁধালো টর্চের আলোর ভেতর দিয়ে সজনীবাবুর দিকে তাকাল। তারপর হঠাৎ ঝকঝকে দাঁতে একটু হেসে বলল, “শব্দের মানে জিজ্ঞেস করবেন নাকি?”
সজনীবাবু গলাটা নরম রেখেই বললেন, “না। আমি অন্য কথা জিজ্ঞেস করব।”
“কী কথা?”
“তুমি যদি নয়নগড়ের রাজপুত্তুর তবে এই নবাবগঞ্জে বসে কী করছ?”
ছেলেরা একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “খাজনা আদায় করছি।”
“অ। তা ভাল। তা এখানেই কি থাকার ইচ্ছে?”
“না। এ তো বিচ্ছিরি জায়গা। সময় হলেই চলে যাব।”
“এখানে কোনও কাজ কি বাকি আছে?”
“হ্যাঁ। জরুরি কাজ। আমি একটা ছুঁচ খুঁজছি।”
“ছুঁচ! ছুঁচ খুঁজছ। সে আবার কী কথা?”
ছোঁকরা অকপটে সজনীবাবুর দিকে চেয়ে বলল, “ছুঁচটা আরও অনেকেই খুঁজছে। কিন্তু ওটা আমার জিনিস।”
“অ। তা কীরকম ছুঁচ?”
ছোঁকরা হঠাৎ একটা খাস ফেলে বলল, “সে তুমি বুঝবে না। পৃথিবীর লোভী লোকেরা ওটা নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে। কিন্তু ওটা আমার খুব দরকার।”
“একটু ভেঙে বলবে বাপু? ছুঁচটা তোমার কী কাজে লাগে?”
“ছুঁচটা না পেলে আমার নির্বাসন ঘুচবে না। আমি দেশে ফিরে যেতে পারব না।”
সজনীবাবুর বুক কাঁপছিল উত্তেজনায়। তিনি চুপ করে রইলেন। ছোঁকরা ধীর গলায় বলল, “এক ভোররাতে মাজুম আমাকে তাড়া করেছিল।”
“মাজুম! সে আবার কে?”
“তুমি তাকে জানো না। সে ভয়ংকর এক মানুষ। নয়নগড়েরই লোক, কিন্তু সে আমার শত্রু।”
সজনীবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, “নাঃ, ছোঁকরা সত্যিই পাগল।”
জ্ঞান আপনমনে ধীর স্বরে বলল, “মাজুম আমাকে পেছন থেকে বল্লম ছুঁড়ে মেরেছিল। ঘুমপাড়ানি বল্লম। জটেশ্বরের জঙ্গলের ধারে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই। তখনই ছুঁচটা বেহাত হয়ে গিয়েছিল।”
“ছুঁচটা কে নিল? মাজুম?”
ছোঁকরা মাথা নাড়ল, “না। তখন দিনের আলো ফুটে উঠছিল। দিনের আলোয় মাজুম চোখে কিছু দেখতে পায় না।”
“সে তখন কী করে?”
“সে দিনের বেলায় লুকিয়ে থাকে। গুহায়, গর্তে, গভীর জঙ্গলে।”
“এ তো আষাঢ়ে গল্প! আমরা তো দিনের আলোতেই দেখি।”
“তোমরা দেখতে পাও, কিন্তু বাদুড় বা প্যাঁচা দেখতে পায় কি?”
“না, তা পায় না।”
“মাজুমের চোখ ওদের মতো।”
“অ। তা হলে ছুঁচটার কী হল?”
“আমি যখন অজ্ঞান হয়ে যাই তখন ওটা আমার হাত থেকে ছিটকে পড়ে। তখন কেউ ওটা কুড়িয়ে নিয়েছিল।”
সজনীবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এর পরের ঘটনা তিনি খানিকটা জানেন। বললেন, “কে কুড়িয়ে পেয়েছিল জানো?”
“তোমাদের এখানে কিছু লোক আছে যারা অন্যের জিনিস পেলেই নিয়ে নেয়।”
“তা তো নেই। এখানে মেলা চোর। তোমাদের নয়নগড়ে কি চোরছ্যাঁচড় নেই নাকি?”
“না। সেখানে অন্যের জিনিস কেউ নেয় না।”
“তা হলে মাজুম তোমার ছুঁচ চুরি করতে চায় কেন?”
“তার কারণ অন্য। সে আমাকে নয়নগড়ে ফিরে যেতে দিতে চায় না।”
“অ। তা হলে ছুঁচটা ছাড়া তুমি নয়নগড়ে ফিরবে না?”
“ফেরা সম্ভব নয়।”
সজনীবাবু খানিকক্ষণ ভাবলেন। ছোঁকরা যা বলছে তা তিনি বুঝতে পারছেন না। কোথায় যেন লটঘট আছে গল্পটার মধ্যে।
আবার অবিশ্বাসও করতে পারছেন না। সজনীবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছোঁকরার পাশেই বসলেন। তারপর বললেন, “ছুঁচটা কুড়িয়ে পেয়েছিল দেড়েল কালী নামে একটা লোক। ছুঁচটা থেকে আলো বেরোয় দেখে সে সেটা দামি কোনও জিনিস মনে করে বেচবার জন্য আমার কাছে নিয়ে যায়। সে দাম চেয়েছিল দশ হাজার টাকা। আমি অচেনা জিনিস পাঁচশো টাকার বেশি দিতে চাইনি বলে সে চলে যায়। জিনিসটা সে আরও কয়েকজনের কাছে বিক্রি করার চেষ্টা করে। শেষে কিছু লোক তাকে মেরেধরে ওটা কেড়ে নেয়। যারা কেড়ে নিয়েছিল তাদের মধ্যেও আবার লড়াই লাগে। তখনই সেটা কারও হেফাজত থেকে খোয়া যায় আর গবাক্ষবাবু সেটা কুড়িয়ে পান। আমি পরে যখন কালীর কাছে জিনিসটা কিনব বলে খবর পাঠাই তখন সে আমাকে ঘটনাটা জানায়। জিনিসটা নবাবগঞ্জে আছে মনে করে আমি লক্ষ্মীকান্ত নামে আমার একজন চেনা চোরকে লাগাই। সে এই কয়েক ঘণ্টা আগে এসে খবর দিল যে, গবাক্ষবাবুর কাছে জিনিসটা আছে।”
সজনীবাবু থামলেন। বাকিটা বলা উচিত হবে না। ছোঁকরা মাথা নেড়ে বলল, “গবাক্ষবাবুর কাছে নেই। আর তোমার লক্ষ্মীকান্তকে মেরে আধমরা করে রেখে গেছে মাজুম। আর গবাক্ষবাবুকে ধরে নিয়ে গেছে।”
“অ্যাঁ! গবাক্ষবাবুকে কোথায় ধরে নিয়ে গেল? কেনই বা!”
“গবাক্ষবাবুর ঘরে যখন জান-এর আলো দেখতে পেলাম তখনই বুঝলাম গবাক্ষবাবুর বিপদ আছে। মাজুম যেখানেই থাকুক, জান এর আলো সে দেখতে পাবেই।”
“জান! জানটা কী জিনিস?”
“ওই ছুঁচটার নাম। নয়নগড়ের একজন মানুষ ছিলেন জান। তিনিই সময়ের এই কাঁটাটি আবিষ্কার করেন।”
“সময়ের কাঁটা! আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না বাপু।”
“বুঝবে না। ওটাই আমার নয়নগড়ে ফেরার চাবি।”
“নয়নগড়টা কোথায় বাপু?”
“এইখানেই। মাইলখানেকের মধ্যেই।”
“তা হলে যেতে বাধা কী?”
“তুমি জানো কাছাকাছি নয়নগড় বলে একটা জায়গা আছে?”
“না তো!”
“কেন জানো না তা জানো? আসলে নয়নগড় এখানেই আছে, কিন্তু ভিন্ন কম্পাঙ্কে।”
“ও বাবা! মাথা যে ঝিমঝিম করছে।”
“পৃথিবীটা খুব বিচিত্র।”
“তুমি কি সত্যিই পাগল?”
“আমার কথা বুঝতে না পারলে লোকে তো পাগলই ভাববে। গালিলেওকে কি তোমরা পাগল ভাবোনি!”
“তা বটে!”
“আমি সোজা করে তোমাকে একটু বুঝিয়ে দিচ্ছি। একটা রেডিয়ো বা টিভি সেটে যেমন অনেক চ্যানেল থাকে, পৃথিবীটাও তেমনই। এর এক-এক চ্যানেলে এক-এক জীবন, এক-এক সমাজ। কেউ কারও মতো নয়। আমরা যেনয়নগড়ে থাকি তোমরা তা কখনও খুঁজে পাবে না, অথচ তা এখানেই আছে।”
রুমাল বের করে সজনীবাবু কপালের ঘাম মুছে বললেন, “ও সব শুনে আমার মাথা ঘুরছে। গবাক্ষর কথাটা শেষ করো।”
“গবাক্ষবাবুর ঘরে জানের আলো জ্বলে উঠতেই মাজুম জটেশ্বরের জঙ্গল থেকে ছুটে চলে আসে।”
“অতদুর থেকে?”
“সে ঘণ্টায় একশো মাইল বেগে দৌড়তে পারে।”
“ও বাবা!”
“সে এসে হাজির হল এবং বুঝতে পারল জান এখানেই আছে। সে তখনই আমার উপস্থিতি টের পায় এবং আমি পালাই। সে কিছুদুর আমাকে তাড়া করে ফিরে আসে। আমিও ফিরি। সে গবাক্ষবাবুর ঘরে ঢোকে। ঢুকে গবাক্ষবাবুকে হিংস্র চাপা গলায় বলে, ছুঁচটা দে। নইলে মেরে ফেলব। গবাক্ষবাবু ভয় পেয়ে দিয়ে দেন। কিন্তু ঠিক এই সময় লক্ষ্মীকান্ত এসে ঘরে ঢোকে আর ছুঁচটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। পারবে কেন? মাজুম তাকে মেরে শুইয়ে দেয়।”
“সে কি মরে গেছে?”
“না। ওরা চলে যাওয়ার পর আমি ঘরে ঢুকে দেখে এসেছি। লক্ষ্মীকান্তর খাস চলছে।”
“বাঁচা গেল। তারপর?”
“এই সময়ে গবাক্ষবাবু একটা ভুল করেন। অবশ্য না জেনে। তাঁর হাতে একটা টর্চ ছিল। হঠাৎ তিনি টর্চটা জ্বেলে ফেলেন। আর আলোটা গিয়ে সোজা মাজুমের চোখে পড়ে। চোখে আলো পড়লেই মাজুমের সর্বনাশ। সে সঙ্গে সঙ্গে কিছুক্ষণের জন্য অন্ধ হয়ে যায়। গবাক্ষবাবু আলো জ্বালাতেই মাজুম খেপে যায়। বরাবরই সে ওইরকম। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য। সে প্রথমে অন্ধের মতো টর্চটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। সেটা না পেয়ে সে গবাক্ষবাবুকেই জাপটে ধরে।”
“কেন?”
“পথ দেখানোর জন্য। বলেছি না সে চোখে আলো পড়লে অন্ধ হয়ে যায়? তখন কে তাকে পথ দেখাবে?”
“তুমি কিছু করলে না?”
“হ্যাঁ। আমি সেই সুযোগে একবার চেষ্টা করেছিলাম তার কাছ থেকে জান কেড়ে নিতে। কিন্তু মাজুমের গায়ে এমনিতেই সাতটা হাতির মতো জোর। তার ওপর সে তখন খেপে আছে। একটা ঝটকায় আমাকে দশ হাত দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে চলে যায়।”
সজনীবাবু বললেন, “তোমার গল্পটা রূপকথার মতো। তবু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। শোনো বাপু, তোমার জানের ব্যাপারে আমারও কিছু অপরাধ আছে। ওটা আমিও দখল করার চেষ্টা করেছিলাম।”
“অনেকেই করবে। জান এক আশ্চর্য জিনিস। সঠিক প্রয়োগ করলে সে তোমাকে ভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সি বা কম্পনে নিয়ে যেতে পারে।”
“না বাপু, ওসব নয়। আমি ভেবেছিলুম, একটা আশ্চর্য আলো ঠাকুরঘরে জ্বালিয়ে রাখব।”
“হ্যাঁ, জানের আলো আশ্চর্য আলো। জ্বালিয়ে রাখলে কয়েক হাজার বছর ধরে জ্বলবে।”
“বলো কী।”
“জান একটি ধাতব জিনিস। তোমরা সেই ধাতুর সন্ধান জানো। অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলেই তা আলো দিতে থাকে।”
‘তুমি সত্যিই নয়নগড়ের রাজপুত্র?”
“হ্যাঁ। আমি যুবরাজ।”
“আর ওই মাজুম?”
“সে আমার শত্রু। সে আমাকে নয়নগড়ে ফিরে যেতে দেবে না। সেইজন্যই সে জান কেড়ে নিয়ে গেছে।”
“তাতে তার কী লাভ?”
“সে তুমি বুঝবে না। নয়নগড়ে রাত আর দিনের মধ্যেই একটা সংঘর্ষের ব্যাপার আছে। মাজুম এবং তার লোকেরা চায় আমার বাবা দিনের বেলা রাজত্ব করুক, কিন্তু সন্ধের পর থেকে ভোর অবধি রাজত্ব করবে ওই মাজুম। এই প্রস্তাব আমার বাবা মানেননি। তাই একটা লড়াই চলছে। আমাকে তোমাদের কম্পাঙ্কে নির্বাসন দিতে পারলে মাজুম নিষ্কণ্টক হবে। আমার অসহায় বুড়ো বাবা তাদের কাছে হার মানতে বাধ্য হবেন। কারণ মাজুমরা সংখ্যায় বেশি, তাদের গায়ের এবং অস্ত্রের জোরও বেশি। শুধু দিনের বেলা অন্ধ হয়ে যায় বলে তারা খানিকটা দুর্বল।”
“এখানে যারা নয়নগড়ের লোক বলে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা কোন দলের?”
“কিছু আমার দলের, কিছু মাজুমের।”
“এখন আমরা কী করব?”
বিষণ্ণ গলায় জ্ঞানপাগলা বলল, “কিছুই করার নেই। বোধ হয় আমি হেরেই গেলাম।”