অগ্রহায়ণ মাসের শেষ
অগ্রহায়ণ মাসের শেষ। শীতের শুরুতে বেশ জম্পেশ করে বৃষ্টি নেমেছে সন্ধেবেলা। নবাবগঞ্জের রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে এসেছে। তবু বৃষ্টির মধ্যেই জনাচারেক আড্ডাধারী ছাতা মাথায় দিয়ে এসে সজনীবাবুর বৈঠকখানায় জড়ো হয়েছে। ঘরের এক কোণে একটা জলচৌকির ওপর আসনপিড়ি হয়ে শ্যামা তান্ত্রিকও বসা।
হাতটাত কচলে হেঃ হেঃ করে বিগলিত হাসি হেসে গবাক্ষবাবু বললেন, “ওঃ, আজ সকালে যা একখানা দিলেন না সজনীবাবু, একেবারে গুগলি। নরু মাস্টারের আর বাক্য সরল না।”
সজনীবাবু খুব উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, “নরু মাস্টার কে?”
“আরে আমাদের অভয় বিদ্যাপীঠের বাংলার মাস্টার নরহরি।”
“ওঃ, তা হবে। তা তাকে সকালে কিছু বলেছি নাকি?”
গবাক্ষ অবাক হয়ে বলেন, “বলেননি? সেই যে কল্যবর্ত শব্দের মানে জিজ্ঞেস করলেন আর নরু মাস্টার হাঁ হয়ে গেল! সারা গাঁয়ে তো টি-টি পড়ে গেছে তাই নিয়ে।”
সুধীরবাবু বললেন, “আমরা তো গণ দরখাস্ত নিয়ে ইস্কুলে গিয়ে নরু মাস্টারকে বরখাস্ত করার দাবি পর্যন্ত জানিয়েছি।”
সজনীবাবু উদাস নয়নে দেওয়ালের দিকে চেয়ে বললেন, “আহা, মাস্টার মানুষ, ক’টা পয়সাই বা মাইনে পায়। ও চাকরি তো ধর্তব্যের মধ্যেই নয়। বেচারাকে বরখাস্ত করার দরকারটাই বা কী? আছে থাক।”
নৃপেন বৈরাগী হেঁঃ হেঃ করে বলল, “আপনার মতো দয়ার শরীর আর দেখিনি। মহাশত্রুকেও হাসিমুখে ক্ষমা করে দিতে পারেন।”
সজনীবাবু করুণ গলায় বললেন, “এই শ্যামাদাও আমাকে একটু আগে বলছিলেন নরহরি মাস্টারের চাকরিটা যাতে না খাই। আমি ভাবি, চাকরি খাওয়ার মতো পাষণ্ড তো নই রে বাপু।”
গবাক্ষবাবু বিগলিত হয়ে বললেন, “পাষণ্ড! আপনাকে পাষণ্ড বলবে কার ঘাড়ে ক’টা মাথা? সাধারণ মানুষের কথা ছেড়ে দিন, এমনকী চোর-ডাকাতরাও আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এই তো কাল রাতেই আমার বাড়িতে একটা চোর ঢুকেছিল–”
হরিপ্রিয়বাবু অবাক হয়ে বললেন, “আপনার বাড়িতে চোর? বলেন কী মশাই? এমন আহাম্মক চোর ভূ-ভারতে আছে নাকি? সবাই জানে আপনি চোর-ডাকাতের ভয়ে আপনার সব টাকা-পয়সা আর দামি জিনিসপত্র নয়াগঞ্জে শ্বশুরবাড়িতে গচ্ছিত রেখেছেন। চোর তবে কীসের আশায় এসেছিল?”
একথাটায় খোঁচা ছিল বলে একটু লজ্জা পেয়ে গবাক্ষবাবু বললেন, “সেকথা অস্বীকার করছি না। চোরটা যে কেন এসেছিল সেটাও ভেঙে বলেনি। তবে তার সঙ্গে আমার অনেক কথা হল।”
সজনীবাবু মৃদু হেসে বললেন, “চোরের সঙ্গে কথা! আপনি তো তা হলে বেশ আলাপি লোক।”
একটু হেঁ হেঁ করে গবাক্ষ বললেন, “আজ্ঞে আপনাদের পাঁচজনের আশীর্বাদে ওই গুণটা আমার আছে বটে।”
নৃপেন বৈরাগী বলল, “আহা, কথাটা কী হল সেটাই বলো না! বাজে কথায় সময় নষ্ট হচ্ছে।”
গবাক্ষবাবু বললেন, “হ্যাঁ, চোরটা বলছিল সজনীবাবুকে এ যুগের যুধিষ্ঠির বললেও অত্যুক্তি হয় না। কিংবা নবাবগঞ্জের গান্ধী। চোরদের এক সর্দার নাকি একবার সজনীবাবুর বাড়িতে ঢুকে ধরা পড়েছিল। তার নাম লক্ষ্মীকান্ত। তা সজনীবাবু তাকে শুধু ক্ষমাই ৩০
করেননি, কোথায় যেন একটা দোকান করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন। সত্যি নাকি সজনীবাবু?”
সজনীবাবু উদাস নয়নে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তা হবে। কত লোককেই তো রোজ ক্ষমা করতে হয়, কে তার হিসেব রাখে বলুন।”
হরিপ্রিয় বলে উঠলেন, “সে তো বটেই, সে তো বটেই।”
গবাক্ষবাবু বললেন, “চোরটা কিন্তু একটা ভয়ের কথাও বলল।”
নৃপেন বৈরাগী বলেন, “ভয়ের কথা। সে আবার কী?”
“চোরেরা নাকি তারা তান্ত্রিক নামে একজন নতুন তান্ত্রিককে পেয়ে গেছে। তার নাকি অনেক ক্ষমতা।”
এতক্ষণ শ্যামা তান্ত্রিক নিশ্চল হয়ে বসে ছিল। একথা শুনেই হঠাৎ ‘ব্যোমকালী’ বলে এমন হুঙ্কার ছাড়ল, সবাই চমকে উঠল। শ্যামা তান্ত্রিক গুরুগম্ভীর গলায় বলল, “কাঁচা খেয়ে নেব তাকে। বাণ মেরে এ-ফোঁড় ওফোঁড় করে দেব। তার মুণ্ডু নিয়ে–”
সজনীবাবু ভারী মোলায়েম গলায় বললেন, “ছাড়ুন তো শ্যামাদা। কোথাকার কে এক চুনোপুটি তারা তান্ত্রিককে নিয়ে খামোখা উত্তেজিত হচ্ছেন। আমরা তো জানি আপনার মতো তন্ত্রসিদ্ধ মানুষ কমই আছে। ক্ষমাই করে দিন না।”
শ্যামা তান্ত্রিক আবার একটু মিইয়ে গেল। মৃদুস্বরে কালী, কালী’ বলতে বলতে চোখ বুজে ফেলল।
সুধীর বৈষ্ণব একটু ফিচেল হাসি হেসে বললেন, “শ্যামাদাদা আগে খুব তারা, তারা’ জপ করতেন, তারা তান্ত্রিকের ওপর খাপ্পা হওয়ার পর থেকে আর ও নাম উচ্চারণও করেন না।”
একথায় শ্যামা তান্ত্রিক চোখ খুলে সুধীরবাবুকে ভস্ম করে দেওয়ার একটা অক্ষম চেষ্টা করতে করতে বলল, “সে নির্বংশ হবে, তার চেলারাও নির্বংশ হবে। মাথায় বজ্রাঘাত হবে–”
সজনীবাবু আবার মৃদুস্বরে বললেন, “আহা, শ্যামাদা, মাথা গরম করবেন না। আপনি চটলে যে মহাপ্রলয় হয়ে যাবে।”
শ্যামা আবার মিইয়ে গেল। গবাক্ষবাবু বললেন, “আরও একটা খবর আছে, বলব কি?”
হরিপ্রিয় বললেন, “আহা, খবরটবরের জন্যই তো এখানে আসা। বলে ফেলো, বলে ফেলল।”
“শুনলুম, জ্ঞানপাগলা নাকি কল্যবৰ্ত কথাটার মানে আগেই নরহরিবাবুকে বলে দিয়েছিল। তখন নরহরিবাবুর বিশ্বাস হয়নি বটে, কিন্তু পরে দেখলেন, পাগলা ঠিকই বলেছিল।”
নৃপেনবাবু হঠাৎ খেচিয়ে উঠে বললেন, “এ, জ্ঞানপাগলা বড় পণ্ডিত এসেছেন কিনা। কল্যবর্ত মানে তো আমরাও জানতুম। কী বলল সুধীর, কী বলল হরিপ্রিয়?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিকই তো।”
“হেডমাস্টার তেজেনবাবু যখন আমাদের জব্দ করার জন্য উলটে আমাদেরই কল্যবর্ত মানে জিজ্ঞেস করল তখন আমরা তো বুক ফুলিয়েই বলে দিলাম যে, কল্যবর্তমানে সকালের জলখাবার। শুনে তেজেনবাবু চুপসে গেলেন।”
সজনীবাবু ভারী অবাক হয়ে বললেন, “তাই নাকি? তা হলে তো বলতে হয় আপনারা বেশ জ্ঞানী লোক।”
নৃপেনবাবু লজ্জার ভাব করে বললেন, “না, না, এ আর এমন কী!”
সজনীবাবু মৃদু-মৃদু হেসে বললেন, “আমি আরও একটা শব্দ নিয়ে বড় ধন্ধে পড়েছি। তা আপনারা জ্ঞানী মানুষ, বলতে পারেন
এসকলাশি শব্দটার সঠিক অর্থ কী হবে?”
নৃপেনবাবু হঠাৎ শশব্যস্তে উঠে পড়ে বললেন, “এই রে, নাতিটার সকাল থেকে জ্বরভাব, দোকান থেকে ওষুধ নিয়ে যেতে হবে। একেবারে মনে ছিল না।”
সুধীরবাবুও তড়াক করে উঠে পড়ে বললেন, “গেল বোধ হয় আমার ছাতাটা। ভুল করে ছাতাটা দিনু মুদির দোকানে ফেলে এসেছি।”
উঠি-উঠি ভাব করে হরিবাবু বললেন, “সকাল থেকে মাথাটা ঘুরছে। শশধর ডাক্তারকে একবার প্রেশারটা না দেখালেই নয়।”
তিনজনেই উঠে পড়েছে দেখে সজনীবাবু মৃদু হেসে বললেন, “আরে তাড়া কীসের? শব্দটার অর্থ আজ না বললেও চলবে। বসুন, বসুন, চা আর পাঁপড়ভাজা আসছে।”
তিনজনেই ফের বসে পড়লেন।
সজনীবাবু তাঁর শান্ত চোখে গবাক্ষবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই জ্ঞানপাগলাটা কে বলুন তো! আগে তো নাম শুনিনি!”
গবাক্ষবাবু বললেন, “নাম শোনার কথাও নয়। এই নতুন এসেছে। আজ সকালেই তো নরহরির বারান্দার সিঁড়িতে বসে ছিল, দেখেননি? মাথায় রঙিন টুপি, মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল।”
“অ। তা দেখে থাকব হয়তো, ভাল করে খেয়াল করিনি। তা সে কেমন পাগল?”
গবাক্ষবাবু বলার আগেই নৃপেনবাবু বলে উঠলেন, “খুব দেমাকের পাগল মশাই, কারও বাড়িতে এটোকাঁটা খাবে না, ফাঁইফরমাশ খাটবে না।”
হরিপ্রিয় বললেন, “ফিলজফার ফিলজফার ভাব। মুখ গোমড়া করে সবসময়ে কী যেন ভাবে।”
গবাক্ষবাবু বললেন, “একটা মজা আছে, ভিক্ষেটিক্ষে চায় না।”
সজনীবাবু বললেন, “তবে চলে কীসে?”
নৃপেনবাবু বললেন, “লোকে এমনিতেই দেয়। ছদ্মবেশী মহাপুরুষ বলেই ভাবে বোধ হয়।”
গবাক্ষবাবু বললেন, “সে নাকি কোথাকার রাজপুত্তুর। লোকের কাছে পয়সা চাওয়ার সময় বলে, ভিক্ষে নয় বাপু, খাজনা নিচ্ছি।”
সজনীবাবু বলেন, “রাজপুত্তুর! বাঃ বেশ! তা কোথাকার রাজপুত্তুর তা জানেন?”
নৃপেনবাবু মুখোনা বিকৃত করে বললেন, “পাগলের কথার কি মাথামুণ্ডু আছে! সে নাকি নয়নগড়ের রাজপুত্তুর। নয়নগড়ের নাম তো জন্মে শুনিনি বাপু।”
সজনীবাবু হঠাৎ একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন।
হরিপ্রিয় বললেন, “নবাবগঞ্জে নতুন নতুন চিড়িয়া আসছে কিন্তু। একটা তান্ত্রিক, একটা পাগল, আরও কে আসে কে জানে বাবা।”
সুধীর বৈষ্ণব বললেন, “আসুক, আসুক, যত আসবে ততই খেল জমবে।”
চা আর পাঁপড়ভাজা খেয়ে শুধু শ্যামা তান্ত্রিক ছাড়া সবাই উঠে পড়লেন। রাত প্রায় ন’টা বাজে। বাইরে এখনও টিপটিপ করে বৃষ্টি হচ্ছে। ঠাণ্ডা হাওয়াও দিচ্ছে খুব। রাস্তাঘাট খুবই ফাঁকা।
সজনীবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটু তফাতে এসেই নৃপেনবাবু খ্যাঁক করে উঠলেন, “সজনীবাবুর আক্কেলটা দেখলে সুধীরভায়া? কথা নেই, বার্তা নেই, দুম করে একটা শব্দের অর্থ জিজ্ঞেস করে বসলেন! কেন বাপু, আমরা কি ওঁর ইস্কুলের পড়ুয়া নাকি? এ তো ঘোর অপমান!”
সুধীরবাবু বললেন, “টাকার গরম, দেমাকের গরম সব মিলিয়ে লোকটা একেবারে টং হয়ে আছে।”
হরিপ্রিয় বললেন, “ওরে বাপু, টাকাটাও তো করেছে বাঁকা পথে। কাজকারবার তো কিছু তেমন দেখছি না, কিন্তু লাখ-লাখো টাকা যে কোত্থেকে আসছে কে জানে। তুমি কী বলল হে গবাক্ষভায়া?”
গবাক্ষবাবু বললেন, “সত্যি কথাই বলেছেন। সজনীবাবুকে নিয়ে একটা রহস্য আছে।”
নৃপেনবাবু বললেন, “আমার তো মনে হয় ওই শ্যামা তান্ত্রিকের সঙ্গে সাঁট করে ভেতরে ভেতরে কোনও কাজকারবার চলছে।”
সুধীরবাবু একমত হয়ে বলেন, “তাও হতে পারে।”
বটতলার গজাননের তেলেভাজার দোকানে ঝাঁপের তলায় গুটিসুটি মেরে বসা জ্ঞানপাগলাকে দেখে নৃপেনবাবু দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন, “জ্ঞানপাগলা না?”
গবাক্ষবাবু বললেন, “হ্যাঁ, জ্ঞানপাগলাই। গজানন জ্ঞানপাগলাকে রোজ রাতে পরোটা আর আলুর দম খাওয়ায়।”
নৃপেনবাবু অবাক হয়ে বলেন, “বলো কী? কেন, খাওয়ায় কেন?”
“গজানন মনে করে জ্ঞানপাগলা সত্যিই রাজপুত্তুর। শুধু গজানন কেন, নবাবগঞ্জের অনেকেরই ধারণা জ্ঞানপাগলা সাধারণ লোক নয়।”
“হুঁঃ, যত্তসব আহাম্মক। রাজপুত্তুর আজকাল গাছে ফলছে কি না। রাজপুত্তুর হওয়া অত সোজা নয়।”
এত লোককে একসঙ্গে মুখোমুখি দেখে জ্ঞানপাগলা জুলজুল করে চেয়ে মাথার রঙিন টুপিটা খুলে মাথাটা একটু চুলকে নিয়ে বলল, “তোমরা কি খাজনা দিতে এসেছ?”
নৃপেনবাবু পয়সাওলা লোক, ফস করে পকেট থেকে একখানা পাঁচ টাকার নোট বের করে বললেন, “নিবি? আর একটা শক্ত কথার মানে বলে দে দিকিনি বাবা।”
জ্ঞানপাগলা কুটি করে বলল, “কেন, আমি কি ডিকশনারি নাকি?”
“সবাই বলে তুই জ্ঞানী মানুষ। পাগল সেজে থাকিস বটে, কিন্তু জ্ঞানের নাড়ি টনটনে।”
জ্ঞান চোখ পাকিয়ে বলে, “পাগল! আমি পাগল! আমি হলুম নয়নগড়ের যুবরাজকুমার। খবর্দার ফের ওকথা উচ্চারণ কোরো না।”
জোড়হাত করে নৃপেনবাবু বললেন, “ভুল হয়ে গেছে রে বাপু, মাপ করে দে। বুড়োমানুষ, সবসময়ে সব কথা খেয়াল থাকে না। এই যে আরও পাঁচটা টাকা।”
টাকা পকেটে গুঁজে জ্ঞান বলল, “কী জানতে চাও?”
“এসকলাশি শব্দটার মানে বলতে পারিস বাবা?”
“দুর! এসব তো ইংরিজি শব্দের অপভ্রংশ। পরীক্ষায় ভাল ফল করলে আমার ঠাকুমা বলে বেড়াত, আমার নাতি এসকলাশি পেয়েছে। এর মানে হচ্ছে জলপানি, স্কলারশিপ।”
চারজন একটু মুখ-চাওয়াচাওয়ি করলেন। হরিপ্রিয় মৃদু স্বরে বললেন, “মনে হয় ঠিকই বলছে।”
সুধীরবাবুও বললেন, “আমারও তাই মনে হচ্ছে।” নৃপেনবাবু পাঁচ পাঁচ দশ টাকা খসিয়ে শব্দটার মানে জেনেছেন। তিনি শুধু বললেন, “হু।”
জ্ঞানপাগলা বলল, “খাজনার কথা এত ভুলে যাও কেন? ভূস্বামীকে যদি তার পাওনা না দাও তা হলে মাটির অভিশাপ লাগে, জানো?”
নৃপেনবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আমরা আবার কবে তোর প্রজা হলুম কে জানে বাবা। তবে তুই জ্ঞানী মানুষ, মাঝে মাঝে খাজনা তোকে দিতে হবে দেখছি।”
জ্ঞানপাগলা একটু ছটাক খানিক হেসে বলল, “খাজনা আদায় করতেই তো আসা।”
.
ওদিকে সজনীবাবু তাঁর ঘরে কিছুক্ষণ গম্ভীর মুখে বসে থেকে হঠাৎ বললেন, “শ্যামাদা, জ্ঞানপাগলটা আসলে কে বলো তো?”
শ্যামা নিমিলিত নেত্রে চেয়ে বলল, “কেন, বাণ টান মারতে হবে নাকি?”
“না, না, ওসব নয়। আগে খোঁজ নাও লোকটা কে, কত বয়স, কোথা থেকে আসছে।”
“কালকেই খোঁজ নিচ্ছি, চিন্তা নেই।”
“ভাল করে খোঁজ নিয়ো। আজেবাজে গুজবে কান দিয়ো না।”
“আরে না, ভাল করেই খোঁজ নেব। দরকার হলে মহেশ দারোগাকে লাগিয়ে দেব। মহেশ আমাকে খুব খাতির করে।”
“আহা, অত হট্টগোল পাকিয়ে দরকার কী? মহেশকে বললে সে হয়তো পাগলকে কোমরে দড়ি দিয়ে থানায় নিয়ে যাবে, তোক জানাজানি হবে। আমি চাইছি গোপনে খবর নিতে, কেউ যেন টের না পায়।”
“তারও ভাবনা নেই। বিশেকে লাগিয়ে দেব’খন। সে চোর ছ্যাঁচড় যাই হোক, খুব চালাক চতুর। পেটের কথা টেনে বের করতে তার জুড়ি নেই। তবে সে মজুরি চাইবে।”
“কত চাইবে?”
“গোটা পঞ্চাশেক টাকায় হয়ে যাবে।”
সজনীবাবু টাকাটা বের করে দিয়ে বললেন, “কালই খবর চাই।”
টাকাটা ট্যাকে গুঁজে শ্যামা তান্ত্রিক উঠে পড়ল। বাইরে তার দু’জন চেলা অপেক্ষা করছিল, শ্যামা বেরোতেই দু’জন তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। একজন একটা ছাতা মেলে ধরল শ্যামার মাথার ওপর।
বজ্র গম্ভীর স্বরে দু’বার কালী, কালী’ বলে শ্যামা রাস্তায় নেমে পড়ল। বৃষ্টির তোড় একটু বেড়েছে, বাতাসের জোরও। রাস্তাঘাট যেমন নির্জন তেমনই অন্ধকার।
দ্বিতীয় চেলা একটা টর্চ জ্বেলে বলল, “একটু দেখে চলবেন বাবা। রাস্তায় জল জমে গেছে।”
শ্যামা সবেগে জল ঠেলে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “ওরে, টর্চের আলোতে কি আমি পথ দেখি? আমি দেখি ধ্যানের চোখে, তৃতীয় নয়নে। সামনে মা হাঁটছেন, দেখতে পাচ্ছিস না? ওই দ্যাখ শ্যামা মা কেমন মল বাজাতে বাজাতে চলেছেন। দেখতে পাচ্ছিস?”
“আমাদের পাপী চোখ বাবা, এই চোখে কি দেখা যায়?”
“হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।”
অট্টহাসি শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ দশাসই চেহারা নিয়ে গদাম করে উপুড় হয়ে পড়ে গেল শ্যামা। তারপরই আর্ত চিৎকার, “বাবা রে!”
চেলা দু’জন পেছনে ছিল। এ ঘটনায় হতচকিত হয়ে টর্চ জ্বালাতেই তারা দেখতে পেল, কোনও বদমাশ রাস্তার দু’ধারে দুটো গাছে আড়াআড়ি একটা দড়ি বেঁধে রেখেছে। তাইতেই পা বেঁধে পড়ে গেছে শ্যামা।
“ওরে, হাঁ করে দেখছিস কী? ধরে তোল!” শ্যামা চেঁচাল। চেলারা গিয়ে তাড়াতাড়ি টেনে তুলল শ্যামাকে। জলে কাদায় দাড়ি গোঁফ রক্তাম্বর সব মাখামাখি। মাজায় চোটও হয়েছে। হাঁফাতে হাঁফাতে শ্যামা বলল, “কোন বদমাশ …?”
সামনের অন্ধকার থেকে কে যেন বলে উঠল, “এটা হল এক নম্বর।”
“কে? কে রে বদমাশ? কে ওখানে?”
কেউ জবাব দিল না।
চেলাদের একজন ভয়-খাওয়া গলায় বলে, “একটু পা চালিয়ে চলুন বাবা, এ তো বেহ্মদত্যির গলা বলে মনে হচ্ছে।”
শ্যামা খচিয়ে উঠে বলে, “নিকুচি করেছি ব্ৰহ্মদত্যির। টর্চের আলোটা ভাল করে ফেল তো, হাঁটু দুটোর ছালবাকল বোধ হয় উঠেই গেছে। গতকাল মাঝরাত্তিরে মা ব্রহ্মময়ী স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেছিলেন বটে, তোর একটা ফাঁড়া আসছে, পথেঘাটে সাবধান। তা কথাটা খেয়াল ছিল না।”
চেলার টর্চের আলোয় দেখা গেল, দুটো হাঁটুরই নুনছাল উঠেছে।
শ্যামা তান্ত্রিক চাপা গলায় বলল, “ঘটনাটার কথা কাউকে বলার দরকার নেই। বুঝলি?”
দু’জনে একসঙ্গেই বলে উঠল, “যে আজ্ঞে।”
আর তৃতীয় নয়নের ওপর ভরসা হল না শ্যামা তান্ত্রিকের। একজন চেলা সামনে টর্চ জ্বেলে পথ দেখাতে লাগল, অন্যজন ছাতা ধরে রইল। শ্যামা তান্ত্রিক ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে ডেরার দিকে হাঁটতে লাগল।
টর্চওলা চেলা বলল, “ব্যাপারটা কিন্তু ভয়েরই হয়ে দাঁড়াল বাবা।”
শ্যামা বলল, “কোন ব্যাপারটা?”
“ওই যে কে একজন বলল এটা এক নম্বর। তার মানে এর পর দু’নম্বর, তিন নম্বর, চার নম্বর হতে থাকবে। কোথায় গিয়ে শেষ হবে আন্দাজ করতে পারছে কি?”
মুখটা বিকৃত করে শ্যামা তান্ত্রিক বলল, “ভয়ের কিছু নেই। কোনও বদমাশ ছেলেপুলে কাণ্ডটা করে রেখেছিল। দাঁড়া না, আজ রাতে পঞ্চমুণ্ডির আসনে ধ্যানে বসলেই সব জানতে পারব।”
ছাতা-ধরা লোকটা বলল, “কিন্তু গলাটা তো বাচ্চা ছেলেপুলের বলে মনে হল না। বেশ ভারী গলা।”
“বললুম তো, যে-ই হোক এই শর্মার কাছে তার পরিচয় গোপন থাকবে না। ধ্যানে বসলেই বায়োস্কোপের ছবির মতো সব ভেসে উঠবে চোখের সামনে। তবে একাজ কার তা বুঝতে আমার বাকি নেই।”
টর্চওলা সোৎসাহে বলল, “কে বটে বাবা?”
“কে আবার, ওই তারা তান্ত্রিক। তন্ত্রের তোত-ও জানে না, গুলগাপ্পা দিয়ে কিছু লোকের মাথা খেয়েছে। এখন তন্ত্রের শক্তিতে
পেরে এইসব হীন পন্থায় জব্দ করার চেষ্টা করছে আমাকে। ভীম যেমন দুঃশাসনের রক্ত পান করেছিল, আমারও তেমনই ইচ্ছে যায় ব্যাটাকে বুকে হাঁটু দিয়ে”
ছাতাওলা বলল, “কুপিত হবেন না বাবা, আপনি কুপিত হলে সর্বনাশ।”
“কিন্তু লোকটার কেমন বাড় বেড়েছে দেখেছিস! ওর চেলাচামুণ্ডারা হল সব চোর-চোট্টাবদমাশ। তাদের কাউকে দিয়েই কাণ্ডটা করিয়েছে। দাঁড়া, আমিও দেখাচ্ছি মজা।”
টর্চলা বলল, “তারা তান্ত্রিকের কিন্তু আজকাল খুব নাম হয়েছে বাবা। অনেকে বলে, তারা তান্ত্রিকের অনেক ক্ষমতা।”
শ্যামা হুঙ্কার দিল, “কাঁচ্চা খেয়ে নেব। মা কালীর সামনে হাড়িকাঠে বলি দেব ব্যাটাকে।”