পরের ম্যাচ স্টার স্পোর্টিং-এর সঙ্গে
পরের ম্যাচ স্টার স্পোর্টিং-এর সঙ্গে। হাটখোলার ক্যাপ্টেন ভবানী। পুরী যাওয়া বন্ধ করেছে ভবানী এই জন্য। আমি মাঠে এসেছি দর্শক হিসেবে। বলা বাহুল্য, একটা চেয়ারে মিনুকে দেখতে পেলাম। তন্ময়কে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে তার অভব্যতার জন্য।
পরশুদিন রাতে ননীদা আমার বাড়িতে এসে অনুরোধ করেন, মতি, এই ম্যাচটায় তুমি বসে যাও।
কেন? সবিস্ময়ে প্রশ্ন করি। টাকার দরকার। ব্যাটটা কিনে দেব তন্ময়কে। নয়তো সি সি এইচ-এর মান থাকবে না। ভবানী বলেছে সে একশো টাকা দেবে যদি সামনের ম্যাচে ক্যাপ্টেনসি করতে দেওয়া হয়! তুমি তো বোঝই কী ভাবে ক্লাব–
ননীদা অসহায়ভাবে থেমে গেলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাই। তারপর কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলাম, আগের দুটো ব্যাটের জন্য একশো টাকা তন্ময়কে কী ভাবে দিলেন? ননীদা প্রশ্নটা এড়িয়ে যাচ্ছিলেন অন্য কথা তুলে। চেপে ধরতে বলে ফেললেন, তোমার বউদির একজোড়া কানপাশা ছিল, বিক্রি করলাম। নিঃসন্তান ননীদার স্ত্রী বছর দশেক আগে মারা গেছেন।
ভবানী যথারীতি হাঁকডাক করে দারুণ ব্যস্ত ভাবে টেন্ট আর মাঠ করছে। মাঝে মাঝে মিনুর কাছে এসে দাঁড়াচ্ছে।
কী যে করব ভেবে পাচ্ছি না। ওয়ান ডাউন রাজেন বলছে সিক্স ডাউন খেলবে।
কেন? মিনু বলল।
ভয় পেয়েছে। স্টারের একটা ফাস্ট বোলার আছে, দারুণ পেস।
তা হলে তুমি নামো ওয়ান ডাউন।
আমি? ভবানী একটু যেন ঘাবড়ে গেল। আমি তো রেগুলার সিক্স ডাউন। নামি।
আজ তা হলে ওঠো।
ইন-কেস যদি কোল্যাপস্ করে তা হলে কে আটকাবে? ভেরি ইমপরট্যান্ট এটা, তুমি ঠিক বুঝবে না, কতবার এরকম হয়েছে, শেষে আমি গিয়ে ঠেকাই। বলতে বলতে ভবানীর খেয়াল হয়, আমি ওদের কথা শুনতে পাচ্ছি। চুপ করে গেল সে।
ভবানী ওয়ান ডাউনেই নামল এবং হাটখোলা পনেরো মিনিটেই পাঁচ উইকেটে ১১ রান হল। ভবানী তার মধ্যে এক রান করে নট আউট। স্টারের ফাস্ট বোলারটি একাই উইকেট পাঁচটি নিল। কিন্তু ভবানী সত্যিই আজ পরাক্রান্ত, দুর্ভেদ্য। একবারও কোনও সুযোগ দেয়নি, যেমন বল তেমন খেলছে। সত্যিই অধিনায়কোচিত খেলা। ছয় উইকেটে ১৮, ভবানী তখনও এক রানে দাঁড়িয়ে। মাঝে মাঝে ক্রিজ থেকে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। মিনু তার রুমালটা তখন নাড়ায়, তাই দেখে ভবানী দ্বিগুণ উদ্যমে লড়াই শুরু করে।
সাত উইকেটে ৩২ হল। ভবানী তিন রান করেছে। মিনু এই সময় প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, আমরা কি হেরে যাব?
স্কোরবোর্ড দেখে আমারও মুখ শুকিয়ে এল। বললাম, ক্রিকেটে কিছুই বলা যায়। হয়তো ভবানী এখন একটা সেঞ্চুরি করে ফেলতে পারে।
ও কিন্তু দারুণ খেলছে! মিনু বলল।
অসাধারণ! কী অথরিটি নিয়ে স্ট্রোক দিচ্ছে, মনেই হচ্ছে না সাতটা উইকেট পড়েছে। আমি যথাসাধ্য ভবানীর প্রশংসা করলাম।
কথা শেষ করেছি আর ভবানী একটা ছয় মারল। আমরা হইহই করে উঠলাম, মিনু রুমাল নাড়ল। এর পর ভবানীর উপর যেন দৈব ভর করল। পরের তিন ওভারে সে ৫২ রানে পৌঁছল। হাটখোলার সাত উইকেটে ৮৬। পরের দুওভারে ভবানী করল আরও ২৯ রান, অর্থাৎ ৮১ হল। এর পর দুটো উইকেট পড়ল ১২ রান যোগ করে। এখন হাটখোলার ৯ উইকেটে ১২৭ রান। শেষ ব্যাটসম্যান নামতেই মিনু উৎকণ্ঠিত স্বরে বলল, ওর কি সেঞ্চুরি হবে না?
বললাম, ক্রিকেটে কিছুই বলা যায় না।
এবং শেষ পর্যন্ত হল না। ভবানী তার ৯৭ রানের মাথায় তাড়াহুড়ো করে রান নিতে যাওয়ায় এগারো নম্বর রান আউট হয়ে গেল। মিনু রুমালে চোখ মুছতে শুরু করল।
ভবানী ফিরে এসে দার্শনিকের মতো বলল, ক্রিকেট আর জীবন একই রকম।
মিনু বলল, পরের বার ঠিক সেঞ্চুরি হবে, আমি বলছি হবে। যদি না হয় তো–
পরের ম্যাচ সত্যসন্ধির সঙ্গে। ভবানী প্রথম বলেই বোল হয়ে গেল। এবারও আমি মাঠের বাইরে দর্শক। মিনু চোখে রুমাল চেপে ধরেছে। ভবানী ফিরে এসে বলল, ক্রিকেটের সঙ্গে জীবনের কতটুকুই বা সম্পর্ক!
দুটি ম্যাচেই সি সি এইচ হেরে গেছে। ভবানী জানিয়েছে, আর সে অধিনায়ক হতে চায় না, প্রয়োজনও নেই। পরের ম্যাচ পাইকপাড়া স্পোর্টিংয়ের সঙ্গে। ভবানী পুরী চলে গেছে, তন্ময় আর আসে না, টিমের আরও দুজন পরীক্ষার জন্য খেলতে আসে না। দুটো বাচ্চা ছেলে ওদের বদলে খেলল এবং হারতে হারতে আমরা ড্র করলাম।
এখন আমরা লিগ টেবিলের মাঝামাঝি কয়েকটা ক্লাবের সঙ্গে সমান পয়েন্ট। উপরের প্রথম তিনটি ক্লাবের পয়েন্টও সমান-সমান। তার মধ্যে রূপোলিও আছে। ওদের সঙ্গে সি সি এইচ-এর তফাত মাত্র দুই পয়েন্টের। লড়তে পারলে আমরা এখনও চ্যাম্পিয়ন হতে পারি।
ননীদার ইচ্ছা নয় চ্যাম্পিয়ানশিপ লড়াইয়ে। ফাস্ট ডিভিশনে উঠলে তো ক্লাবের খরচ বেড়ে যাবে। এখনই আমরা পাঁউরুটি আর আলুর দম দিয়ে লাঞ্চ শুরু করেছি। প্লেয়াররা রীতিমতো অসন্তুষ্ট। আমি কিন্তু চ্যাম্পিয়ানশিপ ফাইট করারই ক্ষে। ফাস্ট ডিভিশনে যে করেই হোক একবার উঠতেই হবে। পরের বছরই নয় নেমে যাব, তবু তো বলতে পারব, আমার অধিনায়কত্বে সি সি এইচ একবার ফাস্ট ডিভিশনে উঠেছিল। প্লেয়ারদের কদিন ধরেই তাতাচ্ছি ফাস্ট ডিভিশনে খেলার ইজ্জতের লোভ দেখিয়ে।
কদিন ধরে ননীদা মাঠে আসছেন না। একটা ম্যাচ খেলা হয়ে গেল ননীদার উপস্থিতি ছাড়াই। আমরা জিতলাম শুধু ফিল্ডিং-এর জোরে। বেলেঘাটা স্পোর্টিং-এর কাছে আচমকা রূপোলি সঙ্ঘ এক উইকেটে হেরে আমাদের সমান হয়ে গেল। হঠাৎ আমার তন্ময়কে মনে পড়ল। এই সময় ও যদি থাকত, তা হলে বাকি ম্যাচ কটা বোধ হয় জিততে পারব, এই রকম একটা ধারণা আমার মনে উঁকি দিতে লাগল। ভাবলাম ননীদাকে বলি, যদি দরকার হয় তন্ময়কে বাকি কটা ম্যাচ খেলবার জন্য ডেকে আনি। কিল খেয়ে অনেক সময় কিল চুরি করতেই হয়। তা ছাড়া, অপরাধী তো আমিই। ওকে ইচ্ছে করে রান আউট করে দেওয়ার পর থেকেই আমার মনে খচখচ করে একটা কাঁটা বিঁধছে। সেটা উপড়ে না ফেলা পর্যন্ত স্বস্তি পাব না।
বলমাত্র ননীদা তেলে-বেগুনে হয়ে উঠলেন।
তোমার লজ্জা করে না, মতি? যেভাবে, যে ভাষায় বাইরের টিমের সামনে আমাদের অপমান করেছে, তারপরও তুমি ওকে আনতে চাও? কী আছে ওর খেলায়, য়্যাঁ? কী আছে? নেমেই দুমদাম ব্যাট চালায়, বরাতজোরে ব্যাটে-বলে হয়ে গেছে তাই রান পেয়েছে। একটু বুদ্ধিমান বোলারের পাল্লায় পড়লে তিন বলে ওকে তুলে নিয়ে যাবে। ক্রিকেট অত সোজা ব্যাপার নয়, এটা ফুটবল নয় যে গোল খেলেও গোল শোধ দেওয়ার সুযোগ পাবে। প্রত্যেকটা বলের ওপর ব্যাটসম্যানের বাঁচা-মরা নির্ভর করে, একটা ভুল করেছ কি তোমার মৃত্যু ঘটে যাবে। কী ভীষণ ডিসিপ্লিনড় হতে হয়, কী দারুণ কনসেনট্রেশন দরকার হয় বড় ব্যাটসম্যান হতে গেলে। তোমার ওই তন্ময়ের মধ্যে তা কি আছে?
আমি চুপ করে ননীদার উত্তেজিত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই লোকটিই, মাসখানেক আগে যার ব্যাটিং দেখে উচ্ছ্বসিত হতেন, আজ তাকে ব্যাটসম্যান বলতে রাজি নন!ননীদা একদৃষ্টে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, খেলাটাই বড় কথা, টাকাই সব কিছু নয়।
কিন্তু ননীদা, টাকা অত্যন্ত দরকারি জিনিস। প্লেয়ারের বেঁচে থাকার জন্য এটা প্রথমেই দরকার। এখানে টাকা না পেলে তন্ময় ফুটবলে চলে যাবে। ছেলেটা ফুটবলও ভাল খেলে।
তাই খেলুক। যে ক্রিকেট ভালবাসে সে অন্য খেলা খেলবে কেন? আমি চুপ করে রইলাম। বাড়িতে ফিরে দেখি তন্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করছে। প্রথমেই বলল, মতিদা, আমি খেলব।
অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, হঠাৎ যে!
ও ইতস্তত করল কিছু বলার জন্য। মাথা নামিয়ে রইল। আমি আবার বললাম, খেলবে, সে তো ভাল কথা, কিন্তু আর আসবে না বলে আবার নিজে থেকেই এসে খেলতে চাইছ, ব্যাপার কী?
তন্ময় বলল, আমার একটা চাকরি পাবার সম্ভাবনা আছে ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যাঙ্কে। ওরা ক্রিকেট টিম করে লিগে সামনের বছর খেলবে। প্রায় তিনশো টাকা মাইনে। ক্রিকেট সেক্রেটারি আর ডেপুটি ম্যানেজার আমার খেলা দেখতে চায়।
চাকরি দেবে তো? অনেক সময় দেব বলে খেলিয়ে নিয়ে আর চাকরি দেয় না। তা জানি না। তবে যদি দেয়, একটা চান্স নিয়ে তো দেখি। ওদের ফুটবল টিম অফিস লিগে খেলে। সেখানেও আমাকে খেলাতে পারবে। চাকরি সত্যিই আমার দরকার। সংসার প্রায় অচল হয়ে এসেছে।
তা হলে সামনের রোববার খেলো। একটা ক্রুশিয়াল ম্যাচ রয়েছে কসবা ভ্রাতৃসঙ্ঘের সঙ্গে। যদি জিততে পারি তা হলে ফ্রেন্ডস্ স্পোর্টিং আর আমরা সমান পয়েন্ট হয়ে লিগ-টেবলের টপে চলে যাব। রূপোলি তা হলে দু পয়েন্ট পিছিয়ে যাবে আমাদের থেকে। বলতে বলতে আমার হাসি পেল। রূপোলি সঙ্ঘ আমাদের পিছনে থাকবে এটাই বড় কথা, লিগ চ্যাম্পিয়ান হই বা না হই—এই মনোভাব দেখছি আমার মধ্যেও বদ্ধমূল হয়ে গেছে।
৩য় বলল, ননীদা কোনও আপত্তি করবেন না তো?
করে যদি তো কী হবে? আমি ক্যাপ্টেন, আমি যাকে খেলাব সেই খেলবে। কেউ আপত্তি করলেও শুনব না।