তন্ময়ের অনুপস্থিতি
তন্ময়ের অনুপস্থিতি আমাকে ব্যস্ত করে তুলল।
ঠিকানা জোগাড় করে তন্ময়ের বাড়ি হাজির হলাম। সরু গলি। আধা বস্তি অঞ্চল। নম্বর অনুযায়ী কড়া নাড়তে এক প্রৌঢ়া দরজা খুললেন। তাঁর চেহারা ও বেশে দারিদ্র্যের তকমা আঁটা কিন্তু কথায় ও আচরণে প্রাক্তন আভিজাত্যের ছাপ। উনি তন্ময়ের মা।
তমু তো দু দিন হল বাড়ি নেই। বর্ধমানের কোথায় যেন ফুটবল খেলতে গেছে।
গ্রামাঞ্চলে শীতকালেই ফুটবল টুর্নামেন্টগুলো হয়। কলকাতার ফাস্ট ডিভিসন ফুটবলারদের তখন ভাড়া পাওয়া যায়। তা ছাড়া, ধান ওঠার পর অবসর ও অর্থ দুই-ই তখন হাতে আসে। এক-একটা গ্রামের ফুটবল টিমে কলকাতারই এগারোজনকে দেখা যায়। এই রকমই কোনও টিমের হয়ে তন্ময় ভাড়া খেলতে গেছে। আমার ঠিকানা দিয়ে বললাম, তন্ময় ফিরলেই যেন আমার সঙ্গে দেখা করে।
দুদিন পরই তন্ময় আমার বাড়িতে এল।
হল না, মতিদা! পরপর দুটো জায়গায় সেমিফাইনাল আর ফাইনাল খেললুম। দুটোতেই ডিফিট, মোট একশো কুড়ি টাকা পাওয়ার কথা—পেলুম পঞ্চান্ন।
ফুটবল খেললে ক্রিকেটের বারোটা বাজবে! ক্ষুঃস্বরে বললাম, কখন চোট লাগবে কে বলতে পারে!
তন্ময় হাসল। বলল, বাঁ কাঁধটা নাড়তে কষ্ট হচ্ছে, ব্যাকটা এমন ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপরই হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, আমি জানি কেন দেখা করতে বলেছেন। দুটো সেঞ্চুরির জন্য দুটো ব্যাট আমার পাওনা হয়েছে। না পেলে আমি যাব না আর।
কিন্তু আমাদের ক্লাব গরিব, কুড়িয়ে বাড়িয়ে কোনওক্রমে টিকে আছে। তুমি এ দিকটা নিশ্চয় বিবেচনা করবে।
আমিও গরিব। কুড়িয়ে বাড়িয়েই চলে আমাদের সাত জনের সংসার। বাবার যা রোজগার তাতে টেনেটুনে পনেরো দিনের বেশি চলে। আমি বড় ছেলে, প্রি-ইউ পাশ, মাঝে মাঝে ফুটবল খেলার কয়েকটা টাকা বাড়িতে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই সাহায্য করতে পারি না। ব্যাট দুটো পেলে বিক্রি করে কিছু টাকা মাকে দিতে পারব। ক্লাব যদি ব্যাটের বদলে তার দামটা দেয় তা হলে আমি যাব। আমার এখন একটা চাকরি ভীষণ দরকার।
চাকরি বা টাকা, কোনওটা দেওয়াই আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
তা হলে আমার পক্ষেও খেলা সম্ভব নয়।
কথাটা ননীদাকে জানালাম।
বললাম, রূপোলির কাছে গত দশ বছর আমরা হারিনি। ভবানী জানিয়েছে, পুরী বেড়াতে যাচ্ছে, তাই খেলতে পারবে না, বিষ্টুর পেটের গোলমাল, কাল থেকে অফিসে যাচ্ছে না। কাকে নিয়ে তা হলে খেলব?
শুনে ননীদা শুকনো হেসে বললেন, আচ্ছা, ব্যাটের টাকা জোগাড় করছি।
রূপোলি সঙ্ঘের সঙ্গে খেলার দিন তন্ময়কে কিটব্যাগ হাতে হাজির হতে দেখে অবাক হলাম। ননীদা কোন ননীটিকস্ প্রয়োগ করে ওকে হাজির করালেন, সেটা জানার জন্য ননীদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, টাকা পেলেন কোথায়?
কীসের টাকা?
ব্যাটের দাম না পেয়েই তন্ময় এল?
ওহ্! ননীদা হঠাৎ ভ্রূ কুঁচকে কী যেন মনে করতে চেষ্টা করলেন, তারপরই যেন মনে পড়ল।
পিচটা দেখেছ কি? দুর্যোধনকে বলেছিলুম আজ যেন একদম জল না দেয়। ওদের একটা ভাল স্পিনার আছে… বলতে বলতে ননীদা মাঠের দিকে প্রায় দৌড়লেন।
তন্ময়কে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, আজ সকালে ননীদা একশো টাকা ওকে দিয়ে এসেছেন। আরও তিরিশ টাকা দেবেন ওমাসে। ননীদা এবং ক্লাব দুয়েরই অবস্থা জানি, তাই বিস্মিত হয়ে যখন ভাবছি, টাকাটা এল কোখেকে, তখন একগাল হেসে চিতু প্যাভেলিয়ানে ঢুকল। দু-চারটে কথা হবার পরই চিতু বলল, হ্যাঁরে, তোদের ক্লাবে একটা ছেলে নাকি দারুণ ব্যাট করছে? আজ খেলবে নাকি?
আমি ঘাড় নাড়লাম। ও বলল, দেখতে হবে তো কেমন খেলে!
রূপোলি ১৬৭ রান করল। অবিশ্বাস্য দুটো ক্যাচ ধরল তন্ময়, যার ফলে রূপোলির দুই ওপেনিং ব্যাটসম্যান ৪ রানেই আউট হয়। এরপর ওদের থার্ড উইকেট পার্টনারশিপে ৫১ রান উঠতে তন্ময় শ্লিপ থেকে স্কোয়ার লেগে ছুটে গিয়ে বল ধরে সোজা উইকেটে মেরে রানআউট করল। ফোর্থ উইকেটে চিতু এল এবং এলোপাথাড়ি পিটিয়ে একাই ৪৭ রান করল। বোল্ড হয়ে চলে যাবার সময় একগাল হেসে আমায় বলল, কোদাল চালিয়েই তাদের কবর খুঁড়ব।
তন্ময় অবশ্য তা হতে দিল না। দেখে দেখে অত্যন্ত সাবধানে এবং ধীরে খুটখাট করে খেলে দেড় ঘণ্টায় পঞ্চাশ করল। সাধারণত এত মন্থর ও খেলে না। আমাদের প্রথম চারটে উইকেট ২৩ রানেই পড়ে যায়। কিন্তু সেজন্য এত সময় ব্যয় করে তন্ময় খেলবে ভাবিনি। ৫০ থেকে ৫১ করতে ওর দশ মিনিট লাগল। ৬০-এ পৌঁছতে আরও আধ ঘণ্টা।
সি সি এইচ যখন ৫ উইকেটে ১০৭, তখন আমি নামলাম। খেলার আর বাকি আধ ঘণ্টা। তন্ময়ের রান ৭৫। আমরা যে হারব না সে সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে গেছি। রূপোলিও বুঝে গেছে তারা জিতছে না।
চিতু একসময় আমায় বলল, ছোকরা আজ তোদের অনেক টাকা খসাবে।
বলেই চিতু পিটপিট করে হাসল। আমি বললাম, কেন। টাকা খসাবে মানে?
সেঞ্চুরি করবে। করলেই নতুন ব্যাট সি সি এইচ-কে দিতে হবে। এবার আমি বল নোব, তিনটে লং হপ আর তিনটে ফুলটস, ব্যস, তোর ননীদার পাঁজর খুলে যাবে।
ননীদা মানেই সি সি এইচ। চিতুর দুষ্টু বুদ্ধি যে হাটখোলার সঙ্গে এতদূর পর্যন্ত খেলবে কল্পনা করিনি। তন্ময় এখন ৮৫। খেলা শেষ হতে পনেরো মিনিট বাকি। চিতু ওকে এক ওভারেই পনেরো রান দিয়ে দেবে। তা হলেই হাটখোলার একশো টাকা খরচ। উপায়? ক্লাবের যা অবস্থা, একটা ব্যাট কিনতে হলে এই সিজনে আর পুরো ফিক্সচার খেলা যাবে না। তন্ময় সেঞ্চুরি করলে তার নিজের নাম বাড়বে কিন্তু ক্লাবের কোনও উপকার হবে না। একমাত্র ক্ষতি ছাড়া। তা হলে উপায়?
ওভার শেষ হল। আমি এবার স্ট্রাইকার। তন্ময় এগিয়ে এসে বলল, মতিদা, সময় তো খুবই কম, আপনি একটা রান নিয়ে এদিকে চলে আসুন।
ওর কথাটা শোনামাত্র হঠাৎ আমার মাথায় সি সি এইচ-এর লোকসান বাঁচানোর স্ট্র্যাটেজি খেলে গেল। আমি বললাম, আমি কল দিলেই বেরোবে, রেডি থেকো।
প্রথম বলটা পেলাম অফ স্টাম্পের উপর হাফ ভলি। চমৎকার অফ ড্রাইভ করতে পারতাম। না করে, বোলারের কাছে ঠেলে দিলাম, তন্ময় কিছুটা বেরিয়ে এসেছিল রানের আশায়। হাত নেড়ে ওকে ফিরে যেতে বললাম।
দ্বিতীয় বলটা একই রকমের। এবার ড্রাইভ করলাম বেশ জোরে। বল ধরার জন্য বোলার হাত পেতেই তুলে নিল। এক্সট্রা কভার থেকে ফিল্ডার ছুটে যাচ্ছে, আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে তাই দেখতে থাকলাম। তন্ময় বেরিয়ে এসে পিচের মাঝ বরাবর পৌঁছে চেঁচাচ্ছে, মতিদা, রান, রান।
ফিল্ডার বল ধরে বোলারের উইকেটে ছুড়েছে, তখন আমি চেঁচিয়ে বললাম, নো নো, গো ব্যাক, গো ব্যাক।
তন্ময় ঘুরে আবার উইকেটে পৌঁছবার আগেই চিৎকার উঠল—হাউজা। আম্পায়ার স্বচ্ছন্দে হাত তুলে দিল। আমি মনে মনে কেমন একটা আরাম পেলাম। সি সি এইচ-এর বেশ কিছু টাকা বাঁচল। তন্ময় আমার দিকে তাকাতে তাকাতে মাঠ থেকে বেরিয়ে গেল। আমি এবার চিতুর দিকে তাকিয়ে হাসলাম। মনে হল, ও যেন দাঁত কিড়মিড় করল।
খেলা ড্র হল। মাঠ থেকে আসতেই ননীদা বললেন, এটা কী করলে তুমি—
ননীদাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, আর একটা ব্যাট কিনে দেবার ক্ষমতা কি হাটখোলার আছে?
ননীদা সেকেন্ড দশেক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ভেরি গুড স্ট্র্যাটেজি।
হেসে মুখ ফিরিয়ে নিতে গিয়ে দেখলাম চিতু হাত নেড়ে তন্ময়কে কী বলছে আর তন্ময়ের মুখ থমথমে হয়ে উঠছে। বুঝলাম, চিতুর দুষ্টবুদ্ধি এখনও খেলা করছে।
দুই দলের খেলোয়াড়রা যখন চা খাচ্ছে তন্ময় হঠাৎ সকলকে শুনিয়েই আমাকে বলল, ব্যাট আমার চাই না, কিন্তু সেঞ্চুরিটা হতে দিলেন না কেন?
তার মানে? আমি বললাম, কে তোমার সেঞ্চুরি হতে দেয়নি?
আপনি। ইচ্ছে করে রানআউট করালেন, অতি সহজ রান ছিল। কিন্তু একটা ব্যাট দেবার ভয়ে এই নীচতা আপনি করলেন।
তন্ময় এরপর অকথ্য ভাষায় কয়েকটা কথা বলল, যাতে রূপোলির ছেলেরাও না শোনার ভাণ করতে বাধ্য হল। অপমানে মুখ কালো করে আমি আর ননীদা চুপ করে রইলাম। চিতু ফিসফিস করে কানের কাছে বলল, কী রে, ননীদাকে যে ঘোল করে ছেড়ে দিল। ছেলেটাকে সামনের বছরই রূপোলিতে নিয়ে নেব।
আমি তখন জ্বলছি। জবাব দিলাম না।